কলকাতার সায়েবদের সায়েবিয়ানা

কলকাতার সায়েবদের সায়েবিয়ানা

১৬৯০ সালে জোব চার্নক সুতানুটিতে পা রেখেছিলেন পাকাপাকিভাবে। তখন থেকে পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় কোম্পানিকে লড়াই করতে হয়েছিল কলকাতা তথা বাংলায় প্রশ্নাতীতভাবে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য। ১৭৫০-এর দশকেই তুচ্ছ দর কষাকষি বণিকের দল বিরাট মাপের রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়ে ওঠে। কিন্তু তার আগে ১৭২০-র দশক থেকেই দু-পয়সা আসতে শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের হাতে। সেই সময় তাদের মার্চেন্ট হিসেবে এশীয় সামুদ্রিক বাণিজ্যের অনুমতি দেওয়া হয়। তবে তাদের জীবন ও দৃষ্টিভঙ্গিতে আচমকা পরিবর্তন ঘটে যায় ১৭৫০ থেকে ১৭৮৫ সালের মধ্যে। কলকাতায় ইংরেজদের রূপান্তর ঘটে অন্যরূপে। এই পরিবর্তনের পর্ব একটু বিলম্বে ঘটলেও, সমাপ্তি ঘটে দ্রুততার সঙ্গে।

শুরু হয়েছিল ১৭৫৬ সালে সিরাজ-উদ-দৌলার হাতে হারানো কলকাতা পুনর্দখল করার পর থেকে। বাংলার মসনদ থেকে নবাব সরানো আর বসানোর ব্যাবসাটা জমে উঠেছিল পলাশির যুদ্ধ চুকেবুকে গেলে। এরপর শুধু কোম্পানির তহবিলেই মুদ্রাস্রোত এসে প্রবেশ করল না, রাজনৈতিক ক্ষমতার জাদুদণ্ডের জাদুতে কলকাতায় কোম্পানির কেষ্ট-বিষ্টুরাও ফুলে-ফেঁপে উঠল প্রায় রাতারাতি। ১৭৫৭-র ১৯ মে, মির জাফরকে নবাব করার দর কষাকষি যখন চলছে, ক্লাইভ ওয়াটসনকে জানালেন, মির জাফরকে চুক্তি অনুযায়ী শুধু এক কোটি সাতাত্তর লক্ষ টাকা দিলেই চলবে না, আরও বাহান্ন লক্ষ দিতে হবে। টাকাটা বেসরকারি নজরানা, কাগজে-কলমে এর উল্লেখ থাকবে না। পলাশির পর ১২,৩৮৫৭৫ পাউন্ড বিলিয়ে দেওয়া হয়েছিল কলকাতার পদস্থ কর্মচারীদের মধ্যে। ওপরতলার বড় ইংরেজ সায়েবরা কে কত পেয়েছিলেন উইলিয়ম হিকির স্মৃতিকথা থেকে তার হিসেব দিয়েছেন বিনয় ঘোষ। পাউন্ডের অঙ্কে ক্লাইভ পেয়েছিলেন ২,১১৫০০, ড্রেক ৩১,৫০০, ওয়াটস্‌ ১,১৭০০, কিলপ্যাট্রিক ৬০,৭৫০, বেশার ২৭,০০০, ভ্যান্সিটার্ট ৫৮,৩৩৩, হলওয়েল ৩০,৯৩৭, জনস্টোন ২৭,৬৫০। সে সময় ১১,০০০ পাউন্ড ছিল এক লক্ষ টাকার সমান। পাউন্ডকে টাকায় হিসেব করলে এই প্রাপ্তির বহরটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। কোম্পানির কম ওজনদার ছোট ইংরেজদের প্রাপ্তিও নেহাত নগণ্য ছিল না।

আঠারো শতকে কলকাতার সায়েবদের মোটামুটি তিনটে শ্রেণি ছিল— কোম্পানির সামরিক ও অসামরিক কর্মচারী এবং বেসরকারি ইউরোপীয়। তাদের স্বতন্ত্র জীবনচর্যা ছিল, কিন্তু লক্ষ্য ছিল অভিন্ন, দ্রুত অর্থ উপার্জন করে ধনী হওয়া। আর্থিক দুর্নীতি ছাড়া সেই লক্ষ্যে পৌঁছনোর আদর্শ পথ ছিল ব্যাবসা-বাণিজ্য। ব্যক্তিগত বাণিজ্যে কোনও বাধা-নিষেধ ছিল না। যেমন খুশি বাণিজ্য করো, শুধু কোম্পানির বাণিজ্যিক স্বার্থ ক্ষুণ্ণ না হলেই হল। তাই অন্য পেশায় নিযুক্ত ইংরেজরা নিজেদের পেশা জলাঞ্জলি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ব্যাবসা-বাণিজ্যের জগতে। এমনকী, সার্জেন সায়েবও অ্যাপ্রন খুলে তুলে নিয়েছিল তুলাদণ্ড।

লর্ড কর্নওয়ালিশ গভর্নর জেনারেল হয়ে আসার আগে পর্যন্ত কোম্পানির কর্মচারীদের বেতন ছিল সামান্য। ক্লাইভ কর্মজীবন শুরু করেন বছরে পাঁচ পাউন্ডের রাইটার হিসেবে। ১৭৬৪ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে বেতন পেতেন মাসে মাত্র ৩০০ টাকা। ১৭৫৭ সালে ড্রেক সায়েবের (Roger Drake) বার্ষিক বেতন ছিল মাত্র ২০০ পাউন্ড। চ্যাপলেন রেভারেন্ড কোবে (Chaplain Rev. Cobbe) পেতেন ৫০ পাউন্ড। সিনিয়র মার্চেন্টের বেতন ছিল বছরে ৪০ পাউন্ড, জুনিয়রদের ৩০ পাউন্ড, ফ্যাক্টরদের ১৫ আর রাইটারদের ৫ পাউন্ড। বিলেতের কর্তাদের এ তথ্য অজানা ছিল না। তাই অভাব পুষিয়ে দেওয়ার জন্য কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়। এমনকী, প্রেসিডেন্ট, চ্যাপলেন এবং ডাক্তারদেরও লবণের ব্যাবসার অনুমতি মেলে। কথায় আছে ‘বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী’। লক্ষ্মীর কৃপা তাদের মাথায় ঝরে পড়েছিল অঝরে। মার্চেন্টদের সম্পর্কে পার্সিভ্যাল স্পিয়ার লিখেছেন, ‘He became a ‘nabob’ in ideal, and commerce was only the method by which he obtained the necessary wealth.’

যারা বেসরকারি কাজে যুক্ত ছিল তাদের উপার্জনও নেহাত মন্দ ছিল না। প্রথম দিকে আইন ব্যাবসা তেমন জমেনি। কিন্তু ১৭৭৪-এ সুপ্রিম কোর্টের প্রতিষ্ঠার পর উকিলরা হয়ে ওঠে ধনী সায়েব। ‘Hartly House’-এর লেখিকা১০ লিখেছেন, কলকাতা তখন টাকা আয় করা আর ওড়াবার শহর। উকিলের ফি বিশাল অঙ্কের। ‘কোনো বিষয়ে তুমি যদি একটা প্রশ্ন কর, তোমাকে তার সামনে রাখতে হবে একটা সোনার মোহর। যদি তাকে দিয়ে তিন লাইনের একটা চিঠি লেখাতে চাও, দিতে হবে আঠাশ টাকা।’১১ ডাক্তার পালকিতে চেপে রুগি দেখতে এলে তার ভিজিট একটা সোনার মোহর।১২ ডাক্তার হ্যালিডে জোসেফ নামে এক রুগির কাছে প্রতিবারের ভিজিট ৬৪ টাকা হিসেবে ছ’বার ভিজিটের জন্য ৩৮৪ টাকা দাবি করেছিলেন। ঘটনাটা ১৮২৮ সালের।১৩ পাদ্রি সায়েবের খাঁই ছিল চমকে দেওয়ার মতো। একজন মৃতের পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য দাবি করতেন কুড়িটা সোনার মোহর।১৪

উনিশ শতকের প্রথম থেকেই বিভিন্ন পেশাধারী সায়েবের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল।১৫ রেভারেন্ড লঙ্‌ মার্টিন নামে একজন সায়েব দর্জির কথা বলেছেন, যে মাত্র দশ বছরে দু’ লক্ষ টাকা উপার্জন করে। মেমসায়েবদের কবরী বিন্যাসের প্রবল শখের জন্য তখন কলকাতায় হেয়ারড্রেসারের ভীষণ চাহিদা। আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে Prescini নামে একজন হেয়ারড্রেসারের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল শহরে। M. Malvaist নামে জনৈক ফরাসি হেয়ারড্রেসার কেশবিন্যাসের জন্য পারিশ্রমিক হিসেবে নিতেন দুটো সোনার মোহর। মেমসায়েবরা নাচ শিখত। তাদের নাচের তালিম দিয়ে মোটা টাকা উপার্জনের সুযোগ ছিল।

সম্ভবত এই কারণে পি জে মার্শাল লিখেছেন, প্রথম থেকেই কলকাতার সায়েবপাড়ার একটা খ্যাতি ছিল, ‘এটা এমন একটা ‘সেট্‌লমেন্ট’ যেখানে পয়সাওয়ালা লোকেরা খানদানি জীবনযাপন করে।’১৬ প্রয়োজনের অতিরিক্ত অঢেল অর্থ হাতে এলে বিলাসিতার বাসনা জাগে মনে। সিভিলিয়ন কিংবা বেসরকারি সায়েব যারা সে সময় কলকাতায় বাস করত, কেউ কর্নওয়ালিশের মতো সম্ভ্রান্ত জমিদার তনয় ছিল না। বেশির ভাগ ছিল বিলেতে সমাজের নিচুতলার মানুষ। এদেশে আসত প্রায় শূন্য হাতে। ক্রমে সৌভাগ্যের দরজা খুলে যেতেই জীবন উপভোগের আসক্তি জন্মাত মনে।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কলকাতায় আর আগের মতো কেউ সোনার সন্ধানে ছুটে আসত না।১৭ বিগত শতকের সেই সোনার গাছ মুড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তখনও দু’হাতে পয়সা ওড়াত ধনী এলিট সায়েবরা, যাদের সামনে বিলাসিতা ও ঠাট-বাটের চূড়ান্ত নজির তুলে ধরেছিলেন গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি। স্যার জেমস ম্যাকিনটস তাঁর এক চিঠিতে ওয়েলেসলিকে ‘Sultanised Englishman’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। ওয়েলেসলি বিলেতে কোম্পানির কর্মকর্তাদের স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন, ‘India should be governed from a palace, not from a country house, with the ideas of a prince, not with those of a retail dealer in muslin and indigo.’১৮ সেজন্য বিলেতের অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে আজকের রাজভবন নির্মাণ করিয়েছিলেন একশো পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড খরচ করে, আর পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড দিয়ে সেই প্রাসাদ সাজান মূল্যবান আসবাবপত্র এনে। গভর্নর জেনারেল রুপো-বাঁধানো দণ্ড বহনকারী, ঝকমকে পোশাকে সজ্জিত সান্ত্রিবেষ্টিত হয়ে থাকতেন এদেশের রাজ-রাজড়ার মতো। সে সময় আশা করা হত, যে কোনও পদের সিভিলিয়ন উপযুক্ত ঠাট বজায় রাখবে। প্রতিষ্ঠিত মার্চেন্ট, প্রাইভেট ব্যাংকের অংশীদার প্রভৃতি বেসরকারি সায়েবরাও সিভিলিয়নদের বিলাসিতা অনুকরণ করেছিল। জন পামার (John Plamer) কলকাতার শ্বেতাঙ্গ সমাজে পরিচিত ছিলেন ‘বণিক রাজপুত্র’ নামে। এই অভিধার মূলে ছিল তাঁর অসীম বদান্যতা, অসাধারণ অমায়িকতা এবং বিপুল সম্পদের জৌলুস।১৯ তাঁর দ্বার ছিল অবারিত। কুড়ি জন বসতে পারে একসঙ্গে এমন বিশাল ডিনার টেবিল প্রস্তুত থাকত অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য। কলকাতার নবাগত কোনও সায়েব তাঁর বাড়িতে আপ্যায়িত হয়নি, এমন ভাবাই যেত না।২০

খাওয়া-দাওয়ার জন্য ক’টা পয়সাই বা খরচ হত। খাবার-দাবার ছিল খুব সস্তা। ১৭৭৮ সালে একটা ভেড়া ২ টাকা, ৬টা মুরগি বা হাঁস এক টাকা, দু পাউন্ড মাখন এক টাকা, ১২ পাউন্ড রুটি এক টাকায় মিলত।২১ মদ ছিল একমাত্র মহার্ঘ বস্তু। ফলে কলকাতার ওপরতলার সায়েবদের জীবন যে বিপুল বিলাসে আচ্ছন্ন হয়েছিল, তা তাদের স্বদেশবাসী কল্পনাও করতে পারত না। ঘোড়ার গাড়ি শুধু বিলাসিতার উপকরণ ছিল না, ছিল সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। উইলিয়ম হিকি ছিলেন কলকাতার বিখ্যাত অ্যাটর্নি, ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে। তিনি লিখেছেন, ‘শ্রীমতী হিকির জন্য একটা ঘোড়া গাড়ির প্রয়োজন হওয়ায় আমি লন্ডনে তৈরি একটা রথ (Chariot) কিনেছিলাম। এজন্য আমার খরচ হয়েছিল তিন হাজার সিক্কা টাকা। নিজের জন্য একটা ফিটন কিনেছিলাম আঠারোশো টাকা দিয়ে। সেটা টানার জন্য তিনটে চমৎকার ঘোড়া কিনতে খরচ হয় সতেরোশো টাকা।’২২ হিকি সায়েব একটা বজরা কিনেছিলেন জলবিহারের জন্য। আটচল্লিশ ফুট লম্বা, প্রয়োজন হত চোদ্দোজন দাঁড়ির। বিলেতে যখন মুষ্টিমেয় কিছু পরিবারের মেয়েদের জন্য ঘোড়া কেনার সামর্থ্য ছিল, সে সময় ফ্যানি পার্কস কলকাতায় প্রায় সব মেমসায়েবকে ঘোড়ায় চড়তে দেখে অবাক হয়েছিলেন। সেসব ঘোড়া ভাড়া করা নয়, ব্যক্তিগত সম্পত্তি।২৩

ম্যাকিনটস-এর (Macintosh) ‘Travels’-এ একজন উঁচুতলার সায়েবের সায়েবিয়ানার বর্ণনা রয়েছে। ‘সকাল সাতটায় দরওয়ান গেট খুলে দেয়। বারান্দা দিয়ে সায়েবের সরকার, পিয়ন, হরকরা, চোবদার, হুকোবরদার, খানসামা, রাইটার এগিয়ে আসে। আটটার সময় হেড বেয়ারা, জমাদার হল এবং শোয়ার ঘরে ঢোকে। দেখা যায়, সায়েবের পাশে শয্যা নেওয়া এক মহিলা উঠে গিয়ে একান্ত ব্যক্তিগত সিঁড়ি দিয়ে হয় তার নিজের ঘরে চলে যাচ্ছে, কিংবা বেরিয়ে যাচ্ছে উঠোন পেরিয়ে। যে মুহূর্তে সায়েব বিছানা ছেড়ে মাটিতে পা রাখেন, অপেক্ষমাণ ভৃত্যের দল দ্রুত প্রবেশ করে ঘরের মধ্যে। প্রত্যেকে মাথা সমেত গোটা শরীরটা যতটা সম্ভব আনত করে তিনবার সেলাম ঠোকে। হাতের আঙুলগুলো কপাল স্পর্শ করে, হাতের উলটো পিঠ থাকে মেঝের দিকে।’২৪

মোটামুটি আধঘণ্টার মধ্যে রাত্রিকালীন পোশাক পালটে দেওয়া হয়। পরানো হয় সায়েবি পোশাক— সার্ট, ব্রিচ, মোজা এবং চটি। সায়েবকে কিছু করতে হয় না। সব তারাই করে। তিনি বসে থাকেন অনড় হয়ে মূর্তির মতো। এরপর আসে নরসুন্দর। তার কাজ মনিবের দাড়ি কামানো, নখ কাটা ও কান পরিষ্কার করা। স্নানপর্ব সেরে সায়েব একটা আরাম কেদারায় বসেন। ভৃত্যকুল সঙ্গে সঙ্গে তৎপর হয়ে ওঠে তার শরীরের পরিচর্যা করতে, পা থেকে মাথা পর্যন্ত। তিনি পদযুগল রাখেন একটা মোড়ার ওপর, একজন তাঁর পা ধুয়ে দেয়। একজন হাত পাখা নিয়ে বাতাস করে। একজন পেছনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ে দেয়, আর একজন সেটা দেখার জন্য সায়েবের মুখের সামনে তুলে ধরে একটা আয়না। তারপর তিনি টেবিলের দিকে এগিয়ে যান প্রাতরাশ গ্রহণের জন্য। এক সময় হুঁকোবরদার তাঁর হাতে তুলে দেয় আলবোলার নল।

এই পর্ব মিটতে দশটা বেজে যায়। পালকি এসে হাজির হয় দোর গোড়ায়। পালকি এগিয়ে চলে। সামনে থাকে চোবদার, হরকরা, পিয়ন প্রভৃতি মিলে আট থেকে বারো জন। বেলা দুটোয় ডিনার। চা পানের পর একটা সুদৃশ্য কোট পরে বেরিয়ে পড়েন মহিলাদের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে। রাত দশটার একটু আগে ফিরে আসেন, যখন পরিবেশন করা হয় সাপার। ডিনার ও সাপার মিলিয়ে অন্তত পনেরোটা পদ থাকে। ভৃত্যকুল চলে যাওয়ার পর সায়েব ‘নায়ক’ শয়ন কক্ষে প্রবেশ করেন, যেখানে একজন নারী অপেক্ষা করতে থাকে তাঁকে সঙ্গ দানের জন্য।২৫

তবে খেয়াল রাখতে হবে, সব সায়েবের জীবনযাপনের ছবি একই রঙের ছিল না। অনেকে ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হত। ঘোড়া ছোটাত ময়দানে যতক্ষণ না পর্যন্ত সূর্য পূর্ব দিগন্তের ওপরে ওঠে। শীতকালে অশ্বারোহণ পর্ব মিটতে একটু সময় নিত। ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে ভৃত্যকুল তৎপর হয়ে উঠত মনিবের সেবার জন্য। তিনি কুরসিতে একটা বই হাতে করে বসতেই শুরু হয়ে যেত তাঁর পদসেবা।২৬

ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে দু’একজন কাউন্সিলারের চাল-চলন তো রাজা-উজিরকেও হার মানাত। হেস্টিংসের অন্যতম কাউন্সিলর ফিলিপ ফ্রান্সিস যে বাড়িতে থাকতেন, তাতে সব মিলে ঘর ছিল চোদ্দোখানা। তাঁর স্ত্রী থাকতেন বিলেতে। দোতলায় খাবার ঘরটা লম্বায় ছিল পঞ্চাশ ফুট। নীচের তলায় ওই মাপের আর একটা খাবার ঘর। এছাড়া ছিল একটা হলঘর। পূর্ব-পশ্চিমে তিনটে করে বড় ঘর। মূল সিঁড়ি ছাড়াও বাড়ির পেছন দিকে দুটো সিঁড়ি। শহরের অন্যতম সুন্দর বাড়ির জন্য ফ্রান্সিসকে ভাড়া গুনতে হত বছরে বারোশো পাউন্ড।২৭

অবশ্য এই বিলাসভঙ্গি বজায় রাখা সম্ভব ছিল একমাত্র সিনিয়র সিভিলিয়নদের পক্ষে। কিছু সায়েব বিলেত থেকেই সৌভাগ্য সঙ্গে নিয়ে ভারতের উদ্দেশে পাড়ি দিত, যারা কলকাতায় এসে কাউন্সিলের সদস্য, সেনাধ্যক্ষ, বিশপ, বিচারপতি, ল’ কমিশনার বা ওই ধরনের পদে নিযুক্ত হত। একটু বেহিসেবি হয়ে বিলাসিতার জন্য খরচ করা সম্ভব ছিল তাদের পক্ষে। কিন্তু ক্যাডেট, সওদাগর সংস্থার কেরানি বা ছোটখাটো ব্যবসায়ী তা করতে গেলে পরিণাম হত দুঃখ-কষ্টের। উনিশ শতকের তিরিশের দশকে কলকাতার একজন সচিব পর্যায়ের পদস্থ সিভিলিয়ন বছরে পেত ৫০০০ পাউন্ড। সে সময় বিলেতে একজন সমপর্যায়ের সিভিলিয়নের বেতন ছিল অনেক কম, ২০০০ পাউন্ড।২৮ তবে কলকাতায় জুনিয়র সিভিলিয়নের বেতন ছিল বছরে মাত্র ১৩০০ টাকা। তা সত্ত্বেও কলকাতায় প্রথম দিকে মেমসায়েবের অভাবে তারা তাদের আয়ের কথা বিবেচনা করত না বিবি রাখতে গিয়ে। জাহাজের ওলন্দাজ ক্যাপ্টেন স্টাভোরিনাস (Stavorinus) সায়েবদের অপরিমিত অপব্যয়ের কথা বোঝাতে গিয়ে লিখেছিলেন, ‘বেশির ভাগ মানুষ যা আয় করে, তার দ্বিগুণ খরচ করে। ব্যয়ের পরিমাণের অর্ধেকও তারা উপার্জন করে না।’২৯ তবে এটাও সত্যি যে, সব সিভিলিয়ন ব্যাপক বিলাসিতার পেছনে ছুটত না। অনেকেই মিতব্যয়ী ও পরিশ্রমী ছিল। দীর্ঘ আটত্রিশ বছর ভারতে কাটিয়েছিলেন উইলিয়াম টেলর। ১৮৩৪-৩৫ সালে সমসাময়িক লেখকরা ব্রিটিশ সিভিলিয়ন সমাজের যে বর্ণনা দিয়েছেন, টেলর সেই বর্ণনার আওতায় পড়েন না।৩০

শুধু টেলরের মতো সিভিলিয়ন কেন, কলকাতায় কোম্পানির কর্মকর্তাদের মধ্যেও কেউ কেউ বিলাসে ভেসে যাননি। উইলিয়াম হিকি ওয়ারেন হেস্টিংস সম্পর্কে লিখেছেন, তিনি এমনিতে মিতবাক এবং বেশ কিছুটা লাজুক প্রকৃতির ছিলেন। তাঁর শরীরের গঠন একেবারেই মজবুত ছিল না। এই কারণে যথেষ্ট সংযমী ছিলেন খাদ্য ও পানীয় গ্রহণে। নরম পানীয়ের সঙ্গে জল মিশিয়ে নিজের হাতে পানীয় তৈরি করতেন। পার্টির সময় অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকতেন চেয়ারে। সঙ্গীরা যখন আর বিন্দুমাত্র পানীয় গলাধঃকরণ করার অবস্থায় থাকত না, তিনি স্থান ত্যাগ করতেন সকলের অলক্ষ্যে। হেস্টিংসের কাউন্সিলর ফিলিপ ফ্রান্সিস সম্পর্কে এডমন্ড বার্ক লিখেছেন, ‘All the luxuries of the East were at his command.’৩১ কৌতূহলের বিষয়, ফ্রান্সিস অন্য ক্ষেত্রে বিলাসিতা করুন না কেন, খানা-পিনার ব্যাপারে তিনি আশ্চর্যভাবে হেস্টিংসের অনুগামী ছিলেন। অথচ দু’জনের মধ্যে ছিল অহি-নকুল সম্পর্ক। দু’জনের মৃত্যুও হয় প্রায় একই সময়ে। হেস্টিংসের মৃত্যুর চার মাস পরে ফ্রান্সিস মারা যান। হেস্টিংসের মৃত্যু হয় ১৮১৮-র ২২ ডিসেম্বর।৩২

১৭৮৪ সালে হেস্টিংস লিখেছিলেন, সকালে প্রাতরাশ গ্রহণের আগে তিনি প্রতিদিন ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে আট মাইল ঘোড়া ছোটান। তারপর ঠান্ডা জলে স্নান করে প্রাতরাশ গ্রহণ করেন। ডিনারে জল ও চা ছাড়া অন্য পানীয় গ্রহণ করেন না। রাত্রে সাপারও না। বিছানায় যান ঠিক রাত দশটায়।৩৩ স্যার জন শোর-এর জীবনযাত্রাও ছিল নিয়মের নিগড়ে বাঁধা, সংযত। ১৭৮৭-র ২১ জানুয়ারি এক চিঠিতে তাঁর স্ত্রীকে লিখেছিলেন, ‘আমি খুব সকালে উঠি। ঘোড়া ছোটাই সাত থেকে দশ মাইল। সকাল আটটার মধ্যে প্রাতরাশ সারি। ডিনার করতে তিনটে বাজে। ওই সময়টা পর্যন্ত ব্যস্ত থাকি কাজে। আমার খাদ্য তালিকা সংক্ষিপ্ত। বিকেলে আবহাওয়া ভাল থাকলে বেড়াতে বেরোই। সাপারও আমার বেশ পছন্দের। বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে বল অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ওসব আমি পছন্দ করি না। এ পর্যন্ত শুধুমাত্র লর্ড কর্নওয়ালিশের দেওয়া বল-এ উপস্থিত থেকেছি।’৩৪

সায়েবরা স্বদেশে ফিরে যাওয়ার পরও নবাবি হাল-চাল চালু রাখার চেষ্টা করত বলে তারা ‘Nabob’ বলে পরিচিত ছিল। E. M. Collingham ১৭৭২-এ বিলেতে ফিরে যাওয়া সায়েব-নবাবের ছবি এঁকেছেন এইভাবে— ‘ব্যঙ্গ কবিতার কবিদের নিশানায় ছিল কৌতুকী চেহারার নবাব। সে না ব্রিটিশ, না ভারতীয়। দুটোর এক অদ্ভুত মিশেল। তাকে দেখলেই চেনা যেত। শুকনো হলদেটে চর্ম, অসুস্থ লিভার। খিটখিটে মেজাজ। মদভক্ত ও রাশি রাশি ডিনারে আসক্ত। জমকালো পোশাকে অবশ্যই একটা সাদা ধবধবে ওয়েস্ট কোট… লন্ডনে হারলে স্ট্রিট, উইমপোল স্ট্রিট ও গ্লসেটর প্লেস-এ তারা বিখ্যাত।’৩৫

সায়েবদের ভৃত্যবিলাস:

আঠারো শতকে কলকাতায় গোরা ভৃত্যের আকাল। নেহাত ঠেকায় না পড়লে তারা ভৃত্যগিরি করত না। অল্প সংখ্যক যারা ছিল তারা সাধারণত পসটিলিয়ন (Postillion— ঘোড়ায় চেপে এগিয়ে গিয়ে পথ দেখাত যারা), কোচম্যান, বাটলার ইত্যাদির কাজ করত। তাদের পোষা ছিল ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। সম্ভবত গোরা ছিল বলে তাদের গুমর ছিল বেশ বড় মাপের। খাঁই ছিল বড্ড বেশি। বেতন ছাড়াও থাকার ব্যবস্থা, তাদের চাকর-বাকরদের বেতন সবকিছু জোগাতে হত মনিবকে। এত করেও নিশ্চিন্ত হওয়ার জো ছিল না। তারা তাদের বেতন থেকে কিছু কিছু সঞ্চয় করে হঠাৎ একদিন অদৃশ্য হয়ে যেত কিছু জানান না দিয়ে। পরে দেখা যেত, কোনও ব্যাবসা শুরু করেছে শহরে। ফলে সায়েবদের নির্ভর করতে হত দিশি ভৃত্যকুলের ওপর।

ভৃত্যের পদসেবা

১৮১৩ সালে প্রকাশিত দি ইউরোপিয়ান ইন ইন্ডিয়া, ক্যাপ্টেন থোমাস উইলিয়ামসন গ্রন্থ থেকে গৃহীত

আলেকজান্ডার ম্যাকরেবি ছিলেন কলকাতার শেরিফ। আঠারো শতকে কলকাতায় ঘর-বাড়ির যথেষ্ট অভাব। সেজন্য তিনি ফিলিপ ফ্রান্সিসের বাড়িতে আরও দু’জন সায়েবের সঙ্গে বাস করতেন ভাগাভাগি করে। ১৭৭৫-এ তিনি তাঁর বাবাকে একটা চিঠিতে লেখেন, ‘একজন জমাদার (স্টিওয়ার্ড) আমার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে সব সময়। সে আমার দেওয়া বার্তা গ্রহণ করে, সাক্ষাৎপ্রার্থীদের নাম জানায়, আবার আমার পালকির পাশে ছুটতে থাকে পথের বাধা দূর করতে করতে। আমার সমস্ত যাত্রাপথে পালকির আগে থাকে দু’জন পিয়ন। সঙ্গে থাকে হরকরা। পালকি বয় আটজন বেহারা। মিস্টার ফ্রান্সিসের পাঁচটা ঘোড়া আছে, দশজন লোক দেখভাল করে। এছাড়াও একজন কোচম্যান আছে। আমি জানি তিনি একজন কাউন্সিলরের অতিরিক্ত কিছু নন্‌। অথচ তাঁর চারজন পিয়ন, চারজন হরকরা, দু’জন চোবদার যারা রুপো বাঁধানো লাঠি নিয়ে চলে।… রাঁধুনি ও তার দু’জন সহযোগী রান্নার ব্যবস্থা করে। বাটলারের দায়িত্বে থাকে পানীয়। আবদার সেটা ঠান্ডা রাখে। দু’জন দরওয়ান পাহারা দেয়। ধোপা কাপড় কাচে, ইস্তিরি করে আর একজন। দু’জন মালি, গোরু-হাঁস-মুরগিকে খাওয়ানোর জন্য আর একজন ভৃত্য। ফ্রান্সিসের বাড়িতে চারজন লোকের জন্য একশো দশজন ভৃত্য।’৩৬ আঠারো শতকে কলকাতার উঁচুতলার সায়েবদের ভৃত্য-বিলাসের ছবি ভেসে ওঠে এই চিঠিতে।

উনিশ শতকেও এই রেওয়াজ রীতিমতো বহাল ছিল। ১৮২২-এর নভেম্বরে ফ্যানি পার্কস কলকাতায় এসে শহরের আকাশ-বাতাসে মুগ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু বিস্মিত হয়েছিলেন কোম্পানির কর্মচারীদের বাড়িতে বিপুল সংখ্যক ভৃত্য দেখে। তাঁর মনে হয়েছিল, এই ভৃত্যকুল লালন করতে গিয়ে কলকাতার সায়েবরা শেষ করে ফেলবে নিজেদের, সর্বনাশ ডেকে আনবে। এমনিতে ভৃত্যদের বেতন খুব একটা বেশি নয়, কিন্তু অতগুলো ভৃত্যের মোট বেতনের পরিমাণ তো বিশাল!৩৭ কথাটা সত্যি। শ্রীমতী মেরি মার্থা শেরউডের স্বামী স্বীকার করেছিলেন, তাঁর মাসিক আয়ের একটা মোটা অংশ বেরিয়ে যায় ভৃত্যদের বেতন দিতে গিয়ে। ৫০৬ টাকা মাসিক বেতনের ১১৫ টাকা খরচ হয় এই খাতে।৩৮

হবে না কেন? ভৃত্যরা একজনের কাজ অন্য জন করত না। নিয়ম ছিল না। তাদের মধ্যে ছিল শ্রেণি ও বর্ণবৈষম্য। ভৃত্যদের দুটো শ্রেণি ছিল— নোকর ও চাকর। এদুটি শব্দ কিন্তু সমার্থ নয়। প্রথম শ্রেণির পদ মর্যাদা ছিল দ্বিতীয় শ্রেণির থেকে উঁচু। এর কারণ, তারা কায়িক শ্রম করত না। তাদের ‘চাকর’ বলা যেত না, সেটা তাদের দেমাকে লাগত। নোকরদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, মুনশি, সরকার, চোবদার প্রভৃতি। চাকররা হল, মশালচি, ভিস্তি, খিদমদগার, হুঁকোবরদার, আয়া, দাই ইত্যাদি।৩৯ ভৃত্যরা সায়েবের বাড়ি কাজ করতে এলেও নিজেদের জাত-পাত নিয়ে তাদের হুঁশ ছিল ষোলো আনা। বর্ণ প্রথানুসারে তাদের কাজ ছিল নির্দিষ্ট। এক জাতের ভৃত্যের কাজ অন্য জাতের ভৃত্য করত না। ফলে প্রতিটি কাজের জন্য নির্দিষ্ট ভৃত্য নিয়োগ না করে উপায় ছিল না। ভৃত্যদের এই নিয়মের পেছনে সম্ভবত তাদের অন্য মতলবও থাকতে পারে। মোগল অভিজাত শ্রেণির অবক্ষয়ের ফলে অনেক মানুষ বেকার হয়ে পড়ে। যাতে বেশি সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয়, সেজন্য ছিল তাদের এই অজুহাত।৪০

১৭৮২ সালে অ্যাটর্নি উইলিয়ম হিকির ছিল ৬৩ জন ভৃত্য। কলকাতায় আসা বিলিতি পর্যটকরা শহরের সায়েবমেমদের এই ভৃত্যবিলাস ভাল চোখে দেখেননি। ১৮২৭-২৮ সালে শ্রীমতী ফেনটনের (Mrs. Fenton) কাছে দাই-এর ওপর মেমসায়েবদের অতি নির্ভরশীলতা অপ্রীতিকর ঠেকেছিল। তিনি লিখেছেন, ‘দেখেছি, আমি ছাড়া কোনও শ্বেতাঙ্গিনী এদের ছাড়া চলতে পারে না। অথচ স্বদেশে তাদের প্রথম জীবন কেটেছিল রীতিমতো মেহনত করে। সেদিন তাদের মধ্যে একজন আমাকে বলেছিল, সে নিজে মোজা পরতে পারে না। আমার বেশ ভাল রকম জানা আছে, ভারতে আসার আগে ওই রকম কিছু পরা ক্বচিৎ তার কপালে জুটত।’৪১ ফ্যানি পার্কস লিখেছেন, ‘গতকাল আটটার সময় আমাদের একটা ছোট ডিনার ছিল। মাত্র আটজন ছিলেন পার্টিতে। অথচ তাদের সঙ্গে উপস্থিত ছিল তেইশজন ভৃত্য। প্রত্যেক ভদ্রলোকই নিজের ভৃত্যপরিবৃত হয়ে এসেছিলেন।’৪২ শ্রীমতী হনোরিয়া লরেন্স ছিলেন স্যার হেনরি মন্টেগোমেরি লরেন্সের (১৮০৬-১৮৫৭) পত্নী। তিনি একবার শ্রীমতী হ্যাচিনসনের কাছে তাঁর দাস-দাসীর সংখ্যা জানতে চেয়েছিলেন। শ্রীমতী হ্যাচিনসন উত্তরটা চট করে দিতে পারেননি। বলেছিলেন, ‘আমি নিশ্চিত নই, তবে খুব একটা বেশি সংখ্যা নয়। আমি গুনে বলছি।’ পরে জানা যায়, তাদের সংখ্যা তিরিশ।৪৩

কেউ কেউ এমন ব্যাখ্যা দেন যে, সায়েবের ঘরে প্রচুর সংখ্যক দিশি দাস-দাসীর উপস্থিতি তার প্রভুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার প্রতীক মাত্র।৪৪ এ ব্যাখ্যা যুক্তিসংগত মনে হয় না। সমসাময়িক কলকাতার ধনী জমিদার পরিবারে দাস-দাসীর প্রাচুর্যকে তা হলে কী ভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে? সামাজিক প্রভুত্ব? তাদের সামাজিক প্রভুত্ব প্রকাশের হাজারো পথ খোলা ছিল। কলকাতার সায়েবরা সম্ভবত কলকাতার ধনী পরিবারের আদব-কায়দা দ্বারা প্রভাবিত হয়েই প্রয়োজনের অতিরিক্ত দাস-দাসী রাখতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এমনও হতে পারে, এর পেছনে অন্য মানসিকতা কাজ করত, একটা আড়ম্বর প্রকাশের প্রবণতা। বিশেষ করে কোথাও ভ্রমণকালে সেটা বোঝা যেত।৪৫ E.M. Collingham মনে করেন, এদেশের কিছু সায়েব বিশাল ভৃত্যকুল নিয়োগ করে প্রতিযোগিতায় নেমেছিল ব্রিটেনের অভিজাতদের সঙ্গে।৪৬ তারা জানত, তাদের এই ভৃত্যবিলাস স্বদেশের মানুষের কাছে অপ্রয়োজনীয় এবং বাহুল্য মাত্র। লে. কর্নেল ট্রেডওয়ে ক্লার্ক তাঁর একার জন্য বাইশজন ভৃত্য রাখা এবং সেই খাতে মাসে সতেরো পাউন্ড চার শিলিং খরচ করার পেছনে যুক্তি দেখিয়ে তাঁর বোনকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘তোমার কাছে এটা বিশাল সংখ্যক মনে হতে পারে, কিন্তু তোমাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমি যে অবস্থায় আছি তার প্রেক্ষিতে এটা মোটেই তেমন কিছু নয়। ভৃত্যের তালিকায় যারা আছে তাদের একজনকেও বাদ দিয়ে আমি চলতে পারি না।’৪৭ সায়েবরা কবুল করত, দাস-দাসী ছাড়া তারা অসহায়, ‘We are taught by experience the impossibility of living without them and surrender ourselves at last wholly to their direction.’৪৮

উনিশ শতকেও সায়েবদের সায়েবিয়ানা টোল খায়নি। শুধুমাত্র দু’একজন ভৃত্যের পদের বিলুপ্তি ঘটে। চোবদার আর রুপো বাঁধানো লাঠি নিয়ে পালকির আগে আগে হাঁটত না। আবদারের আর আদর ছিল না, কারণ উনিশ শতকে কলকাতায় বরফ চলে আসে। যে হুঁকোবরদার আঠারো শতকে সায়েবদের প্রাত্যহিক জীবনের অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী ছিল, তারাও ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছিল। ১৭৮৪ সালে মনে হয় বলরুম থেকে বিদায় দেওয়া হয় হুঁকোবরদারদের।৪৯ কিন্তু উনিশ শতকেও সায়েবদের ব্যক্তিগত জীবনে তাদের আসন অটুট ছিল বলে জানা যায়। Englishman পত্রিকা ১৮৩৫ সালে একজন সিভিলিয়নের দাস-দাসী কী ভাবে মনিবসেবা করত তার বর্ণনা দিয়েছে। তিনি ‘একটা আরাম কেদারায় বসে আছেন। পদযুগল অলসভঙ্গিতে ছড়ানো রয়েছে দামি মোড়ার ওপর। অভিজাত সিভিলিয়ন ৯৪ ডিগ্রি ফারেনহিটে বিলাসিতায় নিষ্কর্মা হয়ে হুঁকো টানছেন। তাঁর সরকার একটা লম্বা সেলাম ঠুকে অপেক্ষা করছে সেদিনের নির্দেশ নেওয়ার জন্য। হুঁকোবরদার ফুরিয়ে যাওয়া ছিলিম পালটানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেয়ারা অপেক্ষা করছে মনিবকে কোন জিনিসটা দেখাতে হবে সেই আদেশের জন্য। একজন ভৃত্য তালপাতার চওড়া পাখা দিয়ে বাতাস করছে।’৫০ যখন তিনি পালকিতে না গিয়ে (সেটা বিরল ঘটনা) হেঁটে যেতেন, একজন মাথায় ছাতা ধরত। ছাতা শুধু রোদকে আড়াল করার জন্য নয়। একজন ভৃত্য মাথায় ছাতা ধরবে, এটা প্রভুত্ব প্রকাশের সাবেকি ভারতীয় প্রথা। অন্যান্য ভৃত্যরা অগ্রগামী এবং অনুগামী হত। সায়েব মনিব পালকিতে যান বা হেঁটেই যান, তাঁর আগে যেত চোবদার।

ভৃত্যদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সরকার। তারা কাজ চালানোর মতো ইংরেজিটা জানত, বলতে পারত। কিন্তু তারা ছিল ভয়ংকর ধুরন্ধর। তার ওপর অসৎ। মনিবকে বেহিসেবি অর্থব্যয়ে উৎসাহ দিত নিজেদের স্বার্থে। অনেক সরকার বেতন নিত না। সায়েবের কাছে চাকরি করতে এসে বলত, তারা বেতন চায় না, শুধু মনিবের টাকা-পয়সার সদ্ব্যবহারের আনন্দটুকু পেতে চায়। সায়েবরা নিজেদের হাতে টাকা-পয়সা রাখার কষ্ট করত না। তার দায়িত্ব থাকত সরকারের ওপর। মনিবের যে অর্থব্যয় হত, তার ওপর দস্তুরি ছিল তার প্রাপ্য। সুতরাং মনিবের যত বেশি অর্থক্ষয়, সরকারের তত বেশি অর্থলাভ। দস্তুরির হার ছিল বেশ চড়া। টাকায় তিন আনা। ফ্যানি পার্কস লিখেছেন, ‘একদিন সকালে আমাদের সরকার যেসব জিনিসপত্র কিনে আনল, আমি লক্ষ করলাম, সেগুলোর দাম বড্ড বেশি। সে কথা বলতেই সে বলল, ‘আপনি আমার মা-বাপ। আমি আপনাদের গরিব সন্তান। আমি শুধুমাত্র টাকায় তিন আনা দস্তুরি নিয়েছি।’৫১

সরকার ছিল সায়েবদের কাছে প্রয়োজনীয় ক্ষতিকারক কর্মচারী। শ্রীমতী এমা রবার্টস তাদের সম্পর্কে লিখেছেন, কোম্পানির অর্ধেক কর্মচারীর সর্বনাশের মূলে ছিল এই সরকাররা। তারা ছিল মনিবের অপচিতির উৎসাহদাতা। বেপরোয়া খরচ করার জন্য তারা সায়েবদের জন্য যে কোনও অঙ্কের ঋণের ব্যবস্থা করে দিত।৫২ অবশ্য সেই সঙ্গে একথাও স্বীকার করেছেন যে, অনেক সরকারই সততার সঙ্গে উপার্জন করত। তাঁর মনে হয়েছে, তাদের প্রশংসা না করা অন্যায়, অকৃতজ্ঞতা। তারা যে মূল্যে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে আনত, তা কোনও সায়েবের পক্ষে সম্ভব হত না।৫৩ সে সময় কোনও সায়েবের পক্ষে এদেশে যথেষ্ট আরাম ও স্বস্তি পাওয়া সম্ভব ছিল না, যদি সে এখানকার রীতি-রেওয়াজের সঙ্গে আপস করতে ব্যর্থ হত।

ভৃত্য ছাড়াও সায়েবদের বিলাসিতার আর একটা উপকরণ ছিল ক্রীতদাস-দাসী। (আঠারো শতকে ক্রীতদাস প্রথা নিষিদ্ধ ছিল না) স্যার উইলিয়ম জোন্স ১৭৮৫ সালে মন্তব্য করেছিলেন, ‘Hardly a man or woman exists… who hath not at least one slave child.’৫৩ক কলকাতয় এই প্রথার জনপ্রিয়তার পেছনে একটা অর্থনৈতিক কারণ থাকতে পারে। ভৃত্য-দাই-আয়াদের জন্য প্রতি মাসে নগদ টাকা গুনতে হত বেতন দিতে গিয়ে। কিন্তু ১৬ টাকায় একজন ক্রীতদাসী কিনে নিলে প্রতি মাসে তার বেতনের জন্য কোনও খরচ ছিল না। কলকাতায় ক্যাথলিকদের মধ্যে ক্রীতদাস-দাসী রাখার চল ছিল বেশি। প্রোটেস্টান্ট পরিবারেও তাদের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। বস্তুত, দাসপ্রথা ছিল; ‘indispensable condition of luxurious living.’৫৪

সায়েবদের সুরা-বিলাস:

আঠারো-উনিশ শতকে কলকাতার অধিকাংশ সায়েবের জীবনচর্যায় ছিল বোহেমিয়ান প্রভাব। ‘খাও-দাও ফুর্তি করো’, এই জীবন দর্শন কিন্তু তাদের এক অদ্ভুত মানসিক অবসাদের গভীরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল এই বিদেশভুঁই-এ। এর কারণ ছিল কর্মশূন্যতা। ফলে দীর্ঘ অবকাশ। বিশেষ করে কোম্পানির কর্মচারীদের ওপর সে সময় কাজের চাপ ছিল সামান্য। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কর্তব্য কর্ম শেষ হয়ে যেত। জেমস লঙ্‌ লিখেছেন, তাদের অবাধ অবসরের বহর দেখে লর্ড বেন্টিঙ্ক বিস্মিত না হয়ে পারেননি।৫৫ কলকাতার জীবন তখন নিস্তরঙ্গ। কোনও রাজনৈতিক উত্তেজনা নেই, খাওয়ার টেবিলে জমিয়ে আড্ডা দেওয়ার মতো লোক নেই, বিষয় নেই। সদ্য প্রকাশিত কোনও সুখপাঠ্য উপন্যাস নেই। পার্টি ও বল ছাড়া সামাজিক অনুষ্ঠান নেই। এমনিতেই ইংরেজরা আলাপবিমুখ। তাই নতুন কারওর সম্পর্কে কৌতূহল নেই। অফুরন্ত অবসর। অথচ তা কাটাবার মতো কোনও ইতিবাচক মাধ্যম নেই। ইউরোপের খবর বয়ে আনত জাহাজগুলো। তা-ও কেবল শীতকালে। আর সেসব ছ’মাসের বাসি খবর। আঠারো শতকের আশির দশকেও কলকাতায় কয়েকজন মাত্র মেমসায়েব। সেটাই পরিচালক সমিতির কাছে যথেষ্ট মনে হয়েছিল। স্বাভাবিক ভাবেই নারীসঙ্গের অভাব ছিল যুব সিভিলিয়নদের হতাশার কারণ। এদেশের প্রবাস জীবনকে মনে হত নির্বাসিত জীবন। মেকলে না লিখে পারেননি, ‘…banishment is no light matter. A complete revolution in all habits of life…’৫৬

সে সময় লন্ডন ও কলকাতার মাঝে ছিল ছ’ মাসের সমুদ্র পথ। এই দীর্ঘ সমুদ্রপথ পাড়ি দেওয়া কম ঝুঁকির ব্যাপার ছিল না— জাহাজ ডুবি, জলদস্যুর দাপাদাপি, তাদের হাতে কিংবা অন্য শত্রু পক্ষের হাতে বন্দি হওয়ার আশঙ্কা, আরও কত কী। শ্রীমতী ফে তো একবার বাংলায় আসার পথে হায়দার আলির হাতে বন্দি হয়েছিলেন। এলিজা ইম্পে ১৭৮৩ সালে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে স্বদেশে ফিরছিলেন। পথে জাহাজ ফুটো হয়ে যায়। মৃত্যু হয় জাহাজের ক্যাপ্টনের। পরে সেন্ট হেলেনা থেকে হাজার পাউন্ড খরচ করে অন্য জাহাজে লন্ডনে ফেরেন। এই বিবিধ বাধার জন্য আক্ষরিক অর্থে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় কলকাতার সায়েবদের প্রবাস জীবন। এই নির্বাসিত জীবনে নিঃসঙ্গতা কাটাতে তারা ডুব দিয়েছিল দেশীয় ভোগ-বিলাসে।৫৭

এই অবস্থার অনিবার্য পরিণাম অমিতাচারিতা, অপরিমিত মদ্যপান। একাকিত্ব, একঘেয়েমি ঘোচানোর সহজ পথ। যে সব সায়েব মদের বদলে জল পান করত অধিকাংশের চোখে হেয় হয়ে তাদের অবস্থা হত জাত হারানোর মতো। মনে করা হত, তারা খাঁটি ইংরেজ নয়, মিশেল, হাফকাস্ট। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান কেবল টাকার থলিতেই থাবা মারত না, কলকাতার উষ্ণ-আর্দ্র জলবায়ুর প্রভাবে শরীর-স্বাস্থ্য হয়ে উঠত নড়বড়ে। কোম্পানির অ্যাসিসটেন্ট সার্জেন ফ্রান্সিস রানডেল-এর কথা বলতে গিয়ে উইলিয়ম হিকি লিখেছেন, ‘আমি কয়েকবারই লক্ষ করেছি, তিনি আশি সিক্কা টাকা দিয়ে এক ডজন শ্যাম্পেনের বোতল কিনেছেন। অনেকদিন ধরে এই নেশায় বুঁদ হয়ে থাকার অভ্যেসের ফলে তিনি চট করে মাতাল হতেন না। শুধু তাই নয়, ছোকরা সায়েবদেরও দরাজ হাতে মদ গেলাতেন। এজন্য সমাজে তিনি ছিলেন খুব জনপ্রিয়।৫৮ লর্ড কর্নওয়ালিশ যথেষ্ট সুরাপায়ী ছিলেন বলে মনে হয়। ডিনারের শেষে অতিথিরা টেবিল ঘিরে বসত। তাদের হাতে হাতে ঘুরত মদের বোতল। কেউ কোনও কারণে বোতলের ছিপি লাগাতে ভুলে গেলে কর্নওয়ালিশ বিরক্ত হতেন। বলতেন, ‘ছিঃ, অন্যের হাতে বোতল দেওয়ার আগে ছিপি লাগাতে ভুলে গেলেন কী করে!’৫৯

১৮০৩ সালে প্রেসটার (Prester) লিখেছিলেন, ডিনার খাওয়ার পর কেউ কেউ এত বেশি পরিমাণ ক্লারেট গিলত যে, মহিলাদের সঙ্গে আর নাচে অংশ গ্রহণ করতে পারত না। সে সব অতিথি গৃহকর্তার বাংলোয় সে রাত কাটিয়ে দিত মেঝে অথবা শোফায় গড়াগড়ি দিয়ে।৬০ Hartly House-এর লেখিকা জানিয়েছেন, পেটপুরে খেয়ে এবং আকণ্ঠ পোর্টার পান করে কেউ কেউ বিছানায় পড়ে থাকত দরজা-জানলা খুলে দিয়ে। দেহ থেকে বেরিয়ে যেত ঘামের স্রোত। উত্তর-পশ্চিমের শীতল বাতাসে সে ঘাম শুকিয়ে গেলে পরিণাম হত মারাত্মক। দেখা দিত ‘পাক্কা’ জ্বর, যাতে মৃত্যু হত ছ’ ঘণ্টার মধ্যে। এই অবস্থার শিকার হত সাধারণত মোটাসোটা ভুঁড়িওয়ালা মানুষগুলো। যে মানুষটার সঙ্গে তার সঙ্গীরা ডিনার করত, সাপারের আগেই তাদের যোগ দিতে হত তার শবযাত্রায়।৬১

নিচু তলার সায়েবরা, বিশেষ করে গোরা সেপাইরা সস্তার আরকের নেশা করলেও, উঁচুতলার সায়েবদের জন্য খানদানি মদ আমদানি করা হত বিদেশ থেকে। ১৭৮৪-র ৯ সেপ্টেম্বর ‘Monte de Carmo’ নামে যে জাহাজটা লন্ডন থেকে কলকাতায় আসে, তাতে ছিল উনিশ রকমের সুরা।৬২ সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, French claret, Madeira, Port, Real French wine এবং Brandy. সায়েবদের পছন্দের পানীয় ছিল মদিরা এবং ক্লারেট বা লাল শরাব। পত্রিকায় ফলাও করে বিজ্ঞাপন দিত কলকাতার সায়েব দোকানগুলো। Calcutta Gazette-এ এমনই একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে ১৭৮৪ সালে। শিরোনাম, Madeira Wines. তাতে লেখা ছিল, ‘Dring and Company’ inform the public, that they have a very General and Extensive stock of Genuine Madeira Wine which they recommend to their Friends and Customers, at the undermentioned Moderate Prices— Picked London particular, of remarkable fine flavour, Nine years old, per pipe— S. R. 900.’৬৩

পোর্ট এবং শেরি গ্রীষ্মকালে টেবিলের ওপর খুব একটা উপস্থিত থাকত না। ফ্যানি পার্কস মনে করেন মদিরা খুব একটা পান করা হত না।৬৪ মদিরার স্বল্প ব্যবহারের কারণ সম্ভবত পছন্দ-অপছন্দের প্রশ্ন নয়। আসলে এই পানীয় ছিল মহার্ঘ। সাধারণভাবে কোনও অভিজাত পানীয় বোঝাতে ‘মদিরা’ শব্দটা ব্যবহার করা হলেও, এটা একটা বিশেষ ধরনের উঁচু জাতের পানীয়। এর একটা ছোট ইতিহাস আছে।

‘মদিরা’ আসলে তিনটে দ্বীপের সমষ্টি নিয়ে একটা দ্বীপের নাম। তিনটে দ্বীপ হল, Porto Sancto, Desertas এবং Madeira। আফ্রিকার উত্তর-পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগরে এর অবস্থান। আঙুর এখানকার প্রধান ফসল, তা থেকে উৎকৃষ্ট মদ, মদিরার উৎপাদন। ১৮০৭-এ ইংরেজরা এই দ্বীপ অধিকার করে নেয়।৬৫ এমন দামি মদ সেনাদের জোগানো সম্ভব ছিল না বলে কোম্পানি ‘রাম’ প্রস্তুত করে সেনাদের জোগান দেওয়ার পরিকল্পনা করে।৬৬

সায়েবদের পছন্দের তালিকায় ক্লারেট প্রথম ছিল বলে কেউ কেউ মনে করেন। ক্লারেট ছিল দু’ রকমের। একটার নাম ছিল ‘ইংলিশ ক্লারেট’। সেটা তৈরি হত ফ্রান্সে। কিন্তু ইংল্যান্ডে আমদানির পর তাতে ব্রান্ডি এবং অন্য পানীয় মেশানো হত ভারতের মতো গরম দেশের উপযোগী করে। অন্য ক্লারেটটি তৈরি হত খুব উৎকৃষ্ট আঙুর থেকে। মদিরা আঠারো শতকে খুব দামি মদের তালিকাভুক্ত ছিল। উনিশ শতকে এর দাম পড়ে যায়।৬৭ আঠারো শতকের প্রথম দিকে আর একটা পানীয় ছিল সায়েবদের বিশেষ পছন্দের। নাম ‘বার্নট্‌ ওয়াইন’। বিলিতি, ফরাসি অথবা ডেনিস ক্লারেটের সঙ্গে দারচিনি, লবঙ্গ ও অন্যান্য মশলা মিশিয়ে ফোটানো হত এই পানীয়। আর একটা স্বল্পপরিচিত মদ ছিল। নাম, ‘শেরি’। বেশ মিষ্টি। দুধের মতো সুস্বাদু। তবে বেশ জোরাল। এটা পান করলে দেহে এমন দহন সৃষ্টি হত যে, সে দহন দমন করার মতো কোনও উপায় খুঁজে না পেয়ে সারারাত পড়ে থাকতে হত খোলা আকাশের নীচে।৬৮ মদিরা বা ক্লারেটের মূল্য যত চড়াই হোক, তা নিয়ে হেলদোল ছিল না উঁচুতলার সায়েবদের। প্রতিদিন ডিনারের পর একজন সায়েবের তিন বোতল ক্লারেন্ট পান করা ছিল খুব সাধারণ ব্যাপার। তা ছাড়া ছিল মদিরা। মেমসায়েবরাও সুরাপানে খুব একটা পিছিয়ে থাকত না। দিনে এক বোতল তো প্রয়োজন হতই। ক্লারেটের বোতলগুলো নিঃশেষ করে চলে যাওয়ার আগে সায়েবরা তাদের শৌর্যের প্রতীক হিসেবে ট্রফির মতো সাজিয়ে রাখত টেবিলের ওপর।৬৯ থোমাস উইলিয়মসন-এর দেওয়া এক ফিরিস্তি থেকে উনিশ শতকের প্রথম দিকে কলকাতার সায়েবমেমদের মদ্যপানের বহরটা অনুমান করতে অসুবিধে হয় না। সে সময় কলকাতায় বছরে বিক্রি হত প্রায় চার হাজার পিপে মদিরা। তাছাড়া, আমদানি করা হত দশ হাজার গ্যালন ব্রান্ডি, হল্যান্ডের রাম এবং অন্যান্য পানীয়।৬৯ক

ফিলিপ ফ্রান্সিস সুরা সেবনে সংযত ছিলেন। কিন্তু তাঁর অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য সুরার যে এলাহি ব্যবস্থা করতেন, তা তাঁর Wine Book থেকে জানা যায়। তাতে দেখা যায়, ফ্রান্সিস অতিথি আপ্যায়নের জন্য একমাসে পঁচাত্তর বোতল মদিরা, নিরানব্বই বোতল ক্লারেট, চুয়াত্তর বোতল পোর্টার, ষোলো বোতল রাম, তিন বোতল ব্রান্ডি এবং এক বোতল চেরি ব্রান্ডির ব্যবস্থা রাখতেন। সব মিলে ২৬৮ বোতল।৭০ অনুমান করা কঠিন, এই বিপুল পরিমাণ সুরার আয়োজন করতে কী বিশাল অঙ্কের অর্থের শ্রাদ্ধ হত।

বিলেতের কর্মকর্তাদের কাছে কলকাতার সায়েবদের সায়েবিয়ানার বাড়াবাড়ির কথা গোপন ছিল না। তাঁরা উদ্বিগ্ন ছিলেন। ১৭৫৫ থেকে চিঠি পাঠিয়ে কলকাতার কাউন্সিলকে সতর্ক করতে থাকেন। তেমন সুফল না পাওয়ায় ১৭৬৭ সালে তাঁরা বাধ্য হন সিভিলিয়নদের আচরণের নিন্দা করে তার সম্পূর্ণ পরিবর্তনের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে।৭১ লর্ড ভ্যালেনসিয়া সিভিলিয়নদের বিশাল বৈভব প্রদর্শনের পক্ষে সওয়াল করেছেন এই যুক্তিতে যে, ভারতে ব্রিটিশ আধিপত্য সুসংহত করার জন্য এটার প্রয়োজন ছিল। তিনি মনে করেন, যারা এই অমিতব্যয়িতার সমালোচনা করেন, তাঁরা এশিয়ায় ইউরোপীয় অর্থনীতির ধারণায় চালিত। কিন্তু খেয়াল রাখা দরকার, ভারত জাঁকজমক ও বিলাসিতার দেশ। শক্তিশালী সাম্রাজ্যের শীর্ষে যাঁরা আছেন, তাঁদের উচিত যে দেশকে শাসন করছেন, সেই দেশের ভাবনাকে স্বীকৃতি দেওয়া। সে সময় ভারতীয়রা মোগল রাজপুরুষদের জাঁকজমক, বৈভব, বিলাসিতাকে সার্বভৌম শাসকের প্রতীক বলে মনে করত। শুধু গভর্নর জেনারেল নয়, কোম্পানির সিভিলিয়ন, যারা মোগল এলিটের উত্তরসূরি, তাদেরও উচিত ভৃত্য পরিবৃত হয়ে আভিজাত্য প্রকাশ করা।৭২

ওপরতলার সায়েবদের বিলাসিতার বহর দেখে বাসনা জাগত ছোট সায়েবদের মনেও। কিন্তু তাদের সংগতি ছিল সীমিত। তাই বাসনা তৃপ্তির জন্য অপরিণামদর্শীর মতো বেহিসেবি ঋণ করতে দ্বিধা করত না। দু’শো বা হাজার টাকার মাস মাইনের সার্জেন কিংবা ক্যাপ্টেনও জীবন ভোগের বাসনায় ঋণ করার অভ্যেস থেকে মুক্ত ছিল না। উনিশ শতকের তিরিশের দশকের মধ্যে একজন মাঝারি মাপের ইংরেজ তনয়েরও শাসক জাতির লোক হওয়ার অহংকার জুড়ে বসেছিল তার মনের পরতে পরতে। ঋণ করার পেছনে যুক্তি ছিল, ‘আমি ইউরোপের আনন্দ উল্লাস, পারিবারিক সুখ-আকর্ষণ পেছনে ফেলে রেখে বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে এই হতচ্ছাড়া দেশে এসেছি। তাই চমৎকার খাদ্য-পানীয়, ভাল পোশাক, ঘরবাড়ি, গাড়ি-ঘোড়া সব কিছু ভোগ করার অধিকার আমার আছে। আমার বেতন যথেষ্ট না হলেও ধার-দেনা করেও এসব কিছু পেতে চাই। তাতে আমার কপালে যা ঘটে ঘটুক।’৭৩ বস্তুত, মদ ও অন্যান্য বাড়তি বিলাসিতা বাদ দিলে একজন সায়েবের দিন গুজরানের জন্য যা খরচ হত, তা একজন আহেলার খরচের থেকে বেশি ছিল না।৭৪

সায়েবদের এই হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ধার-দেনা করার প্রবণতাকে উসকে দিত তাদের সরকাররা। De Grandpre লিখেছেন, ‘যে যুবকটি লন্ডন থেকে শূন্য পকেটে এদেশে এসে পৌঁছত, দেখা যেত চব্বিশ ঘণ্টা না পেরোতেই সে টাকার সাগরে সাঁতার কাটছে। এদেশের মাটিতে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকার টাকার থলি উপুড় করে ঢেলে দিত তার হাতে। অমনি ভোজবাজির মতো তার নাগালে চলে আসত তার পালকি, ঘোড়া, চাকর-বাকর, রাঁধুনি— সব। সরকাররা জানত, এই সব অজানা-অচেনা সায়েব খুব শিগগির একটা ভাল সুযোগ পাবে এবং তাদের টাকা শোধ করে দেবে। অবশ্য ঝুঁকি ছিল একটা। যদি সায়েব হঠাৎ মরে যেত! কিন্তু বেঁচে থাকলে ফিরে যেত সরকারের কপাল।৭৫ পরিচালক সমিতিও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল রাইটারদের ঋণ করার প্রবণতার সংবাদে। ১৮১১-র ২২ মে এক চিঠিতে তারা কলকাতার কাউন্সিলকে নির্দেশ দেয়, তারা যেন এই মর্মেএকটা বিজ্ঞপ্তি জারি করে যে, পরিশোধ করার ক্ষমতা নেই এমন রাইটার ঋণ করলে তাকে দায়িত্বপূর্ণ পদের অযোগ্য বলে বিবেচনা করা হবে।৭৫ক

ঋণ শোধ করতে না পারার জন্য আদালতে সায়েবদের বিরুদ্ধে নালিশের নথিও মেলে। জনৈক সায়েব ১৭৯৫ সালে জেলে ঢুকেছিল। এক আধ বছর নয়। আঠারো বছর জেলে কাটিয়েছিলেন দেনা শোধ করতে না পারার অপরাধে।৭৬

পরিচালক সমিতি, তাদের কর্মচারীদের বিলাসিতায় রাশ টানতে চেয়েছিল একটা অর্থনৈতিক কারণে। ১৭৫৮ সালে তারা কাউন্সিলকে এক চিঠিতে বিস্ময় প্রকাশ করে লিখেছিল, যেখানে ব্যাবসা-বাণিজ্যের এমন উজ্জ্বল সম্ভাবনা এবং সুযোগ, সেখানে কোম্পানির লাভের হার এত কম কেন! তাদের বুঝতে অসুবিধে হয়নি, এর মূল কারণ কর্মচারীদের বেলাগাম বিলাসিতা, অতিরিক্ত অমিতব্যয়িতা এবং আলস্য।৭৭ ব্যাপারটা ক্লাইভের নজরেও এসেছিল। তিনিও চেষ্টা করেছিলেন কর্মচারীদের বিলাসিতায় রাশ টানতে। তাঁর আশঙ্কা ছিল, ‘বাংলায় আমাদের এই প্রবণতা যদি চলতেই থাকে, এই উপনিবেশ বেশিদিন টিকবে না।’৭৮

সায়েবদের এই বিলাসিতা এবং বেহিসেবি খরচে ভাটা পড়ে উনিশ শতকের তিরিশের দশক থেকে। বণিক সংস্থাগুলোর আর্থিক বিপর্যয় কলকাতার ফ্যাশন দুনিয়ায় বিপ্লব ঘটিয়ে দেয়। জীবনচর্যা থেকে উবে যায় পূর্বের ঠাট-বাট। কয়েক বছর আগেও বিদেশি পর্যটকরা কলকাতার সায়েবদের জীবনে বিলাস-ব্যসনের যে উগ্রতা পরখ করেছিলেন, তা নমনীয় রূপ ধারণ করে। তারা বাধ্য হয় বিলাসের বাহুল্য কমাতে।৭৯

সায়েবদের সায়েবিয়ানার একটা বড় বৈশিষ্ট্য হল প্রাচ্যের অনুকরণ। আঠারো শতকে কলকাতার অনেক হোমরা-চোমরা সায়েব শহরের ধনী, অভিজাত পরিবারের বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হতেন। ফলে ধনী বাবু সমাজের দিশি বিলাসিতা এবং জীবনচর্যার কোনও কোনও ধরনধারণের দ্বারা প্রভাবিত হতেন অতিমাত্রায়। সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত হল, হুঁকোবিলাস। কলকাতার ধনী অভিজাতদের মধ্যে এর রেওয়াজ থাকলেও গোটা সায়েব সমাজ হুঁকোর দাস হয়ে পড়েছিল।৮০ হুঁকোর ছিলিম এমন সুগন্ধি-তামাক দিয়ে সাজা হত যে, সায়েব সেই সুগন্ধের প্রবল আকর্ষণ এড়াতে না পেরে মশারির ভেতর শুয়ে শুয়েও গড়গড়ার নলে টান দিত। হুঁকোর ধূমপান ছিল ব্যয় সাপেক্ষ বিলাসিতা। সপ্তাহে এক গিনি খরচ হত। এরজন্য প্রয়োজন হত একজন হুঁকোবরদারের, যার কাজ ছিল হুঁকো সাজার দায়িত্ব সামলানো। তার বেতন ছিল মাসে আট টাকা। উপার্জন এবং জাঁকজমক বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হুঁকো টানা ফ্যাসনের অবিচ্ছিন্ন অংশ হয়ে দাঁড়ায়। সময়ের পরিবর্তন এবং নবাগত সায়েবদের বিলিতি রুচির প্রসার ঘটলেও হুঁকো টানার আমেজ তাদের আবিষ্ট করে রেখেছিল দীর্ঘদিন, উনিশ শতকের মধ্যভাগেও।

প্রত্যেক সায়েবের ব্যক্তিগত হুঁকোবরদার ছিল। কোনও সায়েব পার্টি দিলে অতিথিরা ব্যক্তিগত খিদমৎগারদের সঙ্গে হুঁকোবরদারদেরও সঙ্গে আনত। ডিনারের শেষে পাশের ঘরে ছিলিম তৈরি করে তারা একসঙ্গে ঢুকত ডিনার হলে। আধঘণ্টা ধরে চলত অন্তত তিরিশজনের মুখে গুড়গুড় শব্দের কোরাস। সে শব্দ এমন প্রবল হয়ে উঠত যে, ঘরে অন্য কথা অসহায় বোধ করত। গোটা ঘর হয়ে যেত ধূমায়িত। এই পরিবেশে যদি কোনও অতিথির সঙ্গে হুঁকো এবং হুঁকোবরদার না থাকত, তার অস্বস্তির সীমা থাকত না। শুধু সায়েবরা নয়, মেমসায়েবরাও মজেছিল এই নেশায়। কোনও সায়েব নিজের গড়গড়ার নলের মুখটা খুলে নিয়ে কোনও মেমসায়েবকে প্রদান করলে সেটা হত সবচেয়ে সৌজন্যমূলক আচরণ। এই সৌজন্যবোধটা কিন্তু খুব তুচ্ছ ব্যাপার ছিল না।

তবে এ প্রসঙ্গে একটা কথা উল্লেখযোগ্য। হুঁকোবিলাস কলকাতার সায়েব সমাজে ব্যাপকভাবে চালু থাকা সত্ত্বেও এমন কয়েকজন ব্যক্তি ছিলেন যাঁরা ধূমপানের বাড়াবাড়ি পছন্দ করতেন না। উইলিয়ম হিকি তাঁদের মধ্যে একজন। তিনি লিখেছেন, ‘খুব সুন্দর করে একটা চমৎকার হুঁকো আমার জন্য সাজা হয়েছিল। আমি তার নলটা মুখে দিয়ে টানার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার ভাল লাগল না। সেটা লক্ষ করে আমার বন্ধু রবার্ট বেশ মজা পেল। আমি গম্ভীর হয়ে তাকে জিগ্যেস করলাম, “কেন আমার ধূমপায়ী হওয়াটা কি খুব জরুরি?” বন্ধুটি আমার মতো গাম্ভীর্য নিয়ে, উত্তর দিল, “নিঃসন্দেহে। কারণ, তা না হলে তুমি এই ফ্যাশনের দুনিয়া থেকে নির্বাসিত হবে। এখানে সকলেই হুঁকো ব্যবহার করে, হুঁকো ছাড়া চলা যায় না।”৮১ গসলিংও স্বীকার করেছেন, হুঁকোর রেওয়াজ যথেষ্ট থাকলেও, অনেক সায়েবই কখনও ধূমপান করত না। তিনি নিজেই হুঁকোকে নির্বাসন দিয়েছিলেন। একবার তার স্বাদ নিয়ে বিস্বাদ ঠেকায় আর কখনও ওমুখো হননি।৮২

সায়েবদের সায়েবিয়ানার আর একটা বিষয় ছিল পালকিবিলাস। সে সময় অবশ্য কলকাতায় পালকি চড়াকে খুব একটা বিলাসের অঙ্গ মনে করা হত না। কারণ, অন্তত আঠারো শতক এবং উনিশ শতকের প্রথম দিকেও কলকাতায় অপরিহার্য পরিবহণ বলতে বোঝাত একমাত্র পালকি। কিন্তু সায়েবরা একে বিলাসের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। কোনও সায়েব পায়ে হেঁটে কোথাও যাচ্ছে, এ দৃশ্য কল্পনা করা যেত না, সামান্য দূরত্ব হলেও। এর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল মান-সম্মানের প্রশ্ন। এমনকী, মনে করা হত সে জাত-সায়েব নয়।৮৩ হেনরি মোজেস লিখেছেন, প্রতি বছর পালকি ভাড়ায় যে কী পরিমাণ টাকা খরচ হত, তা ভাবা যায় না। এর পেছনে দুটো কারণ ছিল। কেউ এটা ভাবতে ভয় পেত যে, সে গরিব। অনেকের একটুখানি পথ হেঁটে যেতে অহংকারে আঘাত লাগত। হেনরি মোজেস একজন সায়েবের কথা উল্লেখ করেছেন, যার মাসিক বেতন ছিল আশি টাকা। তথাপি তার বাড়ি থেকে আধ মাইল দূরে কর্মস্থলে যাওয়া-আসার জন্য পালকির পেছনে খরচ হত মাসে কুড়ি টাকা।৮৪

যে স্বাচ্ছন্দ্য, বিলাসিতা ও জাঁকজমকের সঙ্গে কোম্পানির আমলে একজন সায়েব কলকাতায় জীবন কাটাত, স্বদেশে ফিরে যাওয়ার পরও সেই সুখস্মৃতি তার চিত্তকে দোলা না দিয়ে পারত না। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলত অতীতকে স্মরণ করে। সেই আরামে পরমসুখে পালকিতে চড়া, তার ভেতর অলসভঙ্গিমায় অর্ধশায়িত অবস্থায় একটা বই হাতে নিয়ে যেতে যেতে দোলন উপভোগ করা, কোথাও দু’পা যাওয়ার সময় মাথার ওপর ভৃত্যের রেশমি ছাতা ধরা, পালকির আগে আগে চলা চোবদারের রুপো বাঁধানো লাঠির ডগায় বাঁধা ঘণ্টার মিষ্টি মৃদুধ্বনি, আলবোলার তামাকের সুগন্ধ— এ সবের স্মৃতি পাক খেত তার মনে।৮৫ সায়েব হয়তো উন্মনা হয়ে পড়ত কিছুক্ষণের জন্য।

সূত্রনির্দেশ

১. P. J. Marshall, The white Town of Calcutta under the Rule of the East India Company. (Modern Asian studies, Vol. 34, Part I, February 2000, p. 312.

২. Percival Spear, The Nabobs, A Study of the Social Life of the English in Eighteenth Century India, London (1980) p. 23.

৩. তদেব, p. 28।

৪. রজতকান্ত রায়, পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ, কলকাতা (১৯৯৮) পৃ. ২২৮।

৫. P. J. Marshall, East Indian Fortunes, The British in Bengal in the Eighteenth Century, Oxford (1976) pp. 236-37.

৬. বিনয় ঘোষ, কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত (সুতানুটি সমাচার), কলকাতা, (১৯৭৫), পৃ. ৪৪৩।

৭. James Long, Selection from Unpublished Records of Government, M Saha (ed.), Calcutta (1973), p. XXXIX.

৮. W. H. Carey, The Good Old Days of Honourable John Company, Nisith Ranjan Ray (ed.), Calcutta (1980), P. 34. (প্রথম প্রকাশ ১৮৮২)

৯. Percival Spear, প্রাগুক্ত, p. 37.

১০. গ্রন্থটির রচনাকারীর নাম জানা যায় না। তবে গ্রন্থটি পড়লে অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে, কোনও মহিলাই গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন।

১১. Hartly House Calcutta, 1789-এর সংস্করণের পুনর্মুদ্রণ, Calcutta (1908), p. 122.

১২. তদেব, পৃ. 133.

১৩. W. H. Carey, প্রাগুক্ত, p. 106.

১৪. Hartly House, p.11.

১৫. P. J. Marshall, The White Town of Calcutta under the Rule of the East India Company. (Modern Asian Studies, vol. 34, Part I, February 2000) p. 313.

১৬. তদেব, p. 312.

১৭. তদেব, p. 313.

১৮. Robert Rouiere Pearce, Memoirs and Correspondence of the most noble Richard Marquess Wellesley, vol. 2, Delhi (1989) p. 283.

১৯. P. J. Marshall, The White Town, p. 313.

২০. J. P. Losty, Calcutta City of Palaces, London (1990) p. 88.

২১. P. T. Nair (ed.), British Social Life in Ancient Calcutta, 1750-1850, Calcutta (1983), p. 89.

২২. Rudrangshu Mukherjee, British Life in Old Calcutta, (Sukanta Chaudhuri (ed.), Calcutta, the Living City. vol. 1, Calcutta (1990) P. 47.

২৩. Parlby, Fanny (Parks), Wanderings of a Pilgrim, vol. 1, London (1850), p. 24.

২৪. Percival Spear, প্রাগুক্ত, pp. 53-54.

২৫. তদেব, p. 12, pp. 53-54.

২৬. Englishman থেকে উদ্ধৃত (Bengal Past and Present), Vol. XXVIII, 1924, p. 137.

২৭. Rudrangshu Mukherjee, প্রাগুক্ত।

২৮. P. J. Marshall, British Sociery and the East India Company. (Modern Asian Studies, vol. 31, No. 1, 1997, p. 99).

২৯. Calcutta Review, May-August, 1844, p. 304.

৩০. তদেব।

৩১. Edmund Burke, A Letter to Philip Francis, London (1788), p. 10.

৩২. T. O. D. Dunn, The Memories of William Hickey. (Bengal Past and Present, vol. XXVI, 1923, p. 28).

৩৩. Percival Spear, প্রাগুক্ত, p. 96.

৩৪. তদেব।

৩৫. E. M. Collingham, Imperial Bodies, Malden, USA, (2001) p. 13.

৩৬. Rudrangshu Mukherjee, প্রাগুক্ত।

৩৭. Partby, Fanny (Parks), প্রাগুক্ত, p. 21.

৩৮. Ketaki Kushari Dyson, A Various Universe, New Delhi (2006), p. 60.

৩৯. Thomas Williamson, The East India Vade-Mecum, vol. I, London (1810) pp. 186-87.

৪০. E.M. Collingham, প্রাগুক্ত, p. 18.

৪১. William Huggins, Sketches in India (P.T. Nair (ed.), Calcutta in the 19th Century, Calcutta (1989), p. 447.

৪২. Fanny (Parks) প্রাগুক্ত, p. 46.

৪৩. P.T. Nair, প্রাগুক্ত, p. 609.

৪৪. Rudrangshu Mukherjee. প্রাগুক্ত।

৪৫. R. V. Vernede (ed.), British Life in India, New Delhi, (1995), p. 98.

৪৬. E. M. Collingham, প্রাগুক্ত, p. 18.

৪৭. তদেব।

৪৮. Emma Roberts, Scenes and Characteristics of Hindostan with Sketches of Anglo-Indian Society, vol. I, London (1835), p. 9.

৪৯. H.E.A Cotton, Calcutta Old and New, N.R. Ray (ed.), Calcutta (1980), p. 70.

৫০. Bengal Past and Present, vol. XXVIII (1924) p. 138. ১৭৮৫ সালে কলকাতায় টানা পাখার উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে এই পাখার ব্যবহার ১৮৩০-এর দশকের আগে ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হত না।

৫১. Fanny Parks, প্রাগুক্ত, p. 22.

৫২. Emma Roberts, প্রাগুক্ত, p. 5.

৫৩. তদেব, pp. 5-6.

৫৪. Syud Hossain, Slavery Days in Old Calcutta, (Bengal Past and Present, vol. 109, 1990, p. 61).

৫৫. Abhijit Dutta, Glimpses of European life in 19th Century Bangal, Calcutta (1995), p. 6.

৫৬. Suresh Chandra Ghosh, The Social Condition of the British Community in Bengal, Leiden (1970), P. 72.

৫৭. Kathleen Blechynden, Calcutta: Past and Present, New Delhi (2003) pp.-125-26.

৫৮. T.O.D. Dunn, The Memoirs of William Hickey, Bengal Past and Present, Vol. XXVI, 1923, p. 28.

৫৯. তদেব।

৬০. Douglas Dewar, In the days of the Company, London (1920), p. 40.

৬১. তদেব, P. 41.

৬২. Seton Karr, W.S. Selections from Calcutta Gazette, vol. I, Calcutta (1864), p. 50.

৬৩. তদেব।

৬৪. Fanny Parks, প্রাগুক্ত, p. 30.

৬৫. William Milburn, Oriental Commerce, London (1825), pp. 1-8.

৬৬. Nikhil Sur, The Mirjapur Distillery, and the Company’s Trade in Rum, (The Calcutta Historical Journal, vol. IV, No 1, July-December, 1979.

৬৭. Thomas Williamson, প্রাগুক্ত, vol. II, p. 119.

৬৮. Percival Spear, প্রাগুক্ত, p. 18.

৬৯. Hartly House, প্রাগুক্ত, p. 36.

৬৯ক. Thomas Williamson, প্রাগুক্ত, vol. 1, pp. 152-3.

৭০. William Dalrymple, White Mughals, Gurgaon, (2004), p. 407.

৭১. Basanta Kumar Basu, Social Life in Eightteenth Century Calcutta (Bengal Past and Present, vol. 43, 1931, p. 129.)

৭২. E.M. Coliiinglham, প্রাগুক্ত, p. 16.

৭৩. Victor Jaquemont, Letters from India, 1829-30 (P.T. Nair, (ed.), Calcutta in the 19th Century), P. 513.

৭৪. শশীচন্দ্র দত্ত, কেরানি জীবনের রোজনামচা, কলকাতা (২০১৩), পৃ. ১৫৩।

৭৫. Douglas Dewar, প্রাগুক্ত, P. 23.

৭৫ক. Thomas Roebuck, The Annals of the College of Fort William, Calcutta (No date), p. 323.

৭৬. Letters to the Court of Directors (Judicial), 14 June, 1827.

৭৭. Long, Selection, No 285.

৭৮. তদেব, p. XXXIII.

৭৯. George Otto Trevelyan, The Life and Letters of Lord Macaulay, London (1978), p. 393.

৮০. Captain Thomas Williamson, The European in India, London (1813), Plate-X.

৮১. Peter Quennell, Memories of William Hickey, London (1975), p. 233.

৮২. তদেব।

৮৩. Henry Mozes, Sketches of India, London (1850), pp. 178-79.

৮৪. তদেব।

৮৫. R. G. Wallace, Fifteen Years in India, (P.T. Nair ed.), Calcutta in the 19th Century, p. 324.)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *