‘কর্মের ফল আকাঙ্ক্ষা ক’রবে না’

‘কর্মের ফল আকাঙক্ষা ক’রবে না’

শ্রীরামকৃষ্ণকে একজন প্রশ্ন করছেন ; যতদিন না ঈশ্বর লাভ হয়, ততদিন সব কর্ম ত্যাগ করবো? (১-২-৯) আমরা হিন্দুরা মোক্ষ চাই। মৃত্যুর পরে আমরা আবার জন্মগ্রহণ করি। আমরা এই জন্মে বা গত জন্মগুলিতে যেসব কাজ করেছি, সেই কাজের ফল ভোগ করার জন্য মৃত্যুর পর আবার আমাদের দেহধারণ করতে হয়। এইভাবে জন্মমৃত্যুর চক্রে আমরা ঘুরপাক খাই। আমরা এই চক্রের বাইরে যেতে চাই। সেইজন্য ধর্মপথে যাঁরা চলতে শুরু করেন, তাঁদের অনেকেরই মনে এই প্রশ্ন দেখা দেয় যে, আমার বন্ধনের জন্য দায়ী যখন কর্ম, তাহলে আমি কর্মত্যাগ করি না কেন, যাতে নতুন করে আর বন্ধনে জড়াতে না হয়? এইজন্য আবার ধর্মকে অনেকে আক্রমণ করেন এই বলে যে, ধর্ম মানুষকে কর্মবিমুখ করে তোলে, মানুষকে কাপুরুষ করে তোলে—জীবনসংগ্রাম থেকে তাকে সরে যাওয়ার প্রেরণা দেয়। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন : না ; কর্ম ত্যাগ করবে কেন? ঈশ্বরের চিন্তা, তাঁর নামগুণগান, নিত্যকর্ম, এ সব করতে হবে। (ঐ) সংসারের কর্ম? বিষয় কর্ম? ঠাকুর বলছেন : হ্যাঁ, তাও করবে, সংসারযাত্রার জন্য যেটুকু দরকার। (ঐ)

আমরা গীতাতেও দেখছি এই প্রশ্ন। অর্জুন যুদ্ধ করতে চাইছেন না, বলছেন যে, আত্মীয়স্বজনদের হত্যা করে রাজ্যসুখ ভোগ করতে আমি চাই না। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে তিরস্কার করে বলছেন : তুমি কাপুরুষের মতো আচরণ করছ, যুদ্ধ করা তোমার কর্তব্য। এই কর্তব্য তুমি এড়িয়ে যেতে পার না।।

শ্রীকৃষ্ণ বলছেন : ‘যদহঙ্কারমাশ্ৰিত্য ন যোতস্য ইতি মন্যসে। মিথ্যৈষ ব্যবসায়স্তে’— তুমি যে যুদ্ধ করবে না বলছ, এটা অহঙ্কার থেকে বলছ। তোমার এই সংকল্প মিথ্যা। কারণ ‘প্রকৃতিস্ত্বাং নিযোক্ষ্যতি’—তোমার প্রকৃতিই তোমাকে বাধ্য করবে কাজ করতে। ‘স্বভাবজেন কৌন্তেয় নিবদ্ধঃ স্বেন কর্মণা’—তোমার স্বভাবজাত কর্মের দ্বারা তুমি আবদ্ধ। যুদ্ধ করা তোমার স্বভাব, তোমাকে যুদ্ধ করতেই হবে। গীতাতে সেইজন্য বলা হচ্ছে : ‘সহজং কর্ম কৌন্তেয় সদোষমপি ন ত্যজেৎ।’ তুমি তোমার স্বভাব-অনুযায়ী কর্ম করে যাও। তাতে যদি ভুলত্রুটি হয়, ‘দোষ’ থেকে যায় তবুও তা তুমি ত্যাগ করো না। কারও পড়াশুনা ভাল লাগে, কারও হাতের কাজ ভাল লাগে—কত রকমের স্বভাব আমাদের। সেই স্বভাব-অনুযায়ী কাজ করে যাও। সবার এক কাজ ভাল লাগে না। তবে এটা দেখা যায় যে, প্রত্যেকের মধ্যেই কাজ করার একটা প্রবৃত্তি রয়ে গেছে। ‘ন হি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত্যকর্মকৃৎ’—এক মুহূর্তও আমরা কেউ কাজ না করে থাকতে পারি না। ‘কাৰ্য্যতে হ্যবশঃ কর্ম সর্বঃ প্রকৃতিজৈর্গুণৈঃ’ —মানুষের প্রকৃতিই হল কাজ করা। প্রকৃতির গুণে মানুষ অবশ হয়ে কাজ করে চলে। ঠাকুর বলছেন : তোমার প্রকৃতিতে তোমায় কর্ম করাবে। তা তুমি ইচ্ছা কর আর নাই কর।(১-১০-৬) আমাদের শাস্ত্রানুযায়ী, কাজ মানে হাত-পায়ের কাজ নয় শুধু, মনের কাজও কাজ। শরীর দিয়ে যতটা কাজ করি, তার চেয়ে অনেক বেশী করি মন দিয়ে। মনে মনে কত চিন্তা করছি—কত ভাল ভাল জিনিস খাচ্ছি, কত জায়গায় যাচ্ছি—সেসবও কাজ। অবিশ্রাম কাজ করে চলেছি আমরা। ঠাকুরও সেই কথাই বলছেন : কর্ম সকলেই করে—তাঁর নাম গুণ করা এও কর্ম—সোহহংবাদীদের ‘আমি সেই’ এই চিন্তাও কর্ম—নিঃশ্বাস ফেলা, এও কর্ম। কর্মত্যাগ করবার যো নাই। (৩-২-২) সেইজন্য কর্ম করেই আমরা কর্মব্যূহ ভেদ করব। কর্মের দ্বারাই আমাদের যত সঞ্চিত, কর্ম আছে, যার ফলে আমাদের এই জন্ম হয়েছে, হয়তো আরও জন্ম হবে, তা আমরা খণ্ডন করব। কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুলব। সেইজন্যই কর্মযোগ—অর্থাৎ কর্ম করবার কৌশল। ঠাকুর বলছেন : অনাসক্ত হ’য়ে কর্ম করার নাম কর্মযোগ। (১-১০-৬) গীতাতে ভগবানও অর্জুনকে বলছেন :

তস্মাদসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর।

অসক্তো হ্যাচরন্‌ কর্ম পরমাপ্নোতি পূরুষঃ॥

—সর্বদা তোমার কর্তব্যকর্ম করে যাও, কিন্তু অনাসক্তভাবে। অনাসক্তভাবে করতে পারলে তার দ্বারাই মানুষ পরমার্থ লাভ করে। অনাসক্ত হয়ে কর্ম করার অর্থ : কর্মের ফল আকাঙক্ষা ক’রবে না। (ঐ) ভগবান বলছেন অর্জুনকে : ‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন’—কাজেই তোমার অধিকার, ফলে নয়। ‘ত্যক্ত্বা কর্মফলাসঙ্গং নিত্যতৃপ্তো নিরাশ্রয়ঃ। কর্মণ্যভিপ্রবৃত্তোহপি নৈব কিঞ্চিৎ করোতি সঃ’–কর্মফলের আকাঙক্ষা না রেখে যে কাজ আই. সি.এস-হবে সে অনেক কাজ করলেও প্রকৃতপক্ষে সে কিছুই করছে না। সমস্ত গীতার, সমস্ত হিন্দুশাস্ত্রের এই বাণী। নিষ্কামভাবে কাজ করে যাও। কর্মযোগ মানে নিষ্কাম কর্মযোগ। নিষ্কামভাবে কাজ করলে সেটাই ঈশ্বরের দিকে নিয়ে যাবে আমাকে। আমরা যে-কাজ ফলের আকাঙক্ষা নিয়ে করি সেই কাজের জন্যই আমাদের বন্ধন হয়। বন্ধন হয় এই অর্থে যে, সেই কর্মের ফল আমাকে ভোগ করতে হয়। কিন্তু কেউ যদি ফলের আকাঙক্ষা না রেখে কাজ করে, তাহলে সেই কাজের জন্য তার কোন বন্ধন হয় না। গীতার চতুর্থ অধ্যায়ে দেখি, ‘কর্ম’ আর ‘অকর্ম’ এই দুটো কথা নিয়ে খুব আলোচনা আছে। সেখানে এই কথা বলছে যে, একজন মানুষ চুপ করে বসে আছে, হাত-পা নাড়ছে না, তার মানে কিন্তু এই নয় যে, সে কাজ করছে না। কাজ করছে কি করছে না, তা বোঝা যাবে তার কর্তৃত্বাভিমান আছে কি না, ‘আমি কর্তা’ এই বোধ আছে কি না—তা থেকে। অজ্ঞ যারা তারা মনে করে যে, ‘আমি কর্তা’। এরকম লোক যদি চুপ করে বসেও থাকে তাহলেও সে কাজ করছে। কারণ, মনে মনে সে অনেক কাজ করছে। আর সেই কাজের জন্য তার বন্ধন হচ্ছে। কর্তৃত্বাভিমান নিয়ে যে-কাজ করা যায়, তারই একটা ফল হয় আর সেই ফলে মানুষ আবদ্ধ হয়। ভাল কর্ম করলে ভাল ফল হয়তো হয়, কিন্তু সেও বন্ধনের কারণ। স্বামীজী বলছেন : সোনার শিকলও শিকল—’…Fetters though of gold, are not less strong to bind’। ভাল কাজের ফলে আমি হয়তো স্বর্গে গেলাম। কিন্তু সেই কর্মফল ভোগ একদিন শেষ হবে—পাঁচ বছর পরেই হোক কিংবা পাঁচ লাখ বছর পরেই হোক। তখন আবার আমাকে পৃথিবীতে আসতে হবে। একজন হয়তো কোন দেশের প্রধানমন্ত্রী অথবা রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। সেটা একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। তারপরেই আবার হয়তো ‘পুনর্মূষিকো ভব’। সেইজন্য আমাদের শাস্ত্র বলছে : এমন জিনিস চাই না, যা ক্ষণিক, এমন জিনিস চাই না, যা পেয়ে আবার হারানোর ভয় থাকে। বাসনার দ্বারা তাড়িত হয়ে আমরা যা কিছু করি, তার বিনিময়ে একটা কিছু ফল আমরা পাই। কিন্তু যে ফলই পাই না কেন, যত ভাল ফলই হোক না কেন, কিংবা যত দিনের জন্যই হোক—লক্ষ বছর ধরেও যদি সেটা ভোগ করি—মহাকালের তুলনায় সেটা ক্ষণিক। সেইজন্য ভক্ত বলে, ‘মা, সকাম কর্মে আমার বড় ভয় হয়।’ (১-১১-৪) কারণ, সেই কর্ম বন্ধনের কারণ হয়। কিন্তু নিষ্কামভাবে যে কাজ করে, যার মধ্যে কর্তৃত্বাভিমান নেই—যে জেনেছে ঈশ্বরই কর্তা আর সব অকর্তা, কিংবা নিজেকে যে বুঝেছে—নিষ্ক্রিয়, সাক্ষী, দ্রষ্টা—সে আপাতদৃষ্টিতে যত কাজই করুক না কেন, আসলে সে কোন কিছুই করছে না। কাজ তার ক্ষেত্রে ‘অকর্ম’ হয়ে গেছে। কাজ তাকে বাঁধতে পারছে না। ভগবান বলছেন অর্জুনকে :

যস্য নাহংকৃতো ভাবো বুদ্ধির্যস্য ন লিপ্যতে।

হত্বাপি স ইমঁল্লোকান্‌ন হন্তি ন নিবধ্যতে ॥

—অহংকার যার মনে নেই, ‘আমি কর্তা’ কী এই অভিমান যার নেই, সে যদি পৃথিবীর সমস্ত লোককে হত্যাও করে, তাহলেও সে কাউকে হত্যা করছে না বা এই হত্যার জন্য তাকে কোন কর্মবন্ধনে জড়াতে হচ্ছে না। কাজেই কাজ করাটা কোন দোষের নয়। দোষ হচ্ছে এই অহংবুদ্ধিতে। অহংবুদ্ধি যদি থাকে, তাহলে চুপ করে বসে আছি—তাতেও কোন লাভ নেই—মনে মনে আমি হাজার কাজ করে যাচ্ছি। ঠাকুর তাই বলছেন : ‘আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল।’ জ্ঞানী কি করেন? জ্ঞানী জানেন যে, তিনি আত্মা। আত্মা নির্লিপ্ত, নিষ্ক্রিয়, উদাসীন, দ্রষ্টা। আত্মা কিছু করেন না। এই যে জগৎ সংসারে এত কর্মপ্রবাহ—মায়ার জন্য হচ্ছে। আত্মা কিছু করছেন না। জ্ঞানী যিনি—তাঁর এই উপলব্ধি হয়েছে। তিনি হয়তো অনেক কিছু করছেন, আমরা হয়তো দেখছি তিনি কাজে ডুবে আছেন—কিন্তু আসলে তিনি কিছু করছেন না। কর্মের যে শাস্ত্রীয় অর্থ, সেই অর্থে তিনি কিছুই করছেন না। কারণ, তাঁর উপলব্ধি হয়েছে যে, তিনি আত্মা, তিনি নিষ্ক্রিয়। আমরা ব্যাসদেবের সেই গল্প জানি—‘কথামৃত’তে ঠাকুরই বলেছেন সেকথা। গোপীরা যমুনা পার হতে পারছেন না—যমুনায় খুব জল। কি করবেন ভাবছেন—এমন সময় ব্যাসদেবকে দেখলেন সেখানে। ব্যাসদেবকে গিয়ে বললেন : একটা উপায় করে দিন—আমরা যমুনা পার হতে পারছি না। ব্যাসদেব তাঁদের বললেন : সে হবে’খন, এখন আমাকে কিছু খেতে দাও, খিদে পেয়েছে। গোপীরা তখন ব্যাসদেবকে দুধ, ক্ষীর, ননী যা তাঁদের কাছে ছিল দিলেন। ব্যাসদেব খুব করে সব খেলেন। খেয়ে মুখ মুছে যমুনাকে বললেন : আমি যদি কিছু না খেয়ে থাকি তাহলে, যমুনা,তুমি দু-ভাগ হয়ে যাও। আর যমুনা সঙ্গে সঙ্গে দু-ভাগ হয়ে গেল। গোপীরা তো অবাক—আমাদের সামনেই খেলেন, অথচ বললেন, যদি আমি কিছু না খেয়ে থাকি⋯। আর যমুনাও তো তাঁর কথা শুনল। এর কারণ হচ্ছে : ব্যাসদেব ঠিক ঠিক জানেন যে, তিনি আত্মা—আত্মা কিছু করেন না। তাঁর দেহ খেয়েছে—তিনি কিছু খাননি। তাই তিনি বললেন : আমি যদি কিছু না খেয়ে থাকি⋯।

ভক্ত কিন্তু মনে করে সব কাজ ঈশ্বরের, তাঁর ইষ্টদেবতার। এই যে বলি, ফলের আকাঙক্ষা না রেখে কাজ করা—ভক্তের ক্ষেত্রে এটা খুব সুবিধের হয়ে যায়। আমি কাজ করব—কাজের কোন উদ্দেশ্য থাকবে না? আমি পরীক্ষা দেব, পাস করব কি করব না তাতে কিছু যায় আসে না? কোন ফলের আকাঙক্ষা করব না আমি? তা নয়। ভক্ত বলে : কাজ করব, ফলের আকাঙক্ষাও করব, তবে আমার জন্য নয়, ঈশ্বরের জন্য। ঈশ্বরের উদ্দেশে কাজ করব, ঈশ্বরের উদ্দেশে সব ফল সমর্পণ করব। আমার নিজের জন্য আমি কিছু চাই না। ঠাকুর বলছেন : কর্মযোগ মানে কি জান? সকল কর্মের ফল ভগবানে সমর্পণ করা। (৩-২০-১) বলছেন ; কর্ম করবে—কিন্তু ফল ঈশ্বরে সমর্পণ করবে। (৩-২-২) শঙ্করাচার্যও বলছেন যে, অনাসক্ত হয়ে কাজ করার অর্থ ‘ঈশ্বরার্থম’ কাজ করা।১০ বলছেন :১১ ‘নাহং কতা, ঈশ্বরায় ভৃত্যবৎ করোমীত্যনয়া বুদ্ধ্যা’—আমি কতা নই, ঈশ্বরের জন্য তাঁর ভৃত্যের মতো কাজ করছি। এই বুদ্ধিতে সব কাজ করতে হবে। সেটাই হল অনাসক্ত কাজ। ভগবান বলছেন অর্জুনকে :১২ ‘চেতসা সর্বকর্মাণি ময়ি সংন্যস্য মৎপরঃ’—তুমি মৎপরায়ণ হও। আমার উপর নির্ভর করে সব কাজ মনে মনে আমাতে অর্পণ কর। বলছেন :১৩

যৎ করোষি যদশ্নাসি যজ্জুহোষি দদাসি যৎ।

যৎ তপস্যসি কৌন্তেয় তং কুরুষ্ব মদর্পণম্‌৷৷

যা করছ, যা খাচ্ছ, যা আহুতি দিচ্ছ, যা দান করছ কিংবা তপস্যা হিসেবে যা করছ সব আমাতে অর্পণ কর। তা যদি তুমি কর, ‘শুভাশুভফলৈরেবং মোক্ষসে কর্মবন্ধনৈঃ’—এইসব কাজের জন্য যে শুভ এবং অশুভ ফল হবে তা তোমাকে ভোগ করতে হবে না। সমস্ত কর্ম-বন্ধন থেকে তুমি মুক্ত হয়ে যাবে। ‘সন্ন্যাসযোগযুক্তাত্মা বিমুক্তো মামুপৈষ্যসি’১৪—সন্ন্যাসযোগে যুক্ত হয়ে, বিমুক্ত হয়ে আমাকে তখন তুমি লাভ করবে। গানে সেইজন্য বলছে :

হিসাব নিকাশ যা তোর আছে, যা কিছু রয় দোকান মাঝে—

সব সঁপে দে, সব সঁপে দে, তার পায়ে সব সঁপে দে রে।

—পরিপূর্ণভাবে তাঁর পায়ে আত্মসমর্পণ কর। ‘নিবেদয়ামি চাত্মানম্‌’ —আমি নিজেকে নিবেদন করছি, তোমার পায়ে বিলিয়ে দিচ্ছি। সব তোমার কাজ। কাজ তোমার, ফলও তোমার। কারণ, আমিই যে তোমার। আমার সব তোমার। সবকিছু তোমাকে অর্পণ করছি আমি। আমাদের যে হোম করা হয়, তাতে পূজা, আরতি সবকিছু করে যখন আহুতি দেওয়া হয়, তখন বলা হয় :১৫ ‘ওঁ ইতঃপূর্বং প্রাণবুদ্ধিদেহধর্মাধিকারতো জাগ্ৰৎস্বপ্নসুষুপ্ত্যবস্থাসু মনসা বাচা কৰ্মণা হস্তাভ্যাং পাদ্ভ্যামুদরেণ⋯ যৎকৃতং যদুক্তং যৎস্মৃতং তৎসর্বং ব্রহ্মার্পণং ভবতু স্বাহা’—প্রাণ, বুদ্ধি, দেহধর্মের অধিকারী হওয়ার জন্য আমি জেগে ঘুমিয়ে কিংবা সুষুপ্তি অবস্থায়, কায়মনোবাক্যে, হাত দিয়ে, পা দিয়ে কিংবা উদর দিয়ে যা কিছু এতক্ষণ করেছি, বলেছি কিংবা স্মরণ করেছি—সব ব্রহ্মে অর্পণ করছি।নিজের বলে কিছু রাখছি না। সব তাঁর পায়ে নিবেদন করছি। ঈশ্বরের পূজা করছি, সেই পূজার ফলও আমি তাঁতেই অর্পণ করছি। এই হচ্ছে কর্মযোগ। এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে—কর্মযোগ কিন্তু একটা পথ, উদ্দেশ্য নয়। ঠাকুর মনে করিয়ে দিচ্ছেন : জীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বর লাভ। কর্ম তো আদিকাণ্ড ; জীবনের উদ্দেশ্য হ’তে পারে না। তবে নিষ্কাম কর্ম একটা উপায়—উদ্দেশ্য নয়। (১-১০-৬) নিষ্কাম কর্মের দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হয়। আমাদের মনটা এখন মলিন হয়ে রয়েছে।.‘আমি আমার’ বোধ—এই জন্য মলিনতা। আমরা যদি সকামভাবে কোন কাজ করি, তাহলে এই মলিনতা বৃদ্ধি পাবে, আর নিষ্কামভাবে করলে মলিনতা কমবে। এই মলিনতার জন্যই আমরা ঈশ্বরকে দেখতে পাচ্ছি না। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে আমাদের কোন কাজই ঐহিক নয়—সবই আধ্যাত্মিক। এই অর্থে আধ্যাত্মিক যে, সেই কাজের ফলে, হয় আমার মনের মলিনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, না হয় কমছে ; হয় আমি ঈশ্বরের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি, নয়তো ঈশ্বরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। কামনাশূন্য হয়ে যে কাজ করা যায়, তার ফলে আমাদের চিত্তের মলিনতা ক্রমশ দূর হয়। চিত্তের মলিনতা যখন সম্পূর্ণ দূর হয় তখন আমি জ্ঞানলাভ করি। এই যে জ্ঞানলাভ বা ঈশ্বরলাভ তাতে কিন্তু বাইরের কোন জিনিসকে আমি লাভ করছি না। আমার মধ্যেই রয়েছে স্বয়ংপ্রকাশ জ্ঞান বা ঈশ্বর। তার উপরে যেন মলিনতার একটা আবরণ পড়েছিল। নিষ্কাম কর্মের ফলে সেই আবরণ দূর হয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে আমার স্বরূপকে আমি জানতে পারলাম, ‘ঈশ্বরলাভ’ করলাম আমি। ঠাকুর বলছেন : নিষ্কাম কর্ম ক‘রতে ক‘রতে ঈশ্বরেতে ভক্তি ভালবাসা আসে। ⋯নিষ্কাম কর্ম ক’রতে ক’রতে ঈশ্বর লাভ হয়। (৩-১-৬)।

কিন্তু নিষ্কামভাবে কাজ করা খুব সহজ নয়। আমাদের অহংবুদ্ধি সহজে যেতে চায় না। সেই অহংবুদ্ধি দিয়ে কাজ করতে যাই, ভাবছি হয়তো নিজের জন্য ফল কামনা করছি না, কিন্তু কোথা থেকে বাসনা এসে যায়। আর তার ফলে কাজে কত গোলমাল হয়ে যায়। লোকের ভাল করার জন্য কাজ শুরু করলাম। মন্দই করে ফেলি অনেক সময়। নিজেরও মন্দ করি, অন্যেরও মন্দ করি। মানুষকে আঘাত করে ফেলি। একটা ভাল উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ শুরু করলাম, নিঃস্বার্থভাবে শুরু করেছিলাম, শেষে দেখা যায়, সেই উদ্দেশ্য আমি ভুলে গেছি। নিজের ভালটাই উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, নিজের স্বার্থই দেখছি শুধু। অন্যের ভাল-মন্দ আর আমাকে উদ্বিগ্ন করছে না। সেইজন্য বলে ‘গহনা কর্মণো গতিঃ১৬—কর্মের গতি দুর্জ্ঞেয়। বোঝা যায় না, কোনদিকে আমাদের নিয়ে চলেছে। ঠাকুর তাই বলছেন : অনাসক্ত হয়ে কাজ করা ভারী কঠিন। ⋯মনে করছি অনাসক্ত হয়ে কাজ করছি কিন্তু কোন দিক দিয়ে আসক্তি এসে যায়, জানতে দেয় না। হয়তো পূজা মহোৎসব করলুম, কি অনেক গরীব কাঙ্গালদের সেবা করলুম—মনে করলুম যে, অনাসক্ত হ’য়ে করছি, কিন্তু কোন দিক দিয়ে লোকমান্য হবার ইচ্ছা হয়েছে, জানতে দেয় না। তবে একেবারে অনাসক্ত হওয়া সম্ভব কেবল তাঁর, যাঁর ঈশ্বর দর্শন হয়েছে। (১-১০-৬) যিনি ঈশ্বরলাভ করেছেন, তাঁর যে ‘আমি’ সেটা ‘পাকা আমি’, তিনি যা কিছু করেন ঈশ্বরের জন্য করেন—সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে তিনি কাজ করেন। তাঁরা যা কিছু করেন তাতেই লোকের কল্যাণ হয়। তাঁদের উপস্থিতিতেই লোকের কল্যাণ হয়। তাহলে কী করব? আমি কি কোন কাজ করব না? লোকে যদি প্রার্থী হয়ে এসে দাঁড়ায় তাহলে আমি তাকে ফিরিয়ে দেব? তা নয়। কাজ না করে আমি থাকতে পারব না। যথাসাধ্য কাজ করব, যথাসাধ্য লোকের সেবা করার চেষ্টা করব। কিন্তু বিচারবুদ্ধি সবসময় জাগ্রত রাখব। সবসময় চিন্তা করব, এই কাজটা আমি অনাসক্তভাবে করতে পারছি তো? ঈশ্বরের উদ্দেশে করতে পারছি তো? সবসময় প্রার্থনা করতে হয় তাঁর কাছে যে, প্রভু, ‘আমি যন্ত্র তুমি যন্ত্রী’ এই বোধ আমাকে দাও। তুমিই আমাকে দিয়ে সব করিয়ে নিচ্ছ। কাজের যা কিছু ফল আমি যেন তোমাতেই অর্পণ করতে পারি। আর সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্যটা স্থির রাখতে হয়। আমার লক্ষ্য ঈশ্বরলাভ। কাজের মধ্যে আমি যেন নিজেকে হারিয়ে না ফেলি। মন-প্রাণ দিয়ে আমি কাজ করব, ঈশ্বরের কাজ ভেবে করব। কিন্তু এটা খেয়াল রাখতে হবে যে, কাজ উদ্দেশ্য নয়, কাজ হচ্ছে উপায়, ঈশ্বরলাভের উপায়—ঈশ্বর লাভই জীবনের উদ্দেশ্য। (১-১০-৬) কর্ম জোর করে ছাড়া যায় না। কর্ম একসময় আপনা-আপনিই খসে পড়ে, ফল হলে যেমন ফুল খসে পড়ে। যেমন ঘা শুকুলে মামড়ি এমনিই উঠে আসে। ততদিন পর্যন্ত কাজ করে যেতে হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন : খুঁটি ধরে ঘুরপাক খাও। খুঁটি অর্থাৎ ঈশ্বর। যতদিন কর্মক্ষেত্রে আছি ততদিন ঈশ্বরকে যেন ধরে থাকতে পারি। তিনিই আমার অবলম্বন—এটা যেন ভুলে না যাই। একদিনে হয় না। প্রথম প্রথম তাঁকে ভুলে যাব। তাঁর উদ্দেশে কাজ করতে গিয়ে নিজের কাজ করে বসব। কিন্তু অভ্যাস করতে হয়। অভ্যাস করতে করতে এই বোধ পাকা হয় যে, আমার যা কিছু সব তাঁর। ‘যা করি মা সবই তোমার কাজ,“আমার আমার” বলতে লাগে লাজ।’ তখন সব কাজকর্ম সুন্দর হয়, কাজের ফলে আমার চিত্তশুদ্ধি হয়, তাঁর দিকে আমি এগিয়ে যেতে থাকি ক্রমশ।

একটা প্রশ্ন ওঠে যে, আমি তো কাজ নিজের জন্য করছি না—ঈশ্বরের জন্য করছি। নিজের জন্য করলে কাজটা আমি যতটা যত্ন নিয়ে করতাম, এখন কি আমি ততটা যত্ন নেব? আমার কাজে অবহেলা আসবে না? আমি হয়তো চাইব না অবহেলা করতে। কিন্তু আমার অজ্ঞাতসারেই একটা অবহেলার ভাব আসবে না তো? না, তা নয়। ঈশ্বরকে যদি আমি সত্যি সত্যি ভালবাসি, তাহলে কাজে কোনরকম অবহেলা আসতে পারে না। তিনি আমার সর্বস্ব। তিনি আমার প্রিয়তম। আমার আপনার থেকেও আপনার। তাঁর কাজে আমি অবহেলা করব কি করে? যদি নিজের কাজ হত, তাহলে হয়তো অবহেলা করতে পারতাম। কিন্তু তাঁর কাজ—সেই কাজে এতটুকু ত্রুটি থাকলে আমি কষ্ট পাই। সেই জন্য সেই কাজে আমি সবচেয়ে বেশী যত্ন নিই। আমার যত শক্তি আছে সবটা দিয়ে সেই কাজ করি। স্বামী বিশুদ্ধানন্দকে দেখেছি—বিরাট বিরাট যোগ—কিন্তু একবার যোগ করে বসিয়ে দিচ্ছেন—নির্ভুল। দুবার তিনি আর দেখতেন না—কিন্তু তাঁর যোগে কখনও ভুল হত না। কারণ, সেটা তাঁর কাছে অঙ্ক নয়—ধ্যানের সমান। স্বামী ব্রহ্মানন্দ বলতেন : যে ভাল ধ্যান করতে পারে সে সব কাজ ভাল করে করতে পারে। তখন সাধু-ব্রহ্মচারীরা মঠে আলু কাটতেন, আলুর খোসা ছাড়াতেন। স্বামী ব্রহ্মানন্দ একদিন বললেন : তোরা যেসব আলু ছাড়িয়েছিস নিয়ে আয়, আমি দেখে বলে দেব কার কেমন ধ্যান হয়। সাধুরা সব যার যা ভাগের আলু এনেছেন আলাদা করে। স্বামী ব্রহ্মানন্দ সবারটা দেখলেন, দেখে একটা ঝুড়ির দিকে দেখিয়ে বললেন, এই আলু যে ছাড়িয়েছে তারই সবচেয়ে ভাল ধ্যান হয়। দেখা গেল যে, তিনি স্বামী শুদ্ধানন্দ। স্বামীজীর শিষ্য ছিলেন তিনি। তিনি পরে রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনের সাধারণ সম্পাদক হন এবং তারও পরে অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। তাঁর ধ্যান কেমন হত, সে বিচার আমি অবশ্য করতে পারব না। তবে মঠ-মিশনে খুবই সম্মানের পাত্র ছিলেন তিনি। এখনও তাঁর কথা খুব শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি আমরা। সেইজন্য কাজ আর ঈশ্বর-উপাসনা দুটোর মধ্যে বিরোধ নেই কোন। একটা আর একটার পরিপন্থী নয়। ঈশ্বরকে ডাকি বলে আমার কাজ খারাপ হবে কিংবা কাজ করছি বলে ভগবানকে ডাকতে পারছি না তা নয়। একই জিনিস দুটো। কর্মযোগ মানে কর্মবিমুখতা নয় কিংবা কর্মে অনাদর নয়। কর্মযোগ মানে অবিশ্রাম কাজ, আর সেই কাজ একেবারে নিখুঁত, সর্বাঙ্গসুন্দর। কারণ, সেটা আর কাজ নেই তখন—পূজা, আমার ইষ্টদেবতার পূজা। স্বামীজী বলেছেন কাজের সম্বন্ধে একটা বিরাট কথা :১৭ ‘Let us perfect the means ; the end will take care of itself.’ উপায়গুলোর দিকে নজর দাও, তাহলেই ফলটা আপনা-আপনি আসবে। আমি মহৎ কিছু চাই, তার জন্য উপায়গুলিও মহৎ হতে হবে। আমার উদ্দেশ্য মহৎ কিন্তু উপায়টা ভাল নয়, তা হলে হবে না। স্বামীজী বলছেন : চালাকির দ্বারা কোনো মহৎ কাজ হয় না। যিনি ঈশ্বরের পূজা জ্ঞানে কাজ করেন, কাজের প্রতিটি পর্যায় তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি কখনও অসৎ উপায় নিতে পারেন না। আমি কি পারি আমার ইষ্টদেবতার পায়ে এমন ফুল দিতে যে ফুল কীটে নষ্ট করে ফেলেছে, এমন ভোগ নিবেদন করতে যা বাসী, দুর্গন্ধযুক্ত? কাজ আমার কাছে কাজ নয়, নৈবেদ্য। তার মধ্যে কোন ছল, কোন চাতুরী, কোন মলিনভাব আমি জ্ঞাতসারে থাকতে দেব না। End should not justify the means. আমার কাজের আগাগোড়া শুদ্ধ—পবিত্র।

রামকৃষ্ণ মিশনের সাধুরা কি করেন? তাঁরা ঈশ্বরলাভের জন্য ঘর-সংসার ছেড়েছেন। কিন্তু তাঁরা কেউ টাইপ করছেন, কেউ স্কুলে পড়াচ্ছেন, কেউ বাগানে কাজ করছেন, কেউ হাসপাতালে ওষুধ দিচ্ছেন, আরও কত সব করছেন। তাহলে সাধারণ গৃহস্থের সঙ্গে তাঁদের তফাতটা কি হল? তফাতটা হল এইখানে যে, তাঁরা এইসব কাজ করছেন ঈশ্বরের উদ্দেশে। কাজ করছেন না তাঁরা—ঈশ্বরের আরাধনা করছেন। এই প্রসঙ্গে আমাদের মঠের একটা মজার গল্প বলি। আমাদেরই একজন সাধু। গত হয়েছেন। খুব ভাল ছাত্র ছিলেন। এম এসসি-তে ফার্স্ট ক্লাস ফাস্ট হয়েছিলেন। বাবা ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেট—বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলে আই. সি.এস. হবে—কিন্তু ছেলে রামকৃষ্ণ মিশনের সাধু হয়ে গেলেন। বাবা মিশনের বিরুদ্ধে কোর্টে নালিশ করলেন। কিন্তু ছেলে কোর্টে গিয়ে বললেন—আমি সাবালক, আমি স্বেচ্ছায় সাধু হয়েছি। বাবা হেরে গেলেন। খুব অপমানিত বোধ করলেন তিনি। সঙ্গে রিভলভার নিয়ে একদিন মঠে গেছেন। ছেলেকে প্রথমে আসতে বলবেন, যদি না আসে তাহলে গুলি করে মারবেন। ছেলের কাছে গিয়ে দেখেন যে, ছেলে বসে বসে কুমড়ো কাটছে। তিনি বলছেন: আমি হাসব না কাঁদব! আমি ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেট—আর আমার ছেলে, যে ভেবেছিলাম আই. সি. এস. হবে, সে কিনা এখানে এসে কুমড়া কাটছে! ছেলেকে বললেন: যদি কুমড়ো কাটার জন্যই সাধু হয়ে থাকিস তাহলে বাড়ি ফিরে চল, গাড়ি গাড়ি কুমড়ো কিনে দেব। ছেলে বাবাকে প্রণাম করে বললেন: বাবা, আমি কুমড়ো কাটছি না। ঠাকুরের পুজো করছি। এই ভাব—সব তাঁর পুজো। আমি যখন প্রথম রামকৃষ্ণ সঙ্ঘে যোগ দিয়েছি সেইসময়কার একটা ঘটনা বলি। দেওঘরে আমাদের যে স্কুল ছিল সেখানে তখন পড়াতাম। একবার কয়েকদিনের জন্য মঠে এসেছি। একদিন আমাদের এক বৃদ্ধ স্বামীজী আমাকে ডেকে বললেন: এই চিঠিগুলো ডাকে যাবে, এগুলোতে স্ট্যাম্প লাগিয়ে দাও। এক গাদা চিঠি—আমি তাড়াহুড়ো করে টেরা-বাঁকা করে স্ট্যাম্প লাগিয়ে কাজ শেষ করেছি। তারপর সেই স্বামীজীর টেবিলে গিয়ে রেখে দিয়ে এসেছি। কিছুক্ষণ পরেই তাঁর কাছ থেকে আবার ডাক। আমি তো ভাবছি; সেরেছে! আবার স্ট্যাম্প লাগাতে হবে নাকি? গিয়ে দেখি, সেই স্বামীজী প্রতিটা স্ট্যাম্প জল দিয়ে খুলছেন আর সোজা করে লাগাচ্ছেন। আমি যেতেই বললেন: এই তোমার কাজের ছিরি! স্কুলে ছাত্রদের এরকম শিক্ষাই দাও বুঝি!—মারাত্মক কথা! আমি খুব লজ্জা পেয়ে গেলাম, বললাম: দিন, আমি আবার লাগাচ্ছি। তিনি বললেন: না, তোমার দৌড় খুব বুঝেছি! তোমাকে এ আর করতে হবে না। আসলে তিনি তো কাজটাকে শুধু ‘স্ট্যাম্প লাগানো’ মনে করছেন না। স্ট্যাম্প তো যেমন করেই লাগাই না কেন, চিঠি ঠিক চলে যাবে। তিনি মনে করছেন: এ হচ্ছে পূজা, শ্রীরামকৃষ্ণের পূজা। তাই এত যত্ন, এত সতর্কতা। স্বামী শুদ্ধানন্দ যখন ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, তখন বই বের করবার জন্য তাঁকে খুব পরিশ্রম করতে হত। মাঝে মাঝে রাত জেগেও প্রুফ দেখতে হত। কিন্তু তিনি বলতেন: এ প্রুফ দেখা না—মনে হচ্ছে যেন কালীপুজোর জন্য রাত জাগছি, কালীপুজোর আনন্দ পাচ্ছি। একটু আত্মপ্রশংসা হয়ে যায় অবশ্য—আমার কাছে অনেকেই বলে থাকেন যে, মিশনের যেসব আশ্রম আছে সব কী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সন্ন্যাসীরাই তো সব করছেন অথবা দেখাশুনা করছেন, কিভাবে এত পরিষ্কার রাখেন? অবাক হন তাঁরা। এর কারণ আর কিছু নয়, সাধুরা সব করছেন ঈশ্বরের পূজা জ্ঞানে। তাঁদের সঙ্গে যে-সব কর্মী আছেন—বেতনভুক অথবা স্বেচ্ছাসেবী—তাঁদের মধ্যেও সেই ভাবটি অনুপ্রবিষ্ট করিয়ে দেন তাঁরা। শুধু ঠাকুরঘর নয়, হাসপাতালই হোক আর স্কুলই হোক—সমস্ত আশ্রমটাই তাঁদের কাছে মন্দির। সমস্ত কাজই পূজা। আর সমস্ত জীবই তাঁদের কাছে দেববিগ্রহ। তাঁরা যে রোগীর সেবা করছেন, দুর্ভিক্ষে কাজ করছেন, বন্যার্তদের সাহায্য করছেন—এ মানবপ্রেম নয়, ঈশ্বরপ্রেম। জীবসেবা নয়, শিবজ্ঞানে জীবসেবা। স্বামীজী বলছেন: আর্ত-নারায়ণ, মূর্খ-নারায়ণ, দরিদ্র-নারায়ণ। নবযুগের মন্ত্র এই। মানুষ নয়—নারায়ণ। সংসারে যারা আছে তাদেরও এই ভাবটা নিতে হবে। যে যে কাজে আছে, তাকে ভাবতে হবে সেই কাজের মাধ্যমে সে যেন ঈশ্বরের সেবা করছে। স্বামীজী বলছেন: ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর? জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।’ ছাত্র ‘ছাত্র’ নয়—আমার ইষ্ট। পড়াচ্ছি তাকে—আমার ইষ্টকে পূজা করছি। রোগীর সেবা করছি—আমার ইষ্টকে পূজা করছি, তিনি আর্তরূপে এসেছেন আমার সেবা নিতে, কৃপা করে এসেছেন। আমি তাঁর সেবা করব, সেবা করে ধন্য হব আমি। স্বামীজী বলছেন: অবজ্ঞাভরে ভিখারির দিকে পাঁচটা পয়সা ছুঁড়ে দেওয়া নয়। শ্রদ্ধাভরে তাকে দান কর, দান করে কৃতার্থ হও। কারণ, তোমার চিত্তের মলিনতা দূর করার জন্য ঈশ্বর ঐ বেশে এসেছেন। তাঁর সেবা করে তুমি নিজেকে কৃতার্থ কর। মন্দিরের বিগ্রহ ‘অচল বিগ্রহ’। আর তোমার চারপাশে রয়েছেন ‘সচল বিগ্রহ’। সেই জাগ্রত দেবতার পূজা কর তুমি।

আমরা একটা কথা খুব শুনি, ‘dignity of labour’—শ্রমের মর্যাদা। প্রতিটি কাজই সম্মানের। স্বামীজী বলছেন: ১৮ ‘Each is great in his own place’—নিজের নিজের ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই বড়। ‘The scavenger in the street is quite as great and glorious as the king on his throne.’—রাস্তা ঝাড় দিচ্ছে যে-লোকটি আর সিংহাসনে আসীন যে রাজা—দুজনেই সমান বড়। কারণ, যে ঝাড়ুদার সে শ্রদ্ধার সাথে তার কাজ করে যাচ্ছে। আর রাজাও নিষ্ঠার সাথে রাজকার্য পরিচালনা করছেন। যদি নিজের নিজের কাজ তাঁরা যত্নের সাথে করেন, তাহলে দুজনের মধ্যে তফাৎ নেই কোন। কাজটা কি তা দিয়ে দুজনকে বিচার করা যাবে না। রাজা হয়তো রাস্তা ঝাড় দিতে গেলে মোটেই পারবেন না। আবার ঝাড়ুদার সেও রাজ্য চালাতে পারবে না। সমাজে সকলের যোগ্যতা সমান নয়। যোগ্যতা অনুযায়ী একেক জন একেকটা কাজ করে। এটা স্বাভাবিক। এই পার্থক্য প্রকৃতির নিয়ম। এ কখনও দূর করা যাবে না। কিন্তু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা পাল্টাতে হবে। স্বামীজী বলছেন: কাজ দিয়ে মানুষকে ছোট-বড় ঠিক করা হবে না। ছোট-বড় ঠিক করা হবে কাজটা সে কিভাবে করছে তা দিয়ে। ছোট-বড় ঠিক হবে চরিত্রগুণে। আমি সামান্য কাজ করছি, কিন্তু সেই কাজ আমি করছি নিষ্ঠার সাথে, সততার সাথে, ঈশ্বরের পূজা জ্ঞানে—তাহলে আমি সম্মানের পাত্র। আর যদি এমন হয় যে, একটা বড় পদ আমি আঁকড়ে আছি, কিন্তু আমি আমার কর্তব্য পালন করছি না, আমি সৎ নই, আমি স্বার্থবুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত—তাহলে যত বিদ্যাবুদ্ধি আমার থাকুক না কেন, মানুষ হিসাবে আমি অনেক নীচে—আমি সম্মানের যোগ্য নই। ঠিক একই কথা বলছেন আলেকজাণ্ডার পোপ :১৯ Honour and shame from no condition rise Act well your part, there all the honour lies.—সম্মান-অসম্মান বাইরের কোন বস্তুর উপর নির্ভরশীল নয়। তোমার করণীয় যেটুকু আছে সেটুকু তুমি ঠিকভাবে করে যাও। তা যদি হয়, কর্তব্যনিষ্ঠা যদি থাকে তোমার, তাহলেই তুমি সম্মানের যোগ্য। একটা গল্প আছে; এক যুবক সন্ন্যাসী কিছুদিন ধ্যানধারণা করেছেন, তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠা যদি থাকে তোমার, তাহলেই তুমি সম্মানের যোগ্য। একটা গল্প আছে: এক যুবক সন্ন্যাসী কিছুদিন ধ্যানধারণা করছেন, তাঁর কিছু অলৌকিক ক্ষমতা হয়েছে। একদিন এক গাছের নীচে বসে আছেন—গাছের উপরে একটা বক আর একটা কাক তখন নিজেদের মধ্যে লড়াই করছিল। কয়েকটা শুকনো পাতা তাঁর মাথায় পড়েছে। রেগে গিয়ে যেই তিনি উপর দিকে তাকিয়েছেন, অমনি কাক আর বক ভস্ম হয়ে গেছে। সেই সাধু এর কিছুক্ষণ পরে এক গৃহস্থবাড়িতে গেছেন ভিক্ষা করতে। ভিক্ষা চেয়েছেন, ভিতর থেকে বাড়ির বধূ বললেন: বাবা, একটু অপেক্ষা কর, আসছি। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। অপেক্ষা করছেন। কেউ আর আসেন না। সেই সাধু তখন খুব রেগে গেছেন, মনে মনে বলছেন: আমাকে অবজ্ঞা করছ? জান না, তো আমার ক্ষমতা! যেই এইকথা ভাবা, অমনি ভিতর থেকে সেই রমণী বলছেন: বাবা, এত অহঙ্কার কোরো না। আমি কাকও নই, বকও নই যে,আমাকে তুমি শাপ দিয়ে ভস্ম করে দেবে। আমি এখন আমার স্বামীর সেবা করছি। তাঁর সেবা না হয়ে গেলে আমি যেতে পারব না। সেই সাধু তো খুব অবাক হয়ে গেলেন। এ তো অসাধারণ নারী! কিছুক্ষণ পরে সেই মহিলা যখন ভিক্ষা নিয়ে বাইরে এলেন, সাধু তাঁকে প্রণাম করে জিজ্ঞাসা করলেন: মা, আপনি কি করে আমার মনের কথা জানলেন? মহিলা বললেন: আমি সাধনভজন কিছু জানি না, আমি শুধু মন প্রাণ দিয়ে আমার স্বামীর সেবা করি। সেই মহিলা তখন তাঁকে এক ব্যাধের কাছে পাঠালেন—ধর্মব্যাধ। ব্যাধের সাথে কথা বলে ব্রহ্মচারী বুঝলেন যে, সে যথার্থই জ্ঞানী। ব্যাধকে জিজ্ঞেস করলেন: কি করে আপনি জ্ঞানলাভ করলেন? ব্যাধ বললেন: আমি শ্রদ্ধার সাথে মাংস বিক্রি করি আর পিতামাতার সেবা করি। আমি যোগ জানি না, সংসারও ত্যাগ করিনি। সংসারে থেকেই আমার যা কিছু করণীয় অনাসক্তভাবে তা করে যাই। তাতেই আমি এই জ্ঞানলাভ করেছি।

এই কর্তব্যনিষ্ঠাই হোক বা কাজের প্রতি শ্রদ্ধাই হোক, ঈশ্বরের পূজা জ্ঞানে যে কাজ করে তার কাছে এই জিনিসগুলো খুব সহজ হয়ে আসে। ঈশ্বরকে ভালবাসি আমি। তাঁর কাজ করছি—প্রাণ ঢেলে সেই কাজ করব। আপাতদৃষ্টিতে সে কাজ যতই সামান্য হোক না কেন, আমার কাছে তা অসামান্য। কারণ, তার মাধ্যমে আমি আমার প্রিয়তমকে সেবা করার সুযোগ পাচ্ছি। এই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখলে আমাদের সমস্ত জীবনধারাটা পাল্টে যায়। শুধু ব্যক্তিগত জীবনধারা নয়—সমগ্র জাতির জীবনধারা। কোন কাজই ঐহিক নয়, যদি ঈশ্বরের উদ্দেশে করা যায়, তাহলে সব কাজই পারত্রিক। সব কাজই তখন ‘যোগ’ হয়ে যায়। নিবেদিতা তাই বলেছেন: ২০ ‘No distinction, henceforth, between sacred and secular’ পারমার্থিক আর ঐহিক এই দুয়ের মধ্যে কোন ভেদ থাকে না আর। ‘To labour is to pray.’ —কাজ তখন পুজো হয়ে দাঁড়ায়। ‘Life is itself religion.’—জীবনটাই হয়ে যায় ধর্ম। বলছেন: ‘To him, (Swami Vivekananda) the workshop, the study, the farmyard, and the field are as true and fit scenes for the meeting of God with man as the cell of the monk or the door of the temple.’—স্বামীজীর দৃষ্টিতে কারখানা, পড়ার ঘর এবং খেতখামার—সাধুর কুঠরি আর মন্দিরের মতোই ঈশ্বর আরাধনার উপযুক্ত স্থান। এই দৃষ্টিভঙ্গি যদি থাকে তাহলে আমি সংসারেই থাকি আর যেখানেই থাকি, আমি যা কিছু করছি তা তাঁরই কাজ, যা কিছু উচ্চারণ করছি, সবই তাঁর মন্ত্র। যা কিছু শুনছি সব তাঁর বাণী। সমস্ত কাজই উপাসনা। শরীর, মন, বাক্য দিয়ে যা কিছু করছি সবই তাঁর পূজা—Work is worship.

আকর-তালিকা

 । গীতা, ১৮/৫৯

 । ঐ, ১৮/৬০

 । ঐ, ১৮/৪৮

 । ঐ, ৩/৫

 । ঐ, ৩/১৯

 । ঐ, ২/৪৭

 । ঐ, ৪/২০

 । C.W., Vol. IV, 1962, P. 393

 । গীতা, ১৮/১৭

১০। শঙ্করভাষ্য, গীতা, ৩/১৯

১১। ঐ, ৩/৩০

১২। গীতা, ১৮/৫৭

১৩। ঐ, ৯/২৭

১৪। ঐ, ৯/২৮

১৫। শ্রীরামকৃষ্ণ পূজাপদ্ধতি, উদ্বোধন কার্যালয়, কলিকাতা, ১৩৯০, পৃঃ ৫২

১৬। গীতা, ৪/১৭

১৭। C.W., Vol.II, 1963, p.9

১৮। Ibid., Vol. I, 1962, pp. 36, 42

১৯। The Poetical Works Of Alexander Pope, 1956, ‘An Essay on Man.’ Epistle IV

২০। C.W., Vol. I, 1962, “Introduction, P. XV

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *