কলকাতার ব্যবসা
কলকাতার ব্যবসায়ে বাঙালী বনাম অবাঙালীর ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনার কোন কৈফিয়তের প্রয়োজন হয় না। কলকাতা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী। পশ্চিমবঙ্গ বাঙালীদের দেশ। সুতরাং এটাই স্বাভাবিক যে, পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা শহরের ব্যবসা-বাণিজ্যে বাঙালীদেরই প্রাধান্য থাকবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি তা নয়। কলকাতার ব্যবসা-বাণিজ্যের সিংহভাগ অবাঙালীর হাতে। বাঙালীর অংশ খুবই নগণ্য। তা-ও ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষমুখে ইংরেজরা যখন কলকাতায় এসে তাদের বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করে, তখন তারা যাদের সঙ্গে বাণিজ্য করত তারা সবাই বাঙালী। বাঙালী বণিকদের তখন আবাসস্থল ছিল বড়বাজারে এবং বড়বাজারই ছিল ব্যবসার সবচেয়ে বড় কেন্দ্র। ইংরেজদের খাতা-পত্রে এটাকে ‘গ্রেট বাজার’ বলে বর্ণনা করা হত।
কলকাতায় এসে যে বণিকদের সঙ্গে ইংরেজদের প্রথম সাক্ষাৎ হয়, তারা হচ্ছে শেঠ- বসাকদের তৎকালীন প্রতিভু জনার্দন শেঠকে তাদের দালাল নিযুক্ত করে। শেঠেরা চালানী মালের ওপর শতকরা তিন টাকা হারে দালালী পেত। শেঠেরা ইংরেজদের অনেক উপকার করেছিল। তারা ইংরেজদের দুর্গনির্মাণের জন্য লালদীঘির পশ্চিমে তাদের ভদ্রাসন ছেড়ে দিয়ে বড়বাজারে উঠে এসেছিল। তাছাড়া অর্থসংকটের সময় শেঠেরা ইংরেজদের টাকা ধার দিত। ১৭০৪ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজরা শেঠ-বসাকদের কাছ থেকে শতকরা একটাকা সুদ হারে টাকা ধার নিয়েছিল।
চালানী কারবারে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর একচেটিয়া অধিকার ছিল। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য বাঙালীদেরই হাতে ছিল। ইংরেজরা দুর্গ-বিশিষ্ট সুরক্ষিত নগরী তৈরী করছে শুনে বাঙালীরা শহরের দিকে ছুটে এসেছিল। তারা এখানে নানারকম ব্যবসা শুরু করেছিল।
ইংরেজদের রপ্তানি বাণিজ্যের প্রধান পণ্য ছিল সোরা, চিনি, কাঁচা রেশম, সূতা ও সুতীবস্ত্র। বাঙলার সকল জাতিই যে এ-সব পণ্য উৎপন্ন করত তা নয়। মাত্র জাতিবিশেষই বিশেষ পণ্য উৎপন্ন করত। কেবল সুতাই সকল জাতির লোকেরা কাটত। ইংরেজদের সঙ্গে বাণিজ্যের ফলে তাদের বৃদ্ধি ঘটেছিল। সুতীবস্ত্রটা তন্তুবায় গোষ্ঠীই উৎপন্ন করত। শেঠেরা এ বিষয়ে সজাগ ছিল, কেননা ১৭৪৮ খ্রীষ্টাব্দে কোম্পানী যখন তন্তুবায় গোষ্ঠীর বাইরের লোকদের দাদন দিয়েছিল, তখন তারা তার প্রতিবাদ করেছিল। অবশ্য কৌলিক বৃত্তিসমূহের ক্রমশ বিলুপ্তি ঘটছিল।
বাঙালী যে কৌলিক বৃত্তি হারিয়ে ফেলছিল এবং নানান জাতির লোক যে নানারকম ব্যবসায়ে লিপ্ত হচ্ছিল, তা আমরা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধের ব্যবসাদারদের নাম থেকে বুঝতে পারি। এইসব ব্যবসাদারদের মধ্যে ছিলেন বৈষ্ণবচরণ শেঠ, গোকুল মিত্র, মোদনমোহন দত্ত, রামদুলাল সরকার, গোবর্ধন রক্ষিত, গৌরী সেন, নিমাইচরণ মল্লিক, সাগর দত্ত, শিবকৃষ্ণ দাঁ, দর্পনারায়ণ ঠাকুর, প্রীতিরাম মাড় প্রমুখ। বৈষ্ণবচরণ ছিলেন তন্তুবায় গোষ্ঠীর লোক। গোবর্ধন ছিলেন তাম্বুলি ও গৌরীচরণ, নিমাইচরণ, সাগর দত্ত প্রমুখ ছিলেন সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ভুক্ত। আর গোকুল মিত্র, মদন দত্ত ও রামদুলাল ছিলেন কায়স্থ। দর্পনারায়ণ ঠাকুর ছিলেন ব্রাহ্মণ ও প্রীতিরাম মাড় কৈবর্ত।
ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বড় বাঙালী ব্যবসায়ীদের মধ্যে ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, মতিলাল শীল, আনন্দমোহন পাল, সুবলচন্দ্র পাল, কৃষ্ণমোহন পাল, গঙ্গাগোবিন্দ শীল, হরগোবিন্দ শীল, বিশ্বম্ভর পাইন, চন্দ্রকুমার পাইন, রামনারায়ণ দে, মাধবচন্দ্র দে, মথুরামোহন সেন, সুবলচন্দ্র নন্দী, ক্ষেত্রপাল সরকার প্রমুখ। সকলেরই ইংরেজদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। এই সময়ের আরও যে সব বাঙালী ব্যবসায়ীদের নাম করা যেতে পারে তাঁরা হচ্ছেন বিশ্বনাথ মতিলাল, রাধামাধব বন্দ্যোপাধ্যায়, রাধানাথ বসুমল্লিক, পীতম্বর মুখোপাধ্যায়, জয়গোপাল মল্লিক, রামকিনু সরকার, জয়নারায়ণ সাঁতরা, কালীকুমার কুণ্ডু, তারকনাথ প্রামাণিক, রাধামোহন প্রামাণিক, রাখালদাস প্রামাণিক, দ্বারকানাথ গুপ্ত ও রামগোপাল ঘোষ। এঁদের মধ্যে অনেকেই ইংরেজদের সঙ্গে যুক্ত- মালিকানায় ব্যবসায়ে লিপ্ত ছিলেন, বিশেষ করে পীতাম্বর মুখোপাধ্যায়, জয়গোপাল মল্লিক, রামকিনু সরকার, জয়নারায়ণ সাঁতরা, কালীকুমার কুণ্ডু, তারকনাথ প্রামাণিক, রাধামোহন প্রামাণিক, রাখালদাস প্রামাণিক, মনিলাল শীল, রামগোপাল ঘোষ ও দ্বারকানাথ ঠাকুর। ইংরেজদের সঙ্গে বাঙালীরা তো গোড়া থেকেই ব্যবসায়ে লিপ্ত ছিল। কিন্তু এরূপভাবে লিপ্ত থাকার মধ্যে বিভিন্ন কালে একটা তারতম্য ছিল গোড়ার দিকে তারা সরাসরি ইংরেজদের মাল বেচত, তারপর তারা বেনিয়ানগিরি করত, পরে (১৮১৩ খ্রীষ্টাব্দের সনদ দ্বারা ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য অধিকার রহিত হবার পর) যুগ্ম মালিকানায় সওদাগরী অফিস স্থাপন করেছিল। মতিলাল শীলের সওদাগরী অফিসের নাম ছিল ওসওয়ালড্ শীল অ্যাণ্ড কোম্পানি দ্বারকানাথ ঠাকুরের ফার্মের নাম ছিল কার টেগোর অ্যাণ্ড কোম্পানি ও রামগোপাল ঘোষের ফার্মের নাম ছিল কেলসন ঘোষ অ্যাণ্ড কোম্পানি। কার টেগোর অ্যাণ্ড কোম্পানি বিখ্যাত সওদাগর অফিসে পরিণত হয়েছিল। এর অংশীদার ছিলেন চারজন—দ্বারকানাথ ঠাকুর, ডবলিউ. কার, ডবলিউ. প্রিনসেপ ও ডি. এম. গর্ডন। দ্বারকানাথ নীল ও রেশম রপ্তানি, কয়লাখনি ক্রয়, জাহাজী ব্যবসা ও চিনির কল স্থাপন করেছিলেন। ইংরেজদের সঙ্গে যুগ্ম মালিকানায় বিলাতী কেতায় ব্যবসা করে তিনি তাঁর সময়ের একজন বিখ্যাত ধনী শিল্পপতি হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আলেকজাণ্ডার অ্যাণ্ড কোম্পানি (ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের খুব বড় বিলাতী ফার্ম) দেউলিয়া হবার পর, তিনি তাদের কাছ থেকে চিনাকুরি কয়লাখনি কিনে নিয়ে, পরে তাকে ‘বেঙ্গল কোল কোম্পানিতে’ রূপান্তরিত করেন। এ দেশে চিনি উৎপাদনে বাষ্পীয় যন্ত্র ব্যবহারের তিনিই প্রবর্তক। জাহাজী ব্যবসা শুরু করে বহু মালবাহী জাহাজ ও ‘দ্বারকানাথ’ নামে যাত্রীবাহী জাহাজ চলাচলের ব্যবস্থা করেন। তাঁর উদ্যোগের একমাত্র দুর্বলতা ছিল যে, তিনি বহু ব্যাপারে একসঙ্গে হস্তক্ষেপ করেছিলেন। ১৮৪৬ খ্রীষ্টাব্দে তিনি মারা যান, এবং তার দু-বৎসর পরে ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক যখন বিপাকে পড়ে, কার টেগোর অ্যাণ্ড কোম্পানির পক্ষে তখন সবদিক সামলানো খুব দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ১৮৫১ খ্রীষ্টাব্দে ‘কার টেগোর অ্যাণ্ড কোম্পানি’ উঠে যায়।
‘কার টেগোর অ্যাণ্ড কোম্পানি’ উঠে যাবার পর বাঙালীর ব্যবসায়ের আর জলুস রইল না। ১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় যখন ব্যবসা জগতে একটা ‘বুম’ আসে, তখন বাঙালী ব্যবসায়ীরা কিছু পয়সা করেছিলেন বটে, কিন্তু ওই ‘বুমের পদক্ষেপে যখন মন্দা এল, তখন তার প্রতিঘাত বাঙালী ব্যবসায়ীদের ওপরই গিয়ে পড়ল। তারপর ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দের দুর্ভিক্ষের সময় যখন জমিদারীসমূহ নীলাম হতে লাগল, তখন অনেক বাঙালী ব্যবসায়ী জমিদারী কিনে রাতারাতি বণিক থেকে জমিদারে পরিণত হল। তবে বাঙালীর ব্যবসা একেবারে উঠে গেল না। এক নতুন রূপ নিল।
কোম্পানির বিনা শুল্কে বাণিজ্য করবার যে সুযোগ ছিল, তা ইংরেজদের কর্মচারীরা অবৈধভাবে নিত। এতে মাত্র কোম্পানিরই যে ভীষণ ক্ষতি হত তা নয়, তাদের জোর জুলুম ও অত্যাচার বাঙালীর ব্যবসাকেও বিঘ্নিত করত। কোম্পানির কর্মচারীদের এই দুর্নীতি ও অত্যাচার দমন করবার জন্য ১৭৭২ খ্রীষ্টাব্দে বিলাতের কর্তারা ওয়ারেন হেষ্টিংসকে গভর্ণর নিযুক্ত করেন। পর বৎসর রেগুলেটিং অ্যাক্ট বিধিবদ্ধ হবার পর দ্বৈত শাসন প্রণালীর অবসান ঘটে ও নিজেদের অধিকৃত অঞ্চলসমূহের শাসনভার ইংরেজ কোম্পানি নিজ হস্তে গ্রহণ করে। ওয়ারেন হেষ্টিংসকে গভর্ণর-জেনারেল নিযুক্ত করা হয়। হেষ্টিংস কোম্পানির কর্মচারিগণ কর্তৃক অবৈধ ‘দস্তক’ গ্রহণ বন্ধ করে দেন। এরই পদক্ষেপে ১৭৮১ খ্রীষ্টাব্দে কর্ণওয়ালিসের অবৈধ মুনাফা রোধ আইন ও ১৭৮৮ খ্রীষ্টাব্দে এজেন্সী প্রণালীর প্রবর্তন অবৈধ ব্যবসার পতন ঘটায়। ১৭৯০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যেই কলকাতায় ১৫টি এজেন্সী হাউসের সৃষ্টি হয়। তার মধ্যে প্রধান ছিল ফেয়ারলি ফারগুসন অ্যাণ্ড কোম্পানি, প্যাকটন ককারেল অ্যাণ্ড ডেলিসল, ল্যামবার্ট অ্যাণ্ড রস, কলভিনস্ অ্যাণ্ড ব্যাজেট এবং জোসেফ ব্যারোটা। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং ১৮১৩ খ্রীষ্টাব্দের সনদ দ্বারা কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসার বিলুপ্তির পর ইংরেজরা যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিল তাদের মধ্যে ছিল আলেকজাণ্ডার অ্যাণ্ড কোম্পানি, পামার অ্যাণ্ড কোম্পানি, ম্যাকিনটশ অ্যাণ্ড কোম্পানি, ফারগুসন অ্যাণ্ড কোম্পানি, কলভিন অ্যাণ্ড কোম্পানি, ক্রুটেনডেন অ্যাণ্ড কোম্পানি, ডেভিডসন অ্যাণ্ড কোম্পানি, মারসার অ্যাণ্ড কোম্পানি, বারনেট অ্যাণ্ড কোম্পানি, মেনচিটা উনেকোর্ট অ্যাণ্ড কোম্পানী প্রভৃতি।
বস্তুতঃ অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকেই এজেন্সী হাউস ছাড়া, বহু ইংরেজ দোকানদার ও ব্যবসায়ীর কলকাতায় আবির্ভাব ঘটেছিল। এসব ব্যবসায়ী তাদের সঞ্চিত অর্থ শতকরা দশ টাকা সুদ হারে এজেন্সী হাউস সমূহে বিনিযুক্ত করত। বহু বাঙালী ব্যবসায়ীও তাদের টাকা এজেন্সী হাউসে জমা রাখত। পরের ধনে পোদ্দারী করে এজেন্সী হাউসমূহ খুব রমরমা কারবার করত। তাঁদের এক একজন অংশীদার যখন অবসর গ্রহণ করে বিলাতে ফিরে যেতেন, তখন তাঁদের বৃদ্ধির পরিমাণ দাঁড়াত ১০০,০০০ থেকে ১৫০,০০০ পাউণ্ড। (মনে রাখতে হবে সে যুগে আয়করের বালাই ছিল না)।
১৭৮২ খ্রীষ্টাব্দের পর এদেশে যখন নীলের চাষের সূত্রপাত হয়, তখন এজেন্সী হাউসসমূহ এইভাবে পরের গাছ থেকে লব্ধ টাকা নীলচাষে বিনিযুক্ত করেছিল। ১৮১৩ খ্রীষ্টাব্দে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য অধিকার বিলুপ্ত হবার পর, তারা প্রভূত পরিমাণে নীলের রপ্তানী করত। ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দে বিলাতে অর্থনৈতিক মন্দা প্রকাশ পায়। মন্দার ঢেউ এখানে এসেও পৌঁছায়। নীলের দাম ভীষণভাবে হ্রাস পায়। এর প্রতিঘাত এজেন্সী হাউসসমূহ সামলাতে পারে না। একের পর এক এজেন্সী হাউস দেউলিয়া হয়ে যায়। এ সময় রাজকৃষ্ণ দত্ত জালিয়াতি ও এজেন্সী হাউসসমূহের পতনের এক কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এরা দেউলিয়া হওয়ার ফলে বিদেশী ও এদেশী বহু লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এদেশী লোকদের মধ্যে যেসব বাঙালী ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তারা হচ্ছে বিশ্বনাথ মতিলাল যাকে তাঁর ক্ষতির জন্য কাঁসারীপটির জমিজমা বেচে দিতে হয়েছিল। আনন্দমোহন পাল ও সুবলচন্দ্র পালের ক্ষতি হয়েছিল ১,৫০,০০০ টাকা, রাধামোহন ও কৃষ্ণমোহন পালের ১,০০,০০০ টাকা, গঙ্গাগোবিন্দ শীল ও হরগোবিন্দ শীলের ২,৫০,০০০ টাকা, বিশ্বম্ভর পাইন ও চন্দ্রকুমার পাইনের ৬০,০০০ টাকা, রামনারায়ণ দে ও মাধবচরণ দে-র ২,৫০,০০০ টাকা, মথুরামোহন সেনের ১৩,০০,০০০ টাকা ও সুবলচন্দ্র নন্দীর ৫০,০০০ টাকা। আমরা পরে দেখব যে, ঠিক এই সময় থেকেই উত্তর ভারত থেকে অবাঙালী ব্যবসায়ীরা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল, কেননা এর পরই ‘কার টেগোর অ্যাণ্ড কোম্পানি’, ‘কেলসন ঘোষ অ্যাণ্ড কোম্পানি’ প্রভৃতির জন্ম হয়। কিন্তু ইউনিয়ন ব্যাংক ফেল হওয়ার পর বাঙালী-ব্যবসায়ীরা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
তারপর ইংরেজের ব্যবসায়ে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। শতাব্দীর মধ্যাহ্ েলিমিটেড লায়েবিলিটি কোম্পানি আইন প্রণীত হওয়ার পর ইংরেজরা ম্যানেজিং এজেন্সী হাউসসমূহ স্থাপন করে শিল্প উদ্যোগের দিকে মনোযোগ দেয়। তবে প্রথম জুট মিল ভাগ্যান্বেষী জর্জ অকল্যাণ্ড ও বাঙালী বামচরণ সেনের যৌথ চেষ্টাতেই গঠিত হয়েছিল। কিন্তু তার পরে যেসব যৌথ কোম্পানি যথা চটকল, কয়লাখনি, চা-বাগান, চিনির কল, ইঞ্জিনীয়ারিং কোম্পানি প্রভৃতি গঠিত হয়, সেগুলি সবই সাহেবী কোম্পানি। এরাই কলকাতার ব্যবসায়ের অধিপতি হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া, বহু বৈদেশিক ফার্ম নানারূপ কারবারে লিপ্ত হয়। স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে সঙ্গেই এইসব বৈদেশিক কোম্পানি তাঁদের মালিকানা স্বত্ব মারবাড়ীদের বেচে দিয়ে দেশে চলে যায়। তার ফলে কলকাতার ব্যবসা জগৎটার মারবাড়ীদের হাতে চলে যায়।
অবাঙালীদের মধ্যে মারবাড়ীরাই প্রথম কলকাতায় আসেনি। এসেছিল পাঞ্জাব ও উত্তর ভারতের লোক। পলাশী যুদ্ধের সময়েই দু-একজন অবাঙালী ব্যবসায়ীর আবির্ভাব ঘটেছিল। তাদের অন্যতম চিল উমিচাঁদ ও তাঁর আত্মীয় হুজুরীমল। দুজনেই পাঞ্জাবের লোক। উত্তর ভারত থেকে কলকাতায় আসা তখন সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। বেনারস পর্যন্ত পায়ে হেঁটে এসে, মীরজাপুর থেকে নৌকা ভাড়া করে নদীপথে কলকাতায় আসতে হত। নদীপথে কলকাতায় আসার খরচ বেশ মোটা অঙ্কের ছিল। এটাই কলকাতায় আসার পক্ষে প্রধান অন্তরায় ছিল। আর এক অন্তরায় ছিল পথিমধ্যে দস্যুতার ভয়। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে স্লীম্যান সাহেব যখন দস্যুতা দমন করলেন, এবং লটারী কমিটি কলকাতাকে নবগঠিত করল, তখন উত্তর ভারতের লোকেরা কলকাতায় এসে ব্যবসা করার প্রতি নিবিষ্ট হল। তারপর ১৮৬২-৬৫ খ্রীষ্টাব্দে দিল্লী পর্যন্ত রেলপথ স্থাপনের পর উত্তর ভারতের লোকেরা হুড়হুড় করে কলকাতায় আসতে থাকে।
১৮?? খ্রীষ্টাব্দে চার্লস ব্লানসী বনাম ক্ষেত্রপাল সরকার মামলায় ৫৯ জন তুলা ব্যবসায়ীর নাম উল্লিখিত হয়েছিল। তাদের মাত্র ২৩ জন ছিল বাঙালী, আর বাকী ৩৬ জন ইংরেজ, রাজস্থানী, গুজরাটী, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের লোক ও উত্তরপ্রদেশের ক্ষেত্রী সম্প্রদায়ের লোক। অবাঙালী ব্যবসায়ীদের মধ্যে নামজাদা ব্যবসায়ী ছিলেন বাবু নিক্কামল, বৈশাজী, নিশারা, জগন্নাথ ট্যাণ্ডন, মাভোজী মিশ্র, জগন্নাথজী মেহেতা, যোধরাজ ধানুকা, ঘনশ্যামদাস গোয়েংকা, ও মুকুন্দলাল বাবু। ১৮২৩ খ্রীষ্টাব্দে মুকুন্দলাল বাবুর মৃত্যুর সময় তাঁর সম্পত্তির মূল্য ছিল ২৪ লক্ষ টাকা। এ থেকে বোঝা যায় যে, কলকাতার ব্যবসায়ের বেশ একটা বড় অংশ বাঙ্গালীদের হাত থেকে অবাঙ্গালীদের হাতে গিয়ে পড়েছিল।
মুকুন্দলাল বাবুর মৃত্যুর পর কলকাতার ব্যবসায়ের একছত্র অধিপতিরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন একজন পারসী ব্যবসায়ী—নাম রুস্তমজী কাওয়াসজী। তিনি তাঁর ব্যবসার সুবিধার জন্য তৎকালীন প্রসিদ্ধ বাঙালী ব্যবসায়ীদের যথা দ্বারকানাথ ঠাকুর, বিশ্বনাথ মতিলাল, রামকমল সেন, বিশ্বম্ভর সেন, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রাজা কালীকৃষ্ণ বাহাদুর প্রমুখের সহযোগিতা কামনা করেন। রুস্তমজী কাওয়াসজীর বাড়ী ছিল এখন যেখানে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স কলেজ হয়েছে। আর বাকী অবাঙ্গালী ব্যবসায়ীরা এসে নিজেদের আস্তানা গাড়ে বড়বাজার অঞ্চলে বা তার আশপাশে। আগে এ অঞ্চলটা ছিল বাঙালী ব্যবসায়ীদের কেন্দ্র। এখন থেকে এই অবাঙ্গালী ব্যবসায়ীদের আগমনই কলকাতায় বাঙ্গালী ব্যবসায়ের পতন সূচনা করে। এর পর বাঙ্গালী ব্যবসায়ীরা হাটখোলা অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল।
উত্তর ভারত থেকে যারা এসেছিল, তারা সকলেই এক প্রদেশভুক্ত বা এক জাতিভুক্ত ছিল না। এদের মধ্যে বেনিয়ানও ছিল, আবার ব্রাহ্মণও ছিল। কেউ এসেছিল উত্তরপ্রদেশের বারাণসী-লক্ষ্ণৌ অঞ্চল থেকে, আবার কেউ এসেছিল পাঞ্জাব থেকে। এদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল ‘ক্ষেত্রী’ সমাজের লোক। তাদের মধ্যে ১৮৩৩ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ শীতলপ্রসাদ খড়গ হাওড়ায় ‘অভ্যুদয় কটন মিল’ স্থাপন করেন। ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দে মোহনলাল ক্ষেত্রী হাওড়ার ঘুসুরিতে ‘এমপ্রেস অফ ইণ্ডিয়া জুট প্রেস’ স্থাপন করেন। তারপর ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দে ব্রাহ্মণ কুলোদ্ভব দামোদর চৌবে এসে কলকাতায় শেয়ার ও কোম্পানির কাগজ কেনাবেচার কাজ করেন। ১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দে ওমর সিং মণিলাল হীরা জহরতের ব্যবসা শুরু করেন। ১৮৯৫ খ্রীষ্টাব্দে বাদলরাম লছমীনারায়ণ তাঁর সুপ্রসিদ্ধ জরদা ও তাম্বুল বিহারের কারবার প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮৮ খ্রীষ্টাব্দে ছাজুরাম চৌধুরী এসে কতকগুলো ইউরোপীয় কোম্পানীর ডিরেক্টর হন। আরও অনেকে এসেছিলেন এবং তাঁরা অনেক রকম ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেন।
মুসলমান ব্যবসায়ীরাও আসতে শুরু করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে এম. এম. ইসপাহানি চা রপ্তানীর কারবার শুরু করেন। তাছাড়া আরও অনেক মুসলমান ব্যবসায়ী এসে ক্যানিং ষ্ট্রীট ও দিল্লীপটিতে আমদানীকৃত নানা রকম জিনিষের কারবার শুরু করেন।
১৮৬২-৬৬ খ্রীষ্টাব্দে ইস্ট ইণ্ডিয়া রেল কোম্পানি দিল্লী পর্যন্ত লাইন স্থাপন করেন। এর ফলে রাজস্থানের লোকদের কলকাতায় আসার পথ সুগম হয়। রাজস্থানীরা দলে দলে কলকাতার দিকে আসতে শুরু করে। মারবাড়ীরা যখন কলকাতায় এসে হাজির হল, তখন ম্যানচেষ্টারে তৈরী কাপড় কলকাতার বাজারে হুডুমুড় করে আসতে আরম্ভ করে দিয়েছিল। সাহেবদের এ সময় ম্যানচেষ্টারের কাপড় বিক্রির জন্য বেনিয়ানের প্রয়োজন ছিল। মাড়বাড়ীরাই বিলাতী কোম্পানিসমূহের বেনিয়ানের পদে নিযুক্ত হয়। কিন্তু যারা এসেছিল, তারা সকলেই পয়সাওয়ালা লোক ছিল না যে বেনিয়ানগিরি করবে। সেজন্য পয়সা উপায়ের তারা অন্য উপায় খুঁজতে থাকে। মারবাড়ীদের একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য আছে। তাদের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হয় জুয়ার নেশা। জুয়ার সন্ধান পেলে মারবাড়ী নিছক ব্যবসায়ের দিকে কখনও মন দেয় না।
জুয়ারই সহোদর ভাই হচেছ ফাটকা। কেননা ফাটকার জন্য প্রয়োজন হয় ঝুঁকি নেবার বিরাট ক্ষমতা। জুয়াও এই ঝুঁকি নেবার ক্ষমতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। ফাটকার জন্য মারবাড়ী পাটের বাজার ও শেয়ার বাজারকে তাদের উপার্জনের কেন্দ্রস্থল করে নিয়েছিল। শতাব্দীর সূচনায় ও প্রথম মহাযুদ্ধের সময় মারবাড়ী সমাজ প্রচুর অর্থ করে নিল শেয়ার বাজার থেকে। চিত্তরঞ্জন এভেন্যু-র দু’ধারে জমি কিনে বড় বড় প্রাসাদতুল্য বাড়ী করল মারবাড়ীরা।
পরের তিরিশ বছরে শেয়ার বাজারে এল কয়েকবার জোয়ার ও ভাঁটা। তা সে জোয়ারই হোক আর ভাঁটাই হোক মারবাড়ী ঠিক পয়সা করে নিল। নিঃস্ব হল শুধু সে- সব বাঙ্গালী, যারা রাতারাতি বড়লোক হবার আশায় শেয়ার বাজারে যায় ফাকা করবার জন্য। এখন শেয়ার বাজারে মাত্র মুষ্টিমেয় বাঙ্গালী ফার্ম আছে। সমস্ত বাজারটা অবাঙ্গালীর কুক্ষিগত। এরপর দেশ স্বাধীন হল। সাহেবরা যে যার দেশে চলে গেল। যাবার সময় মারবাড়ীর দল সে-সব ব্যবসাগুলো কিনে নিল। তারপর মাড়োয়ারী রাতারাতি শিল্পপতি হয়ে দাঁড়াল। বাঙ্গালী শুধু দোকানদারি, আর গোলামি করতে লাগল।
আমরা আবার বাঙ্গালীর ব্যবসায়ে ফিরে আসছি। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে কলকাতার ব্যবসায়ে রোমাঞ্চকর অভ্যুত্থান ঘটে বটকৃষ্ণ পালের। শৈশবে পিতৃ-মাতৃহীন হয়ে বেনিয়াটোলায় মামার বাড়ীতে মানুষ হয়ে, জীবন শুরু করেন খোংড়াপটিতে এক মসলার দোকান খুলে। মসলার দোকানে কিছু কিছু বিলাতী ওষুধও রাখতেন। পরবর্তীকালে তিনি কলকাতার সর্বশ্রেষ্ঠ ওষুধ ব্যবসায়ী হয়ে দাঁড়ান ও রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা পান। আজ বটকৃষ্ণ পালের প্রতিষ্ঠান জীর্ণশীর্ণ। অনুরূপভাবে হিন্দু হোষ্টেলের সামান্য বাজার সরকারী করে, কলকাতায় প্রতিষ্ঠা লাভ করেন কলকাতার তৎকালীন শ্রেষ্ঠ পুস্তক ব্যবসায়ী ও প্রকাশন সংস্থা গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়।
বটকৃষ্ণ পালের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অনুপ্রেরণা দিয়েছিল আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রকে ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যাণ্ড ফার্মাসিউটিক্যাল’ কোম্পানি স্থাপনে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে আর যেসব বাঙ্গালী কলকাতায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে বিখ্যাত হন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখ করা যেতে পারে জবাকুসুম তৈল প্রস্তুতকারক সি. কে. সেন অ্যাণ্ড কোম্পানী, দর্জিপাড়া কেমিক্যাল ওয়ার্কস্-এর প্রতিষ্ঠাতা পি. এম. বাগচী, কে. বি. সেন অ্যাণ্ড কোম্পানি, বিলাতী কাগজ আমদানীকারক চন্দ্রমোহন সুর, প্যারীচরণ সুর ও পান্নালাল শীল, জরীপ যন্ত্র আমদানীকারক যজ্ঞেশ্বর সুর (জে. সুর অ্যাণ্ড কোম্পানি), ষ্টেশনারী দ্রব্যের আমদানীকারক নীলমণি হালদার ও টোটা বন্দুক আমদানীকারক কালীকুমার বিশ্বাস (কে. সি. বিশ্বাস অ্যাণ্ড কোম্পানি) ও দ্বারিকানাথ বিশ্বাস (ডি. এন. বিশ্বাস অ্যাণ্ড কোম্পানি)।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে স্থাপিত হয় এইচ. বোস অ্যাণ্ড কোম্পানির পারফিউমারী ওয়ার্কস। এইচ. বোস অ্যাণ্ড কোম্পানির ‘কুন্তলীন’ হেয়ার অয়েল এক সময় বাঙলাদেশে খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। আরও যেসব বাঙ্গালী প্রখ্যাত ব্যবসায়ী হিসাবে এ সময় সুনাম অর্জন করেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন ‘হারমোনিয়াম’ যন্ত্রের আবিষ্কারক দ্বারকানাথ ঘোষ। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘ডোয়ার্কিন অ্যাণ্ড সনস্’ এক সময় বাঙলাদেশের বাদ্য-যন্ত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে শীর্ষস্থান অধিকার করত।
বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে এক বিরাট ইংরেজ প্রতিষ্ঠানের অংশীদাররূপে আবির্ভূত হন স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। মার্টিন কোম্পানীর অংশীদার হয়ে তিনি পলতা ওয়াটার ওয়ার্কস, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ভবন প্রভৃতি নির্মাণ করেন। ভারতে রেলপথসমূহ স্থাপনও তাঁর কৃতিত্ব। পরে তিনি বার্ন কোম্পানিরও অংশীদার হন। মার্টিন-বার্ন একত্রিত হবার পর ইণ্ডিয়ান আয়রন অ্যাণ্ড স্টীল কোম্পানি’ নামে বিখ্যাত লৌহ ও ইস্পাত কোম্পানির পরিচালনভার তাঁর পুত্র স্যার বীরেন মুখার্জীর ওপর পড়ে। সরকারী রোষে পড়ায় তাঁর বড় বড় কোম্পানিসমূহ ভারত সরকার কর্তৃক অধিকৃত হয়েছে।
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে স্বদেশী আন্দোলনের আওতায় বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিলস্, মোহিনী মিল, ঢাকেশ্বরী কটন মিল প্রভৃতি কাপড়ের কলগুলি বাঙ্গালীর মূলধনে ও বাঙ্গাালীর পরিচালনে স্থাপিত হয়। বিংশ শতাব্দীর আরও কয়েকজন বাঙ্গালী ব্যবসায়ীর কথা বলে এ প্রসঙ্গ শেষ করব। ৬০ বছর পূর্বে করুণা কুমার কর ‘কে. কে. কর অ্যাণ্ড কোম্পানি স্থাপন করেন। এঁরা ৮০টি কোম্পানীর ম্যানেজিং এজেণ্ট ছিলেন। এখন এঁদের কোম্পানিগুলি সবই উঠে গেছে। একমাত্র ‘নাগা হিল টি কোম্পানি’ জীবিত আছে, তবে অবাঙ্গালীর হাতে। সমসাময়িককালে বাঙ্গালীর উদ্যোগে জলপাইগুড়িতে অনেকগুলি চা- বাগিচা কোম্পানি স্থাপিত হয়, তবে সেগুলি মোটামুটি এখনও বাঙ্গালীর হাতে আছে। ওই সময় শেঠ কোম্পানি ও কে.সি.বসু বিস্কুট বার্লির কারবার করে। এর প্রথমটা আছে, দ্বিতীয়টা নেই। প্রথম মহাযুদ্ধের পূর্বে এন. সি. সরকার অ্যাণ্ড সনস্ বহু কয়লাখনি কোম্পানি স্থাপন করে। ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দে চ্যাটার্জী অ্যাণ্ড কোম্পানি সাতগ্রাম কোল কোম্পানি লিমিটেড স্থাপন করে। কিন্তু বাঙ্গালী পরিচালিত এ সকল কয়লাখনি কোম্পানি বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে উঠে যায়।
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাঙালী প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল ন্যাশনাল ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে বাঙালী জনসমাজের সর্বনাশ করে। পরে স্থাপিত বেঙ্গল সেন্ট্রাল ব্যাংক, কুমিল্লা ইউনিয়ন ব্যাংক, কুমিল্লা ব্যাংকিং কর্পোরেশন ও হুগলী ব্যাংক একত্রিত হয়ে ইউনাইটেড ব্যাংক অফ ইণ্ডিয়া নাম ধারণ করে এখন এদেশে সরকার পরিচালিত অন্যতম বড় ব্যাংক হিসাবে কাজ করছে। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালে ক্যালকাটা ন্যাশনাল ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গিয়ে আবার বাঙালী সমাজকে বিপর্যস্ত করেছে। ওই সময় হেমেন্দ্রনাথ দত্ত প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিসমূহও উঠে যায়।
মধ্যে সামান্য অবস্থা থেকে উঠে আলামোহন দাশ দাশনগরে এক বিরাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন, কিন্তু আজ তা ভারত সরকারের পরিচালনাধীনে।
বিংশ শতাব্দীর তিনটি সাফল্যমণ্ডিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বেঙ্গল ইম্যুনিটি কোম্পানি, ক্যালকাটা কেমিক্যাল ওয়ার্কস্ ও সুলেখা ইংক ফ্যাক্টরী।
শেষ যে বাঙালী যৌথ মূলধনী কোম্পানিসমূহ অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছিল, তারা হচ্ছে কে. এন.মুখার্জী অ্যাণ্ড কোম্পানি ও রণবীর চৌধুরী। কিন্তু আজ তাঁরা নানা রকমভাবে বিপর্যস্ত। প্রথম প্রতিষ্ঠানের ন্যাশনাল রবার ও ইনচেক টায়ার ভারত সরকার কর্তৃক অধিকৃত।
সকলের শেষে আর একটি বাঙালী প্রতিষ্ঠানের কথা বলব। সেটা হচ্ছে সেন র্যালে অ্যাণ্ড কোম্পানি। এঁরা সাইকেল নির্মাণ করে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন।
তবে আজও বাঙালী ব্যবসা ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত থাকলে কি হবে? অবাঙালী রুই- কাতলার মধ্যে সে চুনো-পুঁটি হিসাবে কোন রকমে তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। দোকানদারী ক্ষেত্রে অবশ্য বাঙালীর এখনও প্রাধান্য আছে মেয়েদের শাড়ী ও অলংকারের ক্ষেত্রে। কিন্তু তাও কতদিন থাকবে জানি না। কেননা, ব্যবসা ক্ষেত্রের প্রতি অংশ থেকেই বাঙ্গালী আজ হটে যাচ্ছে। তাছাড়া বাঙালীর ভিটাগুলোও মারবাড়ীরা কিনে নিচ্ছে। এখন বাঙ্গালীর অবস্থা হচ্ছে ‘বল মা তারা দাঁড়াই কোথা?”