কলকাতার সমাজ

কলকাতার সমাজ

গ্যাসের আলোয় কলকাতা শহরে ভূতপ্রেত—ব্রহ্মদৈত্যরা বড় বড় বাড়ির ছাদের কার্নিশে পা ঝুলিয়ে বসে থাকত রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলায়। সে কথা রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন। একশো বছর আগেকার কথা। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির নাগরিক পরিপার্শ্ব তার চেয়ে আরও অন্তত একশো বছরের প্রাচীন। সুতানুটির এই প্রাচীন লোকালয়ে কেরোসিনের আলোয় তো বটেই, গ্যাসের আলোতেও ভূতপ্রেত থাকা আশ্চর্য নয়, এবং ঠাকুমাদের গল্পের আসরে শিশুমানসচক্ষে তাদের যথেষ্ট জীবন্ত হয়ে ওঠার কথা। বর্তমান শতাব্দীর দুইয়ের দশকে, আমাদের শৈশবেও এই ভূতপ্রেতের দৌরাত্ম্য বিশেষ কমেনি, বিশেষ করে সার্কুলার রোডবেষ্টিত আদি কলকাতার বাইরে তো নয়ই। দক্ষিণে বালিগঞ্জ—টালিগঞ্জ, যে অঞ্চলে আমাদের আশৈশব কেটেছে অথবা পুবে শুঁড়া বা বেলেঘাটা, উত্তরে কাশীপুর, বরানগর—দমদম প্রভৃতি অঞ্চলে দিনের আলোয় লোকজন যখন বেশি চলাফেরা করত এবং একজন পথিকের সঙ্গে অন্য একজন পথিকের দৈহিক ব্যবধান থাকত কয়েক গজ, নিকটবর্তী কাউকে ডাকতে হলে বেশ গলা চড়িয়ে ডাকতে হত। উত্তর—দক্ষিণ—পুবে আজকের জমজমাট শহরতলিতে তখন গ্রাম্য পরিবেশ ও গ্রাম্য সমাজেরই প্রাধান্য ছিল। সন্ধ্যা হলে শহরের কর্মজীবনে প্রায় ছেদ পড়ত এবং দিনের যেটুকু কোলাহল তা—ও স্তব্ধ হয়ে যেত। এমন অনেকদিন হয়েছে, সন্ধ্যার পর কেরোসিনের আলোয় প্রায়ান্ধকার নির্জনতা থেকে ভূতপ্রেতের ভয়ে প্রাণপণে দৌড়ে আমরা টিমটিমে গ্যাসের আলোর সীমানায় কালীঘাটে—ভবানীপুরে এসে পৌঁছেছি। এ—ও প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা। খুব বেশি দিনের কথা নয়। তখন কলকাতা শহরের মানুষ ভূতপ্রেতের ভয়ে দৌড়ে পালাত। এখন পঞ্চাশ বছর পরে, কলকাতায় মানুষের ভয়ে মানুষ দৌড়ে পালায়। তখন কেরোসিন ও গ্যাসের আলোয় কলকাতা শহর ছিল প্রায়ান্ধকার। এখন বৈদ্যুতিক আলোয় বাইরে কলকাতা শহর বিবাহবাসরের মতো উজ্জ্বল, ভিতরে গভীর অন্ধকার। তখন কলকাতার পথে চলমান পুরুষ পথিকদের পরস্পরের মধ্যে (মেয়েদের বাইরে চলাফেরা সামান্য ছিল) যে কয়েক গজ ব্যবধান ছিল, এখন পুরুষ—নারী কোনো পথিকের মধ্যেই আর সেই ব্যবধান নেই। অর্থাৎ পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এই কলকাতায় মানুষের সঙ্গে মানুষের দৈহিক দূরত্ব একেবারে কমে গিয়েছে, বাকি সমস্ত দূরত্ব বেড়েছে, যেমন মানসিক দূরত্ব, সামাজিক দূরত্ব। তখন ছিল নির্জনতার ভয়, এখন শুধু জনতার ভয়, ক্রুদ্ধ হিংস্র জনতার ভয়। কাজেই কলকাতা শহরের মানুষেরও সামাজিক জীবনে যে বড় রকমের একটা পরিবর্তন হয়েছে, গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে বেশ দ্রুতগতিতে, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

সামনের আর—একটা দশক শেষ হলেই কলকাতা শহরের বয়স হবে পুরো তিনশো বছর। এমন কিছু প্রাচীন শহর নয়, তবে নগরবিজ্ঞানসম্মত ‘আধুনিক’ শহরের মধ্যে নিঃসন্দেহে প্রাচীন। যদিও মাত্র দশ পুরুষের বা জেনারেশনের শহর, পুরো চৌদ্দপুরুষেরও নয়, এবং তার মধ্যে আমরা মাত্র শেষের দুই পুরুষের কথা বলছি। সামাজিক পরিবর্তনের দিক থেকে বিচার করলে বলতে হয় যে এই শেষের দুই পুরুষের পরিবর্তনের গতি ও ছন্দ আগেকার আট পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি দ্রুততালের, এবং তার মধ্যে গত এক পুরুষের অগ্রগতিকে প্রায় ঘোড়ার গ্যালপিং গতির সঙ্গে তুলনা করা যায়, যার কাছে আগেকার অগ্রগতি মানুষের পায়ে—হাঁটা গতি ছাড়া কিছু নয়।

জলাজঙ্গল ভরতি কয়েকটি এ দেশি গ্রামসন্নিবেশ থেকে কলকাতা শহরের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ হয়েছে, বিদেশি ইংরেজ শাসকদের আমলে। অনেক বড় বড় জলাশয় ছিল কলকাতায়, পঞ্চাশ বছর আগেও ছিল, বিশেষ করে শহরতলি অঞ্চলে, এখন সেখানে লোকালয় গড়ে উঠেছে, অনেক ক্ষেত্রে বড় বড় স্কাইস্ক্রেপার। ঝোপঝাড় গাছপালা জঙ্গলও যা ছিল তা—ও সব নির্মূল হয়ে গেছে। তার বদলে কিছু কর্পোরেশনের গাছ গজিয়ে উঠেছে বটে, কিন্তু সেইসব গাছের রং সবুজ নয়, অনাদরে হলদে। সবুজ রং শহর থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন, এমনকী তৃণের সবুজ পর্যন্ত। তার ফলে চোখ দুটো প্রায় অন্ধ হবার উপক্রম। শহুরে সভ্যতা প্রায় চশমা—সভ্যতা হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞানীরা বলেন, যেরকম দ্রুতগতিতে শহুরে গোলমাল বাড়ছে, লাউডস্পিকার রেডিয়ো হর্ন অটোর শব্দ, ট্রাম বাসের শব্দ, স্কুটার—মোটরবাইকের শব্দ, জনতার স্লোগানের শব্দ, নাচগান হল্লার শব্দ এবং সাম্প্রতিক বীরত্বব্যঞ্জক বোমাবাজির শব্দ, তাতে নাকি ২০০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, অর্থাৎ আগামী বছর পঁচিশের মধ্যে বড় বড় শহরের অধিকাংশ বাসিন্দা একেবারে কালা হয়ে যাবে। সবুজের অভাবে অন্ধ এবং শব্দের দৌরাত্ম্যে কালা হয়ে যাবার পর, বাকি থাকে ‘বোবা’ হয়ে যাওয়া। তারও যে খুব বিলম্ব আছে তা মনে হয় না। প্রায় আমরা বোবা হয়ে গেছি। বাইরের জীবনের সকল রকমের বিকারে আমরা আজ প্রায় নির্বিকার। ন্যায় বা অন্যায় সমস্ত ব্যাপারেই আমরা বোবা। এই অন্ধ, কালা ও বোবার পথে দ্রুত অগ্রগতি, পৃথিবীর অন্যান্য আরও অনেক বড় বড় শহরের মতো কলকাতা শহরেরও হয়েছে, গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে, এবং সবচেয়ে বেশি হয়েছে গত কুড়ি—পঁচিশ বছরের মধ্যে। ব্রিটিশ আমলের ঔপনিবেশিক শহর বলে, অন্যান্য স্বাধীন শহরের দিক থেকে কলকাতা কোনো ব্যতিক্রম নয় এবং হবার কোনো কারণও নেই।

নিসর্গের জঙ্গল নির্মূল করে কলকাতা শহর জনতাজঙ্গলে পরিণত হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ যাকে ‘জনতারণ্য’ বলেছেন :

 ওই যে নগরী, জনতারণ্য****শত রাজপথ গৃহ অগণ্য

 কতই বিপণি কতই পণ্য****কত কোলাহল কাকলি।

 কত না অর্থ কত অনর্থ****আবিল করিছে স্বর্গমর্ত

 তপনতপ্ত ধূলি—আবর্ত****উঠিছে শূন্য আকুলি—

বিশ শতকের গোড়ায় (১৯৩১) দেখা যায়, কলকাতার লোকসংখ্যা প্রায় দশ লক্ষ হয়েছে। দু—শো বছরে পনেরো—বিশ হাজার থেকে দশ লক্ষ, তখনকার ‘আর্বানাইজেশন’ বা নগরায়ণগতির বিচারে খুবই উল্লেখ্য অগ্রগতি, যদিও পাশ্চাত্য শিল্পশহরের মতো কলকাতার পত্তন ও শ্রীবৃদ্ধি হয়নি, হয়েছে পরাধীন ঔপনিবেশিক শহরের মতো প্রশাসনকেন্দ্র ও বাণিজ্যকেন্দ্ররূপে, এবং খানিকটা নব্যশিক্ষাসংস্কৃতির কেন্দ্ররূপে। তাহলেও বিশ শতকের গোড়ায় যখন দশ লক্ষ লোকের শহরসংখ্যা সারা পৃথিবীতে ছিল মাত্র উনিশ—কুড়িটি, তখন কলকাতার একটা স্থান ছিল তার মধ্যে। নগরায়ণের বর্তমান ত্বরিতগতির ফলে ১৯৭০ সালে পৃথিবীতে দশ লক্ষাধিক লোকের শহরসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮২টির মতো এবং ১৯৮০ সালের মধ্যে হবে ৫৬৪টির মতো, ঠিক দ্বিগুণ। এই গতি বজায় থাকলে, থাকবার কথা, বর্তমান শতাব্দীর শেষ দুই দশকের মধ্যে এরকম বড় শহরের সংখ্যা হবে ২২০০ মতো। তখন কলকাতা শহরের অবস্থা কী হবে তা বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টিতে অনুমান করতেও আতঙ্ক হয়।

আগামী কুড়ি—পঁচিশ বছর খুব বেশি সময় নয়। তা না হলেও, অদূর বা সুদূর কোনো ভবিষ্যতের কথাই আপাতত চিন্তা না—করাই ভালো। কারণ বর্তমান সমাজের চালকশক্তির যে ঊর্ধ্বশ্বাস দিকজ্ঞানহীন গতি, তাতে মানুষের সমাজ ও সভ্যতা থাকবে, থাকলে তার কী রূপ হবে, অথবা আদৌ থাকবে কি না, সে বিষয়ে পৃথিবীর বরেণ্য বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক ও চিন্তাশীল মনীষীদের মনে গভীর সন্দেহ জেগেছে। কাজেই কলকাতার ভবিষ্যতের কথা আপাতত চিন্তা না—করাই ভালো। কলকাতার বর্তমান শহুরে সমাজের যে রূপের বিকাশ হয়েছে গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে, তা যে—কোনো চিন্তাশীল মানুষের মনকে মুষড়ে ফেলার পক্ষে যথেষ্ট। ১৯০১ থেকে ১৯৩১ সালের মধ্যে কলকাতার লোকসংখ্যা দশ লক্ষ থেকে বেড়ে পনেরো লক্ষের মতো হয়। তিরিশ বছরে পাঁচ লক্ষ লোকবৃদ্ধি বেশি নয়। ১৯৩১ থেকে ১৯৪১ সালের মধ্যে লোকসংখ্যা বাড়ে সাত লক্ষের মতো, অর্থাৎ আগের তিরিশ বছরে যা বাড়ে তার চেয়ে দশ বছরে বাড়ে বেশি। এর একটা বড় কারণ হল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মওকায় যা হোক কিছু বাণিজ্য করে দু—পয়সা মেরে নেবার প্রলোভনে বাঙালিদের, বিশেষ করে অবাঙালিদের, কলকাতা শহরে আগমন। কিন্তু ১৯৪১ থেকে ১৯৫১ সালের মধ্যে চার লক্ষ, ১৯৫১ থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে আরও চার লক্ষ এবং ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে আর দু—লক্ষ লোক বেড়ে এখন পৌর কলকাতার লোকসংখ্যা হয়েছে একত্রিশ—বত্রিশ লক্ষের মতো। ১৯৪১—৬১ সালের কুড়ি বছরের মধ্যে নগরবৃদ্ধির গতি প্রায় স্থিতিশীল দেখা যায়, এবং ১৯৬১—৭১ সালের দশ বছরের মধ্যে এই গতি বেশ নিম্নমুখী। এর কারণ কী?

তাহলে কি বলতে হবে যে কলকাতার কলেবরবৃদ্ধির স্তর এমন এক চরম সীমায় পৌঁছেছে, যে পরে তার নিম্নমুখী গতিই সম্ভব? ঠিক তা নয়, কারণ কলকাতার লোকসংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার দৈহিক আয়তনবৃদ্ধিও হয়েছে, এবং এই প্রসারণের ফলে শহরতলি গড়ে উঠেছে, তারপর অনেক শহরতলি পৌর এলাকাভুক্ত হয়েছে। কলকাতায় পৌর এলাকার লোকসংখ্যাবৃদ্ধির হার কমে যাওয়ার কারণ প্রধানত তিনটি: প্রথম কারণ, আসল কলকাতায় লোকবসতির চাপবৃদ্ধি, বাড়ি ভাড়াবৃদ্ধি ও স্থানাভাবের ফলে মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ শহরতলিতে ও শহরপ্রান্তে দূরে সরে গিয়েছে, অনেকে বসতবাড়ি তৈরিও করে নিয়েছে। বঙ্গবিভাগের পর ১৯৪৬—৪৭ থেকে ১৯৭০—এর মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় ৪২ লক্ষের মতো যে পূর্ববঙ্গের উদবাস্তু এসেছে, তাদের অধিকাংশই হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী এবং তার বেশ বড় একটা অংশ কলকাতার প্রান্তের ও নূতন শহরতলির বাসিন্দা। কলকাতার শাখা—প্রশাখা বিস্তার ও প্রসারণ এই উদবাস্তুদের উদযোগেই বেশি হয়েছে এবং অবিন্যস্তভাবে হয়েছে। দ্বিতীয় কারণ, শহরতলির দূর প্রান্ত পর্যন্ত, এবং আরও দূরে অনেক অনেক উপনগর পর্যন্ত শহর থেকে লোকজন কিছুটা ছড়িয়ে পড়েছে, মোটরবাস ও বৈদ্যুতিক ট্রেনের সুবিধার জন্য। তৃতীয় কারণ, দুর্গাপুর—চিত্তরঞ্জনের মতো নতুন শিল্পনগরাঞ্চল কলকাতা শহর থেকে বেশ কিছু লোক আকর্ষণ করেছে এবং বাইরে থেকে আকৃষ্ট হয়ে কলকাতা শহরে যারা আসত তাদের কিছু অংশ নতুন শিল্পনগরকেন্দ্রে গিয়েছে। প্রধানত এই কয়েকটি কারণে আসল কলকাতায় লোকসংখ্যাবৃদ্ধির হার কমেছে ১৯৬১—৭১ সালের মধ্যে, কারণ এই সময়েই বাইরের বসতিকেন্দ্রগুলি গড়ে উঠেছে বেশি। তার ফলে বহু উপনগর, প্রান্তনগর, শহরতলি নিয়ে কলকাতার চারদিক বেষ্টন করে একটা নতুন নগরবিন্যাস হয়েছে, যাকে ১৯৭১ সালের লোকগণনায় ‘কলকাতার নাগরিক জনকুণ্ডল’ (‘Calcutta Urban Agglomeration’) বলা হয়েছে। কলকাতার বর্তমান নাগরিক অস্তিত্ব এই সমগ্র জনকুণ্ডল নিয়ে। কলকাতার ‘মেট্রোপলিটন’ অঞ্চল এর চেয়ে অনেক বড় অঞ্চল এবং অনেক বিক্ষিপ্ত গ্রামাঞ্চলও তার অন্তর্ভুক্ত। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, সুসংবদ্ধ জনগোষ্ঠী (‘কমিউনিটি’) বলতে যা বোঝায়, ‘মেট্রোপলিটন’ অঞ্চল ঠিক তা নয়। ‘মেট্রোপলিটন’ এলাকায় নানারকমের বিক্ষিপ্ত সমাজজীবনের একটা ক্রিয়া—প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কযুক্ত ধারাবাহিক বিন্যাস লক্ষ করা যায়। কলকাতার যে নাগরিক জনকুণ্ডলের কথা ১৯৭১ সালের সেন্সাসে বলা হয়েছে, তার সামাজিক রূপ স্বতন্ত্র, গ্রাম্য জীবনের স্পর্শ তার মধ্যে বিশেষ নেই, এবং তা আদৌ বিক্ষিপ্ত নয়, বেশ সুসংহত। ৭৪টি নগরাঞ্চল এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং তার মোট লোকসংখ্যা প্রায় ৭১ লক্ষ। কলকাতার ক্রমপ্রসার্যমাণ নাগরিক সমাজের আসল আওতা অথবা তার জনকুণ্ডলায়নের তাৎপর্য এবং প্রকৃত প্রভাব বিচারের দিক থেকে সাম্প্রতিক সেন্সাস কর্তৃপক্ষের এই দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বেশি বাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত মনে হয়। আর এ কথা ভাবতে বাস্তবিকই আশ্চর্য লাগে যে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ছয় ভাগের এক ভাগ লোক, শতকরা ষোলোজন এই নগরাঞ্চলের বাসিন্দা এবং তাই বিস্ফারিত নগরাঞ্চলেই কলকাতা শহরের বর্তমান সমাজজীবনের সমগ্রতা প্রতিফলিত।

কলকাতার পৌরাঞ্চলে যত লোক বাস করে, তার প্রায় দেড়গুণ বেশি লোক বাস করে এই নাগরিক জনকুণ্ডলে। তা ছাড়া এটাও লক্ষ করার মতো যে ১৯৬১—৭১—এর মধ্যে এই বিস্ফারিত নগরাঞ্চলের লোকসংখ্যাবৃদ্ধির হার বছরে ২০%, কিন্তু কলকাতার পৌরাঞ্চলের লোকসংখ্যাবৃদ্ধির হার হল ৭%। অর্থাৎ বিস্তৃত নগরাঞ্চলে লোকসংখ্যাবৃদ্ধির হার কলকাতার পৌরাঞ্চলের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি। ভাববার মতো ব্যাপার। কেন এরকম অবস্থা, অর্থাৎ কলকাতাবেষ্টিত এই জনকুণ্ডলায়ন? এই লোকসমূহ কারা? কোথা থেকে এরা এল, কেন এল, কীসের মোহে এল, এবং কেনই বা কলকাতা শহরটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে এরকম চাকবদ্ধ জনবসতি গড়ে তুলল? এমনকী তার জন্য আগেকার মিউনিসিপ্যাল এলাকাগুলোরও চেহারা একেবারে পালটে গেল? সাধারণভাবে লোকসংখ্যাবৃদ্ধি এবং জীবনভোগ ও জীবিকার্জনের নাগরিক আকর্ষণের ফলে গত দশ বছরের মধ্যে পশ্চিমবাংলার গ্রামাঞ্চল থেকে যারা এসেছে তাদের একটা বড় অংশ ছাড়া এই জনকুণ্ডলায়নের বিকাশে যারা সর্বাধিক সাহায্য করেছে, তারা পূর্ববঙ্গের বিয়াল্লিশ লক্ষ উদবাস্তুদের একাংশ (‘বাংলাদেশের’ শরণার্থীরা নয়)। কলকাতা শহরের পঞ্চাশোত্তরকালের সমাজজীবনে এই জনকুণ্ডলের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যাকে আধুনিক সমাজবিজ্ঞানীরা ‘নাগরিক গ্রাম’ (Urban Village) এবং ‘নাগরিক জঙ্গল’ (‘Urban Jungle’) বলেন, কলকাতা শহরের চতুর্দিক আজ সেরকম শত শত ‘গ্রাম’ ও ‘জঙ্গল’ ভরে গিয়েছে, যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ স্ত্রী—পুত্রকন্যা নিয়ে বাস করে, মানুষের মতো নয়, জঙ্গলের জন্তুর মতো, তরুণ—তরুণী যুবক—যুবতী বালক—বালিকা মহানগরের মায়ামৃগের পশ্চাদ্ধাবন করে ব্যর্থ হয়, এবং বুকভরা গ্লানি, ক্ষোভ ও ক্রোধের বিষ শহরের জনস্রোতে ঢেলে দেয়। অধিকাংশ আমেরিকান শহর ও অন্যান্য ধনতান্ত্রিক দেশের শহরের মতো কলকাতা শহর আজ এই নাগরিক গ্রাম ও জঙ্গলে পরিবেষ্টিত, যে সামাজিক দৃশ্য পঞ্চাশ বছর আগে তো দূরের কথা, কুড়ি বছর আগেও কল্পনাতীত ছিল। নিম্নমধ্য ও দরিদ্রদের বসতিকেন্দ্রগুলি ‘নাগরিক গ্রাম’ যেখানে সর্বপ্রকারের বহিরাগত ও দেশান্তরিতদের বাস, এবং নানা রকমের ক্রিমিনাল ও সমাজবিরোধীদের বাসস্থান হল ‘নাগরিক জঙ্গল’। এই দুই নতুন সমাজের প্রসারের ফলে কলকাতার যে তিনস্তরবদ্ধ ট্র্যাডিশানাল শহুরে সমাজের গড়ন ছিল, অনেকটা সুনির্দিষ্ট গড়ন, তা বেশ খানিকটা তরলিত হয়ে গিয়েছে। প্রায় একপুরুষকাল আগে পর্যন্ত কলকাতায় যে ধরনের বনেদি শহুরে সমাজের গড়ন প্রায় অক্ষুণ্ণ ছিল, তার রূপ ছিল কতকটা এইরকম: অভিজাত বাঙালি ও অবাঙালিদের সমাজ, বাঙালি মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের সমাজ (প্রধান স্তর), তার মধ্যে অবাঙালি মধ্যবিত্তদের একটি পৃথক উপস্তর, এবং অন্তরাল—সমাজ, যেখানে পরদার অন্তরাল থেকে সমাজের যাবতীয় দুষ্কর্ম ও দুর্নীতি অনুষ্ঠিত হত। এই তিনটি স্তরের সীমানাও ছিল নির্দিষ্ট, এবং সেই সীমানার মধ্যে যে যার সামাজিক জগতে বেশ নিশ্চিন্তে দিন কাটাত। বিভিন্ন সামাজিক স্তরের মধ্যে পারস্পরিক অনুপ্রবেশের কোনো সম্ভাবনা বিশেষ ছিল না। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, কনট্রোল রেশনিং, কালোবাজার দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাজনিত বীভৎস হত্যাকাণ্ড, বঙ্গবিভাগজনিত লক্ষ লক্ষ উদবাস্তু, স্বাধীনতা—পরবর্তী অর্থনৈতিক প্রকল্পজনিত বিপুল মুদ্রাস্ফীতি এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের ধারাবদলের সামগ্রিক প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক জীবনে এমন একটা ওলটপালট হয়ে গেছে, তার সমস্ত স্তর ও মূল পর্যন্ত এমনভাবে নড়ে উঠেছে, চিরায়ত নীতিবোধ, মূল্যবোধ মানবিকতাবোধ এমন সজোরে ধাক্কা খেয়েছে, বিশেষ করে ভাবপ্রবণ তরুণমনে, যে তাকে গতানুগতিক ‘পরিবর্তন’ বা ‘social change’ না বলে একটা ‘বৈপ্লবিক রূপান্তর’ বলা যায়। স্বভাবতই তার দাপট ও ঝাপটা সবচেয়ে বেশি লেগেছে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী ও প্রধান শহর কলকাতার সমাজজীবনে।

কলকাতার অভিজাত সমাজের স্তর আগেকার বনেদি গণ্ডির সংকীর্ণতা অতিক্রম করে আরও বৃহত্তর হয়েছে, নব্যধনিক ও হঠাৎ—অভিজাতরা এই স্তরের কলেবরবৃদ্ধি করেছেন, প্রধানত মুদ্রাস্ফীতির কালো টাকা, নতুন ব্যাবসাবাণিজ্য ও মোটা বেতনের চাকরির কৃপায়। তাঁদের সামাজিক জীবনের ধারাও আর আগেকার মতো নেই। পালকি ও ঘোড়াগাড়ির যুগ থেকে তাঁরা অটোমোবিল যুগে উত্তীর্ণ হয়েছেন, তাই তাঁদের ‘মোবিলিটি’ অনেকগুণ বেড়েছে এবং অনেক বেশি ছিমছাম ও দুরন্ত হয়েছে। পঞ্চাশ বছর আগে ১৯২১—২২ সালে কলকাতায় প্রাইভেট মোটরের ড্রাইভার ও ক্লিনারের সংখ্যা ছিল ৫১৪ জন, ১৯৩১—৩২ সালে ২১০০ (সেন্সাসে রিপোর্ট অনুযায়ী)। ১৯৩১ সালের কলকাতার সেন্সাসেও দেখা যায় যে পালকির মালিক ও বেয়ারাদের সংখ্যা ছিল ১২৫০—র মতো এবং যদি পালকিপিছু চারজন বেয়ারা ধরা যায়, তাহলে অন্তত তিনশো পালকি চলত কলকাতায় চল্লিশ বছর আগে ১৯৩১ সালে, যখন মোটরপ্রতি দু—জন ড্রাইভার ক্লিনার হিসেব করলে প্রাইভেট মোটরের সংখ্যা ছিল এক হাজারের মতো। বর্তমানে কলকাতায় প্রাইভেট অটোর সংখ্যা প্রায় সত্তর—আশিগুণ বেড়েছে এবং মোটর ও যান্ত্রিক বিবিধ অটোসংখ্যা দেড় লক্ষাধিক। কলকাতার জনসংখ্যাবৃদ্ধির হারের তুলনায় যান্ত্রিক যানবাহনবৃদ্ধির হার অনেকগুণ বেশি মনে হয়, যেন তিন—চার দশকের মধ্যে আমাদের পালকি থেকে ক্যারেজে এবং ক্যারেজ থেকে যান্ত্রিক অটোর যুগে দ্রুত উত্তরণ হয়েছে। কলকাতার জীবনের গতি সমাজের গতি, চলার গতি, কয়েক দশকের মধ্যে প্রায় শতগুণ বেড়ে গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ দুঃখ করে বলেছিলেন, জলাশয়ের জল শুকাল, তার উপর শহর গড়ে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে মানুষের হৃদয়ও শুকাল। আমরা বলতে পারি, গোযান—অশ্বযান থেকে অটোমোবিল সমাজের গতি যত দুরন্ত হল, তত নাগরিক মানুষের গতির লক্ষ্য ও চলার লক্ষ্য গেল হারিয়ে। জীবনের ও সমাজের লক্ষ্য অস্পষ্ট হয়ে গেল চলার আবর্তে। বেগের আবেগে যখন মানবিক ও সামাজিক সমস্ত আদর্শ মানুষের দৃষ্টিপথে প্রায় লুপ্ত তখন একটিমাত্র লক্ষ্য কলকাতার মধ্যগগনে দীপ্যমান, টাকার লক্ষ্য আর স্টেটাসের লক্ষ্য। জোব চার্নকের আমল থেকে, অর্থাৎ কলকাতার জন্মকাল থেকে, এই অচঞ্চল লক্ষ্য ক্রমে উজ্জ্বলতর হয়েছে এবং শহর ও শহুরে সমাজ যত বড় হয়েছে, অন্যান্য লক্ষ্য ক্রমে ম্লান হয়ে গেছে। টাকা ক্ষমতা ও স্টেটাস অভিমুখে মনে হয় আজ যেন সমগ্র নাগরিক সমাজ ঊর্ধ্বশ্বাসে ধাবমান। যেনতেনপ্রকারেণ টাকা চাই এবং তজ্জনিত ক্ষমতা ও সামাজিক স্টেটাস চাই। তাতে ব্যক্তিগতভাবে অনেকের লাভবান হবার কথা, যারা প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হতে পারে তাদের তো অবশ্যই, কিন্তু সমষ্টিগতভাবে সমাজের সমূহ লোকসান হবার কথা, এবং কলকাতার নাগরিক সমাজের তা—ই হয়েছে ও হচ্ছে।

কলকাতার যে নব অভিজাত সমাজের কথা বলছিলাম, তার দৃষ্টি যে এই লক্ষ্যের দিকেই দৃঢ়নিবদ্ধ থাকবে তা বলাই বাহুল্য। আভিজাত্যের মানদণ্ডগুলি পর্যন্ত বদলে গেছে। ভোগ্যপণ্যের বেহিসেবি ব্যক্তিগত বিলাসিতা তার মধ্যে অন্যতম। পোষা বেড়াল—বাঁদরের বিয়েতে লাখ টাকা উড়িয়ে দেওয়া, বাগানবাড়িতে বয়স্য বারাঙ্গনা আর বন্ধুবান্ধব নিয়ে হাজার হাজার টাকা ব্যয় করে আমোদ করা, লখনউ—বারাণসীর বাইজির নাচের আসরে মোহর আর অলংকার প্যালা দেওয়া, উৎসব—পার্বণে বিবাহে শ্রাদ্ধে অকাতরে টাকা খরচ করা, দীনদরিদ্র অনাথ আতুর ব্রাহ্মণপণ্ডিতদের ঘটা করে দানধ্যান করা এবং দেশের দরিদ্রনারায়ণদের ঢালাও খিচুড়িভোজন করিয়ে সেবা করা—এইসব অতীতের আভিজাত্যের নিদর্শন বর্তমান কলকাতায় দেখাও যায় না এবং এগুলি আর আভিজাত্যের লক্ষণ বলে গণ্যও হয় না। আধুনিক নাগরিক আভিজাত্য সম্পূর্ণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং সমাজ ও সমষ্টির সঙ্গে তার সংযোগ কেবল আত্মপ্রচারের মাধ্যমে। তাই ব্যক্তিগত ভোগ্যপণ্যের বৈচিত্র্য ও বিলাসিতা প্রদর্শনই আধুনিক আভিজাত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। অঢেল অনাবশ্যক ভোগ্যদ্রব্যের উৎপাদনে আজকের সমাজ তাই পণ্যভোগীদের সমাজে (‘কনজিউমার সোসাইটি’) পরিণত হয়েছে। আধুনিক অভিজাতরা কলকাতার এই পণ্যভোগী সমাজের প্রসার ও পরিপুষ্টির সহায়ক। এই বিচিত্র পণ্যসম্ভার জৈবিক জীবনের প্রয়োজনে নয়, যান্ত্রিক স্টেটাসপ্রধান জীবনের প্রয়োজনে উৎপন্ন। অভিজাত ও বিত্তবানদের সঙ্গে সমাজের ঊর্ধ্বসোপানমুখী মধ্যবিত্তের (যাঁদের ‘আপার মিডল’ বলা হয়) একাংশও আজ কলকাতার সমাজে কাঁধ মিলিয়ে চলার চেষ্টা করছেন। কলকাতা শহরের সর্বত্র আজ তাই এই ভোগ্যপণ্যের বিচিত্র বাজার এবং ততোধিক বিচিত্র ক্রেতা—বিক্রেতায় ভরে গিয়েছে, যা একপুরুষ আগেও অভাবনীয় ছিল। সমস্ত কলকাতা শহরটা একটা বিশাল ‘সুপারমার্কেট’—এ পরিণত হয়েছে এবং সেখানে বাজারের ও পণ্যের কত যে বৈচিত্র্য, কত রকমের যে ভেন্ডার পেডলার হকার দোকানদার তার হিসেব নেই।

কলকাতার সাধারণ মধ্যবিত্তের (মিডল—মিডল) বৃহত্তর অংশ অবশ্য প্রাত্যহিক জীবনসংগ্রামে ক্লান্ত ও অবসন্ন, শিক্ষিত—অর্ধশিক্ষিত সকলেই। অধ্যাপক শিক্ষক উকিল কেরানি দোকানদার শিল্পী সাহিত্যিক কেউ বাদ নেই। মুদ্রাস্ফীতি বেতনবৃদ্ধি ভাতাবৃদ্ধি এবং তৎসহ অত্যাবশ্যক খাদ্যদ্রব্যের (অনাবশ্যক ভোগ্যপণ্যের নয়) উৎপাদনহ্রাসের ফলে ক্রমাগত দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধির চক্রে তাঁরা নিয়ত ঘূর্ণায়মান। বিপুল নিম্নমধ্য শ্রেণি (‘লোয়ার—মিডল’), যাঁরা ভদ্রলোক শ্রেণিবাচ্য, তাঁরা ক্রমে নিম্নগামী হবার ফলে কিছুতেই আর তাঁদের ভদ্রলোকত্ব বজায় রাখতে পারছেন না। তাঁরাও জীবনসংগ্রামের এই চক্রবৎ আবর্তনে ঘুরপাক খাচ্ছেন এবং এই আবর্তনের যেন শেষ নেই মনে হচ্ছে। নিম্নমধ্যবিত্তের বিশাল স্তর টুকরো টুকরো হয়ে ধসে পড়ছে এবং মহানগরের পাতালে অবস্থিত সুবিস্তৃতসমাজের অন্ধকারে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তার ফলে পূর্বোক্ত ‘নাগরিক জঙ্গল’ অঞ্চল যেমন প্রসারিত ও ঘনীভূত হচ্ছে, তেমনি ‘নাগরিক গ্রামাঞ্চল—এরও ক্রমবিস্তার হচ্ছে।

এর মধ্যে কলকাতার অন্তরাল—সমাজের যে পরিবর্তন হয়েছে তা যুগান্তকারী বলা যায়। তার আকার ও ভূমিকা উভয়ই ভয়াবহ। খুনি চোর ডাকাত গুন্ডা জুয়াচোর জালিয়াত জুয়াড়ি স্মাগলার বারাঙ্গনা, যেনতেনপ্রকারেণ দিন গুজরানের বিরাট দল নিয়ে বড় বড় শহরে অন্তরাল—সমাজ গড়ে ওঠে এবং কলকাতা শহরেও গড়ে উঠেছে। অসামাজিক অবৈধ পেশাজীবী ও বৃত্তিজীবীর সংখ্যা অত্যধিক বেড়েছে, সামাজিক বৈধবৃত্তির ক্রমিক সংকোচনের ফলে। তার উপর সর্বপ্রকারের সমাজবিরোধীদের ভূমিকারও বিস্ময়কর পরিবর্তন হয়েছে। অন্তরালবর্তী সমাজ চিরকালই ছিল উপরের সমাজের তলায়, কিন্তু তা অন্তরালেই থাকত। গত পঁচিশ তিরিশ বছরের মধ্যে, অর্থাৎ স্বাধীনতা—উত্তরকালে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কলকাতার নরহত্যা তাণ্ডবের সময় থেকে, এই অন্তরাল—সমাজের প্রাধান্য বেড়েছে এবং তার সামাজিক গোত্রান্তর হয়েছে। তারপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাময়িক সুবিধাবাদী প্ররোচনা ও পোষকতার ফলে আজ কলকাতা শহরে এই অন্তরাল—সমাজ থেকে বিশালকায় এক ‘মস্তান সমাজ’—এর উদ্ভব হয়েছে। এই মস্তানরা আজ আর অন্তরালে চলাফেরা করার প্রয়োজন বোধ করে না, সমাজের প্রকাশ্য মঞ্চে বীর নায়কের মতো চলেফিরে বেড়ায় এবং অনেক ক্ষেত্রে ‘সেভিয়ার’ বা পরিত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে অসহায় মানুষের কাছে ‘অবতারের’ সম্মান পায়। তাদের দাবি অনুযায়ী নিয়মিত ভোগসেবা করতে না পারলে, স্থানীয় অধিবাসীদের জীবন বিপন্ন হয়ে ওঠে। কলকাতার সামাজিক জীবনে (এবং বাংলারও) এই মস্তান শ্রেণির সমমর্যাদায় গভীর ও ব্যাপক অনুপ্রবেশ, ইদানীংকালের সবচেয়ে উল্লেখ্য সামাজিক ঘটনা।

মানবসমাজের ‘নিউক্লিয়াস’ বা কেন্দ্রবিন্দু হল ‘পরিবার’ এবং ‘পরিবার’—এর কেন্দ্র হল ‘বাসগৃহ’। কলকাতা শহরে সমাজের এই কেন্দ্রবিন্দু পরিবার কীভাবে বিশ্লিষ্ট হয়ে যাচ্ছে, অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে নিদারুণ গৃহসংকটের ফলে, তার সামাজিক ক্রিয়া—প্রতিক্রিয়াসহ করুণ ধারাবিবরণ দিতে হলে একটি মহাগ্রন্থ রচনা করতে হয়। একটি ক্ষুদ্রকায় প্রবন্ধের বিষয়বস্তু তা নয়। এখানে অতিসংক্ষেপে তার আভাস দেওয়া যেতে পারে মাত্র। পশ্চিমবঙ্গের, বিশেষ করে কলকাতার, বর্তমান রাজনৈতিক সংকট, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, নৈতিক বিপর্যয়, যুব—সমস্যা ছাত্র—সমস্যা প্রভৃতি যে—কোনো সংকট ও সমস্যার সমাজবিজ্ঞানসম্মত বিচার—বিশ্লেষণ করতে হলে অনুসন্ধানীর দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে প্রথমে পরিবারের দিকে এবং সেই পরিবারের বাসগৃহের দিকে, যেখানে সামাজিক মানুষের প্রথম রূপায়ণ হচ্ছে জীবনের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের পর্যায়ভেদে। সেদিকে তাকালে দেখা যাবে, বাইরে তার যতই ঝলমলে চেহারা হোক, ভিতরটা একেবারে ঝাঁজরা এবং তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষ।

কলকাতার বৃহৎ নগর জনকুণ্ডলের (urban agglomeration) বর্তমান (১৯৭১) জনবসতির ঘনতা হল প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১২৫০০, পৌর কলকাতায় আরও অনেক বেশি, পঞ্চাশ বছরে অসম্ভব বেড়েছে। এই তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের জনঘনতা প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৫০৭ এবং ভারতের ১৮২। ১৯৬১ সালে কলকাতার পৌরাঞ্চলের জনঘনতা ছিল প্রতি বর্গমাইলে প্রায় ৭৪ হাজার, উন্নত অঞ্চলে এক লক্ষাধিক, যার তুলনায় আমেদাবাদ শহরে ৫৭ হাজার, দিল্লি শহরে ৪১ হাজার এবং আমেরিকার বড় শহর নিউ ইয়র্কে ২৮ হাজারের মতো। সাধারণ গড়পড়তা জনঘনতা অবশ্য কলকাতার বিশেষ অঞ্চল বা ওয়ার্ড অনুযায়ী ধরলে যথেষ্ট কমবেশি হবে এবং ঘনতার এই তারতম্য বরাবরই অঞ্চলভেদে কলকাতায় ছিল, সব শহরেই থাকে। উত্তর পূর্ব দক্ষিণ কলকাতার অনেক অঞ্চলে জনঘনতা গড়ের তুলনায় অনেক বেশি, এবং গত দশ বছরের নতুন নতুন প্রান্তীয় শহরতলিতে তা প্রায় মাত্রাতিরিক্ত হয়েছে বলা যায়। কলকাতা বোধহয় পৃথিবীর সমস্ত শহরকে আজ জনঘনতার দিক থেকে ছাড়িয়ে গেছে। পুরোনো বসতির ঘনতা ও নতুন বসতি অনেক বেড়েছে, কিন্তু জনসংখ্যানুপাতে বাসগৃহের সংখ্যা বাড়েনি। তার ফলে বাসগৃহপ্রতি লোকসংখ্যা (প্রধানত পারিবারিক) অনেক বেড়েছে। তার ফলে নাগরিক জীবনের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানো মহাসমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেমন জল বিদ্যুৎ ড্রেন যানবাহন আবর্জনা ইত্যাদি। পরিসাংখ্যিক তথ্য দিয়ে এখানে তা বোঝবার দরকার নেই, অনেকেই তা জানেন। শুধু এইটুকু বলা যায় যে এমন অনেক অঞ্চল আছে কলকাতায় যেখানে স্তূপাকার আবর্জনার দুর্গন্ধে প্রবেশ করা যায় না এবং দূষিত বায়ু সেবন করে সেখানকার লোকজনকে প্রতিদিন বেঁচে থাকতে হয়। গৃহ ও পরিবারের সমস্যা ও সংকট এককথায় বলা যায় ‘ভয়ংকর’। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বছর পনেরো—ষোলো আগে (১৯৫৪—৫৫ থেকে ১৯৫৭—৫৮ পর্যন্ত) শহরের গৃহ সমস্যার একটা সমীক্ষা করেছিলেন, যা পরে আর করা হয়নি। সেই সমীক্ষায় দেখা যায় : শহরের শতকরা ২৮ জন লোক কাঁচা ঘরে বাস করে, ২০ জনের মতো বাস করে হোটেলে—মেসে—দোকানে। এতে প্রায় অর্ধেক লোকের হিসেব পাওয়া গেল। শহরের শতকরা ৫৮টি পরিবার (ব্যক্তি নয়) এক—ঘরের গৃহে বাস করে, ২০টি পরিবার দুই—ঘরের গৃহে। শতকরা প্রায় ৫০ অর্থাৎ অর্ধেক পরিবারের কোনো বৈদ্যুতিক আলো নেই, এমনকী পৃথক জলকলও নেই, ৭৭টি পরিবারের স্বতন্ত্র ল্যাট্রিন নেই, অন্যান্য পরিবারের যৌথ ব্যবহারযোগ্য ল্যাট্রিন আছে আর ১০টি পরিবারের আদৌ কোনো ল্যাট্রিনই নেই, যত্রতত্র সেইসব পরিবারের নারী—পুরুষদের দৈহিক মলমূত্রাদি নিঃসরণ করতে হয়, নারী—পুরুষ যুবক—যুবতী নির্বিশেষে। শতকরা ৫৪টি পরিবারের ব্যক্তিপ্রতি বাসের জায়গা হল টেনেটুনে তিরিশ বর্গফুটের মতো। পরিবারের ব্যক্তি বলতে স্বামী—স্ত্রী ছেলেমেয়ে যুবক—যুবতী শিশু—বৃদ্ধ সবই বোঝায়। চিৎ হয়ে শবাসনে শুয়ে থাকলে একজন মানুষের জায়গা লাগে কুড়ি বর্গফুটের মতো, আর জ্যান্ত মানুষের মতো একটু নড়লে—চড়লে অথবা পাশ ফিরলে তিরিশ বর্গফুটের বেশি লাগে। এরকম কোনো পরিবারের লোকদের যদি রাতের ঘুমন্ত অবস্থার কথা ভাবা যায়, তাহলে চার—পাঁচজন ব্যক্তির হাত—পা—মাথা প্রভৃতি দেহাংশের পরস্পরসংলগ্নতা কীরকম জ্যামিতিক রূপ ধারণ করবে তা ফলিত গণিতবিজ্ঞানীরা বলতে পারেন। সমাজবিজ্ঞানীরা শুধু এইটুকু বলতে পারেন, যে শহরে (যেমন কলকাতায়) অর্ধেকের বেশি পরিবার এইভাবে বসবাস করে, সেখানে পারিবারিক জীবনে, নারী—পুরুষের দাম্পত্যজীবনে, যুবক—যুবতীর যৌনজীবনে চরম বিপর্যয় ঘনিয়ে আসতে বাধ্য। কলকাতা শহরে সেই বিপর্যয় সমাজজীবনে দেখা দিয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও ব্যাপকভাবে দেখা দেবার সম্ভাবনা আছে, যদি না বর্তমান অবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়। আধুনিক নগরবিজ্ঞানীরা বড় বড় শহরে অ্যাপার্টমেন্ট গৃহের আধিক্য লক্ষ করে বলেছেন যে এরকম পার্টিশনের মতো দেয়াল—ঘেঁষা ঘরে বাস করার জন্য নাগরিকদের পারিবারিক দাম্পত্যজীবনের প্রাইভেসি বা গোপনতা বলে কিছু থাকছে না, কাজেই শহরের ঘরবাড়ির নতুন ‘বায়োটেকনিক’ প্ল্যানিং করা উচিত, অর্থাৎ গৃহপ্রকল্পের যান্ত্রিক দিকের সঙ্গে জৈবিক দিকটার দিকেও নজর রাখা উচিত। কলকাতার গৃহপ্রকল্প প্রসঙ্গে সে কথা আপাতত অবান্তর বলে মনে হয়, কারণ যেখানে শতকরা দশটি পরিবারের ল্যাভেটরি বলে কিছু নেই, শতকরা সাতাত্তরটি পরিবারের বারোয়ারি ল্যাভেটরি এবং স্নানঘর ও জলকল নেই অর্ধেকের বেশি পরিবারের, সেখানে পারিবারিক গোপনতা তো দূরের কথা, নারী—পুরুষের ব্যক্তিগত প্রাইভেসিও নেই। জীবন যৌবন মানসম্ভ্রম সমস্ত কিছু এরকম পরিবেশে জলাঞ্জলি দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। সম্ভ্রমবোধ পর্যন্ত ধুলোয় মিশে যায়।

এর সঙ্গে বস্তির কথা অন্তত উল্লেখ না করলে চিত্রটি সম্পূর্ণ হয় না। কলকাতায় প্রায় তিন হাজার বস্তি আছে, যেখানে এক লক্ষ নব্বুই হাজারের মতো পরিবার অর্থাৎ আট লক্ষ লোক বাস করে। বস্তিবাসী শতকরা দুটি পরিবারের পৃথক জলকল স্নানঘর ল্যাভেটরি আছে, বাকি আর কারও তা নেই। অর্থাৎ বস্তিজীবনকে এক রকমের প্রকাশ্য বারোয়ারি জীবন বলা যায়, যেখানে জীবনের গোপনতা পবিত্রতা শালীনতা বলে কিছু নেই, এবং তা রক্ষা করাও সম্ভব নয়। তা যদি সম্ভব না হয় এবং এরকম একটা অবস্থায় মানুষকে বসবাস করতে হয়, তাহলে কলকাতা শহরে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন, যুবক—যুবতীর প্রেম ও যৌনজীবন কেমন করে সুস্থ থাকতে পারে ভাবা যায় না। সুস্থ না—থাকাই স্বাভাবিক। প্রকৃতি তার নিজের পথে নির্মম প্রতিশোধ নিতে বাধ্য। নিচ্ছেও তাই। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায় কলকাতায় আজ আর্থিক পেশা হিসেবে পতিতাবৃত্তি অবৈধ ও নিষিদ্ধ, কিন্তু রক্ষিতাবৃত্তিতে বাধা নেই। পঞ্চাশ বছর আগে ১৯২১ সালে কলকাতার পেশাদার পতিতার সংখ্যা ছিল প্রায় ষোলো হাজার, যখন কলকাতার লোকসংখ্যা ছিল দশ লক্ষের মতো। এমনিতে কলকাতায় নারীর সংখ্যা পুরুষের প্রায় অর্ধেক এবং পঞ্চাশ বছরে লোকসংখ্যা বাড়লেও পুরুষ—নারীর আনুপাতিক হার বিশেষ কমে—বাড়েনি। তার ফলে যৌনাকাঙ্ক্ষার অস্বাভাবিক চোরাগোপ্তা নিবৃত্তির পথ কলকাতায় বরাবরই বেশ প্রশস্ত। বর্তমানে পতিতাবৃত্তি নিষিদ্ধ হওয়ার ফলে মদনভস্মের মতো ‘বিশ্ব মাঝে দিয়েছ তারে ছড়ায়ে’র মতো ব্যাপার ঘটেছে। একদিকে গৃহসংকট, পারিবারিক সংকট, অর্থসংকট, অন্যদিকে কলকাতা শহর পণ্যবাজারে পরিণত হবার ফলে ‘ফুল’ (Full) পতিতাবৃত্তি এবং তার চেয়ে অনেক বেশি ‘হাফ’—পতিতাবৃত্তি শতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ হুতোমের ভাষায়, ‘হাফ—গেরস্ত’র সংখ্যা শহরে অত্যধিক বেড়েছে ও বাড়ছে। নিষিদ্ধ হবার ফলে, পতিতাবৃত্তি আদৌ কমেনি, বরঞ্চ আইনশৃঙ্খলারক্ষকদের আয় বেড়েছে মাত্র।

যে শহরে অর্ধেকের বেশি পরিবারের একটিমাত্র বাসগৃহ এবং মাথাপিছু পঁচিশ—তিরিশ বর্গফুট শোয়া—বসার জায়গা, তা ছাড়া জলকল—আলোর অভাব, সেই শহরে পরিবারের নিজস্ব কোনো আকর্ষণশক্তি বলে কিছু থাকতে পারে না, তার বিকর্ষণশক্তি প্রবল হতে বাধ্য। আজকের কলকাতায় শতকরা প্রায় ষাটটি পরিবারের এই বিকর্ষণশক্তি বৃদ্ধির সামাজিক প্রতিফল কী হয়েছে? প্রথমত, গৃহের বদলে বাইরের আকর্ষণ বেড়েছে, পাড়ায় পাড়ায় তরুণ ছেলেদের স্ট্রিটকর্নার গ্যাং ও দল গড়ে উঠেছে, চায়ের দোকানে, পানের দোকানে, ফুটপাতে, রাস্তার কোণে মোড়ে তরুণদের আড্ডার দল গড়ে উঠেছে। ঘরের টান নেই, ঘরে জায়গাও নেই শোয়া—বসার বা নিভৃতে কথাবার্তা বলার। কাজেই রাস্তা ও চায়ের দোকানই হয়েছে ঘর। এইসব আড্ডার দল যে কত রকমের রূপধারণ করতে পারে তা কলকাতার গত দশ বছরের ইতিহাস থেকে জানা যায়। নানা রকমের ‘ক্রাউড’—এর বা জনতার ইন্ধন জোগায় এইসব দল, যেমন ‘ওপন ক্রাউড’ ‘ক্লোজড ক্রাউড’ ‘বেটিং ক্রাউড’ ইত্যাদি। যে—কোনো সময়, যে—কোনো উত্তেজনা—প্ররোচনায় এই সমস্ত হঠাৎ—জনতা স্থানীয় জীবনযাত্রা লন্ডভন্ড করে দিতে পারে। তার সঙ্গে রাজনীতির মশলা থাকলে, তার বিস্ফোরণশক্তি আরও মারাত্মক হতে পারে। কলকাতায় তা—ই হয়েছে এবং মূলত অধিকাংশ গৃহ ও পরিবারের বিকর্ষণশক্তি বৃদ্ধির ফলে। এই প্রসঙ্গে এ কথাও মনে রাখা দরকার যে বিকর্ষণশক্তি যে কেবল দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের বেড়েছে। তা—ই নয়, সচ্ছল, মধ্যবিত্ত ও অভিজাত পরিবারেও বেড়েছে, সামাজিক জীবনধারার ভোলবদলের জন্য।

পরিবারের টান কমে গেলে আরও অনেক রকমের সামাজিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে, যা কলকাতায় হয়েছে, এবং যার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া এখানে সম্ভব নয়। শুধু ছাত্রদের কথা সামান্য একটু উল্লেখ করছি। ছাত্র সমস্যার কথা। এদিকে ঘরে বসে লেখাপড়া করার স্থানাভাব, অনুকূল পরিবেশের অভাব, আর্থিক অভাব—অনটন তো আছেই। ওদিকে বিদ্যালয়ে ভিড়, ক্লাসে ভিড়, লেখাপড়া সেখানেও বিশেষ হয় না। তাতে বিদ্যালয়ের মালিক বা কর্তাদের অথবা শিক্ষকদের কোনো সমস্যা থাকে না, কিন্তু ছাত্রদের সমস্যা থাকে এবং সেটা খুব বড় সমস্যা, জীবন—মরণ সমস্যা বলা যায়। ‘পরীক্ষার’ সমস্যা। কাজেই ‘পরীক্ষা’ নিয়ে ছাত্র বিক্ষোভ ও বিশৃঙ্খলা অনেক বেড়ে গিয়েছে। ছাত্র বা তরুণদের মধ্যে যেহেতু বাইরের সমাজের মতো শ্রেণিভেদ তেমন প্রকট নয়, তাই মুষ্টিমেয় ছাত্রগোষ্ঠীর বিক্ষোভ অনেক সময় ব্যাপক রূপ ধারণ করে। কলকাতার মতো শহরে এই ধরনের ছাত্রবিক্ষোভ বেশি হয় তার কারণ শহরই হল সবচেয়ে বড় বিদ্যাকেন্দ্র এবং শহরের সামাজিক গড়নটাই আজকাল যে—কোনো ধরনের জনতা বিক্ষোভের অনুকূল। আর এ কথাও ঠিক যে জনতাচালিত বিক্ষোভ, তা যত ক্ষুদ্র জনতাই হোক, রীতিমতো উচ্ছৃঙ্খলতাপ্রবণ।

কলকাতা শহরের পরিবর্তনশীল সমাজজীবনের এটা একটা খসড়া মাত্র। এই খসড়ার মধ্যে ভবিষ্যৎ আশাভরসার কথা কিছু বলতে পারি না, সেজন্য দুঃখপ্রকাশ করা ছাড়া উপায় নেই। আশার কথা C.M.P.O. বলবেন, C.M.D.A. বলবেন, রাষ্ট্রনেতারা বলবেন, রাজনৈতিক পার্টির নেতারা বলবেন। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানের কোনো সূত্র অনুযায়ী আপাতত বর্তমান লেখকের পক্ষে কোনো ভরসার আভাস দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কলকাতার পুনর্গঠন, অর্থাৎ সমস্ত ভেঙে ফেলে নতুন করে কলকাতা গড়াও সম্ভব নয়। নয়াদিল্লির মতো নয়া কলকাতা শহর আর—একটা গড়া যেতে পারে, কিন্তু তা গড়ার আগেই বৃহত্তর নগর জনকুণ্ডল কলকাতা শহর বেষ্টন করে গড়ে উঠেছে। কলকাতার সমাজে গত পঞ্চাশ বছরে অবাঙালির প্রাধান্যও যথেষ্ট বেড়েছে, কাজেই বর্তমান কলকাতার সামাজিক দুর্গতির জন্য এবং জীবনের ধারাবদলের জন্য শুধু যে বাঙালিরাই দায়ী তা নয়, সকল শ্রেণির অবাঙালিরা কম দায়ী নয়। ঔপনিবেশিক শহর কলকাতার মূল আর্থিক বৃত্তিগত যে চরিত্র, অর্থাৎ উৎপাদনবিমুখ চাকরি—বাণিজ্যগত চরিত্র, তারও রূপ বদলানো এখন অসম্ভব। তাহলে কলকাতা শহরের ও তার শহুরে সমাজের ভবিষ্যৎ কী? এ যুগের প্রসিদ্ধ নগর স্থপতি, নগরবিজ্ঞানী ও নগর দার্শনিক ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইটের কয়েকটি কথা এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে। অবশ্য আমেরিকার বড় বড় শহর সম্বন্ধে তিনি কথাগুলি বললেন, কলকাতা শহরের ক্ষেত্রে তা খুবই প্রাসঙ্গিক। রাইট বলেছেন : ‘To put a new outside upon any existing city is simply impossible now. The carcass of the city is far too old, too far gone… Hopelessly, helplessly, inorganic it lies there.’ পুরোনো শহরকে আর কোনোভাবেই নতুন রূপ দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ তার মৃতদেহ অনেককালের বাসি এবং তার বিকৃতিও ব্যাপক। কাজেই রাইটের ভাষায় ‘decentre and reintegrate’, বিকেন্দ্রীকরণ ও নবপূর্ণাঙ্গতা হবে ভবিষ্যৎ নগরপরিকল্পনার লক্ষ্য। রাইটের স্বপ্ন হল, ভবিষ্যতের শহর হবে ‘Broadacre’ শহর যে শহর সর্বত্র ছড়িয়ে থাকবে অথচ কোথাও থাকবে না (‘would be everywhere and nowhere’), যে শহর গ্রামের সঙ্গে বৈষম্যের দূরত্ব ঘুচিয়ে সমগ্র জাতির প্রতিমূর্তি হয়ে উঠবে, যে শহরে প্রত্যেকটি মানুষ অখণ্ড মানুষ হবে, এবং নিরাপদে নিশ্চিন্তে পরিপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারবে (‘each man will be a whole man, living a full life in security’), ভগ্নাংশিক জীবন কাটাবে না। কিন্তু তা করতে হলে তা সমগ্র সমাজের কাঠামোটাও ভেঙে ফেলে নতুন করে গড়তে হবে। সেটা কে করবে?

১৯৭১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *