কলকাতার সিনেমা
যদিও বোম্বাইয়ের ওয়াটসন হোটেলে ৭ জুলাই ১৮৯৬ তারিখে প্রথম চলচ্চিত্র দেখানো হয়েছিল বলা হয়, তা হলেও কলকাতায় প্রথম চলচ্চিত্র দেখানো হয় ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দে স্টার থিয়েটারে। ওই সময় প্রথম বাঙালী চলচ্চিত্র প্রদর্শক—আইনজীবী চন্দ্ৰমোহন সেনের পুত্র—হীরালাল সেন ও তাঁর ভাই মতিলাল সেন গঠিত করেন ‘রয়েল বায়োস্কোপ কোম্পানী’। স্টিফেনসন নামে এক সাহেবের কাছ থেকে তাঁরা যথেষ্ট উৎসাহ পেয়েছিলেন।
১৯০০ খ্রীষ্টাব্দে বিলাতের প্যাথে কোম্পানী কলকাতায় একজন মুভি ক্যামেরাম্যান পাঠান। বাঙলা থিয়েটারে অভিনীত কয়েকটি নাটকের নির্বাচিত অংশের ছবি তুলে দর্শকদের দেখানে হয়। হীরালাল সেন ছোট ছোট কুড়িটি ছবি তোলেন। এগুলি স্টার থিয়েটারে দেখানো হয়। ডি.জি.ফালকের তোলা ‘রাজা হরিশচন্দ্র’ ছবিও অ্যালফ্রেড রঙ্গ মঞ্চে দেখানো হয়।
১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দে হীরালাল সেনের মৃত্যুর পর ম্যাডান কোম্পানির অভ্যুত্থান ঘটে। জে. এফ. ম্যাডান ‘কোরিনথিয়ান থিয়েটার’-এর মালিক ছিলেন। তিনি প্রথমে গড়ের মাঠে তাঁবু খাটিয়ে সেখানে চিত্র প্রদর্শন করতেন। পরে ১৩৮ নং কর্নওয়ালিশ স্ট্রীটের মাঠটা আগাসী সাকার্স (এরাই ওই নোংরা মাঠটা পরিষ্কার করেছিলেন) ছেড়ে দিলে ম্যাডান কোম্পানি ওখানেই একটা তাঁবু ফেলে ‘এলফিনস্টোন বায়োস্কোপ’ নাম দিয়ে চিত্র প্রদর্শন করতে থাকে। তাঁবুটা আগুন লেগে পুড়ে যাবার পর ওখানে ‘কর্নওয়ালিশ থিয়েটার’ নির্মিত হয় ও ‘ক্রাউন সিনেমা’ নাম দিয়ে ওখানে ছবি দেখানো হয়
এদিকে জ্যোতিষ সরকারের সহায়তায় ‘রাজা হরিশচন্দ্র’, ‘মহাভারত,’ ‘নল দময়ন্তী,’ ‘ধ্রুবচরিত্র’, প্রভৃতি হিন্দি চিত্র নির্মাণ করা হয়। পৌরাণিক এই সব চিত্র মেয়েদের আকৃষ্ট করে। বাংলায় সর্বপ্রথম নির্বাক ছবি ‘বিল্বমঙ্গল’ ১৯২৯ খ্রীষ্টাব্দের ৮ নভেম্বর তারিখে কর্নওয়ালিশ থিয়েটারে মুক্তিলাভ করে। এরপর ম্যাডান কোম্পানি প্রায় শতাধিক নির্বাক ও সবাক ছবি তুলেছিলেন। ম্যাডান কোম্পানির নির্বাক ছবি ‘শিবরাত্রি’-তেই সৰ্বপ্ৰথম বাংলা টাইটেল লেখা হয়েছিল।
ম্যাডান কোম্পানি যখন কর্নওয়ালিশ থিয়েটারে ছবি দেখাচ্ছিল, তখন মেছুয়াবাজার স্ট্রীটে ‘সিটি থিয়েটার’ (‘বীণা থিয়েটার’)-এ এডি. পলো’র জনপ্রিয় ‘সিরিয়াল’ ছবিগুলো দেখানো হচ্ছিল।
১৯২১ খ্রীষ্টাব্দে ৪৭ নং কাশী মিত্র ঘাট রোডে (এখন এদের অফিস ১২৫ নং লেনিন সরণী) অরোরা সিনেমা কোম্পানি গড়ে ওঠে। দেবী ঘোষের সাহায্যে এরা প্রথম পূর্ণাঙ্গ নির্বাক ছবি ‘রত্নাকর’ তোলেন। ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দের ১৩ আগস্ট তারিখে ‘রসা থিয়েটার (পূর্ণ থিয়েটার)-এ এটা প্রথম দেখানো হয়। এরপর গড়ে ওঠে অরোরা ফিল্ম করপোরেশন, ব্রিটিশ ডমিনিয়নস্ ফিলম লিমিটেড, ইণ্ডো ব্রিটিশ ফিল্ম কোম্পানি, ইণ্ডিয়ান সিনেমা আর্টস, তাজমহল ফিলম কোম্পানি, ফটো প্লে সিণ্ডিকেট, ইণ্ডিয়ান ফিল্ম প্রডিউসিং কোম্পানি, ইউনিক পিকচারস্, এশিয়াটিক ফিল্মস কোম্পানি, মুভি প্রডিউসিং, বেঙ্গল মুভি অ্যাণ্ড টকি ফিল্ম লিমিটেড, হীরা ফিলমস, অ্যাঙ্গোরা ফিল্মস্ ব্যুরো, রূপম কোম্পানি, প্রভিনসিয়াল ফিল্ম প্রডিউসার, ফিলিমস্ অভ দি ইস্ট, ইস্টার্ন ফিলমস্ সিণ্ডিকেট, ইণ্ডিপেণ্ডেণ্ট প্রডিউসার, ছায়াচিত্র প্রতিষ্ঠান, ন্যাশনাল, পিকচারস্ পিকটোরিয়াল ক্লাব, রাধা ফিলমস্, গ্রাফিক আর্টস্, ইনটারন্যাশনাল ক্র্যাফ্ট্, বড়ুয়া ফিলম ইউনিট, বেঙ্গ ল ইউনাইটেড ফিলম কোম্পানি, ক্যালকাটা ফিলম কোম্পানি, ইউনিভারসেল ফিলম করপোরেশন, সিলেকট্ পিকচার্স করপোরেশন, ইষ্টার্ন ফিলমস্ অ্যালায়েন্স, তরঙ্গিণী ফিলম সিণ্ডিকেট, ব্রিটিশ অ্যাণ্ড ওরিয়েন্টাল কোম্পানি, প্রভৃতি সংস্থা।
আগে এখানে যেসব বিলাতী ছবি দেকানো হত তাতে নগ্নিকার ছবি দেখানো হত। সেটা রোধ করবার জন্য গভর্নমেন্ট বোর্ড অব্ ফিলম সেনসরস্-এর অনুমোদন ছাড়া ছবি দেখানো নিষিদ্ধ করেন। আমার যতটা মনে আছে ‘নেপচুনস্ ডটার’-ই শেষ বই যাতে নগ্নিকার ছবি দেখেছিলাম।
স্বাধীনতা লাভের পূর্বযুগের (১৯১৯-১৯৪৭) পরিচালক, চিত্রশিল্পী, শিল্প-নির্দেশক ও প্রযোজক হিসাবে আমরা যাদের পেয়েছিলাম তাঁদের মধ্যে ছিলেন নিরঞ্জন পাল, ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী, দেবকী বসু, দেবী ঘোষ, নীতিন বসু, জ্যোতিষ সরকার, চার্লস ক্রীড়, জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতি দাস, প্রমথেশ বড়ুয়া প্রমুখদের। ওই যুগের চলচ্চিত্রের অভিনেতাদের মধ্যে ছিলেন দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, তুলসীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ধীরাজ ভট্টাচার্য, রাজীব রায়, ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী, প্রমথেশ বড়ুয়া, তিনকড়ি চক্রবর্তী, জয়নারায়ণ মুখোপাধ্যায়, প্রবোধচন্দ্র বসু, নরেশচন্দ্র মিত্র, অহীন্দ্র চৌধুরী, ফণী বর্মা, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় (বড়), সত্যেন দে, কার্তিক দে প্রমুখ। অভিনেত্রীদের মধ্যে ছিলেন দুর্গারাণী, পেশেনস্ কুপার, মিস লাইট, নীরদাসুন্দরী, দেববালা, রেণুবালা (ছোট), নিভাননী, প্ৰফুল্লবালা, সীতাদেবী, বীণাপানি, প্রেমকুমারী নেহেরু, ডেলেসিয়া ক্লার্ক, মীরাবাঈ, সবিতা দেবী, মিসেস ভাগ’নে, সুশীলাবালা, শিশুবালা, কাননবালা, বেলারাণী, সীতা, শান্তি গুপ্তা, প্রভা, অনিমা দেবী, ভোলা, রেণু, ডলি দত্ত, আয়েষা বাই, কঙ্কাবতী, মৌসুমী, জ্যোৎস্না গুপ্তা, শীলা, চন্দ্রাবতী প্রমুখারা
স্বাধীনতা লাভের পূর্বযুগে কলকাতায় ১৮৪ খানা বাংলা নির্বাক ও স্বপ্ন দৈর্ঘ্য সবাক ও ২৫১ খানা পূর্ণ দৈর্ঘ্য বাংলা সবাক ছবি দেখানো হয়েছিল। শেষের ছবিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অন্নপূর্ণার মন্দির, আলিবাবা, উদয়ের পথে, কর্ণার্জুন, কপালকুণ্ডলা, গৃহদাহ, গোরা, চন্দ্রশেখর, চিরকুমার সভা, চোখের বালি, তটিনীর বিচার, তুলসীদাস, দেনাপাওনা, দেবদাসী, নটীর পূজা, নৌকাডুবি,পথের দাবী, বড়দিদি, বিরাজবৌ, বিষবৃক্ষ, মহানিশা, মানময়ী গার্লস স্কুল, শহর থেকে দূরে, সরলা, সাতনম্বর বাড়ী, মহাপ্রস্থানের পথে ইত্যাদি।
স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরেই বাঙলার চিত্রজগতে এক নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। সেটাকে এক অসাধারণ সঙ্কটও বলা চলে। বাংলা ছবি মার খেতে থাকে হিন্দি ছবির কাছে। হিন্দিতে তখন দিলীপকুমার, রাজ কাপুর, দেব আনন্দ প্রমুখরা ছিলেন নায়ক, আর মধুবালা, বৈজয়ন্তীমালা, নারগিস ও মীনাকুমারীরা ছিলেন নায়িকা। হিন্দি ছবির প্রতিযোগিতায় বাংলা ছবির কোন ‘গ্ল্যামার’ রইল না। সেই সঙ্কটের যুগে ‘মুস্কিল আসান’ রূপে আবির্ভূত হলেন উত্তমকুমার। ছবিতে তিনি ছিলেন এক পরশমণির ছোঁয়াচ। পঞ্চাশের দশকের মাঝখান থেকে প্রতি বছর তিনি এক নাগাড়ে আবির্ভূত হয়েছেন দশবারোখানা ছবির নায়ক হিসাবে। ‘গ্ল্যামার’-সৃষ্টির দিক থেকে তার মত নায়ক বাঙলাদেশে আর কখনও জন্মান নি। মেয়েদের কাছে তিনি ছিলেন তাদের আরাধ্য দেবতা। সব সময়েই তাঁর ছবিতে ‘হাউস ফুল’। ১৯৮০ খ্রীষ্টাব্দের ২৪ জুলাই তারিখে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাঁর ছবির সংখ্যা ২১২, তার মধ্যে ছয়খানা হিন্দি ছবি দিনকতক (১৯৫৩) স্টার থিয়েটারে তিনি অভিনয়ও করেছিলেন ‘শ্যামলী’ নাটকে। ১৯৫৫-তেও আবার করেছিলেন।
উত্তমের বইয়ের নায়িকাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—ছবি রায়, মনীষা দেবী, করবী গুপ্তা, ভারতী দেবী, সুনন্দা দেবী, সন্ধ্যারাণী, গীত দেবী, সুচিত্রা সেন, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, মঞ্জু দে, অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়, কাবেরী বসু, সবিতা চট্টোপাধ্যায়,অনুভা গুপ্তা, অনীতা গুহ, মালা সিনহা, সুমিত্রা দেবী, সুপ্রিয়া চৌধুরী, সুমিতা সান্যাল, বাসবী নন্দী, সুনীতা, নন্দিতা বসু, শর্মিলা ঠাকুর, তনুজা সমর্থ, ললিতা চট্টোপাধ্যায়, সুলতা চৌধুরী, রীণা ঘোষ, অঞ্জনা ভৌমিক, বৈজয়ন্তীমালা, অপর্ণা সেন, সুপর্ণা সেন, সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়, আরতি ভট্টাচার্য, মিঠু মুখার্জী, গায়ত্রী মুখোপাধ্যায়, বিদ্যা সিন্হা, সুলক্ষণা পণ্ডিত ইত্যাদি।
উত্তমের যে সব বই ‘হিট’ করেছিল, তার মধ্যে ছিল ‘বসু পরিবার’ (১৯৫২, সুপ্রিয়ার সঙ্গে প্রথম অভিনয়), ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ (১৯৫৩, সুমিত্রার সঙ্গে প্রথম অভিনয়), ‘অগ্নি পরীক্ষা’ (১৯৫৪), ‘সবার উপরে’ ((১৯৫৫), ‘সাগরিকা’ (১৯৫৬), ‘সাহেব বিবি গোলাম’ (১৯৫৬), “শিল্পী’ (১৯৫৬), ‘তাসের ঘর’ (১৯৫৭), ‘হারানো সুর’ (১৯৫৭) ‘জীবন তৃষ্ণা’ (১৯৫৭), ‘রাজলক্ষ্মী’ (১৯৫৮), — কান্ত’ (১৯৫৮), ‘সোনার হরিণ’ (১৯৫৯), মরুতীর্থ হিংলাজ’ (১৯৫৯), ‘সপ্তপদী’ (১৯৬১), ‘এন্টনী ফিরিঙ্গি’ (১৯৬৭) ‘নিশিপদ্ম’ (১৯৭০), ‘এখানে পিঞ্জর’(১৯৭১), ‘বনপলাশীর পদাবলী’ (১৯৭০), ‘অগ্নিশ্বর’ (১৯৭৫), ‘ভোলা ময়রা’ (১৯৭৭), ‘দেবদাস’ (১৯৭৯), ‘দুই পৃথিবী’ (১৯৮০), ‘ওগো বধূ সুন্দরী’।
উত্তমের ছবির পরিচালক ছিলেন নব্যেন্দু ব্যানার্জি, দিগম্বর চট্টোপাধ্যায়, রাজেন চৌধুরী, *অগ্রদূত, পশুপতি চট্টোপাধ্যায়, *সুকুমার দাশগুপ্ত, কালীপ্রসাদ ঘোষ, নির্মল দে, নীরেন লাহিড়ী, সুবোধ মিত্র, *পরেশ মিত্র, ভোলানাথ মিত্র, *চিত্ত বসু, *সুশীল মজুমদার, সেতীশ দাশগুপ্ত, সুধাংশু মুখোপাধ্যায়, সুবোধ মিত্র, হরিদাস ভট্টাচার্য, * সুধীর মুখোপাধ্যায়, * মানু সেন, অর্ধেন্দু সেন, *তপন সিংহ, *মৃণাল সেন, কমল গঙ্গোপাধ্যায়, *অগ্রগামী, * কার্তিক চট্টোপাধ্যায়, চিত্তরঞ্জন মিত্র, *দেবকী বসু, *অজয় কর, সন্তোষ গঙ্গোপাধ্যায়, * মঙ্গল চক্রবর্তী, * সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, অসিত সেন, হেমচন্দ্র চন্দ্র, *বিশু দাশগুপ্ত, *জীবন গঙ্গোপাধ্যায়, * প্রফুল্ল চক্রবর্তী, বিশু চক্রবর্তী, দিলীপ নাগ, * পীযূষ বসু, সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায়, বিনু বর্ধন * হীরেন নাগ, *উত্তমকুমার (নিজে) *সত্যজিৎ রায়, শচীন মুখোপাধ্যায়, আলো সরকার, সুবোধ মিত্র, অজিত লাহিড়ী, * পিনাকী মুখোপাধ্যায়, হরিসাদন দাশগুপ্ত, সলিল সেন, * অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, এস. মল্লিক, * বিজয় বসু, অজিত গঙ্গোপাধ্যায়, শচীন অধিকারী, * শক্তি সামন্ত, পার্থপ্রতিম চৌধুরী, * সুশীল মুখোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, পীযূষ গাঙ্গুলী, * দিলীপ রায়, সুখেন দাস, পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনেন গুপ্ত, জয়ন্ত বসু, সৃজন, ইন্দর সেন, গৌর চৌধুরী, শান্তিময় বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, মৃণাল চক্রবর্তী, গুলজার, সুলক্ষণা পণ্ডিত। শেষের দুজন উত্তম-অভিনীত হিন্দী ছবির পরিচালক। আর তারকাচিহ্নিত ব্যক্তিগণ একাধিক ছবির পরিচালক।
এ যুগের অন্যান্য খ্যাতিমান অভিনেতা হচ্ছেন উৎপল দত্ত, বিকাশ রায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, চিন্ময় রায়, অনুপকুমার, দীপঙ্কর দে, সন্তু মুখার্জি, তাপস পাল। আর অভিনেত্রীদের মধ্যে সাবিত্রী, সন্ধ্যা, মৌসুমী, জয়া, অপর্ণা, মহুয়া, দেব, সুমিত্ৰা।
কলকাতা এখন ছবি পাগল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার প্রমাণ অসংখ্য ছবি-ঘর ও দর্শকের প্রচণ্ড ভীড়। আগেই বলেছি কলকাতায় প্রথম ছবিঘর তৈরী করে ম্যাডান কোম্পানি তারপর কালীপ্রসন্ন সিংহের পোষ্যপুত্র বিজয় সিংহের সহায়তায় কলকাতায় আরও দুটো প্রেক্ষাগৃহ, করপোরেশন স্ট্রীট ও চিৎপুর রোডে গড়ে ওঠে। ইতিমধ্যে মেছুয়াবাজারের বীণা থিয়েটার ‘সিটি থিয়েটার’ নাম নিয়ে সিনেমা দেখাতে শুরু করে। কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীটে ম্যাডান কোম্পানি সিনেমা হাউস তৈরী করবার পর, ওর কাছাকাছি জায়গায় (৮৩, বিধান সরণী) প্রখ্যাত আইনবিদ নৃপেন্দ্রনাথ সরকারের পুত্র বীরেন সরকার মশায় ‘চিত্রা” নামে একটা প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ করেন। ফড়িয়াপুকুর স্ট্রীট, সারকুলার রোডের সংযোগস্থলের কাছে ‘শো হাউস’ (১৩ এ শিবদাস ভাদুড়ী স্ট্রীট) নামে একটা সিনেমা-ঘর তৈরী হয়। তারপর বিধান সরণীটা (কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট) সিনেমা পাড়ায় পরিণত হয়। কীর্তি মিত্রের বাড়ীর জমিতে এবং ‘চিত্রা’র কাছে ‘দর্পণা’ সিনেমা (৮৪ বিধান সরণী) তৈরী হয়। তারপর একে একে গড়ে ওঠে ‘উত্তরা’ (১৩৮/১, বিধান সরণী), (১৩৮ বিধান সরণী), ‘মিনার’(১২৬/২ বিধান সরণী), ‘রাধা’ (১৪০, বিধান সরণী), ‘রূপবাণী’ (নামকরণ রবীন্দ্রনাথ করে দিয়েছিলেন, ৭৬/১ বিধান সরণী) ও ‘বীণা’ (২১৯ বিধান সরণী)। এখন কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় সিনেমা হাউস। কলকাতায় এখন মোট ১০৫টা সিনেমা হাউস আছে।
এবার ছবি তোলার কথা বলে এ প্রসঙ্গ শেষ করব। ছবি তোলার জন্য মানিকতলায় অরোরা সিনেমাার ষ্টুডিওই সবচেয়ে প্রাচীন। তারপর কলকাতায় আরও তেরটা ষ্টুডিও হয়েছিল। তাদের মধ্যে নয়টা টালিগঞ্জে, দু’টা ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডে (সিঁথি মোড়ের কাছে), একটা ঝাউতলায় ও আর একটা দক্ষিণেশ্বরে অবস্থিত ছিল। টালিগঞ্জের ষ্টুডিওগুলির নাম ছিল ইন্দ্রপুরী ষ্টুডিও, রাধা ফিলম্ ষ্টুডিও, ইষ্ট ইণ্ডিয়া ফিলম্ ষ্টুডিও, ভারতলক্ষ্মী ষ্টুডিও, কালী ফিলম ষ্টুডিও ও নিউ থিয়েটারের নম্বর ওয়ান ও নম্বর টু ষ্টুডিও। ঝাউতলার ষ্টুডিওটার নাম ছিল রূপ ষ্টুডিও। বি. টি. রোডের ষ্টুডিও দু’টার নাম ছিল ন্যাশনাল ফিলম ষ্টুডিও ও বেঙ্গল ফিলম ষ্টুডিও। আর দক্ষিণেশ্বরের ষ্টুডিওটার নাম ছিল ইষ্টার্ন টকীজ। এখন কলকাতায় মাত্র ছয়টা ষ্টুডিও আছে। তাদের মধ্যে ইন্দ্রপুরী ষ্টুডিও, নিউ থিয়েটার নম্বর ওয়ান ও নিউ থিয়েটার নম্বর টু ষ্টুডিও, টেকনিসিয়ানস ষ্টুডিও ও ক্যালকাটা মুভিটোন টালিগঞ্জে অবস্থিত। অরোরা ফিলম ষ্টুডিও মানিকতলায় অবস্থিত। আর এ কয়টা ছাড়া টালিগঞ্জে দূরদর্শন কেন্দ্রের কাছে রাধা ফিলম ষ্টুডিও নামেও একটা সংস্থা আছে।
ইদানীং এদেশে তোলা ছবি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। বিশেষ করে বিমল রায়ের ‘দেবদাস’ ও ‘দুই বিঘা জমি’ ও সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালি’, ‘অপরাজিত, ‘ ‘অপুর সংসার’, ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’ ইত্যাদি।
স্বাধীনতার আগে ও অব্যবহিত পরে কোন নাটক মঞ্চস্থ করতে হলে তার পাণ্ডুলিপি লালবাজারে পুলিশ অফিসারদের কাছে জমা দিতে হত। ১৯৭৩ খ্রীষ্টাব্দ থেকে আর অনুমতি নেওয়ার দরকার হয় না। তবে সাম্প্রদায়িক বা সশস্ত্র বিপ্লবের কোন ইঙ্গিত থাকলে পুলিশ সে ক্ষেত্রে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে।