কর্নেলের একদিন

কর্নেলের একদিন

মার্চের শেষ সপ্তাহে শনিবারের বিকেল। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার প্রশস্ত এবং এয়ারকন্ডিশন্ডু নিউজরুমে বসে খবর লেখার প্যাডে বিমূর্ত চিত্রকলার চর্চা করছিলুম। বাইরে অকালগ্রীষ্মের যাচ্ছেতাই উপদ্রব। তাই ঠিক করেছিলুম, রোদ। মুছে গেলে কেটে পড়ব।

আমার টেবিলের পর তিনটে টেবিলের ওধারে সুদৃশ্য একটি সেক্রেটারিয়েট টেবিল। সেখানে বসেন চিফ অব দ্য নিউজব্যুরো সত্যচরণ সেনগুপ্ত। আড়ালে আমরা সাংবাদিকরা তাকে বুড়ো চিপ বলে পরিহাস করলেও মুখোমুখি শ্রদ্ধাভরে সত্যদা বলে ডাকি। প্রকৃতপক্ষে সত্যদার আর কাজ বা দায়িত্ব বলতে তেমন কিছু নেই। নিয়মমতো ষাট বছর বয়সে তিনি রিটায়ার করলেও এই পত্রিকার জন্য তার প্রাণপাত পরিশ্রম, বিশ্বস্ততা এবং আনুগত্যের প্রতিদানে কর্তৃপক্ষ ওই পদটি তৈরি করে চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু অভ্যাসবশে সত্যদা শুধু খবরের উপর নয়, খবরলেখকদের উপরও খবরদারি করতে ছাড়েন না। আর ওই একটা অভ্যাস, পূর্ববঙ্গীয় ভাষায় কথা বলা। কলকাত্তাই বাংলায় কথা বলতে পারেন না, এমন কিন্তু নয়। আমরা অবশ্য বুঝতে পারি, তার এই অভ্যাসটা নিছক ইচ্ছাকৃত। রসিকতাই তাঁর উদ্দেশ্য।

এদিন সত্যদার চোখ পড়েছিল আমার দিকে। হঠাৎ আমার কানে এল, তিনি বলছেন–ও জয়ন্ত! কী করো?

আমার পাশের টেবিলের রিপোর্টার শ্যামল বসাক বলল–জয়ন্ত ছবি আঁকছে সত্যদা!

সত্যদা বললেন–জয়ন্ত ছবি আঁকতাছে? চিফ এডিটরেরে কইয়া ইনক্রিমেন্ট বন্ধ কইরা দিমু! তাকে কমু, জয়ন্তরে তো প্রশ্রয় দিয়া আকাশে তুলছেন। আর সে শুধু বইয়া বইয়া ব্যাতন লইতাছে।

হাসি চেপে বললুম–প্লিজ সত্যদা! আমার কথাটা আগে শুনুন।

কী তোমার কথা, কও শুনি!

–আজ যে আমার লেখার মতো কোনো খবরই নেই।

–কী কও বুঝি না। এই কইলকাত্তা হইল গিয়া একখানা মেট্রোপলিস। এখানে ঘণ্টায়-ঘণ্টায় কত ক্রাইম ঘটতাছে! কে কারে খুন করতাছে। কোথায় কারা নারীধর্ষণ করতাছে। কোনো ফ্ল্যাটে ডাকাত ঢুকতাছে।

শ্যামল ফোড়ন দিল–জয়ন্ত তো রাঘববোয়াল ছাড়া কিছু ধরতে হাত বাড়ায় না। চুনোপুঁটি বা রুই-কাতলাও সে গ্রাহ্য করে না। বুঝলেন সত্যদা?

চিফ রিপোর্টার মনীশদা বলে উঠলেন–চিন্তা কোরো না ভাই সত্য! ঠিক সময়ে চুনোপুঁটি বা রুই কাতলা ধরার জন্য আজ কিছু আছে নাকি দাদা এসে যাবে।

নিউজরুমে হাসির রোল উঠল। সত্যদা যে এই ব্যাপারটা জানেন না, আজ তা বুঝতে পারলুম। তিনি অবাক হয়ে বললেন–আইজ কিছু আছে নাকি দাদা মানে?

মনীশদা চারদিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন–ও শ্যামল! তোমাদের বুড়ো চিপ-সরি, ব্যুরো চিফকে কথাটা বুঝিয়ে দাও।

শ্যামল চেয়ার থেকে উঠে সত্যদার টেবিলের সামনে গিয়ে বসল এবং চাপা স্বরে কথাটা বুঝিয়ে দিতে থাকল। আসলে মনীশদা নতুন রিপোর্টার প্রবাল রায়কে কেন কে জানে পছন্দ করেন না। লালবাজার পুলিশ হেড কোয়ার্টারের একজন উচ্চপদস্থ অফিসার প্রবালের মেসোমশাই। সম্ভবত সেই সূত্রে প্রবাল দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার মতো বহুল প্রচারিত ও জনপ্রিয় কাগজে রিপোর্টার হয়ে সরাসরি ঢুকতে পেরেছে। সে যাই হোক, মনীশদার ক্ষোভের কারণ হল, প্রবাল তার নির্দেশ গ্রাহ্য করে না। ইচ্ছেমতো আসে-যায়। যখন সে আসে, তখন টেলিফোন তুলে লালবাজারে তার কোনো সোর্সকে বলে–আমি প্রবাল বলছি। আজ কিছু আছে নাকি দাদা? তারপর অপরাধ সংক্রান্ত ঘটনা কানে শুনে খবর লেখে। ঘটনাস্থলে তাকে আমি অন্তত কোনো দিনই যেতে দেখিনি।

প্রবাল ইতিমধ্যে জেনে ফেলেছে, তাকে অনেকেই আজ কিছু আছে নাকি দাদা নাম দিয়ে তার অগোচরে পরিহাস করে। কিন্তু সে কাকেও গ্রাহ্য করে না। কারও সঙ্গে বিশেষ কথাও বলে না। চুপচাপ নিজের চেয়ারে বসে থাকে এবং মাঝে মাঝে ডাইরেক্ট লাইনের রিসিভার তুলে ডায়াল করার পর সাড়া পেলে মৃদুস্বরে কথা বলে। কী কথা সে বলে, তা পাশের টেবিলেরও কেউ শুনতে পায় না। কিন্তু প্রতিদিন কিছু-না কিছু সাংঘাতিক খবর সে সত্যিই লেখে। কিন্তু একদিন বিভ্রাট বেধেছিল। সেদিন নাকি প্রবাল টেলিফোনে যাঁকে পেয়ে বলেছিল, আজ, কিছু আছে নাকি দাদা। সেদিন দৈবক্রমে তার মেসোমশাই নাকি ফোনের অন্য প্রান্তে ছিলেন।

শ্যামলের কথা শুনে সত্যদা হাসছিলেন। একটু পরে তিনি আগের কাজে ফিরে গেলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন–ও জয়ন্ত! রাঘববোয়ালই যদি ধরবা, তবে তোমার বুড়ারে ফোন কর না ক্যান?

বললুম–প্রখ্যাত ন্যাচারোলজিস্ট কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে আপনি বুড়ো বলছেন সত্যদা?

–আরে কী যে কও বুঝি না। দাড়ি-গোঁফ সব সাদা হইয়া গেছে। টাকের নিচে যে কয়খান চুল আছে, তা-ও ব্যাপক সাদা! তারে বুড়া কইলে দোষ হয় না। হঃ! আমাকে যদি বুড়া কও, কইতে পারো। তো তাকে একবার ফোন কইরা দ্যাখো, কিছু পাও নাকি।

কর্নেল কি বাড়িতে থাকবার মানুষ? কোথায় কোন্ পাহাড়ে জঙ্গলে দুর্লভ প্রজাতির পাখি, প্রজাপতি বা অর্কিডের খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আজ অফিসে আসবার আগে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে তাকে ফোন করেছিলাম। ষষ্ঠীচরণ বলল, তার বাবামশাই এখনও ফেরেনি।

সত্যদা জিজ্ঞেস করলেন-তোমার বুড়ার সারভ্যান্ট ওনারে বাবামশাই কয় নাকি? আচ্ছা। এক কাম কর। তোমাগো সেই যে এক্স-পুলিশ অফিসার প্রাইভেট ডিটেকটিভ–কী য্যান কও ওনারে?

হাসি পেল। বললুম–পুরো নাম কৃতান্তকুমার হালদার। অবশ্য কে কে হালদার নামেই উনি পরিচিত। আমি আর কর্নেল ওঁকে হালদারমশাই বলি। কিন্তু আপনার সঙ্গে একটা ব্যাপারে ওঁর খুব মিল।

-কও শুনি।

 –উনিও আপনার মতো পূর্ববঙ্গীয় ভাষায় কথা বলেন।

–হঃ! মাতৃভাষা ছাড়ম ক্যান?

–হালদারমশাইও তা-ই বলেন। উনি আরও কী বলেন জানেন সত্যদা? মাতৃভাষার জন্য ঢাকায় তরুণেরা প্রাণ দিয়েছে। মাতৃভাষা নিয়ে সংগ্রাম করে তারা স্বাধীন বাংলাদেশ গড়েছে। এরপর মাতৃভাষা কি ছাড়া যায়?

মনীশদা বলে উঠলেন–আর শিলচরে বাঙালিরা প্রাণ দেয়নি?

 সত্যদা বললেন–ছাড়ান দাও হে মনীশ। আমরা পলাইয়া আইছিলাম। আর আমাগো নেক্সট জেনারেশন শুধু প্রাণ দ্যায় নাই, স্বাধীন একখান দ্যাশ গড়ছে।

মনীশদা বর্ধমানের লোক। খাপ্পা হয়ে কী বলতে যাচ্ছেন, এমন সময় বেয়ারা হরিবন্ধু নিউজরুমে ঢুকে ঘোষণা করল–বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে।

অমনি সারা নিউজরুম জুড়ে কোরাস উঠল–বৃষ্টি বৃষ্টি। মিষ্টি মিষ্টি। কে বেসুরো গলায় চেঁচিয়ে বলল–ফিষ্টি! ফিষ্টি! রাস্তায় জল। যানবাহন অচল। ক্যান্টিনে ফিষ্টি!

এই সুযোগে কেটে পড়লুম। চারতলা থেকে লিফটে নেমে রিসেপশনের লাউঞ্জে ভিড় দেখতে পেলুম। রিসেপশন কাউন্টারের পাশ দিয়ে বেরিয়ে পোর্টিকোর সিঁড়িতে দাঁড়ালুম। হরিবন্ধু যে সুরে বৃষ্টি ঘোষণা করেছে, তেমন কিছু নয়। তবে ছাতা ছাড়া যারা বেরোবে, তারা পুরো ভিজে যাবে।

একটু ইতস্তত করছিলুম। পত্রিকাভবনের সংলগ্ন যে গ্যারাজে আমার ফিয়াট গাড়িটা আছে, সেখানে পৌঁছতে হলে আমাকে অন্তত মিটারদশেক খোলা লন পেরিয়ে যেতে হবে এবং কিছুটা ভিজতেই হবে। একটু পরে দেখি, অ্যাড ডিপার্টমেন্ট-এর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর তুষার সিনহার ড্রাইভার মধু আমার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে উদাস চোখে বৃষ্টি দেখছে। তার চোখে আমার চোখ পড়তেই সে সেলাম ঠুকে বলল-স্যার কি বেরোচ্ছেন?

বললুম–হ্যাঁ মধু! কিন্তু গাড়ির কাছে যেতে ভিজে যাব বলে অপেক্ষা করছি।

মধু ব্যস্তভাবে বলল–আমাকে চাবি দিন স্যার! গাড়ি এনে দিচ্ছি। বৃষ্টি কখন ছাড়বে ঠিক নেই।

তাকে গাড়ির চাবি দিলুম। সে রুমালে মাথা ঢেকে দৌড়ে চলে গেল। তারপর আমার গাড়িটা ব্যাক করে এনে সিঁড়ির কাছে দাঁড় করাল। গাড়ি থেকে বেরিয়ে সে আমার দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে বলল–অনেকদিন পরে বৃষ্টি। তাই স্যার, আমি লক্ষ্যই করিনি আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন।

আমি গাড়ির দরজা খুলেছি, এমন সময় দেখি, অ্যাড ডিপার্টের চন্দ্রকণা মজুমদার নেমে আসছে। সিঁড়ির শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে সে মিষ্টি হেসে বলল– জয়ন্তদা! আপনি তো পার্ক স্ট্রিট হয়ে সল্টলেক যাবেন। তাই না?

পুলকিত হয়ে বললুম–তুমি কোথায় যাবে?

যাওয়ার পথে আমাকে পার্ক স্ট্রিটে নামিয়ে দেবেন?

–নিশ্চয় দেব। উঠে পড়ো।

সে গাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরে গিয়ে আমার বাঁ পাশে বসল। কর্তৃপক্ষ ইদানীং বিজ্ঞাপন বিভাগে বাছাই করা যে সুন্দরী তরুণীদের চাকরি দিয়েছেন, চন্দ্রকণা তাদের মধ্যে সেরা। ওকে অনেকেই আড়ালে চাঁদের কণা বলে। আমিও যে বলি, এমন নয়। সুন্দরী মেয়েরা কি টের পায়, অফিসের পুরুষ সহকর্মীরা তাদের কী চোখে দ্যাখে? আসলে এই দেশটা তো এখনও ইউরোপ-আমেরিকা হয়ে ওঠেনি। অবশ্য কালক্রমে সুন্দরী সহকর্মিণীরা পুরুষ সহকর্মীদের কাছে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেন, এ-ও ঠিক। তবে চন্দ্রকণা সম্পর্কে আমার মনোভাবটা অন্যরকম। ওর মধ্যে চারিত্রিক একটা গভীরতা আছে, ব্যক্তিত্বও আছে, যা ওর আচার ব্যবহারে বা কথাবার্তায় টের পাওয়া যায়। এককথায় বলতে হলে বলব, চন্দ্রকণা, সেই মেয়ে, যাকে রহস্যময়ী আখ্যা দেওয়া যায়। কিন্তু সমস্যা হল, চন্দ্রকণা মজুমদারের সেই রহস্যটা আমি ব্যাখ্যা করতে পারব না।

চন্দ্রকণার সঙ্গে আমার পরিচয় বেশিদিনের নয়। পত্রিকাভবনের চারতলায় একপাশে নিউজরুম, অন্যপাশে অ্যাডরুম এবং মধ্যিখানে মোটামুটি প্রশস্ত টানা করিডর। সেই করিডরেই অ্যাড ডিপার্টের এক অফিসার অনীশ সোম আমার সঙ্গে চন্দ্রকণার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল।

–এই যে জয়ন্তদা! এই দেখুন আপনার লেখার একজন ফ্যান! চন্দ্রকণা মজুমদার। সবে জয়েন করেছে। চন্দ্রকণা! এই ভদ্রলোক তোমার প্রিয় সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী।

চন্দ্রকণা আমাকে প্রণাম করতে একটু নত হয়েছিল। বাধা দিয়ে বলেছিলুম না, না। প্রণাম কেন?

অনীশ হাসতে হাসতে বলেছিল–চন্দ্রকণা আপনার দিকে ভালো করে তাকায়নি জয়ন্তদা! আপনাকে বুড়ো ফুড়ো ভেবে এসেছে এতদিন! আসলে ও কর্নেলকাহিনির ভক্ত। কর্নেল একজন বুড়োমানুষ। অতএব আপনি তার সহচর হিসেবে একজন বুড়োমানুষ।

চন্দ্রকণা অপরূপ ভঙ্গিতে ভুরু কুঁচকে বলেছিল–সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরীর বয়সও আমার মুখস্থ। ওঁর বয়স পঁচিশ। আর আমার তেইশ। কাজেই অগ্রজকে প্রণাম করা চলে। কিন্তু আসলে আমি প্রণাম করতে যাচ্ছিলুম আমার শ্রদ্ধেয় এক লেখককে।

আমি বলেছিলুমকী সর্বনাশ। আপনি এই ক্রাইম রিপোর্টারকে লেখক বানিয়ে ছাড়লেন?

চন্দ্রকণা বলেছিল–নিছক লেখক নন আপনি। সাহিত্যিক! ওঃ! আপনার লেখা কত যে পড়েছি!

অনীশ বলেছিল–উরেব্বাস! জয়ন্তবাবুর ক্রাইম-রিপোর্টাজে সাহিত্যগুণ থাকে।

তাই আমার মতো ওঁর ভক্ত অসংখ্য। খবরের কাগজ থেকে সেই সব রিপোর্টাজ বই হয়ে বেরুলেই আমি কিনে ফেলি। জয়ন্তবাবু! আপনি আপনার কর্নেলসাহেবের সঙ্গে একদিন আমার আলাপ করিয়ে দেবেন? ওঁকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে।

অনীশ বলেছিল–চন্দ্রকণা কিন্তু থিয়েটারে অভিনয় করে শুনেছি। জয়ন্তদা! সাবধান!

চন্দ্রকণা হেসে ফেলেছিল।–ভ্যাট! এটা কি স্টেজ! যা-তা বলবেন না অনীশদা।

–তা হলে এই কাগজে কাজ করছ, এই করিডরের ওপাশের দরজা খুলে নিউজরুমে ঢুকে জয়ন্তদার সঙ্গে আলাপ করতে যাওনি কেন?

যাইনি! একটু সংকোচ ছিল তা-ই। এখনও নিউজরুমের কারও সঙ্গে আমার আলাপ হয়নি। আলাপ হয়ে গেলে তার সঙ্গে গিয়ে জয়ন্তবাবুর সঙ্গেও আলাপ করে আসতুম। আজ সৌভাগ্যক্রমে জয়ন্তবাবুকে দেখতে পেলুম।

জয়ন্তদা! আপনার একজন সুন্দরী ফ্যানের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলুম কিন্তু।

চন্দ্রকণা আবার অপরূপ ভ্রূ-ভঙ্গি করে বলেছিল–সুন্দরী না ছাই! অনীশদা! আমাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে ভালো হবে না কিন্তু।

অনীশ মুচকি হেসে বলেছিল–জয়ন্তদা! অ্যাড-রুমে ঢুকলে দেখবেন সত্যিই আমার চারদিক ঘিরে এখন চাঁদের হাট!….

এভাবেই আলাপ হয়েছিল চন্দ্রকণা মজুমদারের সঙ্গে। কালক্রমে সে আমাকে জয়ন্তদা বলে ডাকতে শুরু করেছিল। তবে তার সঙ্গে তত কিছু ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠার সুযোগ আমার ছিল না। করিডর, লাউঞ্জ বা কখনও ক্যান্টিনে দেখা হয়েছে। সে প্রতিবারই জানতে চেয়েছে, আমি কর্নেলের সঙ্গে কোনো সাংঘাতিক রহস্যজনক ঘটনার পিছনে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছি কি না। আর সেই একই প্রশ্ন, কবে তাকে কর্নেলের কাছে নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু যখনই বলেছি, আজ ছুটির পর। তুমি যেতে চাইলে কর্নেলের কাছে নিয়ে যাব–উনি আজ বাড়িতে আছেন, তখনই চন্দ্রকণা বলেছে–আমার দুর্ভাগ্য জয়ন্তদা! আজ আমার একটা জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। সে কি আমার সঙ্গে একা যেতে চায় না? মাঝেমাঝে আমার ক্ষোভ হয়নি এমন নয়। কিন্তু আমি বিখ্যাত সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী, একটি মেয়ে যত সুন্দরী বা স্মার্ট হোক, তাকে নিয়ে মাথাব্যথা হবে কেন–এই অহঙ্কারে নিজেকে তুষ্ট রেখে এসেছি। কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গগুণে এ যাবৎ অভিজাত সমাজের সুন্দরীদের কম দেখিনি। কত শ্রেষ্ঠ সুন্দরী ফিল্মস্টারের সঙ্গেও পরিচয় হয়েছে। আর কে এক চন্দ্রকণা মজুমদার।

অথচ সেবার শেষ মার্চের এক বিকেলে বৃষ্টির সুযোগে চন্দ্রকণা মজুমদারকে বাড়ি ফেরার পথে একটুখানি লিফট দিতে পেরে বিখ্যাত সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী যেন বৃষ্টির মতোই কোমল আর সিক্ত হয়ে গিয়েছিল।

কে জানে কেন একটু বৃষ্টি হলেই কলকাতার রাস্তায় যানজট অনিবার্য হয়ে ওঠে। এসপ্ল্যানেড পেরিয়ে যাওয়াই দুঃসাধ্য, এত সব গাড়ির বিশৃঙ্খল গড্ডলিকা প্রবাহ। চন্দ্রকণাকে উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছিল। সে মাঝেমাঝে আলতোভাবে ঘড়ি দেখছিল। অগত্যা জিজ্ঞেস না করে পারলুম না।

-তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে বুঝি?

চন্দ্রকণা ঠোঁটের কোণে কেমন একটু হেসে বলল–দেরি হচ্ছে না বলব না। কিন্তু উপায় তো নেই।

–কারও সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে কি?

চন্দ্রকণা আস্তে বলল–বিশেষ কারও সঙ্গে নয়। সাড়ে পাঁচটায় আমার ক্লাশ।

একটু অবাক হয়ে বললুম–ক্লাশ মানে? তুমি কীসের ক্লাশের কথা বলছ?

–শুনলে আপনি হাসবেন।

–হাসব কেন? ব্যাপারটা তো সিরিয়াস।

চন্দ্রকণা ছোট্ট একটা শ্বাস ছেড়ে বলল–খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন বিভাগে চাকরি পেয়েছি, সেজন্য নয়। আসলে প্রথমে ব্যাপারটা আমার খেয়ালই ছিল। পরে নেশা হয়ে গেল। খুলে বলা চলে আপনাকে। আমি অ্যামবিশাস। নেশাটা ভবিষ্যতে পেশা করতে পারলে কাগজের চাকরিটা ছেড়ে দিতুম। আপনি তো সত্যসেবক পত্রিকার সঙ্গে আমার চেয়ে বেশিদিন যুক্ত আছেন। কিন্তু আপনি সাংবাদিক। আর আমার কাজটা হল বড় কোম্পানির বিজ্ঞাপনের জন্য ছোটাছুটি। ডাইরেক্টর সাহেব তো টেলিফোনে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েই খালাস। এদিকে। আমাকে বা আমার মতো আরও যেসব মেয়ে আছে, তাদের গিয়ে পড়তে হয় প্রায় বাঘের খাঁচায় কেঁদো বাঘের মুখোমুখি। ব্যাপারটা অন্তত আমার কাছে এত অপমানজনক, তা বলার নয়। বিজ্ঞাপন দেওয়ার ক্ষমতা যাঁর, তিনি সুযোগ। নেওয়ার চেষ্টা করেন। জয়ন্তদা! আপনি আমার কথা বুঝতে পারছেন কি জানি না!

বললুম–পারছি বইকি। কিন্তু তোমার এ থেকে মুক্তির প্ল্যানটা কী, তা বুঝতে পারিনি। মানে ওই ক্লাশ ব্যাপারটা।

চন্দ্রকণা হাসল। পার্ক স্ট্রিটে একটি একটা মডেলিং স্কুলে ঢুকেছি। বিজ্ঞাপনের মডেলিং।

-তাই বলো! আজকাল কাগজে এসব বিজ্ঞাপন বেয়োয় দেখেছি। কিন্তু ক্লাশ করা বলছ কেন?

–বা-রে! বিজ্ঞাপনের মডেল হওয়া তত সহজ নয়। এটাও অভিনয়। কিন্তু মুখের ভাষা দিয়ে নয়, শরীর দিয়ে। শরীরের ভঙ্গি দিয়ে।

বডি-ল্যাঙ্গুয়েজ বলো!

–ঠিক বলেছেন। ওই ব্যাপারটা শিখতে হয়। মুখের চেহারা দেখে কোনো মেয়েকে সুন্দরী মনে হলেও ফোটোগ্রাফে তাকে সুন্দরী দেখাবে এমন কিন্তু নয়। ফোটোজেনিক ফেস বলে একটা কথা আছে। আবার মুখের চেহারা গৌণ। মুখ্য হল বডি এবং আপনি যা বললেন, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ।

এই সময় যানজট ছাড়তে থাকল। বললুম–মডেলিং স্কুলটা চালায় কে?

–মিসেস বৈজয়ন্তী অগ্রবাল নামে এক মহিলা। যৌবনে নিজেও বিখ্যাত মডেল ছিলেন। কয়েকটা কনজিউমার গুড়সের মডেলিং-এ ওঁর খ্যাতি ছিল।

–উনি কি শুধু অধ্যাপিকার মতো বক্তৃতা দেন আর তোমরা মনোযোগী ছাত্রীর মতো শোনো? খাতায় নোট নাও নিশ্চয়?

চন্দ্রকণা হেসে উঠল–হ্যাঁ। বক্তৃতাও শুনতে হয়। তবে এ বয়সেও ওঁর ফিগার অসাধারণ। নিজেও. ডেমনস্ট্রেশন দেন। তা ছাড়া প্রতিদিন ক্লাশে কোনো না কোনো একজন বিখ্যাত মডেলগার্ল থাকেন। কোন কনজিউমার গুডসে কী ধরনের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ছাড়াও বিশেষ পোজ-পশ্চার মানাবে–এই সব আর কী!

–শুধু মেয়েরা মডেলিং শেখে? নাকি ছেলেরাও?

-হ্যাঁ। ছেলেরাও শেখে। কোন ছেলে কোন মেয়ের জুটি হলে বিশেষ কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপন পাবলিকের মাথা খাবে, তা মিসেস অগ্রবাল ঠিক করে দেন।

চন্দ্রকণা হেসে উঠল আবার। সে এত হাসতে পারে, তা জানবার সুযোগ পাইনি। এখন তাকে আগের মতো রহস্যময়ী বলে মনে হচ্ছিল না। পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে পৌঁছে জিজ্ঞেস করলুম–তোমার এই মডেলিং স্কুলের নাম কী?

–অজন্তা।

–শুধু অজন্তা?

–হ্যাঁ। জয়ন্তদা! আপনি তো এই রাস্তায় প্রতিদিন যাতায়াত করেন। মুনলাইট বারের উপরদিকে চারতলায় অজন্তা-র সাইনবোর্ড চোখে পড়েনি?

নাঃ! লক্ষ করিনি। তবে মুনলাইট বার আমার চেনা জায়গা। কর্নেলেরও। তার সঙ্গে কতদিন ওখানে বিয়ার খেতে গেছি। কর্নেল একটু-আধটু ড্রিংক করেন। তবে সেটা কোনো বড় পার্টিতে।

চন্দ্রকণা একটু চুপ থাকার পর আস্তে বলল–কর্নেলের সঙ্গে আমার একবার আলাপ করা দরকার।

তার এই কথাটা আগের মতো নয় বলে মনে হল। দরকার শব্দটা আমার কানে বিধেছিল। তাই একটু হেসে বললুম–কোনো রহস্যের পাল্লায় পড়েছ। নাকি?

চন্দ্রকণা আমার কথার জবাব না দিয়ে বলে উঠল-মুনলাইট এসে গেছে জয়ন্তদা! আমাকে এখানে নামিয়ে দিন।

মুনলাইটের সামনে ফুটপাতের উপরটা পের্টিকোর মতো। চারটে মোটা থাম আছে। চারদিকে আলো জ্বলে উঠেছে কিন্তু তখনও টিপটিপ করে বৃষ্টি ঝরছিল। তাই ফুটপাত ঘেঁষে গাড়ি দাঁড় করালুম। আচ্ছাদিত ফুটপাতে ভিড় ছিল। চন্দ্রকণা গাড়ি থেকে নেমে পা বাড়াতেই এক যুবক তাকে লুটে নেওয়ার ভঙ্গিতে তার হাত ধরে টেনে নিল। বলল–আসতে পারলে শেষ অব্দি? আমি তো ভাবছিলাম, তুমি বৃষ্টিতে কোথাও আটকে গেলে প্ল্যানটাই ক্যান্সেল করতে হত!

চন্দ্রকণা ঘুরে আমাকে বিদায় সম্ভাষণের চেষ্টা করছিল। কিন্তু টিশার্ট জিন্স পরা স্বাস্থ্যবান সুশ্রী যুবকটি তাকে সে-সুযোগ দিল না। ভিড়ের মধ্যে তারা হারিয়ে গেল। আমার পিছনে কয়েকটা গাড়ির বিরক্তিকর হর্নের শব্দ। কাজেই আমাকে এগিয়ে যেতে হল। কিন্তু চন্দ্রকণা মজুমদারের জন্য এক স্বাস্থ্যবান সুশ্রী ও স্মার্ট যুবকের প্রতীক্ষা এবং তারপর চন্দ্রকণাকে লুট করে নিয়ে যাওয়ার ভঙ্গিসহ যুবকটির কথাগুলো আমার মাথায় মাছির মতো ভনভন করছিল।

ই এম বাইপাসে সাবধানে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল, যুবকটি নিঃসন্দেহে চন্দ্রকণার প্রেমিক। তার প্রতি ঈর্ষায় নয়, ক্রোধে মনে মনে জ্বলে উঠলুম। তার প্রেমিকাকে কে গাড়িতে লিফট দিল, তার প্রতি সে একবারও তাকাল না। অসভ্য বর্বর কোথাকার!

.

পরদিন রবিবার। সাড়ে সাতটায় উঠে পড়েছিলুম। ফ্ল্যাটে আমি একা। কাজের ছেলে সুরেশ ছুটি নিয়ে মেদিনীপুরে তার গ্রামে গেছে। প্রাতঃকৃত্যের পর কিচেনে গিয়ে চা করলুম। তারপর কাল সন্ধ্যার ঘটনাটা মনে পড়ে গেল। আজ আমার ছুটির দিন। চন্দ্রকণার বিজ্ঞাপন-বিভাগেও আজ ছুটির দিন। সোমবার অফিসে তার সঙ্গে দেখা হলে কীভাবে তাকে চার্জ করব, নাকি ব্যাপারটা গ্রাহ্যই করব না এবং তাকে আর তত পাত্তাও দেব না, এই সব কথা ভেবে নিজেকে শান্ত করছিলুম।

কর্নেল কলকাতায় থাকলে ইলিয়ট রোড এলাকায় তার অ্যাপার্টমেন্টে রবিবারটা আমি কাটিয়ে আসি। কাল তার পরিচারক ষষ্ঠীচরণ টেলিফোনে জানিয়েছিল, বাবামশাই নেই। এই বিচ্ছিরি রবিবারটা কী করে কাটাব, তা-ই ভাবছিলুম। এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। কোনো রথী-মহারথীর নাম আর কোনো খবর ছাপিয়ে দেওয়ার জন্য প্রায়ই ফোন আসে। তাই রিসিভার তুলে রং নাম্বার বলে নামিয়ে পাশে রেখে দিই। এখনও সেই অভ্যাসে রিসিভার তুলে বললুম–রং নাম্বার।

তখনই কানে এল সুপরিচিত ও সস্নেহ কণ্ঠস্বর–রাইট নাম্বার ডার্লিং।

আনন্দে মন ভরে গেল। নারী-পুরুষ নির্বিচারে ডার্লিং সম্ভাষণ করার মতো পৃথিবীতে একটি লোকই আছেন। তিনি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। বললুম–মর্নিং বস্। কখন ফিরলেন?

মর্নিং জয়ন্ত! কিন্তু তুমি কেন বলছ কখন ফিরলুম? আমি তো বাইরে কোথাও যাইনি।

কী আশ্চর্য! কাল দুপুরে অফিস থেকে আপনাকে ফোন করেছিলুম। ষষ্ঠী বলল, বাবামশাই বেইরেছেন। কখন ফিরবেন বলে যাননি। আমি তো ভাবছি আপনি না ফিরলে কীভাবে ছুটির দিনটা কাটবে। আপনি ফিরেছেন শুনে সত্যিই খুব খুশি হলুম।

কর্নেলের হাসি ভেসে এল।ষষ্ঠীটাকে নিয়ে আর পারা যায় না। আর জয়ন্ত, তুমিও মাঝেমাঝে–নির্বোধ বলব না, কারণ ওটা সাতসকালে একটা বিচ্ছিরি গালাগালি-হা, বোধহীন হয়ে যাও। আমি বেরিয়েছি মানে কি কলকাতার বাইরে। গেছি? তা ছাড়া কখন ফিরব তাও ষষ্ঠীকে বলে যাই না, তা তুমি ভালোই জানো। যাই হোক, চলে এসো। এ বৃদ্ধ মাঝেমাঝে খুব নিঃসঙ্গ বোধ করে। আজ সেই দিন!…..

তখনই ফ্ল্যাটে তালা এঁটে এবং যথারীতি একটা ব্যাগে আমার লাইসেন্সড রিভলভার ও দরকারি কিছু কাপড়চোপড় ইত্যাদি ভরে নিয়ে নেমে এলুম। তারপর গ্যারাজ থেকে ফিয়াট গাড়িটা বের করে ই এম বাইপাস হয়ে উড়ে চললুম। রবিবার সকাল আটটায় বাইপাসে গাড়ির সংখ্যা কম ছিল।

কর্নেলের বাড়ির লনে পার্কিং জোনে গাড়ি রেখে তিনতলায় উঠে গেলুম।

জাদুঘর সদৃশ বিশাল স্টাডি-কাম-ড্রয়িং রুমে কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে একটা প্রকাণ্ড সচিত্র বই পড়ছিলেন। না–নিছক পড়া নয়। আতস কাঁচে কিসের রঙিন ছবি দেখছিলেন এবং পাশের টেবিলে একটা প্যাডে কী সব নোট করছিলেন।

আমার দিকে না তাকিয়েই তিনি বললেন–বসো! তারপর বলল কী ঘটেছে!

অবাক হয়ে বললুমঘটেছে মানে? আপনি কেমন করে জানলেন–আমার কথার উপর কর্নেল সহাস্যে বললেন–নিজেই শেষ অব্দি ধরা দিলে জয়ন্ত!

–কী আশ্চর্য! আপনি দেখছি সত্যিই অন্তর্যামী!

–মোটেও না।

কাল আমি অফিস থেকে আপনাকে ফোন করেছিলুম, শুধু এই থেকেই আপনি,

কর্নেল আবার আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন–কখনো না। প্রথম সূত্রটা বলি। আজ সকালে তোমাকে রিং করার পর রং নাম্বার বলেছিলে বটে, কিন্তু তারপর তোমার কণ্ঠস্বরে একটা জোরালো আবেগ টের পেলুম। যেন আমার ফোন পেয়েই তুমি ডুবজল থেকে মাথা তুলে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলে। হ্যাঁ। তোমার কণ্ঠস্বরে প্রবল আবেগ শুধু নয়, ওই রকম একটা অনুভূতিও কাজ করছিল। এবার দ্বিতীয় সূত্রটা বলি। তোমার গাড়ির শব্দ আমি বুঝতে পারি। বহুপরিচিত শব্দ। গাড়ির শব্দ থেমে যেতেই কানে এল, সিঁড়িতে তোমার পায়ের শব্দ আজ খুব দ্রুত এবং জোরালো। এমন করে তুমি আমার তিনতলায় অ্যাপার্টমেন্টে ওঠো না। তৃতীয় সূত্রটা শোনো। তুমি আজ দু-দুবার কলিং বেল বাজিয়েছ। এই তিনটি সূত্রের যোগফল হিসেবে আমার সিদ্ধান্ত, কোথাও কিছু ঘটেছে এবং সেই ঘটনার সঙ্গে তুমি জড়িত। অথবা তুমি সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।

দ্রুত বললম–ওঃ কর্নেল। প্লিজ! দ্যাটস এনাফ। বরং আপনি ওটা কী করছেন বলুন। কর্নেল হাসিমুখে বইটার সেই পাতা দেখিয়ে বললেন–এটা রেনবো অর্কিড। আশা করি এই অর্কিডের ফুলের কথা তোমার মনে আছে। মার্চ থেকে এপ্রিল অব্দি এই অর্কিডের ফুল ফোটে এবং রোদ্দুরে রামধনুর ছটা দেখিয়ে দেয়। বিরল প্রজাতির এই অর্কিড আবিষ্কার করেছিলেন ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে রবার্ট স্টিলার নামে একজন ইংরেজ লেটন্যান্ট। বিহার-বাংলা সীমান্তে ছোটনাগপুর পবর্তমালার কয়েকটা শৈলশিরা যে অঞ্চল দিয়ে গেছে–

ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে কফি আর স্ন্যাক্স নিয়ে আসায় কর্নেল থেমে গেলেন। তারপর চোখ কটমটিয়ে বললেন–ষষ্ঠী! তুই জয়ন্তকে বলেছিলি আমি কলকাতার বাইরে গেছি?

ষষ্ঠীচরণ জিভ কেটে কাঁচুমাচু মুখে বলল–আজ্ঞে বাবামশাই! দাদাবাবু আমার কথাটা মনে হয় ঠিক বুইতে পারেননি।

–ঠিক বুইতে পেরেছিলেন দাদাবাবু। গেট আউট! নৈলে আজ তোকে কেটে ব্রেকফাস্ট করব।

ষষ্ঠী বলল–সেদিনকে জজসাহেব বলছিলেন না? তোমার বাবামশাইকে বাঘে যদি খায়, তা হলে তোমাকে বাঘ টুপি করবে! আমি যে বেজায় রোগা! টুপি হওয়ার যুগ্যি।

–টুথপিক! ইংরেজি শব্দটা মনে রেখেছিস দেখছি। ওরে হাঁদারাম! খড়কে বল। টুথপিক হল খড়কে। দাঁতের ফাঁকে আমার মাংসের কুচি আটকে গেলে বাঘ তোকে খড়কে করবে!

ষষ্ঠীচরণ হাসতে হাসতে চলে গেলে কর্নেল বললেন–কফি খাও জয়ন্ত! আগে নার্ভ চাঙ্গা করো। তারপর কথা হবে।

এই সময় টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। ক্রমাগত হা এবং হ্যাঁ করতে থাকলেন। লক্ষ করলুম, তার দৃষ্টি কিন্তু আমারই দিকে এবং মাঝে মাঝে নিঃশব্দ হাসি তার মুখে ফুটে উঠছিল। কয়েক মিনিট পরে রিসিভার রেখে তিনি বললেন–তাহলে জয়ন্ত এই ব্যাপার?

 ব্যস্তভাবে বললুমকী ব্যাপার কর্নেল? কার ফোন।

লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের এস আই নরেশ ধর এখনই তোমাকে পাকড়াও করতে আসছেন। তোমার সল্টলেকের ফ্ল্যাটে ফোন করে উনি সাড়া পাননি। এদিকে আজ রবিবার। কাজেই আমার এখানে তোমার থাকার সম্ভাবনা। উনি জেনে নিলেন তুমি এখানে আছ কি না।

কথাগুলো শুনতে শুনতে আমি চমকের ধাক্কায় প্রায় নির্জীব হয়ে পড়েছিলাম। কর্নেলের কথা শুনে বুঝতে পারছিলুম উনি কৌতুক করছেন না। শ্বাসপ্রশ্বাসে মিশিয়ে বললুম–আমার কাছে নরেশবাবু আসছেন। তার মানে, চন্দ্রকণা মজুমদার সংক্রান্ত কোনো ঘটনা নয় তো?

কর্নেল চুপচাপ কয়েক চুমুক কফি পানের পর বললেন–হ্যাঁ। নামটা চন্দ্রকণা মজুমদার। জয়ন্ত! একবার একটি মেয়েকে তোমার গাড়িতে লিফটে দিতে গিয়ে সাংঘাতিক বিপদে পড়েছিলে। তাতে তোমার শিক্ষা হয়নি দেখছি।

–চন্দ্রকণা মজুমদার আমাদেরই কাগজের অফিসের মেয়ে।

–তাকে তুমি কাল সন্ধ্যার একটু আগে বৃষ্টির সময় তোমার গাড়িতে তুলেছিলে!

বৃষ্টির জন্য সে পার্ক স্ট্রিটে অজন্তা নামে একটি মডেলিং স্কুলে যেতে পারছিল না। তারই অনুরোধে তাকে সেখানে পৌঁছে দিয়েছিলাম। কিন্তু এতে আমার কী অপরাধ?

কর্নেল কফি শেষ করে চুরুট ধরিয়ে বললেন–একটি মেয়েকে তুমি তার অনুরোধে লিফট দিয়েছিলে, একথা পুলিশ বিশ্বাস করতে চাইবে না। কারণ–

–চন্দ্রকণার কি কোনো বিপদ হয়েছে?

হয়েছে। গতরাতে চন্দ্রকণা বাড়ি ফেরেনি। তার বাবা তোমাদের পত্রিকার অফিসে খোঁজ নেওয়ার পর পার্ক স্ট্রিটের অজন্তা মডেলিং স্কুলে খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন। তখন রাত প্রায় বারোটা। অজন্তা বন্ধ ছিল। কেয়ারটেকার বলেছে, চন্দ্রকণাকে প্রতিদিনের মতো রাত নটায় সে বেরিয়ে যেতে দেখেছে। গতরাতেই ভদ্রলোক ভবানীপুরের তার পাড়ার কাউন্সিলারের সাহায্যে লালবাজার মিসিং স্কোয়াডে খবর দিয়েছিলেন। চন্দ্রকণার ছবিও দিয়েছিলেন। এদিকে আজ ভোরে হেস্টিংস থানার পুলিস ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের দক্ষিণে একটা ক্লাবের পিছনে ঝোঁপের মধ্যে একটি মেয়ের ডেডবডি উদ্ধার করেছে। মিসিং স্কোয়াড প্রভাবশালী সেই কাউন্সিলারের খাতিরে তখনই সেখানে লোক পাঠায়। ডেডবডিটা পরীক্ষা করে তারা নিশ্চিত হয়।

প্রায় চেঁচিয়ে উঠলুম-চন্দ্রকণার ডেডবড়ি?

—হ্যাঁ।

বলে কর্নেল চুরুট টানতে মন দিলেন। যথারীতি তিনি চোখ বুজে ধ্যানস্থ। বললুম–কর্নেল! এবার আমার কাছে ঘটনাটা শুনুন। আপনি নিজেই তো টের পেয়েছিলেন, আমি কোনো ঘটনা আপনাকে জানাতে উদ্গ্রীব।

কর্নেল চোখ বুজেই বললেন–হুঁ। বলো।

কাল বিকেল পাঁচটায় বৃষ্টির সময় থেকে যা-যা ঘটেছিল, আমি কর্নেলকে তা পুঙ্খানুপুঙ্খ জানালুম। সেই যুবকটির চেহারার বর্ণনা দিলুম। সে চন্দ্রকণাকে কী বলেছিল, তা-ও বললুম। যুবকটির মুখে প্ল্যান ক্যান্সেল করতে হত কথাটিও জোর দিয়ে উল্লেখ করে বললুম–কর্নেল! এই কথাটা শুনে কেন কে জানে আমার মনে খটকা বেধেছিল। সেই যুবকটিকে পুলিশ ধরতে পারলে আমি তাকে শনাক্ত করতে পারব। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, প্ল্যান কথাটার মধ্যে চন্দ্রকণাকে হত্যার কোনো সূত্র আছে। তা ছাড়া এইমাত্র মনে পড়ল, চন্দ্রকণা আমাকে বলেছিল, কর্নেল সাহেবের সঙ্গে আলাপ করা দরকার।

.

কর্নেল আস্তে বললেন–নরেশবাবু আসুন। তারপর এ নিয়ে জল্পনার সুযোগ পাওয়া যাবে।

ডিটেকটিভ সাব-ইন্সপেক্টর নরেশ ধর কর্নেল এবং আমারও সুপরিচিত। প্রায় আধঘণ্টা পরে তিনি এলেন। পর্দা তুলে আমাকে দেখে সহাস্যে বললেন–এই যে! আসামি হাজির।

কর্নেল বললেন–জয়ন্ত কেটে পড়ার চেষ্টা করলে আমি তার দুই ঠ্যাং আর হাত বেঁধে সোফায় ফেলে রাখতুম।

নরেশবাবু আমার পাশে ধপাস করে বসে বললেন–ওঃ। আর পারা যায় না। সাতসকালে আমাকে অফিসে তলব করেছিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার বিপুল নিয়োগী। কর্নেলসায়েব তো ভালোই জানেন, নিয়োগী সাহেব আপনার মতো ভারতবিখ্যাত মানুষকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবেন। সুতরাং আপনার সহচর জয়ন্ত চৌধুরীর নাম শুনেই উনি পাঞ্জা লড়তে তৈরি। যাক গে! জয়ন্তবাবুর কাছে ফাস্ট চ্যাপ্টারটা শোনা দরকার।

কর্নেল বললেন–জয়ন্ত মেয়েটিকে তার গাড়িতে লিস্ট দিয়েছে, নিয়োগীবাবু কোন্ সূত্রে জানলেন?

ও সি হোমিসাইড মিঃ তাপস বোস নিয়োগীসায়েবের প্রিয়পাত্র তা তো আপনি জানেন। মিঃ বোস তার নির্দেশে নিজেই জয়ন্তবাবুর কাগজের অফিসে। খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন। এখনও অফিস খোলেনি।

বললুম–দশটার আগে কেউ পত্রিকা অফিসে যায় না।

নরেশবাবু একটু হেসে বললেন–জয়ন্তবাবু! পুলিশের কাজকর্মের নিজস্ব পদ্ধতি আছে। চন্দ্রকণা মজুমদারকে তো গেট দিয়েই বেরুতে হয়। আর গেটে থাকে দারোয়ান। কাল যে দারোয়ানের রাত নটা অব্দি ডিউটি ছিল, আজ তার মর্নিং ডিউটি। এটাই নাকি সিস্টেম।

বললুম–সিস্টেম বদলেও যায়। কেউ ছুটি নিলে–

আমার কথার উপর নরেশবাবু বললেন–আপনার ব্যাড লাক জয়ন্তবাবু! কাল বৃষ্টির সময় দারোয়ান ছিল রামলাল আর ছেত্রী। আজ মর্নিং ডিউটিতে রামলাল আর ইসমাইল খান। কাল বিকেলে বৃষ্টির সময় গেট থেকে রামলাল লক্ষ করেছিল, চন্দ্রকণা মজুমদার আপনার গাড়িতে উঠে বসলেন। গেট সে-ই খুলে দিয়েছিল।

কর্নেল বললেন–ও সি হোমিসাইড মিঃ বোস তা হলে একজন প্রত্যক্ষদর্শী পেয়ে গেছেন?

-হ্যাঁ। এবার জয়ন্তবাবুর কথা শোনা যাক। জয়ন্তবাবু! আমি কিন্তু এখন অফিসিয়ালি আপনার স্টেটমেন্ট লিখব। দেখবেন, যেন আপনার স্টেটমেন্টে কোনো শনির ছিদ্র না থাকে!

কর্নেল হাসলেন– শনির ছিদ্র একটা থাকবে। তবে সেটা জয়ন্তের জন্য নয়।

নরেশ ধর ব্যাগ থেকে মোটা একটা খাতা বের করলেন। তারপর একটা খালি পাতার তলায় কার্বন পেপার ঢুকিয়ে বললেন–বলুন জয়ন্তবাবু!

কাল বৃষ্টির বিকেলে যা-যা ঘটেছিল, কর্নেলকে যেমন বলেছি, নরেশবাবুকেও তা-ই তা-ই বললুম। মাঝেমাঝে উনি প্রশ্নও করছিলেন। জবাব দিচ্ছিলুম। অনেকটা সময় নিয়ে আমার স্টেটমেন্ট লেখার পর নরেশবাবু বললেন–এবার পড়ে দেখে সই করে দিন। পড়ে দেখার পর সই করে দিয়ে বললুম–যুবকটিকে দেখলেই আমি চিনতে পারব। আগে তাকে খুঁজে বের করুন আপনারা।

সে অজন্তার সঙ্গে যুক্ত, তাতে আমি নিশ্চিত।

ষষ্ঠীচরণ নরেশবাবুর জন্য ইতিমধ্যে কফি এনেছিল। কফি শেষ করে তিনি মুচকি হেসে বললেন–নিয়োগীসায়েব কর্নেলসায়েবের স্নেহধন্য সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরীকে সুনজরে দেখেন না। কারণ সত্যসেবক পত্রিকায় জয়ন্তবাবু সবসময় কর্নেলসায়েবকেই হিরো করে দেখান। একদিন নিয়োগী সাহেবকে আড়ালে বলতে শুনেছিলুম, আমরা সাহায্য না করলে কর্নেল সায়েব কি এক পা এগোতে পারবেন?

কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন–কথাটা উনি ঠিকই বলেছেন। পুলিশের সাহায্য তো আমাকে নিতেই হয়।

নরেশবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–এই কেসে দেখা যাবে, আমরা নিজেরা কতদূর পৌঁছোতে পারি।

–একটা কথা নরেশবাবু! চন্দ্রকণাকে কীভাবে খুন করা হয়েছে?

-বডিতে কোনো ক্ষতচিহ্ন নেই। আপাতদৃষ্টে শ্বাসরোধ করে খুন বলেই মনে হচ্ছে। তবে ধস্তাধস্তির চিহ্ন আছে পোশাকে। রেপ করার পর খুন কি না, তা-ও জানা যাবে পোস্টমর্টেমের পরে। চলি কর্নেলসায়েব।

হ্যাঁ–আমার মনে হয়, আপনি আপনার প্রিয়পাত্র ডি সি ডি ডি-ওয়ান লাহিড়িসায়েবের সঙ্গে একটু কথা বলে রাখুন।

–অরিজিৎ ছুটিতে ছিল। ফিরেছে?

–হ্যাঁ। এখন ওঁকে কোয়ার্টারে পেয়ে যাবেন। আচ্ছা জয়ন্তবাবু, চলি। আপনার উদ্বেগের কারণ নেই। তা ছাড়া আপনার মাথার উপর বিশাল বটবৃক্ষ! বলে হাসিমুখে নরেশ ধর বেরিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে বিপদের ঘরে আচ্ছন্ন আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল–তা হলে দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার চাঁদের কণা আমাদের জীবনের আকাশ থেকে চিরকালের জন্য মুছে গেল!

–চাঁদের কণা! বলে কর্নেল তার সাদা দাড়ি থেকে চুরুটের একটুকরো ছাই ঝেড়ে ফেললেন। তারপর প্রশস্ত টাকে বাঁ হাত বুলিয়ে নিলেন। এটা ওঁর অভ্যাস।

বললুম– কর্নেল। চন্দ্রকণা মজুমদারকে আপনি দেখেননি! ওকে দেখলে পরে বুঝতে পারতেন কেন আড়ালে চাঁদের কণা বলত আমাদের প্রায় প্রত্যেকটি লোক। এমনকি গোমড়ামুখো বেয়ারা কালীনাথের মুখেও শুনেছি, মালিকরা কোত্থেকে একটুকরো চাঁদের কণা কুড়িয়ে এনেছেন, শেষে কুরুক্ষেত্র না বেধে যায়!

কর্নেল হাসলেন না। গম্ভীর মুখে বললেন–বুঝতে পারছি কী বলতে চাইছ। জয়ন্ত! পোস্টমর্টেম রিপোর্টে যদি রেপের কথা বলা হয়, তা হলে সেই যুবকটির মুখে শোনা প্ল্যান কথাটাও আর রহস্য হয়ে থাকবে না।

-কেন?

-সত্যি রেপ করে মেয়েটির মুখ বন্ধ করার জন্য তাকে মেরে ফেললে বুঝতে হবে, মেয়েটিকে রেপ করার জন্যই কোনো প্ল্যান সাজিয়েছিল তোমার দেখা যুবকটি। হাযেভাবে মেয়েটিকে সে হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল, তার জন্যই তুমি তাকে মেয়েটির প্রেমিক ভেবেছ। আমার ধারণা, সত্যিই প্রেমিক হলে অমন জঘন্য কাজ সে করত না। তা ছাড়া শুধু তুমি একা নও, ভিড়ের লোকের মধ্যে তার হাত ধরে টেনে-নাঃ।

–কিন্তু চন্দ্রকণার মতো ব্যক্তিত্বময়ী মেয়েকে অমন করে যে টেনে নিয়ে যেতে পারে, সে প্রেমিক ছাড়া আর কী হতে পারে? ঘটনাটা আমার চোখের সামনে ঘটছিল। অথচ চন্দ্রকণা একটুও ক্ষুব্ধ হল না। জোর করে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টাও করল না। যেন নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ করল। আমি ভুল দেখিনি কর্নেল!

–নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ! তোমার মুখ দিয়ে সম্ভবত একটা সত্য বেরিয়ে এল।

কী সত্য?

যে ব্যাপারটাকে তুমি নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ বলছ, হয়তো তা অসহায় আত্মসমর্পণ জয়ন্ত! তুমি আমাকে বলেছ, গাড়িতে আসবার সময় সে বলেছিল, আমি অ্যামবিশাস। তাই তো?

-হ্যাঁ। ঠিক তা-ই বলেছিল।

কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে যেন স্বগতোক্তি করতে থাকলেন–অ্যামবিশন! অ্যামবিশন কত বয়স্ক মানুষকে অন্ধ করে ফেলে। আর চন্দ্রকণা তো মাত্র তেইশ বছর বয়সের একটি মেয়ে। নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে সে সচেতন। আর তার অভিনয়ক্ষমতাও ছিল। অথচ তাকে বিজ্ঞাপন সংগ্রহের জন্য কত ছদ্মবেশী লম্পটের হাত থেকে আত্মরক্ষা করতে হয়েছে। সেই ওই চাকরিটি ছেড়ে দিতে চেয়েছিল। মডেলিং করছিল। হা–অ্যামবিশন। দা ভাইটাল পয়েন্ট ইন দিস কেস। শি ওয়াজ অ্যান অ্যামবিশাস গার্ল!

কর্নেলের এইসব স্বগতোক্তির সময় আমি চুপ করে থাকি। ওঁর এই ভঙ্গিটি আমার সুপরিচিত। এ সময়ে কোনো প্রশ্ন করলে ওঁর কানে ঢুকবে না। তাই চুপচাপ ওঁর কথাগুলো শুনছিলুম।

তখনই ডোরবেল বাজল। কর্নেল চোখ খুলে হাঁক দিলেন–ষষ্ঠী!

একটু পরে সবেগে প্রবেশ করলেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার আমাদের প্রিয় হালদারমশাই! তার সঙ্গে একজন প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা ছিলেন। হালদারমশাই বললেন মিসেস রায়। ইনিই আমাগো সেই কর্নেলস্যার!

তারপর আমাকে দেখিয়ে তিনি বললেন–ইনি আমাগো সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী! আমাগো তিনজনেরে একজন ভাবতে পারেন। ক্যান কী, কর্নেলস্যার আমারে আর জয়ন্তবাবুরে একত্র কইরা মিস্ত্রি সলভ করেন।

ভদ্রমহিলা কর্নেল ও আমাকে নমস্কার করলেন। লক্ষ করলুম তিনি বিধবা। তার এক হাতে রিস্টওয়াচ। অন্য হাতে ছোট্ট ব্যাগ। সিঁথিতে সিঁদুর নেই। পরনে সরু নকশিপাড় সাদা তাঁতের শাড়ি। রং উজ্জ্বল। চেহারায় অভিজাত পরিবারের মহিলাদের ছাপ স্পষ্ট।

কর্নেল বললেন–বসুন!

ভদ্রমহিলা সোফায় বসে বললেন–আমার নাম স্বাগতা রায়। আমার স্বামীর নাম হয়তো শুনে থাকবেন। শুভব্রত রায়। রাজনীতি করতেন। এম পি ছিলেন। গতবছর দিল্লিতে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। সব কাগজে খবরটা বেরিয়েছিল। ওটা স্বাভাবিক দুর্ঘটনা নয়। শত্রুদের চক্রান্ত। কিন্তু সে ব্যাপারে আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিঃ হালদারের কাছে যাইনি।

হালদারমশাই বললেন–মাঝেমাঝে কাগজে বিজ্ঞাপন দিই, আপনি তো জানেন কর্নেলস্যার। মিসেস রায় সেই বিজ্ঞাপন দেইখ্যাই আমার লগে যোগাযোগ করছিলেন। কিন্তু কয়েক পা আউগগাইয়া দেখলাম, হেভি মিস্ত্রি। তাই ওনারে আপনার কাছে লইয়া আইলাম।

কর্নেল বললেন–বলুন মিসেস রায়, আপনার জন্য কী করতে পারি?

স্বাগতা রায় মুখ নামিয়ে একটু চুপ করে থাকার পর বললেন–আমার একমাত্র সন্তান বাণীব্রত গত বুধবার তার বন্ধুদের সঙ্গে বিহারের পঞ্চগড় ফরেস্টে বেড়াতে গিয়েছিল। পঞ্চগড় ঠিক কোথায় আমি তা জানি না। বাণীব্রত বড্ড খেয়ালি আর জেদি। কাদের সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছে, তা-ও আমাকে বলেনি। বৃহস্পতিবার সকাল নটায় টেলিফোনে সে আমাকে শুধু বলেছিল, পঞ্চগড়ে একটা বাংলোয় তারা আছে। আমি যেন চিন্তা না করি। ব্যস্। শুধু এইটুকু খবর। তারপর সেদিনই দুপুরে আমাদের পাড়ার এক ভদ্রলোক টেলিফোনে বলেছিলেন, তিনি হোটেল কন্টিনেন্টালে এক বিদেশি বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সেখানে দশতলার করিডরে বাণীব্রতকে দেখতে পেয়েছিলেন। তাকে দেখেই বাণীব্রত নাকি কোনো একটা স্যুইটে ঢুকে পড়ে। আসলে ভদ্রলোক–শোভন আচার্য নাম, তিনি আমার ছেলেকে সেখানে দেখে অবাক হয়েছিলেন। বিশেষ করে তাকে দেখামাত্র বাণীব্রতের লুকিয়ে পড়ায় তার একটা বাজে ধরনের সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক। বাণীব্রত হয়তো কোনো গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে ওই পশ হোটলে আছে! তাই হিতাকাঙ্ক্ষী হিসেবেই শোভনবাবু আমাকে খবর দেওয়া উচিত মনে করেছিলেন।

স্বাগতা রায় হঠাৎ থেমে গেলে কর্নেল বললেন–তারপর?

–শোভনবাবুর টেলিফোনে কথাটা শুনেই আমি নিজে তখন গাড়ি ড্রাইভ করে হোটেল কন্টিনেন্টালে গেলুম। ম্যানেজারকে বাণীব্রতের ছবি দেখিয়ে রেজিস্টারে নাম খুঁজতে অনুরোধ করলুম। ওখানে থাকলেও সে নাম বদলে থাকবে, তা বোঝা যায়। ম্যানেজার কোনো স্যুইটে বাণীব্রতের মতো কারও খোঁজ দিতে পারলেন না। রিসেপশন এবং ক্যান্টিনের কর্মীদেরও তিনি ছবি দেখালেন। তারা এই চেহারার কোনো যুবককে হোটেলে দেখেনি। ভাবলুম, তবে কি শোভনবাবু ভুল দেখেছেন? তিনি সিরিয়াস প্রকৃতির মানুষ। হোটেল থেকে ফিরে শোভনবাবুর বাড়ি গেলুম। কিন্তু তিনি জোর দিয়ে বললেন, বাণীব্রতকেই তিনি দশতলার করিডরে দেখেছেন। তার পরদিন বাণীব্রতের টেলিফোন পেলুম। তাকে আমি চার্জ করলুম। কিন্তু সে বলল–শোভনবাবু ভুল দেখেছেন। আমি এখন পঞ্চগড়ে আছি। এটা পঞ্চগড় বাজারের টেলিফোন বুথ। তা না হলে তোমাকে নাম্বার দিতুম। বাংলোয় ফোন নেই। তারপর শুক্রবার বিকেলে বাণীব্রতের এক বন্ধু তার খোঁজে আমার কাছে গিয়েছিল। ছেলেটির নাম অরূপ। সে আমাকে অবাক করে বলল, বাণীব্রতকে সে সকালে পার্ক স্ট্রিটের ফুটপাতে দেখেছে। তখন অরূপ ট্যাক্সিতে চেপে তার অসুস্থ মায়ের প্যাথোলজিক্যাল রিপোর্ট আনতে যাচ্ছিল। এই কথা শোনার পর আমি অরূপকে কিছু জানালুম না। সেদিনই মিঃ হালদারের প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির বিজ্ঞাপন লক্ষ করেছিলুম। ওঁকে ফোন করলুম।

হালদারমশাই বললেন–হেভি মিস্ত্রি কর্নেলস্যার। কইতাছি। ষষ্ঠী কফি আনতাছে না ক্যান? ও ষষ্ঠী!

কর্নেল বললেন–ষষ্ঠী বোধহয় আপনাদের দরজা খুলে দিয়ে বাজারে গেছে। এখনই এসে পড়বে।

স্বাগতা রায় তার ব্যাগ খুলে একটা ছবি বের করে কর্নেলকে দিলেন।–এই আমার ছেলের ছবি।

আমি উঁকি মেরে ছবিটা দেখেই বলে উঠলুম-কর্নেল! এই সেই যুবক, যাকে কাল সন্ধ্যায় আমি মুনলাইট বারের সামনে দেখেছিলুম।

কর্নেল ছবিটা আমার হাতে দিয়ে বললেন–ভালো করে দেখে নিয়ে বলো!

ছবিটা দেখতে দেখতে বললুম–এই সেই যুবক। চন্দ্রকণা মজুমদারের হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।

স্বাগতা রায় ভাঙা গলায় বলে উঠলেন–চন্দ্রকণা? চন্দ্রকণা মজুমদার? আজ সকালে খবর পেয়েছি, শি ইজ রেল্ড অ্যান্ড ট্যালি মার্ডান্ড! কর্নেল সায়েব! তা হলে বাণীব্রতও কি…..।

কথা শেষ না করে তিনি দু-হাতে মুখ ঢাকলেন। ভদ্রমহিলা নিঃশব্দে কাঁদছিলেন।…

.

গোয়েন্দাপ্রবর তার ক্লায়েন্টেকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন–ম্যাডাম! আপনাকে কইছিলাম না, কর্নেলস্যারের কাছে গেলেই সব মিস্ত্রি সত্ হইয়া যাইব? এখন দ্যাখলেন তো, একখান কু হাতে আইয়া গেল। চন্দ্রকণা মজুমদার। কর্নেলস্যার। মাইয়াটা কে?

কর্নেল স্বাগতা রায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন–চন্দ্রকণার বাড়ি ভবানীপুরে। আপনার বাড়ি কি একই এরিয়ায়?

স্বাগতা দেবী রুমালে চোখ মুছে বললেন–হ্যাঁ। দেবেন রায় রোডের আমাদের বাড়ির উল্টোদিকে চন্দ্রকণাদের বাড়ি। তবে ওদের ভাড়ার ফ্ল্যাট। ওর বাবা শচীন মজুমদার কী একটা চাকরি করতেন। রিটায়ার করার পর চন্দ্রকণার চাকরির টাকায় টেনেটুনে সংসার চালাচ্ছিলেন। শচীনবাবুর আর কোনো ছেলেমেয়ে নেই।

কর্নেল বললেন–আপনার একমাত্র সন্তান বাণীব্রতের সঙ্গে চন্দ্রকণার সম্পর্কের কথা আপনি জানতেন। তাই তো?

–জানতুম। কিন্তু অবাধ্য ছেলেকে শাসন করার ক্ষমতা আমার নেই। বাণীব্রতের ডাকনাম টিটো। টিটো তার বাবার স্বভাব পেয়েছিল। তবে তার বাবা রাজনীতি করতেন। টিটো রাজনীতি করলেও বুঝতুম রাজনীতি ভালো-মন্দ যা-ই হোক, সে একটা কিছু করছে। বি এ পাশ করে আর পড়তে চায়নি। তার নেশা ছিল ফিল্মে অভিনয়ের।

আমি জানতে পেরেছি চন্দ্রকণা থিয়েটারে অভিনয় করত।

হ্যাঁ। পাড়ার ক্লাবের থিয়েটারেও টিটো অভিনয় করত। চন্দ্রকণার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা থিয়েটার থেকেই।

টিটো যেদিন পঞ্চগড় বেড়াতে যায়, তারপর কি আপনি লক্ষ করেছিলেন চন্দ্রকণা বাড়িতে আছে?

–হ্যাঁ। তাকে জিজ্ঞেসও করেছিলুম টিটো পঞ্চগড়ে বেড়াতে গেছে, তা সে জানে কি না। চন্দ্রকণা বলেছিল, সে জানে না।

এতক্ষণে ষষ্ঠী কফির ট্রে রেখে গেল। কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় ল্যাচ কি সিস্টেম আছে। ভিতর থেকে দরজা খোলা যায়। বাইরে থেকে খুলতে হলে চাবির দরকার হয়। ষষ্ঠীচরণ বাইরে গেলে ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে যায়। চাবি দিয়ে দরজা খুলে সে ওদিকের সংকীর্ণ করিডর দিয়ে সোজা কিচেনে চলে যায়। কর্নেলের কাছে মানুষজন এলে তাকে কিছু বলতে হয় না। নিজে থেকেই কর্নেলের। অতিথিদের আপ্যায়ন করে সে।

কর্নেলের অনুরোধেও স্বাগতা দেবী কফি খেলেন না। এক গ্লাস জল চাইলেন। কর্নেলের ডাকে ষষ্ঠী তাকে জল দিয়ে গেল। জল খেয়ে তিনি রুমালে ঠোঁট মুছলেন। বললেন–টিটোর পিছনে প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিঃ হালদারকে কেন। লাগিয়েছিলুম, কর্নেলসায়েব তা সম্ভবত বুঝতে পেরেছেন।

কর্নেল বললেন–এটুকু বুঝতে পেরেছি, টিটো সত্যি কোথায় আছে, কী উদ্দেশ্যে আছে এবং কী করছে, সেটাই আপনি জানতে চেয়েছিলেন।

হ্যাঁ। তা ছাড়া আমার সন্দেহও ছিল, চন্দ্রকণা তাকে গোপনে সঙ্গ দিচ্ছে এবং বাড়িতেও স্বাভাবিকভাবে যাতায়াত করছে। টিটো ভালোই জানে, শচীনবাবুর ওই চরিত্রহীনা মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে দিতে আমি কিছুতেই রাজি হব না।

–গতরাতে চন্দ্রকণা বাড়ি ফেরেনি–এ কথা কি আপনি জানতে পেরেছিলেন?

-হ্যাঁ। শচীনবাবু আমার কাছে রাতদুপুরে তার মেয়ের খোঁজে গিয়েছিলেন। আমি ব্যাপারটা তার ধৃষ্টতা বলেই মনে করেছিলাম। তাকে অপমান করে বের করে দিয়েছিলুম। তারপর আজ সকাল সাড়ে আটটায় আমার কাজের মেয়ে চপলা। এসে খবর দিয়েছিল, চন্দ্রকণাকে কে খুন করে গড়ের মাঠে ফেলে রেখেছিল। পুলিশ তার ডেডবডি খুঁজে পেয়েছে। তখনই আমার শরীর আতঙ্কে অবশ হয়ে গিয়েছিল। মিঃ হালদারকে খবর দিয়েছিলুম।

–তার মানে, আপনি আশঙ্কা করেছিলেন, আপনার ছেলেকেও কেউ একই সঙ্গে খুন করে কোথাও ফেলে রেখেছে?

প্রাইভেট ডিটেকটিভ বলে উঠলেন–ম্যাডাম তা-ই ভেবেছিলেন। কিন্তু আমি আইজ সকালে ওনার পোলাকে হোটেল কন্টিনেন্টাল থেইক্যা বারাইয়া একজনের। প্রাইভেট কারে চাপতে দেখছি! আমি আইজ ভোর ছয়টাতে ওই হোটেলের কাছে গিয়া ওত পাতছিলাম। হেভি মিস্ত্রি! তাই না কর্নেলস্যার? কিন্তু ম্যাডাম কইলেন, আমি ভুল দেখছি।

কর্নেল বললেন–হালদারমশাই! আপনি কি আজই প্রথম দেখেছেন বাণীব্রতকে?

–না কর্নেলস্যার। কাইল দুপুরে একই হোটেল থেইক্যা ওনার পোলারে বারাইয়া একই প্রাইভেট কারে উঠতে দেখছিলাম। তখনই ট্যাক্সি পাইয়া গেলাম। অরে ফলো কইরা পার্ক স্ট্রিটে গিয়া দেখি, মুনলাইট বারের সামনে গাড়ি থামল। ট্যাক্সি রাস্তা ক্রশ করতে পারব না। তাই ভাড়া দিয়া দৌড়াইয়া রাস্তা ক্রশ করলাম। সেই গাড়িখানা তখনই চৌরঙ্গির দিকে ছুটল। ওনার পোলারে খুঁজতে মুনলাইট বারে ঢুকলাম। কিন্তু বারে তারে দেখলাম না। অথচ তারে গাড়ি থেইক্যা নামতে দেখছিলাম।

কী গাড়ি? নাম্বার নিয়েছেন?

–সাদা মারুতি। নম্বর লইছি। শনি-রবি দুইদিন মোটর ভেহিক ডিপার্টমেন্ট বন্ধ। রাত্রে আমার ভাগ্ন তপেশেরে নম্বর দিমু। কাইল দুপুরের মইধ্যে মালিকের নাম-ঠিকানা সে আমারে জানাইয়া দিব। তপেশ ওখানে এখন উঁচু পোস্টে কাম করে, তা তো আপনি জানেন কর্নেলস্যার!

আমি অজন্তা শব্দটা উচ্চারণ করতে ঠোঁট ফাঁক করেছিলুম। কর্নেলের চোখে চোখ পড়ায় থেমে গেলুম। কর্নেল চোখ কটকট করে তাকালেই বুঝতে পারি, উনি আমাকে মুখ বুজে থাকতে বলছেন।

স্বাগতী দেবী বললেন, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। টিটো এমন কেন করছে? শোভনবাবু আর মিঃ হালদার দুজনেই কি ভুল করছেন? টিটো প্রতিদিন তিনটের মধ্যে বেরিয়ে যেত গাড়ি নিয়ে। বলে যেত, সে ফিল্ম স্টুডিয়োতে যাচ্ছে। ফিরত রাত দশটায়! সে ড্রিংক করে ফিরত, তা টের পেতুম। কিন্তু শাসন করতে গেলে সে আরও ড্রিংক করতে শুরু করবে। তাই তাকে এড়িয়ে থাকতুম। কিন্তু। এবারকার মতো অদ্ভুত কাজ সে কখনও করেনি। তবে টিটোর ভাগ্যে যা-ই ঘটুক, কর্নেলসায়েব, আমার দৃঢ় বিশ্বাস এসবের পেছনে শচীনবাবুর বজ্জাত মেয়েটার হাত ছিল।

কর্নেল আস্তে বললেন, আচ্ছা মিসেস রায়, এমন কি হতে পারে না আপনার ছেলে কোনো দুষ্টচক্রের পাল্লায় পড়েছে।

দুষ্টচক্র মানে? কিসের দুষ্টচক্র?

কর্নেল একটু হেসে বললেন–দুষ্টচক্র একটা অস্পষ্ট কথা। তা মাদকপাচারের হতে পারে। ডাকাতির হতে পারে। নারীপাচারের হাতে পারে। হোটেল কন্টিনেন্টালের নাম শুনেই আমার সন্দেহ হচ্ছে। টিটো কোনো আন্তর্জাতিক দুষ্টচক্র–যাদের মাফিয়া বলা হয়, তাদের খপ্পরে পড়েনি তো? হোটেলটার অবশ্য সুনাম বজায় রাখার চেষ্টা মালিকরা করেন। তবু সর্ষের মধ্যেই তো ভূত থেকে। যায়। এনিওয়ে! আপনার পুত্রের সন্ধানে আমি অবশ্যই পা বাড়াব–সো মাচ আই ক্যান অ্যাশিওর ইউ ম্যাডাম।

স্বাগতা দেবী তার পার্স খুলে কর্নেলকে তার নেমকার্ড দিলেন। তারপর তিনি ব্যাংকের চেকবই বের করতেই কর্নেল বললেন–ক্ষমা করবেন মিসেস রায়! আমি প্রকৃতপক্ষে একজন ন্যাচারোলজিস্ট! অপরাধরহস্য সমাধান আমার পেশা। নয়, নেশা মাত্র। আমি যে উদ্দেশ্যে প্রকৃতিজগতের নানা রহস্য সমাধানের চেষ্টা করি, সেই রকম উদ্দেশ্যেই অপরাধরহস্য সমাধানের জন্য পা বাড়াই। অবশ্য এ সবই আমার বাতিক বলতে পারেন। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আমার পক্ষ থেকে চেষ্টার ত্রুটি হবে না।

স্বাগতা দেবী রুমালে ভিজে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালেন। হালদারমশাই বললেন–আমি ম্যাডামেরে নিচের গেট পর্যন্ত আউগাইয়া দিয়া আইতাছি, কর্নেলস্যার! আমার কিছু কনসাল্ট করনের দরকার আছে। আইয়া সব কমু।….

.

দশটায় ডাইনিংরুমে কর্নেলের সঙ্গে ব্রেকফাস্টের পর ড্রয়িংরুমে ফিরে এলুম। কর্নেলের আজ ব্রেকফাস্টে আধঘণ্টা দেরি হয়েছিল! হালদারমশাই বাড়ি থেকে খেয়ে বেরিয়েছিলেন! আরেক দফা কফিপানের পর চুরুট ধরিয়ে কর্নেল বললেন–এবার বলুন হালদারমশাই, আপনি কী নিয়ে যেন কনসাল্ট করার কথা বলছিলেন।

গোয়েন্দাপ্রবর একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন–চৌতিরিশ বৎসর পুলিশে চাকরি করছি, এমন কখনও দেখি নাই। পোলাটা তার মায়ের লগে লুকোচুরি খেলছে ক্যান? হেভি মিস্ত্রি কি না কন কর্নেলস্যার!

কর্নেল একটু হেসে বললেন, ঠিক বলেছেন হালদারমশাই! আপনার ক্লায়েন্ট স্বাগতা দেবী নিজেই বলছিলেন, তাঁর ছেলে অবাধ্য। শাসন মানে না। তা বলে সে যা কিছু করতে চায়, নিজের বাড়িতে থেকেই করতে পারত। মিথ্যামিথ্যি বিহারের পঞ্চগড়ে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলেছিল কেন সে? এটা একটা ভাইটাল প্রশ্ন।

হালদারমশাই ঢ্যাঙা মানুষ। খাড়া নাক। চৌকো চোয়াল। গায়ের রং গড় বাঙালির মতো–অর্থাৎ যাকে বলে শ্যামবর্ণ। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। সরু গোঁফের দুই ডগা সুঁচোলো। লক্ষ করেছি তিনি উত্তেজিত হলেই সম্ভবত চোয়ালে চোয়ালে ধর্ষণের জন্য তার গোঁফের ডগা তিরতির করে কাঁপে। চোখ দুটি গুলিগুলি হয়ে ওঠে। কর্নেলের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনার সময় তার সেই অবস্থা দেখছিলুম। তিনি এবার চাপাস্বরে বললেন–আমার ক্লায়েন্টের সামনে। একটা কথা কই নাই। এবার কমু!

–হু। বলুন।

–আইজ ভোরবেলা হোটেলের কাছে দেখছি, পোলাটা যে গাড়িতে চাপছিল, সেই গাড়ি ড্রাইভ করছিলেন অর মায়ের বয়সি এক লেডি। নন-বেঙ্গলি চেহারা। টিটো বইয়া ছিল তার বাঁ পাশে। তারপর উইন্ডো গ্লাস উঠাইয়া দিল। পিছনের সিটে কয়েক সেকেন্ডের জন্য দেখছিলাম দুইজন বইয়া আছে। একজনের বয়স আমার মতোই হইব। মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি দেখছিলাম। পরনে স্যুট-টাই। অন্যজন মাইয়া। ইয়াং গার্ল কওয়া যায়। ভাবছিলাম, ওই ভদ্রলোকেরই মাইয়া হইব। ফলে করার সুযোগ পাই না। খালি ট্যাক্সি কাছাকাছি ছিল না!

–হুঁ। কিন্তু এই ব্যাপারটা আপনার ক্লায়েন্টকে বলেননি কেন?

–ওই ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালা ভদ্রলোকেরে আমার ক্লায়েন্ট মিসেস রায়ের বাড়িতে দেখছিলাম। গত শুক্রবার যখন আমার ডিকেটটিভ এজেন্সির কনট্র্যাক্ট ফর্ম সই করাতে যাই, তখন ভদ্রলোক ওনার বাড়ি থেইক্যা বারাইতেছিলেন। তখন ওনার চেহারা দেখছি। ওনার গাড়ি লক্ষ করি নাই।

কর্নেল আবার বললেন–কিন্তু আমার প্রশ্ন, আজ আমার কাছে আসবার সময় কথাটা মিসেস রায়কে আপনি বলেননি কেন?

গোয়েন্দাপ্রবর আরও চাপাস্বরে বললেন আমার ক্লায়েন্টের উপর সন্দেহ জাগছিল, উনি আমারে কোনো উদ্দেশ্যে ইউজ করতাছেন না তো?

আমি হেসে ফেললুম। তার মানে আপনার হাতে হুঁকো খাচ্ছেন।

কর্নেল কথাটা শুনেই গম্ভীর হয়ে উঠেছিলেন। তিনি বললেন, এমনও হতে পারে, মিসেস রায় জানেন না তার পরিচিত ওই ভদ্রলোক তার অজ্ঞাতসারে টিটোকে কোনো কাজে ব্যবহার করছেন।

হালদারমশাই সায় দিলেন।–হঃ। তা-ও সম্ভব। তো এই ব্যাপারে আপনার লগে কনসাল্ট করনের দরকার ছিল। এখন আপনি কন, আমি কী করুম?

আপনি আজই মিসেস রায়ের সঙ্গে দেখা করে কথাটা বলুন। আপনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আপনার কনট্রাক্ট ফর্মে শর্ত আছে, আপনার ক্লায়েন্ট আপনার সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে বাধ্য। তা না দিলে কন্ট্রাক্ট বাতিল হয়ে যাবে। তাই তো?

–হঃ। সেই কন্ডিশন আছে। ওনার কোনো কথা মিথ্যা হইলে কনট্র্যাক্ট ক্যান্সেল্ড হইব। যা অ্যাডভান্স দিছেন, তা ফেরত পাইবেন না।

আমি জিজ্ঞেস করলুম কত টাকা অ্যাডভান্স দিয়েছেন উনি?

–এক হাজার।

–বাঃ! তাহলে আর কথা কী? এতক্ষণে আপনার ক্লায়েন্ট বাড়ি পৌঁছে গেছেন। আপনি বেরিয়ে পড়ুন হালদারমশাই!

কর্নেল তেমনই গম্ভীর মুখে বললেন–ভদ্রলোকের নাম-ঠিকানা জানতে চাইবেন। মিসেস রায়ের সঙ্গে তার কতদিনের পরিচয় এবং শুক্রবার কেন তিনি ওঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন–সব কথা ডিটেলস জেনে নেবেন। তারপর সেই ঠিকানায় গিয়ে ওঁর কথার সত্যতা যাচাই করে নেবেন। কিন্তু এ ব্যাপারে সতর্ক থাকার কথা আপনার মতো অভিজ্ঞ মানুষকে বুঝিয়ে বলার দরকার নেই।

গোয়েন্দাপ্রবর উঠে দাঁড়ালেন। তারপর সবেগে বেরিয়ে গেলেন।

কর্নেল টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করার পর সাড়া পেয়ে বললেন–অরিজিৎ!….তুমি জয়েন করেছ শুনেছি।

রবিবার তোমাকে বাড়িতে পাব তা ধরেই নিয়েছিলুম।…..নরেশবাবু তোমাকে বলেছেন? বাঃ। তারই পরামর্শে…হ্যাঁ, আমি এতই ইন্টারেস্টেড কেন, তা বুঝতেই পারছ।…কর্নেল হেসে উঠলেন। তাঁ। মেয়েদের ব্যাপারে, বিশেষ করে সুন্দরী মেয়ে, জয়ন্ত এমনিতেই নার্ভাস হয়ে পড়ে। আর একে তো মার্ডার কেস, তার উপর তাদের অফিসের মেয়ে এবং তাকে লিফ্টও দিয়েছে….ফোরেন্সিক এক্সপার্টদেরও অকুস্থলে তলব…..তার মানে, দৈনিক সত্যসেবকের কর্তৃপক্ষ হতভাগিনী মেয়েটির পক্ষে লড়তে চান! খুব ভালো খবর, অরিজিৎ!…..হ্যাঁ। নরেশবাবুর মুখে শুনেই আমি ধরে নিয়েছিলুম, মেয়েটিকে অন্য কোথাও মেরে গড়ের মাঠে ফেলে পালিয়েছে খুনি…. হ্যাঁ, বহুবচনও হতে পারে।…ঠিক আছে! যোগাযোগ রেখে চলব।….তা হলে তো খুশিই হব।…ঠিক আছে। ছাড়ি।

কর্নেল রিসিভার রেখে সাদা দাড়িতে হাত বুলোতে থাকলেন। বললুম ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি কমিশনার ওয়ান অরিজিৎ লাহিড়ি মানুষটি কালচার্ড। নানা বিষয়ে প্রতিভাও আছে। কিন্তু আফটার অল পুলিশ ইজ পুলিশ। আমার এতক্ষণে অস্বস্তি হচ্ছে কর্নেল।

-কেন?

কেস সাজাবেন তো ওঁর নিচুতলার অফিসাররা। এ সি নিয়োগী সায়েব আপনাকে পছন্দ করেন না। ধরুন, এভাবে যদি কেসটা ওঁরা গড়ে তোলেন–আমি চন্দ্রকণাকে আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়ে…..।

কর্নেল আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন–অজন্তা-র কেয়ারটেকার সাক্ষী আছে। সে চন্দ্রকণাকে সেখানে ঢুকতে ও বেরিয়ে যেতে দেখেছে।

–নিয়োগীসায়েবের হুমকিতে কেয়ারটেকার যদি বলে, সে চন্দ্রকণাকে দেখেনি?

কর্নেল হাসলেন–অত সাহস অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ভদ্রলোকের নেই। নরেশ ধর তার অধীনস্থ কর্মচারী হলেও অরিজিতের কাছের লোক। আমারও। নরেশবাবু কেয়ারটেকারের স্টেটমেন্ট নিয়ে রেখেছেন

–ফোরেন্সিক এক্সপার্টরা কি বলেছেন চন্দ্রকণাকে অন্য কোথাও মেরে ওখানে বডি ফেলে দেওয়া হয়েছে?

-হাঃ! বলে কর্নেল হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন।–এক মিনিট। পোশাক বদলে আসি। তারপর বেরোব।

কিছুক্ষণ পরে কর্নেল বেরিয়ে এলেন। তার গলায় যথারীতি বাইনোকুলার এবং ক্যামেরা ঝুলছে। মাথায় টুপি। পিঠে শুধু তার কিটব্যাগটা আঁটা নেই। কিন্তু এখন তাকে দেখলে সবারই মনে হবে বিদেশি ট্যুরিস্ট। এমনিতেই তাঁর চেহারা ও ব্যক্তিত্বে বাঙালি হয়েও বিলিতি আদল আছে এবং এর কারণ হিসেবে তিনি তার দীর্ঘ সামরিক জীবনে ইউরো-মার্কিন সেনানীদের সংসর্গে বসবাসের কথা বলেন। আশ্চর্য! সর্বত্র দেখেছি, লোকেরা তাঁকে খাঁটি সায়েব বলে ভুল করে।

নিচে নেমে গিয়ে আমি আমার গাড়ি পার্কিং জোন থেকে লনে গিয়ে এলুম। তাগড়াই চেহারার কর্নেল যথারীতি আমার বাঁ পাশে বসলেন। তারপর বললেন–ফ্রিস্কুল স্ট্রিট হয়ে পার্ক স্ট্রিট। তারপর চৌরঙ্গিতে বাঁ দিকে ঘুরে গিয়ে হোটেল কন্টিনেন্টালের লনে গাড়ি ঢোকাবে।

এই নতুন পাঁচতারা হোটেলটি আমার চেনা। কর্নেলের সঙ্গে সেখানে কয়েকবার গেছি। তাই ম্যানেজার মিঃ অনুরাগ সাকসেনা আমাকেও চেনেন। চৌরঙ্গি রোড থেকে একটা অপ্রশস্ত রাস্তায় ঢুকলে হোটেলের সদর গেট।

গুমটিঘরের বন্দুকধারী দারোয়ান আমার গাড়িতে কর্নেলকে দেখামাত্র সেলাম ঠুকে গেট খুলে দিল। প্রশস্ত লন ঘুরে গিয়ে পার্কিং জোনে গাড়ি রাখলুম।

এবার সিঁড়ি বেয়ে বিশাল কাঁচের কপাটের কাছে পৌঁছতেই দুজন উর্দিপরা লোক কপাট খুলে দিল এবং কর্নেলকে সেলাম দিল। লাল কার্পেট পাতা বিস্তৃত লাউঞ্জে দেশি-বিদেশি পুরুষ ও মহিলা সুদৃশ্য আসনে বসে চাপা স্বরে কথা বলছিলেন। কোণের দিতে বারের সামনে উঁচু টুলে বসে কিছু লোক ড্রিংক করছিল। কর্নেল বাঁ দিকে রিসেপশনে গিয়ে এক সুন্দরীকে তার নেমকার্ড দিয়ে মৃদুস্বরে বললেন–ম্যানেজার মিঃ সাকসেনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। যুবতীটি তখন একটা উর্দিপরা লোককে ডেকে কার্ডটা দিয়ে কী বলল শুনতে পেলুম না। একটু পরেই একজন মধ্যবয়সী শ্যামবর্ণ স্যুট-টাই পরা ভদ্রলোক হ্যালো! হ্যালো বলতে বলতে রিসেপশন কাউন্টারের পাশ দিয়ে বেরিয়ে এলেন এবং কর্নেলের সঙ্গে করমর্দন করলেন। এবার তাকে চিনতে পারলুম। উনিও আমাকে চিনতে পেরে আমার সঙ্গেও করমর্দন করলেন। মিঃ সাকসেনা গায়ে-গতরে মোটা হয়েছেন। পুরু গোঁফে পাক ধরেছে। তাই প্রথমে চিনতে পারিনি।

মিঃ সাকসেনা আমাদেরকে তার অফিসে নিয়ে গেলেন। আমরা বসার পর তিনি ভুরু কুঁচকে একটু হেসে বললেন–হোটেল কন্টিনেন্টালে কি আবার কোনো জীবাণু অনুপ্রবেশ করেছে কর্নেল সরকার?

কর্নেল হাসলেন। নাঃ মিঃ সাকসেনা! তেমন কিছু নয়।

কফি খান! তারপর কথা।

ধন্যবাদ মিঃ সাকসেনা। শুধু একটা খবর জানতে এসেছি। দশতলার কোনো সুইটে একটা ফ্যামিলির গত বৃহস্পতিবার ওঠার কথা। ভদ্রলোকের মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আছে। সঙ্গে তার স্ত্রী, মেয়ে এবং জামাই থাকার কথা!

–তার নাম?

–অরবিন্দ অগ্রবাল আসল নাম। তবে তার অন্য নামও আছে। ভুলে গেছি! সে-নামেও তিনি বুক করে থাকতে পারেন। তাঁর স্ত্রীর নাম মনে আছে। মিসেস বৈজয়ন্তী অগ্রবাল। হাতাদের সঙ্গে একটা সাদা মারুতি গাড়ি আছে।

মিঃ সাকসেনা একটু হেসে বললেন–বুঝে গেছি। কিছু ঝামেলা কোথাও বেধেছে। তবে হোটেলের সুনাম বজায় রাখতে আমি এবারও আপনাকে সাহায্য করব। এক মিনিট।

বলে তিনি কম্পিউটার চালিয়ে দিলেন। একটু পরে বললেন–বিহারের সিংভূম এলাকার পঞ্চগড়, হ্যাঁ। আপনি যে-চারজনের ফ্যামিলির কথা বললেন, তারা পঞ্চগড় থেকে এসেছেন। এই হোটেলে আছেন। তবে আপনি যে নাম বললেন, তা ঠিক নয়। মিঃ হরনাথ গুপ্তা অ্যান্ড ফ্যামিলি। দশতলায় মাত্র একটাই চারশয্যার সুইট আছে। সুইট নাম্বার ১০০৩।

–ফ্যামিলি মেম্বারদের নাম তো হোটেলে থাকা উচিত?

 ম্যানেজার হাসলেন।নাম আছে। তবে তাদের নামে কী আসে যায়? আপনি কা সম্পর্কে আগ্রহী তো? দেখি, উনি সইটে আছেন কি না। থাকারই কথা।

–ওঁরা ভোর ছটায় বেরিয়েছিলেন।

মিঃ সাক্‌সেনা সকৌতুকে বললেন–রহস্যজনক কেসের গন্ধ পাচ্ছি কর্নেল সরকার। এই হোটেলের দিকে তা হলে নজর রাখার ব্যবস্থা করেছেন। দেখবেন, আমার চাকরিটা যেন না যায়।

কর্নেল একটু হেসে বললেন–হোটেল কন্টিনেন্টালের দিকে পুলিশ ও কাস্টমসের লোকেরা ছদ্মবেশে নজর রাখে এবং আপনি তাদের সাহায্য করেন। এটা নতুন কিছু নয়। যাই হোক, ওঁরা হোটলে ফিরেছেন কি না জানতে চাই। আশা করি, আপনার সাহায্য পাব।

অবশ্যই। বলে মিঃ সাকসেনা টেবিলের নিচে কলিং বেলের বোতাম টিপলেন। একজন উর্দিপরা লোক ঘরে ঢুকে সেলাম দিল। তখন মিঃ সাকসেনা তাকে বললেন, গুণধর! কি-বোর্ডে ১০০৩ নম্বর সুইটের চাবি ঝুলছে কি না দেখে এসো।

গুণধর বেরিয়ে গেল। মিঃ সানোর মুখে এবার যেন একটু গাম্ভীর্য লক্ষ করছিলুম। তিনি আস্তে বললেন–অবশ্য বোর্ডারদের কেউ-কেউ বাইরে যাওয়ার সময় চাবি রেখে যেতে ভুলে যান। দেখা যাক।

একটু পরে গুণধর ঘরে ঢুকে আবার সেলাম দিয়ে বলল–কি-বোর্ডে ওই সুইটের চাবি নেই স্যার!

–ঠিক আছে। তুমি যাও। বলে ম্যানেজার টেলিফোনের রিসিভার তুলে একটা নাম্বার ডায়াল করলেন। তারপর রিসিভার কানে রেখেই বললেন–রিং হয়ে যাচ্ছে। ডাবল বাথ আছে। দু-জন স্নান করতে ঢুকলে বাকি দুজনের থাকার কথা। তাদের একজন ফোন ধরবে! নাকি একসঙ্গে সবাই ফেরেননি ওঁরা? একটু পরে আবার দেখছি।

তিনি রিসিভার নামিয়ে রাখলে কর্নেল বললেন–আপনাদের হোটেলের সব ফ্লোরে তো ওয়াকিটকি হাতে নিয়ে গার্ডরা থাকে দেখেছি!

থাকে। তবে সবাই যে কর্তব্যপরায়ণ এমন নয়। দশতলার গার্ড ন-তলার গার্ডের সঙ্গে আড্ডা দিতে আসতে পারে! বরং একটু বসুন। আমি রিসেপশন থেকে খোঁজ নিয়ে আসি, ওদের কেউ গুপ্টা ফ্যামিলিকে নিশ্চয় ফিরতে দেখেছে বিশেষ করে কি-বোর্ডে যখন ওই সুইটের চাবি নেই।

ম্যানেজার বেরিয়ে গেলেন। আস্তে বললুম– অজন্তা মডেলিং স্কুলের কত্রী বৈজয়ন্তীর স্বামী হয়তো সত্যিই পঞ্চগড়ে থাকেন। সম্ভবত মেয়েকে নিয়ে হোটলে উঠেছেন এবং

কর্নেল আমাকে থামিয়ে তেমনই চাপাস্বরে বললেন–বোকার মতো কথা বোলো না। যে মহিলা পার্ক স্ট্রিটে মডেলিং স্কুল চালান, কলকাতায় তার থাকার জন্য বাড়ি নেই, এটা অসম্ভব ব্যাপার।

এই সময় মিঃ সাকসেনা ফিরে এসে বললেন–মিঃ গুপ্টা কি-বোর্ড থেকে চাবি নিয়ে নিয়েছেন প্রায় একঘণ্টা আগে। ওইসময় রিসেপশনে ভিড় ছিল। নেদারল্যান্ড থেকে একদল বাণিজ্য প্রতিনিধি এসেছেন। সরকার তাদের জন্য আমাদের হোটেলের একটা পুরো ফ্লোর বুক করেছেন। যা-ই হোক, আবার রিং করে দেখি।

টেলিফোনের রিসিভার তুলে তিনি ডায়াল করলেন। একটু পরে বললেন রিং হয়ে যাচ্ছে।

কর্নেল বললেন–দশতলার গার্ডের সঙ্গে ওয়াকিটকিতে যোগযোগ করে খবর নিন বরং।

রিসিভার নামিয়ে ওয়াকিটকিতে মিঃ সাকসেনা কথা বললেন। ঘড়ঘড় শব্দের মধ্যে সাড়া এল। তিনি বললেন–সুইট নাম্বার ১০০৩। নক করে দেখো। কেউ বেরোলে বলবে, নিচে একজন ভিজিটার আছেন।

মিনিট তিনেক পরে ওয়াকিটকিতে সাড়া এল। ঘড়ঘড় শব্দের মধ্যে কিছু বুঝতে পারলুম। ম্যানেজার ওয়াকিটকির সুইচ অফ করে টেবিলে রেখে মুচকি হেসে বললেন–মিঃ, গুপ্তা দরজার বাইরে নোটিস ঝুলিয়ে রেখেছেন : প্লিজ ডোন্ট ডিসটার্ব!

কর্নেল বললেন–ওই নোটিসবোর্ড তো আপনাদেরই।

-হ্যাঁ। সব সাইটেই ওই ছোট্ট বোর্ড আছে। ইচ্ছে হলে বোর্ডাররা ব্যবহার করেন।

কর্নেলকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। তিনি বললেন–বাইরে একটা টেলিফোন করতে চাই মিঃ সাক্‌সেনা!

অবশ্যই। বলে ম্যানেজার তার টেবিলের টেলিফোন ঘুরিয়ে কর্নেলের দিকে ঠেলে দিলেন।  

কর্নেল রিসিভার তুলে ডায়াল করার পর সাড়া এলে খুব চাপা স্বরে বাংলায় বললেন–অরিজিৎ! আমি হোটেল কন্টিনেন্টাল থেকে বলছি। সদর দফতরে তুমি জরুরি খবর দাও। নরেশবাবু এলে ভালো হয়।…. হ্যাঁ। হইচই নয়। গাড়ি একটু আড়ালে থাকবে। দুজন সশস্ত্র সঙ্গী পেলেই নরেশবাবু বা যিনি আসবেন, তাঁর পক্ষে যথেষ্ট….এখনও জানি না। তবে একটা গন্ধ পাচ্ছি। …হ্যাঁ….সামরিক জীবনে পাওয়া সেই ষষ্ঠেন্দ্রিয়।……হ্যাঁ। দ্রুত খবর দাও।

মিঃ সাক্‌সেনা বাংলা বোঝেন না। এতক্ষণ কর্নেলের সঙ্গে তিনি ইংরেজিতেই কথা বলছিলেন। এবার তার মুখে উদ্বেগের ছাপ ফুটে উঠল। তিনি আস্তে বললেন কর্নেল সরকার! প্লিজ! জাস্ট আ হি।

কর্নেল মৃদু হেসে বললেন–আমার ভুল হতেও পারে। তবু ওই স্যুইটে আমরা যেতে চাই। তবে আমি তো সরকারি অফিসার নই। প্রাক্তন সামরিক অফিসার। আমার বা জয়ন্তের কোনো অধিকার নেই যে হোটেল কন্টিনেন্টালের কোন সুইটে জোর করে ঢুকি। মিঃ সাকসেনা! মিনিট কুড়ি-পঁচিশ অপেক্ষা করুন।

মিঃ সাকসেনা চেয়ারে হেলান দিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে বললেন–পুলিস আসবে। তাই না?

–ঠিক বলেছেন।

তা হলে তো একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হবে! লাউঞ্জে নানাদেশের লোক বসে আছেন।

নাঃ! পুলিশ হইচই বাধাতে আসবে না। এমনিতেই তো সব হোটেলে রুটিন জব আছে পুলিশের। আপনি ভাববেন না। বরং চলুন, হোটেলের বাইরে লনে কোথাও তিনজনে গিয়ে দাঁড়াই। কিংবা ইচ্ছে করলে আপনি রিসেপশন বা লাউঞ্জে গিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন।

কর্নেলের সঙ্গে আমি বেরিয়ে এলুম। আমাদের পিছনে এলেন মিঃ সাকসেনা। লাউঞ্জে গিয়ে তিনি বললেন–আপনারাও এখানে থাকুন। আমরা স্বাভাবিকভাবে কথা বলি। পেপার কাপে কফি আনিয়ে দিই বরং।

কফি খেতে খেতে অপেক্ষা করলে সময় কেটে যাবে।

 মিঃ অনুরাগ সাকসেনার হাতের ইশারায় একজন বেয়ারা এগিয়ে এল। তিনি তাকে ক্যান্টিন থেকে পেপারকাপে তিনটে কফি আনতে বললেন।

কর্নেল একটু হেসে বললেন কফি খেলেই আমার চুরুট খেতে ইচ্ছে করবে। এখানে তো ধূমপান নিষেধ। বাইরেই যাওয়া দরকার।

সেই বেয়ারা একটা ছোট্ট ট্রেতে তিনটে কফি আনল। কফির কাপ হাতে তিনজনে কাঁচের দরজার কাছে যেতেই উর্দিপরা সেই লোকটা সেলাম ঠুকে দরজা খুলল। লনে গিয়ে সুদৃশ্য ফুলবাগিচার কাছে একটা অশোকগাছের নিচে দাঁড়ালুম। তখন প্রায় এগারোটা বাজে।

কফি শেষ করে আবর্জনার পাত্রে কাপটা ফেলে দিলুম। কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন–আশা করি চুরুটটা শেষ করার মত সময় পাব। রবিবার বলে পুলিশ দফতরে একটু ঢিলে-ঢালা অবস্থা থাকতেও পারে। তবে কলকাতা মহানগরে রবিবার বলে ঘটনা-দুর্ঘটনা তো বন্ধ থাকে না। তাই পুলিশ কর্তাদেরও সারাক্ষণ তৎপর থাকতে হয়।

কর্নেলের চুরুট শেষ হওয়ার আগেই সাদা পোশাকে নরেশবাবুকে গেটের কাছে দেখতে পেলুম। তার সঙ্গে আরও একজন উর্দিপরা অফিসার এবং দুজন কনস্টেবল দ্রুত হোটেলে গিয়ে ঢুকলেন। তার পিছনে ম্যানেজার এবং আমি। লাউঞ্জে ঢুকে কর্নেল আস্তে বললেন–লিফটের সামনে আগে মিঃ সাকসেনা গিয়ে দাঁড়ান।

একটু পরে লিফটের সামনে কর্নেল এবং আমি গেলুম। তারপর নরেশ ধর এবং তার ছোট্ট বাহিনী।

রিসেপশনের লোকেরা একটা কিছু আঁচ করেছে, তা লক্ষ করছিলুম। তবে লাউঞ্জে যাঁরা বসেছিলেন, তারা কিছু টের পেয়েছেন বলে মনে হচ্ছিল না।

অটোমেটিক লিফ্ট নেমে এলে আমরা ঢুকে পড়লুম। দশতলা অর্থাৎ নাইথ ফ্লোরে পৌঁছুনোর আগে নরেশবাবু সহাস্যে বললেন–মিঃ সাকসেনা আপনি বোবা কেন?

ম্যানেজার হাসবার চেষ্টা করে বললেন–আমি সম্পূর্ণ অন্ধকারে। তাই মুখ খুলছি না।

কর্নেলসাহেব সত্যিই আমাদের অন্ধকারে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন কে জানে!

 কর্নেল বললেন–আমিও অন্ধকারে। তবে আই স্মেল আ ডেড র‍্যাট ইন দ্য সুইট নাম্বার ওয়ান জিরো জিরো থ্রি।

দশতলায় আমরা লিফট থেকে বেরোলুম। হোটেলের গার্ড ওয়াকিটকি হাতে সেলাম দিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে তাকিয়ে রইল। ১০০৩ নম্বর সুইট এই ব্লকের শেষপ্রান্তে। তার ওধারে করিডর এবং ডানদিকে সুইটের সারি। দেখলুম, দরজার গোল হাতলে ছোট্ট নোটিসবোর্ড ঝুলছে : প্লিজ ডোন্ট ডিসটার্ব।

কর্নেল দরজা ঠেলে দেখে বললেন–ল্যাচ-কি। তারপর তিনি কপাটে নক করতে থাকলেন।

কোনো সাড়া এল না।

মিঃ সাকসেনা বললেন–ডুপ্লিকেট চাবি আনতে বলছি। একটু অপেক্ষা করুন।

তিনি গার্ডের হাত থেকে ওয়াকিটকি নিয়ে একটা বোতাম টিপে চাপাস্বরে কাকে কিছু বললেন। তারপর গার্ডকে তার ওয়াকিটকি ফিরিয়ে দিলেন।

কী ঘটবে এবার কিংবা ঘরের ভিতরে কী দেখতে পাব–এই উত্তেজনায় আমি অস্থির। এই সময়টা এমন যে ঘড়ির মাপে প্রতিটি সেকেন্ডও লম্বা পা ফেলে হাঁটে। অবশেষে লিফট থেকে উর্দিপরা একটা লোক একগোছ চাবি নিয়ে বেরিয়ে এল। ম্যানেজার তার হাত থেকে চাবির গোছা নিয়েই লম্বা একটা চাবি কপাটে আঁটা লকে ঢুকিয়ে ডাইনে ঘোরালেন। তারপর হাতল ঘোরাতেই কপাট খুলে গেল। স্যুইটের ভিতর আলো জ্বলছে না। মিঃ সাকসেনা ঢুকেই সুইচ টিপে সব আলো জ্বেলে দিলেন।

তারপর যা দেখলুম, শরীর শিউরে উঠল। আতঙ্কের একটা ঠাণ্ডা হিম ধাক্কা বুকের ভিতরটা চমকে দিল।

সামনে সোফাসেট ও সেন্টারটেবিল। মেঝের কার্পেটে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন সুটপরা একটি মানুষ। তার মুখটা বাঁ পাশে একটু ঘুরে আছে। মুখের তলা থেকে ঘন থকথকে রক্ত গড়িয়ে পেটের কাছে এসে থেমে গেছে। মিঃ সাকসেনা প্রায় আর্তনাদ করলেন–ও মাই গড! হি ইজ মিঃ হরনাথ গুপ্তা।

মুখের ফ্রেঞ্চকাট দাড়িতে রক্ত জমাট হয়ে আছে। নরেশ ধর শ্বাস ছাড়লেন জোরে!

কর্নেল বললেন, শ্বাসনালী কেটে খুন করে পালিয়েছে খুনি।

নরেশবাবু বললেন মিঃ সাকসেনা! এই সুইট থেকে সরাসরি বাইরে ফোন করা যায়?

–হ্যাঁ। জিরো ডায়াল করলে ডায়ালটোন আসবে। তখন বাইরে ফোন করা। যাবে।

সোফার পিছনে একটা টুলে টেলিফোন ছিল। নরেশবাবু রিসিভার তুলে ডায়াল করতে থাকলেন। কর্নেল বললেন–মিঃ সাকসেনা। গার্ডকে বলুন, সে যেন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আর যে চাবি এনেছে তাকে ভিতরে আসতে বলুন। তারপর দরজা বন্ধ করে দিন।

দুধারে কাশ্মিরি নকশাদার কাঠের পার্টিশন। তার ওধারে দুটো করে চারটে বেড। কর্নেল বাঁদিকে ঢুকেছিলেন। একটু পরে বেরিয়ে এসে বললেন–এই দুটো বেড দুজন মহিলার। ওদিকের বেড় দুটো নিশ্চয় মিঃ গুপ্তা এবং তার তথাকথিত জামাইয়ের।

কর্নেল ডানদিকের পার্টিশনের ভিতরে চলে গেলেন। ফিরে এসে তিনি বললেন–হ্যাঁ। যা ভেবেছিলুম। কিন্তু স্যুইটে কোনো জিনিসপত্রই নেই। আশ্চর্য।

নরেশবাবু টেলিফোন করার পর বললেন–সুবীর! বাথরুম দুটো দেখতে। হবে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে কেন?

তার সঙ্গী উর্দিপরা অফিসার বললেন–ম্যানেজারসায়েব! প্লিজ শো মি দ্যা লেডিজ বাথরুম ফাস্ট!

নরেশবাবু ভেংচি কেটে বললেন–তোমাদের এই কচিকাঁচাঁদের কেন যে ডি ডি-তে ঢোকায়? 

ততক্ষণে কর্নেল লেডিজ বাথরুম থেকে বেরিয়ে জেন্টস রাথরুমে ঢুকেছেন। সেখান থেকে তিনি বললেন–নরেশবাবু! মার্ডারইউপন বেসিনে রেখে হাত ধুয়েছে খুনি। মাত্র ছ-ইঞ্চি একটা ছুরি। বেসিনে জল পড়ছে। দরজা বন্ধ বলে শোনা যাচ্ছিল না।

নরেশবাবু দেখে এসে বললেন–যা যেখানে আছে, তেমনই থাক। কেউ হাত দেবেন না যেন।

ওসি হোমিসাইড ফটোগ্রাফার এবং ডাক্তার নিয়ে আসছেন। একটু সময় লাগবে। অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসতে বরাবর ঝামেলা হয়। পার্ক স্ট্রিট থানাকেও খবর দিয়েছি। ওসি এখনই ফোর্স নিয়ে আসছেন।

সুবীরবাবু বাঁদিকের কাঠের পার্টিশনের তলার দিকে আঙুল দিয়ে দেখালেন। বললেন–নরেশদা! এই সুইটের চাবি ওখানে পড়ে আছে।

–থাক। ছুঁয়ো না। কর্নেল সায়েব! আশ্চর্য ব্যাপার, এই স্যুইটে ভিকটিমেরও কোনো জিনিস দেখছি না। গায়ে যা পরে আছেন ভদ্রলোক, তা ছাড়া কিছু নেই। বাথরুমেও কিছু নেই। শুধু মার্ডারউইপনটা রেখে গেছে খুনি।

কর্নেল বললেন–ভিকটিম মিঃ হরনাথ গুপ্তার পোশাক খোঁজা দরকার। তবে পুলিশের প্রাথমিক রুটিন ওয়ার্কের পরে। জানি না, এঁর নাম সত্যিই হরনাথ গুপ্তা কি না। যে ঠিকানা হোটেল রেজিস্টারে ইনি লিখেছেন, তা-ও ঠিক কি না এখন বলা কঠিন। যাই হোক, আমি করিডরে গিয়ে চুরুট টানতে চাই! মিঃ সাকসেনা! আমরা ধারণা দুজন মহিলা আর.একজন যুবক সাদা মারুতি গাড়িটা নিয়ে কেটে পড়েছে। ওটার নাম্বারপ্লেট ভুয়ো হওয়াই সম্ভব। তবু আপনি নিচে গিয়ে গাড়িটার খোঁজ নিন। আর আপনার এই কর্মচারীকে সঙ্গে নিয়ে যান। ওঁকে মুখ বুজে থাকতে বলবেন। নরেশবাবু দরজা বন্ধ করে দিন। আপনারা পুলিশ। অনেক খুনজখম রক্তারক্তি দেখতে অভ্যস্ত। ভিকটিমের সঙ্গে থাকা আপনাদের কর্তব্যও।

নরেশবাবু হাসবার চেষ্টা করে বললেন–আপনার হাতের কার্ড এবার আর লুকোনোর উপায় নেই। আপনিই আমাদের মরা ইঁদুর-এর গন্ধ পেয়ে এখানে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

বলে তিনি দরজা বন্ধ করে দিলেন। ম্যানেজার এবং উর্দিপরা লোকটা যেন পালিয়ে বাঁচলেন। শুধু গার্ড বেচারা ওয়াকিটকি হাতে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল দরজার পাশে। কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন–একটা অঙ্ক কষেছিলুম। মিলে গেল দেখে আমি নিজেই অবাক হয়েছি জয়ন্ত।

বললুম –অঙ্কটা কী?

যথাসময়ে জানতে পারবে।

চাপাস্বরে বললুম–টিটো খুনি।

-জানি না। জানতে দেরি হতেও পারে।

–মিসেস রায় ভিকটিমকে চেনেন। হালদারমশাই এঁকে তাঁর বাড়িতে দেখেছিলেন!

জয়ন্ত! তুমি উত্তেজিত হয়েছ! সাবধান!

এবার খুব আস্তে বললুমসুইটে কি কোনো কু পেয়েছেন?

কর্নেল নিঃশব্দ একটু হেসে বললেন–তা পেয়েছি। কিন্তু আর নয়। মুখ বুজে থাকবে।

.

কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরতে প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে গিয়েছিল। একটায় খাওয়া-দাওয়ার পর কর্নেল ড্রয়িংরুমে তার ইজিচেয়ারে বসে চুরুট টানছিলেন। আমি অভ্যাসমতো ডিভানে গড়িয়ে নিচ্ছিলুম। কিন্তু এদিন আমার চোখে ভাতঘুমের টান ছিল না। হোটেল কন্টিনেন্টালের ১০০৩ নম্বর সুইটের বীভৎস দৃশ্যটা চোখে ভেসে উঠছিল। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ কাল সন্ধ্যায় শোনা চন্দ্রকণার কথাটা মনে পড়ে গেল। সে বলেছিল, কর্নেলের সঙ্গে আমার আলাপ করা দরকার। কর্নেলকে আজ কথাটা বলেছিলুম বটে, কিন্তু তত গুরুত্ব দিইনি। এখন তার কথাটা আমাকে অস্থির করে তুলছিল। বললুম–কর্নেল! মিসেস স্বাগতা রায়কে আপনি বলছিলেন, তার ছেলে টিটো কোনো দুষ্টচক্রের পাল্লায় পড়ে থাকতে পারে। এখন মনে হচ্ছে, চন্দ্রকণা কি সেই কথাটা জানাবার জন্যই আপনার সঙ্গে আলাপ করা দরকার বলেছিল?

কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন–হুঁ! তুমি আমাকে ওর ওই কথাটা তখন বলেছিলে বটে!

–আপনি এ-ও বলছিলেন, অ্যামবিশান মানুষকে অন্ধ করে।

একটু চুপ করে থাকার পর কর্নেল বললেন–মৃতেরা কথা বলে না। চন্দ্রকণা মৃত। কিন্তু মৃতদের কথা বলানোর কাজটাই মাঝে মাঝে আমি করে থাকি। জয়ন্ত! অ্যামবিশান কোনো কোনো মানুষকে সত্যিই অন্ধ করে। তুমি সম্ভবত হা, আমি নিশ্চিত এই বলেই সম্ভবত শব্দটা ব্যবহার করছি–তুমি ঠিকই অনুমান করেছ, চন্দ্রকণা টিটোর একটা দুষ্টচক্রে জড়িয়ে পড়ার কথা জানতে পেরেছিল।

–আপনি হোটেলের ওই স্যুইটে কী একটা ক্লু খুঁজে পেয়েছেন বলছিলেন।

কর্নেল হাসলেন। –পেয়েছি। তুমি তা জানতে আগ্রহী হতেই পার। তবে ধৈর্য ধরতে হবে। আগে হালদারমশাইয়ের টেলিফোন পাই কিংবা তিনি এখানে আসুন, তারপর তুমি ওটা দেখতে পাবে।

এতক্ষণ বুকে বালিশ রেখে ডিভানে উপুড় হয়ে শুয়ে কথা বলছিলুম। এবার উঠে বসে বললুম, আপনার কাছে তো মিসেস রায়ের নেমকার্ড আছে। ওঁকে রিং করে জানিয়ে দিন না খবরটা। ওঁর কী রিঅ্যাকশন হয় বুঝতে পারবেন।

–হরনাথ গুপ্তা নামে এক ভদ্রলোকের মার্ডার হওয়ার খবর শুনে উনি যে কিছু বুঝবেন তা মনে হয় না। কারণ আমার জানা হয়ে গেছে যে, ওটা ওঁর ছদ্মনাম।

অবাক হয়ে বললুম–কী করে জানলেন ওটা ছদ্মনাম?

খুব সহজে। অর্থাৎ পুলিশসূত্রে। তুমি তখন হোটেলের লাউঞ্জে আমার অপেক্ষা করছিলে। আমি পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে ছিলুম। ডেডবডি স্ট্রেচারে তোলার আগে নরেশবাবু ওঁর পোশাক সার্চ করছিলেন। কোটের ভিতর পকেট থেকে একগোছ নেমকার্ড পাওয়া গেছে। নরেশবাবু গোপনে একটা কার্ড আমার পকেটে পাচার করেছিলেন।

বলে কর্নেল টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা সাদা ঝকমকে নেমকার্ড বের করলেন। তার কাছাকাছি সোফায় গিয়ে বসলুম। কর্নেল আমাকে কার্ডটা দিয়ে বললেন–ঠিকানা পঞ্চগড়। জেলা সিংভূম, বিহার।

কার্ডে ইংরেজিতে নাম ছাপানো আছে : রাজকুমার সিংহ। তার নিচে ছোট হরফে প্রোঃ জয়লক্ষ্মী জুয়েলারি কোম্পানি। তার নিচে : মেহতা মার্কেট। পঞ্চগড়। জেলা সিংভূম। বিহার, ইন্ডিয়া।

পড়ে বললুম–ইন্ডিয়া লেখা আছে দেখছি।

কর্নেল কার্ডটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে বললেন–তুমি মাঝে মাঝে এমন অবোধ বালক হয়ে যাও জয়ন্ত! কার্ডে ইন্ডিয়া লেখা থাকলে ধরে নিতেই হবে, এই কোম্পানির সঙ্গে বিদেশি কোম্পানির যোগাযোগ আছে। বিশেষ করে রত্ন ব্যবসায়ীরা মুক্তো আর প্রবাল আমদানি করেন গাল এরিয়া থেকে।

একটু হেসে বললুম–আন্তর্জাতিক দুষ্টচক্রের কথা বলছিলেন। একজন আন্তর্জাতিক রত্ন ব্যবসায়ীর খোঁজ পাওয়া গেল। তবে তিনি শোচনীয়ভাবে নিহত।

কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বললেন–এবং তার সঙ্গে টিটোকে দেখেছেন হালদারমশাই। আবার তাকে টিটোর মায়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতেও তিনি দেখেছেন।

কর্নেল! আপনি আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছেন কেন বুঝি না!

লুকোচুরি?

–ঠিক তা-ই তো! আমি তখন মিসেস রায়ের কাছে আপনাকে ফোন করে তার প্রতিক্রিয়া জানবার কথা বললুম। আপনি বললেন, হরনাথ গুপ্তা বললে উনি বুঝবেন না। এদিকে নিহত লোকটার আসল নামটা কী তা আপনি জানেন। কাজেই মিসেস রায়কে

আমাকে থামিয়ে দিয়ে কর্নেল বললেন–একটু ধৈর্য ধরে হালদারমশাইয়ের অপেক্ষা করো জয়ন্ত। আপাতত আমি সরাসরি মিসেস রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইনে। তার মানে, তার সঙ্গে ফোনে কথা বললে তার চেনা ভদ্রলোকের হত্যাকাণ্ডের খবরও দিতে হয়। উনি তাতে সতর্ক হয়ে যেতে পারেন। তাই না?

বললুম–ঠিক কথা। হালদারমশাইকে উনি কী বলেছেন, আগে জানা উচিত।

 কর্নেল বললেন।তুমি বোঝে সবই। তবে দেরিতে।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। হালদারমশাইয়ের ডোরবেল বাজানো শুনলেই বোঝা যায়। কর্নেল হাঁকলেন–ষষ্ঠী!

একটু পরে গোয়েন্দাপ্রবর সবেগে ঘরে ঢুকে সোফায় বসলেন। তারপর তিনি বিরক্ত মুখে বললেন–ক্লায়েন্ট যদি আমার লগে তঞ্চকতা করে, তাকে কী কমু? আমি স্পষ্ট দেখছি ফ্রেঞ্চকাট দাড়িঅলা স্যুট-টাই পরা ভদ্রলোক মিসেস রায়ের বাড়ির গেট থেইক্যা বারাইলেন। আর মিসেস রায় কইতাছেন, তাঁকে উনি চেনেন না। ওনার হাজব্যান্ড এম পি ছিলেন। কত মাইনষের লগে ওনার পরিচয় ছিল। তাদের কেউ হইব।

বললুম–আহা! আপনার ক্লায়েন্ট ঠিক কী বলছেন, স্পষ্ট করে বলুন হালদারমশাই।

–ওই তো কইলাম। ভদ্রলোক তার হাজব্যান্ডের চেনা-জানা হইতে পারেন। উনি জানেন না মিঃ রায় মারা গেছেন। মিসেস রায়ের কাছে সেই কথা শুইন্যা উনি সরি কইয়া বিদায় নিলেন। তখন আমি কইলাম, তা হইলে আপনার পোলা তারে চেনে। তাই তার গাড়িতে বইয়া কোন কামে গিছল।

কর্নেল বললেন–এ কথা শুনে ম্যাডাম কী বললেন?

–উনি কইলেন, তা টিটো ওনারে চিনতে পারে।

-আর কিছু?

–আর কী? টিটো ঠিক কোথায় আছে, অ ওনারে ফোনে জানাইতে কইলেন। এরপর উনি দরকার বোধ করলে পুলিশেরও সাহায্য চাইবেন। শচীনবাবু পুলিশে খবর দিছিলেন। তাই তাঁর মাইয়ার খোঁজ পাইছিলেন। কী কাণ্ড! মিসেস রায় খাপ্পা হইয়া কইলেন, ওনার পোলার যদি ডেডবডিও পাওয়া যায়, তিনি কাঁদবেন না।

কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন–আপনি চৌত্রিশ বছর পুলিসের চাকরি করেছেন। আপনি অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসার। আপনার কী মনে হল, মিসেস রায় ওই ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক সম্পর্কে সত্যি কথা বলছেন?

হালদারমশাই চাপাস্বরে বললেন–ভদ্রলোকেরে আমি ওনার বাড়িতে দেখছি, এই কথা কইতেই মুখে-চোখে চমক লক্ষ করছিলাম আর অত জোরে না, না, চিনি না, চিনি না কইলেন ক্যান?

গোয়েন্দাপ্রবর খি খি করে হাসলেন। সামনে য্যান ফণাতোলা সাপ দ্যাখছেন, এমন ভাবভঙ্গি!

তার মানে, আপনি নিশ্চিত যে, মিসেস রায় ভদ্রলোককে চেনেন?

–হঃ! তারপর যা কইলেন, তা তো আপনি শুনলেন। আমার ধারণা, ওনার পোলা যে ভদ্রলোকের পাল্লায় পড়ছেন, এটা ওনার কাছে খারাপ ঠেকছে। তাই উনি পুলিশের সাহায্যও চাইতে পারেন।

কর্নেল নিভে-যাওয়া চুরুট জ্বেলে বললেন–হালদারমশাই! সেই ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক হোটেল কন্টিনেন্টালে খুন হয়েছেন!

গোয়েন্দাপ্রবর গুলিগুলি চোখে তাকিয়ে বললেন–খুন? মার্ডার?

—হ্যাঁ। দশতলার ১০০৩ নম্বর ফোর বেডেড সুইটে কে ওঁর শ্বাসনালী কেটে খুন করেছে। বাকি তিনজনের পাত্তা নেই। সাদা মারুতি গাড়িটারও পাত্তা নেই। পুলিশ এসে বডি মর্গে নিয়ে গেছে।

কখন? কখন ওনারে মার্ডার করল?

–ডাক্তারের মতে নটা থেকে দশটার মধ্যে। বডি দেখা গেছে এগারোটার কিছু পরে। ততক্ষণে রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করেছিল। তাই ডাক্তার সকাল নটা থেকে সাড়ে নটা, এই সময়ের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

–ওনার নাম জানতে পারছে পুলিশ?

হ্যাঁ। রাজকুমার সিংহ। বিহারের পঞ্চগড়ের এক রত্ন ব্যবসায়ী। হালদারমশাই! এবার আপনি আপনার ম্যাডামকে ফোন করে খবরটা দিন। উনি কী বলেন, তা শুনে নিন।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ দ্রুত একটিপ নস্যি নিলেন। তারপর নোংরা রুমালে নাক মুছে বললেন–ম্যাডাম তো আপনার সাহায্যই চাইতে আইছিলেন। আমার উপর উনি ক্যান য্যান খাপ্পা হইয়া আছেন। কর্নেলস্যার! আপনিই বরং খবরটা দিন। আমারে উনি আর পছন্দ করতাছেন না।

কর্নেল একটু হেসে বললেন–ঠিক আছে। তারপর তিনি বুকপকেট থেকে স্বাগতা দেবীর নেমকার্ড বের করলেন এবং টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন। সাড়া এলে কর্নেল বললেন–আমি মিসেস স্বাগতা রায়ের সঙ্গে কথা বলতে চাই।…জরুরি কথা। ওঁকে বলুন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার ফোন করেছেন। …কর্নেল। শুধু কর্নেলসায়েব বললেই হবে। বুঝতে পারলেন কি? হা! ওঁকে খবর দিন।

একটু পরে কর্নেল বললেন–নমস্কার মিসেস রায়! কর্নেল নীলাদ্রি সরকার ও বলছি।….এবার একটু মন দিয়ে শুনুন। বিহারের পঞ্চগড় কি আপনার সত্যি অচেনা জায়গা? ….প্লিজ প্রশ্নটার উত্তর দিন। আপনার ছেলে টিটোর স্বার্থেই এই প্রশ্ন। …..এবার বলুন, সেখানকার একজন জুয়েলার রাজকুমার সিংহকে আপনি নিশ্চয় চেনেন, কারণ কাল তিনি আপনার বাড়িতে গিয়েছিলেন।…হ্যাঁ, আমার উপর আপনি যখন নির্ভর করে আছেন, তখন মিঃ হালদারকে গুরুত্ব কেনই বা দেবেন? …যাই হোক। এবার একটা শোচনীয় খবর শুনুন।…না। টিটোর খবর নয়। মিঃ রাজকুমার সিং হোটেল কন্টিনেন্টালে আজ সকালে খুন হয়েছেন। …হ্যাঁ। ছুরি দিয়ে কেউ ওঁর শ্বাসনালী কেটে খুন করেছে। পুলিশ বডি মর্গে নিয়ে গেছে। …না, না। আপনি ভাববেন না। মিঃ সিংহের সঙ্গে টিটো আজ ভোরে একটা মারুতি গাড়িতে ওই হোটেল থেকে বেরিয়ে কোথায় গিয়েছিল, হালদারমশাই আপনাকে তা তো জানিয়েছেন। …না। মিঃ হালদার আমার খুব কাছের মানুষ। পুলিশকে উনি এসব কথা বলবেন না।…হ্যাঁ, আই অ্যাশিওর ইউ মিসেস রায়। ..না। হোটেলের কেউ যে টিটোকে চিনে রাখেনি, তা আপনি নিজে গিয়েও জানতে পেরেছেন। …হ্যাঁ। আমারও ধারণা টিটো খুনি নয়। তবে আপাতত নিশ্চিত হওয়া কঠিন। …আমার পক্ষ থেকে যতটা সম্ভব, ততটা সাহায্য করব। …ঠিক। আপাতত টিটোকে খুঁজে বের করা দরকার। …..ধন্যবাদ।

কর্নেল রিসিভার রেখে টাকে হাত বুলোতে থাকলেন। জিজ্ঞেস করলুম মিসেস রায় পঞ্চগড় নামে জায়গাটা এবং সেখানকার রত্ন ব্যবসায়ী মিঃ সিংহকে চেনেন। তাই না?

হালদারমশাইও জিজ্ঞেস করলেন–তা হইলে ম্যাডাম এবারে স্বীকার করলেন ওই ভদ্রলোক তার বাড়ি গিছলেন?

কর্নেল বললেন–স্বাগতা রায়ের জন্ম পঞ্চগড়ে। তার প্রয়াত স্বামীরও সেখানে একটা রিসর্ট ছিল। সেইসূত্রে ওঁদের বিয়ে হয়েছিল। তারপর মিসেস রায়ের বাবা সেখানকার বাড়ি বেচে দিয়ে কলকাতায় চলে এসেছিলেন। সেই বাড়ি কিনে নিয়েছিলেন রাজকুমার সিংহের বাবা অজয় সিংহ। টিটোর বাবাও তাঁর বাড়িটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। কারণ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ার ফলে আর পঞ্চগড়ে বেড়াতে যাওয়ার সময় তার ছিল না।

বললুম–রাজকুমার যিংহ কেন মিসেস রায়ের বাড়ি গিয়েছিলেন?

কলকাতা এলেই নাকি তিনি মিসেস রায়ের সঙ্গে দেখা করতেন। যাকে বলে সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ!

হালদারমশাই বললেন–আপনি কইলেন ওই হোটেলে মিঃ সিংহ ফোর বেডেড স্যুইট বুক করছিলেন। আইজ ভোরে আমি হোটেলের লনে সাদা মারুতিতে চাইরজনেরে দেখছিলাম। তাদের মধ্যে টিটোও ছিল। তা হইলে বোঝা যায়, টিটো মায়েরে কইছিল সে বন্ধুদের লগে পঞ্চগড়ে আছে। কিন্তু সে ছিল ওই হোটেলে।

কর্নেল বললেন–তা-ই তো দেখা যাচ্ছে। তবে ব্যাকসিটে যে মেয়েটিকে দেখেছিলেন, সে চন্দ্রকণা হতে পারে না। কারণ তখন চন্দ্রকণার ডেডবডি পুলিশ গড়ের মাঠে আবিষ্কার করেছে।

–গাড়ি ড্রাইভ করছিলেন যে মহিলা, পুলিশ কি তার খোঁজ পাইছে কর্নেলস্যার?

নরেশবাবু অজন্তা-তে রেড করেছিলেন। কেয়ারটেকার বলেছে, তার মালকিন ম্যাডাম অগ্রবালের একটা সাদা মারুতি আছে। কাজেই হালদারমশাই। যাঁকে গাড়ি চালাতে দেখেছেন, তিনি বৈজয়ন্তী অগ্রবাল বলেই ধরে নেওয়া যায়।

আমি বললুম–তাহলে টিটোর মুখে যে প্ল্যান কথাটা শুনেছিলুম, তার সঙ্গে দেখছি পঞ্চগড়ের রত্নব্যবসায়ী মিঃ সিংহের সম্পর্ক আছে। তার ফোর-বেডেড সুইট ভাড়া করা এবং সেখানে বৃহস্পতিবার থেকে রবিবার অব্দি মিঃ সিংহ, বৈজয়ন্তী অগ্রবাল, বাণীব্রত ওরফে টিটো এবং একটি মেয়ের থাকা-খাওয়া–এই সবটাই সম্ভবত সেই প্ল্যানের একটা অংশ। তাই না কর্নেল?

কর্নেল অন্যমনস্কভাবে শুধু বললেন–হুঁ।

হঠাৎ আমার মাথায় কথাটা এসে গেল। বললুম–কর্নেল! কেব্ল টিভিতে দেখেছি রত্নব্যবসায়ীরা প্রচুর দামি অলঙ্কার পরিয়ে যে-সব সুন্দরী মেয়ের বিজ্ঞাপন দেন, তারা তো মডেলগার্ল!

কর্নেল আস্তে বললেন–ঠিক বলেছ। বিহারের পঞ্চগড়ের রত্নব্যবসায়ী কলকাতায় এসে তার কোম্পানির বিজ্ঞাপনের অডিয়োভিস্যুয়াল ক্যাসেট তৈরি করে নিয়ে যেতেই পারেন। পাটনার চেয়ে কলকাতায় এসব কাজের মান অনেক উন্নত। কিন্তু তাহলে মিঃ সিংহকে প্রচুর অলঙ্কার সঙ্গে নিয়ে

বলে হঠাৎ থেমে গেলেন কর্নেল। বললুম–আপনি একটা সত্যের সামনে এসে থমকে গেলেন!

কর্নেল হাসলেন। –হ্যাঁ। ঠিক ধরেছ। থমকে দাঁড়াতেই হল। কারণ এসব ক্ষেত্রে মিঃ সিংহের পক্ষে নকল অলঙ্কার ব্যবহারই স্বাভাবিক। আর নকল অলঙ্কার হাতানোর লোভে কোন্ মূর্খ তাকে খুন করতে যাবে? স্থানীয় রত্নব্যবসায়ীদের কথা আলাদা। তবে স্থানীয় হলে তিনি নিজের বাড়িতে বিশ্বস্ত গার্ড মোতায়েন রেখে বিজ্ঞাপনের ছবি তোলার আয়োজন করবেন। অবশ্য কেউ অন্যত্র ছবি তোলার জন্য আসল অলঙ্কার পরিয়ে ছবি তোলার রিস্ক নিতেও পারেন। কিন্তু তাকেও নিচ্ছিদ্র পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে। কে বলতে পারে বিজ্ঞাপনের ছবি তুলতে আসা লোকেরা ছদ্মবেশী ডাকাত নয়?

গোয়েন্দাপ্রবর সায় দিলেন। –হঃ! আইজকাইল মাইনষেরে বিশ্বাস করা যায় না।

আমি বললুম–কর্নেল! এবার আমার মনে হচ্ছে, এই জটিল রহস্যের প্রধান সূত্র চন্দ্রকণার কাছেই পাওয়া যেত। কিন্তু তাকে খুন করা হয়েছে। সে মৃত। আপনি কিছুক্ষণ আগে বলছিলেন, মৃতেরা কথা বলে না–

কর্নেল আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন–ওই কথাটা আসলে একটা ইংরেজি ভিডিও ক্যাসেটের নাম। ডেডস ডু নট স্পিক। আসলে ক্যাসেটটা ছিল একটা র ফিল্মের। এ নিয়েও একটা হত্যাকাণ্ডের রহস্যের জট খুলেছিলুম। তুমি তখন বিদেশে গিয়েছিলে। মাই গুডনেস! তোমাকে তো ঘটনাটা বলেছিলুম। তুমি ওই নামে একটা রহস্যকাহিনীও লিখে ফেলেছিলে!

তখনই মনে পড়ে গেল। বললুম–পুরনো ঘটনা নতুন-নতুন ঘটনার তলায় চাপা পড়ে যায়। যাই হোক, আপনি বলছিলেন, মৃতদের আপনি কথা বলানোর চেষ্টা করেন। ওই ঘটনায় তো মৃতদের কথা বলিয়ে ছেড়েছিলেন। এবার মৃত চন্দ্রকণাকে কথা বলানোর চেষ্টা করুন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সব জট খুলে যাবে। আবার মনে করিয়ে দিচ্ছি, কাল সন্ধ্যায় চন্দ্রকণা বলেছিল, কর্নেলসায়েবের সঙ্গে তার দেখা করার দরকার আছে। তার মানে, সে এমন সাংঘাতিক কিছু ঘটতে পারে, তা নিশ্চয় টের পেয়েছিল।

কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর হাত বাড়িয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলে একটা নাম্বার ডায়াল করলেন। তারপর সাড়া পেয়ে বললেন–বিনোদবাবু? আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। …না। একটা কথা জানবার জন্য। …..আচ্ছা, আপনার কোম্পানি তো টিভি-তে বিজ্ঞাপন দেয়? …হ্যাঁ। এ কালে তো টিভি-ই সর্বেসর্বা। যাই হোক, আপনারা নিশ্চয় বাড়ির মেয়েদের গায়ে বহু লক্ষ টাকার দামি অলঙ্কার পরিয়ে বিজ্ঞাপনের ক্যাসেট ….ঠিক বলেছেন। বাড়ির মেয়েদের ক্যামেরার সামনে আড়ষ্টতা স্বাভাবিক। ….তাই জানতে চাইছি। কিন্তু সত্যিকার অলঙ্কার কি ব্যবহার করেন? …বলেন কী! এতে রিস্ক থেকে যায় না? ….তা অবশ্য ঠিক। অনেক দিনের বিশ্বস্ত টিম হলে রিস্ক নেওয়া যায়।…জাস্ট আ মিনিট! একটু জোরে বলুন। টেলিফোন গণ্ডগোল করছে। ….কবে? ও মাই গড! ভদ্রলোক পুলিশকে জানাননি? …কী আশ্চর্য! নিজের মেয়ে বলে চেপে গেছেন। …বিনোদবাবু, আপনার বন্ধুটির নাম-ঠিকানা জানাতে আপত্তি আছে? ..না না। আমাকে তো জানেন। আমি ঘটনাটা গোপন রাখব। …না, না। এটা নিছক কৌতূহল। ….আমি কথা দিচ্ছি। তার বাড়িতে গিয়ে ঝামেলা বাধাব না। …বলুন। লিখে নিচ্ছি।

কর্নেল টেবিলে রাখা প্যাড ও কলম টেনে সম্ভবত কার নাম-ঠিকানা লিখতে থাকলেন। তারপর ধন্যবাদ বলে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন।

গোয়েন্দাপ্রবরের গোঁফ তিরতির করে কাঁপছিল। তিনি উত্তেজিতভাবে বললেন কর্নেলস্যার! কোথায় কিছু ঘটছে মনে হইতাছে।

কর্নেল একটু হেসে বললেন–বউবাজারের একজন রত্নব্যবসায়ী তার মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন গত বছর মে মাসে। যার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন, সে ঘরজামাই হয়ে আছে। কারণ তাঁর ওই একটি মাত্র মেয়ে। জামাই শিক্ষিত ছেলে। তার ব্যবসার দায়িত্ব তারই হাতে। গতকাল এক গুচ্ছের অলঙ্কার পরে মেয়ে তার বাবার সঙ্গে গাড়ি চেপে ছবি তোলাতে গিয়েছিল। রাত দশটায় মেয়ে খালি গায়ে ফিরে এসেছে। জামাইকে কারা মুখে টেপ এঁটে বেঁধে রেখেছিল। মেয়ের গায়ের সব অলঙ্কার ছুরি দেখিয়ে কেড়ে নিয়ে কারা তাদেরই গাড়িতে চাপিয়ে বাড়িতে রেখে পালিয়ে যায়। গাড়িটা জামাইকে কিনে দিয়েছিলেন ভদ্রলোক। মেয়ে দিব্যি দিয়ে বলেছে, থানাপুলিশ করলে ওরা তাদের মেরে ফেলবে। তা ছাড়া লোজ্জার জন্যও বটে, ভদ্রলোক পুলিশকে কিছু জানাননি। তাঁর বন্ধু আরেক রত্ন ব্যবসায়ী বিনোদবাবুকে গোপনে ঘটনাটা জানিয়েছেন। বিনোদবাবুকে তাঁর বন্ধুর মেয়ে চৈতালি বলেছে, তার স্কুল জীবনের এক সহপাঠিনী চিত্রা সেই স্টুডিওতে কাজ করে। এবার আশ্চর্য কথাটা হল, স্টুডিওটা পার্ক স্ট্রিটে মুনলাইট বারের উপরতলায়। নাম অজন্তা স্টুডিও।

হালদার মশাই দ্রুত একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন–জব্বর একখান কু কর্নেলস্যার!..

কর্নেলের মুখে এই ঘটনাটা শুনে অবাক হয়েছিলুম–চন্দ্রকণা বলছিল, অজন্তা মডেলিং শেখার স্কুল। অজন্তা স্টুডিও বলেছে মেয়েটি?

কর্নেল হাসলেন–জয়ন্ত! সাংবাদিকরা আজকাল সবজান্তা আর সর্ববিদ্যা বিশারদ। তুমি দেখছি, এখনও সাংবাদিক হয়ে উঠতে পারনি!

প্রাইভেট ডিটেকটিভ বললেন–কী যেন কন কর্নেলস্যার? জয়ন্তবাবু এখন বিখ্যাত সাংবাদিক!

কর্নেল বললেন–কিন্তু হালদারমশাই। সাংবাদিকদের কমনসেন্স থাকা চাই। মডেলিং স্কুলে স্টুডিও থাকবে না? ক্যামেরার সামনেই তো মডেলদের কতরকম ভঙ্গিতে দাঁড়াতে হবে। ওঃ। জয়ম্ভ! তুমি সম্ভবত আজ ভাতঘুমের সুযোগ না পেয়ে চাঙ্গা নও।

বলে তিনি দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ে হাঁক দিলেন-ষষ্ঠী! কফির সময় হয়ে গেছে।

বললাম–কী আশ্চর্য! মডেলিং স্কুলে ক্যামেরা থাকবে, তা জানব না কেন? আমি বলতে চাইছি, মিসেস বৈজয়ন্তী অগ্রবাল কি বাইরের লোকেদের ফটো তোলার জন্যও ওখানে আলাদা স্টুডিও করেছেন?

কর্নেল বললেন–তা করতেও পারেন বইকি! বাড়তি পয়সা কামানোর সুযোগ পেলে তা কে ছাড়ে? কিন্তু চৈতালি নামে মেয়েটির কথা শুনে বোঝা যাচ্ছে তার স্কুল জীবনের এক সহপাঠিনী চিত্রা ওই স্টুডিওতে কাজ করে। সম্ভবত তাই চৈতালি চিত্রাকে তার বরের সঙ্গে অলঙ্কার পরে ছবি তোলার জন্য অনুরোধ করেছিল। অথবা চিত্রাই বলেছিল, বরের সঙ্গে চৈতালির ছবি তুলে দেবে।

গোয়েন্দাপ্রবর হঠাৎ চাপাস্বরে বলে উঠলেন– কর্নেলস্যার! আমার সন্দেহ, চিত্রাই তার বন্ধু চৈতালিকে ছবি তোলার টোপ দিচ্ছিল।

বললুম–টোপ মানে?

হালদারমশাই উত্তেজিতভাবে বললেন–তারে চিত্রা অনেক অলঙ্কার পইর‍্যা আইতে কইছিল। চিত্রার জানার কথা, চৈতালির বাবা জুয়েলার! কর্নেলস্যার। আমার মাথায় এই পয়েন্টটা আইয়া পড়ল। আপনি কী কন?

কর্নেল একটু হেসে বললেন–আপনি অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসার। এই পয়েন্টে যুক্তি আছে।

এইসময় ষষ্ঠীচরণ কফির ট্রে রেখে গেল। কফিতে চুমুক দিয়ে বললুম, কর্নেল। আপনি দেখছি, ইজিচেয়ারে বসে টেলিফোনের সাহায্যেই রাজকুমার সিংহ এবং চন্দ্রকণা মজুমদারের হত্যা রহস্যের সমাধান করে ফেলবেন!

আমার খোঁচা খেয়েও কর্নেল মুখ খুললেন না। হালদারমশাই বললেন, কর্নেলস্যার কইলে আমি চৈতালির বাবারে

কর্নেল তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন–না হালদারমশাই! কোনো হঠকারিতা করে বসলে চৈতালি, তার স্বামী এবং তার বাবার মুখ একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। আমার পরিচিত জুয়েলার বিনোদবাবুর কাছে যতটুকু শুনেছি, তা-ই যথেষ্ট। এরপর কীভাবে এগোতে হবে, তা চিন্তাযযাগ্য বিষয়।

হালদারমশাই ফুঁ দিয়ে কফি খেতে খেতে বললেন–আচ্ছা কর্নেলস্যার! একটা কথা মাথায় ঢুকতেছে না।

বলুন।

 –পঞ্চগড়ের রাজকুমার সিংহ! ওনার পদবী সিংহ। বিহারে সিংহরা কি জুয়েলার হয়?

কর্নেল সহাস্যে বললেন–বাঃ! হালদারমশাই একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। জুয়েলারি কারবার সারা ভারতে জাত-বণিকদের পেশা। বাংলায় সুবর্ণবণিক বা সোনার বেনে বলা হয়।

বললুম–এ যুগে অন্যেরাও জুয়েলারি কারবারে নামতে পারে। বামুনের ছেলে এ যুগে জুতোর ব্যবসা করে না?

কর্নেল বললেন–কিন্তু রাজ্যটার নাম বিহার। তাছাড়া পঞ্চগড় পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে একটা ছোটো শহর। অবশ্য কাছাকাছি একটা শিল্পাঞ্চলও আছে। হুঁ! হালদারমশাই একটা পয়েন্ট তুলেছেন। এক মিনিট!

বলে তিনি টেলিফোনের রিসিভারের দিকে হাত বাড়িয়েছেন, এমন সময় ডোরবেল বাজল। কর্নেল যথারীতি হাঁক দিলেন–ষষ্ঠী!

একটু পরে ডিটেকটিভ সাব-ইন্সপেক্টর নরেশ ধর ঘরে ঢুকলেন। তিনি হালদারমশাইকে দেখে বললেন–উরেব্বাস! হালদারমশাই যে! নমস্কার! নমস্কার! শেষ অব্দি এখানে আপনারে পেয়ে যাব জানতুম।

হালদারমশাই বললেন–নরেশ কি আমাকে খুঁজছিলা?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। মিসেস স্বাগতা রায়ের কাছে শুনে এলুম, তাঁর ছেলের খোঁজে তিনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ লাগিয়েছেন।

কর্নেল বললেন–বসুন নরেশবাবু! কফি খান। নার্ভ চাঙ্গা করুন!

নরেশবাবু বসে বললেন–আজ দিনটা যা গেল! পুলিশ ক্যান্টিনে দুমুঠো মুখে খুঁজে বেরিয়েছি, এ সি নিয়োগীসাহেব বললেন, চন্দ্রকণার বাবা শচীন মজুমদার কোনো সূত্রে জানতে পেরেছেন, প্রয়াত এম পি শুভব্রত রায়ের স্ত্রী স্বাগতা রায়ের ছেলে নিখোঁজ। তাই প্রাইভেট ডিটেকটিভ হায়ার করেছেন। তাঁর নাম মিঃ হালদার। শুধু এটুকুই শচীনবাবু জানতে পেরেছেন। তা নিয়োগীসায়েব হালদারমশাইকে চেনেন। আমিও চিনি।

হালদারমশাই গম্ভীরমুখে বললেন–আমার ক্লায়েন্টের কাজের মাইয়াটাই কইয়া দিছে। অগো পাড়ার সব খবর জানা থাকে। একজন কাজের মাইয়া আরেকজন কাজের মাইয়ারে সব কইয়া দেয়।

ষষ্ঠী তখনই এক পেয়ালা কফি দিয়ে গেল। নরেশবাবু কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন–হোটেল কন্টিনেন্টালে কর্নেলের সঙ্গে আপনাকে দেখে অত কিছু, ভাবিনি! যাই হোক, মিসেস রায়ের কাছে সব জেনে আপনাকে কয়েকবার রিং করেও সাড়া পেলুম না। অগত্যা কর্নেল সায়েবের এখানে চলে এলুম। প্লিজ হালদারমশাই! একটু ঝেড়ে কাশুন এবার। কাগজ-কলম বের করি। এক মিনিট!

গোয়েন্দাপ্রবর গুলিগুলি চোখে তাকিয়ে বললেন–সব কইতাছি। কিন্তু নরেশ, আগে আমারে একখান ইনফরমেশন তোমারে দিতে হইব–দিস ইজ দা কন্ডিশন!

নরেশবাবু হাসলেন।–ঠিক আছে হালদারমশাই। আপনি চাকরিতে থাকলে স্যার বলতে হত। সায়েব বলতে হত। স্যালুট ঠুকতেও হত। কর্নেল সায়েবের দেখাদেখি আপনাকে হালদারমশাই বলি। আপনি রাগ করেন বলে শুনিনি। তবে আপনি কন্ডিশন চাপাচ্ছেন। একটু প্রবলেমে পড়লুম যে!

হালদারমশাই বললেন–প্রবলেম কিছু না নরেশ। ওই হোটেলে যার ডেডবডি পাইছ, তার নাম জানছ তোমরা। ভিকটিম আর বাকি তিনজনের আসল নামও জানছ। সেই নামগুলি শুধু আমাগো জানাও। ব্যস্! আমি সব কথা কমু!

নরেশবাবু বললেন–ভিকটিমের নাম কর্নেল সায়েবকে বলেছি। রাজকুমার সিংহ।

কর্নেল বললেন–হালদারমশাইকে তা জানিয়েছি। কিন্তু একটা প্রশ্ন তুলেছেন। বিহারের একটা ছোট্ট শহরে সিংহ পদবীধারী কেউ জুয়েলারি ব্যবসা করেন এটা উনি মানতে রাজি নন।

–ঠিক ধরেছেন হালদারমশাই! বিহারে সিংহেরা নিজেদের ক্ষত্রিয় বলেন। মিসেস রায় বললেন, রাজকুমারবাবু ব্যবসা করেন, তা জানেন। তবে কিসের ব্যবসা তা জানেন না। অথচ ওর পোশাক খুঁজে কয়েকটা কার্ডে পেলুম, তাতে দেখলুম ওঁর জুয়েলারি ব্যবসা আছে। কর্নেল সায়েবকেও গোপনে একটা কার্ড দিয়েছি।

হালদারমশাই বললেন–বাকি তিনজনের মধ্যে একজন আমার ক্লায়েন্টের পোলা টিটো। বাণীব্রত রায়।

নরেশবাবু চমকে উঠে বললেন–অ্যাঁ? কী সর্বনাশ! হোটেলে মিঃ সিংহের ফ্যামিলির নাম দেওয়া আছে। আপনি দেখছি, আমাদের চেয়ে এগিয়ে আছেন। হ্যাঁ–রাজকুমার সিংহ তো হরনাথ গুপ্তা নাম নিয়েছিলেন। এবার বোঝা যাচ্ছে তাঁর ছেলে বাণীকুমার সিংহ হচ্ছে বাণীব্রত রায় ওরফে টিটো। তার মেয়ের নাম দেওয়া আছে সংঘমিত্রা সিংহ। আর স্ত্রীর নাম জয়ন্তী সিংহ। রাজকুমারবাবু খুন এবং এই তিনজন ব্যাগেজ-সহ নিপাত্তা। এমনকী, সাদা মারুতি গাড়িটি-সহ। অতএব এই তিনজন ওঁর কেউ নয়।

কর্নেল বললেন–হালদারমশাই আপনাকে সবই জানাবেন। তবে আমি তার আগে একটা কথা বলে দিই। সাদা মারুতিতে চারজনই ভোর ছটা নাগাদ হোটেল থেকে বেরিয়েছিল। গাড়ি নিয়ে তারা কখন ফিরে এসেছিল, হোটেলের কর্মচারীরা নিশ্চয় তা লক্ষ করে থাকবে। কী বলেছে তারা?

নরেশবাবু বললেন–যে লোকটার কাঁচের দরজা খোলার ডিউটি মর্নিং-এ ছিল, তার নাম মানিকলাল। রাত চারটে থেকে সকাল দশটা অব্দি তার ডিউটি। সে বলেছে, সাদা মারুতি থেকে নেমে চারজনে হোটেলে ঢুকেছিল সাড়ে আটটায়। তারপর সাড়ে নটায় তিনজন বেরিয়ে যায়। প্রৌঢ়া মহিলার কাঁধে একটা ব্যাগ ছিল। তার মেয়ের কাঁধেও একটি ব্যাগ। তার ছেলের হাতে একটা ব্রিফকেস।

কর্নেল বললেন–অর্থাৎ স্বাগতা রায়ের পুত্র টিটোর হাতে একটা ব্রিফকেস ছিল।

নরেশবাবু ভুরু কুঁচকে একটু হেসে বললেন–টাকাভর্তি ব্রিফকেস আপনি আপনার সেই তৃতীয় নয়নে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন। তাই না?

কর্নেল বললেন–আমি দেখতে পাচ্ছি, তারা খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গিয়েছিল। কী বলেছে মানিকাল?

–মানিকলাল অত লক্ষ করেনি। কিন্তু মেইন গেটের দারোয়ান বলেছে, সাদা মারুতিটা খুব জোরে বেরিয়ে গিয়েছিল।

–তাহলে টিটো আপনাদের তথ্য অনুসারে খুনি?

–আবার কে? বড়লোকের বখাটে ছেলে। বাবা বেঁচে নেই। একমাত্র সন্তান। মায়ের অবাধ্য।

খুনের মোটিভ?

রাজকুমার সিংহের ব্রিফকেসে প্রচুর টাকা ছিল। এটা আপনি অনুমান বলবেন। কিন্তু অনুমানও একটা যুক্তি। যাই হোক, হালদারমশাই! আপনার স্টেটমেন্টটা নেওয়া যাক।

হালদারমশাই প্রাক্তন পুলিশ অফিসার। তাঁর স্টেটমেন্টে সতর্কতা লক্ষ করছিলুম। নরেশবাবু স্টেটমেন্টে সই করিয়ে নিয়ে বললেন–প্লিজ হালদারমশাই! এমন কিছু করবেন না, যাতে আপনার ক্লায়েন্ট আমাদের তদন্তে অসুবিধের সৃষ্টি করেন।

গোয়েন্দাপ্রবর নস্যি নিয়ে বললেন–ক্লায়েন্ট আমারে সত্য গোপন করছে। কন্ট্রাক্টের কন্ডিশন মানে নাই। তার লগে আর আমার কাম কী?

কর্নেল বললেন–নরেশবাবু! বিহার পুলিশের কাছে খোঁজ নিন, রাজকুমার সিংহের সত্যি জুয়েলারি কারবার আছে কি না। বিচক্ষণ হালদারমশাই একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট তুলেছেন।

নরেশবাবু বললেন–লাহিড়িসায়েবকে আপনি বললে তাড়াতাড়ি কাজ হবে। অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার নিয়োগীসায়েব আমার কথা কতটা গ্রাহ্য করবেন জানি না।

নরেশ ধর চলে যাবার পর হালদারমশাই বললেন–আর একটা খটকা বাধছে কর্নেলস্যার!

কর্নেল বললেন–বলুন হালদারমশাই!

–দুইজন মাইয়া মাইনষের সামনে টিটো মিঃ সিংহের গলা কাটল, আমার মনে হয় এমনটা স্বাভাবিক না। আফটার অল মাইয়া মাইনষের মন! হ! কইতে পারেন, মাইয়ারাও পুরুষেরে খুন করতে পারে। কিন্তু এই ব্যাপারে আমার খটকা বাধছে। এই দুইজন মাইয়া খুনি, তা-ও তো আমাগো জানা নাই।

–আপনি ঠিকই বলেছেন। বিশেষ করে করিডরে ওয়াকিটকি হাতে গার্ড থাকার কথা।

বললুম–এয়ার কন্ডিশনড ঘর। ভিতরের একটুও শব্দ বাইরে শোনা যাবে না। তাছাড়া কপাটে লটকানো ছিল প্লিজ ডোন্ট ডিসটার্ব। এমন হতেই পারে, দুজন মেয়ে তখন বাথরুমে ঢুকে কানে আঙুল গুঁজে দাঁড়িয়ে ছিল। ওরা খুনি না তোক, একটা নয়–দু-দুটো খুনের চক্রান্তে জড়িত। চন্দ্রকণার কথা মনে রাখা উচিত।

কর্নেল একটু হেসে বললেন–চন্দ্রকণা এখন রাজকুমার সিংহের আড়ালে চাপা পড়ে গেছে, এতে তোমার ক্ষুব্ধ হওয়া স্বাভাবিক ডার্লিং! কিন্তু আমার মনে চন্দ্রকণা সম্পর্কে তোমার ওই দুটো কথা জ্বলজ্বল করছে। অ্যামবিশান এবং অসহায় আত্মসমর্পণ!

হালদারমশাই বললেন–ডি সি ডি ডি ওয়ান লাহিড়িসায়েবেরে ফোন করবেন না কর্নেলস্যার?

দরকার হলে করব। আপাতত আপনাদের একটা জিনিস দেখাচ্ছি। হোটেল কন্টিনেন্টালের ১০০৩ নম্বর সুইট লেডিজ বেডরুমের কোনায় ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে এটা কুড়িয়ে পেয়েছিলুম।

কর্নেল উঠে ভিতরের ঘরে গেলেন। তারপর ফিরে এসে ইজিচেয়ারে বসে বুকপকেট থেকে একটুকরো কাগজ বের করলেন। বোঝা গেল, কাগজটা দলা পাকিয়ে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে কেউ ফেলে দিয়েছিল। কর্নেল সেটা যতটা সম্ভব সোজা করেছেন। তিনি বললেন, জয়ন্ত যখন স্নান করছিল, তখন এটা ঠিকঠাক করে আতসকাঁচের সাহায্যে পড়ে ফেলেছি। এটা একটা চিঠি। যাকে লেখা হয়েছিল, সে পড়েই গুটিয়ে আবর্জনার ঝুড়িতে ফেলে দেয়। সে বোঝেনি, এটা কত গুরুত্বপূর্ণ।

জিজ্ঞেস করলুম–কী লেখা আছে ওতে?

কর্নেল টেবিলের ড্রয়ার থেকে আতসকাচ বের করে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে চিঠিটা পড়ে শোনালেন। তারপর বললেন–চিঠিটা সংক্ষিপ্ত। ইংরেজিতে লেখা। বাংলা করলে এ রকম দাঁড়ায়ঃ

সি-র প্রতি,
ঠিক ৯টায় যাচ্ছি। বি-কে আমার জন্য অপেক্ষা করতে বলবে। তোমরা নিচে গাড়িতে অপেক্ষা করছ বলে বেরোবে। আমাকে দেখামাত্র তোমরা চলে যাবে। ঠিক জায়গায় আমি গিয়ে দেখা করব। সাবধান।
–এস

হালদারমশাই বললেন–কোনো সি-রে কোনো এস চিঠি লিখছে। বি-রে সে তার জন্য অপেক্ষা করতে বলেছে।

কর্নেল বললেন–ঠিক ধরেছেন আপনি।

বললুম–তা হলে দেখা যাচ্ছে, একজন পঞ্চম ব্যক্তি এসে যাচ্ছে এই কেসে। তার নামের আদ্যক্ষর এস।

কিন্তু কর্নেল, কোনো আউটসাইডার হোটেলের সাক্ষাৎপ্রার্থীদের রেজিস্টারে নাম-ঠিকানা না লিখে কি কোনো সুইটে কারও কাছে যেতে পারে?

কর্নেল বললেন–অত বড়ো হোটেল। লাউঞ্জে সারাক্ষণ ভিড়। রিসেপশন কাউন্টারেও ভিড় থাকে অনেকসময়। কাজেই কেউ ইচ্ছে করলে সোজা গিয়ে অটেমেটিক লিফটে উঠতেই পারে।

–ওয়াকিটকি হাতে গার্ড আছে প্রতি ফ্লোরে। তারা কিছু জিজ্ঞেস করে না?

 কর্নেল হাসলেন।– অভিজাত হোটেলে কোনো গার্ডের পক্ষে কোনো ভদ্রলোককে বিনা কারণে কোনো প্রশ্ন করাটা তার অসভ্যতা বলে গণ্য হবে। অবশ্য ব্যতিক্রম থাকতেই পারে। ধরো, কোনো ভিজিটর কারও সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে সুইট খুঁজে পাচ্ছেন না। এদিকে-ওদিকে ঘোরাঘুরি করছেন। গার্ড তাকে মার্কিন কায়দায় ক্যান আই হেলপ ইউ স্যার? বলতে পারে। তা ছাড়া একেকটা ফ্লোরে অনেকগুলো করিডর আর সুইট। একজন গার্ডকে সারাক্ষণ প্রতি করিডরে। চক্কর মেরে ঘুরে বেড়াতে হলে বেচারা হার্টফেল করবে। আমি দশতলাটা ঘুরে। দেখে নিয়েছি। এঁকে দেখাচ্ছি। তা হলে আমার কথা বুঝতে পারবে।

বলে কর্নেল টেবিলের প্যাড এবং কলম নিয়ে রেখাচিত্র আঁকলেন।

তারপর তিনি বললেন– লক্ষ করো জয়ন্ত! হালদারমশাই। আপনিও দেখুন। ১০০৩ নম্বর সুইটে কিছু ঘটলে কেউ টের পাবে না।

হালদারমশাই বললেন–জয়ন্তবাবু কইছিলেন, একজন ফিফথ ম্যান আইয়া পড়ল। সে হইল গিয়া এস। কিন্তু সে সি-রে চিঠি দিছিল আরেকজনের হাতে। তা হইলে একজন সিক্সথ ম্যানও আইয়া পড়ল। তাই না কর্নেল স্যার?

কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। তবে এস চিঠিটা সি- কে যার হাত দিয়ে পাঠিয়েছিল, সে হোটেল কন্টিনেন্টালে গিয়ে সেটা কোনো সুযোগে সি– কে দিয়েছিল এতে আমি নিশ্চিত। চিঠিটা খুবই গোপনীয়। বি-র অজ্ঞাতসারেই সেটা সি-কে দেওয়ার কথা। এস লিখেছে বি-কে তার অপেক্ষায় একা বসে থাকতে বলবে সি। কাজেই চিঠি এমন কোথাও সি-কে দেওয়া হয়েছে, যেখানে বি ছিল না। চিঠিটা সুইটের বাথরুমে ঢুকে সি পড়ার পর দলা পাকিয়ে আবর্জনার ঝুড়িতে ফেলে দিয়েছিল।

বললুম–বি-তে বাণীব্রত। বৈজয়ন্তী অগ্রবাল।

–না জয়ন্ত! বাণীব্রত কিংবা বৈজয়ন্তী একটা স্যুইটে ছিলেন না। চিঠি পড়ে মনে হচ্ছে এস খুনি। বি তার জন্য ওই সুইটে একা অপেক্ষা করছিল। কিন্তু রাজকুমার সিংহের নামের আদ্যাক্ষর তো আর। তাহলে বি কে?

কর্নেল হাত বাড়িয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন। তারপর সাড়া এলে বললেন–কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।… মিসেস রায়?… আপনি আমাকে রিং করবেন ভেবেছিলেন? তাহলে আপনার কথাটা শোনা যাক। ….শচীনবাবু আপনার ছেলের নামে পুলিশের কাছে এফ আই আর করতেই পারেন। এতে আপনার চিন্তার কারণ নেই। আমি আপনার কাছে একটা কথা জানতে চাই।…..রাজকুমার সিংহ তো ক্ষত্রিয়। আপনি বিহারের পঞ্চগড়ের মেয়ে। আপনার নিশ্চয় জানার কথা, মিঃ সিংহের কি সত্যিই জুয়েলারির কারবার আছেয…হ্যাঁ। ঠিক বলেছেন। ধন্যবাদ। ক্ষত্রিয় হোন, আর যা-ই হোন, এ কালে ওসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। ….রাজপুত ওঁরা? তাহলে তো কথা নেই। রাজপুতরা সব রকমের কারবারই করেন। আমি রাজস্থানে দেখেছি …..হ্যাঁ। ঠিক। এবার প্লিজ আর একটা প্রশ্নের উত্তর দিন। আপনার ছেলের স্বার্থেই এটা আমার জানা। দরকার।….রাজকুমার সিংহের কি আর কোনো নাম জানেন আপনিঃ …. বনোয়ারি? ডাক নাম?…..আই সি! এফিডেবিট করে রাজকুমার হয়েছিলেন। ….তাহলে পঞ্চগড়ে উনি বনোয়ারিবাবু নামে পরিচিত? ….ধন্যবাদ মিসেস রায়। রাখছি।

হালদারমশাই বলে উঠলেন–বি-তে বনোয়ারি। এস তার খুব চেনা লোক। তাই তারে বি লিখছে।

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–আমি আর জয়ন্ত কিছুক্ষণের জন্য বেরোব হালদারমশাই! আপনাকে একটা দায়িত্ব দিচ্ছি। আপনি এখনই বাড়ি ফিরে ছদ্মবেশে ভবানীপুরে আপনার ক্লায়েন্টের বাড়ির কাছাকাছি কোথাও থেকে বাড়িটার দিকে নজর রাখবেন। পুলিশ মিসেস রায়কে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আমার মনে হয়, টিটো বাড়ি ফিরবে ভেবে লালবাজারের গোয়েন্দা পুলিশ সাদা পোশাকে ওখানে অপেক্ষা করবে না। কারণ পঞ্চগড় নরেশবাবুদের মাথায় ঢুকে গেছে। তাই হাওড়া স্টেশনে গোয়েন্দা পুলিশ ওঁরা পাঠাতে পারেন। তবে ওঁরা পাঠান বা না-ই পাঠান, আপনি সাধুসন্ন্যাসী চমৎকার সাজতে পারেন। সেই বেশে ওত পেতে থাকাই নিরাপদ। সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত ওখানে থাকার পরে আমার এখানে চলে আসবেন।

গোয়েন্দাপ্রবর গুলিগুলি চোখে তাকিয়ে কর্নেলের কথা শুনছিলেন। তাঁর গোঁফের দুই ডগা যথারীতি উত্তেজনায় তিরতির করে কাঁপছিল। তিনি সটান উঠে সবেগে বেরিয়ে গেলেন।….

.

গাড়িতে চেপেই কর্নেল বলেছিলেন–আমহার্স্ট স্টিট চলো। মহাত্মা গান্ধি রোড পেরিয়ে তারপর বলে দেব কোথায় যাচ্ছি। গলি রাস্তাটা আমার চেনা।

আজ রবিবার, রাস্তায় গাড়ির তত ভিড় নেই। ট্রামলাইন পেরিয়ে কিছুদূর চলার পর কর্নেলের নির্দেশে ডানদিকে একটা গলি রাস্তায় এগিয়ে গেলুম। তারপর বাঁকের মুখে বাঁদিকে একটা বাড়ির সামনে একটু খালি ফাঁকা জায়গায় কর্নেল গাড়ি দাঁড় করাতে বললেন।

গাড়ি থেকে নেমে দেখলুম, একটু পুরোনো আমলের দোতলা বাড়ির সামনে কর্নেল উধ্বমুখে দাঁড়িয়ে আছেন এবং ঝকঝকে সাদা ফতুয়া এবং ধুতিপরা বেঁটে এক ভদ্রলোক বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকে হাসিমুখে নমস্কার করছেন। পরক্ষণে তিনি অদৃশ্য হলেন।

কিছুক্ষণ পরে একটা লোক নিচের ঘরের দরজা খুলে ঝুঁকে করজোড়ে কর্নেলকে প্রণাম করল। কর্নেল বললেন কী খবর হারাধন? ভালো আছ তো?

হারাধন একমুখ হেসে বললেসারের আশীর্বাদে ভালো আছি। আসুন! কর্তামশাই এখনই এসে পড়বেন। ঘরে এসে বসুন আজ্ঞে!

বুঝলুম, পাড়ার রকবাজদের উৎপাত বন্ধ করতে বারান্দার একাংশ জায়গায় সিঁড়ি করা হয়েছে এবং দুদিকের বাকি অংশ কেটে ঢালু করে কাঁচের টুকরো বসানো হয়েছে। ঘরের ভিতর এখনই অন্ধকার। হারাধন, আলো জ্বেলে ফ্যান চালিয়ে দিল। আসবাবপত্র দেখে বনেদি পরিবার মনে হল।

একটু পরে সেই ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে বললেন–আমার সৌভাগ্য! আপনার টেলিফোন পেয়েই তখন থেকে কেন যেন মনে হচ্ছিল, আপনার পায়ের ধুলো পড়বে।

কর্নেল বললেন–আলাপ করিয়ে দিই। আমার এই তরুণ বন্ধুর নাম জয়ন্ত চৌধুরী। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক। জয়ন্ত! ইনি বউবাজারের নামকরা জুয়েলার বিনোদবিহারী দত্ত।

ভদ্রলোক আমাকে নমস্কার করে কর্নেলের মুখোমুখি বসলেন। আমি প্রতিনমস্কার করে বললুমবুঝতে পেরেছি। কর্নেল আমার সামনে আপনাকে টেলিফোন করেছিলেন।

বিনোদবাবু বললেন কর্নেলসায়েব আমাকে ডুবো নৌকো থেকে উদ্ধার করেছিলেন। ওঁর ঋণ জীবনে ভুলতে পারি? দশলাখ টাকার জুয়েলস উদ্ধার করে দিয়েছিলেন।

কর্নেল বললেন–ওসব পুরোনো কথা থাক বিনোদবাবু। আমি এসেছি আপনার একটুখানি সাহায্যের আশায়।

বিনোদবাবু চোখে হেসে বললেন–টেলিফোনেই আঁচ করেছিলুম। ব্রজর ঠিকানা নিলেন। কিন্তু সরাসরি তার কাছে যাওয়া উচিত মনে করেননি। হ্যাঁ, ঠিক করেছেন। ব্রজ ঘাবড়ে যেত। চুপিচুপি কিল হজম করেছে। আসল কথাটা টেলিফোনে বলিনি। মাথার উপর একজন আছেন। তার বিচার সূক্ষ্ম। অন্যকে ঠকালে একদিন নিজেকেও ঠকতে হবে।

কর্নেল বললেন–হাতে সময় কম। ঠিকানা শুনে মনে হল, আপনার পাড়ায় ওঁর বাড়ি। আমার দরকার ওঁর মেয়েকে। তাকে না পেলে অগত্যা ব্রজবাবুর জামাই।

বিনোদবাবু খিকখিক করে আবার হাসলেন। অর্থাৎ চৈতালিকে না পেলে সুখেনকে। সুখেনকে না পেলে অগত্যা ব্রজকে। এ বেলা কি চৈতালি ও সুখেনকে পাওয়া যাবে? সিনেমা দেখতে যেতে পারে। তবে দেখি, কাকে পাই। তবে আপনি যেন প্লিজ বলবেন না, খবরটা আমার সূত্রে পেয়েছেন। ব্ৰজ আমার বন্ধুমানুষ। আপনার কথা তাকে বলেছিলুম। ভুলে যাওয়ার কথা নয়। একটু বসুন। কফি আসছে। আমি আমার মেয়ে বুলিকে পাঠিয়ে দেখি। তারপর না হয় টেলিফোনে ব্রজকে ডাকব।

বিনোদবাবু চলে গেলেন। বললুম–বিনোদবাবুর জুয়েলারি উদ্ধার করে দিয়েছিলেন। অথচ আমাকে ঘটনাটা আপনি বলেননি।

কর্নেল বললেন তোমার লেখার মতো ঘটনা হয়। ওঁর এক কর্মচারীর কীর্তি। পুলিস কজন দাগি ডাকাতকে ধরেছিল। এদিকে অদ্ভুত ব্যাপার, চোরাই জুয়েন্স দোকানেরই ভিতরে বিনোদবাবুর বাবার বিশাল পোর্ট্রেটের পিছনে লুকোনো ছিল।

কী সূত্রে আপনি তা টের পেয়েছিলেন?

–ছবির নিচের ফ্রেম দেওয়ালে ঠেকে থাকে বলে একটা দাগ পড়ে। দাগটা ছবি না সরালে দেখা যায় না। আমার চোখ পড়েছিল ছবিটার দিকে। বাঁদিকে একটু সরে গিয়েছিল ছবিটা। ডাইনে একটু দাগ বেরিয়ে পড়েছিল।

–আপনার খুরে খুরে দণ্ডবৎ! আপনার সত্যি তিনটে চোখ আছে বস!

কর্নেল হাসলেন। অরিজিৎ লাহিড়ি আমাকে কৌতুকে বস্ বলে। তুমিও তার মতো বস্ বললে কানে লাগে।

-ঠিক আছে। বলব না। তার বদলে গুরু বলব।

–ওঃ জয়ন্ত! ওটা রকের ছোকরাদের বুলি।

 এই সময় সেই হারাধন ট্রেতে কফি আর এক প্লেট পটোটো চিপস্ নিয়ে এল। কর্নেল কফির কাপ তুলে চুমুক দিয়ে বললেন–বাঃ। তোমার বউ কফি করেছে। তাই না?

হারাধন বলল–আজ্ঞে স্যার! আপনি এসেছেন শুনে সে খুব খুশি। বলছিল, সারের আশীর্বাদ নিয়ে আসব।

বিনোদবাবু ঘরে ঢুকে বললেন–আমার চা নিয়ে আয় হারাধন।

হারাধন চলে যাওয়ার পর তিনি চাপা স্বরে বললেন–বুলিকে পাঠিয়ে এলুম। বুলি বলল, সকালে চৈতালিকে দেখে মনে হয়েছিল, জ্বরটর হয়েছে। ওর বরও নাকি বিছানায় শুয়েছিল। বুলির সন্দেহ, বরের সঙ্গে চৈতালির ঝগড়া হয়েছে। আসল ঘটনা তো বুলি জানে না!

কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। প্রচণ্ড মানসিক শক। সামলানো কঠিন। অতএব ওরা সিনেমা দেখতে যায়নি।

–দেখা যাক। বলে বিনোদবাবু ভিতরের দরজার দিকে ঘুরলেন।

–কে দাঁড়িয়ে রে?

 –চা এনেছি বাবু।

–তা দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এই দেখ, কে এসেছেন।

ঘরে ঢুকল ঘোমটা পরা একটি মেয়ে। কাজের মেয়ে বলে চেনা যায়। সে এসে বিনোদবাবুকে চা দেওয়ার পর কর্নেলের পা ছুঁতে নিচু হাতেই কর্নেল সহাস্যে বললেনঝুমঝুমি! খবরদার! জুতোয় হাত দেবে না। আমার পা কোথায় পাচ্ছ যে ছোঁবে?

বিনোদবাবু বললেন–ঝুমঝুমি প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করে, সেই সাদা দাড়িওয়ালা সায়েব আর আসবেন না? আপনি ওকে সেবার কী জাদুমন্ত্রে বশ করে গেছেন জানি না কর্নেলসায়েব!

ঝুমঝুমি লজ্জা পেয়ে কেটে পড়ল। বুঝলুম, মেয়েটি হারাধনের বউ। কর্নেল আস্তে বললেন–আমি বুঝতে পেরেছিলুম বিনোদবাবু! ঝুমঝুমি তার হারানো ছেলেকে আমার সাহায্যে ফিরে পাওয়ার আশা করেছিল। কিন্তু সে কি সম্ভব? সাত-আট বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ছেলেটি এখন বেঁচে থাকলে সতেরো আঠারো বয়স হবে। ইচ্ছে করলেই সে ফিরে আসতে পারত!

বিনোদবাবু বললেন–ছেড়ে দিন ওসব কথা। অবুঝ মেয়েকে বোঝায় কার সাধ্য? অ্যাকসিডেন্টে ওর ছেলের মৃত্যুর প্রমাণ পেয়েছিলুম। তবু ওকে বিশ্বাস করানো যায়নি।

কিছুক্ষণ পরে এক তরুণী ঘরে ঢুকে কর্নেলকে দেখে একটু হাসল। তারপর পিছন ফিরে পর্দা তুলে তার বয়সি একটি মেয়ের হাত ধরে টানল।কার কাছে। তোমায় নিয়ে এসেছি জানো চৈতালি? সেই কর্নেল সায়েব। ওঁর কত সাংঘাতিক গল্প তোমাকে শুনিয়েছিলুম না?

কর্নেল বললেন–সাংঘাতিক গল্পগুলোর লেখককে আজ নিয়ে এসেছি বুলি! এই সেই সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী।

বুলি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। বিনোদবাবু বললেন–চৈতালি! তোমার বাবা কোথায়?

চৈতালি ভাঙা গলায় বলল–কোথায় গেছে জানি না।

–তুমি ওই চেয়ারে বসো মা! বুলি! তুই এখন যা। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যাবি যেন।

বুলি চলে গেল। ভিতরের দরজা ভেজিয়ে দিতে ভুলল না। চেহারা ও কথা শুনে মনে হচ্ছিল, বিনোদবাবুর অবিবাহিতা মেয়েটি স্মার্ট। বিনোদবাবুর কথায় চৈতালি একটু তফাতে একটা চেয়ারে বসল।

বিনোদবাবু চাপা স্বরে তাকে বললেন–বুলির কাছে তুমি কর্নেল সায়েবের কীর্তিকলাপ শুনেছ। তা হলে তোমার ভয় পাবার কারণ নেই মা চৈতালি। তোমার বাবা বরাবর ওইরকম মানুষ। বিষ খেয়ে বিষ হজম করা ওঁর অভ্যাস, তা তো জানো!

কর্নেল বললেন–পার্ক স্ট্রিটে অজন্তা স্টুডিওর চিত্রার পদবী কী, তুমি জানো?

চৈতালি তেমনই ধরা গলায় বলল–হ্যাঁ। চিত্রা সেনগুপ্ত। আমার সঙ্গে সেন্টপলসে পড়ত। আমার বিয়েতে সে এসেছিল। কিন্তু কাল রাতের ঘটনায় চিত্রার কোনো দোষ নেই। গুণ্ডারা তাকেও বেঁধে রেখেছিল।

–আগে বলো, চিত্রা স্টুডিওতে কাজ করে, তা কবে জানতে পেরেছিলে?

গত মাসে। পার্ক স্ট্রিটে হঠাৎ আমার সঙ্গে দেখা। তখন সে বলল, হঠাৎ সে একজনকে বিয়ে করেছে। তার বর একজন ফটোগ্রাফার। অজন্তা স্টুডিওতে দুজনেই চাকরি করে। স্টুডিওটা সে দেখিয়েছিল। তারপর কথায় কথায় আমি বললুম, তুই আমার আর আমার বরের ছবি তুলে দিবি? চিত্রা বলল, নিশ্চয় দেব। তা তুই তো জুয়েলারের মেয়ে। গয়নাতে গয়নাতে সেজে আসবি। জড়োয়া নেকলেস পরবি। সিঁথিতে টিকুরি ঝোলাবি। আগেকার দিনের স্টাইলে সাজলে খুব ভালো দেখাবে তোকে।

সঙ্গে তখন তোমার বর ছিল?

–সে গাড়িতে ছিল।

ড্রাইভার ছিল গাড়ির?

–না। অশোককে বাবা গাড়ি কিনে দিয়েছিলেন। সে নিজেই ড্রাইভিং শিখে নিয়েছিল।

–তোমার বরের সঙ্গে চিত্রার পরিচয় করিয়ে দিলে না?

–দিলুম। চিত্রার কথা শুনে অশোকও খুশি হল। আমার একটু দ্বিধা ছিল। অত গয়নাগাটি পরে ছবি তুলতে আসা উচিত হবে কি? চিত্রাকে কথাটা বলেছিলুম। সে বলল, তোরা তো গাড়িতে আসবি। স্টুডিওর পাশে গলিতে গাড়ি পার্ক করা যায়। ওখান থেকে স্টুডিওতে উঠলে চোরডাকাতে দেখতে পাবে না।

চৈতালি থেমে গেল হঠাৎ। তার কান্না এসেছিল। কর্নেল বললেন–আমি গয়না উদ্ধারের চেষ্টা করব। বুলি তোমাকে বলেনি তার বাবা–এই বিনোদবাবুর কয়েক লক্ষ টাকার জুয়েল্স উদ্ধার করে দিয়েছিলুম?

চৈতালি চোখ মুছে বলল–বলেছিল। তাই তার সঙ্গে এলুম।

–তাহলে খুলে বলো, তারপর কী হয়েছিল?

চৈতালি এবার যেন একটু উৎসাহ পেল। সে বলল–চিত্রা বলেছিল, স্টুডিওতে খুব ভিড় হয়। নামী স্টুডিও তো। তাই আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে অ্যাডভান্স টাকা জমা দিতে হয়। তুই আমার বন্ধু। তোর অ্যাডভান্স লাগবে না। প্রোপ্রাইটারকে বলে রাখব। এক মিনিট। আমি নোটবই দেখে নিই। কবে তোদের ডেট দিতে পারব। এই বলে ব্যাগ থেকে একটা নোটবই বের করে পাতা উল্টে দেখল। তারপর বলল, ২৯ মার্চ শনিবার আসতে পারিস। একটু ওয়েট করতে হতেও পারে। ওইদিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা অব্দি স্টুডিও বুৰ্ড। তার মানে আধঘণ্টা লাগবে একটা ফ্যামিলির ছবি তুলতে। তারপর ঠিক রাত আটটায় তোদের স্টুডিওতে ডাকব।

-তুমি রাজি হলে?

–আমার দ্বিধা ছিল। কিন্তু অশোক চিত্রাকে দেখে আর তার কথা বলার স্টাইলে কী বলব? আপনারা গুরুজন। মফস্বলের ছেলে তো! স্মার্ট কলকাতার মেয়ে চিত্রা। অশোকের ইমোশনাল হয়ে পড়ার কথা।

বুঝেছি। বলে যাও!

–গতকাল ২৯ মার্চ শনিবার। অশোক দোকানে থাকে। বাবাকে লুকিয়ে আরও একগাদা গয়না এনেছিল। বাবা তখন কারিগরদের ঘরে ছিলেন। বিকেল পাঁচটায় হঠাৎ বৃষ্টি এল। সাড়ে ছটায় ছেড়ে গেল বৃষ্টিটা। সন্ধ্যা সাতটায় আমাকে ইচ্ছেমতো গয়নায় সাজিয়ে অশোক ব্যাকডোর দিয়ে বেরিয়ে গ্যারাজ থেকে গাড়ি বের করল। আমি তার পিছনে ছিলুম। গাড়িতে ঢুকে কাঁচ তুলে দিলুম। আমি কিন্তু ব্যাকসিটে বসেছিলুম। তখন বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেছে।

–তোমার মা নেই?

–আছে। মা তখন রান্নাঘরে কাজের মেয়েকে বকাবকি করছিল। মায়ের ওই এক অভ্যাস!

তোমার বাবা?

–বাবা তখন ক্লাবে আড্ডা দিতে গিয়েছিলেন।

–তারপর কী হল বলো?

–পার্ক স্ট্রিটে একটা মদের আড্ডার পাশের গলিতে অশোক গাড়ি ঢোকাল। দেখলুম, চিত্রা আর একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে।

–লোকটার বয়স বা চেহারা কেমন বলতে পারো?

–অশোকের বয়সি। ইয়াং ম্যান বলা চলে। ভদ্রলোকের ছেলে বলে মনে হল। পরনে স্পোর্টিং গেঞ্জি আর জিন্‌সের প্যান্ট ছিল। চিত্রা আমাদের নিয়ে গেল তিনতলার একটা ঘরে। সে-ঘরে সোফাসেট আর সুন্দর ফার্নিচার আছে। বড় বড় ফুলদানিতে ফুল। আর দেওয়ালে দেওয়ালে রঙিন বড় বড় ফটো। মেয়েদের ফটোগুলো অশ্লীল ভঙ্গিতে তোলা। অশোক হাঁদার মতো তাকিয়ে দেখছিল। চিত্রা একটু পরে আমাদের জন্য দুটো কোল্ড ড্রিঙ্ক দিয়ে গেল। ওর সঙ্গে যাকে দেখেছিলুম, সে একবার এসে অশোককে দামি একটা সিগারেট দিল। তারপর লাইটার জ্বেলে সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে বলল–আর কিছুক্ষণ বসতে হবে। তারপর চিত্রা এসে ডেকে নিয়ে যাবে। উপরতলায় স্টুডিও।

–হুঁ! বলে যাও!

–অশোক সিগারেটটার অর্ধেক শেষ করেছে, হঠাৎ একটা আমার বয়সি মেয়ে খুব সুন্দর দেখতে সে ঘরে ঢুকে চাপাস্বরে বলে উঠল, আপনারা এক্ষুনি পালিয়ে যান। নয়তো বিপদে পড়বেন। তাই শুনে অশোক আর আমি দাঁড়িয়েছি, অমনিই আলো নিভে গেল। তারপর কারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে টর্চের আলোয় চকচকে ছোরা দেখাল। দুজন আমার গয়না খুলে নিচ্ছিল। ব্যথা পেয়ে বললুম, আমি খুলে দিচ্ছি। আমাদের মেরে ফেলবেন না। টর্চের আলোয় দেখলুম, অশোকের মুখে টেপ সেঁটে তার হাত-পা বেঁধে মেঝেয় ফেলে রেখেছে। ওদিকে আর এক সাংঘাতিক ঘটনা। টর্চের ছটায় দেখেই ভয়ে চোখ বন্ধ করেছিলুম।

কী ঘটনা?

যে মেয়েটি আমাদের পালাতে বলেছিল, তার বুকে বসে একজন তার গলা টিপে ধরেছে। হ্যাঁ, সেই মেয়েটি চেঁচিয়ে উঠেছিল। হা–মনে পড়ল। সে বলছিল, এ কী করছ তোমরা? তারপর ওই বীভৎস দৃশ্য। কতক্ষণ পরে একটামাত্র আলো জ্বলে উঠল ঘরে। আমি মেঝেয় পড়ে গিয়েছিলুম। উঠে গিয়ে অশোকের বাঁধন খুলে দিলুম।

সেই মেয়েটিকে দেখতে পেলে না?

–না। ঘরে তখন কেউ ছিল না। তারপর দুজনে ঘর থেকে বেরিয়ে টলতে টলতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গাড়ির কাছে গেলুম। সেই সময় কালো মুখোশপরা একজন গুণ্ডা ছোরা বের করে শাসাল–এই কথা যদি তোমরা কাউকে বলল, তোমাদের প্রাণ যাবে। বোমা মেরে তোমার বাবার দোকান উড়িয়ে দেব। কারও সাধ্য নেই আমাদের বাধা দেয়। তার পিছন থেকে চিত্রার গলা শুনতে পেলুম চৈতালি! আমাকে এরা বেঁধে রেখেছে রে! তোরা পুলিশ বা কাউকেও জানালে আমাকে এরা মেরে ফেলবে। ঠাকুরের দিব্যি চৈতালি! আমার প্রাণ তোর হাতে। সে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।

— তুমি চিত্রা সেনগুপ্তের বাড়ির ঠিকানাটা আমাকে এই নোটবুকে লিখে দাও।

চৈতালি আবার চোখ মুছে কর্নেলের ছোট্ট নোটবই আর কলম নিল। ঠিকানাটা লিখতে থাকল।

বিনোদবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে কর্নেল আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, বিডন স্ট্রিট যেতে হবে। বিডন স্ট্রিটে পৌঁছে আবার এক গলিতে ঢুকে তিনি গাড়ি দাঁড় করাতে বললেন। তারপর আমাকে গাড়িতে অপেক্ষা করতে বলে তিনি এক ফ্ল্যাটবাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। বাড়িটা নতুন। একটু পরে কর্নেল অদৃশ্য হলেন। ঘড়ি দেখলুম, প্রায় চারটে বাজে। ঘিঞ্জি গলিতে গাড়ি রাখার সমস্যা আছে। রিকশাওয়ালাদের ধমক খেতে হয়। পথচারীরাও গাড়ি অন্য কোথাও রাখার জন্য চ্যাঁচামেচি করেন।

নির্বিকার মুখে তাদের সবাইকে বারবার বলছিলুম–দেখছেন না প্রেসের গাড়ি? প্রেস বোঝেন? খবরের কাগজ! পুলিশের গাড়ির মতোই জরুরি কাজ আমাদের আছে।

এই ঝামেলার মধ্যে কর্নেল এসে গেলেন। তারপর গাড়ি ব্যাক করে বিডন স্ট্রিটে পৌঁছে বললুম, কোথায় গিয়েছিলেন? আর একটু দেরি হলে লোকেরা হয়তো গাড়ির কাঁচ ভেঙে ফেলত।

কর্নেল বললেন–এবার সোজা বাড়ির পথে।

তাকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলুম, বাড়ির পথেই শর্টকাটে না হয় যাচ্ছি। কিন্তু আপনি একটা নতুন ফ্ল্যাট বাড়িতে কারও কাছে কি বকুনি খেয়ে এলেন?

কর্নেল এতক্ষণে চুরুট ধরালেন। তারপর একটু হেসে বললেন–এক ডেঞ্জারাস মহিলার পাল্লায় পড়েছিলুম। জেরার চোটে জেরবার করে ছেড়েছেন। তবে আমি খালি হাতে ফিরিনি।

–কে সেই মহিলা?

–চিত্রা সেনগুপ্তের মামি। চিত্রার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলুম। তারপর ঝড় বয়ে যাচ্ছিল যেন। তবে যেটুকু বুঝলুম, চিত্রার বাবা-মা নেই। মামা-মামির কাছে মানুষ হয়েছে। কৌশলে জেনে নিয়েছি, চিত্রার মামা-মামি থাকতেন সিঁথির ওদিকে। চিত্রা চাকরি পেয়ে, ওই নতুন ফ্ল্যাটটা কিনে তাদের সেখানে এনেছে। ওর মামা নানা অসুখে শয্যাশায়ী। চাচামেচি শুনে অনেক কষ্টে ভদ্রলোক ভিতরের দরজার পর্দা তুলে স্ত্রীকে শান্ত করলেন। জয়ন্ত! ভাগ্যিস এই সায়েবি চেহারা আমার আছে। আর মুখের দাড়ি ছাড়াও মাথার টুপিতেও কী মহিমা আছে। শেষ অব্দি ওর মামার মুখে কিছু খবর পাওয়া গেল। চিত্রা নাকি এক বড় অফিসে চাকরি করে। সেই অফিসের কাজে দিল্লি-মুম্বাই যেতে হয় তাকে। গত বুধবার চিত্রা অফিস থেকে ফোনে জানিয়েছিল, সে অফিসের কাজে বাইরে যাচ্ছে। এক সপ্তাহ পরে বাড়ি ফিরবে।

–আপনি কেন চিত্রার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তা বলেননি?

কর্নেল মুচকি হেসে বললেন–হ্যাঁ। ওর মামির প্রথম প্রশ্ন তো সেই ছিল। আমি বলেছিলুম চিত্রা তার এক জরুরি কাজে তাকে সাহায্য করার জন্য ডেকেছিল। এই কৈফিয়ত দিয়েই বিপদে পড়েছিলুম। চিত্রার জরুরি কাজ থাকলে বাইরের লোককে ডাকবে কেন? তার হবু বর সুমন আছে। সুমনের সঙ্গে কত বড়-বড় লোকের ভাব। সুযোগ পেয়ে সুমনবাবু কোথায় থাকেন জানতে চাইলুম। চিত্রার মামি তখনই জেরা শুরু করলেন। ওর মামা এক ফাঁকে জানিয়ে দিলেন, সুমন থাকে বেলেঘাটায়। সে-ও চিত্রার অফিসে চাকরি করে।

বলে কর্নেল চুপচাপ চুরুট টানতে থাকলেন। পৌনে পাঁচটায় কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্ট পৌঁছলুম। ষষ্ঠী দরজা খুলে দিয়ে বললনালবাজারের নাহিড়িসায়েব ফোন করেছিলেন। বাবামশাই ফিরলে যেন ওনাকে ফোন করেন।

কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন–নালবাজারের নাহিড়িসায়েবকে তুই কী বলেছিস?

ষষ্ঠী জিভ কেটে বলল–মুখ দিয়ে ওইরকম বেইরে যায়। আমি বললুম, বাবামশাই কোথায় গেছেন বলে যাননি। ফিরে এলে ফোন করতে বলব সার।

কর্নেল হাসি চেপে ধমকের ভঙ্গিতে বললেন কফি। গলা শুইকে গেছে। বুইলি?

ষষ্ঠী হাসতে হাসতে চলে গেল। কর্নেল তার ইজিচেয়ারে বসে ডি-সি ডি-ডি ওয়ান অরিজিৎ লাহিড়ির কোয়ার্টারে রিং করলেন।কে? বউমার কণ্ঠস্বর শুনছি। …হ্যাঁ। গোয়েন্দা প্রধানের সহধর্মিণী। তুমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের কণ্ঠস্বর শুনে চিনে ফেলবে বইকী! তা তোমার সহধমটি কোথায়? …..ঠিক আছে। ওর মোবাইল নাম্বার আমার জানা। তুমি সপুত্র ঠিকঠাক আছ তো? ….এ বৃদ্ধের আশীর্বাদে আর কাজ হবে না। তবু আশীর্বাদ রইল।

বলে তিনি নোটবই খুলে মোবাইল নাম্বারে ডায়াল করলেন। একটু পরে বললেন–অরিজিৎ! তুমি এখন কোথায়? …কী আশ্চর্য! ওখানে কি কারও ডেডবডি পেয়েছ আবার? ….তাই বলো! তো তুমি রিং করেছিলে। ষষ্ঠী বলল। …হ্যাঁ। ওর নালবাজারের নাহিড়িসায়েব বহাল আছে। যাই হোক, বলো!

এরপর কর্নেল ক্রমাগত হু আর হ্যাঁ বলতে থাকলেন। দীর্ঘ প্রায় পাঁচ মিনিট পরে কর্নেল রিসিভার রেখে এতক্ষণে টুপি খুলে হ্যাঁঙার লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিলেন। অব্যর্থ লক্ষ্য। ষষ্ঠী কফি এনে দুটো ফ্যানেরই সুইচ টিপে দিয়ে আলো জ্বালল। কফির পেয়ালা তুলে চুমুক দিয়ে বললুম–লাহিড়িসায়েবের খবরটা জানতে ইচ্ছে। করছে কর্নেল।

কর্নেল বললেন–চন্দ্রকণার ফাইনাল রিপোর্ট মর্গ থেকে এসেছে। শি ওয়াজ নট রেল্ড। ওটা ডাক্তার প্রথমে অনুমান করেছিলেন শুধু। তবে তার গলা টিপে শ্বাসরোধ করে তাকে মারা হয়েছে। তার পিঠের দিকে প্রচুর লাল রঙের ফাইবার শাড়িতে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। ফোরেন্সিক এক্সপার্টরা এখন বলেছেন, কোনো ঘরে লাল কার্পেটের উপর তাকে ফেলে শ্বাসরোধ করে মেরেছিল খুনি।

চমকে উঠে বললুম–চৈতালি ঘটনাটা দেখেছিল।

–হ্যাঁ। চন্দ্রকণা চৈতালিদের পালিয়ে যেতে বলেছিল। এদিকে ফোরেন্সিক এক্সপার্টরা চন্দ্রকণার ম্যানিকিওর করা বাঁ হাতের নখের ডগায় মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে নীলরঙের সিন্থেটিক ফাইবার পেয়েছেন। আততায়ীর জামা সে জোরে খামচে ধরে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছিল।

–কিন্তু টিটো কেন বাধা দেয়নি?

–চৈতালি টিটোকে চেনে না।

–টিটোর গায়ে আমি ছাইরঙা টি-শার্ট দেখেছিলুম। তো, এটুকু জানাতেই লাহিড়িসায়েব আপনাকে ফোন করেছিলেন বলে মনে হচ্ছে না। পাঁচ মিনিট ধরে কী সব কথা হল, তা বলতে আপত্তি আছে?

কর্নেল কয়েক চুমুক কফি পানের পর বললেন–অজন্তা মডেলিং স্কুলের প্রোপ্রাইটার মিসেস বৈজয়ন্তী অগ্রবাল বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ পার্ক স্ট্রিটে তার স্টুডিওতে ঢুকেছিলেন। সাদা পোশাকের পুলিশ ওত পেতে ছিল। তাকে পাকড়াও করে লালবাজারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গোয়েন্দা-কর্তারা তাকে জেরা করছেন। তার কাছে এ পর্যন্ত জানা গেছে; শনিবার তাঁর মডেলিং ক্লাসে দুজন টিচার ছিল। সুমন দাশগুপ্ত পুরুষদের মডেলিং শেখায়। আর চিত্রা সেনগুপ্ত শেখায় মেয়েদের। মিসেস অগ্রবালের শরীর ভালো ছিল না বলে তিনি নাকি বিকেল তিনটেতে বাড়ি চলে যান। পুলিশ তার বাড়ি সার্চ করে সন্দেহজনক কিছু পায়নি। মিসেস অগ্রবাল বিধবা মহিলা। একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন দিল্লিতে। জামাই ব্যবসায়ী। তারা সেখানেই আছে। আর তার দুই ছেলের মধ্যে একজন থাকে আমেরিকায় হিউস্টনে। সে ইঞ্জিনিয়ার। ছোট ছেলে থাকে মুম্বাইতে। মিসেস অগ্রবাল একজন প্রাক্তন ফিল্মস্টার। তার স্বামী রাজেন্দ্র অগ্রবাল ছিলেন ফিল্ম প্রোডিউসার। স্বামী নিঃস্ব হয়ে মারা যান। মিসেস অগ্রবাল প্রথমে স্টুডিও করেন। পরে মডেলিং স্কুলের আইডিয়া তাঁর মাথায় আসে। সুমন ও চিত্রার সঙ্গে তাঁর স্বামীর সূত্রে চেনাজানা ছিল। হ্যাঁ, এসব কাজের জন্য তাঁর দুই ছেলে টাকা জুগিয়েছিল। জামাইয়ের কাছেও টাকা পেয়েছিলেন।

টিটো আর চন্দ্রকণা সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি?

–এখনও সে-প্রশ্নে গোয়েন্দাকর্তারা এগোননি। তুমি নিশ্চয় জানো, এইসব জেরা কিছুক্ষণ অন্তর চলে। সারা রাত ধরেও চলতে পারে। আসামি শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়ে এবং সব কথা উগরে দেয়।

লাহিড়িসায়েব কি জেরার ঘরে ছিলেন?

–না। তিনি এখন হোটেল কন্টিনেন্টালে ১০০৩ নম্বর স্যুইটে ফোরেন্সিক এক্সপার্টদের সঙ্গে আছেন। লালবাজার তার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে।

হাসতে হাসতে বললুম–ওখানে সেই মার্ডারউইপন ছাড়া আর কী পাওয়ার আশা করছেন ওঁরা? আসল ক্লু তো আপনি বাগিয়ে নিয়েছেন।

কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন–এখনও জানি না ওটা সত্যি কু কি না।

এই সময় টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন।– বলছি। আপনি কে বলছেন? ….বলুন।… আমার কাছে আসতে চান? বেশ তো! আসুন! কিন্তু আমার কাছে আপনাকে কে আসতে বলেছেন? …হ্যাঁ। ওঁকে চিনতুম। কিন্তু উনি ফোন করলেন না কেন? …হ্যাঁ। কিছুক্ষণ আগে আমি একজনের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে ফোনে কথা বলছিলুম।….হ্যাঁ। মিঃ ঘোষের কাছে আমার নেমকার্ড থাকার কথা। যাই হোক, দেরি না করে শিগগির চলে আসুন। আমি অপেক্ষা করব।

জিজ্ঞেস করলুম–কার ফোন?

–এলেই জানতে পারবে।

 –ওঃ বস্! আপনি মাঝেমাঝে ভীষণ সিরিয়াস হয়ে ওঠেন।

 কর্নেল একটু হেসে বললেন–নাঃ! আমি ভাবছি, টেলিফোনে যিনি কান্নাকাটি করেন–হ্যাঁ, করার কারণও আছে, তবে তিনি আমার কাছে এসে ওই রকম কান্নাকাটি করলে বিব্রত বোধ করব। এই ভেবে আমি উদ্বিগ্ন।

একটু ভেবে নিয়ে বললুমকান্নাকাটি? তার মানে–চন্দ্রকণার বাবা নন তো?

–বাঃ! মাঝেমাঝে তুমি আশ্চর্য বুদ্ধিমান হয়ে ওঠো ডার্লিং!

–আপনার মতে, সবই আমি বুঝি। তবে দেরিতে বুঝি এই যা! আচ্ছা কর্নেল, মিসেস অগ্রবালকে দেখলেই হালদারমশাই চিনতে পারবেন। নরেশবাবু তা জানেন। অথচ তিনি হালদারমশাইয়ের খোঁজ করছেন না। হালদারমশাই ভদ্রমহিলাকে দেখলেই বলে দিতেন, উনি হোটেল কন্টিনেন্টালে ছিলেন। সাদা মারুতিতে চেপে হোটেল থেকে ওঁকে হালদার মশাই বেরোতে দেখে ছিলেন।

কর্নেল বললেন–নরেশবাবু এখন হালদারমশাইকে খুঁজে পাবে না।

হেসে ফেললুম–ভবানীপুরে মিসেস রায়ের বাড়ির কাছাকাছি কোথাও এখন তিনি সন্ন্যাসী সেজে বসে আছেন।

ষষ্ঠী এসে বলল–বাবামশাই! ছাদের বাগানে আজ জল লাগবে না। কাল সন্ধ্যার বৃষ্টিতেই সব চাঙ্গা হয়ে গেছে।

কর্নেল বললেন–ক্যাকটাসগুলো আজ রোদ্দুরে বের করেছিলি তো?

–হ্যাঁ। বৃষ্টিবাদলা আর হবে না। আকাশে মেঘ নেই। তাই ফাঁকা জায়গায় থাকুক ওগুলো।

–বাঃ! এতদিনে মালী হওয়ার পথে এক এগিয়েছি। হ্যাঁ রে, সেই অর্কিডটা ঝিমিয়ে পড়েনি তো? বুঝেছিস কোন্টার কথা বলছি?

-হ্যাঁ বাবামশাই! গত সপ্তায় যেটা এক বাবুমশাই দিয়ে গেলেন, সেইটে তো? : ওটা বেশ চাঙ্গা হয়েছে আজ্ঞে।

তা হলে এবার তুই টিভি দেখে চাঙ্গা হবি তো কেটে পড়!

ষষ্ঠীচরণ হাসিমুখে ভিতরে গিয়ে ঢুকল। একটু পরে কর্নেল বললেন–জয়ন্ত। ষষ্ঠীটার প্রশংসা করা ঠিক হল না। আলোগুলো জ্বেলে দিয়ে গেল না দেখছ?

আমি উঠে গিয়ে আলো জ্বেলে দিলুম। ঘরে সন্ধ্যার ছায়া ঘন হয়ে উঠেছিল। জানালায় পর্দা থাকায় বাইরের আলো দেখা যাচ্ছিল না।

কিছুক্ষণ পরে ডোরবেল বাজল। কর্নেল যথারীতি হাঁক দিলেন–ষষ্ঠী।

একটু পরে একজন শীর্ণকায় ধুতি পাঞ্জাবিপরা ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। তার চেহারায় বিষাদের গাঢ় ছাপ। কপাল, নাক ও চোখের ছাঁদে আবছা চন্দ্রকণার মুখের আদল লক্ষ করলুম। আমার চোখের ভুল হতেও পারে। তিনি করজোড়ে নমস্কার করে আস্তে সোফায় বসলেন। তারপর ভাঙা গলায় বললেন–আমি শচীন্দ্রনাথ মজুমদার। আমার মেয়ে

কর্নেল তাকে থামিয়ে বললেন–বুঝেছি। রমেনবাবু পুলিস ইন্সপেক্টর ছিলেন। তিনি আপনার কেমন দাদা হন?

–স্যার। উনি আমার পিসতুতো দাদা। রমেনদাই বললেন, কর্নেল সায়েবকে গিয়ে ধরো। পুলিশের কাজ রুটিন মাফিক চলবে। গড়িমসি হবে। তা ছাড়া আজ বিকেলে চন্দ্রকণার বিছানার তলায় একখানা চিঠি পেয়ে রমেনদার কাছে গিয়েছিলুম। মাথামুন্ডু কিছু বোঝা যায় না। উনি চিঠিটা আপনাকে দেখাতে পরামর্শ দিলেন। তারপর আপনাকে ফোন করেছিলুম।

কর্নেল হাত বাড়িয়ে বললেন–কই, চিঠিটা দিন।

শচীনবাবু পাঞ্জাবির বুকপকেট থেকে একটা খাম বের করে তাঁকে দিলেন। লক্ষ করলুম, খামটা ডাকে পাঠানো হয়েছিল। মুখটা যেন তাড়াহুড়ো করে ছিঁড়েছিল চন্দ্রকণা। কর্নেল তার অভ্যাসমতো টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে ড্রয়ার থেকে আতসকাঁচ বের করলেন। তারপর চিঠিটা বের করে ভাজ খুলে টেবিলে রাখলেন। আতসকাঁচের সাহায্যে তিনি চিঠিটা পড়ার পর বললেন–হ্যাঁ। চিঠিটা বুঝতে পারা যাচ্ছে না। এটা আমার কাছে থাক। আশা করি শিগগির বুঝতে পারব।

ষষ্ঠীকে কিছু বলতে হয় না। কর্নেলের ঘরে কেউ এলে সে তার জন্য কফি দিয়ে যান। শচীনবাবু একটু ইতস্তত করে বললেন, কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। কর্নেলসায়েব! বুঝতে পারছি না, কার কী ক্ষতি করেছিলুম যে আমার মেয়েকে খুন করে আমাকে পথে বসিয়ে দিল।

কর্নেল বললেন–যা ঘটবার, তা ঘটে গেছে। এখন খুনিকে ধরাটাই আসল কাজ। সেই কাজে আপনারও সাহায্য চাই। আপনি কফি খান শচীনবাবু। কফি খেলে নার্ভ চাঙ্গা হয়।

শচীনবাবু অগত্যা কফির পেয়ালা তুলে চুমুক দিতে থাকলেন। আমি নিজের পরিচয় দেব ভাবছিলুম, কারণ চন্দ্রকণা আমাদের পত্রিকার অফিসে চাকরি করত এবং তাকে আমিই কাল সন্ধ্যায় বৃষ্টির সময় যেন যমের দোরে পৌঁছে দিয়েছিলুম। কিন্তু কর্নেল আমার দিকে চোখ কটমটিয়ে একবার তাকাতেই বুঝলুম, আমাকে চুপ করে থাকতে হবে।

শচীনবাবু কফি খেতে খেতে বললেন–ইদানীং চন্দ্রকণা কেন যেন মনমরা হয়ে থাকত। কথাবার্তা বলত খুব। ওর মা জিজ্ঞেস করত, শরীর খারাপ নাকি? চন্দ্রকণা বলত, শরীর খারাপ কেন হবে?

কর্নেল বললেন–কোথায় আপনার মেয়ে চাকরি করত আপনারা নিশ্চয় জানতেন?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন সেকশনে চাকরি পেয়েছিল। মাইনেকড়ি ভালোই পেত।

এ ছাড়া সে আর কিছু করত কি না জানেন?

–থিয়েটারে অভিনয় করত।

–আর কিছু?

–ও হ্যাঁ। ফিল্মে অ্যাকটিং শিখতে যেত। অফিস থেকে বেরিয়ে যেত পার্ক স্ট্রিটে অজন্তা স্টুডিওতে। ওরা ফিল্মে অ্যাকটিং শেখায়। তারপর তারা ফিল্মে নামবার চান্স করে দেয়। সেখান থেকে রাত নটার মধ্যে বাড়ি ফিরত।

–প্রয়াত এম পি শুভব্রত রায়ের ছেলে টিটোর সঙ্গে আপনার মেয়ের মেলামেশা ছিল, তা নিশ্চয় আপনি জানেন?

শচীনবাবু একটু চমকে উঠেছিলেন যেন। বললেন–আপনি কী করে একথা জানলেন স্যার?

–প্লিজ, আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিন।

-হ্যাঁ। মেলামেশা ছিল। তবে টিটোর মা নাকি বলত, আমার মেয়ের সঙ্গে তার ছেলের বিয়ে কখনো দেবে না। আমরাও তা-ই বলতুম। পাড়ার ক্লাবে থিয়েটার করত। নানারকম ফাংশন করত। চন্দ্রকণা গান গাইত। ছোটবেলা থেকে নিজে-নিজে নাচও শিখেছিল। তো মেলামেশার কথা বলছেন। আজকালকার মেয়ে স্যার। বাংলা অনার্স নিয়ে বি এ পাশ করেছিল। আর পড়াতে পারলুম না। ওরও পড়ার চেষ্টা ছিল না। ফিল্মের লাইনে যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল।

টিটো কেমন ছেলে বলে আপনি মনে করেন?

-বড়লোকের একমাত্র ছেলে। বখাটে। বজ্জাত। পাড়ার গুন্ডাগুলোর সঙ্গেও ওর খুব ভাব। খুলেই বলছি স্যার, বাবা পলিটিক্যাল লিডার ছিলেন। তার পোষা গুন্ডামস্তানদের দল এখনও আছে। টিটোকে তারা খুব মানে। তবে ছেলেটার একটা গুণ অস্বীকার করব না। কারও আপদে-বিপদে মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়াত।

কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন–আপনি কি জানেন টিটোও পার্ক স্ট্রিটে অজন্তা স্টুডিওতে যেত–মানে, আপনার মেয়ের মতো ফিল্মের অ্যাকটিং শিখতে?

শচীনবাবু অবাক হয়ে বললেন–তা তো জানি না।

এবার একটা কথা জিজ্ঞেস করছি। আপনার মেয়েটিকে টিটো খুন করেছে বলে কি আপনি মনে করেন?

শচীনবাবু কর্নেলের দিকে কেমন চোখে তাকিয়ে থাকার পর মাথা নাড়লেন।

–আজ্ঞে না। আমার মেয়ের সঙ্গে টিটোর ভাব-ভালোবাসা ছিল। সে আমার মেয়েকে কেন খুন করবে?

তা হলে আপনার মেয়েকে কে খুন করেছে বলে আপনি মনে করেন?

জানি না স্যার! প্রথমে পুলিশ বলেছিল চন্দ্রকণাকে লম্পট বজ্জাতরা তুলে নিয়ে গিয়ে–মানে আজকাল যা প্রায়ই ঘটছে–

রেপ?

–আজ্ঞে। কিন্তু বিকেলে লালবাজারে চিঠি লিখে রমেনদা এক অফিসারের কাছে পাঠিয়েছিল। হ্যাঁ–নিয়োগীসায়েব। তিনি বললেন, ডাক্তারি রিপোর্টে সে রকম কিছু বলা হয়নি। আমার মেয়েকে কেউ গলা টিপে মেরে ফেলেছে। এই শুনে অবাক লেগেছে স্যার! নিয়োগীসায়েব বললেন, আমার মেয়ে নিশ্চয় কারও গোপন কোনো সাংঘাতিক ব্যাপার জানত বা প্রমাণ তার হাতে ছিল। তাই তাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে চিরকালের মতো চুপ করিয়ে দিয়েছে।

বুঝলুম, চন্দ্রকণার পিঠে লাল কার্পেটের ফাইবার পাওয়ার খবর গোয়েন্দা বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার নিয়োগীসায়েব জানেন না। জানলে বলতেন, স্টুডিওতেই চন্দ্রকণাকে খুন করা হয়েছে।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন–ঠিক আছে শচীনবাবু! আশা করছি, শিগগির আপনার মেয়ের খুনিকে ধরিয়ে দিতে পারব। এই চিঠিটা এনে আপনি আমাকে এগিয়ে দিয়েছেন। আচ্ছা! রমেনবাবুকে বলবেন, আমাকে উনি সম্ভব হলে যেন ফোন করে। নমস্কার!

শচীনবাবু অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। নমস্কার করে তিনি বেরিয়ে গেলেন।

বললুম–চিঠিটা পড়ে সত্যি কিছু বুঝতে পারলেন না?

 কর্নেল একটু হেসে বললেন, শুনলে তো! চিঠিটা আমাকে এগিয়ে দিয়েছে।

–চিঠিটা আমাকে দেখাবেন বস?

–দেখাচ্ছি। কিন্তু তোমার ভালো লাগা মেয়ে চন্দ্রকণা একই অফিসে কাজ করত এবং তাকে তুমি পার্ক স্ট্রিটে কাল বৃষ্টির মধ্যে পৌঁছে দিয়েছিলে, এইসব বলার জন্য উসখুস করছিলে। তোমার বোঝা উচিত ছিল, মানুষ অনেক সময় নিজেই জানে না সে কী করছে। শচীনবাবুর যা মানসিক অবস্থা, তাতে তিনি হঠাৎ ভায়োলেন্ট হয়ে তোমার গলা টিপে ধরতেন না, এর কোনো গ্যারান্টি নেই।

বলে কর্নেল আমাকে খামে ভরা চিঠিটা দিলেন। সবে চিঠি খুলেছি, ডোরবেল বাজল। কর্নেল হাঁকলেন–ষষ্ঠী।

আমি চিঠিটা খামে ঢুকিয়ে বুক পকেটে লুকিয়ে ফেললুম। একটু পরে গোয়েন্দা সাব-ইন্সপেক্টর নরেশ ধর ঢুকে ধপাস করে সোফায় বসে বললেন–বাক্স। বুদ্ধিসুদ্ধি একেবারে গুলিয়ে গেছে। বলছি। আগে কফি খাব। ও হে ষষ্ঠীচরণ! কফির কথা বলেই ঢুকেছি। দেরি নয়। গলা শুকনো কাঠ।

কর্নেল হাসলেন। –জেরা করতে করতে নিজেই জেরবার।

–হ্যাঁ। ডেঞ্জারাস মহিলা কর্নেলসায়েব। বলছি। আগে কফি খাই।…..

.

কফি পানের পর নরেশবাবু বললেন–আগে আপনার কাছে ছুটে আসার কারণ বলি। ডি সি ডি ডি-ওয়ান লাহিড়িসায়েব টেলিফোনে আমাকে কিছুক্ষণ আগে বলেছেন, আপনার সঙ্গে শিগগির দেখা করে যেন জেনে নিই, পঞ্চগড়ে জুয়েলার রাজকুমার সিংহের সঙ্গে আজ হোটেল কন্টিনেন্টালে ঠিক কী কারণে আপনি দেখা করতে গিয়েছিলেন?

কর্নেল বললেন– কী আশ্চর্য। হোটেলের ১০০৩ নম্বর স্যুইটে অকুস্থলে থাকার সময় আমি তো সব কথা আপনাদের জানিয়েছি।

নরেশবাবু হাসলেন–আপনি শুধু মিসেস স্বাগতা রায়ের ছেলের খোঁজে গিয়েছিলেন, একথা লাহিড়িসায়েব সম্ভবত বিশ্বাস করেননি। হ্যাঁ– হালদারমশাইয়ের কথাও লাহিড়িসায়েব জানেন। মিসেস রায় তাকে সব কথা খুলে বলেছেন তবু লাহিড়িসায়েবের মনে খটকা বেধেছে। তারপর আমার মনেও সেই খটকা ঢুকে পড়েছে।

কর্নেল হাসলেন।–মোটেও কিছু লুকোইনি নরেশবাবু। টিটোকে হালদারমশাই ছাড়া মিসেস রায়ের জানাশোনা এক ভদ্রলোক ওই হোটেলে দেখেছিলেন। মিসেস রায় আমার কাছে আসবার পর আমি ব্যাপারটার সত্যিমিথ্যা যাচাই করতে গিয়েছিলুম মাত্র। কিন্তু স্যুইটে ফোন করে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না দেখে আমার সন্দেহ হয়েছিল।

লাহিড়িসায়েবের ধারণা, আপনি রাজকুমার সিংহের সঙ্গে পরিচিত। পঞ্চগড়ের ওদিকে পাহাড়-জঙ্গল আছে। বিরল প্রজাতির পাখি প্রজাপতি বা অর্কিডের খোঁজে আপনি সেখানে গিয়েও থাকতে পারেন। তাই আপনি রাজকুমার সিংহের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন।

ধরা যাক, তা-ই ঠিক। তারপর তাকে না পেয়ে তার ডেডবডি আবিষ্কার করেছিলুম।

নরেশবাবু মিটিমিটি হেসে বললেন–এবার মোক্ষম কথা বলি?

–বলুন।

–হোটেলের যে-লোকটা ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে গিয়েছিল, ১০০৩ নম্বর স্যুইট খোলার পর সে ভিতরে ঢুকেছিল। আপনি কিছুক্ষণ পরে লেডিজ বেডরুমে ঢুকেছিলেন। তখন সে পার্টিশনের ফাঁক দিয়ে দেখেছে, আপনি হেঁট হয়ে কী কুড়িয়ে নিয়ে পকেটে ঢুকিয়েছিলেন।

–হ্যাঁ। ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে সন্দেহযোগ্য কিছু আছে ভেবে একটু ঝুঁকে দেখছিলুম। একটা দলাপাকানো ক্যাশমেমো কুড়িয়ে দেখার পর সেটা ফেলে দিয়েছিলুম। পকেটে ঢোকাইনি। লোকটা ভুল দেখেছিল।

আমি বললুম–আবার হোটেলে গিয়েও আপনাদের জেরা চলছে নাকি?

নরেশবাবু বললেন কলকাতা জুড়ে তোলপাড় চলছে। হোটেল কন্টিনেন্টালের মালিকদের ক্ষমতার প্রভাব কতখানি, তা নিশ্চয় বোঝেন। আপনি সাংবাদিক। আপনার চেয়ে আর কে বেশি বুঝবে জয়ন্তবাবু?

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুটটা লাইটার জ্বেলে ধরালেন। তারপর বললেন নরেশবাবু। মিসেস অগ্রবালকে জেরা করে শেষ পর্যন্ত রাজকুমার সিংহকে খুনের মোটিভ জানতেও পারেন। কিন্তু মূল পয়েন্টটা হল, খুনিকে পাকড়াও করা।

নরেশবাবু হতাশার ভঙ্গিতে বললেন–সে কি এখনও কলকাতা শহরে আছে। বলে মনে করেন?

–আপনারা নিশ্চয় হাওড়া-শেয়ালদা রেলস্টেশনে লোক রেখেছেন?

রাখলে কী হবে? তাকে তো এখনও আমরা চিনি না। তার ছবিও দেখিনি।

–মিসেস অগ্রবালকে এখনই তাঁর মডেলিং স্কুলে নিয়ে আসুন।

–তারপর?

–আমি এই হত্যারহস্যের পিছনে একটা প্ল্যান খুঁজে পেয়েছি। সেই প্ল্যানের কথা যথাসময়ে জানাব। আপনারা মিসেস অগ্রবালকে পার্ক স্ট্রিটে তাঁর মডেলিং স্কুলে এনে টিচারদের নামঠিকানা জানবার জন্য চাপ দিন। স্টুডিওতে তাদের ছবিও পেয়ে যাবেন। না পাওয়ার কারণ নেই। কারণ টিচাররা নিজেরাই মডেল। কী মনে হয় নরেশবাবু? নিজে মডেল না হতে পারলে কেউ অপরকে কী শেখাবে?

নরেশবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–ঠিক। একেবারে খাঁটি কথা বলেছেন কর্নেলসায়েব। কিন্তু আপনি কি মনে করেন, কোনো মডেলই খুনি?

–অরিজিৎ আমাকে জানিয়েছে, চন্দ্রকণার পিঠের দিকে লাল রঙের ফাইবার দেখা গেছে। ওটা লাল কার্পেটের ফাইবার। অজন্তা-তে গিয়ে বাড়িটার তিনতলায় লাল কার্পেট বিছানো ঘর আছে কি না দেখুন। ব্যস্! অরিজিতের খাতিরে দুটো ভাইটাল সূত্র দিলুম। কারণ আমি চাই আজ রাতেই খুনি ধরা পড়ুক।

নরেশবাবু দরজার কাছে ঘুরে দাঁড়ালেন। মুখে সেই মিটিমিটি হাসি। বললেন–তার মানে খুনি একজনই।

–হ্যাঁ। বলে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন।

 নরেশবাবু বেরিয়ে যাওয়ার পর এবার পকেট থেকে সেই খামটা বের করলুম। ডাকে পাঠানো চিঠি। চিঠিটা বের করে পড়লুম। লেখা আছে :

চন্দ্রকণা,
তুমি চারদিন এলে না। অসুখ নাকি? তোমার অফিসে ফোন করেও পাইনি। বড় পার্টি পেয়ে গেছি। ২৯ মার্চ শনিবার সন্ধ্যার পর পার্টি আসবে। তুমি তাদের সঙ্গে গল্প করবে। টিটোরও এই সুযোগটা নিতে আপত্তি নেই। সে তোমাকে সব খুলে বলবে। তুমি পার্টিকে ছবি তোলার গল্প বলবে। তারপর আমরা ঢুকলেই তুমি চারতলায় চলে যাবে। তোমার ওই দিন থাকা খুব দরকার। কারণ পার্টিকে তুমিই গল্প করে সময় কাটাতে সাহায্য করবে। টাকার প্রশ্ন পরে। ছবির গল্প রেডি। লোকেশন ঠিক করা আছে। এই প্ল্যানে তোমার সাহায্য জরুরি। কারণ একমাত্র তুমিই মিষ্টি কথায় কাজ আদায় করার ব্যাপারে অভিজ্ঞ। যেন অবশ্য ওইদিন পাঁচটার মধ্যে তোমার আসা চাই। ইতি
—সু.দা.

 চিঠিটা পড়ে বললুমনা বোঝার কী আছে? সুমন দাশগুপ্তের চিঠি। কিন্তু সে চিঠি না লিখে টিটোকে দিয়ে এইসব কথা চন্দ্রকণাকে শোনাতে পারত।

কর্নেল বললেন–চিঠিটা ডাকে দেওয়া হয়েছিল ২৩ মার্চ। পোস্ট অফিসের কারবার। চন্দ্রকণা চিঠিটা পেয়েছিল ২৯ মার্চ সকালে। খামের উপর ডেটস্ট্যাম্প স্পষ্ট।

–কিন্তু টিটোকে কি সুমন তার প্ল্যানের কথা বলেনি?

– সম্ভবত ২৯ মার্চ বিকেলে টিটোকে সে বলেছিল কিছু। আমার ধারণা, প্রকৃতপক্ষে কী ঘটবে, তা খুলে বলেনি। চন্দ্রকণাকে চিঠিতে যেভাবে বলেছিল, টিটোকেও হয়তো সেইভাবে বলেছিল। অবশ্য আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। কারণ সেই সন্ধ্যায় যা ঘটেছিল, তা দেখার পর টিটো কি চন্দ্রকণাকে রক্ষার জন্য লড়ত না?

টিটোকে হয়তো সুমন কোনো ছলে হোটেলে পাঠিয়ে দিয়েছিল। কর্নেল হাসলেন।–নিছক জল্পনা করে লাভ নেই জয়ন্ত। কাউন্টডাউন আমি শুরু করেছি। একশো থেকে শূন্য পর্যন্ত।

–টোয়ার্ডস দা জিরো?

–ইউ আর ড্যাম রাইট।

–আগাথা ক্রিস্টির এই নামে লেখা এক অসাধারণ গোয়েন্দা উপন্যাস আছে।

 টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। …বলছি। …বলুন হালদারমশাই। বাঃ! অসাধারণ খবর। তা আপনি কি এখনও ছদ্মবেশে আছেন? …তাই বলুন। শিগগির চলে আসুন। আমি যথাস্থানে খবর পাঠাচ্ছি।

রিসিভার রেখে কর্নেল ঘড়ি দেখলেন। হাসতে হাসতে বললুমহালদারমশাই অসাধারণ খবর দিলেও তা জানতে চাইছি না। কারণ উনি সশরীরে কিছুক্ষণের মধ্যেই এখানে আবির্ভূত হচ্ছেন।

কর্নেল বললেন–ঠাকুর ঘরে কলা খেয়ো না জয়ন্ত। তুমি খবরটা জানার জন্য ছটফট করছ। খবরটা তোমাকে জানাতে আপত্তি নেই। টিটো তাদের বাড়ির পিছন দিকে বাউন্ডারি ওয়াল ডিঙিয়ে বাড়ি ঢুকেছে। সন্ন্যাসীবেশে কাছেই একটা বটতলায় বসে ছিলেন হালদারমশাই। বটগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে পোশাক বদলে নিয়েছেন। তারপর বড় রাস্তায় একটা ঔষধের দোকান থেকে ফোন করেছেন। রবিবারেও কিছু ঔষধের দোকান খোলা থাকে।

বলে কর্নেল টেলিফোনের রিসিভার তুলে তার নোটবই দেখে ডায়াল করতে থাকলেন। বুঝতে পারলুম ডি.সি ডি ডি-ওয়ান লাহিড়িসায়েবের মোবাইল নাম্বারে ফোন করছেন। একটু পরে সাড়া পেয়ে কর্নেল বললেন অরিজিৎ! ….না। নরেশবাবুকে পাঠানোর জন্য তোমাকে বকব বলে ফোন করিনি। দিস ইজ আর্জেন্ট। …অবশ্যই। তো শোনো। এখনই একটুও দেরি না করে ভবানীপুরে মিসেস স্বাগতা রায়ের বাড়ি ফোর্স দিয়ে ঘিরে ফেলা দরকার। আমার হাতে খবর আছে। আধঘণ্টা আগে বাণীব্রত ওরফে টিটো পাঁচিল ডিঙিয়ে বাড়ি ঢুকছে। …..আমি এখনই বেরোচ্ছি। শুধু একজনের প্রতীক্ষায় আছি। …হ্যাঁ। তুমি ঠিক ধরেছ। যাই হোক। তুমিও যাবে। মিঃ নিয়োগীকে কিছু না জানানো উচিত। উনি মিসেস অগ্রবালকে নিয়েই থাকুন। নরেশবাবু ….রিং করে আমার কথা জানিয়েছেন? বাঃ! ছাড়ছি। তোমরা এখনই অপারেশন স্টার্ট করো।

রিসিভার রেখে কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাই এসে পৌঁছলেন, তখন সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। তিনি সোফায় বসেই বললেন–কর্নেলস্যার! আমার ক্লায়েন্টের পোলারে অ্যারেস্ট করা ব্যবস্থা কী করছেন?

কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। আমরা আপনার অপেক্ষা করছিলুম। এখনই বেরোব। আপনি কি কফি খাবেন?

–না। পোশাক বদলাইয়া রাস্তার একধারে দুই ভাঁড় চা খাইয়া লইছি।

–তা হলে উঠে পড়া যাক। গাড়িতে যেতে যেতে আপনার কাছে ডিটেলস শুনে নেব। চলুন।..

কিছুক্ষণ পরে নিচে নেমে আমার গাড়ির ব্যাকসিটে কর্নেল ও হালদারমশাই উঠে বসলেন। কর্নেল বললেন–জয়ন্ত! চৌরঙ্গি হয়ে সোজা চলে। হাজরার মোড় পেরিয়ে গিয়ে আমি রাস্তা দেখিয়ে দেব। গলি রাস্তায় শর্টকাটে দেবেন রায় রোডে পৌঁছাতে হবে।

পিছনে কর্নেল ও হালদারমশাইয়ের কথাবার্তা কানে আসছিল। হাজরা রোডের মোড় পেরিয়ে গিয়ে কর্নেল ডান দিকে এক রাস্তায় ঢুকতে বললেন। তারপর গলিরাস্তায় কর্নেলের নির্দেশে রোবোটের মতো ড্রাইভ করছিলুম। ততক্ষণে জেনে গেছি, টিটো যখন বাড়ির পিছনে নির্জন গলিতে এসে বাউন্ডারি পাঁচিলে উঠছিল, তখন তার কাঁধে একটা ব্যাগ এবং হাতে এক ব্রিফকেস ছিল। হোটেল কন্টিনেন্টাল থেকে বেরোনোর সময়ও তার হাতে ব্রিফকেস থাকার কথা শুনেছিলুম। ব্যাগে হয়তো তার পোশাক-আশাক থাকতে পারে। কিন্তু ব্রিফকেসে কী আছে, তা নিয়ে কর্নেল ও হালদারমশাইয়ের জল্পনা কানে এসেছিল। কর্নেলের মুখে বারবার প্ল্যান শব্দও শুনতে পেয়েছিলুম। সেই প্ল্যান চৈতালি আর সুখেনকে ছবি তোলার ফাঁদে ফেলে চৈতালির গা-ভরা গয়না কেড়ে নেওয়ার প্ল্যান কি না, তা নিয়েই দুই ধুরন্ধর রহস্যভেদীর আলোচনা কানে এসেছিল। এই সঙ্গে সু. দা, অর্থাৎ সুমন দাশগুপ্তের চন্দ্রকণা মজুমদারকে লেখা চিঠি থেকে প্ল্যান শব্দটার একটা ব্যাখ্যা মেলে। কিন্তু বুঝতে পারছিলুম না, সুমন কেন টিটোকে এড়িয়ে চন্দ্রকণাকে ডাকে চিঠি পাঠিয়েছিল। চিঠিতে সে লিখেছে, টিটো সব জানে। টিটো কি অমন সাংঘাতিক প্ল্যানের কথা সত্যিই জানত?

আঁকাবাঁকা ঘিঞ্জি গলি এবার মোটামুটি একটা চওড়া রাস্তায় গিয়ে মিশেছে। কর্নেল পিছন থেকে বললেন, এটাই দেবেন রায় রোড।

পিছনে গোয়েন্দাপ্রবর তাকে জিজ্ঞেস করলেন–আপনি ক্যামনে চিনলেন কর্নেলস্যার?

কর্নেলকে বলতে শুনলুম–এই রাস্তায় আমার এক বন্ধু ক্যাপ্টেন মোহিত ব্যানার্জির বাড়িতে এক সময় প্রায়ই আসতুম। ওঁর এক ফার্মহাউস ছিল ডায়মন্ডহারবার রোডের ধারে। ওঁর মৃত্যুর পর আর আসিনি। ওঁর ফার্ম হাউসে কত সুন্দর রাত্রি কাটিয়েছি।

কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে ডাইনে ছোট্ট পার্ক। পার্ক পেরিয়ে রাস্তাটা বাঁ দিকে ঘুরে গেছে। বাঁকের পর দুটো পুলিশ ভ্যান দেখতে পেলুম। হালদারমশাই বললেন আইয়া পড়ছি। ওই দ্যাখেন বাড়ির গেট। সামনে পুলিশ খাড়াইয়া আছে দেখি।

কর্নেল বললেন-–অরিজিতের সাদা অ্যাম্বাসাডার গেটের ভিতরে দেখা যাচ্ছে।

বাইরে আর দুটো পুলিশভ্যান এবং দুটো লালরঙের জিপগাড়ি দেখতে পেলুম। রাস্তাটা একেবারে জনহীন কেন বুঝলুম না।

গেটের পাশে আমাকে গাড়ি রাখতে বলে কর্নেল বেরোলেন। তাঁকে দেখে গেটের কাছে একজন পুলিশ অফিসার স্যালুট ঠুকলেন। কর্নেলের পিছনে হালদারমশাই গেটে ঢুকে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। গাড়ি লক করে তারপর আমি ওঁদের কাছে গেলুম। সেই পুলিশ অফিসার আমাদের নিয়ে চললেন। পোর্টিকোর তলায় এক সাদা মারুতি দেখেই হালদারমশাই বললেন–অগো সেই গাড়িটা না! এটা মিসেস রায়ের গাড়ি। কিন্তু গাড়ি এখানে ক্যান? গ্যারেজ ঘরে থাকবার কথা।

পুলিস অফিসার বললেন–ম্যাডাম ছেলেকে নিয়ে বেরোনোর সময় আমরা এসে পড়েছিলুম।

কর্নেল বললেন–অরিজিৎ দেরি করে না। অন্য কেউ হলে গড়িমসি করতেন। ততক্ষণে ছেলেকে নিয়ে মিসেস রায় উধাও হয়ে যেতেন।

পোর্টিকোর নিচে কয়েকধাপ সিঁড়ি বেয়ে অর্ধবৃত্তাকার বারান্দায় উঠলুম। বারান্দা রেলিঙে ঘেরা। অনেকগুলো টবে সাজানো নানা জাতের সুদৃশ্য গুল্ম ও ক্যাকটাস আছে রেলিঙের পাশে। তার মধ্যে বেমানান কয়েকজন সশস্ত্র কনস্টেবল এবং বেটন হাতে পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে আছেন। কর্নেল ঘরে ঢুকে গেলেন। তার পিছনে হালদারমশাই ও আমি ঢুকলুম। প্রশস্ত এক হলঘর। বনেদি অভিজাত বাড়িতে কর্নেলের সঙ্গগুণে এমন ঘর অনেক দেখেছি।

অরিজিৎ লাহিড়ি একেবারে উর্দি পরে এখানে হানা দিয়েছেন। এই প্রথম তাকে উর্দিপরা অবস্থায় দেখলুম। অন্য-অন্য সময়ে প্যান্ট-শার্ট বা প্যান্ট-স্পোর্টিং গেঞ্জি পরা অবস্থায় তাঁকে দেখেছি। এখন তাঁকে দূরের মানুষ মনে হচ্ছিল। কর্নেলকে দেখেই তিনি উঠে দাঁড়িয়ে সহাস্যে বললেন হ্যাল্লো বস্! ওয়েলকাম।

ঘরের ভিতরের দরজায় পর্দার সামনে দুজন পুলিশ অফিসার পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের কাছাকাছি এক গদিআঁটা চেয়ারে বসে আছেন মিসেস স্বাগতা রায়। তার মুখে সেই কোমলতা নেই। পাষাণপাথর যক্ষীর মূর্তি যেন। তাঁর বাঁ দিকে একটা চেয়ারে এক যুবক বসে আছে। হালদারমশাই আমাকে আঙুলের খোঁচা না-দিলেও আমি চিনতে পেরেছিলুম, সে বাণীব্রত রায় ওরফে টিটো। তার পিছনে বেটন হাতে দুজন সাদা পোশাকের পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে।

অরিজিৎ লাহিড়ির পাশে কর্নেল বসে বললেন–ওই সেই ব্রিফকেস আর ব্যাগ। মিঃ হালদার। আপনি তো বটতলা থেকে এই দুটো নিয়েই শ্রীমান টিটোকে পাঁচিল ডিঙিয়ে বাড়ি ঢুকতে দেখেছিলেন?

হালদারমশাই আস্তে বললেন–হঃ! ওই দুইখানই বটে।

কর্নেল বললেন–মিসেস রায়! আপনি ছেলেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিলেন?

মিসেস রায় ঠোঁট কামড়ে ধরেছিলেন। একটু পরে বললেন–পুলিশকে যা বলার সব বলেছি। আর আমার কিছু বলার নেই।

কর্নেল বললেন–অরিজিৎ! ব্রিফকেসে কত টাকা আছে গুনে দেখেছ কি?

অরিজিৎ লাহিড়ি বললেন–হ্যাঁ। মিসেস রায়ের সামনেই গুনেছি। পাঁচ লাখ টাকা আছে। টিটো বলেছে, টাকাটা বিহারের পঞ্চগড়ের জুয়েলার রাজকুমার সিংহের।

কর্নেল হাসলেন।–ঠিক বলেছে টিটো। আমি আফটার অল টিটোর প্রশংসাই করব। কারণ সে রাজকুমারবাবু অর্থাৎ তার বনোয়ারিমামার–

 মিসেস রায় বাধা দিয়ে বললেন–বনোয়ারি আমার ভাই নয়। তার সঙ্গে আমাদের রক্তের সম্পর্ক নেই।

আহা! তাই বলে কি কাউকে মামা বলা যায় না? তো যা বলছিলুম, টিটো বুদ্ধিমানের মতো তার বনোয়ারিমামার টাকাভর্তি ব্রিফকেসটা হাতিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু কীভাবে নিয়েছিল, তা টিটোর মুখে শুনতে চাই। টিটো! তুমি সব খুলে বলো।

টিটো মুখ নামিয়ে গলার ভিতরে বলল–খুলে তো বলেছি পুলিশকে। আপনি আবার কে?

-তোমাকে খুঁজে বের করার জন্য তোমার মা আমার সাহায্য চেয়েছিলেন।

 মিসেস রায় বললেন–উনিই কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

 টিটো একটু পরে কেশে গলা ঝেড়ে বলল–বনোয়ারিমামাকে ওরা খুন করবে আগে তা বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলুম, গয়নাগুলো বেচে টাকা নেবে। কিন্তু ভোরবেলা হোটেল থেকে বেরিয়ে পার্ক স্ট্রিটে মুনলাইট বারের পাশে পুলিশের গাড়ি দেখে মিসেস অগ্রবাল গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে চললেন। আমি তখনও জানি না, চন্দ্রকণাকে শুয়োরের বাচ্চারা খুন করেছে। আমি তো তখন চারতলায় বসেছিলুম।

-বুঝেছি। আজ ভোরের কথা বলো।

–মিসেস অগ্রবাল বললেন, মেয়েটা পুলিশকে জানিয়েছে। চিত্রা বলল, সুমনদার সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। বনোয়ারিমামা তো অত কিছু জানেন না। ওঁকে টেলিফোন করে শুধু জানিয়েছিলুম, কয়েক লাখ টাকার চোরাই জুয়েলারি বেচবে আমার চেনাজানা এক লোক। বনোয়ারিমামা চোরাই মাল কিনতেন, আমি আগে থেকে জানতুম। সুমনদাই হোটেলে চারজনের থাকার মতো স্যুইট ভাড়া করতে বলেছিল বনোয়ারিমামাকে। পার্টি হোটেলে চোরাই মাল নিয়ে যাবে। তো আজ সোজা বেলেঘাটায় সুমনদার বাড়ি গেলুম। সে বাড়িতে ছিল না তাই আবার হোটেলে ফিরে এলুম। তখন নটা বাজে।

–হোটেলে ঢোকার সময় চিত্রাকে তোমার সুমনদার লোক একটা চিঠি দিয়েছিল, তা কি লক্ষ করেছিলে?

টিটো বলল না। আমি বনোয়ারিমামার পিছনে ছিলুম। মিসেস অগ্রবাল আর চিত্রা আসছিল আমাদের পিছনে। সুইটে ফিরে বনোয়ারিমামা ব্রেকফাস্টের অর্ডার দিলেন। পনেরো-কুড়ি মিনিটের মধ্যে ব্রেকফাস্ট এসে গেল। ব্রেকফাস্ট শেষ করার পর বনোয়ারিমামা হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। তখনই চিত্রা বলল, সর্বনাশ! ভদ্রলোক হার্টফেল করলেন নাকি? আমি বনোয়ারি মামার টাকাভর্তি ব্রিফকেসটা তখনই হাতে নিয়েছিলুম। ভেবেছিলুম সত্যি ওঁর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। কিন্তু চিত্রা ব্যস্তভাবে বলল, ভদ্রলোক মারা গেলে আমরাই দায়ী হব। হাজারটা কৈফিয়ত দিতে হবে পুলিশকে। কেটে পড়াই ভালো।

তারপর তোমরা কোথায় গেলে?

মিসেস অগ্রবালের বাড়ি। কিন্তু বাড়ির কাছে গিয়ে আমার সন্দেহ হল, চিত্রা সুমনের পরামর্শে বনোয়ারিমামাকে সাংঘাতিক কোনো ঔষধ খাইয়ে দেয়নি তো? ব্রেকফাস্টের সময় সে-সুযোগ চিত্রার ছিল। আমি আর বনোয়ারিমামা বেসিনে হাত ধুতে গিয়েছিলুম। তখন নিশ্চয় চিত্রা কিছু মিশিয়ে দিয়েছে খাবারে বা জলের গ্লাসে। আমি গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে একটা খালি ট্যাক্সি ধরে চলে গেলুম টালিগঞ্জে। ওখানে আমার মাসিমার বাড়ি। সন্ধ্যার পর সেখান থেকে বেরিয়ে আমাদের বাড়ির গেটের কাছে কয়েকজন অচেনা লোক দেখে সন্দেহ হল, পুলিশ নয় তো? সাদা পোশাকে হয়তো নজর রেখেছে। কারণ হোটেলে বনোয়ারিমামাকে বিষ খাইয়ে মেরেছে চিত্রা। তাই গলি দিয়ে ঘুরে পাঁচিল বেয়ে বাড়িতে ঢুকেছিলুম।

কর্নেল বললেন–তুমি কি জানো মড়ার উপর খাড়ার ঘা মেরেছে তোমার সুমনদা?

টিটো ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল–ওই পুলিশ অফিসারের কাছে শুনলুম। চন্দ্রকণাকে খুন করার কথা মায়ের কাছে শুনেছিলুম।

–সুমন দাশগুপ্ত তোমাকে যা প্ল্যানের কথা বলেছিল, সেটা কী প্ল্যান?

–সুমনদা বলেছিল, ২৯ মার্চ শনিবার সন্ধ্যায় দুটো লোক চোরাই মাল বেচতে আসবে। তাদের তিনতলায় বসিয়ে রেখে বনোয়ারিমামাকে খবর দিতে হবে। সেই টাকায় সুমনদা একটা ফিল্ম করবে। কিছু টাকা মিসেস অগ্রবাল দেবেন। ভদ্রমহিলা একসময় ফিল্মস্টার ছিলেন। বাকি টাকা ডিস্ট্রিবিউটার দেবে। আমি হিরোর রোলে আর চন্দ্রকণা হিরোইনের রোলে থাকবে। আমি বোকার বোকা।

–চন্দ্রকণাকে তুমি প্ল্যানের কথা বলেছিলে। সে না এলে নাকি প্ল্যান ক্যান্সেল করতে হত। কেন এ কথা তাকে বলেছিলে?

টিটো অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার পর বলল–আপনি কী করে জানলেন?

এবার আমি বললুম–চন্দ্রকণাকে বৃষ্টির সময় আমার গাড়িতে মুনলাইট বারের সামনে পৌঁছে দিয়েছিলুম। আমিই কথাগুলো শুনেছিলুম।

টিটো বলল সুমনদা বলেছিল, চন্দ্রকণা পার্টির সঙ্গে গল্প করবে। সময় কাটানোর দরকার। কারণ ওরা চোরাই মাল এনেছে। দেরি করতে চাইবে না। হোটেল থেকে বনোয়ারিমামার আসতে সময় লাগবে। চন্দ্রকণাকে নিয়ে আমি চারতলায় অফিসঘরে গেলুম। সুমনদা আমাকে আড়ালে ডেকে তখন বলল, মালটা কেড়ে নিয়ে পার্টিকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার প্ল্যান করেছি। আমাকে সে চারতলায় বসে থাকতে বলল। আর চন্দ্রকণাকে তিনতলায় গিয়ে পার্টির সঙ্গে গল্প করে সময় কাটাতে পাঠিয়ে দিল। এটাই আমাদের প্ল্যান ছিল।

–চন্দ্রকণা তোমার সঙ্গে সুমনের কথা যেভাবে হোক শুনতে পেয়েছিল। তাই সে তিনতলায় নেমে পার্টিকে সতর্ক করে দিয়ে পালিয়ে যেতে বলেছিল।

–আমি আর মিসেস অগ্রবাল চারতলায় গল্প করছিলুম। নিচে কী হচ্ছে বুঝতে পারিনি। প্রায় আধঘণ্টা পরে চিত্রা এসে বলল, কাজ শেষ। চলুন মিসেস অগ্রবাল। আমরা হোটেলে ফিরে যাই। আমি চন্দ্রকণার কথা জিজ্ঞেস করলুম। চিত্রা বলল, চন্দ্রকণা ব্যাপার দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছে। সুমনদা মাল হাতিয়ে নিয়ে চলে গেছেন। মিসেস অগ্রবালের গাড়িতে আমরা হোটেলে ফিরে গেলুম।

কর্নেল বললেন–বাকিটা আমি বলব। তবে সুমন ও চিত্রাকে আগে খুঁজে বের করা দরকার।

টিটো বলল–আমি আজ বাড়ি ফিরেই সুমনদাকে ফোন করেছিলুম। সে আমাকে টাকাভর্তি ব্রিফকেসটা নিয়ে তার বাড়িতে যেতে বলল। কিন্তু মা আমাকে নিয়ে টালিগঞ্জে মাসিমার বাড়িতে যেতে চাইল। সেখানে গিয়ে মেসোমশাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্রিফকেস পুলিশের হাতে তুলে দিতে হবে। মায়ের কথা শুনে আমিও ভাবলুম–সেটাই ঠিক হবে। মেসোমশাই হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট নরেন্দ্রনাথ চৌধুরী। উনি পুলিশের সাহায্যে খুনি সুমনদা আর চিত্রাকে ধরিয়ে দেবেন।

–কাল স্টুডিওতে সুমন ছাড়া আর কোনো ছেলে ছিল?

–দেখিনি। তবে পরে মনে হয়েছে, মুনলাইট বারের সামনে ভিড়ের মধ্যে সুমনদার কিছু চ্যালা ছিল। শনিবার-রবিবার দুদিন অজন্তা বন্ধ থাকে। সুমনদার প্ল্যানের জন্য শনিবার অজন্তা খোলা ছিল। চন্দ্রকণাও আমার তাগিদে কাল বৃষ্টির মধ্যে এসেছিল।

–কেয়ারটেকার ছিল না তখন?

–তাকে দেখিনি। হয়তো মিসেস অগ্রবাল কোনো কাজের ছলে তাকে বাইরে পাঠিয়েছিলেন।

কর্নেল একটু হেসে বললেন–কেয়ারটেকার বাইরে যায়নি। সে পুলিশকে মিথ্যা বলেছিল।

মিঃ লাহিড়ি বললেন–কেয়ারটেকারকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। পুলিশ রেকর্ডে তার পরিচয় পাওয়া গেছে। মিসেস অগ্রবালের অনুচরটি দাগি অপরাধী। তা ছাড়া কিছুক্ষণ আগে নরেশবাবু আমাকে মোবাইলে ফোন করে খবর দিলেন, মিসেস অগ্রবাল মডেলিং স্কুল খুলেছিল এ মাসের গোড়ার দিকে। তিনতলা আর চারতলার দুটো ঘরে আগে থেকেই অজন্তা নামে স্টুডিও ছিল। তার মালিক ছিলেন এক বাঙালি ভদ্রলোক। স্টুডিও চালাতে না পেরে মিসেস অগ্রবালকে তিনি সাবলেট করেন। এই নিয়ে বাড়িটার আসল মালিকের সঙ্গে মিসেস অগ্রবালের মামলা চলছে। যে-কোনো দিন তাকে কোর্টের অর্ডারে উচ্ছেদ হয়ে যেতে হবে।

কর্নেল বললেন মিসেস অগ্রবাল সুমন আর চিত্রা সম্পর্কে কী বলেছেন?

–ওদের নাম করে কিছু বলেননি। শুধু বলেছেন, ফিল্মলাইন থেকে এক যুবক এবং এক যুবতাঁকে তিনি মডেলিংয়ের টিচার হিসেবে রিক্রুট করেছিলেন। দুজনেরই নাকি ফিল্মলাইন এবং মডেলিং-এ নাম আছে।

কর্নেল হাসলেন।– সঠিক খবর আমি পেয়ে যাব। জয়শ্রী সিনে স্টুডিওর ম্যানেজার গোপাল কুন্ডু আমার সোর্স। তবে আর দেরি না করে টিটোকে কাজে লাগাতে হবে। টিটো! তুমি এখনই তোমার সুমনদাকে ফোন করে জানিয়ে দাও, টাকাভর্তি ব্রিফকেস নিয়ে তুমি যাচ্ছ। ফিল্ম করার জন্য তুমি আরও অন্তত তিন লাখ টাকা তোমার বাবার তোমার নামে রেখে যাওয়া ফিক্সড ডিপোজিট থেকে তুমি লগ্নি করবে–ঠিক এই কথাটি তোমাকে বলতে হবে। পারবে তো?

টিটো বলল–পারব।

তুমি যে চন্দ্রকণার মৃত্যুর খবর পেয়েছ, একথা বলবে না। তুমি তার সম্পর্কে কিছু জানো না। কারণ তুমি এখনও পালিয়ে বেড়াচ্ছ। তখন কি তুমি সুমনকে বলেছিলে, তুমি বাড়িতে আছ?

–সে সব কিছু বলিনি। সুমনদা জানতেও চায়নি। শুধু বলল, ব্রিফকেসটা নিয়ে চলে এসো। দেরি কোরো না।

–তুমি কেন ব্রিফকেস নিয়ে পালিয়েছিলে, তা সে জিজ্ঞেস করেনি?

–না। সুমনদা যে একটা সাংঘাতিক লোক, তা পরে বুঝেছি। সে আমাকে যেন অর্ডার করল, এখনই ব্রিফকেস নিয়ে আমার কাছে এসো। বিটুইন দা লাইনস, হুমকি আছে, তা টের পাচ্ছিলুম।

–এ ঘরে ফোন আছে?

মিসেস রায় বললেন– ভিতরে একটা ঘরে ফোন আছে।

কর্নেল বললেন–চলো টিটো। তুমি সুমনকে ফোন করবে। আমি তোমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকব। না–তোমাকে অবিশ্বাস করছি না। আমি ফোনের পাশে কান রেখে ওর কথাবার্তা শুনব।

টিটোর সঙ্গে কর্নেল ভিতরের ঘরে অদৃশ্য হলেন। মিসেস রায় ভাঙা গলায় বললেন–আমার নির্বোধ ছেলেকে এক স্কাউন্ড্রেল আর ইতর প্রকৃতির দুটো মেয়ে কাজে লাগিয়েছিল। মিঃ লাহিড়ি। আপনারা তাকে সেই স্কাউন্ট্রেলের কাছে নিয়ে যাবেন। ওর খারাপ কিছু হলে আপনাদের আমি দায়ী করব।

মিঃ লাহিড়ি বললেন–চিন্তা করবেন না ম্যাডাম। আপনার ছেলেকে অক্ষত অবস্থায় ফিরে পাবেন। তবে এই কেসে আমরা তাকে রাজসাক্ষী করব।

আমি বললুম–কর্নেলের হাতে আসল তাস আছে মিঃ লাহিড়ি। যথাসময়ে দেখতে পাবেন।

মিঃ লাহিড়ি একটু হেসে বললেন–তা আমি বুঝতে পেরেছি জয়ন্তবাবু। আজ দুপুরেই টের পেয়ে গেছি, পুরো ব্যাকগ্রাউন্ড পাত্রপাত্রীসমেত কর্নেলের মস্তিষ্কে ঢুকে আছে। ক্রমে-ক্রমে উনি তাদের বের করবেন।

একটু পরে কর্নেল টিটোকে নিয়ে হলঘরে ঢুকলেন। কর্নেল বললেন– অরিজিৎ! টোপ গিলেছে সুমন। কিন্তু সে মহা ধূর্ত। এখন বলছে, চন্দ্রনাথ সেন লেনের মোড়ে সে টিটোর অপেক্ষা করবে। তুমি বেলেঘাটা থানাকে অ্যালার্ট করে দাও। এলাকাটা ওঁরা যেন যতটা সম্ভব ঘিরে ফেলেন। এখন রাত আটটা পনেরো। আমাদের পৌঁছতে আধঘণ্টা লাগবে। চন্দ্রনাথ সেন লেনের মোড় মানে ক্লিফটন স্ট্রিটে ঢুকতে হবে।

একজন পুলিশ অফিসার বললেন–আমি বেলেঘাটা থানায় ছিলুম স্যার। জায়গাটা চিনি।

মিঃ লাহিড়ি বললেন– একই রং এবং একই সাইজের একটা ব্রিফকেস হলে ভালো হত। তাই না কর্নেল?

মিসেস রায় বললেন–আছে। আনিয়ে দিচ্ছি! কানুবাবু! কানুবাবু কোথায় গেলেন?

একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক ঢুকে বললেন–আজ্ঞে মা!

–দেখুন তো! এইরকম একটা ব্রিফকেস টিটোর বাবার অফিসে রাখা আছে। নিয়ে আসুন।

কানুবাবু কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটা ব্রিফকেস এনে দিলেন। প্রায় কাছাকাছি রং এবং সাইজ। রাতের আলোতে দুটোর মধ্যে পার্থক্য বোঝা কঠিন। কর্নেল বললেন–টিটোর বাবার ব্রিফকেসে যা আছে থাক। ওটা খোলার দরকার নেই। অরিজিৎ! তুমি আসল ব্রিফকেসটা করায়ত্ত করো। টিটো তার বাবারটা হাতে নিক। এবার কোন্ গাড়ি আগে যাবে, ঠিক করা দরকার।

ততক্ষণে মিঃ লাহিড়ি একজন পুলিশ অফিসারকে ডেকে চাপাস্বরে কিছু নির্দেশ দিলেন। তিনি দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। সম্ভবত বেতারফোনে বেলেঘাটা থানাকে খবর দিতেই গেলেন।

কর্নেল বললেন–-অরিজিৎ! তুমি তোমার গাড়ির পিঠে লাল আলো বসাও না কেন, বুঝতে পারছি!

মিঃ লাহিড়ি বললেন–ওঃ বস্! আপনি সত্যি এবার বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন। ওটা তো আপনারই পরামর্শ ছিল। এইসব গোপন অভিযানে লালা আলো হিতে বিপরীত ঘটায়।

কর্নেল হাসলেন। –তাহলে আমি আর টিটো বসছি তোমার গাড়ির ব্যাকসিটে। অর্থাৎ তুমি আজ আমাদের ড্রাইভার।

মিঃ লাহিড়ি বললেন–আমার সৌভাগ্য, এতদিন পরে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে আমার গাড়ির ভিতরে ঢোকাতে পারলুম।…..

.

লালবাজার পুলিশের সব গাড়ি আগেই বেলেঘাটার দিকে চলে গিয়েছিল। অরিজিৎ লাহিড়ির গাড়ির পিছনে আমি যাচ্ছিলুম। আমার বাঁপাশে হালদারমশাই। বেলেঘাটায় লরেটো স্কুল ডাইনে রেখে কিছুটা চলার পর বাঁক নিল মিঃ লাহিড়ির গাড়ি। তারপর একটা গলিতে ঢুকল। সেইসময় আমাদের পাশ দিয়ে দুটো পুলিশের গাড়ি তীব্র গতিতে চলে গেল বড় রাস্তা দিয়ে। কিছুক্ষণ পরে মিঃ লাহিড়ির গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। আমিও গাড়ি দাঁড় করালুম। দুপাশে কারখানার উঁচু পাঁচিল। কর্নেল ও টিটোকে গাড়ি থেকে নামতে দেখলুম। হালদারমশাই নেমে গিয়ে তাদের সঙ্গ নিলেন। আমি গাড়ি লক করে হন্তদন্ত এগিয়ে গেলুম। ডাইনে ঘুরে গাছের ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে কর্নেল চাপা স্বরে বললেন–হালদারমশাই! আপনি রিভলবার রেডি করে এগিয়ে যাবেন। আপনি রাস্তা দিয়ে হাঁটবেন। টিটো হাঁটবে ফুটপাথ দিয়ে। সামনে এগিয়ে বাঁদিকের গলিটা চন্দ্রনাথ সেন লেন। টিটো ওখানে গিয়ে দাঁড়াবে। আপনি টিটোর কাছে কাউকে দেখলে জিজ্ঞেস করবেন, সুভাষ সরোবর কোনদিকে যাব বলতে পারেন? টিটো যদি রাগ দেখিয়ে বলে– জানি না, আপনি জানবেন সুমন তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আপনি কথা বলার ছলে কাছে গিয়ে সুমনকে জাপটে ধরে মাটিতে ফেলবেন। আশেপাশে সাদা পোশাকে পুলিশ তৈরি আছে। দু-তিন মিনিটের অপারেশান!

মোটামুটি চওড়া রাস্তায় আলো তত জোরালো নয়। বাস ট্রাক রিকশো এবং কদাচিৎ মানুষজন যাতায়াত করছে। টিটো ব্রিফকেস হাতে রাস্তার মোড়ে গিয়ে বাঁদিকে ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকল। হালদারমশাই রাস্তা দিয়ে খুব আস্তে হাঁটছিলেন। আমরা গাছের ছায়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে লক্ষ রাখছি।

টিটো প্রায় পঞ্চাশ মিটার এগিয়ে যেতেই সেখানে গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একজন তাকে ডাকল। তারপর সে টিটোর হাত থেকে ব্রিফকেস প্রায় ছিনিয়ে নিল। তখনই হালদারমশাই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তারপর গলির ভিতর বোমা ফাটল। সম্ভবত সুমনের চ্যালারা পাহারা দিচ্ছিল তাদের গুরুকে। কিন্তু তারপরই জোরালো টর্চের আলোয় সাদা পোশাকের পুলিশের দল গলিতে ঢুকল। কর্নেল বললেন–অরিজিৎ! গাড়ি নিয়ে এসো। জয়ন্ত! তুমিও এসো। আমি গিয়ে আগে সুমনকে আদর করি।

কর্নেল হন্তদন্ত গিয়ে হালদারমশাইয়ে শরীরের তলা থেকে সুমনকে উদ্ধার করেই সামরিক কৌশলে তার দুটো হাত পিছনে টানলেন এবং কোমরে হাঁটুর গুতো মারলেন। সুমন আর্তনাদ করে উঠল। গলির ভিতর আবার বোমা ফাটল। মিঃ লাহিড়ি গাড়ি থেকে নেমে বললেন–প্রিজন ভ্যান কোথায়?

একজন পুলিশ অফিসার বাঁকের মুখ থেকে প্রিজন ভ্যান নিয়ে এলেন। তারপর সুমনের হাতে হাতকড়া পরিয়ে রুলের গুঁতো মেরে প্রিজন ভ্যানে ঢোকালেন। টর্চের আলোয় দেখলুম, প্রিজন ভ্যানে একজন সুন্দরী যুবতী বসে আছে। তার দুপাশে দুজন মহিলা পুলিশ।

মিঃ লাহিড়ি বললেন–ওই মেয়েটি চিত্রা সেনগুপ্ত? ওর ব্যাগটাতে চোরাই গয়না আছে কিন্তু!

একজন অফিসার বললেন–ব্যাগটা পরীক্ষা করিনি। ওটা আমি নিচ্ছি। তবে ঘটনাটা শুনুন স্যার! সুমন বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় তার সঙ্গিনীও বেরিয়েছিল। সুমন ওকে বলল–চিত্রা! রিস্ক নিয়ো না। উপরে গিয়ে বসো। এই বলে সুমন এগিয়ে গেল। আমরা একটু পিছনে ছিলুম। সুমন টের পেল না, সঙ্গিনীকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে কারা। কমলা আর জয়া যেভাবে মেয়েটাকে নিঃশব্দে তুলে নিয়ে গিয়েছিল কল্পনা করা যায় না স্যার। মেয়েটার পিছনের দিকে ব্যাগটা ছিল। সুমনকে তা হলে ফাঁকি দিয়ে পালানোর তালে ছিল!

–আপনি ও সি মিঃ ভাদুড়ি না? ব্যাগটা নিয়ে প্রিজন ভ্যানের সঙ্গে যান।

–যাচ্ছি স্যার। খবর পেয়েই আমি কমলা আর জয়াকে তৈরি রেখেছিলুম। ওদের একটা অপারেশনের জন্য লালবাজার থেকে আনিয়েছিলুম, সেটা ফেল করেছিল। যাই হোক, ওরা ছিল বলে আমাদের লোকেদের মহিলার গায়ে হাত দিতে হল না। হ্যাঁ–ব্যাগটা এখনই নিচ্ছি।

থ্যাঙ্কস মিঃ ভাদুড়ি। প্রিজন ভ্যানের সঙ্গে লালবাজারে চলুন। আমার জন্য ওয়েট করবেন।

আমাদের গাড়ির দিকে যেতে যেতে দেখলুম, এখানে ওখানে বেশ ভিড় জমে গেছে।

কর্নেল টর্চের আলোয় গোয়েন্দাপ্রবরকে দেখে বললেন–কী সর্বনাশ! আজ সন্ধ্যায় এদিকে বৃষ্টি হয়েছিল নাকি? জলকাদায় আপনার প্যান্টশার্ট নোংরা হয়ে গেছে।

হালদারমশাই বললেন–ও কিছু না। আরে ইচ্ছা কইর‍্যাই খানাখন্দে ফেলছিলাম। তবে গায়ে জোর আছে। ঘাড়ে একখান রদ্দা খাইয়া চুপ করছিল।

কর্নেল বললেন–টিটো! ঠিক আছ তো? টিটো বলল–হ্যাঁ স্যার। তবে স্কাউন্ড্রেলটা আমার হাত থেকে এমন জোরে এই ব্রিফকেসটা নিয়েছিল যে আমার রিস্টে ব্যথা করছে। স্যার! গয়নার ব্যাগটা আমি চিনতে পেরেছি।

মিঃ লাহিড়ি বললেন–ওটা লালবাজারে পৌঁছে যাবে। তোমাকে দিয়ে ওটা আজ রাত্রে এবং পরে কোর্টেও শনাক্ত করানো হবে। গয়নাগুলো ভাগাভাগি হয়েছে কি না কে জানে!

আমি বললুম–গয়না ঠিক আছে কি না, যার গয়না সেই বলতে পারবে।

মিঃ লাহিড়ির গাড়িতে উঠতে গিয়ে কর্নেল বললেন–অরিজিৎ! আমার অ্যাপার্টমেন্টে এক পেয়ালা কফি খেয়ে নার্ভ চাঙ্গা করবে।

মিঃ লাহিড়ি বললেন–তা আর বলতে? আপনি না বললেও আমি নিজেও আপনার অ্যাপার্টমেন্টের দিকে ড্রাইভ করে যেতুম। ষষ্ঠীচরণের হাতের এক পেয়ালা কফি এখন খুবই দরকার।

কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে অরিজিৎ লাহিড়ি, কর্নেল ও আমি আরাম করে বসলুম। কর্নেলের নির্দেশে ষষ্ঠী হালদারমশাইকে নিয়ে গেল। বাথরুম থেকে তিনি বেরোলে ষষ্ঠী তাকে একটা পাজামা-পাঞ্জাবি দেবে। তার কাঁধের ব্যাগটা হালদারমশাই ডিভানে রেখে গেছেন। ওটার মধ্যে তাঁর লোডেড রিভলবার আছে, গাড়িতেই তো দেখে নিয়েছি। টিটো তার মাকে কর্নেলের নির্দেশে টেলিফোনে খবর দিল।

দেওয়াল ঘড়িতে নটা বাজল। হালদারমশাই কর্নেলের পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ভদ্রলোক সেজে ডিভানে বসলেন। একটু পরে ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে কফি আর একটা বড় প্লেটে পকোড়া রেখে গেল।

কফি খেতে খেতে কর্নেল বললেন–মূল চক্রান্তটা চিত্রা সেনের মাথা থেকে বেরিয়েছিল। সুমন দাশগুপ্ত, চিত্রা সেন আর মিসেস অগ্রবালের ব্যাকগ্রাউন্ড টালিগঞ্জ সিনেমা মহলের খবরদার গোপালবাবুর কাছে কালই পেয়ে যাব। রাতে তাঁকে বিব্রত করব না। ভদ্রলোক একটু ড্রাংক থাকেন। যাই হোক, মূল চক্রান্ত চিত্রা সেনের। কিন্তু কীভাবে চক্রান্তের কথা তার মাথায় এল সংক্ষেপে বলছি।

কর্নেল বিনোদবাবুর সূত্রে পাওয়া চৈতালি ও তার বর সুখেনের কাহিনি শোনালেন। চৈতালি চন্দ্রকণাকে মেরে ফেলতে দেখেছিল, কর্নেল সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলেন। বুঝলুম, টিটোর মনে আঘাত লাগবে বলেই কর্নেল ঘটনাটা এখন বললেন না। কিন্তু বাকি সব ঘটনা বর্ণনা করলেন। টিটো তাঁকে সায় দিচ্ছিল। একবার সে বলে উঠল-মডেলিং স্কুলের জন্য যেসব ক্যামেরা আর ইলেকট্রনিক গ্যাজেট দরকার হয়, মিসেস অগ্রবালের তা ছিল না। সাধারণ একটা কাঁধে রাখা মুভি ক্যামেরায় কাজ চালাতেন। তাই ছাত্রছাত্রী তত জুটছিল না। আমি বোকার মতো স্কাউন্ড্রেল সুমন আর ওই বজ্জাত মেয়েটা–চিত্রা সেনের পাল্লায় পড়েছিলুম। চন্দ্রকণা শুধু আমার কথায় ওখানে ভর্তি হয়েছিল। আমরা সত্যি একটা স্বপ্ন দেখতুম!

কর্নেল তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন–যা ঘটে গেছে, আর তা ফেরানো যাবে না।

এরপর কর্নেল বুকপকেট থেকে হোটেলে কুড়িয়ে পাওয়া সুমনের চিত্রাকে লেখা চিঠি এবং চন্দ্রকণাকে পাঠানো চিঠি, দুটোই অরিজিৎ লাহিড়িকে দিলেন। মিঃ লাহিড়ি বললেন–ও বস্! আপনার খুরে খুরে দণ্ডবৎ হই! মাত্র একটা দিনেই একটা জটিল রহস্যময় কেসের পর্দা ওঠালেন?

হালদারমশাই সহাস্যে বললেন–আমিও স্যার পুলিশে পঁয়ত্রিশ বৎসর চাকরি করছি, তা আপনি জানেন। আমাগো যে-কাজে লাগে একমাস, কর্নেল স্যারের তা শ্যাষ করতে লাগে একদিন।

কর্নেল বললেন–বরাবর দেখে আসছি, আপাতত যে রহস্য বড্ড বেশি জটিল, তা খোলার কাজ তত বেশি সোজা। শুধু মূলসূত্রটা খুঁজে পেলেই তরতর করে এগিয়ে যাওয়া যায়।

মিঃ লাহিড়ি বললেন–এই রহস্যকাহিনি তো জয়ন্তবাবু লিখে ফেলবেন। কী নাম দেবেন ভেবেছেন?

বললুম–এখনও ভাবিনি!

–আমার কথা শুনুন! হালদারমশাই যেমনটি বলেছেন।

উনি বলেছেন, পুলিশের যা এক মাসের কাজ, কর্নেল তা একদিনে করেন। মিঃ লাহিড়ি একটু হেসে বলেন–নাম দেবেন ‘কর্নেলের একদিন’।….