কর্তার কীর্তি

কর্তার কীর্তি

বর্ধমান জেলার ধনী ও বনিয়াদি জমিদার বাবু হৃষীকেশ রায় তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র হেমন্তকে বাড়ি হইতে দূর করিয়া দিয়াছিলেন। ইহার কারণ সে তাঁহার মনোনীতা পাত্রীকে উপেক্ষা করিয়া একটি আই-এ পাস করা মেয়েকে নিজে পছন্দ করিয়া বিবাহ করিয়াছিল।

ভয় নাই, ইহা পিতৃতরোষপীড়িত হেমন্তের দুর্দশার করুণ কাহিনী নয়। হেমন্তকে শেষ পর্যন্ত অর্থাভাবে স্ত্রী-পুত্রকে পথে বসাইয়া উদ্বন্ধনে প্রাণত্যাগ করিতে হয় নাই। বিবাহের পূর্বে সে কলিকাতার একটা বড় কলেজে অধ্যাপনার কাজ পাইয়াছিল; তাহা ছাড়া পরীক্ষার কাগজ দেখিয়া ও ঘরে বসিয়া শিক্ষকতা করিয়াও যথেষ্ট উপার্জন করিত। সুতরাং পিতা ত্যাজ্যপুত্র করিয়া ঘরের বাহির করিয়া দিলেও, অর্থের দিক দিয়া অন্তত তাহার কোন ক্লেশও হয় নাই।

হৃষীকেশবাবুর মতো বদ্‌রাগী অগ্নিশর্মা লোক আজকালকার দিনে বড়-একটা দেখা যায় না। পুরাকালে বদ্‌-মেজাজী বলিয়া দুর্বাসা মুনির একটা অপবাদ ছিল বটে, কিন্তু তিনিও অকারণে অভিসম্পাত দিয়াছিলেন বলিয়া আমাদের জানা নাই। হৃষীকেশবাবুর কারণ-অকারণের বালাই ছিল না, তিনি সর্বদাই চটিয়া থাকিতেন। শুনা যায়, সতের বৎসর বয়সে তাঁহার একবার টাইফয়েড হয়, সারিয়া উঠিয়া তিনি তেঁতুলের অম্বল দিয়া ভাত খাইবার ইচ্ছা জ্ঞাপন করেন। ডাক্তারের আদেশে তাঁহার সে ইচ্ছা পূর্ণ হইল না, ফলে সেই যে তিনি চটিয়া গিয়াছিলেন সে রাগ তাঁহার এখনও পড়ে নাই। একাদিক্রমে এত বৎসর রাগিয়া থাকার ফলে তাঁহার গোঁফ সমস্ত পাকিয়া গিয়াছিল এবং মাথার সম্মুখ দিকে চুল উঠিয়া পরিষ্কার ও চিক্কণ হইয়া গিয়াছিল। চক্ষু দুটি সর্বদাই কষায়িত হইয়া থাকিত।

রাগের মাত্রা বাড়িয়া গেলে তিনি ঘরের আসবাবপত্র ভাঙিতে আরম্ভ করিতেন। বাড়ির ভঙ্গপ্রবণ জিনিসগুলি প্রায় শেষ করিয়া আনিয়াছিলেন, এমন সময় একদিন দৈব্যক্রমে হাতের কাছে একটি কাচের গেলাস পাইয়া প্রথমেই সেটা ভাঙিয়া ফেলিলেন। ইহাতে ইন্দ্রজালের মতো কাজ হইল। কাচ-ভাঙার শব্দে কর্তার অর্ধেক রাগ পড়িয়া গেল—সেদিন আর তিনি অন্য কিছু ভাঙিলেন না। অতঃপর তাঁহার রাগের মাত্রা চড়িয়া গেলেই বাড়ির যে-কেহ একটা কাচের গেলাস তাঁহার হাতে ধরাইয়া দিয়া সবেগে প্রস্থান করিত। তিনি সেটা মেঝেয় আছড়াইয়া ভাঙিয়া ফেলিতেন। এই অভিনব উপায়ে বাড়ির টেবিল, চেয়ার, আয়না, ঝাড় ইত্যাদি দামী আসবাব অনেকগুলি রক্ষা পাইয়াছিল।

দুই মাস অন্তর কলিকাতা হইতে এক গ্রোস করিয়া নূতন কাচের গেলাস আনানো হইত। তাহাতেই কোনও রকমে কাজ চলিয়া যাইত।

রাগ যখন কম থাকিত, তখন তাঁহার খাসবেয়ারা গয়ারামকে ‘শূয়ারকা বাচ্চা’ না বলিয়া স্রেফ্‌ ‘হারামজাদা’ বলিয়া ডাকিতেন। তখন বাহিরের গোমস্তা হইতে ভিতরে গৃহিণী পর্যন্ত স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিতেন।

দুই বৎসর পূর্বে হেমন্ত যখন জানাইল যে, সে পিতৃনির্বাচিতা কলাবতী নাম্নী একাদশবর্ষীয়া মেয়েটিকে বিবাহ করিবে না, পরন্তু বেথুন কলেজের একটি অষ্টাদশী মাতৃহীনা কুমারীকে বধূরূপে মনোনীত করিয়াছে তখন কর্তা দ্রুতপরম্পরায় তেইশটা গেলাস ভাঙিয়া ফেলিলেন। কিন্তু তাহাতেও যখন ক্রোধ প্রশমিত হইল না, তখন তিনি হেমন্তর ঘরে ঢুকিয়া একখানা ছয় ফুট লম্বা ভিনিসীয় আয়না পদাঘাতে ভাঙিয়া ফেলিয়া দ্বারের দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশপূর্বক ঘোর গর্জনে কহিলেন, ‘বেরিয়ে যা এখনি আমার বাড়ি থেকে, এক কাপড়ে বেরিয়ে যা! তোর মতো শূয়ারের মুখ দেখতে চাই না।”—বলিয়া হ্রেষাধ্বনির মতো একটা শব্দ করিলেন।

হেমন্ত সেই যে এক কাপড়ে বাহির হইয়া গেল, তাহার পর আজ পর্যন্ত পিতৃভবনে পদার্পণ করে নাই।

হেমন্তর বিবাহের সমস্ত ঠিক হইয়াই ছিল,—তাহার মাসীর বাড়ি হইতে বিবাহ হইবে। বিবাহের দিন-দুই পূর্বে গৃহিণী কাঁপিতে কাঁপিতে কর্তার নিকট গিয়া বলিলেন, “আমি কালীঘাট যাব—মানত আছে। শিশিরের সঙ্গে আমায় পাঠিয়ে দাও।”

রাগী হইলেও হৃষীকেশবাবু অত্যন্ত কূটবুদ্ধি; গৃহিণীর আর্জি শুনিয়া তিনি হেষাধ্বনিবৎ শব্দ করিলেন, কট্‌মট্‌ করিয়া তাকাইয়া বলিলেন, “মানত আছে, শিশিরের সঙ্গে পাঠিয়ে দাও! চালাকি! আচ্ছা, আমিই সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি। দেখি কেমন কালীঘাটের মানত!—গয়া শূয়ারকা বাচ্চা কোথায় গেল?”

গৃহিণী চক্ষে অঞ্চল দিয়া দ্রুতপদে প্রস্থান করিলেন। গয়া দ্বারের বাহিরে এক গেলাস সরবৎ হাতে লইয়া দাঁড়াইয়া ছিল, ঘরে ঢুকিয়া কর্তার হাতে দিতেই তিনি সেটা দেয়ালে মারিয়া ভাঙিয়া ফেলিলেন, স-গর্জনে বলিলেন, “ম্যানেজারকে ডাক্‌।”

ম্যানেজার আসিলে তাহাকে হুকুম দিলেন, “খিড়কি আর সদর দেউড়িতে চারটে করে খোট্টা দারোয়ান বসাও। বুড়ি না পালায়!—আর গয়া হারামজাদা তামাক দিয়ে যাক্‌।”

‘হারামজাদা’ শুনিয়া সকলে বুঝিল গৃহিণীর চক্রান্ত ধরিয়া ফেলিয়া কর্তা মনে মনে খুশি হইয়া উঠিয়াছেন।

গৃহিণীর কালীঘাটে পূজা দিতে যাওয়া হইল না। ওদিকে হেমন্তর বিবাহ হইয়া গেল। ইহার পর দুই বৎসর কাটিয়াছে। গৃহিণী বাড়ির মধ্যে নজরবন্দী আছেন, একদিনের জন্যও কোথাও যাইতে পান নাই। এমন কি ভগ্নীপতির অতবড় অসুখেও তাঁহাকে বোনের বাড়ি যাইতে দেওয়া হয় নাই। কিন্তু শিশিরকে বাড়ির মধ্যে অন্তরীণ রাখা শক্ত। সে কলেজে পড়ে, তাই বাধ্য হইয়া তাহাকে কলিকাতায় মাসীর বাড়ি থাকিতে দেওয়া হইয়াছে। যাহোক, হৃষীকেশবাবু তাহাকে ডাকিয়া শাসাইয়া দিয়াছেন যে, কোনদিন যদি সে হেমন্তর বাড়িতে যায় কিংবা তাহার সহিত বাক্যালাপ করে তাহা হইলে তাহাকেও তিনি ত্যাজ্যপুত্র করিয়া বাড়ি হইতে দূর করিয়া দিবেন।

কিন্তু সম্প্রতি কয়েকদিন হইতে বাড়ির মধ্যে ভিতরে ভিতরে কি-একটা ষড়যন্ত্র চলিতেছে, কর্তা তাহা বেশ বুঝিতে পারিয়াছেন। গত শনিবার শিশির আসিয়াছিল, সে মার কানে ফুস্‌ফুস্‌ করিয়া কি বলিয়া গেল, সেই অবধি গৃহিণী অতিশয় চঞ্চল ও বিমনা হইয়া বেড়াইতেছেন। গৃহকর্মে তাঁহার মন নাই; একদিন ক্রন্দনরত অবস্থায় কর্তার কাছে ধরা পড়িয়া গিয়াছেন। কিন্তু বহু উৎপীড়ন ও তর্জন করিয়াও কর্তা ভিতরের কথা কিছুই বাহির করিতে পারেন নাই। তাঁহার সকল প্রশ্নই গৃহিণী উদাস মৌনব্রত অবলম্বন করিয়া সহ্য করিয়াছেন। তাহাতে আর কিছু না হোক, বাড়িতে কাচের গেলাসের সংখ্যা ভয়ানক দ্রুত কমিয়া আসিতেছে।

একে তো এইরূপ অবস্থা, তাহার উপর আজ সকালে উঠিয়াই কর্তা একেবারে সপ্তমে চড়িয়া গিয়াছেন। হতভাগ্য সরকার সকালবেলা হুকুম লইতে আসিয়া কর্তার সম্মুখেই হাঁচিয়া ফেলিয়াছিল। আর যায় কোথা? কর্তা একেবারে হুংকার দিয়া উঠিলেন, “বেয়াদব, উল্লুক কোথাকার! এত বড় আস্পর্ধা! গয়া শূয়ারকা বাচ্চা কোথায় গেল?”

সরকার তো প্রাণ লইয়া পলায়ন করিল, কিন্তু কর্তার সে রাগ সমস্ত দিনে পড়িল না। আজ কিনা সন্ধ্যার সময় আবার শিশির আসিল! নিজের বসিবার ঘর হইতে তাহার গলার আওয়াজ শুনিতে পাইয়া কর্তা তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। শিশির ঘরে ঢুকিতেই তিনি আরম্ভ করিলেন, “তুই হেমন্তর বাড়িতে যাস্‌? সত্যি কথা বল্‌ হতভাগা, নইলে আজ তোকে মেরেই খুন করব।”

কুড়ি বছরের ছেলে শিশির পিতার মুখের পানে হতভম্ব হইয়া তাকাইয়া রহিল, তাঁহার প্রশ্নের হাঁ-না কোনও উত্তরই দিতে পারিল না।

হৃষীকেশবাবু তাঁহার কণ্ঠস্বর তারা গ্রামের ধৈবতে তুলিয়া বলিলেন, “কার হুকুমে তুই সেখানে গিয়েছিলি রে পাজি, নচ্ছার! কি বলেছিলাম তোকে আমি! আমার হুকুম হুকুম নয়, বটে?”

শিশির গোঁজ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। হৃষীকেশবাবু এক পদাঘাতে জ্বলন্ত কলিকাসুদ্ধ গড়গড়াটা দূরে ফেলিয়া দিয়া বলিলেন, “কি করতে তুই গিয়েছিলি সেখানে, বল্‌ আমাকে! আজ তোরই একদিন কি আমারই একদিন! নিজের মার কাছে এসে ফিসফিস করে কি বলেছিস? বল্ শিগ্‌গির হতভাগা, নইলে গাছে বেঁধে তোর গায়ে জলবিছুটি দেওয়াব।”

শিশির ভিতরে ভিতরে মরীয়া হইয়া উঠিল। সে দু-হাত শক্তভাবে মুঠি করিয়া বলিল, “আমি এখন থেকে দাদা-বৌদির কাছেই থাকব ঠিক করেছি। আর—আর মাকেও তাঁদের কাছে নিয়ে যাব।”

হৃষীকেশবাবু একেবারে লাফাইয়া দাঁড়াইয়া উঠিলেন, “কী, এতবড় আস্পর্ধা!”

শিশির গোঁ-ভরে বলিয়া চলিল, “আমাকে থাকতেই হবে,—বৌদির শরীর খারাপ, তাঁর—তাঁর—ছেলে হবে—”

হৃষীকেশ আবার চিৎকার করিবার জন্য হাঁ করিয়াছিলেন, সেই অবস্থাতেই হঠাৎ বসিয়া পড়িলেন। সংবাদটা পরিপাক করিতে মিনিটখানেক সময় লাগিল, তারপর পুনশ্চ গর্জন ছাড়িলেন, “ছেলে হবে তো তোর কি রে শূয়ার?”

শিশির বলিল, “দাদা সমস্ত দিন বাড়ি থাকেন না, বৌদি একলা, তাই আমাকে থাকতে হবে। আর মাকেও—”

“বেরোও! বেরোও! এই দণ্ডে আমার বাড়ি থেকে দূর হ—নইলে চাব্‌কে লাল করে দেব। শূয়ার, পাজি, বোম্বেটে কোথাকার! যাবিনে? গয়া শূয়ারকা বাচ্চা কোথায় গেল, নিয়ে আয় আমার হান্টার—”

শিশির আর অপেক্ষা করিল না, যেমন আসিয়াছিল তেমনি বাহির হইয়া গেল। মার সহিত সাক্ষাৎ পর্যন্ত করা হইল না।

সমস্ত রাত্রি হৃষীকেশ বাড়িময় দাপাইয়া বেড়াইলেন। সেদিন আর ভয়ে কেহ তাঁহার কাছে গেলাস লইয়াও অগ্রসর হইতে পারিল না।

পরদিন বেলা নয়টার সময় স্নানাহার করিয়া তিনি ম্যানেজারকে ডাকিয়া পাঠাইলেন, বলিলেন, “আমি কলকাতায় যাচ্ছি, সন্ধ্যে নাগাদ ফিরব। তুমি সাবধানে থেকো—গিন্নী না পালায়। আর শিশির লক্ষ্মীছাড়া যদি বাড়ি ঢুকতে চায়, মেরে তাড়াবে। —গাড়ি যুততে বলো।”

ম্যানেজার ভয়ে ভয়ে বলিলেন, “মোটর-কোম্পানির এজেন্টকে আজ ডেকেছিলেন, সে এসেছে। তাকে—”

হৃষীকেশবাবু বলিলেন, “তাকে চুলোয় যেতে বলো। আমি কলকাতায় যাচ্ছি, নিজে দেখে মোটর কিনব। গাড়ি যুততে বলো।”—বলিয়া চেকবহিখানা পকেটে পুরিলেন।

ম্যানেজার “যে আজ্ঞে” বলিয়া প্রস্থান করিলেন।

গাড়িতে স্টেশন যাইতে যাইতে হৃষীকেশ নিজের মনে গর্জিতে লাগিলেন, “কি আস্পর্ধা! আমার সঙ্গে চালাকি! দেখে নেব। আমার বৌ—আমার নাতি! আমি হৃষীকেশ রায়—দেখে নেব কে কি করতে পারে।”

বেলা প্রায় দেড়টার সময় একখানা ঝক্‌ঝকে নূতন ফিয়াট্‌ গাড়ি কলিকাতায় প্রোফেসার হেমন্ত রায়ের বাড়ির সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। গাড়ির আরোহী গলা বাড়াইয়া দেখিলেন, ছোট্ট সুদৃশ্য বাড়িখানি, চারি ধারে একটুখানি সংকীর্ণ ঘাসের বেষ্টনী; সামনে লোহার ফটক বন্ধ।

হ্রেষাধ্বনি করিয়া হৃষীকেশবাবু গাড়ি হইতে নামিলেন। ফটক খুলিয়া সম্মুখের বন্ধ দরজায় সজোরে কড়া নাড়িলেন। একটা ছোকরা গোছের চাকর দ্বার খুলিয়া সম্মুখে কষায়িত-নেত্র বৃদ্ধ ও তাঁহার পিছনে একখানি দামী নূতন মোটরকার দেখিয়া সসম্ভ্রমে জিজ্ঞাসা করিল, “কি চাই বাবু?”

হৃষীকেশবাবু উত্তর না দিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলেন। চাকরটা বলিল, “বাবু বাড়ি নেই, কলেজে গেছেন। তাঁর ফিরতে দেরি আছে।”

হৃষীকেশ কর্ণপাত না করিয়া ভিতরের দিকে চলিলেন। চাকরটা এই অদ্ভুত বৃদ্ধের আচরণ দেখিয়া তাড়াতাড়ি সম্মুখের পথ আগলাইয়া রুক্ষস্বরে কহিল, “ওদিকে কোথায় চলেছেন! ওটা অন্দরমহল। বাবু বাড়ি নেই, এসময় আপনি কি চান? আপনার নাম কি?”

হৃষীকেশ শুধু একটি হ্রেষাধ্বনি করিয়া চাকরটার কর্ণধারণপূর্বক এক ধারে সরাইয়া দিলেন। তারপর সম্মুখের সিঁড়ি দিয়া গট্‌ গট্‌ করিয়া উপরে উঠিতে লাগিলেন।

উপরের একটা ঘরে তখন মেঝের উপর মাদুর বিছাইয়া পা ছড়াইয়া বসিয়া প্রতিমা ভেল্‌ভেটের জুতার কাপড়ে রেশমের ফুল তুলিতেছিল। কৃশাঙ্গী সুন্দরী, বুদ্ধির বিভায় মুখখানি জ্বলজ্বল, চুলগুলি পিঠের উপর ছড়ানো, নূতন সৌভাগ্যের কোনও লক্ষণই এখনও দেহে প্রকাশ পায় নাই; তাহাকে দেখিলেই মন খুশি হইয়া উঠে। তাহার হাঁটুর কাছে মাথা রাখিয়া শিশির কড়িকাঠের দিকে চোখ তুলিয়া লম্বাভাবে শুইয়া ছিল। গতকল্য বাবার সহিত যে ব্যাপার ঘটিয়া গিয়াছে তাহা বৌদিদিকে বলা যাইতে পারে কিনা, সে মনে মনে তাহাই গবেষণা করিতেছিল। কিছুক্ষণ ভাবিয়া সে স্থির করিল—না, বলিয়া কাজ নাই। বৌদিদি দুঃখ পাইবেন মাত্র, আর কোনও ফল হইবে না। দাদাকে চুপি চুপি এক সময় বলিলেই হইবে।

বৌদিদির সন্তান-সম্ভাবনার কথা গত সপ্তাহে দাদার মুখে শুনিয়া শিশির আপনা হইতে ছুটিয়া মার কাছে গিয়াছিল। মাও শুনিয়া আনন্দে ও আশঙ্কায় অতিশয় চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিলেন, কিন্তু কর্তার রোষ-বহ্নি ডিঙাইয়া কিছু করিতে সাহস করেন নাই। গতকল্য শিশির দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইয়া আবার বাড়ি গিয়াছিল—যেমন করিয়াই হউক মাকে লইয়া আসিবে। তারপরেই সেই বিভ্রাট! মার সঙ্গে শিশির দেখা পর্যন্ত করিতে পাইল না।

এই কথাটাই মনের মধ্যে তোলাপাড়া করিতে করিতে শিশির বলিল, “আচ্ছা বৌদি, মা যদি এখন কোন রকমে হঠাৎ এসে পড়েন?”

সম্মুখের দেয়ালে শ্বশুর ও শাশুড়ির এনলার্জ্‌ করা ফটোগ্রাফ টাঙানো ছিল। সেই দিকে চোখ তুলিয়া কিছুক্ষণ শাশুড়ির ছবির দিকে চাহিয়া থাকিয়া একটি ক্ষুদ্র নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া প্রতিমা বলিল, “তা যদি হত, ঠাকুরপো—”

শিশির সহসা কনুইয়ে ভর দিয়া উঠিয়া বলিল, “আচ্ছা, মাকে যদি চুরি করে নিয়ে আসি—বাবা কিছু টের না পান?”

জিভ কাটিয়া প্রতিমা বলিল, “বাপ রে! তাহলে কি আর রক্ষে থাকবে? বাবা তাহলে কাউকে আস্ত রাখবেন না।”

বস্তুত, চোখে না দেখিলেও শ্বশুরের মেজাজ সম্বন্ধে কোনও কথাই প্রতিমার অজ্ঞাত ছিল না। তাহাকে বিবাহ করার ফলেই যে স্বামীর সহিত শ্বশুরের এমন বিচ্ছেদ ঘটিয়াছিল তাহা সে বিবাহের সময় হইতেই জানে। হেমন্ত অবশ্য কোনদিন এ-সম্বন্ধে তাহাকে কোনও কথা বলে নাই, কিন্তু শ্বশুরঘরের জন্য সর্বদাই প্রতিমার প্রাণ কাঁদিতে থাকিত। রাগী হউন, কিন্তু শ্বশুর যে কখনই মন্দ লোক নহেন ইহা তাহার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। শ্বশুর-শাশুড়ির আদরে বঞ্চিত হইয়া এই মেয়েটি যে মনের মধ্যে কতখানি বেদনা পোষণ করিয়া রাখিয়াছিল, তাহা তাহার স্বামীও কোনদিন জানিতে পারে নাই। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী বলিয়া সে ও-ভাব কখনও ইঙ্গিতেও প্রকাশ করে নাই, পাছে স্বামী উদ্বিগ্ন হন।

শিশির আবার কড়িকাঠের দিকে চাহিয়া শুইয়া ছিল, প্রতিমা ছলছল চক্ষে বলিল, “আমার ভাগ্যে সে কি আর হবে, ঠাকুরপো? বাবা-মাকে আমি এজন্মে চোখে দেখতে পাব না।”—বলিয়া একটা উচ্ছ্বসিত দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিল।

এমন সময় নীচে হ্রেষাধ্বনির মতো শব্দ শুনিয়া শিশির তড়াক করিয়া উঠিয়া বসিল। এ শব্দ তো ভুল হইবার নয়! সে প্রতিমার কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া বলিল, “বাবা! বাবা এসেছেন!”—বলিয়াই এক লাফে পাশের ঘরে ঢুকিয়া ভিতর হইতে দরজা বন্ধ করিয়া দিল।

প্রতিমার মুখ সাদা হইয়া গেল, বুক ঢিবঢিব করিয়া উঠিল। সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া মাথায় আঁচল টানিয়া দিতেই হৃষীকেশবাবু ঘরের মধ্যে আসিয়া দাঁড়াইলেন। প্রতিমাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া বজ্রগম্ভীরস্বরে কহিলেন, “আমার নাম শ্রীহৃষীকেশ রায়। আমি বর্ধমান থেকে আসছি।”—বলিয়া একটা চেয়ার টানিয়া লইয়া তাহাতে উপবেশন করিলেন।

এইখানে প্রতিমা একটু অভিনয় করিল। মনে যে ভয়ের সঞ্চার হইয়াছিল, তাহা জোর করিয়া চাপিয়া সে সচকিতে ফিরিয়া মুখের ঘোমটা সরাইয়া দিল। বিস্ময়-আনন্দ-ভক্তি-লজ্জা-মিশ্রিত চক্ষে হৃষীকেশবাবুর মুখের দিকে এক মুহূর্ত চাহিয়া থাকিয়া অর্ধস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করিল—“বাবা!” তারপর গলায় আঁচল দিয়া তাঁহার পায়ের উপর মাথা রাখিয়া প্রণাম করিল।

অগ্ন্যুদগারী ভিসুভিয়াসের মাথার উপর উত্তর-মেরুর সমস্ত বরফ চাপাইয়া দিলে কি ফল হয় বলিতে পারি না, হৃষীকেশবাবুরও মুখের কোনও ভাব-পরিবর্তন দেখা গেল না। তিনি ক্ষীণভাবে একটু হ্রেষাধ্বনি করিয়া বলিলেন, “তুমিই আমার পুত্রবধূ? তোমার নাম কি?”

“আমার নাম প্রতিমা”—বলিয়া সে তাঁহার পায়ের কাছেই বসিয়া পড়িল। এইটুকু অভিনয় করিয়াই তাহার ঊরু দুটা থর-থর করিয়া কাঁপিতেছিল।

হৃষীকেশবাবু চাহিয়া দেখিলেন—হাঁ, নাম সার্থক বটে। বধূর মুখ দেখিলে চোখ জুড়াইয়া যায়। শুনিয়াছিলেন বধূ আই-এ পাস, কিন্তু কৈ, তাহার আচরণে বিদ্যাভিমানের কোনও চিহ্নই তো নাই। তিনি এক দর্পিতা তীক্ষ্ণভাষিণী যুবতী মনে মনে কল্পনা করিয়া রাখিয়াছিলেন। কিন্তু এ কি? হৃষীকেশবাবু মনে মনে একবার হ্রেষাধ্বনি করিলেন, কিন্তু তাহা পুত্রদের উদ্দেশে। হতভাগারা তাঁহাকে বলে নাই কেন!

প্রতিমা শ্বশুরের মুখের দিকে একবার চাহিয়া, উঠিয়া দাঁড়াইয়া মৃদু কণ্ঠে বলিল, “আপনি বড় ঘেমেছেন, জামাটা খুলে ফেলতে হত না, বাবা?”

হাতপাখা আনিয়া সে বাতাস করিবার উপক্রম করিতেই হৃষীকেশবাবু বলিয়া উঠিলেন, “থাক্‌ থাক্‌, তোমায় আর কষ্ট করতে হবে না, মা। আমি নিজেই বাতাস খাচ্ছি।”—বলিয়া ফেলিয়াই হৃষীকেশবাবু একেবারে স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। এ ধরনের কথা গত তেত্রিশ বৎসরের মধ্যে তাঁহার মুখ দিয়া একবারও বাহির হয় নাই।

পাশের ঘরের দরজায় কান লাগাইয়া শিশির নিস্পন্দ বক্ষে এতক্ষণ শুনিতেছিল; এবার সে পা টিপিয়া টিপিয়া সরিয়া গিয়া দেয়ালে-টাঙানো রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ছবির সম্মুখে দাঁড়াইয়া প্রাণপণে দুর্গানাম জপ করিতে লাগিল।

হৃষীকেশবাবু গায়ের জামা খুলিয়া মাদুরের উপর বসিলেন, পাখার হাওয়া খাইতে খাইতে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে শয়তানটা ফিরবে কখন? তোমাকে বুঝি এই রকম একলা ফেলে রেখে যায়?”

চোখের জল ও মুখের হাসি একসঙ্গে নিরুদ্ধ করিয়া প্রতিমা নিরুত্তরে বসিয়া রহিল।

হৃষীকেশবাবু গলা এক পর্দা চড়াইয়া দিয়া বলিলেন, “স্টুপিড, বদমায়েস সব! শিশিরটাকেও বাড়ি থেকে দূর করে দিয়েছি। এমন বৌ আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিল! আজই আমি তোমাকে বাড়ি নিয়ে যাব, দেখি কোন্‌ ব্যাটা কি করতে পারে।”

শ্বশুরের মুখের দিকে চাহিয়া প্রতিমা আর অশ্রু সংবরণ করিতে পারিল না, ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। হৃষীকেশবাবু তাহাকে কোলের কাছে টানিয়া আনিয়া নিজের থানের খুঁট দিয়া তাহার চোখ মুছাইয়া দিয়া সগর্জনে কাহিলেন, “কেঁদো না। আমি এই হেমন্তটাকে দেখে নেব। সব ঐ ছোঁড়ার শয়তানি—আমি বুঝেছি। গিন্নীও এর মধ্যে আছেন। আমাকে এতদিন বলেনি কেন? ষড়যন্ত্র! যত সব চোর-বোম্বেটের দল, নইলে এই বৌকে আমি দু-বচ্ছর বাইরে ফেলে রাখি?”

প্রতিমা শ্বশুরের কোলের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া রুদ্ধস্বরে বলিল, “বাবা, আমাকে বাড়িতে মার কাছে নিয়ে চলুন।”

“যাবই তো। এখনি নিয়ে যাব। আমি হৃষীকেশ রায়, আমি কি কারু তোয়াক্কা রাখি?” জামাটা গায়ে দিতে দিতে পুনরায় বলিলেন, “তোমায় নিয়ে যাব বলে নতুন মোটর কিনে নিয়ে একেবারে এসেছি। ট্রেনে তো আর তোমার যাওয়া হতে পারে না।”

হৃষীকেশ উঠিয়া দাঁড়াইলেন। প্রতিমা থতমত ভাবে একবার ঢোক গিলিয়া বলিল, “এক্ষুনি? কিন্তু বাবা—”

হৃষীকেশবাবু চড়া সুরে বলিলেন, “কিন্তু কি? সেই রাস্কেলটার অনুমতি নিয়ে তবে তোমাকে নিয়ে যেতে হবে? (হ্রেষাধ্বনি করিলেন) আমি এই তোমাকে নিয়ে চললাম, ওদের যদি ক্ষমতা থাকে মোকদ্দমা করুক গিয়ে।”

প্রতিমা আর দ্বিরুক্তি করিল না, যেমন ছিল তেমনি বেশে শ্বশুরের সঙ্গে নামিয়া চলিল।

সদর দরজা পর্যন্ত গিয়া হৃষীকেশবাবু থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িলেন। উদ্বিগ্নভাবে পুত্রবধূর দিকে তাকাইয়া কহিলেন, “কিন্তু শুনেছিলাম—ঐ শিশির হতভাগা বলছিল যে, তুমি নাকি—তোমার নাকি? কোনও ভয়ের কারণ নেই তো, মা? মোটরে প্রায় ষাট মাইল যেতে হবে। যদি কষ্ট হয়—যদি কোনও রকম—”

আরক্ত মুখ কোনমতে ঘোমটায় ঢাকিয়া প্রতিমা তাড়াতাড়ি গাড়িতে গিয়া উঠিল।

তিনটার সময় হেমন্ত বাড়ি ফিরিতেই শিশির ছুটিয়া গিয়া তাহাকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, “দাদা! বাবা এসেছিলেন, বৌদিকে বাড়ি নিয়ে গেলেন। বলে গেছেন, আমাদের ক্ষমতা থাকে তো যেন মোকদ্দমা করি!”—বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিল।

ভাইয়ের কাছে সমস্ত আদ্যোপান্ত শুনিয়া হেমন্ত স্মিতমুখে বলিল, “সব তো তুই-ই করলি। এখন আমি কি করব উপদেশ দে।”

অতঃপর দুই ভায়ে আধঘণ্টা ধরিয়া পরামর্শ করিয়া বিকাল পাঁচটার গাড়িতে বর্ধমান রওনা হইল।

রাত্রি আটটার সময় বৌমার তত্ত্বাবধান করিবার জন্য অন্দরে প্রবেশ করিয়া কর্তা দেখিলেন দুই ভাই হেমন্ত ও শিশির মায়ের ঘরের মেঝেয় আহারে বসিয়াছে। গৃহিণী সম্মুখে বসিয়া খাওয়াইতেছেন এবং নববধূ একখানা রেকাবি হস্তে দ্বারের পাশে দাঁড়াইয়া আছে। হৃষীকেশবাবু ভীষণ ভ্রূকুটি করিয়া কহিলেন, “এ দুটোকে কে বাড়ি ঢুকতে দিলে? নিশ্চয় খিড়কি দিয়ে ঢুকেছে! হুঁ—আস্পর্ধা! এখনি ওদের বেরিয়ে যেতে বলো।”

হেমন্ত ও শিশির কথা কহিল না, হেঁটমুখে আহার করিতে লাগিল। গৃহিণী বলিলেন, “কেন যাবে?—যাবে না। আর যায় যদি, বৌমাকে নিয়ে যাবে। আমিও যাব। দেখি তুমি কি করে আটকাও!”

হৃষীকেশবাবু কট্‌মট্‌ করিয়া তাকাইয়া বলিলেন, “হুঁ! ভারি আস্পর্ধা হয়েছে। আচ্ছা, এখন কিছু বলছি না, বৌমার শরীর খারাপ, কিন্তু এর পরে—। বৌমা, তুমি শোও গে যাও, হতভাগাদের আর পরিবেশন করতে হবে না।” বলিয়া মধ্যম রকমের একটা হ্রেষাধ্বনি করিয়া তিনি প্রস্থান করিলেন।

কিছুক্ষণ পরে বৈঠকখানা হইতে কর্তার গলা শুনা গেল, “গয়া হতভাগা কোথায় গেল, তামাক দিয়ে যাক্‌।”

গয়ারামের এতবড় সৌভাগ্য জীবনে কখনও হয় নাই। সে নববধূ ঠাকুরানীর পায়ের কাছে ঢিব করিয়া একটা গড় করিয়া বাহিরে ছুটিল।

হেমন্ত ও শিশির মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া হাসিল। গৃহিণী চোখের জল মুছিয়া ভাঙা গলায় বলিলেন, “যাও বৌমা, তোমার শ্বশুর হুকুম দিয়ে গেলেন, আজকের মতো শুয়ে পড়োগে মা, কাল ওদের পরিবেশন করে খাইও।”

১৩ আষাঢ় ১৩৩৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *