কলকাতার তরুণের মন

কলকাতার তরুণের মন

বিপ্লব নয় বিদ্রোহ, বিনতি নয় বিক্ষেপ হল বর্তমানকালের তরুণের ধর্ম। কেবল তরুণের নয়, মানুষের জীবনের একটা আবশ্যিক মাত্রাই হল আজকের দিনে ‘বিদ্রোহ’, কারণ বিদ্রোহই আজকের মানবসমাজের ঐতিহাসিক বাস্তব সত্য। ‘বিপ্লব’ শুরু হয় শেষ হবার জন্য, এবং যা শেষ হয়, আবার তা শুরু করার প্রয়োজন দেখা দেয়। বিপ্লব জ্বলে ওঠে, আবার নিভে যায়, এবং যা নিভে যায় তাকে আবার জ্বালাতে হয়। মানবসমাজের ইতিহাসে বারে বারে তাই বিপ্লবের আগুন জ্বালাতে হয়েছে, কারণ বারে বারে তা নিভে গিয়েছে। ভালো ভালো কল্পনারঞ্জিত জীবনের মডেল, চমৎকার মনোহর সমাজপ্রতিমা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছে মানুষ যুগে যুগে, বিপ্লবের পর বিপ্লবের ভিতর দিয়ে। তারপর বিপ্লবান্তে বিক্ষুব্ধ ও বিক্ষত পদাতিক মানুষ বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখেছে তাদের সেই সুন্দর সমাজপ্রতিমার বিসর্জনযাত্রা। সমাজের মুখের উপর অঙ্গরাগের প্রলেপ পড়েছে অনেক—সেই প্রাচীন ক্রীতদাসের যুগ থেকে আধুনিক টেকনোলজিক্যাল সমাজের যন্ত্রদাসের যুগ পর্যন্ত—কিন্তু তাতে সমাজের ভিতরের কঙ্কালটির কদর্যতা ও বীভৎসতা একটুও বদলায়নি। বরং সমাজের বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে বহিরঙ্গরাগের আধিক্যের ফলে বৃদ্ধা বিলাসিনীর মতো তার কুরূপটি যেন ক্রমে প্রকট হয়ে উঠেছে। যেমন উৎকট, তেমনি বিপ্রকর্ষক সেই মূর্তি।

মনে হয় যেন একটি প্রকাণ্ড বোল্ডার সিসিফাসের মতো পাহাড়ের কোল থেকে চূড়ায় ঠেলে তুলছে মানুষ, অমানুষিক কষ্টভোগ করে, এবং সেই চূড়া থেকে প্রচণ্ড শব্দ করে আবার সেই বোল্ডারটি গড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের কোলে। তারপর আবার পাহাড়ের চূড়ার দিকে চেয়ে, নতুন আশা নিয়ে, যতবার বোল্ডার তোলা হচ্ছে ততবার সেটি নিজের ভারেই মাটিতে গড়িয়ে পড়ছে। পাহাড়ের চূড়াটি হল বিপ্লব, আর পাথরের বোল্ডারটি হল মানুষের আশা—আকাঙ্ক্ষা কামনা—বাসনার প্রতীক। পাহাড়ের কোলে দাঁড়িয়ে বোল্ডারটির দিকে চেয়ে চেয়ে সিসিফাস কী ভাবছে? ভাবছে তার লক্ষ্য পাহাড়ের চূড়ার কথা, সিসিফাসের সংগ্রামের শেষ নেই, বিরামও নেই। কবে কোন সুদূর অতীতে সেই পেলিওলিথিক যুগে পাথুরে হাতিয়ার নিয়ে নির্দয় প্রকৃতির বনেজঙ্গলে মানুষের সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, আর আজ পর্যন্ত এই অ্যাটম—অটোমেশনের যুগেও সুপারসনিক—জেট—রকেট ও শতসহস্র অটোমেটিক যন্ত্র নিয়েও তার সেই সংগ্রামের শেষ হল ন। সিসিফাসের সর্বাঙ্গে বহু যুগের সংগ্রামের ক্ষতচিহ্ন, আপাদমস্তকে নিষ্ঠুর আঘাতের কালশিটের কালো কালো দাগ। কালো দাগগুলির দিকে চেয়ে সিসিফাস ভাবছে, তার জীবন কেবল সংগ্রাম আর ব্যর্থতা, ব্যর্থতা আর সংগ্রামের আহ্নিক চক্রে অবিভ্রান্ত চংক্রমণ এবং তার চক্রধর কোনো দেবতা বা অপদেবতা নয়, মানুষ। চূড়ার দিকে লক্ষ্য নিবদ্ধ রেখে যাঁরা বোল্ডার ঠেলার কথা বলেন, আজ বিংশ শতাব্দী বার্ধক্যে, তাঁদের কথা শুনে সিসিফাসের অট্টহাসি পাহাড়ের দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়। পৃথিবীর সমস্ত পাগলাগারদের পাগলদের সম্মিলিত অট্টহাসির চেয়েও ভয়ংকর সিসিফাসের অট্টহাসি।

বর্তমান সমাজের প্রত্যেকটি মানুষ আজ সিসিফাসের মতো। ‘মানুষ’ কথাটির উপর বিশেষ জোর দিয়ে বলছি। যাঁরা অ্যানথ্রোপোলজিক্যালি মানুষ তাঁদের কথা বলছি। অর্থাৎ যাঁরা ‘হোমো—স্যাপিয়েন্স’ বা বুদ্ধিমান মানুষ, মননশীল মানুষ, কেবল ‘বাইপেড ম্যামাল’ বা দ্বিপদ স্তন্যপায়ী জীব নন, তাঁরা প্রত্যেকে, তাঁরা সকলে আজ সিসিফাসের মতো আদর্শের পর্বতচূড়ায় জীবনের বোল্ডারঠেলার ব্যর্থতার বোঝা বহন করে চলেছেন। কেউ নীরবে নিঃশব্দে বহন করছেন, কেউ সরবে সশব্দে। যাঁরা নীরবে বহন করছেন তাঁরা ক্লান্তিতে অবসন্ন, সমাজজীবনে তাঁদের সক্রিয় ভূমিকা শেষ হয়ে এসেছে, কারণ তাঁদের বয়স হয়েছে। তাঁরা বয়োবৃদ্ধ, তাঁদের ভবিষ্যৎ নেই। অর্থাৎ তাঁদের ভবিষ্যৎ আছে, কিন্তু তা মৃত্যুর ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যতে যাঁদের মৃত্যু, যাঁদের বিরতি, যাঁদের পূর্ণচ্ছেদ, তাঁরাই সিসিফাসের ব্যর্থতাচেতনা নিয়েও আজ নিষ্ক্রিয় ও নিঃশব্দ। নিষ্ক্রিয়তার অতলস্পর্শ নির্জনতায় তাঁরা বিচ্ছেদ—ব্যর্থতার চেতনায় সতত ক্লিষ্ট। আর যাঁরা বিচিত্রভোগ্য পণ্যপ্রধান সমাজে (অ্যাফ্লুয়েন্ট সোসাইটি) অবিকল অভিযোজিত—এবং বর্তমান সমাজে তাঁদের শ্রেণি আয়তন বেশ বৃহৎ—যাঁরা ভোগলিপ্সার মৃগতৃষ্ণিকার দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ধাবমান, তাঁরা বুদ্ধিমান, ক্ষমতাবান, প্রতিভাবান যা—ই হোন—না কেন, আসলে তাঁরা বাহাদুর সেলসম্যান। সমাজের সুপারমার্কেটে তাঁরা সর্বোচ্চমূল্যে আত্মবিক্রয়ের ধান্দায় শশব্যস্ত। তাঁদের বিচ্ছেদবোধ নেই, ব্যর্থতাবোধও নেই, গড্ডলিকাপ্রবাহে পরম নিশ্চিন্তে সন্তরণই তাঁদের কাম্য। কিন্তু তরুণ ও যুবকদের সমস্যা স্বতন্ত্র। তরুণদের বর্তমান আছে, ভবিষ্যৎ আছে এবং বর্তমান থেকে দূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত বিস্তৃত তরঙ্গময় জীবন আছে। তাঁরা দেখছেন বর্তমান অন্ধকার, ভবিষ্যৎ আরও বেশি অন্ধকার। সমাজের গড়ন এমন, ধরন এমন, চলন এমন, যে তার সঙ্গে পা মিলিয়ে এগিয়ে চলা তরুণদের পক্ষে অসম্ভব। অথচ তাঁরা এগিয়ে চলতে চান, কারণ এগিয়ে চলাই তাঁদের বয়সের ধর্ম। কোনোদিকেই এগোবার পথ নেই, চারদিকে ক্যাকটাস—বন বালি আর কাঁকর। চলার মতো পথগুলিতে দ্বিপদ বনমানুষের কলরব। জ্যেষ্ঠরা সমাজটিকে একটি শ্বাপদসংকুল জঙ্গলে পরিণত করেছেন। পর্বতচূড়ার হাতছানিতে তাঁরা আর প্রলুব্ধ হতে চান না, কারণ পর্বতের কন্দরে কন্দরে আজ তাঁরা সিসিফাসের সেই বোল্ডার গড়ানোর গুরুগম্ভীর ধ্বনি—প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন। বোল্ডার গড়িয়ে পড়ছে—ধনতন্ত্রের বিচিত্রভোগ্য সমাজে, সমাজতন্ত্রের সর্বার্থসাধক সমাজে। লন্ডনে প্যারীতে মস্কোয় নিউ ইয়র্কে কলকাতায়, সর্বত্র সেই বোল্ডার গড়ানোর কর্ণভেদী শব্দ শোনা যাচ্ছে। পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে এ যুগের তরুণরা আজ সেই শব্দ শুনছেন আর অগণিত মেহনতি মানুষের (তরুণ ও যুবকরাই তার মধ্যে অন্যতম) দেহের উপর খোদাই—করা কালো কালো ক্ষতচিহ্নগুলির দিকে চেয়ে দেখছেন। বিপ্লবে আজ তাঁদের অনেকেরই বিশ্বাস টলায়মান, কারণ বিপ্লবের সমাপ্তি আছে, পরিণতি আছে, এবং পরিণতিমাত্রেরই পতন ও পচন আছে। আজ তাঁরা বিদ্রোহে বিশ্বাসী, চিরন্তন বিদ্রোহ—’রিভল্যুশন’ নয়, ‘রিবেলিয়ান’। বিদ্রোহ অনেকটাই আদর্শের আকর্ষণমুক্ত, নীতির নিগড়মুক্ত। কী হবে আদশ? কী হবে নীতি? কত আদর্শ, কত নীতির মহাশ্মশান পার হয়ে এসেছে সমাজ। অতএব আদর্শমুক্ত বিদ্রোহ আজকের তরুণদের জীবনের একমাত্র আদর্শ। এবং বিপ্লব? বিপ্লবও তা—ই। কেতাবি বিপ্লবের কথা কেদারায় বসে যে সমস্ত কথাবিপ্লবী এতদিন আওড়ে এসেছেন, তাঁরা আজ সংস্কারবাদ ও ব্যালটবক্স—বিপ্লবের অধিবক্তা। অতএব বিপ্লবের কৌশলও হবে নতুন কৌশল এবং লক্ষ্যও হবে তার জীবন্ত সজাগ লক্ষ্য। ধীরেসুস্থে ধৈর্য ধরে, বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে, কেতাবের নির্দেশাবলির সঙ্গে মিলিয়ে তারপর বিপ্লব—তা আর সম্ভব নয়, এই হল তরুণদের কথা। পক্বকেশ প্রবীণরা আজ যদি তরুণদের ধৈর্য ধরতে বলেন, তাহলে তরুণেরা নিশ্চয় বলতে পারেন :

We have had enough of waiting, from December to dismal December.

অতএব আর ধৈর্য নয়। আরও ধৈর্য, আরও স্থৈর্য মানে একবারে মৃত্যু। তরুণ ও যুবকরা আজ তাঁদের সমগ্র সত্তা দিয়ে অনুভব করছেন :

Man’s life is a cheat and disappointment;

All things are unreal,

Unreal or disappointing…

All things become less real, man passes

From unreality to unreality

 T.S. Eliot

মানুষের জীবন ফুলবাগান নয়, প্রতারণা ও নৈরাশ্যের বিকট ভাগাড়। এই ভাগাড়ে আদর্শের নামে প্রতারিত হতে, অবাস্তব থেকে বৃহত্তর অবাস্তবে যাত্রার জন্য আত্মবলিদান দিতে তরুণরা আজ নারাজ। তাই তাঁরা নৈরাজ্যের পথযাত্রী।

বর্তমানকালে তরুণদের সংখ্যা অতিদ্রুত বাড়ছে, এমনকী তারুণ্যেরও গতি বাড়ছে। ‘তারুণ্য’ বলতে অবশ্য ‘অ্যাডোলিসেন্স’ বা বয়ঃসন্ধির কথা বলছি। জনসংখ্যার বহুপ্রচারিত বিস্ফোরণের কথা আজ আর কারও অজানা নেই। সপ্তদশ শতকের শেষে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল ৫০ কোটির মতো, প্রায় বর্তমান ভারতের জনসংখ্যার সমান। ১৯২০ সালে এই জনসংখ্যা হয় প্রায় ২০০ কোটি। অর্থাৎ ১৬৫০ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে জনসংখ্যা দু—বার দ্বিগুণ হয়, প্রথম দ্বিগুণ হয় দু—শো বছরে, দ্বিতীয়বার দ্বিগুণ হয় সত্তর বছরের মধ্যে। ১৯৭০ সালের মধ্যে ওই জনসংখ্যাও দ্বিগুণ হবার কথা, অর্থাৎ ৪০০ কোটি। সংখ্যাবৃদ্ধির হারের দ্রুততা পরে আরও বাড়বার কথা। বর্তমান শতাব্দী বিদায় নেবার আগে আনুমানিক ৬০০ কোটি মানুষের পদধ্বনি শোনা যাবে পৃথিবীতে, এবং সে ভার ধরিত্রীর পক্ষে বহন করা সম্ভব হবে কি না বলা যায় না। তার কারণ, ধরিত্রীর মোট পৃষ্ঠায়তন ১৯ কোটি ৭০ লক্ষ বর্গমাইল এবং তার চার ভাগের তিন ভাগই অথই জল। বাকি এক ভাগ, অর্থাৎ এক—চতুর্থাংশ হল মাটি, ঠিক মাটি নয়—ভূভাগ। তার অর্ধেক অংশে এত প্রচণ্ড হিম, অথবা উত্তাপ যে তা চাষ—আবাদের অযোগ্য। বাকি থাকে ধরিত্রীর আট ভাগের এক ভাগ। তার চার ভাগের এক ভাগ পাহাড়—পর্বত অতিবৃষ্টি—অনাবৃষ্টি, মানুষের বসবাস শহর নগর কলকারখানা ইত্যাদির জন্য চাষের যোগ্য নয়। জনসংখ্যাবৃদ্ধির ফলে এই সামান্য ভাগটুকুও ক্রমে কমতে থাকে এবং তার ফলে খাদ্য উৎপাদন ও সংস্থানই কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। কলকাতা শহরের উত্তর—দক্ষিণ—পুবে কত হাজার বর্গমাইল চাষের জমি গত তিরিশ বছরের মধ্যে জনবসতি গ্রাস করেছে শুধু তার হিসেব করলেই এ সমস্যার প্রকৃত গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। আপাতত এ সমস্যার বিচার আমরা করব না, আমাদের সমস্যা তরুণদের সমস্যা।

তরুণদের সংখ্যা যেমন দ্রুতবর্ধমান, মোট জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার অনুপাতে, তেমনি তারুণ্যের গতিও দ্রুতসঞ্চারী। ইউনেসকোর যুব সংস্থার একটি রিপোর্টে প্রায় দশ বছর আগে (১৯৫৯) বলা হয়েছে যে আজকের দিনে তরুণ ও যুবকরা বয়সের দিক থেকে অনেক আগেই তারুণ্য ও যৌবনে পদার্পণ করে, এবং মাত্র সাত—আট বছরের বয়সের ব্যবধানে আগেকার দিনের একপুরুষের অর্থাৎ প্রায় তিরিশ বছরের ব্যবধান হয়ে যায়। কলকাতা শহরেই দেখা যায়, মধ্যবয়সি ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলারা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে নানা বিষয়ের মধ্যে একটি বিষয় নিয়ে প্রায়ই আলোচনা করেন। সেই বিষয়টি হল—ছেলেমেয়েদের অকালতারুণ্য। তাঁদের কথাবার্তার মধ্যে মধ্যে ‘কী পাকা ছেলে, কী পাকা মেয়ে’ এই ধরনের বিস্ময়োক্তি কান পাতলেই শোনা যায়। বারো—তেরো বছরের মেয়ে, ফ্রক পরে (হতে পারে মিনিস্কার্ট), ক্রিকেট থেকে ‘কালচারের রিভল্যুশন’ কণ্ঠস্থ, ডায়েরিতে অসংখ্য টেলিফোন নম্বর ও ঠিকানা (কাদের তা কে জানে!), দৃপ্তভঙ্গিতে লক্কা পায়রার মতো স্কার্ট ঘুরিয়ে চলে, খিলখিল করে হাসে, কলকল করে কথা বলে।

ইউরোপের শীতপ্রধান প্রাকৃতিক পরিবেশে তারুণ্যের এই আঙ্গিক উদগমে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, তার চেয়ে জটিলতর সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে ও হচ্ছে আমাদের ট্রপিক্যাল দেশের সমাজে। আর ইউরোপেই যখন অকালতারুণ্যের জৈবিক ও সামাজিক ফলাফল এখনও বিশেষ কেউ চিন্তা করছেন না, তখন মারাত্মক সামাজিক বিপর্যয় ব্যাপকভাবে ঘটবার আগে আমাদের দেশে যে এ বিষয়ে কেউ চিন্তা করবেন তা মনে হয় না। বৈজ্ঞানিক প্রসূতিসেবা, শিশুপালন ও ডায়েট—চেতনা, যে—কারণেই এই অকালতারুণ্য দেহ—মনে আবির্ভূত হোক—না কেন, এবং জৈবিক ও সামাজিক ফলাফল সম্বন্ধে আমরা অবহিত হই বা না হই, এটা যে এ যুগের সমাজের একটা সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আমাদের সমাজে এই অকালতরুণদের সমস্যা আরও একটি কারণে জটিল হয়েছে ও হচ্ছে। এই কারণটি হল, তিরিশ—চল্লিশ বছরের মা—বাবাদের সন্তানদের প্রতি আদরের একটা আদেখলেমি, গ্রাম্য বাংলায় যাকে বলে আদিখ্যেতা। এই সন্তান—আদিখ্যেতাকে আজকাল মা—বাবারা আধুনিকতা ও কালচারের নিদর্শন বলে মনে করেন। ড্রয়িং রুমে কিছু কারুশিল্পের নমুনা এবং দু—একটি পট ক্যাকটাস না থাকলে যেমন আধুনিক মুদ্রাস্ফীতিপ্রসূত মধ্যবিত্তের একাংশের রুচি ও কালচারের দ্যুতি ঠিকরোয় না, তেমনি ছেলেমেয়েদের ‘ড্যাডি—মামি টা—টা’ ডাক না শুনলে তাঁরা সেই কালচারের উত্তরাধিকার সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হতে পারেন না। এই সন্তান—আদরের আদেখলেমি আধুনিক ইংরেজোত্তর ভদ্রলোকদের একটা বিশিষ্ট ‘কালচার—ট্রেট’। তরুণ বয়সেও তাই ছেলেমেয়েরা ‘খোকা—তরুণ’ ও ‘খুকু—তরুণী’ হয়ে থাকে এবং তাদের দৈহিক ও মানসিক পুষ্টি সমান নয় ভেবে মা—বাবারা নিশ্চিন্ত থাকেন। অতঃপর হঠাৎ একদিন সেই নিশ্চিন্ততা ভাঙে, যখন তারুণ্যের স্বাচ্ছন্দ্যবোধ এহেন উদার পরিবারের সামান্য বন্ধনটুকুও মানতে চায় না এবং যে—কোনো প্রভুত্ব ও শাসন উপেক্ষা করতে চায়। তরুণ বিদ্রোহ প্রথমে গৃহের ড্যাডি—মামিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ থেকে আরম্ভ হয়, তারপর তার ক্ষেত্র বিস্তৃত হয় গৃহ থেকে স্কুল—কলেজে এবং সেখান থেকে বৃহত্তর সমাজে।

অকালতারুণ্য শুধু যুগসত্য নয়, জৈবিক সত্য। শুধু দেহের সঙ্গে নয়, মনের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তারুণ্য কখনো মন বাদ দিয়ে শুধু অঙ্গরেখায় পরিস্ফুট হয়ে ওঠে না। তরুণ মনের এই পরিপুষ্টি সম্বন্ধে ইদানীং জ্যেষ্ঠদের ঔদাস্য—অনেকটাই সজ্ঞান ঔদাস্য—সমাজজীবনে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। একটিমাত্র দৃষ্টান্ত উল্লেখ করলেই তার স্বরূপ বোঝা যাবে। দৃষ্টান্তটি লেখকের প্রত্যক্ষ অনুসন্ধানলব্ধ। কলকাতা শহরের কয়েকজন পরিচিত ম্যারেজ—রেজিস্ট্রারের কাছে শুনেছি, তরুণদের মধ্যে রেজিস্ট্রি—বিবাহের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে এবং অধিকাংশ বিবাহই পরিবারের আড়ালে হচ্ছে। পাত্রীদের মধ্যে টিনএজারই বেশি, পাত্রদের বয়স কুড়ির গোড়ার দিকে।

এটি একটিমাত্র দৃষ্টান্ত, যে তরুণরা কতকটা স্বাভাবিক পথে চলতে চান তাঁদের কথা। কিন্তু সকলের সামাজিক—পারিবারিক পরিবেশ একরকম নয়। ইংল্যান্ডের তরুণ—সমস্যা সম্বন্ধে অনুসন্ধান করে মাসগ্রোভ (এফ. মাসগ্রোভ) যা দেখেছেন তা এই :

‘টিনএজ’ বয়সে (১৩ থেকে ১৯ বছর) বিবাহ করতে ইচ্ছুক (‘অনিশ্চিত’দের নিয়ে) তরুণদের সংখ্যা ইংল্যান্ডেও অল্প নয়, প্রায় চার ভাগের এক ভাগ। যাঁদের সম্মতি নেই তাঁদের যে ইচ্ছা নেই, এমন কথা বলা যায় না। অসম্মতির কারণ অর্থনৈতিক ও বর্তমান সমাজে পারিবারিক জীবনের ভীতি হওয়াই সম্ভব, প্রকৃত অনিচ্ছা নয়। স্বাতন্ত্র্য তরুণমাত্রেরই কাম্য, কাজেই স্বাতন্ত্র্যপন্থীর সংখ্যা বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু স্বাতন্ত্র্যের পথ অনেক, অন্ধকার চোরাগলি থেকে মুক্ত রাজপথ পর্যন্ত সর্বত্র তরুণদের পদধ্বনি শোনা যেতে পারে, এবং শোনা যায়ও। তার কারণ আগে বলেছি, সকল তরুণের সর্বক্ষেত্রে সামাজিক—পারিবারিক পরিবেশ একরকম নয় এবং স্বাতন্ত্র্যের পথ নির্বাচিত হয় এই পরিবেশের নিষ্পেষণে। সকলে ক্রোধান্ধ ‘অ্যাংগ্রি ইয়াংমেন’ নন—

They are not angry youngmen. They want to find their own niche in society as good and respectable citizens, to be a good husband, a good father, and a good friend and neighbour.

তরুণ সমস্যাসন্ধানী একজন বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ফার্ডিন্যান্ড ৎসুইগ এই কথা বলেছেন। কথাটা লন্ডনের তরুণদের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, কলকাতার তরুণদের ক্ষেত্রেও তেমনি সত্য। যদি কেউ বন্ধুর মতো তরুণদের সঙ্গে মিশতে পারেন, নানা বিষয়ে বেশ জমাট আড্ডার মতো কথাবার্তা বলতে পারেন, তাহলে তিনি বুঝতে পারবেন, ৎসুইগের কথা বর্ণে বর্ণে সত্য। এবং কথাটা তরুণ ছেলে ও মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই সত্য, মেয়েদের ক্ষেত্রে আরও বেশি সত্য। কোনো দেশের মেয়েরাই নোঙরহীন জীবন কাটাতে চায় না, সমাজের পাঁক গায়ে মেখে নালা—নর্দমায় ভেসে বেড়াতে চায় না, ঘর বাঁধতে চায়, সংসার করতে চায়। কিন্তু তবু আজ বেশ বড় একদল তরুণ মেয়েদের, টিনএজারদের পর্যন্ত, কলকাতা শহরেও তা—ই করতে হচ্ছে। কেউ কেউ জীবনের এদিকটাকে মনে করেন ‘ফান’, অর্থাৎ দু—দণ্ডের রঙ্গ, এবং রঙ্গ করা তাঁদের কাছে ‘অ্যামর‍্যাল’ অর্থাৎ নীতিনিরপেক্ষ ব্যাপার। তাঁরা হয়তো ‘ফান ফর দ্য সেক অফ ফান’ মনে করেই করেন। কিন্তু বেশির ভাগ করেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও এবং নাগরিক সমাজের নামগোত্রহীন পরিবেশে তা করার ঝক্কি অনেক কম মনে করে অনেকে মেট্রোপলিটন—কলকাতার দূর প্রান্ত থেকে শহর কলকাতায় আসেন, কিছু উপার্জন করে আবার ঘরে ফিরে যান। তাঁদের কাছে এটা রঙ্গ নয়, প্রয়োজন, প্রাত্যহিক জীবনধারণ ও পরিবার প্রতিপালনের প্রয়োজন। উন্মার্গ তরুণদের সম্বন্ধে তাই ফাইভেল লিখেছেন :

…the experience of social workers points to the conclusion that the Teddy boys include a majority of insecure youngsters from bad and broken homes… more than half came from family backgrounds which were ‘absolute hell’, another quarter from homes which looked superficially all right but probably were not; while less than a quarter came from genuinely adequate homes.

এ হল লন্ডনের সমাজের কথা। আমেরিকার ‘অ্যাফ্লুয়েন্ট’ সমাজে এ সমস্যা আরও বেশি ভয়াবহ। কলকাতার নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি ও দরিদ্র উদবাস্তু পরিবারের জীবনযাত্রার সঙ্গে যাঁদের পরিচয় আছে—বিদেশি ট্যুরিস্ট বা প্রেস—রিপোর্টারের তড়িৎঘড়ি পরিচয় নয়—জীবনের দৈর্ঘ্যপ্রস্থবেধসহ বহুমুখী অন্তরঙ্গ পরিচয়—তাঁরা নিশ্চয় স্বীকার করবেন যে বিশ্রী, বিবর্ণ ও বিচূর্ণ গৃহ—পরিবারের সংখ্যা এখানে বহুগুণ বেশি, এবং ‘ইনসিকিওর ইয়াংস্টার’দের সমস্যাও সেজন্য এখানে বহুগুণ জটিল। কলকাতা ও তার প্রসার্যমাণ ‘মেট্রোপলিটন কমপ্লেক্স’—এর কথা বলছি। একে অকালতারুণ্যের সমস্যা, তার উপর তরুণ ছেলেমেয়েদের স্থানাভাবে গৃহবাসের সমস্যা। একটি ১০০/১২০ বর্গফুট শয়নঘর, তার মধ্যে স্বামী—স্ত্রী, তাঁদের কিশোর ছেলেমেয়ে এবং কয়েকটি শিশু, অতিরিক্ত বৃদ্ধবৃদ্ধাও একজন থাকতে পারেন। স্বামী—স্ত্রী—র দাম্পত্যজীবনের একটু ‘প্রাইভেসি’ বা নির্জনতা প্রয়োজন। কিন্তু কোথায় নির্জনতা? সমস্ত মিলিয়ে কলকাতার বিশাল নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণ ছেলেমেয়েদের গৃহ যেন একটা জ্বলন্ত জৈবিক নরককুণ্ড, পুরাণোক্ত নরকবর্ণনাতেও তার বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তোলা যায় না।

বসবাস—সংকট নয় শুধু, আজকের তরুণদের জীবনে তার চেয়েও মর্মান্তিক সংকট হল পিতৃমাতৃস্নেহ—সংকট। অধিকাংশ ছেলেমেয়েদের জীবন বর্তমান সমাজে পিতৃমাতৃত্বের নিবিড় সান্নিধ্য ও স্নেহস্পর্শ থেকে বঞ্চিত। পাশ্চাত্য সমাজবিদরা একে ‘পেরেন্টাল ডিপ্রাইভেশন’—এর সমস্যা বলেছেন। বিশেষ করে মাতৃস্নেহের উপরেই তাঁরা গুরুত্ব দিয়েছেন। গৃহের আকর্ষণ প্রধানত মাতৃকেন্দ্রিক। সেই মা যদি দিনের প্রথম প্রহর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অফিসে কর্মব্যস্ত থাকেন এবং সন্ধ্যায় দারুণ পরিশ্রান্ত হয়ে ঘরে ফেরেন তাহলে তাঁর পক্ষে মাতৃত্বের প্রাথমিক কর্তব্যও পালন করা সম্ভব হয় না। অথচ শিল্পোন্নত পাশ্চাত্য সমাজে ‘ওয়ার্কিং’ স্ত্রী ও মায়েদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে, কেবল যে আর্থিক অভাবমোচনের জন্য তা নয়, জীবনযাত্রার ক্রমোন্নত স্তরে পৌঁছোনোর জন্য। অফিসের মায়েরা কখনো পরিবারের সন্তানদের কাছে আদর্শ মা হতে পারেন না, যেমন ওয়ার্কিং স্ত্রীদের পক্ষেও স্বামীর কাছে আদর্শ স্ত্রী হওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়াও পরিবারের বাইরে কর্মক্ষেত্রে স্ত্রী ও মায়েদের জীবনে যেসব নতুন সমস্যা দেখা দেয়, সে প্রসঙ্গ এখানে উত্থাপনই করছি না। আমাদের মতো শিল্পানুন্নত সমাজে প্রধানত পারিবারিক বাজেট টেনেটুনে ব্যালান্স করার জন্যই অধিকাংশ স্ত্রী ও মায়েদের বাইরের কর্মজীবনে পরিবার ছেড়ে যেতে হয়। কিন্তু সকলে তার জন্য যান না। মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার স্তর ও মান, ভদ্রলোকত্বের উপকরণের বৈচিত্র্য এবং মেয়েদের স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যবোধের ক্রমবিস্তারের ফলে স্ত্রী ও মায়েরা আজ গৃহকোণে বন্দি হয়ে শুধু স্বামীমুখাপেক্ষী গৃহকর্ত্রীর কর্তব্য পালন করতে নারাজ।

যূথ—জনকৃষ্টির প্রভাব কলকাতার সমাজেও মধ্যবিত্তের উচ্চস্তরে যথেষ্ট স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত। ক্লাব পার্টি সভা সিনেমা শপিং ইত্যাদি একশ্রেণির মহিলাদের কাছে গৃহের চেয়ে বেশি আকর্ষণপূর্ণ হয়ে উঠছে এবং তাঁরা মাতৃত্ব ও পত্নীত্বের বোঝা আগেকার মতো প্রসন্নচিত্তে, অথবা একাকী, আর বহন করতে চাইছেন না। শুধু গৃহকোণে বসে জীবনের পেয়ালায় চুমুক দিতে তাঁরা অনিচ্ছুক, বাইরের কাফে—অ্যাসোসিয়েশন—টি—রুমের পেয়ালার নতুন স্বাদ তাঁরা পেয়েছেন। কাজেই একালের তরুণদের জীবনের অবশ্যম্ভাবী অভিশাপ হল পিতৃত্ব—মাতৃত্ব দুইয়েরই, বিশেষ করে মাতৃত্বের, প্রত্যক্ষ গভীর স্পর্শ থেকে বঞ্চিত হওয়া। শ্রেণিভেদে কারণভেদ আছে, কিন্তু তার সামাজিক ফলাফল একই। ফলাফল হল, জীবনের কেন্দ্রবিন্দু পারিবারিক গৃহকোণ থেকে আজকের তরুণরা বিচ্যুত, সামাজিক শক্তির আবর্তাঘাতে গৃহ থেকে বহিষ্কৃত। আর্থিক অনটনের জন্য যাঁদের পক্ষে স্বাভাবিক গৃহবাস মা—বাবার কাছেই প্রায় অবাঞ্ছনীয়, পরিবার থেকে মানসিক বিচ্যুতির সঙ্গে তাঁদের অনেকটা দৈহিক বিচ্যুতিও ঘটে। মানসিক বিচ্যুতির হাত থেকে মনে হয় শ্রেণি—নির্বিশেষে এ যুগের কোনো তরুণেরই মুক্তি নেই। গৃহকোণ থেকে নির্বাসিত তরুণরা বাইরের সমাজে নানা রকমের ‘কোণ’ বা কর্নার খুঁজে বেড়ান, কফি হাউসের কোণ থেকে রাস্তার কোণ। সমাজের চারদিকে মৌচাকের মতো তরুণদের বিচিত্র ‘ডেন’ ও কর্নার’ গজিয়ে ওঠে। এই সমস্ত ‘ডেন’ ও ‘কর্নারের’ বৈচিত্র্য নির্ভর করে তরুণদের সামাজিক শ্রেণিগত শিক্ষাগত পারিবারিক নরকযন্ত্রণাগত ও বিচ্ছেদচেতনাগত পার্থক্যের উপর। কলকাতার সমজে তরুণদের মধ্যে ‘ড্রিফটার’—দের সংখ্যাই তাই বেশি দেখা যায়। ‘ড্রিফটার’ কারা? ফাইভেল বলেছেন :

They are boys and girls who appear adrift, without apparent direction in life, or recognizable moral standards, rejecting all authority, living only for the immediate gratification of desire and the search for security in the mob.

‘ড্রিফটার’ তাদের বলা যায়, যাদের জীবনের গতি আছে কিন্তু গন্তব্য নেই, যারা কারও কোনো প্রভুত্ব মানতে চায় না, কোনো নীতি—মানের মর্যাদা দিতে চায় না, নিজেদের খেয়ালখুশির তাৎক্ষণিক চরিতার্থতা যাদের লক্ষ্য এবং যারা জনতার স্থূলতার মধ্যে সাময়িক আত্মপ্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তার সন্ধান করে। সমাজের জীবনতরঙ্গে গন্তব্যহীন ভেলার মতো তারা ভাসমান।

স্কুল—কলেজ—বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে তরুণদের নানা রকমের সমস্যা আছে এবং ছাত্র আন্দোলন সেইসব বিশেষ সমস্যার সমাধানকল্পে গড়ে ওঠে। শিক্ষাপদ্ধতি, শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাকর্তাদের মনোভাবের আমূল সংস্কার ভিন্ন ছাত্র—সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। কিন্তু আপাতত আমাদের বিচার্য বিষয় তা নয়। এই প্রসঙ্গে, অর্থাৎ বর্তমান শিক্ষাসংকট প্রসঙ্গে, এ যুগের বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী কার্ল ম্যানহাইমের একটি উক্তি উদ্ধৃত করছি এখানে, শুধু বিষয়টির গুরুত্ব নির্দেশ করার জন্য। ম্যানহাইম বলেছেন যে, এ যুগের শিক্ষা হল প্রধানত ‘স্পেশালিস্ট এডুকেশন’, ম্যাজিকের যুগের ‘চ্যারিসম্যাটিক এডুকেশন’ অথবা তার পরবর্তীকালের ‘এডুকেশন ফর কালচার’—এর সঙ্গে তার পার্থক্য মূলগত। ‘স্পেশালিস্ট’ শিক্ষার ফলে সমাজযন্ত্রের নাট—বল্টু—স্ক্রু—হুইল—পিস্টন তৈরি হয় বিদ্যালয়ের কারখানায়, মানুষ তৈরি হয় না। বিদ্বান—বুদ্ধিমানদের যন্ত্রবোধ বৃদ্ধি পায়, সমাজচেতনা ও মানববোধ লুপ্ত হয়ে যায়। বর্তমান ব্যুরোক্রাটিক রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিচালকেদের কার্যকলাপ এবং স্পেশালিস্টদের নিয়ে গঠিত শত শত তদন্ত কমিটি—কমিশনের লক্ষ লক্ষ পৃষ্ঠাব্যাপী রিপোর্টের সামাজিক অনুপযোগিতা ও ব্যর্থতা, এই যান্ত্রিক শিক্ষাদর্শেরই শোচনীয় পরিণতি ছাড়া আর কিছু নয়। আধুনিক ধনতান্ত্রিক সমাজ যত যান্ত্রিক ক্ষেত্রে অটোমেশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, শিক্ষাক্ষেত্রেও তত অটোমেশনের আবির্ভাব হচ্ছে, তার সঙ্গে শিক্ষক—ছাত্রের সম্পর্কেরও পরিবর্তন হচ্ছে। কারণ বিদ্যালয় যদি সমাজযন্ত্র চালু রাখার জন্য মানুষের কলকবজা তৈরির কারখানায় পরিণত হয়, তাহলে সেই যন্ত্রের অঙ্গবিশেষ শিক্ষক ও ছাত্রের সম্পর্কও হয় যান্ত্রিক। যান্ত্রিক সম্পর্কে শ্রদ্ধা ও প্রীতির স্থান নেই, বড়—ছোট ভেদ নেই। তা—ই ছাত্র আন্দোলনে ও ছাত্র বিদ্রোহে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধার ভাব প্রকাশ পায় না। ছোট ছোট যন্ত্ররা বড় বড় যন্ত্রের ভয়াল ব্যাদানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। কিন্তু তরুণরা তো যন্ত্র হতে চান না, অথচ শিক্ষকদের কাছে শিক্ষায়তনের ফাউন্ড্রিতে অনবরত তাঁদের মাথা ও মেধার উপরে অটোমেটিক হাতুড়ির ঘা পড়তে থাকে। তরুণ ছাত্রদের মনে অসন্তোষের আগুন ধূমায়িত হতে থাকে—শিক্ষানীতির যান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে, শিক্ষক—ছাত্রের যান্ত্রিক সম্পর্কের বিরুদ্ধে, কমার্শিয়াল প্যাকেজতুল্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তঃসারশূন্য বিদ্যার মার্কার বিরুদ্ধে। তাঁরা বুঝতে পারেন, যেমন বিকৃত সমাজ তেমনি বিকৃত তার শিক্ষাব্যবস্থা। এই ধূমায়িত অসন্তাোষের বিস্ফোরণ হয় ছাত্র বিদ্রোহে। পরিবার থেকে বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় সবই বৃহৎ সমাজযন্ত্রের ছাঁচে তৈরি বলে সেগুলি সমূলে উৎপাটনের সংকল্পও সেই বিদ্রোহে ঘোষিত হয়। সাম্প্রতিক ফরাসি ছাত্র বিদ্রোহে এই বিকৃত সমাজযন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভই প্রকাশ পেয়েছে, শুধু শিক্ষানীতি বা শিক্ষাযন্ত্রের বিরুদ্ধে নয়। সমগ্র তরুণসমাজের বিদ্রোহ থেকে ছাত্র বিদ্রোহ তাই বিচ্ছিন্ন নয় এবং তার উদ্দীপনারও পার্থক্য নেই।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর সমাজের গতিধারা লক্ষ করলে দেখা যায় যে যুব আন্দোলনের সমস্ত মানবিক আদর্শের অপমৃত্যু ঘটেছে আজ যুবকের জন্য নয়, প্রবীণদের দুর্বুদ্ধির দৌরাত্ম্যের জন্য। বিশ্বতরুণের দৃষ্টিপথে আজ আর কোনো আদর্শের মিনার নেই। কোনে পর্বতশৃঙ্গে তাঁরা আর আদর্শের বোল্ডার ঠেলে তুলতে চান না, কারণ সিসিফাসের মতো তাঁদের কানে আজ অহরহ সেই বোল্ডার গড়িয়ে পড়ার গুমগুম শব্দ ধ্বনিত হচ্ছে।

‘কোথায় তুমি? তুমি তো সর্বক্ষণ এখানে থাকতে! কথার উত্তরে বলতে ”এই তো, এখানে আমি আছি!” এখন কোথায় তুমি? কোনো কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন? কোথায় সেই ছোটখাটো বৃদ্ধ লোকটি, যার নাম ভগবান? কেন সকলে চুপ করে আছে, কোনো কথার উত্তর দিচ্ছে না? কেন?’

তরুণ জার্মান নাট্যকার বোরশার্টের ‘অ্যাট দ্য ফ্রন্ট ডোর’ নাটকের ডায়ালগ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ যখন শেষ হয় তখন তাঁর বয়স ২৪ বছর, তার অল্পদিনের মধ্যে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে তিনি লিখে যান :

We are the generation without ties, without any horizon.

Our horizon is an abyss. We are the generation without happiness,

without a mother country, without farewell…

Our sun is meagre, out loves are cruel and out youth has no youth.

Now we can cry, we can sing whenever we want.

শিল্পী বোরশার্ট এই ঘোষণাপত্রটি, মনে হয় যেন, সারা পৃথিবীর তরুণদের জন্য রচনা করে গিয়েছেন। কলকাতার তরুণ, বার্লিনের তরুণ, প্রাগের তরুণ, প্যারির তরুণ, ওয়াশিংটনের তরুণ, লন্ডনের তরুণ, সকলের মর্মস্থল থেকে উৎসারিত এই ঘোষণা: ‘আমাদের কোনো বন্ধন নেই, কোনো দিগন্ত নেই।… আমাদের দেশ নেই, আমাদের বিদায়কালীন বেদনা নেই। আমাদের সূর্য নিষ্প্রভ, আমাদের প্রেম—ভালোবাসা নিষ্ঠুর এবং আমাদের যৌবনের যৌবন নেই। এখন আমরা যখন ইচ্ছা চিৎকার করতে পারি… গানও করতে পারি।’

কেন এই ঘোষণা? কারণ ‘প্লেগ ও পাথর ও অন্ধকার’ (ক্যামুর ভাষায় : ‘দ্য প্লেগ’) তাদের বহু যুগের বহু ঘোষণা স্তব্ধ করে দিয়েছে। সারা পৃথিবীর প্রবীণ ও প্রাজ্ঞরা সকলে মিলে যদি আজ শোভাযাত্রা করে যান এবং পথের কোনো বিদ্রোহী তরুণকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসা করেন: ‘তোমার সামনে বিস্তৃত ভবিষ্যৎ, তবু কেন তোমার মুখে এই সর্বনাশা বুলি?’ তাহলে সার্ত্রের সেই হতভাগ্য হিউম্যানিস্টের মতো (‘দ্য নসিয়া’) সে জবাব দেবে :

I shall lean against a wall and as they go I shall shout to them: ‘What have you done with your science? What have you done with your humanism? Where is your dignity as a thinking reed?’

এই প্রশ্নগুলির কোনো জবাব আছে কি? গতানুগতিক জবাব অবশ্যই আছে। যেমন বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিকের কৃতিত্বের ক্যাটালগ স্কুলের ছাত্রেরও মুখস্থ আছে এবং সেই ক্যাটালগ আবৃত্তি করে বলা যায়, বিজ্ঞান কী করেছে—না করেছে। আর হিউম্যানিস্ট ও চিন্তাশীল জীব হিসেবে মানুষের বিচিত্র কীর্তির কাহিনি দেশে দেশে রাষ্ট্রীয় দপ্তরের রেকর্ডরুমে স্তূপীকৃত হয়ে রয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানের রূপকথা, হিউম্যানিজমের ডেফিনিশন, এসব মুখস্থ করেও তরুণরা স্বপ্ন দেখেন—বিজ্ঞানের দুঃস্বপ্ন, বিকলাঙ্গ হিউম্যানিজমের দুঃস্বপ্ন। ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন, যা দেখলে ঘুমের ঘোরে বাকশক্তি রহিত হয়ে যায় এবং ঘুমন্ত মানুষ বুকচাপা যন্ত্রণায় গোঙাতে থাকে। তরুণরা এইসব দুঃস্বপ্ন দেখেন আজকাল। ইউরোপের তরুণরা যদি এই দুঃস্বপ্ন দেখেন তাহলে কলকাতার তরুণরা যে সুখস্বপ্নে বিভোর হয়ে কালো কালো রাতগুলো কাটিয়ে দেন তা মনে হয় না। কারণ ভিয়েতনাম কলকাতা থেকে অনেক কাছে এবং ভিয়েতনামে মার্কিন সৈন্যের ‘ফান’ ও গান হল :

Strafe the town and kill the people,

Drop naplam in the square…

এই গানের ধ্বনিতরঙ্গ কলকাতাতেই আগে ভেসে আসে। কলকাতার বিদ্রোহী তরুণও সেই পথের ধারে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রবীণ প্রাজ্ঞদের দিকে চেয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলতে পারেন—’তোমাদের বিজ্ঞান, তোমাদের টেকনোলজি নিয়ে এ কী দানবের রাজ্য তৈরি করেছ?’ পশুর রাজ্য নয়, দানবের রাজ্য, কারণ পশুসমাজও বর্তমান মানবসমাজের তুলনায় অনেক বেশি নিরাপদ, শান্ত ও বাসযোগ্য। শুধু দানবের সমাজ নয়, আজকের উন্নত ধনতান্ত্রিক টেকনোলজিক্যাল সমাজ নতুন এক ক্রীতদাসের সমাজ গড়ে তুলেছে। দার্শনিক হারবার্ট মারকুসে এই নতুন ক্রীতদাস—সমাজের স্বরূপ উদঘাটন করে লিখেছেন (One Dimensionel Man এবং An Essay on Liberation গ্রন্থ দ্রষ্টব্য) :

With technical progress… unfreedom–in the sense of man’s subjection to his productive, apparatus–is perpetuated and intensified in the form of many liberties and comforts …The slaves of developed industrial civilization are sublimated slaces, but they are slaves, for slavery is determined… This is the pure form of servitude : to exist as an instrument, as a thing.

এই হল শিল্পসমৃদ্ধ বিজ্ঞানোন্নত ভোগ্যপণ্যবহুল সমাজের নয়া গোলামির রূপ। গোলামরা সব উঁচুদরের ঊর্ধ্বলোকের গোলাম, আগেকার কালের গোলামদের মতো তাঁদের হাত—পায়ের ডান্ডাবেড়ি দেখা যায় না। তাঁদের ‘স্টেটাস’ আছে, ‘কমফর্ট’ আছে, ‘লিবার্টি’ আছে। তাঁরা নানা শ্রেণির ব্যুরোক্রাট টেকনোক্রাট ম্যানেজার ডিরেক্টর ইঞ্জিনিয়ার সেলস—প্রোমোটার বা ‘অ্যাড—মেন’—যাঁরা যন্ত্রের মতো সমাজটাকে চালাচ্ছেন। ব্যক্তিগত ভোগ—স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বাধীনতার একটা লোভনীয় মরীচিকা সৃষ্টি করছেন তাঁরা সাধারণ মানুষের সামনে এবং দিনের পর দিন বিজ্ঞাপনের শত—কৌশলে নেশার পিল খাইয়ে সেই ভোগ—স্বাধীনতার স্বপ্নে তাদের মশগুল করে রাখছেন।

বিজ্ঞান ও যন্ত্রময় সমাজের এই হল বর্তমান রূপ। ভবিষ্যৎ কী? ভবিষ্যৎ ভয়াবহ। দূরদর্শী বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিকরা এর মধ্যে বহুবার সমাজনায়ক ও রাষ্ট্রনায়কদের মানবসভ্যতার ভয়াবহ ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সাবধান করে দিয়েছেন।

পদার্থবিদ ও রসায়নবিদদের মধ্যে অনেকে বলেছেন যে, নিউক্লিয়ার ফলআউট, ডেটারজেন্ট, ইনসেক্টিসাইড ইত্যাদি যে পরিমাণে পৃথিবীর আলো—বাতাস—জল বিষিয়ে তুলছে তাতে আর কিছুদিন এরকম চলতে থাকলে ‘শ্রেষ্ঠ’ ম্যামাল মনুষ্যজাতির বিলোপ অবশ্যম্ভাবী। বৈজ্ঞানিক অভিব্যক্তিবাদের অন্যতম মূলসূত্র হল, এক—একটা জিয়োলজিক্যাল যুগে যে—হাতিয়ারের শক্তিতে যে জীবের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, শেষ পর্যন্ত সেই হাতিয়ারই হয়েছে সেই প্রধান জীবের ধ্বংসের কারণ। ‘মানুষ’ ম্যামালিয়ান যুগের শ্রেষ্ঠ জীব এবং জীবজগতে মানুষের অর্থাৎ বাইপেড ম্যামালের প্রাধান্যই প্রতিষ্ঠিত। এই প্রাধান্যের হাতিয়ার হল ‘বুদ্ধি’ (ইন্টেলিজেন্স), তাই মানুষের নৃতাত্ত্বিক নাম ‘হোমো স্যাপিয়েনস’ বা ‘বুদ্ধিমান মানুষ’। আশ্চর্য হল, এই বুদ্ধির হাতিয়ারই আজ আমাদের বিলুপ্তিকে আসন্ন করে তুলেছে। বুদ্ধি দিয়ে আজ আমরা প্রকৃতির মৌল উপাদান পরমাণুর শক্তি নিষ্কাশন করেছি এবং সেই শক্তি দিয়ে সর্বাত্মক ধ্বংসের জন্য প্রস্তুত হয়েছি ও হচ্ছি। সুতরাং বৈজ্ঞানিক অভিব্যক্তিবাদের সূত্র অনুযায়ী পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চ থেকে আমাদের বিদায় নেবার সময় হয়েছে, এ কথা বললে নৈরাশ্যবাদ প্রচার করা হয় না, বিজ্ঞানেরও অপমান করা হয় না। মানবসমাজের ভবিষ্যৎ যে ভয়াবহ, মহাশ্মশানের চেয়েও ভয়াবহ, এ কথা বৈজ্ঞানিক সত্য কথা, বর্তমান সমাজের সেলসম্যানদের বিজ্ঞাপনের মন—ভোলানো কথার মতো মিথ্যা নয়।

সমাজ ও সভ্যতার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ফার্ডিন্যান্ড ৎসুইগ তরুণ ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তাঁদের ধারণা কী? তেইশজন ছাত্র গভীর নৈরাশ্যবাদী মত প্রকাশ করেছিলেন, তেরোজনের আশা—নিরাশার দ্বন্দ্ব ছিল, তেষট্টিজন ছিলেন আশাবাদী। ইতিহাস ও সমাজবিদ্যার ছাত্ররা সকলেই প্রায় নৈরাজ্যবাদী। উল্লেখ্য হল, যাঁরা আশাবাদী তাঁরা বলেছিলেন যে এ সমাজে বাঁচাই সম্ভব নয়, ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কোনো আশা পোষণ না করলে। অর্থাৎ তাঁরা ভয়ে এবং অনেকটা কোনোরকমে বেঁচে থাকার তাগিদে বাধ্য হয়ে আশাবাদী।

এই হল সমাজের বর্তমান ও ভবিষ্যতের ছবি। সমাজে যাঁদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দুইই আছে—অন্তত থাকা উচিত—তাঁরাই তরুণ। বর্তমান হচ্ছে, ধনতান্ত্রিক টেকনোলজিক্যাল যুগের নয়া গোলামতন্ত্রের বর্তমান। ধনতান্ত্রিক হোক, গণতান্ত্রিক হোক, সমাজতান্ত্রিক হোক, সকল সমাজের বর্তমানের একই জীবনের গতি এবং সকল ‘তন্ত্রের’ উপরে সবচেয়ে বড় সত্য গোলামতন্ত্র। নিছক যন্ত্র, বা পণ্য, বা নিরেট বস্তু হয়ে বেঁচে থাকা ছাড়া এই গোলামতন্ত্রে বাঁচবার আর কোনো উপায় নেই। মানবসমাজের ইতিহাসে এইটাই হল দাসত্বের চরম পর্যায়, কারণ মিথ্যা ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ভোগ—স্বাচ্ছন্দ্যের মোহে এই দাসত্বচেতনা আচ্ছন্ন। ভবিষ্যৎ নিরাকার, অন্ধকার ও ভয়ংকর। বর্তমানের বুকের উপর বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে, বিপুল আশা ও বিশ্বাস নিয়ে, দেহ—মনের পরিপূর্ণ কর্মশক্তি, নিষ্ঠা ও একাগ্রতা দিয়ে, যাঁরা সমাজের ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে দেখবেন এবং জীবনের পথে নির্ভীক যোদ্ধার মতো এগিয়ে চলবেন তাঁরা দেশের তরুণসমাজ। কিন্তু ভবিষ্যতের কোনো রেখাচিত্র, ইমেজ বা মডেল তরুণদের দৃষ্টিপথে আজ নেই। বহু যুগের বহু স্বর্ণকান্তি ভবিষ্যতের শিলীভূত বোল্ডার পর্বতচূড়া থেকে গড়িয়ে পড়ার ধ্বনি—প্রতিধ্বনি তাঁরা শুনতে পাচ্ছেন। বর্তমানের যান্ত্রিক গোলামতন্ত্রের মোহবৈচিত্র্য ঐন্দ্রজালিক হলেও, তার কাছে তরুণদের মন আত্মসমর্পণ করতে চায় না। সমাজবিজ্ঞানীরাও আজ আত্ম প্রতারণা না করে, অথবা মিথ্যা বাগজাল বিস্তার না করে, ভবিষ্যৎ সমাজের কোনো সম্ভাব্য বাস্তব মূর্তি তরুণদের সামনে প্রতিষ্ঠা করতে অক্ষম। হারবার্ট মারকুসের ভাষায় বলা যায় :

The critical theory of society possesses no concepts which could bridge the gap between the present and its future: holding no success, it remains negative. Thus it want to remain loyal to those who, without hope, have given and give their life to the Great Refusal.

তরুণের মন আজ এই বিরাট না—ধর্মী মন। না—না—না এই তাঁদের ধ্বনি। ধনতান্ত্রিক সমাজযন্ত্রের বিরুদ্ধে ‘না’, রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে ‘না’, শিক্ষাযন্ত্রের বিরুদ্ধে ‘না’, যান্ত্রিক দাসত্বের বিরুদ্ধে ‘না’, প্রকৃতি ও মানুষের যান্ত্রিক বিকৃতি ও বীভৎসতার বিরুদ্ধে ‘না’। আপাতত তরুণের মনের কোনো হাঁ—ধর্মী ভাবান্তরের কোনো আশা নেই। এরই নাম ‘রিবেলিয়ান’, ‘রিফিউজাল’, ‘বিদ্রোহ’—আজকের তরুণের ও চিন্তাশীল মানুষের যা একমাত্র পবিত্র কর্তব্য। বোধহয় চিরকালই তাই তরুণের মন ও মননশীল মানুষের মন বিদ্রোহী। আজকের মন শতগুণ বেশি বিদ্রোহী। তাই তার না—ধ্বনির রূঢ়তা এত উগ্র। বিদ্রোহের সুরে বিশ্বতরুণের মনের সঙ্গে কলকাতার তরুণের মন এক তন্ত্রীতে বাঁধা, এবং সেখানে শুধু না—না আর না—এর সুতীব্র ঝংকার।

১৯৬৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *