কর্নেলের মেয়ে

কর্নেলের মেয়ে

টেবিলের উপর ছড়ানো অনেক রকম ব্র্যান্ডের সিগারেটের প্যাকেট থেকে নিজেরটি বেছে নিয়ে নির্মলদা একটা সিগারেট ঠোঁটের ডগায় ঝুলিয়ে আমাকে বললেন, ‘ব্যস্ত হচ্ছ কেন, বাড়ি আমরা সকলেই যাব, কেউ এখানে সারারাত বসে থাকবে না। বাড়িতে আমাদেরও রোগা, মোটা, পাতলা সরু, মেজাজি মিনমিনে ফ্যাঁসফ্যাঁসে বউ আছে। তোমার খালি একলারই নেই।’ কথা বলার ফাঁকে সিগারেটটা ঠোঁটের ডগায় আস্তে জোরে থির থির করে কাঁপল। ঠোঁটে সিগারেট লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই জ্বলন্ত দেশলাই কাঠি নিয়ে ধরিয়ে দেবার জন্য সামনে ঝুঁকে পড়েছিলেন। একে একে সব কাঠি নিভে গেল। পোড়া কাঠিগুলো পর পর অ্যাশট্রেতে চলে গেল। নির্মলদা এখন সিগারেট না ধরিয়ে ঠোঁটে ঝুলিয়ে কথা বলবেন। আজকে আমি টার্গেট।

আড্ডায় একে একে পাখি উড়ে আসছে। এখনও তেমন জমেনি। কয়েকজন মাত্র এসেছেন। নির্মলদাকে ঘিরে রোজ বিকেলে নিদারুণ আড্ডা জমে। সকলেই বিভিন্ন দলের সাহিত্যিক। নির্মলদার নাম বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের কে না জানে। যশস্বী লেখক। এমন একটি পত্রিকার সম্পাদক, যেখানে লেখা না বেরোলে জাতে ওঠা যায় না। আগে আমরা ধর্মতলার কাছে একটা কুলীন মিষ্টির দোকানে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতুম। আজকাল এখানে বসছি। রেস্তোরাঁর মালিক এক সময় সাহিত্য করতেন। কাগজের ঘাটতির ফলে পত্র-পত্রিকার আকৃতি ছোট হয়ে যাবে, একথা আগেই বোধহয় জেনে ফেলে ব্যবসার দিকে ঝুঁকেছেন। সাধারণত রেস্তোরাঁর মালিকরা যেমন হয়ে থাকেন, অমৃতবাবু সে রকম নন। বয়সে তরুণ। মুখে স্বপ্নের সঙ্গে চিন্তা মেশানো মৃদু হাসির আভাস। সাহিত্য করতেন বলেই বোধহয় সাহিত্যিকদের প্রতি প্রীতি। নির্মলদার ভক্ত। বিশেষভাবে শ্রদ্ধা করেন। নির্মলদার জন্য কোণের দিকে একটা লম্বা টেবিল খালিই থাকে। দূরে একটা ঢাউস পেডেস্টাল পাখা এমন একটা অ্যাঙ্গেলে এডজাস্ট করা যাতে থাকে হাওয়া সোজা গিয়ে নির্মলদাকে ঝাপটা না মারে। নির্মলদার ডান বা বাঁ পাশ দিয়ে কানের লতি ছুঁয়ে ফুর ফুর করে বয়ে যায়। এদিকে বগলের পাশে একটা তিন ঠ্যাঙ নড়বড়ে লম্বা টুলের উপর একটা হোমিওপ্যাথিক পাখা বসানো থাকে। নির্মলদার নির্দেশে সেটা মাঝে মাঝে চালানো হয়। দু পাঁচ মিনিট চলার পর নির্মলদা একবার নাক টেনে দেখেন, যদি বোজা বোজা মনে হয় সঙ্গে সঙ্গে পাখা বন্ধ করে দেওয়া হয়। নাকের সঙ্গে পাখার চলা, না-চলা নির্ভর করে। টুলে বসানো ছোট পাখাটা বহুকালের। ঘোরে যখন বেশ শব্দ হয়। বয়স হবার ফলে পাখাটার মেজাজের ঠিক নেই। কখন কী যে করে বসে! একদিন টুল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্মলদাকে ধরবার চেষ্টা করেছিল। অমৃতবাবু কান ধরে শক্‌ খেয়ে সে যাত্রা বুড়ো পাখার ভীমরতি সামলে ছিলেন। পাখার ভয়ে নির্মলদা তিনচার দিন দোকানে আসেননি। শেষে অমৃতবাবু পাখা সম্পর্কে ‘সেফ কনডাক্ট’ সার্টিফিকেট দেওয়ায় আডডা প্রাণে বাঁচল। এখন মিঃ লড়ি তাঁর বিশাল পিঠ দিয়ে পাখাকে গার্ড করে বসে থাকেন। সাবধানের মার নেই।

এইবার সিগারেটটা নিজেই ধরিয়ে নিয়ে গোটা কতক ধোঁয়ার ডিফেকটিভ রিং শূন্যে ছেড়ে নির্মলদা মৃদু হেসে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে চাইছ কেন? বউকে ওষুধ খাওয়াচ্ছ।’ ইতিমধ্যে অমৃতবাবু এসে দাঁড়িয়েছেন। টেবিলের উপর দুটো হাত রেখে সামনে ঝুঁকে আছেন। আমি বললুম, ‘আজকাল ফিরতে বড় রাত হয়ে যাচ্ছে। আর বেশি রাত হলেই আমার বউয়ের একটা বাতিক আছে। বাড়ি থেকে এক মাইল দূরের বাস স্টপেজে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে। কোনও মানে হয় না। তার ধারণা স্টপেজে দাঁড়ালেই আমি তাড়াতাড়ি এসে যাব। হাতে পাঁচ সেলের টর্চ আর একটা খেঁটে লাঠি। আমাদের ওদিকে আবার ভীষণ ছেনতাই-টেনতাই হচ্ছে। বাস থেকে নামা মাত্রই আমাকে গ্রেফতার করার মতো, খেঁটে লাঠি হাতে পিছনে পিছনে আসতে থাকে। আর সারাটা রাস্তা আমার আক্কেল আর কাণ্ডজ্ঞান সম্পর্কে যা-তা বলতে বলতে আসে। একটা দৃশ্যের মতো দৃশ্য। আমার লজ্জা করে, প্রেসটিজ পাঙচার হয়ে যায়।’

নির্মলদা মিস্টার লড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘জানিস তো বউ আবার কাবলী মেয়ে। দু’হাতের তালুতে আখরোট ভাঙে। হিং দিয়ে চা খায়।’ অমৃতবাবু কথাটা বিশ্বাস করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাই নাকি? আমার কাবলী মেয়ে দেখার ভীষণ সখ।’ আমি বললুম, নির্মলদার কথা বিশ্বাস করলেন? কাবলী মেয়ে নয় ছেলেবেলায় দীর্ঘকাল কাবুলে ছিল। ধাতটা একটু অন্য রকমের, বাঙালি মেয়ের মতো নয়।

অমৃতবাবু আর একটু সামনে ঝুঁকে নির্মলদাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী খাবেন নির্মলদা?’—‘কী খাওয়া যায়?’ প্রশ্নটাকে নির্মলদা টেবিলের উপর আরশোলার মতো ছেড়ে দিলেন। সেই প্রথমেই অধ্যাপকের দিকে উড়ে গেল। অধ্যাপক বোসকে সব সময়েই কেমন একটু ক্লান্ত দেখায়। খুব আস্তে কথা বলেন। সব সময়েই সিরিয়াস। বোসদা বললেন: কিছু একটা খেতে হবে। সেই সকালে বেরিয়েছি, এখনও কিছু খাওয়া হয়নি।’ ‘কী খাবে বলে দাও না,’ নির্মলদা বকলমে কাজ সারতে চাইলেন। গাঢ় কমলালেবু রঙের পাঞ্জাবি গায়ে, চতুর্ভুজ পত্রিকার সম্পাদক এতক্ষণ সদাব্রত সেনের সঙ্গে গল্পহীন গল্প নিয়ে আলোচনায় মত্ত ছিলেন, চোখ তুলে বললেন, ‘কুলচা খান নির্মলদা’।

‘কুলচা? সেটা আবার কী? এমন নাম তো আগে কখনও শুনিনি!’ অধ্যাপকের বিস্ময়ে অমৃতবাবু কুলচার একটা ফুট নোট জুড়ে দিতে চাইলেন—কুলচা দেখতে অনেকটা রুটির মতো, নরম নরম, আদুরে মেয়ের মতো, পেট ঠাসা পুর, ঝাল ঝাল, পেটে থাকে অনেকক্ষণ, মাঝে মাঝে জল সাপ্লাই করতে পারলে এক টাকায় অনেকখানি শান্তি। ইট ইজ এবসোলিউটলি আওয়ার ইনভেনশান।

নির্মলদা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কুলচা খাবে? তোমার লিভারের অবস্থা কী?’

অধ্যাপক মৃদু হেসে, চুলে হাত বুলোত বুলোতে বললেন, ‘দৈর্ঘ্যে হাঁটু পর্যন্ত চলে গেছে প্রস্থে পাকস্থলী ছুঁয়েছে, চাপ দিলে ব্যথা।’

‘ব্যথা?’ ডাক্তার কাঞ্জিলাল চমকে উঠলেন। ভদ্রলোক সবে পাশ করেছেন। কোন একটি বড় হাসপাতালের রেসিডেন্ট ডাক্তার। আগে কুস্তি করতেন। এখন সাহিত্যের প্রাঙ্গণে পায়চারি শুরু করেছেন। মিল ছাড়া কবিতা লেখেন। কাব্যে এনাটমির শক্ত শক্ত নাম থাকে, হেমোগ্লোবিন, থায়রয়েড, লিংটাস। গল্পে মর্গ থাকে, ফর্মালিন থাকে, নাকের ডগা থেকে অক্সিজেন নল খুলে গিয়ে মাঝরাতে নায়কেরা মারা যায়। নির্মলদার শরীরের উপর তাঁর ভীষণ নজর। নির্মলদা কপালে হাত রাখলেই পকেট থেকে এনালজেসিক বের করে দেন। নির্মলদা দুঃসাহস দেখিয়ে কাটলেট খেয়ে ঢেকুর তুললেই এন্টাসিড। ডাক্তার কাঞ্জিলাল অধ্যাপকের পেটে চাপ দিয়ে বললেন, ‘লাগছে?’ অধ্যাপক আদুরে গলায় বললেন, ‘ভীষণ!’ কাঞ্জিলাল বললেন, ‘ভাল সিমটম নয়, কাঁচা হলুদের সঙ্গে মেটে চটকে খেতে হবে। সকালে উচ্ছে ভাজার সঙ্গে চা। দুপুরে গাঁদাল পাতার ঝোল, সরু চালের…’

‘আরে দ্যুৎ, কী ডাক্তারি আরম্ভ করলে ছাই, কী খাবে অর্ডার দাও না, সেই থেকে অমৃত দাঁড়িয়ে রয়েছে,’ নির্মলদা উত্তেজিত হলেন। শেষে নিজেই ফয়সালা করে দিলেন, দু টাকার শোনপাপড়ি আনো।’ শোনপাপড়ি দিয়ে রুটি, একটা নতুন ধরনের কমবিনেশন, তার সঙ্গে চা। নির্মলদার আবার সহজে চা পছন্দ হয় না। বার কতক ট্রায়াল দিয়ে তবে হয়তো এক কাপ জিভে ধরে। চা ধরে দিয়ে বয় উদ্‌গ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। চায়ে চুমুক দিয়ে টি-টেস্টারের মতো জিভ তালুতে বার কয়েক চুক চুক শব্দ করে নির্মলদা চায়ের খুঁত ধরবেন অথবা বলবেন ঠিক আছে। আজকে একবারেই চা পছন্দ হয়ে গেল। কী ভাগ্য! আমরা সাধারণত ঘণ্টা দুয়েক বসি, তার মধ্যে বার চারেক চা আসে। কয়েক কাপ চা আর গোটাকতক ফাঁকা কাপ, ভাগাভাগি করে খাওয়া হয়।

চা তখনও আধ কাপের মতো পড়ে আছে, নির্মলদা কয়েকবার গলা দিয়ে এক ধরনের ঘস্‌ ঘস্‌ আওয়াজ বের করে বললেন, ‘আমার গলায় কী একটা গেছে। খচ্‌ খচ্‌ করছে, কাঁচ নয় তো’!

‘কাঁচ কী করে আটকাবে! আপনি কি ভুলে কাপের কানা কামড়ে ফেলেছেন?’ আমার বোকার মতো প্রশ্ন শুনে, নির্মলদা একবার জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালেন, মিস্টার লড়ি গাঁক গাঁক করে চিৎকার করে উঠলেন, ‘তুমি শালা কী বুঝবে কোথা থেকে কী আসে, নির্মলের গলায় একবার রিস্টওয়াচ আটকে গিয়েছিল, লেডিস ঘড়ি, বুঝেছ বোকু’।

‘লেডিজ ঘড়ি! কেন ম্যাজিক দেখাচ্ছিলেন নাকি?’

‘এ শালাকে বোঝাতে ঝুড়ি কোদাল লাগবে। লুচির মধ্যে ছিল। যে ভদ্রমহিলা ময়দা মাখছিলেন তাঁর হাত থেকে খুলে ময়দার তালের মধ্যে চলে গিয়েছিল। তারপর লুচি হয়ে নির্মলের পাতে চলে এসেছিল। নির্মলকে ডিগবাজি খাইয়ে, কাতুকুতু দিয়ে সেই ঘড়ি গলা থেকে বের করা হল।’

‘বলেন কী? খুব মূল্যবান লুচি ছিল বলুন, সেই ঘড়ি কী হল?’

‘কী আবার হবে, কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে সেই ঘড়ির মালিককে আবিষ্কার করা হল, নির্মল আগে ঘড়ি তারপর ঘরনী লাভ করল।’

‘আমাদের বউদি, বউদির ঘড়ি’! আমি বোধহয় একটু জোরে চিৎকার করে ফেলেছিলুম। চতুর্ভুজ পত্রিকার সম্পাদক অম্বুজ আমাকে চেপে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন, ‘হয়েছে কী, এই তো সবে শুরু, আরও সব ভীষণ ব্যাপার আছে, যত দিন যাবে জানতে পারবেন।’

নির্মলদার পকেটে সব সময় একটা পেনসিল টর্চ থাকে। লোড শেডিংয়ের সময় অন্ধকার রাস্তায় সাপ শুয়ে থাকতে পারে, রাস্তায় ধস নামতে পারে, গলায় কাচ কিম্বা মাছের কাঁটা ফুটতে পারে, টর্চ সেই কারণে পকেটে ঘোরে। ডাক্তার কাঞ্জিলাল চামচে দিয়ে নির্মলদার জিভ চেপে ধরে গলার টাগরায় টর্চের আলো ফেলে কাচের সন্ধান শুরু করলেন। ‘কী, পেলেন?’ অধ্যাপক বোস উৎকণ্ঠা মাখানো গলায় প্রশ্ন করলেন। ‘না, আলজিভ ছাড়া কিছু দেখছি না’, ডাক্তার চামচে তুলে নিয়ে সরে এলেন। নির্মলদা কোঁৎ করে একটা ঢোঁক গিলে বলেন, ‘আছে, আছে, বেশ খচ্‌ খচ্‌ করছে; কী যে তোমরা খাওয়ালে! চলো, উঠে পড়ো, বাড়ি গিয়ে একটা আস্ত কলা গিলে খেতে হবে।’

নির্মলদা উঠছেন দেখে আশ্বস্ত হলাম। এখন সাতটা পাঁচ, সাড়ে আটটার মধ্যে চেষ্টা করলে বাড়ি পৌঁছে যাব। নির্মলদা কিন্তু উঠতে গিয়েও উঠলেন না। আবার বসে পড়লেন। প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে ঝোলালেন। সিগারেটটা ধরিয়ে দেবার জন্য জ্বলন্ত কাঠি নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। মিঃ লড়ি(পুরো নাম কিশোর লাহিড়ি, অধ্যাপক মিস্টার লড়ি বলেন, আমরাও বলি) ডাক্তার কাঞ্জিলাল আর চতুর্ভুজ সম্পাদকের হাতের ফাঁক দিয়ে ঝট করে কাঠি বাড়িয়ে সিগারেট ধরিয়ে দিলেন। ডাক্তার হতাশ হয়ে আমার পাশে বসে পড়ে ফিস ফিস করে বললেন, ‘কোনওদিনই আমি নির্মলদার সিগারেটে আগুন দিতে পারলাম না। আমি একটা অপদার্থ, কী ডিসগ্রেসফুল ব্যাপার বলুন তো, যে একটা সিগারেট ধরাতে পারে না, তার গল্প ছাপা হবে। কাল থেকে আর আডডায় আসব না।’ আমি ফিস ফিস করে ডাক্তারকে চাঙ্গা করার জন্য বললুম, ‘তা কেন? ভাল লিখুন, ঠিকই ছাপা হবে, সিগারেটে আগুনের সঙ্গে কী সম্পর্ক।’ ধোঁয়া ছেড়ে নির্মলদা বললেন, ‘যাব কী, আজ তো আবার ময়দানে খেলা ছিল, নিশ্চয় মারামারি হয়েছে! যাও আগে দেখে এসো, অবস্থা কী। রাস্তায় কাচটাচ ভাঙা পড়ে আছে কি না!’ নির্মলদা আদেশ জারি করার সঙ্গে সঙ্গে মিঃ লড়ি বললেন, ‘যাও, যাও শিগগির দেখে এসো।’ এমনিই খুব ক্লান্ত। উপায় কী, উঠতেই হল। উঠে দাঁড়িয়েছি, নির্মলদা বললেন, ‘কাচ ভাঙা চেনো? কত রকমের কাঁচ ভাঙা হয় জানো?’

ঘাড় নাড়লুম, অর্থ—জানি না। কাচ ভাঙার আবার রকম কী? নির্মলদা বিদ্রূপের সুরে বললেন, ‘এ শালা সাহিত্যিক হবে! অবজার্ভেশানই নেই। শোন, মিছরির দানার মতো ঝুরো ঝুরো কাচ হল, গাড়ির উইন্ড স্ক্রীন ভাঙা। ওই ধরনের কাঁচ পড়ে থাকতে দেখলে বুঝবে, হয় গাড়িতে গাড়িতে ধাক্কা মেরেছে, না হয় ইট মেরে ভেঙে দিয়েছে। ইট কখন গাড়িতে মারে, জানো?’

‘আজ্ঞে না।’

‘তা জানবে কেন? খালি বাড়ি আর বউ জানো? গাড়িতে ইট মারে, মানুষ ক্ষেপে গেলে। মানুষ ক্ষেপে যায় কেন? আশা ভঙ্গ হলে। এখানে আশাভঙ্গের কী কারণ হতে পারে? খেলায় হার জিত। বুঝেছ?’

ঘাড় নেড়ে জানালুম, বুঝেছি।

নির্মলদা ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘এরপর আছে ফিনকি ফিনকি কাচ। দোকানের শো উইন্ডোর কাচ। এরপর আছে বোতল ভাঙা মোটা মোটা কাচ। রাস্তার দিকে তাকাবে, আশেপাশে দেখবে, দেখে বোঝার চেষ্টা করবে মারামারি হয়েছে কি না! হলে কতক্ষণ আগে হয়েছে…।’ নির্মলদার কথা শেষ হবার আগেই মিঃ লড়ি গাঁকগাঁক করে উঠলেন, এই যে শালা ব্রতীন, এতদিন ছিলে কোথায়, তোমার ইয়ে করি’। সকলেই তাকিয়ে দেখলেন ব্রতীন দোকানে ঢুকছেন। স্মার্ট চেহারা। চুল ব্যাক ব্রাশ করা। কপালের কাছে এক খাবলা চুল কে খামছে নিয়েছে। আসলে ওই জায়গায় কিছু চুল পেকে যাওয়ায় ব্রতীন রোজ সকালে দাড়ি কামাবার সময় কাঁচি দিয়ে নিজেই কচু-কাটা করেন। সত্তরটির মতো ছোট গল্প আজ পর্যন্ত লিখেছেন নির্মলদার কাগজে, শেষ গল্পের নাম ছিল ‘ঘোড়ার প্রাণদণ্ড’। ব্রতীন দাঁতে ঠোঁট চেপে এক ধরনের অদ্ভুত উচ্চারণে বললেন, ‘এই যে গুরু,’ তারপর নির্মলদার খুব কাছাকাছি এসে বিনীত গলায় বললেন, ‘কেমন আছেন?’ নির্মলদা বললেন, ‘বসো। ওদিকে মারামারি হচ্ছে?’

ব্রতীন বললেন, ‘না, কিছু তো তেমন দেখলাম না!’

‘কোনও কাচটাচ, আলো নেভা, ফাঁকা রাস্তা, চোখ জ্বালা করা ধোঁয়া, কিছুই চোখে পড়ল না!’

ব্রতীন একটু ঘাবড়ে গেলেন। কোন উত্তরটা নির্মলদার মনোমত হবে বুঝতে পারছেন না। শেষে একটু যেন ভেবেই বললেন, ‘ট্রামগুমটির কাছটায় যেন একটু অন্ধকার অন্ধকার মনে হল।’ নির্মলদা আমার দিকে তাকালেন। মনে মনে একটু ঘাবড়েই গেলুম, এই রে, নির্মলদা বোধহয় আবার জাঁকিয়ে বসে পড়েন! না, নির্মলদা উঠেই পড়লেন। যে কোনও জায়গায় বসে থাকার সময় উঠতে গেলেই, নির্মলদা যেন একটু ভয়ে ভয়ে মাথা নিচু করে ওঠেন, মনে করেন এই বুঝি মাথায় পাখার ব্লেড, কি লোহার বিম, কিংবা ঝোলানো অন্য কিছু লেগে যাবে।

আমার কাঁধে হাত রেখে ঈষৎ কুঁজো হয়ে নির্মলদা সদলবলে অমৃতবাবুর ‘নুক’ থেকে বেরিয়ে এলেন। ঘড়িতে তখন সাতটা পঁয়তাল্লিশ। সকলেই প্রায় কেটে গেলেন, রইলাম আমরা চারজন—আমি, নির্মলদা, অম্বুজ আর কাঞ্জিলাল। সকলেই উত্তরের যাত্রী—কেউ দূরের কেউ কাছের। নির্মলদা ফুটপাতে পা রেখেই বললেন, ‘গলার কাছটা একটু যেন জ্বালা জ্বালা করছে, বোধহয় অম্বল হয়ে গেল। কী যে শালা খাওয়ায়, রুটির ভিতরটা মাইরি কাঁচা ছিল। কাল থেকে আর এখানে আসব না, আমাদের পুরনো দোকানেই বসব।’

আমরা সমস্বরে বলে উঠলুম, ‘রুটির ভেতরটা একেবারে কাঁচা ছিল, কাল থেকে আবার আমাদের পুরনো দোকানে।’ নির্মলদা বললেন, ‘না, তা বোলো না, একেবারে কাঁচা ছিল না, জায়গায় জায়গায় ঠিক সেঁকা হয়নি, বলে দিলেই হবে একটু কড়া করে সেঁকার কথা। এদের চা-টা কিন্তু ভারী সুন্দর!’

আমরা সমস্বরে বলে উঠলুম, ‘রুটি একটু কড়া করে সেঁকা, এমনকী আর শক্ত ব্যাপার। চা-টা কিন্তু সত্যি সুন্দর।’ নির্মলদা বললেন, ‘ভেতরটা কিন্তু ভীষণ গুমোট, সিলিংটা নিচু তো, হাওয়া বাতাস খেলে না। মাথাটা খুব ধরে গেছে। একটা কিছু খেতে হবে।’ আমরা সকলেই নিজেদের কপালটা দু আঙুলে টিপে ধরে বললুম, ‘ঠিক বলেছেন, আমাদেরও কপালটা কী রকম ঢিপ ঢিপ করছে। ভেতরটা ভীষণ গুমোট, বসা যায় না।’ নির্মলদা বললেন, ‘যাই বলো, তোমাদের ও দোকানের থেকে ঢের ভাল। ও দোকানে মাইরি বসা যায় না। যত ফিলমের লোক আর বাজে মেয়েছেলের ভিড়। কাল থেকে আমরা কার্জন পার্কে একটু হেঁটে হেঁটে বেড়াব। সারাদিন বসে থাকি তো, একটু হাঁটা ভাল। তোমরা মাইরি একদম হাঁটতে চাও না। কী যে শালা বসে থাকো। চলো।’

পুরো দলটা আবার চলতে শুরু করল। ডানদিকে কফি হাউস ফেলে আমরা ভিক্টোরিয়া হাউসের কাছে এসে পড়লুম। নির্মলদা বললেন, ‘দেখো তো মিনিবাস আছে কি না?’ নির্মলদার দিকের মিনিবাস এখানে থাকে না, তবুও অন্ধকারে একবার এদিকে ওদিকে ছুটোছুটি করে এলুম। নির্মলদা খুঁতখুঁতে গলায় বললেন, এখান থেকে একটা দুটো ছাড়ে মাইরি। পরশুদিন পলাশ এখান থেকে মিনিবাসে বাড়ি ফিরেছে। আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, দেখো তো পয়েন্ট টু পয়েন্ট ট্যাকসি পাওয়া যায় কি না? আমার তখন আর একদম দৌড়ঝাঁপ করতে ভাল লাগছিল না, ছোট ছেলেকে ভোলাবার মতো, নরম গলায় নির্মলদাকে বললুম, কী হবে শুধু শুধু পয়সা খরচ করে, ট্রাম কিম্বা বাসে যাওয়াই তো ভাল, এখন ভিড় কমে গেছে। নির্মলদা আমার থেকে কয়েক পা ছিটকে সরে গিয়ে মুখ ভেংচে বললেন, ‘তুমি শালা টাকাটাই চিনেছ, কমফার্টস—কমফার্টস—কমফার্টসটা যাবে কোথায়? কথা না বাড়িয়ে একটা ঢোঁক গিলে চুপ করে গেলুম।

একটা-দুটো ট্যাকসি আশেপাশে এসে দাঁড়াল, আবার চলে গেল। কয়েকটা মিনিবাস গেল ঝড়ের বেগে। বাসেও তেমন আর বাদুড় ঝোলা ভিড় নেই। আমি তখন মরিয়া। বুঝেই গেছি, চোরে সিঁদকাটি নিয়ে বেরোবে আর আমিও বাড়ি ঢুকব। যথারীতি আমার স্ত্রী হাতে একটা রুল আর পাঁচ সেলের টর্চ নিয়ে বাসস্ট্যান্ড অবধি এগিয়ে আসবে। খুব শীতল গলায় বলবে, ‘স্ফূর্তি করে শেষ রাতে বাড়ি ফিরছ ফের, বুঝবে যেদিন আমার একটা ভালমন্দ কিছু হয়ে যাবে।’

আসো কেন এই অন্ধকারে বোকার মতো, এটা যে কী ধরনের ভালবাসা! যেদিন সর্বস্ব কেড়ে নেবে সেদিন বুঝবে।

আমি তো আসিই ওই জন্য, দেখি কতদিনে তোমার একটু চেতনা হয়।

নির্মলদা হঠাৎ হাত ধরে একটা হেঁচকা টান দিয়ে প্রায় ধমকের সুরে বললেন, কী, বাড়ি যাবে, না এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েছেলে দেখবে? আমি যেন খুব দূর থেকে ক্লান্ত গলায় বললুম, চলুন, কিসে যাবেন?

কিসে যাবেন? নির্মলদা ভেঙচে উঠলেন, তোমার তো শালা অনেক ল্যাঠা, মিনিতে যাবে না, ট্যাকসিতে উঠবে না, চলো তা হলে ট্রামেই চলো।

ধর্মতলার ট্রাম টার্মিনাস একটু খালি খালি। ট্রাম যেন তেমন নেই। আলোগুলো সব জ্বলেনি, অন্ধকার অন্ধকার। দুপুরে বৃষ্টি হয়েছিল। নানা আকারের গর্তে কাদা জল জমে আছে। সেই লোকটি একপাশে একটা টুলের ওপর দাঁড়িয়ে তখনও ধমকে ধমকে তার সেই অতি আশ্চর্য, মোক্ষম যৌবন বটিকার বক্তৃতা দিয়ে চলেছে। আমরা কাদা আর জল বাঁচিয়ে স্টপেজে এসে দাঁড়ালুম। ট্রাম আর আসে না। লম্বা ট্রাম লাইন এঁকে বেঁকে, ধর্মতলার দিক থেকে আমাদের দিকে এগিয়ে এসেছে, ট্রামের কিন্তু পাত্তা নেই। চারিদিকে লোক থই থই করছে।

নির্মলদা আমার কাঁধের উপর শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে বললেন, পুরুষ মানুষের রাত দশটার আগে বাড়ি ফেরা উচিত নয়। ফিরলে পৌরুষ থাকে না। দিনের শেষে একটা আড্ডা মারবে, খিস্তি করবে। মন ভাল থাকবে, শরীর ঝরঝরে হবে। তা না, তুমি মাইরি সন্ধে থেকে বাড়ি যাবার জন্য ব্যস্ত। আমি আমার স্ব-পক্ষে কিছু বলতে যাচ্ছিলুম, নির্মলদা দেখলাম তখন অন্য জগতে চলে গেছেন। জাত শিল্পীদের যা ধরন! এই আমাদের মধ্যে আছেন, এই আবার ভাবের জগতে চলে গেছেন।

হঠাৎ কোথা থেকে একটা বারো নম্বর ট্রাম সুড়সুড় করে আমাদের সামনে দিয়ে বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে থামল। আমাদের পাদুটো দৌড়ের জন্যে নিসপিস করে উঠল, কিন্তু দৌড়তে পারলাম না। নির্মলদা নির্বিকার। সামনের অন্ধকার আকাশে একখণ্ড ঝুলন্ত সাদামেঘে তাঁর চোখ আটকে গেছে। ট্রামটা কিছুক্ষণ থেমে এক পেট লোক বোঝাই করে বৃত্তাকার ঘুরে ধর্মতলা স্ট্রিটের দিকে চলে গেল। ট্রামটার ল্যাজ তখন দেখা যাচ্ছে, নির্মলদা মেঘলোক থেকে কার্জন পার্কে নেমে এলেন, উঠলে না কেন?

আমরা চমকে উঠলুম, আপনি উঠলেন না।

আমি উঠলাম না, না তোমরাই ক্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে রইলে? সমস্ত দোষটা নির্মলদা আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন। আমরা খুব হাসির প্রলেপ মুখে মাখিয়ে বললুম, পরেরটা আর মিস করা চলবে না। নির্মলদা একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, এখানে দাঁড়ালে জীবনে ট্রামে উঠতে পারবে না, চলো ধর্মতলা স্ট্রিটে গিয়ে দাঁড়াই, ট্রামটা আসার মুখে সেই লাল আলোয় আটকে যাবে, আমরা উঠে যাব, তোফা জানালার ধারে বসে বসে চলে যাব।

তাই হোক, যথা নির্দেশ। আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। স্টপেজ থেকে বেশ কিছুদূর গেছি, একটা বারো নম্বর, বেশ খালি, আমাদের দিকে হইহই করে এগিয়ে এল। আমরা তখন সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত। ট্রামটা আমাদের কলা দেখিয়ে স্টপেজের দিকে চলে গেল। অম্বুজ এবার মরিয়া। তিনি আমাদের ছেড়ে দৌড়তে দৌড়তে পড়ি কী মরি করে চলন্ত ট্রামে লাফিয়ে উঠে ফুটবোর্ড থেকে হাত নেড়ে নেড়ে আমাদের ডাকতে লাগলেন।

না, অত সহজে নির্মলদা ট্রামে উঠবেন? নির্মলদা খেলে খেলে, আমাদের অনেক খেলিয়ে বৃহৎ একটা মাছের মতো ট্রাম কিম্বা বাসের পাটাতনে পা রাখবেন। আমরা একটা ডোন্ট কেয়ার ভাবে ধর্মতলার দিকে বিজয়ী সৈন্যবাহিনীর মতো আমাদের জেনারেলকে পাশে রেখে এগোতেই থাকলুম। অম্বুজ অনেকটা দুরে ট্রাম থেকে নেমে জোর কদমে আমাদের এসে ধরলেন। অম্বুজ একটু উত্তেজিত, কী, হল কী? উঠলেন না কেন? নির্মলদা একটু উপেক্ষার ভাবে বললেন, ভ্যাস, ও ট্রামে কে যাবে? দেখলে না তোমার পিছুপিছু কাঠের বাকসো-টাকসো নিয়ে দুটো জুতোবুরুশওলা উঠল। ওই কাঠের বাকসোর খোঁচা আমার হাঁটুতে লাগত, সেফটিক হত, তারপর গ্যাংগ্রীন, তারপর এমপুটেশান। তুমি কী শালা আমার অটোবায়োগ্রাফি লেখবার আগেই এপিটাফ লেখাতে চাও?

ডাঃ কাঞ্জিলাল কথাটা লুফে নিলেন, গ্যাংগ্রীন, উরে বাবা, পরশুদিন আমাদের ওয়ার্ডে ব্যারাকপুর থেকে একটা কেস এসেছিল। প্যাকিং বাকসোর খোঁচা লেগেছিল।

আমাকে প্যাকিং বাকসো দেখিও না। নির্মলদা ফায়ার হয়ে গেলেন, জানো আমার একবার কী হয়েছিল? রেলে চাকরি করি। সাহারানপুরে ফুটবল খেলতে গেছি। মাঠের মাঝখানে হারামজাদা একটু মুখ ভাঙা দেশি মদের বোতল পুঁতে রেখেছিল। এক ব্যাটা টিকিওলার সঙ্গে বল নিয়ে কোস্তা-কুস্তি করতে করতে থেবড়ে সেই বোতলের ওপর বসে পড়লুম। পাছা পাংচার হয়ে গেল। এখনও খাবলা দাগ আছে, এত বড়। গ্যাংগ্রীন হয়েছে, না কোমর থেকে এমপুট করে বাদ দিতে হয়েছে? আমাকে ডাক্তারি শিখিও না।

ডাঃ কাঞ্জিলাল একটু নার্ভাস হয়ে গেলেন। নির্মলদা চলতে চলতেই বললেন, আমি যখন ‘বিপদ’ লিখছি ধারাবাহিক, কত ডাক্তার চিঠি লিখেছিল জানো? ইয়ার্কি মেরো না। ডাঃ কাঞ্জিলাল মনে হল বেশ বিব্রত। বিব্রতভাবটা কাটাবার জন্য আমার কাছে সরে এসে বললেন, চিনেবাদাম খাবেন? আমি খুব গম্ভীর চালে বললুম, সূর্যাস্তের পর বাদাম খাই না, হর্মোন সিক্রেশান কমে যায়। ডাঃ তখন একেবারে কাত। প্রকৃতই আমার তখন আর কিছুই ভাল লাগছে না। আর, এক ঘণ্টা পনেরো মিনিট পরে আমার বউ একটা খেঁটো লাঠি হাতে আমাদের সেই শহরতলির বাড়ির গেট খুলে দুমদুম করে বাস স্টপেজের দিকে এগতে থাকবে। কর্নেলের মেয়ে। মুখটা একেবারে শ্বশুরমশাই কেটে বসানো মাইনাস হিজ গোঁফ। মুখটা মনে পড়তেই হুটোপুটি করে এগিয়ে যেতে ইচ্ছে করল। নির্মলদা আমার জামার পেছন ধরে টেনে রাখলেন, এটা কলকাতা, তোমার অজগ্রাম নয়, চাপা পড়ে মরবে! কথা বলতে বলতে একটা একবগির ট্রাম চলে গেল। নির্মলদা আবার টিকটিকি ট্রামে উঠতে চান না। সুতরাং ট্রামটাকে আমরা দেখেও দেখলুম না।

একবগির পেছনেই আর একটা বারো ছিল। আমরা কেউ খেয়াল করিনি। নির্মলদার ঠিক নজর ছিল। ট্রামটা খুব আস্তে আস্তে আসছিল, নির্মলদা কাছা কোঁচা সামলে টুক করে উঠে পড়লেন। অপ্রস্তুত আমরা হাঁসফাঁস করে দৌড়তে দৌড়তে গিয়ে উঠলুম। নির্মলদা ততক্ষণে বসে পড়েছেন। কী ভাগ্য! আমাদেরও একটু বসার ঠাঁই মিলল। প্রথমে নেমে যাবেন অম্বুজ মৌলালিতে। ডাঃ কাঞ্জিলাল নামবেন বৌবাজারে। আমি আর নির্মলদা নামব সব শেষে শ্যামবাজারে, পাঁচমাথার কাছে।

আমরা সেকেন্ডক্লাসেই বসেছি। তেমন একটা ভিড় নেই। তবুও নির্মলদা উসখুস করছেন। ঠিক মনঃপূত হয়নি। একবার উঁকি মেরে ফার্স্টক্লাসটা দেখলেন। এখনও জায়গা আছে, গেলে হত। সেকেন্ডক্লাসে যাওয়া যায় না মাইরি, নির্মলদা আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন। ট্রাম তখন বৃত্তাকারে ঘুরে ধর্মতলা স্ট্রিটে ঢুকতে চলেছে। আমি একবার উঁকি মেরে দেখে নির্মলদাকে ভোলাবার চেষ্টা করলুম, ও তো সব লেডিজ সিট নির্মলদা, জেন্টস সিট কী আর খালি থাকে?

ধ্যাৎ তুমি জানো না, লেডিজ সিট ওখানে থাকবে কেন? তাছাড়া এত রাতে ট্রামে-বাসে তেমন ভিড় হয় না। তোমার খালি এড়িয়ে যাবার চেষ্টা, নির্মলদা আলতো করে বললেন; তেমন আর জোর দিলেন না। ট্রাম তখন দৌড়তে শুরু করেছে।

শিয়ালদার কাছে একবার ট্রামের ট্রলি খুলে যাওয়া ছাড়া পথে অন্য আর কোনও বড় রকমের বিপর্যয় হল না। মানিকতলার কাছে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় নির্মলদার মাথার উপর হেঁচে ফেলেন। ভদ্রলোকের কোনও দোষ ছিল না। একহাত ছিল রডে আর একহাতে ধরা ছিল পোর্টফোলিও, হাঁচি চাপবার চেষ্টা করেছিলেন তার ফল হল মারাত্মক। চাপা হাঁচি সশব্দে নাক ফেটে বোমার মতো বেরুল। সরি বললে কী হবে। নির্মলদা একবার অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালেন। ভদ্রলোক অপরাধীর মতো মুখে বললেন, রাজাবাজার থেকে চাপতে চাপতে আসছি। নির্মলদা আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন, তোমাদের জন্য মাইরি অকালে মরব, বাংলা সাহিত্যের তোমরা পয়লা নম্বর শত্রু। জানো, একলক্ষ ভাইরাস আমার নাকে ঢুকে গেল। আমার ইচ্ছে করছিল ভদ্রলোককে পাঁজাকোলা করে ট্রামলাইনে ফেলে দি।

শ্যামবাজারে যখন নামলুম চারিদিক অন্ধকার। সেই থই-থই অন্ধকারে অসংখ্য লোক পোকার মতো কিলবিল করছে। নির্মলদা জিজ্ঞেস করলেন, আজ কী বিয়ের তারিখ? পাঁজিটাঁজির সঙ্গে সম্পর্ক নেই। গায়ে ঘিয়ে রঙের চাদর জড়ানো এক ভদ্রলোককে দেখে মনে হল পুরোহিত পুরোহিত চেহারা, সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, আজ কি বিয়ের দিন? ভদ্রলোক জ্যাঠামশাইয়ের বয়সী, প্রশ্ন শুনে ভাবলেন রসিকতা করছি, ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন, ইয়ার্কি হচ্ছে, আমার মরবার বয়স হল। ছোকরা বিয়ে দেখাচ্ছে। আমার বউ তোমার দিদিমার বয়সী। কথা না বাড়িয়ে অন্ধকারে তলিয়ে গেলুম। নির্মলদা ততক্ষণে পাঁচমাথার দিকে এগিয়ে গেছেন। আমি পাশে যেতেই বললেন, তুমি একটা ইডিয়েট। কান পাতলেই সানাই কিম্বা মাইকের শব্দ শুনতে পেতে, হাওয়ায় ভাসছে। চোখ মেলে তাকালেই মেয়েদের বগলে কাপড়ের প্যাকেট, রজনীগন্ধার স্টিক দেখতে পেতে। নাক থাকলেই সেন্টের গন্ধ পেতে। সেই পাঁচমাথার বিপজ্জনক পথসন্ধিতে, হাঁটুভর আমপাতা, জামপাতা, লিচুপাতা, নিমপাতার মধ্যে দাঁড়িয়ে, একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে, রাত সাড়ে ন’টায় নির্মলদা তাঁর ফাইনাল রায় দিলেন, তোমার শালা জীবনে সাহিত্য হবে না। এদিকে একটা ট্রাম লাল আলোর হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে, সঙ্গে একটা ডবলডেকার নিয়ে আমাদের দিকে তেড়ে আসছে। নির্মলদার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই, প্রথম কাঠিটা হাওয়ায় নিভে গেছে, দ্বিতীয় একটা কাঠি জ্বেলে সিগারেট ধরাতে ব্যস্ত। নির্মলদা, বাস ট্রাম বলে—একলাফ মেরে একটা ছোটখাটো জলভর্তি ডোবায় পড়ে গেলুম। নির্মলদা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে নিয়ে একটু দূরে দাঁড়ানো একটা শাটল ট্যাকসির দিকে এগতে এগতে বললেন, বাকি রাতটা ব্যাঙের মতো ডোবায় পড়ে কাটিয়ে দাও, তোমার বউ ওদিকে থানায় খোকা হারানোর ডায়েরি লেখাক। ট্যাকসি পেছনের চাকা থেকে খানিকটা কাদা ছিটকে দিয়ে নির্মলদাকে পেটে পুরে বেলগাছিয়ার দিকে চলে গেল। আমি তখন রাজহাঁসের মতো প্যাঁক প্যাঁক করতে করতে ফুটপাথের কিনারায় লোহার রেলিং ধরে উঠে পড়েছি। জুতোদুপাটি কাদা জলে ভিজে বেশ ভারী হয়েছে। রবারের সোল, ওপরটায় ক্রেপকাপড়। চাপ দিলেই একটা ক্ষীণ ফিচুং ফিচুং শব্দ করছে, যেন আমার বিবেকের কণ্ঠস্বর, ব্যাটাচ্ছেলে বাড়ি চল।

বিধান সরণির মুখটায় একটা বাস এসে লাল আলোয় ঠেকল। আমার বাস। চেহারা, দেখেই ধরেছি। ছাদে পর্যন্ত লোক উঠেছে। মনে মনে একটা স্টার্ট দিয়ে নিলুম, গেট সেট গো। নক্ষত্র বেগে দৌড়। কে একজন পিছন থেকে বলে উঠলেন, মরবে রে। বাস আর বাড়িই তখন লক্ষ্য। অন্ধকারে দেখিনি। এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে ধাক্কা। আম কিনেছিলেন, বুকের কাছে ধরেছিলেন, ঠোঙাটা। ছড়িয়ে পড়ে গেল রাস্তায়। তাড়াতাড়ি কুড়িয়ে দিলুম। ছেঁড়া ঠোঙায় সবকটা ঢুকল না, গোটাকতক আমার হাতেই রয়ে গেল। ভদ্রমহিলা চাপাস্বরে ‘ভূত’ বলেই প্রায় চলন্ত একটা ডবল ডেকারে উঠে পড়লেন। আমি দু’হাতে দুটো ল্যাংড়া আম ধরে লাল আলোর নিশানার তলায় কিছুক্ষণ ভুতের মতোই দাঁড়িয়ে রইলাম, তারপর চলন্ত ডবলডেকারের পিছনে দৌড়লুম, আপনার আম, আপনার আম। এক জুলপিওলা ষণ্ডা চেহারার ভদ্রলোক আমাকে জাপটে ধরে জড়ানো গলায় বললেন, আ-এ আমটি খাব পেড়ে, ইঁদুর ছানা ভয়ে মরে, ঈগল পাখি পাছে ধরে, উট চলেছে, শালা উটের বাচ্চা দেখতে পাচ্ছ না তোমার সামনে কে দাঁড়িয়ে? কুর্নিশ করো। আমি এক পা পেছিয়ে এসেই, অ্যাবাউট টার্ন, দে ছুট। আমার বাস তখন সবুজ পেয়ে সাইলেনসারের ধমক মারতে মারতে পাঁচমাথায় মুখ বাড়িয়েছে। ফুটবোর্ডে এক ভদ্রলোক ঝুলছিলেন, তাঁর বগলে কাতুকুতু দিয়ে জায়গা করে নিলুম। পিছনে তখন জড়ানো গলা বলছে, বেইমান, পালিয়ে গেলি। বর্ণপরিচয়টা শিখে যা বাপ।

বাড়ির স্টপেজে যখন নামলুম, ঘড়িতে তখন দশটা পনেরো। ঘোর অন্ধকার। সামনে তখন পড়ে আছে মাইলখানেকের মতো অন্ধকার হাঁটা পথ। সব দোকানই বন্ধ। একটি লোক হাতে ঝুলিয়ে জুঁই ফুলের গোড়ের মালা বিক্রি করছিল। একটা মালা কিনে ফেললুম। আমার পথ চলে গেছে পশ্চিমে গঙ্গার দিকে। শেষ আকাশে একটা সাদা মেঘ ঝুলছে। মেঘের গা থেকে কোনও শহরের আলো ছিটকে এসে আমার মতো মাঝরাতের পথিককে একটু পথ দেখাচ্ছে। রিকশা-টিকশা এখন আর পাওয়া যাবে না।

বেশ জোরেই হাঁটছি। ভিজে জুতোর ফ্যাঁচ ক্যাঁচানি থেমেছে। পোস্ট অফিসটা পেরোতেই যা ভেবেছি তাই। তিনি ধীর পায়ে এগিয়ে আসছেন। তোমাকে আমি বার বার বারণ করেছি এই অন্ধকারে একা আসবে না। অন্ধকারে উত্তর এল, কী করব, ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছি। ইস ভুল হয়ে গেছে, আমার স্ত্রী নয়, আকৃতি একই রকম। আমি ভুল হয়ে গেছে বললুম, ভদ্রমহিলাও ভুল হয়ে গেছে বলে, দু’জনে দু’মুখো ছুটলুম। যা অন্ধকার। যেতে যেতে সেই মহিলার কথা মনে পড়ল, শ্যামবাজারে যার বুক থেকে দুটো আম পেড়ে নিয়ে চলেছি। ‘ভূত’ বলে গালাগাল দিলে কী হবে, বেশ দেখতে। এই ভদ্রমহিলাও কেমন মিষ্টি। বেশ একটা প্রেম প্রেম ভাব তালশাঁসের জলের মতো হৃদয়ের খাঁজে জমে উঠল। হাতে জুঁই থেকে ভিজে হাওয়ার গন্ধ উঠছে। নির্মলদা ঠিকই বলেছিলেন, কান পাতলে হাওয়ায় সানাইয়ের সুর শোনা যায়। কেন একটা বিয়ে বিয়ে ভাব হচ্ছিল।

ঠিক গেটের মুখে বউয়ের সঙ্গে ঠোকাঠুকি হল। আমার সন্ধানে সবে বেরুচ্ছিল। ওঃ সাহস বটে। কর্নেলের মেয়ে। কাবুলে ষাঁড়ের ডালনা খেত। আমি এসেছি, এসেছি-ই বধূ হে। অন্ধকার গেটের মুখেই জুঁইয়ের মালাটা গলায় পরিয়ে দিলুম। চকাম করে একটা শব্দ অন্ধকারে ভেসে গেল। হাত থেকে টর্চ আর লাঠিটা নিয়ে ল্যাংড়া দুটো ধরিয়ে দিলুম। অন্যপক্ষে কোনও কথা নেই। বাগানের পথে আগে আগে এগিয়ে চলল। আমি পিছনে মডার্ন বিল্বমঙ্গল। অন্ধকারে মনে হল, একটা মালা ভেসে চলেছে।

মেয়েটা তখনও জেগেছিল। ঘরে ঢুকেই হুকুম হল মেয়েকে, যাও কালকে স্কুলের অঙ্ক বাবার কাছ থেকে বুঝে নাও। মেয়ে একবার করুণ মুখে মার দিকে, একবার আমার দিকে তাকাল। প্রায় এগারোটা। টেবিলের উপর একটা বাতি কেঁপে কেঁপে জ্বলছে। ‘যা-অ-ও’ এক ধমকে, মেয়ে বুকে স্লেট হাতে বই নিয়ে কাঁপা কাঁপা পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এল।

একটা মোড়ায় বসে ভিজে জুতোটা তখন সবে পা থেকে খুলছি, মোজাটায় হাত দিয়ে গা ঘিন ঘিন করছে, মেয়ে এসে পাশে দাঁড়াল, বাবা? তুমি এখনও ঘুমোওনি? মা জাগিয়ে রেখেছে। তা তো রাখবেই, তোমার মা ছাড়া আমাকে আর কে বাঁশ দেবে বলো। ঢোকবার আগে বাড়ির গেটের সামনে মালাটালার ব্যাপার মন থেকে মুছে গেল। ভিজে মোজাটা কোনওরকমে জুতোর মধ্যে ফেলে দাঁতে দাঁত চেপে একটি মাত্র কথা মুখ দিয়ে বার করলাম ‘শয়তান’। ঠিক শুনেছে। ফোঁস করে উঠল, কে শয়তান? রাত বারোটায় যারা মদ গিলে মালা পরে বাড়ি ঢোকে তারা, না যারা সারাদিন তাদের সংসারের ধুনী আগলে বসে থাকে তারা?

কে মদ গিলেছে? আমি?

তা ছাড়া কে? গায়ে ভুর ভুর করে হুইস্কির গন্ধ বেরুচ্ছে। ভাব আমি কিছু বুঝি না?

আমার গায়ে মদের গন্ধ?

আলবাত।

চেঁচিও না জানোয়ারের মতো। ওপরের ঘরে বাবা সবে শুয়েছেন, শুনতে পাবেন।

চেঁচাব না, গুণধর ছেলে মদ খেয়ে মাঝরাতে বাড়ি আসবে, আমি চুপ করে থাকব, আবার জানোয়ার বলা!

মেয়েকে এক ধমক লাগালুম, ‘যাও গিয়ে শুয়ে পড়ো। অঙ্ক-টঙ্ক কাল সকালে হবে। সারাদিন কী করো?’ মেয়ে বুকে শ্লেট চেপে গুটি গুটি শোবার ঘরের দিকে এগল। দেখলাম ব্যাপার আর বেশিদূর গড়াতে দেওয়া ঠিক না, দাবানল জ্বলবে। পায়ে পায়ে এগিয়ে, বেশ মিঠে করে, যেন পরস্ত্রীর সঙ্গে প্রেমের কথা বলছি এইভাবে কাঁধে হাত রেখে বললুম, ‘রাগ করছ কেন? মদ ফদ খাইনি, ওসব আমি ছুঁই না, আসলে শ্যামবাজারে এক বেটা মাতাল আমাকে জড়িয়ে ধরে বর্ণপরিচয় শেখাচ্ছিল, সেই গন্ধটাই বোধহয় গায়ে লেগে আছে। এই দেখো তোমার মুখের কাছে হাঁ করছি’।

আমার কথাটা যেন বিশ্বাসই করল না, কাঁধ থেকে হাতটা ছিটকে ফেলে দিয়ে বলল, জানি, নির্মলদার সঙ্গে মিশে অনেক গল্প বানাতে শিখেছ।

‘অনেক ভাগ্যে মানুষ নির্মলদার মতো সাহিত্যিকের সঙ্গ পায়, বুঝেছ?’

অন্ধকার থেকে ধরা গলায় উত্তর এল, তোমার ভাগ্য নিয়ে তুমি থাকো। আমার ভাগ্যের কথাই ভাবছি। কবে যে নিষ্কৃতি পাব তোমার হাত থেকে।

‘তোমার রাস্তা তুমি দেখে নাও, অনেক দাদা তো তোমার আছে, যৌবন আছে।’

‘কী বললে?’ অন্ধকারে তাল ঠুকে এগিয়ে এল কর্নেলের মেয়ে।

‘চেঁচাবে না, বাবা উঠে পড়বেন।’

অতই যদি বাবার ভয়, বিয়ে করেছিলে কেন? মেয়েছেলে নিয়ে স্ফূর্তি করে বাবু রাত বারোটায় বাড়ি ফিরে বউকে শয়তান জানোয়ার যা খুশি বলবে কিসের অধিকারে?’

কথায় কথা বাড়ে, টাকায় বাড়ে সুদ। শোবার ঘর থেকে মেয়ের করুণ গলা ভেসে এল, মা, মশা কামড়াচ্ছে। আর মেজাজ তখন সপ্তমে, কামড়াক, হয়েছে কী? তোর বরাতে এখনও অনেক কিছুর কামড় লেখা আছে। বোলতা কামড়াবে, ভীমরুল কামড়াবে, যে বাবার হাতে পড়েছিস!

আর জল ঘোলা করে লাভ নেই। স্ত্রীদের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করার সবচেয়ে ভাল জায়গা বাথরুম। বাথরুমের জমাট চাপ অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে কলের মুখ খুঁজে বের করলুম। দাম্পত্য কলহের পরই আমি দেখেছি অনিবার্যভাবে মনে একটা আধ্যাত্মিক ভাবের কুলু কুলু প্লাবন আসে। হরিদ্বার লছমন ঝোলা, হৃষীকেশ, অলকানন্দা, নাঃ ওই সব জায়গাতেই চলে যেতে হবে। কালী কমলীর ধর্মশালায় কম্বল কাঁধে বসে থাকব। জলের শব্দের সঙ্গে গলা থেকে আপনি সুর বেরিয়ে এল। এক সময় একটু গানটান চর্চা করতুম। পুরনো গানের এক একটা লাইন বাথরুমের অন্ধকারে ভাসিয়ে দিলুম, মন ভ্রমরা বারেক ভুলে বসল না মার চরণ মূলে, শ্যামা পদে আশ নদীর তীরে বাস কখন কী যে ঘটে ভেবে হই মা সারা, পড়িয়ে ভবসাগরে ডুবে মা তনুর তরি। গানের ফোয়ারা। শ্রীচৈতন্যদেবের মতো দু’ হাত উপরে তুলে একটু প্রেমদাতা নিতাই বলে ডাইনে বামে দুলে দুলে নেচে নিলুম। ডান হাতটা শাওয়ারে লেগে গেল, একবার দাঁতে দাঁত চেপে শালাও বললুম।

বাথরুম থেকে যখন বেরিয়ে এলুম তখন একেবারে অন্য মানুষ—কাছা খোলা বিমুক্তানন্দ। তখনও মনে গুন গুন করে গাইছে, চল মন গঙ্গা যমুনা তীরে।

মোমবাতির কাঁপা কাঁপা আলোয় রাতের খাওয়া শেষ। প্লেটে সেই ভদ্রমহিলার বক্ষচ্যুত আমের কুচি। সকলকেই তখন আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। নির্বাণ লাভের পূর্ব অবস্থা।

রাতে শোবার ঘরে পাখা বন্ধ, কথাও বন্ধ। মাঝ রাতে পাখা চলল, কথাও শুরু হল। নীল আলো নাইলেকসের মশারির মধ্যে দিয়ে বিছানায় তরল আকাশের মতো গড়িয়ে চলেছে। জুঁই ফুলের মালাটা কোথায় আছে জানি না, সারাঘর গন্ধে মাতোয়ারা। মধ্য রাতের নিস্তব্ধ ঘরে সানাইয়ের সুর ভাসছে। আজ বিয়ের দিন। উম করে পাশ ফিরে শুলাম। কর্নেলের মুখরা মেয়ের সঙ্গে আমার তখন ভীষণ ভাব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *