কলকাতার মন
যে মন নিয়ে জোব চার্নক সুতানুটিতে বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে ভবিষ্যৎ কলকাতা মহানগরের ভিত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই মন হল পাশ্চাত্য বণিকের সজাগ ব্যবসায়ীর মন। নিরাপদ বাণিজ্যে আর্থিক মুনাফার হিসেব ছাড়া কলকাতার প্রতিষ্ঠাতার মনে সেদিন আর কোনো মানবিক সুচিন্তা উদ্ভাসিত হয়নি। জন্মকালের এই মনই কলকাতা শহরের বয়সবৃদ্ধির সঙ্গে পরিপুষ্ট ও পাকাপোক্ত হয়েছে। ১৬৯০ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত প্রায় পৌনে তিনশো বছরে এই অর্থলোলুপ বণিকের মন পুঁজিবাদীর গর্বোদ্ধত ভঙ্গিমায় আকাশস্পর্শী হয়েছে কলকাতা মহানগরে। কলকাতার মানুষের মনের কেন্দ্রস্থ চিন্তা ও অনুধ্যান আজ টাকা এবং আজ মানবিক সাংস্কৃতিক গুণাগুণের যাচাই হয় টাকার কষ্টিপাথরে। মহানাগরিক জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রতীক হল টাকা। টাকা সচল তাই মানুষও সচল। এমনকী মানবহৃদয়ের যে সমস্ত আবেগ, অনুভূতি, ভাবানুভাব ও সহজ বৃত্তিকে আমরা এতদিন শাশ্বত সত্য বলে জানতাম সেগুলিও আজ টাকার চাকচিক্যের কাছে ম্লান হয়ে গেছে। স্নেহ, মায়ামমতা, প্রেম—ভালোবাসা, শ্রদ্ধাভক্তি সমস্ত মানবিক হৃদয়বৃত্তিকে বণিকের মনোবৃত্তি আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। ডালহৌসি—চৌরঙ্গির প্রশস্ত রাজপথ ও স্কাইস্ক্রেপার থেকে নগরপ্রান্তের অখ্যাত অলিগলি, বস্তি এবং শহরতলির সুদূর আনাচকানাচ পর্যন্ত এই বণিকবৃত্তির নির্লজ্জ প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। চার্নকের দেশি ও বিদেশি উত্তরাধিকারীরা সমস্ত কলকাতা মহানগরকে ধীরে ধীরে এক বিশাল বাণিজ্যকুঠিতে পরিণত করেছেন এবং মহানগরের মানুষগুলোকে তৈরি করেছেন বাণিজ্যের বেচাকেনার পণ্যরূপে।
কলকাতা শহরকে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠতে দেখেছেন কিপলিং তাঁর কবিকল্পনায়—‘as the fungus sprouts chaotic from its bed, so it spread’—কিন্তু এর অনেকটাই কল্পনা, ঐতিহাসিক সত্য নয়। বণিকের লাভ—লোকসানের মানদণ্ডে কলকাতার দাঁড়িপাল্লা নিঃসন্দেহে লাভের দিকে বেশি ঝুঁকেছিল, তাই চার্নক ও কোম্পানির কর্তারা কলকাতায় বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করে তার জমিদারিস্বত্ব কেনার জন্য উদগ্রীব হয়েছিলেন। তিনদিকে গড়খাইয়ের মতো নদীবেষ্টিত এবং সমুদ্রের কাছাকাছি এরকম সুরক্ষিত বাণিজ্যবন্দর উত্তর ভারতে দুর্লভ ছিল। তা ছাড়া সোনার বাংলার অফুরন্ত সম্পদের আকর্ষণও নেহাত কম ছিল না। কাজেই কলকাতাকে কিপলিং—এর ভাষায় ‘chance-erected’ বলা যায় না, তবে তাঁর কথার এইটুকু সমর্থন করা যায় যে ‘palace, byre, hovel, poverty and pride side by side’—এই বৈশিষ্ট্য নিয়ে কলকাতার নাগরিক রূপায়ণ হয়েছে এবং সেই একই বৈশিষ্ট্য আজও কলকাতার মেট্রোপলিটন মহাবিকাশপর্বে অক্ষুণ্ণ রয়েছে। কিন্তু এই রূপায়ণের মধ্যেও কোনো দৈবক্রমের ব্যাপার নেই বরং পরিকল্পনাই আছে এবং সবচেয়ে বেশি আছে বাণিজ্যতন্ত্র ও ধনতন্ত্রের দ্বিধাগ্রস্ত যাত্রাপথের স্থূল পদচিহ্ন। কেবল কলকাতার বহিরঙ্গেই যে আছে তা নয়, তার মানসতার মধ্যেও এই স্থূলতার চিহ্ন সুস্পষ্ট।
কলকাতার আদিপর্বে ইংরেজরা কেবল বণিক ছিলেন না, অধিকন্তু জমিদারও ছিলেন। কোম্পানির প্রতিনিধিদের মধ্যে ‘জমিদার’ পদে একজন ইংরেজ কর্মচারী অভিষিক্তও হতেন। এই জমিদার—বণিকের মিশ্রমন আঠেরো শতকের তৃতীয় পর্ব পর্যন্ত কলকাতা শহরে নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার করেছে। সামন্ততন্ত্র ও বণিকতন্ত্রের এই অবাঞ্ছিত পরিণয়ের সামাজিক ফলাফল হয়েছে ভয়ানক শোচনীয়। এ দেশের ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততন্ত্রের অনেক উচ্ছিষ্ট ও আবর্জনা নতুন নগরমুখী জনজোয়ারের স্রোতে ভাসতে ভাসতে কলকাতার ঘাটে এসে ভিড়েছে। গোবিন্দরাম মিত্র, নবকৃষ্ণ দেব, দর্পনারায়ণ ঠাকুর, গোকুল ঘোষাল, রামদুলাল দে, মদন দত্ত এবং আরও যাঁরা তখন কলকাতা শহরে ভাগ্যান্বেষণে এসেছেন, তাঁরা বেনিয়ানি, মুচ্ছুদ্দিগিরি ব্যাবসাবাণিজ্য যা—ই করুন—না কেন, তাতেই কমবেশি কৃতকার্য হয়েছেন এবং ধনদৌলতের অধিকাংশ হয় সামন্তসুলভ প্রমোদমত্ততায় অথবা জমিদার হবার বাসনা চরিতার্থের জন্য ব্যয় করেছেন। সামন্তযুগের প্রেতাত্মা তাঁদের সকলের স্কন্ধে ভর করেছে। তাঁরাই হয়েছেন নতুন কলকাতা শহরে আদিপর্বের অভিজাত শ্রেণি। এই অভিজাতদের সঙ্গে শিক্ষাসংস্কৃতির বিশেষ কোনো সম্পর্ক ছিল না। তখনকার ইংরেজ শাসকরাও আকৃতিতে যেমন, প্রকৃতিতেও তেমনি স্থূল ছিলেন। ইংরেজদের সামাজিক ইতিহাসের একজন পণ্ডিত বলেছেন যে অষ্টাদশ শতকের ইংল্যান্ডে প্রধানত দু—রকমের ইংরেজ দেখা যেত, একরকম robust ও boorish টাইপ, আর—একরকম thin ও quizzical টাইপ। এই রোবাস্ট ও ব্যুরিশ টাইপের ইংরেজদের মধ্যে একদল এ দেশে আসেন কোম্পানির অধীনে রাইটার ফ্যাক্টরের চাকরি নিয়ে প্রধানত ভাগ্যের জুয়াখেলা খেলতে। জুয়াখেলায় জিত হয় যাঁদের তাঁরা প্রচুর ধনসঞ্চয় করে স্বদেশে ফিরে যাবার পর সাধারণের কাছে ‘নবাব’ (Nababs) নামে পরিচিত হন। বাস্তবিক এ দেশে তাঁরা নবাবই ছিলেন এবং স্বদেশে ফিরে গিয়ে এখানকার নবাবি অভ্যাস ও মেজাজ ছাড়তে পারেননি। অষ্টাদশ শতকের ইংরেজি ব্যঙ্গসাহিত্যের এঁরা ছিলেন অন্যতম নায়ক। মানসিক সম্পদ এঁদের এমন কিছু ছিল না যা দান করার যোগ্য। অবশ্য অর্থলোভ ছিল আর অমার্জিত প্রভুত্ববোধ ছিল এবং এগুলি এ দেশের নতুন উপপ্রভু শ্রেণির মধ্যে বেশ কিছুটা সংক্রামিত হয়েছিল। তবে তার চেয়েও বেশি বোধহয় আমাদের এ দেশীয় মানসতার প্রভাব পড়েছিল ইংরেজদের ওপর। তাঁরা এ দেশের বাইজিনাচ, হাতির লড়াই, মুরগির লড়াই, দুর্গোৎসবে ভোজ তামাশা থেকে আরম্ভ করে হুঁকো—গড়গড়ায় তামাক খাওয়া পর্যন্ত শিখেওছিলেন আর আমরা কিছু কিছু ইংরেজি খানাপিনায় অভ্যস্ত হয়েছিলাম মাত্র। উভয়ের মধ্যে তখন হৃদ্যতা ও মেলামেশা বেশ প্রাণখোলা ছিল যা দুই পক্ষই রোবাস্ট ও ব্যুরিশ টাইপ হলে হয় তাই। ওদিকে ক্লাইভের যুগ, এদিকে গোবিন্দরাম নবকৃষ্ণর যুগ। মুর্শিদাবাদ তখনও বাংলার রাজধানী আর বাংলার সংস্কৃতির মণিকেন্দ্র নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রর রাজসভা। এই নবাব দরবার ও জমিদার—রাজসভার মানসিক প্রতিচ্ছবি হল আঠেরো শতকের কলকাতা কালচার।
কলকাতা শহরকে নতুন রাজধানী করার পরিকল্পনা করে ওয়ারেন হেস্টিংস কোম্পানির ডিরেক্টরদের কাছে যে পত্র লেখেন (নভেম্বর ১৭৭৫) তাতে বলেন যে কলকাতা রাজধানী হলে অনেক দিক থেকে সুফল ফলার সম্ভাবনা আছে। কলকাতার জনসংখ্যা বাড়বে, ধনসম্পদ বাড়বে এবং তার ফলে কী হবে? হেস্টিংসের মতে এই হবে যে
—Which will not only add to the consumption of our most valuable manufacture imported from home but will be the means of conveying to the native a more intimate knowledge of our customs and manners and of conciliating them to our policy and Government.
হেস্টিংসের এই উক্তির তাৎপর্য গভীর। রেভারেন্ড ফারমিঙ্গারের কথাই ঠিক যে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে যদি কলকাতার পত্তন করে থাকেন জোব চার্নক, তাহলে হেস্টিংস ‘political capital’ হিসেবে কলকাতার প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন। রাজনীতির প্রধান কেন্দ্র অর্থাৎ ‘রাজধানী’ হল কলকাতা হেস্টিংসের আমল থেকে। কোর্টকাছারি—অফিস সব কলকাতায় স্থাপিত হল, আর ‘ইংলিশ’ আইন অনুযায়ী বিচার আরম্ভ হল এবং এই ইংরেজি আদালতের কাজকর্মের তাগিদে কিছু কিছু ইংরেজি ভাষার চর্চাও শুরু হল। তাকে ঠিক ইংরেজি—শিক্ষা বলে না, কারণ দু—তিন কুড়ি ইংরেজি শব্দ শিখতে পারলেই তখন কাজ চলে যেত। কেবল আদালতের কাজ নয়, তখনকার ইংরেজ শাসক ও বণিকদের সঙ্গে মেলামেশার কাজও তাতে চলে যেত। ইংরেজি—শিক্ষার উপর ইংরেজরাও তখন কোনো মর্যাদা আরোপ করতেন না। বরং হেস্টিংসের আমলে এ দেশীয় সংস্কৃত ফারসিচর্চার মর্যাদা ছিল। উইলকিন্স, জোন্স, কোলব্রুক, ফরবিস, জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন, বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার, এঁরাই ছিলেন এই আমলের মর্যাদাবান ব্যক্তি, বিদ্যার দিক দিয়ে। বিত্তের দিক থেকে অখণ্ড প্রতিপত্তি ছিল ইংরেজদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বড় বড় বাঙালি বেনিয়ান, মুনশি, দালাল, গোমস্তা ও সরকারদের। ইংরেজদের সঙ্গে বাঙালিদের মনের বা অভিরুচির বা শিক্ষাসংস্কৃতির কোনো পার্থক্য বিশেষ ছিল না এবং যেটুকু ছিল তাতে উভয়ের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব তেমন রচিত হয়নি। দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসতার দিক থেকে দুই পক্ষই ছিলেন গাট্টাগোট্টা, রোবাস্ট ও ব্যুরিশ টাইপ।
আঠারো শতকের ইংরেজরা নিজেদের দেশে ইংল্যান্ডে যে ‘fudding and punch-drinking’, ‘club and coffee-house boosing’-এর জন্য ‘shortened their lives and enlarged their waistcoats’—বাংলা দেশের কলকাতা শহরেও ঠিক তা—ই না করলেও অনেকটা তা—ই করে তাঁরা মেদবৃদ্ধি করেছেন এবং অকালমৃত্যুও বরণ করেছেন। কলকাতার পুরোনো গোরস্থানে গেলে তার খানিকটা প্রমাণ পাওয়া যায়। বউবাজার, লালবাজার, খিদিরপুর অঞ্চলে অনেক ট্যাভার্ন গজিয়ে উঠেছিল এবং হারমনিক ট্যাভার্নের মতো কয়েকটি ট্যাভার্ন বিখ্যাত হয়েছিল কোম্পানির ভিআইপি—দের নিয়মিত সঙ্গলাভে। কিন্তু আশ্চর্য হল এই যে আঠারো শতকের কলকাতার নামজাদা নেটিভ বাবুরা এইসব ট্যাভার্নে যাতায়াত করতেন না অথবা এই ধরনের কোনো প্রকাশ্য স্থানে সুরাপানাদি সহযোগে ইংরেজদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন না। অন্তত এই মেলামেশার কোনো সংবাদ কোথাও পাওয়া যায় না। শোভাবাজারের মহারাজা নবকৃষ্ণ, ভূকৈলাসের গোকুল ঘোষাল বা জয়নারায়ণ ঘোষাল, হাটখোলার মদন দত্ত, সিমলার রামদুলাল দে, পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর বা মল্লিকরা কেউ যদি এইসব ট্যাভার্নে গিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন তাহলে উইলিয়াম হিকির মতো প্রত্যক্ষদর্শীরা তাঁদের স্মৃতিকথায় নিশ্চয় এ বিষয়ে কিছু—না—কিছু লিখতেন। অথচ তখনকার এইসব বড় বড় বাঙালি বেনিয়ান বাবুরা ও রাজা—মহারাজারা নানাবিধ কাজকর্মে সর্বদাই ইংরেজদের সান্নিধ্য লাভ করতেন এবং দোল—দুর্গোৎসবে নিজেদের গৃহে খানাপিনা ও নৃত্যগীতের আসরে ইংরেজদের সাদরে আহ্বান করতেন। কিন্তু পাবলিক ট্যাভার্নের প্রমোদকক্ষে পদার্পণ করতে নেটিভ বাবুরা সাহস করতে না। জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁরা অসাধারণ সাহসী ছিলেন, বিশেষ করে অর্থ উপার্জনের ফন্দিফিকির উদ্ভাবনে তাঁদের সমকক্ষ ধুরন্ধর ইংরেজরাও ছিলেন কি না সন্দেহ। তাহলে ভয়টা তাঁদের কীসের ছিল?
ভয়টা হল সমাজের ভয়। কোম্পানির ডেপুটি—জমিদার গোবিন্দরাম মিত্র, পলিটিক্যাল বেনিয়ান মহারাজা নবকৃষ্ণ, ব্যবসায়ী বেনিয়ান রামদুলাল ও মদন দত্তর মতো দুর্ধর্ষ ব্যক্তিদেরও একটি ভয় ছিল মনে—সমাজভয় এবং তারই সঙ্গে জড়িত ধর্মভয়। এই ‘সমাজ’ কোন ‘সমাজ’? নবযুগের কোনো নতুন সমাজ নয়, পুরাতন সমাজ। মধ্যযুগের সমাজ। যাবতীয় বিধিনিষেধ, সংস্কার—কুসংস্কার, টোটেম—ট্যাবু ইত্যাদি নিয়ে মধ্যযুগের সমাজ কলকাতা শহরে আঠেরো শতকে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। রাজনীতিক্ষেত্রে বাহ্যত মধ্যযুগ ও নবাবি আমল অস্ত গেলেও, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানসিক ক্ষেত্রে তার প্রভাব তখনও ম্লান হয়নি। অর্থনীতিক্ষেত্রে মধ্যযুগের বাণিজ্যিক বাধাবিপত্তি সামান্য কিছুটা অপসারিত হলেও, আধুনিক শিল্পায়নের কাজ আরম্ভ হয়নি। বিজ্ঞানের আলো সমাজের ও মনের বদ্ধ জানালা ভেদ করে ভিতরে প্রবেশ করেনি। কলকাতার মন পুরোদস্তুর তখন মধ্যযুগের অন্ধকারে বন্দি। যেমন ছিল কলকাতার মন তেমনি ছিল কলকাতার দৈহিক গড়ন। পলাশির যুদ্ধের কয়েক মাস আগে (৭ এপ্রিল ১৭৫৭) কলকাতার ইংরেজ জমিদার ‘all Weavers, Carpenters, Bricklayers, Smiths, Tailors, Braziers etc. Handicraft, shall be incorporated into their respective bodies, one into each district of the town’—এই মর্মে এক দীর্ঘ ফতোয়া জারি করেন। ফতোয়ার বক্তব্য হল এই যে ছুতোর, কামার, কুমোর, মিস্ত্রি, দরজি, তাঁতি প্রভৃতি কারুবর্গ কলকাতার বিভিন্ন নির্দিষ্ট পাড়ায় স্বতন্ত্র বৃত্তিগত গোষ্ঠী হিসেবে বাস করবে এবং প্রত্যেক গোষ্ঠীর একজন করে ‘চৌধুরি’ (headman) ও প্রত্যেক পাড়ায় একজন করে ‘মণ্ডল’ থাকবে। এ হল পুরাতন গ্রাম্য সমাজকে পুরোপুরি কলকাতা শহরের উপর চাপানোর ব্যবস্থা। আঠেরো শতকের মধ্যে এই ব্যবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। তার চিহ্ন আজও কলকাতায় রয়ে গিয়েছে। দরজিপাড়া, কাঁসারিপাড়া, শাঁখারিপাড়া, বেনিয়াটোলা, পটুয়াটোলা ইত্যাদি আঞ্চলিক নামের মধ্যে তার চিহ্ন আছে। ইংরেজরা তখন কলকাতার ‘জমিদার’ এবং তাঁদের প্রসাদপুষ্ট উদীয়মান ও মধ্যগগনে উদ্দীপ্ত এ দেশি অভিজাত শ্রেণি বিদেশি ফিউডাল লর্ডের ‘ভ্যাসাল’ ছাড়া কিছু নন। মন তাঁদের সামন্তযুগ থেকে এক পা—ও অগ্রসর হয়নি।
পার্সিভাল স্পিয়ার বলেছেন : ‘There was no ‘‘European Third’’ in the 18th century’—অর্থাৎ ইংরেজরা তখন এ দেশের হিন্দু—মুসলমানের সঙ্গে মিলেমিশে চলতেন এবং নিজেদের স্বতন্ত্র তৃতীয় একটি শাসকশ্রেণি মনে করে দূরে সরে থাকতেন না। ওয়ারেন হেস্টিংসের আমল পর্যন্ত ইংরেজ—ভারতীয়ের মধ্যে সামাজিক দূরত্ববোধ তেমন সজাগ ছিল না। আসলে তখন এই চৈতন্যবোধের উদয় হয়নি। কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করে কেবল যে এ দেশে ব্রিটিশ স্বার্থের পরিপোষক নতুন এক হঠাৎ—অভিজাত জমিদার শ্রেণি সৃষ্টি করেছিলেন তা—ই নয়। তার সঙ্গে শাসক—শাসিতের সামাজিক দূরত্ববোধও জাগিয়ে তুলেছিলেন এ দেশের লোককে সরকারি কাজকর্মের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। উনিশ শতকের অভ্যুদয়ে ওয়েলেসলি এলেন খাঁটি ‘ইম্পিরিয়াল’ মেজাজ নিয়ে। তাঁর চালচলন, হাঁকডাক ও জাঁকজমকে এই উদ্ধত রূপ প্রকাশ পেল। লাটভবনে এ দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরও উৎসব—অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করা তিনি বন্ধ করে দিলেন। শাসক—শাসিতের সামাজিক দূরত্ব তাঁর আমলে আরও প্রসারিত হল। এই দূরত্ব দেখে শ্রীমতী গ্রাহাম ১৮১০ সালে কলকাতায় এসে অবাক হয়ে লিখেছিলেন :
The distance kept up between the Europeans and the natives is such that I have not been able to get acquainted with any native family… Every Briton appears to pride himself on being outrageously a John Bull.
এই সময় থেকে ইংরেজরা সমাজমঞ্চে ‘empire-buider’-এর উদ্ধত ভঙ্গি নিয়ে দাঁড়ালেন। এই ভঙ্গি তারপর থেকে প্রত্যেক লাটসাহেবই বজায় রেখে চলতেন, কেবল বেন্টিঙ্কের মতো দু—একজন কিছুটা ভিন্নপ্রকৃতির ছিলেন। কিন্তু সেই প্রকৃতি লাটসাহেবদের ব্যক্তিগত মর্জির উপর নির্ভর করত এবং ব্যক্তিগত ব্যবহার বলেই তা গণ্য হত, সাম্রাজ্য শাসননীতির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না।
এই শাসকোচিত মনোভাব ছাড়াও আরও একটি কারণে ইংরেজ—ভারতীয়ের সম্পর্ক এই সময় থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। ইংরেজরা সপরিবারে এ দেশে আসতে আরম্ভ করেন। যাঁরা সপরিবারে আসেন তাঁদের সঙ্গে আগেকার ফ্যাক্টর রাইটার ইন্টারলোপারদের জীবনযাত্রার পার্থক্য অনেক। পারিবারিক জীবনের প্রয়োজনে ইংরেজরা প্রধানত মেমসাহেবদের তাগিদেই কলকাতার সমাজের মধ্যেই পৃথক একটি অর্গলবদ্ধ আঞ্চলিক সমাজ গড়ে তোলেন। চৌরঙ্গির মতো স্বতন্ত্র ইংরেজপাড়ার প্রতিষ্ঠা হয় এই সময়। ইংরেজ সমাজ এ দেশীয় সমাজের মধ্যে ‘rigid’ ও ‘insular’ হয়ে থাকে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক লেনদেনের পথ বাইরে থেকে বন্ধ হয়ে যায়। নবাবি আমলের প্রতিনিধি নবকৃষ্ণদের যুগও শেষ হয়ে যায়। নতুন পথ খুলে যায় অন্যদিক থেকে। ইংরেজি ভাষার ও ইংরেজি শিক্ষার উপর নতুন এক সামাজিক আভিজাত্য এই সময় থেকে আরোপিত হতে থাকে। ইংরেজরাই এটি আরোপ করেন এবং যে মনোভাব থেকে করেন তাকে ‘ইম্পিরিয়াল’ মনোভাবেরই আর—একদিক বলা যায়। সংস্কৃত, ফারসি ও প্রাচ্য বিদ্যার বদলে ইংরেজি ও পাশ্চাত্য বিদ্যাচর্চা আরম্ভ হয়। বাঙালি হিন্দুরা এই বিদ্যাচর্চার সুযোগ নেন ও নতুন সামাজিক মর্যাদার বিদ্যালব্ধ মানদণ্ড সম্বন্ধে বেশ সচেতন হয়ে ওঠেন। সমাজের একটা বড় অংশ মুসলমান সমাজ এই সুযোগ রাজনৈতিক কারণেই সেদিন নিতে চাননি। কলকাতায় পাশ্চাত্য বিদ্যার প্রথম প্রতিষ্ঠানের (এবং ভারতবর্ষের প্রথম) নাম দেওয়া হয় ‘হিন্দু কলেজ’ (১৮১৭)। নবযুগের বাংলার ট্র্যাজিডি হল এই যে এ দেশের হিন্দুরা যে শিক্ষায়তন থেকে পাশ্চাত্য বিদ্যা আয়ত্ত করে যুক্তিবাদী কুসংস্কারমুক্ত ও উদার মতাবলম্বী হয়ে ওঠেন বলে দাবি করেন, সেই বিদ্যালয় কিন্তু সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। হিন্দু কলেজের পরিচালকদের মধ্যে রাধাকান্ত, গোপীমোহন, রাধামাধবের মতো অধিকাংশই ছিলেন গোঁড়া হিন্দুয়ানির সমর্থক। তাঁদের এই হিন্দুয়ানির প্রচণ্ড আক্রোশে হিন্দু কলেজের উদারধর্মী শিক্ষক ডিরোজিও এবং তাঁর শিষ্যবৃন্দের মাথার উপরে ফেটে পড়ে। সেই ফাটার শব্দে সমগ্র হিন্দুসমাজ সচকিত হয়ে ওঠে। তখনও হিন্দুসমাজের অভিভাবক ছিল ‘ধর্মসভা’, যেমন বর্তমানে আছে ‘হিন্দুমহাসভা’ ও ‘জনসংঘ’। নব্যশিক্ষিত হিন্দু তরুণদের যুক্তিবাদ ও উদারতার বিরুদ্ধে সেদিন খড়্গ ধারণ করেছিল ‘ধর্মসভা’।
উনিশ শতকের বাঙালি সমাজে ইউরোপীয়দের ‘তৃতীয় দল’ তৈরি হল এবং তার পাকাপোক্ত বনিয়াদও প্রতিষ্ঠিত হল। চৌরঙ্গি হল কলকাতা শহরে নতুন ইউরোপীয় কালচারের ‘আইল্যান্ড’। প্রথম ও দ্বিতীয় দলের হিন্দু—মুসলমানরা তার চারদিকে ছড়িয়ে রইল। নতুন ইংরেজি বিদ্যা ও বিত্তের মানদণ্ডে নতুন সামাজিক মর্যাদা নির্ধারিত হতে থাকল। কেন্দ্রস্থল থেকে তৃতীয় দল ইংরেজরা এ দেশের দুই দল হিন্দু ও মুসলমানদের নতুন সামাজিক মর্যাদার সোপানে ওঠানো—নামানোর ঐতিহাসিক সুযোগ পেলেন। রাজনৈতিক অভিমানে ও অপমানে মুসলমানরা স্বভাবতই তখন ক্ষুব্ধ ও ইংরেজদের সাহচর্যের প্রতি বীতশ্রদ্ধ। হিন্দুদের, অন্তত হিন্দু ধনিক ও মধ্যবিত্তদের, এই ক্ষোভ ও অশ্রদ্ধার কোনো কারণ ছিল না। তাঁরা পূর্ণমাত্রায় তাই এই সুযোগ গ্রহণ করে বিত্ত ও বিদ্যা দুইদিক দিয়েই সিঁড়ি বেয়ে সামাজিক মর্যাদার উপরের ধাপে দ্রুত উঠে গিয়েছিলেন এবং মুসলমানেরা অনেক পিছনে পড়েছিলেন। সমাজের শ্রেণিবিন্যাসে যে নবরূপান্তর ঘটল তা প্রধানত হিন্দুসমাজকে কেন্দ্র করে। বাংলার সমাজে নতুন হিন্দু ধনিকশ্রেণি, হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের আধিপত্য বিস্তৃত হল। বাংলার মুসলমানদের বৃহত্তম অংশ সমাজের নিচের তলায় নেমে এলেন। সিপাহি বিদ্রোহের পর সৈয়দ আহমেদের মতো পুরুষদের প্রেরণায় মুসলমান সমাজ আত্মস্থ হয়ে ধীরে ধীরে যখন আধুনিক পাশ্চাত্য বিদ্যা ও সামাজিক চিন্তাধারার দিকে আকৃষ্ট হলেন, তখন থেকে তাঁদের মধ্যেও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ হতে থাকল। কিন্তু প্রায় অর্ধশতাব্দীর বিলম্বের ফলে তাঁদের পক্ষে শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্তের বিকাশবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলা সম্ভব হল না। দুই সম্প্রদায়ের শিক্ষিত শ্রেণির আয়তনের মধ্যে পার্থক্য থেকে গেল। এই পার্থক্য কলকাতার নাগরিক সমাজে প্রকট হয়ে ওঠা স্বাভাবিক। তার উপর অযোধ্যা, মহীশূর প্রভৃতি অঞ্চল থেকে নবাব সুলতানরা উৎখাত হয়ে তাঁদের বিশাল আশ্রিত পোষ্যবর্গসহ কলকাতা শহরে নির্বাসিত হলেন। কলকাতার দক্ষিণে ও পশ্চিমে টালিগঞ্জ ও গার্ডেনরিচ, মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলে নতুন মুসলমান, পল্লি প্রতিষ্ঠিত হল এবং তার প্রসারবৃদ্ধিও দ্রুতহারে হতে থাকল। তার কিছুকাল আগে নবাবি আমলের অবসানকাল থেকে আলিপুর, চিৎপুর, কড়েয়া প্রভৃতি অঞ্চলে মুসলমান পল্লি কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। লক্ষ করার বিষয় হল এই যে কলকাতা শহরের এইসব মুসলমান পল্লির সাধারণ মুসলমানরা পুরাতন ক্ষমতাচ্যুত নবাব বাদশাহদের পোষ্য সেবক ও দাসভৃত্য শ্রেণি। পরবর্তীকালে এই শ্রেণির মধ্যে আধুনিক শিক্ষার আলোক কিছুই প্রবেশ করেনি বলা চলে। মনের সংকীর্ণ গবাক্ষ আজও প্রায় তাদের সম্পূর্ণ মোল্লামুখী হয়ে রয়েছে। নবাব বাদশাহের পরে কলকাতার নতুন ইংরেজ প্রভুরা প্রধানত এই শ্রেণির মুসলমানদের যাবতীয় ভৃত্যের কাজে বহাল করে তাদের সামাজিক জীবনের অগ্রগতির পথ অবরুদ্ধ করে দিয়েছেন। হান্টার তাঁর The Indian Mussalmans গ্রন্থে এর বিস্তৃত বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। এখানে তার সামাজিক গুরুত্ব ব্যাখ্যা—বিশ্লেষণ করার অবকাশ নেই। এখানে শুধু এইটুকু ইঙ্গিত করা যেতে পারে যে কলকাতার মতো নাগরিক সমাজে হিন্দু—মুসলমানের সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধি পেল কৃত্রিম উপায়ে ব্রিটিশ আমলে এবং মুসলমানদের ইংরেজবৈর ও পাশ্চাত্যবিমুখতার সুযোগ নতুন শাসকরা পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করলেন। হিন্দুসমাজে নতুন ভূসম্পত্তিনির্ভর ধনিকশ্রেণি তৎসহ কিছু ‘কমপ্র্যাডোর’ এবং বিপুল চাকুরিজীবী ও বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হল, আর অন্যদিকে মুসলমান সমাজে আরদালি, বেয়ারা, বাবুর্চি ,খানসামা প্রভৃতি ভৃত্য শ্রেণি নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণির প্রসার হল। হিন্দুসমাজ খানিকটা গতিশীল হল কিন্তু মুসলমান সমাজ পূর্ববৎ প্রায় স্থিতিশীল হয়ে রইল। অর্থনৈতিক শ্রেণিবৈষম্যের লৌহবর্ত্মে হিন্দু—মুসলমানের সাম্প্রদায়িকতাবোধ চালিত করার সুবিধা হল শাসকদের। অতঃপর রাজনীতির জ্বলন্ত চুল্লিতে তাকে উত্তপ্ত করে সামান্য অজুহাতে প্রচণ্ড দাঙ্গাহাঙ্গামা করা কলকাতাতে তো বটেই, বাংলার যে—কোনো শহরে অত্যন্ত সহজ ব্যাপার হয়ে গেল।
ঐতিহাসিক পোলার্ড বলেছেন যে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ও বিস্তার হয়েছিল বলেই আধুনিক যুগে ‘রেনেসাঁস’ ও ‘রিফর্মেশন’ সম্ভব হয়েছে। উনিশ শতকে বাংলা দেশে যে সামাজিক নবজাগরণ ও কুসংস্কারমুক্তির আন্দোলন হয় তা মধ্যবিত্তের সৃষ্টি এবং প্রধানত হিন্দু মধ্যবিত্তের। মধ্যবিত্তের মধ্যে নব্যশিক্ষিত মধ্যবিত্তরাই এই পথে অগ্রণী হন। এই সামাজিক নবজাগরণে বাংলার শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্তের দান নানাদিক থেকে স্মরণীয়। নবজাগরণ আন্দোলনে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে নতুন হিন্দু ধনিকদের এবং কমপ্র্যাডোরদের একাংশ যোগ দিয়েছিলেন দেখা যায়। খানিকটা অন্তত ইউরোপের মতো নবজাগরণের একটা পরিবেশ তখন তৈরি হয়েছিল কিন্তু যেহেতু তার আধুনিক কালোপযোগী কোনো অর্থনৈতিক পশ্চাদভূমি রচিত হয়নি এবং মূলত না শহরকেন্দ্রিক ও একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের উপরের ও মধ্যস্তরের অল্পসংখ্যক লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, তাই দেখা যায় যে তার প্রসারণ কলকাতার মতো মহানগরের সীমানার বাইরে খুব বেশি দূর পর্যন্ত হয়নি। এমনকী কলকাতার কাছাকাছি গ্রামাঞ্চলও মধ্যযুগের তিমিরেই ডুবে ছিল। অথচ উনিশ শতকের গোড়া থেকেই কলকাতার আধুনিক নাগরিক রূপায়ণ আরম্ভ হয় এবং পথঘাট, বাড়িঘর, লোকজন, যানবাহন, ব্যাবসাবাণিজ্য সবকিছুর প্রসার হতে থাকে। মধ্যপর্বে রেলপথ স্থাপিত হবার পর কলকাতার কেন্দ্রীয় আকর্ষণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। শিল্প—বাণিজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়, বিশেষ করে গঙ্গাতীরে পাটকলগুলির চিমনির ধোঁয়ায় আধুনিক যুগের পদার্পণ ঘোষিত হতে থাকে। লোকজন ক্রমেই জমাট বাঁধতে থাকে কলকাতা শহরে ও তার পাশের শিল্পাঞ্চলে। ল্যুইস মামফোর্ড যাকে আধুনিক শহরের ‘paleotechnic’ পর্ব বলেছেন, কতকটা সেই পর্বে প্রধানত লোহা—কয়লার কেন্দ্রগুলি জমজমাট হয়ে ওঠে। যেমন হয়ে উঠেছে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের আসানসোল—দুর্গাপুর অঞ্চল। সেইদিক থেকে বিচার করলে কিন্তু উনিশ শতক থেকে কলকাতা বা তার আশপাশের শিল্পাঞ্চলে ‘paleotechinc agglomeration’ হয়নি। তবু এই বিকাশপর্বকেই এখানকার আদি টেকনিক স্তরের ‘জনকুণ্ডলায়ন’ বা ‘অ্যাগ্লোমারেশন’ বলা যায়, কারণ উনিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব থেকে মামফোর্ড বর্ণিত লক্ষণগুলি পরিস্ফুট হয়ে উঠতে দেখা যায়। লক্ষণগুলি এই :
…a partly derivative thickening of population along the new railroad lines, with a definite clotting in the new industrial centres along the great trunk lines and a further massing in the greater junction towns and export terminals. Along with this went a thinning out of population and a running down of activities in the back country.
যানবাহন ও পথঘাটের প্রসারের ফলে কলকাতা শহরই বাংলা দেশে বৃহত্তম ‘junction town’ ও ‘export terminal’ হয়ে ওঠে এবং কলকাতার পাশের কারখানাকেন্দ্রে লোকজনের ‘definite clotting’ আরম্ভ হয় আর তার সঙ্গে কলকাতার অন্তত ৫০/৬০ মাইল রেডিয়াসের মধ্যবর্তী ‘back country’-তে ‘thinning out of population’ ও তৎসহ ‘running down of activities’ দেখা দিতে থাকে। যদি ইউরোপের মতো স্বাধীন শিল্পপ্রধান দেশেই এই ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে কলকাতার মতো বিদেশির পদানত ঔপনিবেশিক শহরে তা যে আরও কত ভয়াবহ আকারে ঘটাতে পারে তা আজকের দিনেও কলকাতার পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চল দেখলে বোঝা যায়। কেবল গ্রাম নয়, তার সঙ্গে পুরাতন কারুবর্গ ও কারুশিল্পকেন্দ্রিক ‘producing town’ একে একে সমস্ত ধ্বংস হয়ে গিয়েছে বাংলা দেশে এবং তার পরিবর্তে কলকাতার মতো ‘parasitic capitial city’ পাহাড়ের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। যেমন পৃথিবীর অধিকাংশ ‘পরাধীন শহরে’ হয়েছে তেমনি কলকাতাতেও হয়েছে। ‘Centralization of the organs of administration’ এবং তার সঙ্গে ব্রিটিশ প্রশাসনিক স্বার্থের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গরূপে ‘the growing dependence of every type of enterprise, political educational economic, upon the process of administration itself’ (Mumford)। এই প্রশাসনিক যন্ত্রটি চালু রাখার জন্য ব্রিটিশ শাসকরা ইংরেজি—শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা ও ডিগ্রি প্রভৃতির যথারীতি ব্যবস্থাও করেছিলেন। কারণ এই যন্ত্রের আসল বস্তু হল ‘কাগজ’ ও ‘ফাইল’ যা ব্রিটিশ শাসকদের ঐতিহাসিক দান। কাগজ—ফাইলবহুল শাসনযন্ত্রের যন্ত্রী হলেন বিপুল অফিসার শ্রেণি ও কেরানি শ্রেণি। বিশ্ববিদ্যালয় হল তার উৎপাদনকেন্দ্র। কলকাতা শহর হল ‘কাগজ’ ও ‘ফাইল’—এর শহর, অফিসার ও কেরানির শহর, সাংবাদিক ও উকিল—মোক্তারের শহর, বিদ্যাবুদ্ধিজীবীর শহর—যাঁরা নিজেরা ‘উৎপাদন’ করেন না শুধু, চাষি—মজুরের উৎপাদন সুনির্দিষ্ট বেতনের বিনিময়ে গলাধঃকরণ করে জীবনধারণ করেন এবং কাগজের কারখানা থেকে উৎপন্ন হাজার হাজার টন কাগজ ‘কনজিউম’ করে সমাজে ‘সার্ভিস’ দেন।
মধ্যবিত্তের শহর কলকাতা। কলকাতার মনও মধ্যবিত্তের মন। তার মধ্যে হিন্দু মন ও মুসলমান গোড়া থেকেই ব্রিটিশ কৌশলে প্রায় বিপরীতমুখী। নতুন সামাজিক মানমর্যাদা, প্রভাব—প্রতিপত্তির দিক থেকেও দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈষম্য গোড়া থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই শ্রেণিগত বিদ্বেষও সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে বর্তমান। শহরে তা এমনভাবে জোট পাকিয়ে আছে যে দুটিকে পৃথক করা বেশ কঠিন। তা ছাড়া হিন্দু বা মুসলমান কোনো সমাজেরই বিকাশ বাংলা দেশে সমতা বজায় রেখে হয়নি। দুই সমাজের ভিতরেও অনেক ছোটবড় ব্যবধান রয়েছে যদিও হিন্দুসমাজের মধ্যেই তা বেশি। কারণ শ্রেণিগত ব্যবধান ছাড়া মুসলমান সমাজে ধর্মীয় বন্ধনের জন্য আর কোনো বড় ব্যবধান নেই। হিন্দুসমাজের ঊর্ধ্বাধস্তরবিন্যাসে অনেক খাল—নালা, নদনদীর ব্যবধান রয়ে গিয়েছে যেগুলির উপর কালভার্ট ও ব্রিজ চাপিয়ে আমরা একসঙ্গে চলেছি। কিন্তু সামান্য ধাক্কাতেই দেখা যায় যে কালভার্ট ব্রিজগুলি ধসে পড়ে, যেহেতু মেকলের পাশ্চাত্য শিক্ষানীতির ঠিকাদারিতে তার গোড়ার স্তম্ভগুলি মজবুত হয়নি এবং তলায় যাবতীয় সামাজিক গোঁড়ামির চোরাবালিস্তর রয়ে গিয়েছে। কথায় কথায় বিশেষ করে রাজনীতির চোঙা ফুৎকারে আজও তাই চিরকালের জাতিবর্ণভেদবোধ (Casteism), ধর্মীয় আচার—আতিশয্য (Cultism) সবই বীভৎস আকারে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। নবজাগরণের সূচনা থেকেই হিন্দু মন দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল, রামমোহন, ইয়াংবেঙ্গল ধর্মসভা, বিদ্যাসাগর, সত্যধর্মপ্রচারিণী সভা, ব্রাহ্মসমাজ ও হরিসভার সময় থেকে। ক্রমে উনিশ শতকের শেষ পর্ব থেকেই দেখা গেল ধর্মসভা—হরিসভার প্রভাব বাড়ছে আর তার প্রচারধারা প্রবলতর হচ্ছে এবং রামমোহন, বিদ্যাসাগর ও ইয়াংবেঙ্গল, তত্ত্ববোধিনীর ধারা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। এমনকী মেকলে—নীতির নবজাতকরাও তাঁদের মনের তলাকার চোরাবালির স্তর লুকিয়ে রাখতে পারেননি। হিন্দুধর্মের পুনরভ্যুত্থানের জোয়ারে অনেকেই ‘Caste’ ও ‘Cult’—এর ঘূর্ণাবর্তে পড়ে দিশাহারা হয়েছেন। এই জোয়ারের মুখেই আমাদের জাতীয়তাবোধের প্রবল প্রকাশ হল একেবারে ‘কংগ্রেস’—এর প্রতিষ্ঠা থেকে বিশ শতকের প্রথম পর্বের ‘স্বদেশি আন্দোলন’ পর্যন্ত। পুনরুত্থানবাদীদের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি যে জাতীয়তাবাদের সবল প্রতিষ্ঠা এ কথা নিঃসন্দেহে স্বীকার্য। এ—ও মধ্যবিত্তের এবং প্রধানত হিন্দু মধ্যবিত্তের অন্যতম কীর্তি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল এই যে গোড়া থেকেই এই জাতীয়তাবাদের মধ্যে ‘হিন্দুয়ানি’ এমনভাবে মিশে রইল যে পরে অনেক চেষ্টা করেও জাতীয় কংগ্রেস তাকে ভেজালমুক্ত করতে পারল না, অন্তত মুসলমান সমাজের মনে তার দাগ কাটল না। তার ফলে অখণ্ড বাংলা দেশকে এবং অখণ্ড ভারতকেও আমরা শেষ পর্যন্ত খণ্ডিত করতে বাধ্য হলাম, যদিও ‘অখণ্ড’ ভারতবোধ আজও একটা ‘আইডিয়া’ মাত্র, ঐতিহাসিক বাস্তব সত্য কি না বিচার্য।
কিন্তু সে বিষয় আপাতত আলোচ্য নয়। কলকাতার নাগরিক সমাজের চরম দুর্গতি ও অবনতি আরম্ভ হল। যত তার বহিরঙ্গের ইট—পাথর—লোহার বিকাশ ও বাহার বাড়তে থাকল তত এই অবনতি ত্বরান্বিত হল। তাই হওয়াই স্বাভাবিক, কারণ শহর হল ‘a collective work of art’ (Mumford) এবং ‘a specialized organ of social transmission’ (Geddes) কিন্তু ব্রিটিশ শাসকদের প্রশাসনিক ও শোষণনীতির ফলে কলকাতা শহর কোনোটাই হল না। এদিকে নানাবিধ সার্ভিসের প্রলোভনে চারদিকের গ্রামাঞ্চল থেকে দলে দলে লোক জীবিকার ধান্দায় কলকাতায় এসে জমা হতে থাকল, যার ফলে শহরের ভিতরে বস্তির পর বস্তি গজিয়ে উঠল এবং শহরতলি অঞ্চল এলোপাথাড়ি ফাঁপতে লাগল আর জনকুণ্ডল অমানুষের মতো চাকবদ্ধ হতে থাকল শহরের ভিতরে যত্রতত্র ও প্রান্তে। তার ফলে বিশৃঙ্খলাও জমাট বাঁধতে থাকল—‘What followed was a crystallization of chaos’ (Mumford) এই জমাটবদ্ধ বিশৃঙ্খলার মধ্যে কলকাতা শহর হল সর্বপ্রকারের মানসিক বিকৃতি ও অস্বাভাবিক মানসতার মহাকেন্দ্রস্থল। ‘As pace of urbanisation increased, the circle of devastation widened’ (Mumford)।
কলকাতার বর্তমান ‘মেট্রোপলিটন’ জীবনপর্বে যথারীতি ত্রিমূর্তির আধিপত্যও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সেই ত্রিমূর্তি ‘finance, insurance, advertsing’। যে—কোনো ক্যালকাটানকে আজ একজন টিপিক্যাল ‘মেট্রোপলিটন’ বলা যায়। আজ তার চারদিকে কাগজ সেলুলয়েড সেলোফেন রবার গ্লাস প্লাস্টিক টেরিলিন দিয়ে ঘেরা একটা স্বচ্ছ তন্তুময় অবাস্তব জগৎ ও স্বর্ণমৃগবৎ জীবন। সবার উপরে কাগজ ও রাসায়নিক তন্তু সত্য তার উপরে দারিদ্র্য। ‘When the metroplitan lives most keenly, he lives by means of paper’ (Mumford)। কাগজের মধ্যে ‘খবরের কাগজ’ চরম সত্য এবং নাগরিক জীবনের সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়ের সর্বময় কর্তা। সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য করার এরকম জাদুকরি ক্ষমতা আদিম যুগের ম্যাজিশিয়ানদেরও ছিল না। বড় বড় কাগজ ও প্রেসের কোটিপতি মালিকরা কলকাতার মতো মেট্রোপলিস থেকে সমগ্র দেশের ‘কালচার’ ‘পলিটিক্স’ ও ‘ইকনমিক্স’ কনট্রোল করেন। কাগজ ও সেলুলয়েডের অশরীরী অবাস্তব জগতে নিত্যনৈমিত্তিক জৈবিক ধর্ম পালন করে, তার উপরে মাথা বা মগজের জৈবিক ক্রিয়া বলে করণীয় আর কিছু থাকে না। মহানগরের মর্যাদাপ্রতীকসর্বস্ব নামগোত্রহীন সমাজে জমাটবদ্ধ জনতার মধ্যে তাই প্রত্যেক মানুষের নির্জনতাবোধ যত তীব্র হচ্ছে তত তার বিচারবুদ্ধিহীন গড্ডলিকাবৃত্তি প্রখর হচ্ছে। ঔপনিবেশিক কলকাতার মেট্রোপলিটন জীবনসায়াহ্নে এই গড্ডলমান সত্যরই উৎকট প্রকাশ দেখা যায়। পৌত্তলিকতার প্রবল উত্তেজনায় বলো, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ‘কাল্ট’ ও ‘ওকাল্ট’—এর পুনরুজ্জীবনে বলো, রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িকতার বীভৎস উন্মত্ততায় বলো, বিকৃত যৌনসাহিত্যের উদগ্র ভোজনলালসায় এবং চলচ্চিত্র ও খেলার মাঠের হিস্টিরিয়ায় বলো, সর্বত্র কলকাতা শহরে ক্রমে এই গড্ডলমনই সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে। সত্যনিষ্ঠ বিচারশীল ব্যক্তিমানস ভয়ে তার কাছে আত্মসমর্পণ করছে অথবা সংকুচিত হয়ে শামুকের মতো নিজের খোলসের মধ্যে গুটিয়ে থাকছে।
১৯৬৪