কর্ণফুলির ডাক – সুবোধ ঘোষ
বোমা পড়েছে দেড় হাজার মাইল দূরে জোহারবাবুর জাঙ্গাল আর সিঙ্গাপুরের জাহাজ ঘাটায়। হাজার লোকের জীবন্ত ধড় ছিটকে পড়ল হাওড়া আর শেয়ালদা স্টেশনে।
মামাবাড়ির গাঁ সম্পর্কে এক দিদিমাকে শেয়ালদার ট্রেনে তুলতে এসে ধ্রুবেশ এই দৃশ্য দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। পালাচ্ছে সবাই— ছেলে মেয়ে জোয়ান বুড়ো সবাই, সব জাতের লোক। আধমরা, উদ্ভ্রান্ত, ফ্যাকাসে সব চেহারা, চোখ ঠিকরে পড়ছে, হিসেবের ঠিক নেই—কাশছে হাঁপাচ্ছে চিৎকার করছে।
ভয় পেলে পালায় সবাই। শিকারির গুলির আওয়াজে হরিণের পালও ভয়ে ছুটে পালায়। নদীর বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে ছোট ছোট জলস্রোত ভিঙিয়ে, হঠাৎ ডাইনে হঠাৎ বাঁয়ে মোড় ঘুরিয়ে ঘুর্ণি হাওয়ার মতো দাপিয়ে চলে যায় তারা। অন্তরঙ্গতার ছন্দে বাঁধা সে ভয়ও কত সুন্দর, কত বেগবান!
আর এখানে। যাত্রী নেবার জন্য একটা স্পেশ্যাল প্ল্যাটফর্মে এসে ঠেকল। বাতিল মানুষের পাল কুৎসিত গর্জনে ভূতের ঢিলের মতো এলোপাথাড়ি ছিটকে পড়ল আবার। কামরার দরজায় দরজায় শুরু হল হুল্লোড় হাতাহাতি।
সেকেণ্ড ক্লাসের দশাও তাই। ভিড় ঠেলে দিদিমাকে নিয়ে কামরার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ধ্রুবেশ। হঠাৎ পেছন থেকে সুটকেস কাঁধে নিয়ে এক ভদ্রলোক হুমড়ি খেয়ে পড়লো। কনুইয়ের একটি ধাক্কায় দিদিমাকে বসিয়ে দিল সেইখানেই। ধ্রুবেশ তার গলাটা টিপে ধরবার আগেই কামরার আরোহীদের ভিড়ে লোকটা ছারপোকার মতো অদৃশ্য হয়ে গেল।
বাড়িতে। ঝি বটার মা ছিল ভাল। বেঁকে বসল এবার। সে দেশে চলে যাবে। কোঁদল করে ধ্রুবেশ ও রমাকে অস্থির করে তুলল। তার পাওনা পয়সাকড়ি আজই মিটিয়ে দেওয়া হোক। তাকে বোঝাতে গিয়ে হার মানল ধ্রুবেশ। ভদ্রাভদ্র কত লোকের মুখে বটার মা সেই গোপন কথাটা শুনে ফেলেছে—জাপানিরা এসে গেছে। মেয়ে মানুষের ছদ্মবেশে। কাল রাত্তিরে তাদের ক’জনকে চক্কোত্তিবাবুদের আমবাগানে দেখা গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। তারপর কাছেই কোথায় লুকিয়ে পড়েছে।
বটার মা রইল না।
হরবিলাস বাবুর বাড়ি। অতি দূর সম্পর্কে ধ্রুবেশের মামা। বড়লোক এবং বাড়িওয়ালা। পথে যেতে সন্ধ্যাবেলা ধ্রুবেশ হঠাৎ এসে ঢুকল। হলঘরে জাজিমের ওপর হরবিলাস মামার চারটি ঘরজামাই চারকোণে তাকিয়ে আঁকড়ে ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়ছে। স্বয়ং মামা একটা নতুন বাড়ির নকশা মনোযোগ দিয়ে দেখছেন।
ধ্রুবেশ একটু বিস্মিত হয়েই বলল—এ কী? আপনারা এখনও আছেন!
মামা—কেন বল তো?
—যুদ্ধ, চারদিকে পালাবার হিড়িক। সিঙ্গাপুরে বোমা পড়েছে।
মামা তাকিয়ে রইলেন। ঘরজামাই চারজন চারকোণ থেকে আস্তে আস্তে মাথা তুলে তাকলে। শুনতে পেয়েছে বলে মনে হল না, ধ্রুবেশের কথাগুলিকে তারা যেন দেখছে। নির্ব্বিকার নির্লিপ্ত অতি প্রশান্ত সাদা সাদা চোখ।
চাকরে একটা পাথরের বাটিতে মধু মকরধ্বজ নিয়ে এল। মামা চাটতে চাটতে বললেন—দিদিমণিকে বলে দাও, রাত্রে লুচি খাব।
ধ্রুবেশ আবার যুদ্ধের প্রসঙ্গ নিয়ে এল। —যুদ্ধটা সকলকে ভাবিয়ে তুলেছে খুব।
কোনও লাভ হল না। জোড়া জোড়া সাদা চোখগুলি তেমনি তাকিয়ে রইল। মোহেঞ্জোমড়ারা যেন তাকিয়ে আছে।
ধ্রুবেশ অগত্যা উঠল। এরা কিছুরই ধার ধারে না। এই পরমাণুর জগৎ যদি ভেঙে গলে একটা নীহারিকার আবর্ত তোলে, তবু মামা নিশ্চয় তাঁর বাড়ি ভাড়া আদায় করে যাবেন আর রাত্রে লুচি।
বেরিয়ে আসার সময় চোখে পড়ল অফিস ঘরে খাতাপত্র নিয়ে বসে আছে লক্ষ্মী মুহুরি। ধ্রুবেশ গিয়ে যুদ্ধের কথা পাড়ল।—কী ভাবছেন লক্ষ্মীবাবু, যুদ্ধ যে এসে পড়ল?
বুড়ো শকুনের মতো চিঁচিঁ করে লক্ষ্মী মুহুরি বলল—মরি এখানেই মরবো।
এ হেন জীবনকে আর ঘাঁটাতে ইচ্ছে হল না ধ্রুবেশের। মুরছিত জনে ঘাতন নহে সমুচিত। এ তো ঘায়েল হয়েই গেছে, পালাবার শক্তিও এর নেই।
এই সন্ত্রস্ত উদ্ভ্রান্ত কলকাতার মধ্যে শুধু সনাতনবাবুর বৈঠকখানা নিয়মিতভাবে প্রতি সন্ধ্যায় গুলজার হয়ে ওঠে আর মাঝরাত্রে ভাঙে। রাজনীতি আলোচনার সঙ্গে পাশা চলে। এখানে ভাগ্যের চালই বড় কথা। কখনও রাজনীতি পাশাকে জমিয়ে দেয়, কখনো পাশা জমায় রাজনীতিকে।
ধ্রুবেশ আসে মাঝে মাঝে। যুদ্ধের কথা ওঠে, আর সনাতনবাবু সঙ্গে সঙ্গে এক কথায় সব সেরে দেন।—আমি লিখে দিচ্ছি, কিছু হবে না। মিছেই লোকগুলো পালাচ্ছে—যত মাথা খারাপের দল।
ধ্রুবেশ—কেন বলুন তো? জাপানিরা এতদূর এগিয়ে আসতে পারবে না?
—না, সে কথা বলছি না।
—তবে কি, সিঙ্গাপুর থেকেই ওরা মার খেয়ে ফিরে যাবে?
—না, তা নয়।
—তবে কী?
—আমি বলছি কিছু হবে না—কিস্সু হবে না।
এই বাঁকা ঠোঁটের ভণিতা নিয়েই সনাতনবাবু মসগুল হয়ে আছেন। সুখে আছেন।
অন্নদাচরণ মেমোরিয়াল স্কুলের ইতিহাসের মাষ্টার। বেতন চল্লিশ টাকা। ক্ষুৎপিপাসায় চৌচির সংসারের ময়দানে ক্লান্ত সওয়ারের মতো ধ্রুবেশ চলেছিল আর পাঁচজনেরই মতো। কিন্তু এটাই তার পরিচয়ের সব নয়। সে ইতিহাসের মানুষ। যে মানুষের মনের বনের শাখায় পৃথিবীর সুখ দুখের পাখির দল কলরব করে ফেরে। প্রতিমুহূর্তের সংগ্রামে সুন্দর এই পৃথিবীর রূপের বালাই নিয়ে সে এক এক সময় মুগ্ধ হয়ে যায়। যে-দ্বন্দ্বের মহিমায় হিমগিরি আকাশ ছুঁয়েছে, ধানের খেত হয়েছে সবুজ, চেতনার রঙে রাঙা হয়ে উঠল মানুষ। যে পরিবর্তনের স্রোতে পদার্থ গলে গিয়ে হল প্রবৃত্তি—সুখের হাসি, বিরহের বেদনা। মানুষ যেখানে স্বয়ং বিধাতা হয়ে আপন পরিণাম গড়ে তোলে আপন হাতে।
স্কুলে আরও মাস্টার আছে। পরীক্ষায় পাশ করার গ্র্যাণ্ড স্ট্রাটেজি শেখায় ছাত্রদের। তাদের সুনামও আছে, মাইনে পায় বেশি। ধ্রুবেশ দত্ত ছাত্রদের শোনায় শিয়ালকোটের খুলির কথা। কী কাহিনি লেখা আছে সেই হাড়ের ঠিকুজির জীর্ণ একটা পাতায়। আমাদেরই এক দুর্দান্ত বন্য পিতামহের কাহিনি। কে ছিল সে? সে ছিল সৈনিক, গুহার মুখে দাঁড়িয়ে পাথরের লগুড় নিয়ে যে লড়েছে বাঘ ভালুকের সঙ্গে—প্রাণ দিয়েছে। সেই সুমহৎ উৎসর্গের সঞ্চার ভেসে এসেছে হাজার বছরের বাতাসে। বর্তমানের আমরা তাই মহত্তর।
ধ্রুবেশ তাই একটা টিউশনিও পায় না। সাবধানী ছেলের বাপেরা ও সব কথা পছন্দ করে না।
রমা টুটুকে ঘুম পাড়াচ্ছিল। প্রতিবেশী দীনুবাবুর বাড়ির সবাই দেখা করে গেল রমার সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত তারাই ধৈর্য ধরে টিকে ছিল, কিন্তু আর সাহস হয় না। পাড়া একেবারে খালি। তবে দীনুবাবু স্বয়ং থাকবেন একটি চাকর নিয়ে। কারণ তার চাকরি আছে আর চাকরিটা ভালই।
দীনুবাবুর স্ত্রী বললেন—আমরা চললুম রমা। হারাধন জ্যোতিষী বলেছে, যা হবার তা তিন মাসের মধ্যেই হয়ে যাবে। এ ক’টা মাস তাই দেওঘরে কাটিয়ে দিয়ে আসি। বীণার বিয়ের তারিখটা তাই পিছিয়ে দিলাম।
রমা—আমাকে একা রেখে সবাই তাহলে চললেন মাসিমা?
বীণা রমার কানে ফিস ফিস করে বলল— তুমি কোথাও যাচ্ছ না বউদি?
রমা মুখ টিপে হাসল।—সত্যি কথা শুনবে? তোমার দাদাকে একা রেখে আমি কোথাও যেতে পারব না।
কথাটা দীনুবাবুর স্ত্রীর কানে এল। উত্তর না দিয়ে পারলেন না। গলার স্বরে রাগের ঝাঁজ বেশ বোঝা যায়।—যাবার জায়গা থাকলেই লোকে যায়। কাছে থাকতে চায় না কে? তবে আপদের সময় ঘাড়ে না চেপে পুরুষ মানুষকে একটু হাল্কা করে দিলে সাধ সোহাগ আর জন্মের মতো পুড়ে কিছু যায় না।
দীনুবাবুর স্ত্রী চলে গেলেন।
মাসিমার কথার আঘাতটা খুব সোজা আর স্পষ্ট। রমার অন্য কোথাও যাবার জায়গা নেই, এ সত্য সে নিজে জানে, মাসিমারাও জানেন।
মা নেই, বাপের একমাত্র মেয়ে। রমার বিয়ের এক সপ্তাহ পরেই বাপ সন্ন্যাস নিয়ে সরে গেছেন সংসার ছেড়ে। বাহির নেই বলেই হয়তো তার ঘরের মায়া এত বেশি। মাসিমার কথার নিষ্ঠুর সত্যটা ছুরির মতো সে সাধের প্রত্যয় কেটে ছিঁড়ে দিল। চুপ করে বসে রইল রমা।
বোমা পড়েনি তবু স্কুলগুলি ভেঙে গেল। ছাত্রেরা বাপমা’র হাত ধরে চলে গেল যত আপদহীন রাজ্যে। মাস্টারিগিরি ঘুচে গেল ধ্রুবেশের।
সত্যি কথা বলতে গেলে এ দুর্ঘটনায় ধ্রুবেশ দমে গেল অনেকখানি। কারণ রমা আর টুটুর কথা বড় বেশি করেই মনে পড়ে। ঘর নিয়ে পড়েছে রমা—সোনার খাঁচা গড়ার আনন্দে সে বিভোর। টুটু এই তো ছ’মাসও পার হয়নি। রমা এরই মধ্যে টুটুকে রাজা করবার প্ল্যানও তৈরি করে ফেলেছে—টুটুর খাওয়াপরা ও শিক্ষা দীক্ষা থেকে শুরু করে বিয়ে পর্যন্ত। কিন্তু এই আত্মারামের খেলার জিয়নকাঠি যে মাস্টারি চাকরিটা, তা-ই হঠাৎ ভেঙে গেল। ধ্রুবেশের দুঃখ এইখানে।
চাকরি গেছে। শুধু এই কথাটা জানিয়ে দিয়ে ধ্রুবেশ বাইরে বেরিয়ে গেল। এই ছোট কথাটা রমার চোখের সামনে নেচে বেড়াল নিষ্ঠুর ভ্রূকুটির মতো। টুটুর গায়ে হাত রেখে রমা কেঁপে উঠতে লাগল বার বার।
চাকরি গেছে, তবু বর্তমানে ধ্রুবেশের কাছে এটাই একমাত্র সত্য নয়। টালিগঞ্জের ছোট বাসাবাড়ির ধোঁয়াটে সন্ধ্যায় তার চোখে সে-ছবি ভেসে ওঠে—লিবিয়ার মরুবেলায় উদ্যত সঙ্গিনের ঝলক। শোনা যায় খারকভের কঠিন তুষারে লক্ষ পায়ের পথচলা ধ্বনি। মন্থিত প্রশান্ত সমুদ্রে আহত ক্রুজারের গর্জন, মহাদেশের পথে পথে ট্যাঙ্কের ক্রেঙ্কার, আকাশে বোম্বারের গুরুগুঞ্জন। এ এক অভিনব অর্কেষ্ট্রা—নবযুগের ভোরের কাকলি।
স্বার্থে ও সর্বার্থে সংঘাত বেধেছে। এই অভ্যুদয়ের যজ্ঞে পুড়ে যাচ্ছে জাতিবাদ, অর্থনীতির অনর্থ, প্রতাপের মূঢ়তা, পরস্ব শোষণের রসনা। সাম্রাজ্যের চর্বি গলে যাচ্ছে। ধূলিসাৎ হয়ে পড়েছে ফাসিস্তি স্পর্ধার চুড়া।
ধ্রুবেশের মন প্রাণ ঘিরে অদ্ভুত এক অনুভবের রোমাঞ্চ লাগে।
রমা চা এনে দিল ধ্রুবেশের সামনে। নিজেও মুখ ভার করে বসে রইল কাছে। হঠাৎ একটা এরোপ্লেন খুব নিচু দিয়ে গেঙিয়ে উড়ে গেল—পাখার ঝাপটা যেন গায়ে লাগল তাদের। রমা চমকে উঠল। দু’জনেরই চোখে পড়ল—টুটু হাত পা ছুঁড়ছে আর হাসছে।
ধ্রুবেশ হেসে ফেলে টুটুকে কোলে তুলে নিল। দু’দিনের কথা না বলার গুমোট এতক্ষণে যেন হাল্কা হল খানিকটা। রমা জিজ্ঞেসা করল—তুমি কি কিছু ভাবছ না?
—ভাবছি বইকী?
রমার সন্দিগ্ধ মুখে দ্বিতীয় প্রশ্ন অবশ্য আর এল না। সত্যিই যদি সে জানতে পারে, ধ্রুবেশ চাকরির কথা ভাবছে, তবে তার কোনও অভিযোগ নেই। কিন্তু এই মানুষটিকে সে কতকটা চেনে। এখুনি খবরের কাগজ নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। ক’বছর আগে ঠিক এই রকম স্পেনযুদ্ধের ভূতে পেয়েছিল ধ্রুবেশকে। রাত্তিরে ঘুমের ঘোরে প্রলাপ বকতো। এক এক সময় ঘুমোত না। বিছানা ছেড়ে সারা রাত ঘরের ভেতর পাইকারি করত।
ধ্রুবেশ বেরিয়ে গেল। ফিরবে হয়তো রাত্রি একটায়।
পথে নীতীশের সঙ্গে দেখা। এক গাদা পোস্টার বগলে নিয়ে চলেছে। ধ্রুবেশকে দেখতে পেয়ে উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল—যেন পলাতক আসামিকে হাতের নাগালে পেয়েছে।
—বাঃ ধ্রুবেশদা, আপনাকে খুঁজে খুঁজে আমরা হয়রান। বেশ ডুব দিয়ে আছেন। আপনারা এ সময় সরে থাকলে আমরা একা কী করে সামলাই বলুন তো?
—ব্যাপার কী তোমাদের?
—কাল সন্ধ্যায় পার্কের সভায় অবশ্য আপনাকে আসতে হবে। আমরাই উদ্যোগী। আপনাকে কিছু বলতেও হবে।
ধ্রুবেশ যেন তাই খুঁজছিল। সুযোগ পেয়ে খুশিও হল খুব। নীতীশকে জানিয়ে দিল—আমি বলব বটে, তবে আগেই জানিয়ে দিচ্ছি, আমি আমার মনের কথা মন খুলে বলব। তোমাদের মতো করে হয়তো বলব না। তাতে আপত্তি নেই তো?
নীতীশ হেসে সায় দিয়ে বলল—আচ্ছা, তা-ই বলবেন।
রমার পৃথিবী খুবই ছোট। টালিগঞ্জের গরিবপাড়ায় দু’ঘরওয়ালা একটা বাসাবাড়ি। বছর তিন আজ তাদের বিয়ে হয়েছে। ধ্রুবেশকে সে ভালবাসে নিজের চেয়ে অনেক বেশি। শেষে এল টুটু—নতুন স্বপ্নের রং লাগল রমার জগতে। কত তৃপ্তি, কত নিদ্হারা উদ্বেগ। দিনরাত শুধু খাটতে ইচ্ছে করে। সংসারের জন্য বিলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে নিজেকে।
অকস্মাৎ এল আঘাত। এত বড় পৃথিবী পড়ে রয়েছে—সেখানে বড় বড় সাধ, বড় বড় লোভ আর পাপ। সেখানে লাগুক না যুদ্ধের আগুন। ছোট ছোট সুখদুঃখে ধুকপুক করছে পাখির নীড়ের মতো রমার এই জগৎ। তাকে না ভেঙে ছিঁড়ে ফতেজঙ্গদের হানাহানি কি চলত না? যুদ্ধের নাম শুনলে রমার সকল মন বিরূপ হয়ে ওঠে। রমার কাছে ঘর-ভাঙানিয়া এ যুদ্ধ ঘোর শত্রু।
আর ধ্রুবেশের মনে লাগে অদ্ভুত এক সুরেলা উল্লাস। ধ্রুবেশের কাছে এ যুদ্ধ যেন যুগ-গড়ানিয়া তীর্থঙ্কর। সকাল সন্ধ্যা ঘুরে বেড়ায় পথে পথে—ট্রামে বাসে জনসভায়। দেশনেতাদের বিবৃতি পড়ে। ছাত্র ও শ্রমিকদের ইস্তাহার পড়ে। শোভাযাত্রা দেখে। পোস্টারের ছবি আর লেখাগুলির কাছে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। কে কী বলল? কারা বুঝেছে এ মহাযুদ্ধ মহাপরিণামের পূর্বগামিনী ছায়া। কারা কাজের কথা বলছে। কারা জেগে আছে।
সমস্ত দিন চাকরির চেষ্টায় ঘোরা আর সন্ধ্যেয় কার্জন পার্ক—শুয়ে পড়লেই নেশাতুর হয়ে আসে সকল ইন্দ্রিয়গ্রাম। পার্কের কাছে এক রকম ক্লান্তিহরা তন্দ্রার আমেজ আছে যেন।
মনে পড়ে যায়, দূর চট্টগ্রামের এক নগণ্য পাড়াগাঁ—বিরাজপুর। কতদিন সে দেশ ছাড়া। ঘরের ভিটেয় হয়তো কাটাবন আর শজারু বাসা বেঁধেছে। ছেলেবেলার সেই সাধের বিরাজপুর জলের দাগের মতো মিলিয়ে গেছে আজকের কর্ম কোলাহলে মুখর দিনের চিন্তা থেকে।
বিরাজপুর—যেখানে শহরের মতো ঘড়ির কাঁটায় জীবন চলে না। যেখানে প্রহরে প্রহরে কর্মের ঘণ্টা বাজে। খালের জলে ছোট ঢেউগুলি আস্তে ওঠে আস্তে ভাঙে। কামার স্যাকরার হাতুড়ি ধীরে ধীরে ওঠে পড়ে। চাষিরা জিরিয়ে জিরিয়ে লাঙ্গল ঠেলে—তামুক খায়। নির্বেগ মন্দাক্রান্তা জীবন।
মনে পড়ে স্কুলের পাশ ঘেঁসে জিলাবোর্ডের কাঁচা সড়ক। জোয়ারের জলে খাল টলমল করে। কাঠের পুল থেকে জলে ঝাঁপিয়ে পড়া—নতুন মাছের আনন্দের মতো ক্রীড়া-চঞ্চল কৈশোরের দিনগুলি।
গাঁয়ের কাউকে সে চেনে না। কিন্তু এখনও চিঠি আসে মাঝে মাঝে।
…শুনেছি বড় হয়েছ, চাকরি করছ, বিয়ে করেছ। দেশের ছেলে দেশে একবার আসলে কি তার মানহানি হবে। এস নিশ্চয়, আসছে বৈশাখে আমের সময়। বউমাকে নিয়ে এস। সকলেই তাকে একবার দেখতে চায়। ইতি—উত্তরের বাড়ির জেঠামশায়।
ধ্রুবেশ চেষ্টা করেও চিনতে পারে না—কে ইনি। এত আপনার জনের মতো ডাকেন।
গাঁয়ের স্কুলের ছেলেরা চিঠি দেয়—আপনার একটা বাণী পাঠাবেন নিশ্চয়। একটা হাতের লেখা পত্রিকা বার করছি আমরা। অনেক আশায় অপেক্ষা করে রইলাম। ইতি—কিশলয় সঙঘ।
ধ্রুবেশ অবাক হয়ে ভাবে—কোথা থেকে তারা ঠিকানা জোগাড় করে, এত খোঁজ রাখে। ঘরের ছেলে পৃথিবীর মেলায় হারিয়ে যাবে, এটা যেন তারা সহ্য করতে পারে না। প্রস্তর যুগের পূর্বপুরুষের অনাবিল গোষ্ঠীস্নেহের রেশ যেন আজও এই গেঁয়ো প্রীতির গায়ে লেগে আছে, ঝরা ফুলের গন্ধের মতো।
এত ভুলে থাকা উচিত হয়নি—ধ্রুবেশ মনে মনে লজ্জিত হয়ে ওঠে।
পার্কের সভায় ভিড় হয়েছে খুব। মণ্ডপ উছলে জনতা রেলিং পর্যন্ত গড়িয়ে পড়েছে। শত শত লাল নিশানে লেগেছে ঝড়ো হাওয়ার পুলক।
ধ্রুবেশ দাঁড়াল।
—বন্ধুগণ। আজ এক ঝড়ের রাত্রে আমরা সবাই এখানে মিলেছি। শতাব্দীর এই পরম লগনে দুরূহতম কর্তব্যের ডাক এসেছে আমাদের কাছে। আজকের এই সভা—এক যোদ্ধার ছাউনিতে আমরা সবাই দাঁড়িয়েছি। আমরা সবাই…।
—নিধিরাম।
সভার পেছন দিকে এক কোণ থেকে বিদ্রূপের বিষে ভরা ভারী গলায় কে একজন বলে উঠল। হাসির সোর পড়ে গেল চারদিকে। দু’জন ভলান্টিয়ার হাতযোড় করে বললো—মশাই, ও রকম করবেন না দয়া করে।
ধ্রুবেশের শান্ত কণ্ঠস্বর প্রতিজ্ঞায় কঠিন হয়ে বেজে উঠল—বন্ধুগণ, আমরা সবাই সৈনিক। আমরা ভারতবাসী। ইতিহাসের পাতা খুলে দেখুন, যুগে যুগে আমাদের ওপর কত আঘাত এসেছে। শত্রুর সঙ্গে, ধ্বংসের সঙ্গে কখনো আমরা আপস করিনি। নিরন্তর সংগ্রামে উদ্দাম সে ভারতের ইতিহাসকে আমরা স্মরণ করি। আমরা ভুলিনি হুনহিংসার মিহিরকুল এখানে এসে কুল পায়নি। কুশান ধনুর্ধরের তূণীর পুড়ে গেছে ভারতের বিপ্লবী গণশৌর্যের আগুনে।
—জয়। হিন্দু ধরম কি জয়। সভার মাঝখানে একদল লোকের উল্লাস শোনা গেল। বিরক্তিভরা ধ্রুবেশের কণ্ঠস্বর এক পর্দ্দা চড়ে উঠল। —না কখনও না। আমি সে কথা বলছি না। বলুন গণসংগ্রামের জয়।
আরম্ভ হল গোলমাল। বিক্ষুব্ধ একদল লোক মারমূর্তি হয়ে চিৎকার করে প্রতিবাদ আরম্ভ করল। তারপর ধিক্কার দিয়ে চলে গেল সভা ছেড়ে।
—বন্ধুগণ! ভেবে দেখুন কোথায় আমরা আজ দাঁড়িয়েছি। পঙ্কিল বন্যার মতো শত্রুর অভিযান দেশের মাটি ভাসিয়ে দিতে আসছে। শত পুরুষের নিঃশ্বাসে সুরভিত এ মাটির প্রতিটি কণিকা। কোথায় সরে যাব আমরা?
আবার যেন কারা কর্কশ চিৎকারে একটা হুল্লোড় মাতিয়ে তুলল।—জয়তু অভ্যুদিত এশিয়া।
ধৈর্য হারিয়ে ধ্রুবেশ চিৎকার করে উঠল।—জয়তু অভ্যুদিত মহামানব। জয়তু অভ্যুথ্থিত বিশ্বগণতা। এশিয়ার নাম নিয়ে যারা গর্জন করছে, তাদের জন্য আমার দুঃখ হয়। এই একচক্ষু হরিণের বিজ্ঞতা নিয়ে তারা নিজেরই সর্বনাশ ডেকে আনবে।
এপাশ ওপাশ থেকে উত্তেজিত প্রতিবাদের রব উঠতে লাগল। ঝুপ করে একটা থান হঁট এসে সজোরে লাগল ধ্রুবেশের ডান হাতে।
বক্তৃতা মঞ্চের টেবিলের ওপর উঠে দাঁড়াল ধ্রুবেশ।—কোনও হুঙ্কার টিটকারি আর থান ইঁট আমায় দমাতে পারবে না। এইখানে দাঁড়িয়ে আমি লক্ষ লোকের সামনে বলব—আমার দেশের ওপর হাতিয়ার হাতে যারা চড়াও করতে আসছে, তারা শত্ৰু, নির্জলা নিছক ষোলো আনা শত্রু। তারা বিংশ শতাব্দীর নতুন গরল। তাদের ভাণ্ডার ভরে আছে স্তূপীকৃত চিতাকাষ্ঠে। তারা আসছে বাবিলনের প্লেগের মতো নতুন করে রাজ্য জনপদ ছারখার করতে। মুখে তাদের ভুয়ো মুক্তির স্তোকবাণী—রাংতা মোড়া ইস্পাতের হাতকড়া নিয়ে আসছে তারা।
ভলান্টিয়ারদের সঙ্গে একটা ধস্তাধস্তির পর প্রতিবাদীর দল সভা ছেড়ে চলে গেল। আবার শান্ত হল সভা।
আবেগে উত্তেজনায় ধ্রুবেশের গলা ভেঙে আসছে।—বন্ধুগণ, এ গরিবের ডাক শুনুন। আত্মশক্তি মাথার মাণিক হারিয়েছিলাম আমরা। আজ এসেছে ডাক, ভয় ভাঙার সাধনায়, শঙ্কাহরণ ব্রতে। আপনাদের চোখে সেই মশালের দ্যুতি দেখছি আমি। এই মুক্তি কালরজনীর তিমিরপথের যাত্রীদের ওই একমাত্র সম্বল।
করকাপাতের মতো করতালির শব্দ। এক অপূর্ব চাঞ্চল্যের লহর সভার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ভেসে গেল।
—শ্মশান ঘাটের সিঁড়ির মতো আগন্তুকের পদাঘাতের ক্ষত নিয়ে আমরা কি যুগ যুগ ধরে স্তব্ধ হয়ে থাকব? কখনওই নয়। আপনাদের সঙ্গে এইখানে দাঁড়িয়ে আমি সেই অনাগত ভবিষ্যতের ছবি দেখছি। ধীরে শান্ত হয়ে আসবে এই মুখর মৃত্যুর আসর। আমাদের আত্মোৎসর্গে উজ্জ্বল সেই নতুন প্রভাতে মুক্ত মানবতার মিছিল পথ ধরে আসবে।
সভা ছেড়ে কিছুদূর চলে আসার পর বেশ একবার ফিরে তাকাল। জনসমুদ্রের গহন থেকে এক একটা জলস্তম্ভ উঠে যেন মহারোলে ভেঙে ভেঙে পড়ছে।—ইনকিলাব জিন্দাবাদ। হাজার হাতের বজ্রমুষ্টি দুলছে ভৈরব গর্বে।
দেশের শ্রদ্ধাস্পদ ছিল যারা, যাদের কাছে দুটো ভরসার কথা শোনবার জন্য— কাজের ইশারা, পথের দিশা পাবার জন্য লোকে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত, তারা দিনের পর দিন বিবৃতি দিচ্ছে।—এ যুদ্ধে আমাদের কিছু করবার নেই। এ ব্রিটিশে জাপানে যুদ্ধ। ভারত নিরপেক্ষ।
ধর্মতলার এক চায়ের কেবিনে বসে পরিচিত অপরিচিত কত লোকের মুখে ধ্রুবেশ মন্তব্য শোনে।—কিছু করবার নেই। বাদ-প্রতিবাদে কুতর্কের ঝড় ওঠে। ধ্রুবেশের এক একবার মনে হয়—কিছু একটা বলি। সোজা একটা প্রশ্ন করি, ভারতবর্ষ কার দেশ?
সেদিন প্রশ্নটা তুলেই বসল। তার আগে সঙ্কোচে, আশঙ্কায় বার বার বুক ছম্ ছম্ করে উঠেছে—কী জানি, সত্যিই যদি সেই নিদারুণ বিপরীত কথাটা এরা বলে ফেলে।
হলও তাই। একবাক্যে তারা জানিয়ে দিল।—কী করে আর আমাদের দেশ বলি মশাই। দেশের জন্য ভালমন্দ দুটো কাজ করার কতটুকু অধিকার ওরা দিয়েছে? আমাদের কিছু করবার নেই।
কেবিন ছেড়ে পথে নেমে ধ্রুবেশের মনে হল সমস্ত শহরটা যেন ভেঙে চুরে কুৎসিত হয়ে গেছে। ঘরবাড়িগুলো পুরানো উইঢিবির মতো। ছন্নছাড়া পোকামাকড়ের মতো মানুষগুলি ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে।
অনেকক্ষণ পথে পথে নিরুদ্দেশের মতো ঘুরে রোদে মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগলো। টালিগঞ্জ পৌঁছতে তখনো মাইল দুয়েক বাকি। এতটা বিমর্ষ জীবনে সে কদাচিৎ হয়েছে।
শ্মশানের শান্তি খুঁজছে সবাই। ইতিহাসের বাণী এখনও এদের কাছে হৃদয়ের সত্য হয়ে ওঠেনি। এরা খুঁজছে এড়িয়ে যাওয়ার পথ। সর্বনাশা ক্লৈব্যবাদকে এরা কত রকমারি বচনে ফাঁপিয়ে রেখেছে। ধ্রুবেশের মনে হল, মথুরার সেই কণিষ্কের মুণ্ডহীন প্রকাণ্ড মূর্তিটা, গোদা গোদা পা দিয়ে সারা দেশের বুক মাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
রমা ধৈর্য হারিয়ে বসেছিল। এখন বেলা দেড়টা, তবু ধ্রুবেশের দেখা নেই। কোনও দিনও প্রশ্ন না করলে আজকাল কথা বলে না। চাকরির খোঁজ যে কতখানি হচ্ছে, তা রমা এখানে বসেই আন্দাজ করে নিতে পারে।
ঘরে ঢুকল ধ্রুবেশ। রমা বলল—ক’টা যুদ্ধ জয় করে এলে?
রমার কথার উত্তর না দিয়ে ধ্রুবেশ জামা ছেড়ে গামছা নিয়ে স্নানের জন্য বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। টবে এক ফোঁটা জল নেই। কাছেই রাস্তার ধারে একটা টিউবওয়েল আছে। ধ্রুবেশ স্নানের জন্য বাইরে চলে গেল।
টবে জল নেই। এটা রমারই ভুল। তবু এই ভুলটার নিষ্ঠুরতা আজ রমার চোখে এমন কিছু ঠেকল না। একজন ঘুরে বেড়াবে ব্যোম ভোলানাথ হয়ে, ঘরের কথা ছেড়ে ব্রহ্মাণ্ডের ব্যাপার নিয়ে। সে একা আর করবে কত? শূন্য থালায় সে অন্ন সাজাতে পারে, অন্ন ফলাতে পারে না।
রমা সব কিছু সহ্য করতে পারে, শুধু ধ্রুবেশের এই পরম নির্লিপ্ততাটুকু ছাড়া। স্বচক্ষে দেখছে— দিন দিন দৈন্য ঘনিয়ে উঠছে। শ্রীহারা হতে চলেছে সংসার। যুদ্ধ নিয়ে তার যত চিন্তা উদ্বেগ, তার এক কণাও যদি ঘরের জন্য থাকত তবে এ রকমটা হত না। আজ দু’মাসের ভেতর দু’জনের মধ্যে একটা ভালবাসার কথা দূরে থাক, ভাল কথাও হয়নি।
ধ্রুবেশ স্নান সেরে এসে রান্নাঘরে ঢুকল। খাবার ঢাকা দেওয়া আছে। এটা না থাকলেও অবশ্য সে আজ আশ্চর্য হত না। রমা বসে বসে সব ব্যাপার লক্ষ করল। তারপর দেখল ধ্রুবেশ গা এলিয়ে শুয়ে পড়ল মাদুরের ওপর, খবরের কাগজে চোখ ঢাকা দিয়ে।
রমা আস্তে আস্তে সামনে এসে দাঁড়াল। ঝগড়া করতে নয়, তবে অনেক কিছু সে আজ মন খুলে বলে যাবে।
রমা ডাকল—শুনছ?
—হ্যাঁ
—টুটুর দিকে আজকাল তুমি তাকিয়েও দেখ না। এ কী করছ তুমি? তুমি নয় বাইরে যুদ্ধ করছ, এদিকে একা এ ঘরের যুদ্ধে আমি যে আর টিকতে পারি না। টুটুর কী হবে, সে কথা একবার তোমার ভাবনায়ও আসে না কি?
ধ্রুবেশ বলল—কাজ করতে পারবে?
—কী?
—বেনারসে এক জমিদারের বাড়ি রাঁধুনির কাজ আছে। খাওয়া-পরা আর মাইনেও পাবে। তা হলে আমাকে বাদ দিয়ে তুমি তো টুটুর ভার নিজেই নিতে পার। আমি না হলে তোমার চলবে, কিন্তু টুটু না হলে চলবে না।
কথাগুলো এক ঝাপ্টা উত্তপ্ত কাঁকরের মতো রমার মুখে এসে যেন লাগল।
—তুমি পুরুষ হয়ে একথা মুখে আনলে? ধ্রুবেশের দিকে সোজা তাকিয়ে রইল রমা। আগুন-লাগা ঘরের জ্বালায় চোখ দুটো পুড়ে যাচ্ছে।
মুখ ফিরিয়ে নিল ধ্রুবেশ।
উদ্বৃত্ত যা কিছু ছিল টেনেটুনে একটা মাস চলেছে। গয়লা ফিরে গেল দোর থেকেই দুধের কলসি দেখিয়ে। মাসকাবারি ব্যবস্থা করতে সে রাজি নয়। রোজ নগদ নগদ কিনতে হবে। এ-বাড়িতে কপাল-ভাঙাদের ক্ষুধা এবার খুব ভালভাবেই পাকিয়ে উঠেছে। গয়লার সজাগ কারবারি চোখে সে রহস্য ধরা পড়তে দেরি হয়নি।
দু’গাছা সোনার চুড়ি বেচে দিল রমা।
সন্ধ্যাবেলা ধ্রুবেশ বাইরে বের হবার উদ্যোগ করছে। চায়ের জন্য আজকাল আর অপেক্ষা করতে হয় না। সব খবরই সে রাখে।
যাবার সময় পেছন থেকে রমা ডাকল—শুনছ? টুটুর জন্য একগজ ফ্লানেল নিয়ে আসবে আজ।
এও একটা অঙ্কুশের আঘাত—ঘরের দায় স্মরণ করিয়ে দেওয়া। একগজ ফ্লানেল কিনে আনবার শক্তি যে আজ হারিয়েছে তার চিন্তায় বড় বড় কাজের কথা শোভা পায় না। এই সার সত্যটি রমা ধ্রুবেশকে বুঝিয়ে দিতে চায়। রমা আজকাল জেনেশুনে এই শেষ উপায় ধরেছে। যদি কিছু হুঁশ হয়। অন্যদিনের মতো সকাল বেলা চাকরির খোঁজেই বার হয়েছিল ধ্রুবেশ। সনাতনবাবুর বৈঠকখানা থেকে শুরু করে অনেক জায়গা। আজ সে ফিরেছে এক বেদনাকর হতশ্বাসের বোঝা নিয়ে। অপমানের তালিকা পূর্ণ হয়েছে এবার।
ধর্মতলার চায়ের দোকানে ফিসফিস করে উঠলে দু’চারজন—স্পাই, স্পাই।
নীতীশ বলল—ধ্রুবেশদা, আপনি নাকি আমাদের বিদ্রূপ করেছেন। আমরা নাকি শুধু কাঠপুতুলের খেলা দেখাচ্ছি?
অনেকে অনেক কিছু বলতে আরম্ভ করেছে, তার সম্বন্ধে—কেউ প্রকাশ্যে কেউ আড়ালে। কারু কাছে সে ইংরেজের পা-চাটা, কেউ এক আঁচড়ে বুঝে ফেলেছে— প্রচ্ছন্ন পাতিবুর্জোয়া। অনেক ক্রিটিকের চোখ আবার এক্সরের মতো—তারা দেখেছে ধ্রুবেশের ফুসফুসভরা নিপ্পনপ্রীতির রস।
কিছু আসে যায় না এতে। কিন্তু চারদিকের এই সব উপসর্গ দেখে সত্যই সব উৎসাহ শিথিল হয়ে যায়। জ্ঞানী-গুণী থেকে আরম্ভ করে ঝি বটার মা পর্যন্ত— সকলের চিন্তা এক সুরে বাঁধা। যুদ্ধের পর কে কী করবে, কী পেতে হবে—এটাই একমাত্র সমস্যা। সকলে ঝুড়ি ঝুড়ি কর্তব্য আর দাবির পসরা মাথায় নিয়ে বসে আছে—যুদ্ধের পরে। মাসিমা যুদ্ধের পরেই বীণার বিয়ে দেবেন। পেট্রিয়টেরা যুদ্ধের পর এক হাত লড়বেন—যারা জিতবে তাদের সঙ্গে। মহাবণিক সঙঘ আজ থেকেই ছটফট করছে যুদ্ধের পরে কে কত বড় কারবার ফলাবে।
ধ্রুবেশ বাইরে যাওয়ার পরে রান্নাঘরে বসে রমা কেঁদেছে। ধোঁয়ার জন্য নয়, অভাবের জন্য নয়, ধ্রুবেশের এই গৃহবৈরাগী আচরণের জন্য নয়।
রমার নিজের চোখেই আজ ধরা পড়েছে তার স্বার্থম্ভর মনের পরিচয়। শুধু টুটু আর টুটু—টুটুর প্রয়োজনের কাছে পৃথিবীর কোনও প্রয়োজনের যেন তুলনা হয় না। টুটুর মানুষ হবার পথে দিনরাত শুধু পাথর ভাঙতে থাকবে—এই জন্যই কি ধ্রুবেশকে তার প্রয়োজন? এ ছাড়া কি ধ্রুবেশ আর কিছু নয়?
ধ্রুবেশ ঘরে ফিরতে রমা ভাল করে তাকিয়ে দেখল—অনেক রোগা হয়ে গেছে।
আরও কিছুক্ষণ হয়তো তাকিয়ে থাকত। কিন্তু তা না করে ঘরের ভেতরে চলে গেল আর ফিরে এল কিছুক্ষণ পরে।
এক গেলাস সরবত নিয়ে এসে বলল—জিরিয়ে এটা খেয়ে নাও।
আজ যা পারল একটু ভাল করেই রাঁধল রমা। তার আচরণের নির্লজ্জ ক্রূরতাগুলি একে একে তাকেই পাল্টে আঘাত করে যাচ্ছে। বার বার চোখে আঁচল দিল রমা। স্নানের জন্য এগিয়ে দিয়ে বলল—পা দুটোর চেহারা হয়েছে কী? ভাল করে সাবান দাও। শেষে ধ্রুবেশের আপত্তি অগ্রাহ্য করে নিজেই সাবান দিয়ে ঘষে মেজে দিল।
দুপুরে ধ্রুবেশ ঘুমিয়েছিল, রমা পাশে বসল পাখা নিয়ে। মুখে হাত বুলিয়ে দেখল—গাল ভেঙে গেছে, চোয়ালটা হাতে ঠেকে।
টানা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রমা একমনে বাতাস করে যায়।
কেন জানি মনটা আজ বেশ শান্ত ছিল—বর্ষাধোয়া গাছপালার মতো।
সেই কলকাতার সন্ধ্যা। কার্জন পার্কের ঘাস নরম বিছানার মতো আরামে ক্লান্ত শরীরটা ঘিরে ধরেছে। আলো-আঁধারি কলকাতার প্রাণ ঠং ঠাং করে বাজছে আরতির ঘণ্টাধ্বনির মতো।
চিৎকার করে একটা ছেলে পার্কের রেলিং ডিঙ্গিয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে। একটা কাগজের হকার। লনের অন্ধকারের কবর থেকে এক এক করে নিস্পন্দ শায়িত মূর্তিগুলি নড়ে চড়ে উঠে বসল। হকার ছেলেটা চিৎকার করে হাঁকছে বিকেলের টাটকা খবর—চট্টগ্রামে বোমা পড়েছে—বোমা পড়েছে চট্টগ্রামে।
হুড়োহুড়ি আরম্ভ হল কাগজ কেনা নিয়ে। ধ্রুবেশও হাতে পেল একটা। একরকম দৌড় দিয়েই সে এসে দাঁড়াল একটা ল্যাম্পপোস্টের কাছে।
দম বন্ধ করেই ধ্রুবেশ পড়ল। সামান্য বাহুল্যহীন কয়েক লাইনের একটা খবর।— তারা এসেছে। বোমা পড়েছে চট্টগ্রামে। লোক মরেছে, লোক ঘায়েল হয়েছে। তারা এসেছে। কর্ণফুলির জলে পড়েছে তাদের কুৎসিত কালো ছায়া। পুব আকাশের তারার গায়ে কালি মাখিয়ে দেখা দিয়েছে খলস্ফুলিঙ্গের দল।
ধ্রুবেশ কাঁপছিল থর থর করে। দাঁতে দাঁত পিষে যাচ্ছিল। …কে এরা? দেশের মাটিতে আগুন ছড়ায়।
বিশ্ব ইতিহাসের সব লেখা ছাপিয়ে সোনালি আখরে ঝিলিক দিয়ে উঠল একটিমাত্র নাম—বিরাজপুর। কর্ণফুলির জ্বালাভরা জলের ঢেউ অসহায়ের মতো ডাকছে কলস্বরে। তা-ও শুনতে পাওয়া যায়। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে হঠাৎ ধড়ফড় করে উঠে বসল রমা। ধ্রুবেশ আসেনি। পিলসুজের আলোর শিখাটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে নীল হয়ে আছে। কতগুলি বাদলা পোকা আলোতে পুড়ে পুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে।
টুটু ঘুমোচ্ছে অঘোরে। জানালাটা খুলে রমা বাইরের দিকে তাকাল। ব্ল্যাকআউটের রাত্রি—এক অগাধ শব্দহীন কাজলসমুদ্রের তলায় সারা কলকাতা যেন ডুবে রয়েছে। ক্ষোভ নয়, দুঃখ নয়, অভিমান নয়। শান্ত চোখ দুটোতে তবু দু’ফোঁটা জল দেখা দিয়েই হাওয়ায় শুকিয়ে গেল। সকলেই ঘরে রয়েছে আজ, শুধু সে ছাড়া। থাক, কেঁদে তার পিছু ডেকে আর লাভ নেই। সে থাকবে না, সে থাকত না। সে যে ইতিহাসের মানুষ—এতদিনে হয়তো সে হাতের কাছে পেয়েছে তার জীবনের পারানি নৌকার হাল।
শান্ত হয়ে চোখ বুজে বসেছিল রমা। তাকাতেই দেখল ভোর হয়ে এসেছে। একজোড়া স্পিটফায়ার গোঁ গোঁ করে উড়ে চলে গেল মাথার ওপর দিয়ে। টুটু হাসল আবার। তাকে কোলে তুলে নিল রমা। তার বুকের গোকুলে বড় হয়ে উঠবে যে মানুষের ভবিষ্যৎ। আস্তে আস্তে চোখ মুদে আসছিল রমার, ধীরে মাথাটা ঝুঁকে পড়ল সামনের দিকে—প্রণাম।
এ প্রণাম তাদেরই উদ্দেশ্যে, মাটির মান বাঁচাতে জীবনপণে দাঁড়াল আজ যারা। কালনাগের মতো দুশমনের পথ রুখে দাঁড়াল যে নওজোয়ানের দল। বিরাজপুরের ধুলিকুট্টিমে যে হার-না-মানা অবুঝেরা নিজের হাতে সাজিয়ে রাখল ভয়াল মরণবাসর। শত্রুর চণ্ড অভিযান থমকে যাবে নিশ্চয়, ওই কাঠের পুলের কাছে—অন্ততঃ কিছুক্ষণের জন্য। আর—শতাব্দীর সিঁথির মতো বিরাজপুরের ওই সড়কে হয়তো মুখ থুবড়ে পড়বে বুলেটের আঘাতে শতদীর্ণ এক ইতিহাসের মাস্টারের শোণিতাক্ত চুম্বন।
১৪.০৬.১৯৪২
লেখক পরিচিতি
সুবোধ ঘোষ : ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে হাজারিবাগে জন্ম। কৈশোর-যৌবনের বহুদিন কেটেছে হাজারিবাগ অঞ্চলের বনে জঙ্গলে। পরে কর্মজীবন কলকাতায়। প্রথম বিতর্কিত উপন্যাস ‘তিলাঞ্জলি’। ফসিল, অযান্ত্রিক, ত্রিযামা প্রভৃতি বহু স্মরণীয় গল্পের স্রষ্টা। ‘ভারত প্রেমকথা’ অনন্য সৃষ্টি। ১৯৫৯ সালে আনন্দ পুরস্কার। মৃত্যু: ১০ মার্চ ১৯৮০।