কর্মে হোক জন্ম জয়
আলবার্ট আইনস্টাইন তার পড়ার টেবিলের সামনে তিনজন। মানুষের ছবি ঝুলিয়ে রাখতেন। তাদের একজন আইজাক। নিউটন, দ্বিতীয়জন ম্যাক্সওয়েল এবং শেষজন হলেন মাইকেল ফ্যারাডে। ফ্যারাডে হলেন বিজ্ঞানের ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্ময়কর চরিত্র! প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা না করে দুনিয়ায় কবি সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, গায়ক, খেলোয়াড় হওয়া যায়। কিন্তু বিজ্ঞানী হওয়া যায়, সে উদাহরণ খুব বেশি নেই। ফ্যারাডে হলেন ইতিহাসের সেই বিরল উদাহরণ।
ফ্যারাডে তাঁর কৈশোরে কাজ করতেন বই বাঁধাইয়ের। দোকানে। তাঁর পরিবার ছিল গরিব। বেশ গরিব। তার বাবা তাঁকে বইয়ের দোকানে কাজ শিখতে দিয়েছিলেন। পুত্রকে পড়ানোর টাকা ছিল না। ফ্যারাডে যখন ২০ বছর বয়সের তরুণ, তখন একদিন এক লেকচার শুনতে গেলেন। সে লেকচারের বক্তার নাম হামফ্রে ডেভি–ইতিহাসের এক সেরা বিজ্ঞানী। ফ্যারাডের জীবন ঘুরে যায় সেদিন থেকে, সেই লেকচার শোনার পর। তিনি ডেভির কাজকে গভীরভাবে জেনে, একসময় নিজেই অসাধারণ বিজ্ঞানী হয়ে উঠলেন। তড়িৎ ও চৌম্বকত্ব। (Electricity and Magnetism) নিয়ে গবেষণা করে, ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।
দারিদ্র্যকে জয় করা মানুষের এমন উদাহরণ নেহায়েত কম নয়। নজরুল তার দারিদ্র্যকে জয় করেছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন এতই দরিদ্র ছিলেন যে তাদের একটি টয়লেট ছিল না। দক্ষিণ ভারতের এক অখ্যাত গরিব ঘরের সন্তান। ছিলেন রামানুজন। ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে সারা দুনিয়ায় খ্যাত হয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় শ্রীনিবাস রামানুজন যখন ইংল্যান্ডে পৌঁছালেন, তখন তার আশেপাশে দুনিয়ার খ্যাতনামা গণিতবিদগণ। তারা এসেছিলেন রামানুজনের লেকচার শুনতে। অথচ রামানুজনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিই ছিল না। গণিতে তাঁর অসামান্য মেধার জন্য তাকে নির্বাচিত করা হয়েছিল রয়েল সোসাইটির ফেলো।
ভারতের আম্বেদকার জন্মেছিলেন দলিত সমাজে। দলিত গোষ্ঠীর মানুষদের এখনো ভারতে নিচু ও অচ্ছুত হিসেবে অবহেলা করা হয়। মেথর-মুচি ইত্যাকার কাজ করেন বলে তারা সমাজে চরম অবহেলিত। অথচ সেই আম্বেদকার, আমেরিকার কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করে গিয়ে স্বাধীন ভারতের আইনমন্ত্রী হয়েছিলেন। তা ছাড়া তিনি ছিলেন ভারতের সংবিধানপ্রণেতাদের একজন। আমার প্রিয় এক গণিতবিদের নাম কার্ল ফ্রেডরিক গাউস। তিনি জন্মেছিলেন জার্মানিতে, খুবই গরিব পরিবারে। মা-বাবা কেউই পড়াশোনা করেননি। তাঁর জন্মতারিখটাও মনে রাখতে পারেননি। কিন্তু সেই ছেলেই উনিশ শতকে গণিতের দেবতা হয়ে উঠেছিলেন।
জন্ম হলো পৃথিবীতে আসার নিছক সূত্র। এর ওপর কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। মানুষের যেটার ওপর নিয়ন্ত্রণ আছে, সেটা হলো কর্ম। মানুষ দরিদ্র পরিবারে জন্মালেই সম্ভাবনাহীন হয় না। দারিদ্র মানুষের বড় হওয়ার পথে অন্তরায়, তবে একমাত্র বাধা নয়। আর জন্ম যেহেতু মানুষকে বড় করে না, সেটা নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করেও লাভ নেই। বাগানের ফুলকে যেমন মানুষ হাতে নেয়, পথের ধারে ফোঁটা ফুলকেও মানুষ হাতে নেয়, খোঁপায় গোঁজে। প্রস্ফুটিত ফুলে কি আর জন্মকথা লেখা থাকে?
দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে বলে অনেকেই দুঃখ ক, দারিদ্র্য নিয়ে হা-পিত্যেশ করে। দারিদ্র্যকে জয় করতে ভয় পায়। আমার কাছে যারা এই দুঃখ করে, তাদেরকে আমি পাথর থেকে ভাস্কর্য হয়ে যাওয়ার কথা বলি। পথের ধারে পড়ে থাকা পাথর কেউ লক্ষ করে না। অথচ সে পাথর দিয়েই যখন, ২য় মানুষ সেটি শিল্পের চোখে দেখে। দূর-দূরান্ত থেকে সে ভাস্ক দেখতে যায়। একটা মানুষের কর্ম ঠিক তেমনই। কম মানষের মধ্যে শিল্পের রূপ দেয়। মানুষকে পরিপূর্ণ করে তোলে। তাই পাথর হয়ে না থেকে কর্মগুণে ভাস্কর্য হয়ে যাও।
বাংলাদেশের অসংখ্য ছেলেমেয়ের মা-বাবা কোনো দিন স্কুলে যাননি। ছেলেমেয়েদের ঠিকমতো খাবার দিতে পারেননি। জামা কাপড় দিতে পারেননি। অথচ সেই ছেলেমেয়েরা আজ পৃথিবী জয়ের পথে নেমেছেন। আমি দিগ্বিদিক এমন মানুষের জয় দেখছি। আমি দেখছি তারা কী করে জন্মকে জয় করছেন। তারা কী করে ফুলের মতো প্রস্ফুটিত হওয়ার চেষ্টায় মগ্ন হয়ে আছে। ফুটতে জানলে কলির গল্পটা হয়ে যায় উপাখ্যান। তাই ফুটতে চেষ্টা করো। মানুষ হাতে নেবেই। জন্ম নিয়ে বৃথা দুঃখ কোরো। না। প্রতিটি মানুষ মহাবিশ্বের নক্ষত্রের মতো। কর্মগুণে যে আলোকিত, তাকেই মানুষ দেখতে পায়। ভালোবেসে দেয় নাম।