কলকাতার সায়েব সমাজ

কলকাতার সায়েব সমাজ

গায়ের রং গোরা, চোখের তারা নীল, চুলগুলো বেশির ভাগ সোনালি, শরীরের গড়ন প্রায় একই রকম। এসব দেখে কলকাতার সায়েব সমাজকে এদেশের মানুষ সম্ভবত সমশ্রেণিভুক্ত বলে মনে করত। হয়তো ভাবত, সায়েবদের মধ্যে কোনও শ্রেণিভেদ নেই। গোটা সমাজটা এক শিলায় তৈরি। কিন্তু আসলে তা নয়। ভারতে অন্যত্র বা কলকাতায় ইংরেজ সমাজ কখনওই শ্রেণিহীন ছিল না। প্রথম থেকেই কলকাতার মতো ছোট ইংরেজ বসতিতে তারা কয়েকটা শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। সময় যত গড়িয়ে যেতে থাকে তাদের প্রত্যেকের সংজ্ঞাও বদলে যায়। শ্রেণিগত পার্থক্যের প্রকৃতি পালটে গেলেও পার্থক্যটা থেকে যায়। শ্রেণিক্রম হয়েছিল পদের ভিত্তিতে, পেশার ভিত্তিতে ততটা নয়। সরকারি চাকরি ও ব্যাবসা-বাণিজ্যের মধ্যে ভেদাভেদ ছিল যেমন প্রকট, তেমনি ব্যাবসার মধ্যেও ছিল উঁচু-নিচুর ব্যাপার। পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরো বিক্রেতা এক শ্রেণির মধ্যে পড়ত না, যদিও কর্ণওয়ালিশের আমল পর্যন্ত এই শ্রেণিপার্থক্য তেমন নজরে পড়ে না। কারণ, সে সময় কোম্পানির সমস্ত আধিকারিকই ছিল বণিক।

এদেশে ইংরেজদের মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে দুটো শ্রেণি ছিল, এলিট ও খেটে-খাওয়া মানুষ। এই দুই শ্রেণির মধ্যে অন্য শ্রেণিও উঁকি মারত। এলিটদের মধ্যেও স্তর ছিল। ভারতে কোম্পানির অধিকৃত এলাকা যতই বিস্তৃত হচ্ছিল, কর্মচারীর প্রয়োজনও হচ্ছিল বেশি সংখ্যায়, সামরিক-অসামরিক উভয়ক্ষেত্রেই। বিশেষ করে বৃদ্ধি পাচ্ছিল সেনার সংখ্যা। বিলেতের সমাজের নিচুতলার যুবকরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এই পেশায়, বেশি করে আইরিশ ও স্কটিশরা। স্বভাবতই, ব্রিটিশ ভারতে ইংরেজ সেনারাই ছিল শ্বেতাঙ্গ সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু কোম্পানির সেনার মধ্যে দুটো ভাগ ছিল— রাজকীয় বাহিনী ও কোম্পানির নিজস্ব সেনা। প্রথমটি ছিল আগাগোড়া গোরা সেনাদের নিয়ে, দ্বিতীয়টি গোরা-কালার মিশেল। এই শ্রেণিকরণ ছিল কোম্পানির সেনা-অফিসারদের নানা অভিযোগের উৎস।

কলকাতায় কোম্পানির ক্ষমতা প্রতিষ্ঠায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ইংল্যান্ডের রাজশক্তি। রাজশক্তির প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় কোম্পানির প্রতিনিধিদের উৎসাহিত করেছিল বাংলার রাজনীতিতে মাথা গলিয়ে শক্তি প্রয়োগ করতে। সেজন্য ১৭৫৬ সালে সিরাজের হাতে কলকাতার পতন ঘটলে মাদ্রাজ থেকে ক্লাইভের সঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয় রাজকীয় নৌ-বাহিনীর অ্যাডমিরাল ওয়াটসনকে। তখন থেকেই বাংলা তথা কলকাতায় কোম্পানির সেনা ও রাজকীয় বাহিনীর যুগ্ম অবস্থান। কিন্তু দুই বাহিনীর সম্পর্কে ছিল নানা টানাপোড়েন। পারস্পরিক ঈর্ষা ও অন্তর্কলহ প্রকাশ পেত বিভিন্ন কারণে। উভয় বাহিনীর সেনাদের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেও ছিল যথেষ্ট পার্থক্য। এর পেছনেও কারণ ছিল। কোম্পানির সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে cadet-রা অল্পবয়সে চলে আসত এদেশে। ফলে এদেশের জলহাওয়া, আচার এবং জীবনযাত্রার রকম সকমের সঙ্গে তারা মানিয়ে নিতে পারত সহজেই। রাজকীয় বাহিনীর সেনাদের পক্ষে সেটা সম্ভব হত না এজন্য যে, তারা অনেক বেশি বয়সে এদেশে আসত ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশে, কর্তব্য করতে। তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং আচরণগুলো স্বদেশে থাকতেই পূর্ণতাপ্রাপ্ত হত। অনেকে এদেশে সায়েব সমাজে প্রচলিত রীতিনীতি পর্যন্ত মানতে চাইত না। মানলেও ক্ষোভ চেপে রেখে দিত মনের মধ্যে।

প্রথম থেকেই রাজকীয় বাহিনী ও কোম্পানির সেনাবাহিনীর অফিসারদের মধ্যে সম্পর্ক খুব একটা মধুর ছিল না। স্পষ্ট করে বলতে গেলে, সে সম্পর্ক ছিল আদায়-কাঁচকলায়। ওয়াটসন ও ক্লাইভের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব অনেক ক্ষেত্রেই প্রকাশ পেয়েছিল পলাশি পর্বে। ‘ওয়াটসন ক্লাইভকে মনে করতেন সেনাপতির পোশাকপরা ফন্দিবাজ সিভিলিয়ন, আর ক্লাইভ মনে করতেন ওয়াটসন একজন অপদার্থ কূটনীতিক।’ রাজকীয় বাহিনী বেশির ভাগ সময় কোম্পানির সেনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকত। তাদের অবস্থান ও পরিবেশ ছিল স্বতন্ত্র। তারা পৃথক সমাজ গড়ে তুলেছিল, যার সঙ্গে কোম্পানির সেনার কোনও সম্পর্ক ছিল না। তা ছাড়া, দুই বাহিনীর সেনাদের সুযোগ-সুবিধের মধ্যে ছিল বিশাল ব্যবধান। আর সেটাই ছিল কোম্পানির সেনা-অফিসারদের ক্ষোভ ও অসন্তুষ্টির বড় কারণ।

১৮১১ সালের ২ মার্চ লন্ডনে মাদ্রাজ আর্মির জনৈক অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপটেন The Asiatic Journal-এ একটা চিঠি লিখে রাজকীয় ও কোম্পানির বাহিনীর সেনাদের সুযোগ-সুবিধের মধ্যে বৈষম্যকে তুলে ধরেন। তিনি অভিযোগ করেন, কোম্পানি ও রাজকীয় বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সেনাদের অর্ধ-বেতনের পরিমাণের মধ্যে যথেষ্ট ফারাক। তাঁর বক্তব্য, বরং কোম্পানির সেনার অবসরকালীন ভাতার পরিমাণ বেশি হওয়া উচিত কারণ, অবসর গ্রহণের পর সে রাজকীয় সেনার মতো আবার কাজে ফিরে আসার সুযোগ পায় না। কোম্পানির কোনও সেনা অফিসার যদি স্বাস্থ্যের কারণে বাইশ বছর সম্পূর্ণ করার আগেই স্বদেশে চলে আসে, তাকে অর্ধবেতন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। ডাক্তার পরে তার সুস্থতার শংসাপত্র দিলেও ভারতে এসে পুনর্বহাল হতে পারে না।

রাজকীয় ও কোম্পানির সেনাদের মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষের একটা বড় কারণ ছিল, কোম্পানির ভারতীয় বাহিনীর প্রধান সেনাপতিসহ উঁচুপদে নিযুক্ত হত রাজকীয় বাহিনীর অফিসাররা। এজন্য দুই বাহিনীর মধ্যে কোম্পানির সমস্ত শাসনকাল জুড়ে দিল বৈরিতা ও অসূয়া। কখনও কোনও ডিনার পার্টিতে দুই বাহিনীর অফিসাররা উপস্থিত থাকলে তারা পরস্পরবিরোধী স্বার্থের প্রসঙ্গ নিয়ে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়ত। কোম্পানির সেনা অফিসারদের মধ্যে কেউ হয়তো এমন মন্তব্য করে বসত যে, কোম্পানির অভিজ্ঞ সেনা অফিসারের মাথার ওপর রাজকীয় বাহিনীর একেবারে ছোকরা অফিসারকে বসিয়ে দেওয়া রীতিমতো অবিচার ও অবিবেচনার কাজ। উভয়ের মধ্যে বিতর্ক ও বাদানুবাদ অনেক সময় চলে যেত অনাকাঙ্ক্ষিত অপ্রীতিকর ঘটনার দিকে। কেউ কেউ উত্তেজিত হয়ে বাক্‌যুদ্ধকে মুষ্টিযুদ্ধে পরিণত করত ডিনার পার্টিতেই। এমনই ঘটনা ঘটেছিল কর্নেল রে-এর (Col. Wray) দেওয়া এক ডিনার পার্টিতে।১০

কোম্পানির গোরা সেনারা ভারতীয় সিপাইদের সঙ্গে মেলামেশা করতে দ্বিধা না করলেও রাজকীয় বাহিনীর মধ্যে এ ব্যাপারে যথেষ্ট রক্ষণশীলতা ছিল। এমনকী, উভয় সেনা অফিসারদের পত্নীদেরও স্পর্শ করেছিল এই অবাঞ্ছনীয় ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। শ্রীমতী শেরউড এবং শ্রীমতী ফেনটন ছিলেন রাজকীয় বাহিনীর অফিসারদের সহধর্মিণী। তাঁরা তাঁদের স্বামীদের সংকীর্ণ মানসিকতার প্রভাবের বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। স্বামীদের মতো তাঁরাও নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলেন ভারতীয়দের থেকে। অথচ শ্রীমতী এলউড (Mrs. Elwood) শ্রীমতী পোসটানস (Mrs. Postans) কোম্পানির সেনা অফিসারের পত্নী হওয়া সত্ত্বেও মানুষের সঙ্গে মেলামেশার ব্যাপারে কোনও বাছবিচার করেননি। নেটিভ সোসাইটির সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।১১ শ্রীমতী শেরউড এবং শ্রীমতী ফেনটন রাজকীয় বাহিনীর অফিসার-পত্নী হওয়ার দেমাকে নিজেদের চারপাশে তুলে দিয়েছিলেন এক অদৃশ্য দেয়াল।

একটা বৈষম্যমূলক নিয়ম উভয় বাহিনীর সম্পর্ককে তিক্ত করে তুলেছিল। রাজকীয় বাহিনীর অফিসাররা এদেশে আসার অব্যবহিত পরই ছুটি পেত স্বদেশে যাওয়ার জন্য। ছুটিতে থাকাকালীন পুরো বেতন পেত। অনুমতি নিয়ে যতবার খুশি যেতে পারত স্বদেশে, সেজন্য তার চাকরি জীবনে কোনও ছেদ বা পদোন্নতিতে কোনও অসুবিধে দেখা দিত না। কিন্তু কোম্পানির সেনা অফিসাররা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল। এদেশে কোম্পানির বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর দশ বছরের আগে ছুটি পেত না। দশ বছর পরে তিন বছরের জন্য ছুটি পেলেও, বিলেতে যাওয়া-আসা সমেত দিনগুলো বাদ যেত চাকরির কাল থেকে। চাকরিতে নিযুক্ত হওয়ার পর দশ বছর না হতেই যদি কেউ স্বদেশে যেত, তার পুরো বেতনটাই কেটে নেওয়া হত। সেজন্য কোম্পানির কোনও সেনা স্বদেশে ছেড়ে আসা পরিবারে হঠাৎ কোনও বিপর্যয় না ঘটলে ফিরে যাওয়ার ঝুঁকি নিত না। চূড়ান্ত অবসর নেওয়ার আগে বাইশটা বছর তাকে কাটাতে হত এদেশের বাসিন্দা হিসেবে।১২

অনেক সময় ভারতে কোম্পানির বাহিনীতে অফিসার পদে রাজকীয় বাহিনীর লোক নিযুক্ত হত লন্ডন থেকে। এইসব অফিসাররা রাজকীয় বাহিনীর পরিচিত অন্যান্যদেরও উৎসাহ দিত ভারতে আসার জন্য। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হত ভারতে থাকা কোম্পানির অফিসাররা, কারণ, রাজকীয় বাহিনীর অফিসাররা কোম্পানির বাহিনীতে নিযুক্ত হয়ে তাদের পদোন্নতির পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়াত।১৩ মহাবিদ্রোহের পর দুটি বাহিনী মিশে গেলে এই সমস্যার অবসান ঘটে।

আঠারো শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত কলকাতার সায়েবদের অর্থোপার্জনের লোভনীয় পথ ছিল ব্যাবসা-বাণিজ্য। কোম্পানির পদস্থ কর্মচারীরাও লিপ্ত ছিল নানান ব্যাবসা-বাণিজ্যে। সে সময় বিত্ত ছিল কলকাতার সায়েব সমাজে স্বীকৃতিলাভের মাপকাঠি। সমস্ত মার্চেন্টকে সমাজ একইভাবে দেখত। সময় এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার সায়েব সমাজের এই দৃষ্টিভঙ্গি পালটে যায়। সমাজের নিচুস্তরে জন্ম গ্রহণ করে বিত্তের বিভূতিতে উঁচুস্তরে স্থান করে নিতে পারত না। বিলেত থেকে কেউ কলকাতায় এসে ব্যবসায় চূড়ান্ত আর্থিক সাফল্য পেলেও সমাজের উঁচুস্তরের সঙ্গে মেলামেশার যোগ্যতার মাপকাঠিতে সে অযোগ্য বলে বাতিল হয়ে যেত।১৪ যারা জন্মসূত্রে ব্রিটিশ সমাজের উঁচুস্তর থেকে আসত তারাই কেবল কলকাতায় আসার পর সায়েব সমাজের উঁচু মহলে প্রবেশের অধিকার পেত।

শ্রেণিবিদ্বেষ ছিল সেনা ও সিভিলিয়নদের মধ্যেও। সেনারা মনে করত, তারা তাদের তরবারির দ্বারা যা জয় করেছে, সিভিলিয়নরা তা নষ্ট করেছে। আর সিভিলিয়নদের ধারণা ছিল, তাদের শ্রমসাধ্য কূটনীতির জটিল জাল ছিঁড়ে ফেলবে সেনাদের নিতান্ত নির্বোধ হাত। সামাজিক দিক থেকে উভয়েই প্রায় সমপর্যায়ের ছিল বলে ঈর্ষা ও রেষারেষি ছিল প্রবল।১৫

আঠারো শতকে কোম্পানির আমলে সায়েব সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অস্তিত্ব খুব স্পষ্ট নয়। স্পিয়ার অবশ্য মনে করেন, উকিল, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাদ্রিরা মিলে একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি করেছিল। তবে এই শ্রেণির চেহারাটা এত ছোটখাটো ছিল যে, স্বতন্ত্র কোনও বৈশিষ্ট্য বা আচরণ নজরে পড়ে না। তাদের রুচি, দৃষ্টিভঙ্গি, হালচাল ছিল একেবারে সরকারি আধিকারিকদের প্রতিচ্ছবি। একমাত্র উকিলরা মধ্যবিত্তশ্রেণির মধ্যে পড়ত কারণ, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়াররা ছিল বেশির ভাগ সামরিক বিভাগের পদস্থ কর্মচারী।১৬ সিভিলিয়নরা নিজেদের ইঙ্গ-ভারতীয় সমাজের অভিজাত হিসেবে জাহির করলেও, শাসকশ্রেণির প্রভাব-প্রতিপত্তি এমন একটা উচ্চতায় পৌঁছেছিল যে, প্রায় গোটা সরকারি কর্মচারী শ্রেণি একটা খানদানি আদব-কায়দায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।১৭ তারাও গ্রহণ করে সিভিলিয়নদের মতো ঠাটবাট। সামাজিক অবস্থানের যে মাপকাঠি এতদিন ছিল, তা বাতিল হয়ে যায়। পরিবর্তে আসে পদ-কৌলীন্যের মাপকাঠি। তাই শাসক হিসেবে সিভিলিয়নরা শ্রেণি কাঠামোর সর্বোচ্চ স্তরে স্থান পায়।১৮ ক্ষমতা ও বিত্তের বৈভবে প্রভাবিত হয়ে তারা ঘৃণা করতে শুরু করে স্বদেশের গরিব মানুষকে। এই মানুষগুলোর অভ্যাস, মদের নেশা, ধার-দেনা, বিয়ে, নিকৃষ্ট ঘর-বাড়ি, জীবনযাত্রা সবকিছু তাদের কাছে চক্ষুশূল হয়ে ওঠে। গরিব সায়েবরা তাদের বিত্তশালী স্বজাতিদের সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করত তা সহজে জানা না গেলেও, বিপরীতটা স্পষ্ট।১৯

উনিশ শতকে বিলেত থেকে কলকাতায় যারা নবাগত ছিল, তাদের বলা হত গ্রিফিন (Griffin)। তারা কলকাতার শ্বেতাঙ্গ সমাজের কোন শ্রেণিভুক্ত হবে, তা স্থির করা হত তাদের রক্তের সম্পর্ক নিয়ে খোঁজ-খবর করার পর। যাদের পরিচয়ে উচ্চ বংশের সন্ধান মিলত না, তারা বড়ো নাচার হয়ে পড়ত শহরের শ্বেতাঙ্গদের সক্রিয় সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে। বিশেষ করে, যারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে সৌভাগ্যের খোঁজে কলকাতায় আসত, অথচ শহরের কোনও হোমরা চোমরা সায়েবের নামে কোনও পরিচয়পত্র থাকত না, তারা পড়ত অকূলে।

লর্ড বেন্টিঙ্কের আগে পর্যন্ত গভর্নমেন্ট হাউসের দরজা খোলা থাকত কেবলমাত্র সিভিলিয়ন ও সামরিক এলিট এবং সিনিয়র মার্চেন্টদের কাছে। এরা ছিল সমাজের প্রথম শ্রেণি। এই কারণে দ্বিতীয় শ্রেণির শ্বেতাঙ্গরা তাদের সামাজিক ক্রিয়াকাণ্ড বজায় রাখার জন্য উনিশ শতকে দ্বিতীয় দশকে গড়ে তোলে টাউন হল। শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির মধ্যে বিভাজন নয়, বৈষম্য তৈরি হয়েছিল দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির মধ্যেও, যারা ছিল মূলত ছোট ব্যবসায়ী বা দোকানদার। ভাবতে অবাক লাগে যে, আপাতদৃষ্টিতে বর্ণ ও জাতিপ্রথামুক্ত সায়েব সমাজে হিন্দুদের বর্ণপ্রথার প্রভাব পড়েছিল, যার ফলে তাদের পান-ভোজনের ক্ষেত্রে অনুকরণ করা হত ব্রাহ্মণ-শূদ্রের আচরণ। পার্সিভ্যাল স্পিয়ার মনে করেন, …the society was already sundered by gulfs deep enough to make it a very fair imitation of the Hindu caste system.২০ কারোর বাড়িতে কোনও অনুষ্ঠানে ছোট ব্যবসায়ীদের আমন্ত্রণ জানানো হলে সেটা গোপন রাখা হত উঁচু, সম্ভ্রান্ত অতিথিদের কাছে। এমনকী, পাদ্রি সায়েব তৃতীয় শ্রেণির কোনও ব্যক্তিকে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানালে দ্বিতীয় শ্রেণির সায়েবরা ভ্রু কোঁচকাত। অথচ খ্রিস্ট ধর্মের প্রেম ও মানবতার আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না এই আচরণ।

কলকাতার সায়েব সমাজে শ্রেণি বৈষম্য কী পর্যায়ে পৌঁছেছিল তার দৃষ্টান্ত হিসেবে একটা ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। একবার একজন প্রতিষ্ঠিত দোকানদার তাঁর বিয়েতে আমন্ত্রণ করেছিলেন সব শ্রেণির সায়েবকে। কিন্তু গোপন রেখেছিলেন কথাটা। তবে প্রত্যেক শ্রেণির জন্য তিনি পৃথক ঘরে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন। শেষরক্ষা করতে পারেননি। ব্যাপারটা প্রকাশ্যে চলে এলে অনেক অতিথি যথেষ্ট অপমানিত বোধ করে অসন্তুষ্ট হন।২১

সায়েব সমাজের বৈষম্যের বিষবাষ্প ঢুকে পড়ে তাদের অন্দরমহলেও। মেমসায়েবরা বরং আরও বেশি করে প্রভাবিত হয়। তারা গৃহকর্ত্রীরূপে সিভিলিয়ানদের মধ্যে বিশেষ গোষ্ঠী বিকাশে উৎসাহ দিত।২২ লে. আর জি ওয়ালেস (Lt. R. G. Wallace) উনিশ শতকের বিশের দশকে কলকাতায় এসে লিখেছিলেন, সিভিলিয়নের বউ মনে করত, আর্মি অফিসারের বউ-এর থেকে সে উঁচু স্তরের মহিলা। এমনকী, পার্টিতে কোনও উঁচু মহলের মহিলাকে নিচুস্তরের অফিসার হাত ধরে অভিবাদন জানালে সেটা মনে করা হত, চরম অভদ্রতা এবং দোষের ব্যাপারে, বলনাচে সঙ্গী হওয়া তো দূরের কথা।২৩ উঁচু স্তরের দেমাকি শ্বেতাঙ্গিনীদের এই শ্রেষ্ঠত্ববোধ সায়েব সমাজের শ্রেণি পার্থক্য ও বৈষম্যকে আরও প্রকট ও অপ্রীতিকর করে তুলত। কর্মক্ষেত্রে সায়েবরা কখনও কখনও এই শ্রেণি পার্থক্যকে আমল না দিয়ে অন্য শ্রেণির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলেও, উঁচু শ্রেণির মেমসায়েবরা নিচু তলার অফিসার-পত্নীদের এ়ড়িয়ে চলত কঠোরভাবে।২৪ শ্বেতাঙ্গ সমাজের সামাজিক বৈষম্য আড়ালে নয় একেবারে প্রকাশ্যে, রাজপথে চোখে পড়ত। সন্ধেবেলায় চৌরঙ্গি এলাকায় সায়েব-মেমরা বেড়াতে আসত হাওয়া খেতে। সেখানে নিচুশ্রেণির ইউরোপীয় দোকানদারদের দেখে তারা ভ্রু কোঁচকাত। ১৮৫৮ সালে W. H. Russel কলকাতায় বেড়াতে এসে এই ব্যাপারটা লক্ষ করে তাঁর মনে হয়েছিল সন্ধেবেলায় চৌরঙ্গি এলাকায় দোকানদারদের বেড়াতে আসা শ্বেতাঙ্গ এলিটদের বিবেচনায় খুবই বেমানান।২৫

কলকাতার সায়েব সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করেছিল খোদ সরকারি প্রশাসন। অপরাধ তো শুধুমাত্র গরিব সায়েবরাই করত না, বিত্তবান সম্ভ্রান্তরাও অনেকে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ত। Jacquemont লর্ড বেন্টিঙ্ককে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলেন এজন্য যে, তিনি উঁচুতলার অপরাধী সায়েবদের গ্রেপ্তারে সক্রিয় ছিলেন না। Jacquemont জোরের সঙ্গে বলেন, ‘এই ধরনের নমনীয় মনোভাব নেটিভদের চোখে শাসকজাতির ভাবমূর্তি নষ্ট করবে।’২৬ তাঁর প্রস্তাব ছিল, নৈতিক দিক দিয়ে অধঃপতিত শ্বেতাঙ্গদের গ্রেপ্তার করে সোজা ইউরোপে পাঠিয়ে দেওয়া দরকার। কারণ, এই রকম মানুষ একটা ভয়ংকর বিদ্রোহের থেকেও বেশি ক্ষতি করে শ্বেতাঙ্গদের অঙ্গে কলঙ্কের কালি ছিটিয়ে।২৭

তবে, একথাও সত্যি যে, লর্ড বেন্টিঙ্কই প্রথম কলকাতার শ্বেতাঙ্গ সমাজের শ্রেণিবৈষম্য ঘোচাবার চেষ্টা করেন গভর্নমেন্ট হাউসের দরজা সকল স্তরের সায়েবদের জন্য খুলে দিয়ে, তা সে প্যাট্রিসিয়ান হোক বা প্লিবিয়ান। কিন্তু বেন্টিঙ্কের এই সিদ্ধান্তকে উঁচুতলার সিভিলিয়নরা ভাল চোখে দেখেনি। অসন্তুষ্ট হয়েছিল।২৮ পরে লর্ড অকল্যান্ড (১৮৩৬-৪২) গভর্নমেন্ট হাউসে প্রবেশের অধিকার সমাজের উঁচুশ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে পূর্বাবস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। তাঁর এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় বেশ কিছু সংখ্যক অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির বিরোধিতায়। এমনকী, তাঁরা গভর্নমেন্ট হাউসের অনুষ্ঠান পর্যন্ত বয়কট করেন। এই ঘটনা প্রমাণ করে, উনিশ শতকের চল্লিশের দশকে শ্রেণি বৈষম্য একেবারে দূর না হলেও সাময়িকভাবে হ্রাস পেয়েছিল।২৯

বস্তুত, কলকাতার সায়েব সমাজে শ্রেণিভেদ ফুটে ওঠে কর্নওয়ালিশের আমলে (১৭৮৬-৯৩)। আঠারো শতকের গোড়া থেকেই কোম্পানির কর্মচারীরা নিজেদের মার্চেন্ট হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত ছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল, একদিনে এক লাখ দেখা, আর একজন ‘বিবি’ রাখা।৩০ কিন্তু কোম্পানি বাণিজ্য থেকে যতই সরকারি প্রশাসনে নজর দিতে থাকল, কর্মচারীরাও হয়ে উঠল মার্চেন্ট থেকে কূটনীতিবিদ্, প্রশাসক এবং বিচারক। পরিবর্তনটা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে কর্নওয়ালিশের আমলে। তাঁর আমলে সিভিলিয়নদের বেতন বৃদ্ধি করা হল। পরিমাণটা নেহাত কম ছিল না, তাদের কাছে বেশ স্বস্তিদায়ক। কিন্তু হারাতে হল, ব্যক্তিগত মুনাফা। নিষিদ্ধ হল, নজরানা ও ঘুষ গ্রহণ। অবশ্য এসব হারালেও কর্নওয়ালিশ সিভিলিয়ানদের বেতন বৃদ্ধি করে তাদের যে সামাজিক মর্যাদা দিলেন, তা তাদের কাছে কম কাঙ্ক্ষিত ছিল না। কিন্তু, এর পরিণামে তারা নিজেদের এক ভিন্ন সম্প্রদায় বলে মনে করতে থাকল। তারা দেখা দিল এক নিছক নির্লিপ্ত এলিট শ্রেণি হিসেবে।৩১ অভিজাত কুলে না জন্মেও তারা নিজেদের কলকাতার সায়েব সমাজে কুলীন হিসেবে ভাবতে থাকল। ১৮৩৩-এর পর কোম্পানির চাকরির দরজা সমস্ত শ্বেতাঙ্গদের কাছে খুলে দেওয়ার পরও এই সরকারি এলিটরা দূরত্ব বজায় রেখেছিল অন্যান্যদের থেকে।

তবে ১৮৪০-এর দশকে এসে কলকাতার শ্বেতাঙ্গ এলিটরা কিছুটা হলেও একটা ধাক্কা খায় পূর্বের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় টান পড়ার ফলে। তাদের আর্থিক সুযোগ সুবিধেও অনেকটা খর্ব করা হয়।৩২ ওদিকে নিচুতলার সায়েবরাও ক্রমশ আর্থিক সচ্ছলতা লাভ করায় তারা হীনম্মন্যতা কাটিয়ে ওঠে। উঁচুমহলের সায়েবদের দেমাক ও মেজাজের তোয়াক্কা তারা করত না। তারাও তাদের একতার বল দেখাতে শুরু করল দোকানদার এবং ব্যবসায়ীদের নিয়ে Trade Association গড়ে তুলে। ঠিকানা হল ওল্ডকোর্ট হাউস স্ট্রিটে।

সূত্রনির্দেশ

১. P. J. Marshall, British Society in India under the East India Company. (Modern Asian Studies, 31, 1 (1997)

২. Percival Spear, The Nabobs: A Study of the Social Life of the English in Eighteenth Century India, London (1980). p. 57

৩. তদেব।

৪. P. J. Marshall, প্রাগুক্ত, p. 91

৫. Percival Spear, প্রাগুক্ত, p.57

৬. তীর্থংকর রায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস, কলকাতা (২০১৪), পৃ. ১২০।

৭. The Asiatic Journal, New Series, vol. 11, 1833, p. 217

৮. তদেব, May 1818, pp. 435-36.

৯. P. J. Marshall, প্রাগুক্ত, pp. 95-96.

১০. Alfred Spencer, (ed.) Memoirs of William Hickey, vol. III. London (1923), p. 312.

১১. Ketaki Kushari Dyson, A Various Universe, New Delhi, (2006), p. 31.

১২. The Asiatic Journal, New Soies, vol.II, 1830, p. 213

১৩. তদেব।

১৪. Abhijit Dutta, European Social Life in 19th Century Calcutta, Calcutta (1994), p. 28.

১৫. Percival Spear, প্রাগুক্ত, p. 58.

১৬. তদেব।

১৭. E. M. Collingham, Imperial Bodies, Malden (USA) 2001, p.21.

১৮. তদেব

১৯. David Arnold, European Orphan and Vagrants in India in the Nineteenth Century, (The Journal of Imperial and Commonwealth History, January. 1979, vol. VII, No. 2, p. 105.

২০. Percival Spear, প্রাগুক্ত, p. 57.

২১. Abhijit Dutta, প্রাগুপ্ত, p. 29.

২২. Kenneth Ballhatchet, Race, Sex and Class under the Raj, London (1980) p. 5.

২৩. Abhijit Dutta, প্রাগুক্ত, p. 30.

২৪. P. T. Nair, (ed.) British Social Life in Ancient Calcutta (1750-1850), Calcutta (1983), p. 118.

২৫. Abhijit Dutta, প্রাগুক্ত p. 31.

২৬. তদেব, p. 24.

২৭. তদেব।

২৮. P. T. Nair, প্রাগুক্ত, p. 71.

২৯. Abhijit Dutta, প্রাগুক্ত, p. 32.

৩০. Kenneth Ballhatched, প্রাগুক্ত, p. 2.

৩১. তদেব।

৩২. Abhijit Dutta, প্রাগুক্ত, p. 33.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *