কর্মে উপলব্ধি

কর্মে উপলব্ধি

একমাত্র যাঁরা জেনেছেন নিয়মের মধ্যে আনন্দ নিজেকে প্রকাশ করে তাঁরাই নিয়মকে পেরিয়ে যেতে শিখেছেন। এমন নয় যে তাঁদের কাছে নিয়মের বন্ধনগুলির অস্তিত্ব চলে গেছে— বরং বন্ধনগুলি তাঁদের কাছে স্বাধীনতার মূর্ত রূপ হয়ে উঠেছে। মুক্ত আত্মা আনন্দিত হয়ে সকল বন্ধন স্বীকার করেন, আর তাদের কোনোটিকেই এড়িয়ে যাওয়ার পথ খোঁজেন না, কারণ প্রত্যেকের মধ্যে তিনি এমন এক অনন্ত কর্মশক্তির প্রকাশ অনুভব করেন সৃষ্টিতে যাঁর আনন্দ।

বস্তুতঃ, যেখানে কোনো বন্ধন নেই, যেখানে উচ্ছৃঙ্খল উন্মত্ততা রয়েছে, আত্মা সেখানে আর মুক্ত থাকেন না। সেখানে থাকে তাঁর বেদনা; সেখানে অসীমের থেকে তাঁর বিচ্ছেদ, তাঁর পাপের নিদারুণ যন্ত্রণা। আত্মা যখন প্রলোভনের আহ্বানে নিয়মের বন্ধন থেকে স্খলিত হয়ে পড়েন, তখন মায়ের হাতের অবলম্বন থেকে বঞ্চিত শিশুর মতো কেঁদে ওঠেন, “আমাকে বিনাশ কোরো না” তিনি প্রার্থনা করেন, “আমাকে বাঁধো”, “তোমার নিয়মের বন্ধনে বাঁধো; আমাকে ভিতরে ও বাইরে বাঁধো; আমাকে শক্ত ক’রে ধরে রাখো; তোমার নিয়মের দৃঢ় আবেষ্টনের মধ্যে আমি যেন তোমার আনন্দের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারি; পাপের মারাত্মক শৈথিল্য থেকে তোমার কঠিন নিয়ন্ত্রণ দিয়ে আমাকে রক্ষা করো।”

নিয়ম আনন্দের বিপরীত এই ধারণায় কিছু মানুষ যেমন উত্তেজনাকে আনন্দ বলে ভুল করেন, তেমন আমাদের দেশে অনেকে কর্মকে মুক্তির বিরুদ্ধ বলে কল্পনা করেন। তাঁরা মনে করেন ব্যবহারিক স্তরে রয়েছে বলে কর্ম আত্মার নির্মল প্রাণ চাঞ্চল্যের বাধা হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে আনন্দ যেমন নিয়মের মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করে, আত্মা সেই রকম কর্মে নিজের মুক্তি খুঁজে পান। আনন্দ যেহেতু কেবল মাত্র নিজের মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না তাই সে বাইরের নিয়মকে চায়। সেইরকম আত্মা যেহেতু নিজের মুক্তি খুঁজে পান না সেহেতু তিনি বাইরের কর্মকে চান। মানবাত্মা তার কর্ম দিয়ে নিজের আবেষ্টন থেকে সর্বদা নিজেকে মুক্ত করছে; অন্যরকম হলে কোনো স্বেচ্ছাধীন কর্ম সে করতে পারতো না।

মানুষ যত বেশী কর্ম করে আর নিজের মধ্যে যা প্রচ্ছন্ন ছিল তা বাস্তবে পরিণত করে, তত সুদূর ভবিষ্যতে যা ঘটবে তাকে কাছে নিয়ে আসে। একে বাস্তবে পরিণত করার মধ্যে দিয়ে মানুষ নিজেকে আরো অনেক স্পষ্ট ক’রে তোলে, আর রাষ্ট্রে, সমাজে নিজের নানা কর্মের মধ্যে দিয়ে নূতন নূতন দৃষ্টিকোণ থেকে নিজেকেই দেখে। এই দৃষ্টি মুক্তির পথ ক’রে দেয়।

মুক্তি অন্ধকারে নেই, অস্পষ্টতাতেও নেই। অস্পষ্টতার দাসত্ব বন্ধনের থেকে ভয়ঙ্কর আর কিছু হয় না। এই অস্পষ্ট অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য বীজ অঙ্কুরিত হয়ে ওঠার, কুঁড়ি ফুল হয়ে ফুটে ওঠার কঠোর চেষ্টা করে। এই অস্পষ্টতার আবরণ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য আমাদের মনের ধারণাগুলি সবসময় বাহ্য রূপ নেওয়ার সুযোগ খোঁজে। একই ভাবে আমাদের আত্মা, অস্পষ্টতার কুহেলিকা থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য ও প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসার জন্য, সর্বক্ষণ নিজের নূতন নূতন কর্মক্ষেত্র নিজেরই জন্য সৃষ্টি করে, এমন কি তার জাগতিক জীবনে প্রয়োজনীয় না হলেও, নূতন কর্মপদ্ধতির পরিকল্পনায় ব্যস্ত থাকে। আর কেন থাকে? কারণ সে মুক্তি চায়। সে নিজেকে দেখতে চায়, আত্মোপলব্ধি করতে চায়।

মানুষ যখন ক্ষতিকারক জঙ্গল কেটে ফেলে ও নিজের জন্য একটি বাগান তৈরি করে, তখন কুরূপতার আবেষ্টনী থেকে যে সৌন্দর্যকে সে মুক্ত ক’রে আনে সেই সৌন্দর্য তার নিজেরই আত্মার সৌন্দর্য; বাইরে এই মুক্তি না দিলে, অন্তরে সে তাকে মুক্ত করতে পারে না। সমাজের যথেচ্ছাচারের মধ্যে যখন সে আইন ও শৃঙ্খলা স্থাপন করে, তখন অশুভের বাধার ভিতর থেকে যে শুভকে সে মুক্ত করে সে তার নিজেরই শুভসত্তা; এই ভাবে বাইরে মুক্তি দিতে না পারলে অন্তরের মুক্তি সে খুঁজে পায় না। এমনি ক’রে মানুষ তার কর্মের মধ্যে দিয়ে তার শক্তিকে, তার সৌন্দর্যকে, তার মঙ্গলকে, তার আত্মাকেই অবিরাম মুক্ত করায় নিযুক্ত থাকে। আর এই কর্মে সে যত সাফল্য অর্জন করে, তত নিজেকে আরো মহৎ ক’রে দেখতে পায়, তত তার আত্মজ্ঞানের পরিধি বিস্তীর্ণ হয়ে যায়।

উপনিষদ বলেন, “একমাত্র কর্মের মধ্যে দিয়ে তুমি শতবর্ষ জীবিত থাকার ইচ্ছা করবে।” এই উক্তি যাঁরা করেছিলেন তাঁরা আত্মার আনন্দ প্রভূত আস্বাদন করেছিলেন। যাঁরা পরিপূর্ণ ভাবে আত্মাকে উপলব্ধি করেছেন তাঁরা কখনো শোকার্ত বচনে দুঃখময় জীবনের কথা অথবা কর্মের দাসত্ব বন্ধনের কথা বলেন না। বোঁটা আলগা ক’রে ধরা দুর্বল ফুল যেমন ফল ফলাবার আগে ঝরে পড়ে তাঁরা তেমন নন। সর্বশক্তি দিয়ে তাঁরা জীবনকে ধরে রাখেন আর বলেন, “ফল না পাকা পর্যন্ত আমরা ছাড়বো না।” আনন্দের মধ্যে তাঁরা চেয়েছেন তাঁদের শ্রমসাধ্য জীবনে ও তাঁদের কর্মে নিজেদের প্রকাশ করতে। দুঃখ ও বেদনা তাঁদের আতঙ্কিত করে না, নিজেদের হৃদয়ভার তাঁদের ধূলায় লুণ্ঠিত করে না। বিজয়ী বীরের মতো মাথা তুলে জীবনের পথ ধরে দৃঢ় পদক্ষেপে চলতে চলতে তাঁরা আনন্দ ও বেদনা দুই-এর মধ্যে আত্মার ক্রমবর্ধমান উজ্জ্বল দীপ্তিতে নিজেদের দেখেন ও প্রকাশ করেন। তাঁদের জীবনের আনন্দ বিশ্ব জগতের গড়া ও ভাঙার মধ্যে যে শক্তির আনন্দ লীলা করছে তার সঙ্গে পা মিলিয়ে চলে। সূর্যালোকের আনন্দ, মুক্ত বায়ুর আনন্দ, তাঁদের জীবনের আনন্দের সঙ্গে মিলে গিয়ে, অন্তরে ও বাইরে এক মধুর ঐক্যের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এঁরাই তাঁরা, যাঁরা বলেন, “একমাত্র কর্মের মধ্যে দিয়ে তুমি শতবর্ষ জীবিত থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করবে।”

মানুষের মধ্যে জীবনের এই আনন্দ, কর্মের এই আনন্দই পরম সত্য। এ কথা বলে কোনো লাভ নেই যে এ আমাদের মোহ; একে দূরে সরিয়ে না দিতে পারলে আমরা কখনো আত্মোপলব্ধির পথে প্রবেশ করতে পারবো না। কর্মের জগৎকে বাদ দিয়ে অসীমের উপলব্ধির চেষ্টায় সামান্যতম মঙ্গলও হবে না।

এ কথা সত্য নয় যে মানুষ বাধ্য হয়ে কর্ম করে। এক দিকে যদি বাধ্যবাধকতা থাকে, তা হলে অন্যদিকে থাকে সুখ; একদিকে প্রয়োজনের তাড়নায় কর্ম সাধিত হয়, অন্যদিকে তার স্বভাবের পরিতৃপ্তির দিকে সে দ্রুত এগিয়ে যায়। এই কারণে, মানব সভ্যতা যত অগ্রসর হয়, মানুষ তত নিজের দায়িত্ব বাড়িয়ে চলে ও ইচ্ছা ক’রেই নিজের জন্য কর্ম সৃষ্টি করে। কেউ ভাবতে পারেন প্রকৃতি তাকে ব্যস্ত রাখার জন্য যথেষ্ট কর্ম দিয়েছেন, বস্তুতঃ ক্ষুধা ও তৃষ্ণার কশাঘাতে আমৃত্যু তাকে দিয়ে কর্ম করাচ্ছেন— কিন্তু তা নয়। মানুষ তাকে যথেষ্ট মনে করে না; পশু ও পাখিদের সঙ্গে সমান ভাবে যে কর্ম প্রকৃতি তার জন্য নির্দিষ্ট করেন শুধুমাত্র তাই ক’রে সে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। এমন কি কর্মের মধ্যেও, অপরিহার্য ভাবে সে সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে চায়। মানুষের মতো এত পরিশ্রম কোনও প্রাণীকে করতে হয় না; সমাজে নিজের জন্য তাকে এক বিস্তৃত কর্মক্ষেত্র উদ্ভাবনে সক্রিয় থাকতে হয়েছে; এবং এ ক্ষেত্রে সে সর্বক্ষণ গড়ে ও ভাঙে, নিয়ম তৈরী করে ও নিয়ম বাতিল করে, জড় বস্তুর বিশাল স্তূপ বানায়, ও অবিরাম চিন্তা করে, খোঁজে ও যন্ত্রণা ভোগ করে। এই ক্ষেত্রে সে সব চেয়ে শক্তিশালী অনেক সংগ্রাম করেছে, বার-বার নবজীবন লাভ করেছে, মৃত্যুকে মহিমান্বিত করেছে, ও বাধা বিপত্তি এড়িয়ে যাওয়ার বদলে, স্বেচ্ছায় নূতন নূতন বিপত্তির বোঝা অবিরাম তুলে নিয়েছে। এই সত্য সে আবিষ্কার করেছে যে তার অত্যন্ত কাছের পারিপার্শ্বিকের খাঁচার মধ্যে সে সম্পূর্ণ নয়, তার বর্তমানের থেকে সে আরো অনেক বড়, আর কোনো এক জায়গায় নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যদিও আরামের, তবুও জীবনের রুদ্ধগতি তার নিজের যথার্থ কর্ম ও তার অস্তিত্বের আসল উদ্দেশ্য বিনষ্ট করে।

এই “মহতী বিনষ্টিঃ”— এই মহা বিনাশ সে সহ্য করতে পারে না, এই জন্য সে কঠোর পরিশ্রম করে ও যন্ত্রণা ভোগ করে যাতে বর্তমানকে অতিক্রম ক’রে সে নিজে আরো বড় হয়ে উঠতে পারে, এখনো যা হতে পারেনি তা হয়ে উঠতে পারে। এই কঠোর পরিশ্রমে মানুষের গৌরব, এবং সে তা জানে বলে, নিজের কর্মক্ষেত্র সঙ্কুচিত করতে চায়নি, বরং সর্বদাই তার পরিধি বিস্তৃত ক’রেই চলেছে। অনেক সময় সে এত দূরে সরে আসে যে তার কর্ম অর্থহীন হওয়ার উপক্রম হয়, এবং ইতস্ততঃ ছোটাছুটি করায় নানা বৃত্তে ভয়াবহ আবর্ত সৃষ্টি হয়— এই আবর্ত স্বার্থপরতার, অহংকারের, ক্ষমতার। তবুও, যতক্ষণ আবর্তের শক্তি হারিয়ে না যায়, ততক্ষণ কোনো ভয় থাকে না; তার কর্মের সমস্ত বাধা তুচ্ছ হয়ে যায়, ও স্তূপীকৃত নিষ্প্রাণ কর্ম ভেসে যায়; প্রচণ্ড বেগ তার সমস্ত ত্রুটি সংশোধন ক’রে নেয়। একমাত্র যখন বদ্ধ অবস্থায় আত্মা সুপ্ত হয়ে পড়েন তখন তাঁর শত্রুরা তাঁকে দমন করার শক্তি অর্জন করে, এবং এই বাধাগুলি তখন এত আবদ্ধ করে যে তার মধ্যে থেকে সংগ্রাম করা কঠিন হয়ে ওঠে। এই কারণে আমাদের গুরুরা আমাদের সতর্ক করেছিলেন যে কর্ম করার জন্য আমাদের বাঁচতে হবে, বাঁচার জন্য কর্ম করতে হবে; জীবন ও কর্ম অবিচ্ছেদ্য ভাবে যুক্ত।

জীবনের বৈশিষ্ট্য এই যে নিজের মধ্যে নিজে সে সম্পূর্ণ নয়; তাকে অবশ্যই বাইরে আসতে হয়। ভিতর ও বাইরের যোগাযোগের মধ্যে তার সত্য রয়েছে। জীবন ধারণের জন্য, দেহকে বাইরের আলো ও বাতাসের সঙ্গে নানা ধরনের যোগ রাখতে হয়— শুধু জীবনীশক্তি লাভের জন্য নয়, কিন্তু তার প্রকাশের জন্যও। বিবেচনা করুন দেহ নিজের ভিতরের কাজে কেমন সম্পূর্ণ ভাবে নিযুক্ত থাকে; তার হৃৎস্পন্দন এক নিমেষের জন্যও থামতে পারে না, তার পাকস্থলীকে, তার মস্তিষ্ককে বিরামহীন ভাবে কাজ করতে হয়। তবুও এ যথেষ্ট নয়; বাইরের দিক থেকে দেহ সর্বক্ষণ অস্থির হয়ে থাকে। বাইরের অন্তহীন কর্মের নৃত্য ও লীলার দিকে জীবন তাকে পরিচালিত করে; তার ভিতরের সংগ্রহের বৃত্তাকার সঞ্চলনে সে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না, আর একমাত্র বাইরের চলাচলে সে আনন্দের পরিপূর্ণতা খুঁজে পায়।

আত্মার ক্ষেত্রেও তাই হয়। শুধু নিজের ভিতরের অনুভূতি ও কল্পনা নিয়ে সে জীবিত থাকতে পারে না। সর্বদাই তার বাইরের বিষয়ের প্রয়োজন হয়; শুধু তার আন্তর চেতনার পুষ্টির জন্য নয়, নিজেকে কর্মে নিযুক্ত করার জন্য, শুধু পাওয়ার জন্য নয় দেওয়ার জন্যও।

প্রকৃত সত্য হলো, যিনি সত্যস্বরূপ তাঁকে দুই ভাগে বিভক্ত ক’রে আমরা বেঁচে থাকতে পারি না। অন্তরে যেমন বাইরেও তেমন আমাদের অবশ্যই তাঁকে মেনে চলতে হয়। যে দিক থেকেই আমরা তাঁকে অস্বীকার করি না কেন আমরা নিজেদের বঞ্চনা করি আর ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকি। “ব্রহ্ম আমাকে ত্যাগ করেননি, আমি যেন ব্রহ্মকে ত্যাগ না করি।” যদি আমরা বলি আমরা শুধুমাত্র অন্তর্দর্শনের মধ্যে তাঁকে উপলব্ধি করবো এবং আমাদের বাইরের কর্মতৎপরতার থেকে দূরে সরিয়ে রাখবো, আমাদের হৃদয়ের ভালবাসা দিয়ে তাঁর আনন্দ পাবো, কিন্তু বাইরের পৌরোহিত্যে তাঁর পূজা করবো না; অথবা আমরা যদি তার বিপরীত কথা বলি, আর আমাদের জীবনের অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে যাত্রায় নিজেদের একই দিকে অতি ভারাক্রান্ত ক’রে তুলি, তা হলে একই ভাবে স্খলিত চরণে আমরা নিজেরা অধঃপতিত হবো।

বিশাল পশ্চিম মহাদেশে আমরা দেখি যে মানবাত্মা প্রধানতঃ বাইরে নিজেকে প্রসারিত করায় নিযুক্ত থাকে; ক্ষমতা ব্যবহারের উন্মুক্ত ক্ষেত্রই তার ক্ষেত্র। সম্প্রসারণের জগতের প্রতি তার অখণ্ড পক্ষপাতিত্ব, এবং যে আন্তর চেতনার ক্ষেত্র পূর্ণতার ক্ষেত্র তাকে সে পরিত্যাগ করে, বস্তুতঃ তাকে একেবারে বিশ্বাসই করে না। এতে সে এত দূর চলে গেছে যে তৃপ্তির পূর্ণাঙ্গ রূপ তার কাছে কোথাও আর থাকেনি। তার বিজ্ঞান সবসময় জগতের অন্তহীন বিবর্তনের কথা বলেছে। তার অধিবিদ্যা এখন স্বয়ং ঈশ্বরের বিবর্তনের কথা বলতে শুরু করেছে। তারা কখনো স্বীকার করবে না যে তিনি হয়ে আছেন; তারা এইভাবে নেবে যে তিনিও হয়ে উঠছেন।

তারা উপলব্ধি করতে পারে না যে অসীম সবসময় যে কোনো নির্দিষ্ট সীমার থেকে অনেক বৃহৎ, ও সেই সঙ্গে সম্পূর্ণ; একদিকে ব্রহ্ম বিবর্তনশীল, অন্যদিকে তিনি পরিপূর্ণ; একদিকে তিনি মূল উপাদান অন্যদিকে প্রকাশ— দুই একই সঙ্গে একই সময়ে, যেমন গান ও গান করা। এ যেন গায়কের চেতনাকে অস্বীকার করা এবং বলা যে কেবল গাওয়াতে অগ্রগতি হচ্ছে, সেখানে গান কোথাও নেই। নিঃসন্দেহে আমরা একমাত্র গান গেয়ে যাওয়া সম্বন্ধে সাক্ষাৎ ভাবে সচেতন থাকি, আর কোনো এক সময়েও সম্পূর্ণ গান সম্বন্ধে থাকি না; কিন্তু আমরা কি সবসময় জানি না যে সম্পূর্ণ গান গায়কের আত্মাতে রয়েছে?

এই ক’রে যাওয়া ও হয়ে ওঠার উপর অতিরিক্ত জোর দেওয়ার জন্য পশ্চিমে আমরা উত্তেজনা অথবা ক্ষমতা প্রত্যক্ষ করি। মনে হয় এই সব লোকেরা বলপ্রয়োগ ক’রে সমস্ত কিছু লুণ্ঠন করার ও আঁকড়ে ধরার জন্য বদ্ধপরিকর। তারা কেবলই একরোখা হয়ে ক’রেই যাবে কখনো শেষ করবে না— সমস্ত কিছুর পরিকল্পনায় মৃত্যুর সহজ স্থান তারা অনুমোদন করে না— পূর্ণতার সুন্দর রূপ তাদের জানা নেই।

আমাদের দেশে বিপদ আসে বিপরীত দিক থেকে। অন্তর্জগতের প্রতি আমাদের পক্ষপাতিত্ব। আমরা ঔদ্ধত্যের সঙ্গে শক্তির ক্ষেত্র ও ব্যাপ্তির ক্ষেত্র পরিহার করতে চাই। আমরা শুধুমাত্র ধ্যানের মধ্যে পূর্ণতার দিক থেকে ব্রহ্মকে উপলব্ধি করতে চাই, এইজন্য বিশ্বের বাণিজ্য ক্ষেত্রে বিবর্তনের দিক থেকে তাঁকে দেখবো না বলে দৃঢ় সংকল্প করেছি। এই কারণে আমাদের অনুসন্ধানীদের মধ্যে প্রায়ই আমরা আধ্যাত্মিক উন্মাদনা এবং পরিণামে অধঃপতন দেখি। তাদের বিশ্বাস কোনো নিয়মের বন্ধন স্বীকার করে না, তাদের কল্পনা অবাধে ঊর্ধ্বমুখী হয়, তাদের আচরণ যুক্তির কাছে কোনো রকম ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টাকে অবজ্ঞা করে। তাদের বুদ্ধি সৃষ্টির থেকে ব্রহ্মকে অবিচ্ছিন্ন ক’রে দেখবার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় নিযুক্ত হয়ে শুকিয়ে পাথর হয়ে যায়, আর তাদের হৃদয়, নিজের প্রবহমান আবেগের মধ্যে তাঁকে অবরুদ্ধ রাখার চেষ্টায় মদোন্মত্ত অনুভূতির ভাবাবেশে মূর্ছিত হয়ে পড়ে। নিয়মের বন্ধন ও বহির্বিশ্বে কর্মের অধিকার অগ্রাহ্য করার দ্বারা মনুষ্যত্ব যে শক্তি ও চরিত্রহানি সহ্য করে তা পরিমাপ করার জন্য নাগালের মধ্যে বাস্তবিক কোনো মানদণ্ড তারা রাখেনি।

কিন্তু আমাদের ধর্মীয় গাথায় যেমন ক’রে শেখানো হয়, তাতে যথার্থ আধ্যাত্মিকতা, ভিতর ও বাইরের পারস্পরিক সম্বন্ধে শান্তভাবে শক্তি সমন্বিত থাকে। সত্যের নিজস্ব নিয়ম রয়েছে, নিজস্ব আনন্দ রয়েছে। তার একদিকে ধ্বনিত হয় “ভয়াদস্যাগ্নিস্তপতি”, অন্যদিকে হয় “আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে”। নিয়মের কাছে আত্মসমর্পণ না করলে মুক্তি লাভ করা অসম্ভব, কারণ একদিকে ব্রহ্ম নিজেই তাঁর সত্যের দ্বারা বদ্ধ, অন্যদিকে তিনি তাঁর আনন্দের মধ্যে মুক্ত।

আমাদের দিক দিয়ে, একমাত্র যখন আমরা সত্যের বন্ধন সম্পূর্ণ স্বীকার করি তখনই মুক্তির পরিপূর্ণ আনন্দ লাভ করি। কেমন করে? বীণায় বাঁধা তার যেমন ভাবে করে। বীণা যখন ঠিক ক’রে বাঁধা হয়, যখন তার বন্ধনের জোর কিছুমাত্র আলগা থাকে না, কেবলমাত্র তখনই ফলরূপে সুর আসে; আর সুরের তানে সেই তার নিজেকে ছাড়িয়ে প্রতিটি ঝঙ্কারে নিজের যথার্থ মুক্তি লাভ করে। তার কারণ একদিকে সে এমন বাঁধাধরা নিয়মে আবদ্ধ থাকে যে অন্যদিকে সে এই সুরের বিস্তারের মধ্যে মুক্তি খুঁজে পায়। যখন সঠিক ভাবে বাঁধা ছিল না, তখন সে কেবল মাত্রই বন্ধন; কিন্তু তার বন্ধন আলগা ক’রে দিলেই যে তার মুক্তির পথ হতো তা নয়, একমাত্র আরো বেশী শক্ত বন্ধনে বাঁধা হয়ে নির্দিষ্ট সুরে পৌঁছাতে পারলে সে সম্পূর্ণ মুক্তি লাভ করে।

আমাদের কর্তব্যের উদারা ও তারার তার শুধু বন্ধনমাত্র হয়ে থাকে যতক্ষণ আমরা সত্যের নিয়ম অনুসারে দৃঢ় ভাবে সুর বেঁধে তাদের ধরে রাখতে না পারি; আর তাদের বন্ধন আলগা ক’রে দিয়ে নিষ্ক্রিয় অবস্থার যে শূন্যতা আমরা তাকে মুক্তি বলতে পারি না। সেই কারণে আমি বলবো যে সত্যের অনুসন্ধানের, ধর্মের অনুসন্ধানের চেষ্টা কর্মের অবহেলাতে নেই বরং রয়েছে অনন্ত ঐক্যের সঙ্গে আরও বেশী সুর মেলানোর চেষ্টার মধ্যে। এই কঠিন অনুসন্ধানের মূল পাঠ হওয়া উচিত “যে যে কর্মই তুমি করো তা ব্রহ্মকে সমর্পণ করো।” অর্থাৎ সমস্ত কর্মের মধ্যে দিয়ে আত্মা নিজেকে ব্রহ্মের কাছে নিবেদন করবে। এই নিবেদন আত্মার সঙ্গীত, এর মধ্যেই তার মুক্তি। তখনই আনন্দের রাজত্ব যখন সকল কর্ম ব্রহ্মের সঙ্গে মিলনের পথ হয়ে ওঠে; যখন আত্মা নিজের ইচ্ছার কাছে অবিরত ফিরে আসা থেকে নিবৃত্ত থাকে; যখন এর মধ্যে আমাদের আত্মনিবেদন আরো বেশী ঐকান্তিক হয়ে ওঠে। তখন সেখানে পূর্ণতা থাকে, তখন মুক্তি থাকে, তখন এই বিশ্বজগতে, ঈশ্বরের রাজত্ব আসে।

কে এমন রয়েছেন, যিনি নিভৃতে বসে, কর্মের মধ্যে মানবতার এই মহান আত্মপ্রকাশকে, এই নিরন্তর আত্মোৎসর্গকে উপহাস করবেন? কে এমন রয়েছেন যিনি ভাবেন যে ঈশ্বর ও মানুষের মিলন খুঁজে পাওয়া যায় তার নিজস্ব কল্পনার কোনো নিঃসঙ্গ আনন্দের মধ্যে, যুগ যুগান্তর ধরে সমগ্র মানবজাতি রোদে ও ঝড়ে অক্লান্ত পরিশ্রমে মানুষের মহত্ত্বের যে আকাশ-ছোঁয়া মন্দির নির্মাণ ক’রে চলেছে তার থেকে অনেক দূরে? কে এমন আছেন যিনি ভাবেন এই নিভৃত মিলন ধর্মের সর্বোচ্চ রূপ?

ওরে পাগল পথিক, হে সন্ন্যাসী, আত্মোন্মাদনার সুরায় প্রমত্ত, আপনি কি ইতিমধ্যে শুনতে পাননি মনুষ্যত্বের সুদূর প্রসারিত ক্ষেত্র তির্যকভাবে পার হয়ে যাওয়া রাজপথ ধরে মানবাত্মার অগ্রগতি— তার সাফল্যের রথে এই অগ্রগতির বজ্রনির্ঘোষ, সমগ্র বিশ্বে এর বিস্তারকে বাধা দেওয়ার সীমা অতিক্রম করতে যা একান্তভাবে নিয়োজিত? যথার্থই পাহাড়গুলি বিদীর্ণ হয়ে যায় আর জয়োল্লাসে আকাশে আন্দোলিত পতাকাগুলির দুর্বার অগ্রগতিকে পথ ছেড়ে দেয়; উদীয়মান সূর্যের সামনে কুয়াশার মতো, এ দুর্নিবার ভাবে কাছে আসায় সমস্ত আধিভৌতিক বিষয়ের জটিল অস্পষ্টতা অন্তর্হিত হয়। বেদনা, রোগ ও বিশৃঙ্খলা এর প্রবল আক্রমণের সামনে প্রতি পদক্ষেপে সরে যেতে থাকে; অজ্ঞতার বাধা সজোরে ঠেলে ফেলা হয়; অন্ধত্বের অন্ধকার বিদীর্ণ হয়ে যায়; আর তাকিয়ে দেখো, প্রতিশ্রুত এই সেই দেশ প্রাচুর্যে ও সুস্বাস্থ্যে, কাব্যে ও শিল্পে, জ্ঞানে ও ন্যায়-পরায়ণতায় দৃষ্টির সামনে ক্রমশ উদ্ঘাটিত হচ্ছে। তুমি কি তোমার জড়িমাগ্রস্ত অবস্থায় বলতে চাও যে মনুষ্যত্বের এই রথ তার বিজয়ের অগ্রগতি দিয়ে পৃথিবীকে কাঁপিয়ে ইতিহাসের সুদূরপ্রসারী পথ ধরে চলেছে, অথচ তাকে পূর্ণতার দিকে পরিচালিত করছেন এমন কোনো সারথী তার নেই? এমন কে রয়েছেন যিনি অগ্রগতির এই জয়যাত্রায় তাঁর আহ্বানে সাড়া দিতে অসম্মত? এমন মূর্খ কে আছেন যিনি এই আনন্দমুখর সমাগম থেকে পালিয়ে কর্মহীন অবসাদের মধ্যে তাঁকে খোঁজেন? এমন কে রয়েছেন যিনি অসত্যে এতটাই নিমজ্জিত যে মানুষের এই মহান জগৎ, ক্রম-বর্ধমান মনুষ্যত্বের এই সভ্যতা, মানুষের এই চিরন্তন প্রচেষ্টা, গভীর দুঃখের মধ্যে দিয়ে, আনন্দের উৎকর্ষের মধ্যে দিয়ে, অন্তর ও বাহিরের অসংখ্য বাধার মধ্যে দিয়ে, তার শক্তির জয় অর্জন করাকে অসত্য বলার সাহস রাখেন? যিনি এই অপরিমেয় প্রাপ্তিকে এক বিশাল প্রতারণা মনে করেন, তিনি কি সত্যস্বরূপ ঈশ্বরে আন্তরিক ভাবে বিশ্বাস করতে পারেন? যিনি জগতের থেকে পালিয়ে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোর কথা ভাবেন, তিনি কখন ও কোথায় তাঁর সঙ্গে মিলিত হওয়ার প্রত্যাশা করেন? তিনি কতদূর পর্যন্ত পালাতে পারেন— পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে পারেন কি, যতক্ষণ পর্যন্ত না নিজে শূন্যতার মধ্যে পালাচ্ছেন? না, যে ভীরু পালায়, সে কোথাও তাঁকে পায় না। আমাদের যথেষ্ট সাহসী হতে হবে যাতে আমরা বলতে পারি: আমরা এইখানে, এই নির্দিষ্ট স্থানে, এখন এই মুহূর্তে তাঁর কাছে পৌঁছে যাচ্ছি। আমাদের অবশ্যই নিজেদের আশ্বাস দিতে হবে যে আমাদের কর্মে যেমন আমরা নিজেদের উপলব্ধি করছি, সেই রকম যিনি আত্মার আত্মা আমরা তাঁকে আমাদের মধ্যে উপলব্ধি করছি। আমাদের কর্মের পথ থেকে সমস্ত বাধা, সমস্ত বিশৃঙ্খলা, সমস্ত বিভেদ নিজেদের চেষ্টায় অপসারণ ক’রে দ্বিধাহীন ভাবে এই কথা বলার অধিকার আমাদের অর্জন করতে হবে; আমরা অবশ্যই বলতে পারবো, “আমার কর্মে আমার আনন্দ, এবং সেই আনন্দে আমার আনন্দের আনন্দ রয়েছে।”

উপনিষদ ব্রহ্মবিদদের মধ্যে কাকে বরিষ্ঠ বলেছেন? তাঁর সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, ব্রহ্মে যাঁর আনন্দ, ব্রহ্মে যাঁর ক্রীড়া, তিনি ক্রিয়াবান। আনন্দের ক্রীড়া বাদ দিয়ে আনন্দ কোনো আনন্দ নয়— কর্ম ছাড়া কোনো ক্রীড়া ক্রীড়া নয়। কর্ম হলো আনন্দের ক্রীড়া। ব্রহ্মে যাঁর আনন্দ, কেমন ক’রে তিনি কর্মহীন জীবন যাপন করবেন? কারণ তিনি কি তাঁর কর্মের দ্বারা অবশ্যই ব্রহ্মের সেই আনন্দের ব্যবস্থা করতে পারবেন না যে আনন্দ আকার ধারণ ক’রে ও নিজেকে প্রকাশ করে? সেইজন্য যিনি ব্রহ্মকে জানেন, যিনি ব্রহ্মের মধ্যে তাঁর আনন্দ পেয়েছেন, তিনি অবশ্যই ব্রহ্মেরই মধ্যে তাঁর সমস্ত কর্ম— তাঁর খাদ্য ও পানীয়, তাঁর জীবিকা অর্জন ও মঙ্গল সাধন করবেন। ঠিক যেমন নিজের কবিতার মধ্যে দিয়ে কবির, নিজের শিল্পের মধ্যে দিয়ে শিল্পীর, নিজের সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশের মধ্যে দিয়ে বীরের, নিজের সত্য বিচারের মধ্যে দিয়ে জ্ঞানীর আনন্দ ক্রমাগত নিজের নিজের কর্মে অভিব্যক্তির উপায় খোঁজে, সেইরকম ব্রহ্মজ্ঞানীর আনন্দ ছোট বড় সমস্ত দৈনন্দিন কর্মের মধ্যে, সত্যের মধ্যে, সৌন্দর্যের মধ্যে, শৃঙ্খলার মধ্যে, মঙ্গল কর্মের মধ্যে অসীমের অভিব্যক্তির উপায় খোঁজে।

ঠিক একই ভাবে ব্রহ্ম তাঁর আনন্দ অভিব্যক্ত করেন। “সর্বত্র বিচ্ছুরিত তাঁর বহুধা শক্তির মধ্যে দিয়ে তিনি তাঁর নানা প্রকার সৃষ্ট জীবের অন্তর্নিহিত ইচ্ছা পূরণ করেন।” অন্তর্নিহিত সেই ইচ্ছা তিনি নিজেই এবং এই রকম নানা ভাবে, নানা রূপে, তিনি নিজেকে অর্পণ করেন। তিনি কর্ম করেন, কারণ কর্ম ছাড়া তিনি নিজেকে অর্পণ করবেন কী করে? তাঁর আনন্দ নিজেকে সর্বদা উৎসর্গ করে, এই উৎসর্গই তাঁর সৃষ্টি।

এরই মধ্যে আমাদের নিজেদের সার্থকতা রয়েছে, এখানে আমাদের পিতার সঙ্গে আমাদের সাদৃশ্য রয়েছে। বহুধা শক্তি যোগে নানা প্রকারে লক্ষিত কর্মে আমাদেরও অবশ্যই নিজেদের উৎসর্গ করতে হবে। বেদে তাঁকে বলা হয়, “আত্মদা বলদা।”১০ নিজেকে আমাদের কাছে দান ক’রে তিনি সন্তুষ্ট থাকেন না, কিন্তু তিনি আমাদের বল দান করেন, যাতে আমরাও তাঁর মতো নিজেদের উৎসর্গ করতে পারি। এই কারণে যিনি এইভাবে আমাদের ইচ্ছা পূরণ করেন, উপনিষদের ঋষি তাঁর কাছে প্রার্থনা করেন, “তিনি আমাদের শুভ বুদ্ধি প্রদান করুন”১১, শুভ বুদ্ধি প্রদান ক’রে তিনি আমাদের পরমতম ইচ্ছা পূরণ করুন। অর্থাৎ আমাদের অভাব দূর করার জন্য তিনি একাই কর্ম করবেন তা যথেষ্ট নয়, বরং তিনি আমাদের ইচ্ছা ও শক্তি দেবেন যাতে আমরা তাঁর সঙ্গে তাঁর কর্ম করতে পারি ও মঙ্গল সাধন করতে পারি। প্রকৃত পক্ষে, তা হলেই, একমাত্র তাঁর সঙ্গে আমাদের মিলন সম্পূর্ণ হবে। সেই মনই মঙ্গলসাধক মন যা আরেক সত্তার “স্বার্থকে” আমাদের নিজস্ব সত্তার “নিহিতার্থ” ক’রে দেখায়; যা দেখায় তা হলো মানবিক কাজে আমাদের বহুমুখী শক্তির বিবিধ লক্ষ্য স্থির করার মধ্যে রয়েছে আমাদের আনন্দ। এই মঙ্গলসাধক মনের তত্ত্বাবধানে যখন আমরা কর্ম করি, তখন আমাদের কর্ম নিয়ন্ত্রিত থাকে, অথচ যান্ত্রিক হয়ে যায় না; এই কর্ম অভাব তাড়িত নয়, কিন্তু আত্মার তৃপ্তিতে উদ্দীপ্ত। এই ধরনের কর্মে বহুজনকৃত কর্মের অন্ধ অনুকরণ, চলিত কায়দার কাপুরুষোচিত অনুসরণ থেমে যায়। এরই মধ্যে আমরা দেখতে শুরু করি, “তিনি বিশ্বের আদিতে ও অন্তে রয়েছেন।”১২ অনুরূপ ভাবে দেখি যে আমাদের নিজেদের কর্মেরও তিনি উৎস ও প্রেরণা, এবং তার অন্তেও তিনি, আর সেইজন্য আমাদের সমস্ত কর্ম শান্তিময়, মঙ্গলময় ও আনন্দময়।

উপনিষদ বলেন, “জ্ঞান, বল ও ক্রিয়া তাঁর স্বভাব।”১৩ এই স্বাভাবিকতা এখনো আমাদের মধ্যে জন্মায়নি বলে আমরা কর্মের থেকে আনন্দকে পৃথক করতে প্রবৃত্ত হয়ে থাকি। আমাদের কাজের দিন আমাদের আনন্দের দিন নয়— তার জন্য আমাদের একটি ছুটির দিন প্রয়োজন হয়; কারণ, আমরা এতই হতভাগ্য যে, আমাদের কাজের মধ্যে আমাদের ছুটি খুঁজে পাই না। নদী তার বহমান স্রোতের মধ্যে নিজের ছুটি খুঁজে পায়, আগুন বিস্ফুরিত অগ্নিশিখার মধ্যে পায়, ফুলের সুগন্ধ পারিপার্শ্বিকে ছড়িয়ে পড়ার মধ্যে পায়; কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন কর্মে আমাদের জন্য এমন কোনো ছুটি নেই। এর কারণ নিজেদের আমরা ছাড়ি না, আমরা আনন্দের সঙ্গে ও সম্পূর্ণ ভাবে আমাদের কর্মের কাছে নিজেদের সমর্পণ করি না, তাই সে প্রবল শক্তিতে আমাদের পরাভূত করে।

হে আত্মদানকারী! আনন্দরূপে আপনার দর্শনে আমাদের আত্মা অগ্নির মতো আপনার জন্য উদ্দীপ্ত হয়ে উঠুক, নদীর মতো আপনার দিকে প্রবাহিত হোক, ফুলের সুগন্ধের মতো আপনার সত্তায় পরিব্যাপ্ত হোক। আমাদের ভালবাসার শক্তি দিন, আমাদের জীবনকে তার সুখে ও দুঃখে, লাভে ও ক্ষতিতে, উত্থানে ও পতনে পরিপূর্ণ ভালবাসার শক্তি দিন। আপনার এই বিশ্বপ্রপঞ্চকে পরিপূর্ণ ভাবে দেখার ও শোনার শক্তি যেন আমাদের হয় ও সেখানে আমরা যেন পূর্ণ প্রাণশক্তি নিয়ে কর্ম করতে পারি। আপনি আমাদের যে জীবন দিয়েছেন আমরা যেন সম্পূর্ণ ভাবে তা অতিবাহিত করতে পারি, আমরা যেন সাহসের সঙ্গে গ্রহণ করতে পারি সাহসের সঙ্গে দান করতে পারি। আপনার কাছে এই আমাদের প্রার্থনা। যে দুর্বল কল্পনা আপনার আনন্দকে কর্মের থেকে বিচ্ছিন্ন করে, তাকে নগণ্য, নিরাকার ও অস্থায়ী প্রতিপাদন ক’রে, আমাদের মন থেকে আমরা যেন তাকে একেবারে দূর করতে পারি। যেখানেই চাষি শক্ত মাটি চাষ করে, সেখানে শস্যের সবুজের মধ্যে আপনার আনন্দ উচ্ছ্বসিত হয়, যেখানেই মানুষ জট পাকানো জঙ্গল সরিয়ে ফেলে, পাথুরে জমি সমতল করে, আর নিজের জন্য কোনো একটি বাসভূমিকে পরিষ্কার করে, সেখানে আপনার আনন্দ তাকে শৃঙ্খলা ও শান্তিতে ঘিরে রাখে।

হে বিশ্বকর্মা! আমরা আপনার কাছে প্রার্থনা করি আপনার জগৎ জোড়া কর্মশক্তির অপ্রতিহত প্রবাহ হঠাৎ প্রেরণা পাওয়া বসন্তের দখিন হাওয়ার মতো আসুক, মানবজীবনের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রের উপর দিয়ে ধেয়ে আসুক, নানা ফুলের সুগন্ধ নিয়ে আসুক, বহু বনের মর্ম্মর ধ্বনি নিয়ে আসুক, আমাদের বিশুষ্ক আত্মিক জীবনের নির্জীবতাকে মধুর ও সরব ক’রে তুলুক। আমাদের নবজাগরিত শক্তি কিশলয়ে ও ফুলে ও ফলে অপরিমিত তৃপ্তির জন্য মুখর হোক।

তথ্যসূত্র

মা মা হিংসীঃ।

২. কুর্বন্নেবেহ কর্মাণি জিজীবিষেৎ শতং সমাঃ।

৩. মাহং ব্রহ্ম নিরাকুর্য্যাং মা মা ব্রহ্ম নিরাকরোৎ।

৪. “তাঁর ভয়ে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়” ইত্যাদি।

৫. “আনন্দের থেকে ভূত সকল উৎপন্ন হয়” ইত্যাদি।

৬. যৎ যৎ কর্ম প্রকুর্বীত তদ্ব্রহ্মণি সমর্পয়েৎ।

৭. ব্রহ্মবিদাং বরিষ্ঠাঃ।

৮. আত্মক্রীড়া আত্মরতিঃ ক্রিয়াবান্।

৯. বহুধা শক্তিযোগাৎ বর্ণাননেকান্ নিহিতার্থো দধাতি।

১০. আত্মদা বলদা।

১১. স নো বুদ্ধ্যা শুভয়া সংযুনক্তু।

১২. বিচৈতি চান্তে বিশ্বমাদৌ।

১৩. স্বভাবিকী জ্ঞান বল ক্রিয়া চ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *