তৃতীয় খণ্ড (স্নেহের চুমকিকে)
3 of 6

কলকাতায় চিত্রগুপ্ত

কলকাতায় চিত্রগুপ্ত

চারজন যমদূত আমাকে টানতে-টানতে চিত্রগুপ্তের দপ্তরে নিয়ে গেল। আমার মতো সামান্য একজন মানুষের জন্যে চার-চারজন যমদূত। টু মাচ। যমরাজের ‘দূত পাওয়ার’ খুব বেশি।

আপনাদের মাইনে কত?

মাইনে? যমালয়ে তো টাকা বা ডলারের চল নেই। ওকানকার সিস্টেমটাই অন্য। গেলেই বুঝতে পারবে, ছোকরা।

তা একবারে চারজন কেন? একজনই তো যথেষ্ট ছিল।

না হে, না। যমরাজের নির্দেশ, মৃত ব্যক্তি যদি চাকুরিজীবী বাঙালি মধ্যবিত্ত হয়, আবার তার যদি ডিসেন্ট্রি, ডায়েরিয়া কি ডিসপেপসিয়া থাকে, তাহলে চারজন কেন, আটজন দূতও আসতে পারে। সে ব্যক্তি অতি বিপজ্জনক, ভেরি ভেরি ভেরি ডেনজারাস। আমাদের কাজের কৈফিয়ত কি তোমাকে দিতে হবে?

কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পিঠে এক-ঘা ডাঙ্গশ।

মারলেন কেন, স্যার। আপনারা কি পাঠশালার পণ্ডিত ছিলেন, কিংবা পুলিশ।

না, আমরা পশ্চিম বাংলার কলকাতাতেই ছিলুম, ডাক্তার। মরে যমদূত হয়েছি। ও ছিল ই এন টি স্পেস্যালিস্ট। এ ছিল আই স্পেস্যালিস্ট, ও ছিল গাইনি, আমি হার্ট।

আবার এক-ঘা ডাঙ্গশ।

শুনে রাখো, ছোকরা, যতবার প্রশ্ন ততবার ডাঙ্গশ। আমরা প্রত্যেকেই এক-একজন জাঁদরেল ডাক্তার ছিলুম। রুগিদের কোনও ফালতু প্রশ্নের জবাব দিতুম না। প্রেসক্রিপশান ঠুকেই পকেটে টাকা পুরতুম। যমদূত বলে হেঁজিপেঁজি ভেবো না।

প্রশ্ন করলেই ডাঙ্গশ, তবু প্রশ্ন না করে থাকা যায়? একে বাঙালি, তায় কলকাতার লোক, তার ওপর সরকারি চাকরে ছিলুম। ত্র্যহস্পর্শ যোগ। সারা জীবন বকবক, পরচর্চা, ব্ল্যাফ, এই করেই তো কেটেছে। অন্যের ব্যাপারে নাক গলিয়ে-গলিয়ে নাকটি তো ভোঁতা মেরে গেছে। ডাঙ্গশেই বা আমাকে কতটা কাবু করতে পারে। কলকাতার বাসে-ট্রামে নিত্য পঁচিশ বছর বাড়ি বিবাদিবাগ, বিবাদিবাগ-বাড়ি করে করে শরীরের স্পর্শকাতরতা নষ্ট হয়ে গেছে।

স্যার-মাস্তান মরে কী হয়?

ছারপোকা।

আচ্ছা, মন্ত্রী মরে কী হয়?

শুঁয়াপোকা।

ব্যাবসাদার মরে।

ডগ ইন দ্য ম্যাঞ্জার।

কেরানি মরে?

উইপোকা।

আমাকে তা হলে উইপোকা হতে হবে?

হতে হবে, তার আগে নরকের টার্মসটা শেষ করতে হবে।

আর-একটা প্রশ্ন, স্যার, বউ মরে কী হয়?

পরস্ত্রী।

ও, আপনাদের বেশ সুন্দর নিয়ম তো।

হ্যাঁ, সুন্দর নিয়ম। স্বভাব আর প্রবণতা অনুসারে পুনর্জন্ম।

চিত্রগুপ্ত মানুষটি বেশ শান্তশিষ্ট। তাঁর সেক্রেটারিয়েটটিও বেশ বড়। এলাহি ব্যবস্থা। হবেই তো। সারা পৃথিবীর প্রেত নিয়ে কারবার। ক্রিকেটের স্কোর বোর্ডের মতো দেওয়ালজোড়া বোর্ড। মৃত্যুর সংখ্যা ভেসে-ভেসে উঠছে। বিভিন্ন দেশ, বিভিন্ন ধরনের মৃত্যু। ভুগে মরা, চাপা পড়ে মৃত্যু। প্রাণদণ্ডে মৃত্যু, পুড়ে মৃত্যু, বাড়ি ধসে মৃত্যু, খুন, আত্মহত্যা, জলে ডুবে মৃত্যু, অনাহারে মৃত্যু, ভুরিভোজে মৃত্যু, রাজনৈতিক মৃত্যু, নরবলি, ধর্মীয় মৃত্যু, অনশনে মৃত্যু। এত মৃত্যুর মধ্যে বসেও কেমন হাসি-হাসি মুখ।

আমি দপ্তরে ঢুকতেই টেবিলের ওপর একটা ফাইল তিড়িং-বিড়িং করে নেচে উঠল। আমার কেস-হিসট্রি। চিত্রগুপ্ত একটা স্লিপে খসখস করে লিখলেন, বাহাত্তর বছর নরক বাস।

যাও, নিয়ে যাও।

বাহাত্তর লেখা একটা পদক যমদূতের হাতে দিয়ে বললেন, পেছনে এক লাথি মেরে নরকে ফেলে দাও।

প্রভু, ঠান্ডা নরক, না গরম নরক?

ফুটন্ত নরক।

আমার কিছু বলার ছিল, স্যার।

বলে ফ্যালো।

আজ্ঞে, আমি কলকাতার লোক। ইংরেজের কলকাতা নয়, স্বাধীন ভারতের কলকাতা।

জানি।

তাহলে জেনেশুনে আমাকে আবার নরকে পাঠাবেন কেন? এটা কি ন্যায়বিচার হচ্ছে? আমার নরকবাস তো হয়েই গেছে। আপনার নরকের মডেল আমার জানা নেই। মিলটন সায়েবের প্যারাউইস লস্টে পড়েছি আর ফিলিমে দু-একবার দেখেছি। কিন্তু কলকাতা! যাবেন নাকি একবার। অমন একটা সুপরিকল্পিত নরক আপনার কল্পনা, আপনার প্ল্যানিং -এর কান কেটে দেবে।

চিত্রগুপ্ত কাছে দেখার চশমা খুলে, দূরে দেখার চশমা পরে আমার দিকে তাকালেন।

যাবেন নাকি, স্যার? ওই নরকে যদি একবছর থাকতে পারেন আমি সারা প্রেতজীবন আপনার গোলাম হয়ে থাকব। আমি ষাটটা বছর ওখানে কাটিয়ে এলুম। আপনি আমাকে নরকের ভয় দেখচ্ছেন স্যার। আপনারটা তো লোক্যালাইজড, ফিলমি নরক, কলকাতা হল রিয়েল নরক, বিশাল তার বিস্তার, আকৃতিতে বিকৃতিতে সে নরক দিন-দিন আদর্শ নরকের চেহারা নিচ্ছে। নরকের ভয় কী দেখাচ্ছ, প্রভু।

বেশ, তুমি মিথ্যে বলছ কী সত্য বলছ, দেখার জন্যে আমি যাব। এই কে আছিস—আমার ‘ডিসি টেনে’ তেল ভর। ওভাবে গেলে হবে না গুরু। বিমান থেকে সব জায়গাই একরকম দেখতে, কলকাতা আর স্কটল্যান্ডের কোনও তফাত নেই। ছবিতে সব সুন্দর।

তুমি কী বললে, ‘গুরু’?

আজ্ঞে হ্যাঁ, ওটা ফুটবলের ভাষা।

সেটা আবার কী?

আপনি গেলেই বুঝতে পারবেন। কলকাতায় একদল নাগরিক তৈরি হয়েছেন, এতখানি এতখানি ঝাঁকড়া-ঝাঁকড়া চুল, লতপতে প্যান্ট, বুকের বোতাম খোলা, কাঁধে পতাকা, যাঁদের আপনি শুধু ময়দানে খেলা দেখার এবং খেলার শেষে তাঁদের নিজস্ব খেলা দেখানোর জন্যে ছেড়ে রেখেছেন। শেষ খেলাটাই বড় খেলা। আপনার যমদূতেরাও এইসব ক্রীড়ারসিকদের কাছে ছেলেমানুষ।

কীভাবে তাহলে যেতে হবে!

আপনি আর আমি সোজা ময়দানে ল্যান্ড করব, তারপর জনারণ্যে মিশে গিয়ে আমি এতকাল যা-যা করে এসেছি, তার গোটাকতক আপনাকে করে দেখতে বলব। যদি পারেন, আপনাকে আমি বাহাদুর চিত্রগুপ্ত উপাধি দেব, যদি না পারেন বলব, ল্যাদাড়ুস চিত্রগুপ্ত।

তোমার তো তাহলে একটা শরীর চাই।

আবার শরীর! কলকাতায় আমি কোনও শরীর নিয়ে ঘুরতে চাই না। অশরীরীর হাওয়া হয়ে আপনার পকেটে-পকেটে থাকব। তাইতেই আমার মোক্ষলাভ হবে।

মোক্ষলাভ?

আজ্ঞে হ্যাঁ। শরীরটা হার্ট-অ্যাটাকে গেছে, আত্মার বাতাসটা পলিউসানেই শেষ হয়ে যাবে। ডিজেল আর পেট্রলের ধোঁয়া, ধুলো, ইনডাসট্রিয়াল ফিউমস ভূগর্ভস্থ নর্দমা, জমে-থাকা জঞ্জালের পচা বিষবাষ্পে ফিনিশ।

চলো, তা হলে।

হে মহানগরী! আবার ফিরে এলাম। আমি এখন ভূত, এই নিরীহ চেহারার মানুষটি হল প্রেত-লোকের বড়বাবু, চিত্রগুপ্ত।

সময় বিকেল ছ’টা। স্থান, ধর্মতলার চৌমাথা। বার, অফিসবার। দৃশ্য, আকাশে কাল মেঘ, কয়েক পশলা হয়ে গেছে, আবার আসছে।

চিত্রগুপ্ত : বা-ব্বা! গিজগিজ করছে লোক। মৃত্যু দেখছি ফেল করেছে। এত মেরেও শেষ করতে পারছি না।

ভূত : আজ্ঞে, এঁরা মরণজয়ী কলকাতাবাসী।

চিত্রগুপ্ত : আমি দাঁড়াব কোথায়। অনবরত গোঁত্তা মেরে চিৎপাত করে দিতে চাইছে।

ভূত : এইভাবেই দাঁড়াতে হবে, প্রভু। পাতালরেলের টিনের বেড়ায় পিঠটা ঠেকিয়ে রাখুন। মনে রাখবেন, বেঁচে ফিরতে হবে।

চিত্রগুপ্ত : এখানে দাঁড়াব কেন?

ভূত : যখন মানুষ ছিলাম তখন রোজ এইখান থেকে বাস ধরে উত্তর কলকাতায় যাওয়ার চেষ্টা করতাম।

দৃশ্য।। বিশাল একটা মিছিল ফেস্টুন-মেস্টুন নিয়ে মনুমেন্টের দিকে চলেছে। শ্লোক গান—রুখবই রুখব, রুখবই রুখব। উলটোদিকে মিছিলের মতোই ছাড়াছাড়া একটা দল হল্লা করতে-করতে চলেছে। ঘূর্ণিঝড় যে পথে যায় সব ভেঙ্গেচুরে রেখে যায়। পতাকার লাঠি দিয়ে বাসের পেছনে, মোটরগাড়ির চালে, কাচে ধড়াম ধড়াম করে মারছে। বৃদ্ধ মানুষের চোখ থেকে চশমা খুলে নিচ্ছে। গাড়ির পেছনের আসনে বসে থাকা মহিলার ঝুঁটি নেড়ে দিচ্ছে। হে রে রে। এদের উল্লাসের চিৎকার। মিছিলের রুখবই রুখব। সব দিকের বাস বন্ধ। নিরীহ পথচারী ত্রস্ত। দোতলা বাসের একতলার জানালায় পা রেখে কিছু যুবক দোতলায় উঠে ড্যাং ড্যাং করে ঝুলছে। ট্রামের ওভারহেড ট্রলি ধরে কয়েকজন। সামনে ঝুঁকে পড়ে মাঝে-মাঝে বিকট চিৎকার ছাড়ছে। ফটাফট, চটাপট, শব্দ, শব্দ আর শব্দ।

চিত্রগুপ্ত : আমার বুকের ভেতরটা কেমন করছে। এরা কারা? কী হচ্ছে! কী হবে!

ভূত : ধীরে, প্রভু ধীরে। খেলা ভেঙেছে, মিছিল চলেছে।

চিত্রগুপ্ত : খেলা ভাঙা মানেই কি সব ভেঙেচুরে তছনছ করা!

ভূত : আনন্দ, উল্লাস। যৌবন জলতরঙ্গ রোধিবে কে?

চিত্রগুপ্ত : মারা পড়বে যে। ট্রামের ট্রলিতে হাই ভোল্টেজ চলেছে, শক খেয়ে মরবে যে! দোতলা বাসের জানালা থেকে চিৎপাত হলেই মার কোল খালি!

ভূত : আপনার মৃত্যু এদের কাছে ম্লান। মরণরে তুঁহু মম শ্যাম সমান। মরবে এরা, যারা রুখবই রুখব-র মিছিলে নেই, ময়দানের খেলা ভাঙার হুল্লোড়ে নেই।

চিত্রগুপ্ত : না:, যমরাজকে বলতেই হবে, মহারাজ আপনার মৃত্যুর দাঁতের ধার কমে গেছে।

দৃশ্য ।। সার-সার দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ-ঠাসা বিভিন্ন মাপের বাসের ভেতর থেকে আর্তনাদ গোঙানির শব্দ। অ্যাই কনডাকটার, চালাও না, বাপ। কী করে চালাব ছেলে, সামনে মিছিল, খেলা ভেঙেছে। বাসের ভেতর থেকে বৃদ্ধের আর্তনাদ আর করব না, ওরে বাপ, আর করব না, আমাকে নামিয়ে দাও। ধ্যার মশাই, নামবেন কী করে। মরতে হয়, এখানেই মরুন, টার্মিনাসে গিয়ে মাল খালাস করে নেবে। উদভ্রান্ত চেহারার এক ভদ্রলোক চিত্রগুপ্তকে এসে বলছেন—কী করে একটা ট্যাকসি পাই, বলুন তো। ওই দেখুন আমার স্ত্রী রাস্তার ওপর বসে পড়েছে। ভীষণ অসুস্থ। অন্ধকার উত্তর দিল, ট্যাকসি কোথায় পাবেন, নিউমার্কেট থেকে একটা ঝাঁকামুটে ভাড়া করে আনুন। ট্যাকসি পাবেন না, খেলোয়াড়দের ভয়ে রাত আটটার আগে কোনও বাস এ তল্লাটে আসবে না। রাত ন’টার আগে জ্যামও খুলবে না। আবার বৃষ্টি শুরু হল।

চিত্রগুপ্ত : ওই যারা রুখবই রুখব করছে, কী রুখতে চাইছে।

ভূত : প্রথমে চক্রান্ত রুখবে, তারপর লোডশেডিং রুখবে, আসলে যানবাহন রুখেছে।

চিত্রগুপ্ত : কীসের চক্রান্ত, কার চক্রান্ত! বিদেশি চক্রান্ত নাকি?

ভূত : না স্যার, দেশি চক্রান্ত। যখন যে দল পাওয়ারে আসে তারাই অফিস ছুটির পর রোজ একটা করে মিছিল বের করে। প্রতিটি ক্ষমতাসীন দলেরই ধারণা, বিদায়ী দল, সংবাদপত্র, ব্যাবসাদার মিলে, ঘোরতর একটা চক্রান্ত করে ন্যাজেগোবরে করার তালে আছে।

চিত্রগুপ্ত : ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে গাত্রে হল ব্যথা।

দৃশ্য ।। জোর বৃষ্টি। কেরানি-ভেজানো বৃষ্টি। যে যে দিকে পারছে, ছুটছে। একজন ছুটন্ত আর একজনের চটি পেছন দিক থেকে চেপে ধরেছেন, তিনি হুমড়ি খেয়ে ছিটকে পড়লেন, পাশ দিয়ে যিনি ছুটছিলেন তিনি অভ্যাসবশে বলে গেলেন—সরি। চিত্রগুপ্ত ছুটছেন গাড়ি বারান্দার তলায় আশ্রয় নেওয়ার জন্যে। কোথায় আশ্রয়? সেখানেও শক্তির লড়াই চলেছে। সবল দুর্বলকে টপকে, ধাক্কা মেরে, মাড়িয়ে জায়গা দখল করছে। ঠেলতে-ঠেলতে হয় খোলা রাস্তায় নামিয়ে দিচ্ছে, নয়তো দেওয়ালে পিষে পুঁটকি পেঁট করে ছাড়ছে। অহঙ্কারী গাড়ি দুপাশে জল-কাদার ফোয়ারা তুলে হু কেয়ারস হুম ভাবে ছুটছে।

চিত্রগুপ্ত ধপাস। আমার কী? আমি তো মরে ভূত হয়ে সঙ্গে-সঙ্গে ঘুরছি। বাতাসের মতো, আকাশের মতো।

ভূত : কী হল, প্রভু?

চিত্রগুপ্ত : সিলিপ করে পড়ে গেলুম না পেছন থেকে ল্যাং মারলে বুঝতে পারছি না। কোথায় পড়লুম বলো তো?

ভূত : আজ্ঞে ফুটপাথে।

চিত্রগুপ্ত : এর নাম ফুটপাথ?

ভূত : কলকাতার ফুটপাথ, প্রভু। সিঙ্গাপুর কি হংকং-এর নয়। এর চেয়ে জঘন্য ফুটপাত আপনি পাবেন?

চিত্রগুপ্ত : সারায় না কেন?

ভূত : কে সারাবে, কেন সারাবে, কাদের জন্যে সারাবে। সারালেই বেদখল, গোটাকতক প্রদেশের মানুষে-মানুষে মারদাঙ্গা। ভাগের মা গঙ্গা পায় না, স্যার। নিন উঠে পড়ুন। এই তো সবে শুরু। এই অঞ্চলটা তো নরকের ঠোঁট। আসল গহ্বরে তো এইবার ঢুকতে হবে।

।। দুই ।।

ভেনিস হওয়ার সব গুণই কলকাতার ছিল। ইংরেজরা ভুল করেছিলেন। জাতের দোষ। ইংরেজরা যেখানে-যেখানে কলোনি করতে গেছেন, সেইখানেই একটা করে ইংল্যান্ড বানাবার চেষ্টা। কলকাতার মাঝখানটা ছিল লন্ডন, উত্তরটা হারলেম, দক্ষিণটা জেরুজালেম। অথচ কত সহজেই আজ আমরা এই শহরটাকে ভেনিস করে খেলতে পারি। নতুন করে লিখতে পারি মহান একটি উপন্যাস—ডেথ ইন ভেনিস।

 দেখতে-দেখতে জল জমে রাস্তাঘাট বেপাত্তা হয়ে বেশ একটা ভরাট-ভরাট উদার-উদার চেহারা তৈরি হল। ভূত আমি আর চিত্রগুপ্ত কোনওরকমে ভিকটোরিয়া হাউসের ফুটপাথে এসে দাঁড়ালাম। স্বর্গের বৃদ্ধ মর্তের নরকে এসে এরই মধ্যে বেশ কাবু হয়ে পড়েছেন। আগেই চিনিয়ে রাখলুম, স্যার, এই স্থানটি আঁধারে ঘেরা, কারুর-কারুর পক্ষে অতিশয় নিরাপদ, আলোর উৎপাত নেই। প্রদীপের নীচেই অন্ধকার, কত সত্য দেখুন। এই গৃহ হইতেই বিদ্যুতের বিলবিল, না একটা বিল, মেশিন মেড হয়ে দিকে-দিকে বিদ্যুৎহীন বাড়িতে প্রবেশ করে। গেরস্থের চক্ষু ছানাবড়া হয়। সেই ছানাবড়া চোখের সামনে নৃত্য করে ওঠে মোলায়েম বিজ্ঞাপন—হে পুরবাসী! শোনো বিদ্যুতের সমাচার। বিলে টাকার অঙ্ক দেখে ঝম্প মেরুনি, আলোর যেমন মূল্য আছে অন্ধকারও কিছু ফেলনা নয়। অন্ধকার আছে বলেই আলোর এত দাম। অন্ধকার আলোর জননী এসো জেনে বিলটি দিয়ে যাও, নইলেই কেঁচি।

চিত্রগুপ্ত : এখানে দাঁড়ালে কেন?

ভূত : মজা দেহেন না। সারা দিন এই মানুষগুলো অফিসে, সেরেস্তায়, কলে কারখানায়, দালালদের অফিসে খেটে মরেছে। এইবার বাড়ি যাওয়ার আশায় আঁকুপাঁকু করছে। সেখানে বউ আছে, মা আছেন, ছেলে আছে, পিলে আছে, বেকার ভাই আছে। একচিলতে ঘর আছে। নড়বড়ে খাট আছে, ছোবড়া-বেরোন গদির ওপর চোদ্দো টাকা দামের সেল থেকে কেনা একসপোর্ট কোয়ালিটির বেডকভার আছে। শুকনো রুটি আছে, সকালের তৈরি গেঁজে-ওঠা তরকারি আছে। হিসেবের খাতা আছে। আয়ের ঘরে তিন ফিগার ব্যয়ের ঘরে চার ফিগারের ইনসমনিয়া আছে। তবু সেই সুইট হোমে যেতেই হবে।

চিত্রগুপ্ত : ভূত হলে কি বেশি বকতে হবে? যেতে হবে যাবে। তার জন্যে তোমার অত ভাবনা কেন?

ভূত : কেমনে যাবে।

চিত্র : হেঁটে-হেঁটে যাবে। খপাত-খপাত করতে-করতে। জলে হাঁটার আনন্দ জান না! ভুলে গেলে নাকি শৈশবের অভ্যাস। এরা সব শিশুর মতো খলবলিয়ে মাছের মতো খলখলিয়ে ফিরে যাবে আপন ঘরে।

ভূত : এই জলের একটা অ্যানালিটিক্যাল রিপোর্ট আপনাকে দি। এই পদার্থ তরল একটি ডিজিজ কালচার। এতে টাইফয়েড, লেপরসি, কলেরা, একজিমা, পোলিও, এনকেফেলাটিস, জন্ডিস ইত্যাদি যাবতীয় প্রাণী মিলেমিশে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। এই প্রবাহ—পথ ছেড়ে ঘরে ঢুকেও বসে আছে। এ তো আপনার মন্দাকিনীর প্রবাহ নয়। জলে পা দেবার আগে তাই কিঞ্চিৎ ইতস্তত। তা ছাড়া…আচ্ছা নিজেই হেঁটে দেখুন। দেখতেই তো এসেছেন।

আকাশের মেঘের আলো নীচের দিকে প্রেতলোকের আলোর মতো নেমে এসেছে। চতুর্দিকে কালো জলের ঢেউ ভাঙার শব্দ। চারপাশে নিরেট, নিথর ভূতুড়ে বাড়ি। অসংখ্য কালো-কালো মাথা ভেসে-ভেসে বেড়াচ্ছে। হেহে করে হেসে উঠলুম।

চিত্রগুপ্ত : হাসছ কেন? জানো তোমার দেহ নেই। দেহহীনে ভূতের হাসি শুনে আমিই চমকে উঠেছিলুম।

ভূত : দুটো কারণে হাসলুম, মহাজন। এক, ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে। এক সময় আমাকেও এই ভাবে হা বাস, হা ট্রাম, হা বাড়ি করে নিত্য নাচানাচি করতে হত। আজ আর সে দুশ্চিন্তা নেই। আবার যখন এই গোবর ঈশ্বরের গোশালায় পড়ে ঘুঁটে হয়ে পৃথিবীর ফারনেসে নেমে আসবে তখন আর হাসব না, ভেউভেউ করে কাঁদব। হাসির দ্বিতীয় কারণ, ডোবায় ব্যাং ভাসে আর গ্যাঙোর গ্যাঙোর করে ডাকে। প্রভু। এদের কণ্ঠে এমনি কোনও স্বতোৎসারী জীবনের ডাক জুড়ে দাও না।

চিত্রগুপ্ত : তাহলে কী হবে!

ভূত : এই ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক হাঁটু ময়লা জলে দাঁড়িয়ে থাকার উদ্বেগ আর ক্লেশ কত কমে যেত। সবাই কোরাসে ডাকছে, কোলা ডাকছে, সোনা ডাকছে, কুনো ডাকছে। ডাকছে তো ডাকছেই। নাম সংকীর্তনে কেবল একটা মাতোয়ারা ভাব আসে, দৈহিক ক্লেশ আর কাবু করতে পারে না। তা ছাড়া এইরকম একটা সাইড ডায়ালগ কেমন লাগবে?

রমা : বিপ্লব, তুমি কি কলকাতা থেকে আসছ?

বিপ্লব : হ্যাঁ, বউদি। আজ খেলা ছিল। যা করে এসেছি। জলে ডুবে গেছে। বাস নেই, ট্রাম নেই। জামাফামা ছিঁড়ে, চশমা-ফশমা ভেঙে, চুল-ফুল ছিঁড়ে। সব সহ্য হয়। সহ্য হয় না এইরকম খেলা! তুই অতবড় একটা পেলেয়ার, গোলের দশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে বলটা সোজা গোলকিপারের হাতে তুলে দিলি! এর নাম খেলা!

রমা : না, সে তো ঠিক কথাই। কিন্তু দশটা বেজে গেল, তোমার দাদা ফিরলেন না।

বিপ্লব : দাদাকে তো দেখে এলুম ধর্মতলার ডোবায় দাঁড়িয়ে গ্যাঁঙোর গ্যাঁঙোর করছেন। পাশে অধীরদাও রয়েছেন।

চিত্রগুপ্ত : তার মানে তুমি বলছ কলকাতা ভেসে গেলেই বাবুরা সব ভেক হয়ে ডাকতে থাকবেন?

ভূত : আজ্ঞে হ্যাঁ। সেই শব্দায়মান মণ্ডুকদের মধ্যে দিয়ে ঢেউ খেলিয়ে-খেলিয়ে চলে যাবেন মন্ত্রীরা, পুরপ্রধানেরা, স্টেট বাসের বড়কর্তারা। যেতে-যেতে বলবেন, ও:, তোফা বৃষ্টি হয়েছে, খুউব ডাকছে আজ, খুউব ডাকছে।

চিত্রগুপ্ত : দ্যাখ তো, দ্যাখ তো, পায়ে এটা কী লাগল? গিরগিটির মতো?

ভূত : ধ্যাত মশাই। ড্যাঙ্গা খুঁজতে-খুঁজতে কোথায় গিয়ে উঠেছেন। এখুনি যে মাড়িয়ে ফেলবেন। ওখানে মানুষের শূককীট কিলবিল করছে। দেখছেন না, ধনুকের মতো একসার মানুষ প্লাস্টিকের ঠোঙায় ঢুকে হিলহিল করছে। ওর মধ্যে নারী আছে পুরুষ আছে। সোস্যালিস্টদের খাদ্য ওরা। ওরা আছে তাই ডেমোক্র্যাসি আছে। ওরা আছে তাই সোস্যাল ওয়েলফেয়ার আছে। বৈদান্তিকের ভগবান আছে। কিছু মানুষের আয়েস আছে।

চিত্রগুপ্ত নীচু হয়ে দেখলেন। হ্যাঁ, মানুষেরই বাচ্চা। আকৃতিতে গিরগিটির চেয়ে সামান্য বড়। অন্ধকার না হলে চিত্রগুপ্ত আরও একটু ভালো করে দেখতে পেতেন, সাদা খ্যাসখেসে গায়ের চামড়া, কুঁচকে লেগে আছে হাড়ের গায়ে। ছটাকখানেক রক্ত শরীরের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত। জর্দার কৌটোর মতো এতটুকু একটা হৃদয় সেই রক্ত পাম্প করে করে হয়তো একেও একদিন ওই বসে থাকা ধনুক তৈরি করে দেবে। একটি ভোট, একজন লিকলিকে মেহনতি মানুষ, অথবা একটি ছিঁচকে চোর কিংবা ইনফরমার, বুটলেগার, পিম্প, প্রসটিটিউট।

চিত্রগুপ্ত : এর নাম মানুষ? ওহে ভূত, কে এদের পিতা, কে এদের মাতা। এরা কোন সাহসে জন্ম দেয়?

ভূত : সেই সাহসে, কোনও একদিন, গ্রাম গ্রামই থাকবে, শহর শহরেই থাকবে। বৃত্তি অনুসারে সুস্থ জীবিকার ব্যবস্থা হবে। জমি হবে জমা হবে। ন্যূনতম জীবনযাত্রায় মানুষ একটু মানুষের মতো বেঁচে থাকবে। গ্রাম এদের শহরের দিকে ঠেলে দেবে না ফুটপাথের ভিখিরি করে। স্বামী বিবেকানন্দকে আপনারা এখন কোথায় রেখেছেন, প্রভু?

চিত্রগুপ্ত : তিনি এখন সপ্তর্ষিমন্ডলের এক ঋষি। কথামৃততেই আছে, তিনি যেখান থেকে নেমে এসেছিলেন, সেইখানেই ফিরে গেছেন। কেন?

ভূত : আজ্ঞে, তিনি খুব জোর গলায় বলে গিয়েছিলেন, আই হোলড এভরি ম্যান এ ট্রেটার, যারা এইসব অবদলিত মানুষদের ভাঙিয়ে শিক্ষিত হয়, ধনী হয়, রাজনীতি করে, গলাবাজি করে। তারপর বছরে একদিন বিশেষ উপলক্ষে গায়ে আতর মেখে এসে গোটাকতক কমলালেবু ছুঁড়ে মারে, খানকয়েক সুতোর কম্বল বিলোয়।

তাহলে নীতিবাক্যটি এই দাঁড়াল : চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। যে রাস্তায় গেলে আখেরে ভালো হবে, সেই রাস্তায় তোমার পূর্বপুরুষ যদি তোমাকে ঠেলে দিতে পারেন এবং তুমি যদি ঠিকমতো চলে থাকতে পারো তাহলেই তুমি, চাকুরিজীবী, ব্যবসায়ী, এম. পি., এম. এল. এ., ডকটর, প্লিডার, লিডার, সেক্রেটারি, ডিরেকটার, কাউন্সিলার, কমিশনার, প্ল্যানার। মর্তলোক আর স্বর্গলোকের মাঝখানে একটি খেলাঘর। দর্শনের বই পড়বে কিন্তু দ্যাখো কৌপীনটি যেন খুলে না পড়ে। বিবেকানন্দ পড়বে, বড় বড় কোটেশন ঝাড়বে কিন্তু সাবধান নিজের ঘর সামলে। হ্যাঁ, সোস্যালিজম করবে তবে নিজেকে বাইরে রেখে। ডেমোক্রেসি অবশ্যই ভালো জিনিস, উত্তম দৃষ্টিভঙ্গি, তবে নিজের অটোক্রেসি বাঁচিয়ে। তা না হলে, আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত ভালো-ভালো কথা, জ্ঞানের কথা, ত্যাগের কথা, আদর্শের কথা বলা হয়েছে তার তিনের চার ভাগ উঠেছে ভারতের মাটি থেকে এবং আমরা যে তিমিরে সেই তিমিরেই।

চিত্রগুপ্ত : নর্দমা দিয়ে যে ভাবে জল গলে যায় সেই ভাবেই গত তেত্রিশটা বছর তোমাদের পরিকল্পনার পয়:প্রণালী দিয়ে টাকা গলে গেল। এদের কিছু হল না কেন?

ভূত : সুবাতাসে পালটি তুলে যারা পেরেছে তারা মালটি ধরে তলার পরে তলা তুলেছে। শকুনের দৃষ্টি চাই, শৃগালের বুদ্ধি চাই, সাধকের উদাসীনতা চাই, চোরা লন্ঠনের আলোর সংকীর্ণতা চাই তবেই না হাওয়া মহলের বাসিন্দা হওয়া যায়।

চিত্রগুপ্ত : তোমার ওসব সেন্টিমেন্টাল কথার কোনও মূল্য নেই আমার কাছে। আমি মৃত্যুর দপ্তরের বড়বাবু। অনেক আগে ডারউইন নামক এক পণ্ডিত এসে সব রহস্য ফাঁস করে দিয়েছেন। বাঁচতে পারো বাঁচতে না পারো হড়কে যাও। ভগমান আছেন, ভগমান আছেন করলে কাঁচকলা হবে। তবে আমারও সন্দেহ হচ্ছে।

ভূত : কী সন্দেহ, প্রভু?

চিত্রগুপ্ত : ডারউইনের থিওরিটা ঠিক নয়। কত বছর বললে? চৌত্রিশ বচর! স্টিল গোয়িং স্ট্রং। এরা বেঁচে আছে। তোমাদের সিস্টেমে বেঁচে থাকবে কারা, পোলিটিসিয়ান, ফিজিসিয়ান, প্লেয়ার, গ্যাম্বলার, ট্রেডার, মার্ডারার, ল-মেকার্স, ল-ব্রেকার্স, রুলার্স, ডিফেকটার্স, ইনডাসট্রিয়ালিস্ট। এরা কেন বেঁচে আছে। খুব ভয়ের কথা যে অবস্থাটাকে আমরা মৃত্যুর পক্ষে আদর্শ বলে মনে করতুম, আহা, গিরগিটি বা ধনুকের মতো হলেও মানুষ শুধু বেঁচে নেই বংশবৃদ্ধিও করছে। কী সাংঘাতিক কথা। যমরাজকে বলতে হচ্ছে।

ভূত : মাভৈ:! ফারমেনটেসান কাকে বলে জানেন? নিশ্চয় জানেন। ব্যাকটিরিয়া কী ভাবে জন্মায় জানেন? তাও জানেন। গেঁজে-ওঠা নরকে, দারিদ্র্যের খমিরে এক ধরনের জীবন বজবজ করে বেড়ে উঠছে। হ্যাঁ, তারাও মানুষ। হতে পারে, তাদের হৃদয়বৃত্তি, অনুভূতি, নৈতিকতা, সুখ-দু:খবোধ অন্যরকম। তারা ছাদের চেয়ে খোলা আকাশের তলায় ভালো থাকে। হাইজিনের হা শোনেনি, শোনার প্রয়োজনও নেই। ম্যালনিউট্রিসানটাই তাদের নিউট্রিসান। রাস্তার এই আবর্জনাধৌত জলই তাদের পেনিসিলিন। প্যানজার বাহিনীর মতো, প্যাটন ট্যাঙ্কের মতো সব গ্রাস করতে-করতে এরা এগিয়ে আসছে। আর ওদিকে হর্ম্যতলবাসী উচ্চাঙ্গমানব প্রাোটিন, নিউট্রিসান, স্টেরিলাইজেসানের চাপে টপাটপ রসগোল্লার মতো আপনাদের মুখে চলে যাচ্ছে। হৃদয়হীন হৃদয় মুঠোয় করে ধরেছে থ্রম্বোসিস। ক্যানসার কুরেকুরে খেয়ে চলেছে। মৃত্যুর দরবার ফাঁকা যেতে পারে না, প্রভু!

চিত্রগুপ্ত গুটিগুটি হাঁটছেন। ভেবেছিলেন মন্দাকিনীর পাতাভরা জলে মিহি বালির ওপর দিয়ে বেশ খেলে-খেলে হেঁটে যাবেন। আমি জানি, জলের তলায় কি আছে। ভূত হয়ে গেলেও কলকাতার ভূত্বক তো এখনও ভুলিনি।

চিত্রগুপ্ত : বুঝলে, ভূত।

ভূত : আজ্ঞে, প্রভু।

চিত্রগুপ্ত : লজিক পড়েছ। পড়োনি? তা হলেও বুঝতে অসুবিধা হবে না। শিশুরা জলে হাঁটতে ভালোবাসে; অর্থাৎ জলে হাঁটলে শিশু, হয় তার মানে শিশুর মতো দেহ না হলেও মন পবিত্র হয়। তোমার হচ্ছে না?

ভূত : আমার মনই তো নেই। পবিত্র আর অপবিত্র।

চিত্রগুপ্ত কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। বলা হল না। তিনি হঠাৎ অনেকটা ওপরে উঠে গিয়ে ঢেঁকির মতো ঘপাস করে নেমে গেলেন। চিত্রগুপ্ত ভ্যানিশ। বুদ্ধের সলিল সমাধি। গভীর গর্তের ওপর আধ-ভাঙা একটি কংক্রিট স্ল্যাব কোনও রকমে ফেলা ছিল। অসংখ্য ডেথ ট্র্যাপের একটি ট্র্যাপ। কলকাতার মানুষ জানেন। ‘মরতে চাইলেও মরব না’ এই প্রতিজ্ঞায় পাশ কাটিয়ে ‘ভোলে বাবা পার করে গা’ বলে চলে যান। স্বয়ং যমের দফতরি সেই ফাঁদে পা দিয়ে ফেঁসে গেছেন।

হঠাৎ কলকাতার সমস্ত টেলিফোন ডেড হয়ে গেল। কেউ প্রেমিকার সঙ্গে বর্ষার প্রেমালাপ করছিলেন, জনৈক মন্ত্রী সেক্রেটারিকে ধমকাচ্ছিলেন, বালিগঞ্জের মাসি তালতলার পিসিকে খিচুড়ির ফর্মূলা শেখাচ্ছিলেন, কবি সম্পাদককে বিছানা থেকে তুলে কবিতা শোনাচ্ছিলেন, বড়বাজারের ব্যবসায়ী ট্রাঙ্কলে দিল্লির ভায়রাভাইকে লোহা আর সিমেন্টের পারমিটের কথা বলছিলেন, ডাক্তার জনৈকা রোগিনীর একসট্রা কেয়ার নিচ্ছিলেন, সমস্ত লাইন একসঙ্গে ডেড। হ্যালো, হ্যালো। লাখ-লাখ হ্যালো। সব হ্যালোরই এক উত্তর, ‘ইয়েস চিত্রগুপ্ত স্পিকিং।’ হোয়াট?

চিত্রগুপ্ত স্পিকিইং…

সমস্ত টেলিফোন লাইন যেখানে জট পাকিয়েছে, সেই জটায় আটকে চিত্রগুপ্ত ভূগর্ভে ঝুলছেন। এদিকে কলকাতার ত্বকে কালো জল আরও গভীর ও ঘন হয়ে উঠেছে। আবার বৃষ্টি আসছে ঝেঁপে। প্রতিটি বাড়ির জানালায়, দরজায় উৎকণ্ঠিত মুখ। ছেলে ফেরেনি, মেয়ে ফেরেনি, স্বামী ফেরেনি, স্ত্রী ফেরেনি, বৃদ্ধা বৃদ্ধা কেউ ফেরেনি। সবাই রাস্তায় হাবুডুবু। বেতারে কাব্য চলেছে—আজ এই বর্ষণ-মেদুর রাতে কলকাতা অতি সুজলা। এখানে বারো, ওখানে আঠারো, যেখানে কয়েক কোটি খরচ করা হয়েছিল জল জমা বন্ধ করার জন্যে, সেখানে ডুবজল। পৌর কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, এবার কলকাতায় আর তেমন জল জমতে দেওয়া হবে না। জল নিয়ে ছেলেখেলা আর চলবে না। সর্দি হলে, নিউমোনিয়া হলে, ইনফ্লুয়েঞ্জা হলে কে দেখবে? ওরে! দুষ্টু ছেলে। মাফ করবেন, স্টুডিয়োর দরজা লিক করে পাশের স্টুডিয়োর কিছু কথা ঢুকে পড়েছে। হ্যাঁ, বর্ষা এসেছে। বর্ষা, বর্ষা, সুন্দরী বর্ষা।

জনৈক দারুবিলাসী জলের ওপর গোটাকতক খালি বোতল ভাসিয়ে গান গাইছে ‘তোরা কে কে খাবি আয়। ওরে নদেবাসী বলেদে রে আসি, দেখেছিস তারে এই নদীয়ায়।’

আমহার্স্ট স্ট্রিটের জলে দুটি মৃতদেহ ভেসে চলেছে। কলকাতায় এ দৃশ্য প্রথম। ‘কেয়ারি বন্ধ করো নেহি তো ঘুঁস যায়ে গা।’ সারি-সারি বন্ধ দরজায় কখনও হাতের, কখনও পায়ের, কখনও গলিত মাথার—ধাক্কা মারতে-মারতে দুটি মৃত মানুষ ভেসে চলেছে।

বন্ধ ঘরে ফিসফিস আলোচনা—একী দৃশ্য! ডুবে মরেছে। ও নো নো মার্ডার। ম্যানহোল থেকে বেরিয়ে পড়েছে। ডেথ ইন ভেনিস।

।। তিন ।।

চিত্রগুপ্ত কলকাতার তলায় তলিয়ে বসে রইলেন। বাহাত্তর ইঞ্চি জলের পাইপ, টেলিফোন লাইন, আন্ডার-গ্রাউন্ড ইলেকট্রিক কেবলস, নর্দমার জল, তার মধ্যে হাবুডুবু চিত্রগুপ্ত। ভূতেদের উদ্ধার করার ক্ষমতা নেই। ভালো করারও ক্ষমতা নেই। ভূত কেবল ভয় দেখাতে জানে। জীবিত অবস্থায় আমি ভূত দেখিনি। তবে ভূতের অনেক কীর্তিকাহিনি পড়েছি, লোকমুখে শুনেছি। আমাদের পাড়ার এক মহিলাকে ভূতে ধরতে দেখেছি। ভূত ছাড়াবার দাওয়াইও দেখেছি। ভূত দেখার চেয়েও রোমহর্ষক প্রেত ছাড়াবার চিকিৎসা—ঝ্যাঁটা, জুতো, লাথি, কিল, চড়, ঘুষি, চুলের মুঠি ধরে আকর্ষণ, অকথ্য খিস্তি। শাস্ত্রবিরোধী কাজ আমি কেমন করে করব! ইচ্ছে করলে আমার হাতটাকে ফায়ার ব্রিগেডের টার্নটেবল ল্যাডারের চেয়েও বড় করে পাতাল প্রবেশ করাতে পারি, চিত্রগুপ্তের টিকি ধরে তুলে আনতে পারি। পারলেও করব না। ভূত-কালচারের বিরুদ্ধাচারণের শাস্তি জানা নেই! একে ভূত, তায় কলকাতার ভূত!

জীবিত অবস্থায় কলকাতার নাগরিক হিসেবে যে সব আচরণে অভ্যস্ত ছিলুম, সেই অভ্যাসের ওপর দাঁড়িয়েই আমার আচরণবিধি তৈরি করতে হবে। যেমন :

১।। জীবনে কখনও কারোর ভালো করার চেষ্টা করিনি, সাহায্যে লাগার চেষ্টাও করিনি। চেষ্টা তো দূরের কথা, চিন্তাতে পর্যন্ত আনিনি। যদিও পড়েছি, লিভ ফর আদার্স ইভন ডাই ফর আদার্স। বহুদূর থেকে শঙ্কর আমার কানে-কানে বলেছিলেন, জেনে রাখো তিনটি দুর্লভ জিনিস জীবের কাম্য, মনুষ্যত্বং, তুমি সেটি পেয়েছ, এইবার আর দুটির জন্যে চেষ্টা করো, মুমুক্ষুত্বং, মহাপুরুষ সংশ্রয়। বিবেকানন্দ বলেছিলেন, হ্যাভ ফেথ ইন ইওরসেলভস, গ্রেট কনভিকসানস আর দি মাদারস অব গ্রেট ডিডস। অনওয়ার্ড ফর এভার। সিমপ্যাথি ফর দি পুওর, দি ডাউনট্রডন, ইভন আনটু ডেথ। এসব পড়েছি, পড়তে-পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম চোখে এক কাপ গরম দুধ খেয়েছি—নাইটক্যাপ। খেতে-খেতে ভেবেছি, হে ঈশ্বর! সকালে দাস্তটি যেন বেশ সাফা হয়। মুড়ি আর ভুঁড়ি, ভুঁড়ি আর মুড়ি! মনের ব্ল্যাকবোর্ডে শুধু লেখাই ছিল,

Learn to live with the thought that it is more important to be like God than to believe in God.

এখন মরে ভূত।

২।। অন্যের আচরণেও আমি তাই দেখেছি। গল্পের সেই চরিত্রটির মতো প্রতিবেশীর কাছে মই চেয়ে দেখেছি, বলেছেন সিন্দুকে আছে। জাল চেয়ে দেখেছি, বলেছেন, জালে সরষে বাঁধা আছে। বিপন্ন আত্মীয়কে মধ্য রাতে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্যে গাড়ি চেয়ে দেখেছি, বলেছেন, ড্রাইভারের কাছে চাবি, ও:, অফুলি সরি, গামছা দিয়ে বেঁধে রাখুন, পরানটাকে যদি বেঁধে রাখা যায়, জীবনটাকেও এক রাত বেঁধে রাখা যাবে।

৩।। আমি ছিলুম সেই প্রবাদোক্ত পুরুষ। ‘আমি খেতে পারি, নিতে পারি, দিতে পারি না। আমি বলতে পারি, কইতে পারি, সইতে পারি না। আমি পড়েছিলুম, এ জীবন ধরিত্রীর দান। তুমি অন্ন মুখে তুলে দিলে, তুমি শীতল জলে জুড়াইলে। তোমার শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি অন্যের দান। গাভী তোমাকে দুগ্ধদানে পুষ্ট করেছে (বয়ে গেছে)। মাতা তোমাকে স্নেহে লালনপালন করেছেন (বেশ করেছেন। বউ আগে, না, মা আগে। দাও বুড়িকে কাশীবাসী করে! যতের বুড়িমা এক গলা গঙ্গা জলে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ছেলের মুখের আগুন। বউ এলেই মা—মাগি? আমার স্ব-কর্ণে শোনা)। কৃষক তোমাকে চাষ করে অন্ন দিয়েছেন (তার বদলে পয়সা নিয়েছেন। যদ্দিন বেঁচে ছিলুম রেশানে একদিনও মনুষ্যখাদ্য চাল পাইনি। ব্ল্যাকে মজুতদারের চাল কিনেছি) তন্তুবায় তোমাকে পরিধেয় বস্ত্র দিয়েছেন (প্রতি বাজেটে আমাকে ন্যাংটা করার চেষ্টা করেছেন অর্থমন্ত্রী। শরীরের প্রতি ইঞ্চি ত্বকের দাম বাড়েনি, বছরে-বছরে লাফাতে বেড়েছে কাপড়ের দাম)। সূর্য তোমাকে উত্তাপ দিয়েছেন, দীপ্তি দিয়েছেন (অবশ্যই দিয়েছেন, আলোবাতাসহীন ঘরে সপার্ষদ ঘেমে নেয়ে, বিষফোঁড়া, ঘামাচি নিয়ে, লিভার-পিলে বেড়ে, ফুলে সারা জীবনের উপার্জনের অর্ধাংশ ডাক্তার-বদ্যিকে দিয়ে, দীপ্তিমান সূর্যমুখী নেতিয়ে ন্যাতা হয়ে গেছি)। মেঘ বারিধারায় নদীকে জলপুষ্ট করে, সেচের জল, তৃষ্ণার জল দিয়েছেন (তা দিয়েছেন, সেই জল এসেছে শ্যাওলাধরা পাইপ বেয়ে, ব্যাকটিরিয়া মিশ্রিত হয়ে, শৈশবের ক্ষীণ মূত্রধারার চেহারা নিয়ে। সেচ যত না হয়েছে, বেশি হয়েছে বন্যা। বন্যায় ঘর ভেসেছে, বানের জলে রাজ (নীতি) লক্ষ্মী ঝুমুর-ঝুমুর হেঁটে কিছু মানুষকে ইয়ে করেছে। বন্যা আও, কম্বল নাও, ভোট দাও)। বাস্তুকার তোমাকে বাসস্থান দিয়েছেন (হ্যাঁ দিয়েছেন, সেলামি, জিভবের-করা ভাড়া আজ জল বন্ধ কাল বাথরুম বন্ধ, পরশু দেওয়ালে পেরেক ঠোকা নিয়ে ভাড়াটে-ভাড়াটেতে চুলোচুলি)

অতএব, তুমি সেই সব ঋণ তোমার জীবন দিয়ে শোধ করে যাও। দাতা যিনি তিনি দাতাই, গ্রহীতা যে সে গ্রহীতাই। আধুনিক ব্যবস্থায়, রেন্টপেয়ারস, ট্যাকসপেয়ারসদের কাছ থেকে ঘাড় ধরে আদায় করে নেওয়া হয় তার দেয়। সেই টাকাতেই তো জীবনের ঋণ শোধের জন্যে নতুন করে ঋণ। ট্যাকস ইভেডারসদের জন্যে দণ্ড। মরে বেঁচেছি। শুল্কই যখন শূলেচাপিয়েছে তখন আবার সম্পর্ক কীসের, কীসের দানখয়রাত! যার যা পাওনা দফতর থেকে বুঝে নাও গে।

৪।। তিনি লিখেছিলেন, কুকুরের সমাজ আছে, নেকড়ের সমাজ আছে, দে আর প্যাক অ্যানিম্যালস। মানুষের সমাজের আর তেমন বাঁধন নেই। ছাড়া ছাড়া, বিচ্ছিন্ন, বিভক্ত। এমন কে করেছে! মানুষই মানুষকে এমন কদাকার করে তুলেছে। এক-একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, চারপাশে দিগন্তপ্রসারী নোনা জল। আমার আমিটিতে হয়ে যাব হারা। আমার সুখ আমারই সুখ, আমার দু:খ আমারই দু:খ। (একদিন, ১৯৭৩ সাল, বেলা তিনটে। তখন আমি বেঁচে। রবিবার। শ্রীসেনগুপ্তর অসুখ। বড় অফিসার। আমার স্ত্রী বলেছিলেন, দেখা করে এসোঃ এক বাকস ভালো সন্দেশ নিয়ে যাও। উন্নতি হবে। খুঁজে-খুঁজে গিয়েছিলুম দক্ষিণ কলকাতায়। বিশাল-বিশাল ফ্ল্যাট বাড়ি। প্ট মিলিয়ে, নম্বর মিলিয়ে, সেকেন্ড ফ্লোরে উঠলুম। মহা সমস্যা! মুখোমুখি দুটি ফ্ল্যাট, দুটি কলিং বেলের বোতাম অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কোনটা টিপব! ডান দিকেরটা? বাঁদিকেরটা? কোনও নেমপ্লেট নেই। অলওয়েজ টার্ন লেফট। বাঁয়ের বোতামে আঙুল। উগ্র চেহারার একজন মানুষ, স্লিপিং স্যুট পরে, রাগ-রাগ মুখ করে দরজা খুললেন। প্রশ্নের বাণ ডেকে গেল, কি চাই, কাকে চাই, হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট। ভদ্রলোকের গলার পাশ দিয়ে ভেতর থেকে আর একটি সুরেলা গলা ভেসে এল, কে-এ গো, মিহির, টিকিট পেয়েছে! ভদ্রলোক অদৃশ্য স্ত্রীকে ধমকে উঠলেন—কোথায় মিহির। হি ইজ অ্যা স্কাউন্ড্রেল। ওকে আমি জলপাইগুড়ি ট্যানসফার করে দেব। কি চাই আপনার?

মি: সেনগুপ্ত কি এখানে থাকেন?

হু ইজ ইওর সেনগুপ্ত?

আজ্ঞে, লালবিলডিং-এর অমুক ডিপার্টমেন্টের জয়েন্ট সেক…

নো-ও।

দড়াম করে মুখের ওপর দরজা বন্ধ হয়ে গেল। বেশ, এবার তা হলে ডানটা টিপি। একজন ভৃত্য দরজা খুললেন। সেনগুপ্ত সাহেব আছেন? ভেতর থেকে মি: সেনগুপ্তর গলা ভেসে এল।

কে-এ।

আজ্ঞে, আমি।

ব্যালকনিতে বসে অসুস্থ সেনগুপ্ত আর শ্রীমতী সেনগুপ্তা চা খাচ্ছেন? আমাকে দেখে অবাক হয়েছেন, রেগেও গেছেন মনে হল।

কী চাই?

দেখতে এলাম স্যার, কেমন আছেন?

হ্যাঁ, ভালো।

কথা দুটো কেটে-কেটে বললেন, বসতেও বললেন না। স্ত্রীর সঙ্গে মৃদু-মৃদু সোহাগের গলায় কথা বলতে লাগলেন।

আমি আসি স্যার?

হ্যাঁ, আসুন, ইয়েস, আসুন।

আবার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন।

সন্দেশের বাকসটা হাতে নিয়ে গুটি-গুটি বেরিয়ে এলুম। জীবনে সেই একবারই দশ টাকার সন্দেশ একা খেয়েছিলুম।

শিক্ষা ।। উচ্চ (অর্থ) বর্ণের মানুষ মুখোমুখি বসবাস করলেও পরস্পর পরস্পরকে না-চেনার ভান করে গর্ব অনুভব করেন। ড্যাম, ম্যাড, ফ্যাট, ম্যাট, ভ্যাট কথা বলার ধরনটাই এইরকম। অবশ্যই কষ্টার্জিত। এই সব পদস্থ মানুষকে নিম্ন পদস্থ মানুষরা দেখতে এলে অপদস্থ তো হবেনই, এমনকী ট্র্যানসফার অথবা সাসপেনশানও হয়ে যেতে পারে। অন্যের মান হরণ করলে মানী ব্যক্তির মান আরও বেড়ে যায়।

জীবনে যা শিখেছি, মরেও তা ভুলতে পারি না। স্পিরিটে আটকে গেছে বেঁচে থাকার ধরন। যেমন বীজ তেমনি ধান। যেমন জীবন, তেমন স্পিরিট। আমি তা হলে কেমন ভূত?

স্পর্শকাতর, ক্ষতিকারণ, নীচ, কপট, ধূর্ত, খল, হিংসুটে, সঙ্কীর্ণ।

সুতরাং, আমার প্রথম কাজ, জলমগ্ন শহরের সব আলো নিবিয়ে দি, তারপর ট্রাম কোম্পানির কর্মীরা যে সব ম্যানহোল খুলে জল বের করবার চেষ্টা করছিলেন ও একটি করে হুঁশিয়ারী নিশানা উঁচিয়ে রেখেছিলেন, সেগুলো সরিয়ে নি। যে ক’টা বাস, ট্যাকসি চলব-চলব করছিল তাদের বিগড়ে দি। বিলিতি কায়দায় যাঁরা ম্যারূনড মানুষকে লিফট দিতে চাইছিলেন, তাঁদের মনে ঢুকে স্বার্থপর করে তুলি।

সারা কলকাতাটাকে বানিয়ে দি ভূতের কলকাতা।

তারপর জীবনে যাকে কোনভাবেই ভয় দেখাতে পারিনি, আমার সেই সদ্য-বিধবাটিকে একবার ভয় দেখিয়ে আসি। শোওয়ার ঘরের জানালায় আমার ভৌতিক মুখ,—

শ্যাঁমা, শ্যাঁমা, ও শ্যাঁমা।

কে? কে?

আঁমি, আঁমি, অশোঁক। হিহি। বড় কষ্ট।

শ্যামা উঠল। তারপর দাঁত ছিরকুটে ঘরের কোণে ধপাস করে আছাড় খেয়ে পড়ল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *