কলকাতার আধাসায়েব সমাচার

কলকাতার আধাসায়েব সমাচার

কলকাতার নগরায়ণের এক অভিনব ফসল হল অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়। আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তারা half caste নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তী কালে তাদের কখনও বলা হয়েছে ‘Indo Britons’, কখনও ‘East Indians’ এবং কখনও ‘Eurasians’। ১৯১১ সালে সর্বপ্রথম সরকারিভাবে তাদের ‘অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান’ তকমা দেওয়া হয়। ভারতীয়দের চোখে তারা আধা-সায়েব।

যদিও সাধারণভাবে তাদের সম্প্রদায় বলা হয়, আসলে তারা একটা সংকর জাতি বা দোআঁশলা। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের মা অবশ্যই ভারতীয়, কিন্তু বাবা সব সময় যে ইংরেজ হত, এমন নয়। ইউরোপের অন্যান্য জাতি, যেমন, পর্তুগিজ, ফরাসি, ওলন্দাজরাও ভারতীয় নারী বিয়ে করত। তবে কলকাতায় যে হেতু শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে ইংরেজরা ছিল বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের বেশির ভাগের জন্ম হত ইংরেজ সায়েবের ঔরসে। তারপর পর্তুগিজদের।

বস্তুত, পর্তুগিজরাই প্রথম ভারতীয় নারী বিয়ে করে এই সংকর জাতির সৃষ্টি করে, যার অস্তিত্ব ষোড়শ শতকের আগে কখনও ছিল না ভারতীয় সমাজে। পর্তুগিজরাই প্রথম ইউরোপীয় যারা ভারতে আসে এবং ভারতের মাটিতে কিছু অঞ্চলে শাসন প্রতিষ্ঠা করে। প্রথম দিকে পর্তুগিজ সরকার ভারতে তাদের কর্মচারীদের চরিত্রের নৈতিক মান বজায় রাখার জন্য প্রতি বছর কয়েক ঝাঁক পর্তুগিজ তরুণী পাঠাত ভারতে, যারা স্বদেশে বর খুঁজে ব্যর্থ হত। কিন্তু এক সময় দেখা গেল, এইভাবে পর্তুগাল থেকে তরুণী আমদানি ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। তা ছাড়া, দীর্ঘ সমুদ্রপথ পাড়ি দেওয়ার আনুষঙ্গিক সমস্যাও ছিল। এই কারণে পর্তুগিজ সরকার তাদের কর্মচারীদের এদেশের মেয়ে বিয়ে করার অনুমতি ও উৎসাহ দিতে থাকে। অবশ্য, পর্তুগিজদের ভারতীয় নারী বিয়ে করার এটাই একমাত্র কারণ ছিল না। প্রাচ্যে বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যের সঙ্গে মিশে ছিল আর একটা মতলব। খ্রিস্টধর্মের প্রসার। এই মতলব হাসিল করার সহজ উপায় ছিল ভারতীয় নারী বিয়ে করা। পর্তুগিজ পুরুষরা যত বেশি ভারতীয় নারী বিয়ে করবে, তত বেশি প্রসার ঘটবে খ্রিস্টধর্মের। এজন্য বিয়ের আগে পাত্রীকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা হত। ফলে পর্তুগিজ অধ্যুষিত অঞ্চলে এই হাইব্রিড সম্প্রদায় গড়ে ওঠে।

এইসব বিয়ের পরিণামে যে সব সন্তান হত, তাদের বলা হত, Luso-Indian। ভারতীয় সমাজ তাদের স্বীকৃতি দিত না এমনকী, তাদের সঙ্গে ব্যাবসা-বাণিজ্যও করতে চাইত না। ফলে Luso-Indianরা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল জীবিকা অর্জনের জন্য। কেউ হয় জলদস্যু, কেউ ভাড়াটে সেনা, কেউ ডাকাত।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও প্রথম দিকে পর্তুগিজদের মতো বছরে একবার এক ঝাঁক তরুণী পাঠাত বোম্বাইয়ে। কিন্তু সতেরো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এই আমদানি বন্ধ হয়ে যায় সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির কারণে। ওলন্দাজ সরকারও একইভাবে তাদের সেনাদের ভারতীয় মেয়ে বিয়ে করার জন্য অনুমতি দেয়। ১৬৮৪ সালে কোম্পানির পরিচালক সমিতি ভারতে তাদের প্রতিনিধিদের জানায়, সেনাদের পত্নীরা ভারতে তাদের পতিদের কাছে যেতে পারে যদি পাথেয় জোগাড় করার সামর্থ্য থাকে। যারা অবিবাহিত, যদি পারে ভারতীয় নারী বিয়ে করুক। তবে অখ্রিস্টান ভারতীয় নারী বিয়ে করতে হবে। পর্তুগিজ নারী কখনওই নয়, তারা রোমান ক্যাথলিক।

আঠারো শতকে কোম্পানির কর্মচারীরা কলকাতায় ইংরেজ রমণীর অভাবে কীভাবে সমস্যার মুখে পড়ত, তার বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে আগের অধ্যায়গুলিতে। প্রধানত সেই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য সায়েবরা ঝুঁকেছিল এদিশি মেয়েদের দিকে। তবে উল্লেখ করা দরকার, ইংরেজ সায়েবরা এদিশি মহিলাকে কেবল ঘরনি করে রাখত, পর্তুগিজদের মতো ধর্মান্তরিত করে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করে পত্নীর মর্যাদা দিত না। তারা ছিল তাদের সন্তানের মা, ঘরনি, বিবি, রক্ষিতা। জনৈক লেখক ১৮১৪ সালে কলকাতায় এসে শহরের শ্বেতাঙ্গ সমাজের বর্ণনা দিতে গিয়ে মন্তব্য করেন, ‘প্রায় প্রত্যেক বেসরকারি ইউরোপীয়র হাফকাস্টদের নিয়ে পরিবার আছে। উঁচুপদের সামরিক অফিসার এবং সিভিলিয়ানরা হারেম ছাড়া সন্তুষ্ট নয়।… এইভাবেই সৃষ্টি হয়েছে এক জঘন্য এবং নিকৃষ্ট সম্প্রদায়…।’

কলকাতা বা বাংলায় যে সব দিশি মহিলা সায়েবদের মিসট্রেস বা ঘরনি হত, তারা বেশির ভাগ ছিল মুসলমানি, দশজনের মধ্যে নয় জন। সামাজিক অনুশাসনের জেরে হিন্দু মেয়েদের সায়েব-ঘরনি হওয়া ছিল বিরল ব্যতিক্রম। আঠারো শতকে মুসলমানরা ইউরোপীয়দের সঙ্গে নির্দ্বিধায় মিশলেও হিন্দুরা দূরত্ব বজায় রাখতে তৎপর ছিল। এর মূলে ছিল তাদের জাত-পাতের গোঁড়ামি। মুসলমান মেয়েরা কোনও সায়েবের আশ্রয়ে থাকলেও তাদের আত্মীয়স্বজন সেটাকে অসম্মানের ব্যাপার বলে মনে করত না। কিন্তু যেটা অবাক করার বিষয়, তা হল, সায়েবদের ঘরনি হিন্দু-মুসলমান যাই হোক না কেন, খুব কম ক্ষেত্রে সে নিজের ধর্ম, প্রথা এবং জীবনচর্যার ধারা ত্যাগ করত।

কলকাতায় সম্ভবত জোব চার্নক ছিলেন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের জনক, যাঁর এদিশি পত্নীর গর্ভে জন্ম নিয়েছিল কয়েকটা সন্তান। বাংলায় ইউরেশিয়ানরা প্রথমে ‘কিন্তাল’ নামে পরিচিত ছিল। শব্দটার উৎস স্পষ্ট নয়। ‘কিন্তাল’ শব্দটার অর্থ একটু ভিন্ন ধরনের। ইউরেশিয়ানরা যে অঞ্চলে থাকত, সেই বসতিকে বলা হত ‘কিন্তাল’। সম্ভবত, পর্তুগিজ শব্দ ‘quintal’-এর সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে, যার অর্থ বাগানবাড়ি। হতে পারে, শহরের বাগানবাড়িতে সায়েবরা তাদের রক্ষিতাদের রাখত এবং তাদের সন্তানদের নিয়ে সেখানে বাস করত। সেজন্য তাদের বলা হত ‘কিন্তাল’। ১৮০৩ সালে তালতলা বাজারে এরকম একটা বাগানবাড়ি নিলামের বিজ্ঞাপন দিয়েছিল Faria Williams and Holder। কলকাতায় প্রথম দিকে অনেক নবাগত ইংরেজ পর্তুগিজ ভাষা শিখত, চর্চা করত। এজন্য হয়তো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের উদ্দেশে ব্যবহার করত ‘কিন্তাল’ শব্দটা। ১৭০৮ সালে হ্যামিলটন লিখেছিলেন, ‘Portuguese is the language that most Europeans learn, to qualify themselves for general converse with one another,” ১০

এক সময় ভারতে উপকূলবর্তী এলাকায় ইউরোপের বিভিন্ন ভাষা-ভাষীদের মধ্যে যোগাযোগের ভাষা ছিল পর্তুগিজ। ক্লাইভ কোনো ভারতীয় ভাষার একটা শব্দ উচ্চারণ করতে পারতেন কিনা সন্দেহ। কিন্তু পর্তুগিজ ভাষায় অনর্গল কথা বলতে অভ্যস্ত ছিলেন।১০ক

আঠারো শতকের দ্বিতীয় ভাগ পর্যন্ত অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ও ইংরেজদের অভিন্ন বলে মনে করা হত। তাদের কোনও রকম অক্ষমতা ও অযোগ্যতা আছে, এমন ভাবনা তখনও গ্রাস করেনি কলকাতার পাক্কা সায়েবদের। যদি তাদের অভিভাবকদের সামর্থ্য থাকত, লেখাপড়া করার জন্য পাঠিয়ে দিত বিলেতে। ফিরে আসত কোম্পানির কভন্যানটেড কিংবা কমিশনড সার্ভিসে যোগ দেওয়ার যোগ্যতা নিয়ে। যাদের সে সুযোগ ছিল না, কলকাতায় লেখাপড়া করে অনেকেই আনকভন্যানটেড সিভিল সার্ভিসে নিযুক্ত হত। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের সেই সৌভাগ্যের সময় ছিল মোটামুটিভাবে ১৭৮৫ পর্যন্ত।১১

এরপরই তাদের কপাল ভাঙে। প্রথম অশনি সংকেত নিয়ে আসে এক নির্দেশ। ১৭৮৬-র ১৪ মার্চ তাদের স্বার্থের প্রতিকূলে প্রথম ফতোয়া এল। তাতে বলা হল, ব্রিটিশ সামরিক অফিসারদের অনাথ সন্তান যারা কলকাতার Upper Orphanage School-এ পড়াশোনা করেছে, তারা কভন্যানটেড সার্ভিসের জন্য বিলেতে গিয়ে শিক্ষা নিতে পারবে না। দ্বিতীয় আঘাত এল ১৭৯১-এর এপ্রিলে। বলা হল, ইংরেজ বাবা ও ভারতীয় মা-এর অবৈধ সন্তান এখন থেকে কোম্পানির সামরিক এবং অসামরিক বিভাগে চাকরির জন্য বিবেচিত হবে না। এর ফলে, জনৈক জন টার্নিং (John Turning) ক্যাডেট পদে মনোনীত হলেও তার চাকরি বাতিল হয়ে যায় ব্রিটিশ বাবা ও ভারতীয় মা-এর সন্তান হওয়ার অপরাধে। ১৭৯৫ সালে গভর্নর জেনারেল ঘোষণা করলেন, যাদের মা-বাবা উভয়েই ইউরোপীয় নয়, তারা শুধুমাত্র সামরিক ব্যান্ডে বিবেচিত হবে।১২ ১৭৯০ থেকে ঔপনিবেশিক শাসকরা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের একটা সমস্যা হিসেবে দেখতে শুরু করে। তাদের ওপর দমন নীতি প্রয়োগের অশুভ সূচনা করেন লর্ড কর্নওয়ালিশ। তিনি কতকগুলো আইন তৈরি করে ছেঁটে ফেলেন এই সংকরজাতির অধিকারগুলোকে।১৩

আঠারো শতকের শেষদিকে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের সম্পর্কে বিলেতের কর্তৃপক্ষের এমন কঠোর মনোভাব গ্রহণ করার পেছনে কারণ ছিল। ক্লাইভের সময় গোরা পল্টনরা একবার বিদ্রোহ করে। সেই অভিজ্ঞতা কর্তৃপক্ষকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল।১৪ কোম্পানি মনে করত, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা রাজনৈতিক দিক থেকে বিপজ্জনক। তারা যে কোনও সময় ভারতীয়দের সঙ্গে হাত মেলাতে পারে কোম্পানির বিরুদ্ধে। ১৭৯১ সালে এমনই ঘটনা ঘটেছিল স্পেনের আমেরিকান উপনিবেশে। সেখানকার নেটিভরা শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল বর্ণসংকরদের নিয়ে। কিন্তু ভারতে এই আশঙ্কার কোনও ভিত্তি ছিল না। এদেশে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা সব সময় কোম্পানির শাসনের অনুগত ছিল।

আসলে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের বিরুদ্ধে এই বিমাতৃসুলভ পদক্ষেপ নেওয়ার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল পরিচালক সমিতির স্বার্থ। কোম্পানির চাকরি বিলেতে ইংরেজদের কাছে ক্রমশ লোভনীয় হয়ে উঠতে থাকায় তারা চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নিজেদের হাতে রাখতে ব্যগ্র হয়ে উঠেছিল। কোম্পানির সামরিক ও অসামরিক বিভাগে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা বেশি সংখ্যায় সুযোগ পেলে মার খেত তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করার ক্ষমতা। কিছু অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সন্তানের গাত্রবর্ণ দেখে কিছুতেই তাদের খাঁটি ইংরেজদের থেকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করা যেত না। তারা বিলেতে থেকে শিক্ষিত হয়ে কোম্পানির চাকরির যোগ্য হয়ে উঠলে দেখা দিত সমস্যা। তারা অনেকেই খাঁটি ইংরেজের তুলনায় যোগ্যতায় কিছু কম ছিল না। বরং কখনও কখনও অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও কৃতিত্বের পরিচয় দিত।

সেজন্যই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের বিলেতে গিয়ে শিক্ষালাভের সুযোগ কেড়ে নেওয়া হয়, যাতে তারা কোম্পানির কোনও চাকরিতে যোগ্যতা অর্জন করতে না পারে। আর একটা আশঙ্কা চেপে বসেছিল পরিচালক সমিতির মাথায়। কোম্পানির চাকরিতে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের বেশি সংখ্যায় উপস্থিতি নেটিভদের মনে খাঁটি সায়েবদের যোগ্যতা সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি করতে পারে।১৫ এ বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন পরিচালক সমিতির অন্যতম সদস্য হেনরি ডুনডাস।১৬

তথাপি পরিচালক সমিতির নীতি কলকাতা বা বাংলায় এই সংকর জাতির সংখ্যা বৃদ্ধিতে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। Upper Orphanage-এর মেয়েরা দিব্যি ব্রিটিশ সেনাকে বিয়ে করে চলে যেত বিলেতে। ফোর্ট সেন্ট ডেভিডের গভর্নর ক্রুক-এর ঔরসজাত ভারতীয় মা-এর মেয়ে চারজন ইংরেজকে বিয়ে করেছিল পর পর। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ফোর্ট উইলিয়মের গভর্নর উইলিয়ম ওয়াটস্ এবং উইলিয়ম জনসন। ১৭৬৯ সালে ওয়াটস্-এর মেয়ে এমেলিয়া চার্লস জেনকিনসনকে বিয়ে করেন। তাদের ছেলে রবার্ট জেনকিনসন ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হন ১৮১৮-১৮২৭ সালে।১৭ লে. কর্নেল জে. স্কিনার (১৭৭৮-১৮৪১) কিংবা কোম্পানির বিখ্যাত জাহাজ নির্মাতা জেমস কিড-এর (১৭৮৬-১৮৩৬) মতো কয়েকজন ইউরেশিয়ান বিত্ত ও সামাজিক মর্যাদা লাভ করেছিলেন নিজেদের কৃতিত্বে।১৮

উনিশ শতকের প্রথম দিকে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী লর্ড লিভারপুল ছিলেন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পরিবারের সন্তান।১৮ক উইলিয়ম পামার (১৭৮০-১৮৬৭) ছিলেন পুনার দরবারে রেসিডেন্ট জেনারেল উইলিয়ম পামারের মুসলমান পত্নী ফিজ বক্‌স্ (Fyze Baksh)-এর সন্তান। শরীরে খাঁটি ব্রিটিশ রক্ত না থাকা সত্ত্বেও নিযুক্ত হয়েছিলেন ব্রিটিশ বাহিনীর পদস্থ অফিসারের পদে।

কিন্তু কয়েকজন বিশিষ্ট অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের সৌভাগ্য ও পদমর্যাদার প্রেক্ষিতে সমস্ত অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানের অবস্থা নির্ধারণ করা যায় না।

শুধুমাত্র কলকাতা এবং বিলেতে কোম্পানির কর্তৃপক্ষ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের সমস্ত রকম সুযোগ-সুবিধে থেকে বঞ্চিত করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল, তা নয়। অনেক ইংরেজ ব্যক্তিগত ভাবে তাদের প্রতি বিদ্বিষ্ট ছিল প্রধানত তাদের জন্মদোষের জন্য। ইংরেজ ও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে চরম বৈষম্যের ফলে ব্রিটিশ সংবাদপত্রগুলো পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রলেখকের বিদ্বেষপূর্ণ চিঠি প্রকাশ করতে দ্বিধা করত না। সে সব চিঠিতে বিভিন্ন নাম দেওয়া হয়েছিল অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের যেমন, Half-blood, Brunetle, Black Moor, Half-Caste ইত্যাদি। প্রত্যেকটি ছিল রীতিমতো অবজ্ঞাসূচক।১৯ অথচ তারাই কখনও প্রয়োজনে, কখনও ইন্দ্রিয় তৃপ্তির তাগিদে সৃষ্টি করেছিল তাদের চোখে ঘৃণ্য এই সম্প্রদায়কে। নিজেদের সৃষ্ট একটা প্রজন্মকে তারা দেখত অবিশ্বাসের চোখে।

১৮০০ সালে ক্যাপ্টেন উইলিয়মসন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের কোনও দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগে বিরোধিতা করে মন্তব্য করেন, তাদের নিয়োগের ফলে সম্ভ্রান্ত নেটিভদের কাছ থেকে আদায় করা সম্মান এবং তাদের সঙ্গে যে ব্যবধান রয়েছে, তা ঘুচে যাবে।২০ কিন্তু মজার বিষয় হল, যারা নিজেদের খাঁটি ইংরেজ বলে দাবি করত, মনে করত তাদের শিরা-উপশিরায় শুদ্ধ ইংরেজের বিশুদ্ধ রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে, তারা অনেকেই ছিল তাদের পিতার জারজ সন্তান। ১৭৬৭ সালে কিন্ডারসলি এক চিঠিতে লিখেছিলেন, যারা নিজেদের ফরাসি, ওলন্দাজ বা ইংরেজ বলে দাবি করেন, তারা অনেকেই আদৌ তা নয়।২১

অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়েরা প্রায়শই সুন্দরী ও আকর্ষণীয়া হত। বাবা খাঁটি সায়েব হওয়ায় মেয়ে বেশি গৌরী হত তার দিশি মায়ের থেকে। কলকাতায় তাদের চলিত নাম ছিল চি চি। তাদের আকর্ষণ এত জোরালো চুম্বকীয় ছিল যে, তরুণ সায়েবদের পক্ষে তাদের অবজ্ঞা করা ছিল দুঃসাধ্য। তারা অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে ঘরনির সমস্ত কর্তব্য পালন করত। অথচ শ্বেতাঙ্গ সমাজের সান্নিধ্য ভোগ করতে পারত কেউ কেউ, কদাচিৎ। সায়েবরা দিশি মেয়ের সঙ্গে সংসার বসালেও, মেমদের ক্ষেত্রে বিপরীতটা ছিল প্রায় বিরল। কারণ মেমরা এদিশি কোনও ধনীর সঙ্গে ঘর বাঁধলে তার সমাজে সে জাত হারাত। আর মেম বলে পরিচিত হত না। তা ছাড়া দিশি মেয়েদের প্রতি সায়েবদের মনোভাব তেমন অনমনীয় না হলেও, মেমরা তেমনটি ছিল না। জাত্যভিমান তাদের মধ্যে ছিল পুরুষের থেকে অনেক বেশি।

যেটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, তা হল, ইংরেজরা কখনও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের আপনজন বলে মেনে নিতে পারেনি। দীর্ঘকাল গভর্নমেন্ট হাউসের দরজা তাদের কাছে বন্ধ ছিল। এ ব্যাপারে কঠোর মনোভাব দেখিয়েছিলেন বেশ কয়েকজন গভর্নর জেনারেল। কোনও সায়েব অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়ে বিয়ে করলে শ্বেতাঙ্গ সমাজে সে ব্রাত্য বলে বিবেচিত হত। এমনকী, কখনও কখনও কর্মস্থলে জবাব পর্যন্ত পেয়ে যেত। অথচ Father Doyle বলেন, কিছু ইউরেশিয়ানের গাত্র এতটাই গৌরবর্ণ ছিল যে, খাঁটি ইউরোপীয়দের সঙ্গে তাদের আলাদা করে চেনা যেত না। তাদের প্রতি খাঁটি ইংরেজদের বিদ্বেষ এতটাই প্রবল ছিল যে, কোনও ভিখিরি তেমন কোনও অফিসারের কাছে ভিক্ষে করতে এলে তিনি খানসামাকে বলতেন, ‘ভিখিরি যদি ইউরোপীয় হয়, এক টাকা দাও। হাফকাস্ট হলে আট আনা।’২২

জেমস কার্কপ্যাট্রিক (১৭৬৪-১৮০৫) তার মুসলমান পত্নীর গর্ভজাত সন্তানদের ভবিষ্যৎ ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন। ব্রিটিশ ভারতে ইংরেজদের তীব্র জাতি-বিদ্বেষ দেখে মর্মাহত না হয়ে পারেননি। অথচ সেই সময়, উনিশ শতকের সূচনায়, ব্রিটেনে জাতি-বিদ্বেষ এদেশের ইংরেজদের মতো জমাট বাঁধেনি।

ইংরেজরা কখনও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের গুণের কদর করত না, যদিও অনেকে স্বীকার করেছেন, তাদের মধ্যে অভাব ছিল না অনেক নজর-কাড়া গুণ ও যোগ্যতার। অনেক ইউরেশিয়ানের মধ্যে ছিল বিশিষ্ট ভদ্রলোকের বৈশিষ্ট্য। তাদের যথেষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতা ও রুচিবোধ ছিল। উনিশ শতক থেকে তারা শিক্ষা ও সামাজিক মর্যাদায় ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছিল। অনেকেই শিক্ষা-দীক্ষা, রুচিবোধে বিলেতের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানদের সমকক্ষ ছিল। তার উজ্জ্বল উদাহরণ হিন্দু কলেজের শিক্ষক ডিরোজিও। ব্রিটিশ সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য ব্রিটিশ প্রজার থেকে কোনওভাবেই কম ছিল না। এসব স্বীকার করেও The Calcutta Review তাদের খোঁচা দিতে কসুর করেনি। মন্তব্য করে, কোনও সন্দেহ নেই যে, জন্ম ও শিক্ষা তাদের অনেক গুণ নষ্ট করে দিয়েছে, যেগুলো তারা পৈতৃক সূত্রে পেয়েছিল।২৩ কখনও কখনও অবশ্য দু’-একজন ইংরেজ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের প্রতি শ্বেতাঙ্গ সমাজের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিকে ভর্ৎসনা করেছিল। জনৈক স্কটিশ নীলকর সায়েব বলেন, ‘বর্ণসংকরদের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে একটা অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং জাত্যভিমানের অন্যায়, অযৌক্তিক ধারণা আছে, যা প্রতি পদে তাদের প্রতিবন্ধী করে তুলেছে, তাদের যতই যোগ্যতা থাকুক না কেন। প্রায়ই বলা হয়ে থাকে, হাফকাস্টদের মধ্যে দুটো জাতির বদগুণগুলো শুধু আছে, সদগুণ একটাও নেই। এই ধারণা ভ্রান্ত। সাধারণ অজ্ঞ, অকরুণ মানুষই এমন কথা বলতে পারে।’২৪ বনি স্কটলান্ডের (Bonny Scottland) ছেলে বলেছিলেন, ‘আমি অনেক ইউরেশিয়ান কেরানির নাম করতে পারি, যারা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের কাজকর্মের সামাল দিয়ে থাকে যোগ্যতার সঙ্গে, নিখুঁতভাবে। আমি এমন অনেকের নাম বলতে পারি যারা বিচারপতির হয়ে রায় পর্যন্ত লিখে দেয়।’২৫

কোম্পানির প্রতিটি বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা। ১৭৯৮ সাল নাগাদ কোম্পানি যখন মারাঠা-মহীশূর যুদ্ধে ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়ে, উপায় না দেখে শরণাপন্ন হয় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের। নিজের স্বজাতির ডাক মনে করে তারা লড়াই করেছিল ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগ দিয়ে। অথচ যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে কোম্পানি তাদের ছুড়ে ফেলে দিল চরম অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দিয়ে। ১৮০৮ সালে প্রধান সেনাপতি তাদের জবাব দিলেন।২৬ এইভাবে প্রথম পর্যায়ে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যসৌধ নির্মাণে ইউরেশিয়ানদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও ক্রমশ তাদের প্রান্তিক করা হয় আর্থ-সামাজিকভাবে।

ডিনারের সময় টানাপাখা

১৮১৩ সালে প্রকাশিত দি ইউরোপিয়ান ইন ইন্ডিয়া, ক্যাপ্টেন থোমাস উইলিয়ামসন গ্রন্থ থেকে গৃহীত

ইউরেশিয়ান বা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের সম্পর্কে ধারণাগুলো গড়ে উঠেছিল মূলত, জাতিগত রক্তের সম্পর্ককে ভিত্তি করে। ইউরেশিয়ানদের সম্পর্কে একটা অনড় ধারণা ছিল যে, তাদের শরীরটাই ভারতীয় রক্তে দূষিত। শুধু তাই নয়, খাঁটি ইউরোপীয় সন্তান হয়েও যারা ভারতে জন্মেছে ও লালিত হয়েছে, তাদের সম্পর্কেও প্রায় একই মনোভাব পোষণ করত বিলেতে জন্ম ও লালিত ইংরেজরা, যাদের মা-বাবা দু’জনেই খাঁটি ইংরেজ।২৭ এলিজাবেথ বুয়েটনার (Elizabeth Buettner) অবশ্য মনে করেন, ‘পাক্কা’ ইউরোপীয় এবং ‘Country born’-দের মধ্যে পার্থক্যের মাপকাঠি জন্মস্থান নয়, কোথায় শিক্ষালাভ করেছে সেটাই বড় কথা। দৃষ্টান্ত হিসেবে রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর কথা বলা যেতে পারে। তিনি জন্মেছিলেন বোম্বাইয়ে। তবু তাঁকে ‘Country born’ মনে করে অবজ্ঞা করা হত না, যেহেতু তাঁর মা-বাবা ছিলেন সুপ্রতিষ্ঠিত মধ্যবিত্ত অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান এবং কিপলিং-এর স্কুল জীবন কেটেছিল বিলেতে। গরিব দিশি ইউরোপীয়দের কিন্তু ঠেলে দেওয়া হত ইউরেশিয়ানদের দিকে। তারা বিচ্ছিন্ন ছিল সেইসব সম্ভ্রান্ত-মধ্যবিত্ত শ্বেতাঙ্গ শ্রেণি থেকে যারা তাদের সন্তানদের বিলেতে পাঠিয়ে শিক্ষা দেওয়ার সামর্থ্য রাখত। সুতরাং নিখাদ শ্বেতাঙ্গদের জাতিগত অবস্থান শেষ পর্যন্ত নির্ভর করত শ্রেণি হিসেবে তাদের পটভূমির ওপর, রক্তের সম্পর্কের ওপর নয়।২৮

তবে এটাও সত্যি যে, অনেক কিছু নির্ভর করত গাত্রবর্ণের ওপর। জন পামার তাঁর তিনটে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান নাতনি নিয়ে সমস্যায় পড়ে ওয়ারেন হেস্টিংসকে চিঠি লিখেছিলেন পরামর্শ চেয়ে। প্রথম দুটি ছিল ইউরোপীয়দের মতো গৌরাঙ্গী। তাদের বিলেতে পাঠানো চলত। কিন্তু সমস্যা ছিল ছোটটাকে নিয়ে যার গায়ের রং সন্দেহের আওতায় পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তাকে কী করে বিলেতে পাঠানোর জন্য সুপারিশ করা যায়, সেটাই ছিল দুশ্চিন্তা। বিলেতে অশ্বেতাঙ্গ নেটিভ সন্তানদের প্রতি কী দুর্ব্যবহার করা হয়, সেটা ভেবে পামার শেষ পর্যন্ত ছোটটাকে ভারতে রেখে দেওয়াই সিদ্ধান্ত নেন। তবে উইলিয়ম ডালরিমপিল (William Dalrymple) মনে করেন, বিলেত থেকে ভারতের ইংরেজদের মধ্যে বর্ণবিদ্বেষটা ছিল বেশি পরিমাণে।২৯

উনিশ শতকের প্রথম দশকে কলকাতার ইংরেজরা সিভিলিয়নদের বিধবা ও অনাথ ছেলেমেয়েদের সাহায্যের জন্য একটা তহবিল গড়ে তুলেছিল। প্রবীণ সিভিলিয়নরা চেয়েছিলেন, ওই তহবিল থেকে সায়েবদের অবৈধ সন্তানদেরও অর্থ সাহায্য করা হোক। কিন্তু প্রচেষ্টায় বাদ সাধে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ থেকে পাশ করা নবীন সিভিলিয়নরা। তাঁদের বক্তব্য ছিল, বিলেতে আইন করে বৈধ ও অবৈধ সন্তানদের সুযোগ-সুবিধের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া, অবৈধ সন্তানদের সুযোগ-সুবিধের ব্যবস্থা করলে প্রকৃত মা ও পতিতাদের মধ্যে আর পার্থক্য থাকবে না। হাফ কাস্টের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে যা শ্বেতাঙ্গ সমাজের কলঙ্ক। উৎসাহ পাবে ব্যভিচারিতা, পতিতাবৃত্তি। মধ্যবয়স্ক ইংরেজরাও উপপত্নী লালন করাকে সমর্থন করতে পারেনি। তাদের মনে হয়েছিল, এর ফলে নাগরিক সমাজের চরিত্রের আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।২৯ক আসল কথা, কলকাতার সিভিলিয়নদের ঔরসে দিশি বিবি বা উপপত্নীর গর্ভের সন্তান আর বিলেতে শ্বেতাঙ্গিনীর গর্ভে অবৈধ সন্তানের মধ্যে পার্থক্য খাড়া করতে চেয়েছিল নব্য সিভিলিয়নরা। অবৈধ সন্তান হলেই বা, শ্বেতাঙ্গিনীর গর্ভের সন্তান আর এদিশি কৃষ্ণাঙ্গীর গর্ভের সন্তান কীভাবে সমগোত্রীয় হতে পারে! এটাই ছিল তাদের মূল বক্তব্য।

খুবই কম সংখ্যক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ছিল বিত্তবান ও প্রভাবশালী। বেশির ভাগ ছিল, বিশেষ করে পর্তুগিজ-ভারতীয় সন্তান, অত্যন্ত গরিব। তাদের প্রতি খাঁটি সায়েবদের ঘৃণার আর একটা কারণ ছিল, তারা ধর্মে রোমান ক্যাথলিক। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়েরা চাইত নিজেদের সম্প্রদায়ের কোনও পুরুষকে নয়, খাঁটি সায়েবকে বিয়ে করে কৌলীন্য অর্জন করতে। অ্যাংলো- ইন্ডিয়ান ছেলেরা ছিল বিপরীত। তারা সাহস করত না খাঁটি মেমকে বিয়ে করতে, পাছে পত্নী তাকে ইউরেশিয়ান বলে ঘৃণা করে, এই ভয়ে।৩০ স্যার আলেকজান্ডার আরবুথনট (Alexander Arbuthnot) তাদের এই সাহসের অভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর মনে হয়েছে, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ছেলেদের মধ্যে বড় ত্রুটি হল আত্মবিশ্বাসের অভাব।৩১

সরকারি অবজ্ঞা এবং বিমাতৃসুলভ আচরণ তো ছিলই। কলকাতার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা অবহেলিত ও অপমানিত হত সামাজিকভাবে। উনিশ শতক শেষ হওয়ার আগেই তাদের অবস্থান হয়েছিল অনেক দিক দিয়ে হিন্দু-মুসলমানের নীচে। কোনও কোনও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান চেষ্টা করত নিজেদের ইউরোপীয় বলে চালাতে। অন্যদিকে ইউরোপীয়রা যত গরিবই হোক না কেন, ভীষণভাবে চেষ্টা করত নিজেদের জাতিগত পরিচয় আঁকড়ে থাকতে। একেবারে নিচু স্তরে যারা ছিল, তাদের কাছেও খাঁটি ইউরোপীয়র পরিচয় ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এই ভাবনার জন্য দায়ী ছিল সরকার। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ও ব্রিটিশ সেনার পত্নীদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করেছিল তাদের বাসস্থান, বেতন এবং বিলেতে যাওয়ার ক্ষেত্রে। এমনকী, কিছু অনাথ আশ্রম ছিল শুধুমাত্র খাঁটি সায়েবদের সন্তানদের জন্য।৩২

আঠারো শতকের শেষ দিকে সামরিক ও অসামরিক কর্তৃপক্ষ সেনাদের অনাথ সন্তানদের লালন-পালন ও শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ১৭৮২ সালের আগস্টে বেঙ্গল আর্মির মেজর জেনারেল কার্কপ্যাট্রিক প্রথম অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে একটা তহবিল গড়ার প্রস্তাব দেন। সরকারের অনুমোদন নিয়ে সেজন্য প্রত্যেক অফিসারের বেতন থেকে বাধ্যতামূলকভাবে কেটে নেওয়া হয় একটা অংশ। সাবালটর্নদের দিতে হত মাসে তিন টাকা, ক্যাপ্টেন ও সার্জেনদের ছ’টাকা এবং মেজরদের ন’টাকা।৩৩ ১৭৮৩ সালে অনাথ আশ্রম স্থাপিত হয়। একটার নাম হয় Upper Orphange School, খিদিরপুরে। আর একটা আলিপুরে Lower Orphan School। প্রথমটি ছিল শুধুমাত্র অফিসারদের সন্তানদের জন্য। এগুলোর সঙ্গে স্থাপিত হয় European Female Asylum। এই প্রতিষ্ঠানে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের কোনও স্থান ছিল না। Calcutta Charity School মিশে গিয়েছিল Free School Society-র সঙ্গে। এখানেও অগ্রাধিকার ছিল ‘খাঁটি ইউরোপীয়দের’।৩৪

যতদিন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ছেলের বাবা ভারতে থাকত, ততদিন সে ভোগ করত সুদিন। তার মা ও তাকে রেখে বাবা বিলেতে চলে গেলে শুরু হত দুর্দিন। মা একটা নামমাত্র পেনশন পেত ঠিকই। কিন্তু তার কপালে উপযুক্ত শিক্ষা জুটত না। কোনওরকমে একটা কেরানির চাকরি জোটাতে পারলে বর্তে যেত। তার ওপর শহরে ছিল খাঁটি সায়েবদের অবজ্ঞা, অবহেলা, ঠিক যেমন ছিল হিন্দু ব্রাহ্মণ ও অস্পৃশ্যদের মধ্যে সম্পর্ক। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সন্তানরা পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকার হতে পারত না, যদি বাবার বিবাহিত পত্নীর সন্তান থাকত। নিল এডমোনস্‌টোন (Neil Edmonston) ১৭৮৩ সালে সিভিল সার্ভেন্ট হয়ে ভারতে আসেন। তাঁর বিবির চারটে সন্তান হয় এদেশে। তিনি তাদের স্কটল্যান্ডে পাঠান বোনের কাছে, শিক্ষালাভের জন্য। এডমোনস্‌টোন পরে দেখেন, দু’জন লেখাপড়া শিখে নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সমাজে তাদের অবস্থান একেবারে তলানিতে। কুড়ি বছর পরে তিনি একজন খাঁটি মেমকে বিয়ে করেন। তাঁর গর্ভে যেসব সন্তান হয়, তারাই তাঁর সম্পত্তির অধিকারী হয়।৩৫ কোনও কোনও সায়েব তাদের বিবির গর্ভের সন্তানদের জন্য একটা বিধি-ব্যবস্থা করে গেলেও, অনেকেই সেই সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত ছিল। তাই কলকাতায় তাদের জন্য গড়ে ওঠে অনাথ আশ্রম।

অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের ব্রিটিশ ফৌজে কমিশন দেওয়ার বিরোধিতা করে ১৮৩২ সালে মেজর জেনারেল স্যার জাসপার নিকোলস (Sir Jasper Nicolls) এক অদ্ভুত যুক্তি খাড়া করেছিলেন। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা ফৌজে নিযুক্ত হোক, এটা নাকি নেটিভদের বড় অপছন্দ। নেটিভরা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের ঘৃণা করে, এজন্য সেনাবাহিনীতে তাদের নিয়োগ করা যাবে না।৩৬ হাস্যকর যুক্তি। এমন তথ্য মেলে না যা প্রমাণ করে নেটিভরা কোম্পানির বাহিনীতে কাদের নিয়োগ করা হচ্ছে, তা নিয়ে মাথা ঘামাত বা তাদের সে বিষয়ে অভিমত দেওয়ার অধিকার ছিল। সামরিক বাহিনী কাদের নিয়ে গঠিত হবে সে ব্যাপারে সামরিক কর্তা এবং পরিচালক সমিতির নির্দেশ ছিল শেষ কথা। বলা হত, হিন্দু ভদ্রলোকরা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের বিদেশির ঔরসে জন্ম বলে ঘৃণা করত না, তাদের আপত্তি ছিল অসবর্ণের বিয়েতে। বিখ্যাত অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান নেতা জন উইলিয়ম রিকেটস (John William Ricketts) একথা অস্বীকার করেছিলেন যে, নেটিভরা ইউরেশিয়ানদের ঘৃণা করে।৩৭

অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের প্রতি শাসক জাতির অবজ্ঞা এবং অসম্মান তারা মেনে নিতে পারেনি। কলকাতার সম্ভ্রান্ত অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের নিয়ে গঠিত হয় East India Committee। এই কমিটি ১৮২৯ সালে জন রিকেটসকে বিলেতের পার্লামেন্টে পাঠায় এক স্মারকলিপি দিয়ে।৩৮

সম্ভবত ডিরোজিও ছিলেন এই স্মারকলিপির অন্যতম রচয়িতা। এরপরই ১৮৩৩ সালে সনদ আইনে ব্রিটিশ সরকার কিছুটা উদারতা দেখিয়ে কোম্পানির সমস্ত চাকরি সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয় জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে। তথাপি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের অবস্থার খুব একটা হেরফের হয়নি। উঁচু পদগুলো খাঁটি ইংরেজ ছাড়া বাকি সকলের নাগালের বাইরে থেকে যায়। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন চার্লস মেটকাফের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পত্নীর পুত্র জেমস মেটকাফ।

চার্লস মেটকাফ ১৮৩৫-৩৬-এ ভারতের অস্থায়ী গভর্নর জেনারেল ছিলেন। বাবার কৃতিত্বের সুবাদে জেমস ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার সুযোগ পান ওপর মহলের সঙ্গে। এর ফলেই লর্ড ডালহৌসি তাঁকে aids-de-camp পদে নিয়োগ করেন।৩৯

১৮৫৩ সালে সনদ আবার নবীকরণের সময় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা অভিযোগ তোলে, বিগত কুড়ি বছরে তাদের অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে সামান্য। প্রভাবশালী শ্রেণি ও অধস্তনদের মধ্যে এক বিরাট পার্থক্য রয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রেই অভিজ্ঞ ও দক্ষ অধস্তনকে অনভিজ্ঞ কভন্যানটেডের হুকুম তালিম করতে হয়। সরকারি সাক্ষ্যই প্রমাণ করে, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা সম্মান পায় না। সিভিলিয়নদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন চার্লস ট্রেভেলিয়ন। একজন খাঁটি সায়েব, মেকলের ভগ্নিপতি। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের সম্পর্কে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যদের অশিষ্ট এবং অবজ্ঞাসূচক ভাষা প্রয়োগের প্রতিবাদে বলেন, তিনি তাদের মধ্যে নেটিভ ও ইংরেজদের সদগুণগুলোই দেখেন। তাদের প্রশংসায় বলেন, ‘With the amiability and quickness and tact of the Natives of India, they unite a great deal of the energy and high moral qualities of Europeans.৪০ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের নিয়ে বিতর্ক হয় লর্ড এলেনবরো ও ট্রেভেলিয়নের মধ্যে। এলেনবরো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের দুর্বল শারীরিক কাঠামোকে তাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য বলে উল্লেখ করে প্রশ্ন তোলেন, ‘দৈহিক শক্তিতে তারা কি নেটিভদের থেকে নিকৃষ্ট নয়?’ উত্তরে ট্রেভেলিয়ন জানান, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে ইংরেজদের মতোই আকার ও চেহারায় রকমফের আছে। যদি তারা ভারতীয় কৃষকদের মতো দৈহিক শক্তির অধিকারী না হয়ে থাকে, তবে সেটা ইংরেজদের ক্ষেত্রেও প্রয়োজ্য।৪১

কলকাতার জনসমাজে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা ছিল অনেকটা ত্রিশঙ্কু অবস্থায়। তারা না ছিল শাসকজাতির পরিচয়বাহী, না ভারতীয়দের। উভয় জাতির কাছে তারা ছিল এক ধরনের আপদ বিশেষ। বাঙালিদের কাছে তারা ফিরিঙ্গি, ইংরেজদের চোখে হাফকাস্ট। খ্রিস্টান হওয়ার জন্য হিন্দু-মুসলমানের দেওয়ানি আইন বর্তাত না তাদের ক্ষেত্রে। আবার খাঁটি ইংরেজের চোখে অবৈধ সন্তান হিসেবে কলঙ্কিত হওয়ায়, তারা বঞ্চিত ছিল ব্রিটিশ প্রজার প্রাপ্য সুবিধেগুলো থেকে। তাদের সম্পর্কে কলকাতার বাঙালিদের মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে ঈশ্বর গুপ্তের কবিতায়—

“চূণাগরি অধিবাস খোলার আলয়।

তাহাতেই কতরূপ আড়ম্বর হয়॥

ছাড়েন বাঙ্গালী দেখি বিলাতের বুলি।

‘লিচু খাও কেলাম্যান নেটিব বেঙালী’॥”৪২

তাদের সম্পর্কে বাঙালির মুখে ‘ফিরিঙ্গি’, ‘ট্যাস’ প্রভৃতি উচ্চারিত শব্দগুলো গালি-গালাজের নামান্তর। তবে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের প্রতি ভারতীয় ও ইংরেজদের এই অনুদার দৃষ্টির জন্য তারাও দায়ী ছিল যথেষ্ট। তাদের মানসলোক ছিল দ্বিখণ্ডিত। একদিকে তারা নিজেদের কখনও ভারতীয় বলে ভাবতে পারেনি, নিজেদের পরিচয় দিয়েছে Citizen of India বলে, অন্যদিকে নিজেদের রক্তে খাঁটি ইংরেজের রক্ত থাকার অহমিকায় জীবনচর্যায় বজায় রেখেছে বিলিতি সমাজের আদব-কায়দা, বেশভূষা, খাদ্যাভ্যাস, ঘরে-বাইরের বুলিতে ইংরেজি ভাষা। ফলে তাদের অবস্থা হয়ে উঠেছিল ময়ূরপুচ্ছধারী দাঁড়কাকের মতো। ইংরেজ বা ভারতীয় কোনও সমাজে ঠাঁই হয়নি তাদের। একটা প্রশ্ন প্রাসঙ্গিকভাবে উঠে আসে। হিন্দুকলেজের তরুণ ইউরেশিয়ান শিক্ষক ডিরোজিওর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিল কলকাতার রক্ষণশীল বাবুরা। ডিরোজিওর বিরুদ্ধাচরণ করার পেছনে তাদের ‘ফিরিঙ্গি-ঘৃণা’র কোনও ভূমিকা ছিল কি? অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের সম্পর্কে বাঙালির বিদ্বেষ এমন একটা সন্দেহ সৃষ্টি করে।

কিন্তু বাঙালির পক্ষে কলকাতার ইউরেশিয়ান বা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। উনিশ শতকের বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ডিরোজিওকে বাদ দিয়ে রচিত হতে পারে না। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়েরা ছিল নারীমুক্তি আন্দোলনের অগ্রদূতী। তারা বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত হয়ে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করেছিল কলকাতার নারী সমাজে। উনিশ শতকে কলকাতার অনেক ধনী প্রগতিশীল পরিবারের অন্দরমহলে প্রবেশ করে তাঁরা লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন বাঙালি মেয়েদের। বস্তুত, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সমাজের দুর্গতির মূলে ছিল ব্রিটিশের নীতি। পরিচালক সমিতির স্বার্থ এবং ঔপনিবেশিক শাসক হিসেবে কোম্পানির স্বার্থ— দুই-এ মিলে মানবিক ও নৈতিক দাবি থেকে বঞ্চিত করেছিল অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের। ফলে আধা-সায়েবের পরিচয় নিয়ে থেকে গিয়েছিল ভারতীয় সমাজে প্রান্তিক হয়ে।

সূত্রনির্দেশ

১. Suresh Chandra Ghosh, The Social Condition of British Community in Bengal, 1757-1800 Leidn (1970), p. 57.

২. V. R. Gaikwad, The Anglo-Indians, Bombay (1933) p. 15.

৩. তদেব, p. 16

৪. তদেব; Suresh Chandra Gosh, p. 76.

৫. Suresh Chandra Ghosh, তদেব।

৬. The Calcutta Review, vol, 72, 1881, p. 40.

৭. Suresh Chandra Ghosh, p. 75.

৮. T. R. Barret, Calcutta— Strange Memoirs— Foreign Perception, Kolkata (2014), p. 231.

৯. Amicus, The Neglected Christian Poor of Calcutta, (তারিখ নেই), p.1

১০. তদেব, p. 2.

১০ক. Sisir Kumar Das, Sahibs and Munshis, Calcutta (1978) p. 36.

১১. V. R. Gaikwad, প্রাগুক্ত, p.20.

১২. তদেব, pp. 20-21.

১৩. Harald Fischer— Tine, Low and Licentiou Europeans, প্রাগুক্ত, p. 71.

১৪. V. R. Gaikwad, p. 21.

১৫. Suresh Chandra Ghosh, প্রাগুক্ত, p. 88.

১৬. তদেব।

১৭. তদেব, p. 90.

১৮. Harald Fischer—Tine, প্রাগুক্ত, p. 72.

১৮ক. William Dalrymple, White Mughals, প্রাগুক্ত, p. 51

১৯. T. R. Barret. প্রাগুক্ত, p. 236.

২০. তদেব,

২১. তদেব, p. 242.

২২. The Calcutta Review, vol. CXXI, July 1905, p. 382.

২৩. তদেব, vol. 72, 1881, p. 40.

২৪. তদেব, vol. CXXI, July 1905, p. 382.

২৫. তদেব, p. 390.

২৬. V. R. Gaikwad, প্রাগুক্ত, p. 23.

২৭. Harald Fisher— Tine, প্রাগুক্ত, p. 73.

২৮. তদেব, p. 74.

২৯. William Dalrymple, প্রাগুক্ত, p. 51, Fn.

২৯ক. The Asiatic Annual Register, London (1806) pp. 44-47.

৩০. The Asiatic Journal, New Series, vol. 15, 1834, p. 60.

৩১. The Calcutta Review, vol. 72, 1881, p. 38.

৩২. David Arnold, European Orphan and Vagrant in India in the Nineteenth Century. (The Journal of Imperial and Commanwealth History, January, 1979, vol. vii, No 2, p. 106.)

৩৩. Percival Spear, প্রাগুক্ত, p. 64.

৩৪. David Arnold, প্রাগুক্ত, p. 108.

৩৫. E. M. Collingham, প্রাগুক্ত, p. 75.

৩৬. Kenneth Ballhatchet, Race, Sex and Class Under Raj, London (1980), p. 98.

৩৭. তদেব।

৩৮. তদেব, p. 97.

৩৯. তদেব, p. 99.

৪০. তদেব, p. 100.

৪১. তদেব।

৪২. শ্রীপান্থের ‘ঐতিহাসিক অনৈতিহাসিক’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত, কলকাতা (২০১৫) পৃ. ৭৪-৭৫।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *