কর্নেলের জার্নাল থেকে-২
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে উত্তরপ্রদেশের আজমগড় এলাকায় একরকম অদ্ভুত রোগ দেখা দিয়েছিল। এই রোগের নাম দেওয়া হয়েছিল অট্টহাস। কোনও কারণ ঘটেনি, অথচ লোকে আচমকা হা-হা করে বিকট হাসতে শুরু করত এবং হাসির চোটে কিছুক্ষণের মধ্যে দম ফেটে মারা পড়ত।
বীভৎস রোগ বলা যায়। ভারতে তখনও ব্রিটিশ রাজত্ব। বাঘা-বাঘা বিলিতি ডাক্তারের একটা দল গিয়ে এই রোগের কারণ আবিষ্কার করতে পারেননি। কোনও রোগীকে বাঁচানো তো দুরের কথা। ওই সময় আমি সামরিক দফতর থেকে ছাঁটাই হয়েছি। যুদ্ধ থেমে আসছে। তরুণ বয়সে বেকার হয়ে বসে থাকতে মন চাইছিল না। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন খুঁজে দরখাস্ত করে যাচ্ছিলাম একনাগাড়ে। অবশেষে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হল। কিন্তু চাকরিটা পেলাম সেই আজমগড়ে। অর্থাৎ যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়।
বন্ধু ও হিতৈষীরা নিষেধ করলেন। অট্টহাস রোগের ভয় দেখালেন। কিন্তু আমি কারুর কথায় কান দিলাম না। কারণ চাকরিটা ছিল আমার পক্ষে ভারি লোভনীয়। আজমগড় তখন দেশীয় রাজার। স্টেট। বন, পাহাড় এবং প্রচুর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা। আমার চাকরি মহারাজার গেম ওয়ার্ডেনের। মহারাজার একটি সংরক্ষিত জঙ্গল ছিল। সেখানে প্রচুর শিকারের প্রাণীর সমাবেশ। মহারাজা মাঝে মাঝে শিকারে যেতেন বন্ধুবান্ধব নিয়ে। কখনও লাট-বড়লাটের শিকারের খেয়াল হতো। তাদেরও নিয়ে যেতেন মহারাজ প্রতাপ সিং বাহাদুর। আমার কাজ হল ওঁদের শিকারের ব্যবস্থা করা। সেইসঙ্গে এই সংরক্ষিত জঙ্গলে চোরা শিকারিরা যাতে ঢুকে জীবজন্তু না মারতে পারে, সেদিকেও। কড়া নজর রাখতে হতো।
অট্টহাস লোগ যখন শুধু মানুষকেই ধরছে, তখন মানুষের বসতির বাইরে ঘোর জঙ্গলে থাকাটা নিরাপদ ভেবেই ওই চাকরি নিতে দ্বিধা করিনি। আজমগড় শহর থেকে প্রায় তিরিশ মাইল দূরে ধারি নামে সুন্দর একটা পাহাড়ি নদীর ধারে জঙ্গলের ভেতরে আমার ডেরা হল। ডেরাও ভারি রোমাঞ্চকর। কাছাকাছি কয়েকটা গাছের প্রকাণ্ড সব ডালের ওপর মাটি থেকে অন্তত বিশ ফুট ওপরে একটা সবুজ রঙের কাঠের বাড়ি। দূর থেকে চোখে পড়া কঠিন ছিল। বাড়িটার ছাউনিও সবুজ রঙের করোগেট শিটের। একটু হাওয়া দিলে কিংবা বৃষ্টি হলে ভীষণ শব্দ হতো, এটাই যা বিরক্তিকর। কিন্তু ক্রমশ সেটা কানে সয়ে গিয়েছিল। বাড়িতে তিনটে ঘর। একটা ড্রয়িংরুমে–মহারাজা কিংবা তার অতিথি শিকারিরা এলে ওখানেই বসতেন। অন্যটা আমার বেডরুম। বাকিটা কিচেন। সে ঘরে আমার ভৃত্য ও রাঁধুনি মুহব্বত খাঁ থাকত।
.
০২.
তখন মার্চ মাস। জঙ্গলে বসন্ত এসেছে। কত রকমের বুনো ফুল ফুটেছে। সারাক্ষণ মিঠে গন্ধে জঙ্গল মউ-মউ করে। কাঁধে রাইফেল নিয়ে জঙ্গলের ভেতর চক্কর দিতে বেরোই সকাল-বিকেল দুদফা। জনাচার ফরেস্টগার্ডও ছিল। তারা পঞ্চাশ বর্গমাইল এলাকায় চার সীমানায় ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে চার। জায়গায় থাকত। সেই ঘরগুলোও ছিল গাছের মাথায়। চোরাশিকারি দেখলে বা কিছু ঘটলে গার্ডের হুইসল বাজানোর নিয়ম ছিল। উঁচুতে হুইসল বাজালে তার তীক্ষ্ণ শিস আরেকজন শুনতে পেত। আমিও পেতাম। তখন আমার কুকুর জিমকে নিয়ে ছুটে যেতাম।
দিন পনেরো কেটে গেল। তারপর একদিন জঙ্গলের ভেতর এলোমেলো ঘুরতে ঘুরতে ডেরায় ফিরছি, হঠাৎ কার বিকট হাসি শুনে চমকে উঠলাম। প্রথমে ভাবলাম হায়েনার ডাক। কিন্তু দিনদুপুরে হায়েনা ডাকে না। তাছাড়া হা-হা-হা-হা বিকট শব্দটা থামছে না।
শব্দ লক্ষ করে দ্রুত এগিয়ে গেলাম। ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে এগুতে পোশাক প্রায় ফর্দাফাই হবার উপক্রম। আমার প্রিয় কুকুর জিম আমার আগে আগে যাচ্ছিল। শব্দটা থেমে গেল একটা আঁ-আঁ-আঁ আর্ত চিৎকার। অমনি অমন সাহসী মারমুখী কুকুরটাও ভয় পেয়ে আমার দুপায়ের ফাঁকে এসে লেজ গুটিয়ে ফেলল।
তাকে ধমক দিয়েও নড়ানো যাচ্ছিল না। অগত্যা আমি পা বাড়ালাম। জিম তখন আমার পেছন পেছন কাঁচুমাচু মুখে হাঁটতে থাকল। উঁচু গাছের একটা জটলা, তার পাশে একটা প্রকাণ্ড বাড়ির মতো ন্যাড়া পাথর। সেই পাথরের নিচে ছায়ার ভেতর কী একটা পড়ে থাকতে দেখলাম। কাছে গিয়ে হকচকিয়ে গেলাম।
একজন আদিবাসী চিত হয়ে পড়ে রয়েছে। তার হাতের পাশে একটা দিশি গাদা বন্দুক। নিশ্চয় লুকিয়ে জঙ্গলে হরিণ মারতে এসেছিল। তার মুখ থেকে গলগল করে তখনও রক্ত বেরুচ্ছে। দেখামাত্র মনে পড়ে গেল অট্টহাসের কথা। ভয়ে সারা শরীর শিউরে উঠল। তাহলে এই লোকটি জঙ্গলের ভেতর এসেও সেই মারাত্মক রোগ থেকে রেহাই পায়নি দেখছি।
হুইসল বাজিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর একজন গার্ড এল। সে ব্যাপারটা দেখে চমকে উঠে বলল, সর্বনাশ-এ যে দেখছি কাঠুয়াগড়ের সেই রঙ্গলাল। গতমাসে এর দাদা আজিরলালও এভাবে মারা পড়েছে।
বললাম, জঙ্গলের ভেতর নাকি?
গার্ড বুধ সিং গম্ভীর মুখে বলল, না স্যার। ওদের বস্তিতে। যাই হোক, এখানে আর থাকা উচিত নয়। চলুন।
মড়াটার কী হবে?
জানোয়ার খেয়ে ফেলবে। আর কী হবে?
বুধ সিংয়ের নির্বিকার মনোভাব খারাপ লাগল। বললাম, তুমি বরং ওদের বাড়িতে খবর দিয়ে এসো। আমি ততক্ষণ পাহারায় থাকছি। একজন মানুষ তো বটে!
বুধ সিং যেন পলায়নের তালে ছিল। সে গোমড়া মুখে বলল, তা যাচ্ছি। কিন্তু আপনি আর এখানে থাকবেন না স্যার। এ বড় ভয়ংকর রোগ। কিছু বলা যায় না।
বলে সে লম্বা পা ফেলে হনহন করে কয়েক পা এগিয়ে গেল। তারপর হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল। বললাম, কী হল, বুধ সিং?
বুধ সিংয়ের চেহারা দেখে একটু অবাক হলাম। ওখানে ফাঁকা জায়গা বলে যথেষ্ট রোদ পড়েছে। তার মুখের রঙটা হঠাৎ কেমন যেন লাল দেখাচ্ছে। তার চোখ দুটো বড় হয়ে যাচ্ছে। তারপর মনে হল, চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসছে। চেঁচিয়ে ফের বললাম, কী হল বুধ সিং?
অমনি বুধ সিং নিঝুম জঙ্গল কাঁপিয়ে হা-হা-হা-হা করে বিকট হেসে উঠল। তার হাত থেকে বন্দুকটা পড়ে গেল, তারপর দুহাত শূন্যে তুলে সে ভয়ংকর অট্টহাসি হাসতে হাসতে ধপাস করে পড়ে গেল। সে সমানে হাসছিল আর গড়াগড়ি খাচ্ছিল ঘাসের ওপর। তারপর তার মুখে রক্ত দেখতে পেলাম।
এই বীভৎস দৃশ্য দেখার পর আর স্থির থাকতে পারলাম না। এবার আমার অট্টহাসের পালা ভেবে পড়ি কী মরি করে ঝোপঝাড় ভেঙে ছুটতে শুরু করলাম। জিমের কথা ভুলে গেলাম যেন। ধারি নদীর ধারে আমার ডেরায় পৌঁছে জিমের খোঁজ করলাম। দেখলাম সে আমার আগেই পৌঁছে গেছে। কুটিরের তলার আগাছা থেকে বেরিয়ে লেজ নাড়তে লাগল। তাকে আদর করে মুহব্বত খাকে ডাকলাম সিঁড়ি নামিয়ে দিতে। কিন্তু কোনও সাড়া পেলাম না। বারকতক ডেকে অবাক হয়ে কুটিরের চারদিকে ঘুরে তাকে খুঁজলাম। বিশ ফুট উঁচুতে কুটির। দরজা-জানলা খোলা। অথচ মুহব্বতের পাত্তা নেই। নদীতে স্নান করতে গেলে তো কাঠের সিঁড়িটা নামানো থাকত। আশংকা গা ছমছম করছিল। সাহস করে আরও কয়েকবার ডাকলাম। কিন্তু তবু কোনও সাড়া পেলাম না। তাই হুইসল বাজাতে শুরু করলাম। এই হুইসলগুলো মহারাজা বিদেশ থেকে বিশেষভাবে তৈরি করে আনিয়েছিলেন। এতে ফুঁ দিলে তীক্ষ্ণ আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হতে-হতে বহু দুর অবধি শোনা। যায়। প্রয়োজনে এর ক্ষমতা টের পেয়েছি। এদিকে বাকি তিনজন গার্ডের একজনেরও সাড়া মিলল না।
কুটিরে ওঠা অসম্ভব হতো না আমার পক্ষে। কিন্তু আর সে চেষ্টা না করে জিমকে নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ধারি পেরিয়ে ছুটে চললাম আজমগড়ের উদ্দেশে। পাকা রাস্তায় কোনও মোটর গাড়ি পেয়ে যাব….।
.
০৩.
হ্যাঁ, মুহব্বত খাঁও অট্টহাস রোগে মারা পড়েছিল। শুধু তাই নয়, একই দিনে বাকি তিনজন ফরেস্টগার্ডের একই মর্মান্তিক পরিণতি ঘটেছিল। এরপর জঙ্গলে গিয়ে থাকার সাহস ছিল না। মহারাজা প্রতাপ সিং বাহাদুর বলেছিলেন, আমার জঙ্গলের প্রাণীদের চেয়ে মানুষের প্রাণ আমি বেশি মূল্যবান মনে করি। আপনি কিছুদিন প্রাসাদে বিশ্রাম করুন। অবস্থা বুঝে একটা ব্যবস্থা করা যাবে। বিশ্রাম করা আমার ধাতে নেই। প্রাসাদের বিশাল চিড়িয়াখানার তদারকিতে মন দিয়েছিলাম। কিন্তু খোঁজ রাখতাম, জঙ্গল এলাকায় আর কেউ মারা পড়েছে কি না। এদিকে মহারাজা আবার ইউরোপের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, যদি কোনও বিশেষজ্ঞ অট্টহাস রোগের কারণ আবিষ্কার ও প্রতিকার করতে পারেন, তাকে মোটা টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।
আমি ডাক্তারি পড়িনি। রোগ বিশেষজ্ঞ নই। কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা তীব্র জেদ কাজ করছিল। তাছাড়া একটা আশ্চর্য ব্যাপার আমার মাথায় এসেছিল। আদিবাসী চোরাশিকারি রঙ্গলালের অট্টহাসে মৃত্যু দেখে ফরেস্টগার্ড বুধ সিং আক্রান্ত হল সঙ্গে সঙ্গে। অথচ আমার কোনও কিছু হল না? এমনকী মুহব্বত খাঁ এবং আমি একই সঙ্গে থেকেছি। মুহব্বত খাঁ আক্রান্ত হল, আমি হলাম না। এ কি আমার শরীরের বিশেষ ক্ষমতায়? কী ক্ষমতা? বুধ সিং আমার চেয়ে স্বাস্থ্যবান জোয়ান ছিল।
অট্টহাসে যেখানে সেখানে প্রথমে লোক মারা পড়েছে, সেখানে গিয়ে খোঁজখবর শুরু করলাম। তখনও কোনও কোনও গ্রামে একটা করে লোক মারা পড়েছিল। কিন্তু আশ্চর্য, তাদের মারা পড়তে যারা দেখেছে বা দেখছে, তাদের কিন্তু কিছু হচ্ছে না। কেন?
হাতিপুরা বলে একটা গাঁয়ে সর্বশেষ যে লোকটি অট্টহাসে মারা গেল, তার বাড়ি হাজির হলাম। তার বউকে অনেক জিগ্যেস করে পয়সাকড়ি সাহায্যের লোভ দেখিয়ে একটা মূল্যবান সূত্র বেরিয়ে এল। হ্যাঁ, এটাই আমার সন্দেহ হয়েছিল। লোকটা ছিল ওই জঙ্গলের নিয়মিত চোরাশিকারি। এরপর অন্তত গোটাদশেক অট্টহাসে মৃত্যুর পুরনো কেস তদন্ত করে একই সূত্র মিলে গেল। কেউ ছিল চোরাশিকারি, কেউ জঙ্গলে গিয়েছিল কাঠ ভাঙতে বা গরু চরাতে। তাহলে কি ওই জঙ্গলেই অট্টহাসের বীজাণু আছে?
কিন্তু তাহলে আমি রেহাই পেলাম কেন?
মহারাজার কাছে ফের জঙ্গলে গিয়ে থাকার অনুমতি চাইলাম। উনি আঁতকে উঠে বললেন, না না। জঙ্গল ফতুর হয়ে যাক। আমার ওই শখে আর কাজ নেই। আপনি যা করছেন, তাই করুন। অগত্যা একদিন গোপনে জিমকে নিয়ে মহারাজার অগোচরে জঙ্গলের দিকে পাড়ি জমালাম।
.
০৪.
ফরেস্টগার্ড চতুষ্টয়, আজীরলাল এবং মুহব্বত খাঁয়ের জঙ্গলে অট্টহাসে মৃত্যু হওয়ায় ওদিকে কোনও মানুষ আর ভুলেও পা বাড়াবে না জানতাম। কাঠের কুটিরের অবস্থা যেমন ছিল, তেমনি আছে দেখলাম। দুপুর পর্যন্ত বেশ কয়েক মাইল চক্কর দিয়ে এলাম। বিকেলে ধারি নদীর ধারে ঘঘারাঘুরি করলাম। অনেক ভাবলাম। কোনও খেই পেলাম না।
এ রাতে জ্যোৎস্না ছিল। জঙ্গলে মাঝে মাঝে বন্য প্রাণীর চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। রাতচরা পাখি ডাকছিল। সারাক্ষণ উত্তাল বাতাসের শব্দও ছিল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল জিমের গর গর গর্জনে। উঠে দেখি, জিম জানলার তারের জালিতে মুখ ঘষে নিচে কিছু দেখার চেষ্টা করছে। জানলা আস্তে খুলে নিচে একটু তাকাতে খোলামেলা জায়গায় কালো একটা মূর্তির নড়াচড়া চোখে পড়ল। চোরাশিকারি না কি? যেই হোক, সাহস তো কম নয়।
টর্চ ও রাইফেল নিয়ে চুপি চুপি বেরুলাম। জিমকে ইশরায় বুঝিয়ে দিলাম, তাকে চুপ করে থাকতে হবে। কাঠের সিঁড়ি ছায়ার ভেতর নিঃশব্দে নামিয়ে নেমে গেলাম দুজনে। তলার প্রচুর ঘাস আর আগাছা। ঘন ছায়ায় একটা গাছের আড়ালে দাঁড়ালাম ছায়ামূর্তিটা মুখ তুলে কুটির দেখছে। একটু পরে সে ওপাশের গাছ বেয়ে উঠতে শুরু করল। তারপর গেছো জন্তুর দক্ষতায় ডাল ধরে ঝুলতে ঝুলতে কুটিরের দেয়াল আঁকড়ে ধরল। ওদিকে তারের জালঘেরা বারান্দা আছে। চাপা ঘষ-ঘষ শব্দ শুনতে পেলাম। সে কি তারের জালটা কাটছে?
ইচ্ছে করলে তো সে পরিত্যক্ত নির্জন কুটিরে এতদিন ঢুকতে পারত। এখন যখন ঢুকছে, তখন তার লক্ষ আমি ছাড়া আর কী হতে পারে?
জিমকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে পা টিপেটিপে উলটো দিকে সিঁড়িতে চলে গেলাম। ওপরে উঠে টের পেলাম শ্রীমান ছায়ামূর্তি কিচেনের দিকে বারান্দায় সমানে ঘষ ঘষ চাপা শব্দ তুলে তারের জাল কেটে চলেছে। কিচেনে নিঃশব্দে ঢুকে তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম।
জাল কাটা হলে সে বারান্দায় উঠল। তারপর ওপাশ ঘুরে ড্রয়িংরুমের দরজার সামনে দাঁড়াল। ওই দরজা দিয়ে আমরা দুটিতে সদ্য ঢুকেছি। খোলাই আছে। বন্ধ করার কথা খেয়াল করিনি। একটু ইতস্তত করে সে ভেতরে যেই ঢুকেছে, অমনি কিচেনের দরজা থেকে আমি টর্চ জ্বেলেছি এবং জিমও তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
সে এক বীভত্স কদাকার প্রাণী। কতকটা মানুষের মতো দেখতে। সম্পূর্ণ উলঙ্গ শরীর। সারা গায়ে লোম। একমাথা জটাপাকানো চুল। একরাশ জঙ্গুলে দাড়িগোঁফ। বিকট দুর্গন্ধ টের পেলাম এতক্ষণে।
কিন্তু তার গায়ে অসুরের মতো জোর। জিমকে দুহাতে ধরে দরজা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। জিমের আর্তনাদে বুঝলাম মারাত্মক আঘাত পেয়েছে। আমি রাইফেল বাগিয়ে গুলি করলাম। কিন্তু গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। সেই মুহূর্তে সম্ভবত গুলির প্রচণ্ড শব্দে ভয় পেয়ে ভয়ংকর প্রাণীটা এক লাফে বেরুল এবং যে পথে এসেছিল সেই পথেই চলে গেল। দৌড়ে গিয়ে তাকে আর খুঁজে পেলাম না। নিচে ধপাস করে একটা শব্দ হল বটে, তাকে দেখতেই পেলাম না।
এখন আহত জিমের শুশ্রূষা জরুরি। তার দিকেই মন দিলাম।
.
০৫.
সকালে ড্রইংরুমের ভেতর এক টুকরো মধুভরা মৌচাক আবিষ্কার করে অবাক হয়েছিলাম। ওই প্রাণীটিই কী এই মৌচাক নিয়ে হানা দিয়েছিল?
ভাগ্যিস, মৌচাকটুকু থেকে মধু নিঙড়ে খাওয়ার লোভ করিনি। তাহলে এই গল্প বলার জন্য বেঁচে থাকতাম না।
কিন্তু মৌচাক উপহারের উদ্দেশ্য কী? মেঝের দিকে তাকিয়ে সেইকথা ভাবছি, সেই সময় ধারি নদীর ওদিকে জিমের শব্দ শুনলাম। বারান্দায় গিয়ে দেখলাম, মহারাজা দুজন সাহেব সঙ্গে নিয়ে আসছেন। তক্ষুনি নেমে গিয়ে তাদের অভ্যর্থনা করলাম। মহারাজা আলাপ করিয়ে দিলেন। অস্ট্রিয়ার প্রখ্যাত জীবাণু বিশেষজ্ঞ হ্যারিস বার্ডনট এবং তার এক শিকারি বন্ধু ফ্রাঙ্ক জিওট্রাস। ফ্রাঙ্ক প্রাণীতত্ত্ববিদও। আমি এভাবে ফের এসেছি বলে মহারাজা একটু ভর্ৎসনা করলেন আমাকে।
হ্যারিস মৌচাকটা দেখেই চমকে উঠেছিলেন। বললেন, সর্বনাশ? এত এক মারাত্মক বিষাক্ত মৌমাছির মধু। অবশ্য সব মৌমাছিই বিষাক্ত। কিন্তু এ জাতের মৌমাছির মধুও বিষাক্ত। এরা আফ্রিকার জঙ্গলে বাস করে। এদেশে এল কীভাবে?
মহারাজা হাঁ করে শুনছিলেন। বললেন, আফ্রিকার মৌমাছি? তাহলে কী…
ওঁকে চুপ করতে দেখে বললাম, কী মহারাজা বাহাদুর?
মহারাজা গম্ভীর মুখে বললেন, আমার পিসতুতো ভাই দুর্জয় সিং আফ্রিকায় ছিল। মাস ছয়েক হল সে ফিরেছে। আমার সঙ্গে তার শত্রুর সম্পর্ক। কিন্তু ব্যাপারটা কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তাছাড়া সে একজন ডাক্তারও বটে।
বললাম, একটা ব্যাপার বোঝা যাচ্ছে। দুর্জয় সিং এ জঙ্গলে কাউকেও ঢুকতে দিতে চান না।
মহারাজা বললেন, ঠিক, ঠিক, তাই বটে। কিন্তু কেন? আমার জঙ্গলে তার এরকম খবরদারির কারণ তো বোঝা যায় না।
ফ্রাঙ্ক বললেন, মৌচাক ফেলতে এসেছিল যে প্রাণীটি, বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে, এ একজাতের আফ্রিকান বাঁদর। গরিলা ও বেলুনের মাঝামাছি প্রজাতির প্রাণী। মানুষের মতো উঁচু। গড়নও সেরকম। দুপায়ে হাঁটতে পারে। কোনও কাজ শেখালে করতে পারে। আফ্রিকায় তাদের বলা হয় জুমোজুমো।
সেবেলা আমরা ফরেস্টগার্ডদের কুটির খুঁজে একটা করে শুকনো মৌচাক পেলাম। রঙ্গলালের মৃত্যু হয়েছিল যেখানে, সেখানেও একটুকরো পেলাম। মুহব্বত খাঁ যে মৌচাকটার মধু খেয়েছিল, সেটা আবিষ্কৃত হল কিচেনের আবর্জনার ঝুড়িতে।
অট্টহাস রোগের কারণ খুঁজে পাওয়া গেল তাহলে। কিন্তু দুর্জয় সিং কেন কাউকে জঙ্গলে থাকতে দিতে চান না?
সেদিনই রাতে মহারাজা খবর পাঠিয়ে একশ সশস্ত্র সেপাই আনালেন জঙ্গলে। নিজেও সঙ্গে রইলেন। হ্যারিস, ফ্রাঙ্ক ও আমি একদলে রইলাম। সারা জঙ্গলে ছড়িয়ে রইল বাহিনী। জুমোজুমো নামে প্রাণীটি দেখামাত্র গুলি করা হবে।
তখন রাত প্রায় একটা। ফ্রাঙ্ক, আমি এবং হ্যারিস একটা টিলার ধারে বিরাট পাথরের আড়ালে বসে বিশ্রাম নিচ্ছি, হঠাৎ সামনে টিলার গায়ে একখানা আলো জ্বলে উঠল। আলো লক্ষ করে পাথরের পেছনে গুঁড়ি মেরে তিনজন এগিয়ে গেলাম। একটু পরে খসখস মাটি কোপানোর শব্দ কানে এল। আলোর কাছেই শব্দটা হচ্ছে। কাছাকাছি গিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম, একটা লোক লণ্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আর সেই বিকট প্রাণী জুমোজুমো প্রকাণ্ড কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ছে। আমরা ওত পেতে বসে তাদের এই অদ্ভুত ক্রিয়াকলাপ দেখতে লাগলাম।
জুমোজুমো ক্রমাগত মাটি খুঁড়ছে। লোকটি চাপা গলায় তাকে কী নির্দেশ দিচ্ছে। একসময় আর আমি উত্তেজনা দমন করতে পারলাম না। একলাফে বেরিয়ে রাইফেল বাগিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, হ্যান্ডস আপ।
ফ্রাঙ্ক এবং হ্যারিস সম্ভবত আমার কাণ্ড দেখে একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। তারাও বেরিয়ে এলেন রাইফেল তাক করে।
লোকটা সঙ্গে সঙ্গে আলো নিবিয়ে দিল ফুঁ দিয়ে। ঘন অন্ধকারে কয়েক সেকেন্ড কিছু দেখতে পেলাম না। তারপর ফ্রাঙ্ক ও হ্যারিসের টর্চ জ্বলে উঠল। জুমোজুমোকে দেখলাম ডিগবাজি খেয়ে পড়েছে। গুলি ছুঁড়লাম। প্রাণীটি গর্জন করে টিলার গা বেয়ে গড়াতে গড়াতে নিচের দিকে চলে গেল।
হ্যারিস লোকটার বুকে রাইফেলের নল ঠেকিয়ে বলল, নড়লেই মারা পড়বে!
টিলার নিচের দিকে সেইসময় মহারাজার সেপাইদের হইহই শোনা গেল। তারা প্রাণীটাকে দেখতে পেয়েছে। মুহুর্মুহু গুলির শব্দ আর চিৎকার চেঁচামেচিতে রাতের জঙ্গলে হুলস্থূল হচ্ছিল। তারপর মশাল জ্বলতেও দেখলাম।
লোকটার হাত থেকে লণ্ঠন কেড়ে নিয়ে ফ্রাঙ্ক জ্বেলে দিলেন। বেশ লম্বা-চওড়া লোক সে। পরনে বুশশার্ট আর ব্রিচেস। মাথায় ঘন চুল, কোমরে বাঁধা বেল্টে রিভলবার ঝুলছে চামড়ার খাপে। বললাম, আপনি কি মহারাজা বাহাদুরের ভাই দুর্জয় সিং?
সে কোনও জবাব দিল না। কিন্তু পেছন থেকে মহারাজার সাড়া পাওয়া গেল। হাওর নামই দুর্জয় সিং। ওকে ছাড়বেন না। সারাজীবন আমাকে ও বিপদে ফেলতে চেয়েছে। তাছাড়া ওর নামে ব্রিটিশ সরকার হুলিয়া করেছেন। ওকে কালেক্টরের হাতে তুলে দিতে হবে।
দুর্জয় সিং মহারাজার দিকে ক্রুদ্ধদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, তার আগে আমি সবার কাছে তোমার কীর্তি ফাঁস করে দেব।
মহারাজা বাঁকা হেঁসে বললেন, কীর্তি ফাঁস করবে? কেউ বিশ্বাস করবে না।
দুর্জয় সিং বললেন, দাদামশাই বেঁচে নেই তাই। তবে তাঁর উইল আছে ব্রিটিশ সরকারের কাছে। তাতে স্পষ্ট লেখা আছে, বজ্ৰকান্ত মণি আমাকেই দিয়ে গেছেন। অথচ তুমি তা লুকিয়ে রেখে আমাকে বঞ্চনা করেছ।
আমরা অবাক হয়ে শুনছিলাম। মহারাজা বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে বললেন, তাই উদ্ধার করার জন্য কি এখানে মাটি খুঁড়েছিলে দুর্জয়?
দুর্জয় সিং বললেন, আমি জানি তুমি বজ্ৰকান্ত মণি এই জঙ্গলের ভেতর এনে লুকিয়ে রেখেছ। আমার ভয়ে আজমগড় প্রাসাদে রাখতেও সাহস পাওনি। মহারাজা প্রতাপ সিং হুইসল বাজালেন। কয়েকজন দেহরক্ষী হন্তদন্ত দৌড়ে এল। তারা নিচে অপেক্ষা করছিল সম্ভবত। মহারাজা হুকুম দিলেন, একে বেঁধে নিয়ে এসে তোমরা। এখনই আজমগড়ে ফিরে যেতে হবে। ….
.
০৬.
পরে সব কথা জানতে পেরেছিলাম, প্রতাপ সিং আর তার পিসতুতো ভাই দুর্জয় সিংয়ের মধ্যে বিবাদ বহু মূল্যবান একটা মণি নিয়ে। দুর্জয় সিং কোনও বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছিলেন, মহারাজা তার সংরক্ষিত জঙ্গলের ভেতর একটা টিলায় বিশেষ চিহ্নিত স্থানে সেই মণি লুকিয়ে রেখেছেন। কিন্তু জঙ্গলে এসে দুর্জয় সিংয়ের তা খোঁজাখুঁজি করায় বাধা ছিল। ফরেস্টগার্ডরা মহারাজার হুকুমে সবসময় নজর রেখে ঘুরত। তার ওপর আমাকে গেম ওয়ার্ডেনের চাকরি দিয়ে জঙ্গলে পাঠানো হল–যাতে আমিও নজর রাখি কেউ জঙ্গলে যেন ঢুকতে না পারে। দুর্জয় সিং ইতিমধ্যে গোপনে জঙ্গলে এসে আস্তানা করেছেন। পোষা জুমোজুমো নামে আফ্রিকার প্রাণীটিকে দিয়ে বিষাক্ত মৌচাকের সাহায্য জঙ্গলরক্ষীদের খতম করতে শুরু করেছেন। আমি এসে পড়ায় আমাকেও একই পদ্ধতিতে খতম করতে চেয়েছিলেন। কারণ জঙ্গলরক্ষীদের মতো আমারও দুর্জয় সিংকে দেখে ফেলার সম্ভবনা ছিল। নির্বিঘ্নে মণি অনুসন্ধানের কাজ করতে পারতেন না। যাইহোক, অট্টহাস। রোগের ফঁস হল এভাবে। দুর্জয় সিংয়ের গোপন আস্তানাও পাহাড়ের গুহায় আমরা আবিষ্কার করলাম।
গুহার ভেতর সার-সার বিষাক্ত মৌমাছির মৌচাক ছিল। গুহার মুখে শুকনো জ্বালানি ঠেসে আগুন ধরিয়ে পাথর চাপা দিলাম। আফ্রিকা থেকে দুর্জয় সিং ওই মৌমাছির একটা চাক এনেছিলেন। ক্রমশ তাদের বংশবৃদ্ধি হয়েছিল। সব পুড়ে মরল। আহত জুমোজুমোকে মৃত অবস্থায় জঙ্গলে পাওয়া গিয়েছিল।
আর বজ্ৰকান্ত মণি? মহারাজা তা আবার গোপনে কোথাও লুকিয়ে ফেলেন। তার হদিশ আমার জানা নেই।