কলকাতা এবং রামকৃষ্ণলোক
ঠাকুর আপনার কাছে সমর্পণ করে দিলুম। আপনি কি আমাকে গ্রহণ করবেন? প্রথমেই তো আপনি আমার মন দেখবেন। দেখবেন আমি কতটা বিষয়াসক্ত। আমার আসক্তি ঘুচেছে কিনা! সুপুরিগাছের বেল্লো। না শুকোলে তো খুলে পড়বে না। দেখবেন আমি ঝুনো হয়েছি কিনা! ঝুনো হলেই না শাঁস আর খোলা আলাদা হবে। নাড়ালে খটখট শব্দ হবে। ঝুনো কাকে বলে? সংসারে আর রস পাই না। শুকনো মনে হয়। ভাল লাগে না। একঘেয়ে বৈচিত্র্যহীন এক অস্তিত্ব। গাইতে ইচ্ছা করে—
“জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এস।
সকল মাধুরী লুকায়ে যায় গীতসুধারসে এস।”
সবকিছুর মধ্যে থেকেও ভিতরে সদাই এক হাহাকার। ঠাকুর, আপনি আমার এই হাহাকারকে অবশ্যই গ্রহণ করবেন। আমার নিবেদন, আমার এই শূন্যতা। আপনি আমাকে নতুন আশায় বাঁচতে শেখাবেন। ধন, জন, মান সম্মান নয়, আনন্দে বাঁচার কৌশল শেখাবেন! ভয় থেকে যে মুক্ত হতে পারে সেই তো থাকে আনন্দে। কিসের ভয়! হারাবার ভয়। আমরা তো হারাতেই বসেছি। একটা একটা করে খসে পড়ছে জীবনের দিন। ‘যাহা যায় তাহা যায়।’ দিন গেলে তো আর ফেরে না। এগিয়ে আসে অনিবার্য জরা। এই সংসারের যাকিছু সবই তো অর্জন করেছি শরীর দিয়ে। শরীর দিয়েই ধরে রাখতে হবে। প্রথম প্রথম মনের সায় ছিল। দেহ যা করছে, মন তাতে উল্লসিত হচ্ছে। হঠাৎ সেই মন পড়েছে মুষড়ে। দেহনির্ভর সুখ তো চিরস্থায়ী হতে পারে না। ভোগের অশ্বের লাগাম ধরা হাত শিথিল হলেই তো ছিটকে পড়ে যাব। অবিরত নৃত্য কারই বা ভাল লাগে! কিন্তু যে প্রান্তরে সব অশ্বারোহীই ছুটছে সেখানে আমি এক পাশে দাঁড়াই কি করে! বেঁচে থাকার এই অসিযুদ্ধে নিজের তরোয়াল তো খাপে ভরার উপায় নেই। প্রথমে পেয়েছি। অর্জন করেছি বিষয়। এখন চলেছে ধরে রাখার সংগ্রাম। যেন না হারাই!
ঠাকুর হয়তো বলবেন, শতাব্দী শেষ হয়ে আসছে। স্বাভাবিক কারণেই জনপদের চেহারা পালটাচ্ছে। কলকাতার ভগ্নদশা দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। জীবন যন্ত্রণা প্রখর হচ্ছে। যেখানে সমস্যা ছিল না সেখানেও সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সরল আর কিছুই নেই। সবই জটিল। সহানুভূতি, ভালবাসা উবে গেছে। মানুষে মানুষে সম্পর্ক অতিশয় তিক্ত। হানাহানি, কাটাকাটি ছাড়া মানুষ আর কিছুই ভাবতে পারছে না। মানুষ ক্রমশ গুটিয়ে আসছে মনে। যা তোমার মন চায় তার কিছুই তুমি পাবে না। কোথাও শান্তি নেই। সেই তো ভাল। এই তো তোমার উপযুক্ত পরিবেশ—বাইরের মোহিনীমায়ায় তুমি আর আত্মবিস্মৃত হবে না। নিজেকে হারিয়ে ফেলবে না। তোমার ইচ্ছে আরো উদগ্র হবে। তুমি বাইরে থেকে সরে আসবে ভিতরে। সেখানে তুমি আমাকে দেখবে। শুনতে পাবে আমার কণ্ঠস্বর। কলকাতার উপকণ্ঠে, বনে। কলকাতার দিকে আমি হাত বাড়িয়েছিলুম কেন জান? অশান্তিতেই মানুষ শান্তি খুঁজবে, বিক্ষিপ্ততায় খুঁজবে শৃঙ্খলা, অধর্মের পটভূমিতেই ধর্ম উজ্জ্বল হয়। মহা ভাগ্য তোমার। এই শহরে মিশে আছে আমার পদরেণু। এই শহরেই ঘটেছিল উনিশ শতকের জাগরণ।
ঠাকুর আমাকে জিজ্ঞেস করবেন, তুমি তো কলকাতার মানুষ?
—হ্যাঁ ঠাকুর, একেবারে খাস কলকাতার না হলেও, সংলগ্ন এলাকায় বসবাস।
—কলকাতা তো এখন অনেক দূর ছড়িয়েছে। কিলবিল করছে মানুষ। তুমি তো তাদেরই একজন!
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
—আমার সময়েই কলকাতার মানুষ খুব কথা বলত-লম্বা-চওড়া কথা। বকে বেশি। সে অভ্যাস তো যাবার নয়। বরং এখন আরো বেড়েছে।
–(অবশ্যই আমি মাথা নিচু করে থাকব।) বেড়েছে মানে? সাঙ্ঘাতিক বেড়েছে। আমরা যে যেখানে আছি, অনন্ত বকুনির স্রোতে ভেসে চলেছি। শব্দ আর শব্দ। উত্তাল, উন্মাদ শহর। কোথাও কোন শৃঙ্খলা নেই। সবই এলোমেলো আর বিশৃঙ্খল। কোন কিছুই আর বশে নেই। লাগামছাড়া জীবনস্রোত আইন- কানুন, সঙ্ঘ-সংগঠন—সব ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে।
—তোমার জীবনে তো তাহলে কোন নির্জনতা নেই বাপু! নিভৃতে, একান্তে নিজেকে নিয়ে বসতে পার কি?
—আজ্ঞে না। কোন উপায় নেই। আমরা এখন বাস করি পায়রার খোপে। কলকাতার জীবনকে আমরা এখন পোস্টাপিসের চিঠির খোপের মতো রেখেছি। ঠাকুর আপনি কতবার কত ভক্তের গৃহে পদার্পণ করে তাঁদের ধন্য করেছেন। মহামান্য কেশব সেন, বলরাম বসু, কাপ্তেন। আপনি ঝামাপুকুর রাজবাড়িতে কলকাতার জীবন শুরু করেছিলেন। আপনার সাধনপীঠ দক্ষিণেশ্বর, রানী রাসমণির কালীবাড়িতে। শ্যামপুকুরে যে অন্ত্যলীলার শুরু কাশীপুর উদ্যানবাটীতে তার পরিসমাপ্তি। সঙ্কীর্ণ পরিবেশ আপনি পছন্দ করতেন না। তেলচিটে সংসার আপনি ঘৃণা করতেন। সংসার আর সংসারীকে আপনি ঘৃণা করতেন না। ঘৃণা করতেন দুখচেটে সংসারীকে। আপনি বলতেন সংসার হবে শিবের সংসার। আমাদের পায়রার খোপে আপনাকে সাদর আমন্ত্রণ জানাবার সাহস আমার নেই। অতিশয় অপবিত্র! আদর্শভ্রষ্ট। নিষ্ঠাশূন্য জীবনযাপন মাত্ৰ। কোথায় চলেছি আমরা জানি; কিন্তু ফেরাতে পারি না কিছুতেই নিজেকে। এই খোপই শুধু সঙ্কীর্ণ নয়, আমাদের মন ও মানসিকতাও ততোধিক সঙ্কীর্ণ। নিভৃত, নির্জন পরিবেশ কোথায়! স্বল্প পরিসরে বিভিন্ন মানসিকতার মানুষের চাপাচাপি আরাধ্য একটাই—অর্থ। সাধনা হলো নিদ্রা। ভগবান একটু ঘুম দাও।
—আমি যে বলেছিলুম, সংসার থেকে মাঝে মাঝে একটু দূরে চলে যাবে। মাঝে মাঝে সংসার ছেড়ে দেবে। ধর, তোমরা ময়দানে চলে গেলে। কোন পার্কে গিয়ে, একপাশে একটা গাছতলায় নীরবে বসে রইলে কিছু সময়। নিজের ভাবে রইলে কিছুক্ষণ তন্ময় হয়ে। একসময় ফিরে এলে আবার তোমার সেই সংসারে।
–ঠাকুর সেই কলকাতা আর নেই। যে কলকাতায় আপনি ফিটনে চেপে আসতেন। চিৎপুর রোড ধরে যাবার সময় আপনি শিশুর আনন্দে বলতেন, ‘চালাও, চালাও জোরে চালাও, এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও।’ আপনার দুপাশ দিয়ে খেলে চলে যেন উনবিংশ শতকের আলোকিত জনপদের ছবি। আপনি দেখতেন কলকাতার টেরিকাটা যুবকের জটলা। বন্ধুবান্ধবদের নাম ধরে ডাকছে। দেখতেন সাজানো দোকানপাট। বেনিয়ান, মুৎসুদ্দিরা হাঁটছেন ইঙ্গবঙ্গ পোশাকে। কারো মাথায় গোলদার ছাতি। ময়দানে দেখতে গেছেন বেলুন ওড়া। সেখানে দেখেছেন সাহেবদের ফুটফুটে ছেলে। দেখে কৃষ্ণভাবের উদ্দীপন হয়েছে আপনার। আপনি থিয়েটার পাড়ায় গিয়েছেন। থিয়েটার দেখেছেন অপূর্ব আধ্যাত্মিক পরিবেশে। সে-কলকাতা যে আর নেই! পার্ক ও ময়দানের পরিবেশ ভীতিপ্রদ। ভাগীরথীর তটভূমি ব্যবসায়ীদের দখলে। পারিবারিক পরিবেশ বিক্ষিপ্ত। ততোধিক বিক্ষিপ্ত সামাজিক পরিবেশ। সর্বত্রই কোলাহল। হানাহানি, হামলা।
—তাহলে কি হবে। আদর্শ পরিবেশ যখন নেই, আদর্শ মানুষও তাহলে হবে না। তাহলে একটা গল্প শোন—একজন ধ্যানে বসেছে পঞ্চবটীতে। কিছুক্ষণ চেষ্টা-চরিত্রের পর হতাশ হয়ে উঠে এল। কি হলো, না ধ্যান হলো না। ধ্যান করাই গেল না। মন চঞ্চল হয়ে যাচ্ছে কাকের ডাকে। এমন কোন দেশ আছে যে-দেশে কাক ডাকে না! সেই দেশে গিয়ে ধ্যান জমাতে হবে!
–বুঝেছি যা বলতে চাইছেন আপনি। স্বামীজীর ধ্যান চাই। পিঠে কম্বল। না কম্বল নয়, মশা। তবু ধ্যান ভাঙেনি তাঁর।
—কলকাতার কর্মজীবী তুমি। উদয়াস্ত তোমাকে জীবন আর জীবিকার লড়াইয়ে ক্ষতবিক্ষত হতে হবে। তুমি যদি আমাতে সমর্পিত হতে চাও, তাহলে নিজের অন্তরে খুঁজে নাও অদ্ভুত সেই নির্জনতা।
সেই নির্জনতার নাম রাখব রামকৃষ্ণলোক। যে-লোকেই থাকি না কেন, এই রামকৃষ্ণলোক আমার হৃদয়াসীন। আর প্রভু আমার, সখা আমার, প্রিয় আমার শ্রীরামকৃষ্ণ।