2 of 2

কলকাতার শেঠ ও বসাকগণ

কলকাতার শেঠ ও বসাকগণ

শেঠরা ছিলেন গৌড়ের অধিবাসী, পরবর্তীকালে তাঁরা সুবর্ণ গ্রাম, ঢাকা কাসিমবাজার মুর্শিদাবাদ এবং হুগলী জেলার হলুদপুরে বসবাস করতে চলে আসেন। পূর্বে তাঁরা পেশায় তন্তুবায়* ছিলেন। ক্রমে তাঁরা সূতি কাপড়ের ব্যবসায় করতে আরম্ভ করেন। ব্যবসায়ের জন্য তাঁরা বাংলার প্রধান প্রধান শহরে বাস করতেন; পর্তুগীজ ও ওলন্দাজরা যখন উপনিবেশ গড়ে তুলছেন, সেই সময় তাঁরা কলকাতায় বসতি স্থাপন করেন। জনশ্রুতি, পলাশী যুদ্ধের পঞ্চাশ বছর আগে, বর্তমান কেল্লা যে জমিটির ওপর অবস্থিত, সে জায়গায় ধনী শেঠরা বসবাস করতে আরম্ভ করেন, তাঁদের আরাধ্য দেবতা গোবিন্দ জীউ-এর একটি মন্দিরও নির্মিত হয়। ওয়ারেন হেস্টিংসের শাসনকালে বা তৎকালে প্রভাবশালী সরকারি ব্যক্তি মহারাজা নন্দকুমার রায়ের** সময়, শেঠরা বসাকদের কলকাতায় এনে বসবাস করান। উদ্দেশ্য, বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপনে সুবিধা বসাকরাও ধনী ছিলেন। প্রথমে তাঁরা মুর্শিদাবাদে সূতি কোরা) কাপড় ও রেশমী বস্ত্রের ব্যবসায় করতেন, তখন আলিবর্দি খানের শাসনকাল; ক্রমে তাঁরা কাসিমবাজার, ঢাকা এবং অন্যান্য স্থানে শাখা স্থাপন করেন। বর্তমানের কলকাতার শেঠ ও বসাকগণ কাসিমবাজার, ঢাকা প্রভৃতি স্থানের শেঠ ও বসাকদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন না।

অনারেবল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বর্তমান কেল্লা*** নির্মাণের সময় গোবিন্দপুরের জমির বদলে শেঠ ও বসাকদের জমি দান করেন। সেই সময় শেঠগণ গোবিন্দ জীউর মূর্তিটি বড়বাজারে নিয়ে যান; বৈষ্ণব দাস শেঠের বাড়ির উত্তর কোণে নির্মিত মন্দিরে এখনও এই মূর্তি অধিষ্ঠিত আছে। এই সময় শেঠ ও বসাকদের মধ্যে পাঁচ ব্যক্তি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিলেন। এঁরা হলেন যদুবিন্দু শেঠ, বৈষ্ণবদাস শেঠ, শোভারাম বসাক, বৃন্দাবন বসাক ও কৃষ্ণচন্দ্র বসাক। যদুবিন্দু ও বৈষ্ণবদাস অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। বিষ্ণুপুরের রাজাদের ইষ্টদেবতা রাধাকান্ত জীউ-এর বিগ্রহ এনে যদুবিন্দু শেঠ ৫নং বাঁশতলা লেনে প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে রাধাকান্ত জীউর একটি সুন্দর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন; সেখানে আজও ৪০ থেকে ৫০ জনকে প্রত্যহ খাওয়ান হয়। আর ধার্মিকপ্রবর বৈষ্ণবদাস কলকাতা থেকে মুখ-ঢাকা পাত্রে করে পবিত্র গঙ্গাজল সোমনাথ ও দ্বারকনাথের মন্দিরে পাঠাতেন; খাঁটি ও নির্ভেজাল গঙ্গাজলের প্রমাণস্বরূপ পাত্রগুলির উপর তাঁর নামের মোহর অঙ্কিত থাকত। তাঁর প্রপৌত্রের সময় পর্যন্ত এই ব্যবস্থা চালু ছিল।

যদুবিন্দু শেঠের দুই বংশধর চৈতন্যচরণ ও আনন্দচন্দ্রও অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। মহারাজা নরকৃষ্ণ দেববাহাদুর ও কলকাতার নাগরিকবৃন্দ চৈতন্যচরণের দানশীলতা ও অন্যান্য বহু গুণের জন্য তাঁকে বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন। আনন্দচন্দ্র ছিলেন অত্যন্ত মিতব্যয়ী; মৃত্যুকালে তিনি পঞ্চাশ লক্ষ টাকা রেখে গিয়েছিলেন; উত্তরাধিকারসূত্রে এই অর্থ পেয়েছেন চৈতন্যচরণ শেঠের বংশধর রাধাকৃষ্ণ শেঠের পুত্র বাবু মাধবকৃষ্ণ শেঠ। তিনি (মাধবকৃষ্ণ) চৈতন্যচরণ ও আনন্দচন্দ্র উভয়ের সম্পত্তিরই মালিক। তিনি কলকাতা শহরের জাস্টিস অব দি পীস্।

যদুবিন্দু শেঠের অন্যতম বংশধর নন্দলাল শেঠের পৌত্র রাধাকান্ত শেঠ হিন্দু কলেজের উজ্জ্বল ছাত্র ছিলেন। তিনি রাজা রাধাকান্ত দেববাহাদুরের প্রীতি ও শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন; তিনি উচ্চশ্রেণীর সঙ্গীতজ্ঞ ও ফার্সী ভাষায় পন্ডিত ছিলেন। তাঁর পুত্র প্রিয়নাথ শেঠ যদুবিন্দু শেঠের বাসভবনে বাস করছেন; সচ্চরিত্র, বুদ্ধিমান ও অত্যন্ত ভদ্র।

রাধাকান্ত বসাকের পুত্র বাবু তারিণীচরণ বসাক বর্তমানে শোভারাম বসাকের বংশের কর্তা। বৃন্দাবনচন্দ্র বসাকের বংশধরদের অনেকে এখনও জীবিত। এখনও কৃষ্ণচন্দ্র বসাকের বাসগৃহ কলকাতায় বর্তমান। বিডন স্কোয়ারের নিকট চিৎপুর রোডের ওপর গৃহটি অবস্থিত। শহরের কিছু শিক্ষিত উৎসাহী যুবক এখানে একটি পাঠকক্ষ স্থাপন করেছেন।

——-

[* তন্তুবায়দের মধ্যে শেঠ, বসাক, দত্ত, মল্লিক ও হালদার এই পাঁচটি পদবী প্রচলিত।

** কামাল-উদ্-দীন মহারাজা নন্দকুমারের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে মামলা দায়ের করেন। মহারাজাকে দোষী সাব্যস্ত করে ‘১৭৭৫-এর জুলাই মাসে ফাঁসি দেওয়া হয়। ভারতীয়গণ স্তম্ভিত হয়ে পড়েন যে, একজন অতি উচ্চস্থানাধিকারী ভারতীয়, তদুপরি তিনি ব্রাহ্মণ, এইভাবে ফাঁসিতে প্রাণ হারালেন। এই প্রথম ইংরেজরা একজন পদস্থ ভারতীয়কে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করলেন।’ তাঁর পুত্র মহারাজা গুরুদাস রায়, রায় রায়ান, সূতানুটির চড়কডাঙ্গায় বাস করতেন। ভাগিনের রাজা মহানন্দ ব্যতীত মহারাজা গুরুদাসের অন্য কোন উত্তরাধিকারী ছিলেন না। রাজা মহানন্দ ছিলেন মুর্শিদাবাদ নিজামতের দেওয়ান। এঁর তিন পুত্রের মধ্যে কনিষ্ঠ কুমার জয়কৃষ্ণ মুর্শিদাবাদে বাস করতেন।

*** (কলকাতার) বর্তমান কেল্লা যে জমির ওপর অবস্থিত, কেল্লা স্থাপিত হবার পূর্বে ঐ স্থানটি ছিল গোবিন্দপুর। অনারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পুরাতন কেল্লা ছিল ড্যালহৌসি স্কোয়ারের উত্তর- পশ্চিম ৷]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *