1 of 2

কলকাতার জন্মদিন কবে?

কলকাতার জন্মদিন কবে? 

কলকাতার জন্মদিন কবে? যাঁরা ২৪ আগস্ট ১৯৯০ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতার তিনশ বছর পূর্তি উৎসব পালন করতে প্রবৃত্ত হয়েছেন, তাঁরা সকলেই বলবেন, কলকাতার জন্মদিন হচ্ছে ২৪ আগস্ট ১৬৯০। কিন্তু আমি বলব নৈব নৈব কদাচন। কিন্তু একটা নেতিবাচক উত্তর দিলেই তো চলবে না। সেটা প্রমাণ করা চাই। 

শহর কলকাতা তো ইংরেজরাই প্রতিষ্ঠা করেছিল। সুতরাং এর একটা পটভূমিকা তো ছিলই। ১৬৪০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ ইংরেজরা বাঙলা দেশে আসে। তারা হুগলিতে নিজেদের বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন করে! হুগলিতে ইংরেজরা বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন করবার আগে প্ৰায় একশত বৎসর যাবৎ হুগলি ছিল পর্তুগীজদের বাণিজ্যকেন্দ্র। ১৬৩২ খ্রীষ্টাব্দে এক নারীঘটিত ব্যাপারের জন্য সম্রাট শাজাহান পর্তুগীজদের হুগলি থেকে বিতাড়িত করে। পরে সম্রাট শাজাহানকে প্রশমিত করে, তারা ব্যাণ্ডেলে আশ্রয় পায়। এই সময়ের অব্যবহিত পরেই ইংরেজরা বাঙলায় এসে হুগলিতে পর্তুগীজদের পরিত্যক্ত শূন্য স্থান পূরণ করে। ১৬৮৬ খ্রীস্টাব্দে হুগলিতে ইংরেজদের সঙ্গে বাঙলার নবাবের এক যুদ্ধ হয়। যদিও ওই যুদ্ধে ইংরেজরাই জয়ী হয়েছিল, তা হলেও তারা বুঝে নিয়েছিল যে হুগলিতে তাদের পক্ষে নির্বিঘ্নে আর বেশিদিন থাকা চলবে না। সেজন্যই নূতন কোন কেন্দ্রের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে, চার্ণক ১৬৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ২০ ডিসেম্বর তারিখে সুতানটিতে এসে অবতরণ করেন। 

১৬৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ২০ ডিসেম্বর তারিখটাকেই আমি শহর কলকাতার জন্মদিন বলতে চাই। আমার বক্তব্যের পিছনে কি কি যুক্তি আছে, তা আমি এখনই পেশ করব। তার আগে আমি বলে নিতে চাই যে শহর কলকাতার চেয়ে গ্রাম কলকাতা অনেক পুরানো। ষোড়শ শতাব্দীতে গ্রাম কলকাতার উল্লেখ আমরা পাই আকবরের রাজস্বসচিব রাজা তোদরমল কর্তৃক ১৫৮২ খ্রীষ্টাব্দে প্রণীত ‘ওয়াশিল-ই-জমাতুমার’ নামক রাজস্ব সংক্রান্ত সমীক্ষায়। আবার ওই ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত বাংলা মঙ্গলকাব্যসমূহেও আমরা কলকাতা গ্রামের উল্লেখ পাই। 

১৬৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ২০ ডিসেম্বর তারিখে জোব চার্ণক যখন তাঁর এদেশীয় স্ত্রী ও তার গর্ভজাত তিন কন্যা সমেত সুতানটিতে এসে অবতরণ করেন, তখন সুতানটির সীমারেখা ছিল উত্তরে বাগবাজারের খাল, পূর্বে লবণ হ্রদ, পশ্চিমে ভাগীরথী ও দক্ষিণে পুরানো টাকশাল বাড়ি পর্যন্ত। আর তার দক্ষিণে ছিল পর পর দু’খানা গ্রাম-কলকাতা ও গোবিন্দপুর। সুতানটিই চার্ণকের কাছে ইংরেজদের আদর্শ বাণিজ্যকেন্দ্র হবার পক্ষে উপযুক্ত স্থান বলে বিবেচিত হয়েছিল। এখানেই চার্ণক বসতি স্থাপন করেছিলেন, এবং কয়েকদিন পরে সপরিবারে বড়দিনের উৎসব পালন করেছিলেন। 

সুতানটিই ছিল পরবর্তীকালের কলকাতা শহরের কেন্দ্রবিন্দু। কেননা পরবর্তী দশ বৎসর ইংরেজরা কলকাতা থেকে বিলাতের কর্তৃপক্ষগণের কাছে যত চিঠি-পত্তর লিখত, সেগুলির মাথায় তারা সুতানটিরই ঠিকানা দিত। সুতরাং সুতানটিতে প্রথম অবতরণ ও আগমনের তারিখটাকেই শহর কলকাতার প্রতিষ্ঠা দিবস বলে গণ্য করবার যথেষ্ট যুক্তি আছে। সুতানটিতে প্রথম আগমন (২০ ডিসেম্বর ১৬৮৬) ও সুতানটিতে তৃতীয়বার আগমন (২৪ আগস্ট, ১৬৯০)—এই সময়কালের মধ্যে সংঘটিত ঘটনাবলীও তা সমর্থন করে। 

চার্ণক ইংরেজদের বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে সুতানটিকে যে সুরক্ষিত (fortified) করবার পরিকল্পনা করেছিলেন এবং সে সম্বন্ধে বিলাতের কর্তৃপক্ষকে লিখেছিলেন, সেটা আমরা জানতে পারি ১৬৮৮ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে ক্যাপটেন হীথ বিলাতের কর্তৃপক্ষের লিখিত যে চিঠিখানা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন, তা থেকে। ‘If the place Mr. Charnock may have already settled and fortified upon will in any measure answer our known purpose, in such case, since we can’t help it.’ তিন সপ্তাহ পরে বিলাতের কর্তৃপক্ষ কলকাতাতেই ইংরেজদের অবস্থান করবার সপক্ষে আর একখানা চিঠি লেখেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ক্যাপটেন হীথের গোঁয়ারতুমির জন্য ১৬৮৮ খ্রীষ্টাব্দের ৮ নভেম্বর থেকে ১৬৯০ খ্রীষ্টাব্দের ২৪ আগস্ট তারিখে সুতানটিতে তৃতীয়বারের মত ফিরে আসার সময়কালের মধ্যে চার্ণককে হীথের গোঁয়ারতুমির জন্য এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াতে হয়েছিল। তবে ১৬৯০ খ্রীষ্টাব্দের ২৪ আগস্ট তারিখের পর চার্ণককে আর সুতানটি ত্যাগ করতে হয়নি বলেই আমরা ২৪ আগস্ট ১৬৯০ তারিখটাকেই কলকাতার জন্মদিন বলে ধরি। 

১৬৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ২০ ডিসেম্বর তারিখে ইংরেজরা সুতানটিতে আসবার পর এখানে যে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল, সেটা আমরা ক্যাপটেন হীথ বিলাতের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে যে চিঠিখানা এনেছিলেন মাত্র তা থেকেই যে জানতে পারি, তা নয়। ১৬৯০ খ্রীষ্টাব্দের ২৪ আগস্ট তারিখে চার্ণক তৃতীয়বারের জন্য সুতানটিতে আসবার পর, সুতানটি কাউন্সিলের যে প্রথম অধিবেশন হয়, সেখানে গৃহীত প্রস্তাব থেকেও জানতে পারি। ওই প্রস্তাবের পাঠ আমি এখানে উদ্ধৃত করছি। যথা—‘আগে যে সমস্ত ঘরবাড়ি ছিল, সেগুলি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পুনরায় কতকগুলি গৃহনির্মাণ প্রয়োজন। একটি মালগুদাম, একটি রান্না ও খাবার ঘর, কোম্পানির কর্মচারীদের থাকবার স্থান, পাহারাদারদের বাসস্থান ও এলিস সাহেবের আবাসগৃহ নির্মাণ করা শীঘ্রই প্রয়োজন। এজেণ্ট ও মিস্টার জেরেমিয়া পিটির আবাসস্থানের কতকটা এখনও আছে—সেগুলো মেরামত করে নিলেই চলবে।’ এই প্রস্তাব থেকেই বুঝতে পারা যাচ্ছে যে ১৬৮৮ খ্রীষ্টাব্দের ৮ নভেম্বর তারিখে ইংরেজরা যখন ক্যাপটেন হীথের সঙ্গে অন্য কেন্দ্রের সন্ধানে বেরিয়েছিল, তখনই ইংরেজ উপনিবেশে নিতান্তপক্ষে অনুরূপ ঘরবাড়ি ছিল। সুতানটি কাউন্সিলের যে অধিবেশনে ওই প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল, সেখানেই মন্তব্য করা হয়েছিল যে আগে যে সব ঘরবাড়ি ছিল, সেগুলি হয় লুণ্ঠিত, আর তা নয়তো অগ্নিদগ্ধ হয়েছে।’ 

যখন ১৬৯০ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বেই ইংরেজদের এখানে উপনিবেশ ও ঘরবাড়ি ছিল, সেক্ষেত্রে ১৬৯০ খ্রীষ্টাব্দের ২৪ আগস্ট তারিখটাকে কলকাতার জন্মদিন হিসাবে গণ্য করবার পিছনে কোন যুক্তি নেই। 

এখানে আরও উল্লেখনীয় যে ১৬৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসেই চার্ণক সুতানটি থেকে তাঁর প্রতিভূ ওয়াটস্ ও বরামলকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন নবাব শায়েস্তা খানের কাছে এক আরজি-পত্র পেশ করবার জন্য। ওই আরজি-পত্রে বারো দফা প্ৰাৰ্থনা ছিল। তার মধ্যে দু’ দফা ছিল—কলকাতায় একটা দুর্গ ও একটা টাকশাল নির্মাণ। ১৬৮৭ খ্রীষ্টাব্দের ২৮ জানুয়ারী তারিখে শায়েস্তা খান চার্ণককে জানান যে তিনি তাঁর আরজি অনুমোদন করেছেন ও ওটা সহি-সাবুদের জন্য দিল্লির বাদশাহের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এ তথ্য থেকেও বুঝতে পারা যায় যে ১৬৯০ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বেই ইংরেজরা কলকাতায় উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *