কলকাতা তিনহাজার তিনশো
কলকাতার বয়স যে মাত্র তিনশো বছর একথা আমি স্বীকার করি না, বিশ্বাস তো করিই না। পণ্ডিতেরা যে যাই বলুন কোনও পণ্ডিতের, কোনও ঐতিহাসিকের সঙ্গেই এ বিষয়ে আমি একেবারেই একমত নই।
তাতে অবশ্য পণ্ডিত মহোদয়দের কিছু এসে যায় না। তাঁরা মনের আনন্দে সভা করে যাচ্ছেন, বক্তৃতা করছেন, বড় বড় সুগম্ভীর তথ্যমূলক প্রবন্ধ লিখছেন দৈনিকের ক্রোড়পত্রে, নামীদামি পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায়। সেসব সংখ্যা অলংকরণ করেছেন বড় শিল্পীরা, কী চমৎকার সেইসব ড্রইং। জব জার্নক থুড়ি জব হবে না, আমাদের বাল্যকালের জব চার্নক ইতিমধ্যে জোব চার্নক হয়ে গেছেন। তা সেই জোব সাহেব কলকাতার গঙ্গার ঘাটে পদার্পণ করছেন বটতলায়, কী আশ্চর্য সেই বটগাছ যার পাতাগুলো একেবারে আমপাতার মতো আর আলখাল্লা পরা চার্নক হুবহু ইতিহাস বইয়ের নানা সাহেবের মতো দেখতে।
এদিকে হে-কলকাতা, আহা কলকাতা, ওগো কলকাতা আ-মরি কলকাতা, কলকাতা-কলকাতা সর্বসমেত কাল দুপুর পর্যন্ত এক হাজার সাতশো বত্রিশটা গান ও আবৃত্তির ক্যাসেট বেরিয়েছে। গায়ক, শিল্পী, সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক, আমলা, অধ্যাপক, সবাই প্রাণপণ কলকাতা তিনশো-র পিছনে দৌড়চ্ছেন।
দৌড়চ্ছেন মানে সত্যিই দৌড়চ্ছেন, লিটারালি দৌড়চ্ছেন। শ্যামবাজারের পাঁচমাথার নেতাজির মূর্তি থেকে সল্ট লেক, গোলপার্ক থেকে রবীন্দ্রসদন প্রবল বৃষ্টিতে, ঘোর ঠান্ডায়, প্রখর রৌদ্রে রাস্তার যানবাহন তুচ্ছ করে, জীবন বিপন্ন করে বৃদ্ধ ঐতিহাসিকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়চ্ছেন প্রবীণ কবি। দু’জনেই কলকাতার জন্য দৌড়চ্ছেন, সবাই কলকাতার জন্য দৌড়চ্ছে।
কেউ খেয়াল করছেন না। কলকাতার কোনও বয়স থাকতে পারে না। কোনও জায়গারই কোনও আলাদা বয়স নেই, সব জায়গাই পৃথিবীর সমান বয়সি।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমি একটা অনিয়মিত পত্রিকায় যথাসাধ্য নিয়মিত লিখতাম। তখনও কলকাতা তিনশোর হুজুগ ওঠেনি। কিন্তু সেই সম্পাদক মহোদয়ের ঘটে কিছু বুদ্ধি ছিল, তাঁর কাগজের নাম ছিল কলকাতা দু’হাজার। অবশ্য এখন আমি যদি কোনও কাগজ করি তবে ঠিক করেছি যে তার নাম দেব কলকাতা ১০,০০,০০,০০,০০০,০০০ অর্থাৎ কলকাতা দশ অক্ষৌহিণী।
কলকাতার উল্লেখ যে আবুল ফজলের আইন-ই আকবরি গ্রন্থে রয়েছে, মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলে যে গঙ্গাতীরবর্তী কলকাতার কথা বলা আছে কলকাতা তিনশোর কল্যাণে এবং সংবাদপত্রসহ অধ্যাপক মহোদয়, মাস্টারমশাইদের দৌলতে সেসব খবর সবাই জানে। এসব থলেপচা বিষয় নিয়ে আমার কিছু লেখার ইচ্ছে নেই, যোগ্যতাও অবশ্যই নেই।
কিন্তু আমি যাব আরও পিছনে। কলকাতা যে কত পুরনো সেটা প্রতিপন্ন করার জন্য আমার তূণীরে আছে দুটি অব্যর্থ শর।
প্রথম শরটি সংক্ষেপে নিক্ষেপ করি।
নবদ্বীপবাসী প্রাচ্য বিদ্যার্ণব জ্ঞানেন্দ্রনাথ তর্ক বাচস্পতির কাছে আমি স্বয়ং একথা শুনেছি। সবাই নিশ্চয় অবগত আছেন সংস্কৃত ভাষায় বা পুরাণ সাহিত্যে আমার দখল অপরিসীম নয়। সুতরাং এটা শোনা কথা।
তর্কবাচস্পতি মহোদয় আমাকে যা বলেছিলেন তা আমার মতো অভাজনের পক্ষে যাচাই বা পর্যালোচনা করা সম্ভব নয়, যে রকম শুনেছি তাই লিখছি।
বাচস্পতি মহোদয়ের মতে কলকাতার তিনশো বছর বয়স ব্যাপারটা কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কলিকাতা কথাটা আসলে কালিকাতা। কালী, কালিকা, কালিকাতা।
কালিকাতা নামে কারও কোনওরকম সংশয় থাকা উচিত নয় কারণ সত্যিই তো কোনও জায়গার কোনও বাঁধা নাম নেই। চোখের সামনেই তো পিকিং, ফেচিং, বেজিং, ভেটজিং হয়ে গেল। ভাইজাগ হল বিশাখাপত্তনম। বোম্বাই, বোম্বে, দ্রুত মুম্বাই হওয়ার দিকে এগোচ্ছে।
আর সত্যিই তো কলকাতার নামের অন্ত নেই। কলকাতার মতো এমন জায়গা আর কোথায় আছে যার সাধুভাষায় আর চলিতভাষায় দু’রকম নাম, কলিকাতা আর কলকাতা। বাঙালেরা বলে কইলকাতা।
ঢাকা গেলে শিক্ষিত লোকেরা জানতে চান, ‘কেলকাটা থেকে কবে আসলেন?’
হিন্দুস্থানিরা বলেন ‘কলকাত্তা’। ওড়িয়ারা খুব জোরের সঙ্গে বলেন ‘ক্লীক্কাতা’।
সাহেবদের তো কথাই নেই— ক্যালকাটা থেকে কালকুত্তা, একেক জাতের সাহেবের কাছে কলকাতার একেকরকম নামডাক।
তা এইসব নামের মধ্যে সবচেয়ে আদি নাম কালিকাতা। কালীঘাটের কালিকা মন্দির থেকে কালিকাতা, জন থেকে যেমন জনতা, শূন্য থেকে যেমন শূন্যতা, পূর্ণ থেকে যেমন পূর্ণতা, মানব শব্দ থেকে যেমন মানবতা ঠিক তেমনভাবেই কালিকা শব্দ থেকে কালিকাতা।
কলিতীর্থ কালীঘাটের কালিকামন্দির আজকের ব্যাপার নয়, তিনশো বছরের ব্যাপারও নয়। সেই দক্ষযক্ষের পৌরাণিক যুগে পাগল শিব প্রমথেশ পিতৃগৃহে অভিমানে অপমানে দেহত্যাগকারিণী সতী পার্বতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে প্রলয় নাচন শুরু করেছিলেন, সৃষ্টি রক্ষা করার জন্য স্বয়ং বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ টুকরো টুকরো করে ফেলেন, সেগুলো পৃথিবীর নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।
কালীঘাটে পড়েছিল সতীর বাঁ হাতের কড়ে আঙুল। আমরা যখন কথায় কথায় কাউকে হেয় করার জন্য বলি, ‘তুই আমার বাঁ হাতের কড়ে আঙুলেরও যোগ্য নস।’
আমরা কী সাংঘাতিক কথা বলি তা কি আমরা জানি।
সে যা হোক, সেই দক্ষযক্ষ মহাদেবের সেই প্রলয় নাচন সে কি আজকের কথা!
চার্নকের বাপঠাকুরদা চৌদ্দপুরুষ তখন জন্মায়নি, সে তাদের চোদ্দ হাজার পুরুষ আগের কথা। চার্নক সাহেবের আদি পূর্বপুরুষেরা সেই টিউডর, নরমানেরা এমনকী স্যাক্সন বা ডেনেরা পর্যন্ত তখনও এ ধরাধামে অবতীর্ণ হয়নি।
তর্কবাচস্পতি মহোদয় আমাকে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলেছেন যে কালিকাপুরাণই হল কালিকাতাপুরাণ। কালিকাপুরাণে যে বরাহ উপাখ্যান আছে, নরকাসুরের উপাখ্যান আছে সেসব যে কলকাতার পটভূমিতেই রচিত, বাচস্পতি মহোদয়ের মতে, সে বিষয়ে কারও মনে সন্দেহের অবকাশ থাকা উচিত নয়, এবং সেইজন্যেই কলকাতার বয়স কালিকাপুরাণের চেয়ে কম নয়, কম হতে পারে না।
মনে রাখতে হবে কালিকাপুরাণ যদিও ব্যাসাদি মুনি প্রণীত ব্রহ্মপুরাণ বা পদ্মপুরাণের মতো মূল পুরাণ নয়, একটি উপপুরাণ, তবুও তার প্রাচীনতা প্রশ্নাতীত।
এতদ্সত্ত্বেও আমার মনের মধ্যে যেটুকু সংশয় বা প্রশ্ন উঠেছিল তা দূর হল ডক্টর বিদ্যাসুন্দর ভট্টাচার্যের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনার পরে। কলকাতার প্রাচীনতার সপক্ষে আমার তূণীরে দ্বিতীয় শরটি ডক্টর ভট্টাচার্যই দান করেছেন।
ডক্টর বিদ্যাসুন্দর ভট্টাচার্য কোনও সামান্য কেউকেটা লোক নন। ইন্টারন্যাশনাল মহাভারত সোসাইটির তিনি প্রতিষ্ঠাতা, সভাপতি ও প্রাণপুরুষ। একশো দশ বাই তেত্রিশ গরচা চতুর্থ লেনে তাঁরই বসবার ঘরে আন্তর্জাতিক মহাভারত সমিতির হেড অফিস।
ডক্টর ভট্টাচার্য আমাকে যা বললেন তা নিতান্ত প্রণিধানযোগ্য। মহাভারতের নাকি একটি প্রক্ষিপ্ত অংশ রয়েছে যেটি কোনও বিশেষ কারণে বেদব্যাস মূল মহাভারত থেকে শেষ মুহূর্তে বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে কাশীরাম দাস, কালীপ্রসন্ন সিংহ মহাশয়রাও এই অংশটুকু মহাভারতে রাখতে সাহস পাননি।
সম্প্রতি ডক্টর ভট্টাচার্য দূরদর্শনে মহাভারতের প্রযোজক প্রমোদসম্রাট মিস্টার বি. আর. চোপরা সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়েছিলেন এই প্রক্ষিপ্ত অংশে, তিনি কথাও দিয়েছিলেন বিবেচনা করবেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত করেননি।
ঘটনাটি মহাভারতের বনপর্বের শেষভাগের। বারো বৎসর বনবাসের পরে পাণ্ডবদের যখন এক বৎসর অজ্ঞাতবাসের সময় এল তাঁরা গোড়াতেই বিরাটনগরে গিয়ে ছদ্মবেশে এক বছর কাটিয়ে দেওয়ার কথা ভাবেননি। তাঁরা প্রথমে অন্যত্র, হস্তিনাপুর থেকে যতদূরে সম্ভব থাকার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁদের সে চেষ্টা সফল হয়নি।
ঘটনাটি কিঞ্চিৎ বিস্তারিত বলা প্রয়োজন। বনবাসের বারো বছর অতিক্রান্ত হওয়ার মুখে পাঞ্চালিসহ পঞ্চপাণ্ডব অজ্ঞাতবাসের স্থান ঠিক করার জন্য গঙ্গার পশ্চিম তীর ধরে ক্রমশ দক্ষিণ-পূর্বদিকে এগোতে লাগলেন। তাঁরা শুনেছিলেন সাগরদ্বীপে গঙ্গার মোহনায় কপিলমুনির আশ্ৰম আছে এবং তার চারপাশে জনমানবহীন গহন সব জঙ্গল। পাণ্ডবেরা ভাবলেন এই একটা বছর ওই জঙ্গলে কোনওক্রমে অজ্ঞাতবাসে কাটিয়ে দেবেন।
গঙ্গার তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে এক অপরাহ্ন বেলায় দ্রৌপদী ও পাণ্ডবেরা এমন জায়গায় এসে পৌঁছালেন যেখান থেকে সাগরদ্বীপ খুব দূরে নয়। এখানে গঙ্গানদীর মূল ধারা থেকে একটা সংকীর্ণ শাখা বেরিয়েছে লোকেরা যাকে বলে কাটিগঙ্গা।
কাটিগঙ্গার পূর্বধারে গ্রাম-নগর, মন্দির দেবস্থান। কিঞ্চিৎ খোঁজখবর করে পাণ্ডবেরা জানতে পারলেন কাটিগঙ্গার পাড় দিয়ে কপিলমুনির আশ্রমে যাওয়াই নিরাপদ এবং পথও কিছুটা কম। তাঁরা গঙ্গা অতিক্রম করে কাটিগঙ্গার পশ্চিমতীরে এসে পৌঁছালেন। সেটা গ্রীষ্মকাল। কাটিগঙ্গা মাত্র পনেরো-বিশ হাত চওড়া, তাতে কোমরজলের বেশি জল নেই। তখন সন্ধে হয়ে এসেছে। অন্তত সেদিনের মতো রাত্রিবাসের একটা জায়গা প্রয়োজন। তা ছাড়া ওপারে কালিকামন্দির দেখা যাচ্ছে একটা, সেখানে কাঁসর ঘন্টা বাজছে, ঢাকের বাজনাও শুনতে পাওয়া যাচ্ছে, ‘টাকডুমাডুম’, সেই সঙ্গে পাঁঠার আর্তনাদ ব্যা ব্যা ব্য। দ্রৌপদী মেষবলি দেখতে খুব ভালবাসেন। তিনি যে যজ্ঞ থেকে আবির্ভূতা হয়েছিলেন সেই যজ্ঞে পাঞ্চালরাজ একশো আটটি মোষ বলি দিয়েছিলেন, সেই জন্মলগ্ন থেকে দ্রৌপদীর পশুবলির ওপরে ঝোঁক।
বারো বছর বনবাসে পশুবলি দেখার খুব একটা সুযোগ দ্রৌপদী পাননি। কখনও ভীম গদার আঘাতে একটা বাইসন বা নীলগাই মেরে এনেছে, কখনও অর্জুন তির দিয়ে হরিণ বা সম্বর মেরে এনেছে, নকুল ও সহদেব সাধ্যমতো খরগোশ বা বন্য কুক্কুট শিকার করে গলায় মালার মতো করে পরে এসেছে। কিন্তু রাজপ্রাসাদ ছেড়ে আসার পর দীর্ঘ দ্বাদশ বৎসর দ্রৌপদীর পশুবলি দেখা হয়নি।
আজ বলির বাজনা শুনে দ্রৌপদীর হৃদয় উত্তাল হয়ে উঠেছে। তিনি যুধিষ্ঠিরের কাছে বায়না ধরলেন, ‘ধর্মপুত্র আমি ওই কালিকামন্দিরে গিয়ে মেষবলি দেখব।’
প্রথম পাণ্ডব যুধিষ্ঠির সাবধানী, ধুরন্ধর, বহুদর্শী লোক। একটা অচেনা জনপদের অচেনা মন্দিরে দল বেঁধে, ভাইবউ নিয়ে হঠাৎ সন্ধ্যাবেলা যাওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত কতটা নিরাপদ বিশেষত দ্রৌপদীর মতো সুন্দরী গৃহিণী যেখানে সঙ্গে রয়েছে, তাই একটু চিন্তা করে তিনি ভীমকে অনুরোধ করলেন, ‘মধ্যম পাণ্ডব, পাঞ্চালি ওপারের কালিকামন্দিরে মেষবলি দেখতে যেতে চাইছে, তুমি একটু ওপারে গিয়ে দেখ দেখি স্থানটা নিরাপদ কি না?’
জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার আদেশ পেয়ে মহাবলী ভীম ‘যথা আজ্ঞা’ বলে এক লাফে কাটিগঙ্গা পেরিয়ে ওপারে চলে গেলেন।
কিন্তু ওপারে যাওয়ার পরে ভীমের আচার আচরণে কেমন একটা অদ্ভুত ভাবান্তর পরিলক্ষিত হল। এপারে দাঁড়িয়ে চার পাণ্ডব এবং দ্রৌপদী দেখলেন ভীম কাটিগঙ্গা পার হয়েই হঠাৎ হাতের গদা দিয়ে পাড়ের জমি মাপতে লাগলেন, এবং মুখে কী সব বিড়বিড় করতে লাগলেন।
ঘটনা দেখে যুধিষ্ঠির চিন্তায় পড়লেন, তাঁর কেমন খটকা লাগল, ভীমের কি মাথা খারাপ হয়ে গেল। এপার থেকে যুধিষ্ঠির চেঁচিয়ে বললেন, ‘ভীমসেন অযথা বিলম্ব করছ। তাড়াতাড়ি করো। আমাদের জানাও যে আমরা ওপারে আসব কি না?’
এই কথা শুনে মাথার ওপরে গদা বোঁ বোঁ করে ঘোরাতে ঘোরাতে রোষ কষায়িত লোচনে ভীমগর্জনে ভীমসেন বললেন, ‘এদিকে এক পা বাড়িয়েছ তো একদম মাথা গদার এক আঘাতে চূর্ণ বিচুর্ণ করে দেব।’
ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির প্রমাদ গণলেন, সত্যিই তো বারো বৎসর বনবাসের কষ্টে তারপরে শেষ কয়দিনের পথশ্রমের ফলে মধ্যম পাণ্ডবের মস্তিষ্ক-বিকার দেখা দিয়েছে, তিনি তাড়াতাড়ি অর্জুনকে অনুরোধ করলেন, ‘ধনঞ্জয়, তুমি একবার ওপারে গিয়ে দেখ তো মধ্যম পাণ্ডব এ রকম করছে কেন?’
অর্জুন সঙ্গে সঙ্গে ওপারে চলে গেলেন। তারপর যা কোনওদিন কখনও হয়নি ভীম অর্জুনকে দেখে তাড়া করে এলেন।
স্থিরচিত্ত অর্জুনও বুদ্ধিভ্রংশ হয়ে ভীমের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। দু’জনে কাদার ওপরে গড়াগড়ি খেতে লাগলেন। দু’জনেই দু’জনকে বলতে লাগলেন, এ এলাকা আমার। শয়তান, তুই এখান থেকে ভাগ, না হলে আজ তোর একদিন কি আমার একদিন। রীতিমতো গচ্ছ-কচ্ছপের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।
দ্রৌপদীকে নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে বিমূঢ় যুধিষ্ঠির নকুল-সহদেব দুই মাদ্রীপুত্রকে নির্দেশ দিলেন ওপারে দৌড়ে গিয়ে ভীমার্জুনের বিবাদ মেটাতে।
কিন্তু নকুল-সহদেব ওপারে পৌঁছতে গোলমাল আরও বেড়ে গেল। এবার চার পাণ্ডবে শুরু হল তুমুল ধস্তাধস্তি, জাপটাজাপটি। এ ওকে মারে, ও তাকে মারে। ভীম লাথি মেরে ফেলে দেয় অর্জুনকে, নকুল ভীমের কেশাকর্ষণ করে, সহদেব ঘুষি চালাতে থাকে নকুলের ওপরে। খামচাখামচি, কামড়া-কামড়ি ভয়াবহ ব্যাপার, ছোটখাটো কুরুক্ষেত্র একটা।
কাটিগঙ্গার এপারে দাঁড়িয়ে এই ভয়াবহ ভ্রাতৃকলহের তথা পতিকলহের দৃশ্য দেখে দ্রুপদনন্দিনী থরথর করে কাঁপতে লাগলেন, কিন্তু মহামতি যুধিষ্ঠির সর্বজ্ঞানী, ত্রিকালদর্শী পুরুষ। তিনি মুহূর্তের মধ্যে ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন এবং দ্ৰৌপদীকে আলিঙ্গন করে অপর প্রান্তে বিবাদরত ভ্রাতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চেঁচিয়ে বললেন, ‘ভালই হয়েছে, তোমরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করো, দ্রৌপদী এখন থেকে আমার একার।’
এই কথা শোনা মাত্র ভীম, অর্জুন, নকুল সহদেব এক দৌড়ে কাটিগঙ্গা পার হয়ে যুধিষ্ঠিরকে তাড়া করে এলেন। এসে দেখলেন যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর পাশে দাঁড়িয়ে মৃদু মৃদু হাসছেন। ইতিমধ্যে ভীম অর্জুন নকুল সহদেবের সংবিত ফিরে এসেছে। তাঁরা যথেষ্ট লজ্জিত হয়ে পড়েছেন। তাঁরা প্রত্যেকে জিভ কেটে স্বীকার করলেন, ‘মহা অপরাধ হয়ে গেছে। ওপারে গিয়ে মাথার মধ্যে কীরকম হয়ে গিয়েছিল। কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে হিতাহিত বোধশূন্য হয়ে পড়েছিলাম। কী করছিলাম কিছুই বুঝতে পারিনি।’
তখন মহাজ্ঞানী যুধিষ্ঠির বললেন, ‘তোমাদের কারও কোনও দোষ নেই। কাটিগঙ্গার ওপারে ওই কালিকা মন্দির আর কালিকাপুরাণোক্ত দুর্দান্ত কালিকাতা নগরী। ওখানে গেলে মানুষের বুদ্ধিভ্রংশ হয়। সংকীর্ণমনা, স্বার্থপর হয়ে ওঠে। যে যার ভাগ গোছাতে ব্যস্ত থাকে। ভাইয়েরা ভাইয়ের সঙ্গে কলহে, মারামারিতে, বাদবিসম্বাদে মেতে ওঠে।’
এই বলে যুধিষ্ঠির নির্দেশ দিলেন, ‘আর এক মুহূর্তও দেরি নয়। এই স্থান থেকে যত তাড়াতাড়ি যতদুর যাওয়া যায় ততই মঙ্গল।’ দ্রৌপদীসহ পঞ্চপাণ্ডব কালিকাতা নগরী বর্জন করে যে পথ ধরে এসেছিলেন সে পথ ধরে ফিরে গেলেন সেই রাতেই।
এই কাহিনী পুরোপুরিই আমার ডক্টর বিদ্যাসুন্দর ভট্টাচার্যের কাছে শ্রুত। তিনি আমাকে আরও দুটো তথ্য দিয়েছিলেন।
এক, এই ঘটনার কারণেই কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গকে পাণ্ডববর্জিত দেশ বলা হয়।
এবং দুই, মহাভারতে কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে ভারতের সমস্ত রাজাই কোনও না কোনও পক্ষে লড়েছিল। বঙ্গদেশ লড়েছিল দুর্যোধনের পক্ষে।
কলকাতার প্রাচীনত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে এই মহাভারতীয় কাহিনী কিঞ্চিৎ দীর্ঘ হয়ে গেল। কিন্তু কালিকাতা তথা কলিকাতা তথা কলকাতা মহানগরী যে কৌরবপাণ্ডবের আমলেও ছিল এ বিষয়ে নিশ্চয় কারও মনে অতঃপর আর কোনও সন্দেহ থাকছে না। অধ্যাপক, সাংবাদিক, ঐতিহাসিকেরা যে যা ইচ্ছে বলুন, দুটো প্রমাণের মতো প্রমাণ দিয়ে দিলাম।
মহাভারতের কথা
অমৃত সমান।
তারাপদ রায় কহে
শুন বুঝমান॥