কল

কল

পুজোর ছুটিটা কলকাতায় মামার বাড়ি কাটিয়ে বাবুদের ছেলেপিলারা গ্রামে ফিরল। সঙ্গে এনেছে হইবাজি গুটিকতক। ছোটবাবুর সম্বন্ধী রাত্রে ছাত থেকে বাজি ছুটালেন। আকাশ রোশনাই হল। বাড়ির তলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুনিষ মাইন্দাররা হাঁ করে দেখল। বলাবলি করল বঃ, বিগিন গিয়া,— তাজ্জব কারখানা! বাবুদের ছোটছেলেটা একটা রেলগাড়ির মাথায় চাবি পেঁচিয়ে ছেড়ে দিল আর ভ্যাকর ভ্যাকর চলতে লাগল। কী জানি—কী বোঙার ভর আছে এতে। ছোটমেয়ে মঞ্জু দিদিমণি এনেছিল দু’জোড়া ইন্দুর। সাদা ফুটির মতো ফংফঙে রং। ঘন জালের খাঁচার মধ্যে ইন্দুর চারটে তুড়ুৎ ফুরুৎ ঝম্প করে। মঞ্জুদিদি ওই নিয়েই থাকেন। ছোলা দেন, ছাতু দেন।

সুবল কোঁড়া মজুমদার বাড়ির মাইন্দার। চাষের সময় চাষ, চাষ উঠলে ঝাড়াই মাড়াই— অন্যসময়ে গাইবলদের জাবনা দেয়া। কত্তাবাবুর সেবা, এটা ওটা ফাই-ফরমাস। রোজ সুয্যি ওঠার আগে হাজির দিতে হবে। রাত্রে ছুটি। একবেলা খাবার পায় সুবল। আর বছরে নগদা দুশো টাকা পাঁচ কিস্তিতে।

সুবলের এখন কাজ বেড়েছে। হুকুম হয়েছে রোজ পাতিক্কালে ইঁদুরের খাঁচার গু-নাদি পোষ্কার করতে হবে। খাবার জল পালটাতে হবে।

সুবল কোঁড়া দিদিমণির রগড় দ্যাখে। ইঁদুরগুলোর সাথে দিদিমণির কত মশকরা-ঠাট্টা, রং-তামাশা,— সার্কেস। ইঁদুরগুলোর আবার নাম লাগিয়েছেন তিনি,— নটি, পেটি, ফুল, টুলু। ওরা ঢ্যাঁড়শ দানা ভালবাসে, কুসুম বীজ ভালবাসে, সুবল এইসব এনে দেয়। দিদিমণি এইজন্য সুবলকে ভালবাসেন। একদিন একটুকরো সর মাখানো পাউরুটি আর একদিন প্যাঁচ দেয়া মণ্ডা খেতে দিয়েছিল চুপি চুপি।

আশ্বিন গত হল। চাষের কাজ এখন আর নেই। ধানগুলো ক্রমশ রোদুরের রং গিলতে লেগেছে এখন। হলুদ হলুদ প্রজাপতি আর ধানের রং মিলে যায়, মিশে যায়। ধানের শিষগুলো মোরগের ঝুঁটির মতো হিলহিল করছে। আর এক মাসের মধ্যেই ধানকাটা শুরু হবে। লোকের হাতে পয়সা আসবে। গদাই দাসের তেলেভাজার দোকান সকাল-সন্ধে ধোঁয়া উগরোবে। দু-চারটি ন্যাড়া কুকুর প্রতি বছরের মতো এবারও ছুটে যাবে দোকানের পাশে,— সেই ভিনগাঁয়ের বুড়িটা কি বেঁচে আছে? বেঁচে থাকলে এবারও আসবে নিশ্চয়ই,— ফুরুলিটা দিবি বাবা? না দিলেই শাপ-শাপান্ত— এ ফুরুলিতে ওলাওঠা হবে। ভেদিয়ার যে-বায়োস্কোপের ঘরটা কেবল অঘ্রাণ থেকে বৈশাখ পর্যন্ত চালু থাকে, সেটার বাবুরা আসতে লেগেছে। চালে খড় দেয়া হচ্ছে। ছুতোররা এসে বারোয়ানির বেঞ্চিগুলোর লড়বড়ে পায়ায় পেরেক ঠুকতে লেগেছে। শুঁড়িখানা জমজমাট হয়ে উঠবে, হাঁড়িয়ার সঙ্গে কুড়মুড় ভাজা চিবুবে সব। বিড়ি ধরাবার জন্য পাঁচ সিকের খেঁচাকল কিনবে অনেকেই।

ধান পাকলে হই হই ঢ্যাঁড়া। তাতে কিন্তু সুবলের কিছু যায় আসে না। ওর তো নিজের চাষ নেই, নিজের গোলাও নেই,—তবু অঘ্রাণ এলে লোকের মুখে হাসি ফোটে শালুক ফুলের মতো টাটকা। ওটা দেখতে বেশ লাগে। ধান কাটা হয়ে গেলে যখন সমস্ত মাঠ খাঁ খাঁ করবে— শুধু মাঠে জেগে থাকবে কুষ্ঠক্ষত আঙুলের মতো ধান গাছের খোঁচাখোচা ‘লাড়া’ তখন মাঠের গোপন আনাচে কানাচে, ঢেলার পাশ আর ফাটল থেকে পায়রা-ঘুঘু-চড়াই এর সাথে খুঁটে খুঁটে একটা একটা করে ধান জড়ো করবে ন্যাংটো ছেলেপিলেরা। বাবুদের গোরু চরাতে গিয়ে সুবলের ছেলে-দুটোয় ধান কুড়োবে।

অঘ্রাণের জন্য এ কারণেই বসে থাকা। তারপর রাত্রি হলে কুয়াশা ঢাকা শিরশিরে জ্যোৎস্নায় তির-ধনুক হাতে মাঠে নামবে সুবল, গর্তের ভিতর থেকে ইঁদুরেরা তখন মাটির ওপর ধানের খোঁজে আসে। তখন ইঁদুর ধরবে সুবল। খাবার।

এই জন্যই অঘ্রাণ পানে চেয়ে থাকা সুবলের। সুবল পয়সা পেলেই বউ ছাড়াবে জরিমানা দিয়ে। আশ্বিনের কিস্তির টাকাটা ফুরুৎ হয়ে গিয়েছে কবে। পয়সা শালা ল্যাটা মাছের ছা, ধরে রাখা যায় না, ফুকো পেলেই পালায়। তাই অঘ্রাণের পয়সা পেয়েই শুঁড়ির দোকানে কিছু আগাম দিয়ে রাখবে।

অঘ্রাণ অবশেষে এল। দুমকা থেকে গা হাত উলটে কলজের দম আর শিরার টান পরীক্ষা করে বারোজন মাঝি-মেঝেন ভাড়া করে এনেছে বাবুরা—মেয়ামদ্দ সব নেমেছে ধানখেতে। আকাশে পাতলা সরসরে মেঘ। ঝড়ো হাওয়ায় উড়ছে ওদের ফ্যানারি। হাওয়ায় এক সাঁওতাল বিড়ি ধরাতে পারে না, কাঠি নিভে যায়, তাই বুকের কাপড় দু’হাতে মেলে হাওয়া আড়াল করে তার পরিবার।

সুবল আর পারে না, আর না। ওরও বউয়ের জন্য মন কেমন করে।

ওর পরিবার ওকে ছেড়েছে আজ দু’বছর হবে। সেবার বড় আকাল গেল। বোলপুরের হাট থেকে যে শাড়িটা কিনে ছিল ওর পরিবারের জন্য, জলে দিতেই একেবারে জালি। ছ’মাস না যেতেই ছিঁড়ল চার জায়গায়। একে জালি তায় ছেঁড়া, ওটা শরীরে প্যাচালে গতরের সবই দ্যাখা যেত। নিজেদের জাতের লোকদের নিয়ে চিন্তা ছিল না, কিন্তু কাজে বেরুলে বাবুদের ছেলে-ছোকরাগুলো এমন করে মুখ ফিরিয়ে তাকাত যেন চাটছে। ওর বউ বলেছিল— হয় আমার শরীরে গোবর নেপে রাখো কেনে, নয় একটা শায়া দাও।

— শালা ভাদ্র মাস বটে। গেঁড়োকচু ছাড়া পেটে জোটে না, শায়া কাপড়! বলিস কী?

শেষটায় বুদ্ধি করে সুবল ওকে বাপের বাড়ি রেখে এল, বাপের কাছে থাকলে পুজোর সময় একটা কাপড় পাবে ঠিকই।

সেবারই পুজোর ক’দিন পর বাবুর সম্বন্ধী সুবলকে নিয়ে গেল দুর্গাপুর। উনি রাস্তা তৈরির ঠিকাদার বটেন। দুর্গাপুরে মুনিষের দর খুব চড়া, গ্রাম থেকে নেয়াই সুবিধে। চলল সুবল দুর্গাপুর। ও হচ্ছে বছরে দুশো টাকায় কেনা মাইন্দার, যা হুকুম তা তামিল।

দুগ্‌গাপুরে কাটছিল মন্দ না, খেতে পেত। সন্ধে হলে পাকিমদ, ‘শালার বোতলে ভরা।‘

অঘ্রাণে সুবল দেশে ফিরতে চাইল, দেশে ফেরার জন্য ও কাঠবেড়ালের মতো হয়ে গেছিল, কিন্তু বাবুরা কাজের ক্ষতি করে ওকে ছুটি দিল না। ওর ফিরতে ফিরতে আষাঢ় হল। তখন দেশে ধান রোয়া হয়। তখন মুনিষ মজুরের খুব বাজার দর ওঠে। তখন সুবল বাইরে থাকলে বাবুদের নগদা মুনিষ রাখতে হয় ফের পয়সা দিয়ে। তাই সুবল দেশে ফিরতে পারল।

দেশে ফিরে সুবল ওর ভায়রাভাই মুরাইয়ের কাছে গালে হাত দিয়ে শুনল যে ওর বউ এসেছিল অঘ্রাণ মাসে— সুবলকে না পেয়ে মন খারাপের গাওনা গেয়ে গেছে ওর বোনের কাছে। ছেলে-দুটোকে বাবুবাড়ি কাজে লাগিয়ে দিয়ে ফিরে গেছে ফের।

কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে সুবল দৌড়োল ওর শ্বশুরবাড়ির বনপাশ। সঙ্গে নিল দুর্গাপুর থেকে কেনা নকল সোনার বালা।

গিয়ে শুনল ওর বউ ধানকলে কাজ নিয়েছে। ওর কী রকমের কুটুম হল-গে ওই ধানকলের ধোঁয়াবাবু। ধানেতে ইস্টিম ঢুকোবার কাজ করে। তিনি লাগিয়ে দিয়েছেন কাজে।

ফিরে আসে সুবল। রাত্রে ছোটবেটার গায়ে ঘায়ে হাত বোলান করতে করতে বলে— তুদের মা এলনারে— রোস। তুদের অন্য মা এনে দুব কেনে— সুবলের বাচ্চাটা চিৎকার করে ওঠে হঠাৎ। সুবলের হাতটা পুঁজ-রক্তে ভিজে সরসর করে ওঠে— ভুল করে ওর ছেলের কাঁধের গোয়াল ঘরের টিন বেঁধা ঘা-এর উপর হাত সেঁধিয়ে দিয়েছে সুবল, রাগে না মমতায় কে জানে।

আহারে— ছোটমোটো রক্তমাংসের শরীরটায় মায়ের হাতের আদর নাই,— সুবলের মনে পড়ে— ছোটটার জন্মের পর পালং-এর দুধ ছিল না। হাঁড়িয়ার সাথে ভাতের মাড় মিশিয়ে হাতের কেঁড়ো আঙুলে করে চুষিয়েছে পালং।

সুবলের ভায়রাভাই মুরাই। সে-ও বাবুবাড়ির মাইন্দা। সেই যাবতীয় খবরা-খবর দেয় সুবলকে। একবার বলল পালং সাঙ্গা করবে ধানকলের অন্য কাউকে। আর একদিন বললে সে নাকি রানিগঞ্জ চলে যাবে সেখানে রোজগার ভাল।

সত্যি বলতে দোষ কী— যখনই পালং-এর কথা উঠেছে তখনই সারা শরীরে যেন শালুক ফুল ফুটে ওঠে।— পালং এর সমস্ত দোষ ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছে যায় সুবলের। পালংকে ছাড়া ও থাকতে পারবে না— সুবলের মনে হয়।

কেউ যদি শুধোয় সুবলকে— কীরে বউকে খালাস দেছিস নাকি? সুবল বলে, না হে বউ খালাস চায়নি এখনও। বলতে গর্ব লাগে সুবলের।

মুরাই একদিন খবর দিলে— বনপাশের ধানকল বন্ধ হয়ে গেছে— পালং-এর আর কাজ নেই। পরের হপ্তাহেই খবর দিলে ফের— পালং-এর পেট হয়েছিল— খসিয়েছে। তারপর— এই কিছুদিন আগে মুরাইকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে পালং—ও আসতে চায় সুবলের কাছে ফের।

ওহো— আ মরি চামুণ্ডোর দাসী, ফের তুই পরলি ফাঁসি, ডিগ্‌ ডিগ্‌ ডিগ্‌ ঢুকুর ঢুকুর।— সুবলের মজা।

সন্ধে পর্যন্ত বকের ধ্যান করেছিল সুবল। পালং এল— ওর বউ। সন্ধের আলো-আঁধারিতে সুবল দেখল পালং-এর সারা চুলে ধানের কুঁড়ো, মুখে হাতে গায়ে খড়খড় করছে ধানের তুষ। সুবল দেখল চোখের ওপরকার ভ্রূ ধানের তুষে সাদা— চোখের নীচে মন খারাপের কাল রং। সুবলকে দেখেই সেই তুষ লেপটানো ভ্রূ কুঁচকোল পালং— উ অ…। তু বটে? — থুঃ থুঃ কেমন মরদ তুই?— মোকে বাপের কাছে থোয়া করে খিতে দিবার ভয়ে পলাইলি? মদ গিলে এসেছিল পালং। শামুকের ঢাকনা খোলার মতো— ঠোঁটটা ফাঁক করল পালং— শামুকের মাংসের মতো দলাপাকানো জিভে অদ্ভুত শব্দে আহত করল সুবলকে!—তা এখন এলি কেনে?—সুড়সুড়োচ্ছ? বুক থেকে কাপড়টা খসিয়ে শরীরটা সামনে এগিয়ে নিয়ে চিৎকার করল পালং— মাগ্‌ মানে কি শুধু এইগুলান্‌? এটা? এটা? পেটেতে ভীষণ জোরে থাপ্পর মারতে মারতে বলতে থাকে, প্যাটের জ্বালা কি কিছু নয়, বল, তু বল। হু হু করে কাঁদে পালং।

খোলা পেট সুবলের চোখের একহাত মাত্র দূরে ছিল। পালং যখন পেট চাপড়াচ্ছিল তখন ওই শব্দ, ওই চিৎকার, ওই রং ওই মদের গন্ধ নাইকুণ্ডলীর মধ্যেকার ধানের গুঁড়ো ওই কোমরের উঁচু হাড় মাছের কাঁটার মতো পাঁজড়ায় দামোদরের বানের আওয়াজ সর্বোপরি পালং-এর তুষ মাখানো মুখের মধ্যে দু’পাশে দুটো চোখের জলের ধারা কীরকম কালো রং-এ ফুটে উঠেছে। কুড়লের ফলার মতো দুটো স্তনের সামনে উবু হয়ে বসে থাকা সুবল কোঁড়া,— তির বেঁধা কাঠবেড়ালির মতো ক্রমশ নিঃসাড় হয়ে যেতে থাকে। বালা জোড়াটা ভয়ে মুঠোর মধ্যে লুকোয়। একবার বিড়বিড় করে বলতে চেষ্টা করে, আমার দোষ নাই রে… দোষ আমার লয় রে…

বুড়ো লগন দাস— সম্পর্কে সুবলের জ্যাঠামশাই। কোঁড়াদের সমাজে সব চেয়ে প্রাচীন লোক। সুবলকে আঙুল উঁচিয়ে সাফ বলে দিলে— উঁহু,— লস্‌টো মেয়াছেলা গাঁয়ে আনা চলবে না। আনতে হলে চল্লিশ টাকা জরিমানা চাই। অনেক কাকুতি মিনতি করলে সুবল। বুড়োর এক কথা। মদের দাম বেড়ে গেছে চল্লিশের কমে কিছুতেই নয়।

জারা আসছে— উত্তর থেকে কনকনে হাওয়ায় সারা গায়ে কাঁপন। চিতে বেড়ার গাছ লাল ফুলে ভরে গেল। বাবুদের ‘লবান্‌’ হয়ে তবে আরও কিছু টাকা পাবে সুবল। একগণ্ডা হাঁ এখুনি হাঁকিয়ে আছে। জরিমানার কড়ি জোগাড় করতে গেলে উপরি কিছু চাই-ই চাই।

অনেক ভেবে একটা মতলব আঁটলে সুবল। শম্ভ হাটির মতো কয়লার কারবার করলে কেমন হয়?

সন্ধের মধ্যে কাজকর্ম সেরে সুবল চলল লাইনের ধারে।

সুবল দ্যাখে শম্ভু হাটি পুলের গোড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকছে। ট্রেনের শব্দ শোনে সুবল। একটা কঞ্চির আগায় সুতো দিয়ে একটা এক টাকার নোট বেঁধে— লাঠিটা হরধনুর মতো হাতে রাখে।

ট্রেনের ফোকাস বাতিতে দেখা যাচ্ছে শম্ভু হাটিকে। উঁচোনো হাতে কঞ্চির মাথায় তিরতির করে কাঁপছে টাকা। ড্রাইভার সাহেব ছোঁ মেরে তুলে নিল লাঠিটা— তারপর ঝপঝপ কয়লা পড়তে থাকে লাইনের পাশে পাশে। শম্ভু হাটির মাইনে করা হারু বাগদির বউ কয়লাগুলো ঝুড়িতে কুড়োবে।

সুবলের ওঠানো হাত থেকেও ছুটন্ত ড্রাইভার সপ করে টেনে নেয় কঞ্চিটা তারপর ঝপঝপ করে দু’বেলচা কয়লা ফেলে দেয় ড্রাইভার সাহেব। জয় ভগবান! সুবল বস্তায় ভরতে থাকে, আর অমনি হইবাজির মতো ছুটে আসে শম্ভু হাটি।— শালা হারামির পো— কাকে নিকেশ করে কয়লা কুড়োচ্ছিস, এ কয়লা আমার। সুবল বলে, এ আমার। আমি টাকা লাগিয়ে কয়লা লাবিয়েচি, দিব্যি গালছি।— শালা রেলের কয়লা চুরি তুই,— চ’ মাস্টারবাবুর কাছে ইস্টিশনে। এ তো রেলের কয়লা। ‘আমনারটাও তো রেলের কয়লা’ সুবল মিন মিন করে। শম্ভ হাটি জোরসে বিড়িতে টান মেরে দূরে ছুড়ে ফেলে হুংকার দিল— আমার ইজারা লেয়া আছেরে বাঞ্চোত। চ’ স্টেশনে,— মাস্টারবাবুর কাছে মোকাবেলা করে লিবি।

শেষ পর্যন্ত কয়লাটা বস্তায় পুরে শম্ভু হাটির কয়লার গাদায় পৌঁছে দিতে হল সুবলকে।

তারপর রোজ সন্ধেবেলা কয়লা কুড়োনো আর বস্তায় পুরে আড়তে পৌঁছে দেবার একটা চাকরিও পেয়ে গেল সুবল। আট আনা রোজ। কারণ হারু বাগদির বউ-এর সূতিকা হয়ে হাড় জিরজিরে শরীর হয়েছে। একাজ আর ওকে দিয়ে হবে না।

সুবল ভেবেছিল ওই উপরি রোজগারটা জমাবে।

কিন্তু দু-চার দিন পরপরই আট আনা এক টাকা চেয়ে নিয়ে খরচ করে ফেলছে সুবল।

গ্রামের ইস্কুলে কতগুলো ডাক্তারবাবু এলেন। ব্যাটাছেলে,— সাদা টুপি পরা মেয়েছেলে। শম্ভু হাটি একদিন বললে সুবলকে— তোর তো ট্যাকার দরকার সুবল,— হ্যাঁরে। বউ ছাড়াবি বলেছিলি।

তা তোকে আমি পাইয়ে দোব ট্যাকা।

একদিন আমার সাথে যাস ইস্কুলে। ডাক্তারবাবুরা একটা ইনজেকশান দেবে তোর পেটে। কিচ্ছু টের পাবি না। নগদা আঠারো টাকা পাবিরে সুবল হাতে হাতে। তারপর, ধর খাওয়া-দাওয়া, দুধ ফল তু জম্মে খাস্‌নি।

সুবল গেল শম্ভু হাটির সাথে। শম্ভু হাটিকে ওরা কিছু টাকা দিল। শম্ভু বলল, তু বোস। কিছু চিন্তা নাই। কাল পরশু—দু’দিন আমার কাজে ছুটি।

তারপর সেই ইস্কুল ঘরে জীবনে প্রথম তক্তপোষে তোশকের উপর শুল। ব্যাটাছেলে মেয়েছেলেরা মিলে তাকে ন্যাংটো করে দিল— ন্যাংটো হবার আগে পায়ের গোড়ালিতে চাপ দিয়ে কোমরটা উঠিয়ে বাধা দিয়ে টাকাটা চেয়েছিল…

তারপর শেষকালে পেটে সাদা ধবধবে ন্যাকড়া প্যাঁচানো অবস্থায় মুঠোতে আঠারোটা টাকা আর দুটো করে লেবু আর কলা নিয়ে যখন গাঁয়ে ফিরল তখন সবাই বললে—তু খাসি হয়ে গিছিসরে সুবল।

সুবলের হাতে এখন টাকা এসেছে। সে সমাজের মোড়লকে তেড়ে খবর পাঠালে—বউছাড়ানি জরিমানা দিয়ে দেবে সে। শম্ভু হাটির কাছে জমানো টাকার সাথে ওই আঠারো টাকা মিলিয়ে লগন দাসের সামনে ছুড়ে দিয়ে বুক থাবড়ালে। আমি বাপ্পের ব্যাটা বটি।

এরপর একদিন খড় জ্বালিয়ে আগুন করা হল। আগুনের চারিদিকে বসে মৌতাত হল খুব। খাসির ‘নাই ভুটুরি’ খুব কষে রান্না হল সেদিন। তাড়ির সাথে মেশানো বোতলের মদ। বুড়ো লগন দাস তার হাত দুটো পেছনে রেখে কনুইয়ে ভর দিয়ে পা দুটো টানটান করে আগুনের উপর মেলে ধরে হাঁক পাড়লে, হারা কোঁড়ার ব্যাটা সুবল ওর লস্‌টো বউ ঘরে লিবে তার আজ্ঞা হয়…। সবাই সমস্বরে হেঁকে উঠল— আজ্ঞা হয় হে… তারপর সবাই হই হই করে চিৎকার করে উঠল। মুরাই দাস নেশার ঝেঁকে গান গাইল—

‘ওরে ফের শুতে যাস যদি তু পর মরদের ঘর

তোর পাছাতে নোহার সেঁকা জেনে লে খবর

তুর গায়েতে পেসাব তুর মুখে ছাগের মল

মা মনসার সাপ দেবে তুর মাথাতে ছোবল।‘

অনেক রাতে সব মিটল।

সুবল মুরাই দাসকে বলল— তোর শালি এলে এখন ক’দিন তোর ঘরেতেই থাকতে দিস তাকে। তারপর মাগ ভাতারে খেটেখুটে ভিটে তো সারিয়ে লিব।

আর তারপর থেকেই বাবুদের মোষের গা মুছতে মুছতে সুবল ভাবে পালং-এর খোলা পিঠে এলানো চুল। ভিটের চালে লাউয়ের মাচা, মুরগির ডাক, শামুক গুগলি নিয়ে এল ছেলেটা, এই সব ছবি দ্যাখে। এখন মাঘ মাস। বোরো ধানের চাষ চলছে বাবুদের জমিতে। এক দিনের জন্যেও ছুটি মিলছে না যে সুবল ওর বউকে নিয়ে আসবে ওর কাছে। ওর মনে হল— দিদিমণির ইঁদুরের সাথে ওর নিজের কোনওই তফাত নেই। তবে ইদুরগুলো খাঁচায় থেকেও পেটভরা খাবার পায়, ও তা-ও পায় না। যেমন বন্ধ খাঁচার মধ্যে সাদা ইঁদুরের খেলা দ্যাখেন দিদিমণি, তেমন বাবুদের উঠোনে সাঁওতালদের নাচের খেলা হয়, কোঁড়াদের লাঠিখেলা হয়।

তারপর অনেক কষ্টে এক দিনের ছুটি জোগাড় করে শ্বশুর ঘর গেল সুবল। বউ আসতে চাইলেও ওর শ্বশুর বললে এখন ছাড়বে না মেয়েকে। এখন আলুখেতে টানা কাজ করছে পালং, দু’পয়সা পাচ্ছে বুড়ো, এখন নয়। বলে দশই ফাগুন ভাল দিন। সেদিন যাবে পালং ওর ভাইকে নিয়ে।

১০ই ফাগুন মা মনসার জাগান। পুরো শীতকালটা গর্তের গভীরে শীতঘুম ঘুমিয়ে এই দিনেই নাকি জেগে ওঠে সর্পকুল। সেদিন কোঁড়াদের একটা পার্বণ। সে দিনটার আরও বড় পার্বণ সুবলের কাছে।

সেই দিনটা ঘনিয়ে আসতে লাগল ক্রমশ;

সুবল ঠিক করেছিল যেদিন ওর বউ ঘরে আসবে সেদিন ওর শালা, ভায়রাভাই মুরাইয়ের গোটা পরিবারকে ও কিছু খাওয়াবে। মদ তো হল। তার সাথে কী এ নিয়ে দিনকয় মহাচিন্তা করল সুবল। শেষকালে একটা বুদ্ধি বার করলে মাথা থেকে। আর সে মতলব কাউকে বলল না সে। কাউকেই বিশ্বাস নেই।

১০ই ফাগুন সক্কালবেলা বাবুদের খেসারি খেতে ফলিডল ছড়াচ্ছিল বাবুবাড়ির গোমস্তা দুকড়ি সামন্ত। সুবল তার কাছ থেকে একটু ফলিডল চাইল।

ফলিডল কী হবে রে, মরবি নাকি?

সে হলে তো বাঁচতাম। লগন দাসের ডিংলা গাছে বড় শুঁয়ো ধরেছে— তা দ্যাও না এটু।

ভাঁড়ে করে ফলিডল একটু নিয়ে বাবুবাড়ির সিঁড়ির তলায় লুকিয়ে রাখল সুবল। বাবুবাড়িতে তখন ছোলা আর সরষে ঝাড়াইয়ের কাজ চলছিল উঠোনে। সন্ধ্যার গাড়িতে পালং আসবে তার ভাইকে নিয়ে মুরাইয়ের ঘরে।

এক ফাঁকে কিছু ছোলাদানা ফেলে দিল সুবল ভাঁড়ের ফলিডলের মধ্যে। তারপর ইঁদুরের খাঁচা পরিষ্কারের সময় সেই ফলিডল মাখানো ছোলাগুলো মিশিয়ে দিল সাদা ইদুরের খাঁচার অন্য খাবারের সাথে।

দু-তিন ঘণ্টার মধ্যেই ইঁদুরগুলো মরতে শুরু করবে। সন্ধ্যার আগেই সবকটা মরবে। মরে গেলে দিদিমণি ওগুলো ফেলে দেবে। তখন ওগুলো নিয়ে যাবে সুবল। নাড়িভুঁড়িগুলো ফেলে দিলে কোনও ভয় নেই। ফলিডলে মরা মাছ এরকম করে খেয়েছিল সুবল। কোনও অসুবিধে হয়নি।

বিকেলবেলা বাবু সুবলের খোঁজ করলে। জানতে পারলেন নাকি? সুবল ভয়ে ভয়ে গেল বাবুর কাছে। বাবু বললেন— যা দিকিনি সুবল একবার ছুট্টে জয়কেষ্টপুরে। ইদ্রিস ডাক্তারকে ডেকে নে আয়। গোরুটার খুব কাঁপুনি লেগেচে,— লালা গড়াচ্ছে। সাথে করে নে আসবি।

অন্য কাউকে পাঠান বাবু, আমি কাজ করছি,— কাজের ক্ষতি হবে কেনে।

আমার কাজ আমি বুঝব, মায়ের চেয়ে মাসি দড়। মুরাইয়ের পা খোঁড়া, কেষ্ট বুড়ো, যেতে- যেতেই রাত করবে।

জয়কেষ্টপুর প্রায় দুই ক্রোশ পথ। সুবল ছুটতে লাগল। রাস্তা ছেড়ে মাঠের মধ্য দিয়ে সাঁইসাঁই করে ছুটতে থাকে। বনপাশ থেকে পালং-এর ট্রেনও এখন ছেড়েছে, ঝমঝমিয়ে— এর আগেই পৌঁছতে হবে, পাখা থাকলে উড়ত সুবল খাল পেরিয়ে মাঠ পেরিয়ে।

ইদ্রিস বাড়ি ছিল না। ওর জন্য একটু বসতে হল। তারপর ইদ্রিস এলে ওকে নিয়ে চলতে লাগল। ইদ্রিস বারবার পেছিয়ে পড়ছে। পথে রেলগাড়ি চলে যাবার শব্দ শুনল। সুবল ইদ্রিসকে ফেলে বারবার এগিয়ে যাচ্ছে।

বাবুবাড়ি ঢুকেই দিদিমণির কান্না শুনতে পায় সুবল। যেন কিছুই জানে না, এমনি ভাবে জিজ্ঞাসা করল সুবল, দিদিমণি কাঁদে কেন!

— কীসের মড়ক লেগে শখের বিলিতি ইঁদুরগুলো মরে গেছে রে।

— আহা চ্‌ চ্‌। ইংদুর গুলান কই, না—এমনি, মরার পর দেখতাম। আমিই গু-নাদি পোস্কার করতাম কিনা। কথাগুলো যদিও বানিয়ে বলেছিল সুবল, বলার পরমুহুর্তেই মনে হয়েছিল কথাটা বানানো নয়, সত্যি, ভীষণ সত্যি কথা, ওর ইঁদুরগুলোর জন্য খুব কষ্ট হচ্ছিল।

—মরা ইঁদুরগুলো মুরাই নিয়ে গেছে।

প্রায় ছুটেই মুরাইয়ের বাড়ি ফিরল সুবল, বাড়িতে ভিড়। পালং আর ওর ভাই মেঝেতে শুয়ে ঝপটাচ্ছে। মুরাইয়ের বউ টিনের থালায় বাতাস করছে, কেউ জল ঢালছে। পালং-এর ডুরে শাড়ি জলে কাদায় একাকার।

কী হল কী?—কী হল?

ফ্যানারি পরা কোঁড়া মাগীমদ্দরা সবাই সুবলের দিকে কপাল কুঁচকে তাকাচ্ছে নাকি?

মুরাই বললে— কী জানি রে ভাই— তবু পালং এল, বসল। তারপর বাবু বাড়িতে মড়ক লেগে যে ইঁদুরগুলো মরে গেছিল ওগুলো নে এসেছিলাম তো,— পালং আসবার পর ভাবলাম নাড়িভুঁটিগুলো দিয়ে ক’টা বড়া বানাই কুটুম দুটোকে দিই, পরে তু এলে মাংস রান্না হবে। তা ওগুলো খেয়েই ওরা এমন ধারা করতে নেগেচ্ছে।

সুবল এবার ঝড়ের মতো ছুটল।

তেরাস্তার মোড়ে এসে থমকে দাড়াল ও। কোনদিকে যাবে সুবল। রাস্তার একমাথা গেছে বাবুবাড়ির দিকে। আরেক মাথা ডাক্তারবাবুর বাসার পানে। পেছনের রাস্তায় পালং মরছে।

পালং মরছে সুবলের জন্য। ঝড়ের নারকোলগাছের মতো মাথা ঝাকিয়ে বলতে ইচ্ছে হল সুবলের, না, না, না। ওকে দুর্গাপুর নে গেল বাবুরা—বাবুদের পয়সা বাঁচানোর জন্য। ও মাইন্দার তাই ওর কথার দাম নেই। ও তো মাইন্দার হত না। ওর বাবাও চাষি ছিল। গোলা ছিল। হাঁস ছিল। ওর বাবা ছিল মাথা উঁচু করা অবাধ্য চাষি। বুড়ো লগন দাসের কাছে শুনেছে সুবল, বাবুরাই বিষ খাইয়ে বলদ জোড়াকে মেরে সুবলের বাপকে মাইন্দার বানিয়েছে।

তেমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে ক্রমশ দানোর মতো বিশাল হতে থাকে সুবল।

দীর্ঘ শীতের পর সাপেরা জেগে উঠছে। বাউরি পাড়া থেকে গান আসছে—

কেলে যারে যারে তুই চম্পাই নগর

দংশি এসো গা বালা লখিন্‌ দর

যেতে লারব লারব চম্পাই নগর

চম্পাই নগরে আছে লোহারই বাসর…

সুবল এখন কোনদিকে যাবে? ডাক্তারবাবুকে আনতে গেলে টাকা চাই। টাকা চাইতে বাবুবাড়ি যেতে হয় আগে।

বাবুবাড়ি গিয়ে ও কী বলবে?

ডাক্তারবাবুকেও বলতে হবে যে ইঁদুরের পেটে ফলিডল ছিল।

বাবুবাড়ির গোমস্তার কাছ থেকে একভাঁড় ফলিডল চেয়ে এনেছিল সুবল।

একফোঁটা ফলিডল লগন দাস পায়নি ওর ডিংলা গাছের শুঁয়ো মারতে—

তেমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে সুবল। একেবারে কলে পড়ে গেছে সে। কলে কি এখন পড়েছে, কলে তো আটকানোই ছিল।

ও ক্ষোভে ওর মাথার চুল ছিঁড়তে থাকে। কালো কালো পাথরের মতো শরীর কী রকম গোলাচ্ছে।

তেমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে সে ভাবে—এ কল থেকে বের হতে হলে এই তিন পথের একটাও নয়। অন্য রাস্তা চাই।

এখনই কলে পড়েনি সুবল, কলে সে পড়াই আছে। এ কল থেকে বেরুতে হলে বাবুদেরও কলে ফেলতে হবে।

সুবল ক্রমশ বিরাটাকার হয়ে উঠতে থাকে, তারপর বিরাট বিরাট লম্বা পায়ে দৈত্যের মতো ডাক্তারবাবুর বাড়ির দিকে চলতে থাকার ইচ্ছে হতে থাকে সুবলের। গিয়ে বলবে টাকার কথা পরে, আগে চলুন। যেতে হবে। নইলে আশেপাশে গান হচ্ছে—যারে যারে তুই চম্পাই নগর…।

‘ভূমিসূত্র’, ১৯৮১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *