গৌড়ানন্দ কবি ভনে

কলকাতার নৌবহ খাল প্রসঙ্গ

কলকাতার নৌবহ খাল প্রসঙ্গ

কলকাতার বুকে নৌবহ খালগুলি চালু করতে সরকার আর কত গড়িমসি করবেন? বিধানসভার আগামী কোনও অধিবেশনে এই ধরনের কোনও সম্ভাব্য দৃষ্টি আকর্ষণী প্রশ্নের আকস্মিকতায় সরকার পক্ষ যাতে বিপদগ্রস্ত হয়ে না পড়েন, সেজন্য ভারপ্রাপ্ত কেবিনেট উপসমিতির সদস্যরা প্রস্তুত হচ্ছেন বলে বিশ্বস্তসূত্রে খবর পাওয়া গিয়েছে।

কলকাতার নৌবহ খাল খনন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং জনস্বার্থে তার ব্যবহার ইত্যাদি পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানের জন্য স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকে পার্ট টাইম চেয়ারম্যান এবং পূর্ত মন্ত্রীকে স্থায়ী ভাইস চেয়ারম্যান করে উক্ত কেবিনেট উপসমিতি গঠিত হয়। পূর্তমন্ত্রী, বিদ্যুৎ ও সেচমন্ত্রী, পরিবহণ মন্ত্রী এবং পৌরমন্ত্রীকে এই উপসমিতির সদস্য নির্বাচিত করা হয়েছে।

কেবিনেট উপসমিতির সদস্যগণ পর পর কয়েকটি বৈঠকে মিলিত হয়ে বিধানসভার সমালোচকদের আক্রমণ প্রতিহত করার এক রণকৌশল ঠিক করে ফেলেন।

সমালোচকদের প্রশ্ন এবং মন্ত্রী মহোদয়গণের উত্তর এখানে আগাম তুলে ধরা হল।

দৃষ্টি আকর্ষণী প্রশ্ন : কলকাতার বুকে নৌবহ খাল চালু করার যে-সকল প্রতিশ্রুতি আজও পালিত হয়নি। কলকাতার বুকে এই বর্ষাতেও নৌকো চলবে কিনা, সে বিষয়ে কলকাতার নাগরিকদের মনে ঘোরতর সন্দেহ দেখা দিয়েছে। আমরা জানতে চাই, কলকাতার বুকে নৌ-পরিবহণ ঠিক কবে থেকে শুরু হবে?

ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী মহাশয়ের উত্তর : স্পিকার, সার! কলকাতার বুকে নৌ-পরিবহণের যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা একেবারেই পালিত হয়নি, এ অভিযোগে একটু অত্যুক্তি আছে। সার, ১৯৭২ সালে বর্ষার ঠিক প্রারম্ভেই আমাদের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, এ কথা আপনি জানেন। আপনি এও জানেন যে, সেই সময় পশ্চিমবঙ্গে এমন এক অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যে শুধুমাত্র আইন এবং শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতেই সে বর্ষাটা কেটে যায়। তবু সার, সরকার কলকাতার বুকে নৌকো চালাবার ব্যাপারটা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করেন বলেই সেই ডামাডোলের মধ্যেও কলকাতা পৌর এলাকার কোনও কোনও অঞ্চলে নৌকো চালাবার ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছেন। মাননীয় সদস্যগণ যদি মনোযোগ দিয়ে এই পরিসংখ্যানটি লক্ষ্য করেন, তাহলেই বুঝতে পারবেন, এই সরকার কলকাতা মহানগরীর বুকে নৌ-পরিবহণ ব্যবস্থা চালু করতে কতটা উৎসাহী এবং কতটা উদ্যোগী

স্পিকার সার! আপনাকে জ্ঞাত করায় উদ্দেশ্যে আমি সভার অনুমতি নিয়ে সেই পরিসংখ্যান পেশ করছি। সার, ১৯৭২ সালে কলকাতার উত্তরে কাশীপুর, পাইকপাড়া, টালা এবং বেলগাছিয়া এবং দক্ষিণ সিঁথি অঞ্চলে বৃষ্টির জলে নৌ-পরিবহণের উপযোগী অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। সরকার সঙ্গে সঙ্গে ওই সকল অঞ্চলে প্রাইভেট সেক্টরকে নৌকো চালাবার অবাধ সুযোগ দান করেন। তদনুযায়ী উত্তর কলকাতার ব্যাপক অঞ্চলে নাগরিকগণ আটাত্তর দিন নৌকো অথবা নৌ-জাতীয় পরিবহণে যাতায়াতের সুযোগ পান। পূর্ব কলকাতার অর্থাৎ বেলেঘাটা, ট্যাংরা ইত্যাদি অঞ্চলের নাগরিকগণ অনুরূপ সুযোগ পান পঁচানব্বই দিন। দক্ষিণ কলকাতায় ডোভার লেন, সুইনহো স্ট্রিট, বালিগঞ্জ গারডেনস, কাঁকুলিয়া প্রভৃতি অভিজাত পল্লীর বাসিন্দাগণ যাতে সরকারের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ না আনতে পারেন, তাই ঐ সব অঞ্চলে বর্ষণজনিত অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ামাত্র ওই অঞ্চলের নাগরিকদিগকে নৌ-পরিবহণের সুযোগের আওতায় এনে ফেলা হয়। নিউ আলিপুর, ভবানীপুর, কালীঘাট এবং পশ্চিম কলিকাতার কোনও কোনও অংশেও এই সুযোগ করে দেওয়া হয়।

সার, ১৯৭৩ সালে সরকারী প্রচেষ্টায় কলকাতার বুকে নৌ-পরিবহণযোগ্য অবস্থার আশাতীত উন্নতি হয়। এবং, জাস্ট টু কিপ দি রেকরড স্ট্রেইট, এখানে সার, এই কথাটাই উল্লেখ করতে চাই যে কলকাতা পৌরসভা টেলিফোন, বিদ্যুৎ সরবরাহ কোম্পানি এবং সি এম ডি এ বিশেষত সি এম ডি এর সক্রিয় সাহায্য না পেলে ১৯৭৩ সালে এত তাড়াতাড়ি কলকাতার বুকে নৌবহ খাল রেডি করে ফেলা সম্ভব হত না। সার, ১৯৭৩ সালের অবস্থা হচ্ছে এই : রবীন্দ্র খাল বাগবাজার থেকে টেরিটিবাজার পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে, চিত্তরঞ্জন খাল গিরীশ পার্ক থেকে বৌবাজার পর্যন্ত নৌবহণের উপযোগী হয়েছে, এমন কি জওহরলাল নেহরু খালের কয়েকটি জায়গাতে পরীক্ষামূলকভাবে নৌকো চালিয়ে পূর্ত বিশেষজ্ঞদের বিস্ময় উৎপাদন করা হয়েছে। চৌরঙ্গী অঞ্চলে অবস্থিত জওহরলাল নেহরু খালে যে কোনোদিন নৌকো চালানোর অবস্থা সৃষ্টি করা যেতে পারে, এ কথা বিশ্বাসের অতীত বলেই লোকের বিশ্বাস ছিল।

সার, হরিশ মুখারজি খালের জলের লেভেল এখন এমন চমৎকারভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে যে ওখানে অনায়াসে একটা ছোটখাট প্রমোদ-তরণী ভাসানো যাবে।

অতিরিক্ত প্রশ্ন : সার, সরকারী বক্তব্যে আসল সমস্যার পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে। প্রমোদ-তরণীর খবর আমাদের শুনে লাভ নেই। আমরা জানতে চাই, এই বর্ষায় আমরা নৌকো করে কলকাতার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, টালিগঞ্জ থেকে টালায় যাতায়াত করতে পারব কি, পারব না। আমরা এই প্রশ্নের সুস্পষ্ট উত্তর চাই।

ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী : মাননীয় স্পিকার সার! মাননীয় সদস্যগণের কাছে আপনার মাধ্যমে আমরা এই অনুরোধ জানাতে চাই যে তাঁরা যেন অধৈর্য হয়ে না পড়েন। ১৯৭৪ সালে আমরা বর্ষাকালীন কর্মসূচী এমনভাবে ছকে রেখেছি যে তা থেকে এই গ্যারানটি আমরা নিশ্চিতরূপেই দিতে পারি যে এই বর্ষায় আমরা কলকাতার শতকরা আশিভাগ রাস্তাকেই নৌবহ খালে পরিণত করতে পারব। এই সকল খালের স্রোতকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে দ্রুততর করে তা থেকে অনায়াসে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করে আমরা বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণ করতে পারব। কিন্তু সার, সরকারের পক্ষে এত নৌকো এত অল্প সময়ে সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না। কাজেই ব্যাপকভাবে নৌ-পরিবহণের ব্যবস্থা এখনই করে ওঠা যাবে না। কাজেই নাগরিকদিগকে অত্যাবশ্যক কাজকর্ম আপাতত কিছুদিন সাঁতার কেটে কেটেই সারতে হবে। জনসাধারণ সরকারি অসুবিধার কথা বিবেচেনা করে সরকারের সঙ্গে যে সহযোগিতা করবেন, সে ভরসা আমাদের আছে।

পুনশ্চ : ভিজে জামাকাপড় পরে আপিস কাছারিতে কাজ করতে যাতে অসুবিধা না হয়, সেই জন্য সরকার সুবিধাদরে ‘রিটারন গামছা’ সরবরাহের ব্যবস্থা করেছেন। একখানা গামছা কর্মস্থলে যাবার জন্য এবং আরেকখানা গামছা বাড়ি ফেরার জন্য। এই ‘রিটারন গামছা’ যে-কোনও ন্যায্যমূল্যের দোকানে অথবা সমবায়িকাতে পাওয়া যাবে।

২৭ মার্চ ১৯৭৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *