কলকাতা ৩০০
কলকাতা একসময়ে ছিল সন্ধ্যার শ্যাম্পেনের মতো। বেশ একটা নেশা ধরে যেত। দু-চারদিনের জন্যেও কোনও জায়গায় গেলে মন কেমন করত। হাওড়া স্টেশনে নেমে ব্রিজের মাথাটা দেখা মাত্রই মন নেচে উঠত—ফিরে এসেছি, ফিরে এসেছি। গঙ্গার ওপর দিয়ে শহরে ঢুকেছি। পোস্তা আর বড়বাজারের ঘিঞ্জি এলাকা। বাড়ির গায়ে বাড়ি। সাবেক আমলের স্নানঘাট। পরিত্যক্ত ওয়্যার হাউস। কোম্পানির কলকাতার স্মৃতিচিহ্ন। প্রাচীন টাঁকশাল। বাঁদিকে ঘাড় ঘোরাই, একরকম দৃশ্য। ডানদিকের আকাশপটে বিধান রায়ের কলকাতার বহুতল। লোকজন, ঠ্যালা, লরি, লোহালক্কর, বালতি, কড়াই। থিকথিকে মানুষজন। স্ট্রান্ডরোডের বিখ্যাত জ্যাম। পোস্তার গুদামে দিবারাত্র মাল-খালাস, নিমতলার শেষযাত্রা, কাঠগোলার টংঘর। একটু প্রাচীন, একটু নূতন স্যাঁতসেঁতে ভাঙাচোরা। মশলার গন্ধে নর্দমা আর আবর্জনার গন্ধ মিশে আছে। তবু প্রবেশ মাত্রই মন নেচে উঠত। এই আমার কলকাতা। হ্যারিসন রেডের দুপাশে জমজমাট সব দোকান। বাঁপাশে ঘুরে গেছে পথ সত্যনারায়ণ পার্কের দিকে। কলকাতার রাজস্থান চলে গেছে আহিরিটোলার দিকে। উত্তর থেকে আরও উত্তরে। সেই কলকাতার স্মৃতিসরণি ধরে, যে কলকাতায় ছিল বড়বড় থামওয়ালা বাড়ি, ঝাড়লন্ঠন, বেলোয়ারি কাচের বাহার, শার্সির রঙিন কাচ, বিখ্যাত বাঙালি, জ্ঞানি বাঙালি, শিল্পী বাঙালি, ভোগী বাঙালি, বিলাসী বাঙালির পীঠস্থান। হ্যারিসন রোড যখন চিৎপুর এসে মিশবে, ডানদিকে তাকিয়ে দেখে নেব নাখোদার কারুকার্য করা চুড়া। চিকনের-কাজ করা ওই গুম্বুজ আর সারসার পাজামা, পাঞ্জাবি, আতর, বদরি, আর জুতোর দোকান দেখলে মন চলে যায় রোমান্সের দিকে। হায়দ্রাবাদের চারমিনার, লক্ষ্মৌ, বেনারসের কথা মনে পড়ে যায়।
বাঁদিকে পথ চলে গেছে হরেন শীলের বিশাল বাড়িকে ডানদিকে রেখে জোড়াসাঁকোর দিকে। ডি. গুপ্তর বাড়িটাকে দেখলে মনে হয়, হ্যাঁ, এই তো আমার সেই নানা সমস্যাসঙ্কুল প্রাণের কলকাতা। লন্ডনের ডাকসাইড রোডের মতো চিৎপুরের কবলড রোড সোজা চলে গেছে বাগবাজার। সেখানে সেই প্রাচীন খাল। নর্দমার চেয়েও অপরিষ্কার। তবু সেই খাল আমার কত প্রিয়। খালের ওপর বিশাল একটা হাতির মতো বাগবাজার পোল। চিৎপুর সেই আদিপথ। নাম ছিল তীর্থযাত্রীর পথ। শান্তিপুর নবদ্বীপ থেকে তীর্থযাত্রীরা এই পথ ধরে চৌরঙ্গিতে চৌরঙ্গিবাবার আশ্রম হয়ে যেতেন কলিতীর্থ কালীঘাটে।
হ্যারিসন রোড চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ ভেদ করে আমাকে ফেলে দেবে কলেজ স্ট্রিটে। আমার ডানপাশে বিদ্যার পীঠস্থান। প্রেসিডেন্সি, হিন্দুস্কুল। বিশ্ববিদ্যালয়। একটু দু:খ আমার এখনও হবে। কলিসিয়ামের মতো অমন সুন্দর সেনেট হলটা ভেঙে দিল। কলকাতার অমন সুন্দর ল্যান্ডমার্ক। সামনেই কলেজ স্কোয়ার। কে যে পরিকল্পনা করে অমন সুন্দর এক দৃশ্যকে দোকান দিয়ে চাপা দিয়ে দিলেন। কলকাতার ব্যবস্থাপকরা আমার মনে অজস্র ক্ষত তৈরি করেছেন। বহুবার নিজেকে প্রশ্ন করেছি—একটা সুন্দর শহরকে সুপরিকল্পিত ভাবে কেন তাঁরা ধ্বংস করছেন। ইচ্ছে করলেই তো কত সুন্দর করে তোলা যায়। তাঁরা তো বিদেশে যান। সুন্দর সুন্দর শহর দেখেন। তাঁরা তো সব কর্তাব্যক্তি। যেমন আমাদের মুখ্যমন্ত্রী, আমাদের মেয়র। সেই শহরের রূপকার, ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে দেখা হয়, আলোচনা হয়, লাঞ্চ, ডিনার হয়। বক্তৃতাও করেন কত। তাঁদের কি মনে হয় না, এই শহরে ওঁরা যখন আসবেন, অব্যবস্থা, কল্পনাহীনতা, উদাসীনতা দেখে তাঁরা নাক সিটকোবেন। বিশ্রী একটা ধারণা হবে তাঁদের। মেয়র, মন্ত্রীকুল, বড় ব্যবসায়ী, এঁদের কেন লজ্জা হয় না?
বইপাড়া, কলেজপাড়া ছেড়ে আমহার্স্ট স্ট্রিটে পড়ব। ডানদিকে সেই বিখ্যাত শ্রদ্ধানন্দ পার্ক। রাজনীতির কারণে স্মরণীয়। স্বদেশি আন্দোলনের দিনে কত বড় বড় সভা এখানে হয়ে গেছে। শ্রী অরবিন্দ, রাসবিহারী বসু, সুভাষ বসু। এই ঐতিহাসিক পার্কটিও ছোট ছোট স্টল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ট্রামলাইন ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা জানান হয়েছে কোণের দিকে দুর্গন্ধী এক আবর্জনা স্তুূপ তৈরি করে। সেই রকের ভাষায় বলে না—গুরু তোমার কাজ আছে। তবু কেন জানি না এই শহরের জন্যে প্রাণ কাঁদে।
কলকাতার ৩০০ বছর বেশ ভালোই হচ্ছে! জোব চার্ণকের আমলে বেশ সুপরিকল্পিত ভাবেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পথঘাট-নেই। ছিল একদা। একটা বৃষ্টি। অন্ধকার। আলো তো থাকেই না। সে এক বীভৎস নরক। সন্ধ্যার শ্যাম্পেন আর নেই—এখন মাঝরাতের চুল্লু।