কলকাতার সায়েবদের অস্তিত্বের প্রাথমিক সংকট

কলকাতার সায়েবদের অস্তিত্বের প্রাথমিক সংকট

‘ফোর্ট উইলিয়মে এক বছর থাকার চেয়ে তিনটে ওয়াটার লু-র যুদ্ধে যাওয়া একজন সৈনিকের পক্ষে অনেক কম ঝুঁকির ব্যাপার’ বলে একসময় মন্তব্য করেছিলেন স্যার জর্জ ট্রেভেলিয়ন (Sir George Trevelyan)। কথাটা খুব মিথ্যে নয়।

যুদ্ধে গিয়ে জীবিত এবং অক্ষত হয়ে ফিরে এলে যেমন একজনকে অভিনন্দন জানানো হয়, ওইরকম একটা রীতি কলকাতার ইংরেজদের মধ্যে চালু ছিল সতেরো শতকের শেষ দশকে। প্রতি বছর ১৫ ডিসেম্বর একটা ডিনার পার্টিতে সায়েবরা জড়ো হয়ে পরস্পরকে অভিনন্দন জানাত জীবিত থাকার দুর্লভ সৌভাগ্যের জন্য। অনেক বছর চলেছিল রেওয়াজটা। সতেরো শতক কেন, উনিশ শতকেও কলকাতার প্রতিকূল জলহাওয়া নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন বিভিন্ন জন। জর্জ ক্যাম্পবেল এমনও দাবি করেছিলেন যে, প্রতিকূল জলবায়ু ও ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে পশ্চিম ভারতে নাসিকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক।

জোব চার্নক বাংলায় কোম্পানির বাণিজ্য কুঠি স্থাপনের জন্য একটা মনোমতো উপযুক্ত স্থান খুঁজছিলেন অনেকদিন ধরে। সরেজমিনে সমীক্ষা করেছিলেন হুগলি, হিজলি, ফলতা, উলুবেড়িয়া, সাঁকরাইল প্রভৃতি গঙ্গাতীরের স্থানগুলো। অনেক পোড়খাওয়া এই ইংরেজ পুরুষটি শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেন, সুতানুটি-কলকাতা হল কোম্পানির কুঠি নির্মাণ ও ইংরেজ বসতির উপযুক্ত স্থান। তাঁর সিদ্ধান্তে কোম্পানির সমসাময়িক অনেক কর্তাব্যক্তি বেজায় বেজার হয়েছিলেন। তবু তাঁকে টলানো যায়নি। মাদ্রাজের ফোর্ট জর্জ থেকে ১৬৯১-এর ২০ নভেম্বর বিলেতে পরিচালক সমিতির কাছে অভিযোগ জানানো হয় জোব চার্নক ও তাঁর সহকর্মীদের বিরুদ্ধে। তাতে লেখা হয়েছিল, ‘মৃত্যুর কারণে সুতানুটিতে মাত্র চল্লিশ জন সেনা পড়ে আছে। সুতানুটির মতো নিরাপত্তাহীন স্থান থেকে আমরা বিন্দুমাত্র উপযোগিতা আশা করি না। তা সত্ত্বেও সমস্ত যুক্তিকে অগ্রাহ্য করে তিনি (চার্নক) সেখানে বসবাস বহাল রেখেছেন।’ আলেকজান্ডার হ্যামিলটনও লিখেছিলেন, কলকাতার থেকে অধিকতর অস্বাস্থ্যকর স্থান হুগলির তীরে খুঁজে পাওয়া যাবে না। চার্নকের জবরদস্ত জেদকে টলানো যায়নি। শেষমেশ বিলেতের কর্তারাও কবুল করেন তাঁর সিদ্ধান্তকে। কলকাতার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল। তবে কলকাতার সায়েবদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছিল এর জন্য, একেবারে উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত।

আঠারো শতকে প্রায় সব সায়েবমেমদের কাছে কলকাতা ছিল একটা ভীতিপ্রদ স্থান। এই শতকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত সায়েবরা বাস করত বর্তমান বি-বা-দী বাগের চৌহদ্দির মধ্যে। সায়েবরা বলত ‘ট্যাঙ্ক স্কোয়ার’, লালদিঘির অবস্থানের জন্য। সে সময় কলকাতা তো একটা অজ গ্রাম মাত্র। ১৮১৫ সালে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া গেজেটিয়ার’-এ ওয়াল্টার হ্যামিলটন ১৭১৭ সালের কলকাতার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, তখন দশ-বারোটা কুঁড়ে ঘরের গুচ্ছ নিয়ে কয়েকটা চাষি-ঘর বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিল কলকাতায়। চাঁদপাল ঘাটের দক্ষিণে বিশাল জঙ্গল। চৌরঙ্গিও জঙ্গলে ঢাকা। পঞ্চাশ বছর পরেও ১৭৬৮ সালে চৌরঙ্গির খুব একটা উন্নতি হয়েছিল বলে মনে হয় না। ওই সময়ের চৌরঙ্গির বর্ণনা দিতে গিয়ে শ্রীমতী কিন্ডারসলি লিখেছেন, পালকির বেহারারা রাতে চৌরঙ্গিতে যাওয়ার জন্য দ্বিগুণ ভাড়া দাবি করত ডাকাতের হাতে পড়ার ভয়ে। কর্নওয়ালিশও জানিয়েছেন তাঁর সময়ে (১৭৮৬-১৭৯৩) চৌরঙ্গিতে কয়েকটা মাত্র ঘর-বাড়ি ছিল। বেশিরভাগ অংশ জঙ্গলে ঢাকা, বন্যপশুর লীলাক্ষেত্র।

সেই সময়কার কলকাতার অকল্পিত ছবি এঁকেছেন জেমস অ্যাটকিনসন (Atkinson) তাঁর কবিতায়—

‘কলকাতা! তুমি কেমন ছিলে তখন?

আশঙ্কা নিয়ে বাধ্য হয়ে থাকা,

কারণ তুমি ছিলে তেমন,

জঙ্গলে ঘেরা অনিষ্টকর জলাভূমি

অনেক সাহসী উচ্চাকাঙ্ক্ষীর ভীতি তুমি;

চারিদিকের বনস্পতিতে বাধা পেত দৃষ্টি

অস্বস্তিকর বাষ্পের আস্তরণে;

প্রচণ্ড দাবদাহে দিবাভাগে দহনের আঁচ

তারাখচিত রাতে উপচে পড়া আর্দ্রতা, বিছানায় অস্থিরতা;

সন্ধের পর্যটকেরা সকালে নিথর।

শ্রীমতী কিন্ডারসলির মনে হয়েছিল, এ শহরে শীত ছাড়া সব ঋতুই রীতিমতো দাপুটে। গ্রীষ্মে দাবদাহ, বৃষ্টি মানে বন্যা, ঝড় হলে তা হারিকেন।

এহেন কলকাতায় সায়েবদের বাস করতে হত প্রাণ হাতে করে। নেটিভ হাসপাতালের ডাক্তার জেমস রেনাল্ড মার্টিনের মনে হয়েছিল, পূর্ব ভারতে ইংরেজদের যেকোনও বন্দরের থেকে কলকাতার জলহাওয়া স্বাস্থ্যবৈরী।১০ এজন্য কোম্পানির পদস্থ কর্মচারীরা শহর থেকে দূরে বাগানবাড়িতে বাস করতেন। ক্লাইভের বাড়ি ছিল দমদমে। উইলিয়ম জোন্স থাকতেন গার্ডেনরিচে। স্যার আর চেম্বারস ভবানীপুরে, জেনারেল ডিকেনসন দক্ষিণেশ্বরে। আলিপুরে ছিল ওয়ারেন হেস্টিংসের বাগানবাড়ি, বারওয়েলের খিদিরপুরে। শ্রীমতী এলিজা ফে লিখেছিলেন, গঙ্গার ধারে গার্ডেনরিচে ছিল গাছ-গাছালি আর সবুজ লন দিয়ে সাজানো পরপর চমৎকার অট্টালিকা।১১

উঁচু তলার সায়েবদের পকেট তখন টাকা-পয়সায় উপচে পড়ছে। তাদের পক্ষে শহর ছেড়ে দূরে বাগানবাড়ি তৈরি করে বিলাসে থাকা সমস্যা ছিল না। কিন্তু কলকাতার সব সায়েব তো আর ক্লাইভ বা জোন্স ছিল না। ইংরেজরা শীতের দেশের মানুষ। কলকাতার উষ্ণ-আর্দ্র জলবায়ুর সঙ্গে রাতারাতি মানিয়ে নেওয়া ছিল কষ্টকর। তারা এ শহরে এসেই অসুস্থ হয়ে পড়ত। ক্লাইভ কলকাতায় ১৭৫৬ সালে আসার চোদ্দো বছর আগে এদেশের মাটিতে পা রেখেছিলেন। তা সত্ত্বেও কলকাতায় এসে কাবু হয়ে পড়েন এখানকার জলহাওয়ায়। ১৭৫৭-র ৬ আগস্ট পরিচালক সমিতিকে তিনি চিঠিতে লিখেছিলেন, বারবার রোগাক্রান্ত হওয়ার জন্য যথেষ্ট স্নায়বিক দৌর্বল্য বোধ করছেন। একই অবস্থা হয়েছিল ভেরেলেস্টের। ঘন ঘন পীড়ায় পীড়িত হয়ে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছিলেন।১২

আলেকজান্ডার হ্যামিলটন লিখেছেন, ১৭০০ সালে কলকাতায় ইংরেজ সায়েবের সংখ্যা ছিল বারোশো। আর তার পরের বছর জানুয়ারিতে তিনি মৃত্যুর খতিয়ানে দেখেছিলেন, তাদের মধ্যে ৪৬০ জন মাটি নিয়েছে।১৩ সিরাজ-উদ-দৌলা ১৭৫৬ সালে কলকাতা আক্রমণ করলে কেল্লায় নবাবের গোলায় কিছু ইংরেজ প্রাণ দিয়েছিল, বাকিরা পালিয়ে যায় ফলতায়। ক্লাইভ এসে কলকাতা আবার দখল না করা পর্যন্ত তাদের থাকতে হয় সেখানে। কিন্তু ফলতায় মেজর কিলপ্যাট্রিকের ২৪০ জন সেনার মধ্যে তিরিশ জনের বেশি রক্ষা পায়নি মহামারীর হাত থেকে। ঘটনাটা ঘটেছিল ১৭৫৬-র আগস্ট থেকে ডিসেম্বর, এই পাঁচ মাসের মধ্যে।১৪ কলকাতায় ব্যাপক মৃত্যু হারে বিচলিত হয়েছিল পরিচালক সমিতি। তারা ১৭৫৭-র ২৫ মার্চের চিঠিতে বিশেষ উদ্বেগ প্রকাশ করে। কলকাতায় মৃত্যুর কথা তখন সায়েব সমাজে প্রতিদিনের আলোচনার বিষয়। ওই বছরে ২২ আগস্ট পরিচালক সমিতিকে লেখা ক্লাইভের চিঠিতে দেখা যায়, তিনি সেনাবাহিনীর অনেককে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন অসুস্থতার কারণে। রিচার্ড স্মিথ ১৭৬৭-র ২৭ মার্চ সিলেক্ট কমিটিকে লিখেছিলেন, ‘বিগত বছরে অসুখের ঋতুগুলোতে কলকাতায় যে সেনাবাহিনী ছিল, তাদের মধ্যে ভয়ংকর প্রাণহানি ঘটে। সে কথা আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। সারা বছরে আমরা যত সংখ্যক সেনা হারিয়েছি, তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক হারিয়েছি বিগত তিন মাসে।’১৫

কলকাতায় এসে সায়েবরা যেসব রোগে সাধারণত আক্রান্ত হত, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল স্কার্ভি ও জ্বর। এ দুটো রোগ মাঝে মাঝে মহামারীর রূপ নিত। ১৭৫৭-র ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৮ আগস্টের মধ্যে এই দুটো রোগে অসুস্থ হয়ে পড়ে ১১৫০ জন। মারা যায় ৫২ জন। আর ৭ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বরের মধ্যে আক্রান্ত হয় ৭১৭ জন, গোর দেওয়া হয় ১০১ জনকে। তাদের মধ্যে ছিলেন ১৭৫৬ সালে কলকাতা পুনর্দখলের নায়ক ক্লাইভের দোসর অ্যাডমিরাল ওয়াটসন।১৬ তিনি মারা যান ১৬ আগস্ট, পলাশি বিজয়ের মাত্র এক মাস তেইশ দিন পরে।

শ্রীমতী কিন্ডারস্‌লি একটা অদ্ভুত জ্বরের কথা উল্লেখ করেছেন, নাম Pucker fever। ভয়াবহ রোগ, কলেরার থেকেও মারাত্মক। এই রোগে আক্রান্ত হলে মৃত্যু হত কয়েক ঘণ্টার মধ্যে।১৭ সায়েবদের গরম সহ্য হত না। প্রচণ্ড গরমে পাকস্থলীর আবরণ শিথিল হয়ে গিয়ে হজম ক্ষমতা ক্ষয়ে যেত। প্রায়ই মৃত্যু ঘটত এর ফলে। তবে মেমসায়েবদের অসুস্থতার জন্য তিনি প্রচলিত ধারণাকে সমর্থন করেননি। জল-হাওয়ার ক্ষতিকর প্রভাবে তারা সচরাচর অসুস্থ হত না, এটাই ছিল তখনকার ধারণা। কারণ তারা পুরুষের তুলনায় রোদের তাপ কম ভোগ করত। সেজন্য জ্বর-টরও তেমন হত না। তাছাড়া, পুরুষের তুলনায় তাদের সংযত জীবনযাপন তাদের সুস্থ রাখত। কিন্ডারসলি এই ধারণাকে সঠিক মনে করেন না। তিনি দেখেছিলেন, মেমরা বেশিরভাগ স্নায়ু দৌর্বল্যের শিকার হত। আক্রান্ত হত ঘুস-ঘুসে জ্বর ও পিত্তাধিক্যে।১৮ মহামারী ঘটাত কলেরা ও বসন্ত। ১৭৬২ এবং ১৭৯৬ সালে কলকাতায় মহামারী ঘটে এই দুটি রোগের যৌথ অভিযানে। তাদের সঙ্গে কুচ করে প্লেগ, ম্যালেরিয়া ও ইনফ্লুয়েঞ্জা। নিচু শ্রেণির সায়েবদের মধ্যে ছিল নানান চর্মরোগ। রোগের জ্বালায় জেরবার হয়ে এবং ন্যূনতম স্বাচ্ছন্দ্যের অভাবে অনেকে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে বসত। এমনই করেছিলেন এক প্রখ্যাত প্রতিকৃতি অঙ্কন শিল্পীর ছেলে, মেয়ার (Meyer) । ঘন ঘন তীব্র মাথা ধরায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এই পথ বেছে নিয়েছিলেন।১৯

আঠারো শতকে কলকাতায় ব্যাপক হারে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ চিকিৎসার অভাব। ওষুধ ও ডাক্তার দুটোই ছিল দুষ্প্রাপ্য। ১৭০৭ সালের আগে শহরে কোনও হাসপাতাল গড়ে ওঠেনি। ১৭০৫-এর আগস্টের আগে পর্যন্ত কলকাতায় ডাক্তার ছিল মাত্র একজন।১৯ক শহরে যে অল্প কয়েকজন ডাক্তার ছিল, তারা আদৌ চিকিৎসা বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত ছিল কিনা সন্দেহ। তাদের ব্যবস্থাপত্র ছিল যেমন উদ্ভট, তেমনি ভয়াবহ। ১৭৮০ সালে ডাক্তারদের যোগ্যতাকে ব্যঙ্গ করে একজন লিখেছেন, ‘If you fracture skull, they pronounce it the bile.’২০ কারও কলেরা হলে তেষ্টায় ছাতি ফেটে গেলেও সায়েব ডাক্তার রুগিকে এক ফোঁটা জল দিত না। অথচ যারা গোপনে জল পান করত, সুস্থ হয়ে উঠত ক্রমশ। আসলে, প্রথম দিকের সায়েব ডাক্তাররা অর্থলোভের টানে নিজেদের পেশা ছেড়ে দিয়ে ঢুকে পড়েছিল বাণিজ্য জগতে। আর তাদের স্থান নিয়েছিল ভুঁইফোঁড় এমন কিছু ব্যক্তি যাদের চিকিৎসাশাস্ত্রের বর্ণপরিচয়ের সঙ্গে কখনও পরিচয় ছিল না।২১ ডাক্তার গুডইভ (Goodeve) তাঁর ‘The Progress of European Medicine in the East’ প্রবন্ধে লিখেছেন, সায়েব ডাক্তারদের একটা ধারণা ছিল, আমাশয় হলে রুগি যাতে দুর্বল না হয়ে পড়ে সেজন্য মদ-মাংস হল উপযুক্ত পথ্য।২২ শহরে যে ক’জন ডাক্তার ছিল, তাদের ভিজিট ছিল আকাশছোঁয়া। গরিব সায়েবদের পক্ষে ডাক্তারের খাঁই মেটানো সম্ভব ছিল না। ডাক্তার পালকিতে চেপে রুগি দেখতে এলে ভিজিট হিসেবে দাবি করত একটা সোনার মোহর।২৩

১৭০৭-এর আগে কলকাতায় হাসপাতাল গড়ে তোলার কথা ভাবা হয়নি। ওই বছর ১৬ অক্টোবর কেল্লার কাছে হাসপাতাল তৈরি করার জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়।২৪ পুরনো কেল্লায় একটা হাসপাতাল ছিল, মূলত সামরিক বিভাগের জন্য। ১৭৬৬-তে সেটা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় আলিপুরে। কিন্তু সে হাসপাতালে ছিল ব্যাপক দুর্নীতি, অনেকটা আজকের মতো। হাসপাতালের ডাক্তারদের বিরুদ্ধে প্রায়ই অভিযোগ উঠত কাজে গাফিলতি এবং টাকা-পয়সা তছরুপ করা নিয়ে। তারা নাকি মোটা টাকা লুটত নিজেরাই রুগির পথ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী জোগান দিয়ে। তাই একটা নির্দেশ জারি করা হয়, কাউন্সিলের সদস্যরা পালা করে হাসপাতাল পরিদর্শন করবে। ওষুধপত্র ছিল যেমন দুষ্প্রাপ্য তেমনি দুর্মূল্য। এমনকী, ক্যাস্টর অয়েল পর্যন্ত আমদানি করতে হত বিলেত থেকে।২৫

শুধু মহামারী নয়, মন্বন্তরও কলকাতার সায়েবমেমদের করুণা করেনি। হিকির গেজেট জানায়, ১৭৭০-এর মন্বন্তরে ১৫ জুলাই থেকে ১০ সেপ্টেম্বর, মাত্র দু’মাসের মধ্যে কলকাতায় মৃত্যু হয়েছিল কম করে ছিয়াত্তর হাজার মানুষের। তার মধ্যে সায়েবের সংখ্যা ছিল দেড় হাজার। মহামারী ও মন্বন্তরে মৃত্যুর মিছিল কলকাতার মেমদের কাছে ছিল অসহনীয় দৃশ্য। Hartly House-এর লেখিকা লিখেছেন, ‘শবযাত্রীদের মিছিলকে যতদূর সম্ভব মহিলাদের চোখের আড়ালে রাখার চেষ্টা করা হত, যাতে তাদের প্রাণোচ্ছলতায় আঘাত না পড়ে।’২৬ মৃত্যু আসত প্রায় বিদ্যুৎগতিতে, বিন্দুমাত্র জানান না দিয়ে। যে গৃহস্বামীর সঙ্গে বসে সন্ধেবেলায় পানীয়তে চুমুক দেওয়া হল, এবং যাকে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় দেখে বিদায় নেওয়া হল, পরদিন সকাল হতেই ডাক পড়ল তার শবযাত্রায় অংশ নিতে। এমন ঘটনা খুব একটা বিরল ছিল না। আঠারো শতকে সায়েবদের মৃত্যুর হারের ঊর্ধ্বগতি কিন্তু লাভবান করেছিল একধরনের পেশার মানুষকে। তারা আন্ডারটেকার। গোর দেওয়ার জন্য মাটি খোঁড়া, কফিন তৈরি করে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা করা ছিল তাদের কাজ। বর্ষাকালের শুভেচ্ছা থাকলে বছরে পঞ্চাশ হাজার রোজগার ছিল নিশ্চিত।২৭

আলেকজান্ডার হ্যামিলটন, শ্রীমতী কিন্ডারস্‌লি প্রমুখ সকলেই আঠারো শতকে কলকাতায় সায়েব পাড়ায় ব্যাপক হারে অকাল মৃত্যুর জন্য মূলত দায়ী করেছেন শহরের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও জলহাওয়াকে। উনিশ শতকেও মৃত্যুর মিছিল অব্যাহত ছিল। ১৮১৪ থেকে ১৮৩৩ এই কুড়ি বছরে পার্ক স্ট্রিটের গোরস্থানে গোর দেওয়া হয়েছিল ২৬৭৫ জন সায়েবকে। তাদের মধ্যে ১১৫২ জনের বয়স ছিল ২১ থেকে ৩০-এর মধ্যে।২৮ আলেকজান্ডার হ্যামিলটন মনে করেন, কলকাতার বাতাসকে দূষিত করত শহরের উত্তর-পূর্বে লবণ হ্রদের অবস্থান। এই অগভীর জলাশয়ে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে জন্মাত প্রচুর মাছ। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে সেগুলো মরে যেত জল শুকিয়ে গেলে। শীতের শুরু থেকেই উত্তর-পূর্বের বাতাসের টানে ভেসে আসত সেই পচা মাছের দুর্গন্ধ। কিন্তু সাম্প্রতিক কালের পণ্ডিতরা মনে করেন, ১৮৩০-র দশক থেকে সায়েবদের অসুখ-বিসুখের জন্য প্রকৃতি ততটা দায়ী ছিল না, যতটা ছিল সামাজিক অবস্থা, অভ্যেস এবং রক্ষণশীলতা।২৯ সায়েবরা লন্ডনের মতো কলকাতায় ছিল ‘টোপিওয়ালা’। এদেশের মাটিতে পা দিয়েই এখানকার মানুষের আচরণ, অভ্যেস তারা কেবল অবাক চোখেই দেখত না, অবজ্ঞাও করত অমার্জিত মনে করে। তাই এড়িয়ে চলত এদেশীয়দের অভ্যেসগুলো। অনেককে দেখা যেত প্রথম প্রথম ছত্রধারী না হয়ে প্রচণ্ড রোদে হেঁটে চলেছে। মাথায় ছাতা ধরে চলা ছিল তাদের কাছে লজ্জার ব্যাপার। এই চূড়ান্ত বোকামির ফলে বিপাকে পড়ত অহরহ। অনেক সময় দেখা যেত তাদের মধ্যে কেউ গোরস্থানে যাচ্ছে চিরবিশ্রাম নিতে।৩০

লর্ড ম্যাকারটনে (Macartney) কলকাতায় এসে এখানকার সায়েবদের পালকি ও ঘোড়ার গাড়ি চড়তে দেখে বিরক্ত হয়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, এটা বড়ো বাড়াবাড়ি বিলাসিতা। তিনি নিজে কিছুদিন পায়ে হেঁটে চলা-ফেরা করলেন। ফল পেলেন হাতে-নাতে। রোদের তাপে অসুস্থ হয়ে পড়লেন ক্রমশ। দেখা দিল ক্ষুধামান্দ্য ও ঘন ঘন মাথাধরা। একদিন প্রবল জ্বর নিয়ে ফিরলেন। ডাক্তাররা জানালেন রোদে ঘুরে তিনি বিরাট ভুল করেছেন। শেষপর্যন্ত পায়ে হাঁটার জেদকে জবাব দিতেই সুস্থ হয়ে উঠলেন। হাজার যোজন দূরে বসে থাকা বিলেতের পরিচালকরা কলকাতার পরিবেশ-পরিস্থিতির কথা না ভেবেই সিভিলিয়নদের উদ্দেশে ফতোয়া জারি করে বসেছিলেন, তারা ঘোড়ায় সওয়ার হতে ও পালকি চাপতে পারবে না।৩১ তাদের কাছে মনে হয়েছিল, এটা অনাবশ্যক বিলাসিতা। তাতে রাশ টানা দরকার। কলকাতা কাউন্সিল এর পরিণামে আতঙ্কিত হয়ে ১৭৫৫-র ৭ ডিসেম্বর এক চিঠি লিখে আর্জি পেশ করল, অন্তত গ্রীষ্ম ও বর্ষা ঋতুতে তাদের ওপর থেকে এই বাধা-নিষেধ বাতিল করা হোক। বিলেতের কর্তারা সমস্যার গুরুত্ব বুঝতে পেরে আর্জিকে অনুমোদন করেন।৩২

কলকাতার প্রতিকূল জল-হাওয়ায় বয়স্কদের মতো কষ্ট পেত ছোটরাও। বাচ্চাদের শরীর খারাপ হলে মা-বাবার চিন্তা হত। এমনও হত, সন্তানের স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য মা সন্তানকে নিয়ে চলে যেত বিলেতে। বাবার যাওয়ার উপায় থাকত না চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে। থেকে যেত এই শহরে। পদস্থ সিভিলিয়নরা কিংবা সামরিক অফিসারদের স্ত্রীরা হয়তো বারবার স্বদেশ-বিদেশ করত আর্থিক সংগতি থাকার জন্য। কিন্তু আর্থিক দিক দিয়ে কমজোরি সায়েবদের স্ত্রীরা পড়ে থাকত বিলেতে। দীর্ঘকাল স্বামী-স্ত্রীর সাক্ষাৎ হত না।

আঠারো শতকে কলকাতায় সায়েবদের অকাল মৃত্যুর অন্যতম কারণ ছিল তাদের বেহিসেবি মদ্যপান। সায়েবদের মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানের একটা সম্ভাব্য কারণ ছিল, কলকাতা শহরে বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাবে বিকল্প হিসেবে মদে মজে যাওয়া। লালদিঘির জল তারা পানীয় হিসেবে ব্যবহার করলেও, সেই দিঘি সুরক্ষিত না থাকায় জল দূষিত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটত কখনও কখনও। গঙ্গার জল পান করা তো বিষ পান করার সামিল ছিল। গরিব হিন্দুরা নিমতলা ও কাশীমিত্র ঘাটে আধপোড়া শবদেহ ফেলে দিত গঙ্গায়। ১৮৬৪ সালে স্যানিটারি কমিশনার স্ট্র্যাচি তাঁর রিপোর্টে লেখেন, বছরে ১৫০০ মৃতদেহ নদীতে ফেলা হয় শুধু সরকারি হাসপাতাল থেকে।৩৩ ১৮৭০ সালের আগে কলকাতায় পরিস্রুত পানীয় জল সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি।৩৪

তবে স্বীকার করতেই হবে, কলকাতার সায়েবদের সুরাসক্তির পেছনে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল তাদের সায়েবি আদব-কায়দা বজায় রাখার গোঁড়ামি। বিলেতের মতো শীতপ্রধান দেশে মদ্যপান শরীর-স্বাস্থ্যের পক্ষে তেমন হানিকারক নয়। বিলেতের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও অবাধে মদ্যপান করত, বাধা-নিষেধের বালাই ছিল না।৩৪ক

কিন্তু মুশকিল হল, মদ্যপানে অভ্যস্ত সায়েবরা এদেশে এসে জলবায়ুর আকস্মিক পরিবর্তনকে আমল না দিয়ে অভ্যেসটাকে লালন করত। অনেক ক্ষেত্রে তারা অপরিমিত পান করত পরিণামকে না ভেবে। যতক্ষণ না কপর্দকশূন্য হত, চলতেই থাকত মদ্যপান। আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কলকাতার সায়েবদের মধ্যে একটা প্রবাদ বাক্য চালু হয়েছিল, ‘Live like Englishman and die like rotten sheep.’৩৫ আকণ্ঠ মদ্যপানের পেছনে যে কারণই থাকুক না কেন, কলকাতায় এমন সায়েবও ছিলেন, যাঁরা প্রচুর অর্থবান হয়েও মদের নেশাকে নাকচ করতে পেরেছিলেন। এজন্য তাঁরা দীর্ঘজীবী হন। উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ওয়ারেন হেস্টিংস ও ফিলিপ ফ্রান্সিস। হেস্টিংস তিরিশ বছর কাটিয়েছিলেন বাংলায়। বেঁচেছিলেন পঁচাশি বছর বয়স পর্যন্ত। ফ্রান্সিসও ভোগ করেছিলেন দীর্ঘ আয়ু। সায়েবরা এদেশে, এই কলকাতা শহরে সুস্থ শরীরে বাস করতে পারত ততদিন, যতদিন তারা ভারতীয় খাদ্যাভ্যাস এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পারত অসংযমে রাশ টেনে রেখে। হোমিওপ্যাথি ওষুধের মাত্রায় ভারতীয়করণ ছিল এই প্রতিকূল জল-হাওয়ায় দীর্ঘজীবী হওয়ার একমাত্র পথ।৩৬

পলাশি যুদ্ধের পর বিলেতের তরুণদের মনে হয়েছিল বাংলা তথা কলকাতা ভাগ্য ফেরাবার মন্ত্র জানে। পলাশির পর কলকাতা থেকে কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা রাশি রাশি সম্পদ লাভ করে, ‘নবাব’ হয়ে ফিরে গিয়েছিল বিলেতে।৩৭ তাদের প্রত্যক্ষ করে এমনটা ভাবা ছিল স্বাভাবিক। সদ্য কৈশোর পেরোনো ১৫-১৬ বছরের ইংরেজ তনয়রা বাংলা তথা কলকাতার উদ্দেশে পাড়ি দিত এক স্বপ্ন নিয়ে। জাহাজে চড়ার মুহূর্তে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করেছেন Atkinson তাঁর এক কবিতায়—

‘Released from home and parents, uncontrolled,—

Wild as a colt from bit and briddle free—

Launched into public life, where shining gold

Glitters before his view invitingly.’৩৮

কলকাতায় পৌঁছে জাহাজ ঘাটে নামতেই এগিয়ে আসত একদল ঠগবাজ। শুধু জাহাজ ঘাটে নয়, জাহাজ আসার খবর পেয়ে খদ্দের পাকড়াও করার জন্য তারা উজিয়ে সাগরের দিকে চলে যেত নদীপথে পঞ্চাশ থেকে ষাট মাইল। উদ্দেশ্য, সায়েব ধরার প্রথম মওকা যাতে মাঠে মারা না যায়।৩৯ ইউরোপীয় পর্যটকরা তাদের কথা বলতে গিয়ে নিন্দায় পঞ্চমুখ। তাদের পুঁজি ছিল মামুলি ভাঙা-ভাঙা ইংরেজি বলা-কওয়ার দক্ষতা। ‘রামজনি’ নামে তারা পরিচিত ছিল। শব্দটা এসেছে ‘রামজানি’ থেকে। মনে হয় বেশিরভাগ ‘রামজানি’ ছিল মুসলমান।৪০ Sir Charles D’oyly তাঁর ‘Tom Row, the Griffin’-এ এদের সম্পর্কে লিখেছেন, ‘রামজনিরা সব রক্ত-চোষা হাড়-বজ্জাত জোঁকের দল।’৪১ তবে রামজানিদের মধ্যে শুধু মুসলমান নয়, হিন্দুও থাকত। জাহাজ এলেই তারা জড়ো হত গঙ্গার ঘাটে ‘সাহেব লোগ’দের সেবার জন্য। নতুন দেশে, নতুন পরিবেশে, নতুন মানুষজনের সামনে বিভ্রান্ত নবাগত তরুণ সায়েবদের দিকে এগিয়ে যেত রামজনিরা। সেই মুহূর্তে সেইসব সায়েবদের প্রথম প্রয়োজন হত সাময়িকভাবে মাথা গোঁজার ঠাঁই। সে ঠিকানা বাতলে দিত রামজনিরা। তারা সায়েবদের নিয়ে যেত কোনও পাঞ্চ হাউস বা ট্যাভার্নে। সেসব আস্তানার মালিকদের কাছ থেকে পেত মোটারকম দস্তুরি। পাঞ্চ হাউস বা ট্যাভার্নের মালিকরা সব ইংরেজ হলেও নবাগত স্বজাতিকে কোনওরকম সহানুভূতি দেখাত না। তারা জানত এইসব নবাগতরা বেশিদিন তাদের আশ্রয়ে থাকবে না। সেজন্য যতটা পারা যায় আদায় করে নিত। জেমস প্রিন্সেপ কলকাতায় আসেন প্রায় খালি হাতে। তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘আমার ঝোলাঝুলি নিয়ে কাস্টম হাউসে নামলাম। এগিয়ে গেলাম পাঞ্চ হাউসের দিকে। এক বন্ধুর কাছ থেকে দশটা গিনি ধার করেছিলাম কেল্লায় মেজরের কাছে পৌঁছনোর আগে পর্যন্ত খরচ চালাবার জন্য। ফ্ল্যাগ স্ট্রিটের যে বোর্ডিং হাউসে ইংরেজ নাবিকরা থাকত, তা এক কথায় ভয়াবহ।’৪২

আঠারো শতকে যেসব পর্যটক কলকাতাকে ‘City of Palaces’ বা প্রাসাদ নগরী বলে বর্ণনা করেছেন, তাঁদের মুগ্ধতা নিঃসন্দেহে ছিল সায়েব পাড়া বা হোয়াইট টাউনকে ঘিরে। সুতানুটি-কলকাতা-গোবিন্দপুর নিয়ে যে কলকাতা, তার চেহারা মোটেই দৃষ্টিনন্দন ছিল না। রাস্তা-ঘাট যেমনই হোক, যানবাহন বলতে ছিল পালকি ও ঘোড়ার গাড়ি। ঘোড়ার গাড়ির মালিক হওয়ার সামর্থ্য ক’জন সায়েবেরই বা ছিল। আম সায়েবের একমাত্র ভরসা ছিল পালকি। নবাগত সায়েবদের কাছে এই যানটি ছিল অভিনব। তবে প্রথম প্রথম তাতে সওয়ার হতে গিয়ে বেশ বিপাকে পড়তে হত। পালকিতে চাপতে গিয়ে তারা রীতিমতো মজার দৃশ্য উপহার দিত কলকাতার পুরনো সায়েবদের, যারা ইতিমধ্যে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল পালকিতে উঠতে-নামতে। পালকিতে বসার কায়দায় ধাতস্থ হতে বেশ কিছু সময় লাগত নবাগতদের। বেশি মুশকিলে পড়ত মেমসায়েবরা। পালকির বেহারাদের ভাষা বুঝতে না পারার ফলে তাদের পালকিতে চড়ার দৃশ্য বেহারাদের কাছে হয়ে উঠত অনাবিল হাসির উৎস।৪৩ পালকির বেহারারা ছিল প্রায় সকলেই ওড়িশাবাসী। ১৭৬৬ সালে বালেশ্বর থেকে সাত হাজার কর্মঠ যুবক কলকাতায় আসে কাজের সন্ধানে।৪৪ তখন থেকেই তারা পালকি বেহারা।

পালকির এই বেহারারা ছিল বড় বেয়াড়া, কিন্তু সৎ এবং সদা প্রফুল্ল। পালকি বওয়ার মতো প্রচণ্ডরকম ক্লান্তিকর কায়িক শ্রমেও কাতর না হয়ে মশগুল থাকত হাসি-কৌতুকে। তাদের রসিকতাবোধও ছিল তেমনি।৪৫ এ প্রসঙ্গে ক্লিভল্যান্ডের প্রথম পালকি চড়ার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করতে হয়। প্রথম পালকিতে চেপে যাওয়ার সময় পালকির বেহারাদের মুখে এক অদ্ভুত শব্দ শুনে তাঁর মনে হয়েছিল, বেচারা বেহারারা নিশ্চয় ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তিনি তাদের থামতে বললেন। কিন্তু কেন থামতে বললেন তা তাদের বোঝাতে পারলেন না। তারা আবার চলতে থাকল। তাদের মুখে আবার সেই শব্দ। ক্লিভল্যান্ড শঙ্কিত হয়ে আবার তাদের থামতে বলেলন। এবার বেহারারা পথের পাশে পালকি নামিয়ে হাসি-মস্করায় মেতে উঠল। সায়েব বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেন। তাদের এগিয়ে যেতে ইঙ্গিত করতেই পালকি এগিয়ে চলল। কিন্তু একশো গজ যেতে না যেতেই তাদের মুখে আবার সেই শব্দ। শেষ পর্যন্ত তিনি তাদের থামিয়ে পালকি থেকে নেমে বললেন, তিনি হেঁটেই যাবেন। যাওয়ার আগে প্রত্যেককে একটা করে টাকা দিলেন। টাকা পেয়ে তারা উৎফুল্ল। সায়েব ভাবলেন, ওদের খুব কষ্ট হচ্ছিল। তাই টাকা পেয়ে মুখে হাসি। পরে তাঁর ভ্রান্তি দূর করেন কর্নেল ওয়াটসন।৪৬

কিন্তু তাদের নিয়ে যেটা সমস্যা হত, তা হল, তারা খুশিমতো যাত্রীবহন করত। তাদের এলাকা ভাগ করা ছিল। এক এলাকার যাত্রী বয়ে নিয়ে অন্য এলাকায় যেত না। তেমন কিছু করলে, পথের ওপর পালকি রেখে দিয়ে গা ঢাকা দিত পাশের জঙ্গলে। যাত্রীরা পড়ে থাকত অসহায় হয়ে, ডাকাত আর বন্য পশুদের করুণার ওপর নির্ভর করে। ১৮২৭ সালে সরকার তাদের বেয়াদপি শায়েস্তা করতে গেলে হিতে বিপরীত ঘটল। ধর্মঘট করে বসল বেহারারা। বেশ ক’দিন কলকাতার পথে-ঘাটে পালকির দর্শন মেলেনি।৪৭

আঠারো ও উনিশ শতকের প্রথম দিকে কলকাতার সায়েবদের অতিথিপরায়ণতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ সমসাময়িক পর্যটক ও লেখকরা। কলকাতায় নবাগত তরুণ সায়েবদের সবরকম সাহায্যের জন্য তৎপর থাকত শ্বেতাঙ্গ সমাজ। কিন্তু রেভারেন্ড জে. স্টাথাম-এর (Rev. J. Statham) Indian Recollection গ্রন্থে দেখা যায় কলকাতার সায়েব সমাজের এক ভিন্ন ছবি, যেখানে সায়েবরা একে অপরের জন্য ভাবিত নয়, একপ্রকার উদাসীন। স্টাথাম কয়েকটা দৃষ্টান্ত তুলে দেখিয়েছেন, অসুস্থ অর্থবান সায়েবরা অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ভৃত্যদের ওপর ভরসা করে থাকে একটু সেবা-যত্নের প্রত্যাশায়। কলকাতায় এক স্কটিশ সায়েবকে তার ভৃত্য শুধুমাত্র পরনের পোশাক ছাড়া সবকিছু নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল মুমূর্ষু মনিবকে ফেলে রেখে। তিনি লিখেছেন, ‘ভারতে অসুস্থতা অনেক বেশি পীড়াদায়ক সহানুভূতিশীল স্বজনের অভাবে।’৪৮ তিনি আরও লিখেছেন, ‘সবরকম অসুস্থতার ক্ষেত্রে ইউরোপীয়দের প্রয়োজন হয় অবিরত ব্যজন। সেটা সাধারণত নেটিভরা করে। কিন্তু কেউ তাকে পরিচালনা না করলে সেটা হয় না। আমি অনেকবার দেখেছি, একটু তাজা প্রশ্বাস নেওয়ার জন্য একজন প্রচণ্ড হাঁপাচ্ছে, অথচ আশেপাশে এমন কোনও সহৃদয় সুহৃৎ নেই যে তাকে একটু বাতাস করে।’৪৯ রেভারেন্ড স্টাথামের বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করে, সে সময়ে কলকাতার অন্যতম মানী-গুণী এবং প্রভাবশালী সায়েব স্যার উইলিয়াম জোন্সের মৃত্যুর ছবি। স্যার জোন্সের পত্নী কলকাতার প্রতিকূল জল-হাওয়ার ভয়ে এই শহরে আসতে রাজি হননি।৫০ একাই থাকতন কলকাতায়। ১৭৯৪ সালে একদিন স্যার জোন্সের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে রিচার্ড ব্লিচিনডেন (Richard Blechynden) তাঁকে দেখতে গিয়ে বিস্মিত ও মর্মাহত হন। দেখেন, মাত্র ৪৮ বছর বয়সের জোন্সের মৃতদেহটি ওপর তলায় একটা অন্ধকার ঘরে শায়িত রয়েছে। কাছেপিঠে কেউ নেই। তিনি একজন ভৃত্যকে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে এনে সেখানে থাকতে বললেন।৫১ অথচ সেই মানুষটার মৃত্যুতে শোকাহত হয়েছিল সায়েব-নেটিভ নির্বিশেষে কলকাতার সকলে।

কলকাতা আঠারো-উনিশ শতকে সায়েবদের যেমন দিয়েছে, তেমনি নিয়েছে। তবে কলকাতার নেওয়া বড় নির্মম, বড় মর্মান্তিক। কলকাতার গোরস্থানে ক’জন সায়েবই বা শুয়ে আছে। যারা এই শহরে এসে মৃত্যুর সংকেত পেয়ে স্বদেশে খালি হাতে ফিরে গিয়ে মাটি নিয়েছিল, তাদের সংখ্যা কম নয়। শেষ নিশ্বাস ফেলার আগে তারা কলকাতাকে অভিশাপ দিয়েছিল কি না জানা যায় না।

সূত্রনির্দেশ

১. S. N. Mukherjee, Calcutta: Essays in urban History, Calcutta (1993), p. 63. (রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্তের মতে, উক্তিটা ট্রেভেলিয়নের বাবা জর্জ ওটোর (George Otto), Rabindra Kumar Dasgupta, Old Calcutta as presented in Literature, Sukanta Chaudhuri, (ed.), Calcutta the Living City, vol. 1, Calcutta (1990), pp. 118-127.

২. এ তথ্য দিয়েছেন ক্যাপ্টেন আলেকজান্ডার হ্যামিলটন যিনি ১৬৮৮ নাগাদ ভারতে এসেছিলেন। (General Committee of Fever Hospital, vol. 1, 1835-40, p. 15.

৩. S. N. Mukherjee, প্রাগুক্ত, p. 63.

৪. C. R. Wilson, Indian Records Series Old Fort William in Bengal, Vol. 1, London (1906), p. 10.

৫. Raja Binaya Krishna Deb, The Early History and Growth of Calcutta, Calcutta (1977), p. 33. (প্রথম প্রকাশ ১৯০৫)

৬. নিখিল সুর, কলকাতার নগরায়ণ: রূপান্তরের রূপরেখা, কলকাতা (২০১৫), পৃ. ৪৫

৭. James Long, Calcutta in the Olden Times, (Alok Ray, (ed.), Nineteenth Century Studies, Calcutta (1974), pp. 7-63

৮. Raja Binay Krishna Deb, প্রাগুক্ত, p. 32 কবিতাটি লেখক কর্তৃক অনূদিত। অ্যাটকিনসন কলকাতায় আসেন ১৮১৩ সালে। বিয়াল্লিশ বছর কোম্পানির বিভিন্ন পদে চাকরি করে অবসর নেন ১৮৪৭-এ। মৃত্যু হয় ১৮৫২ সালে।

৯. P. T. Nair, (ed.) Calcutta in the 18th century, Calcutta (1984), p. 140

১০. James Ranald Martin, Notes on the Medical Topography of Calcutta, Calcutta (1837) p. 121

১১. H. E. A Cotton, Calcutta: Old and New, [N. R. Ray (ed.)] Calcutta (1980), p. 67. প্রথম প্রকাশ 1909

১২. Calendar of Persian Correspondence, Vol. 3, 1770-72, No. 5.

১৩. Captain Alexander Hamilton, A New Account of The East Indies, vol. 1, London (তারিখ নেই) p. 5

১৪. James Ranald Martin, প্রাগুক্ত, p. 121

১৫. Ranjit Sen, A Stagnating City: Calcutta in the Eighteenth Century, Calcutta (2000), p. 172.

১৬. H. E. A Cotton, প্রাগুক্ত, p. 66

১৭. Kindersley, Letters from the East, London (1777), pp. 84-85

১৮. তদেব।

১৯. Alfred Spencer, (ed.) Memoirs of William Hickey, Vol. IV, London (1925), p. 18

১৯ক. T. R. Barret, Calcutta: Strange Memoirs—Foreign Perceptions, Kolkata (2014) p. 179

২০. Raja Binaya Krishna Deb, প্রাগুক্ত, p. 36

২১. P. Spear, The Nabobs, London (1980), p. 10

২২. Abhijit Dutta, Glimpses of European Life in 19th Century Bengal, Calcutta (1995), p. 4

২৩. Hartly House, Calcutta, ১৭৮৯-এর সংস্করণের পুনর্মুদ্রণ, Calcutta (1908), p. 133

২৪. C. R. Wilson, প্রাগুক্ত, No. 71

২৫. Long. Selections, p. XXXVI

২৬. Hartly House, Calcutta p. 137

২৭. Abhijit Dutta, প্রাগুক্ত, p. 5

২৮. W. H. Carey, The Good Old Days of Honorable John Company, Calcutta (1980), p. 335

২৯. Harald Fischer—Tine, Low and Licentions Europeans— Race, class and ‘White subalternity’ in Colonial India, New Delhi (2009), p. 112

৩০. Captain Thomas Williamson, The East India Vade-Mecum, Vol. 1, London (1810), p. 2

৩১. Douglas Dewar, In the Days of the Company, London (1920), p. 85

৩২. Long. Selections, p. XXXIII

৩৩. Theon Wilkinson, Two Monsoons, London (1976), p. 10

৩৪. Judicial Proceedings, June 1872, No. 32

৩৪ক. Sir M. Monier- Williamsons, Memorials of Old Haileybury College, Westminister (তারিখ নেই) p. 235

৩৫. Bengal Past and Present, Vol. XLVI, Oct-Dec, 1933, p. 97

৩৬. Harald Fischer—Time, প্রাগুক্ত, p. 63

৩৭. P. Spear, The Nabobs, London (1980), p. 32

৩৮. P. T. Nair, Calcutta Bevy, Calcutta (1989), p. 117

৩৯. Captain Thomas Williamson, The European in India, London (1813), Preface

৪০. Thomas Williamson, The East India Vade-Mecum, Vol. I, p. 167

৪১. P. T. Nair, Calcutta Bevy, p. 179

৪২. Bidisha Chakraborty, Sarmistha De, Calcutta in the Nineteenth Century, New Delhi (2013), p. 367

৪৩. The Asiatic Journal, New Series, Vol. 18, 1835, p. 123

৪৪. P. J. Marshall, The Company and the Coolies: Labour in Early Calcutta. (Pradip Sinha (ed.), The Urban Experience, Calcutta (1987), pp. 23-38

৪৫. Ketaki Kushari Dyson, A Various Universe, New Delhi (2006), p. 61

৪৬. Alfred Spencer, প্রাগুক্ত, Vol. 11, p. 124

৪৭. নিখিল সুর, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৪

৪৮. Abhijit Dutta, European Social Life in 19th Century Calcutta, Calcutta 1994), p. 19

৪৯. তদেব।

৫০. Suresh Chandra Ghosh, The Social Condition of British Community in Bengal, 1757-1800, Leiden (1970), p. 74

৫১. Peter Robb, Richard Blechynden’s Calcutta Diaries, 1792-1822, New Delhi (2011), p 5

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *