(কলকাতার) রাজন্দ্রেনাথ মিত্রের পরিবারবর্গ
কলকাতার দক্ষিণস্থ সুপরিচিত হরিনাভি গ্রামে ছিল এই পরিবারের আদি বাস। এখানেই আদিগঙ্গার একটি পুরনো খাতকে এখনো বলে মিত্রদের গঙ্গা।
এই পরিবারের ২২তম পুরুষ দাতারাম মিত্র প্রথম বসবাসের জন্য কলকাতা আসেন। ঠনঠনিয়ায় তিনি সুরম্য প্রাসাদতুল্য একটি বাসগৃহ নির্মাণ আরম্ভ করেন। এর নির্মাণ সম্পূর্ণ করেন তাঁর খ্যাতিমান পুত্র চন্দ্রশিখর মিত্র। কিন্তু গত চল্লিশ বছরের মধ্যে বাড়িটি অনেক হাত-বদল হয়েছে। এখন এটি বাবু দুর্গাচরণ লাহার বাসগৃহ।
কলকাতার কায়স্থ সমাজে দাতারামের উচ্চ স্থান ছিল; ধর্মপরায়ণতা ও ভক্তির জন্য সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন। ১৮১০ সাল নাগাদ তাঁর মৃত্যু হয়; তাঁর ধর্মপ্রাণা স্ত্রী সতী হয়ে স্বামীর সহগামিনী হন। দাতারামের তিন পুত্র : মদনমোহন, চন্দ্রশিখর এবং ভোলানাথ।
সেযুগেও মদনমোহন ইংরেজি ও সংস্কৃতে তাঁর পান্ডিত্যের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের বন্ধু। তাঁরই সহযোগিতায় তিনি কিছু বাংলা বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ করতে থাকেন। কিছুকাল তিনি বরিশাল কালেক্টরেটের দেওয়ান ছিলেন; কিন্তু মাত্র ২২ বছর বয়সে প্রতিশ্রুতিময় এই জীবনের অবসান ঘটে।
চন্দ্রশিখর ছিলেন এই পরিবারের বিশিষ্ট ব্যক্তি; ঔদার্য ও দানের জন্য তিনি যে খ্যাতি অর্জন করেন, তার দ্বারা পিতার খ্যাতিও ম্লান হয়ে যায়।
ম্যারাইন বোর্ডের দেওয়ানরূপে চন্দ্রশিখর বর্মা যুদ্ধের সময় সরকারের প্রভূত উপকার সাধন করেন। উচ্চতর সরকারি অফিসারগণ তাঁকে বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন আর এদেশীয়গণ তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন তাঁর ধর্মপরায়ণতার জন্য। প্রতিটি পূজাই তিনি মহাধুমধামের সঙ্গে পালন করতেন, তাঁর সুবিস্তৃত আঙিনায় পূজা উপলক্ষে বিখ্যাত ‘অধিকারী’ পরমানন্দের যাত্রাগানের অনুষ্ঠান হতো।
রাজপুরের ধনী জমিদার দূর্গারাম করের কন্যার সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়, অন্যান্য দিক থেকেও তিনি কলকাতার প্রধান প্রধান কায়স্থ পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন; কিন্তু তিনি পরিবারের জন্য ধনসঞ্চয় করে রাখতে চাননি। আয় করতেন তিনি প্রচুর, কিন্তু দান ও ধর্মকর্মে তাঁর ব্যয় ছিল ততোধিক। অমিতব্যয়িতার ফলে জমিদারী হাতছাড়া হয়ে গেল; সমগ্র সংসারের আর্থিক পরিস্থিতি এসে দাঁড়াল বিভ্রান্তিকর অবস্থায়। তাঁর ছোট ভাই ভোলানাথ, যিনি এতকাল দাদার একান্ত অনুরক্ত ছিলেন, লোকে বলত রাম-লক্ষ্মণ, সেই ভোলানাথ দাতার তীব্র বিরোধিতা করতে লাগলেন, এই তিক্ততা এবং বিভ্রান্তিকর আর্থিক পরিস্থিতির জন্য ভগ্নহৃদয় চন্দ্রশিখর এই সব ঘটনার অল্পকাল পরেই মাত্র ৪২ বছরে পরলোকগমন করেন।
ভাই ভোলানাথ অতি শোচনীয় অবস্থায় জীবনযাপন করলেও চন্দ্রশিখরের পরিবারের সঙ্গে তার মারাত্মক বিরোধ চালিয়ে যেতে লাগলেন– চল্লিশ বছর ধরে এই বিরোধ চালাবার পর পৈতৃক ভদ্রাসন বিক্রি হয়ে গেলে দুই শরিক পৃথক হয়ে যায় –বিরোধেরও অবসান ঘটে। ভোলানাথের তিন ছেলে– তিনজনই এখন মৃত।
চন্দ্রশিবরের পাঁচ পুত্র : ঈশ্বরচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, গোপালচন্দ্র, কালাচাঁদ ও গোকুলচন্দ্র। কালাচাঁদের মৃত্যু হয় ১২/১৩ বছর বয়সে। নবীনচন্দ্র ছিলেন সুশিক্ষিত তিনি প্রথমে জেনারেল ট্রেজারিতে চাকরি করতেন, পরে হন স্মল কজ কোর্টের অ্যাকাউন্টেন্ট; তাঁর বুদ্ধিমত্তা, ন্যায়বোধ এবং শিষ্টাচারের জন্য জজসাহেবরাও তাঁকে সম্মান করতেন। ১৮৫১তে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর সন্তান ছিল না। কনিষ্ঠ গোকুলচন্দ্ৰ বুদ্ধিমান কিন্তু কিছুকাল যাবৎ তিনি অসুস্থ। তিনি ধর্মতলায় বাস করেন; তাঁর দুই পুত্র চন্দ্রশিখরের তৃতীয় পুত্র গোপালচন্দ্র খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বর্তমান বয়স ৬০ বছর। তিনি শিক্ষালাভ করেন প্রথমে হেয়ার স্কুলে এবং উচ্চতর শিক্ষালাভ করেন বিশপস কলেজে। রেভঃ জি সি মিটার সুপন্ডিত এবং ধার্মিক এবং বিনয়ী খ্রিস্টীয়ান। তিনি বাংলা, সংস্কৃত, ইংরেজি, গ্রীক, ল্যাটিন এবং হিব্রু ভাষায় পন্ডিত। তিনি কালীঘাটের দক্ষিণে টালীগঞ্জে বাস করেন। বিনা পারিশ্রমিকে তিনি বালকদের শিক্ষাদান করেন। এই অঞ্চলের সকল অধিবাসীরই তিনি অতীব প্রিয়জন 1
চন্দ্রশিখরের জ্যেষ্ঠ পুত্র ঈশ্বরচন্দ্রের যৌবন পর্যন্ত কাটে পারিবারিক ঐশ্বর্যে। সে গৌরব অস্তমিত হওয়ায় তিনিই সব থেকে বেশি আঘাত পান; তিনি অসাধারণ স্থৈর্যের সঙ্গে বর্তমানের দুরবস্থা মেনে নেন। হতাশায় ভেঙে না পড়ে তিনি ধৈর্যের সঙ্গে সুদিনের অপেক্ষা করতে থাকেন। ব্যক্তিগত জীবনে সৎ ও ধার্মিক ঈশ্বরচন্দ্র দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে সৎভাবে এবং ধর্মপথে থাকলে পিতৃপিতামহের গৌরবের দিন আবার ফিরে আসবে। এখন তাঁর একমাত্র লক্ষ্য হল পাঁচ পুত্রকে সুশিক্ষিত করে তোলা; নিজে তিনি হিন্দু কলেজে শিক্ষালাভ করেছিলেন; এবং স্বয়ং ছেলেদের শিক্ষায় সহায়তা করতে লাগলেন। ৬৭ বছর বয়সে ১৮৭৪এর এপ্রিল মাসে তাঁর মৃত্যু হয়; কিন্তু এই তৃপ্তি নিয়ে তিনি মরতে পেরেছিলেন যে কনিষ্ঠ পুত্র ব্যতীত অন্য সকলেই প্রেসিডেন্সি কলেজের শিক্ষা সমাপ্ত করতে পেরেছেন এবং জীবিকার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিতও হতে পেরেছেন। তাঁর পাঁচ পুত্র হলেন : রাজন্দ্রেনাথ, মহেন্দ্রনাথ, উপেন্দ্রনাথ সুরেন্দ্রনাথ এবং যোগেন্দ্রনাথ।
পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষালাভের পর রাজেন্দ্রনাথ ৯ বছর বয়সে হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন; সেখান থেকে ১৮৪৮এ তাঁকে ভর্তি করা হয় প্রেসিডেন্সি (তখন হিন্দু) কলেজে। এখানে তিনি দু’টি জুনিয়র এবং পাঁচটি সিনিয়র স্কলারশিপ লাভ করেন; কলেজি শিক্ষা জীবনের শেষ বছরে ১৮৫৪-৫৫তে তিনি বাংলার সকল কলেজের মধ্যে প্রথম স্থানের অধিকারী হন। এই কলেজের আইন বিভাগেও তিনি ভাল ফল করেছিলেন; আইন পরীক্ষায় তিনি পুরস্কার ও ডিপ্লোমার সঙ্গে সম্মানসূচক প্ৰশংসাপত্র লাভ করেন; ফলে তিনি সদর (এখন, হাই) কোর্টে প্র্যাকটিস করার অধিকারী হন, মুনসেফের চাকরির উপযোগী শিক্ষাগত যোগ্যতাও অর্জিত হয়। ১৮৬১তে তিনি সদর আদালতে উকিল হিসাবে নিজের নাম নথিভুক্ত করান। কিন্তু তাঁর কলেজ জীবনে, কলেজ কর্তৃপক্ষের জোর সুপারিশক্রমে বাংলা সরকারের সচিব স্যার উইলিয়াম গ্রে তাঁকে ১৮৫৫তে বেঙ্গল অফিসে নিয়োগ করেছিলেন; ওকালতি না করে এই অফিসে থাকা শ্রেয় বিবেচনা করে তিনি চাকরি করতে থাকেন; এই অফিসে, হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট, রেজিস্ট্রার প্রভৃতি স্তরগুলি পার হয়ে তিনি বাংলা সরকারের সচিবের পদে উন্নীত হন এই পদেই তিনি এখন মর্যাদার সঙ্গে অধিষ্ঠিত আছেন। চার নম্বর ওয়ার্ড থেকে তিনি ক্যালকাটা টাউনের নির্বাচিত কমিশনার, বেথুন সোসাইটির অবৈতনিক সম্পাদক এবং বেঙ্গল সোস্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য। তাঁর বর্তমান বয়স ৪৭ বছর; তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র খগেন্দ্রনাথ কিছুদিন পূর্বে ঢাকার ডেপুটি ম্যাজিট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর নিযুক্ত হয়েছেন।
ঈশ্বরচন্দ্রের মধ্যমপুত্র মহেন্দ্রনাথও তাঁর প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন হেয়ার স্কুলে এবং পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়ন করে শিক্ষা সমাপ্ত করেন। বিখ্যাত ব্যারিস্টার মিঃ এ টি টি পিটারসনের অধীনে চাকরির মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূত্রপাত হয়; তারপর তিনি ঈ বি রেলওয়েতে চাকরি করেন। কয়েক বছর চাকরি করার পর তিনি ব্যবসা করার জন্য চাকরি ছেড়ে দেন; শুরু করেন ঠিকাদারি এবং মাল সরবরাহের ব্যবসা “ বুদ্ধিমান ও পরিশ্রমী হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীন পেশায় সফল হতে পারলেন না। এখন তিনি ই আই আর অফিসে চাকরি করছেন। তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও ব্যবসায়ী স্বভাবের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তিনি প্রিয়পাত্র। তাঁর বর্তমান বয়স ৪৩ বছর।
ঈশ্বরচন্দ্রের তৃতীয় পুত্র উপেন্দ্রনাথের এখন বয়স ৩৭ বছর; তিনি এম এ বি এল। ১৮৬৩তে কলেজ ছাড়ার পর তিনি ঢাকা কলেজের লেকচারার হন; পরে হন সেখানকার সরকারি উকিল। এখন তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসায় করেছেন।
ঈশ্বরচন্দ্রের চতুর্থ পুত্র সুরেন্দ্রনাথ। এখন তাঁর বয়স ৩০। তিনি বাংলা সরকারের সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে চাকরি করছেন।
ঈশ্বরচন্দ্রের পঞ্চম পুত্র ঋগেন্দ্ৰনাথ ল’ পাস করে তিন বছর ঢাকা জজ কোর্টে প্র্যাকটিস করার পর, এখন জলপাইগুড়িতে নসেফের চাকরি করছেন।