কলকাতার শীত
কতরকমের দুর্ভাবনা মানুষের, শীত কেন পড়ছে না। জনে-জনে প্রশ্ন, শীতের কী হল বলুন তো মশাই? আবহাওয়াটা কি একেবারেই বদলে গেল? পৌষ মাস শেষ হতে চলল। আর কবে শীত আসবে! কথায় আছে আধা মাঘে কম্বল কাঁধে। ভয় দেখাবার মানুষের অভাব নেই, শীত না পড়ার মানে বোঝেন, পকস। মায়ের দয়ায় সব উজাড় হয়ে যাবে। হয় শীতের দয়া না হয় মায়ের দয়া। শীত না আসুক শ্বাসকষ্টের রোগীরা যথারীতি কাতর হয়ে পড়েছেন। ধুলো আর ধোঁয়ায় ঘনঘন হাঁচি। মধ্যরাত পর্যন্ত বিছানায় খাড়া বসে। শ্বাসে প্রশ্বাসে মাউথ অরগ্যান। ওষুধের কম্ম নয়। সভ্যতার হাঁসফাঁসানি শেষ রাতে অটোমেটিক্যালি সাবসাইড করবে। সিভিলাইজেশানের দীর্ঘশ্বাস। লক্ষ লক্ষ চুলা বাতাসে ধোঁয়া উগরে গেছে, সারাদিন হাজার হাজার গাড়ি ফুঁসে গেছে, এগজস্ট ফিউম তুলে গেছে ধুলোর ঝড়। শীত না আসুক বাতাস ভারি হয়েছে। বিষাক্ত চন্দ্রাতপের তলায় জীবনের ছটফটানি। সেমিনারে সেমিনারে বায়ু-দূষণের বিরুদ্ধে রোমহর্ষক সব হুঁশিয়ারি। ক্যানসার রোখে কে। প্রতি শ্বাসে ফুসফুসের ঝিল্লি অঙ্গার কণিকায় কালো হচ্ছে। কত আর নাকে রুমাল চাপা দিয়ে মৃত্যুদূতকে ঠেকানো যায়!
শীত কোন দিক থেকে আসে! উত্তরবঙ্গের পথ বেয়ে না রাজধানীর দিক থেকে! শীত না আসাটা কি কেন্দ্রের বিমাতৃসুলভ আচরণ না দার্জিলিং এর ঘিসিং-আন্দোলন। অথবা পাকপরমাণু বোমা, কী চিনের কোনও আণবিক কেরামতি! অত্যন্ত দুর্ভাবনার মধ্যে দিন কাটছে। যত অনিষ্টের গোড়া আমাদের লেজে পড়ে থাকা বঙ্গোপসাগর। চাপের গোলমালে হিমালয়ের হিমেল বাতাসকে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে।
শীত এখন স্মৃতি। কলকাতায় সেই শীত সত্যিই আর পড়ে না। লাজুক মেয়ের মতো উঁকিঝুঁকি মেরে সরে পড়ে। আমার বয়েস তখন খুবই কম। তবে প্রবীণ মানুষদের নানা কিছু বলার মতো, আমিও বলতে পারি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ আমি দেখেছি। শীতের রাতে দোতলার ঘেরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাতিবাগানে জাপানি বোমা পড়া আমি দেখেছি। ফুটফুটে চাঁদের আলোয় চরাচর ভেসে যাচ্ছে। হঠাৎ আকাশ গুমরে উঠল। যেন এক ঝাঁক ভ্রমর কাছেই কোথাও উড়ে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ আগুনের করাতে আকাশ চিরে গেল। পরক্ষণেই একটা গম্ভীর শব্দে জানলার শার্সি, আলমারির কাচ কেঁপে ঝনঝন করে উঠল। পুরোনো বাড়ির ভিতরের ছাদ খসে ঝরে পড়ল চুন বালি। বড়রা হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন একতলার জানলাহীন গুদামঘরে। যে ঘরে আমরা অন্যসময় ভয়ে ঢুকতাম না। ড্যাম্প লেগে দেওয়ালে নোনা ধরে গেছে। সেই ঘরের শীতল মেঝেতে জড়াজড়ি করে বসে আছে গোটা পরিবার। টিমটিম করে বাতি জ্বলছে কেঁপে-কেঁপে। ওই ঘরে ছিল অসংখ্য ইঁদুর, ছুঁচো আর কয়েক হাজার লাল-লাল স্বাস্থ্যবান আরশোলা। একটি শিশুর কাছে জাপানি বোমার চেয়েও ভীতিপ্রদ ছিল আরশোলা। জ্যাঠামশাইয়ের গরম চাদরের তলায় গুটিসুটি মেরে বসে থাকতুম। আরশোলা ওড়াওড়ি করত। মৃত্যুর মতো শীতলতা চারপাশ থেকে চেপে আসত। জ্যাঠমশাই আমাকে বুকের উষ্ণতায় চেপে ধরে বলতেন, ভয় নেই বাপি। এখুনি অল ক্লিয়ার হয়ে যাবে।
অল ক্লিয়ারই হয়ে গেছে। ভালোবাসার যাঁরা ছিলেন, বুকে টেনে নিয়ে অভয় দেওয়ার যাঁরা ছিলেন তাঁরা অল ক্লিয়ার করে চলে গেছেন। স্মৃতিটুকুই কেবল পড়ে আছে। আপনজন ঘিরে না থাকলে শীতের মাধুর্য খোলে না। শীতে একা আর কফিনে শুয়ে মাটির তলায় চলে যাওয়া একই অভিজ্ঞতা। বিশাল খাটে রোদ-ফোদ নরম গরম বিছানা। রাতের তরিবাদি খাওয়া শেষ। উত্তরের বারান্দায় হিমশীতল জলে কোনওরকমে হাত ধোওয়া। উত্তুরে বাতাসে বুকের ভেতরটা গুড়গুড় করে কেঁপে উঠছে। বড়রা বলছেন, জলে যেন হাত ঠেকানো যাচ্ছে না। হাত কেটে নিচ্ছে। যাদের দাঁত খারাপ তাঁরা কুলকুচো করার জন্যে মুখে জল নিয়েই, বাবারে বলে লাফিয়ে উঠছেন। সাবধানী, স্বাস্থ্য বাতিকগ্রস্ত গুরুজন মহিলাদের কেউ বলছেন, খোকার হাতটা ধোওয়ার পর ভালো করে দেখো, শীতের ভয়ে গামছাতেই এঁটো হাত মুছে দেবে। ছেলেবেলায় আমরা তাই করতুম। কোনওরকমে হাত মুছে হিহি করতে-করতে সোজা বিছানায়, একেবারে লেপের তলায়। ওরে! পা মোছ, পা মোছ। আর পা মোছ! পায়ের দায়িত্ব লেপের ওয়াড়ের। বিছানায় সাদা চাদরে শীত লেগে আছে। গায়ের গরমে-গরমে না হওয়া পর্যন্ত একটা কুঁইকুঁই ভাব। মুখে লেগে আছে, শীতের ফুলকপির স্বাদ। এখনও ফুলকপি আছে। সে স্বাদ নেই। কেমিকেল সারে স্বাদ নষ্ট হয়ে গেছে। ফুলকপির সঙ্গে কড়াইশুঁটি এক দুর্লভ পাওনা। যেমন পায়েসের সঙ্গে কিসমিস। সেযুগের নতুন আলু, তারও কোনও তুলনা ছিল না। খোসা-ওঠা-ওঠা এক অনবদ্য আকর্ষণ। শুকনো দমের ঘ্রাণ এখনও যেন নাকে লেগে আছে। সেকালের শৈশব একালের মতো মাথায়-তোলা আদরে ভরপুর ছিল না। অভিভাবকরা বলতেন, ছেলেদের একটু কষ্টের মধ্যে রাখতে হয়, মানুষ করতে হয়। হাতে একআনা পয়সা এলে আমাদের মনে হত কী বড়লোক। এক পয়সা, দু-পয়সা চাঁদা তুলে শিশুদের বনভোজন। শীতের মাঠে সোনা রোদ। ঝোপের আড়ালে মিষ্টি গরমে, ইটের উনুনে কাঠকুটো জ্বেলে বনভোজন। পদ একটাই, নতুন আলুর দম। আমার বোন অল্প বয়সে পাকা রাঁধুনি হয়ে উঠেছিল। সেই রাঁধত। শালপাতায় পরিবেশন। এক-একটা আলুতে লেগে থাকত অদ্ভুত পানসে স্বাদ। নতুন আলুর বৈশিষ্ট্য। পাতাটাকে চেটেচুটে তেলা করে ফেলতুম। তাই দেখে আমার বোন তার ভাগ থেকে একটু ভাগ দিত। ঝালের চোটে ওই শীতেও আমাদের নাকের ডগায় ঘাম জমত। শীত গেছে। শৈশব গেছে। বোন গেছে। স্মৃতি নিয়ে পড়ে আছে পাকতেড়ে এক বৃদ্ধ।
সময়ের সেতু যত বড়ই হোক মন তাকে ইচ্ছেমতো ছোট-বড় করতে পারে। শৈশব নামক নদীর ওপারটি যত দূরেই হোক তাকে ইচ্ছে করলেই নাগালে আনা যায়। মনে হয়, এই তো সেদিন। এই তো সেদিন আমাদের দোতলার ঘরে সাদা বিছানায়, সাদা লেপের তলায় শুয়ে আছে শিশুটি। পাশে শাল মুড়ি দিয়ে বালিশে আড় হয়ে আছেন তার জ্যাঠামশাই। যিনি সারাদিনে দুটি পান খেতেন। সকালে আর রাতে খাওয়ার পর। সামান্য একটু জর্দা। সেই গন্ধে মনে একটা সুখ-ভাব হত। জ্যাঠামশায়ের মুখটা যত না কাছে তার চেয়েও বেশি কাছে মনে হত। তিনি মজার মজার সব গল্প শোনাতেন। সেই গল্প শুনে মেয়েরা সব হাসাহাসি করত। গল্পের বিশ্বাসযোগ্যতায় সন্দেহ প্রকাশ করত। গঙ্গার ব্রিজের ওপর দিয়ে মালগাড়ি যাওয়ার একটানা গুমগুম শব্দ উত্তুরে বাতাসে ভেসে আসত। মনে-মনে ভাবতুম, ইঞ্জিনের ড্রাইভার তবু আগুনের কাছে আছে; কিন্তু গার্ডসায়েবের কতই না শীত করছে। গাড়ির শব্দ লেপের তলা থেকে আমার মনটাকে তুলে নিয়ে যেত, দূরে-বহুদূরে। জামতাড়ায়, মধুপুরে, দেওঘরে, কারমাটারে, শিমূলতলায়।
শীতে বাইরে যাওয়ার রেওয়াজ তখন বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে খুব চালু ছিল। এখন হয়েছে পুজোয়। বাঙালির আর একটা প্রিয় জায়গা ছিল সাহেবগঞ্জ। পাহাড় ঘেরা ছোট্ট একটি শহর। পাশে বয়ে চলেছে গঙ্গা। সেখানে আবার ছিল নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ। এখনও হয়তো আছে। সন্ধেবেলা পাহাড়ের মাথায় ফুসফুসি ঘাসে কারা আগুন ধরিয়ে দিত। কাচের ঘরে বসে মাংসওয়ালা মাংস বিক্রি করত। সকালে ঘি-চপচপে মোহনভোগ খেয়ে বড়দের হাত ধরে মাইলের পর মাইল শুধু হাঁটা। পাহাড়ি নদীর মজা বুজে গোল-গোল নুড়ি আর চুনাপাথর। চলতে পা হড়কে যেত। এমন শীত যে, গলাবন্ধ অলেস্টার পরেও যুত হত না। মাথায় হনুমান টুপি। গলায় মাফলার। পায়ে মোজা। কিছুক্ষণ হাঁটার পরই, নাকে জল। নিজের আঙুল গলার কাছে ঠেকালেই ছ্যাঁক করে উঠত।
শীতে একবার গড়ের মাঠ, ইডেন গার্ডেন, এখন অদৃশ্য কার্জন পার্ক আর চিড়িয়াখানায় যাওয়া হতই। সঙ্গে খাবার আর অজস্র কমলালেবু। চিড়িয়াখানায় ঝিলে অজস্র হাঁস। বেতগাছের ঝোপের পাশে শতরঞ্জি বিছিয়ে রোদে বসা। কমলালেবুর খোসা ছাড়িয়ে এক…একটি কোয়া মুখে ফেলা। শীতের সঙ্গে রোদ্দুর রঙের কমলালেবুর গন্ধের একটা আত্মীয়তা আছে। লেবুর কোয়ার ফুল বের করে খাওয়া ধৈর্যের ব্যাপার হলেও এক ধরনের বিলাসিতা। আমার পরিবারের সুন্দরী মেয়েরা কোথায় চলে গেলেন আমাকে ফেলে। আমার মা, জ্যাঠাইমা, দিদি। নীল রঙের ফুল-হাতা সোয়েটার, সিল্কের শাড়ি, মাথায় সিল্কের স্কার্ফের ঘোমটা। পায়ে ডোরাকাটা পামশু। শীত এলেই মেয়েদের দেহত্বক আরও তেলা, আরও শুভ্র হয়ে উঠত। মরা মরা চিড়িয়াখানাটা এখনও আছে। ঝিলে আর তেমন পাখি নামে না। মিলিয়ে গেছে শীতের দুপুরে আমার প্রিয়জনদের উচ্ছল হাসি। সেই জমিটুকু আছে, যেখানে পঞ্চাশ বছর আগে পৌষের দুপুরে সুখী একটি পরিবার গিয়ে বসত। রোদ মোলায়েম হতে-হতে এক সময় গিয়ে উঠত গাছের মাথায়। বিছনো খবরের কাগজ শীতল হয়ে আসত। গুটিগুটি সবাই এগিয়ে যেত গেটের দিকে। ঘাসের ওপর থেকে তুলে নিত গরমজামা।
আমাদের ছাদে ঢালু একটা চিলের ছাদ ছিল। অনেকটা বসে থাকা চিলের মতো। তারই ছায়ায় মাদুর পেতে শীতের দুপুরের অঙ্ককষা। শ’খানেক বড় বড় টবে নানা বর্ণের চন্দ্রমল্লিকা ফুটে আছে। সেকালের অনেক বাড়িতেই চন্দ্রমল্লিকার চর্চা ছিল। প্রখর শীতের যাদুতে চন্দ্রমল্লিকার রূপ খোলে। এই জাপানি ফুলকুমারীকে দিয়ে শীত মাপা যায়। শীত যখন সময়ের পথ গড়িয়ে মাঝামাঝি চলে যায় তখন আসর সাজাতে আসে ডালিয়াকুমার। তখন শীত ছিল, মানুষের শখ ছিল, খোলামেলা ছাদ ছিল। ছাদে-ছাদে ছিল ফুলের বাহার। হেলিকপ্টার নামার জন্যে চাই বড় ছাদ আর সবুজ মাঠ। একালের মানুষের জীবন থেকে ছাদের বিলাসিতা হারিয়ে গেছে। মাঠ হারিয়ে গেছে কংক্রিটের জঙ্গলে। অধিকাংশ মানুষই ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। ছাদ পড়ে থাকে তালাবন্ধ।
শৈশবে আমার জীবনে একটা ছাদ ছিল। সেই ছাদের তলায় ছিল শীতের লেপের নরম উষ্ণতার মতো স্নেহভরা এক পরিবার। হাসি ছিল, গান ছিল, গল্প ছিল। সদলে বেড়ানো ছিল। ছাদে রোদে বসে তেলমাখা, সেই রোদে বসে স্নান। পায়ে জড়িয়ে যেত ছাদের কালো-কালো বালি। ঠান্ডা শরীর ধীরে-ধীরে রোদের তাপে গরম হত। মনে হত ক্রমশই সজীব আর সতেজ হয়ে উঠছি। শরীরের ত্বক থেকে উঠত জীবনের গন্ধ।
চিলের ছাদের ছায়ায় বসে বিদ্যাচর্চা। পাশেই ফুলের মেলা। রোদ যেন বর্ণ ঢালছে, নেশা ঢালছে, চন্দ্রমল্লিকার পাপড়িতে। মাঝে-মাঝে ভ্রমর আসত স্কুলের হেডমাস্টারের মতো পর্যবেক্ষণে। ডেঁও আর লাল পিঁপড়ে আসত সার দিয়ে লোভীর মতো খাদ্যের সন্ধানে। ছুটছাট প্রজাপতিও আসত নেচে-নেচে। আমাদের এলাকায় ঘুড়ি উড়ত সরস্বতী পূজার সময়। ঘুড়ির খুব নেশা ছিল। পূজার এক মাস আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত। আর পূজার দিন আকাশ ছেয়ে যেত রঙবেরঙের ঘুড়িতে। ঘুড়ি মানুষের চোখকে আকাশলগ্ন করে। নীলের নেশায় বুঁদ করে দেয়। পড়ার ফাঁকে-ফাঁকে দ্বিপ্রহরের আকাশের দিকে চোখ মেললেই দেখা যেত লাট খাচ্ছে চাঁদিয়াল, পাক মারছে চিল। সেকালে আবার ঘুড়ি বেয়ে প্রেম হত। আমাদের পাড়ার পাকা ছেলে বিজয় ঘুড়ির গায়ে লিখলে, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তারপর সেই ঘুড়িটাকে নামিয়ে দিলে বোস-বাড়ির ছাদে। আলসেতে দাঁড়িয়ে ছিল সুন্দরী উত্তরা। রোদে চুল শুকোচ্ছিল। ভালোবাসার বদলে বিজয়ের বরাতে জুটল অভিভাবকের জুতোপেটা।
শীতের ভোরে ঘরের জানলা খোলাটাও ছিল বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। কোনও-কোনওদিন জানলা খুলেই অবাক। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সব ধোঁয়া। আকাশ বাতাস যেন জমে গেছে। কুয়াশা, কুয়াশা বলে চিৎকার চেঁচামেচি। কথা বললেই মুখ দিয়ে ভলভল করে ধোঁয়া বেরচ্ছে। জানালার বাইরে অদৃশ্য হাতের পাঁচিল তৈরি হয়েছে রাতারাতি। রাস্তায় মাফলারে মাথা ঢেকে কে চলেছে বোঝা দায়। সবাই যেন আততায়ী। রুটির গাড়ি চলেছে কফিনের মতো। বড়রা বলছেন—লগুন-ফগ। আমরা কথা বলছি। ভলকে ভলকে ধোঁয়া। মনে-মনে ভাবছি সায়েব হয়ে গেছি।
অনেক অনেক পরে কুয়াশার জাল ছিঁড়ে ভেজা-ভেজা রোদ গরাদ গলে লাল মেঝেতে পিওনের ফেলে যাওয়া চিঠির মতো এসে পড়ল। ইস্ত্রি করা নিভাঁজ নীল আকাশে গলগলে আনন্দের মতো ঝাঁকঝাঁক পায়রা। ছেঁড়া মাকড়সার জালের মতো কুয়াশা তখনও ঝুলে আছে, ঝোপে ঝাড়ে মাটির কাছাকাছি। আমরা ছুটে যেতুম ঘাসের ডগায় শিশিরের নোলক দেখতে। সবুজ, ভেলভেটের মতো বহুবর্ণ কচুপাতায় টুসটুস করছে বিশুদ্ধ শিশিরের ফোঁটা। হাঁসেদের শীত নেই। পুকুরের সবুজ জলে পেছন উলটে-উলটে চান করছে। প্যাঁকপ্যাঁক ডাকে প্রভাত মুখর। গরুর দুধ দোয়া হচ্ছে। দুধ থেকেও ধোঁয়া বেরচ্ছে।
শীত কি সত্যিই পড়ে না? না, বহুদিনের বেঁচে থাকার কর্কশ অভিজ্ঞতায় প্রবীণদের চামড়া গণ্ডারের মতো পুরু আর অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছে। বাসন্তী রঙের উল জড়ানো, রাঙা টুপি মাথায় তিনমাসের টাটকা শিশুটি প্রবীণ পিতার বুকের কাছে। তার চোখ দুটো যেন নীলকান্ত মণি। তার আপেলের মতো গালে আমার ভাঙা গাল ঠেকালুম। কী, ঠান্ডা! নিশ্বাসে পবিত্র দুধদুধ গন্ধ। শীত কি তাহলে আছে। প্রবীণের বুকে ধরা পবিত্র শিশুটির মতো।
DARUN