তৃতীয় খণ্ড (স্নেহের চুমকিকে)
3 of 6

কলকাতা তাল তাল একতা

কলকাতা তাল তাল একতা

আমি মার্কোপোলো, একটি চলন্ত অফিস টাইমের বাসের প্রবেশ-পথের কাছে দাঁড়িয়ে রিলে করছি। চুম্বক লোহাকে আকর্ষণ করে। পাদানির কাছে একটি মনুষ্য আকর্ষণী বলয় তৈরি হয়। সেই বলয়ে নিজেকে ছেড়ে দিতেই আমি আটকে গেছি। কোথায় আমার হাত, কোথায় আমার পা, মাথা, দেহকাণ্ড—আমি বলতে পারব না। আমি অখণ্ড, কী খণ্ডখণ্ড, তাও জানি না। ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় আমার কোনও অনুভূতি ছিল না। মনে হয়, এখনকার অভিজ্ঞতার সঙ্গে সে অভিজ্ঞতার যথেষ্ট মিল আছে। দুটি বিশাল ভুঁড়ির মাঝখানে আমার শরীর আটকে আছে। ঘাড় থেকে মাথা কর্কস্ক্রুর মতো পেঁচিয়ে গেছে। ডান পায়ের গোড়ালির কাছটা, মনে হচ্ছে, কেউ হ্যাক-সঅ দিয়ে কাটছে। একটু প্রতিবাদ মতো করতে গিয়েছিলাম। বাসসুদ্ধ সকলে কোরাসে জানালেন, বাসে মশাই ওরকম একটু হবেই। অসহ্য লাগলে ট্যাকসি করে যান। শুনলাম, কলকাতার বাসযাত্রীদের এইটাই নাকি সাধারণ উত্তর। ইতিমধ্যে সামনের দরজা দিয়ে এক ভদ্রমহিলা নামবার চেষ্টা করলেন। নেমেছেন, তিনি তেড়েফুঁড়ে নেমেছেন। কিন্তু একী। এ যে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ। শাড়ির আঁচল বাসে, মহিলা রাস্তায়। বাস ছেড়ে দিয়েছে। নাইলন শাড়ি লাট্টু ঘোরাবার লেত্তির মতো ফড়ফড় করে খুলে গেল। মহিলা লাট্টুর মতো রাস্তায় ঘুরপাক খাচ্ছেন। আমার নাকের কাছে একটা গামছা এসেছে। সমগ্র কোলন শহরের নির্যাসে এই বস্তুকে চোবালেও দুর্গন্ধ যাবে না। শুনলাম, কলকাতা শহরে এই ধরনের লক্ষ লক্ষ গামছা আছে। মানুষের গায়ের, জামা-কাপড়ের, মাথার চুলের, চুলের তেলের এই গন্ধ, ডিজেলের মিশ্রিত গন্ধকে ছাপিয়ে, সাংঘাতিক হয়ে উঠেছে, যেন সেপটিক ট্যাঙ্কের ঢাকনি খোলা হয়েছে। সকলেই একটু উঁ উঁ করলেন। জনৈক ভদ্রলোক বললেন, স্যানেটারি ইনস্পেকটারকে খবর দাও। একেবারে সামনের মাথা থেকে কে একজন উত্তর দিলেন, বলুন। উত্তর-প্রত্যুত্তরের টানাপোড়েন চলল। তোমার কী হল? সিজারিয়ান। স্টিচ ক’টা? ষোলোটা। মানুমাসির মেয়ের অম্বলের অসুখ কমেছে? ভুবন কোথায়? কাশ্মীরে।

পেছনের গেটে নামতে গিয়ে একজনের ব্রিফকেস আটকে গেছে। খুব টানাটানি চলছে। রাস্তায় ভদ্রলোক, ডানহাত-সমেত ব্রিফকেস ভেতরে। বাস চলেছে, ভদ্রলোক চলেছেন। চিৎকার—ছেড়ে দিন, ছাড়ুন না মশাই, ছেড়ে দিন। প্রচণ্ড উত্তেজনা! কে হারে, কে জেতে!

কে বলেছে, অক্সিজেন ছাড়া মানুষ বাঁচে না। এখানকার আবহাওয়ায় আগ্নেয়গিরির উত্তাপ, হাওয়ায় নব্বইভাগ কার্বন-ডাই-অক্সাইড। এই বাসের আধকাটা জানলা দিয়ে হাওয়া ঢোকেও না, বেরোয় না। যিনি ডিজাইনার, তার মাথায় হয় সিরাজউদ্দৌলার কোনও ইঞ্জিনিয়ারের ভূত, নয়তো আইখম্যানের ভূত চেপেছিল। কোথায় লাগে নাজি কনসেনট্রেসান ক্যাম্প, গ্যাস চেম্বার, ব্ল্যাক হোল!

আমরা পায়ে-পায়ে পেঁচিয়ে, হাতে-হাতে জড়জড়ি করে, মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি করতে-করতে, সমষ্টির মধ্যে বেষ্টিকে নিমজ্জিত করে, দলা পাকিয়ে, কখন আস্ফালন, কখন আলাপন করতে-করতে বিশাল একটি মণ্ডের মতো ধপাস করে মার্টিন বার্নের সামনে রাস্তায় পড়লাম। তারপর সেই মনুষ্য পিণ্ড থেকে, রাম, রহিম, যদু, মধু, শ্যাম, শ্যামল নিজেদের গুছিয়ে-গাছিয়ে নিয়ে হনহন করে গন্তব্যের দিকে দৌড়োলেন।

গাঁটকাটায় আমার পকেটটি কেটে নিয়ে গেছে। কলকাতার মানুষ বাইরে বিচ্ছিন্ন, কিন্তু বাসে বা ট্রামে তালতাল একতা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *