কলকাতার স্ট্রিটকর্নার গ্যাং
কলকাতার কলাবাগান থেকে রামবাগান, চলন্ত লোকাল ট্রেনের কামরা থেকে রক, ফুটপাত, স্ট্রিটকর্নার, সর্বত্র চলমান সমাজের টুকরো টুকরো ছবি দেখা যায়, যেগুলি ‘মন্তাজ’ করলে বর্তমান জীবনের চমকপ্রদ চলচ্চিত্র হতে পারে। বাইরের যে বড় সমাজ তার চেহারা একরঙা কাগজের শিটের মতো নয়। ছোট ছোট নানা রঙের বিচিত্র সব ‘সমাজ’ নিয়ে বাইরের বৃহত্তর সমাজের ‘মোজায়েক’ তৈরি হয়েছে। আমরা কথায় বলি, বিপুল এই পৃথিবী, তার কতটুকুই বা আমরা জানি। তারই প্রতিধ্বনি করে বলতে পারি, বিপুল এই সমাজ, যেমন জটিল তেমনি জবরজঙ্গ, তার কিছুই আমরা জানি না। যেটুকু জানি তা নিজেদের গৃহকোণ থেকে একটু জানলা ফাঁক করে দূরের সমুদ্র বা পাহাড় বা মহারণ্যকে জানার মতো। বিশ্বমানবসমাজ কি ভারতীয় সমাজ, এসব অনেক বড় ব্যাপার এবং অনেকেরই নাগালের বাইরে। বাংলার এই বাঙালি সমাজেরই বা কতটুকু আমরা জানি।
হিন্দুসমাজ, মুসলমান সমাজ, তার মধ্যে দরিদ্র কৃষক মজুর নিম্নমধ্য মধ্যবিত্ত উচ্চমধ্য ধনিক প্রভৃতি শ্রেণিসমাজ, নানা স্তরের শিক্ষিত সমাজ, বৈষ্ণব—শাক্ত—শৈব প্রভৃতি ধর্মসম্প্রদায়ের সমাজ, ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্য সদ্গোপ গোপ মাহিষ্য কৈবর্ত বণিক প্রভৃতি শত শত জাতিধর্মগত সমাজ, কর্মকার চর্মকার তন্তুবায় কারুকার প্রভৃতি অসংখ্য পেশাগত সমাজ, বালকসমাজ, তরুণসমাজ বা যুবসমাজ ইত্যাদি বয়সানুক্রমিক সমাজ, এবং তার উপরে নারীসমাজ ও পুরুষসমাজ—একই সমাজের মধ্যে এরকম শত শত খণ্ডসমাজ। দৈশিক ও কালিক বৈচিত্র্যও আছে সমাজের, যেমন ভারতীয় সমাজ, ফরাসি সমাজ, চৈনিক সমাজ, আফ্রিকান সমাজ, গ্রাম্য সমাজ, নাগরিক সমাজ, প্রাচীন ও আধুনিক সমাজ। সামাজিক অণুবীক্ষণ দিয়ে দেখলে প্রত্যেকটি খণ্ডসমাজের মধ্যেও বহু অণুসমাজ দেখা যায়। সমস্ত খণ্ডসমাজ মিলিয়ে সমাজের যে সমগ্রতা, তার প্রকৃত স্বরূপ চেনা যে কত দুঃসাধ্য ব্যাপার তা সহজেই অনুমান করা যায়। জীববিজ্ঞানের সঙ্গে সমাজবিজ্ঞানের এইদিক থেকে একটা সাদৃশ্য আছে। যেমন এক—কোষ থেকে বহু—কোষ জীব ও জীবনের ক্রমাভিব্যক্তি হয়েছে, তেমনি মনুষ্যসমাজের ক্রমবিকাশ ও বয় বৃদ্ধির ফলে সমাজও বহুকোষবিশিষ্ট সমাজ হয়েছে। অর্থাৎ সমাজের যত বিকাশ হয়েছে, বয়স বেড়েছে, তার তত প্রাগৈতিহাসিক অতীতের সহজ—সরল রূপ আধুনিক জটিল রূপ ধারণ করেছে, বৈচিত্র্য বেড়েছে, ভিতরকার খণ্ডসমাজ ও অণুসমাজের সংখ্যাও বেড়েছে।
যেমন গ্রাম্য সমাজ। সমুদ্রগুপ্ত কি লক্ষ্মণসেনের আমলে যে গ্রাম্য সমাজ বাংলা দেশে ছিল—ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রাম ও গ্রাম্য সমাজ—তা বর্তমান যুগের গুপ্ত—ও—সেনদের আমলে তাপদগ্ধ অশান্তি ও অসন্তাোষের জ্বলন্ত চুল্লিতে পরিণত হয়েছে এবং ক্রমেই যত দিনের পর রাত আর রাতের পর দিন যাচ্ছে, তত যেন সেই চুল্লির উত্তাপ বাড়ছে। তার প্রধান কারণ, এই চুল্লির ‘স্টোকার’ বা ইন্ধনিকের সংখ্যা আজ দ্রুতবর্ধমান। নাগরিক জীবনের ইন্ধন, রাজনীতির ইন্ধন, অর্থনীতির ইন্ধন—এবং আরও অনেক ইন্ধন ও ইন্ধনিক। ইন্ধনের আজ অভাব নেই। দ্রুতচল যানবাহন আজ শহর—নগর ও গ্রামের ব্যবধানও ঘুচিয়ে দিয়েছে। কাজেই সুদূর ভবিষ্যতের কোনো স্বর্ণযুগেই আর আমাদের গ্রাম্য সমাজে ‘শান্তির নীড়’ খুঁজে পাওয়া যাবে না, এমনকী দরিদ্রতম খেতমজুরও যদি বিনা মেহনতে গাণ্ডেপিণ্ডে গিলে অঘোরে ঘুমোবার সুযোগ পায়, তা—ও না, কক্ষনো না। ইস্পাত—কারখানায় ‘ব্লাস্টফার্নেস’—এর মতো এই তপ্তচুল্লি গ্রাম্য সমাজের সনাতন নীলাকাশ লাল করে জ্বলতে থাকবে এবং সেই লাল আকাশের দিকে চেয়ে ভবিষ্যতের মানুষের মনে কোনো রাজনৈতিক বা কাব্যিক রোমান্সের শিহরন জাগবে না। নতুন এক জীবনের স্বাদে নতুন শিহরন হয়তো জাগবে।
কেন শিহরন জাগবে না, কেন চোখগুলো ঝলসে যাবে, তা বর্তমান কলকাতার নাগরিক সমাজের রূপ দেখলেই বোঝা যায়। মানুষের সমস্যা যে শুধু ঔদরিক নয়, তার চেয়ে শতগুণ বেশি মানসিক, তা শহরের উদরনিশ্চিন্ত সমাজের চেহারার দিকে চেয়ে যে—কেউ স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হবেন না, যদি না অবশ্য তিনি রাজনীতির নায়কদের মতো দিনকানা হন। উদরের আগুন দাবানলের চেয়েও ভয়াবহ, এ কথা ঠিক, এ কথা মান্ধাতার আমলের সত্যি কথা, এবং সেই আগুনের ইন্ধনিক হবার জন্য যে মার্কসীয় দার্শনিক হবার প্রয়োজন নেই, রাস্তার পাগল হলেও যথেষ্ট, সে কথাও তেমনি সত্যি। কিন্তু তাতে আজকের মানুষের ও সমাজের সমস্যার সমাধান যে হয় না তা রুশ—ডিন, রুশ—চেক, রুশ—হাঙ্গেরির ‘কমরেডি রূপ’ দেখেই বোঝা যায়। রাজনীতির পাঠশালায় বাল্যকাল থেকে আমরা শিখেছি যে একদিন সাম্রাজ্যবাদ—বনাম—সাম্রাজ্যবাদে যুদ্ধ অনিবার্য, এবং সাম্রাজ্যবাদ—বনাম—সমাজতন্ত্রবাদের সম্মুখ সমরে পৃথিবীর যুগযুগান্তের মানবসমস্যার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়ে যাবে, তারপর দীনদুঃখী—আতুর যারা তারাও তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে নিশ্চিন্তে ছিলিমের—পর—ছিলিম তামাক খেতে পারবে। কিন্তু কোথায় সেই তাকিয়া আর সেই তামাক। তামাক বৈপ্লবিক বচনাকীর্ণ গ্রন্থাগারে। আর যদি কোনো পাঠশালার হতভাগ্য শিক্ষক বলেন যে, সাম্যবাদ—বনাম—সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্রপাদ—বনাম—সমাজতন্ত্রবাদের সম্মুখ সমর অনিবার্য এবং কমরেডদের সঙ্গে কমরেডদের খুনোখুনিতে মানবসমাজ ও সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যেতেও পারে, তাহলে তাঁকে বৈপ্লবিক বচনের বোমায় নিশ্চয় উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মনুমেন্টের তলায় বচনবোমার বিস্ফোরণে হয়তো সেই হতভাগ্য শিক্ষকের অন্তরাত্মা আতঙ্কে কেঁপে উঠবে, কিন্তু যা সত্য তা এতটুকুও কাঁপবে না।
যে সত্য অকম্প থাকবে তা হল বর্তমান সমাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের যাবতীয় মানবিক সম্পর্কের বিলুপ্তি এবং যান্ত্রিক সম্পর্কের প্রতিষ্ঠা। বিজ্ঞান ও টেকনোলজির লক্ষ্যহীন দুর্ধর্ষ গতির এই পরিণতি নিষ্করুণ হলেও নির্মম বাস্তব সত্য। বিজ্ঞান ও টেকনোলজি হবে মানুষের দাস, সমাজ ও মানুষের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের জন্য—এই ছিল গোড়ার কথা। শেষের কথা যা আজ সত্য হয়েছে তা হল—মানুষ হয়েছে বিজ্ঞান ও টেকনোলজির ক্রীতদাস। যন্ত্রের হওয়া উচিত ছিল মানবিক, তা না হয়ে মানুষ হয়েছে যান্ত্রিক এবং যন্ত্রমানুষের দ্বারা যে অন্তত কোনো সুন্দর সমাজ বা সভ্যতা গড়া যায় না, ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র উভয়েই তার বর্তমান সাক্ষী।
তা যদি হয় তাহলে পরবর্তী প্রশ্ন হল, সমাজের কোন শ্রেণির মানুষের কাছে ‘ভবিষ্যৎ’ সবচেয়ে বেশি মূল্যবান? ষাট থেকে আশি বছরের বৃদ্ধদের কাছে? পঞ্চাশ থেকে ষাট বছরের প্রৌঢ় ও প্রায়—প্রৌঢ়দের কাছে? তিরিশ থেকে পঞ্চাশ বছরের মধ্যে দ্রুত বিলীয়মান যৌবন যাদের তাদের কাছে? বয়সবিভাগ ট্রপিক্যাল দেশের মানদণ্ড দিয়ে করছি না। একজন আধুনিক পাশ্চাত্য জীবনশিল্পী জীবনের গতি সম্পর্কে লিখেছেন :
To be sure, he was ageing. At forty, though he had remained as slim as a vine shoot, a man’s muscles don’t warm up so quickly… At forty he’s not yet in a wheelchair, but he’s definitely heading in that direction…
Albert Camus : The Silent Men
গভীর স্বচ্ছ জল, ঝকঝকে গরম রোদ, সুন্দরী যুবতী মেয়ে, সতত কর্মচাঞ্চল্য—এ ছাড়া সুখ বলতে আর কিছু ছিল না দেশে। অলব্যিয়র ক্যামু তাঁর দেশের কথা বলেছেন। জীবনেও এ ছাড়া সুখ বা আনন্দ আর কীসে আছে! যৌবন গত হলে সেই আনন্দের আস্বাদ থেকে বঞ্চিত হয় মানুষ। চল্লিশ থেকেই যৌবনের বিদায়কালীন পদসঞ্চার শোনা যায়, যদিও তখন মানুষ হুইলচেয়ারে চলে বেড়ায় না, তবুও বেশ বোঝা যায়, জীবনের এই আনন্দগুলি বিস্বাদ হয়ে আসছে, দেহের স্নায়ুপেশিতে আগেকার মতো আর সাড়া জাগছে না, মনে আর দোলা বা রং লাগছে না। চল্লিশের পর মানুষ হয় ‘স্কাউন্ড্রেল’, এ কথা বার্নার্ড শ বলেছেন। তার প্রায় একশো বছর আগে ডস্টয়েভস্কি বলেছেন :
I am forty years old now, and you know forty years is a whole lifetime; you know it is extreme old age. To live longer than forty years is bad manners, is vulger, immoral. Who does live beyond forty? Answer that, sincerely and honestly. I will tell you who do, fools and worthless fellows.
Dostoevsky : Notes from Underground 1864
এরপর কেউ নিশ্চয় বলবেন না যে চল্লিশের পর জীবনের ‘ভবিষ্যৎ’ আছে। যদিও বর্তমানকালে পুরুষরা তো বটেই, মেয়েরাও চল্লিশের কোঠায় যুবক—যুবতীর ভাবভঙ্গি নিয়ে চলতে চান, তাহলেও জীবনের আলোকোজ্জ্বল রঙ্গমঞ্চে তাঁদের ট্র্যাজিডির নায়ক—নায়িকা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। ভোগের অদম্য আগ্রহ থেকে যখন এই স্থূলপেশি মেদবহুলদের কৃত্রিম যৌবনভঙ্গি প্রকাশ পায়, তখন এই ট্র্যাজিডি হয় আরও করুণ ও নির্মম। তখন আরও পরিষ্কার বোঝা যায় যে যারা ‘টিনএজার’ (তেরো থেকে উনিশ বছরের) ও আদিকুড়ি (কুড়ি থেকে পঁচিশ বছরের), যারা বয়ঃসন্ধি ও যৌবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে, তাদের তারুণ্যোচ্ছ্বাসের অকৃত্রিম ও অসংযত প্রকাশ কত স্বাভাবিক। বিগতযৌবনরা, অথবা (কনসেশন—সহ) অস্তমান—যৌবন নারী—পুরুষরা যদি আজ মহানগরের পথেঘাটে ট্রাম—বাসে শপিং সেন্টারে সিনেমা—থিয়েটারে কলাপ্রদর্শনীতে হোটেল—রেস্তরাঁয় সভাসমিতিতে তাঁদের বেশভূষায় চলনে—বলনে অঙ্গভঙ্গিতে পূর্ণযৌবন যুবক—যুবতীদের প্রতিস্পর্ধী হতে চান এবং সর্বত্র সচেতনভাবে তার অভিনয় করে বেড়ান, তাহলে তরুণ—তরুণীদের দৃপ্ত ও উদ্ধত আচরণের সমালোচনা করার অধিকার, অন্তত নৈতিক অধিকার তাঁদের কিছু আর থাকে না। ‘টিনএজার’ ছেলেমেয়েরা যদি পথে বেরুলে দেখতে পায় যে তাদের মা—বাবার বয়সি যাঁরা তাঁরাই জীবনের রসাস্বাদনে আজ তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী, তাহলে বর্তমান সমাজের এই বিচিত্র জীবনদ্বন্দ্বে তরুণ—তরুণীদের উদ্দাম তারুণ্য স্বভাবতই সমস্ত নীতির বাঁধ ভেঙে আত্মপ্রকাশ করার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে।
অথচ চল্লিশের প্রতিদ্বন্দ্বীদের জীবনের কোনো ‘ভবিষ্যৎ’ বলে কিছু নেই। তাঁদের শুধু ক্রাচের মতো কতকগুলি অবলম্বন আছে, আর আছে প্রাণপণে পশ্চাদ্ধাবন করার মতো বর্তমান ভোগবহুল স্টেটাস—সর্বস্ব ধনতান্ত্রিক টেকনোলজিক্যাল সমাজে কতকগুলি স্বর্ণমৃগ—যেমন অর্থ, প্রতিপত্তি, খ্যাতি। কিন্তু যাকে ‘জীবন’ বলে তার কোনো স্বাদ নেই এর মধ্যে। স্বর্ণমৃগ তো আর বনমৃগ নয়। যে স্বাদ আছে ঝকঝকে রোদের তাপে, স্বচ্ছ জলের গভীরতায়, তরুণ—তরুণীর বলিষ্ঠ দেহ—মনে, পাখির ডাকে, সেই স্বাদ কোথায় টাকার সিন্দুকে? কোথায় জরদগবের প্রতিপত্তিতে? অথবা মৃত্যুপথযাত্রীর খ্যাতির দুন্দুভিতে? কোথাও নেই। তাই বলছি, চল্লিশের পরে ভবিষ্যৎ নেই, জীবন নেই, ধনসুখ নেই, যতই আয়নার সামনে গ্রীবাভঙ্গি করে আমরা যৌবনের রিহার্সাল দিই—না কেন, তবু নেই। শুধু স্বর্ণমৃগ আছে পশ্চাদ্ধাবনের জন্য, স্থূল দেহপিণ্ড আছে উটের মতো জীবনের মরুভূমিতে বহনের জন্য, স্তিমিত স্নায়ু ও শ্লথ পেশি আছে মধ্যে মধ্যে হারিয়ে—যাওয়া জীবনের বেসুরো ঝংকার শোনার জন্য। আগেকার বানপ্রস্থকালে ছিল ‘ধর্ম’, বর্তমানে বানপ্রস্থকালে তার বিকল্প হয়েছে ‘রাজনীতি’, চল্লিশের আর—একটি স্বর্ণমৃগ। এই চল্লিশের মা—বাবাদের ছেলেমেয়েরাই বর্তমান সমাজের সমস্যা। তাদের বয়স তেরো থেকে পঁচিশ বছর। তাদের জীবন আছে, জীবনের ‘ভবিষ্যৎ’ আছে, যদ্যপি রাষ্ট্রনায়করা সেই ভবিষ্যৎটিকে আজ গভীর অন্ধকারে আবৃত করে ফেলেছেন। যাদের ভবিষ্যৎ থাকে তারাই ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে দেখে। যদি সেই ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়, তাহলে বর্তমানের বুকের দাঁড়িয়ে তারা কী করতে পারে?
বর্তমানের বুকের উপরেও দাঁড়াবার স্থান নেই তাদের। তাই তারা স্ট্রিটকর্নারে দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের যোগ্য কোনো কাজ নেই সমাজে, বর্তমানে নেই, এবং বর্তমান সমাজের চেহারা, এরকম থাকলে ভবিষ্যতেও নেই। তাই তারা খেয়ালখুশিমতো কাজ করে, যে—কোনো কাজ, অকাজ—কুকাজ যা—ই হোক, কারণ কিছু—না—করার চেয়ে একটা—কিছু—করা তাদের বয়সের দিক থেকে প্রয়োজন। জ্যেষ্ঠদের মতো তাদের স্বর্ণমৃগের ধান্দা নেই, জীবনের কুটিল পথে দুরভিসন্ধি নিয়ে সন্তর্পণে পা টিপে টিপে তারা চলতে শেখেনি এবং নির্বিকার উদাসীন যন্ত্রের মতো মুনাফার লোভে মৃত্যুর ব্যাবসা করতেও তারা জানে না। মিথ্যা ধর্মাচরণের মতো বয়স তাদের হয়নি, অধর্মের বিবেকদংশনও নেই। কোনো সম্বল বা কোনো মূলধন তাদের নেই, কেবল নতুন তারুণ্য ও যৌবনের দুরন্ত কর্মশক্তির সম্বল ছাড়া। সেই তারুণ্যের উদ্দাম শক্তি যখন সমাজে স্বাভাবিক আত্মনিয়োগের পথ খুঁজে পায় না, তখন তার খানিকটা বিচ্ছুরণ যে স্ট্রিটকর্নারে হবে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কলকাতার স্ট্রিটকর্নারে নয় শুধু, সারা পৃথিবীর শহর—নগরের স্ট্রিটকর্নারে, এমনকী গ্রামের ও পথের কোণে হাটে—মাঠে আজ যুবশক্তির এই বিভ্রান্ত বিক্ষেপণ আমরা দেখতে পাচ্ছি। বর্তমান তরুণ—বিক্ষোভের সমগ্র রূপ নিশ্চয় স্ট্রিটকর্নারের শক্তিবিক্ষেপণে দেখা যায় না, যেমন কোনো দেশের সমগ্র তরুণসমাজকেও শুধু স্ট্রিটকর্নারে দেখা যায় না। তবু এটাকে সেই ব্যাপক তরুণ বিক্ষোভেরই একটা অগ্নিকণা বলা যায়, পথের কোণের অগ্নিকণা। বৃহৎ তরুণসমাজের মধ্যে স্ট্রিটকর্নার। সমাজ একটি খণ্ডসমাজ, এবং বৃহত্তর জনসমাজের মধ্যে একটি অণুসমাজ। কিন্তু এই অণুসমাজটিও যে উপেক্ষার বস্তু নয়, আণবিক শক্তির মতোই প্রচণ্ড তার শক্তি, তার পরিচয় আমরা কলকাতার স্ট্রিটকর্নার সমাজ থেকে প্রতিদিন পাই।
স্ট্রিটকর্নার সমাজ প্রধানত টিনএজারদের সমাজ, অর্থাৎ তেরো থেকে উনিশ বছরের তরুণদের সমাজ। আমেরিকান সমাজে তরুণদের মধ্যে সাধারণত দু—রকমের দল বা গোষ্ঠী দেখা যায়, একটিকে উইলিয়াম ফুট হোয়াইট বলেছেন ‘Corner boys’, আর—একটিকে ‘College boys’, খানিকটা শিক্ষা, খানিকটা পারিবারিক পরিবেশের তারতম্যের জন্য এই দলগত পার্থক্য গড়ে ওঠে। ‘কর্নার—বয়’দের সম্বন্ধে হোয়াইট বলেছেন *:
Corner boys are groups of men who centre their social activities upon particular street corners… They constitute the bottom level of society within their age group…
কিন্তু ‘কলেজ—বয়’রা, হোয়াইটের মতে—“have risen above the cornerboy level through high education.”
কর্নারের ছেলেরা তাদের সমবয়সি তরুণদের মধ্যে নিম্নতম স্তরভুক্ত, শিক্ষাদীক্ষাও তাদের বেশি নয়। এইজন্য তাদের দলকে বলা হয় ‘gang’ আর কলেজের তরুণদলকে ‘club’ বলা হয়। হোয়াইট আমেরিকান সমাজে, এবং Cornerville-এর মতো একটি বিশেষ অঞ্চলে, স্ট্রিটকর্নার তরুণদল সম্বন্ধে অনুসন্ধান করেছিলেন। এরকম অনুসন্ধান আরও অনেক সমাজবিজ্ঞানী নানাদিক থেকে অন্যান্য দেশেও করেছেন। আমাদের দেশে এরকম সামাজিক অনুসন্ধানের গুরুত্ব ও আবশ্যকতা খুব বেশি হলেও, অনুসন্ধানীদের দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজচেতনা, সাহস ও ব্যক্তিগত উদ্যমের অভাবের জন্য তা করা হয়নি। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঔদাস্য ও অচৈতন্যও এই জাতীয় সমাজসমীক্ষার অনুকূল নয়। বিভিন্ন দেশের সমাজবিজ্ঞানীদের প্রত্যক্ষ অনুসন্ধানের ফলে দেখা গিয়েছে যে মূলত তরুণসমাজের এবং তরুণদলের সমস্যা সব দেশেই আজ প্রায় একরকম, এমনকী স্ট্রিটকর্নারের তরুণদলেরও। দেশভেদে তার কিছু বৈচিত্র্য আছে, পার্থক্য বিশেষ উল্লেখ্য কিছু নেই। তার কারণ, আর্থিক দিক থেকে ‘উন্নত’ ও ‘অনুন্নত’ দেশের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও, এবং ভোগবিলাসের স্তরে যে পার্থক্যই আজ থাক—না কেন, সামাজিক ও মানসিক স্তরে সর্বত্র আজ পার্থক্যের চেয়ে সাদৃশ্যই বেশি। অধিকন্তু কি আর্থিক দিক থেকেও আজকাল আর তাদের ‘under-developed’ বা ‘অনুন্নত’ দেশ বলা হয় না, বলা হয় ‘developing’ ‘উন্নতিশীল’ দেশ। তাহলেও আমেরিকার ‘অ্যাফ্লুয়েন্ট’ সমাজের সঙ্গে আমাদের দেশের সমাজের নিশ্চয় পার্থক্য আছে। কিন্তু যন্ত্রায়ণ—শিল্পায়নের সঙ্গে ‘উন্নতিশীল’ অর্থনীতির অগ্রগতির এমনই মাহাত্ম্য (যুগমাহাত্ম্য তো আছেই) যে গলব্রেথ বর্ণিত আমেরিকার সেই অ্যাফ্লুয়েন্ট সোসাইটির সমস্ত উপসর্গ আজ আমাদের সমাজেও প্রকট হয়ে উঠেছে। নিউ ইয়র্কে বা লন্ডনে বা প্যারিতে বা মস্কোয় নয়, কলকাতা—দিল্লির মতো শহরেও তার প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। কলকাতার ‘বার’—হোটেলের ‘ম্যাডহাউস’—এর দৃশ্য ও স্ট্রিটকর্নার তরুণদলের কীর্তির প্রভেদ নেই। সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠরা ‘ম্যাডহাউস’—এর অভিনেতা এবং তরুণরা স্ট্রিটকর্নারের।
সামাজিক শ্রেণির দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে কলকাতার স্ট্রিটকর্নার তরুণসমাজ প্রধানত নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির কিশোরদের সমাজ। কিশোরী বা তরুণীদের ঠিক এরকম ‘কর্নার—সমাজ’ এখনও গড়ে ওঠেনি, কারণ কিশোরীদের পক্ষে স্ট্রিটকর্নারে জটলা করার অসুবিধা আছে, এবং তাদের স্বাধীনতা থাকলেও স্বাচ্ছন্দ্য ঠিক ছেলেদের মতো নেই। যেমন কর্নারের ছেলেদের পক্ষে রাস্তার যাত্রীদের কাউকে লক্ষ্য করে শিস দেওয়া, হুইসল দেওয়া, টিপ্পনী কাটা অথবা কোড—ল্যাংগুয়েজে অপ্রিয় মন্তব্য করা যত সহজ, মেয়েদের পক্ষে আদৌ তত সহজ নয়। তাই কিশোরী মেয়েরা ঠিক স্ট্রিটকর্নারে চাক বাঁধতে পারে না, অথচ কিশোরদের কর্নারের কাছাকাছি তারা গুচ্ছে গুচ্ছে চলমান থাকে, খিলখিল—কলকল করে ফ্রক দুলিয়ে হেসে—চলে বেড়ায়, সিনেমাস্টার ও খেলোয়াড়দের গল্প করে, এক—আধ সময় দেখেছি কর্নার—দলের সঙ্গে চকোলেট—লজেন্স ছোড়াছুড়িও হয়। কর্নারের কাছাকাছি যদি কোনো মাঠ থাকে, কোনো বাড়ির ফালতু রক অথবা দোকানের চত্বর, কিশোরীরা সেখানেও ঝাঁক বেঁধে থাকে। তার মধ্যে যদি কোনো ফুচকাওয়ালা, আলুকাবলি বা ঘুগনিওয়ালা রাস্তায় হাজির হয়, তাহলে তাকে সেন্টার করে চোখের পলকে কিশোর—কিশোরীদের একটা মিশ্র সমাজ গজিয়ে ওঠে এবং পথিকদের ভ্রূক্ষেপ না করেই তাদের স্বাধীন বাক্যালাপ ও বকম বকম চলতে থাকে। বান্ধবীদের সঙ্গে বয়ফ্রেন্ডদের এবং বন্ধুদের সঙ্গে গার্লফ্রেন্ডদের আলাপ—পরিচয় হয় বিশুদ্ধ বঙ্গভাষায়, বিহারি ফুচকাওয়ালা না—বোঝার ভান করে ফুচকার মশলা মাখতে থাকে। তাই মনে হয়, অদূর ভবিষ্যতে স্ট্রিটকর্নারে কিশোরী—তরুণীদের সমাজও গজিয়ে উঠতে পারে, এমনকী কিশোর ও কিশোরীদের মিশ্র সমাজও, কারণ ফুচকাওয়ালার আড়াল খুব বেশি দিন টেকসই হবে বলে মনে হয় না। কলকাতার ‘মেট্রোপলিটন—কমপ্লেক্স’—এর কথা বলছি না, উত্তর—পূর্ব—দক্ষিণের প্রসার্যমাণ শহরতলির নিম্নমধ্যবিত্তপ্রধান জনবহুল সমাজের দিকে চেয়ে মনে হয়, তরুণ তরুণীদের দুর্বার গতি আজ স্ট্রিটকর্নার সমাজের দিকে, এবং তরুণদের স্ট্রিটকর্নার সমাজের গতি অচিন্তনীয় দুঃসাহসিক কীর্তির বৈচিত্র্যের দিকে। মেট্রোপলিটন কমপ্লেক্সের নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজের রূপও অন্যরকম নয়, একরকম। এমনকী গ্রাম্য সমাজের স্বাতন্ত্র্যও এইদিক থেকে আজ প্রায় নিশ্চিহ্ন।
কর্নার—সমাজের অন্যতম বিশেষত্ব হল, প্রত্যেকটি কর্নারের কিশোরদের কাছে সেই নির্দিষ্ট কর্নারের স্থানিক মাহাত্ম্য। মনে হয় যেন পুণ্যলোভীদের তীর্থের চেয়েও কর্নারের আকর্ষণ দলের ছেলেদের কাছে অনেক বেশি। রাস্তার উপর ভাঙা কালভার্ট যাদের কর্নার, রাস্তার ধারে অর্ধসমাপ্ত প্রাচীরের পাশ যাদের কর্নার, কোনো চায়ের দোকানে বেঞ্চি—টুল যাদের কর্নার, পানের দোকানের কোণ যাদের কর্নার, এমনকী দক্ষিণকোণ ও বামকোণ, বছরের পর বছর দেখেছি তারা সেই কর্নারেই জমা হয়। কালভার্ট থেকে প্রাচীরের পাশে যায় না, চায়ের দোকান থেকে পানের দোকানে যায় না, এমনকী দোকানের দক্ষিণ কোণ থেকে বাম কোণেও স্থান পরিবর্তন করে না। একই রাস্তার দুইপাশে একাধিক কর্নার বিরাজ করতে পারে, অদ্ভুত স্বাতন্ত্র্য নিয়ে। অনুসন্ধানে হোয়াইটের ‘গাইড’ কর্নার—লিডার ডকের কথা মনে হয়—
Fellow around here don’t know what to do except within a radius of about three hundred yards.
কলকাতার নিম্নমধ্যবিত্তপ্রধান শহরতলিতে—পাইকপাড়া দমদম থেকে যাদবপুর গড়িয়া গঙ্গাপুরী পুটিয়ারি বেলেঘাটা রথতলা—কসবা হালতু পর্যন্ত—অনেক জায়গায় একশো গজের ব্যবধানে বেশ বড় বড় কর্নার—সমাজ গড়ে উঠেছে দেখা যায়। প্রত্যেক কর্নার—গোষ্ঠীর নিজস্ব ও অন্যের সীমানা সম্বন্ধে ইনটিগ্রিটি—বোধ অসামান্য, সাধারণত কেউ কারও সীমানা লঙ্ঘন করে না, প্রত্যেকটি দল নিজস্ব এলাকার ডিক্টেটর। সীমানা লঙ্ঘন অথবা সীমানার কর্তৃত্বে হস্তক্ষেপ করলে কর্নার—লিডারের অঙ্গুলিহেলনে খণ্ডপ্রলয়ও হতে পারে। এক কর্নারের ছেলে যদি অন্য কর্নারে যায়, অথবা কোনো কর্নার লিডার দল ভাঙার উসকানি দেয়, তাতেও খণ্ডপ্রলয় অনিবার্য। এরকম খণ্ডপ্রলয় অনেক দেখেছি—হাতবোমা ক্র্যাকার ছুরি ইট—পাটকেল সোডার বোতল ইত্যাদি সহযোগে রীতিমতো গেরিলা যুদ্ধ বলা চলে। বিষয়টা কর্নারের প্রতি ‘লয়ালটি’ নিয়ে, অথবা কর্নারের ‘টেরিটোরিয়াল ইনটিগ্রিটি’ ও ‘সভরেনটি’ নিয়ে। দুটোই হল কর্নার—সমাজের মূল ভিত্তিস্তম্ভ। কোনোটি ধরে নাড়া দেওয়ার উপায় নেই।
কর্নারের আকর্ষণ কর্নার—বয়ের কাছে তাই দুর্নিবার। কর্নার—লিডার ডকের কথায় বলা যায় :
They come home from work, hang on the corner, go up to eat, back on the corner, up to a show, and they come back to hang on the corner.
টিনএজার তরুণদের আজকাল কাজও করতে হয়, যোগ্যতা ও সুযোগ অনুসারে নানারকমের কাজ, এবং অসময়ে স্কুল ছেড়ে, কলেজ ছেড়ে, আর্থিক অনটনের জন্য কাজ করতে তারা বাধ্য হয়। আজ করলেও কর্নার তারা ভোলে না। কাজের পর কর্নারে যায়, বাড়িতে দু—মুঠো খেয়ে কর্নারে যায়, সিনেমা বা খেলে দেখে ফিরে কর্নারে যায়। বন্ধুরা কেউ আজকাল আার বাড়িতে খোঁজ করে না, কর্নারে খোঁজ করলেই বন্ধুর খবর জানতে পারে। বাড়িতে বা পরিবারে খোঁজ করে না, কারণ বাড়ির লোক জানে না তার খবর, কর্নারের বন্ধুরা সব জানে। বিস্তৃত অনুসন্ধানের পর হোয়াইট তাই এ বিষয়ে তাঁর সুচিন্তিত মতামত প্রকাশ করেছেন।
Home plays a very small role in the group activities of the corner boy. Except when he eats, sleeps, or is sick, he is rarely at home, and his friends always go to his corner first when they want to find him.
কর্নারের ছেলেদের দৈনন্দিন জীবন ও কার্যকলাপের সঙ্গে পরিবারের বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই। দু—বেলা দু—মুঠো খাবার সময়, ঘুমোবার সময় এবং অসুখবিসুখ ছাড়া রাস্তার কোণের ছেলেদের ঘরে থাকতে দেখা যায় না এবং তার বন্ধুরা তাই তার ঘরে খোঁজ করে না, খোঁজ করে কর্নারে। স্ট্রিটকর্নার—সমাজের উৎপত্তি ও প্রসারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল, বর্তমানকালে পারিবারিক জীবনধারার বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
আমাদের সময় ছেলেবেলা থেকে আমরা শিখেছি ও জেনেছি ‘হোম, সুইট হোম’ এবং গৃহের মতো, পরিবারের মতো আর কোনো স্থান নেই জগতে। এখন সেই গৃহ মধুময় নয়, বিষময়। যন্ত্রযুগের গড্ডলসমাজে বাবা—মা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন সকলে ভাসমান। বেশি দিন নয়, মাত্র গত পঁচিশটা বছরের দিকে (দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ থেকে আজ পর্যন্ত) যদি কেউ চেয়ে দেখেন খোলা চোখে, সমস্ত পরদা সরিয়ে, তাহলে পরিষ্কার দেখতে পাবেন, পারিবারিক স্নেহ—প্রীতি—ভালোবাসার সম্পর্ক ও সংস্পর্শ কোন স্তরে পৌঁছেছে। নিকট আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্কের দূরত্ব এত বেড়ে গিয়েছে যে, বছরের পর বছর ঘুরে গেলেও অনেকের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎই হয় না, এবং অনেকের চেতনার সীমানার মধ্যেই আত্মীয়রা বিরাজ করেন না। বিবাহ—শ্রাদ্ধের মতো অনুষ্ঠান ছাড়া আত্মীয়দের চোখের মিলনও ঘটে না। পরিবার শুধু স্বামী—স্ত্রী ও তাঁদের ছেলেমেয়েদের একক—পরিবার হয়েছে—যন্ত্রযুগের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। জন্ম থেকে এ যুগের ছেলেমেয়েরা সমস্ত নিকটআত্মীয়দের প্রত্যক্ষ স্নেহ—ভালোবাসার সম্পর্ক থেকে বঞ্চিত (গত পঁচিশ কেন, কুড়ি বছরে যেসব ছেলেমেয়েদের জন্ম হয়েছে, তাদের কথাই আমরা বলছি)। বাকি থাকেন বাবা ও মা।
বাবা ও মা সম্পর্কে একটি কথা সবার আগে মনে রাখা দরকার। কথাটা হল, তাঁরাও মানুষ। পিতৃত্ব ও মাতৃত্বের জৈবগুণ পালনের জন্য তাঁরা দৈবগুণের অধিকারী হন না। আত্মীয়হীন একক—পরিবারে সংসারের ও সন্তানের সমস্ত দায়িত্ব তাঁদের দু—জনকে পালন করতে হয়। এ দেশে বাবা চিরকালই গৃহকর্তা, আর্থিক বোঝা তিনিই প্রধানত বহন করেন। বর্তমানে মায়েরাও আর্থিক ক্ষেত্রে তাঁদের সহযোগী হয়েছেন। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে শিক্ষিত—অশিক্ষিত নির্বিশেষে মা—বাবাদের সকলকেই প্রায় জীবিকার জন্য কোনো—না—কোনো কাজ করতে হয়। যাঁদের নিছক জীবনধারণের সমস্যা নেই, স্বামীর আয়ই তাঁদের পক্ষে যথেষ্ট, তাঁরাও বর্তমান যুগে স্ত্রী—স্বাধীনতা কামনা করেন, বিশেষ করে আর্থিক স্বাধীনতা। তার জন্য তাঁরাও স্বামীর মতো চাকরি করতে যান। স্বাধীনতার চেয়েও বড় কথা হল, মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার মান (standard of living) বর্তমান ভোগ্যদ্রব্যবহুল সমাজে দ্রুত পরিবর্তনশীল, এবং সেই মান উন্নয়নের জন্য সকলেই প্রাণপণে প্রয়াসী। কাজেই নিম্নমধ্যবিত্ত স্তরের উপরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তের মধ্যেও দেখা যায়, স্বামী—স্ত্রী উভয়েই অর্থোপার্জনে ব্যস্ত। নিম্ন থেকে উচ্চ, মধ্যবিত্তের সকল স্তরেই আজ বাবা—মা বা স্বামী—স্ত্রী—র জীবন বহির্মুখী, আর্থিক কর্মমুখী—কারও নিছক জীবনধারণের জন্য, কারও বা ক্রমাগত পরিবর্তনশীল জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য, সামাজিক স্টেটাস উত্তোলনের জন্য। তা—ই যদি হয় তাহলে আত্মীয়হীন একক—পরিবারের অবস্থা কী হয়, এবং সেই পরিবারের ছেলেমেয়েদের অবস্থা?
অবস্থা সহজেই কল্পনা করা যায়। কল্পনার প্রয়োজন হয় না, কলকাতা শহরে মধ্যবিত্ত পরিবারের বিভিন্ন স্তরে ঘরের দিকে একটু উঁকি দিয়ে তার বাস্তব ছবি দেখলে শিউরে উঠতে হয়। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহ জনমানবহীন গ্রাম্য শ্মশানের মতো ভয়াবহ, মধ্য ও উচ্চবিত্ত পরিবার কাকপক্ষীহীন কেয়ারি—করা টবের বাগানের মতো কৃত্রিম, প্রাণহীন। কোনোটাই মনুষ্যবাসোপযোগী নয় এবং মনুষ্যসন্তান প্রতিপালনের অনুকূল নয়। সংগতি অনুসারে এইসব গৃহ ভৃত্যদের অধীন (পুরুষ ও মহিলা ভৃত্য) থাকে এবং বালক—বালিকা ও কিশোর—কিশোরীদের ভৃত্যের অভিভাকত্বে রেখে যাওয়ার ফলে যে কত প্রকারের বিপর্যয় তাদের জীবনে ঘটতে পারে তা বিশদ ব্যাখ্যা করে না—বলাই বাঞ্ছনীয়। বাবা ও মা সন্ধ্যার পরে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফেরেন, অবসাদ কাটিয়ে এবং সমাজের অবশ্যকর্তব্য করে ছেলেমেয়েদের প্রতি স্নেহপ্রদর্শনের মতো মেজাজ তাঁদের আর থাকে না। যাঁদের সংগতি আছে, ভৃত্যবেষ্টিত ও গ্যাজেটদুরস্ত পরিবার আছে, তাঁদের চাকরিকর্ম ছাড়াও অন্যান্য সামাজিক—সাংস্কৃতিক কর্ম থাকে—যেমন শপিং, সান্ধ্য মজলিশ, ক্লাব, আসর, সিনেমা, প্রদর্শনী—রাত্রি এক প্রহর পর্যন্ত তাতেই তাঁদের কেটে যায়—আধুনিক মায়েদের—কারণ আগেই বলেছি, নারীর জীবন আজকাল পঁয়ত্রিশ বা চল্লিশের পর শেষ হয়ে যায় না, শেষ হয়ে যাক তা—ও তাঁদের কাম্য নয়। কাজেই একটু স্নেহ, একটু ভালোবাসা, একটু আদরযত্ন, একটু সান্নিধ্য—এসব মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা আধুনিক বাবা—মা—র কাছ থেকে পায় না—এমনকী একশ্রেণির উন্নাসিক ন্যাকামিপ্রসূত ‘ড্যাডি—মামি’ বা ‘টা—টা’র তোতাপাখির বুলির ভিতর দিয়েও না। পাশ্চাত্য সমাজে এই সমস্যা যদি অত্যন্ত প্রকট হয়ে থাকে, আমাদের সমাজে তাহলে তা অত্যন্ত বিকট হচ্ছে বলা যায়, কারণ আমাদের সমাজ পাশ্চাত্যের তুলনায় অনেক বেশি জবড়জং। পাশ্চাত্য সমাজের একটা পরিষ্কার আকার আছে তা সে যেরকমই হোক—না কেন, আমাদের সমাজ কিম্ভূতকিমাকার—ঐতিহ্য ও আধুনিকতা, বিজ্ঞান ও ধর্ম, গুরুবাদ ও নেতাবাদ, পৌত্তলিকতা ও ব্রহ্মবাদ, সলজ্জ সাধুতা ও নির্লজ্জ অসাধুতা, ঐশ্বর্য ও দারিদ্র্য, বহুদেবতা, বহুদানব এবং বহুমানবের এক বিচিত্র মিশ্র সমাজ।
যে পাশ্চাত্য সমাজের একটা বিশেষ আকার আছে, সেখানেই বাবা—মা—র, বিশেষ করে মেয়েদের বহির্মুখী জীবনের প্রতিক্রিয়া পারিবারিক জীবনে কীভাবে দেখা দিচ্ছে, সে বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানী ফাইভেল বলেছেন :
The general exodus of married women, many of them mothers, into outside work, in itself helped to create a new social atmosphere, a new general way of family life whereby ‘home’ for many boys and girls becomes less important in their lives, and the companionship of the irresponsible gang therefore become more important.—বাঁকা হরফ লেখকের।
পৃথিবীর সমস্ত শহরে আজ তাই তরুণদের স্ট্রিটকর্নার—সমাজের বিকাশ ও প্রসার হচ্ছে ব্যাপকভাবে। কলকাতা শহরও পিছিয়ে নেই, বরং ইউরোপের অনেক শহরের চেয়ে এগিয়ে আছে। অন্যান্য শহরের মতো ঘর ও পরিবার কলকাতা শহরে ভেঙে গেছে, কিন্তু কলকাতার ভাঙন আরও বেশি মর্মান্তিক। লক্ষ লক্ষ বাস্তুচ্যুত পরিবার আজ কলকাতার শহরতলি ও মেট্রোপলিটন কমপ্লেক্সে নির্মম জীবনসংগ্রামে লিপ্ত। নিম্নমধ্যবিত্ত তরুণরা পথের ভেন্ডার, ট্রেনের ক্যানভাসার, কারখানার সাধারণ মজুর, অফিসের বেয়ারা, অথবা বেকার। অধিকাংশেরই বাসগৃহ দরিদ্রের গোয়ালের চেয়েও নিকষ্ট, মাথা গোঁজার বা বিশ্রামের স্থান নেই। পিতা—মাতার দাম্পত্যজীবনের সঙ্গে কিশোর—কিশোরী ছেলেমেয়েদের একশো বর্গফুট স্থানের মধ্যে সহবাসের অভিজ্ঞতা যে কী ভয়ংকর, তা যাদের বাস করতে হয় তারাই জানে। কাজেই গৃহ ও পরিবার কলকাতার নিম্নমধ্যবিত্ত তরুণ্যের কাছে জ্বলন্ত নরককুণ্ড—সেখানে যে শুধু স্নেহ—মায়া—মমতা নেই তা নয়, কোনোরকমে পশুর মতো দৈহিক বসবারেও সুযোগ নেই। এ ছাড়া কলকাতার সাধারণ মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত তরুণদের অধিকাংশের কাছে গৃহ ও পরিবারের কোনো আকর্ষণ নেই, কারণ মানবিক সম্পর্কের স্বাদ সেখানে তারা পায় না। তাই তারা মর্যাদার জন্য স্ট্রিটকর্নারে না এলেও, কফি কর্নারে যায়। অর্থাৎ স্ট্রিটকর্নার থেকে কফি কর্নার বাইরের যে—কোনো কর্নার আজ তরুণদের কাছে ঘর ও পরিবারের চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয়। কারণ ঘর আর আগের ঘর নেই, পরিবার আর আগের পরিবার নেই, বাইরের হৃদয়হীন যান্ত্রিক সমাজের হুবহু প্রতিচ্ছবি হয়েছে পরিবার। ধনতন্ত্রের বার্ধক্যে যা হবার কথা তা—ই হয়েছে।
স্ট্রিটকর্নার—সমাজ তরুণসমাজ। তরুণীদের কথা আপাতত থাক। স্ট্রিটকর্নার সমাজের হৃদয় আছে, মন আছে, বিবেক আছে, উচ্ছল প্রাণ আছে, তারুণ্যের উদ্দাম শক্তি আছে, সাহস আছে। এর কোনোটাই বৃহত্তর সমাজে নেই, এবং তার ক্ষুদ্র প্রতিচ্ছবি পরিবারেও নেই। স্ট্রিটকর্নার—সমাজের বৈশিষ্ট্য হল দৃঢ় গোষ্ঠীবদ্ধতা, পরস্পরের অবিচ্ছেদ্য বন্ধুপ্রীতি, লিডার বা গোষ্ঠীপতির প্রতি অন্ধ অনুরাগ। এগুলি মানসিক গুণ এবং অবশ্যই তারুণ্যের ধর্ম। কিন্তু সমাজের মানুষের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নেই, ভালোবাসাও নেই বিশেষ, কারণ আজকের সমাজে খুব কম মানুষই আছেন যাঁরা শ্রদ্ধার পাত্র, ভালোবাসার পাত্র, বিশেষ করে উচ্চসমাজে। এই তরুণরা যেমন পিতা—মাতার স্নেহস্পর্শ থেকে বঞ্চিত, তেমনি পিতা—মাতারাও তাদের শ্রদ্ধা থেকে বঞ্চিত। স্ট্রিটকর্নার—সমাজের তরুণদের যদি কোনো শ্রদ্ধা সমাজের প্রতি না থাকে, তাহলে তার জন্য তরুণরা দায়ী নয়, দায়ী সমাজ, বিশেষ করে সমাজের শাসক ও পরিচালক জ্যেষ্ঠরা। আজ সমাজের জ্যেষ্ঠরা সমাজজীবনের সর্বক্ষেত্রে সমস্ত আদর্শ ও নীতিবোধ বিসর্জন দিয়ে, এমনকী সামান্য শিষ্টাচার পর্যন্ত ভুলে গিয়ে, যে আচরণ করছেন, তাতে তরুণদের কাছে কোনো দাবি করারই তাঁদের অধিকার নেই। কর্পোরেশন—অ্যাসেম্বলি থেকে পার্লামেন্ট, স্কুল—কমিটি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট—সিন্ডিকেট, ব্যাবসাক্ষেত্র থেকে রাজনৈতিক ক্ষেত্র, সর্বত্র মেকিভণ্ড ও নিধিরামদের তাণ্ডব, এবং সেই তাণ্ডবের কী অশিষ্ট অভদ্র অশালীন রূপ! স্ট্রিটকর্নারের যে—কোনো হতচ্ছাড়া বাউন্ডুলে তরুণ তার সমস্ত ঔদ্ধত্য ও অশালীনতা নিয়ে সমাজের জ্যেষ্ঠ ও প্রাজ্ঞদের এই মিথ্যা দম্ভ ও অশিষ্টতার কাছে লজ্জায় মাথা হেঁট করবে। তারপর সমাজের বিচিত্র প্রচারযন্ত্রের সাহায্যে কেবল এই অপদার্থতার গুণকীর্তন এবং ভণ্ডদের জয়ধ্বনি! যেমন বাণিজ্যে, তেমনি শিক্ষাক্ষেত্রে, তেমনি রাষ্ট্রশাসনে, সর্বত্র সমান। কাজেই তরুণরা যদি আজ জ্যেষ্ঠদের শ্রদ্ধার পাত্র বলে মনে না করে, এবং শহরের স্ট্রিটকর্নার থেকে তীব্র বিদ্রুপাত্মক শিসের শব্দ শোনা যায়, তাহলে চমকে ওঠার কিছু নেই।
স্ট্রিটকর্নারের তরুণরা ‘ভায়োলেন্ট’ বলেও চমকে ওঠার কিছু নেই। বর্তমানকালের বুর্জোয়া—ডেমোক্রাটিক রাষ্ট্রশাসনের ভিত্তি হল ‘ভায়োলেন্স’। সমাজের অস্থিপঞ্জরে ‘ভায়োলেন্স’। বহুনিনাদিত, যুগে যুগে বহু মানব—অবতার ঘোষিত বড় বড় আদর্শের কী পরিণতি? শিশুর খাদ্যে বিষ, কারণ মুনাফা চাই—দেশাত্মবোধ ও শান্তিতে বিষ, কারণ আণবিক অস্ত্রনির্মাণে মুনাফা চাই, অথবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা চাই। সভ্যতার পরিণতি ‘ভিয়েতনাম’, আণবিক মারণাস্ত্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিণতি শ্মশানযাত্রী বিশ্বমানবের মুখে ‘রামনাম’। মুণ্ডিতমস্তক বিদেশিদের মুখেও চৌরঙ্গিতে ‘হরেকৃষ্ণ হরেনাম’। ‘ভায়োলেন্স’ প্রকৃতির আলো—বাতাসে, মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসে। তরুণদের—এবং স্ট্রিটকর্নার—তরুণদের—হাতবোমা ও ক্র্যাকার, বোতল ও পাইপগান—তার কাছে নিতান্ত ছেলেখেলা বা পুতুলখেলা ছাড়া কিছু নয়। কারণ ‘ভায়োলেন্স’—এর ভয়ানক অস্ত্রশস্ত্র শাসক জ্যেষ্ঠদের করায়ত্ত—তা—ই দিয়ে তাঁদের প্রয়োজনে তাঁরা স্ট্রিট সেন্টার থেকে স্ট্রিটকর্নার পর্যন্ত একনিমেষেই নির্মূল করতে পারেন। তরুণরা তা পারে না, ফ্রান্সের তরুণরাও তা পারেনি। কলকাতার স্ট্রিটকর্নারের তরুণরাও তা জানে। তারা জানে তাদের মতো স্ট্রিটকর্নারের তরুণদের ক্র্যাকারের প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ জ্যেষ্ঠদের কামান—বোমারু বিমানের কাছে আপাতদৃষ্টিতে হাস্যকর মনে হবে। তবু প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ তারা করবে—ধনতান্ত্রিক, যান্ত্রিক ও ভায়োলেন্ট সমাজের বিরুদ্ধে, শ্মশানের মতো ভয়াবহ ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে, দানবের চেয়েও ভয়ংকর হিংস্র মানুষের বিরুদ্ধে, পিতৃমাতৃহীন পরিবারের বিরুদ্ধে, আদর্শ ও নীতির নামে স্তূপীকৃত ভণ্ডামি ও মিথ্যার বিরুদ্ধে।
১৯৬৮
……
* William Foote Whyte : Street Corner Society, Chicago, Seventh Impression, 1964