কর্তব্যের আহ্বান – অনুবাদক: হীরেন্দ্রনাথ দত্ত

কর্তব্যের আহ্বান

পিয়াৎসা মারিনার উপর সারোপুলেৎসোর ওষুধের দোকান। দোকানের বাইরে একটি টুল পাতা। পাওলিনো লোভিকো টুলটার উপর ধপ করে বসে পড়ল। গরমে মুখ তার লাল, টস টস করে মাথার ঘাম গালের ওপর গড়িয়ে পড়ছে। রুমালে ঘাম মুছে দোকানের দিকে তাকিয়ে পাওলিনো সারোপুলেৎসোকে জিজ্ঞেস করল: ‘দোকানে এসে ফের আবার বেরিয়ে গেছে না কি?’

‘কে, গিগি? না তো, এই এল বলে। কেন?’

‘কেন আবার কী? ওকে আমার দরকার, তাই। কেন? ওঁর কাছে আমার এখন জবাবদিহি করতে হবে।’

ঘামে ভেজা রুমালটা মাথার ওপর বিছিয়ে দিয়ে, হাঁটুর উপর ভর দিয়ে পাওলিনো ঝুঁকে বসল। গালে হাত দিয়ে মলিন মুখে একদৃষ্টে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল।

পিয়াৎসা মারিনার সবাই ওকে চেনে। কিছুক্ষণ পরে একটি পরিচিত লোক ও রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল, ‘এই যে পাওলি যে!’

একটিবার চোখ তুলেই পরমুহূর্তে চোখ নাবিয়ে পাওলিনো বিড়বিড় করে বলল, ‘থাক থাক, যথেষ্ট হয়েছে। আমায় বিরক্ত করতে হবে না।’

আরেকজন যেতে যেতে বলে, ‘পাওলি যে! কী ব্যাপার?’

এবার লোভিকো মাথার উপর থেকে রুমালটা সরিয়ে, টুলের উপর ঘুরে বসে, প্রায় দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে।

‘শরীরটা ভাল নেই না কি?’ সারোপুলেৎসো ভেতর থেকে প্রশ্ন করে। আচমকা দোকানের ভেতর হুড়মুড় করে ঢুকে পাওলিনো রাগে কাঁপতে থাকে।

‘জাহান্নামে যাও, মরণ হয় না। আমার শরীর ভাল কি মন্দ তোর তাতে কী বাপু। আমি কি তোকে শুধোতে যাই তোর অসুখ করেছে কি না, কী ব্যামো, কদ্দিনের ব্যামো? লোকটাকে একদণ্ড চুপচাপ থাকতে দে না বাবা।’

‘বাব্বাঃ, কী মেজাজ,’ সারো বলে, ‘কথায় কথায় ফোঁস করে ওঠে! গিগির খোঁজ করছিলে তাই তো ভাবলুম…’

মুখ ভেংচিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে লোভিকো বলে, ‘কেন রে বাপু, আমি ছাড়া জগতে আর কারও অসুখ হতে নেই বুঝি? যদি বলি আমার কুকুরের ভেদবমি শুরু হয়েছে, আমার মুরগির হাঁপানি… নিজের কাজটি নিজে করো তো বাবা, পরের কথায় তোমাকে থাকতে হবে না।’

সারো হাসতে হাসতে বলে, ‘এই যে গিগি এসে গেছে।’

গিগি পুলেৎসো ব্যস্তভাবে দোকানের মধ্যে ঢুকে সোজা চিঠির বাক্স খুলে দেখতে লাগল জরুরি চিঠি কিছু আছে কি না।

‘এই যে পাওলি।’

প্রতি-অভিবাদন না করেই পাওলিনো জিজ্ঞেস করল, ‘খুব যে ব্যস্ত দেখছি!’

ডাক্তার গিগি পুলেৎসো দুঃখের সঙ্গে বলে, ‘নিশ্বাস ফেলবার সময় নেই ভাই।’ টুপিটা পেছন দিকে ঠেলে দিয়ে রুমাল ঘুরিয়ে হাওয়া করতে থাকে। ‘দু’দণ্ড জিরোবার উপায় নেই, সারাক্ষণ কাজ আর কাজ।’

রাগে ঠোঁট বেঁকিয়ে, ঘুসি পাকিয়ে পাওলিনো বলে, ‘তা তো বলবেই। মড়ক লেগেছে, দেশ উজাড়। অসুখটা কী শুনি? কলেরা? প্লেগ? ক্যান্সারে তোমার রুগিগুলো টপাটপ মারা যাচ্ছে? মরুকগে । আমি এদিকে বেঁচে মরে আছি— আমার বেলা কী করছ শুনি? আমার কথাটা আগেভাগে তোমায় শুনতেই হবে।… বলি ও সারো, হাঁ করে শুনছিস কীরে? তোর ওষুধ মাড়বার কাজ নেই বুঝি?’

‘নাই-বা থাকল তাতে তোমার কী?’

গিগি পুলেৎসোর হাত ধরে ওকে প্রায় টেনে দোকানের বাইরে এনে লোভিকো বললে, ‘ওখানে কথা হবে না, চলো অন্য কোথাও যাই।’ রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে গিগি জিজ্ঞেস করল, ‘কথাটা খুব লম্বা নয় তো?’

‘হুঁ, অনেক কথা আছে।’

‘তা হলে বলে রাখি ভাই, আমার হাতে সময় খুবই অল্প।’

‘তা তো বলবেই সময় নেই। বেশি বাড়াবাড়ি করলে কী করব জানো? ট্রামের তলায় পড়ব, নিজের পা-টি ভাঙব, অর্ধেক দিন তা হলে বাধ্য হয়ে আমার হেফাজত করতে হবে।…রুগি কোথায়?’

‘এই এইখানেই। ভিয়া বুতেয়ার উপর বাড়ি।’

লোভিকো বলল, ‘চলো সেখানে। তুমি উপরে গিয়ে রুগি দেখে এসো, আমি নীচের তলায় তোমার জন্য বসে থাকব। তোমার কাজ সারা হয়ে গেলে ফের আলাপ করা যাবে।’

ডাক্তার অবাক হয়ে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ল। বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, ব্যাপারখানা কী বলো তো?’

একটা দারুণ হতাশার ভঙ্গি করে হাতের তেলো উলটে প্রায় কাঁদো-কাঁদো ভাবে পাওলিনো বলল, ‘গিগি ভাই, এবার আমার রক্ষে নেই।’ সত্যই ওর চোখ জলে ভরে এল।

ডাক্তার বলল, ‘কী হয়েছে সোজা বলেই ফেলো না। দাঁড়িয়ে পড়লে কেন, চলতে শুরু করো। কী ব্যাপার ঠিক করে বলো তো?’ কয়েক পা এগিয়ে আবার ডাক্তারের হাত জড়িয়ে ধরে পাওলিনো গভীর রহস্যের সুরে বলল, ‘দেখো ভাই, বন্ধুভাবে বলছি। তা না হলে একটি কথাও বলতাম না। আর তা ছাড়া ডাক্তারের কাছে তো পেট খোলসা করে সব কথা বলা চলে কেমন কি না?’

‘তা তো বটেই। কতরকম অসুখ বিসুখের কথা লোকে বিশ্বাস করে আমাদের কাছে বলে— সব গোপন রাখতে হয়।’

‘বেশ তা হলে ভাই আমার কথাটা তোমাকে বলি। খবরদার কাকপক্ষীও যেন না জানতে পারে।’

ভুঁড়ির ওপর একটি হাত রেখে গম্ভীরভাবে পাওলিনো বলল, ‘যাকে বলে একেবারে পাথরের মতো নিস্তব্ধ কেমন?’ চোখ দুটো বড় বড় করে গিগির কানে কানে পাওলিনো বলল, ‘জানো পেতেল্লার দু’-দুটো সংসার।’

গিগি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘পেতেল্লা? সে আবার কে?’

লোভিকো চেঁচিয়ে ওঠে, ‘আরে তাও জানো না, ক্যাপটেন পেতেল্লা— সেই যে জেনারেল স্টিম-শিপ কোম্পানিতে…’

ডাক্তার পুলেৎসো বলল, ‘মানুষটাকে চিনি না তো।’

‘চেনো না তাকে? বেশ কথা— তা হলে তো ভালই হল। কিন্তু চেনো বা না চেনো, স্পিকটি নট। একেবারে পাথরের মতো চুপ…’ পাওলিনোর গলা ধরে উঠল, করুণভাবে বলল, ‘দু’-দুটো সংসার ভাই, দু’-দুটো! একটি এখানে আর একটা নেপলসে।’

‘তারপর?’

‘ওঃ, কথাটা বুঝি খুব ফেলনা হল?’ হঠাৎ রাগে মুখ-চোখ পাকিয়ে পাওলিনো লোভিকো জিজ্ঞেস করল, ‘বিয়ে করা স্ত্রীকে ফেলে কাপ্তেন ব্যাটা আর-একটা মেয়েমানুষের সঙ্গে বসবাস করছে— সেটা বুঝি কিছু নয়। হা ভগবান, এরকম অন্যায় কাজ ভদ্দরলোকে করে! এ করে তো ম্লেচ্ছরা।’

‘ম্লেচ্ছরাই করে বটে! কিন্তু আমি জানতে চাই এতে তোমার কী এল গেল? এত মাথাব্যথা কেন?’

‘আমার কী এল গেল! মাথাব্যথা কেন!’

‘হ্যাঁ, এতে রাগ করার কী আছে? পেতেল্লার স্ত্রী তোমার কিছু হয় নাকি?’

রেগে চোখ লাল করে লোভিকো বলল, ‘নাই-বা হল। সে বেচারি ভারী কষ্টে পড়েছে জানো? বড় ঘরের মেয়ে, তাকে নির্লজ্জ স্বামীটা কী রকম প্রতারণা করছে জানো? ওর আত্মীয় নাই-বা হলুম। এ সব অন্যায় দেখে রাগে সর্ব শরীর জ্বলে যায় না?’

কাঁধের একটা ভঙ্গি করে গিগি পুলেৎসো জিজ্ঞেস করল, ‘তা না হয় মেনে নিলুম, কিন্তু আমি কী করতে পারি এতে?’

লোভিকো ফোঁস করে বলে উঠল, ‘সে কথা আমায় বলতে দিচ্ছ কই! নিপাত যাক হতভাগা! কী বিশ্রী গরম দেখছ? সমস্ত শরীরটা ফুটিফাটা হয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, কী বলছিলুম শোনো এখন… এই যে পেতেল্লার কথা বলছিলুম— ভদ্রলোকটি কেবল যে তার স্ত্রীকে ঠকিয়েছে তা নয়। শুনছি নেপলসে তার তিন-চারটে ছেলে আর এখানে কেবল একটি সবেধন নীলমণি। হতভাগা ওর স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করবে না। ও-পক্ষের ছেলেপুলেগুলো জারজ তো, তাই ওদের সম্বন্ধে পেতেল্লার কোনও দুর্ভাবনা নেই, ইচ্ছে হলেই ত্যাগ করতে পারে। এখানে তো আর সেটি হতে পারবে না। এ পক্ষে ছেলে হলে আইনত তাকে স্বীকার করে নিতে, তার ভরণপোষণ করতে ও বাধ্য। বদমাশটা কী করে জানো? আজ প্রায় বছর দুই হয়ে গেল এখানে জাহাজ ভিড়লেই ও সেই দিনই কোনও সামান্য ছুতোয় স্ত্রীর সঙ্গে ইচ্ছে করে ঝগড়া বাধায়। তারপর রাত্তির হলে নিজের ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে একা একা শুয়ে থাকে। পরদিন জাহাজ ছাড়ে, আর এ পক্ষের যত সব ভাবনা চিন্তা ছেড়ে পেতেল্লা চলে যায়। একদিন নয় দু’দিন নয়, আজ দু’বছর হল এই রকম চলছে।’

গিগি পুলেৎসোর দুঃখও হয়, হাসিও পায়। বলে, ‘আহা বেচারি! আমি কিন্তু এখনও বুঝতে পারছি না— আমি…’

গলার সুরটা নরম করে বন্ধুর হাত ধরে লোভিকো বলে, ‘ভাই গিগি, আজ মাস-চারেক হল আমি ওই ছেলেটিকে— পেতেল্লার ছেলেকে— ল্যাটিন পড়াচ্ছি। দশ বছর বয়স, প্রথম বর্গে পড়ে।’

ডাক্তার বললে, ‘ও!’

‘ভদ্রমহিলার জন্য আমার কী দুঃখ হয় তুমি যদি জানতে! বেচারি কী কান্নাটাই না কাঁদে! যেমনি লক্ষ্মী তেমনি রূপসী! আর কুৎসিত হলেও-বা একটা কথা ছিল… সত্যি সে ভারী সুন্দর দেখতে। ভেবে দেখো কেমন লাগে, যখন দেখি বেচারিকে ঘেন্নায় এক পাশে ফেলে রেখেছে। আমি জানতে চাই কে এমন ব্যবহার মুখ বুজে সহ্য করত— অন্য মেয়ে হলে এতদিন একটা কাণ্ড বাধিয়ে দিত। ওকে দোষ দেওয়া যায় না। ও এত ভদ্র— এত ভালমানুষ। ওকে ভাই যে করে হোক বাঁচাতেই হবে। বুঝলে তো? ও বেচারি এখন কী মুশকিলেই পড়েছে— যাকে বলে গিয়ে বিপদ— রীতিমতো বিপদ।’

গিগি পুলেৎসো হঠাৎ দাঁড়িয়ে, কড়া চোখে লোভিকোর দিকে তাকাল, বলল, ‘না, না, ভাই, ওসব কাজ আমার দ্বারা হবে না। আইনের প্যাঁচে আমি পড়তে রাজি নই।’

‘আহাম্মুক কোথাকার, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে, শেষকালে তুমি এই বুঝলে? আমাকে ভেবেছ কী? আমি কি দুশ্চরিত্র? তুমি কি ভাবছিলে তোমাকে দিয়ে…ছিঃ ছিঃ ছিঃ ছিঃ ভাবতেও ঘেন্না হয়।’

‘তা হলে আমাকে দিয়ে কী করাতে চাও শুনি, বুঝিয়েই বলো না—’ ডাক্তার পুলেৎসো অধীর হয়ে চেঁচিয়ে বলল।

‘যা হওয়া উচিত আমি তাই শুধু চাই।’ পাওলিনো লোভিকো উলটে চেঁচাল, ‘আমি চাই যে পেতেল্লা যেন একটি ভদ্রগোছের স্বামী হয় আর যেন বাড়ি এসে ওর স্ত্রীর একেবারে মুখের সামনে দড়াম করে শোবার ঘরের দরজাটা বন্ধ করে না দেয়।’ গিগি পুলেৎসো হো হো করে হেসে উঠল, ‘কী— কী— কী বললে? কী বলছ… হাঃ হাঃ হাঃ… পেতেল্লাকে নিয়ে কী করব— পেতেল্লাকে নিয়ে… ঘোড়াকে জোর করে ধরে নিয়ে যাব জল খাওয়াতে— হাঃ হাঃ হাঃ…’

পাওলিনো লোভিকো উত্তেজিত হয়ে, ঘুসি পাকিয়ে বলল, ‘তা হাসবে বই কী ছোটলোক কোথাকার, এদিকে একজনের সর্বনাশ হতে চলেছে আর তুমি হাসছ— বদমাশ বেটা তার সামাজিক কর্তব্য করবে না— আর তুমি ঠাট্টা করছ— একটি মেয়ের আত্মসম্মান এমনকী তার জীবন পর্যন্ত বিপন্ন— আর তুমি তা নিয়ে তামাশা করছ! আমার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, আমি তো একরকম মরেই আছি। এ বিপদ থেকে যদি না উদ্ধার করো, তা হলে আমি সমুদ্রের জলে ডুবে আত্মহত্যা করব— জেনে রাখো।’

হাসি চাপবার চেষ্টা করতে করতে পুলেৎসো বলল, ‘আমি কী করতে পারি?’ এবার পাওলিনো লোভিকো একেবারে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ল— ডাক্তারের হাতটা শক্ত করে ধরে বিমর্ষভাবে বলতে লাগল, ‘ব্যাপার কী জানো? পেতেল্লা আজ সন্ধেবেলা এসে আবার কালকেই প্রায় এক মাসের জন্য বেরিয়ে পড়বে— ওর জাহাজ যাচ্ছে স্মার্না। দেরি করলে চলবে না, আজই সব ব্যবস্থা করতে হবে, তা নইলে আর হবে না। দোহাই, গিগি আমাকে বাঁচাও— ওই দুঃখিনীকে রক্ষা করো। একটা পথ তুমি নিশ্চয়ই বাতলে দিতে পারবে— একটা কোনও উপায়… খবরদার, হেসো না বলছি, গলাটা টিপে দেব না!… আরে আরে আমি কি তাই বলছি হাসো, হাসো, যত পারো হাসো, আমার অবস্থাটা দেখে হাসি তো পাবেই কিন্তু একটা উপায় তোমাকে বার করতেই হবে— একটা কোনও ওষুধ।’

ইতিমধ্যে গিগি পুলেৎসো ভিয়া বুতেরার উপর সেই বাড়ির কাছে পৌঁছে গিয়েছে কোনও রকমে হাসি চেপে সে বলল, ‘অর্থাৎ কিনা তুমি চাও যে আজ রাত্তিরটায় ক্যাপটেন তার স্ত্রীর সঙ্গে কোনও অছিলায় ঝগড়া না বাধাতে পারে। এই তো?’

‘ঠিক বলেছ…।’

‘আচ্ছা শোনো, আমি এখন ওপরে যাচ্ছি। তুমি সোজা সারোর ওষুধের দোকানে গিয়ে অপেক্ষা করো, আমি শিগগিরই ফিরছি।’

‘কিন্তু তোমার মতলবটা কী বলো তো?’

‘সে কথা তোমাকে ভাবতে হবে না, তুমি সারোর ওখানে অপেক্ষা করোগে।’

‘আচ্ছা, চটপট চলে এসো ভাই’ — অনুনয়ের সুরে লোভিকো বলল।

সূর্য তখন অস্ত যায়-যায়। কী একটা অহেতুক ইচ্ছা পাওলিনোকে টেনে নিয়ে চলল জেটির দিকে— যেখানে পেতেল্লার জাহাজ ‘সেজেস্তা’ এসে ভিড়বে। পেতেল্লাকে ওর দেখা চাই, দূর থেকে হলেও ক্ষতি নেই। কেবল চোখে দেখা, আর ওকে উদ্দেশ্য করে গালাগাল দেওয়া— এ দুটো কাজ ওকে যেন করতেই হবে। সারাদিন ও যে উত্তেজনার মধ্যে কাটিয়েছে ডাক্তার পুলেৎসোর সাহায্য পেয়ে ভেবেছিল সে ঘোরটা কেটে যাবে। কিন্তু বৃথা আশা। সিনোরা পেতেল্লার হাতে পাওলিনো বশীকরণের ওষুধ পৌঁছে দিয়েছে। মিষ্টি জিনিসে ক্যাপটেনের রুচি আছে জেনে ডাক্তার একটি মোদক তৈরি করে দিয়েছে। সিনোরার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ও এদিক ওদিক গরঠিকানা ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এদিকে ওর মানসিক উদ্বেগ বেড়েই চলেছে।

সন্ধে হল। বাড়ি ফেরার নাম নেই। ঘুম চুলোয় গেছে। ঘুরছে তো ঘুরছেই। ঘুরে ঘুরে ক্লান্তি ধরে গেল। মেজাজ বিগড়ে গেছে এমন যে লোভিকোর নিজেরই ভয় হচ্ছিল পাছে কারও সঙ্গে ঝগড়া বেধে যায়। বন্ধুবান্ধবের তো কমতি নেই, তাদের মধ্যে কেউ যদি-বা বেফাঁস কথা বলে ফেলে? বেচারার মনটা বড় সাদা, সেই তো মুশকিল। কোনও কথা চেপে রাখতে পারে না, তাই ওর বন্ধুরা ওকে নিয়ে সারাক্ষণ মজা করে। ওরা নিজেরা সব চালাক লোক, ভদ্রতার মুখোশের তলায় মনের কথা দিব্যি চাপা দিতে পারে। মানুষের গভীরতম অনুভূতি, এমনকী গভীরতম বেদনার নিরাবরণ প্রকাশকে ঠাট্টার বিষয় করে তুলতে ওদের বাধে না। হয়তো ওদের জীবনে কখনও ওই জাতীয় অভিজ্ঞতা ঘটেনি অথবা ওদের প্রকৃতি এমনি স্থূল যে পাওলিনোর মতো সাদাসিধে স্বভাব বোঝবার ক্ষমতাটাই ওরা হারিয়ে ফেলেছে।

বাড়ি ফিরে এসেই ও সোজা গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল, কাপড়জামা না ছেড়ে। সিনোরার করুণ মুখখানা থেকে থেকে মনে পড়ছে। সেই যখন ডাক্তারের দেওয়া ওষুধটা ওর হাতে দিল তখন বেচারির মুখ কী মলিন দেখাচ্ছিল। চোখে এমন একটা উদ্বেগের দৃষ্টি মুখ— থেকে সবটুকু সৌন্দর্য যেন মুছে গেছে।

ধরা গলায় পাওলিনো বলল, ‘মুখে হাসি নেই কেন? একটু সেজে-গুজে নাও। তোমার সেই জাপানি সিল্কের ব্লাউজটা পরে নাও! ওটা পরলে তোমাকে বেশ দেখায়। দেখো, ও এসে যেন তোমার ব্যাজার মুখ না দেখে। তোমার ভাবনা-চিন্তা সব রাখো। সব গোছগাছ করে রেখেছ তো? দেখো, যেন কিছুতে খুঁত ধরতে না পারে। আচ্ছা, আমি এখন চলি, কাল আবার দেখা হবে। কিছু ভয় নেই সব ঠিক হয়ে যাবে। হ্যাঁ, একটা কথা। তোমার এই শোবার ঘরের জানালায় রুমাল ঝোলাবার কথা ভুলো না কিন্তু। সকালে উঠেই আমি দেখে যাব। সংকেতটার কথা ভুলো না, লক্ষ্মীটি।’

ও বাড়ি থেকে বেরুবার আগে ছেলেটার ল্যাটিন খাতায় নীল পেন্সিল দিয়ে বড় বড় অক্ষরে দশের মধ্যে দশ বসিয়ে গেল। ছেলেটির এমনিতেই বুদ্ধিশুদ্ধি একটু কম— এই অভাবনীয় আতিশয্যে আরও যেন বুদ্ধি গুলিয়ে গেল। পাওলিনো ওর পিঠ চাপড়ে বলল, ‘ভয় কী রে। বাবা এলে খাতাটা দেখাস; দেখবি কত খুশি হবে। এ ভাবে লেখাপড়া করে যাস তো দেখিস একদিন বড় বড় ল্যাটিন পণ্ডিতদেরও তুই ছাড়িয়ে যাবি। অত গোমড়ামুখো কেন? আজ তো ফুর্তি করবার দিন, তোর বাবা আসছে। লক্ষ্মী ছেলেটি হয়ে থাকিস। দেখি নখগুলো— পরিষ্কার আছে তো? বেশ বেশ, ঠিক আছে। নোংরামো করিস না যেন।’

যাবার আগে আবার একদফা পিঠ চাপড়ে বলে গেল, ‘সাবাস ছেলে আমাদের নোনো!’

শুয়ে শুয়ে পাওলিনো আবার ভাবছে, ‘কিন্তু সেই ওষুধটা। পুলেৎসো ব্যাটা বোকা বানায়নি তো! না, না, সে কি হয়। সে এত করে ডাক্তারকে বুঝিয়েছে ব্যাপারটা কত গুরুতর। নিতান্ত পাজি না হলে পুলেৎসো ঠকাবে না। কিন্তু ওষুধটা যদি ঠিকমতো না ধরে?’

স্ত্রীর প্রতি ক্যাপটেনের দুর্ব্যবহারের কথা ভেবে ওর সর্বশরীর রাগে জ্বলতে লাগল— অপমানটা যেন ওরই গায়ে বিঁধছে। হ্যাঁ, অপমান নয় তো কী? পাওলিনো লোভিকোর মতো লোক যে মেয়েকে দেখে মুগ্ধ, যাকে পেলে সে বর্তে যায় তাকে কিনা পেতেল্লার মতো একটা নিতান্ত ছোটলোক ঘৃণা করে দূরে সরিয়ে রাখে। যেন পাওলিনো লোভিকোর মতো লোক অপরের পাতের উচ্ছিষ্ট পেয়েই খুশি— যে মেয়েকে অপর একজন পায়ে ঠেলে দিলে, তাকে পেয়েই হাতে স্বর্গ পেল। কীসের সঙ্গে কীসের তুলনা! নেপলসের ওই বদ মেয়েটা ওর স্ত্রীর চাইতে ভাল হল— দেখতে বেশি সুন্দর! একবার ওদের দু’জনকে পাশাপাশি দেখলে হত— তা হলে ক্যাপটেনের মুখের ওপরেই বলতে পারত— চোখের মাথা খেয়েছ, রুচি বলে পদার্থ নেই— জানোয়ার কোথাকার, কাকে ছেড়ে কাকে! ভাল করে দেখে নাও— এমন স্ত্রীকে ছেড়ে যেতেও মন চায়? নিতান্ত চাষাড়ে কিনা, তাই ওর রূপ তোমার চোখে পড়ে না— ওর ওই করুণ মুখের মাধুরী! তুমি পশু, তাই এসব সূক্ষ্ম জিনিস বুঝতে পারো না। আচ্ছা সেসব কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু একটা বেশ্যার সঙ্গে বিবাহিতা স্ত্রীর কোনও তুলনা হয়!

রাত্তিরটা যে কী ভাবে কেটে গেল, চোখে এক পলক ঘুম নেই! আর কতক্ষণ বিছানায় পড়ে ছটফট করা যায়। আকাশটা যেন ফ্যাকাসে হয়ে আসচে, ভোর হতে দেরি নেই। হঠাৎ ওর মনে হল সিনোরা আর তার স্বামী আলাদা ঘরে শোয়। হয়তো ওর দুর্ভাবনা ঘোচাবার জন্য সিনোরা রাত থাকতেই জানালায় রুমাল ঝুলিয়ে রেখেছে। সিনোরা তো জানে যে কিছুতেই ওর চোখে ঘুম আসবে না। ভোর হতে না হতেই সংকেত-চিহ্নটা দেখতে আসবে। এই ভেবে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ও পেতেল্লার বাড়ির দিকে চলল। মনে মনে ওর দৃঢ় ধারণা যে এতক্ষণে নিশ্চয়ই জানালার রুমাল ঝুলেছে। গিয়ে দেখলে রুমালের চিহ্নমাত্র নেই, বেচারি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। নেই, নেই, কিছু নেই। সব খড়খড়িগুলো বন্ধ, বাড়িটার কেমন যেন শোকাচ্ছন্ন চেহারা। হঠাৎ ওর মাথায় খুন চেপে গেল। সোজা সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাবে নাকি ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকে পেতেল্লার টুঁটি চেপে ধরবে? পর মুহূর্তে দারুণ অবসাদে পাওলিনো হাত-পা ছেড়ে ধপ করে বসে পড়ল— যেন সত্যিই ও খুন করেছে। কত করে ও মনকে প্রবোধ দিতে লাগল। মাঝরাত্রে উঠে লোভিকোর জন্য সংকেত ঝুলিয়ে রাখবে এতটা আশা করা অন্যায়। বেচারি বোধহয় ব্যস্ত ছিল, সময়ই পায়নি।

না, না, হতাশ হলে চলবে না; আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখা যাক। কিন্তু এ কী হল! দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না যেন; পায়ের তলা থেকে মাটি যেন সরে যাচ্ছে!

কোনও রকমে পা দুটো টেনে নিয়ে ও পাশের একটি গলিতে গিয়ে ঢুকল। ভাগ্যিস রাস্তার ওপর একটা কাফে খোলা ছিল— ছোটখাটো একটা রেস্তোরাঁ, ভোরবেলায় ডকের মজুরেরা সেখানে এসে আড্ডা জমায়। কাফেতে ঢুকে একটা বেঞ্চের উপর লোভিকো বসে পড়ল। কারও দেখা নেই। দোকান আছে, মালিক নেই। পেছনেই অন্ধকার ঘরটাতে দু’-একটা কথা শোনা যাচ্ছে। ওরা বোধকরি এতক্ষণে উনুনে আগুন দিয়েছে। কিছুক্ষণ বাদে একটা গুন্ডা গোছের লোক পাওলিনোর অর্ডার নিতে এল। লোভিকো ওর দিকে প্রথমটায় একটু বিরক্তভাবেই তাকাল। পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘একটা রুমা… না, না, না, এক কাপ কফি। বেশ কড়া হয় যেন।’

কফি এল। এক চুমুক খেয়ে লোভিকো তড়াক করে লাফিয়ে উঠল, ‘উঁহুহুহু— কী গরম, মুখটা পুড়ে গেল!’

‘কী হল স্যর?’

মুখটাকে যতদূর সম্ভব বিকৃত করে লোভিকো আর্তনাদ করে উঠল, ‘উঃ!’ রেস্তোরাঁর মালিক এক গ্লাস জল এনে বললে, ‘একটু জল খান ঠিক হয়ে যাবে।’

ওর ট্রাউজারের দিকে তাকিয়ে লোভিকোর মনটা হু-হু করে উঠল— সেখানে কফি পড়ে প্রকাণ্ড একটা দাগ হয়ে গিয়েছে। রুমাল বের করে একটি কোনা জলে ভিজিয়ে খুব কষে দাগটার উপর ঘসতে লাগল। আর কিছু না হলেও ফোস্কার উপর ভিজে রুমালের স্পর্শটা বেশ ভালই লাগল। ভিজে রুমালটা টেবিলের উপর বিছিয়ে দিতে গিয়ে ওর হঠাৎ আবার রুমালের কথা মনে পড়ে গেল। ট্রের ওপর দামটা ফেলে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল কাফে থেকে। গলির মোড় ঘুরতে না ঘুরতেই মুখোমুখি দেখা ক্যাপটেন পেতেল্লার সঙ্গে!

‘এ কি, আপনি যে এ অসময়ে?’

পাওলিনোর মনে হল ওর শরীরের সমস্ত রক্ত যেন জল হয়ে গিয়েছে। আমতা আমতা করে বলল, ‘হ্যাঁ আমি… একটু… সকাল- সকাল উঠলাম কিনা… তাই…’ ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে পেতেল্লা বললে, ‘তাই বুঝি ভোরের ঠান্ডা হাওয়া খেতে বেরিয়েছেন। কপাল ভাল, ভাবনা নেই, চিন্তা নেই, পরিবার নেই সুতরাং বন্ধনও নেই… একেই বলে সুখের জীবন…’

লোভিকো পেতেল্লার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করল ব্যাপারখানা কী। ঠিক ও যা ভয় করেছিল তাই হয়েছে। নইলে এই সকালে বাড়ি ছেড়ে…

ক্যাপটেনের চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল। নিশ্চয় হতভাগা আবার ওর স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করেছে। ওকে খুন করতেই হবে। মনের ভাব গোপন রেখে বলল, ‘কিন্তু আপনিও যে…’

‘আমি? আমি আবার কী করলাম?’

‘আপনিও এত সকাল-সকাল…?’

‘ও, আমি এই সকালবেলা বেরিয়ে পড়েছি কেন তাই জিজ্ঞেস করছেন? কী বলব প্রোফেসর সাহেব বিশ্রী কেটেছে রাতটা। যা গরম…।’

‘কী বললেন… ভাল ঘুম হয়নি?’

বিরক্তির সুরে পেতেল্লা বলল, ‘একবিন্দুও না। আর, ঘুমুতে না পেলে আমার মেজাজ একেবারে বিগড়ে যায়।’

লোভিকোর সমস্ত শরীরটা যেন কেঁপে উঠল। কাষ্ঠ হাসি হেসে বলল, ‘কিছু মনে করবেন না, কিন্তু রাগটা কার ওপর? আপনার ঘুম যদি না আসে তা হলে অন্য লোকের কী দোষ?’

‘অন্য লোকের দোষ আমি দিয়েছি না কি? আপনি তো বেশ কথা বললেন, মশাই।’

‘কেন, এই তো বললেন ঘুম না হলে মেজাজ বিগড়োয়, চটে যান। চটে যান কার উপর? রাত্রে যদি গুমোট গরম হয় তা হলে সেটা কি অপর লোকের দোষ?’

‘কেন নিজের উপরেই চটি, সবকিছুর উপরই রাগ হয়। আমি চাই খোলা হাওয়া, চিরটা কাল জাহাজে-জাহাজে কাটিয়েছি কি না। ডাঙা আমার ধাতে সয় না, বিশেষ এই গরমিকালে… সারি সারি বাড়ি, দেয়াল, দুর্ভাবনা… স্ত্রী-পুত্র-পরিবার…’

লোভিকো নিজের মনে ভাবছে যে খুন একে করতেই হবে। বাইরে কিন্তু এখনও সেই বিনয়ের হাসি হেসে বলল, ‘স্ত্রীলোকদের আপনার ভাল লাগে না বুঝি?’

‘স্ত্রীলোক? দেখো মাস্টার, বেশির ভাগ সময়ই তো জাহাজে কাটাই। মেয়েমানুষের মুখ খুব কমই দেখি। এখন তো বুড়ো হয়ে গেছি… এখনকার কথা আলাদা। কিন্তু যখন যৌবন ছিল তখন মেয়েদের ভাল লাগত বই কী! তবে কিনা যাকে বলে উদ্দাম ভাল লাগা এ আমার কখনও ঘটেনি। ইচ্ছে হল গেলাম। ইচ্ছে না হল গেলাম না।’

‘তা সবসময় কি মনকে বেঁধে রাখা যায়?’ (খুন! খুন!)

‘নিশ্চয়। তবে ইচ্ছে নিয়ে কথা। আপনার বেলা উলটো বুঝি? সহজেই ধরা দিয়ে ফেলেন তো? একটু ভঙ্গিমা, সলজ্জ চোখের চাউনি— ব্যস, শ্রীচরণকমলেষু! কেমন না, সত্যি বলুন দেখি?’

লেভিকো স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলল: ‘সত্যি বলব? যদি আমার স্ত্রী থাকত…’

‘আরে রাখুন মশাই, স্ত্রীদের কথা হচ্চে না। স্ত্রীর সঙ্গে আবার প্রেম কী? আমি বলছিলাম স্ত্রীজাতির কথা।’ এই বলে পেতেল্লা হো হো করে হেসে উঠল।

‘স্ত্রীরা কি স্ত্রীলোক নয়?’

‘স্ত্রীলোক হবে না কেন… তবে সব সময় নয়, কখনও কখনও। কিন্তু মাস্টার, আপাতত আপনার তো স্ত্রী নেই। ভগবান যেন আপনার এই সুখের আইবুড়ো অবস্থা কখনও না ঘোচান। স্ত্রীরা, বুঝলেন কিনা…’

পেতেল্লা লোভিকোর হাতের ভিতর হাত গলিয়ে অনর্গল বকে যেতে লাগল। এদিকে লোভিকোর মন ক্রমাগত প্রশ্ন করে চলেছে। সে কেবল তাকায় পেতেল্লার মুখের দিকে— ওর চোখ দুটো কেমন ফোলাফোলা। চোখের কোলে কালি পড়েছে। তবে কি সত্যিই ওর ভাল ঘুম হয়নি…হয়তো…। এদিকে এক-একটা কথার ভাব-ভঙ্গিতে হঠাৎ মনে আশা হয় বেচারি সিনোরার বুঝি এতদিনে কপাল ফিরেছে। আবার পরক্ষণেই সন্দেহে হতাশায় ওর মনটা দমে যায়। এ যেন দগ্ধে দগ্ধে মরা। আর সহ্য হয় না। পেতেল্লা হাঁটছে তো হাঁটছেই। ওকে সুদ্ধু টেনে নিয়ে সমুদ্রের ধারের সমস্ত রাস্তাটা এ মোড় থেকে ও মোড় অবধি ঘুরে তারপর বাড়ির দিকে ফিরতে শুরু করল।

লোভিকো ভাবছে, ‘আমি ওর সঙ্গ ছাড়ছি না। ওর সঙ্গে ওদের বাড়ি যাব, দেখব— পেতেল্লা ওর কর্তব্য করেছে কি না। যদি না করে থাকে তবে হয় এসপার নয় ওসপার।’

পেতেল্লার প্রাণ নেবার জন্য ও দৃঢ়সংকল্প। ওর সমস্ত মনটা নিদারুণ ঘৃণার বিষে জর্জর। অন্য কোনও দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।

মোড় ঘুরতে গিয়ে হঠাৎ দৃষ্টি পড়ল পেতেল্লার বাড়ির জানলার দিকে। ও দাঁড়িয়ে পড়ল স্থাণুর মতো— শরীর থেকে সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। জানলার দিকে তাকিয়ে দেখে এ কী! এক… দুই… তিন… চার… পাঁচ… পাঁচ-পাঁচটা রুমাল উড়ছে!

পাওলিনো হাঁ করে দেখতে লাগল। আনন্দের আবেগে ওর প্রায় দম বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়। পিছন থেকে ক্যাপটেন ওকে ধরে ফেলল, নইলে তো পড়েই যাচ্ছিল! ‘কী হয়েছে, মাস্টার! অমন করছ কেন?’

‘ক্যাপটেন ভাই, কী বলে তোমায় ধন্যবাদ দেব! কী খুশিই না হয়েছি… সুন্দর কাটল সকালটা… এখন ভারী ক্লান্ত লাগছে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। ধন্যবাদ, বন্ধু! এবার চলি। যাত্রা তোমার সুখের হোক। বিদায় হই এবার। আবার তোমায় ধন্যবাদ দিই বন্ধু— ধন্যবাদ।’

পেতেল্লা তার বাড়ির ভেতর ঢুকতে না ঢুকতেই পাওলিনো বিশেষ উত্তেজিত ভাবে রাস্তার উপর দিয়ে হনহন করে হাঁটতে লাগল। কী তার উল্লাস; গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে আনন্দে! একেবারে আহ্লাদে আটখানা! চোখমুখের ভাব এমন যেন এক্ষুনি দিগ্বিজয় করে এসেছে। রাস্তায় যাকে পাচ্ছে তাকেই দেখাচ্ছে ডান হাতের পাঁচ-পাঁচটা আঙুল—

—হীরেন্দ্রনাথ দত্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *