কর্মজীবন
বিদ্যালয় ছেড়ে প্রথমে ডিরোজিও বছর দুই সদাগরি অফিসে কেরানির চাকরি করেন। কিন্তু চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি হয়ে কেরানির একঘেয়ে কলম পেষার কাজ করতে কোনো তরুণেরই ভালো লাগার কথা নয়, তাঁরও ভালো লাগেনি। চাকরি ছেড়ে ভাগলপুরে কিছুদিনের জন্য তিনি বেড়াতে যান তাঁর মাসিমার কাছে। সেখানে তাঁর মেসোমশায় জনসন সাহেব নীলকুঠির মালিক ছিলেন। নীলচাষের বড়ো কেন্দ্র ছিল তখন ভাগলপুর অঞ্চল। নীল—ব্যবসায়ে মুনাফাও ছিল যথেষ্ট। কুঠিয়াল জনসনের অর্থের অভাব ছিল না। পরম নিশ্চিন্তে, প্রকৃতির মনোরম পরিবেশে, কিছুদিন তাঁদের স্নেহাশ্রয়ে থাকার সুযোগ পেয়ে ডিরোজিওর কিশোরচিত্ত কাব্যিক প্রেরণায় উদবুদ্ধ হয়ে উঠেছিল। তখন তাঁর বয়স বছর ষোলো। ভাগলপুর অঞ্চলের পাহাড় নদী বন উপবন তাঁর কাব্যপ্রতিভার মুকুলটিকে অগোচরে ফুটিয়ে তুলল। গঙ্গার তরঙ্গপ্রবাহ এবং মুঙ্গের ভাগলপুর ডালটনগঞ্জের গিরিশ্রেণির দিকে তাকিয়ে ডিরোজিও তন্ময় হয়ে যেতেন কাব্যিক কল্পনায়। তাঁর কিশোর—কল্পনা মূর্ত হয়ে উঠত শব্দের ছন্দে।
Ye waters-bright that beneath me roll!
Tell me, where is the light of my soul––
On the mountain-top, on the boundless main
By the pebbly beach, or the desert plain?
এই কাতর আকুলতা ‘The Maniac Widow’—র বেদনার প্রকাশ হলেও এর ভিতর দিয়ে ডিরোজিওর নিজের প্রেমোন্মুখ হৃদয়ের ব্যাকুলতাই প্রকাশ পেয়েছে। কিশোর কবি বিধবার অন্তরের কথায় নিজেরই মনের কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়েছেন।
এইভাবে কবিতা লিখে এবং সদাজাগ্রত কাব্যিক অনুভূতি দিয়ে প্রকৃতির বিচিত্র রূপ উপভোগ করে ডিরোজিওর ভাগলপুরের দিনগুলি নিশ্চিন্তে কেটে যেত। কলকাতায় ‘ইন্ডিয়া গেজেট’ পত্রিকার সম্পাদক গ্র্যান্টের কাছে কবিতাগুলি তিনি পাঠিয়ে দিতেন। Juvenis ছদ্মনামে তাঁর অনেক কবিতা ও সাহিত্যরচনা ‘ইন্ডিয়া গেজেট’—এ প্রকাশিত হয়েছে। গ্র্যান্টের সঙ্গে এই সময় থেকে লেখার সূত্রে একটা ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও তাঁর গড়ে উঠেছিল। প্রধানত গ্র্যান্টের পোষকতায় ও উৎসাহে তাঁর কাব্য ও সাহিত্য অনুশীলন অবাধে চলতে থাকে, সাংবাদিকতার কলাকৌশলও তিনি আয়ত্ত করেন, এবং অল্পকালের মধ্যেই সুধীমহলে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। মনে হয় বছরখানেকের বেশি ভাগলপুরের থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি, কারণ ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি তিনি কলকাতার হিন্দু কলেজের শিক্ষকের পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন বলে সংবাদ পাওয়া যায়। সংবাদটি এই—
ইংরেজি পাঠশালায় ডিয়ারম্যান নামক একজন গোরা আর ডি রোজি সাহেব এই দুইজন নূতন শিক্ষক নিযুক্ত হইয়াছেন।*
হিন্দু কলেজের চতুর্থ শিক্ষকের পদে ডিরোজিও নিযুক্ত হন। তখন তাঁর বয়স সতেরো বছর।
১৮১৭, ২০ জানুয়ারি হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলা দেশে ও ভারতবর্ষে ইংরেজি—শিক্ষার সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠান হল হিন্দু কলেজ। আলেকজান্ডার ডাফ ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে ‘সিলেক্ট কমিটি’র কাছে এক বিবৃতি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘It was the very first English Seminary in Bengal, or even in India, as far as I know.’ হিন্দু কলেজ তখন ‘জুনিয়র’ ও ‘সিনিয়র’ দুই ভাগে বিভক্ত ছিল, একটিকে ‘পাঠশালা’ ও আর—একটিকে ‘মহাপাঠশালা’ বলা হত। জাস্টিস হাইড ইস্ট ও ডেভিড হেয়ার কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিশেষ উদযোগী হলেও, প্রধানত সম্ভ্রান্ত বাঙালিরাই এই ধরনের ইংরেজি—শিক্ষার একটি বিদ্যালয় স্থাপনের সংকল্প করে পরম উৎসাহে অগ্রসর হয়েছিলেন। আর্থিক সংগতি তাঁদের সকলেরই প্রায় ছিল বলে, সরকারি পোষকতার চিন্তা প্রারম্ভেই তাঁদের করতে হয়নি। বিশিষ্ট বাঙালি—প্রধান ‘ম্যানেজিং কমিটি’ বা ‘অধ্যক্ষসভা’র অধীনে সূচনা থেকেই হিন্দু কলেজ অবাধে তার উদ্দেশ্যসাধনের পথে যাত্রা করতে পেরেছিল। কলেজের ‘গভর্নর’ ছিলেন গোপীমোহন ঠাকুর ও বর্ধমানরাজ তেজচন্দ্র বাহাদুর। কিছুদিন পরে কমিটি যখন সরকারি সাহায্যের জন্য আবেদন করেন, তখন কলেজের ‘ভিজিটার’ বা ‘পরিদর্শক’ নিযুক্ত হন। ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে প্রাচ্যবিদ্যাবিদ উইলসন কলেজের পরিদর্শক—পদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
হিন্দু কলেজ যখন প্রথম স্থাপিত হয়, তখন এ দেশের সাধারণ লোকের মধ্যে তো নয়ই, উচ্চশ্রেণির মধ্যেও ইংরেজি—শিক্ষার আগ্রহ তেমন জাগেনি। উচ্চশ্রেণির অতি সংকীর্ণ একটা গোষ্ঠীর মধ্যে এই আগ্রহ সীমাবদ্ধ ছিল, বিশেষ করে ইংরেজি—শিক্ষার সঙ্গে ইংরেজের প্রসাদলাভের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আর্থিক ক্ষেত্রে যাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে। ইংরেজি তখন সরকারি ভাষা বলে এ দেশে গৃহীত হয়নি, কেবল আইন—আদালত ও ব্যাবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে আধা—সরকারিভাবে চলিত হয়েছে। সেসব ক্ষেত্রেও যেখানে ইংরেজের সান্নিধ্যে আসতে হত, কেবল সেখানেই যৎসামান্য ইংরেজি—জ্ঞানের আবশ্যক হত। সুতরাং হিন্দু কলেজের আদিকালে, উনিশ শতকের প্রথম পর্বে, যদি দেশের সাধারণ লোকের মধ্যে ইংরেজি—শিক্ষার আবশ্যকতাবোধ না জেগে থাকে তাহলে বিস্মিত হবার কিছু নেই। শোনা যায়, প্রথমে জন কুড়ি ছাত্র নিয়ে কলেজের ক্লাস আরম্ভ হয়েছিল। তখনকার দিনে এই কুড়িজনকেই ‘অনেক’ বলতে হবে। কুড়িজন থেকে ধীরে ধীরে পাঁচ—ছ’বছরে ছাত্রসংখ্যা ষাট—সত্তরজন পর্যন্ত হয়। এই বৃদ্ধি খুব আশাপ্রদ না হলেও উপেক্ষণীয় নয়। কিন্তু ক্রমেই ‘অধ্যক্ষসভা’র সভ্যদের নানা বিষয়ে মতানৈক্যের জন্য বিদ্যালয়ের দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। ইংরেজ সদস্যরা অনেকেই বিরক্ত হয়ে পদত্যাগ করেন, শুধু ডেভিড হেয়ার হাল ছাড়েননি। ১৮২২—২৩ খ্রিস্টাব্দের কথা। এই সময় ডেভিড হেয়ার উদযোগী হয়ে বিদ্যালয়ের প্রতি সরকারের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেন। এর পর থেকেই বিদ্যালয়ের সঙ্গে সরকারের যোগসূত্র স্থাপনের জন্য ‘ভিজিটার’ নিযুক্ত হন। ডাফ বলেছেন, ‘and it was in this way that the British Government was first brought into active participation in the cause of English Education.’
হেয়ারের পরিদর্শনের আমলে বিদ্যালয়ের উন্নতি হতে থাকে এবং উইলসনের দূরদর্শিতার ফলে তার উন্নতির পথের বহু বাধাবিপত্তি অপসারিত হয়ে যায়। ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের রিপোর্টে হিন্দু কলেজের শিক্ষার উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে উইলসন বলেন, ‘The general result of the operations of the Hindu College is to give the students a considerable command of the English language to extend their knowledge of History, Geography and to open to them a view of the objects and means of Science.’ ইংরেজি ভাষায় ও সাহিত্যে, ইতিহাসে, ভূগোলে ও বিজ্ঞানে ছাত্রদের শিক্ষা নেওয়াই হিন্দু কলেজের প্রধান লক্ষ্য ছিল। কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও পৃষ্ঠপোষকরা এই বিদ্যালয়ের ভিতর দিয়ে পাশ্চাত্য জ্ঞান—বিজ্ঞানের ধারা হিন্দুস্থানের নব্যশিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। হিন্দু কলেজ হবে, ‘The main channel by which real knowledge may be transferred from its European sources into the intellect of Hindusthan.’—এই ছিল পরিকল্পকদের বাসনা।
বিদ্যালয়ের এই উদ্দেশ্য বা আদর্শ কোনো কিছুর সঙ্গেই তরুণ ডিরোজিওর আদৌ কোনো বিরোধ ছিল না। যখন তিনি কলেজের শিক্ষক নিযুক্ত হলেন, উইলসন তখন পরিদর্শক। পরিদর্শকের বাৎসরিক বিবরণীতে হিন্দু কলেজের এই উদ্দেশ্য তিনি বারংবার সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন। তরুণ কবি ডিরোজিওর কৈশোরের স্বপ্ন নব্যশিক্ষার এই অনুকূল পরিবেশ বাস্তবে মূর্ত হয়ে ওঠার জন্য যদি ব্যাকুল হয়ে থাকে তাহলে তা অস্বাভাবিক হয়নি। অথচ কলেজে শিক্ষক নিযুক্ত হবার পর মাত্র চার—পাঁচ বছরের মধ্যে ঘটনাচক্রে আদর্শচ্যুতির অপরাধে তাঁর পদচ্যুতি ঘটল। নবযুগের সত্যকার আদর্শকে ডিরোজিও যখন চোখের সামনে তুলে ধরলেন, তখন তার প্রকৃত রূপ দেখে কলেজের প্রতিষ্ঠাতারা অনেকে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন। ডিরোজিও তাঁদের সেই সন্ত্রাসে অগ্নিসংযোগ করলেন।
ডিরোজিওর শিক্ষকতাকালে ছাত্রদের শিক্ষার মান ও অগ্রগতি যে অব্যাহত ছিল তা উইলসনের রিপোর্ট থেকে বোঝা যায়। ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে, পরীক্ষা রীতিমতো কঠিন হওয়া সত্ত্বেও, উইলসন সিনিয়র ছাত্রদের ইংরেজি রচনাশক্তি দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি রিপোর্ট লেখেন যে কলেজের প্রথম শ্রেণির ছাত্ররা পোপের কবিতা, মিলটনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ এবং শেক্সপিয়রের ভালো—ভালো নাটকগুলি সম্বন্ধে বেশ চমৎকার জ্ঞানলাভ করেছে। এ ছাড়া তিনি লিখেছেন, ইতিহাস দর্শন গণিত ও বিজ্ঞানেও তারা বেশ ভালো শিক্ষা পেয়েছে মনে হয়। ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে উইলসন যখন পরিদর্শক নিযুক্ত হন, তখন প্রথম শ্রেণির ছাত্ররা Tagg—এর Book of Knowledge এবং Enfield—এর Speaker পাঠ করত, এবং তাতে যেটুকু শিক্ষা তাদের হত, তার চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষা এখন (১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে) পঞ্চম শ্রেণির ছাত্ররাই পেয়ে থাকে। আর এখনকার প্রথম শ্রেণির ছাত্রদের সঙ্গে আগেকার প্রথম শ্রেণির ছাত্রদের কোনো তুলনা হয় না : ‘Whilst those of the present first class, admit of no comparison with anything yet effected by the College, and far exceed the expectation which I then expressed or entertained.’ ছাত্রদের কৃতিত্ব উইলসনের নিজের কাছেই অপ্রত্যাশিত মনে হয়েছিল।
১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ স্থাপিত হবার পর প্রায় সাত—আট বছরের মধ্যে ছাত্রসংখ্যা বিশেষ বাড়েনি বললেই হয়। ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ছাত্রসংখ্যা গড়ে একশতের বেশি ছিল না, তার মধ্যে ২৪ জন ছিল পে—স্কলার, বাকি সকলে বিনা বেতনে পড়ত। ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে পে—স্কলারের সংখ্যা ধীরে ধীরে বেড়ে ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দের শেষে ২২৩ জন ১৮২৭—এর শেষে ৩০০ জন এবং ১৮২৮—এর শেষে ৩৩৬ জন হয়। মোট ছাত্রসংখ্যা ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ছিল ৪৩৬ জন। ১৮৫০—৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দেখা যায় পে—স্কলারের সংখ্যা গড়ে ৪৫০ জনের বেশি হয়নি। কিন্তু হঠাৎ ১৮২৯—৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে দেখা যায়, দু—তিন বছর ধরে ছাত্রসংখ্যা ক্রমে কমতে থাকে।
এর কারণ বিশ্লেষণ করে J.Kerr সাহেব বলেছেন :
The falling off… was supposed to be owing partly to the establishment of other schools, partly to the commercial distress which prevailed at that period, and partly to a panic among the natives caused by a supposed interference with the religion of the boys who, under the influence of Mr. Derozio, were fast losing their respect for the venerable customs of their forefathers.
অন্যান্য আরও স্কুল প্রতিষ্ঠা ও আর্থিক সংকটের কথা কের সাহেব হিন্দু কলেজের ক্রমাবনতির কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কারণ হল, শিক্ষক ডিরোজিও ও তাঁর ছাত্রবৃন্দকে কেন্দ্র করে তখন কলেজের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে যে প্রবল আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তাতে অভিভাবকরা শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন। ১৮২৯ থেকে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিক্ষোভের এই ঝড় বয়ে গিয়েছিল কলকাতায়।
কিন্তু হঠাৎ কী কারণে এমন অভাবনীয় অবস্থার সৃষ্টি হল, যার জন্য দু’এক বছরের মধ্যে তরুণ শিক্ষক ডিরোজিও সমগ্র হিন্দুসমাজের সামনে অপরাধীর বেশে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বাধ্য হলেন। পরিদর্শকের রিপোর্টে আমরা দেখেছি যে, ডিরোজিওর আমলে কলেজের ক্রমিক উন্নতি ছাড়া অবনতি হয়নি। শিক্ষার মানের দিক থেকে বিচার করে, এবং ইংরেজি দর্শন—সাহিত্য—ইতিহাস—বিজ্ঞান প্রভৃতি প্রত্যেক বিষয়ে ছাত্রদের উন্নতি লক্ষ করে উইলসন নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। শুধু যে শিক্ষার মান উন্নীত হয়েছিল তা নয়, বিদ্যালয়ের বৈতনিক ছাত্রসংখ্যাও ডিরোজিওর আমলে দু’তিন বছরের মধ্যে দ্রুতহারে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ডিরোজিওর শিক্ষানীতির উপর অভিভাবক ও ছাত্রদের যদি আশানুরূপ আস্থা না থাকত তাহলে বোধহয় বিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা বাড়ত না। এই কারণেই প্রশ্ন জাগে মনে যে, হঠাৎ কোথা থেকে কী এমন কারণের উৎপত্তি হল, যাতে বিক্ষোভ ধূমায়িত হয়ে উঠল ডিরোজিওর বিরুদ্ধে, এবং অবশেষে তাঁরই মাথার উপর গোঁড়া হিন্দুসমাজের পুঞ্জীভূত আক্রোশের মেঘ সশব্দে ফেটে পড়ল?
যদিও ড্রামন্ডের মতো ডিরোজিওর সমাধিফলকে তাঁর শিক্ষকতার কোনো গুণের কথা খোদাই করা নেই, তাহলেও গুরু ড্রামন্ডের মতোই ডিরোজিও ছিলেন—‘a successful teacher of youth’—তরুণদের একজন সার্থক শিক্ষক। হিন্দু কলেজে আরও অনেক শিক্ষক ছিলেন, কোনো—কোনো বিষয়ে ডিরোজিওর চেয়ে তাঁরা হয়তো বেশি অভিজ্ঞ ও জ্ঞানীগুণী ছিলেন, ভালো পড়াতেও পারতেন। কিন্তু কলেজের রেজিস্টার—খাতায় ছাড়া—ইতিহাসের পাতায় তাঁরা কোনো স্বাক্ষর রেখে যেতে পারেননি। তার কারণ বিদ্যাবুদ্ধি পাণ্ডিত্য নিষ্ঠা কর্মক্ষমতা সব তাঁদের থাকলেও, ডিরোজিওর মতো ব্যক্তিত্ব ও চুম্বক—চরিত্র ছিল না। তাঁদের পাণ্ডিত্যের ওজন ছিল, কিন্তু তাতে প্রতিভার দীপ্তি ছিল না। পাণ্ডিত্যের ভারের চেয়ে ডিরোজিওর প্রতিভার দীপ্তি ছিল বেশি, তাই বিদ্যা যেটুকু তাঁর ছিল তা প্রতিভার মন্ত্রস্পর্শে জ্বলে উঠত চকমকির মতো। ছাত্ররা তাঁর সান্নিধ্যে আসত, তারা কেবল বিদ্যার হিমশীতল পাথুরে চাপ সহ্য করত না, প্রতিভা—স্ফুলিঙ্গের উত্তাপও অনুভব করত। গুরু—শিষ্য, শিক্ষক—ছাত্রের মধ্যে তো নিশ্চয়ই—মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কেও যেখানে কেবল বাধ্যবাধকতার চাপ থাকে, মনের কোনো তাপ থাকে না, সেখানে পরস্পরের বন্ধন কদাচ অকৃত্রিম হয় না, এবং স্বাভাবিক কারণেই তা হতে পারে না। ডিরোজিওর সঙ্গে তাঁর ছাত্রদের যে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, অকৃত্রিম মানবিক বন্ধনের মতো অন্তরঙ্গ ছিল বলেই বাইরের জনসমাজে তার প্রকাশ হয়েছিল চোখ ঝলসানো বিদ্যুৎচমকে।
ডিরোজিওর নিজের ছাত্ররাই এই মানবিক সম্পর্কের কিছু—কিছু বিবরণ দিয়ে গেছেন। রাধানাথ শিকদার লিখেছেন যে, ডিরোজিওর সামান্য বিদ্যাভিমান থাকলেও তাঁর মতো সহানুভূতিশীল স্নেহপ্রবণ শিক্ষক তখনকার শিক্ষায়তনে বাস্তবিকই দুর্লভ ছিল। কোনো বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার আগে তিনি পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিতেন শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কী। ছাত্ররা তাতে যে কত লাভবান হত বলা যায় না। কেবল বিদ্যাশিক্ষা করেই তারা ক্ষান্ত হত না, বাস্তব জীবনে ও সমাজে তার প্রত্যক্ষ প্রয়োগ—প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় তারা চঞ্চল হয়ে উঠত। আর কোনো শিক্ষক ছাত্রদের মনে এরকম প্রেরণা জাগাতে পারতেন না। রাধানাথ নিজে তাঁর কাছে সাহিত্য ও দর্শনশাস্ত্রে জ্ঞানলাভ করে বিশেষ উপকৃত হয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন যে, শুধু বিভিন্ন পুঁথিগত বিদ্যাতেই তাঁদের শিক্ষা শেষ হয়ে যায়নি। মানুষের জীবনের সবচেয়ে যে মহৎ শিক্ষা সত্যের প্রতি অবিচলিত নিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতি বিজাতীয় ঘৃণা, তা—ও তাঁরা তাঁদের তরুণ শিক্ষক ডিরোজিওর কাছ থেকে লাভ করেছিলেন।
ডিরোজিওর ছাত্র নন, অথচ সেকালের একজন বিশিষ্ট প্রত্যক্ষদর্শী হিন্দুসমাজ—পরিত্যক্ত আর—একজন প্রতিভাবান বাঙালি—সন্তান রেভারেন্ড লালবিহারী দে, ডিরোজিও ও তাঁর ছাত্রদের সম্বন্ধে যা লিখে গেছেন তা প্রণিধানযোগ্য। ডিরোজিওর মৃত্যুর বছর তিনেক পরে ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে লালবিহারী দে, লেখাপড়া শেখার জন্য প্রথম কলকাতায় আসেন। ডিরোজিয়ান যুগের কলরব তখনও শান্ত হয়নি। গুরুর মৃত্যুর পর ‘ইয়াং বেঙ্গল’ দল দ্বিগুণ উৎসাহে তাঁর আদর্শ প্রচারে অগ্রসর হয়েছিলেন। তারুণ্যের উৎসাহে এই পরিবেশের সঙ্গে মুখোমুখি পরিচয় ছিল লালবিহারী দে—র। ডিরোজিও সম্বন্ধে নানা রকমের কথা তিনি তাঁর ছাত্রদের মুখ থেকে শুনেছিলেন। তিনি লিখেছেন :
‘হিন্দু কলেজের তরুণ ছাত্ররা বেকন (Bacon), লক (Locke), বার্কলে (berkeley), হিউম (Hume), রীড (Reid), স্টুয়ার্ট (Stewart), প্রমুখ পাশ্চাত্য দার্শনিকদের শ্রেষ্ঠ রচনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় লাভ করেন। এই পরিচয়ের ফলে তাঁদের গতানুগতিক চিন্তাধারার এক বৈপ্লবিক আলোড়নের সূত্রপাত হতে থাকে। প্রত্যেক বিষয়ে তাঁরা প্রশ্ন করতে ও তর্ক করতে আরম্ভ করেন। তার ফলে তাঁদের অনেক প্রচলিত বদ্ধমূল ধারণার মূল নড়ে যায়, বহুকালের বাছা—বাছা সব আস্থার স্তম্ভ টলমল করে ওঠে। এই নতুন শিক্ষার অপ্রতিদ্বন্দ্বী গুরু ছিলেন ডিরোজিও। হিন্দুকলেজে তিনি ছাত্রদের যে ক্লাস করতেন তার আবহাওয়াই ছিল অন্যরকম। তাঁর পড়াবার পদ্ধতি ছিল একেবারে স্বতন্ত্র। ছাত্ররা তাঁর ক্লাসে শিক্ষার যে নতুন আস্বাদ পেতেন তা আর কোথাও বিশেষ পাওয়া যেত না। ডিরোজিওর প্রধান লক্ষ্য ছিল, ছাত্রদের মনে তীব্র জ্ঞানানুসন্ধিৎসা জাগিয়ে তোলা। হয়তো ছোটো বিষয়ের সঙ্গে বড়ো বিষয়ের তুলনা করা হবে, কিন্তু তা হলেও ডিরোজিওর ক্লাসের সঙ্গে একমাত্র প্লেটো ও আরিস্ততলের ‘অ্যাকাডেমি’র তুলনা করা যায়। ক্লাসরুমের বদ্ধ পরিবেশের মধ্যে স্বভাবতঃই বিষয়ালোচনার স্বাচ্ছন্দ্য ও গাম্ভীর্য বজায় রাখা কঠিন হত। ডিরোজিও তাই কলেজের বাইরে তাঁর বাড়ির বৈঠকখানায় ছাত্রদের আহ্বান করতেন। সেখানকার স্বচ্ছন্দ পরিবেশে আলোচনা আরও ভালোভাবে জমে উঠত, শিক্ষক ও তাঁর ছাত্ররা সকলেই মন খুলে অবাধে কথাবার্তা বলার সুযোগ পেতেন। কিছুদিনের মধ্যে বৈঠকখানার পরিবেশও আলোচনার পক্ষে যথেষ্ট অনুকূল নয় মনে হল। তখন তিনি ছাত্রদের নিয়ে বাইরে একটি পাঠচক্র ও বিতর্কসভা গড়ে তুললেন।’
ডিরোজিও কী শিক্ষা দিতেন ও কেমন করে শিক্ষা দিতেন, তার খানিকটা পরিচয় পাওয়া গেল। ছাত্রদের চেয়ে শিক্ষক বয়সে মাত্র তিন—চার বছরের বড়ো ছিলেন, প্রাচীনকালের প্রবীণ গুরুমশায় ও ঋষিদের সঙ্গে তার তুলনা করা চলে না। বিদ্যাভিমান খানিকটা ডিরোজিওর ছিল বলে তাঁর ছাত্রদের মধ্যে কেউ—কেউ উল্লেখ করেছেন বটে, কিন্তু সেই অভিমানের প্রাচীর তুলে তিনি ছাত্রদের কখনো দূরে ঠেলে রাখেননি। বয়সের দিক থেকে ছাত্রদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মেলামেশার যে সুযোগ ছিল, তার সদব্যবহার তিনি পূর্ণমাত্রায় করেছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রবল আকর্ষণে ছাত্ররা মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে গেছে তাঁর দিকে, কোনো সংকোচ বা বাধা মানেনি। শিক্ষকের প্রতিভা, পাণ্ডিত্য ও চরিত্রের গভীর আধ্যাত্মিক প্রভাব ছাত্রদের মনে তাই অমন করে দাগ কেটে গেছে। ডিরোজিওর ছাত্ররা তাই যে কেবল সুশিক্ষিত হয়েছেন তা নয়, সমাজে চরিত্রবান বলিষ্ঠ মানুষ হিসেবেও সমাদর পেয়েছেন।
ডিরোজিওর এই শিক্ষাপদ্ধতির অভিনবত্ব কী? অন্যদের সঙ্গে তার পার্থক্যই বা কোথায়? পুঁথিগত বিদ্যা কোনোরকমে ছাত্রদের মাথায় ঠেসে দেবার পক্ষপাতী ছিলেন না ডিরোজিও। মুখস্থ করে পরীক্ষায় পাস মার্ক পাওয়া এবং প্রতিযোগিতায় লটারির মতো জয়লাভ করার যে আদর্শ, ডিরোজিও শিক্ষক হিসেবে তা আদৌ পছন্দ করতেন না, অথবা ছাত্র হিসেবে ছাত্রদেরও তার প্রতি অনুরাগী হতে উপদেশ দিতেন না। তিনি বলতেন, শিক্ষার্থীর মনে জ্ঞানবিদ্যার অনির্বাণ আগ্রহ ও আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলাই শিক্ষকের উদ্দেশ্য ও আদর্শ হওয়া উচিত। শিক্ষক—জীবনে তিনি এই আদর্শই মেনে চলতেন। দর্শন—সাহিত্য বা যে—কোনো বিষয় নিয়ে যখন তিনি আলোচনা করতেন, তখন পাঠ্যপুস্তকের সংকীর্ণ সীমানা ছাড়িয়ে বিষয়বস্তুর অনন্ত দিগন্তে একটার পর একটা রহস্যের দ্বার উদঘাটন করতে—করতে তিনি যেন অভিযান করতেন মনে হয়। আলোচনার আকর্ষণে আত্মহারা হয়ে তিনি বিস্মৃত হতেন তাঁর গতানুগতিক কর্তব্যের কথা। ছাত্ররাও ভুলে যেত ক্লাসের ও পাঠ্যবস্তুর বন্ধনের কথা। মনে তাদের প্রশ্নের পর প্রশ্নের ঢেউ উঠত, অজানাকে জানার, অনায়ত্তকে আয়ত্ত করার ব্যাকুলতা বাড়ত। সোৎসাহে তারা প্রশ্ন করত, নানাদিক থেকে নানা রকমের প্রশ্ন। ডিরোজিও সেই উৎসাহে ক্রমাগত ইন্ধন জোগাতেন। সর্বদা শিক্ষকই যেসব প্রশ্নের জবাব দিতেন তা নয়, ছাত্ররা নিজেরা প্রশ্ন করে নিজেরাই তার জবাব দেওয়ার চেষ্টা করত। এই বন্ধনহীন বিষয়ালোচনার মধ্যে ডিরোজিওর ক্লাসটিকে আর কলেজের বাঁধাধরা ক্লাস বলে মনে হত না, বিতর্কসভা বলে মনে হত। শিক্ষাক্ষেত্রে এই স্বাতন্ত্র্যের জন্যই ডিরোজিও তরুণ বয়সে বাংলার নবীন ছাত্রসমাজে অপ্রত্যাশিত প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদা লাভ করেছিলেন।
এই ধরনের স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করার পক্ষে কলেজের ক্লাসরুম ক্রমে সংকীর্ণ মনে হতে লাগল। কলেজ থেকে ডিরোজিওর বাড়ির বৈঠকখানায় আলোচনাসভা স্থানান্তরিত হল। তাতেও আলোচনার আশানুরূপ স্ফূর্তি সম্ভব হল না। অবশেষে মানিকতলায় শ্রীকৃষ্ণ সিংহর বাগানবাড়ির ঘরে, সভার নিয়মিত বৈঠক বসতে আরম্ভ করল। সভার নাম দেওয়া হল ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ (Academic Association)। মনে হয়, ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দ থেকেই এই আলোচনাসভার ঘরোয়া বৈঠক নিয়মিতভাবে শুরু হয়ে গিয়েছিল। ১৮২৮—২৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই এই ‘অ্যাকাডেমিক’—এর খ্যাতি ও প্রভাব বাইরে বেশ ছড়িয়ে পড়েছিল দেখা যায়। বাগানবাড়ির নিভৃত গৃহকোণ থেকে বাইরের বৃহত্তর সমাজের মুক্ত প্রাঙ্গণে রীতিমতো শোরগোল তুলেছিল তরুণ ছাত্রদের এই বিদ্বৎসভা। বিচক্ষণ প্রবীণ প্রাজ্ঞরাও তরুণদের এই সভায় যোগদান করার লোভ সংবরণ করতে পারতেন না। রেভারেন্ড লালবিহারী দে লিখেছেন :
In this grove of Academus, and the debating society had a garden attached to it, being held on the premises now occupied by the Ward’s Institution, did the choice spirits of Young Calcutta hold forth, week after week, on the social, moral and religious questions of the day. The general tone of the discussions was a decided revolt against existing religious institutions… The young lions of the Academy roared out week after week ‘Down with Hinduism! Down with Orthodoxy.’
বাংলার তরুণ সিংহশাবকদের গগনভেদী গর্জন শোনা যেত মানিকতলার বাগানবাড়িতে, যাবতীয় ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে, নৈতিক ভণ্ডামি ও নোংরামির বিরুদ্ধে, কুপ্রথা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, বিচারবুদ্ধিহীন শাস্ত্রবচনের বিরুদ্ধে, প্রাণহীন চিরাচরিত আচার—অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে, জাতিভেদ ও পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রিক অর্থনৈতিক ও মানসিক জড়ত্বের বিরুদ্ধে, এমনকী মধ্যে—মধ্যে দেবতার অস্তিত্বের বিরুদ্ধে পর্যন্ত। ঘরে—বাইরে তার প্রতিধ্বনি হত। ঘর কাঁপত, সমাজও কাঁপত।
সদাপ্রসন্নমুখ ডেভিড হেয়ার আসতেন সবুজ রঙের কোট পরে যুবক সেজে। যৌবনসুলভ সরলতা তাঁর চলাফেরার পদে—পদে ফুটে উঠলেও, তরুণ ডিরোজিয়ানদের সভায় যোগদান করে তিনি যেন তারুণ্যের স্পর্শে পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠতেন। উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের প্রাইভেট সেক্রেটারি আসতেন, বিশপ’স কলেজের অধ্যক্ষ মিলস সাহেব আসতেন, কলকাতার সুপ্রিমকোর্টের চিফ—জাস্টিস আসতেন। বিদ্যোৎসাহী আরও অনেকে আসতেন প্রলুব্ধ হয়ে, বাধা মানতেন না। ডিরোজিও সভাপতি, সম্পাদক উমাচরণ বসু। সদস্য ও বক্তাদের মধ্যে প্রতিভাবান হলেন কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক এবং ডিরোজিওর অন্যান্য প্রিয় ছাত্ররা। সভা কীভাবে পরিচালনা করা হত তার বিবরণ দিয়ে গেছেন প্রত্যক্ষদর্শী আলেকজান্ডার ডাফ। তিনি লিখেছেন :
Opportunities were constantly presented for the advancement of counteracting statements and opinions on almost all subjects. When a topic for debate was selected, individuals were not appointed to open the discussion on either side as is customary in this country. Their theory was, that, as professing inquiries after truth, they ought not to do violence to any-one’s conscience, by constraining him to argue against his own settled convictions. All were therefore left alike free in their choice; hence it not ifrequently happened that more than half a dozen followed in succession on the same side. After all the members who were disposed had concluded, the strangers of visitors present were invited to deliver their sentiments on the leading subject of the evening’s discussion, or on any of the sentiments expressed by the different speakers in the course of it, It is scarcely necessary to add, that to this invitation it was ever felt a privilege to respond.
এমন কোনো বিষয় ছিল না, যা নিয়ে সভায় আলোচনা হত না। কেবল বিষয়ের নয়, আলোচনার স্বাচ্ছন্দ্য ও বিতর্কের রীতিরও এমন অভিনবত্ব ছিল, যা তখনকার সভাসমিতিতে তো বটেই, আজকালকার অতি আধুনিক বিদ্বৎসভাতেও সাধারণত দেখা যায় না। এই অভিনবত্বের জন্যই ডাফ সাহেবের বর্ণনা তাঁর নিজের ভাষাতেই উদ্ধৃত করার প্রয়োজন হল। বিতর্কসভার প্রচলিত রীতি হল, আলোচ্য বিষয়বস্তুর পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করে যে—কেউ একজন সভার কাজ শুরু করেন। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ একটা যান্ত্রিক রীতি, কারণ বক্তাদের মতামতটা এখানে গৌণ, তর্কের খাতিরে তর্কটা হল মুখ্য। ডিরোজিওর অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনে এই গতানুগতিক রীতি বর্জন করে বক্তাদের ব্যক্তিগত মতামত অবাধে প্রকাশ করার সুযোগ দেওয়া হত। কারণ ‘ইয়াং বেঙ্গল’—এর এই সভার সমস্ত আলোচনার ও তর্কবিতর্কের একমাত্র লক্ষ্য ছিল, প্রকৃত সত্য কী তা—ই অনুসন্ধান করা। সেইজন্য কোনো বিষয়ের পক্ষে বা বিপক্ষে হয়তো প্রথমেই একাধিক বক্তা তাঁদের বক্তব্য নিবেদন করতেন। এইভাবে অবাধে আলোচনা ও তর্ক চলত। মনে হত যেন কূলকিনারাহীন জ্ঞানসমুদ্রে, সত্যের অজানা দ্বীপে পৌঁছোবার উদ্দেশ্যে, একদল নাবিক একই জাহাজের ডেকের উপর দাঁড়িয়ে পথের নিশানা নিয়ে ব্যাকুল হয়ে আলাপ—আলোচনা করছে।
সভার সভ্যদের আলোচনা শেষ হবার পর আমন্ত্রিত ও উপস্থিত অতিথিদের আহ্বান করা হত প্রতিপাদ্য বিষয় সম্বন্ধে তাঁদের মতামত নিঃসংকোচে ব্যক্ত করার জন্য। এবং অতিথিরা, যতই জ্ঞানীগুণী ও প্রবীণ হন—না কেন, এই আমন্ত্রণে সকলেই বিলক্ষণ উৎসাহিত হয়ে সাড়া দিতেন। তার কারণ, প্রত্যেকটি বিষয়ে আলোচনার মান এত উন্নত ছিল যে, সভাটিকে তরুণ ছাত্রদের সভা বলেই মনে হত না। এই আলোচনার মান সম্বন্ধেও ডাফ সাহেব যা বলেছেন তা তাঁর নিজের ভাষাতেই উল্লেখ করতে হয়।
The sentiments delivered were fortified by oral quotations from English authors. If the subject was historical, Robertson and Gibbon were appealed to; if political, Adam Smith and Jeremy Bentham; if scientific, Newton and Davy; if religious, Hume and Thomas Paine; if metaphysical, Locke and Reid, stewart and Brown. The whole was frequentlly interspersed and enlivened by passage cited from some of our most popular English poets, particularly Byron and Sir Walter Scott. And more than once were my ears greeted with the sound of Scotch rhymes from the poems of Robert Burns.
প্রত্যেক বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করার সময় বক্তারা ইংরেজি সাহিত্য থেকে ভালো কথা অনর্গল আবৃত্তি করতেন। ঐতিহাসিক বিষয় হলে রবার্টসন ও গিবন, রাজনৈতিক বিষয় হলে অ্যাডাম স্মিথ ও জেরেমি বেন্থাম, বৈজ্ঞানিক বিষয় হলে নিউটন ও ডেভি, ধর্মীয় বিষয় হলে হিউম ও টমাস পেইন, আধ্যাত্মিক বিষয় হলে লক, রিড, স্টুয়ার্ট ও ব্রাউন প্রমুখ মনীষীদের রচনা তরুণ তার্কিকরা নিজেদের উক্তির সমর্থনে অবলীলাক্রমে আবৃত্তি করতে পারতেন। গুরুগম্ভীর বিষয় ও রচনার মধ্যে মধ্যে হিরে—মুক্তার মতো তাঁরা ছড়িয়ে দিতেন তখনকার স্বনামধন্য ইংরেজ কবিদের উৎকৃষ্ট সব কবিতার পঙক্তি, বিশেষ করে বাইরন ও ওয়াল্টার স্কটের। তার মধ্যে কতবার যে ডাফের (নিজে স্কচম্যান) কানে কবি রবার্ট বার্নসের স্কচ কবিতার ছন্দ ধ্বনিত হয়ে আসছে, তার ঠিক নেই। জানি না, বর্তমানকালের শিক্ষক ও তরুণ ছাত্ররাও বোধহয় জানেন না, এরকম বিদ্বৎসভা আজকের কলকাতা শহরে আছে কি না, এবং যা আছে তার বিতর্কের মান তরুণ বক্তাদের জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের দিক থেকে ডাফের এই অকুণ্ঠ প্রশংসা দাবি করতে পারে কি না। এই প্রসঙ্গে এ কথাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ডাফ সাহেব ডিরোজিও ও তাঁর ছাত্রদের প্রতি, এমনকী হিন্দু কলেজের প্রতিও, ধর্মশিক্ষা ও ধর্মভাবের অভাবের জন্য একেবারেই প্রীত ছিলেন না।
যে—কোনো একজন সভ্য উঠে সভায় একটি বিষয় সম্বন্ধে আলোচনা আরম্ভ করতেন যেমন, ঈশ্বর আছেন কি নেই, জাতিভেদ ভালো কি মন্দ, প্রতিমাপূজা বর্জনীয় কি না, যুক্তি বড়ো না অন্ধবিশ্বাস বড়ো, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু না ক্ষুরধার বুদ্ধির আলোকে ও তর্কে, অবাধ ব্যক্তিস্বাধীনতা না বাধ্য সমষ্টিবশ্যতা, কোনটা কাম্য? এই ধরনের দার্শনিক সামাজিক সাহিত্যিক বৈজ্ঞানিক আর্থনীতিক রাজনৈতিক প্রভৃতি নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হত সভায়। ডাফের বর্ণনা শুনে বোঝা যায় যে, সভাকক্ষ কেবল বিশুদ্ধ যুক্তিসর্বস্ব কথার প্রতিবাদে উত্তপ্ত হয়ে উঠত না, তরুণদের কঠোর সাধনালব্ধ জ্ঞানবিদ্যার গভীর প্রকাশবৈচিত্র্যেও থমথম করত। প্রবীণেরা অবাক হয়ে যেতেন, বিদেশি ইংরেজ শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকতেন। দুই পক্ষই যুক্তির জাল বিস্তার করতেন, ঠিক বাদী—প্রতিবাদীর মতো নয়, কেবল বাদীর মতো বলা চলে। ন্যায়শাস্ত্রে যাকে ‘ধাদ’ বলে, তারই অবতারণা করা হত সভায়। রাজনৈতিক আলোচনা শুনে ইংরেজরা যে ভয় পেতেন না এমন কথা বলা যায় না। কারণ তরুণ শিক্ষক ডিরোজিও ফিরিঙ্গি হলেও ভারতবর্ষকে স্বদেশ মনে করতেন। মনেপ্রাণে ডিরোজিও ছিলেন ভারতীয়। তাঁর তরুণ বয়সের লেখা অনেক কবিতায় এই স্বদেশপ্রেমের সুর ঝংকৃত হয়ে উঠেছে। কেবল ‘জঙ্গিরার ফকির’ কাব্যে নয়, ছোটো—ছোটো আরও অনেক কবিতায়। তার মধ্যে ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ডিরোজিওর প্রথম কাব্যসংকলনের প্রথম কবিতা The Harp of India একটি চমৎকার নিদর্শন।
Why hang’st thou lovely on your withered bough?
Unstrung for ever, must thou there remain?
Thy music once was sweet who hearts it now?
Why doth the breeze sigh over thee in vain?
Silence hath bound thee with her fatal chain :
Neglected, mute, and desolate art thou,
Like ruined monument on desert plain :––
…but if thy notes divine
May be by mortal wakened once again,
Harp of my country, let me strike the strain!
আঠারো বছরের তরুণ কবির স্বদেশ সম্বন্ধে এই কল্পনা, বেদনাবোধ এমনিতেই প্রশংসনীয়, তার উপর ডিরোজিও কেবল বয়সে তরুণ নন, পোর্তুগিজ ফিরিঙ্গি পরিবারের সন্তান বলে এই ভারতবেদনাবোধ আরও বিস্ময়কর। ‘হে আমার স্বদেশি বীণা। তোমার ওই বেসুরো ছেঁড়া তারে আবার আমার সুর বাঁধতে দাও।’
ভারত—বীণার ছেঁড়া তারে ডিরোজিও নিজেই যে কেবল সুর বাঁধতে চেষ্টা করেছিলেন তা নয়, তাঁর তরুণ ছাত্রদের মনের অগ্নিবীণাতেও সেই সুরের ঝংকার তুলেছিলেন। অ্যাকাডেমিকের আলোচনাসভায় মধ্যে—মধ্যে ভারতের রাষ্ট্রীয় পরাধীনতা সম্বন্ধেও তর্ক হত। ‘Young Lions of Bengal’ কেবল সামাজিক কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে নয়, বিদেশির দাসত্বের বিরুদ্ধেও ঘন—ঘন গর্জন করে উঠতেন। ‘পার্থিনন’ নামে সভার একটি মুখপত্রও প্রকাশ করা হয়েছিল। এই ‘পার্থিনন’ বোধহয় বাঙালিদের দ্বারা প্রথম প্রকাশিত ইংরেজি পত্রিকা। ‘বেঙ্গল স্পেক্টেটর’ পত্রিকা (১ সেপ্টেম্বর, ১৮৪২) থেকে জানা যায় যে ‘পার্থিনন’ দুই সংখ্যা মাত্র প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম সংখ্যায় বিষয়বস্তু ছিল স্ত্রীশিক্ষা, হিন্দুধর্ম, গভর্নমেন্টের বিচারবিভাগের ব্যয়বাহুল্য ইত্যাদির আলোচনা ও সমালোচনা। দ্বিতীয় সংখ্যা ছাপা হয়েছিল বটে, কিন্তু গ্রাহকদের কাছে পাঠানো হয়নি। প্রথম সংখ্যা দেখেই গোঁড়া হিন্দুরা এত দূর শঙ্কিত হয়েছিলেন যে দ্বিতীয় সংখ্যা ‘মুদ্রাঙ্কিত’ হলেও তাঁরা ‘গ্রাহকদিগের নিকটে প্রেরিত হইতে দেন নাই।’ পত্রিকা বন্ধ হলেও ‘যুবক হিন্দুদিগের সত্যানুসন্ধানের প্রবল ইচ্ছা নিবারিত হয় নাই।’
অ্যাকাডেমিকের আলোচনার ভিতর দিয়ে সত্যের দুর্গম দ্বীপে তরুণ বাংলার দুঃসাহসিক অভিযান চলতে থাকল অনিরুদ্ধ গতিতে। বাংলার এই তরুণ অভিযাত্রিকদের নাবিক হলেন ডিরোজিও।
ডিরোজিও যে কেবল অ্যাকাডেমিকেই বক্তৃতা দিতেন তা নয়, মধ্যে—মধ্যে অন্যান্য বিদ্যালয়ের ছাত্রদের সভাতেও তিনি বক্তৃতা দিতে যেতেন। হেয়ার সাহেব তাঁর পটলডাঙার স্কুলে তাঁকে বক্তৃতা দেবার জন্য প্রায়ই আমন্ত্রণ জানাতেন। হিন্দু কলেজের বাইরে কলকাতার তরুণ ছাত্রসমাজের মধ্যে ডিরোজিওর ব্যক্তিত্বের প্রভাব ধীরে—ধীরে প্রসারিত হচ্ছিল। এ প্রভাব বন্ধনহীন স্বাধীন চিন্তার প্রভাব, বাংলার দীপ্ত তারুণ্যের কাছে যার আবেদন গভীর। এই আবেদনে তরুণদের মনে সাড়া জাগছিল এবং হিন্দুসমাজও আতঙ্কিত হয়ে উঠছিল। কিন্তু এত আতঙ্কের কারণ কী?
‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ নবযুগের বৈপ্লবিক চিন্তার প্রথম প্রবর্তক বলে আলোড়ন এত ব্যাপক ও গভীর হয়েছিল। রামমোহন রায় ‘আত্মীয় সভা’ স্থাপন করেছিলেন ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে। পৌত্তলিকতা, জাতিভেদ, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, সহমরণপ্রথা ইত্যাদি সামাজিক কুপ্রথা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ‘আত্মীয় সভা’র বৈঠকে যে নিয়মিত আলোচনা হত, সে কথা আগে উল্লেখ করেছি। ১৮১৯, ১৮ মে ‘ক্যালকাটা জার্নাল’ পত্রিকা সভার বিবরণ প্রসঙ্গে লেখেন।
At the meeting in question, it is said, the absurdity of the prevailing rules respecting the intercourse of several castes with each other, and of the restrictions on diet, etc. was freely discussed, and generally admitted––the necessity of an infant widow passing her life in a state of celibacy––the practice of polygamy and of suffering widows to burn with the corpse of their husbands, were condemned as well as all superstitious ceremonies in use amongst idolaters….
—The Calcutta Journal, No. 87, 18 May, 1819.
যদিও ‘freely discussed’ কথাটি এখানে আছে, তাহলেও আত্মীয় সভা’র আলোচনায় বাইরের সমাজে সেরকম কোলাহলের সৃষ্টি হয়নি কেন? কেন হিন্দুসমাজের মনে তেমন ভীতির শিহরন জাগেনি? তার কারণ ১৮১৫—২০ থেকে ১৮২৫—৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কালের ব্যবধান মাত্র দশ—পনেরো বছরের হলেও সামাজিক পরিবেশের ব্যবধান ঘটে গিয়েছিল অনেক বেশি। কালের ছন্দের সঙ্গে তাল রেখে চলেনি সামাজিক পরিবর্তনের স্রোত।
মানুষের জীবনের মতো সমাজের জীবনেরও বিভিন্ন যুগের ও পর্বের গতিবেগ ও ক্রিয়া—প্রতিক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য থাকে। জীবনের পর্বে—পর্বে বাল্যে যৌবনে প্রৌঢ়ত্বে ও বার্ধক্যে যেমন চলার গতি ও ছন্দ বদলায়, তেমনি যুগ থেকে যুগান্তরে, এবং একই যুগের ভিন্ন—ভিন্ন পর্বে সমাজের পরিবর্তনের গতি ও ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাতের ধারা বদলায়। সামাজিক গতিবিজ্ঞানের (Social dynamics) এটা একটা মূলসূত্র বলা চলে। ডিরোজিয়ানদের কালে ঘটনাস্রোত অনেক দ্রুতগতিতে প্রবাহিত হয়েছিল এবং তার ফলে পুরাতন সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসও ভাঙতে আরম্ভ করেছিল। রামমোহনের ‘আত্মীয় সভা’ এবং ডিরোজিওর ‘অ্যাকাডেমিক সভা’, এই দুয়ের সামাজিক গড়ন (Social composition) লক্ষ করলেই তা বোঝা যায়। ‘আত্মীয় সভায়’ ছিল বিত্তের দিক থেকে ধনিক এবং বয়সের দিক থেকে মধ্যবয়সিদের প্রাধান্য। রামমোহন ও তাঁর অনুগামীর মধ্যে সকলেই প্রায় ধনিক ও প্রৌঢ় ছিলেন। ডিরোজিওর যুগে সমাজের আকারে বেশ একটা বড়ো রকমের পরিবর্তন ঘটল। সর্বপ্রথম বাংলা দেশে নতুন পাশ্চাত্যবিদ্যায় শিক্ষিত একদল মধ্যবিত্ত যুবকের আবির্ভাব হল সমাজে। নবযুগের বাংলার এটা একটা যুগান্তকারী ঘটনা। এই মধ্যবিত্ত তরুণদলের নায়ক হলেন যিনি, বয়সে তিনিও তরুণ। এ—ও একটা ইতিহাসের অপ্রত্যাশিত যোগাযোগ। বাংলার নব্যশিক্ষিত তরুণদলের চিন্তানায়করূপে প্রায় সমবয়স্ক তরুণ ডিরোজিওর আবির্ভাবে স্বভাবতই তাই আমাদের দেশে যুগসম্মত একটা চিন্তাবিপ্লবের সূচনা হল।
শিক্ষার দিক থেকে পাশ্চাত্যবিদ্যায় সুশিক্ষিত, সামাজিক শ্রেণির দিক থেকে মধ্যবিত্ত এবং বয়সের দিক থেকে তরুণ—এই তিনটি ঘটনার সংযোগ উনিশ শতকের বাংলার সমাজের প্রথম জাগরণকালে যে কত দূর বিস্ফোরক বৈপ্লবিক পরিবেশের সৃষ্টি করতে পারে তা অনুমান করা কঠিন নয়। ডিরোজিয়ানদের যুগে ঠিক এই পরিবেশই সৃষ্টি হয়েছিল। রামমোহনের যুগের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবয়স্কদের জড়তা ও মন্থরতা তরুণ ডিরোজিয়ানদের মধ্যে একেবারেই ছিল না। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের এই ঐতিহাসিক অগ্রগামিতার সঙ্গে ডিরোজিও তখন নবীন তারুণ্যের স্বতঃস্ফূর্তি মিলিত করতে পেরেছিলেন বলে সে যুগের জাদুকর হয়েছিলেন তিনি। তাই তাঁর ছাত্রদের স্বাধীন চিন্তার উচ্চশব্দে ও প্রাণচাঞ্চল্যের তরঙ্গাঘাতে সমাজের জীর্ণ পুরাতন বাঁধগুলি কাঁপতে আরম্ভ করেছিল।
কোনো উদ্দাম নদীর তীরে দাঁড়িয়ে তরঙ্গভঙ্গের দৃশ্য দেখলে সামাজিক ঘটনাবর্তের স্বরূপ সম্বন্ধে খানিকটা ধারণা করা যায়। তরঙ্গকে আঘাত করে তরঙ্গ, তরঙ্গমালা ভেঙেচুরে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, আরও বৃহত্তর তরঙ্গ উদবেল হয়ে ওঠে সমাজেও ঘটনার সঙ্গে ঘটনার সম্পর্কে এইরকম অবিচ্ছিন্ন সূত্রে গ্রন্থিত। প্রথম ঘটনা দ্বিতীয়কে আঘাত করে এবং তৃতীয়কে ভেঙে আত্মসাৎ করে পরবর্তী ঘটনাকে দূরপ্রসারী করে তোলে। ডিরোজিও জীবনের ট্র্যাজিডি হল, ১৮২৯—৩০—৩১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এইরকম একসূত্রে গাঁথা কয়েকটি বড়ো—বড়ো ঘটনার সম্মিলিত আবর্ত। এগুলির সম্মুখীন হয়েছিলেন তিনি এবং তার প্রচণ্ড ঝাপটা সমাজের সর্বকোণ থেকে তাঁর দিকে ধাবিত হয়ে যৌবনের মধ্যাহ্নেই তাঁর জীবনকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল।
১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর থেকে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর। মাত্র দু’বছর। এই দু’বছরের মধ্যে ডিরোজিওর জীবননাট্যের অকস্মাৎ যবনিকাপাত হল।
……..
* সমাচার দর্পণ, ১৩ মে ১৮২৬