কর্ণ
বার বার এই কথাটা আমার মনে হয়েছে যে, ব্যাস-বাল্মীকি যে মর্যাদার কবি, তাঁদের পক্ষে যুধিষ্ঠির-ভীম-অর্জুন অথবা রাম-রাবণের মতো চরিত্র তৈরি করা কোনও কঠিন ব্যাপার নয়। এমনকী সে আন্দাজে রামায়ণের মেঘনাদকে সৃষ্টি করা তবুও বা সম্ভব ছিল, কিন্তু কর্ণকে সৃষ্টি করা ছিল অনেক কঠিন। রামায়ণের রাবণ প্রতিপক্ষের নায়ক হলেও তাঁর পরস্ত্রীপাংশুল মূর্তি আমাদের বিরক্তি ঘটিয়ে দেয় পূর্বাহ্নেই। বিশেষত, সোনার লংকার যে সামরিক ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার’, তাতে বানর সহায় রামচন্দ্রের প্রতি আমাদের সবসময়েই মায়া থাকে। বরঞ্চ রাবণি-মেঘনাদ এখানে অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠেন। পিতার স্ত্রীপ্রিয়তার কথা মাথায় না-রেখে সম্পূর্ণ ব্যাপারটাকেই তিনি রাক্ষসবংশের সম্মান এবং ততোধিক বীর পিতা রাবণের সম্মান হিসেবে ভাবনা করে শুধু সাময়িক যুদ্ধোন্মাদনায় নিজের প্রাণ দিয়েছেন। কিন্তু এই চরিত্র সৃষ্টি করা কিছু কঠিন ছিল না আদি কবির পক্ষে। বস্তুত মেঘনাদ অনেক সরল। কিন্তু কেমন হয় ব্যাপারটা, যদি প্রতিপক্ষ চরিত্র এত জটিল যে, অধিগুণসম্পন্নতার সমস্ত মাত্রাগুলি থাকা সত্ত্বেও জীবনযাপনের ক্ষেত্রে তাঁর জন্মাবধি বঞ্চনা, তাঁর বেড়ে ওঠার অন্যায় অনুষঙ্গ, যেখানে ব্যক্তিগত উচ্চাশা সংক্রান্ত করতে হয় অন্যের অন্যায় উচ্চাশার মধ্যে, অথচ তিনি দয়ালু, অথচ তিনি নৈতিকতায় নিপুণ এবং সর্বোপরি এক ভয়ংকর বীর।
কর্ণ-চরিত্র এমন কোনও রঘু-ডাকাতের চরিত্রও নয় যে, তাঁর সামরিক ক্রিয়াকাণ্ড মহদুদ্দেশ্যে নিয়োজিত, তিনি কোনও রবিনহুড নন, অথবা নন কোনও ‘ডন’, যার বিপরীত তথা সমাজ বহির্ভূত উচ্চাশার প্রতি অন্যের মান্যতা তৈরি হয়। মহাকবি তাঁকে এমন অদ্ভুত এক জটিলতায় তৈরি করেছেন, যাতে জন্মাবধি তাঁর ওপরে আমাদের করুণা তৈরি হবে, প্রত্যেক মুহূর্তে আপনি তাঁর খেয়াল রাখতে বাধ্য হবেন, অথচ তাঁর অনন্ত অনুষঙ্গগুলি এবং তাঁর ক্রিয়া, কান্ড এবং পদ্ধতি আপনাকে পীড়া দেবে এবং অবশেষে তাঁর জন্য আপনি চোখের জল ফেলতে বাধ্য হবেন। আশ্চর্য দেখুন, কর্ণচরিত্রের মধ্যে সেইসব উপাদান রয়ে গেছে, যেখানে সেই কালেই মহাভারতের ঈপ্সিত অতিক্রম করে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয়-তৃতীয় শতাব্দীতেই একাঙ্ক নাটকের স্পেশালিস্ট ভাস তাঁর বিখ্যাত কর্ণভারম্ নাটক লিখে গেছেন এবং একালে এসে রবীন্দ্রনাথ এমন একটা মহাকাব্যিক ‘সংবাদ’ লিখলেন, যাতে কবিজনোচিত বেদনায় কর্ণ এতটাই মহনীয় হয়ে ওঠেন যে, তাঁর প্রকৃত চরিত্রটাই বোধহয় হারিয়ে যায়।
আসলে মনস্তত্ত্বের জগৎ এমনই এক জটিল যন্ত্রণার জগৎ, যা সাধারণ এবং চিরাচরিত গড্ডালিকার শান্ত সীমানার বাইরে থাকে। চিরকালীন ছাঁদে যাঁদের জীবন চলছে— জীবনের সব সুখ যিনি পাচ্ছেন, অথবা সব যিনি পাননি, এমন জীবনও ধরা-বাঁধা ছাঁদের বাইরে নয়। কিন্তু জীবনের প্রথম মুহূর্ত থেকেই যাঁর জীবন অনিশ্চিত, নিজের কোনও দোষ না থাকা সত্ত্বেও যাঁর জীবনে অনাগত বিধাতার কলঙ্ক নেমে আসে, অথচ সেই নিন্দাপঙ্কে তিলক টেনে আপন পৌরুষে যিনি ত্রিজগতের মায়া কেড়ে নিতে পারেন, এমন একটা চরিত্র তৈরি করা মহাকবির পক্ষেও সম্ভব হত না, যদি না তিনি অতিনিকট থেকে এমন চরিত্র দেখতেন। আমি এমন কথা বলছি না যে, মহাকবি কর্ণকেই নিজে কাছ থেকে দেখেছেন, কেননা এমনটা আপনাদের বিশ্বাস নাও হতে পারে। কিন্তু জীবনের মধ্যে এমন বঞ্চিত মানুষের মনস্তত্ত্ব না জানলে মহাভারতের তন্তুবয়ন করার সময় জটিল-গহন মনস্তত্ত্বের এমন নিখুঁত চিত্র তৈরি করা সম্ভব হত না। আমরা অবশ্য কর্ণকে মহাভারতের অন্য ঐতিহাসিক চরিত্রগুলির অন্যতম বলে মনে করি, এবং মহাকবি নিজেই তাঁর জননীর কন্যাকালের জাতক বলেই অপর এক কানীনের জীবন-জটিলতা এবং তাঁর মানসিক গঠন এমন বর্ণময় করে আঁকতে পেরেছেন।
মহাভারতের কবির আরও এক অসাধারণ ক্ষমতা হল— তিনি একটা বড় চরিত্রকে পূর্বাপর পরম্পরায় বাঁধতে পারেন অন্তর্জাত কারণ-সমূহের মধ্য দিয়ে। কর্ণের স্বয়ংজ্ঞাত জীবনের মধ্যে তাঁর জননী কুন্তী কোথাও নেই, অথচ সমস্ত জীবন ধরেই কুন্তী তাঁর জীবনের অন্তঃক্রিয়াগুলি চালিত করেছেন— এই বিপ্রতীপ সমন্বয়ের জন্য কুন্তীর জীবনও কর্ণ-জীবনের অন্যতম অঙ্গ হয়ে ওঠে। আমি বার বার এ-কথা বিভিন্ন প্রসঙ্গে বলেছি যে, বঞ্চিত কর্ণের ব্যথাগুলি বিচার করার আগে আপনারা কুন্তীর বঞ্চনাগুলি বিচার করবেন। তা হলেই কর্ণকে সবচেয়ে ভাল বোঝা যাবে।
মহাভারতের এইরকম দাপুটে কথা একজন মহিলার মুখ থেকেই বেরিয়েছে এবং তিনি কিন্তু দ্রৌপদী নন, কুন্তী। সেই উদ্যোগ পর্বে গিয়ে কুন্তী তাঁর ভাইপো কৃষ্ণের কাছে বলেছিলেন— আমি বাপের বাড়িতেও সুখ পাইনি, শ্বশুরবাড়িতেও নয়। আপন গর্ভজাত তিনটি ছেলে এবং সতীনের দুটি নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে নিজের স্থান করে নিতে নিতেই তাঁর বৃদ্ধকাল এসে গেছে এবং তার জন্য একটা যুদ্ধ ঘটে গেছে মাঝখানে এবং তাঁর প্রথমজাত পুত্ৰ কৰ্ণ সেখানে মারা গেছেন। আর যাই হোক, কর্ণের মৃত্যু তিনি চাননি। অন্যদিকে বাপের বাড়ির কথাটা আপাত দৃষ্টিতে মন্দশ্রুত না লাগলেও সেখানেও কুন্তী বড় একাকী দুঃখভাগিনী। বাপের বাড়িতে যেভাবে তিনি দুঃখ পেয়েছেন সেটা বাপের বাড়ির গুরুজনদের বোধগম্যই হয়নি। এই দুই জায়গায় জ্বলতে জ্বলতে কৃষ্ণকে তিনি বলে ফেলেছিলেন— বাপের বাড়িতেও আমার চরম লাঞ্ছনা জুটেছে আর শ্বশুরকুলের শ্বশুরেরাও আমার যন্ত্রণা বাড়িয়েছেন সকলেই— সাহং পিত্রা চ নিকৃতা শ্বশুরৈশ্চ পরন্তপ।
আপনারা জানেন সকলে যে, কুন্তী জন্মেছিলেন মথুরা-শূরসেন অঞ্চলে যেখানে রাজত্ব করতেন আর্যক শূর, কুন্তীর আসল জন্মদাতা পিতা। পিতা শূর তাঁর প্রাণের বন্ধু এবং আপন পিসতুতো ভাই কুন্তিভোজের কাছে কুন্তীকে দত্তক দিয়েছিলেন। কুন্তী আর্যক শুরের প্রথমজাতা কন্যা, কিন্তু কুন্তিভোজের কাছে তাঁকে দত্তক দেবার কথা পাকা হয়ে থাকলেও পিতা শূর বোধহয় জন্মানোর সঙ্গে-সঙ্গেই কুন্তীকে কুন্তিভোজের হাতে তুলে দেননি। প্রথমজাতা কন্যার জন্য মায়াই হোক অথবা অন্য কোনও কারণ থাকতে পারে, কিন্তু যে-কারণই থাকুক, এই যে দেরি হয়ে গেল— এটার মারাত্মক ফল ফলেছে কুন্তীর জীবনে। প্রথমত, এটা তো ভীষণ সত্যি যে, একটি বাচ্চাকে যদি জন্মানোর কয়েক দিনের মধ্যেই অথবা এক মাস, দু’মাস বা তিন-চার মাসের মধ্যেই দত্তক দিয়ে দেওয়া যায় এবং সে যদি পালক পিতামাতার স্নেহ-মমতায় মানুষ হতে থাকে, তবে তার মানসিক গতি-প্রকৃতি অস্বাভাবিক নাও হতে পারে। কিন্তু যে-শিশুটি বেশ কিছুদিন স্নেহ-মমতায় লালিত হয়েছে এবং তার জ্ঞান-বুদ্ধিও যদি হয়ে গিয়ে থাকে, এই অবস্থায় তাকে দত্তক দিলে সেই শিশুর মানসলোকে নানারকম জটিলতা তৈরি হয়ে যায়। বিশেষত কুন্তী অত্যন্ত সংবেদনশীল মহিলা বলেই কুন্তিভোজের বাড়িতে দত্তক কন্যা হয়ে ওঠার মধ্যে অনেক জটিলতা ভোগ করেছেন। সে জটিলতা এতটাই যে, সমস্ত ধর্মবোধ, নীতিবোধ এবং পারিবারিক মহিমায় জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি বলেছেন— আজকে এই কৌরব রাজবাড়িতে এত যন্ত্রণা সয়েও আমি দুর্যোধনকে দোষ দিই না, সে তো এরকম করবেই। কিংবা আমি নিজেকেও দোষ দিই না, কেননা আমি কোনও অন্যায় করিনি। কিন্তু সমস্ত দোষ আমার পিতার। আমি তাঁকেই দোষ দিচ্ছি— পিতরং ত্বৈব গর্হেয়ং নাত্মানং ন সুযোধনম্— কেননা যখন আমার খেলার বয়স, ছোট্ট ছোট্ট ‘বল’ নিয়ে এলোপাথাড়ি ছুঁড়ি, ধরি, দৌড়ই, খেলনা নিয়ে খেলা করি, তখন আমার বাবা আমাকে কুন্তিভোজ রাজার কাছে দত্তক দিয়ে দিলেন।
একটি মনুষ্যশিশুকে এইভাবে দিয়ে দেওয়াটা কুন্তী ভাল চোখে দেখেননি। আজকে নারী-স্বাধীনতার যুগে, নারী-প্রগতির যুগে মেয়েরা তো এই জিগিরটাই তোলেন যে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের ভোগ্য পণ্য মনে করা হয় এবং যখন-তখন কথায় এবং কাজে এই ভোগ্যভাব তথা পণ্যভাব প্রকাশও করে ফেলেন পুরুষেরা। আমরা বলব— এসব কথা আজকে কিছুদিন ধরে উঠছে, কিন্তু দু’হাজার বছর আগে একটি শৈশব-বিহারী কন্যাকে অন্যের হাতে তুলে দেবার জন্য কুন্তী পিতার বিরুদ্ধে বলছেন— যাদের টাকাপয়সা আছে, তারা যেমন দেদার দানছত্তর করে নাম কিনতে চায়, আমার বাবাও তেমনই তাঁর বন্ধুর কাছে আমাকে দত্তক দিয়ে দিলেন এমনভাবে, যেন আমি একটা টাকার থলে— ধনং বৃত্তৈরিবার্পিতা।
আমাদের মনে হয়, নিজের জীবন সম্বন্ধে কুন্তীর নিজেরই এই পণ্যতাবোধ এক দিনে তৈরি হয়নি। বিশেষত সামান্য জ্ঞানবুদ্ধি হয়ে যাবার পর অন্য একজনের বাড়িতে কন্যাভাবে মানুষ হয়ে ওঠার মধ্যে যে যন্ত্রণা ছিল, তাতে একটা সর্বাঙ্গীণ জীবনবোধ অবশ্যই তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, অন্য বাড়িতে দত্তক হিসেবে বেড়ে ওঠার মধ্যেও এক অসামান্য জটিলতা আছে। দত্তক-নেওয়া পুত্র বা কন্যা, বিশেষত সে যদি কন্যা হয়, তবে বেড়ে ওঠার পর গুণে-চরিত্রে সে যদি ভাল হয়, তবে দত্তক-নেওয়া পিতা নিজগৃহের গুণ আস্ফালন করেন। কিন্তু সে যদি কোনও ভাবে খারাপ হয় অথবা যদি সে শুধুমাত্র স্বতন্ত্র হয় অথবা শুধুমাত্র স্বতন্ত্র মত ব্যক্ত করে, তা হলে কিন্তু দত্তক পিতামাতা গালাগাল দেন সেই বীজী পিতাকে অথবা গর্ভধারিণী মাকে যাঁরা সন্তানের প্রথম জন্মভার বহন করেছিলেন, এমনকী লালনও করেছিলেন কিছুদিন।
আমার তো মনে হয়, সামান্য জ্ঞান-বুদ্ধি হবার পর কুন্তীকে দত্তক দেওয়া হয়েছিল বলেই কুন্তী দত্তক-পিতার চাপটা আরও বেশি অনুভব করেছিলেন। মহর্ষি দুর্বাসা কুন্তিভোজের বাড়িতে এলে তাঁকে তুষ্ট করা এবং সেবা করার ভার পড়ে কুন্তীর ওপর। অত্যন্ত সুলভকোপ এই ঋষিকে তুষ্ট করা যে কতটা কঠিন, সেটা কুন্তীই বুঝেছেন, কুন্তিভোজ বোঝেননি। কিন্তু ভাল হয়ে থাকার বা নিজেকে ভাল প্রমাণ করার যে দায়টা কুন্তীর ছিল, সেই দায় অত্যন্ত সফলভাবে মেটানোর পর কুন্তী দুর্বাসার কাছে যে দেবসম্ভোগের বর পেলেন, তার প্রথম প্রয়োগের ক্ষেত্রেই সেই মানসিক বিভ্রম তৈরি হল, যেখানে দত্তক-গ্রহীতা পিতার শঙ্কিত অন্তর কাজ করতে থাকে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, কুন্তী যে কন্যাবস্থায় তাঁর প্রথমজাত পুত্রটিকে ধাত্রীর সাহায্যে জলে ভাসিয়ে দিলেন, সেখানে এই দত্তক-মানস কাজ করেছে। এমনিতে সেকালের দিনে কানীন পুত্রের কোনও মান-মর্যাদা ছিল না এমন নয়, কানীনকে কেউ জারজ সন্তানও বলত না। কিন্তু তবুও যে কুন্তী তাঁর পিতৃগৃহে তাঁর সূর্যসম্ভোগে পুত্রলাভ করার কথা লুকিয়ে গেলেন, তার কারণ এই অবিশ্বাস এবং আশঙ্কা তাঁর মনের মধ্যে কাজ করেছে যে, এই ঘটনা পালক পিতা কুন্তিভোজ ভালভাবে নেবেন না।
কুন্তিভোজের বাড়িতে আপন বস্ত্রাঞ্চলের কৌশলী স্থাপনায় যে গর্ভ লুকিয়ে রেখেছিলেন কুন্তী— গর্ভং তং বিনিগূহতী— সেই গর্ভমোচনের পর তাঁর মায়া কম ছিল না। সোনার বর্ম, সোনার কুণ্ডল, দেহের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য কবচ-কুণ্ডল নিয়ে কর্ণ জন্মালেন। কুন্তীর মনে কত গর্ব— ছেলে ঠিক বাবার মতো দেখতে হয়েছে— যথাস্য পিতরং তথা। অথচ মুহুর্তেই এই সমস্ত মুগ্ধতা কাটিয়ে ধাত্রীর পরামর্শে শিশুপুত্রটিকে একটি বড়-সড় পেটিকার মধ্যে শুইয়ে দিলেন কুন্তী। তারপর ভাসিয়ে দিলেন অশ্বনদীর জলে, পুত্রের দীর্ঘ জীবন প্রার্থনা করে কত আশীর্বাদ উচ্চারণ করলেন কুন্তী— আমাকে যিনি কন্যাকালেই মাতৃত্বের আস্বাদ দিলেন, তোর সেই পিতা যেন তোকে সব জায়গায় বাঁচিয়ে রাখেন। আমার কোলে ছেলে দিয়ে তোর বাবাই আজ ধন্য, তিনি আকাশ থেকে তাঁর কিরণ-চক্ষুতে সর্বত্র দেখতে পাবেন তোকে। তুই যেখানেই থাকিস বাছা! আমি তোকে ঠিক চিনব, ওই কবচ-কুন্ডল দেখেই চিনব।
অশ্বনদীর জলে ঢেউ লাগছে, ঢেউয়ের পরে ঢেউ, সুদৃশ্য পেটিকাখানি চলতে লাগল। যতই পেটিকাখানি দূরে যেতে লাগল, কুন্তীর হৃদয়ে হাহাকার বাড়তে থাকল তত। তাঁর জননী-হৃদয় বিদারিত হতে থাকল শুধু সেই ধন্যা রমণীর কথা ভেবে— যিনি কর্ণকে কোলে তুলে নেবেন পেটিকা থেকে অথবা তৃষিত শিশুটিকে স্তন্যপান করাবেন।
সোনার পেটিকাখানি অশ্বনদী ছেড়ে চর্মন্বতী জলে এসে পড়ল। চম্বলের শিলাভূমির পাশ দিয়ে চর্মন্বতী কর্ণকে পৌঁছে দিল যমুনায়। যমুনা থেকে গঙ্গা— সোনার পেটিকাখানি মাতৃগর্ভের মতো সুরক্ষিত রাখল সদ্যোজাত শিশুকে— স মঞ্জুষাগতো গর্ভস্তরঙ্গৈ রুহ্যমানকঃ। ভাসতে ভাসতে পেটিকা এসে পৌঁছল সুদূর চম্পা নগরীতে— চম্পা অঙ্গরাজ্যের রাজধানী— তৎকালীন পূর্বভারতের আরম্ভ-স্থান। অঙ্গরাজ্য তখন কুরুরাজ্য হস্তিনাপুরের অন্তর্গত রাজ্য ছিল। কাজেই এটা বলা যায়— কুন্তী যেখানে ভবিষ্যতে বউ হয়ে আসবেন, তাঁর কানীনপুত্র সেইখানেই বাহিত হয়ে এলেন অনেক আগে, হয়তো এমনও বলা যায় যে, তাঁর পিতৃভূমিতে।
সূত অধিরথ হস্তিনাপুরের ভারপ্রাপ্ত রাজা ধৃতরাষ্ট্রের বন্ধু। তিনি সারথি জাতের মানুষ, এককালে কুরুবাড়ির রথ চালাতেন হয়তো, এখন একটু বয়েস হয়েছে। তিনি তাঁর সুন্দরী স্ত্রী রাধার সঙ্গে গঙ্গাস্নানে এসেছেন। এই সুখী দম্পতির সব সুখ আছে কিন্তু তাঁরা অপুত্রক। রাধা গঙ্গায় স্নান করতে নেমেছেন আগে, সূত অধিরথ তীরে একটু দূরে দাঁড়িয়ে কথালাপ করছেন পুরাতনদের সঙ্গে। গঙ্গায় ভেসে আসতে থাকা স্বর্ণ-পেটিকাটি প্রথমে রাধারই নজরে আসে এবং পরম কৌতূহলে লোকজন ডেকে পেটিকাটি গঙ্গা থেকে তীরে ওঠানোর ব্যবস্থা করেন। সূত অধিরথকে খবর জানাতে তিনি এসে পেটিকাটি খুলতেই দেখতে পেলেন ঘুমন্ত এক শিশু। প্রভাতসূর্যের মতো তার গায়ের রং, গায়ে সমাবিদ্ধ কবচ-কুণ্ডল।
অপুত্রক দম্পতি এই ভেসে আসা ধনকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। ছেলেটিকে কোলে তুলে নিতেই দুটি মানুষের এতদিনের রুদ্ধ বাৎসল্য মুখর হয়ে উঠল। অধিরথ পুত্রটিকে রাধার কোলে তুলে দিলেন পরম আদরে। এতদিনে ভগবান মুখ খুলে চেয়েছেন। রাধার অতৃপ্ত জননী-হৃদয় স্নেহে বিগলিত হল, পিতামাতা নবলব্ধ পুত্রকে কোলে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। অনন্ত লালন এবং পালন-ভাবনার মধ্যে পুত্রের নামকরণের চিন্তা হল। ব্রাহ্মণেরা জন্ম থেকেই ছেলের গায়ে সোনার কবচ-কুণ্ডল দেখে তার নামকরণ করলেন বসুষেণ। ‘বসু’ মানে ধন-রত্ন-সোনা, আর জন্মলগ্নেই গায়ে যার সোনার বর্ম, তাঁকে যুদ্ধবীর ক্ষত্রিয়ের ভাবনায় নামের শেষে ‘বর্মা’ বা সেন’ সম্বোধনে বসুষেণ বলে চিহ্নিত করলেন ব্রাহ্মণেরা।
অঙ্গরাজ্যে সূত অধিরথের বাড়িতে লালিত-পালিত হতে হতে কর্ণের গায়েও সেই বিখ্যাত চিহ্ন পড়ে গেল— তিনি সূতপুত্র। সেকালের দিনে দুই ভাবে সূতের পরিচয় হত। একটা হল, যাঁরা রাজা-মহারাজাদের কুলকীর্তি গাইতেন তাঁদের সূত বলা হত। আর মনুর বর্ণবিভাগের নিয়মে কোনও ক্ষত্রিয় যদি প্রতিলোমে ব্রাহ্মণের মেয়ে বিয়ে করতেন, তা হলে তাঁদের ছেলেকে সূত বলা হত। তবে এখানেও বড় ঘর, ছোট ঘরের ব্যাপার ছিল বলে মনে হয়। কেননা দেখুন, মহাভারতখ্যাত যযাতি রাজাও তো ব্রাহ্মণ শুক্রাচার্যের মেয়ে দেবযানীকে বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু কই, যদু-তুর্বসু, অথবা দ্রুহ্যু-পুরুকে তো কেউ সূতপুত্র বলেনি। কাজেই সমাজের অল্পমানী ক্ষত্রিয়, যদি ব্রাহ্মণ-রমণীর প্রেমে পড়ে বিয়ে করতেন, এবং শক্তি-মর্যাদা কম থাকায় মুখর সমাজের মুখ যাঁরা রুদ্ধ করতে পারতেন না, তাঁদের পুত্র-কন্যাদের সূতপুত্র বা সূতপুত্রী বলে সম্বোধন করতেন সামাজিকেরা।
মৎস্যপুরাণ কর্ণপিতা অধিরথের পরিচয় দেবার সময় সূত অধিরথের পূর্বপুরুষদের সকলকেই রাজা বলে সম্বোধন করেছেন, কিন্তু অধিরথের প্রসঙ্গ যেই এল, সঙ্গে সঙ্গে পৌরাণিক বললেন— সূতশ্চাধিরথঃ স্মৃতঃ। অর্থাৎ অধিরথ ছিলেন সূত। যাঁর পূর্বপুরুষেরা পিতৃ-পিতামহক্রমে সকলেই রাজা তাঁদের শেষ ক্রমে হঠাৎই অধিরথকে ‘সূত’ বলা হল কেন, তার কারণ বোধহয় একটাই যে, অধিরথের পিতা কোনও বামুন ঘরের মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন এবং এই অতিক্রান্ত বৈবাহিক ঘটনায় অধিরথ ‘সূত’ বলে পরিচিত হন এবং সূত অধিরথ কর্ণকে পালন করেছিলেন বলেই কর্ণও সূতপুত্র বলে পরিচিত হলেন— মৎস্যপুরাণের ভাষায়— তেন কর্ণস্তু সূতজঃ। অধিরথ সূত নিজের জীবনে সূত-নামের গ্লানি ভোগ করেছেন বলেই দৈবপ্রেরিত পুত্র বসুষেণের বয়স কিছু বাড়তেই তিনি তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন হস্তিনাপুরে। হস্তিনাপুরের রাজা ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁর সখ্যসূত্র আছে— ধৃতরাষ্ট্রস্য বৈ সখা— অধিরথ বসুষেণকে হস্তিনাপুরে পাঠালেন অস্ত্র শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য। তিনি জানতেন— হস্তিনাপুরে দ্রোণাচার্য আছেন এবং দ্রোণাচার্যের মতো অস্ত্রগুরুর কাছে অস্ত্র শিক্ষা করলে তাঁর আদরের পুত্রটি যুদ্ধবিদ্যায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে।
তবে আমরা বলব— দ্রোণাচার্যের শিক্ষার জন্য নয়, সূত অধিরথ পুত্র বসুষেণকে হস্তিনায় সখা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে পাঠিয়েছিলেন পুত্রের সার্বিক বিদ্যালাভের জন্য। কেননা মহাভারতে কর্ণের যে গুরুতালিকা দেখছি, তাতে কৃপাচার্যও তাঁর গুরু ছিলেন। তার মানে, বসুষেণ-কর্ণ (তখনও তাঁর কর্ণ নাম হয়নি) হস্তিনায় কুরুবাড়িতে এসেছিলেন অনেক আগে এবং পাণ্ডব-কৌরবরা যেভাবে প্রথমে কৃপাচার্যের পাঠশালায় শিক্ষা নিতে ঢুকে ছিলেন, ঠিক সেইভাবে কর্ণও তাঁদের সঙ্গে কৃপাচার্যের কাছে প্রাথমিক অস্ত্রশিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। যাঁরা ভাবেন, সেই অস্ত্রপরীক্ষার দিনে কর্ণ উদয় হলেন যুদ্ধ-রঙ্গমঞ্চে, তিনি অর্জুনকে চ্যালেঞ্জ করলেন, তারপর অকথা-কুকথায় তাঁর রাজপুত্র বা রাজা হওয়ার প্রশ্নে দুর্যোধন তাঁকে অঙ্গরাজ্যে বসিয়ে দিলেন রাজা করে, তাঁরা ভুল ভাবেন। বস্তুত কর্ণ কুরুবাড়িতে এসেছেন অনেক আগে এবং দুর্যোধনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বও গড়ে উঠেছে অনেক আগে থেকে, সেই বাল্যকাল থেকেই— স সখ্যমকরোদ্ বাল্যে রাজ্ঞা দুর্যোধনেন চ।
হস্তিনায় কুরু-পাণ্ডবদের মেলে এসে দুর্যোধনের সঙ্গেই কর্ণের বিশেষ বন্ধুত্ব তৈরি হল কেন, তার একটা প্রধান কারণ হল— সূত অধিরথ কর্ণকে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে পাঠিয়ে ছিলেন এবং সেই সূত্রে দুর্যোধনের সঙ্গেই তাঁর প্রথম পরিচয়-প্রণয় হবার কথা। তারপর কৃপাচার্যের পাঠগৃহে যেতে যেতে এই বন্ধুত্ব আরও গাঢ়তর হয়। এদিকে পাণ্ডবদের ওপর দুর্যোধনের যে জন্মাবধি আক্রোশ ছিল, সেটা সঞ্চারিত এবং সংক্রামিত হতে থাকে কর্ণের মধ্যে। দুর্যোধনের পক্ষপাতী এই আক্রোশ কর্ণের মধ্যে নতুন এক স্পষ্ট রূপ নেয়, কর্ণ যখন কুরুকুলের বড় গুরু দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রশিক্ষা নিতে যান। দ্রোণাচার্যের অস্ত্রশিক্ষার গুরুকুলে যাঁরা সবচেয়ে ভাল বিদ্যা গ্রহণ করছিলেন, তাঁদের মধ্যে ভীম, দুর্যোধন, কর্ণ, অশ্বত্থামারা যদি সবচেয়ে ভাল হয়ে থাকেন, তবে সকলের মধ্যে সবচেয়ে ভাল ছিলেন অর্জুন। অর্জুনের এই ভীষণ ভাল হওয়াটাই কর্ণের দিক থেকে সবচেয়ে বড় ঈর্ষার কারণ হয়ে গেল। ধনুর্বিদ্যায় অর্জুনের প্রয়োগ-নৈপুণ্য এবং কৌশল লক্ষ করে কর্ণ আস্তে আস্তে হতাশ বোধ করতে আরম্ভ করলেন। এই হতাশা থেকেই কর্ণের ক্রোধ তৈরি হল। তিনি যখন বুঝলেন যে, দ্রোণের পাঠশালায় অর্জুনই সবার সেরা— সর্বথাধিকসালক্ষ্য ধনুর্বেদে ধনঞ্জয়ম্— তখন তিনি ঠিক করলেন— বল নয়, শক্তি নয়, এমনকী কৌশলও নয়, তিনি মারণাস্ত্র দিয়ে অর্জুনকে শেষ করবেন। তাঁর মারণাস্ত্র চাই কিন্তু সেই মারণাস্ত্রও তো আছে দ্রোণাচার্যের কাছে। গুরু-পরম্পরায় দ্রোণাচার্যের কাছে ব্রহ্মাস্ত্র আছে, সেটি যদি কর্ণ আদায় করতে পারেন, বুঝে নিতে পারেন তার প্রহার-সংহরণের প্রক্রিয়া, তা হলে অর্জুনকে শায়েস্তা করা তাঁর কাছে কঠিন হবে না। আসলে অর্জুনকে মেরেই ফেলতে চান কর্ণ। দুর্যোধনের কাছ থেকে যে পাণ্ডব-বিরোধিতা আত্মসাৎ করেছিলেন কর্ণ, তার সঙ্গে এই চরম ঈর্ষা সংযুক্ত হওয়ায় কর্ণ একদিন বেপরোয়া হয়ে দ্রোণাচার্যকে ধরলেন। আশেপাশে তখন লোকজন নেই, গুরুপুত্র অশ্বত্থামা পর্যন্ত তখন কুটির-বাহিরে, এই সময়ে কর্ণ চুপি চুপি এসে উপস্থিত হলেন গুরু দ্রোণাচার্যের কাছে। চারদিকে তাকিয়ে দ্রোণকে বললেন— গুরুদেব! আমাকে ব্রহ্মাস্ত্র ছোড়বার কৌশল শিখিয়ে দিন। শিখিয়ে দিন ব্রহ্মাস্ত্র ছুড়েও তা সম্বরণ করার উপায়। গুরুদেব! আমি অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাই— অর্জুনেন সমং চাহং যুদ্ধেয়মিতি মে মতিঃ।
হঠাৎ এই উচ্চারণ! সমস্ত সমবয়সি ছেলেমেয়েদের মধ্যে একজন অন্য এক সতীর্থের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চায় প্রতিহিংসা নিয়ে— হঠাৎ এই উচ্চারণ দ্রোণাচার্যকে সচকিত করে তুলল। অর্জুন ততদিনে নিশ্চয় গুরু দ্রোণাচার্যের কাছ থেকে ব্রহ্মাস্ত্র পেয়ে গেছেন, কিন্তু কোন ধীরতা, কোন আত্মশক্তি অথবা কোন বিশেষত্বের বলে অর্জুন গুরুর কাছ থেকে ব্রহ্মাস্ত্রের শিক্ষা লাভ করেছেন, সেটা কর্ণ অনুধাবন করেন না। তিনি শুধু ভাবেন— তিনি যা পারছেন না, অর্জুন তা কেন পারবেন। অতএব দ্রোণের কাছে অনুযোগ করে বললেন— ঠাকুর! সমস্ত শিষ্যদের প্রতিই তো আপনার সমদৃষ্টি। এমনকী নিজের ছেলে এবং শিষ্যদের মধ্যেও আপনি ভেদ করেন না— সমঃ শিষ্যেষু বঃ স্নেহঃ পুত্রে চৈব তথা ধ্রুবম্। এই সমদর্শিতার পরেও যেন কেউ না বলে যে, কর্ণ দ্রোণাচার্যের শিষ্য হওয়া সত্ত্বেও সঠিক বিদ্যে হয়নি তার।
পুত্র এবং শিষ্যে তাঁর সমদৃষ্টি— এই কথাটা বলে দ্রোণকে খানিকটা উসকেই দিলেন কর্ণ। বাস্তবে দ্রোণ নিজের পুত্রের চেয়েও অর্জুনকে বেশি পছন্দ করেন। অর্জুনের প্রয়াস, প্রচেষ্টা, ধীরতা এবং বিনয় দেখে গুরু দ্রোণাচার্য নিজের খুশিতেই অর্জুনকে ব্রহ্মাস্ত্রের শিক্ষা দান করেছিলেন, পুত্র অশ্বত্থামাকে তার পর এবং সেটা নিতান্তই মায়াবশত। আজ কর্ণ সেই সব কথা তুলে তাঁকে বিব্রত করছেন। কিন্তু মহাভারতের কবি দেখিয়েছেন— মেধাবী এবং বিনয়ী শিষ্যের প্রতি পক্ষপাত কিছু থাকেই, দ্রোণেরও তাই ছিল— সাপেক্ষঃ ফাল্গুনং প্রতি— ফলে একদিন অর্জুনের অস্ত্রপ্রয়োগের নৈপুণ্য দেখেই তিনি অর্জুনকে ব্রহ্মাস্ত্র দিয়েছিলেন। কিন্তু আজকে কর্ণের কথা শুনেই দ্রোণ বুঝে গেলেন যে, গুরু হিসেবে প্রতিজ্ঞাত সমদর্শিতার জায়গাটাকে অভিযুক্ত করেই কর্ণ আজ অর্জুনের প্রতি ঈর্ষায় ব্রহ্মাস্ত্রের প্রয়োগ করতে চাইছেন। বিশেষত কর্ণের প্রতিযোগী মনোভাব, দুর্যোধনের সঙ্গে তাঁর ওঠা-বসা, অর্জুনের প্রতি তাঁর প্রতিহিংসা বৃত্তি— এগুলি দ্রোণের নজর এড়ায়নি। তা ছাড়া একটি বিশেষ ব্যক্তির ওপর প্রতিস্পর্ধা এবং প্রতিহিংসার কারণেই যে মানুষ ব্রহ্মাস্ত্রের মতো প্রখ্যাত মারণাস্ত্রের প্রয়োগ-কৌশল শিখতে চায়, তার মধ্যে অস্ত্রশিক্ষার ইচ্ছা ছাড়াও অন্য অসদিচ্ছা আছে, এটা দ্রোণ বুঝতে পারলেন— দৌরাত্মঞ্চৈব কর্ণস্য বিদিত্বা তমুবাচ হ।
দ্রোণ সোজাসুজি প্রত্যাখ্যান করলেন না, কিন্তু তিনি যে কর্ণের মনোভাব বুঝে গেছেন, সেটা বুঝিয়ে দিয়েই বললেন— ব্রহ্মাস্ত্র জানার অধিকার আছে ব্রাহ্মণের, যিনি সাধারণত অস্ত্র-ব্যবহার করেনই না। সদাচারী সচ্চরিত্র ক্ষত্রিয় এই ব্রহ্মাস্ত্র লাভের উপযুক্ত, এমনকী সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীও এই ব্রহ্মাস্ত্র লাভ করতে পারেন, কিন্তু আর কেউ নন— নান্যো বিদ্যাৎ কথঞ্চন। আসলে ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই যে সততা এবং ত্যাগের কথা বলা হচ্ছে, তাতে আরও প্রমাণ হয় যে, এই অস্ত্র প্রয়োগ করার জন্য বহুল হিতকর অথচ এক নিষ্কাম ঔদাসীন্য লাগে। দ্রোণাচার্যের কাছে কর্ণ যে অ্যাটিটুডে কথা বলেছেন, তাতে তাঁর সব বোঝা হয়ে গেছে; অতএব প্রত্যাখ্যানের ভাষা ব্যবহার না করেও ব্রহ্মাস্ত্র লাভের যোগ্য ব্যক্তির চারিত্র-বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে দ্রোণ বুঝিয়ে দিলেন— কর্ণ এখানে একেবারেই যোগ্য নন।
কর্ণ বোধহয় মানসিকভাবে প্রস্তুতই ছিলেন এবং হয়তো বা জানতেনও যে, অর্জুনকে যিনি সপক্ষপাতে ব্রহ্মাস্ত্র দান করেছেন, সেই অস্ত্র তিনি অর্জুনের প্রতি অসূয়াপরায়ণ ব্যক্তিকে দেবেন না। অতএব আর কোনও ভণিতা না করে, কোনও কথা না বাড়িয়ে, তিনি দ্রোণাচার্যের কাছ থেকে বিদায় নিলেন— আমন্ত্র্য প্রতিপূজ্য চ। কাউকে তিনি এ-ব্যাপারে বেশি কিছু বললেন না, কর্ণ সটান চলে গেলেন মহেন্দ্র পর্বতে, যেখানে ক্ষত্রিয়ান্তক পরশুরাম থাকেন। সেখানে কী হল জানার আগে এটা বলা দরকার যে, যাঁরা ভাবেন— গুরু দ্রোণাচার্য কর্ণকে সূতপুত্রতার কারণে অস্ত্রশিক্ষা দিতে অস্বীকার করেছেন, তাঁরা ভুল ভাবেন। এরকম কোনও ঘটনা ঘটেনি। বরঞ্চ বলব— অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য যখন মারণাস্ত্র চেয়েছেন কর্ণ, তখন তাঁর অস্ত্রশিক্ষা সম্পূর্ণও হয়ে থাকতে পারে, কেননা অস্ত্রশিক্ষার শেষ পর্বেই এই ব্রহ্মাস্ত্র-দানের প্রসঙ্গ আসে। আর যদি অস্ত্রশিক্ষা শেষ না হতেই কর্ণ ব্রহ্মাস্ত্র দাবি করে থাকেন, তা হলে বলব এটা কর্ণের পক্ষে ‘স্ট্রাটিজিক’ ভুল। এবং দুই ক্ষেত্রেই দ্রোণাচার্যের পক্ষে ব্রহ্মাস্ত্রের দাবি প্রত্যাখ্যান করাটা নিতান্ত স্বাভাবিক।
বসুষেণ কর্ণ পরশুরামের কাজে উপস্থিত হলেন অস্ত্রলাভের জন্য। পরশুরামের মাহেন্দ্র বিদ্যালয়ে সূতপুত্রের পরিচয়ও চলবে না, ক্ষত্রিয়ের পরিচয়ও খুব পছন্দের নয় ক্ষত্রিয়ান্তক পরশুরামের কাছে। অতএব সম্পূর্ণ মিথ্যাচারে পরশুরামের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে কর্ণ বললেন— আমি ভার্গব গোত্রের ব্রাহ্মণ— ব্রাহ্মণো ভার্গবোহস্মি। কাশ্যপ, ভরদ্বাজ কিংবা মৌদ্গল্য নন, একেবারে ভার্গব ব্রাহ্মণ শুনে পরশুরাম বেশ খুশিই হলেন, কেননা তিনি নিজেই ভৃগুবংশীয় ভার্গব। এক প্রখ্যাত ভার্গবের কাছে অন্য এক ভার্গব ব্রাহ্মণ এসেছে বিদ্যাশিক্ষার জন্য, পরশুরাম ভারী খুশি হয়ে তাঁকে স্বাগত জানালেন— স উক্তঃ স্বাগতঞ্চেতি প্রতিমাংশ্চাভবদ্ ভৃশম্।
এটা আমরা বুঝতে পারি যে, কর্ণ যোদ্ধা হিসেবে যথেষ্টই বড় ছিলেন এবং এই বড় হওয়ার জন্য তাঁকে পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে অনেক। পরিবেশ মানে ওই আর কী! সেই কালে, সূত অধিরথের ছেলে বড় ঘরে এসে বড় মাস্টারের কাছে পড়ছে, সেখানে অভীষ্ট-লাভে সম্পূর্ণতা এল না, তাই কর্ণ আরও বিখ্যাত গুরুর কাছে গেলেন নিজেকে উন্নত করার জন্য— কর্ণের এই যে চেষ্টা, এই যে নিরলস প্রয়াস— এটা দেখেই অনেকে মায়া করেছেন তাঁকে। এমনকী মহাভারতের বিখ্যাত টীকাকার নীলকণ্ঠ, তিনিও এই মুহুর্তে করুণ হয়েছেন কর্ণের ওপর। তিনি বলেছেন— কর্ণ যে নিজেকে ‘ভার্গব’ বলে পরিচয় দিলেন, তার কারণ— তিনি ভাববেন— গুরু তো পিতার সমান হন, অতএব ভার্গব পরশুরামকে তিনি যখন মনে মনে একবার গুরু বলে মেনে নিয়েছেন, সেখানে নিজেকে ভার্গব বলে পরিচয় দিতে ক্ষতি কী? অর্থাৎ কিনা, আপন অভীষ্টসিদ্ধির জন্য কর্ণের যে এই মিথ্যাচার, তাও আমরা খানিকটা ঢেকে দিতে চাই তাঁর জন্মাযাতনার অপরিসীম লাঞ্ছনার নিরিখে। কিন্তু সব কিছুর ওপরে এটাও মানতে হবে যে, সূত অধিরথের গৃহে পালিত হলেও কর্ণের মধ্যে সেই অন্তর্জাত বিনয়-শুদ্ধি নেই, তিনি যে পরশুরামের কাছেও এসেছেন, তাও কোনও বিদ্যাশিক্ষার সরসতায় নয়, এখানেও তিনি মারণাস্ত্র লাভের জন্যই এসেছেন এবং স্বকার্যসিদ্ধির জন্যই মিথ্যাপরিচয় দিয়েছেন।
কর্ণ নিশ্চিন্তে বিদ্যাশিক্ষা করছিলেন এবং তাঁর সেবামাধুর্যে এবং শ্রদ্ধায় এতটাই তুষ্ট করেছিলেন গুরু পরশুরামকে যে, তিনি ব্রহ্মাস্ত্রের গ্রহণ, ধারণ এবং সম্বরণের সমস্ত কৌশল কর্ণকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। হয়তো সেই শিক্ষণ-প্রশিক্ষণের প্রক্রিয়া তখনও চলছিল, যখন সেই বিরাট দুর্ঘটনা ঘটল। সেদিন উপবাসে ক্লিষ্টদেহ পরশুরাম শিষ্য কর্ণের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন আর সেই সময় কাঁকড়া-বিছে-জাতীয় একটি কীট কর্ণের উরু ভেদ করে রক্ত খেতে লাগল। নড়াচড়া করলে গুরু যদি জেগে যান, তাই কর্ণ এতটুকুও নড়লেন না, কিন্তু উরুর উপরিতল বাহিত চুঁইয়ে পড়া রক্ত পরশুরামের গায়ে গিয়ে লাগল। পরশুরাম জেগে গিয়ে দেখলেন— নিবাত নিষ্কম্প প্রদীপের মতো কর্ণ নিশ্চল বসে আছেন। অসহ্য ব্যথা নিজে সহ্য করছেন, কিন্তু গুরুকে ব্যাথা দিচ্ছেন না, তাঁর ঘুমের ব্যাঘাত করছেন না এতটুকুও— অকম্পয়ন্ অব্যথয়ন্ ধারয়ামাস ভার্গবম্। রক্ত গায়ে লাগায় ব্রতধারী পরশুরাম অশুচি বোধ করলেন, কিন্তু তার থেকেও বড় কথা, তাঁর সন্দেহ হল— এই অসম্ভব ব্যথা বসুষেণ কর্ণ সহ্য করলেন কী করে! পরশুরাম বললেন— তুমি পরিষ্কার বলো, কে তুমি? তুমি নিজেকে ভার্গব ব্রাহ্মণ বলে পরিচয় দিয়েছ, কিন্তু ব্রাহ্মণদের সহ্যশক্তি কতটুকু, সব আমার জানা আছে, এই ভয়ংকর কীটের দংশন কোনও ব্যাটা বামুন সহ্য করতে পারবে না, এই সহ্যশক্তি ক্ষত্রিয়কে মানায়, অতএব বলো তুমি কে?
কর্ণ বললেন। নিজের সত্য পরিচয় জানিয়ে কর্ণ বললেন, আমি জন্মেছি সেই ঘরে, যেখানে এক ক্ষত্রিয় পুরুষ এক ব্রাহ্মণ কন্যার পাণিগ্রহণ করেছিল— ব্রহ্মক্ষত্রান্তরে জাতং সূতং মাং বিদ্ধি ভার্গব। লোকে আমাকে রাধার ছেলে রাধেয় কর্ণ বলে ডাকে। কর্ণ যে মায়ের পরিচয়ে নিজেকে পরিচিত করছেন, সেখানেও হয়তো এই অচেতন প্রয়াস ছিল যে, আমার পিতা যাই হোন, আমার মা তো বামুনের মেয়ে বটে। হয়তো ব্রাহ্মণ-কন্যার গর্ভজাত বলেই রাধার যে সামাজিক উচ্চতা ছিল, সেই সামাজিক উচ্চতা সেকালের মানুষও পছন্দ করত বলেই কর্ণকে লোকে রাধার নামে সংজ্ঞিত করত। হয়তো বা এসব কিছুই নয়, এতকাল পরে অধিরথ-ভার্যা রাধা তাঁর কোলে ছেলে পেয়েছিলেন বলে পালিকা জননীর সমধিক স্নেহই বসুষেণ কর্ণের প্রধানতম উপাধি হয়ে গিয়েছিল, কেননা অধিরথ সূতের ঘরে তো আর কুন্তীর দেওয়া বসুষেণ নামটি জানা ছিল না, আর তখনও পর্যন্ত তিনি কর্ণও হননি, অতএব দৈবপ্রাপ্ত ছেলেটিকে লোকে রাধার ছেলে বলেই ডাকত এবং কর্ণও সেটাই পছন্দ করতেন। আর আমরা তো বলব, মায়ের নামে নিজেকে পরিচিত করার এই পছন্দটার পিছনে কর্ণের জীবন-যন্ত্রণা বা অভিমান যতই থাকুক, এখানে তাঁর আধুনিকতাও কম নয়।
যাই হোক, রাধার নামেও যে আংশিক ব্রাহ্মণ্য তৈরি হয়, সেটা যৌক্তিকভাবে বুঝিয়ে দেবার পরেই কর্ণ অত্যন্ত সাহসীভাবেই বললেন, হ্যাঁ, আমি অস্ত্রলুব্ধ হয়ে অস্ত্রের লোভেই আপনার কাছে এসেছিলাম, এই সত্য শুনে অন্তত আপনি প্রসন্ন হোন— প্রসাদং কুরু মে ব্রহ্মান্ অস্ত্রলুব্ধস্য ভার্গব। একই সঙ্গে মিথ্যে পরিচয় দেবার কারণটাও যে বিপরীত এক সমাজের জাতি-বর্ণ-বিন্যাস অস্বীকার করে নিজের বোধ-বুদ্ধি-কৌশল প্রতিষ্ঠা করার জন্যই, সেটা কর্ণ জানালেন স্পষ্ট ভাষায়। বললেন, গুরু হলেন পিতার মতো, অতএব আপনাকে গুরু মেনেছি বলেই আপনার গোত্রে নিজের পরিচয় দিয়েছি আমি। এইভাবে বলার পর একটু ভয় ভয়েই ছিলেন কর্ণ, পরশুরাম সেই ভয় সত্য করে দিয়ে বললেন— শুধুমাত্র অস্ত্রের লোভে তুই যেহেতু আমার সঙ্গে মিথ্যা আচরণ করেছিস, অতএব সংকট-মূহুর্তে যখন তোর বিনাশকাল ঘনিয়ে আসবে, তখন এই ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগের কৌশল তোর মাথায় আসবে না— ন তে মূঢ় ব্রহ্মাস্ত্রং প্রতিভাস্যতি— তবে হ্যাঁ, এইটুকু নিশ্চয়ই হবে যে, যুদ্ধকালে অন্য কোনও ক্ষত্রিয় পুরুষ তোমার সঙ্গে এঁটে উঠবে না।
এই শেষ সান্ত্বনাটুকু বোধহয় এইজন্যই যে, কর্ণ তাঁর অন্যান্য সুযোগ্য ব্যবহারে গুরু পরশুরামকে তুষ্ট করতে পেরেছিলেন। পরশুরামের সামান্য ঘুমের ব্যাঘাতটুকু এড়ানোর জন্য তিনি যে অসম্ভব ব্যথা সহ্য করেছেন, এটা তারই সান্ত্বনা পুরষ্কার— কর্ণ যুদ্ধ করলে কেউ তাঁর সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে না। কিন্তু শিক্ষা শিক্ষাস্থান বা শিক্ষার্থীর পক্ষে কোনও মিথ্যাচার সেকালের দিনে বরদাস্ত করা হত না। আর একটা কথা হল, দ্রোণাচার্য, পরশুরাম— দুই গুরুর কাছেই যে কর্ণের ব্রহ্মাস্ত্র-লাভের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে গেল, তার মর্মাৰ্থে বোঝা যায়— অস্ত্রের জন্যই অস্ত্র, মারব বলেই মারণাস্ত্র-সংগ্রহের চেষ্টাটা সেকালের অস্ত্রশিক্ষা-নীতির দার্শনিকতার মধ্যে পড়ত না। হয়তো সেটাই কর্ণ জীবন দিয়ে বুঝিয়েছেন।
॥ ৩ ॥
যাই হোক, পরশুরামের মহেন্দ্র পর্বতাবাস ছেড়ে এসে কর্ণ প্রথমেই যাঁর সঙ্গে দেখা করলেন, তিনি হলেন পাণ্ডব-বৈরী দুর্যোধন। কর্ণ তাঁর কাছে অস্ত্রশিক্ষার বিস্তারে গেলেন না, কিন্তু ওই যে পরশুরামের আশীর্বাদ ছিল— কেউ তাঁর সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে না, তাতেই কৃতকৃত্য বোধ করে কর্ণ দুর্যোধনকে বলেছেন— অস্ত্রের সমস্ত কৌশল শিক্ষা করে ফিরে এসেছি আমি— দুর্যোধনম্ উপাগম্য কৃতাস্ত্রোহস্মীতিচাব্রবীৎ। দুর্যোধন ভারী খুশি হলেন, তাঁর খুশিতে কর্ণও আজ মহাখুশি— দুর্যোধনেন সহিতো মুমুদে। তবে এটা মনে রাখতে হবে যে, দুইজনের এই খুশির মিল হয়ে যাবার মূলস্থান একটাই এবং সেটা হল প্রবল পাণ্ডব-বিরোধিতা— দুর্যোধন পাঁচ ভাই পাণ্ডবেরই জন্মশত্রু, আর কর্ণ কিছুতেই পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম অর্জুনকে সহ্য করতে পারেন না।
ঠিক এই জায়গা থেকেই এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, অস্ত্রপরীক্ষার দিনে অর্জুন যখন তাঁর অস্ত্র-কৌশল দেখাচ্ছিলেন, সেই সময় হঠাৎ কোথা থেকে কর্ণ এসে উদয় হলেন অস্ত্ররঙ্গের প্রসারিত ভূমিতে— এই বর্ণনাটা নেহাৎই এক নাটকীয় উপস্থাপনা, যেটা মহাকাব্যের চমৎকার তৈরি করেছে। অন্যদিকে এটাও মহাকাব্যিক প্রক্রিয়াই বটে যে, ঘটনা চলার ফাঁক-ফোঁকরে মহাকবি কতগুলি সংবাদ দিয়ে রাখেন— ঠিক যেমনটি এখানে, কর্ণ পরশুরামের আবাস ছেড়ে এসে আর অঙ্গরাজ্যের রাজধানী চম্পায় ফিরে যাননি। তিনি এসে দুর্যোধনের সঙ্গে মিলেছেন এবং অস্ত্রপরীক্ষার দিনে তিনি পূর্বপরিকল্পতিভাবেই— অথবা বলা উচিত দুর্যোধনের পরিকল্পনা, মাফিকই এসে উপস্থিত হয়েছেন ঠিক সেই সময়ে, যখন অর্জুন তাঁর অস্ত্রকৌশল প্রদর্শন করে সমবেত জনতার ধন্য-ধ্বনি গ্রহণ করছেন। সূত অধিরথ, যিনি খবর পেয়েছেন যে, তাঁর ছেলে ফিরে এসেছে হস্তিনাপুরে, অথচ অঙ্গরাজ্যে চম্পায় সে এল না— এই অবস্থায় তিনি নিজেই রওনা দিয়েছেন ছেলের সঙ্গে দেখা করতে এবং পাকেচক্রে তিনিও সেই দিনই অস্ত্র-রঙ্গমঞ্চে এসে উপস্থিত হয়েছেন, যেদিন তাঁকে প্রিয় পুত্রের অপমানও যেমন দেখতে হয়েছে, তেমনই দেখতে পেয়েছেন তাঁর আকস্মিক রাজপদবীর উচ্চতায় আরোহণ।
আপনারা জানেন সকলে— দ্রোণাচার্যের অস্ত্রপরীক্ষার মঞ্চ যখন অর্জুনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, অস্ত্রের কৌশল দেখানোর আর্জুনিক পর্ব যখন শেষ হয়ে আসছে, বাজনদারদের বাদ্যি বাজন প্রায় মন্দীভূত, তখনই নিজের চরম অস্তিত্ব জানিয়ে, যেন ‘অয়মহং ভোঃ’ বলে রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করলেন কর্ণ। বজ্রের মতো তাঁর কণ্ঠস্বর, মেঘধ্বনির মতো সেটা শুনতে হয় অনিচ্ছেতেও, তাঁর হাঁটাচলায় পর্বতের প্রতিস্থাপন— পাদচারীব পর্বতঃ— অর্থাৎ পর্বত যদি পা ফেলে হাঁটে, সেই পর্বতকে যেমন ইচ্ছে করলেই ছুড়ে ফেলে দেওয়া যায় না, তেমনই অপ্রতিরোধ্য ভঙ্গিতে প্রবেশ করলেন কর্ণ। সটান এসে দাঁড়ালেন অর্জুনের সামনে, দ্রোণ-কৃপকে একটা নমস্কার ঠুকলেন অনাদরে অবহেলায় এবং অর্জুনকে বললেন, তুমি যা যা এখানে অস্ত্রকৌশল দেখিয়েছ, তা সবই আমি করে দেখাব। অর্জুনের কিছু বলার রইল না, সমবেত জনতার কৌতূহল চিৎকার শুনে দ্রোণও অনুমতি দিতে বাধ্য হলেন এবং এটাও ভয়ংকর এক সত্য যে, অর্জুন যা যা কায়দা-কেতা দেখিয়েছিলেন, কর্ণ সবকিছুই করে দেখালেন— যৎ কৃতং তত্র পার্থেন তচ্চকার মহাবলঃ।
কর্ণের বাণমুখর জবাব দেখে দুর্যোধন একশো ভাইয়ের সঙ্গে নেমে এলেন কর্ণকে অভিবাদন করতে। কর্ণকে জড়িয়ে ধরে দুর্যোধন বললেন, উচিত শিক্ষা দিয়েছ লোকটাকে, একেবারে মুখের মতো জবাব। আমার এই কুরুরাজ্যের সমস্ত ভোগে তোমারও স্বত্ত্ব আছে। কর্ণ বললেন, আমি কিচ্ছু চাই না, আমি শুধু তোমার বন্ধুত্ব চাই, আর অর্জুনের সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধ করতে চাই। দাদা ভাইকে চিনল না, ভাইও দাদাকে চিনল না, মাঝখান থেকে দু’জনের স্বার্থ এক হয়ে গেল।
অস্ত্রের একই রকম ভেলকি দেখিয়ে দেবার পর কর্ণ যখন মেজাজে অহংকার প্রকাশ করছেন এবং তাঁর সমর্থকরা তাঁর সঙ্গে গলা মেলাচ্ছেন, এই অবস্থায় অর্জুনের অপমানিত মুখে তেমন কথা যোগাল না। যা তিনি বললেন, সেটাও কর্ণের দাপটে প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেল। কর্ণ বলে দিলেন— কথায় কোনও কাজ নেই, তুই যুদ্ধ কর আমার সঙ্গে, আমি তোর গুরুর সামনেই তোর মাথা খেটে মাটিতে ফেলে দেব। অর্জুন প্রস্তুত হলেন যুদ্ধের জন্য এবং এই আসন্ন যুদ্ধ থামানোর জন্য কৃপাচার্য সেই চরম অপমান-শব্দ উচ্চারণ করলেন, যা তাঁর বলা উচিত ছিল না। যুদ্ধের আগে নিজের গোত্রপ্রবর জানিয়ে যুদ্ধ করতে হবে— এমন কোনও শাস্ত্রবাক্য বা শাস্ত্র নির্দেশ সেকালেও ছিল না এবং যোদ্ধারা সমস্ত বর্ণ থেকেই ‘রিক্রুটেড’ হতেন, এমন প্রমাণ ভূরি ভূরি আছে। এই অবস্থায় অর্জুন হলেন রাজপুত্র, এবার কর্ণ! তুমি কোন বংশের ছেলে সেটা বলো, সেই বুঝে অর্জুন তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করবেন’— এটা বলা মানে কর্ণকে সোজাসুজি জন্ম-যন্ত্রণা নিয়ে আঘাত করা। কর্ণ একেবারে চুপ করে গেলেন।
এত বড় বীর যে এক মুহূর্তে চুপ করে গেলেন তাতে মহাভারতের কবির মনে আঘাত লেগেছে। তিনি বলছেন, কৃপের প্রশ্ন শুনে কর্ণের মুখটি লজ্জায় অবনত হল। অর্জুনের সঙ্গে প্রতিস্পর্ধী কর্ণের মুখটি লাগছিল সদ্য ফোটা পদ্মের মতো। এই মুহুর্তে সেই ফুল পদ্মের ওপর কৃপের প্রশ্ন যেন বর্ষার জল ঢেলে দিল— বভৌ বর্ষাম্বুবিক্লিন্নং পদ্মমাগলিতং যথা। পদ্মের উপমা কেন? পদ্ম যে পাঁকে ফোটে, কর্ণও তো সেই সূতপঙ্কে পঙ্কজ। যদি বা পাঁকে পদ্ম ফুটল, তার ওপরে বর্ষার জলধারা নামল। নিজের মৃণাল-মেরুদণ্ডে তাঁকে আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে হল না— বর্ষাম্বুবিক্লিন্নং পদ্মমাগলিতং যথা।
এগিয়ে এলেন দুর্যোধন। এই অপমানের দিনে দুর্যোধন সত্যিই বন্ধুর কাজ করলেন। তিনি বললেন, আচার্য! তিন রকমের রাজা হয়— যিনি সৎকুলে জাত, যিনি বীর এবং যিনি সৈন্যপরিচালনা করতে পারেন। তবু যদি রাজা নয় বলে অর্জুনের যুদ্ধে শুচিবায়ু থাকে, তবে এই মুহুর্তে কর্ণকে আমি অঙ্গরাজ্যের রাজা করে দিচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে ফুল, খই, মুকুট, সোনার পিঁড়ি, সব এসে গেল। মন্ত্রবিদ ব্রাহ্মণেরা অভিষেকমন্ত্র পড়লেন। জয়শব্দ উচ্চারণ করলেন কৌরবেরা। যবনী রমণীরা কর্ণের মাথার ওপর ছাতা ধরে চামর দুলাতে লাগল— সচ্ছত্রবালব্যজনো জয়শব্দোত্তরেণ চ। কর্ণ একেবারে অভিভূত হয়ে পড়লেন। দুর্যোধনকে তিনি বললেন, রাজ্য দিয়েছ তুমি, এর উত্তরে আমি কীই বা দিতে পারি তোমায়। দুর্যোধন বললেন, কিছু নয়, শুধু তোমার বন্ধুত্ব চাই। দুই পাণ্ডববিরোধী মহাবীর পরস্পর আলিঙ্গন করলেন।
তবু যুদ্ধ হত, অর্জুন-কর্ণে তবু একটা যুদ্ধ তখনই লাগত। কিন্তু সেই মুহূর্তে রঙ্গস্থলে প্রবেশ করলেন বৃদ্ধপ্রায় এক মানুষ, পথক্লেশে এবং তাড়াতাড়িতে তাঁর উত্তরীয়বাস লুটোচ্ছে ভূঁয়ে। ঘেমে নেয়ে লাঠিতে ভর করে প্রবেশ করলেন কর্ণের পিতা সূত অধিরথ। তাঁকে দেখা মাত্র ধনুক ত্যাগ করে কর্ণ তার অভিষেকের জল-ধোয়া মাথাটি লুটিয়ে দিলেন অধিরথের পায়ে— কর্ণোহভিষেকাদ্ৰশিরাঃ শিরসা সমবন্দত। এতগুলি প্রণম্য লোকের সামনে পুত্রের এমন সগর্ব প্রণাম পেয়ে অধিরথের যেন কেমন লজ্জা করতে লাগল। নিজের কাপড়ের খুঁটি দিয়ে নিজের পা দু’খানি ঢেকে তিনি বললেন, থাক্ বাবা! থাক্ থাক্। অঙ্গরাজ্যের অভিষেকে আর্দ্র-শির কর্ণের মাথায় পিতৃতীর্থের আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
অসহিষ্ণু মধ্যম পাণ্ডব এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। এবার সূত অধিরথকে দেখে তাঁর কথায় ধার এসে গেল। ভীম বললেন, ওরে সারথির বেটা, তুই না রাজপুত্রের সঙ্গে যুদ্ধ করবি বলছিলি। তুই বরং যা, ধনুক ছেড়ে তাড়াতাড়ি ঘোড়ার লাগাম ধর হাতে— কুলস্য সদৃশস্তূর্ণং প্রতোদো গৃহ্যতাং ত্বয়া। এ আবার অঙ্গরাজ্যের রাজা হয়েছে, তোর কি সে যোগ্যতা আছে? কুত্তা যেন যজ্ঞের ঘি খেতে এসেছে। এইসব কাদা-ছোড়া কথার উত্তরে কর্ণের বিকল্প আছে শুধু দীর্ঘশ্বাস, আর আছে পিতৃকল্প সূর্যের দিকে তাকানো। আবার প্রতিবাদ করলেন দুর্যোধন। বললেন, এসব বাজে কথা বোলো না ভীম। ক্ষত্রিয়ের বলই সব; বলবান পুরুষ আর নদীর উৎস খুঁজতে যেয়ো না, কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরবে। এই বিশ্বামিত্র, দ্রোণ, কৃপ— এঁদেরও জন্মবিন্দুতে রহস্য আছে। আর ভীম! তোমাদের পাঁচ ভায়ের জন্ম কেমন করে হয়েছে তাও আমি জানি— ভবতাঞ্চ যথা জন্ম তদপ্যাগমিতং ময়া। তা ছাড়া চেয়ে দেখো, এই যাঁর চেহারা, সোনার বর্ম আর সোনার কুণ্ডল যাঁর জন্ম থেকে গায়ে আঁটা, সূর্যের মতো উজ্জ্বল গায়ের রং— এইরকম মানুষের জন্ম কি নীচকুলে হতে পারে, হরিণীর পেটে কি বাপু বাঘ জন্মায়— কথমাদিত্যসংকাশং মৃগী ব্যাঘ্রং জনিষ্যতি। দুর্যোধন বললেন, আরে! শুধু অঙ্গরাজ্য নয়, সমস্ত পৃথিবীতেই রাজা হবার উপযুক্ত আমাদের কর্ণ। তা ছাড়া কারও যদি আমার কথাবার্তা ভাল না লাগে, সে এসো না বাপু, যুদ্ধ করবে।
আবার যুদ্ধ হয় হয়। রঙ্গস্থলের লোকেরা, দর্শকেরা হাহাকার করে উঠল। কিন্তু ওই সময়ে সূর্য সম্পূর্ণ অস্ত গেল। কাজেই শুধুমাত্র আলোর অভাবে সে যাত্রা আর কিছু হল না। অস্ত্র-পরীক্ষার দিনে সবচেয়ে বড় লাভ হল দুর্যোধনের। সব শিখে এসেছি বললেও কর্ণেরও একটা পরীক্ষা প্রয়োজন ছিল। ব্রহ্মাস্ত্র পর্যন্ত নাই যাক, যতটুকু দেখেছেন, তাতেই দুর্যোধন দারুণ খুশি। তিনি হাতে ধরে আগে আগে নিয়ে চললেন তাঁকে এবং তাঁর একশো ভাই মশাল জ্বালিয়ে কর্ণের জয়ধ্বনি দিয়ে মিছিল করে চলল— দীপিকাগ্নিকৃতালোক স্তম্মাদ্ রঙ্গাদ্ বিনির্যযৌ। পাণ্ডবরাও ভীষ্ম-দ্রোণদের সঙ্গে বেরিয়ে নিজের নিজের ঘরে গেলেন। সমাজের লোকেরা কেউ অর্জুনের প্রশংসা করতে লাগল, কেউ বা কর্ণের, এমনকী কেউ কেউ দুর্যোধনেরও প্রশংসা করতে লাগল। পাণ্ডবভাইদের মধ্যে যুদ্ধবলে কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ যুধিষ্ঠিরের ধারণা হল যে, কর্ণের মতো বীর বুঝি আর দুনিয়ায় নেই। অবশ্য এই ধারণা হল অর্জুনের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের অতিপরিচয়ের ফলেই, যাকে ইংরেজিতে বলি familiarity breeds contempt. কিন্তু দুর্যোধনের লাভ, পাণ্ডবদের ক্ষতি, আচার্যদের অপমান— এ সব কিছু অতিক্রম করে অতি অদ্ভুত এক চাপা আনন্দ রঙ্গস্থলে বসে-থাকা এক রমণীকে আপ্লুত করে দিল। যেখানে পাণ্ডব-জননী কুন্তী অন্যান্য কুলবতীদের সঙ্গে তাঁদের মতো করেই কথাবার্তা বলতে বলতে ঘরে ফিরছিলেন, সেখানে তাঁরই মধ্যে এক কুমারী-জননী হৃদয়ভরা চাপ আবেগে ভেসে যাচ্ছিলেন। যাঁকে নাম ধরে ডাকতে পারেননি, লোকলজ্জায় যাঁকে জননীর প্রথম বাৎসল্য থেকে বঞ্চিত করেছেন, তাঁর সেই ছেলে আজ রাজা হয়েছে। কুমারী গর্ভের মতো এ আনন্দও যে অপ্রকাশ্য— আনন্দ প্রকাশিত হলে পূর্বের লজ্জাও প্রকাশিত হবে, তাই চাপা আনন্দ— পুত্ৰম্ অঙ্গেশ্বরং স্নেহাচ্ছন্না প্রীতিরজায়ত।
॥ ৪ ॥
কর্ণ ছোট ছিলেন, বড় হয়েছেন। তাঁর জন্মের রহস্য তাঁর যতখানি বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে জন্ম-রহস্যে পরম্পরায় জমে ওঠা অপমান। অস্ত্রশিক্ষার ‘স্ট্রাগল’ তাঁর বয়স বাড়িয়েছে, বয়স বাড়িয়েছে রাজবাড়ির পরতন্ত্রতা। অঙ্গরাজ্যের রাজা হয়ে তিনি পরের দিনই পিতা অধিরথকে নিয়ে সিংহাসন দখলের জন্য রওনা হননি। বরঞ্চ দুর্যোধনের অসামান্য উপকারের প্রতিদানে তাঁর কাছে প্রতিদিনের বিশ্বস্ততা প্রমাণ করাই যেন কর্ণের একমাত্র কাজ বলে মনে হল। দ্রোণ গুরুদক্ষিণা হিসেবে দ্রুপদকে ধরে আনতে বললে, কর্ণ কিন্তু দ্রোণের সম্পূর্ণ শিষ্য না হওয়া সত্ত্বেও দুর্যোধনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেলেন এবং অর্জুনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এইখানে তাঁর প্রথম হার হল। আর কী, এবার তিনি হস্তিনাপুরের রাজবাড়ির দৈনন্দিন ‘পলিটিক্সে’ জড়িয়ে পড়লেন। দুর্যোধন প্রতিনিয়ত চিন্তা করছেন কী করে জ্ঞাতিভাই পাণ্ডবদের শায়েস্তা করা যায়। দুর্যোধনের সঙ্গে থাকতে থাকতে পাণ্ডবদের শাস্তিচিন্তা কর্ণেরও একান্ত আপন কর্তব্য বলে মনে হতে লাগল। আগুনে ঘি পড়ল যখন অস্ত্রপরীক্ষার দিন থেকে প্রায় এক বছর পরেই যুধিষ্ঠিরকে যুবরাজের পদে অভিষেক করলেন স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্র। শুধু যুবরাজ হলেও হত, রাজ্য পাওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই যুধিষ্ঠির আপন গুণে পিতা-পিতামহের কীর্তি ম্লান করে দিলেন। অন্যদিকে গুরু দ্রোণ গদগদ হয়ে অর্জুনকে দিয়ে দিলেন ব্রহ্মশিরা অস্ত্র, যা তিনি তাঁর গুরুর কাছে পরম্পরাক্রমে পেয়েছিলেন। কৌরবদের আরও রাগ হল এইজন্যে যে, যুধিষ্ঠিরের প্রতিনিধি হয়ে অর্জুন এমন কতগুলি রাজ্য জয় করে এলেন, যা তাঁর বাবাও পারেননি— ন শশাক বশে কর্তুং যং পাণ্ডুরপি বীর্যবান্। সবাই যখন ধন্যি ধন্যি করতে আরম্ভ করল, তখন দুর্যোধনের অন্তঃকক্ষে যে সামান্য ক’জন পাণ্ডবদের জতুগৃহে পুড়িয়ে মারবার বুদ্ধি করলেন, তার মধ্যে একজন হলেন কর্ণ— দুঃশাসনশ্চ কর্ণশ্চ দুষ্টং মন্ত্রম্ অমন্ত্রয়ন্। এ কথা অবশ্য মানতে হবে যে, কৌরবদের এইসব হীন চক্রান্ত কর্ণ ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করতেন না। কিন্তু পরতন্ত্রতা এবং অধমর্ণতার এই এক দায় যে, অনীপ্সিত হলেও তিনি আস্তে আস্তে রাজবাড়ির কূট চক্রান্তগুলির মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠলেন। বারণাবতে জতুগৃহের আগুন পাণ্ডবদের গায়ে আঁচ লাগাতে পারল না, কিন্তু এই আগুনের পথ ধরে আরেক আগুন উলটে এসে লাগল হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে। এতে দুর্যোধনেরা যতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেন কর্ণ। ব্যক্তিগতভাবে কর্ণ।
জতুগৃহ থেকে বেঁচে পাণ্ডবেরা এ বন সে বন ঘুরে গঙ্গাদ্বারে এসে পৌঁছলেন। সেখানে এসেই শুনলেন যজ্ঞের বেদী থেকে জন্মানো দ্রৌপদীর কথা— আগুনপানা দ্রৌপদীর কথা। শুনলেন, সেই দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর হবে। পাণ্ডবেরা ব্রহ্মচারীর বেশে এসে পৌঁছলেন পাঞ্চলে। অন্যদিক থেকে বড় বড় রাজ্যের যত রাজা-মহারাজা আছেন— তাঁরা সবাই এসে উপস্থিত হলেন পাঞ্চালে। তিন ভুবনের সেরা সুন্দরী দ্রৌপদী। গায়ের রং কালো বটে, কিন্তু বিদগ্ধতা এবং ব্যক্তিত্বে তিনি সমস্ত রমণীকুলের মূর্ধন্যভূমিতে দাঁড়িয়ে আছেন। সবার ওপরে তাঁর জন্মলগ্নে অলৌকিকতার স্পর্শ থাকায় বহু রাজাই এলেন তাঁর পাণিপ্রার্থী হয়ে। স্বয়ম্বরা দ্রৌপদী যখন বরমাল্যের থালি নিয়ে অপেক্ষা করছেন রাজসভায়, তখন পাঞ্চাল রাজকুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন পাণিপ্রার্থী বড় বড় রাজাদের নাম ডাকতে থাকলেন জোরে জোরে। তার আগেই তিনি ঘোষণা করেছেন— যে ওই যন্ত্রস্থিত মৎস্যচক্ষু ভেদ করতে পারবে, সেই হবে দ্রৌপদীর স্বামী। ধৃষ্টদ্যুম্নের বলার মধ্যে একটু প্যাঁচ ছিল। তিনি বলেছেন— এই মহান কাজ যে করতে পারবে, সেই কুলীন, রূপবান এবং বীর্যবান পুরুষই দ্রৌপদীর স্বামী হবে— কুলেন রূপেণ বলেন যুক্তঃ। তস্যাদ্য ভার্যা ভগিনী মমেয়ম্। হয়তো একথা শুনে কর্ণের মনে একটু খটকা লেগেছিল— আবার সেই কুলের কথা! হয়তো ভাবলেন— সাজানো বক্তৃতার মধ্যে কুলের কথাটা অভ্যাসবশেই এসেছে নিশ্চয়। কিন্তু একী! বড় বড় রাজাদের নাম ডাকার সময় ধৃষ্টদ্যুম্ন তো দুর্যোধন, দুঃশাসন, এমনকী বিকর্ণ, দুর্বিষহ, দুর্মুখ নামে ধৃতরাষ্ট্রের অকর্মা ছেলেগুলিরও নাম করলেন। এমনকী ধৃতরাষ্ট্রের যে ছেলেগুলির নাম বলা গেল না. ধৃষ্টদ্যুন্ম তাদেরও কারক-বিভক্তি ঠিক করে কর্তৃপদে ব্যবহার করলেন। আর কর্ণের কথা বলতে গিয়ে বললেন— ওঁদের সঙ্গে এসেছেন কর্ণও— কর্ণেন সহিতা বীরা স্ত্বদর্থং সমুপাগতাঃ। কারক-বিভক্তির এই অপব্যবহার কর্ণের মনে লাগে বইকি! তবু তিনি ভাবলেন— যাকগে, তির ছোঁড়ার সময় দেখা যাবে, তখন আর কাউকে কলকে পেতে হবে না।
সত্যিই তো তাই, মৎস্য-চক্ষু ভেদ করার সময় দুর্যোধন, শাল্ব, শল্যেরা তো কিছুই করতে পারলেন না। না হয় ধৃষ্টদ্যুম্ন কর্ণের নামটা যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে বলেননি, তাই বলে কি মহাভারতের কবিও নির্মমতায় মুখ ঘুরিয়ে থাকবেন কর্ণের দিক থেকে। কবি সমস্ত ধনুক তোলা রাজাদের মধ্যে হাহাকার আর্তস্বর তুলে দিয়ে বলেছেন— রূপে, ক্ষমতায়, কুলগর্বে, টাকাপয়সা, যৌবনে যারা বলীয়ান— রূপেণ বীর্যেণ কুলেন চৈব শীলেন বিত্তেন চ যৌবনেন— তারা তো প্রথম থেকেই একসঙ্গে কৃষ্ণাকে পাবার জন্য লাফিয়ে উঠেছিলেন লক্ষ্যভেদ করতে; কিন্তু তাঁরা যে সবাই একে একে ধনুক তুলতে গিয়ে মাটিতে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়েছেন— বিচেষ্টমানা ধরণীতলস্থাঃ। কর্ণ এতক্ষণ বংশবাগীশ রাজাদের মুরোদ দেখছিলেন। কর্ণের প্রতি মমতায় ব্যাস অন্তত তাই বলেছেন— সর্বান্ নৃপাংস্তান্ প্রসমীক্ষ্য কর্ণঃ— সমস্ত রাজাদের চেষ্টাচরিত্তির দেখে, ধনুর্ধারী বীরদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কর্ণ এবার এগিয়ে গেলেন ধনুকের কাছে— ধনুর্ধরাণাং প্রবরো জগাম।
না, অন্যান্য তথাকথিত বীরদের মতো দ্রুপদের রাখা ধনুক তুলতে গিয়ে কর্ণের গলার হারটি খসে পড়েনি, শিথিল হয়নি হাতের কাঁকন— বিস্রস্তহারাঙ্গদচক্রবালম্। কর্ণ ধনুক তুললেন এক মুহূর্তে, উদ্যত ধনুকে গুণ পরালেন সঙ্গে সঙ্গে এবং তাতে লক্ষ্যভেদী বাণ জুড়লেন চোখের নিমেষে। এই তৎপরতা দেখেও যাঁরা ভাবলেন কর্ণ লক্ষ্যভেদ করে দ্রৌপদীকে জিতে নিতে পারবেন না, তাঁরা হচ্ছেন সেই আহাম্মকেরা, যাঁরা পূর্বে ধনুক তোলার চেষ্টা করে মাটিতে গেঁড়ে বসেছেন। কিন্তু ধনুকের রীতিনিয়ম যাঁরা জানেন, সেই পাণ্ডবেরা কিন্তু ব্রহ্মচারীর মতো বসে থেকেও কর্ণকে দেখে সবিষাদে নিশ্চিত হলেন যে, আর দ্রৌপদীকে পাওয়া হল না, কর্ণ তাঁকে লক্ষ্যভেদ করে এই নিয়ে নিল বলে। আর দ্রৌপদী, যিনি এতক্ষণ বরমাল্য হাতে মজা দেখছিলেন, স্বয়ম্বরের শর্ত অনুযায়ী লক্ষ্যভেদ করলেই যাঁর বরমাল্য হাতে এগিয়ে আসার কথা, সেই দ্রৌপদী নিশ্চয় ভাবছিলেন— এ পুরুষটি যেন ধনুক তুলতেই না পারে। কিন্তু এবার! লোকে যে এই মানুষটাকে সূতপুত্র বলে জানে, শেষে অলৌকিক আগুন থেকে জন্ম নিয়ে সারথি জাতের গলায় মালা! সমস্ত সভাকক্ষ উচ্চকিত করে দ্রৌপদী রীতিমতো চেঁচিয়ে বললেন, আমি কিন্তু সূতপুত্রকে বরণ করব না— নাহং বরয়ামি সূতম্।
কর্ণ মনে মনে প্রচণ্ড রেগে গেলেন, সামনে হয়তো তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে তাঁর চিরপরিচিত বিকল্প, সূর্যের দিকে তাকালেন— সামর্ষহাসং প্রসমীক্ষ্য সূর্যম্— ছুড়ে ফেলে দিলেন ধনুকটি। এই যে কর্ণ মাঝে মাঝেই সংকটকালে সূর্যের দিকে তাকান, এর একটা অভিনব ব্যাখ্যা দিয়েছেন মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠ। নীলকণ্ঠের ধারণা, কর্ণ তাঁর নিজের জন্মবৃত্তান্ত জানতেন, অন্তত সূর্যের ঔরসে যে তাঁর জন্ম, এটা তিনি জানতেন। পিতা অধিরথ এবং মাতা রাধার সগৌরব ব্যবহারে এও হয়তো কর্ণের ধারণা ছিল যে, এই সূতবংশের সঙ্গে তার যোগ হয়েছে মাত্র, এঁরা তাঁর জন্মদাতা নন। ভাগ্যের পরিহাসে সূত পিতামাতার স্নেহসম্বন্ধ কর্ণ কখনও অস্বীকার করতে পারেন না বা করতে চানও না, কিন্তু এইসব বিপন্ন মুহূর্তে সূতবংশের সঙ্গে তাঁর আরোপিত কৌলিক যোগ আছে বলে মনে মনে তিনি ভীষণ রেগে যান। নীলকণ্ঠের ধারণা দ্রৌপদীর উচ্চ প্রত্যাখ্যানের পর যে তাঁর রাগ হয়েছে তা এই কারণেই— নীচকুলযোগাদ্ অমর্যঃ! আর কর্ণ যে তবু হাসলেন, সে হাসি দ্রৌপদীকে তাচ্ছিল্য করে নয়। নীলকণ্ঠ মনে করেন, ও হাসিটা সূর্যের প্রতি কটাক্ষ। ভাবটা এই— কার অপরাধে কার শাস্তি— অতএব সূর্যাপরাধত্বাৎ হাসঃ।
আমরা যদি নীলকণ্ঠের মতো অত গভীরে নাও যাই, যদি বলি যোগ্য ব্যক্তিকে অহেতুক ছুতোয় দ্রৌপদী প্রত্যাখ্যান করেছিলেন বলেই কর্ণের রাগ হয়েছে এবং তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছেন তিনি, তা হলেও কোনও ক্ষতি নেই। বস্তুত কর্ণের মনস্তত্ত্ব-গঠনে দুটি নারীর অবদান সাংঘাতিক। কর্ণের জীবনে যে বিকারগুলি ঘটেছে, যে আচরণগুলি তাঁর জীবনে পরস্পরবিরোধী— সেই বিকার এবং স্বতোবিরোধিতার মূলে আছে দুটি নারীর ভূমিকা— এবং সে দুটিই প্রত্যাখ্যানের কাহিনী। এই দুই নারীর প্রথমটি কুন্তী, দ্বিতীয়জন দ্রৌপদী। প্রথমজন অতি শৈশবে জন্মলগ্নেই কর্ণের প্রতি তাঁর পুত্র-সম্বন্ধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। দ্বিতীয়জন যৌবনে যৌগ্য-পুরুষের যোগ্যতা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। যদি বা কুন্তীর দিক থেকে পুত্রত্ব-অস্বীকারের পরেও সূতজননীর স্নেহপ্রলেপে সে জ্বালা কিছুটা কমেছিল, যৌবনোদ্দীপ্ত বীরপুরুষের পৌরুষ অস্বীকার করে সে জ্বালা চতুর্গুণ বাড়িয়ে তুললেন এমন এক রমণী, যিনি একমাত্র পুরুষকারের দ্বারা লক্ষ্যভেদ মাত্রেই যে কোনও পুরুষের দ্বারা জিতা হবেন বলে পূর্বাহ্নেই স্বীকৃত। উন্মুক্ত সভাস্থলে দ্রৌপদীর এই অপমান কর্ণ কোনওদিন ভোলেননি এবং ভোলেননি বলেই এ অপমান কর্ণের মনের গভীরে এমন এক কূট অন্তঃক্রিয়া করেছিল যা থেকে দ্রৌপদী কোনওদিন রেহাই পাননি; পরস্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও নয়।
বারণাবতের অগ্নিকাণ্ড বানচাল হয়ে গেল এবং উলটে পাণ্ডবেরা বেঁচে ফিরে উপহারের মতন পেলেন দ্রৌপদীকে— এই ঘটনা কৌরবশিবিরে দারুণ প্রতিক্রিয়া তৈরি করল। দ্রুপদের রাজসভায় দ্রৌপদীর বিয়েকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণবেশী অর্জুনের সঙ্গে কর্ণের যুদ্ধ হয়েছিল বটে, কিন্তু কর্ণ তখন অর্জুনকে চিনতে পারেননি। সন্দেহ হয়েছিল অবশ্য; কর্ণ বলেও ফেলেছিলেন— ব্রাহ্মণ! যুদ্ধে তোমার নৈপুণ্য দেখে আমি তুষ্ট হয়েছি— তুষ্যামি তে বিপ্রমূখ্য— কিন্তু সত্যি বলতে কি সাক্ষাৎ ইন্দ্র ছাড়া কিংবা অর্জন ছাড়া আমার সঙ্গে এমনিতর এতক্ষণ যুদ্ধ করবে, এ হতেই পারে না। তুমি কি বাপু পরশুরাম না সাক্ষাৎ হরিহর। অর্জুন তখন মিথ্যে কথা বলেছিলেন। যুদ্ধ থামানোর জন্যই হোক, কিংবা নববধূর বিস্মিত, স্ফুরিত মুখখানি দেখার জন্যই হোক, অৰ্জুন বলেছিলেন— আমি পরশুরামও নই, অন্য কেউই নই, আমি ব্রাহ্মণ। আজকে তোমাকে যুদ্ধে জয় করব বলেই এখানে উপস্থিত, তুমি ক্ষান্ত হও আজ— বীর স্থিরো ভব। অর্জুনের মধ্যে প্রচুর ব্রাহ্মতেজ আছে, এইরকম একটা বিচারেই কর্ণ সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধে ক্ষান্তি দিলেন— ব্রাহ্মং তেজস্তদাযজ্যং মন্যমানো মহারথঃ। কিন্তু পরে যখন চর এসে কৌরবশিবিরে খবর দিল যে, দ্রৌপদীকে অর্জুনই জিতে নিয়েছে এবং ভীম, অর্জুন সকলেই ব্রাহ্মণের বেশ ধরে সবাইকে বোকা বানিয়েছে, তখন কৌরবপক্ষে নিজেদের মধ্যে যেন ধিক্কার উঠল। একে তো জতুগৃহের আগুন থেকে বেঁচেছে পাণ্ডবেরা, তার মধ্যে আবার অর্জুন জিতে নিল দ্রৌপদীর মতো সুন্দরীকে— এতসব ভেবে দুর্যোধন, দুঃশাসন, কর্ণ, শকুনি— সবাই মাথা নিচু করে বসেছিলেন। দুঃশাসনটার লজ্জা একটু কম। সে যেন কর্ণকে তাঁর পুরনো সংলাপ স্মরণ করিয়ে দিয়েই চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে থাকল— বেটা যদি বামুনের বেশ ধরে না থাকত তা হলে আর পেতে হত না দ্রৌপদীকে। ভাবটা এই— আমাদের কর্ণ তা হলে দিত ঠান্ডা করে ওই অর্জুনটাকে। দুঃশাসন বললেন— সবই কপাল, দাদা! সবই কপাল— দৈবঞ্চ পরমং মন্যে— নইলে একটা লোকও সেদিন অর্জুনকে চিনতে পারল না।
পাণ্ডবদের এমন সফলতায় মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রও বড় খুশি হলেন না। বিদুরের সামনে মিথ্যে আনন্দ দেখিয়ে দুর্যোধনকে তিনি বললেন— তোমাদের যা ইচ্ছে, আমি তাই করব— যচ্চ ত্বং মন্যসে প্রাপ্তং তদ্ ব্রবীহি সুযোধন। কর্ণকে বললেন, এই অবস্থায় কী করা যায় শীগগির বলো, কর্ণ! কী করা যায়— এমন প্রস্তাবে স্বাভাবিকভাবে দুর্যোধনই প্রথমে বলবেন। তিনি অনেকগুলি প্রস্তাব দিলেন। বললেন, আমরা এবার ওদের মধ্যে পারস্পরিক ভেদ তৈরি করব। ভাল গুপ্তচর দিয়ে এমন কৌশল করা যেতে পারে যাতে সৎমা মাদ্রীর ছেলেদুটো কুন্তীর ছেলে তিনটেকে বিষ নজরে দেখে। দ্বিতীয়ত এমন করা যাতে পারে যে, দ্রুপদ, দ্রুপদের ছেলে ধৃষ্টদ্যুম্ন, এমনকী দ্রুপদের মন্ত্রীদের পর্যন্ত টাকা পয়সা খাইয়ে এমন করব যাতে যুধিষ্ঠিরকে তাঁরা ত্যাগই করে বসবেন, কিংবা যুধিষ্ঠিরের কানের কাছে সদাসর্বদা গুপ্তচররা বলবে, হস্তিনাপুর অতি বাজে জায়গা, তোমর বাপু এখানেই থাকো। তৃতীয়ত আর একটা উপায় হতে পারে যে, অত্যন্ত বিশ্বস্ত গুপ্তচর গিয়ে নববধূ দ্রৌপদীর মনে বহুস্বামিতার দোষ জাগিয়ে তুলবে। এটা করা খুব কঠিন হবে না, কারণ দ্রৌপদী সে কষ্ট নিশ্চয়ই বুঝতে পারছে— বহুত্বাৎ সুকরং হি তৎ— তারপর স্বামী স্বামীতে ঝগড়াঝাঁটি লাগিয়ে দিয়ে গুপ্তচর কেটে পড়বে। চতুর্থ উপায়, ছদ্মবেশে সেইরকম কিছু মানুষ গিয়ে ভীমকে মেরে ফেলুক, আর ভীম মারা গেলে ওই অর্জুনটা আমাদের কর্ণের কড়ে আঙুলের যোগ্যও নয়— রাধেয়স্য ন পাদভাক্ (‘পাদভাক্’ মানে নীলকণ্ঠ বলেছেন, কর্ণের এক চতুর্থাংশের সমানও হবে না)। দুর্যোধন বললেন, অথবা আরেক কাজ করা যেতে পারে, দারুণ দেখতে কতকগুলি মেয়েছেলে পাঠান। তারা গিয়ে এক একটি পাণ্ডবকে ধরবে আর রঙ্গরসে মজিয়ে দেবে, তখন দ্রৌপদীই ওদের ওপর রাগ করে ভেগে যাবে— অথবা দর্শনীয়াভিঃ প্রমদাভির্বিলোভ্যতাম্। আর এটাও আপনার ভাল না লাগলে কর্ণকে পাঠান পাণ্ডবদের নিয়ে আসতে। তারপর নিয়ে আসার পথে গুপ্তঘাতক দিয়ে রাস্তাতেই পাণ্ডবদের সাবাড় করে দিন। এতগুলো প্রস্তাব দিলাম, আপনি যেটা ইচ্ছে করুন। একেবারে সব কথার শেষে দুর্যোধন বললেন, কর্ণ, কী বলো, উপায়গুলো দারুণ না?
গুপ্তহত্যা, মেয়েছেলে পাঠানো, শেষে— কর্ণ গিয়ে পাণ্ডবদের নিয়ে আসবেন আর রাস্তায় গুমখুন— এইসব কাপুরুষোচিত উপায় কর্ণের একটুও পছন্দ হল না। যুধ্যমান অবস্থায় অর্জুনকে ব্রাহ্মণ ভেবে হঠাৎ যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছেন, সেই ভুল এখনও কর্ণের হাতে পায়ে কামড় দিচ্ছে, সেই তিনি কিনা গুম-খুন করাবেন পাণ্ডবদের! তার ওপরে ওই এক লহমার দেখায়, একবার উচ্চ-চকিত কথায় দ্রৌপদীর স্বভাব তিনি বুঝে গেছেন। যাঁকে তিনি বীরতার প্রতিদানে পেতে চেয়েছিলেন তাঁকে যে কর্ণের ভাল লেগেছিল। সেই মনের মানুষ অপমান করেছে বলেই তাঁকে তিনি এখন ঘেন্না করেন। তবু দুর্যোধনের উপায় কৌশলগুলি কর্ণের একটুও পছন্দ হল না। এই প্রথম প্রকাশ্যে তিনি দুর্যোধনের কথার প্রতিবাদ করলেন। বিশেষত কর্ণ লুকিয়ে ছদ্মবেশী ঘাতক দিয়ে পাণ্ডবদের খুন করাবেন— এই প্রস্তাব কর্ণের পৌরুষে আঘাত দিল। তিনি প্রতিবাদ জানালেন দুর্যোধনের প্রত্যেকটি প্রস্তাবে।
কর্ণ বললেন, তোমার কথা আমার একটুও ঠিক মনে হচ্ছে না, দুর্যোধন! পাণ্ডবদের বধ করার জন্য অনেক কূট কৌশল, অনেক সূক্ষ্ম উপায় আগেও তোমার মাথা থেকে বেরিয়েছে, কিছুই হয়নি, তুমি কিছুই করতে পারোনি। পাণ্ডবেরা যখন শিশুটি ছিল, ডানা-না-গজানো পাখির মতো, তখন এখানে থাকা সত্ত্বেও তুমি তাদের কিছুই করতে পারোনি! এখন তারা হাতের বাইরে, বিদেশে। তারপরে দ্রুপদ রাজার সহায়তায় তাদের শ্রীবৃদ্ধিও ঘটেছে। এখন কি আর তাদের কৌশল করে কাত করা যায়? তারপর দ্রৌপদীর কথাটা তুমি কী বললে? যেখানে পাঁচ ভাই মিলে একটি বউ বিয়ে করেছে, তাদের মধ্যে কখনও বিরোধ বাধে? বউদের জন্য ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়াঝাটি হবে না বলেই তো একটা বউ, সেখানে কখনও ঝগড়া বাধে— একস্যাং যে রতাঃ পত্ন্যাং ন ভিদ্যন্তে পরস্পরম্? তার ওপরে আর একটা ব্যাপার কী জানো। দ্রৌপদী যখন পাণ্ডবদের বরণ করেছেন, তখন তাঁদের খারাপ অবস্থা, দীন ব্রহ্মচারী বেশ— এসব দেখেশুনে মনে মনে তাঁদের দীনাবস্থা মেনে নিয়েই বরণ করেছেন, সেই দ্রৌপদীর মন ভাঙানো অত সহজ হবে না জেনো। দ্রৌপদীর দৃঢ়তা কতখানি কর্ণ তা সত্যিই জানেন। উন্মুক্ত সভাস্থলে তাঁর নিজের প্রতি যে অপমান-বাক্য বর্ষিত হয়েছিল তাতেও যেমন দৃঢ়তা ফুটে উঠেছিল দ্রৌপদীর, কর্ণ মনে করেন, সেই দৃঢ়তাতেই ওই মেয়ে সমস্ত রাজ-মহারাজা ত্যাগ করে অর্জুনকে অর্জুন না জেনেই, পাণ্ডবদের দীনতার সঙ্গেই সে বরণ করেছে। ওই মেয়েকে ফুসলানো কি অত সহজ? এইবার কর্ণের মনে ভেসে উঠল সেই অপমান, সূতপুত্র বলে তাকে বিয়ে না করার অপমান। দ্রৌপদীর সমস্ত দৃঢ়তা জেনেও তাঁর কেবলই মনে হতে লাগল তাঁরই খাবার গ্রাস, পাণ্ডবেরা সবাই মিলে যেন চেটেপুটে খাচ্ছে। এতে যেন দ্রৌপদীরই কাম-অভিলাষ পরিতৃপ্ত হচ্ছে। কর্ণ বললেন, জানো দুর্যোধন! মেয়েদের এক স্বামী থাকা সত্ত্বেও সবসময় তাদের ইচ্ছে করে আরও পুরুষমানুষ তাকে ভোগ করুক— ঈপ্সিতশ্চ গুণঃ স্ত্রীণাম্ একস্যা বহুভর্ত্তৃতা। সেখানে রমণীকুলের পরম বাঞ্ছিত এই বহুপুরুষের ভোগ একেবারে আইন মেনেই পাচ্ছে দ্রৌপদী— এই রমণীকে কি ফুসলানো যায়— ন সা ভেদয়িতুং ক্ষমা।
শুধু অর্জুন নয়, এলেবেলে নকুল-সহদেবকে নিয়ে পাঁচজন পুরুষমানুষ দ্রৌপদীকে ভোগ করছে, মনে মনে এই পীড়নই কর্ণকে দ্রৌপদীর বিরুদ্ধে বারবার প্ররোচিত করেছে। তবু একথা পরে হবে। প্রথমে মনে রাখতে হবে, হস্তিনাপুরে একটা ‘ডাবল-অ্যাডমিনস্ট্রেশন’ চলছিল। এই দ্বৈতশাসনের একদিকে আছেন ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, কৃপ— এইসব প্রাজ্ঞ এবং বৃদ্ধ পুরুষেরা। অন্যদিকে আছেন দুর্যোধন, দুঃশাসন, শকুনি, কর্ণ, অশ্বত্থামা— এঁরা। মাঝখানে আছেন রাজা ধৃতরাষ্ট্র, যিনি চক্ষুষ্মত্তার পরিচয় দিয়ে একবার ভীষ্ম-দ্রোণের দিকে হেলেন, আবার পরমুহূর্তে উচ্চাভিলাষের অন্ধতায় দুর্যোধন-কর্ণের দিকে হেলেন। কিন্তু এই দুর্যোধন-দুঃশাসনের যে যুবগোষ্ঠী, এই গোষ্ঠীতে অতি অল্পকালের মধ্যেই অতি উল্লেখযোগ্য স্থান করে নিয়েছেন কর্ণ। এই স্থান এতটাই উঁচুতে যে, কর্ণ দুর্যোধনের সমস্ত কূট প্রস্তাব বাতিল করে দিয়ে সোজাসুজি যুদ্ধের প্রস্তাব দিয়েছেন। কর্ণের মতে, ঠিক এই সময়টাই ছিল যুদ্ধের প্রকৃষ্ট সময়। কারণ, পাণ্ডবদের শিকড় তত দৃঢ় নয়, পাঞ্চালেরাও কমজোরি। যতক্ষণে কৃষ্ণ যাদব বাহিনী নিয়ে না আসছেন, যতক্ষণে পাণ্ডবেরা সৈন্যসামন্ত সংগ্রহ করে বলশালী না হচ্ছেন, তার আগেই কৌরববাহিনী সমস্ত শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ুক পাণ্ডবদের ওপর— এই ছিল কর্ণের প্রস্তাব। কর্ণের মনোভাব যখন এতখানি দুঃসাহসিক, সেখানে ভীষ্ম-দ্রোণ যখন সস্ত্রীক পাণ্ডবদের প্রায় আরতি করে রাজ্যে ফিরিয়ে আনতে বললেন, তখন কর্ণ আর থাকতে পারলেন না। তিনি ভীষ্ম আর দ্রোণকে সোজাসুজিই প্রায় ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রিসভার ‘দুষ্ট মন্ত্রী’ বলে চিহ্নিত করলেন এবং ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি পরিষ্কার জানান, মহারাজ! আপনি আপনার দুষ্ট মন্ত্রীদের থেকে সাবধান থাকবেন এবং আপনার মন্ত্রণাদাতাদের মধ্যে দুষ্ট নয় যাঁরা তাঁদেরও আপনি চিনে নিন— দুষ্টানাঞ্চৈব বোদ্ধব্যম্ অদুষ্টানাঞ্চ ভাবিতম্। কর্ণ যে ভীষ্ম-দ্রোণের মতো বৃদ্ধ মন্ত্রীদের সামনেই তাদের প্রতি কটূক্তি করতে পারলেন, এটা থেকে বোঝা যায় দুর্যোধনের গোষ্ঠীতে কর্ণ কতটা স্থান করে নিতে পেরেছিলেন। অবশ্য তাঁর এই শক্তি বাড়ার পিছনে দু-একটা সামান্য কারণ আছে, সেটা আগেই বলে নিই।
দুর্যোধন, দুঃশাসন, কর্ণ— এঁরা সকলেই একসময় দ্রৌপদীকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কারও অপদার্থতায়, কারও বা দুর্ভাগ্যে সে বিয়ে হয়ে উঠল না। এর মধ্যে কিছু সময় চলেও গেল এবং খবর এল যে, উড়িষ্যার রাজা চিত্রাঙ্গদ তাঁর মেয়েকে স্বয়ম্বর সভায় ঈপ্সিত পতি লাভের সুযোগ দেবেন। দুর্যোধন ভাবলেন— দুর! দ্রৌপদী কালো মেয়ে, তার ওপর চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে। ভাগ্যিস ধনুক তুলতে পারিনি। আর দ্রৌপদীর সঙ্গে বিয়ে হয়নি বলে, অন্য সুন্দরীদের হৃদয়ে স্থান না দিয়ে, তিনি মানব জমিন পতিত রাখবেন কেন? অতএব কর্ণকে সঙ্গে নিয়ে দুর্যোধন উড়িষ্যা রাজ্যের রাজপুর নগরে এসে পৌঁছলেন। এখানেও অনেক বড় বড় রাজা— জরাসন্ধ, শিশুপাল— সবাই এসেছেন। স্বয়ম্বর সভায় একটা একটা করে রাজার নাম বলা হতে থাকল কিন্তু কলিঙ্গরাজনন্দিনী দুর্যোধনের নাম শুনেও তাঁকে অতিক্রম করে গেলেন— অত্যক্রামদ্ ধার্ত্তরাষ্ট্রং সা কন্যা বরবর্ণিনী। যত সুন্দরীই হোক একটি উড়িয়া রমণী পর্যন্ত তাঁকে অতিক্রম করে যাচ্ছে, এটা দুর্যোধনের কাছে দুর্বিষহ। তিনি সমস্ত রাজমণ্ডলের সামনে সেই কলিঙ্গ-নন্দিনীকে রথে নিয়ে তুললেন এবং চললেন হস্তিনাপুরের দিকে। এটা সমবেত রাজমণ্ডলীর অপমান। তাঁরা আক্রমণ করলেন দুর্যোধনকে। এবারে এই রাজমণ্ডলের পেছনে ধাওয়া করলেন কর্ণ। কর্ণ এক এক বাণে এক এক রাজার ধনুক-বাণ সব কেটে ফেললেন। কর্ণের বাণের গতিতে পর্যুদস্ত হয়ে তাঁদের আর দ্বিতীয়বার ধনুক তোলা হল না। তাঁরা এবার পালাতে লাগলেন। এবার শুধুমাত্র একা কর্ণের ক্ষমতায় দুর্যোধন একটি রাজকুমারীকে বিয়ে করে আনতে পারলেন। দুর্যোধন এতে বড় খুশি হলেন। এর অবধারিত ফল দুর্যোধনের গোষ্ঠীতে কর্ণের শক্তিবৃদ্ধি হল।
কর্ণের শক্তিবৃদ্ধির আরেক কারণ মগধরাজ জরাসন্ধ। মনে রাখতে হবে, দুর্যোধন, কর্ণ যখন প্রায় যুবক, সেইসময়ে জরাসন্ধের মতো প্রবল রাজা দ্বিতীয় কেউ ছিলেন না। কলিঙ্গরাজ্যের এই স্বয়ম্বরে যৌবনোদ্দীপ্ত কর্ণের যুদ্ধনৈপুণ্য দেখে প্রাজ্ঞ জরাসন্ধের বেশ ভাল লাগল। তিনি এই নতুন ছেলেটির মধ্যে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে তাঁকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করলেন। নিছকই পরীক্ষার জন্য। নানা অস্ত্রে, নানা প্রহরণে দু’জনের যুদ্ধ আরম্ভ হল। কখনও এঁর বাণ কাটা পড়ে, কখনও ওঁর, কখনও অন্যতরের আঘাতে এঁর ধনুক কিংবা খড়্গ খসে পড়ে হাত থেকে, কখনও বা ওঁর। এইভাবে অস্ত্র-শস্তর শেষ হয়ে এলে শেষে কুস্তাকুস্তি আরম্ভ হল। কেউ হারেন না। কিন্তু জরাসন্ধ অধিক বলবান হওয়া সত্ত্বেও যেহেতু জীর্ণ হয়ে পড়েছিলেন, তাই তিনিই যুদ্ধে ক্ষান্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন কর্ণকে। ভারী খুশি হয়ে তিনি মগধের অন্তর্গত মালিনী নগরীটি উপহার হিসেবে দিয়ে দিলেন কর্ণকে— প্রীত্যা দদৌ স কর্ণায় মালিনীং নগরীমথ। নিজের রাজ্য অঙ্গের সঙ্গে মালিনীর যোগ হওয়ায় কর্ণের রাজ্য বড় হল। তাঁর পিতার আবাসভূমি চম্পা নগরীর শাসনভারও ছিল কর্ণের ওপরেই, যদিও অনেকে মনে করেন চম্পা ছিল অঙ্গরাজ্যেরই ভুক্তি বিশেষ। যাইহোক জরাসন্ধের সঙ্গে যুদ্ধ পরীক্ষায় কর্ণ পাশ করায় তাঁর মানসম্মান রাজ্য-সম্পদ সবই বেড়ে গেল। ঠিক এই অবস্থায় তাঁর স্নেহময় জনক-জননী যে ছেলের বিয়ে দেবার জন্য ব্যাকুল হবেন, তাতে আশ্চর্য কী? দ্রৌপদীর মতো অভীষ্টা রমণীকে পাওয়া গেল না, অন্যদিকে তাঁরই সহায়তায় দুর্যোধনেরও বিয়ে হয়ে গেল। তাই বলে অন্য কোনও স্বয়ম্বর সভায় কন্যা-হরণ করতে গিয়ে আবার যদি কেউ দ্রৌপদীর মতো সূতপুত্রের কলঙ্ক দিয়ে বসে, তাই নিজে কোনও স্বয়ম্বর সভায় বিয়ে করতে যেতে সংকুচিত হয়েছেন কর্ণ। পিতা-মাতাও নিশ্চয় ব্যস্ত হয়েছেন তাঁর বিয়ের জন্য। আর বিশেষত প্রিয়বন্ধু দুর্যোধনের বিয়ের পর কর্মহীন কোনও অবকাশে তাঁর নিজের মনও বুঝি ব্যাকুল হল। অতএব পিতা-মাতার পছন্দ, করা নির্ঝঞ্ঝাট সূত-সুন্দরীরাই তাঁর কাছে বেশ কাম্য মনে হল। পরবর্তীকালে কর্ণ স্বয়ং কৃষ্ণের কাছে সশ্রদ্ধে স্বীকার করেছেন যে, কত যত্ন করে তাঁর পিতা অধিরথ অন্তত তিনটি সূতজাতীয়া রমণীর সঙ্গে কর্ণের বিয়ে দিয়েছিলেন— ভার্যাশ্চোঢ়া মম প্রাপ্তে যৌবনে তৎপরিগ্রহাৎ।
রাজ্য বড় হয়েছে, দুর্যোধনের যুবগোষ্ঠীতে তাঁর মর্যাদা বেড়েছে, তিনটি রমণীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছে, তবু কিন্তু কর্ণের মনে সুখ নেই। সত্যি কথা বলতে কি, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে না, দ্রৌপদীর বদলে তিন তিনটি বউ পেলেও উতলা বসন্ত-বাতাসের দীর্ঘশ্বাস তাঁর মনকে যে এখনও ভীষণ আকুল করে তোলে, দ্রৌপদীকে যে তিনি এখনও ভুলতে পারেন না। আর ভুলবেনই বা কী করে? যাঁদের ঘরে দ্রৌপদী বধূ হিসেবে মিলিত হয়েছেন, তাঁদেরও যে বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। যে জরাসন্ধের সঙ্গে কর্ণের দ্বৈরথ যুদ্ধমাত্রেই কর্ণের মর্যাদা বেড়ে গিয়েছিল সেই জরাসন্ধকে মধ্যমপাণ্ডব ভীম মেরেই ফেলেছেন। তার ওপরে ধৃতরাষ্ট্রের দেওয়া খাণ্ডবপ্রস্থকে ভেঙে গড়ে এখন ইন্দ্রপ্রস্থ বানিয়েছেন পাণ্ডবেরা, যা অনেকেরই ঈর্ষার কারণ। তার মধ্যে আছে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়যজ্ঞ। এই যজ্ঞের সূত্রেই জরাসন্ধবিজেতা ভীম কর্ণের রাজ্য অঙ্গদেশ আক্রমণ করেছিলেন— কর্ণমভ্যদ্রবদ্ বলী। তবে হ্যাঁ, ভীমের চতুরঙ্গ বাহিনী আর ভীমের শক্তির কাছে যে কর্ণ হার মানলেন, এ কথাটা আমরা সোজাসুজি বিশ্বাস করি না, কর্ণ হার মানলেন জরাসন্ধ বিজেতা ভীমের কাছে, যাঁর আধিপত্য সমস্ত পূর্ব ভারত তখনকার মতো স্বীকার করে নিয়েছে। সে যাই হোক ভারতবর্ষের সমস্ত রাজমণ্ডল রাজসূয় উপলক্ষে একযোগে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের সভাপ্রাঙ্গণে হাজারো উপহার দিয়ে বশ্যভাবে উপস্থিত হওয়ায় দুর্যোধনের ঈর্ষার কারণ ঘটল, সঙ্গে সঙ্গে কর্ণেরও। রাজসূয়ের মূলপর্বে চরম সম্মান দেওয়ার জন্য কৃষ্ণকে বেছে নেওয়ায় জরাসন্ধের ডান হাত চেদিরাজ শিশুপাল প্রচণ্ড গালাগাল করলেন কুরু-কুলপতি ভীষ্মকে, এমনকী যুধিষ্ঠিরকেও। শিশুপালের মতে— নামকরা মানুষকে যদি সম্মান জানাতেই হয়, তা হলে আরও অনেকেই ছিলেন, যাঁদের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে পারতেন ভীষ্ম কিংবা যুধিষ্ঠির। শিশুপাল অতি শ্রদ্ধার সঙ্গে কর্ণের নামও এখানে স্মরণ করেছেন। বলেছেন, দেবরাজ ইন্দ্রের মতো যাঁর ক্ষমতা, ধনুক-চালনায় যিনি অসাধারণ, যিনি অঙ্গ-বঙ্গের অধীশ্বর, সেই কর্ণকে আপনি সম্মান জানাতে পারতেন ভীষ্ম— বঙ্গাঙ্গবিষয়াধ্যক্ষং… স্তুহি কর্ণমিমং ভীষ্ম…।
বোঝা যাচ্ছে, শক্তিমান এবং সম্মানিত পুরুষদের যদি আঙুলে গোনা যায় তবে এই পর্যায়ে এখন কর্ণেরও নাম করতে হচ্ছে। খবর পাওয়া যাচ্ছে, তিনি শুধু অঙ্গ, চম্পা কিংবা জরাসন্ধের দেওয়া মালিনী নগরীর অধীশ্বর নন, আমাদের এই বাংলাদেশও ছিল তাঁরই রাজ্যের অন্তর্গত— বঙ্গাঙ্গবিষয়াধ্যক্ষং সহস্রাক্ষসমং বলে। কিন্তু হলে কী হয় তিনি যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন হস্তিনাপুরের রাজনীতির সঙ্গে। ফলে হস্তিনাপুরের যুবরাজ দুর্যোধন যখন যুধিষ্ঠিরের সম্মান আর ইন্দ্রপ্রস্থের কারিগরি দেখে মনে মনে জ্বলে গেলেন, তখনও কর্ণেরও মনে ব্যথা হল। ক্রোধ এবং ঈর্ষার কারণ ছিল দুটি— যুধিষ্ঠিরেরা তাঁদের পিতার রাজ্যাংশও ফিরে পেল, আবার দ্রৌপদীকেও পেল ওরাই— তৈর্লব্ধা দ্রৌপদী ভার্যা দ্রুপদশ্চ সুতৈঃ সহ। প্রথম ব্যাপারটায় কর্ণের তত কিছু আসে যায় না, কিন্তু দ্বিতীয় ব্যাপারটা যে দ্রৌপদী— তাঁর আপন মুখের গ্রাস! আমরা জানি কুরুসভায় যে পাশাখেলার চক্রান্ত তৈরি হয়েছিল, এই চক্রান্তের মূল পর্বে কর্ণ দুর্যোধনের সঙ্গে ছিলেন না। এই পুরো চক্রান্তটাই ছিল শকুনি এবং দুর্যোধনের মস্তিষ্ক-প্রসূত, যার সহায়ক ছিলেন রাজা ধৃতরাষ্ট্র স্বয়ং। কিন্তু সবকিছুর পরেও যে পাশাখেলার আসরে বসে গেলেন কর্ণ, তার একমাত্র কারণ দ্রৌপদী— যদি দ্রৌপদীকে হেনস্থা করা যায় কোনওক্রমে।
॥ ৫ ॥
অবশেষে সেই চরম লাঞ্ছনার মুহূর্তটি এগিয়ে এল। শকুনির সঙ্গে পাশাখেলায় মহারাজ যুধিষ্ঠির সর্বস্ব হেরে গেলেন। হেরে গেলেন একে একে প্রাণপ্রিয় ভাইদের বাজি রেখে। হেরে গেলে নিজেকেও। যুধিষ্ঠিরের তখন প্রায় উন্মত্ত অবস্থা। জুয়াখেলার সময় জুয়াড়ি যেমন ভাবে— পরের দানটা নিশ্চয় জিতব, ঠিক সেই প্রত্যাশায় তিনি শেষ পর্যন্ত নিজেকেও বাজি রেখেছেন। কিন্তু হল না, কিছুতেই হল না। অন্তঃপুরচারিণী কৃষ্ণার কথা তাঁর মনেই ছিল না; কিন্তু যারা আগে থেকেই জানে যে, যুধিষ্ঠির পাশা খেলতে ভালবাসেন, কিন্তু পাশাখেলাটাই তিনি ভাল জানেন না— দ্যূতপ্রিয়শ্চ কৌন্তেয়ো ন স জানাতি দেবিতুম্— সেই তারা যে কিচ্ছুটি না ভুলে একটি একটি করে সবই আদায় করে নেবেন যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে, তাতে সন্দেহ কী! শকুনিই মনে করিয়ে দিলেন যুধিষ্ঠিরকে। বললেন, নিজেকে বাজি রেখে হেরে যাওয়াটা বড় কষ্টকর মহারাজ! তা ছাড়া তোমার তো জিনিস রয়েছে। অন্য ধন অবশিষ্ট থাকতেও নিজেকে হেরে বসাটা একেবারেই ঠিক নয়— শিষ্টে সতি ধনে রাজন্ পাপ আত্মপরাজয়ঃ। ঠিক এইটুকু বলে শকুনি, পাঞ্চালী-কৃষ্ণার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন যুধিষ্ঠিরকে। দ্রৌপদীর কথাটা ধরিয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গেই যুধিষ্ঠির পণ্য বস্তুর গুণ গাইতে থাকলেন। পণ রাখার এই নিয়ম— যেখানে টাকা পয়সা সব হেরে বসে আছে সেখানে প্রথাবহির্ভূত জিনিস বাজি রাখতে গেলে সে জিনিসের উৎকর্ষ বুঝিয়ে দিতে হয় পরপক্ষের কাছে। শকুনি বললেন, তোমার যে জিনিসটা এখনও হাতে আছে, সে হল দ্রৌপদী, তাকে বাজি রাখতে পারো— পণস্ব কৃষ্ণাং পাঞ্চালীম্। সঙ্গে সঙ্গে যুধিষ্ঠির যেন পণ্যের গুণ বলতে থাকলেন— জানেন তো, সে মোটেই বেঁটেও নয়, ঢ্যাঙা লম্বাও নয়, আবার রোগাও নয়। কালো-কোঁকড়া চুলের ঢল নেমেছে পিঠ বেয়ে। মুখখানি দেখলে মনে হবে যেন পদ্মফুল ফুটেছে। ঠোঁট লাল, গায়ে লোম নেই-ই প্রায়, অঙ্গসংস্থান অপূর্ব— সুমধ্যমা চারুগাত্রী— আর স্বভাব-চরিত্তির থেকে সবকিছু— ঠিক যা যা একটা পুরুষ মানুষ একটা মেয়ের মধ্যে দেখতে চায়— যামিচ্ছেৎ পুরুষঃ স্ত্রিয়ম্— সেইরকমই এই পাঞ্চালী দ্রৌপদী। আমি তাকেই পণ রাখছি।
ঠিক এমনি একটা দিনের জন্যে অনেকদিন অপেক্ষা করে আছেন কর্ণ। প্রমত্ত যুধিষ্ঠিরের এই নগ্ন বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে সভাক্ষেত্রে যখন ধিক্কারের গুঞ্জন উঠল, তখন সবচেয়ে খুশি হলেন দুটি লোক— এক জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্র যিনি কেবলই জিজ্ঞেস করছিলেন— শকুনি এই বাজিটা জিতেছে তো, জিতেছে তো? দ্বিতীয় হলেন কর্ণ। দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় যাবার সময় ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের সঙ্গে কর্ণের পরিচয় ছিল সহাৰ্থক তৃতীয়া বিভক্তিতে অর্থাৎ ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা এসেছেন, সঙ্গে কর্ণও গেছেন। কিন্তু এই মুহুর্তে দ্রৌপদীর এই বর্ণনা শুনে যিনি সজোরে প্রতিহিংসার হাসি হেসে উঠলেন তিনি কর্তৃপদে প্রযুক্ত, তিনি কর্ণ, অর্থাৎ কর্ণ হাসছেন, তাঁর সঙ্গে দুঃশাসন এবং অন্যান্য ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা হাসছেন— জহাস কর্ণোহতিভৃশং সহ দুঃশাসনাদিভিঃ। বাস্তবিক পক্ষে যুধিষ্ঠির যেমনটি বর্ণনা দিলেন, এমনতর দ্রৌপদীর নগ্নরূপ কর্ণ মনে মনে অনেকবার কল্পনা করেছেন, কিন্তু সে-রূপ তাঁর আয়ত্তে ছিল না। আজকে তিনি সেই রূপকল্পনায় হেসে উঠেছেন এইজন্যে যে, দ্রৌপদী, অর্জুনের জেতা দ্রৌপদী, পঞ্চপাণ্ডবের ঘরণী দ্রৌপদী আজ দুর্যোধন-শকুনির কৌশলে তাঁদের হাতের মুঠোয়। পঞ্চপাণ্ডবের উপভুক্তা নগ্না দ্রৌপদী যেমনটি কর্ণের কল্পনায় ছিল, সেই দ্রৌপদীকে আজ তিনি সবার সামনে নগ্ন দেখতে চান। তিনি আগ বাড়িয়ে হেসে উঠলেন, সবার চাইতে জোরে— অতিভৃশম্।
শকুনি দ্রৌপদীর বাজি জিতবার সঙ্গে সঙ্গে দুর্যোধনের আদেশ হল সভায় দ্রৌপদীকে নিয়ে আসবার জন্য। যে নিয়ে আসতে গেল দ্রৌপদীকে সেও কিন্তু এক সারথি জাতের লোক, সূতপুত্র। বারবার সে দ্রৌপদীর কাছে যাচ্ছে, দুর্যোধনের কাছে দ্রৌপদীর বক্তব্য পৌঁছে দিচ্ছে— এই পৌনঃপুনিকতায় দুর্যোধনের রাগ হল। তিনি দুঃশাসনকে বললেন, আসলে সূতপুত্র এই সারথির বেটা, ভীমকে দেখে ভয় পাচ্ছে, যাও তো, তুমি যাও তো ধরে নিয়ে এসো দ্রৌপদীকে— স্বয়ং প্রগৃহ্যানয় যাজ্ঞসেনীম্। এই যে সময়টা, সূতজাতীয় প্রাতিকামীর দ্রৌপদীর কাছে যাওয়া আসা এবং তার প্রতি ‘সূতপুত্র’ বলে দুর্যোধনের গালাগালি— এই সময়টা কর্ণ চুপ করেই ছিলেন, একটা কথাও বলেননি। কারণটা জলের মতো স্পষ্ট। সূতপুত্রের পর্বটা চুকলে দুঃশাসন যখন দ্রৌপদীকে অকথ্য গালাগালি দিতে দিতে উন্মুক্ত রাজসভায় নিয়ে এল, অসহায় দ্রৌপদী যখন পাশার বাজিতে বাঁধা অসহায় পাণ্ডবদের দিকে জ্বলন্ত কটাক্ষ নিক্ষেপ করছেন, তখন দ্রৌপদীর সেই অসহায় অবস্থা বুঝেই তাঁকে এক ঝটকা দিয়ে দুঃশাসন সশব্দে হেসে বলল, তুই হলি আমাদের দাসী। সেকালের দিনে ‘দাসী’ মানে শুধু কাজকর্মের লোক বুঝত না, দাসী মানে ছিল সময়ে অসময়ে, অবসরে পুরুষের ভোগ্যা। দুঃশাসনের এই কথাটা কর্ণের মনে এক অদ্ভুত বিকৃত আনন্দ জাগিয়ে তুলল। দুঃশাসনের ‘দাসী’ সম্বোধন মাত্রেই কর্ণ দারুণ খুশি হয়ে তাকে যেন ধন্যবাদ জানালেন শব্দটার জন্য, হেসে উঠলেন দুঃশাসনের মতোই সজোরে— কর্ণস্তু তদ্ বাক্যমতীব হৃষ্টঃ সম্পূজয়ামাস হসন্ সশব্দম্।
দ্রৌপদীকে সবার সামনে দুঃশাসন টানা-হেঁচড়া করছে, তাঁর উত্তমাঙ্গের উত্তরীয় বাস খসে পড়ে গেছে, তবু রেহাই নেই। পাণ্ডবপক্ষের ভীম ক্ষেপে উঠে দাদা যুধিষ্ঠিরকেই গালাগালি দিতে থাকলেন। কুরু-বৃদ্ধেরা কিছুই বলতে পারছেন না। এই অবস্থায় কৌরবপক্ষের একজনই এই ঘটনার নিন্দা করা আরম্ভ করলেন। তিনি দুর্যোধনের ভাই বিকর্ণ। বিকর্ণ দ্রৌপদীকে পণ রাখার বৈধতা নিয়ে আইনসঙ্গতভাবে লড়াই আরম্ভ করলেন। কিন্তু পূর্বাহ্নেই যে পুরুষ-মানুষদের মধ্যে রাজ্যলোভ, পরশ্রীকাতরতা প্রবেশ করেছে তাদের কি আর আইন ভাল লাগে! অথচ যেখানে ছোটভাই হিসেবে বিকর্ণ ন্যায়সঙ্গতভাবে দুর্যোধনের বিরোধিতা আরম্ভ করেছেন, সেখানে দুর্যোধনের পক্ষে প্রতিবাদ করে জেতা মুশকিল। ঠিক এই অবস্থায় সভার হাল ধরলেন কর্ণ। কর্ণ এই মুহূর্তে ন্যায়-অন্যায় বোঝেন না। পাঁচ ভাই পাশাখেলার জাঁতাকলে আটকে ছটফট করছে, কর্ণের মজা লাগছে। পঞ্চস্বামিগর্বিতা দ্রৌপদীর বুকের প্রাবরণ-বাস খুলে পড়েছে দুঃশাসনের টানাটানিতে, কর্ণের ভাল লাগছে, তাঁহ গহন মনের রুদ্ধ বিকার কথঞ্চিৎ শান্তি লাভ করছে। অন্তত দ্রৌপদীর ঘটনাটা বিকার জেনেও কর্ণ এই বিকারকে স্বাগত জানাচ্ছেন। বিকর্ণের কথা শুনে কর্ণের ভীষণ রাগ হল— ক্রোধমূৰ্ছিতঃ। রাগে বিকর্ণের হাতে একটা ঝাঁকাড় দিয়ে কর্ণ বিকর্ণকে তিরস্কার করতে থাকলেন।
কর্ণ বললেন, বিকর্ণ! অস্বীকার করি না এ সভায় অনেক বিকার দেখা যাচ্ছে— দৃশ্যন্তে বিকর্ণেনেহ বৈকৃতানি বহূন্যপি। অর্থাৎ কর্ণ জানেন কুলবধূ দ্রৌপদীকে টানা-হ্যাঁচড়া করাটা একটা বিকার। কিন্তু তাঁর মতে দ্রৌপদী নিজেই এই বিকারের কারণ। কর্ণ বললেন, দুটি কাঠে ঘষা লেগে যে আগুন জন্মায়, সে আগুন যেমন ওই কাঠকেই পুড়িয়ে দেয়, তেমনি এই বিকারই ওই মেয়েছেলেটাকে শায়েস্তা করবে। কর্ণ বললেন, তা ছাড়া তোমার এত সোহাগ কীসের, বিকর্ণ? কই যাঁদের বউ এই দ্রৌপদী তাঁরা তো দ্রৌপদীর ডাক শুনেও টুঁ-শব্দটি করছেন না— এতে ন কিঞ্চিদপ্যাহুশ্চোদিতা হ্যপি কৃষ্ণয়া। তাঁরা তো মনে করছেন, দ্রৌপদীকে আমরা জিতেইছি। তুমি বাপু বিকর্ণ! বাচ্চা ছেলে, বাচ্চা ছেলের মতো থাকো, ছোট মুখে বড়দের মতো কথা বলার দরকারটা কী তোমার— বালঃ স্থবিরভাষিতম্। তুমি দুর্যোধনের থেকে অনেক ছোট, ধর্মাধর্মের তুমি বোঝোটা কী হে! শুধু শুধু তখন থেকে বক বক করে বাজিতে জেতা দ্রৌপদীকে না-জেতা বলে যাচ্ছ? কর্ণ বিকর্ণকে হেঁই-মারি কি সেই-মারি করে বসিয়ে দেননি পুরোপুরি। কিন্তু সভাস্থ লোক যেটাকে বীরপুরুষের মানসিক বিকার বলে মনে করতে পারে, সেটা যে আসলে দ্রৌপদীরই বিকার এবং সুস্থ সমাজের দিকে তাকিয়ে সে বিকার যে শান্ত করা একান্ত প্রয়োজন, সেটা বোঝাতেই যেন কর্ণ বিকর্ণকে শাসন করে কুরু-বৃদ্ধদের বোঝাতে চাইলেন।
কর্ণ বললেন, বিকর্ণ! এটা নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে যে, যুধিষ্ঠির সর্বস্ব বাজি রেখে হেরেছেন। তা হলে এই দ্রৌপদী কি সেই সর্বস্বের বাইরে? কর্ণ জানেন দ্রৌপদী পঞ্চপাণ্ডবের জীবন-সর্বস্ব ধন, কিন্তু সেই দ্রৌপদী এখন অঙ্কের হিসেবে পণ রাখা সর্বস্বের অভ্যন্তরা। তা ছাড়া— কর্ণ বলে চললেন, তা ছাড়া বাজির কথায় দ্রৌপদীর নাম উচ্চারণ করা হয়েছে, সমস্ত পাণ্ডবের মৌনতায় সে বাজি সমর্থিত হয়েছে, এখন তুমি বলছ দ্রৌপদীকে আমরা জিতিনি! কর্ণ এবার আসল বিকারের কথায় এলেন। দ্রৌপদীকে টানাটানি করা হচ্ছে, তাঁর উত্তরীয় খসে পড়েছে, তিনি এক কাপড়ে কুরুসভায় উপস্থিত— এগুলি কর্ণের ভাল লাগছে। বিকর্ণকে তিনি বললেন, অবশ্য হ্যাঁ, তুমি যদি বলো একবস্ত্রা দ্রৌপদীকে সভায় টেনে এনে বড় অধর্ম হয়ে গেছে, তা হলেও কিন্তু আমার উত্তর আছে। তুমি তো জানো, দৈববিহিত নিয়ম অনুসারে একটি স্ত্রীলোকের একটিই স্বামী থাকে। এই দ্রৌপদীর স্বামী তো একটা নয়, পাঁচটা। তবে এই মেয়েছেলে বেশ্যা ছাড়া কী— বন্ধকীতি বিনিশ্চিতা। এইরকম একটা বেশ্যা মেয়েকে উন্মুক্ত সভায় এনেছে দেখে আশ্চর্য হওয়ারও কিছুই নেই। তা ছাড়া কোনও বেশ্যা এক কাপড়ে এখানে এসেছে না উলঙ্গ হয়ে এসেছে, তাতেও মাথা খারাপ করার কিছুই নেই— একাম্বরধরত্বং বাপ্যথ বাপি বিবস্ত্ৰতা। বিকর্ণ তুমি জেনে রেখো, আমরা পাশার চালে সবাইকে জিতেছি— ধনরত্ন জিতেছি, একটি একটি করে সমস্ত পাণ্ডবদের জিতেছি, এই দ্রৌপদীকেও জিতেছি। কর্ণের মনের ভাব— সব এখন আমাদের, আমরা এদের নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করব।
যা ইচ্ছে তাই করব— এই তাগিদেই কর্ণ দুঃশাসনকে বললেন— দেখো ভাই! এই বিকর্ণ ছেলেটা বড় বেড়ে পাকা হয়েছে— বিকর্ণ প্রাজ্ঞবাদিকঃ তুমি ওর কথায় কান দিয়ো না। বরঞ্চ এক কাজ করো তো, তুমি এই সমস্ত পাণ্ডবদের আর দ্রৌপদীর কাপড়-চোপড় খুলে নিয়ে এসো তো। কর্ণের এই আদেশের নিরিখে অধিকতর অপমানের আশঙ্কায় পাণ্ডবেরা নিজেরাই নিজেদের উত্তরীয় বসনগুলি নামিয়ে দিলেন মেঝেতে। বস্তুত বীরপুরুষের পক্ষে এই ছিল যথেষ্ট অপমান। কিন্তু দ্রৌপদীর উত্তরীয় তো টানাটানিতে আগেই খসে পড়েছে এবার একবস্ত্রতার জায়গায় তাঁর বিবস্ত্রতা কাম্য হয়ে উঠেছে কর্ণের। অন্তত দুঃশাসনের কাছে কর্ণের আদেশের মর্ম ছিল তাই। ভীমের ভয়েই হোক কিংবা স্বেচ্ছায়, পাণ্ডবদের চাইতেও কুলস্ত্রীকে অপমান করতে বেশি ভাল লাগছিল বলেই দুঃশাসন দ্রৌপদীর পরিধানের বসন ধরে টান দিলেন— দ্রৌপদ্যা বসনং বলাৎ… ব্যাপাক্রুষ্টুং প্রচক্রমে। সবাই জানেন, কর্ণের এই আদেশ শেষ পর্যন্ত কার্যকরী করা যায়নি। অলৌকিকভাবেই হোক কিংবা লৌকিক কারণেই হোক, দ্রৌপদীর কাপড় টানার ব্যাপারটা দুঃশাসনের হাতের বাইরে চলে গেল। সুযোগ বুঝে বিদুর আবার গালাগালি দেওয়া আরম্ভ করলেন। কর্ণও যেন একটু থতমত খেয়ে গেলেন এবং যা চেয়েছিলেন তা করা গেল না বলে থতমত করেই দুঃশাসনকে আবার বললেন, ঠিক আছে, এখন তুমি এই দাসীটাকে বাড়ির ভেতরে কোথাও রেখে এসো তো— কর্ণো দুঃশাসনং ত্বাহ কৃষ্ণাং দাসীং গৃহান্ নয়।
সত্যি বলতে কি পাশা খেলার পর যে অংশটা মহাভারতে আছে সেটা যদি অভিনয় করা যেত, তা হলে দেখা যেত নাটকের এই অংশটায় মঞ্চে প্রধান ভূমিকা হত কর্ণ এবং দ্রৌপদীর। দ্রৌপদী আত্মসম্মান বাঁচাতে ব্যস্ত আর কর্ণ যেভাবে হোক সেটা নষ্ট করতে। সভার মর্যাদা রক্ষায় একমাত্র চেষ্টা ছিল বিদুরের, আর সব কুরুবৃদ্ধেরা ছিলেন কর্তব্য নির্ণয়ে বিমূঢ়। এই অবস্থায় দুর্যোধন যে পাঁচ কথা বলে শেষ পর্যন্ত নিজের ‘কদলীস্তম্ভ সদৃশ’ ঊরুখানি দ্রৌপদীকে একবারের তরে দেখাতে পেরেছিলেন সেও বুঝি এই কর্ণের দৌলতে। দুঃশাসনের অসহায়তা দেখে দুর্যোধন আবার সেই মূল প্রশ্নে ফিরে গেলেন অর্থাৎ ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বলুন আমরা দ্রৌপদীকে জিতেছি কি না? দুর্যোধন খুব ভালই জানতেন যে, যুধিষ্ঠির এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না এবং এই উত্তরহীনতার অন্তরে মহাবলী ভীম আবার খানিকটা আক্রোশ প্রকাশ করায় সভামঞ্চে আবার কর্ণের ভূমিকা বড় হয়ে উঠল। যাতে আইনসঙ্গতভাবে সব বদমায়েশি করা যায়, তারই একটা উপায় করার চেষ্টা করতে লাগলেন কর্ণ। কিন্তু মজা হল, তিনি ভীমের আক্রোশ সত্ত্বেও ভীমের সঙ্গে কথা বলছেন না। অথচ কোনও অবস্থাতেই তিনি দ্রৌপদীকে ছাড়ছেন না এবং যেসব কুরুবৃদ্ধেরা মৌনতার কৌশলে দ্রৌপদীর পক্ষ নিয়েছেন, তাঁদেরও কর্ণ এক হাত নিয়েছেন। কর্ণ বললেন, এ সভায় তিনজন আছেন যারা সবল এবং ধর্ম উল্লঙ্ঘন করতে সমর্থ। এঁরা হলেন ভীষ্ম, দ্রোণ এবং বিদুর। এঁরা এঁদের প্রভু ধৃতরাষ্ট্রকেই দুষ্টতম বলে জানেন, অথচ তাঁর বাড়বাড়ন্ত হোক, এটাও চান, নিজেরাও কোনও পাপাচরণ করেন না— যে স্বামিনং দুষ্টতমং বদন্তি বাঞ্ছন্তি বৃদ্ধিং ন চ বিক্ষিপন্তি। কর্ণের ভাবটা এই যে, ভীষ্ম, দ্রোণ এবং বিদুর এই তিনজনই রাজনির্ভর ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও, এঁদের কিছু স্বত্ব আছে, কিন্তু দাস, পুত্র এবং স্ত্রীলোক এদের কোনও স্বাতন্ত্র্যই নেই। ঠিক যেমন এই মুহূর্তে দ্রৌপদীর কোনও স্বাতন্ত্র্যই থাকতে পারে না, কারণ তিনি দাসের পত্নী। যে মুহূর্তে পাণ্ডবেরা শকুনির পাশার চালে জিত হয়েছেন, সেই মুহূর্ত থেকে তারা দাস, আর স্ত্রীলোকের সত্তা যেহেতু একান্তভাবেই পতি নির্ভর অতএব দাসের স্ত্রী দাসী। দাসের সত্তা এবং দাসের ধন যেহেতু প্রভুর অধীন তা হলে দাসের স্ত্রীতেও প্রভুরই অধিকার— দাসস্য পত্নী অধনস্য ভদ্রে হীনেশ্বরা দাসধনঞ্চ সর্বম্।
এটা বোঝা যাচ্ছে কর্ণের ওকালতি বুদ্ধি সাংঘাতিক। কর্ণ কিন্তু দ্রৌপদীর প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন। সেই সভাগৃহে প্রবেশ করার মুহূর্ত থেকে দ্রৌপদী যে প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন অর্থাৎ যুধিষ্ঠির যদি নিজেকে আগে বাজি রেখে হেরে থাকেন তা হলে দ্রৌপদীকে আর তিনি বাজি রাখতে পারেন কিনা, এই প্রশ্নে কুরুবৃদ্ধেরা বিমূঢ় বোধ করছিলেন। কর্ণের বক্তব্য— অত কূট-কচালির দরকার কী। পাণ্ডবেরা বাজির চালে সবাই দাস আর সেকালে স্ত্রীলোকের যেহেতু স্ব-অধীনতা ছিল না— ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমৰ্হতি— সেই নিয়মে দাসের স্ত্রীও আপাতত কৌরবদের অধীন। তা ছাড়া স্বয়ং ধর্মরাজ তাঁর জন্ম, পরাক্রম এবং পৌরুষ মাথার মধ্যে না রেখে আপন স্ত্রীকে দ্যূতমুখে সমর্পণ করেছেন— এর থেকে বড় ‘পয়েন্ট’ আর কী হতে পারে। কর্ণের ওকালতি এতটাই মোটা দাগের ছিল যে, স্বয়ং ক্রোধ-কষায়িত ভীমও একসময় যুধিষ্ঠিরকে বললেন, আমি এই সূতের ব্যাটাকে দোষ দিই না— নাহং কুপ্যে সূতপুত্রস্য রাজন্— সত্যিই তো আপনার জন্যেই আমরা দাস হয়ে গেছি, আজ অন্তত যদি পাঞ্চালী কৃষ্ণাকে আপনি বাজি না ধরতেন, তা হলে কি এই শত্রুরা আমাদের এত কথা বলতে পারে।
বেচারা ভীম! সরল ভীম জানেন না যে, তাঁর শত্রুরা বহুদিন ধরে এই মুহূর্তটির অপেক্ষা করছিল। ওকালতি নয়, কূটবুদ্ধি নয়, বিক্রম নয়— কিছু নয়, যেন তেন প্রকারেণ এই মুহূর্তটি তারা চেয়ে এসেছে। দ্রৌপদীকে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করব, তাঁকে দিয়ে যা ইচ্ছে তাই করাব— এমন একটি মুহূর্ত। অতএব কর্ণের ওকালতির ফল হল এই যে, কৌরবদের এক ভাই দুঃশাসন যখন কর্ণের আদেশ সত্ত্বেও দ্রৌপদীর পরার শাড়িটি খুলে ফেলতে পারল না, তখন বড় ভাই দুর্যোধন নিজের পরার কাপড়টিই তাঁর ঊরুমূল পর্যন্ত টেনে তুলে বাম ঊরুটি দেখাতে লাগলেন। এ এমন এক আক্রোশ যাতে অন্যজনকে বিবসনা করতে না পেরে নিজেই ন্যাংটো হয়ে গেলাম। শুধু ঊরু দেখানোই নয়, দুর্যোধন ঊরু দেখিয়ে দ্রৌপদীকে আহ্বানের হাসি হাসতে লাগলেন— স্ময়ন্নিবৈক্ষ্য পাঞ্চালীম্। দ্রৌপদীকে দেখিয়ে দেখিয়ে— দ্রৌপদ্যাঃ প্রেক্ষমাণায়াঃ— দুর্যোধন যতই তাঁর ঊরু বিকশিত করতে থাকলেন, কর্ণের উৎসাহ ততই বাড়তে থাকল। এই কুৎসিত কর্মে কর্ণ যেন আপন মনোবৃত্তির চরিতার্থতা লাভ করলেন। তিনি খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে থাকলেন— অভ্যুৎস্ময়িত্বা রাধেয়ম্।
দুর্যোধন যে এই পর্যন্ত আসতে পেরেছেন, তার পেছনেও ছিল কর্ণেরই উৎসাহ। দ্রৌপদীর স্বাতন্ত্র্যহীনতা এবং দাসীত্ব প্রমাণ করার সঙ্গে সঙ্গে কর্ণ বলেছিলেন— এখন থেকে পাণ্ডবেরা কেউ তোমার প্রভু নয়, কৌরবেরাই তোমার প্রভু। তুমি বরং এঁদের মধ্যে থেকে নতুন কোনও স্বামী বেছে নাও— অন্যং বৃণীষ্ব পতিমাশু ভাবিনি। কর্ণ বলেছিলেন, স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর যে কামসংক্রান্ত ব্যাপার তা বাইরে কখনও আলোচনার বিষয় হতে পারে না, কিন্তু দাসীভাবে সব কথাই চলে, আর সবচেয়ে বড় কথা ওই গোটা পাঁচেক স্বামীর রতি-বন্ধনের চেয়ে, অগুন্তি পুরুষের রতিসাহচর্য লাভ করা যায় যাতে, এমন দাসীত্বই তোমার ভাল— পরিমিত-পতিকাদ্ দারভাবাদ্ অনন্তপতিকং দাস্যমেব তবাস্তু ইতি। কর্ণের এত কৌরবানুকূল ওকালতির পরে দুর্যোধন আর স্থির থাকেন কী করে? বিশেষত দুঃশাসনের অপচেষ্টা ব্যাহত হওয়ার নিরিখে দুর্যোধন এবার নিজেরই কাপড় তুলে ফেললেন ঊরু থেকে। দেখাতে থাকলেন দ্রৌপদীকে, আর বিকট কোন মর্ষকামিতায় হাসতে থাকলেন কর্ণ।
না, শেষ পর্যন্ত দৈহিকভাবে কিছুই করা গেল না দ্রৌপদীকে। উপরন্তু কৌরবসভায় নানা দুর্লক্ষণ দেখা দিতে থাকল; ভীমের ভয়ংকর প্রতিজ্ঞা উচ্চারিত হল, গান্ধারী এবং বিদুর পুনরায় ধৃতরাষ্ট্রকে প্রকৃতিস্থ করতে সফল হলেন। ধৃতরাষ্ট্রের বরে দ্রৌপদীই স্বামীদের একে একে দাসত্ব থেকে মুক্ত করলেন। সভাস্থলে কেউ আনন্দে, কেউ কেউ মুক্তিতে এবং কেউ বা নিরানন্দে— প্রত্যেকেই নিশ্চুপ হয়ে ছিলেন, কিন্তু কর্ণ দ্রৌপদীকে দেখে দ্বিতীয়বার মুগ্ধ হলেন। এই বিপরীত রঙ্গস্থলে বিপরীতধর্মী মানুষের কাছে ততোধিক বিপ্রতীপ আচরণে লাঞ্ছিত হওয়া সত্ত্বেও দ্রৌপদী যে শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়েননি এবং শেষ পর্যন্ত তাঁরই ধৈর্যে, বিদগ্ধতায় এবং তাঁরই অপমানের মূল্যে পাণ্ডবেরা যে আবার সব ফিরে পাওয়ার আশ্বাস পেলেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে, এতে কর্ণ দ্বিতীয়বার মুগ্ধ হলেন। মহাভারতের কবি তাঁর এই লেখনীর পরিসরটুকু এমনভাবেই সাজিয়ে রেখেছেন যাতে মনে হবে কর্ণ বুঝি তখনই টিপ্পনী কাটছেন দ্রৌপদীর দিকে তাকিয়ে। কিন্তু আমরা জানি এটি সেই মুগ্ধতা, যা তাঁকে পাঞ্চালরাজ্যের স্বয়ম্বর সভায় প্রথম মুগ্ধ করেছিল। কর্ণ বললেন, এমন কোনওদিন শুনিনি বাপু! মানুষের মধ্যে রূপবতী রমণীর কথা অনেক শুনেছি, কিন্তু এমনটি কোনওদিন শুনিনি— যা নঃ শ্রুতা মনুষ্যেষু স্ত্রিয়ো রূপেণ সম্মতাঃ। তাসামেতাদৃশং কর্ম ন কস্যাশ্চন শুশ্রুম॥ হ্যাঁ কর্ণের গলার সুর এখন অবশ্যই খুব নরম। পাণ্ডবেরা প্রত্যেকেই এখন দ্রৌপদীর কল্যাণে দাসত্বের দায় থেকে মুক্ত। কর্ণ সেদিকটাতেও একটু ইঙ্গিত করে দ্রৌপদীর প্রশংসায় যেন পাণ্ডবদের লজ্জা দিতে থাকলেন। কর্ণ বললেন, হ্যাঁ, পাণ্ডব, কৌরব— সকলকেই যেন রাগে পেয়ে বসেছিল, সেখানে শান্তি নিয়ে এসেছে শান্তির প্রতিমূর্তি দ্রৌপদী— কৃষ্ণা শান্তিরিহাভবৎ। কেমন এক অথই জলে ডুবে যাচ্ছিল যেন পাণ্ডবেরা সবাই, যেখানে পাঞ্চালী কৃষ্ণা যেন নৌকো হয়ে সমস্ত পাণ্ডবদের পারে এনে তুলল— পাঞ্চালী পাণ্ডুপুত্রানাং নৌরেষা পারগাভবৎ।
বাস্তবিক পক্ষে দ্রৌপদীর সম্বন্ধে কর্ণের ধারণাটা যদি এমন মুগ্ধতারই হয়, তা হলে সে মুগ্ধতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ক্ষণেকের তরে। বিশেষত চূড়ান্ত অপানের পর এই কথাগুলি সামান্য প্রলেপের কাজ করতে পারে— এটা ভাবাও কর্ণের পক্ষে অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু মজা হল, যে নারকীয় অপমান শুধুমাত্র কথায় তার ভঙ্গিতে সম্পন্ন করেছিলেন কর্ণ, কোনও প্রলেপ, কোনও গৌরবই সেই কথা-ক্ষত পূরণের পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। তার ওপরে এখন একটা ভয়ও ধরেছিল। কৌরবদের পক্ষে প্রথমবার পাশাখেলাটা যদি ঈর্ষা কিংবা জ্ঞাতিশ্রীকাতরতার ফল হয়, তবে দ্বিতীয়বার পাশাখেলাটা ছিল তাঁদের জীবনের পক্ষে অত্যন্ত জরুরি। এই কারণে ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের সবকিছু ছেড়ে দিয়ে আবার অর্ধেক পথ থেকেই— ততো ব্যধ্বগতং পার্থং— দ্বিতীয়বার পাশা খেলার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। পাণ্ডবেরা সভা ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে দুঃশাসন তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন দুর্যোধনের কাছে এবং সঙ্গে সঙ্গে দুর্যোধনের ঘরে যে ‘মিটিং’ বসেছে তাতে দেখছি এবার কর্ণও আছেন দুঃশাসন এবং শকুনির সঙ্গে। চারজনই যুক্তি করে বুঝেছেন— এবারে পাণ্ডবেরা ছাড়বেন না। ধৃতরাষ্ট্রকে তাঁরা সভয়ে জানিয়েছেন যে, অর্জুন যেভাবে বিনা কারণে গাণ্ডীব তুলে নিচ্ছে হাতে আর ভীম যেভাবে এমনি এমনিই গদা ঘোরাচ্ছে, তাতে এবার কিছুতেই তারা ছেড়ে দেবে না— ন ক্ষংস্যন্তে। তা ছাড়া দ্রৌপদীকে যেভাবে অপমান করা হয়েছে তাতে কিছুতেই পাণ্ডবেরা বসে থাকবে না এবার— দ্রৌপদীশ্চ পরিক্লেশং কস্তেষাং ক্ষন্তুমৰ্হতি। পুত্র, শ্যালক এবং কর্ণের কথার সারবত্তা মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র বুঝেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে পাণ্ডবদের ডেকে পাঠিয়েছেন বনবাসের পণ রেখে পাশা খেলার জন্য। কুরুবৃদ্ধেরা ধৃতরাষ্ট্রকে বারণ করেছিলেন, ধৃতরাষ্ট্র কোনও যুক্তি মানেননি, কোনও প্রতিযুক্তিও দেননি। কিন্তু গান্ধারী বারণ করার পর ধৃতরাষ্ট্র একটাই কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, আমি কুরুকুলের সর্বনাশ কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখতে পারব না— অন্তঃ কামং কুলস্যাস্য ন শক্লোমি নিবারিতুম্।
কুরুকুলের সর্বনাশের ব্যাপারে দুর্যোধনের যতখানি দোষ আছে, কর্ণের দোষ তার চেয়ে কিছু কম নয়। পরে, অনেক পরে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধশেষে শ্মশানভূমিতে দাঁড়িয়ে ধর্মদর্শিনী গান্ধারী কৌরবদের ন্যায়-অন্যায়ের একটা পর্যালোচনা করেছিলেন। গান্ধারী বলেছিলেন, মূল অপরাধটা অবশ্যই দুর্যোধন এবং শকুনির কিন্তু তাতে সবসময় ইন্ধন জুগিয়ে গেছে কর্ণ আর দুঃশাসন— কর্ণ দুঃশাসনাভ্যাঞ্চ বৃত্তোহয়ং কুরুসংক্ষয়ঃ। এই যে কৌরবসভায় দ্রৌপদীর চরম লাঞ্ছনা রূপায়িত হল তার কারণ যতখানি দুর্যোধন, তার চেয়ে অনেক বেশি কর্ণ। দুর্যোধন দ্রৌপদীকে রাজসভায় নিয়ে আসবার হুকুমটি দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু রাজসভায় তাঁকে নিয়ে আসবার পর কতটা নোংরামি করা যায় এবং সেই নোংরামির মধ্যেও বা কতটা বৈচিত্র্য আনা যায়, আবার সেই অশ্লীল বৈচিত্র্যও কতটা সীমাহীন করে তোলা যায়, তার সম্পূর্ণ শিল্পী ছিলেন কর্ণ। বস্তুত কৌরবসভায় অতিথিশিল্পী হিসেবে এসেও পাশাখেলার পর্বে এমন এক জঘন্য নাটকের প্রস্তাবনা করে গেলেন তিনি, যাতে করে এরপর থেকে নাটকের গতি-প্রকৃতি রাজনীতির সূক্ষ্ম পথ ত্যাগ করে কুলবধূর ধর্ষণের কলঙ্কে কালিমাখা এক নতুন রূপ নিল। এরপর থেকে পাণ্ডবদের রাজ্যপ্রাপ্তির প্রত্যেক প্রসঙ্গে দ্রৌপদীর কথা এসেছে। পাণ্ডবেরা বনে চলে গেলে ধৃতরাষ্ট্র যখন মনে মনে ভয় পাচ্ছেন, তখন সঞ্জয় সমস্ত কথা বাদ দিয়ে দ্রৌপদীর প্রতি জঘন্য আচরণের কথা তুলেছেন। ধিক্কার দিয়েছেন দুর্যোধনের সহায় কর্ণকে, যিনি মুখে আনা যায় না এমন কথা বলেছেন দ্রৌপদীকে— দুর্যোধনশ্চ কর্ণশ্চ কটুকান্যভ্যভাষতাম্। ধৃতরাষ্ট্র নিজে স্বীকার করেছেন, কর্ণের আদেশে দ্রৌপদীর যে বস্ত্রহরণ সম্ভব হয়েছিল তাতে তৎকালীন সমাজমুখ্য ব্রাহ্মণদের মধ্যে কী নিদারুণ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল এবং তাঁরা কতটা রেগে গিয়েছিলেন— ব্রাহ্মণাঃ কূপিতাশ্চাসন্ দ্রৌপদ্যাঃ পরিকর্ষণে। মূলত দ্রৌপদীর কারণেই কুরুসভা থেকে বেরিয়ে যাবার পথে অর্জুনের মুখে কর্ণবধের ভীষণ প্রতিজ্ঞা উচ্চারিত হল। ভীম বললেন, সময় আসবে, যখন এই দুর্যোধন আর কর্ণ, শকুনি আর দুঃশাসনের রক্তপান করবে বসুন্ধরা। ঠিক ভীমের এই কথার সূত্র ধরেই অর্জুন প্রতিজ্ঞা করলেন, যে আমাদের দেখতে পারে না, যে আমাদের সবসময় বিদ্বেষ করে, খারাপ কথা বলে, সেই কর্ণকে আমি যুদ্ধে নাশ করব, কথা দিলাম— হন্তাহং কর্ণমাহবে।
॥ ৬ ॥
পাণ্ডবেরা বনে চলে গেলে ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্যে সামান্য একটা প্রজাবিদ্রোহ হয়েছিল। দ্যূতসভায় পাণ্ডবদের যেভাবে জয় করা হয়েছে এবং যেভাবে কুলবধূ দ্রৌপদীকে অপমান করা হয়েছে, তাতে একটা বিরুদ্ধ জনমত অবশ্য তৈরি হয়েছিল। সেকালে ব্রাহ্মণ্য সমাজ, যাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই রাজন্যবর্গের গতি প্রকৃতি নির্ধারণ করতেন, তাঁরা যে ধৃতরাষ্ট্রের দুর্বুদ্ধিতায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন, সে প্রমাণ তো স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্রের বক্তব্যেই রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হল, এঁরা বুঝতে পারছিলেন যে, হস্তিনাপুরের রাজ্যশাসন ধৃতরাষ্ট্রের হাতে নয়, সে শাসনের যন্ত্রী হলেন দুর্যোধন, শকুনি এবং কর্ণ। একটা সময়ে দেখা যাচ্ছে যে, এই ব্রাহ্মণ্যসমাজের একাংশ কুরুজাঙ্গলের প্রজাদের সঙ্গে নিয়ে কাম্যক বনে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। ব্রাহ্মণ, বৈশ্য এবং অন্যান্য সাধারণ লোকেরা, যারা সেদিন কাম্যকবনে রীতিমতো বিশাল এক জনসমাগম তৈরি করেছিল— সমবায়ঃ সুমহাদ্ভুতদর্শনঃ— তারা এখন আর কেউ ধৃতরাষ্ট্রতে দোষ দিচ্ছে না, তাদের শ্লোগান ছিল— দুর্যোধন, শকুনি আর কর্ণের অশুভ আঁতাত নিপাত যাক— নিপাত যাক— ধিক্ ধার্ত্তরাষ্ট্রং সুনৃশংসবুদ্ধিং ধিক্ সৌবলং পাপমতিঞ্চ কর্ণম্। শুধু প্রজারা কেন, ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রিসভার অন্যতম মন্ত্রী বিদুর পর্যন্ত একসময় ধৃতরাষ্ট্রকে ছেড়ে পাণ্ডবদের কাছে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর দোষ ছিল, তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছিলেন— আপনি আপনার ছেলে দুর্যোধন, শালা শকুনি আর ওই সারথির বেটা কর্ণকে বলুন যাতে তারা পাণ্ডবদের অনুগামী হয়ে চলে— দুর্যোধনঃ শকুনিঃ সূতপুত্রঃ প্রীত্যা রাজন্ পাণ্ডুপুত্ৰান্ ভজন্তু। দেখুন, বিদুরের ক্ষোভ যে তিনজনের বিরুদ্ধে, ব্রাহ্মণ-সজ্জন এবং অন্যান্য সাধারণ লোকেরও ক্ষোভ তাদের বিরুদ্ধেই। অতএব পাণ্ডবেরা যে বনেই থাকুন, কাম্যকবনে কি দ্বৈতবনে, দলে দলে ব্রাহ্মণেরা ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্য ছেড়ে এসে যোগ দিতে থাকলেন পাণ্ডবদের সঙ্গে— অপেত্য রাষ্ট্রাদ্ বসতান্তু তেষাম্/ঋষিঃ পুরাণোহতিথিরাজগাম। জিনিসটা কৌরবদের পক্ষে ভাল হচ্ছিল না। সমস্ত বনগুলিতে পাণ্ডবদের ধনুষ্টংকার এবং ব্রাহ্মণদের ওঙ্কার নাদ একসঙ্গে মিশে যেতে থাকল— জ্যাঘোষশ্চৈব পার্থানাং ব্রহ্মঘোষশ্চ ধীমতাম্।
কিন্তু মজা হল, এতে কর্ণের কী আসে যায়? দুর্যোধনের কাঁধে ভর রেখে তিনি নিজের বৃদ্ধিবাসনা চরিতার্থ করছেন, হস্তিনাপুরের রাজনীতিতে কীংবা শান্তনু-ভীষ্মের খানদানে ভাল-মন্দ কী হল, তাতে কর্ণের কিছু আসে যায় না। পাঠকসাধারণ অনেকেই ভাবেন, কর্ণ যা করেছেন, বন্ধু দুর্যোধনের প্রীতির জন্য করেছেন এবং এই কারণেই কর্ণকে মহাভারতের এক করুণ চরিত্রে রূপান্তরিত করতে কখনওই অসুবিধে হয় না। হ্যাঁ, কর্ণ করুণ চরিত্র বটেই, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার যে, দুর্যোধনের সঙ্গে কর্ণের যে বন্ধুত্ব ঘটেছিল সেটা শুধুমাত্র বন্ধুত্বের জন্যই নয়, সেটা যে-কোনওভাবে অর্জুনকে ঢিট করার জন্য। এই যে উন্মুক্ত রাজসভায় দ্রৌপদীকে লাঞ্ছনা করার বিচিত্র কৌশল বার করলেন কর্ণ, সেটা দুর্যোধনের প্রীতির জন্য যতখানি, তার থেকে অনেক বেশি নিজের প্রীতির জন্য। কারণ, দ্রৌপদী হলেন সেই মহিলা যিনি তাঁকেও উন্মুক্ত রাজসভায় ‘সূতপুত্র’ বলে অপমান করেছিলেন; সেই মহিলা, যিনি তাঁকে ইচ্ছে করে বিয়ে করেননি; সেই মহিলা, যিনি উলটে বিয়ে করে বসলেন এমন একজনকে যিনি তাঁর চিহ্নিত শত্ৰু, চিরকালের প্রতিদ্বন্দ্বী। এমন একজন মহিলাকে শায়েস্তা করার জন্য তিনি দুর্যোধনের বন্ধুত্ব-পদ ব্যবহার করেছেন মাত্র। বস্তুত দুর্যোধনের দিক থেকে পাণ্ডবদের প্রতি জ্ঞাতিশত্রুতা থাকার ফলে শত্রুতার অঙ্কে মিল হওয়ায় তিনি কর্ণের দ্বারা বারংবার নিজের অজান্তেই ব্যবহৃত হয়েছেন।
কর্ণ এতকাল দুর্যোধনের সমস্ত ব্যাপারে নাক গলিয়ে দুর্যোধনের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, সুখ-দুঃখ, মান-অপমান, ভাবনা— সব বুঝে নিয়েছেন। এই বোঝাটা তাঁকে কুচুটে-স্বভাবের লোকের মতো কৌশলে ভাবনা করে বুঝতে হয়নি, দুর্যোধন এতটাই মোটা দাগের মানুষ এবং কর্ণ এতটাই উচ্চাভিলাষী যে, এই বোঝাটা ছিল নিতান্তই পারস্পরিক। কর্ণ পাশার আসরে বসে সমস্ত কুরুবৃদ্ধদের অপমান করলেন। ঘরের ছেলে দুর্যোধনের পক্ষে এই অপমান করাটা লৌকিকতা কিংবা চক্ষুলজ্জায় বাধত, কিন্তু কর্ণের সেই দায় নেই, কাজেই দুর্যোধন নিজের মতো করে যেটাকে কুরুকুলপতিদের মুখোস বলে মনে করেন, সে মুখোস খুলে দিতে কর্ণের একটুও বাধে না, কারণ কর্ণ কুরুদের কেউ নন। আবার এই অপমান করার মধ্যেও যে সীমা অসীমের দ্বন্দ্ব আছে, সেটাও কর্ণ বোঝেন দুর্যোধনের দৌলতেই। কাকে কতটা অপমান করতে হবে অর্থাৎ দুর্যোধন কাকে কতটা অপমান করতে চান, সেটা দুর্যোধনই এত প্রকট করে ফেলেন যে, কর্ণের পক্ষে কোনও অসুবিধেই হয় না সে দায় বহন করার। এই যে বিদুর ফিরে এলেন বনবাসী পাণ্ডবদের কাছ থেকে, আর দুর্যোধন একেবারে মুষড়ে পড়লেন তার কারণ কী? দুর্যোধন যেখানে নিজেই বলেন যে, এই বিদুরটা হল পাণ্ডবদের বন্ধু, পাণ্ডবদের হিতকামী, তখন কর্ণ আরও বেশি বোঝেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, বিদুর— এদের সবাইকে যেখানে দুর্যোধন স্বয়ংই পাণ্ডবপক্ষপাতী ঘরের শত্রু বলে মনে করছেন, সেখানে শুধুমাত্র পাণ্ডব-বিদ্বেষের নিরিখেই কর্ণ যে এই মানুষগুলির ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবেন, তাতে আশ্চর্য কী? কিন্তু কর্ণের যেহেতু কোনও সীমাবদ্ধতার দায় নেই, তাই একদিকে তিনি যেমন দুর্যোধনের মানসিকতার মই বেয়ে কুরুসভায় কেউকেটা হয়ে উঠছিলেন, তেমনি অন্যদিকে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, বিদুর— এদের সবার বড় অপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।
যাই হোক, বিদুর ফিরে আসায় দুর্যোধন খুব মুষড়ে পড়েছেন বটে কিন্তু কর্ণের মনে সে প্রতিক্রিয়া হয়নি। শকুনি, দুঃশাসন সবার সঙ্গে কর্ণও দুর্যোধনকে বুঝিয়েছেন যে, প্রথমত যুধিষ্ঠির প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে ফিরে আসার লোক নন। আর যদি ফিরে আসেন তবে ফের পাশাখেলায় তাদের হারিয়ে বনে পাঠাব— পুনর্দ্যূতেন তান্ জয়। কর্ণ এ-কথাটা বলেছিলেন শকুনির মুখ চেয়ে কারণ দুর্যোধন শকুনির পরামর্শেই পাশা খেলে সফল হন। কিন্তু এবার কর্ণ দেখলেন যে, দুর্যোধন এই প্রস্তাবে খুশি হলেন না। কারণ একবার নয়, দু’বার পাশা খেলার পর সমস্ত জনসাধারণ এবং সমাজমুখ্য ব্রাহ্মণদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া হয়ছে, তাতে আর যে পাশাখেলা সম্ভব নয় সেটা দুর্যোধন বেশ বুঝেছিলেন। অতএব এ প্রস্তাব তাঁর একটুও ভাল লাগল না— নাতিহৃষ্টমনাঃ… পরাঙমুখঃ। কাজেই কর্ণ এবার দ্বিতীয় প্রস্তাব দিলেন— কর্ণ বললেন— পাণ্ডবেরা এখন বনে আছে, এই আমাদের সুযোগ। কর্ণ চোখ পাকিয়ে বেশ ঝাঁঝালো সুরে বললেন, ঝাঁঝালো এই জন্যে যে তিনি আগেও এ প্রস্তাব করেছিলেন, কিন্তু কেউ মানেনি। কর্ণ বললেন, আমরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বনবাসী পাণ্ডবদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। পাণ্ডবেরা এখন বিশাল ঝামেলার মধ্যে রয়েছে, মনেও শান্তি নেই, বন্ধুবান্ধব রাজন্যবর্গও তাদের সহায় নেই, এই সময়েই তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মেরে ফেলব ওদের। বাস্, দুর্যোধনেরও শান্তি, আমাদেরও শান্তি— নির্বিবাদা ভবিষ্যন্তি ধার্তরাষ্ট্ৰাস্তথা বয়ম্।
‘আমাদেরও শান্তি’ বলতে কর্ণ নিশ্চয়ই তাঁর নিজের এবং শকুনির কথা বলেছিলেন, যাঁরা দুর্যোধনের বাড়িতে বাইরের মানুষ, কিন্তু দুর্যোধনের হিতকামিতার অছিলায় স্বয়ং উচ্চাভিলাষী। কর্ণের কথা দুর্যোধনের মনে ধরল। তাঁরা যুদ্ধযাত্রায় বেরোলেন বটে কিন্তু কৌরবসভায় মহামতি বেদব্যাস এসে উপস্থিত হওয়ায় যাওয়াটা তাঁদের হল না। যদিও এই বাধাটা ছিল নিতান্তই সাময়িক। সুযোগ আবার এল যখন এক ব্রাহ্মণ বনে বনে ঘোরা পাণ্ডবদের দুরবস্থার কথা এসে শোনালেন ধৃতরাষ্ট্রকে। সেই মুহূর্তে ধৃতরাষ্ট্রের সভায় দুর্যোধনও ছিলেন না, কর্ণও ছিলেন না, ছিলেন একমাত্র শকুনি। শকুনি প্রথমেই এসে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলেন কর্ণকে— অবোধয়ৎ কর্ণমুপেত্য সর্বম্। পাণ্ডবেরা বিপাকে কষ্ট পাচ্ছেন শুনে কর্ণ খুব খুশি হলেন এবং মনের হরষ বাড়ানোর জন্য তিনি দুর্যোধনকে এক নতুন প্রস্তাব দিলেন। শকুনি তাঁর সঙ্গে ছিলেন বটে কিন্তু সমস্ত ‘প্ল্যানটা’ যে তাঁরই সেটা বেশ বোঝা যায়। কর্ণ বললেন, মহারাজ দুর্যোধন! এই সমস্ত বসুন্ধরা এখন তোমার হাতের মুঠোয়, সামন্ত রাজারা তোমার আদেশের প্রতীক্ষা করছে সবসময়। ধন-সম্পদ, প্রাচুর্য-প্রতিপত্তি যাই তোমার থাকুক, সেগুলি দেখে যদি পাণ্ডবদের কষ্টই না লাগল তা হলে সে সম্পদের মানে কী। তোমার ভর্তি আছে, তাদের কিচ্ছু নেই— এই অবস্থাটা, এই বাড়বাড়ন্ত তাদের দেখানো দরকার। সত্যি বলতে কি, রাজ্যপাট, ধনসম্পত্তি— এসব থেকে কিছুই সুখ নেই, যদি না তোমার বাড়বাড়ন্ত দেখে বনবাসী এবং দুর্বিপাকগ্রস্ত পাণ্ডবদের চোখ না টাটায়।
কর্ণ বললেন, তুমি এক কাজ করো। পাণ্ডবেরা দ্বৈতবনে যেখানে কুটির বেঁধে রয়েছে, সেইখানেই যাওয়া যাক। তুমি যাবে দারুণ দামি পোশাক পরে, সঙ্গে থাকবে টাকাপয়সা দাসদাসী। এই অবস্থায় গাছের বাকল পরা অর্জুন তোমাকে দেখলে, তোমার কী আনন্দই না হবে— কিং নু তস্য সুখং ন স্যাৎ। কুরুবাড়ির বউরা সব ঘটা করে সেজেগুজে বাকল-পরা দ্রৌপদীর সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়াবে। রাজসভার মধ্যে বেচারা দ্রৌপদীর যা অপমান হয়েছিল, সুসজ্জিতা কৌরবস্ত্রীদের দেখলে সে দ্বিগুণ জ্বালায় জ্বলবে। ভাববে, পাণ্ডবদের বিয়ে করে কী হল আমার— সা চ নির্বিদ্যতাং পুনঃ।
সেই অর্জুন, সেই দ্রৌপদী। কী উপায়ে, কী কৌশলে অর্জুন কষ্ট পান, দ্রৌপদী কষ্ট পান কর্ণের কেবল সেই চিন্তা। কর্ণের সুবিধে, তাঁর এই পাণ্ডব নিপীড়নের বাসনা দুর্যোধনে সঙ্গে মিলে যায়। বস্তুত এগুলি সবই কর্ণের মনের ইচ্ছে এবং এই ইচ্ছেগুলি তিনি চাপিয়ে দিয়েছেন দুর্যোধনের ওপর। দুর্যোধন এই কথাগুলি আগে একটুও ভাবেননি, এই মুহুর্তে কর্ণ এতসব বলায়, তাঁরও মনে হল— আরে তাই তো, এভাবে তো পাণ্ডবদের খানিকটা হেনস্থা করা যেতে পারে। সুপ্ত অভিলাষে সুড়সুড়ি লাগার সঙ্গে সঙ্গে দুর্যোধনের মনে হয়— এইরকম একটা দারুণ বুদ্ধি তো আমার মাথাতেই আসা উচিত ছিল। অতএব নিজের অপ্রস্তুত ভাব ঢাকতে বেশি সপ্রতিভ হয়ে দুর্যোধন বলেন— ভাই কর্ণ তুমি যা বলেছ, এসব তো আমার মনেও ছিল, কিন্তু নেহাত পিতা ধৃতরাষ্ট্র সেখানে যেতে অনুমতি দেবেন না বলেই যেতে পারছি না। নইলে আমার কি আর ইচ্ছে করে না যে পাণ্ডবদের একটু মেজাজ দেখিয়ে আসি, গাছের বাকল-পরা দ্রৌপদীকে পর্যাপ্তি দেখিয়ে আসতে আমারই কি ইচ্ছে করে না— দ্রৌপদীং কর্ণ পশ্যেয়ং কাষায়বসনাং বনে। কিন্তু কী উপায়ে সেখানে যাব সেইটাই তো ভেবে পাচ্ছি না। তোমরা যদি একটা উপায় বার করতে!
কর্ণ বুদ্ধিমান মানুষ, তাতে পরজীবী। তিনি বেশ জানেন— এসব দুর্যোধনের মাথায় কিছুই ছিল না, তিনি বলার সঙ্গে সঙ্গে পাণ্ডব-কৌরবের সেই কাল্পনিক দুঃখসুখের অবস্থা বৈষম্য দুর্যোধনের মনে ধরেছে। পরগাছা হওয়ার দরুন কর্ণ বেশ জানেন— কোন গাছের, কোন জায়গায় তাঁর স্বপ্নবীজ ফলবে, যেমন এক্ষুনি যে দুষ্টবীজ উপ্ত হল দুর্যোধনের মাথায়, তাকে সফল করার দায়িত্বও কর্ণেরই। তাই পরদিন সকালবেলায় উঠেই তিনি চলে এলেন দুর্যোধনের কাছে। প্রসঙ্গত বলা ভাল, দুর্যোধনের রাজকার্যে কর্ণ এতটাই গুছিয়ে বসেছিলেন যে, তাঁর রাজ্যে কোথায় কী ঘটছে সবই তিনি জানেন। সকালবেলায়— এসেই তিনি বললেন— উপায় পাওয়া গেছে। দ্বৈতবনে যেখানে পাণ্ডবেরা থাকে, সেখানেই রয়েছে হস্তিনাপুরের খাস প্রজা গয়লাদের বাড়ি-ঘর। রাজবাড়ির গোরুবাছুরদের পালন করে তারাই। সে গয়লারাও বহুদিন ধরে তোমাকে যেতে বলছে— ত্বৎপ্রতীক্ষা নরাধিপ। আমরা সেই অছিলায় দ্বৈতবনে যাব, পাণ্ডবদেরও মুখোমুখি হব। শকুনিও কর্ণকে সমর্থন করলেন। দুর্যোধন বললেন, বেশ, আমি কালকে যখন রাজসভায় ধৃতরাষ্ট্র এবং অন্যান্য কুরুবৃদ্ধদের সঙ্গে বসে থাকব তখন তোমরা এই ‘প্ল্যান’ দেবে। আমি সেই মুহূর্তে যা করার করব।
কর্ণ-শকুনি অত কাঁচা লোক নন। তাঁরা ইতিমধ্যেই দ্বৈতবনের এক গোয়ালাকে ‘ফিট’ করে এনেছেন, যার প্রসঙ্গ তুলে কর্ণ গলা মিলিয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, ঘোষপল্লীতে একবার যাওয়া দরকার (যেন দ্বৈতবন তাঁরা চেনেন না), গোরুবাছুরদের গণনা করে তাদের গায়ে ছাপ মারারও দরকার— স্মরণে সহায়ঃ প্রাপ্তো বৎসানামপি চাংকনম্। তা ছাড়া দুর্যোধন যদি যান তো একটু মৃগয়া-টৃগয়াও হতে পারে, আপনি অনুমতি দিন মহারাজ। ধৃতরাষ্ট্রের কাছে খবর ছিল যে, অর্জুন দেবতাদের তুষ্ট করে অনেক অস্ত্রশস্ত্রও লাভ করেছে, সেখানে ঘোষপল্লীতে গিয়ে যদি কৌরবেরা আবার পাণ্ডবদের বিনা কারণে খোঁচায়, এটা তিনি চাইছিলেন না। শকুনিও অনেক বোঝালেন বটে, তবে নিতান্ত অনিচ্ছায় ধৃতরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত অনুমতি দিলেন। কর্ণ, দুঃশাসন এবং শকুনিকে সঙ্গে নিয়ে দুর্যোধন চললেন দ্বৈতবনে পাণ্ডবদের বাবু-মেজাজ দেখাতে। সঙ্গে থাকল সৈন্যসামন্ত, রথ, হস্তী। সমস্ত কুলবধূরা সেজেগুজে চলল। গাড়ি-ঘোড়া, দোকান-পাট, বেশ্যা-দাসী সবাই চলল দুর্যোধনের সঙ্গে। দ্বৈতবনে এলাহি ব্যবস্থা হল থাকা-খাওয়া, নাচা-গানার। ঘোষপল্লীতে প্রাথমিক কাজকর্ম সেরেই মৃগয়া চলল কিছুদিন। তারপরেই দুর্যোধন ‘অর্ডার’ দিলেন— দ্বৈতবনের যে সরোবরের একধারে পাণ্ডবেরা রয়েছেন তারই আরেক ধারে বেশ কিছু বাড়ি বানিয়ে ফেলতে। কারিগরেরা চলল বটে বাগানবাড়ি বানাতে, কিন্তু সে জায়গা আগেই এসে দখল করেছিলেন গন্ধর্ব চিত্রসেন। একজনকে দেখাতে এসে আরেকজনের সঙ্গে গণ্ডগোল বেধে গেল। রীতিমতো যুদ্ধ, তুমুল যুদ্ধ। পাণ্ডবেরা পরপারেই রয়েছেন, তাঁদের সামনেই যুদ্ধ হচ্ছে, কাজেই দুর্যোধনের তরফে এটা দারুণ ‘প্রেস্টিজে’র ব্যাপার। প্রধান প্রধান সৈনিকদের দিয়ে কিছু হল না, অতএব ‘প্রেস্টিজ’ বাঁচাতে যুদ্ধ করতে এলেন কর্ণ। প্রচণ্ড যুদ্ধ হল। কর্ণ অনেক গন্ধর্বদের মেরে ফেললেন বটে কিন্তু গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন মায়াযুদ্ধ জানেন। দুর্যোধন, দুঃশাসনেরা সবাই কর্ণের ভরসাতেই যুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ নয়, চিত্রসেন এমন যুদ্ধ করলেন যে, কর্ণ দেখলেন রণক্ষেত্রে প্রায় তিনি একা। গন্ধর্বরাও বুঝেছে যে, কর্ণই আসল যুদ্ধবাজ, তারা সবাই মিলে কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ করল। কেউ কর্ণের রথ ভাঙে, কেউ ধ্বজা কেটে দেয়, কেউ রথের চাকা নিয়ে পালায়, কেউ বা রথের ঘোড়া মারে, কেউ বা শুধুই বাণ মেরে যাচ্ছে কর্ণের গায়ে। শেষে সমস্ত গন্ধর্বরা মিলে কর্ণকে এমন ব্যতিব্যস্ত করে তুলল যে, কর্ণ রথ থেকে লাফিয়ে পড়ে দুর্যোধনের ভাই বিকর্ণের রথে চড়ে পালাতে বাধ্য হলেন। সেই সুযোগে দুর্যোধন চিত্রসেনের হাতে সস্ত্রীক ভাইদের সঙ্গে বন্দি হলেন এবং তাঁকে মুক্ত হতে হল ভীম এবং অর্জুনের মধ্যস্থতায়। এর থেকে বড় অপমান দুর্যোধনের আর কী-ই বা হতে পারে। গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন দুর্যোধনের সমস্ত ‘প্ল্যান’টাও বলে দিলেন পাণ্ডবদের।
দুর্যোধন লজ্জায় মাথা নিচু করে হস্তিনাপুরের দিকে চললেন, নিজের ওপর অশ্রদ্ধায় তাঁর মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। এরই মধ্যে কর্ণ এসে উপস্থিত হলেন দুর্যোধনের কাছে। অতি আহ্লাদে আটখানা হয়ে কর্ণ বললেন, বাঃ! তোমরা যে গন্ধর্বদের জিতে আবার ফিরে চলেছ, এটা দেখে খুবই ভাল লাগছে। আমাকে তো তোমরা দেখেছ, গন্ধর্বরা কী করল! সবাই মিলে এমন আমার পেছনে লাগল— অহং ত্বভিদ্রুতঃ সর্বৈঃ গন্ধর্বৈঃ পশ্যতস্তব— যে, পালিয়ে যেতে বাধ্য হলাম— ব্যপযাতোহভিপীড়িতঃ। যেখানে আমারই এই অবস্থা, সেখানে ভাইদের সঙ্গে করে তুমি যে যুদ্ধ জিতে ফিরেছ, এটা তুমি ছাড়া আর কেউ পারত না।
বলাবাহুল্য, এই কথায় দুর্যোধন আপাতত খুবই বিব্রত বোধ করলেন এবং গম্ভীরভাবে জানালেন, তুমি কিছুই না জেনে এসব কথা বললে বলে আমি কিছু মনে করছি না, নইলে জেনে রেখো আমি কিছুই জিতিনি, বরঞ্চ বউ-ঝি, মন্ত্রী-ভাই— সবাইকে নিয়ে আমি তাদের হাতে বন্দি হয়েছিলাম। দুর্যোধন সব খুলে বললেন। কীভাবে তাঁদের সব কৌশল ফাঁস হয়ে গেছে, কীভাবে নিতান্ত উদাসীনতায় অর্জুন চিত্রসেনের হাত থেকে তাঁকে রক্ষা করেছেন এবং কীভাবে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির পর্যন্ত তাঁকে ‘লাস্ট ওয়ার্নিং’ দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন— মা স্ম তাত পুন কার্ষীরীদৃশং সাহসং ক্কচিৎ। কর্ণ সব শুনলেন, বুঝলেন ভীষণ অপমানবোধে দুর্যোধন জর্জরিত। এই অপমান-পঙ্ক থেকে দুর্যোধনকে কীভাবে উদ্ধার করা যায়, তাও তিনি জানেন। তবু তিনি দুর্যোধনকে বলতে দিলেন। দুর্যোধন এতই ভেঙে পড়েছেন যে, তিনি কর্ণকে বললেন, তোমরা যাও ভাই সব, দুঃশাসনকে আমি যুবরাজ পদে অভিষিক্ত করছি। দুঃশাসনই কর্ণ এবং শকুনির দ্বারা প্রতিপালিত এই ঋদ্ধা বসুমতীকে শাসন করবে— প্রশাধি পৃথিবীং স্ফীতাং কর্ণসৌবলপালিতাম্।
একটা বিরাট খবর পাওয়া গেল। যে পৃথিবী এইমাত্র দুর্যোধন দিয়ে দিলেন দুঃশাসনকে, দুঃশাসন সেই পৃথিবীর রাজা মাত্র হবেন, বস্তুত সেই পৃথিবী এতদিন সমৃদ্ধ হয়েছে কর্ণ এবং শকুনির চালনা গুণে, পালনের বুদ্ধিতে— কর্ণসৌবল-পালিতাম্। দুর্যোধন মনে প্রাণে যা বিশ্বাস করেন, আমরাও তাই বিশ্বাস করি। রাজ্যভার নবসেবকের হাতে প্রত্যর্পিত হোক আর নাই হোক, দুর্যোধনের রাজ্য এতকাল কর্ণ আর শকুনির বুদ্ধিতেই চলছে, দুর্যোধন রাজা, কর্ণ রাজ্যপাল। দুর্যোধনের রাজ্যে এত বড় যাঁর সম্মান, সেই কর্ণ জানবেন না কীভাবে দুর্যোধনের অপমান ঘোচাতে হবে? অনেকক্ষণ দুর্যোধনের কথা শুনে, তাঁর আত্মধিক্কার হজম করে কর্ণ একটা সাধারণ উত্তর দিলেন। আগেই বলেছি কর্ণের ওকালতি বুদ্ধি খুব পরিষ্কার। ভীম, অর্জুন এবং যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের প্রতি যে উদাসীনতা দেখিয়েছেন, ততোধিক উদাসীনতায় কর্ণ জবাব দিলেন, তোমরা এমন বোকার মতো মনোকষ্ট পাচ্ছ যে কী বলব— বালিশ্যাৎ প্রাকৃতাবিব। পাণ্ডবেরা তাদের কর্তব্য করেছে, করাই উচিত। কারণ তারা তোমার রাজ্যের অন্তেবাসী প্রজা, তো প্রজা রাজাকে বাঁচাবে না? তা ছাড়া জনপদবাসী সাধারণ মানুষেরা সৈনিকদের সাহায্য করবে, রাজার কাজে সহায়তা করবে— এই নিয়ম। পাণ্ডবেরাও তোমার জনপদবাসী। অতএব সাহায্য করেছে, তাতে হয়েছেটা কী? পাণ্ডবেরা অনেককাল আগেই তোমার দাসে পরিণত হয়েছে— প্রেষ্যতাং পূর্বমাগতাঃ— আমি তো মনে করি তুমি যে সময়ে গন্ধর্বদের বিরুদ্ধে সসৈন্যে যুদ্ধযাত্রা করেছ, সেই সময়েই পাণ্ডবদের উচিত ছিল তোমার সেনাবাহিনীর পেছনে এসে যোগ দেওয়া— স্বসেনয়া সম্প্রয়ান্তং নানুযান্তি স্ম পৃষ্ঠতঃ— কারণ সেটাই ছিল তাদের কর্তব্য। কর্ণের কথায় দুর্যোধনের মনে নিশ্চয়ই কাজ হচ্ছিল, তবুও তিনি ওপরে ওপরে ভীষণ অবসন্ন দেখাচ্ছিলেন। এবারে যখন শকুনিও কর্ণের সমস্ত কথা সমর্থন করলেন— সম্যগ্ উক্তং হি কর্ণেন— এবং দুর্যোধনকে খুব একচোট বকা লাগালেন তখনই কর্ণের কাজ সাঙ্গ হল। দুর্যোধন সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে হস্তিনায় ফিরে এলেন।
গন্ধর্বদের সঙ্গে যুদ্ধে কর্ণ যে একেবারে জঘন্যভাবে হেরে গেলেন, এর ফল ফলল দুই তিন-ধারায়। যিনি বাস্তবিক অহঙ্কারী পুরুষ যেমন কর্ণ, তিনি ভাবলেন তাঁর এই পরাজয়টা নিতান্তই আপাতিক এবং অর্জুন যে গন্ধর্বদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভ করেছে, সেটাও কোনওক্রমে হয়ে গেছে। দুর্যোধনকে তিনি বুঝিয়েছেন, তুমি অর্জুনের বিক্রম দেখে ভয় পেয়ো না, তেরো বছর বাদে যদি যুদ্ধ হয়, তবে অর্জুনকে আমি প্রাণে মারব— একথা নিশ্চয় জেনো— সত্যং তে প্রতিজানামি বধিষ্যামি রণেইর্জুনম্। দুর্যোধন তো এই কথা বিশ্বাস করতেই চান। যার ওপরে ভরসা করে তিনি এগোচ্ছেন, সে একটা যুদ্ধ হেরে গেলে তার একটা প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হয় বটে। কিন্তু ভরসা করার মতো বশংবদ বীরপুরুষ যদি বিকল্পে না থাকে, তবে তাকেই আবার ভরসা করতে হয়, ভাবতে হয়— পরেরবার কর্ণ নিশ্চয় দেখে নেবে অর্জুনকে— এবমাশা দৃঢ়া তস্য ধার্তরাষ্ট্রস্য দুর্মতেঃ। কিন্তু নিরপেক্ষ জন ছাড়বে কেন? যারা আগে একের পর এক অন্যায় করেছে, তারা যখন হেরে যায়, তখন নিরপেক্ষ জনে কটূক্তি করবেই। কাজেই কর্ণ দুর্যোধন, যখন লজ্জার মাথা খেয়ে হস্তিনায় ফিরলেন, তখন ভীষ্ম বললেন, দ্যাখো বাপু দুর্যোধন, আগেই তোমায় বারণ করেছিলাম দ্বৈতবনে না যেতে, এখন শত্রুর হাতে বন্দি-বাঁধন কেমন লাগল? লজ্জা করল না তোমার যখন পাণ্ডুপুত্রেরা এসে তোমাদের বাঁচাল? আর এই যে সারথির পো, সে তো ভয়ে পালিয়েই গেল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে, তোমরা তো ‘কর্ণ কর্ণ’ বলে ডাক ছাড়ছিলে, তবু সে পালিয়ে গেল— ‘ক্রোশতস্তব রাজেন্দ্র সসৈন্যস্য নৃপাত্মজ। সূতপুত্রোহপযাদ্ ভীতঃ…। এই তো অবস্থা, তুমি অর্জুনের ক্ষমতাও দেখলে, কর্ণের ক্ষমতাও দেখলে, এত তো ‘কর্ণ’ ‘কর্ণ’ করো, আরে কর্ণ অর্জুনের পায়ের নখের যুগ্যি নয়— ন চাপি পাদভাক্ কর্ণঃ পাণ্ডাবানাং নৃপোত্তম। ভীষ্ম বললেন— আমি সারকথা বলি, তুমি সন্ধি করো পাণ্ডবদের সঙ্গে, সেটাই হবে চরম মঙ্গল। দুর্যোধন সপার্ষদ এতক্ষণ ভীষ্মের কথা শুনছিলেন, এবারে সন্ধির কথা শুনে ভীষ্মের মুখের ওপর দারুণ এক অবজ্ঞার হাসি হেসে উত্তরের সৌজন্য না দেখিয়েই হুম হুম করে চলে গেলেন, পেছন পেছন চললেন কর্ণ আর দুঃশাসন।
স্বয়ং কুরুকুলপতি বৃদ্ধ পিতামহের প্রতি একই কুলজাত অধস্তন পুরুষের এই যে ব্যবহার এই ব্যবহারের মধ্যে মন্দবুদ্ধি উচ্চাভিলাষী রাজপুরুষ প্রশ্রয় পাবে। দুর্যোধন সেটা বোঝেন না। আমরা পূর্বেই দেখেছি, দুর্যোধনের প্রশ্রয়ে কর্ণ এতটাই বেড়ে উঠেছেন যে দ্যূতসভার আসরে তিনি কুরুবৃদ্ধদের বিরুদ্ধেও কটূক্তি করতে ছাড়েননি। এখন এই মুহূর্তে স্বয়ং রাজপুত্রই যখন তাঁর পিতামহের মুখের ওপর অবজ্ঞার হাসি হেসে তাঁর সমস্ত সদুপদেশ উড়িয়ে দিলেন— প্রহস্য সহসা রাজন্ বিপ্রতস্থে সসৌবলঃ— সেখানে কর্ণের কী দায় থাকে? বাইরের লোকের সামনে এমনি করে অপমানিত হয়ে ভীষ্ম তো কোনওরকমে নিজের ঘরে মুখ লুকিয়ে বাঁচলেন, কিন্তু আর একটি উচ্চভিলাষী মুখ তখন দুর্যোধনের দুর্বলতায় ঘা দিয়ে বলল— এই ভীষ্মটা আমাদের একদম দেখতে পারে না। সবসময় ওর মুখে শুনবে পাণ্ডবদের প্রশংসা। বুড়ো তোমাকে দেখতে পারে না, তাই আমাকেও দেখতে পারে না— তদ্দোষাচ্চ মহাবাহো মমাপি দ্বেষ্ট্রমৰ্হতি।
লক্ষ করুন, কর্ণ সবসময় এখানে দুর্যোধনকে জড়িয়ে নিয়ে নিজের কথা বলছেন এবং তিনি যে রেগে যাচ্ছেন, এটা যেন নিজের অপমানে ততটা নয়, যতটা দুর্যোধনের অপমানে। কর্ণ বললেন, দেখবে সবসময় তোমার সামনে আমাকে খাটো করবে। তোমার সামনে আমাকে যেসব কথা বলছে, এ কিন্তু আমি আর সহ্য করব না; আমাকে তাও যা বলার বলুকগে, কিন্তু সবসময় ওই পাণ্ডবদের প্রশংসা আর তোমার নিন্দা— এ আর আমি সহ্য করতে পারছি না— ন মৃষ্যামীহ ভারত। তুমি যদি আজকে বলো তো সমস্ত পৃথিবী তোমায় আমি জিতে এনে দিতে পারি। যে সমস্ত সামন্ত রাজ্য পাণ্ডবেরা একসময় জিতেছিল, সেসব আমি চতুরঙ্গ সেনা নিয়ে একাই জিতে আনব। দেখুক বেটা দুষ্টুবুদ্ধি ওই কুরুকুলের কুলাঙ্গার ভীষ্মটা— সংপশ্যতু সুদুর্বুদ্ধিভীষ্মঃ কুরুকুলাধমঃ। কর্ণ বললেন, ভীষ্ম সবসময় যাকে নিন্দে করার নয় তাকে নিন্দে করবে, যেমন আমাকে, তোমাকে। আর যাকে প্রশংসা করা কখনও উচিত নয় তাকে প্রশংসা করবে, যেমনি পাণ্ডবদের। ও এইবার আমার ক্ষমতা দেখবে, আর নিজেই একেবারে কুঁকড়ে যাবে— আত্মানাং তু বিগর্হতু। আমি দিগ্বিজয় করে আসব, তুমি অনুমতি দাও।
সত্যি কথা বলতে কি ভীষ্মের প্রতিকূল ব্যবহারে কর্ণ যে আজ হঠাৎ খেপে উঠলেন, তা মোটেই নয়; ভীষ্ম একটা উপলক্ষ মাত্র। আসল কথা তিনি নিজে যে গন্ধর্বদের হাতে প্রচণ্ড পিটুনি খেয়ে এলেন এবং তিনি থাকতেও দুর্যোধনকে যে অর্জুনের সহায়তায় মুক্তি পেতে হল, এর একটা প্রতিপূরক ব্যবহার করতে চাইছিলেন কর্ণ। এতে যেমন দুর্যোধনের ক্ষোভও একটু প্রশমিত করা যাবে তেমনি দিগ্বিজয়ের সূত্রে বেশ কয়েকটা রাজ্য জিতে এলে দুর্যোধন তাঁর ওপর হৃত বিশ্বাস ফিরে পাবেন। বিশেষত যুদ্ধবিদ্যায় তিনি যে কারও চাইতে কম নন এটা যদি অর্জুন বাদে অন্য রাজাদের ওপর দিয়ে পরীক্ষা হয়ে যায়, তার চাইতে সুবিধেজনক আর কী আছে। কিন্তু এই দিগ্বিজয়ের কথাটা হঠাৎ করে পাড়তে কর্ণের অসুবিধে হচ্ছিল। দুর্যোধনের সামনে ভীষ্ম তাই যেদিন কর্ণকে কিঞ্চিৎ খাটো করলেন, ওমনি কর্ণ দিগ্বিজয়ের কথাটা পেড়ে ফেললেন এবং সেইসঙ্গে কুরুবৃদ্ধ পিতামহকেও যথেচ্ছ গালাগালি করে নিলেন। কিন্তু কী আশ্চর্য যে মানুষ দুর্যোধনের দাক্ষিণ্যে এত দূর এসেছেন, তাঁরই মুখে আপন পিতামহের কুৎসা শুনেও দুর্যোধন তাঁকে কিছুই বললেন না। ‘ভীষ্ম কুরুকুলের অধম,’ ‘ভীষ্ম দুর্বুদ্ধি’— এ-কথা যদি সত্যও হত, তবু কর্ণের মুখে এ-কথা শুনে দুর্যোধনের প্রতিবাদ করা উচিত ছিল, তা তো তিনি করলেনই না বরং উলটে বললেন— ধন্য হলাম বন্ধু, ধন্যি আমি! তোমার মতো মহাবল পুরুষ যে সব সময় আমার হিত চিন্তা করছে, তাতে আজ আমার জন্ম সফল— হিতেষু বৰ্ত্ততে নিত্যং সফলং জন্ম চাদ্য মে। যাও বীর, তুমি বিশ্বভুবন জয় করে ফিরে এসো।
পাণ্ডবেরা দিগ্বিজয় করতে বেরিয়েছিল, সেই দিগ্বিজয় কর্ণ করতে যাচ্ছেন দুর্যোধনের প্রতিনিধি হয়ে— এই গর্বেই দুর্যোধনের বুক ফুলে উঠল। ভীষ্মের অপমান তাঁর মাথাতেই ঢুকল না। বিশ্ব নিখিল জয়ের জন্য কর্ণ জয়রথে উঠলেন এবং অর্জুনের মতো ধনুর্ধারী বীর দ্বিতীয় না থাকার ফলে দিগ্বিজয় করে ফিরেও এলেন। কর্ণের সাফল্যে গর্বিত দুর্যোধন, গদগদ ধৃতরাষ্ট্র তাঁর ভাইবন্ধুদের নিয়ে আরতি করে কর্ণকে নামিয়ে আনলেন জয়রথ থেকে এবং সবার সামনে কর্ণকে মাথায় তুলে দিয়ে বললেন— যে সুখ আমি ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ— কারও কাছ থেকে পাইনি, আজ তুমি কর্ণ সেই সুখ দিলে— যন্নভীষ্মান্ন চ দ্রোণাৎ… ত্বত্তঃ প্রাপ্তং ময়া হি তৎ। কর্ণ বুঝলেন, তাঁর বুদ্ধি কাজে লেগেছে, দুর্যোধন তাঁর পুরনো দুঃখ ভুলে গেছেন। আজ তিনি ভীষ্ম দ্রোণের থেকেও বড় ‘হিরো’। দুর্যোধন বললেন— বেশি কথা কী, তোমার জন্যই আজ আমরা অনাথ নই। বেশ বিশ্বাস হচ্ছে, তোমার শক্তির তুলনায় পাণ্ডবদের শক্তি এক ফুটো পয়সাও নয়— ন হি তে পাণ্ডবাঃ সর্বে কলামৰ্হন্তি ষোড়শীম্। কর্ণ তো এইটাই চেয়েছিলেন, এমন একটা ব্যাপার করা যাতে দুর্যোধন আবার বিশ্বাস করবেন যে, অর্জুনকে তিনি ছাড়া আর কেউই জয় করতে পারবেন না। দুর্যোধন বিশ্বাস করেছেন। কর্ণ আজ সফল এবং এতটাই সফল যে কর্ণকে দুর্যোধন রণবিজেতা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মর্যাদায় ভূষিত করে বললেন— যাও তুমি আজ দেখা করো পিতা ধৃতরাষ্ট্র, জননী গান্ধারীর সঙ্গে, ঠিক যেমন পুরন্দর ইন্দ্র যুদ্ধ জয় করে এসে দেখা করেন দেবমাতা অদিতির সঙ্গে। কর্ণও বাধ্য ছেলের মতো— পুত্রবচ্চ নরব্যাঘ্র— ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারীর পাদবন্দনা করলেন। যিনি এতকাল বাইরের লোক ছিলেন সেই কর্ণ আজ দিগ্বিজয়ের পর কৌরবকুলে ঘরের ছেলে হয়ে গেলেন। দুর্যোধন আর শকুনি ভাবলেন, কর্ণ বুঝি পাণ্ডবদের জয় করেই ফেলেছেন, শুধু একটা খেলা-খেলা যুদ্ধের অপেক্ষা— জানতে নির্জিতান্ পার্থান্ কর্ণেন যুধি ভারত।
হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে কর্ণের প্রেস্টিজ এখন দারুণ বেড়ে গেছে। দুর্যোধন দেখলেন, দিগ্বিজয়ও হয়ে গেল, ভেট হিসেবে টাকাপয়সাও অনেক এসেছে, এখন যুধিষ্ঠিরের মতো একটা রাজসূয় করলেই বেশ জাতে ওঠা যায়। জনসাধারণের কাছে দ্যূতক্রীড়ার পরে তাঁর যে একটা সম্মান-হানি হয়েছিল, কর্ণের দিগ্বিজয়ের পর সে গ্লানি খানিকটা ঘুচেছে। জনগণ নিশ্চয়ই সুরক্ষিত বোধ করছে, এখন একটা রাজসূয়যজ্ঞ করলেই দুর্যোধনের ভাবমূর্তি একেবারে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। সময় বুঝে দুর্যোধন তাঁর রাজসূয়ের বাসনা জানালেন কর্ণকে। দুর্যোধন বললেন— পাণ্ডবদের রাজসূয় দেখা অবধি আমার বড় সাধ হয় কর্ণ যে, রাজসূয়যজ্ঞ করব। তুমিই সে ব্যবস্থা করো— তাং সম্পাদয় সূতজ। কর্ণ বললেন— এ আর বেশি কথা কী? সমস্ত ধরণী তোমার বশগত। এখন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে বলে ব্রাহ্মণদের ডাকিয়ে রাজসূয় করলেই হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য! একই বংশের দুই জ্ঞাতি পুরুষ রাজসূয়যজ্ঞ করতে পারে না, সে নিয়ম নেই। যুধিষ্ঠির বেঁচে থাকতে— জীবমানে যুধিষ্ঠিরে— দুর্যোধনের পক্ষে দ্বিতীয়বার রাজসূয় করা সম্ভব নয়। ব্রাহ্মণেরা অনেক ভেবে চিন্তে রাজসূয়ের সমতুল্য বৈষ্ণবযজ্ঞ করার অনুমতি দিলেন। দুর্যোধন ভাবলেন— তাই সই, হাজারও লোকজন তো যজ্ঞের আড়ম্বর দেখে দুর্যোধনের ধন্যধ্বনি দেবে, তাই সই। তা বৈষ্ণবযজ্ঞে ভীষ্ম, দ্রোণ, সবাই সক্রিয় ভূমিকা নিলেন। তাঁরা ভাবলেন ছেলের বুঝি সুমতি হয়েছে, ধম্ম-কম্ম করছে। কর্ণের বিজয়-ঘোষে দুর্যোধনের উদার যজ্ঞপুণ্যের মহিমায় মণ্ডিত হয়ে বৈষ্ণবজ্ঞ জনগণের মনে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়ের স্মরণ ঘটাল। কেউ বা ভাল বলল কেউ বা মন্দ। তুলনা-প্রতিতুলনার দ্বন্দ্বশেষে দুর্যোধনের বৈষ্ণবযজ্ঞ যেদিন সমাপ্ত হল সেদিন পরম আহ্লাদিত মনে জনগণের শেষ স্তুতি-চন্দনের চূর্ণ গায়ে মেখে তিনি এসে বসলেন নিজের ঘরে আপন গোষ্ঠীর মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে কর্ণ দাঁড়িয়ে উঠে ঘোষণা করলেন— ঘোষণা করলেন এইজন্যে যে, তিনি আজকের কৌরবগোষ্ঠীতে সবচেয়ে বড় ‘হিরো’ হওয়া সত্ত্বেও বুঝেছেন, দুর্যোধনের বৈষ্ণবযজ্ঞের উন্মাদনা যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়ের স্মৃতিলোপ ঘটাতে পারেনি; বুঝেছেন— তাঁর আপন দিগ্বিজয় পাণ্ডবদের বলবীর্য ম্লান করে দিতে পারেনি; বুঝেছেন— দিগ্বিজয় এবং বৈষ্ণবযজ্ঞের সমাপ্তির পরেও অর্জুন এখনও জীবিত। তাই কর্ণ ঘোষণা করলেন— আজকের যজ্ঞ শেষ হল বটে। কিন্তু দারুণ যুদ্ধে পাণ্ডবেরা সবাই মারা যাবার পর যেদিন তুমি রাজসূয়যজ্ঞ করবে— হতেষু যুধি পার্থেষু রাজসূয়ে তথা ত্বয়া— সেদিন আবার আমি তোমার উপযুক্ত সৎকার করব। দুর্যোধন জড়িয়ে ধরলেন কর্ণকে। মনে মনে কল্পনা করলেন কেমন করে নিহত পাণ্ডবদের মৃত্যুক্ষেত্রে রাজসূয়ের উদ্বোধন করবেন তিনি। দুর্যোধন বললেন— কবে সেদিন আসবে যেদিন পাণ্ডবদের মৃত্যুর পথে যাত্রা করিয়ে আমি রাজসূয়ের অনুষ্ঠান করব? সমস্ত উত্তেজনা একসঙ্গে জড়ো করে কর্ণ জবাব দিলেন— তবে আমার কথা শোনো দুর্যোধন! যতদিন আমি অর্জুনকে না মারতে পারি, ততদিন আমি নিজে নিজের পা ধোব না, খাব না মাংস, পালন করব ‘অসুরব্রত’, আর এই ব্রতের নিয়ম হিসেবে আজ থেকে কেউ যদি এসে আমার কাছে কিছু চায়, আমি না বলব না। কর্ণ এমনি এক নিশ্চয়তায় অর্জুন বধের প্রতিজ্ঞা করলেন যে দুর্যোধন পুনরায় বিশ্বাস করলেন— পাণ্ডবেরা মরেই গেছে— বিজিতাংশ্চাপ্যমন্যন্ত পাণ্ডবান্ ধৃতরাষ্ট্রজাঃ।
টীকাকার নীলকণ্ঠ বলেছেন ‘অসুরব্রত’ মানে অসুরদের কোনও ব্রত-ট্রত নয়, সুরা পান না করার ব্রত। কর্ণ মদ, মাংস ত্যাগ করে মলিন হয়ে, দানের পুণ্যে অর্জনবধের প্রতিজ্ঞা করলেন। যাঁরা ভাবেন কর্ণ সারাজীবন দান-ধ্যান করে ‘দাতা কর্ণ’ হয়েছেন, তাঁরা মনে রাখবেন— পাণ্ডবদের বনবাসপর্বের যখন আর এক বৎসর আটমাস মাত্র বাকি, তখন থেকে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত কর্ণ তাঁর দানের ব্রত পালন করেছিলেন। নিখুঁত হিসেব করে দেখলে এই সময়ের অঙ্ক খুব বেশি দিনের নয়, যদিও কর্ণের ‘দাতা’ সুনামটিও সময়ের হিসেব ধরে আসেনি, এসেছে নিজের মৃত্যু তুচ্ছ করে আপন অঙ্গ-জাত কবচ-কুণ্ডল দানের ফলে। মহাভারতের অন্যত্র যেখানে কর্ণের গৌরব শোনা যাচ্ছে করুণ সুরে, সেখানে অবশ্য বলা আছে যে, মধ্যদিনে দেব দিবাকরের পূজা সমাপন করার পর কর্ণ কোনও ব্রাহ্মণ প্রার্থীকে ফেরাতেন না। কিন্তু সে-কথা আক্ষরিক অর্থে বিশ্বাস করলে বিপদ বাড়ে। তাতে বৈষ্ণবযজ্ঞের অন্তে দুর্যোধনের কাছে পুনরায় দানব্রত গ্রহণের প্রতিজ্ঞা করার অর্থ থাকে না। বিশেষত দুর্যোধনের রাজবাড়িতে কর্ণের দৈনন্দিন জীবনের যে চিত্র আঁকা আছে তাতেও কোনও দানের কথা কোনওদিন পাওয়া যায় না। যাই হোক, কর্ণ প্রথম থেকেই দান করুন কিংবা তাঁর প্রতিজ্ঞারম্ভের পর, সে-কথা অকিঞ্চিৎকর, বস্তুত এই দানের কাহিনী থেকেই কর্ণের জীবনে অতি কারুণ্যের স্পর্শ লেগেছে, নইলে এতদিন কৌরব সভায় বৃদ্ধ সজ্জনের চোখের ওপর যে ব্যবহার তিনি করে যাচ্ছিলেন, তাতে তাঁর জন্মলগ্নের অনিশ্চয়তা থেকে পাঠকের হৃদয়ে যে করুণা জন্ম নিয়েছিল তা প্রায় ধুয়ে মুছে যাচ্ছিল। কিন্তু দুর্যোধনের বৈষ্ণবযজ্ঞ সমাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্ণ যে অর্জুনবধের প্রতিজ্ঞা নিলেন, সেদিন থেকেই কর্ণের জীবনে আরেক অধ্যায় আরম্ভ হল— করুণ অধ্যায়। অস্ত্র প্রতিযোগিতার রঙ্গভূমিতে দুর্যোধনের কাছ থেকে অঙ্গরাজ্যের রাজমুকুট লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে কর্ণের জীবনে ভাগ্যোত্তরণের শুরু। একে আমরা ভাগ্য বলব কিনা জানি না, তবে রাজার ঘরে জন্মালে একজন রাজপুত্রের যা যা লাভ হতে পারত, কর্ণ সে সবই লাভ করেছিলেন দুর্যোধনের বন্ধুত্বের দৌলতে এবং নিজের ক্ষমতায়, বুদ্ধিবৃত্তিতে তথা কৌশলে। হস্তিনাপুরের রাজনীতিতে ক্রমে ক্রমে তিনি এমন এক পদমর্যাদা লাভ করেছিলেন, যা ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ এইসব পুরাতন ব্যক্তিত্বের কাছে ঈর্ষণীয় ছিল। কর্ণের দিগ্বিজয় ছিল এই মর্যাদার চূড়ান্ত বিন্দু। কিন্তু দুর্যোধনের বৈষ্ণবযজ্ঞ সমাপনের পর যে দানব্রত গ্রহণ করলেন কর্ণ, সেই ব্রত থেকেই তাঁর যত ক্ষয়-ক্ষতি আরম্ভ হয়, যদিও এই ক্ষয়স্থানগুলি যশের গৌরবে মাঝেমাঝেই ভাস্বর।
॥ ৭ ॥
কর্ণ খুব দান করে চলেছেন। দিনের পর দিন তাঁর দানের পুণ্য বেড়েই চলেছে। এদিকে পাণ্ডবদের বনবাস বারো বচ্ছর পুরে তেরো পচ্ছরে পড়ি পড়ি। বনবাসের দিন যত শেষ হয়ে আসছে, পাণ্ডব-কৌরব দুই পক্ষই মানসিকভাবে ততই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এই প্রস্তুতির ছায়া পড়েছিল দেবলোকেও। ইন্দ্র, সূর্য— এঁরা কীরকম দেবতা জানি না, তবে মহাভারতের পটভূমিতে এই দেবতাদের সঙ্গে মর্ত্যলোকের মাখামাখি যথেষ্ট ছিল বলেই মর্ত্যনারীর গর্ভে উৎপন্ন আপন আপন পুত্রের জন্য দেবসমাজেও কিঞ্চিৎ চিন্তাভাবনা দেখা দিল। অর্জুনকে বাঁচানোর জন্য স্বয়ং দেবরাজের মনোবাসনা টের পেয়ে গেলেন দেব দিবাকর। ভগবান সূর্য বুঝলেন, কর্ণের দানব্রতের সুযোগ নিয়ে ইন্দ্র ব্রাহ্মণের রূপ ধরে হরণ করবেন তাঁর সহজাত কবচ এবং কুণ্ডল, যা থাকলে কর্ণের মৃত্যু নেই। দেবরাজের অভিপ্রায় জেনে সূর্য নিজেই ব্রাহ্মণের রূপ ধরে দেখা দিলেন কর্ণের স্বপ্ন-শয়নে। সূর্য বললেন— তোমার ভালর জন্য বলছি বাছা। দেবরাজ ইন্দ্র ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে তোমার কাছে আসবেন কবচ এবং কুণ্ডল যাচনা করার জন্য। তিনি জানেন যে, দানের সময় তুমি কাউকে ফেরাও না— ন প্রত্যাখ্যাসি কস্যচিৎ। কিন্তু তুমি যেন বাপু ইন্দ্র ঠাকুরকে তোমার কবচ আর কুণ্ডল দিয়ে দিয়ো না। তুমি তোমার সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করবে ইন্দ্রকে কবচ আর কুণ্ডলের ব্যাপারে বিমুখ করতে কিংবা তাঁর দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে।
নিজের ঘরের লোক বলে সূর্য ইন্দ্রের স্বভাব জানেন। সূর্য ভাবলেন, ইন্দ্রের ঈপ্সিত বস্তুগুলি যদি পর পর সাজিয়ে দেওয়া যায়, তা হলে হয়তো বা তিনি তাঁর উদ্দেশ্য থেকে সরে যেতেও পারেন। সূর্য বললেন— ইন্দ্র যখন ভিক্ষে চাইবেন, তুমি তখন হিরে-জহরতের লোভ দেখাবে, লোভ দেখাবে মদমত্ত যুবতী কামিনীদের। তা ছাড়া ঋগ্বেদের প্রথম সারির দেবতা তিনি, গোরু-ঘোড়াও তাঁর ঈপ্সিত হতে পারে, তুমি সেগুলোও একবার বলে দেখো— রত্নৈঃ স্ত্রীভিস্তথা গোভির্ধনৈর্বহুবিধৈরপি। আসল কথা কী জানো, তোমার এই কবচ আর কুণ্ডল যদি একবার দিয়ে দাও, তা হলেই তোমার পরমায়ু শেষ। যতদিন ও দুটি তোমার সঙ্গে আছে, ততদিন তুমিও আছ। ও দুটি হারালে যুদ্ধক্ষেত্রে আর তুমি শত্রুর অবধ্য থাকবে না। তাই বলি, যদি বাঁচতে চাও কর্ণ, তা হলে অমৃতের ভাণ্ড থেকে উঠে-আসা ওই কবচ আর কুণ্ডলটি তোমায় বাঁচিয়ে রাখতেই হবে— তস্মাদ্ রক্ষ্যং ত্বয়া কর্ণ জীবিতং চেৎ প্রিয়ং তব!
সূর্য ব্রাহ্মণের বেশে দেখা দিয়েছিলেন কর্ণের স্বপ্নশয্যায়। যে মানুষ সারাজীবন কলঙ্ক বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন, তিনি এক ব্রাহ্মণবেশীর মুখে তাঁর জীবনের দাম শুনে ভারী পুলকিত হলেন। তাঁর বেঁচে থাকার জন্য, শুধু তাঁর বেঁচে থাকার জন্য এমন মমত্বময় দুশ্চিন্তা তিনি কারও মধ্যে দেখেননি, এমনকী তাঁর মায়ের মধ্যেও নয়, যিনি তাঁকে জন্ম দিয়ে ভুলে গেছেন। এই মমত্বটুকুর জন্য কর্ণ সব দিতে পারেন। বিশ্বসংসারের বিচিত্র বন্ধনের রূপ দেখে ব্যক্তি-মানুষের যেমন ক্কচিৎ এমন কল্পনা আসে যে, এই মুহুর্তে আমি মরে যেতে পারি, ঠিক তেমনি এই মুহূর্তে তাঁরই জীবনের জন্য এক ব্রাহ্মণবেশীর এত ভাবনা জেনে কর্ণেরও বুঝি মনে হল— এই মমতার বিকল্পে আমি মরতেও পারি। কিন্তু তার আগে জেনে নেওয়া দরকার কে এই ব্রাহ্মণবেশী। কর্ণ বললেন— কে আপনি ব্রাহ্মণ, আমার ওপর এত মমতা দেখাচ্ছেন— দর্শয়ন্ সৌহৃদং পরম্। সূর্য বলতে পারলেন না— আমি তোমার বাবা। তিনি তাঁর দেবলোকের মাহাত্ম্য অক্ষুন্ন রেখে, যেন ভক্তের কাছে ভগবান এসেছেন, এমনি এক অবগুণ্ঠনে কর্ণকে জানালেন— আমি সহস্রাংশু সূর্য। তোমার ওপর করুণাবশত এতক্ষণ যা বলেছি তুমি তাই কোরো।
প্রতিদিন সহস্র মানুষের বৈদিক স্তুতিবাদে যিনি দেবতার পদবী লাভ করেছেন, সেই সূর্যের পক্ষেও বোঝা সম্ভব নয় তাঁর আপন সন্তানের যাতনা কতখানি। যিনি শৈশব থেকেই পিতৃমাতৃপরিচয়হীন, সূতপুত্র বলে সর্বত্র লাঞ্ছিত তাঁর কাছে মরণের থেকে যশই বেশি প্রার্থনীয়। এতদিন কুরুকুলের রাজবাড়িতে আপন শক্তি এবং প্রতিভায় তিনি যা পেয়েছেন, তা তাঁর প্রাপ্য, কিন্তু প্রার্থনীয় নয়। বরঞ্চ রাজবাড়ির রাজনীতির কলুষতায় যশের বদলে তাঁর কলঙ্ক জুটেছে। আজ তিনি যশ চান, কারণ যশই হল সেই দুগ্ধশুভ্র বস্তু, যা তাঁর জন্মের গ্লানি, জীবনের সব লাঞ্ছনা সমস্ত কিছু ধুয়ে মুছে দিতে পারে। কর্ণ মরণের ভয় তুচ্ছ করে সূর্যকে বললেন— আপনি আমার ভালর জন্য যা বলেছেন, তা আমি বুঝি। কিন্তু আমি যদি সত্যি আপনার প্রীতিভাজন হই, তা হলে আমার দাননিষ্ঠায় আপনি আমায় বাধা দেবেন না— ন নিবার্যো ব্ৰতাদ্ তাস্মাদ্ অহং যদ্যস্মি তে প্রিয়ঃ। আজকে যদি পাণ্ডবদের কারণে দেবতাদের রাজা ইন্দ্রদেব ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে ব্রাহ্মণের বেশ ধরে স্বয়ং আসেন আমার দুয়ারে— হিতার্থং পাণ্ডুপুত্ৰাণাং খেচরোত্তম ভিক্ষিতুম্— তা হলে আমি কবচ এবং কুণ্ডল দুটিই দেব, অবশ্য দেব। আমাকে যে দিতেই হবে।
মহাভারতের এই অংশে, কর্ণের মনের ভাবটা পরিষ্কার বুঝেছিলেন কালিদাসের পূর্বজন্মা এক মহাকবি— ভাস। তিনি লিখেছেন— কর্ণ একটুও বঞ্চিত বোধ করছেন না। কেননা, সহস্র বৈদিক যজ্ঞে মুনি-ঋষিদের আহুতি আর স্তুতিবাদে যে দেবতাকে মাথায় তুলে রাখা হয়েছে, যিনি স্বয়ং হাজারো দৈত্য-দানবের নিহন্তা বলে চিহ্নিত, ঐরাবতের মতো দেবহস্তী চালনা করতে করতে যাঁর হাতে কড়া পড়ে গেছে, সেই দেবরাজ যদি অর্জুনের মতো ত্রিভুবনজয়ী পুত্রের প্রাণ বাঁচাতে কর্ণের কাছে ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে আসতে পারেন, তা হলে তিনি বুঝবেন তিনিই তাঁকে কৃতার্থ করেছেন, কর্ণ একটুও বঞ্চিত নন— ময়া কৃতার্থঃ খলু পাকশাসনঃ। আসল কথা, স্বর্গের দেবতার হুকুম তামিল করে করে যেখানে মর্তের মানুষ কৃতার্থ বোধ করে সেই দেবতা যদি মন্দারগন্ধী স্বর্গপথ ছেড়ে মর্তের ধূলিতে নেমে এসে ভিক্ষা চান মানুষের কাছে, তাঁকে কর্ণ ফেরাবেন কী করে? তাও কী, অর্জুনের প্রাণের জন্য তাঁর কাছে ভিক্ষা! এক্ষেত্রে যাচনাবৃত্তি দেবরাজের দেবত্ব হানি করে আর কর্ণের দানবৃত্তি কর্ণের চরিত্র উজ্জ্বল করে— তন্মে কীৰ্ত্তিকরং লোকে তস্যাকীৰ্তির্ভবিষ্যতি। এত বড় সুযোগ ছাড়বার বিলাসিতা কর্ণ দেখাতে পারেন না, কেননা কর্ণই অর্জুনকে করুণা করতে চান চিরকাল। অতএব প্রগাঢ় আত্মতৃপ্তিতে, নিরুচ্চার আনন্দে কর্ণ স্বপ্নের অতিথিকে বললেন— আমাকে বারণ কোরো না প্রভু! আমি ইন্দ্রকে কবচ-কুণ্ডল দুইই দেব। কেননা আমার মতো মানুষ, যে মানুষ প্রাণের গ্লানিতেই ভুগেছে চিরকাল, সেই আমার মতো মানুষের কাছে প্রাণরক্ষার তাগিদ নেই কোনও— মদ্বিধস্য যশস্যং হি ন যুক্তং প্রাণরক্ষণম্। তা ছাড়া মরণ যখন হবেই, সে মরণ যশের সঙ্গে যুক্ত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। ভিক্ষার জন্য এলে আমি দেবরাজকে ফেরাব না, কারণ এই ভিক্ষাই আমার কীৰ্ত্তি অক্ষয় করে তুলবে।
কর্ণ তাঁর শিক্ষার শুরু থেকে দিগ্বিজয় পর্যন্ত যা করে এসেছেন, তা কীর্তির জন্যই করে এসেছেন; কিন্তু দুর্ভাগ্য তাঁর; যে পথে তিনি এতকাল চলছিলেন তাতে কীর্তি আসে না, আসেনি, বরং অকীর্তি এসেছে। আজ সব শুধরে নেবার দিন। দ্বিতীয়ত অৰ্জুন। ক্ষমতায়, বুদ্ধিতে, সম্মানে সব ব্যাপারে অর্জুন তাঁর চেয়ে খাটো হোক, এই তো চেয়েছিলেন কর্ণ। আজ যখন পুত্রের প্রাণের জন্য অর্জুনের পিতা নিজের স্বরূপ ভাঁড়িয়ে তাঁর কাছ থেকেই তাঁর জীবন ভিক্ষে চাইবেন, তখন কর্ণ ভাববেন— আমি সব ছলনা জেনেও আমার দেহরক্ষার বর্ম আমার নিজের হাতেই ভিক্ষে দিচ্ছি, নইলে দেবাসুর কারও সাধ্য ছিল না, আমার এই কবচ-কুণ্ডল কোনওভাবে ছিন্ন করতে পারে আমার দেহ থেকে। কর্ণ জানেন, তাঁর অস্ত্রশিক্ষার কৌশল একদিন ব্যর্থ হতে পারে, যাঁর আশ্রয়ে আজ তাঁর এত বাড়বাড়ন্ত, সেই দৃঢ়মূল কৌরবকুলও এক দিন ঝড়ে-পড়া গাছের মতো উৎপাটিত হতে পারে, এমনকী কৌরবের রাজনীতিতে তাঁর আজকের যে সুস্থিরতা, সে সুস্থিরতাও নষ্ট হতে পারে যে কোনওদিন। কিন্তু শিশুকাল থেকে যে অর্জুনবধের লক্ষ্যে তিনি এগিয়ে চলেছেন, সেই অর্জুনের প্রাণের জন্য যদি দেবতাদের রাজা কর্ণের প্রাণ ভিক্ষা চান ভিক্ষুকের মতো, তা হলে কর্ণ তা দেবেন। কারণ, কর্ণ জানেন, এই দানের সুযোগে তাঁর কীর্তি ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বময়, যা তাঁর জন্ম-কুৎসার ধূলিধূসর অক্ষয় জীবনের চেয়ে অনেক বেশি অক্ষয়। কর্ণ তাই সোজাসুজি সূর্যকে জানালেন— যুদ্ধে আমি জীবন আহুতি দেব, যতটা সম্ভব ঝুঁকি নেব— হুত্বা শরীরং সংগ্রামে কৃত্বা কর্ম সুদুষ্করম্— কিন্তু এই উত্তমর্ণের ভূমিকায় যশ আমার চাই— যশঃ প্রাপ্স্যামি কেবলম্।
হায়! একমাত্র পিতামাতা ছাড়া আর কে বোঝে যে, ধন-জন-যশ-মাহাত্ম— এই সমস্ত কিছুর চেয়েও পিতামাতার কাছে পুত্রের প্রাণই বড়। তার ওপরে ভগবান সূর্যের ওপরে এই ক্ষেত্রে বাড়তি চাপ আছে। জৈবিক চরিতার্থতার মুহুর্তেও তিনি এক শঙ্কিতা কুমারী জননীকে কথা দিয়েছিলেন যে, পুত্রের জীবনের জন্য তার জননীর কোনও চিন্তার কারণ নেই, কেননা সে জীবনরক্ষার উপায় নিয়েই জন্মাবে। সূর্য জানেন— তবু জননী-হৃদয়ে শঙ্কার অন্ত থাকে না। সবচেয়ে বড় কথা, এই পুত্রের মাতা সূর্যের বাহুবন্ধনে ধরা দেবার আগে এবং পরে সূর্যের ওপর এতটাই বিশ্বাস করেছিলেন যে, সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে গিয়েও আজ তিনি পুত্রের কাছেই পরাভূত। এই পুত্রের জননী পেটিকাবদ্ধ পুত্রকে জলে ভাসিয়ে দিয়ে বলেছিলেন— তুমি যেখানেই থাকো তোমার পিতা যেন তোমাকে রক্ষা করেন, কেননা আমি না চাইলেও তিনি তোমাকে দিয়েছেন— পিতা ত্বাং পাতু সর্বত্র তপনস্তপতাং বরঃ। যেন দত্তোহসি মে পুত্র— কাজেই পিতার দায়িত্বই এখানে বেশি। মিলনের মুহুর্তে সূর্যদেবের আশ্বাস আর কুন্তীর বিশ্বাসের ওপরেই যাঁর জীবন নির্ভর করছে, সেই পুত্র যদি হঠাৎ এখন বলে— আজ আমি ‘সুইসাইড’ করব, তা হলে পিতা হিসেবে সূর্যদেবের কেমন লাগে? বিশেষত যে পিতা আপন প্রাণ বাঁচানোর উপায় বলে দিতে এসেছেন পুত্রকে, সে পুত্র যদি বাঁচার কৌশলকে মরণের কৌশলে রূপান্তরিত করার বায়না করে, তবে পিতার হৃদয় কেঁপে ওঠে। তেমনি কেঁপে উঠেই সূর্য বললেন— না বাছা না, নিজের প্রতি এত অবিচার কোরো না— মাহিতং কর্ণ কার্ষী স্ত্বম্।
সূর্য একবারও বলেননি, তিনি কর্ণের পিতা। তবু তিনি এমন করতে আরম্ভ করলেন যে, তাঁর গুপ্ত পিতৃসত্তা মাত্রাহীন স্নেহে দ্রবীভূত করল তাঁর ভাষা, যে ভাষা অস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করল তাঁর পিতৃত্বের প্রতি। সূর্য বললেন— না বাছা না, শুধু নিজেরই নয়, তোমার বন্ধুজন, তোমার নিজের স্ত্রীপুত্র এবং সবার ওপরে তোমার পিতামাতার এমন সর্বনাশ তুমি কোরো না বাছা— পুত্ৰাণামথ ভার্যাণামথ মাতুরথো পিতুঃ। তুমি যশ চাইছ, বেশ কথা, কিন্তু সেটা জীবনের বিনিময়ে কেন বাবা। সূর্য বলতে চাইলেন— কর্ণ তুমি এখন সামাজিক সম্পর্কহীন একটি ব্যক্তিমাত্র নও। তুমি কারও পুত্র, কারও পিতা, কারও বা স্বামী। আর এইসব স্নেহ-ভালবাসার সম্পর্ক তোমার সঙ্গে ততক্ষণই, যতক্ষণ তুমি বেঁচে আছ— জীবতাং কুরুতে কার্যং পিতা মাতা সুতাস্তথা। তা ছাড়া যে যশ তুমি এত করে চাইছ, তুমি নিজে মরে গেলে সে যশের স্বাদ তুমি কী পাবে? ভস্মীভূত মৃত ব্যক্তি যশের কী খবর পায়? গতপ্রাণ ব্যক্তির গলায় মালা পরালে, সে যেমন তার কিছুই টের পায় না, মৃত ব্যক্তির কাছে যশও সেইরকম— কীৰ্ত্তিশ্চ জীবতঃ সাধ্বী পুরুষস্য মহাদ্যুতে।
সূর্যের ভাবে ভাষায় তাঁর আপন পিতৃত্ব বড় বেশি প্রকট হয়ে উঠেছিল। কিন্তু দেবতা হওয়া সত্ত্বেও এতদিন তিনি পিতৃপরিচয় দেননি, সেই সূর্য যদি এখনও বলেন— আমিই তোমার পিতা— তা হলে নতুন কোনও দুর্বাধ আনন্দে কর্ণ যদি মৃত্যুবরণ করে আরও বেশি সুখ পান, সেই ভয়েই তিনি আমতা আমতা করে বললেন— না না আমার আর কী, এতদিন ধরে তুমি সূর্যোপাসনা করছ, তুমি আমায় ভক্তি কর কত। সেইজন্যই ভক্তের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদেই তোমায় বলতে এলাম যে, দেবলোকে তোমাকে নিয়ে একটা খেলা চলছে, সে খেলায় যেন তুমি বলি হয়ো না। কিন্তু সামান্য এই নির্বিকার, নির্মোহ ভাষ্য দেবার পরমুহূর্তেই সূর্যের মুখ দিয়ে ঝরে পড়ল চিরন্তন পিতার অভ্যাস। সূর্য বললেন— আমি বার বার বলছি কবচ আর কুণ্ডল— এই দুটি জিনিস তুমি যেন দিয়ো না। ওই কবচ আর কুণ্ডল দুটি তোমার শরীরে যেমনটি আছে, তেমনটিই থাকলে কেমন সুন্দরই না দেখতে লাগে তোমায়— শোভসে কুণ্ডলাভ্যাঞ্চ রুচিরাভ্যাং মহাদ্যুতে। বিশাখা নক্ষত্রের দুই ভাস্বর তারার মাঝখানে চাঁদ যেমনটি, সহজাত ভাস্বর কুণ্ডল দুটির মাঝখানে তোমার মুখখানিও লাগে ঠিক তেমন চাঁদের মতো— বিশাখয়োর্মধ্যগতঃ শশীব।
সব ছেড়ে শেষে ছেলেকে দেখতে কত সুন্দর দেখাবে এই মোহ-ভাবনায় যিনি মগ্ন, তিনি যে যশের চেয়ে পুত্রের জীবন বেশি আকাঙ্খা করবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী? সূর্য যখন বুঝলেন কর্ণ কিছুতেই শুনবেন না, তখন তিনি কর্ণকে অর্জুনের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। এই সুচিরকাঙ্খিত প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্যই যে তাঁর বেঁচে থাকা দরকার, এই কথাটা কর্ণকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলেন সূর্যদেব। বললেন— তুমি না অর্জুনের সঙ্গে লড়তে চাও— নিত্যং স্পর্ধসে সব্যসাচিনা— তা তোমার দেহে যদি এই কবচ আর কুণ্ডল থাকে, তা হলে অর্জুন কেন অর্জুনের বাবাও তোমার কিছু করতে পারবে না— ন তু ত্বাম্ অর্জুনঃ শক্তঃ… স্বয়মিন্দ্রঃ সখা ভবেৎ।
কে শোনে কার কথা! যার যত অভিমান, সে তত বেপরোয়া। শিশুকাল থেকে ঔরস-পুত্রহীন সূত-পিতা-মাতার অতিরিক্ত আদরে, কুরুবাড়িতে দুর্যোধনের অতিরিক্ত প্রশ্রয়ে এবং নিজের মধ্যে জমে থাকা হাজারো অভিমানে অভিমানী কর্ণ এমনিই বেপরোয়া এবং গোঁয়ার গোছের লোক। কবচ এবং কুণ্ডলের অলৌকিকতায় যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি অর্জুনের সমকক্ষ হবেন— এই কথাটাও তাঁর সদা-জাগ্রত পৌরুষে আঘাত করল যেন। সূর্যকে একেবারে স্তব্ধ করে দিয়ে কর্ণ বললেন— অর্জুনের সঙ্গে শক্তিপরীক্ষার ব্যাপারে আমার এই কবচ আর কুণ্ডলের যে কার্যকারিতা, সে-কথা নিয়ে আপনি ভাববেন না। আপনি তো জানেন অস্ত্রবল আমার কম নেই। পরশুরাম এবং দ্রোণাচার্যের মতো গুরুর কাছে আমি অস্ত্রশিক্ষা লাভ করেছি, কাজেই অর্জুনকে আমি কবজা করবই— বিজেষ্যামি রণেহর্জুনম্। তবে হ্যাঁ! আপনি আর বাদ সাধবেন না। ইন্দ্র এসে যদি আমার কাছে ভিক্ষে চান, তা হলে আমি তাঁকে ফেরাব না, জীবন দিতে হলেও, না। আপনি অনুমতি করুন।
সূর্য বুঝলেন, কর্ণ কথা শোনার লোক নন। তিনি বললেন, অগত্যা, তুমি কবচ এবং কুণ্ডল হারাবে বুঝতে পারছি। তবু তুমি এক কাজ কোরো। ও দুটি দেওয়ার ব্যাপারে একটা শর্ত আরোপ কোরো। তুমি বলবে— দিয়ে দেব আপনাকে কবচ-কুণ্ডল, কিন্তু তার বদলে আপনি দিন আমায় সেই অমোঘ শক্তি, যা ব্যর্থ হবে না আমার শত্রুর ওপর। এই বিনিময়ের আদেশ দিয়ে স্বপ্ন-সূর্য আর দাঁড়ালেন না। সহসাই স্বপ্ন ভেঙে গেল কর্ণের। সূর্যপূজার কালে কর্ণ যাচাই করে বুঝলেন সূর্যই এসেছিলেন তাঁর কাছে।
তারপর একদিন যখন কর্ণের দানভূমি থেকে একে একে ব্রাহ্মণেরা দান নিয়ে ফিরে গেছেন, সেই সময়ে কর্ণের দুয়ারে গুরু গম্ভীর এক শব্দ শোনা গেল— ভিক্ষাং দেহি। এই গলার স্বর কোনও রুক্ষ-জীর্ণ, উপবাস-ক্লিষ্ট ব্রাহ্মণের হতে পারে না। কর্ণ ঠিক চিনেছেন, ইনি ইন্দ্র— ব্রাহ্মণবেশী। প্রখর সূর্যের সহস্র কিরণ এতক্ষণ যেন আশীর্বাদের মতো বর্ষিত হচ্ছিল কর্ণের মাথার ওপর, হঠাৎই সে সূর্যের গতি অবরুদ্ধ হল, দলে দলে মেঘ এসে সূর্যের সদা জাগ্রত সহস্র চক্ষু ঢেকে দিল যেন। দেবকুলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি সূর্যের চোখের সামনে তাঁরই পুত্রের সর্বনাশ করতে স্বয়ং দেবরাজেরও বাধোবাধো ঠেকে। তাই বুঝি তাঁরই আদেশে অনন্ত মেঘের সারি সূর্যকে ঠিক আড়াল করে রাখল কর্ণের চোখ থেকে। দেবরাজ হাঁকলেন— ভিক্ষাং দেহি। কর্ণ ব্রাহ্মণবেশীকে বললেন— স্বাগত দ্বিজরাজ, আপনাকে প্রণাম।
মহাকবি ভাস মহাভারতের এই অংশ অবলম্বনে নাটক লিখতে গিয়ে ইন্দ্রের মনে বড় দ্বিধা লক্ষ করেছেন। সেকালে কেউ নত হয়ে প্রণাম জানালে সম্মানিত ব্যক্তি তাঁকে আয়ুষ্মত্তার আশীর্বাদ দিতেন। কিন্তু ব্রাহ্মণবেশী দেবরাজ যেখানে কর্ণের আয়ু হরণ করতে চান, সেখানে তিনি যদি বলেন ‘দীর্ঘায়ু হও’, তা হলে তো আর ইষ্টসিদ্ধি হয় না। আবার আশীর্বচনের মুখে যদি তাঁর শব্দভাণ্ডার ফুরিয়ে যায়, তা হলে প্রণামান্তে নিবেদনকারী কর্ণ ভাববেন— কী মূর্খ এই ব্রাহ্মণ! কাজেই উভয় পন্থা ত্যাগ করে দেবরাজ বললেন— সূর্যের মতো, সাগরের মতো, হিমালয়ের মতো তোমার যশ অক্ষয় হোক।
আমরা জানি কর্ণও তাই চান। কিন্তু তবু তিনি দেবরাজকে একটু খেলাবার জন্য তাঁর দানের বস্তুগুলির গুণাগুণ শোনাতে লাগলেন। মহাভারতে দেখেছি— সূর্যের কথা কর্ণের স্মরণ আছে। তিনি বললেন— বলুন ব্রাহ্মণ কী চাই আপনার, কীই বা আমি দিতে পারি, সোনায় মুড়ে দেওয়া যুবতী মেয়েছেলে নেবেন— হিরণ্যকণ্ঠীঃ প্রমদাঃ— অথবা গ্রাম দিতে পারি, জনপদ দিতে পারি। ইন্দ্র বললেন— ওসব মেয়েছেলে, গ্রাম, জনপদ, আরও যেসব ভাল ভাল জিনিসের নাম তুমি করছ, ওসব অন্যদের দিয়ো, আমি ওসব চাই না বাপু। কর্ণ তবু তাঁর ঋদ্ধির সূচী মাথায় রেখে একবার গজ-বাজি, একবার গোধন, একবার স্ত্রীলোক, একবার গোটা রাজ্য দিতে চাইলেন। কিন্তু দেবরাজ তাতে ভুললেন না, তিনি চান কর্ণের গায়ের সঙ্গে লেগে থাকা কবচ এবং কুণ্ডল, যা তাঁকে নিজেরই নিজের দেহ থেকে কেটে দিতে হবে— এতদ্ উৎকৃত্য মে দেহি।
ভাসের নাটকটায় ঘটনাগুলি এমনভাবে সাজানো আছে, যাতে করে দেবরাজকে আস্তে আস্তে সুনিপুণ ভিখারি করে তোলা হয়েছে। কর্ণ একবার সহস্র সোনার শিংওয়ালা গোধন দিতে চান, আর ইন্দ্র বলেন— ও দুধ তো খেলেই শেষ, ও চাই না বাপু চাই না— নেচ্ছামি কর্ণ নেচ্ছামি। এমনিভাবে ঘোড়ার কথা আসে, হাতির কথা আসে, আর দেবরাজ বলেন— ও তো চড়লেই সুখ শেষ— নেচ্ছামি কর্ণ নেচ্ছামি। এইভাবে রাজ্যপাট, যজ্ঞের ফল সব দিতে চেয়েও কর্ণ খালি শোনেন— ও চাই না বাপু চাই না— নেচ্ছামি কর্ণ নেচ্ছামি। শেষে বিরক্ত কর্ণ একবার ক্ষোভে বলে ওঠেন— তা হলে আমার মাথাটা কেটে দিই, নিয়ে যান— তেন হি মচ্ছিরো দদামি। ইন্দ্র বাধা দেন। কিন্তু হতাশ হয়ে আসল কথাটা বলতেও পারেন না, অথচ লোভও ছাড়তে পারেন না। শেষে কর্ণ নিজেই বুঝে আপন কবচ-কুণ্ডলের কথা তোলেন, আর ওমনি মহাকবির আঁকা লুব্ধমুখ ভিখারির মুখে জেগে ওঠে বিকৃত হাসি; লজ্জা-ঘেন্না ত্যাগ করে সে হাত বাড়ায়— দাও দাও— দদাতু দদাতু।
মহাভারতের ভিখারি আরও লজ্জাহীন। তিনি সবকিছু প্রথমেই নস্যাৎ করে কবচ-কুণ্ডল চান এবং বলেন এই মুহুর্তেই চাই সেটা। খোঁটা দিয়ে বলেন— তুমি না দানের ব্রত নিয়েছ— যদি সত্যব্রতো ভবান্। কর্ণ আরও একবার চেষ্টা করেন কিন্তু ওসব মনভুলানি কথায় দেবরাজ ভুললেন না, কবচ-কুণ্ডল তাঁর চাইই চাই। কর্ণ এবার হেসেই ফেললেন। বললেন— আমি সবই জানি দেবরাজ, কেনই বা এই ব্রাহ্মণবেশ আর কেনই বা এই প্রার্থনা। আপনি দেবরাজ, আপনাকে বর দেওয়া কি আমার সাজে। কোথায় আপনিই আমাকে বর দেবেন, তা না আপনিই বসেছেন প্রার্থীর আসনে। তা ছাড়া আপনি তো জানেন, এই কবচ-কুণ্ডল দিলে আমি মৃত্যুর মুখে পড়ব এবং তাতে আপনাকে নিয়ে লোকে হাসবে। তার চেয়ে বিনিময়ের পথে আসুন, আপনি কিছু দিন, আমিও ব্রাহ্মণবেশীকে কবচ-কুণ্ডল দিচ্ছি, নইলে কিছুতেই দেব না— ন দদ্যামহমন্যথা! ইন্দ্র বললেন— আমি এখানে আসবার পথেই বুঝেছি, সূর্যদেব সব বলে দিয়েছেন তোমাকে। তা বেশ, তুমি বাপু আমার নিজের হাতিয়ার বজ্রটা ছেড়ে দিয়ে আর যা চাও তাই দেব।
কর্ণ সূর্যের কথামতো এবার সেই অমোঘ শক্তি চাইলেন। ইন্দ্র বললেন— শক্তি নিচ্ছ নাও, কিন্তু এ শক্তি তোমার ঈপ্সিত একজন প্রধান শত্রুকে বধ করা মাত্রই আমার হাতে ফিরে যাবে, তুমি কিন্তু দ্বিতীয়বার এটি ব্যবহার করতে পারবে না। কর্ণ বললেন— আমি একজনকেই মারতে চাই— একমেবাহম্ ইচ্ছামি রিপুং হন্তুং মহাহবে— দ্বিতীয়বার ব্যবহারের আমার প্রয়োজনই নেই। ইন্দ্র বললেন— একজনকে তো মারতে চাচ্ছ, কিন্তু যে একজনের কথা তুমি ভাবছো, তাকে রক্ষা করছেন স্বয়ং বাসুদেব কৃষ্ণ। কাজেই কী যে হবে, তা কে জানে। কর্ণ ইন্দ্রের কথা উড়িয়ে দিয়ে বললেন— সে যা ইচ্ছে হোক ভাবনা নেই, আমাকে একবীরঘাতিনী সেই শক্তি দিন, আমি আমার কবচ-কুণ্ডল কেটে দিচ্ছি।
ঠিক সেই মুহূর্তে সূর্যের কথা বুঝি কর্ণের মনে পড়ল। দুই সহজাত কুণ্ডলের মাঝে তাঁর মুখটি নাকি চাঁদের মতো দেখায়। দুল-কাটা, রক্ত-ঝরা কানে কর্ণের বিকৃত মুখ যদি সূর্যের মনে ব্যথা দেয়। কর্ণ বললেন— ও ভাল কথা! আমি কবচ-কুণ্ডল গা থেকে কেটে দেব আপনাকে, কিন্তু তাতে যেন কোনও বীভৎসতা না আসে আমার শরীরে, কাটা-ঘা দগদগে হয়ে না থাকে। ইন্দ্র বললেন— না বাপু কিচ্ছু হবে না। তুমি যেমনটি সুন্দর আছ তেমনি সুন্দর থাকবে। ঠিক তোমার বাবা সুয্যিঠাকুরের গায়ের যেমন রং, যেমন তাঁর তেজ— যাদৃশস্তে পিতুর্বর্ণস্তেজশ্চ বদতাং বর— ঠিক তেমনিই হবে তোমার শরীর।
কর্ণ আপন হাতের তরবারিতে নির্বিকারে নিজের দেহ থেকে তাঁর শরীররক্ষার দৈববর্ম কেটে রক্তমাখা অবস্থাতেই দিলেন দেবরাজের হাতে। কান থেকে কুণ্ডল দুটি কর্তিত ছিন্ন করে দেবার ফলেই তাঁর নাম হল দাতা কর্ণ, প্রদদৌ কুণ্ডলে তে কর্ণাৎ তস্মাৎ কর্মণা তেন কর্ণঃ। এমন দানের মহিমায় স্বর্গ থেকে পুষ্পবৃষ্টি ঝরল, শঙ্খ-দুন্দুভি বাজল আর মহাভারতের কবি সিদ্ধান্ত দিলেন— স্বর্গের দেবতা ইন্দ্র ভুঁয়ে পা রেখে কর্ণের সঙ্গে বঞ্চনা করা সত্ত্বেও, কর্ণ যেহেতু তাঁকেই কৃতার্থ করেছেন তাই কর্ণের যশের পথ প্রশস্ত করে দিলেন স্বয়ং ইন্দ্র— ততঃ শত্রুঃ প্রহসন্ বঞ্চয়িত্বা, কর্ণং লোকে যশসা যোজয়িত্বা। আসলে কর্ণের প্রতি শিশুকাল থেকে যে বঞ্চনা চলছিল, কর্ণের সত্যব্রত এবং তাঁর আত্মদানের মাধ্যমে সে বঞ্চনার চূড়ান্ত সাধন করে তাঁকে যশ উপহার দিলেন মহাভারতের কবি। এক চূড়ান্ত বঞ্চনার জীবনে কবির হৃদয় যশ ছাড়া আর কীই বা উপহার দিতে পারে! অবশ্য কর্ণের যশোবিস্তারে আমরা পুলকিত হচ্ছি বটে, কিন্তু এই যশের কিছু বাস্তব প্রতিক্রিয়া ঘটল। সমকালে ব্যাপারটা ছিল অন্যরকম— কবচকুণ্ডল আছে, না খোয়া গেছে? খোয়া গেলে যাঁদের খুশি হওয়ার কথা, যেমন পাণ্ডবেরা, তাঁরা বনে বসে এই খবর পেলেন যে, কর্ণের জীবনরক্ষার কবচ-কুণ্ডল হরণ করেছেন দেবরাজ; তাঁরা দারুণ খুশি হলেন। আর যাদের মুষড়ে পড়ার কথা, যেমন কৌরবেরা, তাঁরা একেবারেই ভেঙে পড়লেন, কেউ কেউ এমনও ভাবলেন যে, হয়ে গেল, আর সম্ভব নয়— দীনাঃ সর্বে ভগ্নদর্পা ইবাসন্।
কর্ণের কবচ-কুণ্ডল দানের মাহাত্ম্যে আমরা আপাতত কিঞ্চিত আপ্লুত বটে, তবে সঙ্গে সঙ্গে এও মনে রাখতে হবে যে, যিনি প্রতিহিংসাপরায়ণ বীর তিনি সাময়িকভাবে ধর্মে-কর্মে মন দিলেও তাঁর মৌলিক চরিত্র একেবারে পালটে যায় না। দেবালয়ে দেবমূর্তির সামনে দাঁড়ালে অতি ক্রুর মানুষেরও যেমন চক্ষুদুটি শিবায়িত হয়, তেমনি এই দানব্রতের সত্যরক্ষার তাগিদে কর্ণের চূড়ান্ত দানও কর্ণকে খানিকটা গম্ভীরতা দিল বটে, কিন্তু এতে তাঁর মূল স্বভাব সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হল না। হবেই বা কেন? রাজসভার রাজনীতিও রয়েছে, দুর্যোধনও রয়েছেন, পরম শত্রু অর্জুনেরাও বেঁচে আছেন। বরঞ্চ রাজসভায় ‘টেনশন’ এখন অনেক বেশি। পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাস শেষ হয়ে আসছে, অথচ গুপ্তচরেরা এ বন, সে বন তন্ন তন্ন করে খুঁজে এসে খবর দিল যে পাণ্ডবদের কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছে না। দুর্যোধন যদি বা চরদের কথা শুনে, তাদের নিষ্ঠা সত্ত্বেও অসহায়তার কথা বুঝে বিমনা হয়ে পড়ছিলেন, কিন্তু এই অবস্থাতেও কর্ণ দমে যাবার পাত্র নন। তেরো বছর পরে পাণ্ডবেরা ফিরে এসে আবার রাজ্য চাইবে এবং তা পেয়েও যেতে পারে— এ যেন কর্ণেরই দুশ্চিন্তা। তাঁর ধারণা, আরও ভাল করে খোঁজা দরকার পাণ্ডবদের। পাঠানো দরকার আরও ধূর্ত গুপ্তচর, যারা নদীর তীর থেকে আরম্ভ করে পর্বতের গুহা, সব একেবারে চষে ফেলবে। কর্ণের মত যে দুর্যোধনের যুবগোষ্ঠী সম্পূর্ণ মেনে নেবে, তাতে কোনও সন্দেহই নেই। কিন্তু ভীষ্ম দ্রোণেরা পাণ্ডবদের ফিরিয়ে আনার পক্ষেই রায় দিলেন। কিন্তু এরই মধ্যে নতুন একটা ঘটনা ঘটল।
দুর্যোধনের চরেরা পাণ্ডবদের খবর দেবার সঙ্গে সঙ্গে ‘সুখবর’ মনে করে আরও একটা খবর দিয়েছিল। তারা বলেছিল বিরাটরাজার প্রবল পরাক্রান্ত সেনাপতি কীচক কোনও এক গন্ধর্বর হাতে মারা গেছে। এই কীচক যেহেতু দুর্যোধনের বন্ধুরাজ্য ত্রিগর্তদেশের রাজাকে বারবার যুদ্ধে নাকাল করেছে, তাই কীচক মারা যেতে বিরাটরাজার ওপর প্রতিশোধ নেওয়াটা এখন সুবিধেজনক। কাজেই ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ যখন পাণ্ডবদের প্রত্যাবর্তনের তর্কে নানা মতামত ব্যক্ত করছেন, তখন ত্রিগর্তের রাজা স্বয়ং সে-কথাগুলি চাপা দিয়ে বিরাটরাজ্য আক্রমণের প্রস্তাব দিলেন। কীচকহীন অসহায় বিরাটরাজাকে আক্রমণ করে কী পরিমাণ ধন-রত্ন, অশ্ব-গজ, গোধন পাওয়া যেতে পারে, সেই সম্ভাবনার কথাই ত্রিগর্তরাজ তুলে ধরলেন। মতামত চাইলেন দুর্যোধন প্রভৃতি ভাইদের এবং কর্ণের— কৌরবানাঞ্চ সর্বেষাং কর্ণস্য চ মহাত্মনঃ। প্রস্তাবের অনুকূলেও যিনি প্রথম কথা বললেন, তিনি কর্ণ। নতুন এক যুদ্ধোদ্যোগের হঠাৎ সুযোগ আসায় কর্ণ পাণ্ডবদের বিষয়ে তাঁর দৃঢ় মত পালটালেন। বললেন — সেই ভাল, বিরাটরাজ্য আক্রমণ করে ভালমন্দ ধনরত্ন আহরণ করাই ভাল। পাণ্ডবদের কথা পরে ভাবা যাবে, অথবা এখন অর্থহীন, বলহীন, সহায়হীন পাণ্ডবদের কথা ভেবেই বা আমাদের কী হবে— কিঞ্চ নঃ পাণ্ডবৈঃ কার্যং হীনার্থবলপৌরুষৈঃ।
কর্ণের কথা শোনা মাত্রই দুর্যোধন বিরাটরাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রার আদেশ দিলেন— বৈকৰ্ত্তনস্য কর্ণস্য… বাক্যম্ আদায় তস্য তৎ। কর্ণ জানতেন, এটা পাণ্ডবদের ব্যাপার নয় বলেই অন্তত বিরাটরাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রায় ভীষ্ম-দ্রোণ প্রভৃতি বৃদ্ধদের অমত হবে না এবং সেইজন্যই এই বিষয়ে তিনি তাঁদের মত চেয়েছেন। একটা গোটা রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হবে— সেই সিদ্ধান্তটা কিন্তু শুধুমাত্র কর্ণের সমর্থনবাক্যেই ‘পাস’ হয়ে গেল। ত্রিগর্তরাজ প্রথমে বিরাটরাজ্য আক্রমণ করলেন কিন্তু সে যুদ্ধে ছদ্মবেশী পঞ্চপাণ্ডব এমন যুদ্ধ করলেন যে তাঁর যুদ্ধবাসনা ঘুচে গেল। কিন্তু তিনি যেতে না যেতেই কৌরবেরা সবাই মিলে আক্রমণ করলেন বিরাটরাজ্য। বিরাটের প্রায় অজ্ঞাতেই কুমার উত্তরের সঙ্গে রণক্ষেত্রে চলে গেলেন বৃহন্নলাবেশী অর্জুন। অর্জুনকে স্পষ্ট চিনে স্বয়ং দ্রোণাচার্য কৌরবদের উন্মাদনায় ঠান্ডা জল ঢেলে দিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে নানা দুর্লক্ষণ দেখে আজ তিনি অর্জুনের হাতে হার একেবারে অবধারিত মনে করলেন।
কিন্তু এইখানে একটা কথা বলে নেওয়া দরকার। কুরু-পিতামহ ভীষ্ম, আচার্য দ্রোণ, কৃপ— এইসব বৃদ্ধদের সম্বন্ধে সকলের সামনেই অনেক অপমানজনক কটূক্তি করেছেন কর্ণ। বারংবার অপমানে এই বৃদ্ধেরা যেমন একদিকে নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে যাচ্ছিলেন, অন্যদিকে কর্ণের সম্বন্ধে তাঁদের অসন্তোষও বাড়ছিল। কর্ণ মনে করেন, এই বৃদ্ধেরা আসলে পাণ্ডবদের পক্ষপাতী। ধৃতরাষ্ট্রের অন্ন খাওয়া সত্ত্বেও এঁরা যে তাঁর গুণমুগ্ধ হয়ে দুর্যোধনের সকল ক্রিয়াকলাপ নির্বিচারে প্রশংসা করেন না— এটা তাঁর মনে লাগে। নিরপেক্ষ বিচার, নীতি, যুক্তি— এগুলিও যে কখনও কাউকে পাণ্ডবদের পক্ষপাতী করে তুলতে পারে— এটা কর্ণের মাথায় আসে না। ফলে কর্ণ বারংবার বৃদ্ধদের অপমান করেছেন এবং খোদ কুরুসভাতেই এই ঘটনা বারবার হওয়ায় কুরুবৃদ্ধদের অসন্তোষ এখন প্রগাঢ় হয়েছে। কর্ণের কবচ-কুণ্ডল খোয়া যাবার পর থেকে এখন আর সে অসন্তোষ তাঁরা চেপেও রাখেন না। তাঁরা ভাবেন— কর্ণের প্রতিপত্তি দিন দিনই বেড়ে চলেছে স্বয়ং দুর্যোধনের আস্কারায়। তাঁদের যখন এমনিও সম্মান নেই, অমনিও নয়, তখন তাঁরাই বা সুযোগ পেলে এই পুরুষটিকে ছেড়ে দেবেন কেন? বিরাটরাজ্যের প্রত্যন্ত প্রদেশে উন্মুক্ত মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে গুরু দ্রোণ যখন মহাদেবের বর-পাওয়া, স্বর্গ-ফেরত অর্জুন সম্বন্ধে তাঁর আপন শঙ্কার কথা ব্যক্ত করলেন, তখন আবারও একবার অপমানের ভাষা বেরিয়ে এল কর্ণের মুখ থেকে। কর্ণ বললেন— অর্জুনের ওপর আপনার এত সোহাগ যে, সব সময় আমাদের খাটো করে দেখেন— সদা ভবান্ ফাল্গুনস্য গুণৈরম্যান্ বিকত্থসে। আরে! আমার সামনে কিংবা দুর্যোধনের সামনে অর্জুন পুরোপুরি দাঁড়াতেই পারবে না।
দুর্যোধন কিন্তু এইসব শৌর্যবীর্যের তুলনায় না গিয়ে কর্ণের কথায় ধুয়া ধরে বললেন— দেখো বাপু! এ যদি অর্জুন হয়, তা হলে আমার পোয়া বারো। অজ্ঞাতবাসের সময় শেষ হয়নি। আবার বনে পাঠাব পাণ্ডবদের। আচার্য দ্রোণকে উদ্দেশ করে ভীষ্ম, কৃপ সবাইকে শুনিয়ে দুর্যোধন বললেন— আচার্য! আমি আর কর্ণ আগে বার বার বলেছি— ময়া কর্ণেন চাসকৃৎ— যে, অজ্ঞাতবাসের সময় পাণ্ডবদের খোঁজ পেলে তাদের আবার বনে যেতে হবে। তা ছাড়া এই সময়ে যুদ্ধ করতে যেই আসুন, বিরাটরাজা, কি অর্জুন, যুদ্ধ তো আমাদের করতেই হবে। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, বিকর্ণ, এঁদের এত ত্রস্ত দেখাচ্ছে কেন? আপনারা খেয়াল রাখবেন যুদ্ধ ছাড়া দ্বিতীয় কোনও রাস্তা নেই আমাদের। দুর্যোধনের এইটুকু আস্কারাতেই কর্ণ সরাসরি দ্রোণকে উপহাস করতে আরম্ভ করলেন। বললেন— বন্ধু! ওই আচার্য দ্রোণকে বাদ দিয়ে যুদ্ধের নীতি-নিয়ম ঠিক করো। তুমি এঁদের মত জানো। এঁদের সবারই অর্জুনের ওপর বড় বেশি সোহাগ, আর সেইজন্যেই আমাদের তখন থেকে ভয় দেখাচ্ছেন— জানাতি হি মতং তেষামতস্ত্রাসয়তীহ নঃ। কীরকম সোহাগ যে, অর্জুন সামনে আসতে না আসতেই তার প্রশংসা আরম্ভ হয়ে গেল। যেখানে শত্রুপক্ষের ঘোড়ার চিঁহি চিঁহি ডাক শুনেই— হ্রেষিতং হ্যুপশৃণ্বানে— আচার্য গুরুর সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমাদের সৈন্যদের মনোবল না ভেঙে যায়, সেই ব্যবস্থাটা আগে করো, দুর্যোধন!
কর্ণের বক্রোক্তিতে মনে হল— দ্রোণাচার্য যেন সাধারণ সৈনিকের চেয়েও খারাপ। তাঁর যে উপযুক্ত শিয্যের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা থাকতে পারে, এটা তিনি বোঝেন না। কর্ণ সোজাসুজি দ্রোণকে অভিযুক্ত করে বললেন— এঁরা সবাই, বিশেষত এই আচার্য দ্রোণ, চিরটাকাল পাণ্ডবদের হয়ে গান গেয়ে গেলেন। এঁদের আপন পর বুঝ বলতে কিচ্ছুটি নেই, নইলে ঘোড়ার ডাক শুনে কেউ শত্রুর প্রশংসায় মেতে ওঠে! আরে, এই যে সব দুর্লক্ষণ দেখা যাচ্ছে বলে দ্রোণ মন্তব্য করছেন, এর সঙ্গে অর্জুনের সম্পর্ক কী, তাকে প্রশংসা করারই বা কী আছে? আসল কথা এই— যে সব দুর্লক্ষণ-ফুর্লক্ষণের কথা তখন থেকে বলে যাচ্ছেন দ্রোণ, এর মূলে আছে ওদের ওপর সোহাগ, আর আমাদের ওপর জন্মের রাগ— অন্যত্র কামাদ্ দ্বেষাদ্ বা রোষাদ্ বাস্মাসু কেবলম্। এই মুহূর্তে দ্রোণের ওপর কর্ণের এত রাগ হয়েছে যে, তিনি চিবিয়ে চিবিয়ে দ্রোণকে কথা শোনালেন, যদিও তাঁর সামনে আছেন দুর্যোধন। কর্ণ বললেন— দুর্যোধন! এই আচার্যদের বড় মায়ার শরীর (ভাবটা এই— ব্যাটা যুদ্ধ-ফুদ্ধ কিস্সু বোঝে না— যুদ্ধধর্মানভিজ্ঞত্বমুক্তম্), এঁদের হিংসাবৃত্তি বলতে কিচ্ছুটি নেই। কাজেই তোমার সামনে যখন ভয় এসে উপস্থিত হবে, তখন অন্তত এই সমস্ত প্রাজ্ঞ-পণ্ডিতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে যুদ্ধনীতি ঠিক কোরো না— নৈতে মহাভয়ে প্রাপ্তে সংপ্রষ্টব্যঃ কদাচন।
কর্ণ এবার ঘুরিয়ে দ্রোণাচার্যকে গালাগালিই দিতে আরম্ভ করলেন। তাঁর মতে দ্রোণের মতো লোকের যুদ্ধক্ষেত্রে কথা বলাই শোভা পায় না। জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ হওয়ার দরুন দ্রোণাচার্যকে এবার সেইসব কথা শুনতে হল, যা তাঁকে এ পর্যন্ত কেউ বলেনি। কর্ণ বললেন— দুর্যোধন! এসব লোকের পণ্ডিতি কথা কোথায় মানায় জানো? বড় বড় লোকের বড় বড় বাড়িতে, যেখানে অলসে আড্ডা চলছে দিন-রাত। সভাস্থলে, যেখানে বড় বড় কূট তর্ক হচ্ছে, নিদেনপক্ষে ধনীদের বাগানবাড়িতে, যেখানে রসের আলোচনা চলছে, সেখানে এই দ্রোণের মতো পণ্ডিত লোকেরা কথা বললে মানায়— কথা বিচিত্রাঃ কুর্বাণাঃ পণ্ডিতাস্ত্ৰত্র শোভনাঃ। অথবা জনসমাজে যদি অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ দেখাতে হয়, এই বামুনগুলোকে মানায় সেখানে। যজ্ঞ, অস্ত্রশিক্ষা, সন্ধি করার নিপুণতা— এসব ব্যাপারে এই বামুন-পণ্ডিতেরা খুব উপযুক্ত। তা ছাড়া পরের দোষ বার করতে দাও, মনুষ্য চরিত্রে কোথায় স্খলন ঘটল, সেটা বার করতে দাও, কোন বামুন কার বাড়িতে ভাত খেয়ে নিজের অন্নদোষ ঘটাল, সেটা বার করতে দাও— এই সব পণ্ডিত খুব পারবে— পরেষাং বিবরজ্ঞানে মনুষ্যচরিতেষু চ। অন্নসংস্কারদোষেষু পণ্ডিতাস্তত্র শোভনাঃ।
কর্ণের শেষ প্রস্তাব ছিল দ্রোণের মতো লোককে সোজা উপেক্ষা করে— পণ্ডিতান্ পৃষ্ঠতঃ কৃত্বা— নিজের মত চাপানো। ব্যাপারটা পুরানো। কর্ণ দুর্যোধনের মনস্তত্ত্ব বোঝেন। যে দ্রোণাচার্য আপন সরসতায় অর্জুনের প্রশংসা করে ফেলেছেন, তাঁকে এই মুহূর্তে গালাগালি দিয়ে নিজের মত, সে মত যত উদ্ধতই হোক, চাপিয়ে দিতে যে কর্ণের অসুবিধে হবে না, সে তিনি ভালই জানেন এবং জানেন বলেই কর্ণ নিজের মতটা কী সুকৌশলে উপস্থাপন করলেন দেখুন। কর্ণ বললেন— আরে! আমাদের সেনারা সব ভিতুর মতো দাঁড়িয়ে আছে কেন— ভীতান্ সন্দ্ৰস্তান্ ইব লক্ষয়ে। আরে অর্জুনই আসুক আর বিরাটই আসুক— সমুদ্রের ঢেউ এসে যেমন তীরভূমিতে আটকে যায়— তারাও তেমনি আমার সামনে এসে থমকে দাঁড়াবে; আমি একা তাদের সামাল দেব— অহম্ আবারয়িষ্যামি বেলেব মকরালয়ম্। সাপের বিষ যেমন ব্যর্থ হয় না, আমার বাণও তেমনি ব্যর্থ হবার নয়, সব সুতীক্ষ্ণ শরগুলি একেবারে ঘিরে ধরবে অর্জুনকে। এই তোরো বচ্ছর ধরে অর্জুন নিশ্চয়ই অপেক্ষা করে আছে। আমাকে সে মারবারও চেষ্টা করবে প্রচুর। শুনেছি বটে যে, তিনি তিন ভুবনের সেরা বীর, কিন্তু আমিও তো কিছু কম যাই না— অহঞ্চাপি নরশ্রেষ্ঠাদ্ অর্জুনান্নাবরঃ ক্বচিৎ। এদিক ওদিক থেকে আমার বাণ যখন অজস্রধারায় চলবে, আর শকুনের পাখার মতো শন শন শব্দ হবে, তখন অর্জুনের বোধ হবে যেন আকাশ ভরে গেছে জোনাকের আলোতে। আরে যুদ্ধে আমার সামনে দাঁড়াবে এমন পুরুষ এখনও স্বর্গে-মর্ত্যে পয়দা হয়নি। আজকে আমি অর্জুনকে মেরে দুর্যোধনকে যে কথা দিয়েছিলাম, সেই কথা রাখব এবং ঋণমুক্ত হব।
দুর্যোধনের প্রতি বশ্যতায় কর্ণ এখন নিজেকে এত বড় ভাবছেন যে, অর্জুনের মতো মহাবীরকে তিনি ভাবছেন গরুড়ের কাছে সাপের মতো, প্রবল বারিবর্ষণের মুখে জ্বলন্ত অগ্নির মতো। নিজের বুক বাজিয়ে কর্ণ বলছেন— আমি সেই পরশুরামের শিষ্য। তাঁর শিক্ষা, আর আমার ক্ষমতা— এই দুটোর জোরে আমি অর্জুন কেন, অর্জুনের বাবাকেও ঠাণ্ডা করে দিতে পারি— যুধ্যেয়মপি বাসবম্। অর্জুনের কপিধ্বজ রথের মাথায়-বসা কপিটি আজকে কাঁদতে কাঁদতে কাটা পড়বে, অর্জুনকে আজ আমি রথ থেকে মাটিতে ফেলে ছাড়ব— বীভৎসুং পাতয়ন্ রথাৎ। কৌরবেরা দেখুক আজকে, কেমন করে সেই অর্জুন তার ভাঙা রথ থেকে নেমে অকর্মণ্য দাম্ভিকের অক্ষম চেষ্টায় শুধু আহত সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে— নিঃশ্বসন্তং যথা নাগমদ্য পশ্যন্তু কৌরবাঃ।
কর্ণ যা বললেন এতক্ষণ, তা নিজেদের সৈন্যদলের মনোবল উত্তেজিত করতে যতখানি, তার চেয়ে অনেক বেশি আপন অহমিকা প্রকাশ করতে; বিশেষত অর্জুন যেখানে প্রতিপক্ষ, সেখানে এইরকম একটা কাল্পনিক মাহাত্মে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে কর্ণের ভাল লাগে। কিন্তু তাঁর এই উত্তেজনা বা অহমিকা অন্যেরা কতদিন সহ্য করবেন? আগেই বলেছি, সেই পাশাখেলার আসর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ক্রমাগত অপমানিত হতে হতে এখন আর বৃদ্ধেরা কর্ণের সব কথাবার্তা চুপ করে মেনে নিতে পারছেন না। অতএব কর্ণের এই মৌখিক আড়ম্বরের উত্তরে কৃপাচার্য আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। বস্তুত কৃপাচার্যের কথাই ছিল কর্ণের বিরুদ্ধে বৃদ্ধদের প্রথম সংহত প্রতিবাদ। কৃপ বললেন— এই যে রাধামায়ের ছেলে কর্ণ! কূটযুদ্ধে তোমার যে খুব বুদ্ধি খেলে সে আমরা বেশ বুঝি। (কৃপ কপট পাশা খেলার দিকে ইঙ্গিত করলেন)। তবে এই ক্রূর যুদ্ধের মূলও তুমি বোঝ না, পরিণামও বোঝ না। তোমার শকুনি মামারা শাস্ত্রমতে যেসব কপট যুদ্ধ করেন, সে কপটতা আরও অনেক কিসিমে করা যায়; তবে কী জানো, ভদ্রলোকেরা ওই ধরনের যুদ্ধকে বড়ই জঘন্য মনে করেন। কোথায় যুদ্ধ করছি, তা বুঝলাম না, কোন সময়ে যুদ্ধ করছি, তা বুঝলাম না, যুদ্ধ করলেই হল? দেশ-কাল বুঝে যুদ্ধ করলেই তবে না জয় আসে, নইলে উলটো ফল হবে যে! ব্যাপারটা কী জানে কর্ণ! যুদ্ধের জন্য যে রথ বানায়, সে যোদ্ধাপুরুষকে অতিশয়োক্তি করে বলে যে, এই রথে চড়ে যুদ্ধ করলে আপনি দেবতাদেরও ঠাণ্ডা করে দিতে পারবেন, কিন্তু রথকারের অতিশয়োক্তির ওপর নির্ভর করে তো আর বুদ্ধিমান লোকেরা কাজ করে না, তেমনি তোমার ওই বড় বড় আত্মম্ভরি ‘হ্যান্ করেঙ্গা ত্যান্ করেঙ্গা’র ওপর আস্থা রেখে, দেশ-কাল এবং আপন বলাবল কিছুই না বুঝে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে নেমে পড়ব, এটা হয় না।
কৃপ কর্ণের আত্মম্ভরি বক্তৃতা অনেকক্ষণ শুনেছেন। এবার তাই তিনি একটা তুলনা-প্রতিতুলনার জায়গায় এসে বলতে থাকলেন— দেখো কর্ণ! তুমি বেশি সাহস দেখিয়ো না— কর্ণ মা সাহসং কৃথাঃ। একটু চিন্তা করে দেখলেই বুঝতে পারবে যে, আমরা গুষ্টিশুদ্ধু একা অর্জুনের সঙ্গে নাও এঁটে উঠতে পারি— পরিচিন্ত্য তু পার্থেন সন্নিপাতো ন নঃ ক্ষমঃ। অর্জুন একসময় একাই সমগ্র কুরুদেশ রক্ষা করেছে, একাই খাণ্ডব বন পুড়িয়েছে, একাই সুভদ্রাকে হরণ করে কৃষ্ণকে পর্যন্ত দ্বৈরথে আহ্বান জানিয়েছে এবং একাই তুষ্ট করেছে। কিরাতরূপী মহাদেবকে। তারপরেও একটু ভেবে দেখো। অর্জুন একাই সম্পূর্ণ জয়দ্রথের বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে অপহৃতা দ্রৌপদীকে ফিরিয়ে এনেছে। বেশি দূরে নয়, এই বনেই। সমগ্র উত্তর দিকটা অর্জুন একাই দিগ্বিজয়ে জিতে এসেছিল। কৃপাচার্য এই কথাটা বলেই ভাবলেন কর্ণ হয়তো এবারে উত্তর দিতে পারেন যে, দিগ্বিজয় তো তিনিও করেছেন। তাই কৃপাচার্য এবার কর্ণকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলতে লাগলেন— কর্ণ! গন্ধর্ব চিত্রসেনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে তুমি পালিয়ে বেঁচেছিলে, সেই চিত্রসেনের সঙ্গে অর্জুন কিন্তু একাই লড়ে গেছেন। তাঁর সেনাবাহিনীকেও অর্জুন একাই পর্যুদস্ত করেছিলেন অথচ সেই সেনাবাহিনীই তোমার রথ ভেঙে, ঘোড়া মেরে তোমাকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেক দূরে তাড়িয়ে ছেড়েছিল।
কৃপাচার্য এবার কর্ণের দিকে প্রতিতুলনার আঙুল তুলে বললেন— তুমি কি বলতে পারো, কর্ণ, কোন কাজটা তুমি এমন একা একাই করেছ— একেন হি ত্বয়া কর্ণ কিন্নামেহ কৃতং পুরা। একা একা যুদ্ধ করব! এমন আশা কোরো না। এ যেন হাতের আঙুল দিয়ে ক্রুদ্ধ সাপের বিষদাঁতে আক্রমণ করা। পাণ্ডবদের অপমান আর ক্রোধের ঘি মাখা রয়েছে তোমার শরীরে, কাজেই তোমার পক্ষে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করা মানে— গায়ে চপচপে করে ঘি মেখে, সূক্ষ্ম কাপড় পরে অর্জুন নামে সেই জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলা। তুমি আর বেশি সাহস দেখিয়ো না, গলায় পাথর বেঁধে হাত দিয়ে সাঁতার কেটে অর্জুন-সমুদ্র পার হবার চেষ্টা কোরো না। আমাদের দ্বারা এই তেরো বচ্ছর অপমানিত হয়ে অর্জুন এখন বাঁধন-ছাড়া সিংহের মতো ফুঁসছে, সে আমাদের অবশেষ রাখবে না। তাই বলি কি, তুমি আর অর্জুনের সঙ্গে একা একা যুদ্ধ করার সাহস দেখিয়ো না। আমরা সবাই মিলে যুদ্ধ করব, দ্রোণ, ভীষ্ম, অশ্বত্থামা, দুর্যোধন, তুমি, আমি— সবাই মিলে সেই যুদ্ধশূর অর্জুনের সঙ্গে লড়াই করি— সহ যুধ্যামহে পার্থম্। তুমি যে বলেছিলে— কৌরবেরা সব গোধন নিয়ে চলে যাক, আর আমার একার যুদ্ধ দেখুক কৌরবেরা— যুদ্ধং পশ্যত মামকম্ ওই বড়াইটা আর না করলে, বেশি সাহস দেখিয়ো না— কর্ণ মা সাহসং কৃথাঃ।
দ্রোণের ছেলে অশ্বত্থামা কৃপের কথাও শুনেছেন, কর্ণের কথাও শুনেছেন। এই অশ্বত্থামাকে আগে আমরা দুর্যোধনের যুবগোষ্ঠীতে কর্ণ, দুঃশাসনের সঙ্গে অনেকবার নানা আলোচনায় অংশ নিতে দেখেছি। কিন্তু পাশাখেলায় পাণ্ডবদের সস্ত্রীক চরম অপমানের পর অশ্বত্থামা বোধহয় দুর্যোধন এবং কর্ণের সব যুক্তি মেনে নিতে পারছিলেন না। বিশেষ করে তাঁর বাবা দ্রোণাচার্য কর্ণের কাছে বারবার যেভাবে অপমানিত হচ্ছিলেন, তাতে মাঝে মাঝেই অশ্বত্থামার ধৈৰ্য্যচ্যুতি ঘটছিল। অশ্বত্থামা নিজে বড় মাপের বীর, কর্ণও তাই। কিন্তু যে কর্ণ তাঁর পিতাকে অপমান করছেন বারংবার, যে কর্ণ সর্বজনবন্দিত আচার্যগুরুকে অভিযুক্ত করছেন নিমকহারামির দায়ে, তাঁর সঙ্গে অশ্বত্থামা থাকেন কী করে? তিনি তাই কর্ণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন। অশ্বত্থামা বললেন— তোমার লজ্জা জিনিসটা বড় কম, কর্ণ! যুদ্ধবীরেরা অনেক যুদ্ধ জিতেও পরের ধন নিজের নগরে নিয়ে গিয়েও এত বকবক করে না, আর এখানে তো তুমি এখনও বিরাটরাজার গরুগুলিও জিতে আননি, তাঁর রাজ্যের সীমাও পেরোওনি, হস্তিনাপুরেও এখনও ফিরে যাওনি, অথচ কী হামবড়াইটাই না তখন থেকে করে যাচ্ছ! দেখো, আগুন মেলা বকবক না করেও শরীর পুড়িয়ে দেয়, সূর্যদেব বিনা বাক্যেই তাপ দান করেন। এঁরা যখন বিনা কথায়, নিশ্চুপে এত বড় বড় কাজ করে ফেলতে পারছেন, সেখানে তুমি কিন্তু বকেই যাচ্ছ, অথচ তুমি এখনও কিছুই করনি। বীর পুরুষেরা ন্যায় অনুসারে, সারা পৃথিবী জয় করে এসে গুণহীন গুরুকেও সৎকার করার চেষ্টা করে, আর তোমরা অন্যায় পাশাখেলায় পাণ্ডবদের জয় করেছ, তাতেও হয়নি, এখন আবার গুরুকেও নিন্দা করছ। পাশাখেলার বাজিতে রাজ্যসম্পদ জয় করে কোনও ভদ্র ক্ষত্রিয় কি সন্তুষ্ট থাকতে পারে? আর তেমনি হয়েছে এই নচ্ছার নির্লজ্জ ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেগুলো, যারা নাকি ব্যাধের মতো শঠতায় শুধু ফাঁদ পাতার জন্য বসে আছে— নিকৃত্যা বঞ্চনাযোগৈশ্চরন্ বৈতংসিকো যথা।
পিতৃনিন্দায় অশ্বত্থামা এতই রেগে গেছেন যে, মাতুল কৃপাচার্যের কথার সূত্র ধরে তিনি কর্ণকে ‘চ্যালেঞ্জ’ জানিয়ে বললেন— একটা, মাত্র একটা যুদ্ধের কথা বলো তো, যেখানে অর্জুনকে তুমি একা জয় করেছ— কতমদ্ দ্বৈরথং যুদ্ধং যত্রাজৈষীদ্ ধনঞ্জয়ম্। ওই নকুল, সহদেব— যাদের তুমি একরত্তি পোঁছ না, সেই তাদেরই বা তুমি কী করতে পেরেছ, কী করতে পেরেছ ভীমকে, কি যুধিষ্ঠিরকে? খুব তো দিগ্বিজয় করেছ বলে বড়াই করে বেড়াও, বলতে পারবে, অর্জুনেরা থাকতে কবে তুমি যুদ্ধ করে তাঁদের রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থ জয় করেছ— ইন্দ্রপ্রস্থং ত্বয়া কস্মিন্ সংগ্রামে বিজিতং পুরা? এই যে পঞ্চস্বামীর সোহাগিনী কৃষ্ণা, তাঁকেও কোনওদিন ক্ষাত্রবীর্যে যুদ্ধজয় করে জিতে আনতে পেরেছ? স্বয়ম্বর সভার পর যে যুদ্ধ হয়েছিল, তাতেও জেতনি, অন্য কোনও যুদ্ধও জেতনি। মাঝখান থেকে কুলবধূকে রজস্বলা অবস্থায় এক কাপড়ে রাজসভায় টেনে এনে ন্যায়-ধর্মের মূলটাই দিয়েছ উপড়ে। বেটা সারথির জাত! বদমাশ— দুষ্টকর্মন্— তুই কি ভেবেছিস দ্রৌপদীর সঙ্গে ওই জঘন্য ব্যবহারের পরেও অর্জুন তোকে ছেড়ে দেবে? তুই যে পণ্ডিতের মতো বড় বড় বাত দিয়ে যাচ্ছিস— ত্বং পুনঃ পণ্ডিতো ভূত্বা বাচং বক্তুমিহেচ্ছসি— তোর সঙ্গে কি অর্জুনের তুলনা? দেবতা, মানুষ, গন্ধর্ব— এমন কেউ নেই যাকে অর্জুন ডরায়। দ্রোণ, কৃপ যে এতক্ষণ অর্জুনের প্রশংসা করেছেন, ঠিক করেছেন। সে তোর থেকে অনেক বড় যোদ্ধা— ত্বত্তো বিশিষ্টো বীর্যেণ। সত্যি কথা বলতে কি, অর্জুনের মতো এত বড় যোদ্ধা আর কে আছে— কোহর্জুনেন সমঃ পুমান্?’
অশ্বত্থামা যে কর্ণকে এতটা গালাগাল করলেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়েও অর্জুনের এত প্রশংসা করলেন, এর কারণ আছে কতগুলো। অশ্বত্থামা জানতেন, তাঁর পিতা দ্রোণাচার্য পুত্রের পরেই কিংবা পুত্ৰাধিক যাকে স্নেহ করেন, তিনি হচ্ছেন ওই তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন। অশ্বত্থামা সেটা বলেও ফেললেন। বললেন এইজন্যে যে, দ্রোণ যা কিছুই আগে বলে থাকুন সেটা প্রিয়ত্বের সম্বন্ধে বলেছেন, যুদ্ধের ভয়ে নয়। বস্তুত দ্রোণ, কৃপ এঁরা অনেক আগে থেকেই পাণ্ডবদের ওপর অন্যায় অত্যাচারে দুর্যোধনের পক্ষ থেকে মানসিকভাবে সরে এসেছিলেন। আজকে যে দুর্যোধনের গোষ্ঠীরই একজন, সেই গোষ্ঠীরই অন্যতম আরেকজনকে প্রকাশ্যে আক্রমণ করলেন, তাঁর কারণ অশ্বত্থামাও কোনওভাবেই পাণ্ডবদের গ্লানি আর সহ্য করতে পারছিলেন না এবং ওই গ্লানির অন্যতম হাতিয়ার যে কর্ণ, এটাও তাঁর বুঝতে দেরি হয়নি। অশ্বত্থামার পক্ষে নিরপেক্ষ ভূমিকায় কর্ণকে গালাগাল দেওয়ার কোনও অসুবিধেও নেই, তার কারণ তিনি কৌরবকুলের কেউ নন, আবার কর্ণের মতো কৌরবকুল আশ্রয় করে আত্মোন্নতির প্রয়োজনও তাঁর নেই। তাই অতি কুটিল পরিহাসে, দ্যূতসভার অসভ্যতা স্মরণ করিয়ে দিয়ে অশ্বত্থামা কর্ণকে বললেন— যেমন করে পাশা খেলা করেছিলে, যে বুদ্ধিতে পাণ্ডবদের ইন্দ্রপ্রস্থ চুরি করেছিলে, যে অভব্যতায় দ্রৌপদীকে রাজসভায় নিয়ে এসেছিলে, কর্ণ! সেই কায়দায় অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করে দেখো না, কী হয়? কর্ণ! তোমার ক্ষাত্রধর্মের গুরু হল তোমার মামা শকুনি, সেই ‘গ্র্যান্ড মাস্টার’কে এখন যুদ্ধ করতে বলো— দুর্দ্যূতদেবী গান্ধারঃ শকুনির্যুধ্যতামিহ। তবে মনে রেখ, অর্জুনের গাণ্ডীব ধনু থেকে ‘কচে বারো, ছয়, চার’— পাশার দান পড়ে না, সেখান থেকে ক্ষুরধার বাণের ধারাপাত ঝরে পড়ে। তুমি কুরুরাজের রাজসভায় শকুনির সাহায্যে যে খেলা খেলেছিলে, এখনও সেই শকুনির দ্বারা সুরক্ষিত হয়ে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ কর। তবে মনে রেখ, এই যুদ্ধে তোমার মতো অন্য যোদ্ধারা যত ইচ্ছে যুদ্ধ করতে যাক, আমি অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করব না, সেটা বলে দিচ্ছি— যুধ্যন্তাং কামতো যোধা নাহং যোৎস্যে ধনঞ্জয়ম্।
কর্ণের বিরুদ্ধে অশ্বত্থামার এই প্রতিবাদও অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ভয়ে নয়, প্রতিবাদের জন্যই প্রতিবাদ। বৃদ্ধদের প্রতি কর্ণের অবমাননাকর মন্তব্যের বিরুদ্ধে শুভ যুবচেতনার প্রতিবাদ। শক্তিধর, আত্মপরায়ণ পরগাছার বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ জনের প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদে ভাঙনের ভয় ছিল, কুরুকুলের চিরন্তন হিতৈষীদের মধ্যে ভাঙনের ভয় ছিল এবং সে ভয় এসেছিল কর্ণের অন্যায় আস্ফালনের দ্বারা। স্বয়ং পিতামহ ভীষ্মকে এইজন্যে সাময়িকভাবে অশ্বত্থামার ক্রোধমুক্তির জন্য চিন্তা করতে হয়েছে, তাঁকে সাময়িকভাবে নামতে হয়েছে কর্ণকে ‘জাস্টিফাই’ করার জন্য। মধ্যপন্থী হয়ে ভীষ্মকে বলতে হয়েছে— কর্ণ যা বলেছে, তা হয়তো সকলের মনোবল বাড়ানোর জন্য বলেছে। কিন্তু সেই সূত্রে দ্রোণের বিরুদ্ধে যে সব কথা এসেছে, সে জন্য আচার্য তাঁকে ক্ষমা করুন, কৃপাচার্যও ক্ষমা করুন, ক্ষমা করুন আচার্যপুত্র অশ্বত্থামা— কারণ অর্জুন সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেছে, এখন নিজেদের মধ্যে বিরোধের সময় নয়— নায়ং কালো বিরোধস্য কৌন্তেয়ে সমুপস্থিতে। ভীষ্ম অশ্বত্থামাকে সানুবন্ধে নিজেদের মধ্যে ভাঙন বাঁচিয়ে চলার কথা বলেছেন। বৃদ্ধ হয়েও যুবক অশ্বত্থামাকে তিনি হাত জোড় করে বলেছেন— আচার্যপুত্র! ক্ষমা করুন, এখন নিজেদের মধ্যে বিরোধের সময় নয়— আচার্যপুত্র ক্ষমতাং নায়ং কালঃ স্বভেদনে।
ভীষ্মের কথার সূত্র ধরে দুর্যোধন এতক্ষণে বুঝে গেছেন যে, অশ্বত্থামার এই রাগ যতখানি নিজের কারণে, তার চেয়ে অনেক বেশি দ্রোণের কারণে। কাজেই সময় বুঝে ভীষ্ম, কৃপ, দুর্যোধন এবং সবার ওপরে কর্ণ— সবাই মিলে আচার্য দ্রোণকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন— সহ কর্ণেণ ভীষ্মেণ কৃপেণ চ মহাত্মানা। অবস্থার গতিকে কর্ণ কিছু অপ্রস্তুত হলেন বটে কিন্তু বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ সহজেই ক্ষমাপ্রবণ, অতএব যুদ্ধের তোড়জোড় আরম্ভ হল। যুদ্ধের ‘স্ট্রাটিজি’ ঠিক করার ভার ছিল ভীষ্মের ওপরে। কর্ণকে বাঁচানোর জন্য দ্রোণ-কৃপের সামনে কিঞ্চিৎ ওজর দেবার চেষ্টা করেও ভীষ্ম কিন্তু এমন একটি প্যাঁচ কষলেন যাতে কর্ণকেই বেশিরভাগ অর্জুনের মুখোমুখি হতে হয়। ভীষ্ম বললেন— দ্রোণ থাকুন সেনাবাহিনীর মধ্যভাগে, অশ্বত্থামা বাঁদিকে আর কৃপ ডান দিকে। সামনে থাকুন কর্ণ, আর আমি সবার শেষে থেকে চারিদিক রক্ষা করব। ভীষ্মের কথামতো দুর্যোধন বিরাটরাজার গোধন হরণ করে পালাচ্ছিলেন। স্বাভাবিকভাবে অর্জুন প্রথমে দুর্যোধনের পিছু নিলে সমস্ত কৌরববাহিনী একযোগে এসে পড়লেন অর্জুনের সামনে। প্রথমে কয়েকজন মধ্যমান বীরের মান হরণ করার পরেই অর্জুনের সঙ্গে কর্ণের যুদ্ধ আরম্ভ হল। কর্ণ প্রথমে যেভাবে যুদ্ধ আরম্ভ করেছিলেন এবং অর্জুনের রথ আর তাঁর সারথি উত্তরের যে অবস্থা করেছিলেন, তাতে অর্জুনকে অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে যুদ্ধ করতে হচ্ছিল। কর্ণ এবং অর্জুন দু’জনেই এমন সমানে সমানে যুদ্ধ করছিলেন যে, মহাভারতের কবিকে প্রশংসা করে বলতে হয়েছে— কেউ কম যান না। সমস্ত ধনুর্ধরদের মধ্যে ইনিও উত্তম, উনিও উত্তম। দু’জনেই মহাবল, দুইজনেই সমস্ত শত্রুর পক্ষে বিপজ্জনক— তাবুত্তমৌ সর্বধনুর্ধরাণাং মহাবলৌ সর্বসপত্নসাহৌ। কৌরবেরা সবাই মিলে কর্ণ এবং অর্জুনের এই আশ্চর্য যুদ্ধ দেখছিলেন।
কৌরবেরা যে দেখছিলেন, তার কারণও আছে। আমাদের ধারণা, কৌরবদের একাংশ, যাঁরা কর্ণের ওপর ভরসা রাখেন, তাঁরা দেখছিলেন যে, কর্ণ কতটা হারেন, কারণ তাঁরা জানতেন তেরো বছরের যুদ্ধ-উপবাসী অর্জুন সেদিন ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। অর্জুন এবং কর্ণ— দু’জনেই সেদিন অপূর্ব যুদ্ধ করেছিলেন, এতটাই অপূর্ব যে, কবির বাণীতে নতুন ছন্দ লেগেছে, ভাষা হয়ে উঠেছে দীপ্তিময়ী। যুদ্ধক্ষেত্রে যতবারই অর্জুনের কেরামতি বানচাল করে দিয়েছেন কর্ণ, ততবারই তিনি কৌরবদের অসংখ্য হাততালি কুড়িয়েছেন— ততস্তু অভূদ্ বৈ তলতালশব্দঃ, কিন্তু অর্জুন এ সুযোগ পাননি। তবু সেদিনকার যুদ্ধে দু’জনেই ছিলেন এত উজ্জ্বল, এত ভাস্বর যে, হাজারো বাণবর্ষার মধ্যে দু’জনকে দেখাচ্ছিল যেন বৃষ্টির আকাশে চাঁদ আর সূর্যের উদয় হয়েছে— রথে বিলগ্নাবিব চন্দ্ৰসূর্যৌ, ঘনান্তরেণানুদদর্শ লোকঃ। কিন্তু হায়, শেষমেশ এই দ্বৈরথ যুদ্ধের ফল কর্ণের কপালগুণে এবং অর্জুনের হাতযশে— কর্ণের অনুকূলে যায়নি। হাতে, গলায়, ঊরুতে, মাথায় বিভিন্ন রকমের চোট-আঘাত নিয়ে কর্ণকে কোনওক্রমে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে হল। কিন্তু কবি লিখলেন— বনের মধ্যে এক হাতি যেমন আরেক হাতির কাছে হেরে গিয়ে সাময়িকভাবে পালায়, তেমনি অর্জুনের বাণের আঘাতে কর্ণকেও যুদ্ধ থেকে পালাতে হল। কর্ণ তবু আবার ফিরে এসেছিলেন, কিন্তু সেটা এমন একটা সময়ে যখন ভীষ্ম, দ্রোণ, দুর্যোধন সবাই প্রায় অর্জুনের হাতে পর্যুদস্ত। সমস্ত আঘাতের ওপর অর্জুনের বাণ কর্ণের দুই কানে গিয়ে লাগল। তাঁর রথ, অশ্ব, সারথি সব গেল। কর্ণ আবার দৌড়লেন নতুন সাজানো রথের জন্য।
এতক্ষণ সবার সঙ্গে যুদ্ধে কর্ণ একজন মাত্র ছিলেন। এবার একক সংগ্রাম আরম্ভ হল। কৃপাচার্য এবং দ্রোণাচার্য দু’জনেই হেরে গেলে প্রচুর বাগাড়ম্বরের পর আবার অর্জুনের সঙ্গে কর্ণের যুদ্ধ আরম্ভ হল। মনে রাখা দরকার এই বিরাট-যুদ্ধে প্রথম থেকেই বেশির ভাগ যুদ্ধটা করতে হয়েছে কর্ণকে, তাঁকেই সইতে হয়েছে প্রথম সমরাঘাতগুলি। কাজেই তৃতীয়বার যুদ্ধে এসে তাঁকে অর্জুনের কাছে শুনতেই হল যে, তিনি যুদ্ধ থেকে পালিয়েছিলেন, কিংবা তাঁর ভাই মারা পড়েছে এই যুদ্ধে। তবু আবার যুদ্ধ আরম্ভ হল এবং স্বাভাবিকভাবেই ক্লান্ত মহাবীরকে বিরথ অবস্থায় অর্জুনের বাণে মূর্ছিত হয়ে পড়তে হয়েছে, তাঁকে আবারও পালাতে হয়েছে। তেরো বছর পর কর্ণ-জয়ের আনন্দে হাসি ফুটেছে অর্জুনের মুখে।
॥ ৯ ॥
সত্যিই তো কর্ণ বারবার বলেন— আমি জিতব, তবু বার বার অর্জুনের কাছে হারেন কেন? এর একটা অদ্ভুত যুক্তি দিয়েছেন মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠ। মনে রাখতে হবে, তখনকার দিনের সামাজিক প্রেক্ষাপটে জাতি ব্যবস্থা কিংবা বর্ণ ব্যবস্থায় বিশ্বাস করাটা ছিল স্বাভাবিক। নীলকণ্ঠ সেই বিশ্বাস অনুসারেই লিখেছেন এবং এ ব্যাপারে তাঁকে মদত জুগিয়েছে অশ্বত্থামার ‘সূত’ বলে কর্ণকে সম্বোধন। নীলকণ্ঠ লিখেছেন— কর্ণকে গালাগালি দেওয়ার সময় অশ্বত্থামা যে তাঁকে ‘সূত’ বলে সম্বোধন করেছেন তার একটা কারণ আছে। অশ্বত্থামা একের পর এক যুদ্ধের নাম করেছেন আর বলেছেন— কোন যুদ্ধটায় তুই অর্জুনের সঙ্গে জিতেছিস রে বেটা। প্রায় এই প্রসঙ্গেই ‘সূত’ সম্বোধন। নীলকণ্ঠ লিখেছেন— কর্ণ যে সূর্যের ঔরসজাত পুত্র সে কথা অশ্বত্থামা জানতেন। কিন্তু সারথি জাতীয় অধিরথের ঘরের পরিবেশে কর্ণ তাঁর ক্ষত্রিয়ত্ব হারিয়েছেন বলে অশ্বত্থামা মনে করেন। নীলকণ্ঠ লিখেছেন— সমস্ত বর্ণেই মানুষের দুই রকমের জন্ম হয়। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র— সব বর্ণেই। এক জন্ম পিতামাতার শুক্ৰশোণিত সূত্রে, আর এক জন্মসংস্কারে। ছেলে যে জন্মাল, সে যদি পিতামাতার আপন সংস্কারেই মানুষ হয় তাহলে প্রায় ক্ষেত্রেই সন্তানের প্রকৃতির কোনও পরিবর্তন হয় না। এই ধরনের ছেলেকে বলে ‘একজ’— তত্র য এব যোনিঃ স এব সংস্কর্ত্তা চেৎ স একজো ন প্রকৃতিতশ্চ্যবতে। কিন্তু কর্ণ ‘একজ’ নন, ‘দ্বিজাত’। দেবলোকের ক্ষত্রিয় পুরুষ সূর্যের ঔরসে জন্মালেও কর্ণ মনুষ্যলোকে সমান্তরাল কোনও ক্ষত্রিয় সংস্কারে সংস্কৃত হননি। তিনি মানুষ হয়েছেন সূত অধিরথের বাড়িতে সারথি-জাতের সংস্কারে। ঠিক এই কারণে তাঁর প্রকৃতিতে একটা দো-আঁশলা ব্যাপার ঘটেছে। নীলকণ্ঠের মতে— সূর্যের থেকে জন্মানোর ফলে ঔরসগতভাবে ক্ষত্রিয়ত্বের কারণে কর্ণ যথেষ্ট পরিমাণে শত্রুপাতনে সক্ষম, পর-প্রহারেও কুশল। কিন্তু তাঁর মধ্যে যেহেতু সূতের সংস্কারও সম পরিমাণে বর্তমান, তাই অতি বড় শত্রুর প্রহার তিনি শেষ পর্যন্ত সহ্য করতে পারেন না এবং এইজন্যই অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে তাঁকে মাঝে মাঝেই পালাতে হয়— কর্ণস্তু দৈবক্ষত্রজোপি অক্ষত্রিয়েণ সূতেন সংস্কৃত ইতি দ্বিজাতত্বাৎ ক্ষত্রিয়ত্বেন প্রহর্ত্তুং কুশলোহপি সূতত্বেন পরকীয়প্রহারং সোঢুমশক্ত ইতি যুদ্ধাৎ পলায়তে।
আমরা আজকের দিনে বর্ণব্যবস্থার নিরিখে পুরো ব্যাপারটা ঠিক এইভাবে দেখতে চাই না। তবে যা ঘটেছিল, তার একটা উচিত ব্যাখ্যা দিতে গেলে আমরা নীলকণ্ঠের মতটা একটু অন্যভাবে বলতে পারি। একটা জিনিস সবাই নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন যে, অতি নিম্নবিত্ত মানুষের ঘরে যদি কেউ কখনও বিত্তবান হয়, তবে প্রায়শই সেই হঠাৎ বড়লোকের বৃথা বাগাড়ম্বর বৃদ্ধি পায়, এবং অন্য যথাযুক্ত হজমশক্তিশালী বিত্তবানকে সে যথার্থ বিত্তবান বলে গ্রাহ্য করে না। একইভাবে অতি মূর্খ পিতামাতার ঘরে যদি দৈববলে অতি পণ্ডিত পুরুষ জন্মায়, তবে সেই পণ্ডিতের অনেক ক্ষেত্রেই বৃথা পাণ্ডিত্য প্রকাশ পায়, এবং যথোপযুক্ত পণ্ডিত মানুষকে সে গণনার মধ্যেই আনে না। কর্ণের ব্যাপারটাও একই রকম। চিরন্তন সত্য বোঝার জন্য জাতি-বর্ণের প্রসঙ্গ তোলার প্রয়োজন নেই। তবে এ-ও ঠিক যে, সূত অধিরথের বাড়ির পরিবেশে থেকে যে ছেলে দ্রোণাচার্য, পরশুরামের পাঠশালা ঘুরে এসেছে, তার কদর অনেক। এই কদরে কর্ণের আদরও বেড়েছে এবং আদর শুধু অধিরথের ঘরে নয়, এই আদর যেহেতু এসেছে প্রসিদ্ধ ভরতবংশের যুবরাজের কাছ থেকে, তাই কর্ণের পক্ষে বাগাড়ম্বর স্বাভাবিক। কিন্তু বনেদি বড়লোকের যেমন টাকা-পয়সা হজম করার শক্তি থাকে, প্রকৃত বিদ্বানের পক্ষে যেমন বিদ্যাবত্তা হজম করা সম্ভব হয়, কর্ণের এই হজমশক্তি ছিল না। অতিক্রূর দুর্যোধনের বন্ধুত্ব তাঁর এই বদহজম আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। ফলে পেটুক যেমন তার শেষ ক্ষমতার দিকে লক্ষ না রেখেই যথেষ্ট খেয়ে যায় এবং অতি গুরুপাক দ্রব্য জীর্ণ করতে অক্ষম হয়, তেমনই কর্ণ পরশুরামের শিষ্য হওয়ার বাবদে দুর্যোধনের বহু শত্ৰু-পাতনে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও অর্জুনের মতো গুরুপাক বস্তু তিনি শেষ পর্যন্ত জীর্ণ করতে পারেন না, তাঁকে পালাতে হয়। অর্জুনের মধ্যে যে নায়কোচিত ধীরোদাত্ততা আছে, যে লঘুগুরু জ্ঞান আছে এবং সর্বোপরি অর্জুনের মধ্যে যে সহনশীলতা আছে, কর্ণের তা নেই এবং সেই জন্যই কর্ণকে হারতে হয়। এ হার শক্তির পরীক্ষায় নয়, এ হার হয় প্রকৃতিতে।
এই যে দেখুন বনবাস— অজ্ঞাতবাসের পর পাণ্ডবেরা দ্রুপদের পুরোহিত মারফত— যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই— বলে নিজেদের রাজ্যাংশ প্রার্থনা করে পাঠালেন, সেখানে কী হল? না হয় পুরোহিতের ভাষায় পাণ্ডবের শক্তি-প্রশংসা কিছু ছিল, না হয় তাঁর ভাষায় মিশেছিল পাণ্ডবদের তেরো বছরের গ্লানি— তার জবাব তো ভীষ্মই দিচ্ছিলেন। ভীষ্ম তো ভণিতা করে বলেই দিলেন— ব্রাহ্মণ! পাণ্ডবেরা সন্ধি চায় বটে, তবে আপনার ভাষাটা বেশ কড়া, তবে হ্যাঁ সেটা হয়তো আপনি ব্রাহ্মণ বলেই— অতিতীক্ষ্ণং তু তে বাক্যং ব্রাহ্মণ্যাদিতি মে মতিঃ। কিন্তু ভীষ্ম বলতে পারলেন কই? ভণিতা করে কথারম্ভের আগেই তো— ‘ধ্যাত্তারিকার’ বলে রাগ দেখিয়ে ফেললেন কর্ণ— ভীষ্মে ব্রুবতি তদ্বাক্যং ধৃষ্টম্ আক্ষিপ্য মন্যুমান্। দুর্যোধনের ‘ডিসিশন’ কর্ণই তৈরি করে দিচ্ছেন। ভীষ্মের যুক্তিগ্রাহ্য কথা শুনে পাছে দুর্যোধন নিজে কোনও সিদ্ধান্ত নেন, তাই পূর্বাহ্নেই তাঁর ইন্ধন জোগাচ্ছেন কর্ণ, পূর্বাহ্নেই তাঁকে সচেতন করছেন কর্ণ। বৃদ্ধেরা কেউ নন, রাজা ধৃতরাষ্ট্র নন এমনকী যুবরাজ দুর্যোধনও নন, কুরুদের হয়ে একবার মাত্র দুর্যোধনের দিকে তাকিয়ে, ভীষ্মকে ‘ধুত্তোর’ বলে, কথা শোনালেন কর্ণ। তেরো বছর বনবাসের পর পাণ্ডবেরা যে প্রস্তাব পাঠালেন, তার উত্তর দিচ্ছেন কর্ণ। কুরুসভায় তাঁর এতই প্রতাপ।
কর্ণ বললেন— বার বার এক কথা বলে পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে চাই না— কিং তেন ভাষিতেন পুনঃপুনঃ। কর্ণের ধারণা, দুর্যোধনের মতোই কর্ণের ধারণা যে, অজ্ঞাতবাসের আগেই অর্জুনকে দেখা গেছে সেই বিরাট যুদ্ধের আসরে। আসলে ওই যুদ্ধে অর্জুনের কাছে হেরে যাওয়ায় কর্ণের সমস্ত অহমিকা যেহেতু মলিন হয়ে গিয়েছিল, তাই কর্ণ কিন্তু ক্ষত্রোচিত ক্ষমতার বদলে আবার কপটতার দিকে মন দিচ্ছিলেন। কর্ণ বললেন— সবাই জানে যে, শকুনির পাশার দানে কী শর্ত ছিল, অজ্ঞাতবাসের সময় তাদের দেখা গেলে আবার তাদের বনে যেতে হবে— এইটেই কথা। এই সত্য প্রতিজ্ঞার বাইরে এসে পাণ্ডবেরা যদি বিরাটরাজা আর দ্রুপদরাজার ওপর নির্ভর করে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে আমাদের, তাহলে মনে রেখো, সেই ভয়ে ভীত নয় দুর্যোধন। ভয় দেখালে দুর্যোধন একের চার ভাগ কেন, এক পা জমিও ছাড়বেন না— দুর্যোধনো ভয়োদ্বিগ্নো ন দদ্যাৎ পাদমন্ততঃ। হ্যাঁ যদি ন্যায়ের কথা বলো তা হলে অতি বড় শত্রুকেও আমাদের দুর্যোধন সমস্ত পৃথিবী দিয়ে দিতে পারেন এবং সেটা পাণ্ডবদেরও দেবেন, যদি তারা প্রতিজ্ঞাটি ঠিক ঠিক মতো পালন করে। হ্যাঁ, আবার বারো বছরের বনবাস শেষ হোক, তারপর তারা নির্ভয়ে আমাদের দুর্যোধনের কোলে এসে বসুক। কিন্তু তা না করে যদি অন্যায়ভাবে বোকার মত দাবি চালায় পাণ্ডবেরা, তাহলে যুদ্ধক্ষেত্রে আমার কথা যেন স্মরণে থাকে— স্মরিষ্যন্তি বচো মম।
আবার সেই দম্ভ। দর্পী কর্ণের কথাগুলি শুনলেন? সাধে কি আর গান্ধারী মাতা সবার শেষে বলেছিলেন যে ভারত যুদ্ধের অনুক্ত কর্তা ছিলেন কর্ণ। কর্ণ যেভাবে যুক্তি সাজিয়ে, ইন্ধন জুগিয়ে দুর্যোধনকে অশুভ পথে প্ররোচিত করলেন, তাতে সাময়িকভাবে যে কোনও ঠাণ্ডা মানুষও প্ররোচিত বোধ করবেন, সেখানে দুর্যোধন শত জটিলতায় দীর্ণ। এর ওপরে আছে সেই দম্ভ, যার ওপর দুর্যোধন বার বার ভরসা করে আশাহত হন, আবারও ভরসা করেন, কেননা কর্ণ ছাড়া আর কোনও শক্তিশালী বীরই তাঁরই মতো করে তাঁরই ছন্দে, তাঁর কথা ভাবেন না। কিন্তু কথার মাঝখানে স্তব্ধ হওয়া ভীষ্ম কর্ণকে ছাড়বেন কেন; কর্ণের স্পর্ধা এতই বেড়ে গিয়েছিল যে, দ্রোন-ভীষ্মেরা আর কর্ণের সাহংকার কথাগুলি সয়ে যেতে পারছিলেন না— আগেই সে কথা বলেছি। কর্ণের মুখরতায়, দাম্ভিকতায় আহত ভীষ্ম বেশ রেগেই বললেন— ওরে রাধার বেটা! মেলা বকবক কোরো না, তোমার নিজের কাজকর্ম একটু স্মরণ কর তাহলেই হবে। তুমি একা নও, আমরা ছ’জন মহারথ যোদ্ধা ছিলাম বিরাটরাজ্যে গোধন হরণের সময়। আমাদের ছ’জনকেই অর্জুন একা হারিয়ে দিয়েছিল। তুমি যে তার সঙ্গে যুদ্ধ করেও বার বার বেঁচে গেছ, তার থেকেই বুঝি, কী কর্ম তুমি করেছ— বহুশো জীয়মানস্য কর্ম দৃষ্টং তদৈব তৎ— অর্থাৎ পালিয়ে বেঁচেছ। তোমার কথা শুনে যদি এখন এই ব্রাহ্মণের মুখে পাণ্ডবদের সন্ধির প্রস্তাব মেনে না নিই, তা হলে যুদ্ধক্ষেত্রে শুয়ে শুয়ে আবার আমাদের মাটি খেতে হবে। যেমনটি আগের যুদ্ধে মূর্চ্ছিত হয়ে খেয়েছিলাম— ধ্রুবং যুধি হতাস্তেন ভক্ষয়িষ্যাম পাংশুকান্।
ভীষ্মের রাগ দেখে মহামতি ধৃতরাষ্ট্র একটু ভয়ই পেলেন, একটু তিরস্কারও করলেন কর্ণকে। পরে সঞ্জয়ের কাছে মন খুলেই বললেন যে, “আমাদের পক্ষে এই দুর্যোধন আর কর্ণ ছাড়া আর কেউই নেই, যারা পাণ্ডবদের এত বিদ্বেষ করে।” নিরপেক্ষতার মুহূর্তে ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনের বিশেষণ দিয়েছেন পাপমতি, মন্দবুদ্ধি আর কর্ণের বিশেষণ দিয়েছেন ক্ষুদ্রচেতা— অন্যত্র পাপাদ্ বিষমান্মন্দবুদ্ধের্দুর্যোধনাৎ ক্ষুত্রতরাচ্চ কর্ণাৎ। সত্যি দুর্যোধনের অসমদর্শিতার সঙ্গে সঙ্গে কী এক পরশ্রীকাতরতা কর্ণকে পেয়ে বসেছিল যে, অতবড় উদার দাতা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর অতি বিশ্বস্তজনের চিত্তভূমিতেও ক্ষুদ্রচেতার পদবী লাভ করেছেন তিনি। কিন্তু এহ বাহ্য, ধৃতরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া বড়ই সাময়িক। সাময়িকভাবে তিনি ভীমার্জুনের শক্তি চিন্তা করে ভয় পেয়েছেন, অতএব আপাতত দুর্যোধন তাঁর কাছে মন্দবুদ্ধি, কর্ণ তার চেয়েও ক্ষুদ্রতর। লোকে যা বলে, এখন ধৃতরাষ্ট্রও তাই বললেন। কিন্তু কর্ণের বিপদটা তো অন্য জায়গায়। ধৃতরাষ্ট্র কী বলছেন, না বলছেন তাতে কিছু আসে যায় না, স্বয়ং দুর্যোধন তাঁকে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ— এইসব মহারথীদের সমান মনে করেন— ভীষ্ম দ্রোণকৃপাণাং চ তুল্যঃ কর্ণো মতো মম। শুধু তাই নয়, কখনও বা স্বয়ং পরশুরামের সমান মনে করেন কর্ণকে। অবশ্য এ ধারণা দুর্যোধনের হয়েছে কর্ণের মারফতই, কারণ কর্ণই তাঁকে এসে বলেছেন— পরুশুরাম নাকি তাঁকে জানিয়েছেন— আমার মতনই কিংবা আমার সমানই ক্ষমতা তোমার— অনুজ্ঞাতস্তু রামেণ মৎসমোহসীতি ভারত।
আমরা জানি যে, দুর্যোধনেব কাছে কর্ণ পরশুরামের কথাটা হয়তো একটু বাড়িয়ে বলেছেন এবং কিছু কথা যে তিনি চেপেও গিয়েছিলেন তাও আমরা জানি। এখন যুদ্ধ এগিয়ে আসছে, এখন সবারই সঠিক মূল্যায়ন হওয়া দরকার। ধৃতরাষ্ট্র বলেছেন যে, তাঁর গুষ্টিতে দুর্যোধন আর কর্ণ ছাড়া তেমন পাণ্ডব-বিদ্বেষী আর কেউ নেই। বস্তুত এঁরাই যুদ্ধ চান। আর চাইবেনই বা না কেন, না চেয়ে উপায়ই নেই, যুদ্ধের কারণ তো এঁরাই। এখন এই যুদ্ধোদ্যোগের মুহূর্তে যখনই দূতেরা একবার পাণ্ডবদের কাছে যাচ্ছে, আরেকবার ধৃতরাষ্ট্রের কাছে আসছে, তখনই কিন্তু পাণ্ডব পক্ষ থেকে বার বার সেই দ্যূতসভায় পাঞ্চালী-কৃষ্ণার অপমানের কথা উঠেছে। বার বার কর্ণের কথা উঠেছে, যিনি পঞ্চপতির সামনেই পঞ্চস্বামীগর্বিতা দ্রৌপদীকে ‘বেশ্যা’ বলেছিলেন। পাণ্ডবদের প্রতিনিধি হয়ে স্বয়ং বাসুদেব ধৃতরাষ্ট্রের শান্তি-দৃত সঞ্জয়কে জানিয়েছিলেন— মনে রেখো সঞ্জয়! সেই সূতপুত্র কর্ণ দ্রৌপদীর শ্বশুরস্থানীয়দের সামনে তাঁকে কী বলেছিল। বলেছিল— তোমার এখন আর কোনও গতিই নেই দ্রৌপদী, তুমি এখন ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেদের ভোগ্যা দাসী। বলেছিল— দ্রৌপদী! এখন তুমি বরং তোমার পঞ্চস্বামী বাদ দিয়ে নতুন কোনও স্বামী বেছে নাও কৌরবদের মধ্যে থেকে। কৃষ্ণ বললেন— সঞ্জয়! এসব কথা অর্জুনের মনের মধ্যে ছুঁচের মত বিঁধে রয়েছে, কর্ণের কথার ছুঁচ— কর্ণাৎ শরে বাঙ্ময়স্তিগ্মতেজাঃ প্রতিষ্ঠিতো হৃদয়ে ফাল্গুনস্য।
সঞ্জয় যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে ফিরে এসে সব বলেছেন ধৃতরাষ্ট্রকে। তাঁকে বোঝানোও কম হয়নি। স্বয়ং বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে সহস্র নীতিকথা শুনিয়ে শেষ মন্তব্য করেছেন— মহারাজ। আপনি দুর্যোধন, শকুনি অথবা কর্ণের ওপরে কুরুদের সমস্ত ঐশ্বর্য ন্যস্ত করে কী করে ভাবছেন আপনি মঙ্গল লাভ করবেন— কর্ণে চৈশ্বর্যমাধায় কথং ত্বং ভূতিমিচ্ছসি। কিন্তু একটু আগেই যে বলেছি দুর্যোধন-কর্ণের ব্যাপারে ধৃতরাষ্ট্রের বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিতান্তই সাময়িক, নইলে স্বয়ং কুরু-কুলপতি ভীষ্মকেও তিনি কীরকম অবজ্ঞাই না করলেন। সঞ্জয়ের কথার সূত্র ধরে ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্রকে কৃষ্ণ এবং অর্জুনের ক্ষমতা সম্বন্ধে সচেতন করছিলেন। একই সঙ্গে ভীষ্ম সতর্ক করছিলেন দুর্যোধনকেও। ভীষ্ম বলেছিলেন— বার বার বলছি দুর্যোধন, কৃষ্ণ আর অর্জুনকে যুদ্ধে যদি এক রথে আসতে দেখো, তা হলে কৌরবদের সমূহ বিপদ। এটা মনে রেখো, সমগ্র কৌরবকুল তোমারই সিদ্ধান্তের প্রতীক্ষা করে, কিন্তু তুমি নিজে চালিত হও তিন জনের বুদ্ধিতে। তাদের মধ্যে একজন হল ওই পরশুরামের অভিশপ্ত শিষ্য, বেজাতে জন্মানো সূতপুত্ৰ কৰ্ণ— রামেণ চৈব শপ্তস্য কর্ণস্য ভরতর্ষভ। দুর্জাতেঃ সূতপুত্রস্য…। দ্বিতীয় শকুনি, তৃতীয় দুঃশাসন। দুর্যোধনের বুদ্ধিদাতাদের লিস্টিতে প্রথম নাম কর্ণের। কুরুবৃদ্ধেরা যে তাঁর ওপর সন্তুষ্ট নন, তা তাঁদের আরোপিত বিশেষণগুলি থেকেই বোঝা যায়। কর্ণ ‘দুর্জাতি’, কর্ণ ‘সূতপুত্র’— এইসব বিশেষণ কর্ণের গা-সওয়া, কিন্তু যাঁর ক্ষমতা এবং অস্ত্রবলের ওপর দুর্যোধন সমধিক ভরসা করেন, সেই অস্ত্রবিদ্যাও যে গুরু পরশুরামের অভিশাপে কার্যকালে কাজে লাগবে না সেই কথাটা দুর্যোধনকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার ফলে কর্ণের রাগ আরও বেড়ে গেল। তিনি অবশ্য সুচতুরভাবে ওই শাপ-টাপের প্রসঙ্গে গেলেন না। উলটে শক্তিমান পুরুষের জাতি নিয়ে যে কোনও আলোচনা ভদ্র সমাজে বিগর্হিত, সেই দিকটা দিয়ে চেপে ধরলেন ভীষ্মকে।
কর্ণ বললেন— যা বলেছেন, বলেছেন। কিন্তু আপনি আর দ্বিতীয়বার এসব বাজে কথা বলবেন না, পিতামহ! আমি ক্ষত্রিয়ের ধর্ম পালন করি এবং সেই ধর্ম থেকে আমি একচুলও নড়ি না। তা ছাড়া, আর কী খারাপটা আপনি দেখেছেন আমার মধ্যে, যাতে করে আমাকে এমন করে গালাগালি দিতে পারেন আপনি— কিঞ্চান্যন্ ময়ি দুর্বৃত্তং যেন মাং পরিগর্হসে, কই, আমার মধ্যে ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা তো কোনও অন্যায় আচরণ দেখতে পায় না। আর আমিও কোনওদিন তাদের বিরুদ্ধে কাজ করিনি। অর্থাৎ তুমি তা করছ। এই কথাটা ভীষ্মের দিকেই অঙ্গুলি সংকেত করে বলা। কর্ণ বলতে চান— ভীষ্ম কৌরবদের যথেষ্ট দোষ দেখতে পান, যা কর্ণ পান না। ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরাও ভীষ্মকে খুব একটা আপনার বলে মনে করেন না, অথচ তিনি ঠাকুরদাদাগিরি করে নাতিদের দোষ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। বাঙাল প্রবাদ জানলে কর্ণ এখুনিই বলতেন— মায় মানে না ঝি, আপনা-আপনি সোহাগী। প্রায় এতটা বলার পর কর্ণ উদ্ধত হয়ে বললেন— যা বলেছি, বেশ করেছি। হ্যাঁ, আমি পাণ্ডবদের একা শেষ করে ছাড়ব। কর্ণ স্পষ্টতই বলতে চাইলেন— আপনি কে? মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের যা প্রিয়, আমি তাই করেছি, তাই করি, আর কাজ করি দুর্যোধনের, রাজ্যের ভার যাঁর ওপরে, আপনি কে— রাজ্ঞো হি ধৃতরাষ্ট্রস্য সর্বং কার্যং প্রিয়ং ময়া। তথা দুর্যোধনস্যাপি স হি রাজ্যে সমাহিতঃ।
এই অপমান ভীষ্মের সহ্য হবার নয়। এতদিন ধরে যিনি এই বিশাল কুরুকুলের সমস্ত তন্তুগুলি রক্ষা করে এসেছেন, তিনি ধৃতরাষ্ট্র, দুর্যোধনের প্রিয় বোঝেন না, বোঝে এই কুরুদের আশ্রয়পুষ্ট কর্ণ। অথবা আশ্রয়পুষ্টের এই স্বভাব, সে শ্রেয় বোঝে না, প্রেয় বোঝে, পরিণামে হিতকারিতা বোঝে না, বিষয়ের আপাতরম্যতা বোঝে। কিন্তু ভীষ্ম যদি এখন সেই সব তর্ক তোলেন, তা হলে স্নেহান্ধ ধৃতরাষ্ট্রের তা মোটেই বুদ্ধিগোচর হবে না— হবে না যে, তা বিদুরের বিরাট বক্তৃতা শেষেই বোঝা গেছে। ভীষ্ম তাই সে ধার দিয়ে গেলেনই না, তিনি বাস্তবতার কথা তুললেন। তিনি কর্ণের সেই আত্মম্ভরিতার কথাটা উদ্ধার করে নিলেন, তাঁর বাক্যগুলি থেকে। ভীষ্ম জানেন, যুদ্ধ যখন লাগবে, তখন সেই বাস্তবতার নিরিখেই কর্ণের কথার উত্তর দেওয়াটা ভাল। ভীষ্ম বললেন— প্রায় প্রতিদিনই একবার এই কর্ণ হামবড়াই করে বলবে— ‘আমি একাই পাণ্ডবদের শেষ করে দেব— হস্তাহং পাণ্ডবানিতি। আরে পাণ্ডবদের তুলনায় এই কর্ণটা একের ষোলো ভাগও নয়— নায়ং কলাপি সম্পূর্ণা পাণ্ডবানাং মহাত্মনাম্।
বিরাটরাজ্যের যুদ্ধের আসরে, দ্রোণাচার্যের কথার উত্তরে কর্ণ যখন একই কথা বলেছিলেন— পাণ্ডবদের আমিই মারব— তখন এই ভীষ্ম কোনওমতে কর্ণের কথার যৌক্তিকতা স্থাপন করে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বন্ধ করেছিলেন; দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য অশ্বত্থামার মতো বীরকে কোনওমতে তিনি কৌরবপক্ষে পুনরায় স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু আজ যখন সেই লোক, সেই একই কথা তাঁরই মুখের ওপরে ছুড়ে দিয়ে তাঁকেই ‘নিমকহারাম’ বলতে চাইছে, তখন ভীষ্মও লাগামছাড়া কথাবার্তা আরম্ভ করে দিলেন। ভীষ্ম বললেন— ধৃতরাষ্ট্র! আজ তোমার ছেলেদের কপালে যে দুর্ভাগ্য ঘনিয়ে আসছে, তার সবটাই জানবে এই বদমাশ সারথির বেটার কাজ— তদস্য কর্ম জানীহি সূতপুত্রস্য দুর্মতেঃ। প্রধানত, এইটার ওপর নির্ভর করেই তোমার দুর্বুদ্ধি ছেলে দুর্যোধন, তার বীর জ্ঞাতিভাইদের অপমান করেছিল। আর এই কর্ণ পাণ্ডবদের মারবে বলছে— তা বেশ— এই কর্ণের একটা সেইরকম সাংঘাতিক কর্মের কথা বলো, যা পাণ্ডবদের কেউ না কেউ করেনি। এই যে বিরাটনগরে এত বড় যুদ্ধটা হয়ে গেল, সেখানে কর্ণটা লড়তে গেছিল অর্জুনের সঙ্গে। কী হল? সেই যুদ্ধে তোমার এই দুর্যোধন ভাইটি তো অজ্ঞান হয়ে মৃত্যুর মুখ দেখছিল, তখন এই কর্ণ কী করেছিল— কিমনেন তদা কৃতম্। সেই যুদ্ধে অর্জুন যখন সমস্ত কুরু-প্রধানদের যুদ্ধে মূর্চ্ছিত করে পরনের কাপড়টা পর্যন্ত খুলে নিয়ে চলে গেল, তখন এই কর্ণটা কোথায়, কোন দূরদেশে লুকিয়েছিল— প্রমথ্য চাচ্ছিনদ্ বাসঃ কিময়ং প্রোষিতস্তদা? যখন গন্ধর্ব চিত্রসেন তোমার ছেলে দুর্যোধনকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে, তখন কোথায় ছিল এই সূতের বেটা, যেটা আজকে এখানে দাঁড়িয়ে ষাঁড়ের মত গোঁ গোঁ করে চেঁচাচ্ছে— ক্ক তদা সূতপুত্রোহভূদ্ য ইদানীং বৃষায়তে। আরে সেদিন, সেই অর্জুন, সেই ভীম, সেই নকুল-সহদেব— এরাই গিয়ে গন্ধর্বদের হটিয়ে দিয়ে তোমার ছেলেকে ফিরিয়ে এনেছিল। এই কর্ণের মিথ্যা বাগাড়ম্বর অনেক শুনেছি, ওসব ফালতু কথার কোনও মূল্য নেই— এতান্যস্য মৃষোক্তানি বহূনি ভরতর্ষভ।
ভীষ্মের কথাগুলি অক্ষরে অক্ষরে সমর্থন করলেন দ্রোণাচার্য, কারণ তিনিই কর্ণের কটু অপমানের পূর্বভোগী। দ্রোণাচার্য ধৃতরাষ্ট্রকে সাবধান করে দিলেন এবং বললেন— খবরদার এইসব ধান্দাবাজদের কথা শুনে আপনি পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বেন না— ন কামম্ অর্থলিপ্সূনাং বচনং কর্তুমর্হসি। কিন্তু ভীষ্ম, দ্রোণ বললে কী হবে, আমরা আগেই বলেছি ধৃতরাষ্ট্রের কর্ণ বিষয়ক বিরূপ প্রতিক্রিয়া অতি সাময়িক। হিতের কথা তাঁর আর ভাল লাগে না, বরঞ্চ কর্ণের আপাতবশংবদতার কথাই তাঁর ভাল লাগে, কেউ তাঁর প্রিয় সাধন করছে এইটাই তাঁর ভাল লাগে, অন্ধ রাজার গোপন অন্ধ ইচ্ছেগুলি কেউ নির্বিচারে পালন করছে— এইটাই তাঁর ভাল লাগে। ফল হল এই যে, ভীষ্ম-দ্রোণ যা বললেন, সেদিকে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে, যেন কিছু শুনতেই পাননি এমন একটা ভাব করে তাঁর বিস্ফারিত অন্ধ চক্ষু দুটি দিয়ে ইঙ্গিত করলেন সঞ্জয়কে— অনাদৃত্য তু তদ্বাক্যমর্থবদ্ দ্রোণভীষ্ময়োঃ। যেন এই ভীষ্ম-দ্রোণের প্রলাপ বাক্যের কোনও মূল্যই নেই, বরং কর্ণ যা বলেছেন ঠিক বলেছেন, এমনি একটা ভাব করে ধৃতরাষ্ট্র সাবহেলায় জিজ্ঞাসা করলেন— হ্যাঁ সঞ্জয়, কী হল তারপর, পাণ্ডবেরা কী বললেন?
মহাভারতের কবি আর কিছুতেই কর্ণকে সমব্যথা দেখাতে পারছেন না। কবির ধারণা, ধৃতরাষ্ট্র যখন ভীষ্ম, দ্রোণের মত মানুষের সার কথা শুনলেন না, ভদ্রতা করে তাঁদের কথার জবাবও দিলেন না, উলটে কর্ণের প্রতিই যখন ধৃতরাষ্ট্রের গূঢ় সমর্থন রয়ে গেল, তখন কুরুকুলের সাধারণ জনেরা নিজের জীবনের আশা বিসর্জন দিলেন। ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়ের সমস্ত কথা শুনলেন, পাণ্ডবদের প্রতিজ্ঞা শুনে তাঁর যে একটু ভয় ভয়ও করছিল না, তা নয়, কিন্তু তাঁকে আপন মতে প্রতিষ্ঠিত করতে দুর্যোধনই ছিলেন যথেষ্ট। ভীষ্ম যেহেতু কর্ণের বীরত্ব নিয়ে কটু সমালোচনা করেছেন, তাই দুর্যোধন সবার সামনেই পুনরায় তাঁকে কাল্পনিক পাণ্ডবহন্তার আসনে প্রতিষ্ঠিত করলেন। তুলনা দিয়ে বললেন, কর্ণ আপন শক্তিমত্তায় ওই ভীষ্ম, দ্রোণ কি কৃপের থেকে কোনও অংশে কম নয়, বরঞ্চ ভীষ্মের গুরু পরশুরামও নাকি তাঁকে সমযোদ্ধার আসন দিয়েছেন— অনুজ্ঞাতশ্চ রামেণ মৎসমোহসীতি ভারত। হ্যাঁ, ইন্দ্রদেবের প্রবঞ্চনায় এবং কর্ণের দানশূরতায় কবচ-কুণ্ডলটি খোয়া গেছে বটে, কিন্তু মজুত আছে কর্ণের কাছে সেই ইন্দ্রের দেওয়া এক বীরঘাতিনী শক্তি— যে শক্তি থেকে অর্জুনের কিছুতেই নিস্তার নেই— কস্মাদ্ জীবেদ্ ধনঞ্জয়ঃ। দুর্যোধন কর্ণের শক্তি দেখিয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন— আপনি একটুও চিন্তা করবেন না মহারাজ, পাকা ফলের মতো জয় আমাদের হাতের মুঠোয়— ফলং পাণৌ ইবাহিতম্।
আমরা আগেই বলেছি মহাভারতের কবি আস্তে আস্তে তাঁর সমস্ত সমব্যথিতা উঠিয়ে নিচ্ছেন কর্ণের ওপর থেকে। যে শক্তি, যে রণনিপুণতা নিয়ে জন্মেছিলেন কর্ণ, সেই শক্তি শুধু অন্যায় বুদ্ধির মোসাহেবি করে এখন একেবারে দুর্যধনেরই একান্ত শক্তিতে পরিণত। সহনশীলতা এবং পাত্রাপাত্র বোধ— দুটিই কর্ণের মধ্যে না থাকাতে তিনি শেষ পর্যন্ত কৌরবকুলের ধ্বংসসাধকদের মধ্যে অন্যতম প্রধান বলে চিহ্নিত হয়েছেন। এমনকী স্থিতিশীল প্রকৃতিস্থ অবস্থায় মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র পর্যন্ত মনে করেন— দুর্যোধন আমার গোপাল ছেলে, সুবোধ বালক, আসল কাজটা করছে ওই কর্ণ। দুর্যোধনকে তিনি স্পষ্টই জানিয়েছেন— দেখো বাপু তুমি তো নিজে ইচ্ছে করে কিছু করো না, ওই কর্ণ তোমাকে দিয়ে করিয়ে নেয়— ন ত্বং করোষি কামেন কর্ণঃ কারয়িতা তব। দুর্যোধনের গোষ্ঠীতে কর্ণের এই প্রযোজক কর্তার ভূমিকা, এটা খানিকটা সত্যও বটে। কর্ণ নিজে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা— এইসব বড় মাপের মানুষদের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন এবং ধৃতরাষ্ট্র যখন সবার চাপে পড়ে দুর্যোধনের কাছে সন্ধির প্রস্তাব করলেন, তখন দুর্যোধন পরিষ্কার সেই একাকিত্বের দায়িত্ব নিয়েছেন। অর্থাৎ যুদ্ধ যদি লাগে এবং ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, কেউ যদি যুদ্ধ না-ও করেন, তবু তিনি যুদ্ধ করবেন, শুধু তাঁর সঙ্গী হবেন কর্ণ। তিনি বলেছেন— আমি কারও ওপর কোনও ভরসা রাখছি না, শুধু আমি আর কর্ণ— অহঞ্চ তাত কর্ণশ্চ— এ দু’জনে মিলেই আমরা যুদ্ধ করব। যুদ্ধটা যদি যজ্ঞের মতো চেহারা নেয়, তাহলে সেই রণযজ্ঞের পশুবলি হবেন যুধিষ্ঠির, আর সেই যজ্ঞের পুরোহিত হবেন কর্ণ আর দুর্যোধন— অহঞ্চতাত কর্ণশ্চ রণবজ্ঞং বিতত্য বৈ। যুধিষ্ঠিরং পশুং কৃত্বা দীক্ষিতৌ পুরুষর্ষভৌ।
রণযজ্ঞে পাণ্ডব-প্রতিনিধি যুধিষ্ঠিরকে বলি দেওয়ার জন্য দুর্যোধন কারও ওপর নির্ভর করেননি, প্রধানত কর্ণের ওপর ছাড়া। এই নির্ভরতার জন্য কর্ণের মত নিতে হয়নি দুর্যোধনকে, কর্ণের ওপর দুর্যোধনের দখলদারি এতটাই। কর্ণও অবশ্য তাঁর কথার মর্যাদা দিয়েছেন কিন্তু সেই সঙ্গে একটা বড় ঘটনাও ঘটে গেল। কুরুসভার বৃদ্ধেরা যে আস্তে আস্তে কর্ণের থেকে একেবারেই আলাদা হয়ে পড়ছিলেন তারই এক চূড়ান্ত রূপ দেখা গেল এই সময়। দুর্যোধনের নির্ভরতায় আপ্লুত হয়ে কর্ণ খেয়ালই করলেন না যে, ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়ের কাছে পাণ্ডবদের সম্বন্ধে নানা কথা জানতে ব্যস্ত আছেন— বৈচিত্রবীর্যম্ তম্ অচিন্তয়িত্বা। এমনিতেই কর্ণ কথা বলতে উঠলেই কুরুসভায় দুর্যোধনের অনুগতদের মধ্যে ‘এনকোর’ ‘এনকোর’ ধ্বনি ওঠে। ঠিক তেমনিভাবেই— প্রহর্ষয়ন্ সংসদি কৌরবাণাম্— কর্ণ নিজের মনে দারুণ আস্থা নিয়ে বলতে আরম্ভ করলেন। কর্ণ বললেন— দুর্যোধন! পাণ্ডবদের ব্যাপারটা তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও, ওদের সঙ্গে আমি বুঝে নেব— পার্থান্ হনিষ্যামি মমৈষ ভারঃ।
কুরুসভায় এখন পাণ্ডব-কৌরবের ক্ষমতা-অক্ষমতা যাচাই চলছে দিন রাত। কে কাকে মারতে পারবে। কার শক্তি কত— এ সব তুলনা, প্রতিতুলনা চলছে। সেই অবস্থায় কর্ণ তাঁর স্বাভাবিক নিয়মে আবারও বলে ফেললেন— পাণ্ডবদের দণ্ড দেওয়ার ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। হ্যাঁ, আমি গুরু পরশুরামের কাছে মিথ্যা কথা বলে অস্ত্রবিদ্যা শিখেছিলাম বটে, গুরুও আমাকে অভিশাপ দিয়েছেন যে, আমার অন্তকালে সেইসব মারণাস্ত্র আমার স্মৃতিগোচর হবে না। কিন্তু তবু বলছি, সে সব অস্ত্রের শেষমেশ এখনও যা আমার মাথায় আছে, তাতেই ওই পাণ্ডবদের বারোটা বেজে যাবে— তস্মাৎ সমর্থোহস্মি মমৈষ ভারঃ। কর্ণ গুরুর কথাটা তুললেন এই জন্যে যে, বার বার পরশুরামের অভিশাপের কথাটা বলে তাঁকে একটু খাটো করে দেখার একটা প্রবৃত্তি ভীষ্ম-দ্রোণের মধ্যে দেখা যাচ্ছিল। অতএব ভীষ্ম-দ্রোণের মুখ ভোঁতা করে দিয়ে বললেন— আরে! পিতামহ ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য— আপনারা এত কষ্ট করবেন কেন? আপনারা বুড়ো মানুষ। আপনারা মেজাজে বসে থাকুন ওই দুর্যোধনের পাশটিতে। পাণ্ডবদের ব্যাপারে আপনাদের কারও কোনও চিন্তা নেই, ওটা আমার ওপর ছেড়ে দিন— পার্থান্ হনিষ্যামি মমৈষ ভারঃ।
আর কত! আর কত সহ্য করতে পারেন ভীষ্ম! ভীষ্ম বললেন— তোমার সময় হয়ে এসেছে বাছা। যথেষ্ট বড় বড় কথা শুনেছি— কিং কত্থসে কালপরীতবুদ্ধে— আর নয়। ওই যে ইন্দ্রের দেওয়া ওই শক্তিটার ওপর অত ভরসা করছ তুমি, ভাবছ একবার ব্যবহার করেই অর্জুনকে সাবাড় করবে তুমি। আরে, যুদ্ধক্ষেত্রে যখন বাসুদেব কৃষ্ণের চক্র চলবে, তখন ইন্দ্রের শক্তি গুঁড়িয়ে যাবে— চক্ৰাহতাং দ্রক্ষ্যসি কেশবেন। ওই যে সাপের মুখওয়ালা বাণটা, যেটাকে তুমি প্রতিদিন মালা-টালা দিয়ে পুজো করো, তোমার সঙ্গে ওটারও আর চিহ্ন থাকবে না অর্জুনের বাণে। এটা মনে রেখ অর্জুনকে রক্ষা করছেন স্বয়ং বাসুদেব, তোমাদের মতো বিরাট যোদ্ধাকে ওপারে পাঠাতে যাঁর সময় লাগবে না একটুও— যঃ ত্বাদৃশানাঞ্চ বলীয়সাঞ্চ হন্তা রিপূণাং তুমুলে প্রগাঢ়ে।
কর্ণের রাগ হল সাংঘাতিক, অথচ প্রথমে স্বীকারও করে নিলেন কৃষ্ণের বলবত্তার কথাটা। বললেন— হ্যাঁ, স্বীকার করলাম কৃষ্ণ খুব বড় মানুষ কিন্তু তাই বলে আমিও যা বলেছি তাও এমন কিছু বাজে কথা নয়। শুনে রাখুন পিতামহ! এই আমি অস্ত্র ফেলে দিলাম, আপনি বেঁচে থাকতে এই সভাতেও আমি আসব না, এবং যে যুদ্ধে আপনি আছেন, সে যুদ্ধেও নয়। কিন্তু আমি কী করতে পারি আর পারি না, তা সবাই দেখবে আপনি গতায়ু হলে— ত্বয়ি প্রশান্তে তু মম প্রভাবং দ্রক্ষ্যন্তি সর্বে ভুবি ভূমিপালাঃ। এই বলে কর্ণ কুরুসভা ত্যাগ করে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিজের বাড়ি চলে গেলেন। দুর্যোধন ভীষ্মকে খানিকটা বকাবকি করলেন এবং পরিষ্কার তাঁকে জানালেন— পিতামহ! আপনি কিংবা দ্রোণের ওপর নির্ভর করে আমি পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাচ্ছি না, পঞ্চপাণ্ডবদের ঠাণ্ডা করতে আমি, কর্ণ আর দুঃশাসনই যথেষ্ট— অহং বৈকৰ্ত্তনঃ কর্ণো ভ্রাতা দুঃশাসনশ্চ মে। এ কথাগুলি সবই কর্ণের কথা। কর্ণ চলে গেলে, কর্ণের কথা বলেই ভীষ্মকে অস্বস্তিতে ফেলে দিলেন স্বয়ং দুর্যোধন। দুর্যোধন কর্ণের পুরনো কথাটা ফিরিয়ে দিলেন। বললেন— অস্ত্রে, ক্ষমতায়, সৈন্যবলে আমরাও পাণ্ডবদের থেকে কম যাই না, তবু খালি আপনি পাণ্ডবদের জয় দেখতে পান সব জায়গায়, কেন? আমরা কি এতই ফেলনা— পিতামহ বিজানীষে পার্থেষু বিজয়ং কথম্। বললাম তো পাণ্ডবদের ঠাণ্ডা করতে, আমি, কর্ণ আর দুঃশাসনই যথেষ্ট, আপনাদেরও কাউকে প্রয়োজন নেই— পাণ্ডবান্ সমরে পঞ্চ হনিষ্যামি শিতৈঃ শরৈঃ।
এ হল কর্ণের সঙ্গে দুর্যোধনের পারস্পরিক সেই পিঠ-চুলকানি, যাতে করে, কুরুবৃদ্ধেরা সবাই একে একে প্রত্যেকেই আপন কক্ষে গিয়ে পৌঁছেছেন; আর কেউই দুর্যোধনের সঙ্গে মানসিকভাবে কাছাকাছি নেই। ভীষ্ম, দ্রোণ যতদূর সরেছেন দুর্যোধনের কাছ থেকে, দুর্যোধন তত কাছাকাছি হয়েছেন কর্ণের। দূত সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে ‘রিপোর্ট’ দিয়েছেন যে, তিনি অর্জুন আর কৃষ্ণকে এক আসনে বসে থাকতে দেখে বড়ই ভয় পেয়েছেন— একাসনগতৌ দৃষ্টা ভয়ং মাং মহদাবিশৎ| সেই কালের দিনে দেবপ্রতিম এই দুই প্রবাদ পুরুষের ঘনিষ্ঠতা সঞ্জয়ের মনে যে প্রমাদের সঞ্চার করেছে, অনুরূপ ভয় পাণ্ডব পক্ষেরই হতে পারত— কর্ণ-দুর্যোধনের ঐকান্তিক ঘনিষ্ঠতায়, কারণ তাঁদেরও আমরা একাসনেই বসতে দেখেছি। কৃষ্ণ যখন শান্তির দূত হয়ে এলেন কৌরবদের সভায়, তখন কর্ণ-দুর্যোধনও একাসনেই বসে ছিলেন— কর্মদুর্যোধনাবুভৌ… একাসনে মহাত্মানৌ। কিন্তু তবুও যে তাঁরা কোনও ভয়ের সৃষ্টি করতে পারেননি, তার কারণ হিসেবে না হলেও মহাভারতের কবি তাঁদের একটা বিশেষণ দিয়ে আমাদের সব কিছু বুঝিয়ে দিয়েছেন। কবি লিখেছেন— কৃষ্ণের আসনের অত্যন্ত কাছাকাছি কর্ণ আর দুর্যোধন একাসনে বসেছিলেন, কিন্তু শান্তি-সন্ধির কথা শোনার মতো তাঁদের প্রকৃতি ছিল না, তাঁরা দু’জনেই রাগে গুম হয়ে বসেছিলেন— একাসনে মহাত্মানৌ নিষীদতুরমর্ষণৌ। মনের মধ্যে ক্রোধের মতো এত বড় একটা রিপু নিয়ে, পাত্রাপাত্র-বিবেকহীন স্বার্থপরায়ণ এক অহমিকা নিয়ে কখনও মহান ব্যক্তিত্বের দাবি করা যায় না। তাঁদের একাত্মক অহমিকা যেখানে কৌরবদের নিজের ঘরের মধ্যেই ভাঙন ধরিয়ে দিয়েছিল সেখানে পাণ্ডবের শিবিরে কৃষ্ণার্জুনের একাত্মতায় তাঁদের শত্রু পক্ষের যে শুধু ভয় উৎপাদিত হচ্ছিল তাই নয়, কৌরব পক্ষের অনেক মান্য পুরুষই তাঁদের হৃদয়-ভরা সম্মান নিবেদন করতে আরম্ভ করেছিলেন পাণ্ডব পক্ষের ওই দুই মহান পুরুষের উদ্দেশ্যে। ভীষ্ম-দ্রোণের মতো পুরুষেরও তাঁদের প্রতি এই সম্মান-বোধ ভয়ে তৈরি হয়নি, তৈরি হয়েছে নীতি-যুক্তির বৈধতায়, যে বৈধতা কর্ণ-দুর্যোধনের হৃদয়ে ছিল না। সমস্ত মতে নিরপেক্ষ গান্ধারীর যুক্তিতেও কর্ণ পরিচিত হয়েছেন অত্যন্ত ক্রোধী বলে— সূতপুত্রো দৃঢ়ক্রোধঃ। কর্ণ-দুর্যোধনের যৌথ আস্ফালন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, কৌরব পক্ষের স্থিতধী পুরুষেরা শেষ পর্যন্ত পাণ্ডব পক্ষেই যোগ দিয়ে বসেন কি না, এমন আশংকার কথাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছিল না। কৃষ্ণের দূতকর্ম যখন প্রায় ব্যর্থ হল, সেই সময় গান্ধারী তো পরিষ্কার দুর্যোধনকে বলেছিলেন— তোমার বন্ধু ওই সূতপুত্ৰ কৰ্ণ, কিংবা দুঃশাসন জীবনেও পাণ্ডবদের সঙ্গে পেরে উঠবে না। স্বয়ং কৃষ্ণও দুর্যোধনকে শাসিয়ে গেছেন তাঁর, দুঃশাসনের এবং কর্ণের অভদ্র ভাষা এবং ব্যবহারের জন্য, বিশেষত যে ভাষা কর্ণ ব্যবহার করেছিলেন পাশা খেলার আসরে কুলবধূ দ্রৌপদীর প্রতি। কৃষ্ণ স্পষ্টতই বলেছেন, সে ভাষা ছোটলোকের ভাষা— নৃশংসানাম্ অনার্যানাং পুরুষাণাঞ্চ ভাষণম্।
কিন্তু গান্ধারীর নিরপেক্ষ বাক্য, কৃষ্ণের শাসানি এবং ভীষ্ম-দ্রোণের মতো পুরুষদের বিরুদ্ধতাও দুর্যোধন-কর্ণকে টলাতে পারেনি। তাঁরা এক সময় শান্তির দূতকে বেঁধে রাখার কল্পনাও করেছিলেন— দুর্যোধনস্য কর্ণস্য…ইদমাসীদ্ বিচেষ্টিতম্। কৃষ্ণ বুঝেছিলেন, সব বুঝেছিলেন। বুঝেছিলেন যে দুর্যোধনের যত মেজাজ, তা বোধহয় সবটাই কর্ণের জন্য। একটা সময় এল, যখন পুরুষোত্তম কৃষ্ণ কুরুসভার সমস্ত মানুষগুলিকে আপন ব্যক্তিত্বে বিমূঢ় করে দিয়ে কর্ণকে তুলে নিলেন আপন রথে— আরোপ্য চ রথে কর্ণং প্রায়াৎ সাত্যকিনা সহ। কুরুসভার ছেলে-বুড়ো সবাই জল্পনা কল্পনা করতে লাগল— কী হল, কৃষ্ণ কর্ণকে হঠাৎ তুলে নিয়ে গেলেন কেন— ব্যাপারটা কী?
॥ ১০ ॥
দৌত্য সেরে ফিরে যাবার সময় কৃষ্ণ কুন্তীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। বীরমাতার মতো কুন্তী এতকাল ধরে যে অবিচার হয়ে আসছে তাঁর ছেলেদের ওপর, সে সব কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। কুন্তী কৃষ্ণের মাধ্যমে পুত্রদের উত্তেজিত করার চেষ্টাও করেছেন। পাশা খেলার সময় কুরুসভায় পাঞ্চালীর ওপর যে ধর্ষণাত্মক ব্যবহার চলেছে তার প্রতিকার চেয়েছেন কুন্তী। কিন্তু মজা হল, এই সমস্ত অপমানগুলির কথা তিনি উল্লেখ করেছেন— কৌরব পক্ষের কারও নাম না করে। কারণ নাম করতে গেলেই সেখানে কর্ণের কথা আসবে। এ কী দ্বিধায় পড়েছেন কুন্তী! পুত্রবধূর ওপর যে অপমান হয়েছে তিনি তার প্রতিকার চান, অথচ এই মুহূর্তে তিনি দোষীদের নাম করতে পারছেন না; অন্যদিকে তিনি এ-ও বুঝতে পারছেন যে, যুদ্ধের সময় এগিয়ে আসছে, কৃষ্ণের শান্তির বাণী ব্যর্থ হয়ে গেছে। এখন কী হয়, কী হয়! কৃষ্ণ কুন্তীর কথা শুনে কী বুঝলেন কে জানে! তিনি হঠাৎ এসে কর্ণকে তুলে নিলেন নিজের রথে। নগরের বাইরে নির্জন প্রান্তে এসে রথ থামালেন। অনুগামী যদুবীরেরা দূরে তাঁর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন, শুধু কৃষ্ণ কর্ণকে নিয়ে পৌঁছলেন নগরের বাইরে। কর্ণের সঙ্গে আরম্ভ হল গভীর আলোচনা এবং তাও অনেকক্ষণ ধরে— মন্ত্রয়ামাস চ তদা কর্ণেন সুচিরং সহ।
কৃষ্ণের বলাটা ছিল অদ্ভুত। নরমে, গরমে, স্তুতিবাদে, টোপ ফেলে, সবরকমভাবে কৃষ্ণ কর্ণকে দুর্যোধনের থেকে বিযুক্ত করতে চেয়েছেন। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা, যে-কথাটা আজ পর্যন্ত তাঁকে কেউ বলেনি, সে-কথাটা কৃষ্ণ বললেন কী করে! কৃষ্ণ বললেন— কর্ণ! তুমি বিদ্বান এবং বিচক্ষণ মানুষ। সনাতন ধর্ম, বেদবাদ, ধর্মশাস্ত্র সবই তুমি জান এবং জান বলেই এখন যা বলছি, তা নিজের সঙ্গে মেলাতে তোমার অসুবিধে হবে না। কৃষ্ণ বললেন জান তো কর্ণ! শাস্ত্রকারেরা বলেছেন— পুরুষ যে মেয়েকে বিয়ে করে, সেই মেয়ের যদি অবিবাহিতা কুমারী অবস্থায় কোনও পুত্র থেকে থাকে, তা হলে বিবাহিত পুরুষটি সেই পুত্রেরও পিতা হয় অর্থাৎ একই স্ত্রীলোকের কুমারী এবং বিবাহিত অবস্থায় যতগুলি পুএই জন্মাক, সবগুলিরই পিতা হবেন পাণিগ্রহণকারী পুরুষটি। এই নিয়মে কর্ণ তুমি কিন্তু মহারাজ পাণ্ডুরই ছেলে— পাণ্ডোঃ পুত্রোহসি ধর্মতঃ— কারণ তুমি তোমার জননী কুন্তীর কুমারী কালের পুত্র।
কর্ণ একটুও চমকালেন না। সারা জীবন যাঁকে জন্মের লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়েছে, সারা জীবন যাঁকে সূতজাতির কলঙ্ক-পঙ্কে তিলক রচনা করে জীবনের পথে চলতে হয়েছে, তাঁকে আগেই সব জানতে হয়। গ্লানির মধ্যে যে সন্তানকে চলতে হয়, সে সন্তান নিজেই তার জন্ম রহস্য ভেদ করে। কর্ণও তাই সব জানতেন, সব জেনেও পাথর-প্রতিমার মতো স্থির হয়ে কেবলই সংসারের কূটবুদ্ধি যাচাই করতে লাগলেন। ভাবটা এই— আমি ছাড়া অন্যেও তা হলে কেউ জানে এ রহস্য, তবে এতকাল ধরে সূতপুত্রের গালাগালিটা কেমন ন্যাকামো। যাই হোক কৃষ্ণ বলতে থাকেন— নিয়ম অনুসারে কর্ণ তোমারই কিন্তু রাজা হওয়ার কথা— এহি রাজা ভবিষ্যসি। তা ছাড়া তোমার ‘ফ্যামিলি-প্রেস্টিজ’ কিছু কম নয়। তোমার পিতৃকুলে আছেন পাণ্ডবেরা, মাতৃকুলে আমি আমরা, বৃষ্ণিবংশের পুরুষেরা। তুমি ভাই আজকে আমার সঙ্গে চলো, তোমাকে তোমার পাঁচ ভাই সবার বড় দাদা বলে জানুক— অভিজানন্তু কৌন্তেয়ং পূর্বজাতং যুধিষ্ঠিরাৎ।
কর্ণ যদি ভাবেন এমনি উটকো গিয়ে পাণ্ডবদের ভাই ভাই করলে কেউ যদি ব্যঙ্গ-বক্রোক্তি করে, কৃষ্ণ তাই শত-শতাংশ কথা দিয়ে বললেন— আরে, সবাই তোমার পায়ে পড়ে যাবে, পাণ্ডবেরা পাঁচ ভাই তাদের ছেলেপুলেরা, এমনকী আমরাও তোমার পায়ে পড়ে থাকব— পাদৌ তব গ্রহীষ্যন্তি সর্বে চান্ধক-বৃষ্ণয়ঃ। উত্তেজনার আতিশয্যে কৃষ্ণ প্রস্তাব দিলেন— যে রাজারা আজকে পাণ্ডব পক্ষে যুদ্ধ করবার জন্য উপস্থিত হয়েছেন, তাঁরা বরঞ্চ তোমার অভিষেকের জোগাড় করুন, মাঙ্গলিক বিধান করুক রাজকন্যারা, আর দিনের ষষ্ঠভাগে যখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে প্ৰেমনত নয়নের দীর্ঘচ্ছায়াময় পল্লবের মতো তখন তিন ভুবনের সেরা সুন্দরী দ্রৌপদী এসে দেখা করুক তোমার সঙ্গে— ষষ্ঠে ত্বাং চ তথা কালে দ্রৌপদী উপগমিষ্যাতি।
কৃষ্ণ জানেন— দ্রৌপদীর ওপর কর্ণের লোভ ছিল। পরবর্তীকালে দ্রৌপদীর ওপর যত আক্রোশ দেখা গেছে কর্ণের, সেও দ্রৌপদীকে না পাওয়ার কারণেই। তবু যদি কর্ণের মনে এমন ভাবনা আসে যে— এতকাল তাকে পেলুম না, আর এখন এই মাঝ বয়সে এসে, যখন প্রেম প্রায়ই দাম্পত্য অভ্যাসে রূপান্তরিত হয়, এখন সেই প্রথম যৌবনের স্বপ্ন দেখানো— এতে কি যন্ত্রণা কিছু কমে, যন্ত্রণা আরও বাড়ে। কৃষ্ণ তাই কথা পরিবর্তন করে বললেন— তা হলে কী বলো, ধৌম্য পুরোহিত অভিষেকের মন্ত্র পড়ুন, আমরাও সবাই অভিষেকের জোগাড় করি। তোমার যুবরাজ হবেন যুধিষ্ঠির, তোমার পাশে দাঁড়িয়ে চামর দোলাবেন তিনি। তোমার মাথায় রাজচ্ছত্র ধরে দাঁড়িয়ে থাকবেন মহাবলী ভীমসেন, তোমার সাদা ঘোড়ার রথ চালাবেন স্বয়ং অর্জুন, আর আমরা সবাই থাকব তোমার অনুগামী হয়ে। সবার শেষে কৃষ্ণ বললেন— তুমি রাজা হও, নিজের রাজ্যপাট সামলাও আর তৃপ্ত করো জননী কুন্তীর পুত্রস্নেহাতুর হৃদয়খানি— প্রশাধি রাজ্যং কৌন্তেয় কুন্তীঞ্চ প্রতিনন্দয়,— দূর হোক সমস্ত শত্রুতা, ভাই ভাই মিলে যাক।
খট করে কর্ণের কানে বাজল— ‘কৌন্তেয়’। এতকাল তো কেউ তাঁকে কুন্তীর ছেলে বলে ডাকেনি, সবাই বলেছে রাধেয়— রাধার ছেলে। সারা জীবন লাঞ্ছনা সয়ে আজকে যদি হঠাৎ কুন্তীর ওপর সোহাগে মা মা বলে ডেকে ওঠেন কর্ণ, তবে সে আদিখ্যেতা বুঝি তাঁর নিজেরই সইবে না। কর্ণ বললেন— আজকে তুমি ভালবেসে, আপন সখার মতো আমার ভাল চেয়ে যা কিছু বললে, সে সব আমি জানি— সর্বঞ্চৈব অভিজানামি। আমি জানি, আমি পাণ্ডুর ছেলে— পাণ্ডোঃ পুত্রোহস্মি ধর্মতঃ। আমি জানি আমার জননী কুন্তীর কুমারী কালের গর্ভে ভগবান ভাস্করের ঔরসে আমার জন্ম। আমি জানি, হ্যাঁ জানি যে, সূর্যদেবের কথামতই আমার জননী আমাকে বিসর্জন দিয়েছিলেন— আদিত্যবচনাচ্চৈব জাতং মাং সা ব্যসর্জয়ৎ। কিন্তু আমার মা কী ভেবে কোন মঙ্গলের জন্য আমাকে বিসর্জন দিলেন— যথা ন কুশলং তথা? কাজেই ধৰ্মত পাণ্ডুর ছেলে হওয়া সত্ত্বেও, মায়ের প্রথম ছেলে হওয়া সত্ত্বেও, আমি যদি মায়ের প্রথম সন্তানকামী হৃদয় থেকে তাঁরই ইচ্ছায় মুছে গিয়ে থাকি,— কুন্ত্যা ত্বহম্ অপাকীর্ণঃ— সেখানে আজ হঠাৎ তাঁকেই মা মা বলে সোহাগ দেখানো আদিখ্যেতা নয় কি?
কর্ণের এই অভিমান স্বাভাবিক। আগেই বলেছি কর্ণের জীবনে দুটি নারীর বিশেষ ভূমিকা আছে এবং সে ভূমিকা তাঁর জীবন জটিলতর করার। দ্রৌপদী কর্ণের যৌবনের স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছেন, তাঁর ওপরে আক্রোশ দেখিয়ে। অন্যদিকে সেই দ্রৌপদীকে অপমান করে, কর্ণের আক্রোশ খানিকটা প্রশমিত হয়েছে নিশ্চয়। কিন্তু জননী কুন্তী, তাঁকে যে অপমানও করা যায় না আবার সওয়াও যায় না। কর্ণ বললেন— সূত অধিরথ আমাকে এনে জননী রাধার হাতে দিয়েছিলেন। আমাকে দেখামাত্র সূতজননীর-স্নেহস্তন্য আপনি ঝরে পড়েছিল— সদ্যঃ ক্ষীরমবাতরৎ। তিনিই শৈশব অবস্থায় আমার গু-মুত কেচে মানুষ করেছেন— সা মে মূত্রপূরীষঞ্চ প্রতিজাগ্রহ মাধব। সব বুঝে-সুঝে আজকে হঠাৎ আমি তাঁর ঋণ মুক্ত হয়ে চলে যাই কী করে? তা ছাড়া সেই যে সূত অধিরথ, তাঁকেই তো আমি পিতা বলে জানি। তিনি পিতার মতো জাতকর্ম, অন্নপ্রাশন সব করিয়েছেন, যৌবনে মেয়ে খুঁজে খুঁজে বিয়ে দিয়েছেন। সেই বিবাহিতা স্ত্রীদের গর্ভে আমার তো ছেলে-পিলেও আছে। আমার সেই পরিণীতা স্ত্রীদের আমি ভালবাসি, কৃষ্ণ— তাসু মে হৃদয়ং কৃষ্ণ সঞ্জাতং কামবন্ধনম্। কর্ণের ভাবটা এই যে, এতকালের বিয়ে-করা বউ যাঁরা, যাঁরা এতদিন যৌবনের ভোগ, সুখ, আনন্দ— সব দিয়েছেন, হঠাৎ তাঁদেরকে নীচে ঠেলে বড় ঘরের সুন্দরী বউ দ্রৌপদীকে যদি আজকে বড় আপনার বলে মনে করি, তা হলে আমিই তো আমি থাকি না। সারথির ঘরে আমি লালিত, সারথির ঘরে আমার বিয়ে, সারথির ঘরের নীতি-নিয়ম আমার মজ্জায় মজ্জায়। কাজেই আজ আর ফিরে যাবার পথ নেই।
কর্ণ-চরিত্রের পক্ষে এই সময়টা হল একদিকে ভীষণ সঙ্কটপূর্ণ, অন্যদিকে সঙ্কট মোচনের এক চূড়ান্ত বিন্দু। মহাভারতের কবি এতদিন তাঁকে জন্মের লাঞ্ছনায় ভুগিয়ে, দুর্যোধনের মতো দুঃসঙ্গে পুষ্ট করে, লোভ, হিংসা, ঈর্ষা আর অহমিকায় বর্ধিত করে, সমস্ত নীতি-পরায়ণ মানুষদের কাছ থেকে একেবারে একাকিত্বে এনে ফেলেছেন। মিথলজিষ্টদের ভাষায় একে ‘হেরোইক আইসোলেশন’ বলব কিনা জানি না, তবে ‘আইসোলেশন’ তো বটেই। এই ‘আইসোলেশন’-এর বড় প্রয়োজন ছিল কর্ণের চূড়ান্ত মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য। হিংসা-প্রতিহিংসার অন্তরে কর্ণ যে কতবড় মানুষ, সেটা বুঝি প্রতিতুলনায় প্রতিষ্ঠা করার জন্যই এতদিন কর্ণের গায়ে শত কালিমা লেপন করা হয়েছে। ঠিক এই অংশে এসে মহাভারতের কবি তাঁর কবি-হৃদয়ের সমস্ত সম্মান উজাড় করে দিয়েছেন কর্ণের জন্য। সত্যি কথা বলতে কি, কৃষ্ণের কথায় প্রণয় ছিল, সৌহার্দ্য ছিল, সান্ত্বনাও ছিল, কিন্তু সেই সঙ্গে ছিল কিছু প্যাঁচও। ইঙ্গিতজ্ঞ কর্ণ সে প্যাঁচ বুঝেছেন এবং সেইখানেই তাঁর মাহাত্ম্য। অনেক কথার মাঝে কৃষ্ণ বলেছিলেন— তোমায় আমরা সবাই মিলে রাজার আসনে বসাব, যুধিষ্ঠির হবেন তোমার যুবরাজ— যুবরাজস্তু তে রাজা ধর্মপুত্রো যুধিষ্ঠিরঃ। কর্ণ বললেন— আমার এই ছোট সংসারের মোহগণ্ডী পেরিয়ে আমার আর ফিরে যাবার উপায় নেই কৃষ্ণ। আমি চাই, তুমিও আমার এই জন্মের রহস্য এতকাল পরে আর ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের সামনে প্রকাশ কোরো না। তাঁকে যতটুকু জানি, তাতে সেই ধর্মভীরু মহাত্মা যদি জানতে পারেন যে, আমিই কুন্তীর বড় ছেলে, তা হলে কিছুতেই তিনি আর রাজা হবেন না। আর আমার দিক থেকে বিপদ হল, আমি রাজা হলে কখনও-ই যুধিষ্ঠিরকে যুবরাজ করতে পারব না, রাজা তো তিনি হবেনই না। আমি রাজা হলে এই সমৃদ্ধ সম্পূর্ণ রাজ্য আমাকে তুলে দিতে হবে দুর্যোধনের হাতে— স্ফীতং দুর্যোধনায় এব সম্প্রদদ্যামরিন্দম। তাই বলি, যুধিষ্ঠির রাজা আছেন, তিনিই রাজা থাকুন।
কুরুক্ষেত্রে যে যুদ্ধ ঘটতে যাচ্ছে কর্ণ তার ফল জানেন। কর্ণ জানেন যে, সে যুদ্ধে জয়ী হবে পাণ্ডব পক্ষই। জীবন মৃত্যুর সন্ধিলগ্নে দাঁড়িয়ে কর্ণ আজ কৃষ্ণের কাছে স্বীকার করেছেন— আমি এতকাল পাণ্ডবদের যে জঘন্য কটু কথা শুনিয়েছি, তা সবই দুর্যোধনকে তুষ্ট করার জন্য এবং সে জন্য আমার অনুতাপও আছে— প্রিয়ার্থং ধার্ত্তরাষ্ট্রস্য তেন তপ্যে হ্যকর্মণা। কর্ণ বললেন— যে যুদ্ধ হতে যাচ্ছে, সে যুদ্ধ হবেই। এ যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দেওয়াটাই আমার আনন্দ। তুমি যাও, কৃষ্ণ! সমস্ত রহস্য যা তুমি জান, চেপে রাখো নিজের মধ্যে। নিয়ে এসো কুন্তীপুত্র অর্জুনকে, যার সঙ্গে যুদ্ধ হবে আমার— সমুপানয় কৌন্তেয়ং যুদ্ধায় মম কেশব।
কৃষ্ণ যেন এবার একটু শাসনের সুরে কথা বললেন। যুদ্ধের সময়ে পঞ্চপাণ্ডব যে তীক্ষ্ণ, তীক্ষ্ণতর হবেন এবং সে তীক্ষ্ণতা থেকে যে রক্ষা নেই কর্ণের, রক্ষা নেই কুরুকুলের কারও— সে কথাটাও বুঝিয়ে দিলেন বেশ করে। কর্ণ একটুও ভয় পেলেন না, উলটে রীতিমতো জ্যোতিষ-চর্চা করে বুঝিয়ে দিলেন— জয় হবে পাণ্ডবদেরই, কৌরবদের নয়। কর্ণ দুঃস্বপ্নে দেখেছেন একে একে কৌরবের সব সেনাপতি অর্জুনের গাণ্ডীবের আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে। এই স্বপ্ন কর্ণ সত্য বলেই মনে করেন। তিনি একদিকে স্বীকার করেন যে, ভারত যুদ্ধের নিমিত্ত কারণ তিনি নিজে, দুঃশাসন এবং শকুনি এবং অন্য দিকে মরণের মুখে ঝাঁপ দিয়ে কৃষ্ণকে বলেন— অন্তকালে আবার দেখা হবে তোমার সঙ্গে স্বর্গভূমিতে— অথ বা সঙ্গমঃ কৃষ্ণ স্বর্গে নো ভবিতা ধ্রুবম্।
আচ্ছা, আমরা যদি এমন একটা কাল্পনিক ব্যবস্থা করি যে, কর্ণ কৃষ্ণের কথা শুনে, পঞ্চপাণ্ডবকে নিজের ভাই বলে মেনে পাণ্ডব শিবিরে রাজা হতে এসেছেন, তা হলে ব্যাপারটা কীরকম হত! হ্যাঁ, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির হয়তো সূক্ষ্ম ধর্মজ্ঞানে তক্ষুনি তাঁকে শাসিতার আসন ছেড়ে দিতেন, কিন্তু ধরুন ভীমের কথা। যে ভীমের খাওয়া নিয়ে, বুদ্ধি নিয়ে, চলা-বলা, সব নিয়ে এতকাল দুঃশাসন-দুর্যোধনের সঙ্গে গলা মিলিয়ে হেসেছেন, সে নাকি তাঁর আপন ভাই, তাঁকে তিনি মুখ দেখাবেন কী করে? যে অর্জুনের সঙ্গে চিরকাল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এসেছেন, যে তাঁর বিবাহের প্রথম গ্রাসটি কেড়ে নিয়েছে, যাঁর বিবাহিতা পত্নীকে তিনি সবার মধ্যে উলঙ্গ করার আদেশ দিয়েছেন, সে নাকি তাঁর আপন ভাই, তাঁকে তিনি মুখ দেখাবেন কী করে? সবার ওপরে দ্রৌপদী, প্রথম প্রেমেই যে তাঁকে বিবাহ করতে প্রত্যাখ্যান করেছে, যে প্রত্যাখ্যানের আক্রোশে প্রথম সুযোগেই তিনি যাঁকে ‘বেশ্যা’ বলে চিহ্নিত করেছেন, যাঁর সঙ্গে কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করে ব্যবহারও করেছেন বেশ্যার মতো, সে নাকি তাঁর স্ত্রী, তাঁকে তিনি মুখ দেখাবেন কী করে? তাই আমরা বলি কি— দুর্যোধনের প্রতি নিষ্ঠাবশত বন্ধুকৃত্য করবার জন্য তো বটেই, এমনিতেও পাণ্ডব শিবিরে দাদা বলে উপস্থিত হওয়ার মতো মানসিক প্রস্তুতি কর্ণের ছিল না, কিংবা সেটা বাস্তবসম্মতও ছিল না। বেঁচে থেকে এই রকম বিপ্রতীপ বাস্তবতার সম্মুখীন হওয়ার চেয়ে, মরণও তাঁর কাছে শ্রেয় ছিল, তাই কর্ণ মরতেও চেয়েছেন, দুর্যোধনের পক্ষে থেকে বিরোধিতার প্রদর্শনী করে মরতে চেয়েছেন।
ওদিকে আরেক বিপদ হল। কুরুসভা থেকে কৃষ্ণ চলে যাবার পর পরই মহামতি বিদুর এসে উপস্থিত হলেন কুন্তীর ঘরে। তিনি এসেই আপন মনে গজরাতে লাগলেন— আর কি, যুদ্ধ লেগে গেল বলে। এই দুর্যোধন কারও কথা শোনে না, ধৃতরাষ্ট্রের আস্কারায় একেবারে মাথায় উঠে গেছে। তার মধ্যে জয়দ্ৰথ, কর্ণ, দুঃশাসন, শকুনি— এরা সবাই কুবুদ্ধি দিয়ে উসকে দিচ্ছে দুর্যোধনকে। ব্যস, বিদুরের সমালোচনায় অনেকগুলো নাম শোনা গেল বটে, তবে কুন্তীর কর্ণশূল উৎপাদন করার জন্য একটা নামই ছিল যথেষ্ট— কর্ণ। তাঁর নিঃশ্বাস দৃঢ়তর হল, দুঃখ গভীরতর। পাঁচটি অভব্য ছেলের মধ্যে নিজের ছেলের অভব্যতাই যেমন জননীর বুকে বাজে, ঠিক সেই ভাবেই কুন্তী মনে মনে বলতে লাগলেন— দুর্যোধনের সঙ্গে থেকে থেকে ছেলেটা আমার বয়ে গেল। যুদ্ধ লাগলে কী অনর্থই না ঘটবে। ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ— এঁরা সবাই দুর্যোধনের পক্ষ হয়ে লড়বেন বটে কিন্তু আচার্য দ্রোণও তাঁর পরম প্রিয় শিষ্যদের গায়ে হাত তুলবেন না, ভীষ্মও এড়াতে পারবেন না পাণ্ডুর ঘরের নাতিদের ওপর তাঁর স্নেহ। কিন্তু মুশকিল করেছে ওই কর্ণ। দুর্যোধনের সঙ্গে পড়ে তারই মোহে সে নিজের ভাই পাণ্ডবদের সঙ্গে ঝগড়া করে যাচ্ছে। ছেলের ক্ষমতাও আছে যথেষ্ট কিন্তু সেই ক্ষমতার জোরে সে অনর্থে মন দিয়েছে। তা এতদিন যা করেছে, করেছে, কিন্তু সে যে পাণ্ডবদেরই চরম সর্বনাশে মন দিয়েছে, এতেই আমার মন পুড়ে যাচ্ছে।
॥ ১১ ॥
কুন্তী ঠিক করে ফেললেন। এতদিন যা বলেননি, এবার তা বলতে হবে। কুন্তী ভাবলেন— আমি সব গুছিয়ে বলব। ভগবান ভাস্করের কথা, দুর্বাসার মন্ত্র-কথা, কর্ণের জন্ম, তাকে বিসর্জন— সব গুছিয়ে বলব। সে আমার কুমারী গর্ভের ছেলে, হাজার হোক আমি তো তাকে পেটে ধরেছি। সে আমার মুখ চেয়ে, ভাইদের হিতের দিকে তাকিয়ে নিশ্চয় আমার কথা শুনবে— কস্মান্ন কুর্যাদ্ বচনং পশ্যন্ ভ্রাতৃহিতং তথা। মনে মনে সব ঠিক করে কুন্তী যখন কর্ণের কাছে পৌঁছলেন, তখন অপরাহ্ন হয়ে এসেছে প্রায়। কর্ণ তখনও বেদ মন্ত্রে স্তুতি করে যাচ্ছেন সূর্যদেবকে। সূর্যের তাপ আজ বড় প্রখর। জননী কুন্তীকে প্রখর মধ্যাহ্নসূর্য মাথায় বয়ে আসতে হয়েছে। শুষ্ক পদ্মমালার মতো মুখ-চোখ শুকিয়ে গিয়েছিল তাঁর। ভাগীরথীর তীরে পুবমুখী কর্ণের সূর্যবন্দনা দেখে কুন্তী অপেক্ষা করতে লাগলেন। শ্বেতশুভ্র আঁচলখানি দিয়ে সূর্যের কিরণ থেকে কেবলই তিনি আড়াল করে রাখছিলেন নিজেকে— অতিষ্ঠদ..উত্তরবাসসি। হয়তো কন্যাবস্থার এই নায়ককে অতি তাপযুক্ত দেখলে এখনও কুন্তীর বড় লজ্জা করে। সূর্য কিরণের স্পর্শ অন্য কোনও গভীর অনুভূতি বয়ে নিয়ে আসে বুঝি। তাই হয়তো উত্তরীয়ের আড়াল খোঁজা। মধ্যাহ্ন কেটে গিয়ে যেই সূর্য পুবমুখী বসা কর্ণের পিঠের ওপর পড়ল, ওমনি বুঝি অপরাহ্নের ঘণ্টা বেজে কর্ণের সূর্য-পূজা শেষ হল— আপৃষ্ঠতাপাদ্ জপ্ত্বা সঃ। তিনি পশ্চিম দিকে ঘুরে বসতেই দেখেন— কুন্তী। বিস্ময়ে, আনন্দে, অভিভূত কর্ণ অভিবাদন জানালেন কুন্তীকে। কর্ণ এই চেয়েছিলেন। তিনি মায়ের পরিচয় জানা সত্ত্বেও আপনা আপনি গিয়ে সোহাগী হবেন না, মাকেই একদিন আসতে হবে তাঁর কাছে। মা এসেছেন। কর্ণ বললেন— আমি রাধা মায়ের ছেলে, অধিরথের ছেলে, কর্ণ। আমার প্রণাম গ্রহণ করুন ভদ্রে-রাধেয়োহহম্ আধিরথিঃ কর্ণস্ত্বাম্ অভিবাদয়ে। বলুন আপনার জন্য আমি কী করতে পারি— ব্রুহি কিং করবাণি তে।
একেবারে ‘অফিসিয়াল’ কথা, এতটাই ‘অফিসিয়াল’ যে কুন্তী আর কোনও ভণিতা করার সময় পেলেন না। একেবারে প্রথম আক্ষেপেই তাঁকে বলতে হল— না, বাবা, না। তুমি রাধার ছেলে নও, কুন্তীর ছেলে— আমার ছেলে। অধিরথ তোমার বাবা নন, তুমি মোটেই সারথি ঘরের ছেলে সূতপুত্র নও। তুই আমার কোল-ছেঁচা ধন, আমার প্রথম ছেলে। আমার বিয়ে হয়নি, তখন তুই জন্মেছিলি। তাও এখানে নয়, সেই কুন্তিভোজ রাজার ঘরে। এই যে সূর্যদেব, সব কিছু প্রকাশ করাই যাঁর কাজ, তিনিই তুই হয়ে আমার পেটে এসেছিলি। সহজাত কবচ-কুণ্ডল ধারণ করে তুই আমার বাবার ঘরে থাকতেই জন্মেছিলি আমার কোলে। আর আজ নিজের ভাইদেরই তুই চিনিস না। ভাইদের ছেড়ে যে মোহে তুই দুর্যোধনের সেবা করছিস, সে ঠিক হচ্ছে না বাছা। বাপ-মাকে সন্তুষ্ট করা ছেলের কাজ। তুই বাবা ফিরে আয় পাণ্ডবের ঘরে। যে বিপুল সম্পত্তি একদিন অর্জুন দিগ্বিজয়ে জিতে এনেছিল, সে সম্পত্তি এখন ছলনার গ্রাসে দুর্যোধনের ঘরে। তুই সম্পত্তি ফিরিয়ে এনে ভাইদের সঙ্গে ভোগ কর। পৃথিবী আজ দেখুক, দুই বিরোধী গোষ্ঠীর শ্রেষ্ঠ দুই বীর কর্ণ আর অর্জুন আজ এক জায়গায়। ঠিক যেমনটি যাদবদের ঘরে বলরাম আর কৃষ্ণ, তেমনি আমাদের ঘরে কর্ণ আর অর্জুন— কণার্জুনৌ বৈ ভবেতাং যথা রামজনার্দনৌ। তুই আমার সবার বড় ছেলে, সমস্ত গুণে গুণী। এতকাল যে সূতপুত্র বলে তোকে ধিক্কার করেছে লোকে, দূরে যাক সেই শব্দ— তুই পার্থ। পৃথার ছেলে— সূতপুত্রেতি মা শব্দঃ পার্থত্ত্বমসি বীর্যবান্।
সহৃদয় পাঠক! আমাদের কর্ণ চরিত্র বিশ্লেষণের এই অংশে কবিগুরুর কর্ণ-কুন্তী সংবাদ স্মরণ করিয়ে দিলেই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু মনে রাখা দরকার, মহাভারতের কমলকলি থেকে এক মহাকবির হৃদয়ের মধু সঞ্চিত করে যে মধুকর বাংলা কবিতায় তা ছড়িয়ে দিয়েছেন, তার মধ্যে সহজ, সরল কর্ণ গেছেন হারিয়ে। রবীন্দ্রনাথ যেমন মহাভারতের কর্ণ-কুন্তী সংবাদ থেকে তাঁর কাব্যতথ্য সঞ্চয় করেছেন, তেমনি কৃষ্ণ-কর্ণ সংবাদের অনেক জিনিসও এসে গেছে বাংলায় কর্ণ-কুন্তী সংবাদের মধ্যে। তার ওপর আছে কবির আপন মনের মাধুরী। মহাভারতের কর্ণ কুটিল ব্যঞ্জনায়, গূঢ় ভাবের অভিব্যক্তিতে কুন্তীকে জর্জরিত করেননি, বরঞ্চ তাঁর মর্মে আঘাত করেছেন একেবারে সোজাসুজি। এমনকী কুন্তী আপন সচেতন বক্তব্য বুঝিয়ে বলার পর ভগবান ভাস্কর সেই আকাশ থেকেই কুন্তীকে সমর্থন জানিয়ে কর্ণকে মায়ের কথা শুনতে বলেছিলেন, কিন্তু কর্ণের অবস্থা তাতে কিছু পালটায়নি। পিতার দ্বিতীয়া বিবাহিতা পত্নীকে মাতৃহীন বয়স্ক যুবক যেমন অদ্ভুত চোখে দেখে, যেমন চাঁচাছোলা কথা বলে, ঠিক তেমনিভাবে কর্ণ উত্তর দিলেন কুন্তীকে।
কর্ণ বললেন— আমি আপনার কথায় একটুও পাত্তা দিই না— ন চৈতৎ শ্ৰদ্দধে বাক্যম্। আপনার কথামত কাজ করলে ধর্ম তো দূরের কথা, অধর্ম হবে আমার। আপনি যে অন্যায় পাপ আমার জন্মলগ্নেই আমার ওপর করেছিলেন, তার জন্যেই আজকে আমি নিজেকে ক্ষত্রিয় বলে পরিচয় দিতে পারি না। আপনি সেদিন আমাকে বিসর্জন দিয়ে, সমস্ত দুর্নামের ভাগী করেছেন আমাকে— অপাকীর্ণোহস্মি যন্মাতস্তদ্ যশঃ কীর্তিনাশনম্। আমি ক্ষত্রিয় হয়ে জন্মেছিলাম, কিন্তু আপনার জন্যেই আমি কোনও ক্ষত্রিয়ের সংস্কার লাভ করতে পারিনি, আপনি ছাড়া অতি বড় কোনও শত্রুও আমার এত বড় ক্ষতি করত না— ত্বৎকৃতে কিন্নু পাপীয়ঃ শত্ৰুঃ কুর্যান্ মমাহিতম্। যে সময়ে আমার ক্ষত্রিয়োচিত জাতকর্মাদি সংস্কার করা উচিত ছিল, সে সময় আপনি কিচ্ছুটি করেননি, এখন আপনি আপনার নিজের কাজের জন্য আমাকে অনুরোধ করছেন। কই, আগে তো আপনি মায়ের মতো কোনও স্নেহ-ব্যবহার করেননি, আর আজকে নিজের কাজ গুছোনর জন্য খুব ভালভালাই করে ‘ছেলে ছেলে’ বলে ডাকছেন— সা মাং সম্বোধয়সি অদ্য কেবলাত্মহিতৈষিণী।
কুন্তী ভাবতেও পারেননি, এতটা ফিরে পাবেন। তিনি ভেবেছিলেন— কর্ণকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলে, পুত্রের কর্তব্য স্মরণ করালেই সে তাঁর শূন্য বুকে ফিরে আসবে। কিন্তু জন্ম-না-জানা পুত্রের দুঃখটা যে কী, তা তাঁর পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না। বস্তুত কর্ণের কথা এখনও শেষ হয়নি। তিনি বললেন— অর্জুন আর কৃষ্ণ এক জায়গায় হলে কে না ভয় পায়? কিন্তু আজকে যদি আমি অর্জুন-কৃষ্ণের গুষ্টিতে যোগ দিই, তা হলে লোকে আমাকেও ভিতু ভাববে। তা ছাড়া বাপের জন্মে যার ভাই-বেরাদর বলে কিছু ছিল না, হঠাৎ যুদ্ধের সময় তার পাঁচ পাঁচটা পাণ্ডব ভাই ভুঁইফোড়ের মতো উদয় হল, আর আমিও ‘ভাই ভাই’ করে হামলে পড়লাম— এ-কথা শুনে ক্ষত্রিয়-সুধীজনেরা বলবেটা কী— অভ্রাতা বিদিতঃ পূর্বং যুদ্ধকালে প্রকাশিতঃ। পাণ্ডবান্ যদি গচ্ছামি কিং মাং ক্ষত্রং বদিষ্যতি।
কর্ণের আর একটা পয়েন্ট আছে, সেটা হল বাস্তবতার কথা। তাঁর কথা হল পাণ্ডবপক্ষে গেলে তাঁর বাড়-বাড়ন্তটা নতুন করে কী হবে? একথা তিনি কৃষ্ণকেও বলেছেন, কুন্তীকেও বললেন। তিনি কৃষ্ণকে বলেছিলেন— ধৃতরাষ্ট্রের কুলে দুর্যোধনের ছত্র-ছায়ায় থেকে এই তেরোটা বছর আমি রাজার মতো নিষ্কণ্টক রাজ্যভোগের সুখই পেয়েছি— ময়া এয়োদশ সমা ভুক্তং রাজ্যম্ অকণ্টকম্,— সেই দুর্যোধন যখন এই যুদ্ধে আমার ওপরেই ভরসা করছে, তখন তাঁকে আমি বঞ্চনা করতে পারি না— অনৃতং নোৎসহে কর্ত্তুম্। আজকে কর্ণ কুন্তীকে একই কথা বললেন— ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা আমাকে যথেষ্ট সম্মান দিয়েছে, যে সম্মান কেউ দেয়নি সেই সম্মান দিয়েছে, আমার কোনও ইচ্ছেই তারা না পুরিয়ে রাখেনি— সর্বকামৈঃ সংবিভক্তঃ পূজিতশ্চ যথাসুখম্। সেই ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা, যারা এখন আমার ওপর ভরসা করে যুদ্ধে নেমেছে, তাদের আমি ফেরাব কী করে? এ হয় না, হতে পারে না। বরঞ্চ সময় এসেছে, যতটা তারা করেছে, তার কিছুটা ফিরিয়ে দেবার।
ইঙ্গিতটা কুন্তীর দিকেই। তুমি কিছু করনি, তোমাকে ফিরিয়ে দেবারও কিছু নেই। বস্তুত পিতা-মাতা যে বাল্যকালে অসহায় শিশুর মূত্র-পুরীষ ঘেঁটে পুত্রকে মানুষ করেন, সেই সময়েই নিজের কাছে তাঁরা পুত্রের ঋণ তৈরি করে দেন। পুত্র বড় হয়ে পিতামাতার কাছে তাঁর জন্ম-ঋণ শোধ করতে না পারলেও, কিছুটা শোধ করতে পারে— তাঁদের সেবা করে, তাঁদের ইচ্ছাপূরণ করে। কিন্তু এক্ষেত্রে কুন্তী সে দাবি তো করতে পারেনই না এবং সেই সব বড় বড় কথা বলার তাঁর এক্তিয়ারই নেই, যা অন্য সাধারণ মা-বাবাও বলতে পারে। বিশেষত তিনি যে বলেছিলেন, পিতা-মাতার কথা পুত্রের শোনা উচিত— সে কথার যথার্থতা নস্যাৎ হয়ে যায় কর্ণের যুক্তিতে। কর্ণ বললেন— যুদ্ধ আমাকে করতেই হবে। আপনার কথাগুলি খুব যথার্থ, খুব মিষ্টি বাণীর মতো শোনাচ্ছে বটে, কিন্তু আপনি যা বলছেন তা আমি কিছুতেই করব না— ন করোম্যদ্য তে বচঃ।
কর্ণের জেদ চেপে গেল। কৃষ্ণও তাঁকে একই কথা বলেছিলেন, কিন্তু তাঁর বলার ভঙ্গির জন্যই হোক কিংবা তিনি অন্য লোক বলেই হোক, কর্ণ তাঁর সঙ্গে অতি মধুর ব্যবহার করেছিলেন। আলোচনা চলেছিল সৌহার্দ্যের সূত্র ধরে। কিন্তু এতদিন পরে নিজের মাকে সামনে পেয়েও তাঁকে তিনি ভালবাসতে পারলেন না। উলটে ফেটে পড়লেন ক্রোধে। ক্রোধের কারণও বুঝি ছিল। সত্যি কথা বলতে কি, কুন্তী যে এখনও কর্ণের কাছে উপস্থিত হয়েছেন, সেও যে বড় জননীর মমতা-রসে, তা নয়। এখানেও তাঁর স্বার্থবুদ্ধি কিছু ছিল। তা ছাড়া একেবারে জন্মলগ্নেই যে ছেলেকে বিসর্জন দিয়েছেন, তার প্রতি মমত্বও তাঁর সেইভাবে জন্মায়নি, যা দিন-প্রতিদিনের অভ্যাসে, ব্যবহারে জন্মায়। এখানে তাঁর শুধু এই স্বার্থবোধ কাজ করছে যে, কৌরবপক্ষের সাধারণ অন্য কারও পক্ষে ভীম-অর্জুনদের মারাই সম্ভব নয়। ভীষ্ম এবং দ্রোণ, পুত্র কিংবা শিষ্য-স্নেহের কারণে খানিকটা হাত গুটিয়ে থাকবেন। যদিও তাঁদের হত্যা করার ক্ষমতা ছিল। কিন্তু কর্ণের তো সে সব বালাই নেই, সে সুযোগ পেলেই অর্জুন কিংবা ভীমকে হত্যা করবে, বিশেষত অর্জুনের সঙ্গে তাঁর চিরকালের টক্কর। এই অবস্থায় আপন পাঁচ পুত্রকে খানিকটা বিপন্মুক্ত করতেই কর্ণের কাছে কুন্তীর আসা। এই স্বার্থবুদ্ধি অতি কূটস্থ হলেও কুন্তীর অন্তরে তা ছিল এবং কর্ণ বুঝি তা বুঝতে পেরেছিলেন। কর্ণ হাজার হলেও বীর, হাজার হলেও দাতা, অতএব এতকাল পরে ফিরে-পাওয়া মাকে তিনি খালি হাতে ফিরে যেতে দেননি। বললেন— তোমার এই চেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হবে না। আমি কথা দিচ্ছি, অর্জুন ছাড়া যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল, সহদেব— এদের কাউকেই আমি মারব না, অসহ্য হলেও না। কিন্তু অর্জুনকে হয় আমি মারব, নইলে তার মতো বীরের হাতে মৃত্যুবরণ করে যশের ভাগী হব। তবে হ্যাঁ তোমার পাঁচ ছেলে, পাঁচটাই থাকল— হয় অর্জুন থাকবে না, আমি থাকব। নয়তো আমি থাকব না, অর্জুন থাকবে— নিরর্জুনা সকর্ণা বা সার্জুনা বা হতে ময়ি।
এই এতক্ষণে বোধহয় কুন্তীর স্বার্থবুদ্ধি কিছুটা লুপ্ত হল। আপন পুত্রের পরুষ-পৌরুষ বাক্যে এবার হয়তো তিনি খানিকটা বুঝলেন যে, শুধু বাক্য দিয়ে জননীত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায় না। সারা জীবন লাঞ্ছিত পুত্রের অভিমান বুঝে এবারে তাঁর বুক ভেঙে কান্না এল। ভাবী যুদ্ধফল প্রত্যক্ষ করে তিনি দুঃখে কাঁপতে থাকলেন— কুন্তী দুঃখাৎ প্রবেপতী। মনে মনে পুত্রস্থানে অর্জুন-কর্ণের ব্যক্তি পরিবর্তন করে কর্ণকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন— সবই আমার কপাল— দৈবন্তু বলবত্তরম্। চার ভাইয়ের জীবন সম্বন্ধে অভয় পেলাম তোর কাছে, এখন তোদের দু’জনের মধ্যে কে থাকে, কে জানে। তোর ভাল হোক বাবা, তোর মঙ্গল হোক। মাতা-পুত্রের একবার মাত্র আলিঙ্গনের পর দু’জনে দু’জনের পথ ধরলেন। যুদ্ধের ভেরী বেজে উঠল।
কর্ণ-কুন্তী সমাগম সংবাদ কেউ জানল না। যুদ্ধের সাজ-সাজ রবে পাণ্ডব-কৌরব সকলেই ব্যস্ত। এরই মধ্যে পিতামহ ভীষ্ম সেনাপতির পদে বৃত হলেন। কিন্তু সেনাপতি হলে হবে কী, কুরুপক্ষে ভীষ্ম আর কর্ণের পুরনো ঝগড়াটা মোটেই মেটেনি। ভীষ্ম কিছুতেই কর্ণের সঙ্গে এক রণক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে রাজি ছিলেন না। তাঁর স্পষ্ট মত ছিল— হয় কর্ণ আগে যুদ্ধ করুন, নয়তো আমি— কর্ণো বা যুধ্যতাং পূর্বমহং বা পৃথিবীপতে। এরই মধ্যে একদিন কুরুকুলের রাজবাড়িতে বসে সমস্ত যোদ্ধারা কৌরবকুলের প্রধান যোদ্ধাদের বলাবল নির্ধারণ করছিলেন। সেনাপতি হিসেবে এ ক্ষেত্রে ভীষ্মকেই প্রশ্ন করে মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল। ভীষ্ম হিসেব-নিকেশ ভালই করেছিলেন। প্রতিপক্ষের সৈন্য কে কত ক্ষয় করতে পারে, এই নিয়মে কৌরবপক্ষের প্রধান পুরুষদের কাউকে ‘রথ’, কাউকে ‘অতিরথ’, কাউকে বা ‘মহারথ’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন ভীষ্ম। ক্ৰম অনুসারে ভীষ্ম দুর্যোধনের দুটি নাম-না-জানা ভাইকেও ‘রথ’ আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু কর্ণের কথা উঠতেই ভীষ্ম দুর্যোধনকে বললেন,— বললেন এইজন্যে যে, এখন তাঁর মওকা, তিনি সেনাপতি,— ভীষ্ম বললেন— তবে, তোমার যে পরাণের বন্ধু কর্ণ— সখা তে দয়িতো নিত্যং, সে কিন্তু ‘রথ’ও নয়, ‘অতিরথ’ও নয়। সে তোমাকে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য সব সময় উসকে দিচ্ছে বটে, কিন্তু আসলে ও মানুষটা বাক্যি দেয় বেশি এবং তার স্বভাবও অত্যন্ত নীচ। এই বৈকৰ্ত্তন কর্ণ তোমাকে চালনা করে। তোমার বুদ্ধিদাতা মন্ত্রীও সে বটে। কিন্তু মনে রেখো সে ‘রথ’ও নয়, ‘অতিরথ’ও নয়— এষ নৈব রথঃ কর্ণো ন চাপ্যতিরথো রণে।
বৈকৰ্ত্তন কর্ণ। কথাটার মধ্যে ইঙ্গিত আছে। সহজাত কবচ আর কুণ্ডল নিজের গা থেকে কেটে দিয়েছিলেন বলেই, কর্ত্তন করে দিয়েছিলেন বলেই তাঁর বিশেষণ বৈকৰ্ত্তন। কিন্তু ভীষ্ম যেটা ইঙ্গিত করালেন, সেটা তাঁর নিজের ভাষায়— কবচ আর কুণ্ডল হারানোর ফলে কর্ণের অর্ধেক শক্তি গেছে কমে। তার ওপরে আছে পরশুরামের অভিশাপ, হোম-ধেনু-হারানো সেই ব্রাহ্মণের অভিশাপ— সময়কালে কোনও দিব্যাস্ত্র তাঁর স্মৃতিতে আসবে না— এ অবস্থায় সেই মূর্খ, পরনিন্দুক কর্ণের কী বাকি থাকল? তবু যদি ‘রথ’, ‘অতিরথ’ বলে মার্কা মারতে চাও তার গায়ে, তবে কর্ণ শুধু ‘অর্ধরথ’ ছাড়া আর কিছুই নয়। মহামতি দ্রোণ কর্ণের কাছে অপমানিত হয়েছিলেন পূর্বে। তিনি ভীষ্মের কথা সম্পূর্ণ সমর্থন করে উদাহরণ দিয়ে বললেন— যা বলেছেন ভীষ্ম। প্রত্যেক যুদ্ধেই এর হুঙ্কার শোনা যাবে— ও-ই নাকি সবাইকে শেষ করে দেবে, কিন্তু প্রত্যেকটা বড় যুদ্ধ থেকে ও সরে পড়েছে— রণে রণেহভিমানী চ বিমুখশ্চ্যাপি দৃশ্যতে। কাজেই ভীষ্ম যে বলেছেন— ‘অর্ধরথ’— ঠিকই বলেছেন তিনি। ভীষ্ম-দ্রোণের কথা থেকে বোঝা যায় যে, যুদ্ধের মুখে সেনাপ্রধানদের অন্তঃকলহ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে এবং এর জন্য দায়ী কর্ণ নিজে। রাগের চোটে চোখদুটি বড় করে কর্ণ ভীষ্মকে বলতে লাগলেন যেন ঘোড়ার ওপর চাবুক কষাচ্ছেন— তুদন্ বাগ্ভিঃ প্রতোদবৎ। কর্ণ বললেন— যথেষ্ট হয়েছে পিতামহ, যথেষ্ট। আমি নিজের মনে আছি, আপনি যখন তখন, আমাকে যে এইভাবে পদে পদে অপমান করছেন, এটা সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত এবং আমার ওপর রাগে— সদা দ্বেষাদ্ এবমেব পদে পদে। শুধু দুর্যোধনের মুখ চেয়ে আমি এতকাল সব ক্ষমা করেছি কিন্তু আর নয়। আরে! আপনি আমাকে কাপুরুষ, খারাপ লোক, কত কিছুই না বলছেন, কিন্তু আমি বলছি— আপনি কোন মহারথ? আপনিই ‘অর্ধরথ’— ভবান্ অর্ধরথো মহ্যম্— অন্তত আমার কাছে তাই। সবাই বলে গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম মিথ্যা কথা বলেন না, কিন্তু আমার মতে আপনার প্রতিটি ব্যবহার মিথ্যাচার, কেননা চিরটা কাল আপনি কুরুকুলের বিরোধিতা করে গেলেন, কিন্তু রাজা ধৃতরাষ্ট্র বুঝলেন না। নইলে, এই যুদ্ধের সময় কি কেউ কারও হীনতা প্রমাণ করে, কিংবা কেউ কি এমনভাবে মনোবল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করে? আরে, বয়েসের ভার আর পাকা চুল দেখে— ন হায়নৈর্ন পলিতৈঃ— রথ, মহারথ ঠিক হয় না, ওসব ঠিক হয় ক্ষমতায়, আপন ক্ষমতায়। ব্যক্তিগত রাগ আর ব্যক্তিগত মোহে, আপনি আপনার যেমন ইচ্ছে— কাউকে রথ সাজাচ্ছেন, কাউকে মহারথ সাজাচ্ছেন, বকেও যাচ্ছেন তখন থেকে, যা ইচ্ছে বকে যাচ্ছেন।
ভীষ্মকে অনেকক্ষণ গালমন্দ করার পর কর্ণ দেখলেন, বলাটা বৃথা যাচ্ছে। তিনি তখন দুর্যোধনকে বলতে থাকলেন— দেখো দুর্যোধন সাফ কথা বলে দিচ্ছি— তাড়িয়ে দাও এই বদমাশটাকে— ত্যজ্যতাং দুষ্টভাবোহয়ম্— তোমার যত গণ্ডগোলের মূলে হল এইটা, নইলে এ সময়ে কেউ এমনিভাবে সামনাসামনি মনোবল ভেঙে দেয়? কোথায় রথ, অতিরথের বোধ আর কোথায় এই মাথামোটা ভীষ্ম— রথানাং ক্ক চ বিজ্ঞানং ক্ক চ ভীষ্মোহল্পচেতনঃ। তাড়াও এটাকে, আমি একা তোমার পাণ্ডবসেনা সামাল দেব। এ বেটা বুড়ো ভাম, বয়স চলে গেছে— গতবয়া মন্দাত্মা— অথচ একা একাই লড়বে বলে ফুটুনি কচ্ছে— একাকী স্পর্ধতে নিত্যম্। হ্যাঁ, বুড়ো মানুষের কথা শোনা উচিত, ঠিক আছে। কিন্তু সে বুড়ো, এইরকম বুড়ো নয়। এরকম ধেড়ে বুড়োর কথা শোনা, আর বাচ্চা ছেলের কথা শোনা একই রকম। আমি বলে দিচ্ছি দুর্যোধন আমি কিছুতেই ভীষ্মের সেনাপতিত্বে যুদ্ধ করব না। আমি যুদ্ধ করে মরব, আর সমস্ত ‘ক্রেডিট’টা হজম করবেন সেনাপতি ভীষ্ম— যশো ভীষ্মং গমিষ্যতি,— তা হবে না। এই ভীস্ম বেঁচে থাকতে আমি যুদ্ধ করছি না। ভীষ্ম মরবে, তারপর থেকে আমি যুদ্ধে নামব— হতে ভীষ্মে তু যোদ্ধাস্মি।
দুর্যোধন কিছুতেই ভীষ্ম আর কর্ণের উতোর চাপান থামাতে পারেন না। কিন্তু ক্ষতিটা তাঁরই হল। বস্তুত ভীষ্ম যদি পাণ্ডবদের গায়ে হাত না দিয়েও শুধুই অসংখ্য সৈন্য মেরে যেতেন, তা হলে সেই অবসরে কর্ণ পঞ্চপাণ্ডবের বিপদ ঘটাতে পারতেন অনেকটাই। কিন্তু তা হল না, দশদিনের সম্পূর্ণ যুদ্ধের পর ভীষ্ম মারা গেলেন এবং মহাভারতের ভীষ্মপর্বের শেষ অধ্যায়ে ‘জন্মশয্যা’র মতো মৃত্যুশয্যায় শয়ান ভীষ্মের কাছে উপস্থিত হলেন কর্ণ। অত গালাগালি দিয়েছিলেন, তাই কর্ণের মনে আছে সংকোচ, সাশ্রুমুখে মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধের পায়ে এসে পড়লেন। বললেন— আমি রাধেয় কর্ণ, আপনার চোখের শত্রু। কথাটা শোনামাত্রই পক্ককেশ বৃদ্ধ, কুটিল বলিরেখায় আবৃত চক্ষুদুটি উঁচু করে একখানা হাতেই কর্ণকে জড়িয়ে ধরলেন— জড়িয়ে ধরলেন আপন পুত্রের মতো— পিতেব পুত্রং গাঙ্গেয়ঃ পরিরভ্যৈকপাণিনা। বললেন— এসো বাবা, এসো। চিরটা কাল তুমি আমার সঙ্গে ঠেলাঠেলি করে প্রতিস্পর্ধিতা করে গেলে। এখন যদি এই মরণের সময়েও তুমি না আসতে আমার কাছে, ভাল হত না তোমার। ভীষ্ম এবার স্পষ্ট করে বললেন— আমি জানি, তুমি কুন্তীর ছেলে, সূর্যের তেজে তোমার জন্ম! তুমি রাধা কিংবা অধিরথ কারওই ছেলে নও। আমি এ সব কথা ব্যাসের মুখে শুনেছি। সত্যি কথা বলতে কী আমি কোনওদিন তোমার ওপর বিদ্বেষ পোষণ করিনি— ন চ দ্বেষোহস্তি মে তাত। কিন্তু তবু যে আমি তোমার মনোবল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেছি, তার কারণ হল— তুমি যে সব সময় পাণ্ডবদের নিন্দা করতে, এটা আমার সহ্য হত না। ব্যাপারটা কী হয়েছে জান— গুণী মানুষদের ওপর সব সময় যে তোমার একটা বিদ্বেষ আছে, এক ধরনের ঈর্ষা আছে, এর কারণ হল, স্ত্রী-পুরুষের স্বাভাবিক নিয়মে তোমার জন্ম হয়নি— জাতোহসি ধর্মলোপেন। এর ওপরে তুমি যাকে আশ্রয় করে বেড়ে উঠেছ সে নীচ লোক। এই সব কারণেই কুরুসভার নানা জায়গায় তোমাকে আমি বিস্তর বাজে কথা বলেছি— রুক্ষং শ্ৰাবিতঃ কুরুসংসদি।
একমাত্র এই বৃদ্ধ মানুষটি, যিনি চিরকাল কর্ণকে গালমন্দ করে এসেছেন, তিনিই কিন্তু কর্ণচরিত্রের আসল মনস্তত্ত্বটি ধরতে পেরেছেন। সমাজের নিয়মের বাইরে কুমারী গর্ভে যার জন্ম হয়, সেই মানুষ যদি আবার স্বার্থপরায়ণ অহঙ্কারী বন্ধুর সাহচর্যে শিশুকাল থেকে বেড়ে ওঠে, তবে তার মধ্যে নানান জটিলতা আসবে, পৃথিবীর স্বাভাবিক নিয়মে জাত উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বকে সে সহ্য করতে পারবে না— এটা মেনে নিতেই হবে। এদিক দিয়ে ভীষ্মের বিশ্লেষণ অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত। কর্ণের বুদ্ধি-বিপর্যয়ের কারণ বলেই ভীষ্ম কিন্তু স্বীকার করলেন— আমি জানি, আমি জানি তুমি কতটা ক্ষমতা রাখ। তোমার মতো শক্তিমান পুরুষ দেবলোকেই বা ক’টা আছে? কিন্তু আসলে কী জান, এই বিরাট কুলের পিতামহ হিসেবে এসব কথা আমার বলার উপায় ছিল না, বললে— পাণ্ডবেরা আমাকে ভুল বুঝত, ভুল বুঝত কৌরবেরাও, কুলভেদ গভীরতর হত। বস্তুত অস্ত্রচালনায় তুমি অর্জুন, কি কৃষ্ণের সমকক্ষ। এই স্বল্প-পরিসর জীবনে তুমি কতগুলো বড় যুদ্ধ একা জিতেছ, সেও আমি জানি। আমি বলি কি কর্ণ, তুমি আপন ভাইদের সঙ্গে আর বিবাদ-বিসংবাদের মধ্যে যেয়ো না। আমি মরেছি, আমার সঙ্গে সঙ্গেই এই যুদ্ধ শেষ হোক, তুমি ফিরে যাও ভাইদের কাছে।
এতদিন যাকে শত্রু বলে জেনে এসেছেন, তাঁর কাছে আপন জীবনের একটা ব্যাখ্যা পেয়ে, মরণোন্মুখ বীরের কাছে আপন অস্ত্র-নৈপুণ্যের জয়ঘোষ শুনে কর্ণ বড় খুশি হলেন বটে, কিন্তু সত্যিই তো, তাঁর কি আর ফিরে যাবার উপায় আছে? খুব অল্প কথায় কর্ণ তাই তাঁর পুরনো যুক্তি প্রকাশ করলেন ভীষ্মের কাছে— সেই জন্মমাত্রেই কুন্তীমাতার পুত্রত্যাগের কথা, সূত পিতা-মাতার স্নেহমমতার কথা এবং সর্বশেষে এতকাল দুর্যোধনের খেয়ে-পরে, ভোগ করে, এই মুহূর্তে তাঁকে ত্যাগ করে কৃতজ্ঞতা ভঙ্গের কথা। কর্ণ তা পারেন না। সত্যপ্রতিজ্ঞ বীরের যুক্তি সত্যপ্রতিজ্ঞ ভীষ্ম বুঝলেন। কর্ণ যেহেতু ভীষ্মকে অকথ্য গালাগাল দিয়েছিলেন, আজ তাই তাঁর কাছেই অনুমতি চাইতে এসেছেন— অনুজানীহি মাং তাত যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ম্। ভীষ্ম অনুমতি দিলেন এবং দু’জনেই বুঝলেন যে, সমস্ত পুরুষকার, সমস্ত শৌর্য-বীর্যের ওপরেও আরও এক শক্তি মানুষের অন্তর্গত ললাটের রেখায় চিহ্নিত থাকে— তার নাম দৈব। কর্ণের পুরুষকার কর্ণের স্বায়ত্ত থাকা সত্ত্বেও, এই দৈববলেই তাঁর জন্ম এবং মৃত্যু। দুইই পরেচ্ছায় সম্পন্ন— জন্ম, কুন্তী-সূর্যের আপন সম্ভোগবাসনার চরিতার্থতায়। মৃত্যু, দুর্যোধনের ভাগ্যের সঙ্গে জড়িত হয়ে, তাঁরই কেটে যাওয়া পথ ধরে। অথচ কর্ণ দৈব মানেন না।
॥ ১২ ॥
আমরা যুদ্ধের কথা বেশি বলতে চাই না। তবে এটুকু বলা দরকার যে, দশদিন যুদ্ধ করে ভীষ্ম রণক্ষেত্রে শায়িত হবার পর কর্ণ কিন্তু দারুণ বাস্তব বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। মজা হল, ভীষ্মের শরশয্যার পর কৌরবপক্ষের সমস্ত রাজপুরুষেরা এবং কৌরবেরা সবাই কিন্তু কর্ণকেই একমাত্র ভীষ্মের সমান বলে মনে করেছিলেন। এমনকী সেনাপতি হিসেবে দ্রোণের কথাও কারও মনে আসেনি। উন্মুক্ত রণক্ষেত্রে প্রত্যেক রাজপুরুষই তখন ‘কর্ণ’ ‘কর্ণ’ বলে ডাকছিলেন কারণ ভীষ্মের নৌকো ডুবে যাবার পর কর্ণই ছিলেন রণ-সাগর পাড়ি দেবার ভেলা। তা ছাড়া অনেকেই এটা ভাবছিলেন যে, দশদিন এই মহাযুদ্ধে কিছুই না করায় কর্ণ শারীরিক এবং মানসিক দিক দিয়ে অনেক ‘ফিট’ আছেন, অতএব ভীষ্মের পর তিনিই একমাত্র লোক যাঁকে সেনাপতিত্বে বরণ করা যেতে পারে। কৌরবদের সেই বিপন্ন মুহূর্তে শরশয্যায় শায়িত স্বয়ং ভীষ্ম পর্যন্ত কর্ণকে কৌরববন্ধুদের আশ্রয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। উপমা দিয়ে বলেছেন, সমস্ত নদীর কাছে কর্ণ যেন সমুদ্রের মতো, সমস্ত আলোর মধ্যে কর্ণ যেন সূর্যের মতো অবলম্বন— জ্যোতিষামিব ভাস্করঃ।
কিন্তু বললে হবে কী, কর্ণ কিন্তু এতদিনে বাস্তব অবস্থাটা বেশ বুঝতে পারছেন, বিশেষত ভীষ্মের পতনের পর তাঁর এই উপলব্ধি গভীরতর হয়েছে। হ্যাঁ, একদিকে তিনি তাঁর স্বভাবমতোই বলে যাচ্ছিলেন যে, পাণ্ডবযোদ্ধাদের তিনি রণক্ষেত্রে হত্যা করবেন। কিন্তু অন্যদিকে সম্পূর্ণ বাস্তববোধে কর্ণ স্বীকার করেছিলেন যে, ভীষ্ম ছাড়া কৌরবযোদ্ধাদের মধ্যে আর কেউই তেমন নেই যে রণক্ষেত্রে অর্জুনের বাণ রোধ করতে পারে— কো হ্যর্জুনং যোধয়িতুং ত্বদন্যঃ। কর্ণ বুঝতে পেরেছেন যে, ভীষ্মহীন কৌরবসৈন্যকে এবং স্বয়ং কৌরবদেরও অর্জুন একেবারে ছারখার করে দেবেন— ধার্ত্তরাষ্ট্রান্ প্রধক্ষ্যন্তি তথা বাণাঃ কিরীটিনঃ। তবু কর্ণের মতো ক্ষত্রিয় বীর যে যুদ্ধে পিছুপা হবেন না, এ তো সবাই জানে। তার ওপরে কৌরবশিবিরে সমস্ত যোদ্ধারা যেখানে ‘কর্ণ’ ‘কর্ণ’ বলে তারস্বরে চিৎকার করছেন, সেখানে কর্ণের মতো মহাবীর যে অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে সোজাই উপস্থিত হবেন, এতেও আশ্চর্য নেই কিছু। কর্ণের ব্যাপারে অনুগত রাজাদের উচ্চকিত আহ্বান শুনে দুর্যোধনই বা কী করেন! আমাদের ধারণা, দুর্যোধনের মধ্যে এই বোধ সম্পূর্ণ ছিল যে, ভীষ্মের পরে দ্রোণকেই সেনাপতি করা উচিত। কিন্তু সবাই এমন ‘কর্ণ’, ‘কর্ণ’ বলে চেঁচাচ্ছে যে তিনি শেষ পর্যন্ত কর্ণের ওপরেই ছেড়ে দিলেন সেনাপতি চয়নের ভার। কর্ণ বন্ধুর মন বোঝেন, উপযুক্ত বাস্তববোধও তাঁর আছে। তিনি বললেন— দুর্যোধন! তোমার পক্ষে অনেকেই আছেন যাঁরা সেনাপতি হবার উপযুক্ত, কিন্তু যেহেতু তাঁরা সবাই সমান মাপের যোদ্ধা, তাই একজনকে সেনাপতি করলে আরেকজন মনে মনে আহত হবেন এবং মনেপ্রাণে তোমার জন্য যুদ্ধ করবেন না— শেষা বিমনসো ব্যক্তং ন যোৎস্যন্তি হিতাস্তব। কিন্তু দেখো, এঁদের সবার মধ্যে সবচেয়ে গুণী মানুষ এবং গুরুজন হলেন দ্রোণ। অস্ত্রবিদ্যায় তিনি সবারই প্রায় গুরুস্থানীয়, তাঁকে সেনাপতি করলে কারওই কিছু বলার থাকে না। অতএব আচার্য দ্রোণকেই সেনাপতি করা উচিত।
বাস্তব অবস্থার বিচারে দেখা যেত— দ্রোণকে বাদ দিয়ে কর্ণকে সেনাপতি করলে, দ্ৰোণ অবশ্যই আহত হতেন এবং তাঁর অহংবোধেও লাগত। কাজেই এক্ষেত্রে কর্ণের বুদ্ধি-কৌশল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আচার্যের সঙ্গে সঙ্গ দিয়ে কর্ণ বারবার পাণ্ডবদের পর্যুদস্ত করেছেন। অবশ্য শুধুই পর্যুদস্ত করেছেন বললে যুদ্ধের মূল কথাটাই নষ্ট হয়ে যায়। কেননা, দ্রোণপর্বের যুদ্ধে কর্ণ তো শুধুই জেতেননি অনেকবার, পরাস্তও হয়েছেন, তাও অর্জুনের কাছে নয়, ভীমের কাছেই। জেতার মুহূর্তে ভীম নেচে কুঁদে কর্ণকে অনেক গালাগালি দিয়েছেন, কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হল যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থাতেও অন্যান্য পাণ্ডবদের ব্যাপারে কর্ণের সাধারণ নীতি ছিল ‘ডিফেনসিভ’। ব্যাসের ভাষায় প্রকাশ করতে গেলে সেটা দাঁড়ায়-মৃদুপুর্বঞ্চ রাধেয়ো দৃঢ়পূর্বঞ্চ পাণ্ডবঃ। বেশি ‘ডিফেনসিভ’ যুদ্ধ করতে গেলে কখনও বা পরপক্ষের হাতে নাকালও হতে হয়, কর্ণ তা হয়েছেন, এমনকী তাঁকে পালাতেও হয়েছে। আবার কখনও বা একটু শিক্ষা দেওয়ার তাগিদে যখন ভীমের মতো বিরাট যোদ্ধাকে বিরথ এবং নিরস্ত্র করে দেন কর্ণ, তখন অন্য এক অনুভূতি তৈরি হয়। কর্ণ বলেন— ভীম! তুমি হলে গিয়ে লোভী মানুষ— ঔদরিক। যেখানে ভাল খাবার দাবার আছে, ভাল ভাল পানীয় আছে— যত্র ভোজ্যং বহুবিধং ভক্ষ্যং পেয়ঞ্চ পাণ্ডব— সেইখানেই তুমি আদর্শ লোক, এই যুদ্ধক্ষেত্র তোমার উপযুক্ত নয়। কর্ণ এখানেই শেষ করলেন না, খোঁচা দিয়ে বললেন— তুমি আরেক কাজ করতে পার, ভীম! তুমি বনে চলে যাও। সেখানে যুদ্ধটুদ্ধর ঝামেলা নেই, বেশ ভাল থাকবে মুনিদের মতো, তুমি বনে চলে যাও— বনং গচ্ছ বৃকোদর।
এসব কটূক্তি, খোঁচা যুদ্ধক্ষেত্রে সব সময় চলে। কিন্তু সুযোগ পেলে এবং না পেলেও ভীম যাঁকে ‘সূতপুত্র’ ছাড়া ডাকতেন না, সেই ভীমের প্রতি এই মুহূর্তে কর্ণের কটুক্তিগুলি কিন্তু প্রচ্ছন্ন মমতাও বহন করে, যদিও এ মমতা সাক্ষী-সাবুদ দিয়ে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। যাই হোক জয়ে, পরাজয়ে, অন্যায়-আচরণে কর্ণ দ্রোণের সেনাপতিত্বে ভালই যুদ্ধ করলেন। অন্যায়ের কথাটা উল্লেখ করলাম এইজন্যে যে, যিনি কুরুপাণ্ডবের একমাত্র যোগ্য বংশধর হতে পারতেন, সেই অভিমন্যুবধে কর্ণের অবদান ছিল বিরাট। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে কর্ণের রথের চাকা যখন আটকে গেছে মাটিতে, সেই সময় কর্ণ ধর্মের কথা তুলেছিলেন— অর্থাৎ সেই অবস্থায় তাঁকে হত্যা করাটা যে অর্জুনের মতো বীরের পক্ষে অধর্ম হবে, সেই কথাটা তুললেন। এর উত্তরে কর্ণের জীবনে হাজারো অন্যায় আচরণের মধ্যে সপ্তরথী মিলে বালক অভিমন্যুকে হত্যা করার কথাটাও বলেছিলেন কৃষ্ণ। বলেছিলেন— সেদিন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল— ক্ক তে ধর্মস্তদা গতঃ। দ্রোণপর্বে এই অভিমন্যুবধের পর পরই কৌরবপক্ষের জয়দ্রথ বধের সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা বড় ঘটনা ঘটে, কিন্তু সে ঘটনার একটা পূর্বপট আছে, সেটা আগে বলি।
সোজা কথা, পঞ্চপাণ্ডব, বিশেষত ভীম এবং অর্জুনকে কিছুতেই আটকানো যাচ্ছিল না। তার মধ্যে কৌরবদের কাছে আরেক নতুন উৎপাত এসে দাঁড়াল। ভীমপুত্ৰ ঘটোৎকচের উদয় হল কোথা থেকে, আর সমস্ত কৌরবসৈন্যের মধ্যে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠে গেল। এমনকী দ্রোণ, অশ্বত্থামার মতো বড় বড় বীরেরাও তাকে কিছু করতে পারছেন না। কৌরবপক্ষের হাল যখন খুবই খারাপ, এই সময়ে কুরুরাজ দুর্যোধন যেন আর দ্রোণের সেনাপতিত্বে বিশ্বাস রাখতে পারছিলেন না। পাণ্ডবদের যুদ্ধোন্মাদনা দুর্যোধনের মনে এমন শঙ্কা জাগিয়েছিল যে, দুর্যোধন শেষ পর্যন্ত দ্রোণের সেনাপতিত্বকালেই কর্ণকে ত্রাণকর্তা হিসেবে ধরে নিলেন। অনেকের সামনেই তিনি কর্ণকে বলে বসলেন— আমাদের বাঁচাও কর্ণ। কৌরব যোদ্ধাদের তুমি বাঁচাও। পাণ্ডবেরা সবাই মিলে আমাদের একেবারে বিষাক্ত সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরেছে, আমাদের তুমি বাঁচাও— ত্রায়স্ব সমরে কর্ণ সর্বান্ যোধান্ মহারথান্।
শুনেছি, মরণকাল এগিয়ে আসলেও স্বভাব পরিবর্তিত হয় না। কর্ণ তাঁর সেই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে দুর্যোধনকে হামবড়াই করে বলতে আরম্ভ করলেন। এটা ভাবলেন না যে, দিন প্রতিদিনের যুদ্ধে বৃদ্ধ গুরু দ্রোণাচার্য পর্যন্ত পাণ্ডবদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছেন না। এই অবস্থায় নিজের ক্ষমতা বীরত্ব সম্বন্ধে বেশি বলা মানে সেই পুরনো ঝগড়া চেতিয়ে তোলা। আমরা বেশ বুঝি কর্ণের কবচ-কুণ্ডল খোয়া গেলেও তিনি অতিমাত্রায় নির্ভর করছিলেন ইন্দ্রের দেওয়া সেই একাঘ্নী বাণটির ওপর। কিন্তু তাই বলে— অহম্— আমি একা অর্জুনকে মেরে ফেলব, কোনও চিন্তা নেই, অর্জুনের বাবা আসলেও আমাকে রুখতে পারবে না— এই কথাগুলি মাত্রাছাড়া। কর্ণ বললেন— পাণ্ডবদের মেরে, পাঞ্চালদের শেষ করে তোমাকে জয় এনে দেব আমি। জান তো সেই একাঘ্নী বাণটির কথা। সব পাণ্ডব ভাইদের মধ্যে অর্জুনই যা একটু ক্ষমতা রাখে— তার ওপরে সেই একাগ্নী বাণটি ছাড়ব। অর্জুন মরে গেলে অন্য পাণ্ডবেরা হয় বনে চলে যাবে নয়তো তোমার বান্দা হয়ে থাকবে। চিন্তা নেই— সমাশ্বসিহি ভারত— আমি একা সমস্ত পাণ্ডবদের ঠাণ্ডা করে দেব— অহং জেষ্যামি সমরে সহিতান্ সর্বপাণ্ডবান্। আমি বেঁচে থাকতে— ময়ি জীবতি কৌরব্য— তোমার দুঃখ কিসের, দুর্যোধন?
যেখানে বিভিন্ন ব্যূহ-প্রতিব্যূহ সাজিয়ে, নিজে প্রচণ্ড যুদ্ধ করেও দ্রোণাচার্য পাণ্ডবদের কিছু করতে পারছেন না, সেখানে কর্ণের এই দম্ভোক্তি যে দ্রোণাচার্য এবং তাঁর প্রিয়জনদের ক্রুদ্ধ করে তুলবে, এতে আশ্চর্য কী! বিশেষত দ্রোণের শ্যালক বয়োবৃদ্ধ কৃপাচার্য এবং দ্ৰোণপুত্র অশ্বত্থামা, যিনি নিজে কর্ণের থেকে কম বীর নন, তাঁরা কর্ণের এই সাহঙ্কার আত্মম্ভরিতা সহ্য করবেন কেন! কৃপাচার্য তো কর্ণের কথা শুনে প্রায় হাততালি দিয়ে উঠলেন। বললেন— দারুণ বলেছ, কর্ণ, দারুণ, দারুণ— শোভনং শোভনং কর্ণ— বুঝতে পারছি, দূর্যোধন আর অনাথ নয়। তবে হ্যাঁ কথা দিয়ে আর বাক্যি মেরেই যদি পৃথিবী জয় হয়ে যেত, তা হলে তো ভালই হত— বচসা যদি সিধ্যতি। এই দুর্যোধনের সামনে তোমার এমনিধারা বচন-গর্জন অনেক শুনেছি কিন্তু তোমার বিক্রমও কোথাও দেখনি কিংবা এই বচনের ফলও কিছু হয়নি। কৃপাচার্য আবার সেই পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে তুললেন, কারণ রাগটা তাঁর রয়েই গেছে। কৃপ বললেন— এমন তো নয় যে, অর্জুনের সঙ্গে তোমার কোনওদিন সামনাসামনি যুদ্ধ হয়নি। যতগুলো যুদ্ধ হয়েছে সবগুলোতেই তুমি হেরেছ। তুমি একা অর্জুনকেই সামলাতে পারো না, সেখানে ভাবছ কৃষ্ণসহায় সমস্ত পাণ্ডবদের তুমি মারবে।
কৃপাচার্য এবার একটু রেগেই উঠলেন। বললেন— দেখো কর্ণ! যুদ্ধ করতে হয় করো, তবে মুখে এত বেশি ফটর-ফটর করো না— অব্রুবন্ কর্ণ যুধ্বস্ব কত্থসে বহু সূতজ। তোমার সমস্ত তর্জন-গর্জন শরৎকালের মেঘের মতো আড়ম্বর-সার মৌখিকতা। তা বেশ, অর্জুনকে যতক্ষণ না দেখছ, ততক্ষণ তোমার এই চিল্লানি চালিয়ে যাও— তাবদ্ গর্জস্ব রাধেয় যাবৎ পার্থং ন পশ্যসি— অর্জুনকে যখন সামনে দেখবে তখন আর তোমার গলা দিয়ে শব্দ বেরবে না। দেখো কর্ণ-ক্ষত্রিয়রা বাহুবলে নিজের বীরত্ব দেখায়, আর মুখে বীরত্ব দেখায় বামুনেরা— বাগ্ভিঃ শূরা দ্বিজাতয়ঃ,— তেমনি অর্জুন তার ক্ষমতা দেখায় ধনুকের মুখে, আর কর্ণ! তোমার মতো স্ব-প্রতিষ্ঠিত বীর মনে মনেই সেই ক্ষমতা দেখায়— কর্ণঃ শূরো মনোরথৈঃ।
কর্ণ আর থাকতে পারলেন না। বললেন— আমি গর্জাচ্ছি তো তাতে তোর কী হয়েছে রে, বিটলে বামুন— তব কিং তত্র নশ্যতি। যা বলেছি, ঠিক বলেছি, পাণ্ডবদের মেরে এই পৃথিবী আমি অবশ্যই দুর্যোধনকে দেব। কৃপ আবার প্রতিবাদ করলেন। পাণ্ডবদের নানা ক্ষমতা এবং জনবল, অস্ত্রবলের পরিচয় দিলেন। কিন্তু কর্ণ তাতে মোটেই দমবার পাত্র নন। এবার তিনি একাঘ্নী বাণের কথাটা পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন এবং আরও জানিয়ে দিলেন যে, ওই অমোঘ বাণই হবে অর্জুনের কাল। বাস! এটুকু বললেই হত, কিন্তু ধৈর্য হারিয়ে কর্ণ মাথা গরম করে কৃপকে ‘চ্যালেঞ্জ’ করে বললেন— আমার এলেম বুঝেই আমি চেঁচিয়েছি, তুই বেটা বামুন, বুড়ো-হাবড়া, যুদ্ধ করার ক্ষমতা নেই— ত্বন্তু বিপ্রশ্চ বৃদ্ধশ্চ অশক্তশ্চাপি সংযুগে— ফের যদি আবার উলটো পালটা কথা শুনি— বক্ষ্যসে ভূয়ো মমাপ্রিয়মিহ— তা হলে তোর জিব কেটে দেব মাথামোটা— জিহ্বাং ছেৎস্যামি দুর্মতে।
আমরা জানি— যে একবীরঘাতিনী শক্তিটির ওপর এত নির্ভর করছিলেন কর্ণ, সেটি তাঁকে খোয়াতে হয়েছে ভীমপুত্ৰ ঘটোৎকচের সঙ্গে যুদ্ধেই। ঘটোৎকচ এমন প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছিলেন যে, সমস্ত কৌরবেরা সেদিনকার রাত্রিযুদ্ধে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। সমস্ত সৈন্যেরা পালিয়ে যাচ্ছিল, পালিয়ে যাচ্ছিলেন বড় বড় যোদ্ধারা। কৌরবেরা সবাই মিলে সমস্বরে সেদিন কর্ণকে ইন্দ্রদত্ত শক্তি প্রয়োগ করতে বলেছিলেন, না হলে সেদিন তাঁরা মারা পড়তেন— শক্ত্যা রক্ষো জহি কর্ণাদ্য তূর্ণং নশ্যন্ত্যেতে কুরবো ধার্ত্তারাষ্ট্রাঃ। কর্ণ শক্তি প্রয়োগ করেছিলেন, ঘটোৎকচও মারা পড়েছিল, কিন্তু কর্ণের কঠিন কথাগুলি কৃপাচার্যকে যেভাবে বিদ্ধ করেছিল, তার মূল্য ছিল আরও বেশি। কর্ণ যেভাবে কুলগুরু কৃপাচার্যের জিব ছিঁড়ে নিতে চেয়েছেন, তাতে দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা থেমে থাকেননি। তিনি সঙ্গে সঙ্গে খড়গ নিয়ে তেড়ে গিয়েছিলেন কর্ণের দিকে— খড়্গমুদ্যম্য বেগেন দ্রৌণিরভ্যপতদ্ ভৃশম্। নিজেদের মধ্যে বিশেষ করে কৃপাচার্য-অশ্বত্থামা এবং কর্ণের মধ্যে যে সম্বন্ধটা মোটেই ভাল ছিল না, সেটা তো অশ্বত্থামার ব্যবহার থেকেই বোঝা যায়। তিনি কর্ণের ধড় থেকে মুণ্ডু নামিয়ে দিতে চেয়েছিলেন— শিরঃ কায়াদ্ উদ্ধরামি সুদুর্মতে। নেহাত দুর্যোধন কোনওমতে সব ব্যাপারটা চাপাচুপি দিয়ে দেন। নিজেদের মধ্যে এই যে গণ্ডগোল, তার ফলভোক্তা দুর্যোধন। বস্তুত তিনিই কর্ণকে এত দূর বাড়তে দিয়েছেন। দুর্যোধনের নিজের ভাষার লাগাম ছিল না, কিন্তু ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ যে তবু তাঁকে মেনে চলতেন, সে যুবরাজ বলে, ধৃতরাষ্ট্রের প্রতিনিধি বলে। কিন্তু কর্ণ যদি দুর্যোধনের মতোই দুর্বিষহ কথা বলেন, সেখানে কৃপ, দ্রোণ, অশ্বত্থামার কী দায় আছে তা শোনবার? কুরুগৃহে এঁরা যদি বাইরের লোক হন, তবে কর্ণও তাই। কাজেই দুর্যোধন যা বলতে পারেন, কর্ণ তা বলতে পারেন না। কিন্তু বাস্তবে কর্ণ তাই বলতেন। এর ফল ভাল হয়নি। নিজেদের মধ্যে এই ঝগড়া কতটা বেড়ে গিয়েছিল, তার একটা চিত্র পরবর্তীকালের সংস্কৃত নাট্যকার ভট্টনারায়ণ দিয়েছেন তাঁর বেণীসংহার নাটকে। কর্ণের সঙ্গে অশ্বত্থামার ঝগড়ার সময়টা যদিও নাট্যকার পালটে দিয়েছেন, তবু ঝগড়াটা চলেছে মহাভারতের সুরে এবং এই ঝগড়াটা সচেতন নাট্যকারের চোখ এড়িয়ে যায়নি বলেই বলতে পারি যে, এটা ছিল পরিণামে দুর্যোধনের পক্ষে ক্ষতিকর।
বেণীসংহার নাটকে অশ্বত্থামার সঙ্গে কর্ণের বাদ-প্রতিবাদ হয়েছে দ্রোণবধের পরে। নাট্যকার একটা দারুণ যুক্তিসই কথাও এখানে কৃপের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন। কৃপের মতে এখানে দ্রোণাচার্যের পর সেনাপতি হওয়া উচিত ছিল অশ্বত্থামার, কর্ণের নয়। পিতার মৃত্যুর পর স্বভাবতই তিনি রাগে টগবগ করে ফুটছিলেন, তা ছাড়া বীরত্বেও তিনি কর্ণের থেকে কম ছিলেন না এবং লোকান্তক ব্রহ্মশিরা অস্ত্রটিও ছিল তাঁর দখলে। কৃপাচার্য এই বীর যুবকটির পিতৃবধজনিত ক্রোধ এবং ক্ষোভ পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চেয়ে তাঁকে সেনাপতি করার প্রস্তাব নিয়ে আসছিলেন দুর্যোধনের কাছে। কিন্তু দুর্যোধন এবং কর্ণ সেখানে পূর্বাহ্নেই ব্যস্ত ছিলেন আচার্য দ্রোণের সমালোচনায়। দ্রোণ কতটা বীর, কতটা স্বার্থপর, পাণ্ডবদের প্রতি তিনি উদাসীন কেন— এইসব কথা দুর্যোধনের মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছিলেন কর্ণ। ঠিক এই সময়ে কৃপ এবং অশ্বত্থামার প্রবেশ। কর্ণের মতে, রণক্ষেত্রে যুধিষ্ঠিরের মুখে অশ্বত্থামার বধ সংবাদ শুনেও আচার্য দ্রোণের অস্ত্রত্যাগ করা উচিত হয়নি। কর্ণ বললেন— তিনি নিজেই যেখানে নিজের বিপদ ডেকে এনেছেন, সেখানে অশ্বত্থামা! আপনি কী করবেন?
এ-কথা শুনে অশ্বত্থামা ক্রোধে ফেটে পড়লেন এবং কী কী তিনি করতে পারেন তার একটা কাল্পনিক চিত্র দিলেন। প্রায় এই রকম একটা অবস্থায় কৃপাচার্য প্রস্তাব করলেন অশ্বত্থামাকে সেনাপতিত্বে নিযুক্ত করতে। কিন্তু বেণীসংহারের নাট্যকার জানেন যে, ভীষ্ম-দ্রোণের নিরিখে দুর্যোধন আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। কাজেই দুর্যোধন যখন বললেন যে, কর্ণকে তিনিই আগেই সেনাপতিত্বে নিযুক্ত করেছেন তখন কৃপের যুক্তি আমরা বুঝি। কৃপ বলেছিলেন— কর্ণের জন্য, শুধুমাত্র কর্ণকে তোয়াজ করার জন্য অশ্বত্থামাকে উপেক্ষা করা ঠিক হবে না, কারণ শোকসন্তপ্ত অবস্থায় তাঁকে সেনাপতি করলে তাঁর পিতৃশোকের ভারও কিছু লঘু হত, অন্যদিকে তাঁর পিতৃশোকজনিত ক্রোধও ব্যবহার করা যেত পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে।
মহাভারতে কৃপাচার্যের এসব যুক্তিজাল বর্ণিত হয়নি, কিন্তু মহাকবির অন্তরে হয়তো বা তা কিছু ছিল, নইলে কর্ণকে সেনাপতি করার প্রস্তাব সেখানে অশ্বত্থামার মুখ দিয়েই এসেছে কেন? যাই হোক বেণীসংহার নাটকেও অশ্বত্থামা শেষ পর্যন্ত সেনাপতিত্ব নিয়ে মাথা ঘামাননি। শুধু দুর্যোধনকে তিনি বলেছিলেন— আজ সকালের যুদ্ধে আপনি ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখবেন— পৃথিবী অর্জুনহীন এবং কৃষ্ণহীন হয়ে গেছে— অকেশবম্ অপাণ্ডবং ভুবনম্। আজ থেকে আর যুদ্ধের কথা থাকবে না। বেণীসংহারের কর্ণ এবার ফুট কাটলেন— এসব কথা মুখে বলা সহজ, কাজে করা কঠিন, তা ছাড়া কৌরবশিবিরে অনেকেই এ কাজ করতে পারে। ‘অনেকেই’ বলতে কর্ণ নিজেকে অবশ্যই মনে করছেন। কারণ যে কথা তিনিই সচরাচর বলে থাকেন, সে কথা অন্যে বললে তাঁর পরশ্রীকাতরতা আসে। অশ্বত্থামা কর্ণের কথাটা মেনে নিয়ে বললেন, হয়তো শোকাবেগে তিনি এমন গর্বোক্তি করে ফেলেছেন, কোনও বীরের নিন্দা করাটা তাঁর অভিপ্রেত ছিল না। কিন্তু এতেও কর্ণ আবার উপদেশ দিয়ে বসলেন। বললেন— শোকার্তের কাজ চোখের জল ফেলা আর বীরের কাজ হল যুদ্ধে যাওয়া। তুমি আর প্রলাপ বোকো না— নৈবংবিধাঃ প্রলাপাঃ।
একে তো পিতৃশোক, তাতে সেনাপতিত্বও জুটল না, তার ওপরে এখন থেকেই কর্ণের কাছ থেকে সেনাপতির মতো উপদেশ। অশ্বত্থামা আর থাকতে পারলেন না। বললেন— ওরে রাধামায়ের গর্ভের ভার, সারথির বেটা— রাধাগৰ্ভভারভূত, সূতাপশদ। আমার নাম অশ্বত্থামা, দুঃখ হলে চোখের জলের উপদেশ দিচ্ছিস আমাকে। কেন, আমার এই অস্ত্রগুলো কি গুরুর অভিশাপে নিবীর্য হয়ে গেছে, যেমনটি তোর হয়েছে। আমি কি তোর মতো এইমাত্র রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে এসেছি? আমি কি তোর মতো অপরের বংশ-স্তাবক সারথির ঘরে জন্মেছি।
এসব কথা শুনে কর্ণই বা আর থাকেন কী করে? প্রথমত বংশের কলঙ্কটা এড়াতে চেয়ে তিনি একটি কালজয়ী উক্তি করলেন। বললেন— আমি সূতই হই, আর সূতপুত্রই হই, কিংবা যাই হই না কেন— যো বা কো বা ভবাম্যহম্— মানুষ কোন ঘরে জন্মাবে সেটা একেবারেই দৈবায়ত্ত, কিন্তু পৌরুষ জিনিসটা মানুষ আয়ত্ত করতে পারে, আমি সেটাই করেছি— দৈবায়ত্তং কুলে জন্ম মদায়ত্তং তু পৌরুষম্। কর্ণ যখন দেখলেন, তাঁর জাত তুলে কথা বলেছেন অশ্বত্থামা, তখন তিনিও তাঁর জাত তুলেই কথা আরম্ভ করলেন, কারণ জাতি হিসেবে ব্রাহ্মণেরও তো কিছু দোষ আছে। কর্ণ বললেন— ওরে বেটা বাচাল বামুন, বৃথাই তুই অস্ত্র ধরেছিস। ক্ষমতা থাকুক আর নাই থাকুক, আমি তো অস্ত্রত্যাগ করিনি, কিন্তু ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তোর বাপ পাঞ্চাল ধৃষ্টদ্যুম্নের ভয়ে অস্ত্র ফেলে দিয়েছিল কেন হাত থেকে? কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়, কিন্তু ঝগড়ার সময় অনেক ঘটনাই এমন বিকৃত করে দেখা হয়। কিন্তু তাতে অশ্বত্থামা চুপ থাকবেন কেন? সদ্য পিতৃশোক পাওয়া হৃদয়ে পিতার সম্বন্ধে এই উলটো কথা তাঁর ক্রোধ আরও বাড়িয়ে তুলল। আবার খুব খানিকটা জাত তুলে গালাগালি দিয়ে অশ্বত্থামা বললেন— আমার বাবা ভিতু ছিল, নাকি বীর ছিল, কিংবা এই যুদ্ধে তিনি কী করেছেন না করেছেন তা দুনিয়ার লোক জানে। আর সেই চরম যুদ্ধের সময়ে তিনি অস্ত্রত্যাগ করেছিলেন কেন, তা জানেন সত্যবাদী যুধিষ্ঠির। কিন্তু সে যাই হোক, আমার বাবা যখন অস্ত্রত্যাগ করলেন, তখন তুই ছিলি কোথায়, কাপুরুষ কোথাকার।
সত্যি কথা বলতে কি, বেণীসংহারের কর্ণ দ্রোণকে বিশ্বাস করেন না। মহাভারতের কর্ণও প্রায় তাই। তবে মহাভারতে যদি বা কোথাও দ্রোণের প্রতি কর্ণের শ্রদ্ধাও আছে, বেণীসংহারের কর্ণের সে শ্রদ্ধা নেই। এই কর্ণ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, দ্রোণ ভীষণ স্বার্থপর। তিনি অশ্বত্থামাকে পৃথিবীর রাজা হিসেবে দেখতে চেয়েছেন এবং সেইজন্যেই আচমকা পুত্রের মৃত্যুসংবাদ শুনে হতাশ হয়ে অস্ত্রত্যাগ করেছিলেন। কর্ণ দুর্যোধনের মাথাতেও তাঁর এই যুক্তি ঢুকিয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন, কেননা দুর্যোধন দ্রোণের অস্ত্ৰত্যাগের ব্যাপারে ব্রাহ্মণোচিত নরম স্বভাবকেই কারণ হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু কর্ণের কথা শুনে দুর্যোধনের ধারণা পালটাল এবং কর্ণ বললেন— পুত্র বিষয়ে দ্রোণাচার্যের এই উচ্চাশার কারণেই পাণ্ডবসৈন্য বধে তাঁর উপেক্ষা ছিল এবং জয়দ্রথ বধেও তিনি ছিলেন উদাসীন। এমনকী বেণীসংহারে কর্ণ দ্রোণের ব্যাপারে এতটাই সন্দেহপ্রবণ যে তিনি দ্রুপদ এবং দ্রোণাচার্যের বাল্যকালের ঝগড়াকেও অন্যভাবে চিন্তা করেছেন। কর্ণ দুর্যোধনকে বুঝিয়েছেন যে, মহারাজ দ্রুপদ যে কথা দিয়েও শেষ পর্যন্ত নিজের রাজ্যে তাঁর বাসস্থান দেননি, তার কারণ হল দ্রুপদ দ্রোণাচার্যের ওই কু-অভিপ্রায় জানতেন।
মহাভারত পড়ে অবশ্য কর্ণকে আমরা এইভাবে চিনব না। কিন্তু দ্রোণের সম্বন্ধে কর্ণের যে অনেক বক্তব্য ছিল এবং সে বক্তব্য যে দ্রোণ-চরিত্রের অনুকূল নয়, সেটা আমরা আগেই খানিকটা বুঝেছি। যাই হোক বেণীসংহারে অশ্বত্থামার মুখে কাপুরুষতার অভিযোগ শোনামাত্র কর্ণ একেবারে জ্বলে উঠলেন। বললেন— আমি কাপুরুষ, তাই না? আর তুমি খুব বীর, তোর বাপের কথা মনে হলে তোর বলবিক্রম সম্বন্ধে আমার খুব সন্দেহ হয় রে মূর্খ! নইলে শত্রু এসে তাঁর চুল টেনে ধরল আর তিনি মেয়েছেলের মতো সবার সামনে চুপ করে বসে থাকলেন— সুচিরং স্ত্রিয়েব নৃপচক্রসন্নিধৌ। অশ্বত্থামা রাগে কাঁপতে কাঁপতে এবার দুর্যোধনের সামনেই সত্য কথাটা বলে ফেললেন। বললেন— ওরে সারথির বেটা, দুর্যোধনের প্রিয়পাত্র বলে এত বড় কথা। যে কোনও কারণেই হোক আমার বাবা ধৃষ্টদ্যুম্নকে বাধা দেননি। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে আমি তোর মাথায় এই আমার বাঁ পা রাখছি, তোর ক্ষমতা থাকে তো সরিয়ে দে— শিরসি চরণ এষ ন্যস্যতে বারয়ৈনম্। অশ্বত্থামা এই কথা বলে মাটিতে বাঁ পাখানি দাপিয়ে বেড়ালেন বারবার অর্থাৎ কর্ণের মাথায় পা রাখার প্রতীকী অভিনয় করলেন। কর্ণ এবার সোজা শাণিত তরবারি বার করে নিলেন কোষ থেকে। তারপর ব্রাহ্মণত্বের মুখে ছাই দিয়ে বললেন— বেটা বাচাল বামুন, যদি তুই ব্রাহ্মণ না হতিস তা হলে আজ এতক্ষণে দেখতিস তোর বাঁ ‘পা’টা কাটা পড়ে রয়েছে মাটিতে। বিবাদের চরম সীমায় অশ্বত্থামাও সব ভুলে বললেন— ও তুই বামুন বলে আমায় মারতে পারছিস না, তো নে এই আমি ব্রাহ্মণত্ব ত্যাগ করলাম। বলেই অশ্বত্থামা নিজের পৈতে-টৈতে ছিঁড়ে ফেললেন— ইতি যজ্ঞোপবীতং ছিনত্তি। দু’জনেই খড়্গ হাতে তেড়ে গেলেন দু’জনের দিকে।
মহাভারতে কৰ্ণ কৃপর দিকে ধেয়ে গিয়েছিলেন খড়্গ হাতে, আর অশ্বত্থামা কর্ণের দিকে ধেয়ে গেলেন খড়্গ হাতে। এই অবস্থায় দুর্যোধনের অনুনয়ে বিনয়ে শেষ পর্যন্ত দু’পক্ষই শান্ত হল। বেণীসংহারেও তাই। কর্ণ সেনাপতি হলেন, অনেক যুদ্ধ করলেন। কিন্তু তিনি এমনই ভাগ্যহত যে, যা তিনি মুখে বলেছেন এতদিন, তা তিনি কিছুই করতে পারেননি। আজকে তাঁর দেবদত্ত কবচ-কুণ্ডল নেই, ইন্দ্রের অমোঘ শক্তি নেই, মাথার ওপরে খাঁড়ার মতো ঝুলছে গুরু পরশুরামের অভিশাপ, হোমধেনু হারানো ব্রাহ্মণের অভিশাপ— এত কিছু বিরুদ্ধতা নিয়েও কর্ণ ভাবলেন— তিনি অর্জুনের বিরুদ্ধে জয়ী হবেন। অভিমানই কর্ণকে চিরকাল স্থান, কাল, পাত্র সব ভুলিয়েছে, এই আত্মম্ভরিতার ওপরে দাঁড়িয়েই মহাবীর কর্ণ আজ কৌরবের সেনাপতি। ধৃতরাষ্ট্রের কাছে যুদ্ধের আনুক্রমিক ধারা বিবরণী দিতে দিতে সঞ্জয় পর্যন্ত একটুখানি বক্রোক্তির আভাস দিয়ে বলেছেন— আপনার ছেলে দুর্যোধন মনে মনে এই আশা করে আশ্বস্ত হয়েছেন যে, ভীষ্ম গেছে, দ্রোণ গেছে, তো কী হয়েছে, কর্ণ অবশ্যই পাণ্ডবদের জয় করবে— হতে ভীষ্মে চ দ্রোণে চ কর্ণো জেষ্যতি পাণ্ডবান্। কর্ণকে সেনাপতিত্ব দান করার সময় দুর্যোধন পরিষ্কার তাঁকে জানিয়েছেন যে, ভীষ্ম এবং দ্রোণের ওপর তিনি কোনওদিনই আস্থা রাখতে পারেননি। একে তো তাঁরা বৃদ্ধ, তার ওপরে অর্জুনের ওপরে তাঁদের পক্ষপাত ছিল— বৃদ্ধৌ হি তৌ মহেষ্বাসৌ সাপেক্ষৌ চ ধনঞ্জয়ে। এখন তো আর সেসব বালাই নেই, কাজেই দুর্যোধন কর্ণকে অপার প্রশংসা করে সেনাপতিত্বে বরণ করলেন। কর্ণের মধ্যে দুর্যোধন দেবসেনাপতি কার্তিককে দেখতে পেয়েছেন, দেখতে পেয়েছেন অসুর নিহন্তা ইন্দ্রের মাহাত্ম্য, দেখতে পেয়েছেন দেবসহায় বিষ্ণুর পরাক্রম।
কিন্তু এত বিশ্বাস যেখানে, সেখানে বিশ্বস্ত জনের দায়িত্বও বড় বেশি বেড়ে যায়। অনেক গুণ, অনেক পরাক্রম এবং দুর্যোধনের অনন্ত বিশ্বাস নিয়েও কর্ণ দুর্যোধনের প্রাণপ্রিয় দুঃশাসনকে বাঁচাতে পারলেন না। বাঁচাতে পারলেন না নিজের ছেলেকেও। অনেক যুদ্ধ হল, অনেক লোকক্ষয় হল, কর্ণ অনেক যুদ্ধ করলেন কিন্তু দুর্যোধনের অনেক বিশ্বাসই তিনি পূর্ণ করতে পারলেন না, রাখতে পারলেন না আত্মবিশ্বাসও। অর্জুনের সঙ্গে শেষ এবং চরম যুদ্ধের আগে তিনি আরও একটা ভুল করে ফেললেন মদ্ররাজ শল্যকে নিজের রথের সারথি নির্বাচন করে। শল্য নিঃসন্দেহে খুব ভাল সারথি ছিলেন, কিন্তু দুর্যোধনের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে কৌরবপক্ষে যোগ দেবার পরপরই তিনি কিন্তু যুধিষ্ঠিরের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন যে, কর্ণের সারথ্য করার সময় তিনি কর্ণের মনোবল ভেঙে দেবেন। তাই হল। দুর্যোধনের মাধ্যমে কর্ণ শল্যকে সারথি পেলেন বটে। কিন্তু সারাটা কর্ণপর্ব জুড়ে কর্ণের চরম সমাপতন পর্যন্ত শল্য কেবলই কর্ণের কাছে ভ্যানভ্যান করে অর্জুনের প্রশংসা করে গেছেন, আর ক্রমাগতই কর্ণের মনঃস্থিতি নষ্ট হয়েছে। যুদ্ধকালে অথবা রথস্থ বীরকে যদি ক্রমাগতই ভয় পাওয়ানোর চেষ্টা করা হয়, তবে অল্পসত্ত্ব ব্যক্তির পতন ঘটে, আর মহাসত্ত্ব ব্যক্তি, তিনি যতই যুদ্ধক্ষম হোন না কেন, তাঁর মনঃসংযোগ ব্যাহত হয়। প্রথম প্রথম যখন শল্য বলে যেতেন, তখন কর্ণ উদাসীনভাবে খানিকটা ধরে খানিকটা ছেড়ে দিয়ে শল্যকে বলতেন— ঠিক আছে, ঠিক আছে, এখন চল দেখি— যাহি যাহীতি। কিন্তু শেষে তাঁর ধৈর্য চলে গেল এবং শল্যকে তাঁর দেশ তুলে, ব্যক্তিত্ব তুলে, অশ্লীল কথা বলে মাথা গরম করতে থাকলেন কর্ণ। মনঃসংযোগ ক্রমেই নষ্ট হতে থাকল। তিনি বাইরে যতই ভয়কে অস্বীকার করুন না কেন তাঁর অন্তরে নিশ্চয়ই এক অজানা, অনামা আশঙ্কা ছায়া ফেলতে লাগল।
একটা কথা মনে রাখতে হবে যে কর্ণের সেনাপতিত্বকালে তাঁর ন্যায়নীতির দিকটা বিশেষভাবে লক্ষ করার মতো। দেখুন, সারা জীবন ধরে যিনি দুর্যোধনের দুঃশাসনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কত শত অন্যায় আচরণ করেছেন, পাণ্ডবদের প্রতি অসহ্য অত্যাচার করেছেন, তাঁদের প্রিয়তমা কুলবধূকে পর্যন্ত আপন বিকার থেকে রেহাই দেননি, সেই কর্ণ কিন্তু নিজের সেনাপতিত্বকালে কোনও অন্যায় করেননি, এমনকী সামান্য নীতিভঙ্গও নয়। অর্জুনের খাণ্ডবদহনের কালে যে সাপটি প্রতিশোধস্পৃহায় এসে কর্ণের তূণে আশ্রয় করেছিল, সেই সর্পমুখ বাণ কর্ণ অর্জুনের বিরুদ্ধে ছুড়েছিলেন নিজের অজান্তে— ন চাপি তং বুবুধে সূতপুত্রঃ। সেই সর্পবাণে অর্জুনের রেহাই ছিল না, তিনি বাঁচলেন শুধু কৃষ্ণের সারথ্যকৌশলে। কিন্তু এই ভয়ঙ্কর সাপ আবার এসে কর্ণের তূণে প্রবেশ করতে চাইল এবং কর্ণকে সে অনুরোধ করল দেখেশুনে যাতে তাকে ঠিকমত অর্জুনের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়, কারণ ঠিকমত প্রয়োগ করতে পারলে এই সর্পমুখ বাণ থেকে অর্জুনের রেহাই নেই। কিন্তু কর্ণ রাজি হননি, তার সেই চিরাচরিত বলদর্পিতাই কিন্তু এখানে তাঁর গুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কর্ণ বললেন— অন্যের শক্তি আশ্রয় করে কর্ণ কোনওদিন কারও ওপরে জয়ী হতে চায় না— ন নাম কর্ণোহদ্য রণে পরস্য বলং সমাস্থায় জয়ং বুভূষেৎ। একশোটা অর্জুনকে মেরে ফেলতে পারলেও কর্ণ কোনওদিন এক শর দু’বার ধনুকে যোজনা করে না। কথাটা আরও একটু ঘটা করে একেবারে গুরু পরশুরামের নাম জড়িয়ে কর্ণ বলেছেন পরবর্তীকালের এক কবির লেখনীতে। কর্ণ বলেছেন— সারা গায়ে যেন জল পিছলে পড়ছে এমনিতর কর্ণ-বধির সাপ তুমি কর্ণকে চেননা— ন বেৎস্যপকর্ণ কর্ণম্— তুমি জান না যে পরশুরামের শিষ্য কর্ণ কখনও দু’বার একই শর সন্ধান করে না— দ্বিঃ সন্দধাতি ন শরং হরশিষ্য-শিষ্যঃ। সমস্ত দুনিয়ার সঙ্গে তুমিও বরং তাকিয়ে দেখো কী করে এই মানুষের উপযুক্ত শরপ্রহারেই কিরীটী অর্জুনের কিরীট-পরা মাথাটা আমি ধড় থেকে নামিয়ে দিই— মর্তৈঃ শরৈরপি কিরীটি-কিরীটমাথম্।
পরবর্তী কবির লেখনীতে কর্ণের এই দম্ভোক্তির মধ্যেই কর্ণের চরিত্রটি মহাভারতের মতো করে পাব। এই যে কর্ণ বললেন— ‘মানুষের উপযুক্ত শর’— এই কথাটাই প্রণিধানযোগ্য। সমস্ত কর্ণপর্বে কর্ণ একজন সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠেছেন, যা তিনি হতে চেয়েছেন। যে মুহূর্তে কর্ণ কুন্তীর দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে হীনকুলে লালিত হতে লাগলেন, সেই মুহূর্তেই দৈবায়ত্ত জন্মের ওপরে কর্ণের ঘৃণা ধরে গেছে। দৈববশে নিজের জন্মের জন্যই যে মানুষ কলঙ্কিত, মহামতি ব্যাস একটু একটু করে সেই মানুষের সমস্ত দৈবাধীনতা হরণ করেছেন। সূর্যের ছেলে হওয়া সত্ত্বেও সেই পরিচয় থেকে তাঁকে বঞ্চিত করেছেন, তাঁর সহজাত দৈব কবচ-কুণ্ডল কেটে দিয়েছেন ইন্দ্রের হাতে, অমোঘ দৈব-শক্তি প্রয়োগ করিয়েছেন রাক্ষসের ওপর। এখন একমাত্র দৈবসম্পদ যে সর্পমুখ বাণ, সেটিকেও তিনি দ্বিতীয়বার কর্ণের তূণে ঢুকতে দিলেন না। মহাকবি যেন একে একে কর্ণের সমস্ত দৈবসজ্জা মুক্ত করে, তাঁকে রণদর্পে, আত্মশ্লাঘায় নিতান্ত মাটির মানুষটি করে তুলেছেন। ঠিক এমন একটা মানুষের রথের চাকা মাটিতেই দেবে যায়, অন্তকালে সে চাকা আর মাটি থেকে তোলা যায় না। ভাগ্যহত পুরুষের ভাগ্যচক্র বার বার মাটিতেই প্রোথিত হয় আর ঠিক সেই মুহূর্তে ওপর থেকে ঝলসে ওঠে অগ্নিবাণ, বায়ুবাণ, ব্রহ্মাস্ত্র— মানুষ কর্ণের ছিন্ন মুণ্ড তখন মাটিতে গড়াগড়ি যায়।
আমরা আগেই বলেছি কর্ণের উচ্চাভিলাষ ছিল অসম্ভব রকমের এবং সেই উচ্চাভিলাষ তিনি পূর্ণ করতে চেয়েছেন দুর্যোধনের কাঁধে ভর রেখে। বাস্তবে পাণ্ডবদের প্রতি অতি কঠিন দুর্যোধন কর্ণের এতটাই বন্ধু যে সময়ে অসময়ে কর্ণের আজ্ঞাবাহী হতেও দুর্যোধনের বাধে না। এই বন্ধুত্বের সুবাদে কর্ণ দুর্যোধনের বকলমে পুরো হস্তিনাপুরের রাজনীতি চালনা করেছিলেন— এতটাই বলা যায়। ঠিক এই কারণেই কুরুসভার যত অন্যায়, তার সমস্ত দায় এসে পড়েছে কর্ণের ঘাড়েই। অন্তিমলগ্নে যখন কর্ণের রথচক্র গ্রাস করেছে পৃথিবী, তখন কর্ণ অর্জুনকে ধর্মের কথা তুলে থামতে বলেছিলেন, নিরস্ত্রের ওপর শর যোজনা করতে বারণ করেছিলেন। উত্তরটা দিয়েছিলেন স্বয়ং বাসুদেব কৃষ্ণ। কর্ণ মুখ ফসকে বলেছিলেন— দৈববশে এই মুহূর্তে আমার রথের চাকা আটকে গেছে মাটিতে। অন্তত এই সময়টাতে তুমি বাণের অভিসন্ধি ত্যাগ করো অর্জুন। ‘দৈব’, কর্ণের মুখে ‘দৈব’— কথাটা মহাভারতের কবির কানে লেগেছে তৎক্ষণাৎ স্বয়ং পুরুষোত্তম কৃষ্ণের মুখ দিয়ে মহাকবি বলিয়েছেন— বদমাশ লোকেরা যখন বিপদে পড়ে, তখনই দৈবের দোষ দেয়, নিজের বদমায়েশির কথা মনে করে না— প্রায়েন নীচা ব্যসনে নিমগ্না নিন্দন্তি দৈবং কুকৃতং ন তু স্বম্।
অর্থাৎ কবি বলছেন— না দৈব নয়, যিনি দৈবকে এতকাল ঘৃণা করে এসেছেন, তাঁর মৃত্যুর জন্য দৈব দায়ী হবে কেন, তার মৃত্যুর জন্য তিনি নিজেই দায়ী। তিনি কর্ণের অসহায় মৃত্যুর সমস্ত মানুষোচিত কারণগুলি একে একে কৃষ্ণের মুখে আবার স্মরণ করেছেন। কৃষ্ণ বলেছেন— যেদিন একটি মাত্র কাপড় পরা দ্রৌপদীকে তুমি আর দুর্যোধনের দল সবাই মিলে কুরুসভায় নিয়ে এসেছিলে সেদিন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? যেদিন পাশাখেলায় অজ্ঞ যুধিষ্ঠিরকে অক্ষশৌণ্ড শকুনি জিতে নিল, সেদিন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল— ক্ক তে ধর্মস্তদা গতঃ? যেদিন তোমার মত অনুসারে দুর্যোধন ভীমকে বিষ খাইয়েছিল— আচরত্তন্মতে রাজা ক্ক তে ধর্মস্তদা গতঃ— সেদিন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? তেরো বচ্ছর বনবাসে কাটিয়ে যেদিন পাণ্ডবেরা এসে তাঁদের রাজ্য-ভাগ চেয়েছিলেন এবং তোমরা এক টুকরো জমি দাওনি, সেদিন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? যেদিন বারণাবতের জতুগৃহে সমস্ত পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার মতলব করেছিলে, সেদিন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? যেদিন রজস্বলা পাণ্ডববধূকে দুঃশাসনের হাতে ছেড়ে দিয়ে তুমি হাঃ হাঃ করে হেসেছিলে, সেদিন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল কর্ণ— সভায়াং প্ৰাহসঃ কর্ণ ক্ক তে ধর্ম স্তদা গতঃ? যেদিন সমস্ত নারীসমাজের মধ্যে থেকে টেনে এনে গজগামিনী কৃষ্ণাকে তুমি বলেছিলে— পাণ্ডবদের সব শেষ হয়ে গেছে দ্রৌপদী, তুমি অন্য কোনও স্বামী খুঁজে নাও, সেদিন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল, কর্ণ? রাজ্যের লোভে যেদিন শকুনি পাশাখেলায় পাণ্ডবদের হারিয়েছিল, সেদিন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? যেদিন সমস্ত মহারথীরা একসঙ্গে মিলে একটি বাচ্চা ছেলে অভিমন্যুকে বধ করেছিলে, সেদিন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল, কর্ণ? এত শত সব ঘটনার মধ্যে যদি তুমি এতকাল ধর্মানুষ্ঠান না করে থাকো, তা হলে এখন আর ‘ধর্ম’ ‘ধর্ম’ করে গলার তালু শুকিয়ে কী হবে— কিং সর্বথা তালুবিশোষণেন? আর এখন এই মুহূর্তে যদি তুমি খুব ধর্মপরায়ণও হয়ে ওঠ, তবু এখন আর তোমার রক্ষা নেই।
দেখা যাচ্ছে, সারা জীবন ধরে দুর্যোধন যত অপকর্ম করেছেন, তার সবকিছুরই দায় এসেছে কর্ণের ওপর। কৃষ্ণের আক্ষেপোক্তি শুনে এই প্রথম এবং এই শেষবারের মতো কর্ণের মাথাটা লজ্জায় নত হয়ে গেল, এক পংক্তি উত্তর পর্যন্ত তাঁর মুখে জোগাল না— লজ্জয়াবনতো ভূত্বা নোত্তরং কিঞ্চিদুক্তবান্। মহাভারতের কবি বলতে চাইলেন— দৈব নয়, এতগুলি স্বকৃত অন্যায়ের জন্যই কর্ণ আজ এত অসহায়। তিনি যা করেছেন এবং করেননি, তা সবই তিনি চুকিয়ে দিয়েছেন নিজের অসহায় মৃত্যু দিয়ে। কর্ণ মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে কৌরবদের যশ, দর্প এবং জয়াশা একসঙ্গে উবে গেল। যুদ্ধশেষের অপরাহ্নে কর্ণের ছিন্ন মুণ্ডটি পড়ে রইল মাটিতে, তার ওপরে সন্ধ্যাসূর্যের শেষ অস্তরাগের ছোঁয়া এসে লাগল, ছিন্ন মুণ্ডটি মনে হল যেন অস্তসূর্যের সম্পূর্ণ বিম্ব বুঝি— অস্তঙ্গতং ভাস্করস্যেব বিম্বম্। কর্ণ মারা যাবার পর কর্ণকে নিয়ে যত উপমা দিয়েছেন ব্যাস, তা সবই প্রায় সূর্যকে নিয়ে। ভাবে বুঝি সূর্য যে অন্যায় করেছিলেন কর্ণের জন্ম দিয়ে, তাঁর মৃত্যুর পর মহাকবি যেন সূর্যের উপমায় তাঁর পুত্রতৰ্পণ সমাপ্ত করছেন এখন। ব্যাস লিখলেন— অস্ত যাবার সময় সূর্য যেমন তাঁর সমস্ত প্রভা প্রত্যাহার করে নিয়ে যান, তেমনি কর্ণের জীবন-জ্যোতিও তিনি প্রত্যাহার করে নিলেন পৃথিবী থেকে। এতদিন যাঁর শর-কিরণজালে শত্রুসেনা তপ্ত হয়ে উঠেছিল, সেই কর্ণসূর্য গ্রস্ত হল অর্জুনের রাহুগ্রাসে। দিনের শেষে যখন অপরাহ্ন ঘনিয়ে আসছিল যুদ্ধভূমিতে, ঠিক সেই সময় কর্ণেরও জীবন-অপরাহ্ন ঘনিয়ে এল। সহস্রনেত্র ইন্দ্রের মতো যাঁর ক্রিয়াকলাপ, সহস্রদল পদ্মের মতো যাঁর মুখ, সেই কর্ণের ছিন্ন মুগু মাটিতে পড়ে থাকল যেন দিনশেষের অস্তরাগে রাঙানো সহস্ররশ্মি সূর্যটি।
কর্ণের মৃত্যু হল বটে, কিন্তু এই মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মহাকাব্যিক মৃত্যু ঘটে যায় না। বিশেষত যেখানে এই বিশাল চরিত্রকে আমরা শুধু মহাভারতের সামাজিক প্রেক্ষিতেই দেখবার চেষ্টা করেছি, তাতে এই চরিত্রের মধ্যে অনেক অতিক্রান্ত ঘটনা থেকে যায়, যেখানে এই রকম না হয়ে অন্য রকম কিছু ‘হইলেও হইতে পারিত’ ধরনের ইঙ্গিত থেকে যায়। মহাকাব্যের কবির সহস্রার নির্মাণ-কৌশলের মধ্যে এমনই কতগুলি ইঙ্গিত থেকে যায়, যেগুলি পরবর্তী কালের ‘মিথ’ তৈরি করে দেয়। হ্যাঁ, মহাভারতের মধ্যে রাজনৈতিক জটিলতা যতখানি আছে এবং তার সঙ্গে ক্ষত্রিয়-বৃত্তির মর্যাদা এবং কৌলীন্যও যতখানি মিশে আছে, তাতে বিপ্রতীপ ভাবনায় কর্ণ-চরিত্র হয়ে উঠেছে আরও জটিল এবং বিপ্রতীপভাবেই তা উজ্জ্বল।
খেয়াল করে দেখুন, এই যে জন্মমাত্রেই জননী কুন্তী সদ্য প্রসূত শিশুটিকে অশ্বনদীর জলে বিসর্জন দিলেন, অথবা খুব সাধারণ ভণিতায়, এক কুমারী কন্যা নিজের ভবিষ্যৎ-লজ্জা নিবারণের জন্য আপন গর্ভজাত পুত্রটিকে জলে ভাসিয়ে দিলেন— এই রকম একটা ঘটনা তো কিছু নতুন নয়। আজও এই একবিংশ শতাব্দীর জল-জঙ্গল-নোংরা ফেলার ভ্যাটে আমরা এইরকম কানীন শিশুর সাক্ষাৎ পাই, কখনও মৃত, কখনও বা জীবিতও— আমরা দেখি, শুনি, পুলিশে খবর দিই, স্বভাবে-কল্পিতা সেই কুমারী জননীর উদ্দেশে গালাগালি বর্ষণ করি, তারপর সম্পূর্ণ দায়িত্বহীন অবস্থায় ফিরে আসি। এইরকম শিশু জীবিত থাকলে— তার গতি অরফ্যানেজ, হোম ইত্যাদি, অনেক সৌভাগ্য থাকলে দেবতার মতো উপস্থিত হন অপুত্রক কোনও জনক-জননী। কিন্তু আমরা, আমরা তারপর কতটুকু খবর রাখি।
আমি বলেছিলাম— কর্ণের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মৃত্যু হয় না। কেননা কুমারীর পরিত্যক্ত শিশুর জীবন-সমস্যা আজও পর্যন্ত প্রসারিত এবং আরও প্রসারিত তার জটিল মনস্তত্ত্বের বিস্তীর্ণ আকাশ। আজকাল অপুত্রক জনক-জননীরা কথঞ্চিৎ সদয়। আমি উদার বলছি না একবারও; বরঞ্চ সদয় বলছি এই কারণে যে, তাঁরা কেউ দয়া করে দত্তক নেবার দিকে সামান্য ঝুঁকছেন। আমি বিদেশিদের কথা বলছি না, কিন্তু এ-দেশের দত্তক নেবার ভাবনার মধ্যে আমি এত আশঙ্কা দেখেছি, তা কহতব্য নয়। আমি এক মহিলাকে দেখেছি, তিনি তাঁর সন্তানহীনতার জন্য বহুল দুঃখ প্রচার করেছেন এককালে, তিনি কর্মরতা বলে সহকর্মীরাও তাঁকে আলতোভাবে কোলে করে রাখেন, যাতে অন্যকৃত কর্মে তাঁর হৃদয়ে এতটুকুও আঘাত না লাগে, কিন্তু দত্তকের প্রশ্নে আমি এই মহিলাকে জঘন্য কথা বলতে শুনেছি। কুমারী অবস্থায় জাত প্রায় সকল শিশুকেই তিনি বদমাশ, গুণ্ডা, মাস্তান ইত্যাদির বলাৎকৃত সন্তান ভাবেন এবং তাঁর ধারণা— এই রকম শিশুরা রক্তের দোষেই ভবিষ্যতে চোর-গুণ্ডা-মস্তান ছাড়া আর কিছু হবে না। এই কথা শোনার পরেই আমি বুঝেছি— শুধু বাৎসল্য নয়, বাৎসল্যহীন অন্য এক স্বার্থ বা আইডেনটিটিও বহুতর স্বামী-স্ত্রীর অন্যতম জ্ঞাতব্য বিষয়। মহাভারতের কর্ণ-চরিত্র এই বিষয়ে অসাধারণ এক ‘পয়েন্টার’ হিসেবে কাজ করে।
প্রথমত মহাভারত দেখাতে চায় যে, বলাৎকার-প্রসূতই হোক, অথবা কোনও নারীপুরুষের সম্মিলিত ইচ্ছায়, অথচ সামাজিক নিয়মের বাইরে এমন সন্তান প্রসূত হলেও কুমারী জননী তাঁর সন্তানকে ভোলেন না। যদি বা কেউ সমাজের কারণে বা আত্মসর্বস্বতায় সাময়িকভাবে ভোলেনও, তবুও জননীর হৃদয় আকাশ থেকে সেই তারার মৃত্যু হয় না। কুন্তীকে তো দেখলাম— তিনি শতবার শত মন্ত্র পড়ছেন যাতে দৈব তাঁর সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখে সবচেয়ে বড় কথা, বিয়ে হয়ে যাবার পরেও, স্বয়ং মহাভারতের কবি তাঁর পুত্র-বিষয়ে অদম্য কৌতূহল জানিয়েছেন— কুন্তী রাজবাড়ির বিশ্বস্ত দাসী-চরদের বলে রেখেছিলেন— কোথাও যদি সোনার কবচ-কুণ্ডল-পরা কোনও ছেলের খবর পাও, আমাকে জানিও। দাসী-চরেরা অনেক ঘুরে অনেক জায়গায় খবর নিয়ে তাদের রানিমাকে খবর এনে দিয়েছিল— সেই যে অঙ্গরাজ্যের রাজধানী চম্পা, সেখানে সারথি-জাতের লোকেরা আছে এক গুষ্টি— সেই সূতবিষয়ে এই রকম একটি ছেলে বড় হয়ে উঠছে, অল্পবয়স থেকেই ছেলেটি বেশ নজর কাড়বার মতো— পৃথা-কুন্তীর কাছে চর-মারফৎ সব খবর এসে পৌঁছল— চারেণ বিদিতশ্চাসীৎ পৃথয়া দিব্যবৰ্মভৃৎ।
হস্তিনাপুর থেকে কত দূরে কোনও অঙ্গরাজ্যের চম্পানগরীতে তাঁর শিশুপুত্র মানুষ হচ্ছিল— এ-কথা যেমন কুন্তী জানেন, তেমনই তিনি জানেন যে, রাধেয় বসুষেন অস্ত্রশিক্ষার আসরে এসেছিল তাঁরই অন্যতর পুত্র অর্জুনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কর্ণ যখন অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইলেন, সেদিন কুন্তী স্ত্রীলোক-দর্শকদের মধ্যে রঙ্গমঞ্চে বসে থাকলেও উত্তেজনায় অজ্ঞান হয়ে গেলেন। কুন্তী কিছু বলতে পারেননি। বলতে পারেননি— কর্ণ এবং অর্জুন দু’জনেই তাঁর ছেলে। আবার কর্ণ যখন অঙ্গরাজ্য পেলেন, কুন্তী তখন খুশি হলেন মনে মনে, হয়তো বা খুশি হলেন আরও যেদিন থেকে কর্ণ হস্তিনাপুরেই থাকতে আরম্ভ করলেন দুর্যোধনের ছত্রচ্ছায়ায়। কিন্তু পঙ্কিল রাজনীতির মধ্যে কর্ণ যখন পঞ্চপাণ্ডবের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলেন, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের ঘটনা ঘটল তাঁরই পরোক্ষ নির্দেশে— এই সব সময় জননী হিসেবে কুন্তীর কী মানসিক বিপর্যয় ঘটেছিল, সেটা মহাভারতের কবি স্বকণ্ঠে জানাননি এবং পরবর্তী কালেও কোনও কবি-মহাকবি কুন্তীর মানস নিয়ে তেমন কোনও কবিতা লিখলেন না।
মহাভারতের কবির দেখানোর বিষয় ছিল— কার গর্ভে কার ঔরসে জন্ম নিল এক শিশু— এই শুক্র-শোণিত সম্পর্ক হয়তো তাঁর মৌল গঠন তৈরি করে, হয়তো বা গঠন করে তার মৌল প্রকৃতি— সে বীর, সে ভীরু, সে উদ্যোগী— এইরকম স্বভাব অথবা শারীরিক বিকাশ— কিন্তু একটা মানুষ-শিশু জননীর পরিত্যক্ত হলে সে যেখানে মানুষ হচ্ছে, বড় হয়ে উঠছে, সেই পরিবেশই তাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। পালক পিতা অধিরথের ঘরে অথবা পালিকা মাতা রাধার কাছাকাছি আর কতটুকু ছিলেন কর্ণ, সেই বালক বয়স থেকেই তো তিনি হস্তিনাপুরের রাজনীতিতে জড়িয়ে গেলেন দুর্যোধনের সঙ্গে। অর্জুনের সঙ্গে শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা যদি মৌল বীর স্বভাবের অভিব্যক্তি হয়ে থাকে, তবে দুর্যোধনের সঙ্গে থাকতে থাকতে তিনি তো সম্পূর্ণ পাণ্ডব-বিরোধিতাতেই জড়িয়ে গেলেন— দ্রৌপদী, ভীম, যুধিষ্ঠির— কারও ব্যাপারেই তাঁর মন্তব্য, বক্তব্য অথবা কর্তব্য— কোনওটাই দুর্যোধনের ব্যবহার থেকে পৃথক ছিল না। হয়তো কখনও কখনও কর্তব্য বিষয়ের ভাবনায় কর্ণের স্বভাব-বীরত্ব আখ্যাত হয়েছে অর্থাৎ লুকিয়ে চুরিয়ে নয়, কোনও কপটতা দিয়ে নয়, সামনা-সামনি যুদ্ধেই সমস্ত কিছুর সমাধান করতে চেয়েছেন তিনি, কিন্তু দুর্যোধন কিংবা শকুনির ছলনা বা কপটতার যুক্তিতে তিনি যখন প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন, তখন সেই ছলনা, কপটতার মধ্যে তিনি কিন্তু উপস্থিত আছেন পুরো মাত্রায়।
মহাভারতের কবি দেখাতে চেয়েছেন— জন্মের সংস্কার নয়, জনক-জননী শুক্র-শোণিতের স্বভাব নয়— কেননা সেই দিক থেকে ভাবলে সূর্যের ঔরসে কুন্তীর গর্ভজাত সন্তানের সংস্কার তো যুধিষ্ঠির, ভীম কিংবা অর্জুনের মতোই সরল বীরত্বে উজ্জ্বল হওয়া উচিত ছিল— তা যে হয়নি, তার কারণ হল— পারিপার্শ্বিক পরিবেশের যে সংস্কারে মানুষ বড় হয়ে ওঠে, তারই প্রভাব জীবন-গঠনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কথাটা ভীষ্মের মুখ দিয়ে উচ্চারিতও হয়েছে একাধিকবার, কিন্তু ভীষ্ম কর্ণের জীবনে পালক পিতা সূত অধিরথের সংস্কারকেই বেশি মূল্য দিয়েছেন, কিন্তু আমরা মনে করি— এটা উপলক্ষ্য মাত্র, আসলে যত সময় ধরে কর্ণ সূত অধিরথের ঘরে লালিত হয়েছেন, তার চেয়েও বেশি তিনি পালিত হয়েছেন দুর্যোধনের বন্ধুত্ব-ছত্রের ছায়ায়। এই সংস্কারই তাঁর জীবনে অনেক বেশি তাৎপর্য বহন করে।
আমাদের বক্তব্য— কর্ণের চরিত্রসৃষ্টিতে মহাকাব্যের কবির এই অঙ্গুলী-সংকেত আমরা বুঝি, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিজীবনে তাঁর জন্ম-যন্ত্রণার যে তথাকথিত গ্লানি, যা বারবার তাঁর জীবনের ইচ্ছাপূর্তির মুহূর্তগুলিকে আচ্ছন্ন করেছে, মহাকাব্যের কবি সেগুলিকে খুব প্রসারিত ব্যাকুল দৃষ্টিপাতে বর্ণনা করেননি। অস্ত্রপরীক্ষার আসরে যে চরম ক্ষণ এসেছিল, সেখানে যেমন তাঁকে সূতপুত্রত্বের নিন্দাপঙ্ক গায়ে মাখতে হয়েছিল, ঠিক তেমনই দ্রৌপদীর স্বয়ংবরে মীনচক্ষু বিদ্ধ করার পূর্ব মুহূর্তেই শুনতে হয়েছিল— নাহং বরয়ামি সূতম্— আমি সূতপুত্রকে বরণ করব না— শক্তি-ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বারংবার জন্মের এই বিড়ম্বনা সহ্য করাটা যে কতটা যন্ত্রণাদায়ক, সেটা মহাকাব্যের কবি ঘটনা দিয়ে বোঝান, কিন্তু মন্তব্য করেন না। শুধু কর্ণের হৃদয়-যন্ত্রণাটুকু নিপুণ ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেন, যখন বারবার এই কলঙ্করোপন ঘটতে থাকে এবং প্রত্যেকটি অপমানের পর কর্ণ সূর্যের দিকে তাকান।
আসলে পালিত হতে হতে কর্ণ তাঁর জন্মরহস্য জানতেই পেরে গিয়েছিলেন হয়তো এবং হয়তো সেই অভিমানেই নিজেকে ‘রাধেয়’ বলে পরিচয় দিতে গর্ব বোধ করতেন। পরবর্তী কালের মহাকবি মহাভারতের কর্ণের ওপরে তাকিয়েছেন করুণ দৃষ্টিপাতে। কৌরব-সভার বিচিত্র রাজনীতিতে কর্ণ যে-যে-ভাবে পাণ্ডবদের ওপর প্রতিশোধ নিয়েছেন, কিংবা দ্রৌপদীকেও তিনি যেভাবে অপমান করেছেন অথবা সামগ্রিকভাবে দুর্যোধনের দুঃসঙ্গে কর্ণ কতটা প্রভাবশালী নেতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন— এই বিরাট বিতত জীবন তথা চরিত্রের মৌল রহস্য যে তার কানীন জন্ম, তাঁর শৈশবিক বিসর্জন এবং তাঁর পালিত হওয়ার সংস্কারের মধ্যেই নিহিত, সেটা প্রকট করে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। কর্ণ-কুন্তীসংবাদের মূল ঘটনা মহাভারত থেকেই নেওয়া বটে কিন্তু কর্ণ এবং কুন্তী উভয়ের সংলাপেই এখানে করুণ রসের এমন বিনিময় ঘটেছে যা মহাভারতে স্পষ্ট এবং প্রত্যক্ষভাবে না থাকলেও, তার সূত্র আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। রবীন্দ্রনাথ কর্ণের শৈশব-যন্ত্রণা যেভাবে প্রকট করেছেন, সেটা মহাভারতের কবির আশয়-বহির্ভূত নয় মোটেই, বরঞ্চ তা প্রাচীন কবির মানস-লোকেরই অপূর্বনির্মাণ এবং রবীন্দ্রনাথের মতো সংবেদনশীল কবিই মহাকাব্যের হৃদয় থেকে এই সঙ্কেত আহরণ করতে পারেন।
মহাভারতের যুদ্ধোদ্যোগপর্বে কর্ণ-কুন্তীর প্রথম মুখোমুখি সংলাপ সংঘটিত হবার সময় অপেক্ষমাণা কুন্তীকে কর্ণ প্রথম নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন— আমি কর্ণ, আমি রাধা-মায়ের সন্তান, অধিরথের পুত্র, আমি আপনাকে অভিবাদন জানাচ্ছি— রাধেয়োহমাধিরথিঃ কর্ণস্ত্বামভিবাদয়ে। সংস্কৃতে এই ‘রাধেয়’ শব্দটা ব্যবহার করলে পালিকা মায়ের পুত্রই বোঝাতে পারে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যখন কর্ণের মুখে— ‘অধিরথ সূতপুত্র রাধাগর্ভজাত’ কথাটা ব্যবহার করেন, তখন কর্ণের নিজস্ব অভিমানটুকু তীব্রতর হয়ে ওঠে। নিজেকে রাধার গর্ভজাত বলে প্রমাণ করার মধ্যে কর্ণের জন্মযন্ত্রণা যখন বিপ্রতীপভাবে করুণ, তখন তার মধ্যে আরও বিপ্রতীপ সেই সম্বোধন— তুমি কুন্তী অর্জুনজননী? একদিকে নিজের আত্ম-পরিচয়ের মধ্যে পালিকা মাতার গর্ভে নিজের সত্তা অন্বেষণ, অন্যদিকে গর্ভধারিণী জননীকে প্রতিপক্ষের সত্তায় চিহ্নিত করা— এই দুই পরস্পর-বিরোধী, অথচ একেবারেই ইচ্ছাকৃত আরোপ রবীন্দ্রনাথের লেখা কর্ণ-কুন্তী-সংবাদের আবেগ তৈরি করেছে কাব্যিক সরসতায়। কর্ণের প্রতি বঞ্চনা এখানে কুন্তীর আত্মপক্ষ-সমর্থনের প্রয়াসকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। পুরাতন সত্য অন্য এক নতুন সত্য হয়ে ওঠে কালোচিত সম্প্রয়োগে, যদিও এই সত্য বৈয়াসিক মহাভারতের প্রবাহিনী সহস্রধারার মধ্যে স্ফুটাস্ফুট ফল্গুর মতো আচ্ছন্ন ছিল।
মহাভারতে কুন্তী-কর্ণ-সমাগমে যে সংলাপ আছে, তা অনেকটাই মহাকাব্যিক রূঢ়তায় আবেগহীন। কুন্তী এখানে কর্ণকে তাঁর গর্ভধারিণী জননী হবার সুবাদ শোনাচ্ছেন বটে, কিন্তু সে অনেকটাই সংবাদের মতো— তুই সূতপুত্র নোস, তুই আমার ছেলে— অনেকটা এইরকম অধিকার-প্রধান শব্দরাশি, জননীর আবেগ সেখানে ধরা পড়ে না, রবীন্দ্রনাথ সেখানে বেশি সারসিক, কন্যা-জননীর হৃদয় উদঘাটনে পরম নিপুণ। অন্যদিকে মহাভারতের কর্ণকে দেখুন, তিনি ‘সত্যধৃতি’ সত্য থেকে নড়েন না, সত্যকে ধারণ করে আছেন। অতএব নির্মম, কুন্তীকে তিনি চরম কথা বলেন নিজের ওপর তাঁর বঞ্চনা প্রকট করে। বিশেষত ক্ষত্রিয়ের ঘরের সংস্কার লাভ করলে, তাঁর জীবন যে কত সহজ হত, সেই কথা শোনানোর সময় কর্ণ এমনও বলেন যে, ছেলে জন্মানোর সময় তুমি মায়ের কাজ একটুও করলে না, আর নিজের স্বার্থে এখন তুমি আমায় ফিরিয়ে নিতে এসেছ, এটা হয় না। তোমার মতো পাপিনীর জন্যই আমার সমস্ত জীবনের ভোগান্তি, তোমার মতো অন্যায় পাপ আমার কোনও শত্রুও করেনি— ত্বৎকৃতে কিন্নু পাপীয়ঃ শত্রু কুৰ্য্যান্মমাহিতম্।
এরই বিপরীতে, ‘যাব মাতঃ, চলে যাব, কিছু শুধাব না— না করি সংশয় কিছু না করি ভাবনা’— কর্ণের এই সাময়িক সব ভুলে যাওয়া— এটা কানীন তথা শৈশবে বিসর্জিত পুত্রের মাকে ফিরে পাবার প্রথম উচ্ছ্বাস এমনভাবে আর্ত করে তোলে, যা মহাভারতের মহাকাব্যিক বিস্তারের মধ্যে সম্ভবই ছিল না। অথচ এটাও ভীষণ রকমের এক জীবন-সত্য এবং তা রবীন্দ্রনাথের কর্ণ-কুন্তী-সংবাদে কাব্যিক সত্যে পরিণত হয়েছে।
অবশ্য রবীন্দ্রনাথের কথা আর কী বলব, অনেক পৌরাণিক সত্যকেই তিনি নতুন এক মহনীয়তায় আস্বাদ্য করে তুলেছেন। তবে বিশেষত কর্ণের ব্যাপারে এটা বলতেই হবে যে, তাঁর চরিত্রের মধ্যেই সরসতার এমন সব বীজ ছিল, যাতে শুধু এই রবীন্দ্রনাথ নন, প্রাচীন থেকে নবীন, আরও অনেক কবিই— যেমন কালিদাসের পূর্বজ ভাসের কথা আমরা উল্লেখ করেছি, উল্লেখ করেছি বেণীসংহারের নাট্যকার ভট্টনারায়ণের কথাও। এঁরা সবাই কর্ণচরিত্রের সরল, ঋজু এবং পৌরুষদৃপ্ত দিকটি নিয়েই নাটক-শরীর নির্মাণ করেছেন, কিন্তু ক্ষত্রিয়ের নাম-গোত্রহীন জন্মের বিড়ম্বনা তাঁকে মহাকাব্যের সামাজিক প্রেক্ষিতে খানিকটা খাটো করে রাখলেও এইসব নাটকে তাঁর ঋজুতা, সরলতা, সত্যনিষ্ঠা এবং সবার ওপরে বীরত্বই অনেক অনেক বেশি মহনীয় হয়ে উঠেছে।
মহাভারতে অর্জুনের হিতৈষী ইন্দ্রদেব যখন ব্রাহ্মণবেশে কর্ণের কবচ-কণ্ডল হরণ করে নিয়েছিলেন, তখন যুদ্ধের উদ্যোগপর্ব চলছে। সেখানে শতেক বিচিত্র আলোচনা, দুর্যোধন-কর্ণের গোঁয়ার্তুমি, এতকাল বনে থাকা পাণ্ডবদের প্রতি তাঁদের অকরুণ ব্যবহার, একখানি গ্রাম, এমনকী সূচ্যগ্র মেদিনী পর্যন্ত দুর্যোধন বনপ্রোষিত পাণ্ডবদের ফিরিয়ে দিচ্ছেন না এবং যুদ্ধের ব্যাপারে দুর্যোধন কর্ণকেই ভরসা করে যাচ্ছেন আপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য— কৃষ্ণের শান্তিপ্রক্রিয়ার মধ্যে এই সব ঘটনা যখন আমাদের কর্ণের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলে, তারই পরবর্তী পটভূমিতে ইন্দ্রের মাধ্যমে কর্ণের কবচ-কুণ্ডল হরণের ঘটনাটি আমাদের অখুশি করে না, বরঞ্চ রাজ্যভ্রষ্ট বঞ্চিত পাণ্ডবদের প্রতি সমস্ত উদ্যোগপর্ব জুড়ে আমাদের সমবেদনা উদ্বেলিত হওয়ায় কর্ণের কবচ-কুণ্ডল হরণের ঘটনাটা আমাদের খানিকটা তৃপ্তই করে। কিন্তু ওই একই ঘটনা যখন মহাভারতের ঘটনারণ্য থেকে তুলে এনে অন্যতর মহাকবির হৃদয়-পুণ্ডরীকের মধ্যে স্থাপন করি, তখন তাঁর কবিজনোচিত সংবেদনশীলতার অরুণ-কিরণ সম্পাতে কর্ণের জীবন কমলকলির মতো ফুটে ওঠে।
ভাসের নাটকে ইন্দ্র কর্ণের কাছে ভিক্ষা চাইছেন, অথচ কর্ণের হাতি-ঘোড়া-গোরু দেবার প্রস্তাব, রাজ্য দেবার প্রস্তাব একটা একটা করে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে, ইন্দ্রের মুখে ভেসে আসছে সেই খল-কপট বঞ্চনার ঘোষণা— নেচ্ছামি কর্ণ নেচ্ছামি— আমি এটা চাই না কর্ণ! আমি এটা চাই না। অথচ ঠিক কোনটা চান, সেটাও লজ্জায় মুখ খুলে বলতে পারছেন না ব্রাহ্মণবেশী ইন্দ্র। ভিক্ষার্থী ব্রাহ্মণের কাছে খাবার-দাবার, হাতি-ঘোড়া এবং রাজ্যশাসনও পছন্দ হচ্ছে না, অথচ কোন সেই বিশেষ জিনিসটা যেটা ব্রাহ্মণের প্রয়োজন হতে পারে, এটা কর্ণও যেমন সরল ভাবনায় বুঝতে পারছেন না, তেমনই ইন্দ্রও সেটা আপন কপটতায় ব্রাহ্মণের ‘ইমেজ’ দেখিয়ে বলতে পারছেন না। এই অবস্থায় ইন্দ্র যেন তাঁকে দিয়ে বলিয়েই ছাড়লেন— তা হলে এটাই নাও, আমার জীবন-রক্ষার প্রতীক এই অভেদ্য বর্ম এবং কুণ্ডল। ইন্দ্র লালা ঝরিয়ে এবার বললেন— দদাতু দদাতু— দাও, দাও, এইটে দাও।
কর্ণের সারথি শল্য— মহাভারতে যিনি কর্ণের সারথ্যকালে তাঁর মানসিক শক্তি নষ্ট করার কাজ করেছিলেন, তিনি পর্যন্ত কর্ণকে বারণ করেছেন, স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন সম্ভাব্য বঞ্চনার কথা, কিন্তু কর্ণ শোনেননি। স্বকৃত প্রতিজ্ঞার ঋজুতা এবং যশোকামিতা তাঁকে বীরের সদ্গতি দিয়েছে। তিনি মনে করেন— স্বর্গের রাজা হওয়া সত্ত্বেও যাঁকে ধুলো পায়ে ব্রাহ্মণ্য ভিক্ষার কপটতা করতে হয়, তাঁর থেকে বঞ্চিত আর কে থাকতে পারে। এই মানসিক তুঙ্গতার মধ্যে ইন্দ্রের দূত যখন তাঁকে কবচ-কুণ্ডলের বিনিময়ে একাঘ্নী বাণ গ্রহণ করতে বলে, তখনও তাঁর বীরোচিত প্রত্যুত্তর— দান দিয়েছি, তার প্রতিদান নেব আমি? ধিক্— এই ধিক্কার কর্ণকে এক বিরাট বঞ্চনার মধ্যে আরও মহনীয় করে তোলে।
ভাস যেভাবে এই কর্ণচরিত্র সৃষ্টি করেছেন, সেখানে পরবর্তী নাট্যকার ভট্টনারায়ণের ক্ষমতাও কম নয়। তিনি ব্রাহ্মণ্য অধ্যুষিত সমাজের মধ্যে বাস করে যে প্রতীকী কালের মধ্যে কন্যা অবস্থায় জাত কানীন পুত্রদের ঘৃণার চোখে দেখতে শিখেছেন, সেই সময়ে তাঁর নাটকে প্রবাদের মতো যে উক্তিটি উচ্চারিত হয়েছে, সেটা এই সদ্যোগত বিংশ শতাব্দীতেও বহু শিক্ষিত মানুষের মুখে-মুখে ফিরত। ভাল বংশে জন্ম হওয়াটা দৈবের খেলা, কিন্তু পৌরুষ, বীরত্ব— সেটা তো আমি নিজে অর্জন করেছি— দৈবায়ত্তং কুলে জন্ম মদায়ত্তং তু পৌরুষম্— কর্ণের এই সপ্রতিভ উক্তিটি নিন্দিত-বর্ণ, কুলমানহীন কত মানুষের কাছে যে কত বড় সন্দীপনী মন্ত্র ছিল, সেটা আমি বারবার শুনেছি আমার ছোটবেলায়, জাতি-বর্ণ-বিদ্বেষের বিপরীত গবেষণায়। তবে ভাস— ভট্টনারায়ণ বা রবীন্দ্রনাথ— যিনি যেভাবেই কর্ণচরিত্রকে মহনীয় এবং আস্বাদ্য করে তুলুন, এই ‘রিক্রেয়েশন’-এর জায়গায় আমার সবচেয়ে ‘ইনট্রিগিং’ লাগে কাশীরামের মধ্যযুগীয় উদ্ভাবন। শুধুমাত্র একটা সম্ভাবনাকে কেন্দ্র করে তিনি এমন সুন্দর একটা রোম্যান্টিক গল্প তৈরি করেছেন, যেখানে মূল সংস্কৃত মহাভারতের ‘না বলা বাণীর ঘন যামিনী’র আড়াল থেকে হঠাৎই এক আলোর আভাস দেখা যায়। একথা আপনারা সবাই জানেন যে, স্বয়ংবর সভায় দ্রৌপদী কর্ণের বীরত্ব প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং সেই বীরত্ব বিবাহ-মুহূর্তের সন্ধিক্ষণেই প্রত্যাখ্যাত হল দ্রৌপদীর ঘোষণায়। আমরা ‘দ্রৌপদী’ প্রবন্ধে পূর্বে বলেছি যে, স্বয়ংবর সভার মধ্যেও কিছু কিছু কপটতা সেকালে থাকত এবং দ্রৌপদীর স্বয়ংবর-সভাতেও রাজা দ্রুপদ যে অর্জুনকেই তাঁর মেয়ের স্বামী হিসেবে চেয়েছিলেন, সেটা আমরা প্রমাণ দিয়ে বলেছি। কিন্তু নববধূর সাজে স্বয়ংবরা দ্রৌপদী যখন অন্য রাজাদের অনন্ত বিফলতার মধ্যে কর্ণের উন্মুখ বীরত্ব দেখলেন, দেখলেন যে শুধু মীনচক্ষু ভেদ করাই বাকি এবং সেটাও এই মানুষটি করবে, তখনই তো সেই অপলাপ অপশব্দ উচ্চারণ দ্রৌপদীর— আমি সূতপুএকে বরণ করব না।
মুখে এই কথা বললেও মন থেকে কি বিদায় নিল সেই পুরুষ! আমাদের মহাভারতের কবি স্পষ্টত কখনও এ-কথা জানাননি, দ্রৌপদীর মুখেও সে-সংবাদ আসেনি কখনও। বিশেষত বিবাহের পরপরই ইন্দ্রপ্রস্থে মহারানী হতে-না-হতেই তাঁর জীবনে এমন সব ঘটনা ঘটেছে এবং দুর্যোধনের বন্ধু কর্ণের ভূমিকা এমনই যে, দ্রৌপদীর মধ্যে কর্ণ-বিমুখতা বহুল হয়ে ওঠার কথা। অন্যদিকে স্বয়ংবর-সভায় প্রত্যাখ্যাত হবার কারণেই হোক অথবা দুর্যোধনের সহমর্মিতার কারণেই হোক অথবা দ্রৌপদী ভয়ংকর রকমের কাম্যা বলেই হোক, দ্রৌপদীর ব্যাপারে কর্ণের ভীষণ রকমের আক্রোশ ছিল, সেটা আমরা বুঝতে পারি। জিজ্ঞাস্য হয়, এই আক্রোশের অন্তরে ‘পুষ্পে কীটসম’ কোনও তৃষ্ণা জেগে ছিল কিনা। দ্বৈপায়ন ব্যাস স্পষ্টত কোনও খবর দেননি এ পক্ষেও। কিন্তু সম্পূর্ণ মহাভারত জুড়ে দ্রৌপদী-কর্ণের সম্পর্কে কোনও তন্তুবয়ন না থাকলেও একটা অদ্ভুত অপ্রত্যক্ষ সম্ভাবনার কথা সব সময়েই রয়ে গেছে— যদি কুন্তীর পুত্র হিসেবে সত্য-পরিচয় লাভ করতেন— তা হলে?
মূল সংস্কৃত মহাভারত এই সম্ভাবনা ধরেও কোনও কথা বলেনি, এমনকী মহাভারতের উদ্যোগপর্বে— কর্ণ-কুন্তী-সমাগমেও কুন্তী দ্রৌপদীর কথা একবারও তোলেননি। কর্ণ পাণ্ডবশিবিরে ফিরে এলে তিনিই রাজা হবেন, যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন— এঁরা সব তাঁর আজ্ঞাবহ হয়ে থাকবেন, এই সব কথা কুন্তী শুনিয়েছেন, কিন্তু পঞ্চভ্রাতার জ্যেষ্ঠতম হবার সুবাদে দ্রৌপদীও যে ভোগ্যা হবেন ‘অফিসিয়ালি’, সেটা কুন্তী একবারও বলেননি কর্ণকে। লক্ষণীয়, কুন্তীর মতো স্বয়ং কৃষ্ণের সঙ্গেও কর্ণের একান্ত কিছু কথা হয়েছিল। কর্ণের জন্মরহস্য কৃষ্ণ জানতেন এবং সেই কথা বলেই যুদ্ধের প্রাক্কালে কৃষ্ণ চেষ্টা করেছিলেন কর্ণকে পাণ্ডব-শিবিরে টেনে আনার জন্য। কৃষ্ণের কথাতেও সেই একই প্রস্তাব ছিল— কর্ণ ফিরে এলে তিনিই রাজা হবেন এবং যুধিষ্ঠির ভীমেরা তাঁর বশ্য অনুগত হয়ে কাজ করবেন। এখানেও কিন্তু দ্রৌপদীর প্রসঙ্গ আসেনি। ঠিক এইখানেই একটি গবেষণার তথ্য আমাদের জানাতে হবে।
মহাভারতের প্রায় কোনও সংস্করণেই কর্ণের প্রতি কৃষ্ণের প্রলোভক প্রস্তাবের কথা আসেনি। কিন্তু জৈমিনীয় মীমাংসা-দর্শনের ভিতরে একবার যেখানে দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামীর সঙ্গে বিবাহ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, সেখানেও ভট্ট কুমারিল পঞ্চস্বামীর তাত্ত্বিক একতা স্থাপন করেছেন। কিন্তু তিনিও কর্ণের প্রসঙ্গ টানেননি। অথচ এই গ্রন্থেরই অন্য একটি টীকায় সোমেশ্বর ভট্ট নামে এক প্রাচীন মীমাংসা-দার্শনিক দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামীর প্রসঙ্গে একটি মহাভারতীয় শ্লোকের কথা উল্লেখ করেছেন। এখানে উদ্যোগপর্বে কর্ণের সঙ্গে কৃষ্ণের দেখা হবার পর কৃষ্ণ তাঁকে অন্যান্য প্রলোভনের সঙ্গে এটাও বলেছেন— পাঁচ স্বামীর সঙ্গে দ্রৌপদীর যে বার্ষিক মিলন পর্যায় চলে, সেখানে ছয় বৎসরের মাথায় দ্রৌপদী এবার তোমার সঙ্গেও মিলিত হবেন— ষষ্ঠে ত্বাং চ যথাকালে দ্রৌপদ্যুপগমিষ্যতি।
মহাভারতের সব সংস্করণে এই শ্লোকের উল্লেখ না থাকলেও কোনও কোনও সংস্করণে এই শ্লোক প্রত্যাশিতভাবে ছিল বলেই সোমেশ্বর ভট্টের মতো মীমাংসক এই শ্লোক উল্লেখ করেছেন এবং আমরাও এই শ্লোক পূর্বে সংশয়হীনভাবেই ব্যবহার করেছি। তাতে এইটা প্রথমত প্রমাণ হয় যে, দ্রৌপদীর সঙ্গ কর্ণের কাছে অন্যতম লোভনীয় বস্তু ছিল। আর দ্বিতীয়ত এই সম্ভাবনা সবচেয়ে সার্থক হয়ে ওঠে যে, যদি তিনি কুন্তীর ছেলে বলেই পরিচিত হতেন তা হলে অনেক অনেক ঘটনাই যেমন অন্যরকম হত, তেমনই এখনও পাণ্ডব-শিবিরে তিনি ফিরে এলে দ্রৌপদী কর্ণের ভোগ্যা হতে পারেন।
মহাভারতের এই শ্লোক কর্ণের দিক থেকে দ্রৌপদীর সঙ্গম-সম্ভাবনা তৈরি করে, কিন্তু পঞ্চস্বামীর একতমা স্ত্রী হবার জন্য তৎকালীন সমাজেই এত বেশি কথা শুনতে হয়েছে দ্রৌপদীকে, বিশেষত তাঁর সতীত্বের প্রশ্নটা এতই বেশি যুক্তিতর্ক দিয়ে প্রমাণিত করতে হয় যে, মহাভারতের কবি দ্রৌপদীর দিক থেকে কোনও কর্ণ-জল্পনার সূত্র রাখেননি। কিন্তু সমাজ-সংসার আর মানুষ দেখে মহাকাব্যের কবি তাঁকে রেহাই দিলেও মহাকাব্য-নির্ভর অনুবাদে বাংলার রসিক কবি এ-সুযোগ ছেড়ে দেবেন কেন? সবচেয়ে বড় কথা, কর্ণের দিক থেকে যদি দ্রৌপদীর লাভ-সম্ভাবনা (অলাভে আক্রোশ) তৈরি হয়ে থাকে, তবে দ্রৌপদীর দিক থেকেই বা তাঁর প্রতি বীর-পূজার সম্ভাবনা থাকবে না কেন? যতদিন আমি মহাভারতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখছি, তখন থেকে আমি সাধারণ তথা শিক্ষিত মানুষের কাছে এই প্রশ্ন শতবার শুনেছি যে, কর্ণের প্রতি দ্রৌপদীর কোনও দুর্বলতার কথা মূল মহাভারতে আছে কিনা?
চিরকাল বলে এসেছি— না, মহাভারতে নেই, কিন্তু আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি— মূল মহাভারতে না থাকলেও অন্য যদি কোথাও থাকে, তবে সেই সম্ভাবনাটা মিথ্যে নয়। কেননা পরবর্তী সময়ে যিনি মহাভারত লিখছেন তাঁর সংস্কারের মধ্যে প্রাচীন ‘মিথ’ যে মিশ্ৰক্ৰিয়া তৈরি করেছে, সেটা থেকে অন্যতর এক নতুন সত্য তৈরি হয়। কাশীরাম দাস অবশ্য অসাধারণ একটি উপাখ্যান তৈরি করেছেন এবং তার শেষ ফলটা এই যে, চিরকালের জন্ম-যন্ত্রণায় দিগ্ধ কর্ণের জন্যও দ্রৌপদীর মতো এক বিবাহিত বিদগ্ধা রমণীর দুর্বলতা ছিল, যা তিনি জানতেন না এবং জানলে হয়তো তাঁর অত আক্রোশ হত না দ্রৌপদীর ওপর।
কাশীরাম দাসের মহাভারতে এই ঘটনাটা উদ্যোগ পর্বেও ঘটেনি। ঘটেছে সদ্য এই সভাপর্বে বস্ত্র হরণের জঘন্য ঘটনা ঘটে যাবার পর বনপর্বেই। অবশ্য বনবাসের অনেকটা সময় তখন কেটে গেছে, দুর্যোধনের জয়দ্রথ বনমধ্যে একবার দ্রৌপদীকে হরণ করার অপচেষ্টা করেছেন, তারপর মার্কণ্ডেয় মুনির কাছে রামায়ণী কথা, সীতাহরণের গল্প শুনছেন যুধিষ্ঠির এবং সর্বশেষ সাবিত্রী-সত্যবানের গল্পে সতীত্বের মাহাত্ম্য খ্যাপিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রৌপদীও যে পরম সতী নারী— এই আশীর্বাদ আসছে মার্কণ্ডেয় মুনির মুখে। ঠিক এই পটভূমিতে স্বয়ং কৃষ্ণ পূর্ব থেকে উপস্থিত রয়েছেন কাম্যক বনে, যুধিষ্ঠির তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করছেন— কীভাবে কাম্যক বন ছেড়ে অন্য কোনও জায়গায় বনবাসের শেষ দিনগুলি কাটানো যায়, অথবা একেবারে অজ্ঞাতবাসেরই তোড়জোড় করা যায়। কাম্যক বন থেকে সকলকে বিদায় দিয়ে পঞ্চপাণ্ডব কৃষ্ণের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লেন এবং সেখানে —
চলিলেন যাজ্ঞসেনী পাকপাত্র হাতে।
ত্রৈলোক্যমোহিনীরূপা সবার পশ্চাতে॥
চলতে চলতে সকলে এক অপূর্ব সুন্দর জায়গায় এসে উপস্থিত হলেন এবং সেটা নাকি সন্দীপন মুনির তপোবন। পথশ্রমে সকলেই ক্লান্ত রজনীযাপনের পর তিন দিন পাণ্ডবরা থাকলেন সেখানে। এইরকম এক মনোরম সকালবেলায় দ্রৌপদীর মন খুব ফুরফুরে। তিনি মনে মনে ভাবছেন— এত কাল পাঁচ-পাঁচটা স্বামীর সঙ্গে আমি ঘর করছি, তাঁদের দুঃখের সঙ্গী হয়ে বনবাসে কাল কাটাচ্ছি, অতএব আমার মতো সতী নারী আর ত্রিভুবনে নেই আর মার্কন্ডেয় মুনিও তো সেই কথাই বলে গেলেন। কাশীরাম দাস এই সতীত্বের কল্পনাকে অদ্ভুত এক বীরত্বজনক শব্দে আখ্যাত করে দ্রৌপদীর জবানিতে বলেছেন— ‘ইহার অধিক মম কী আছে পৌরুষ।’ যাই হোক, যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদীর এই সতীত্বের অহংকার কোনওভাবে কৃষ্ণ জানতে পারলেন এবং তিনি ঠিক করলেন— কোনও বিষয়েই অহংকার ব্যাপারটা ভাল নয়, তিনি এই দর্প চূর্ণ করবেন।
সন্দীপন মুনির তপোবনে সেদিন সকলেই বেশ আলস্যে দিন কাটাচ্ছেন— শুয়ে বসে, ফল-মূল আহরণ করে। এরই মধ্যে হঠাৎ করে একটি অদ্ভুত আমগাছ দ্রৌপদীর চোখে পড়ল। তখন আম পাকবার সময় নয়, অথচ সেই আম গাছে একটি পাকা আম ফলে রয়েছে। দ্রৌপদীর বড় কৌতূহল হল এবং তিনি আশে-পাশে ঘুরতে থাকা অর্জুনকে বললেন— আমটি পেড়ে দিতে। অর্জুন এক মুহূর্তও দেরি না করে ধনুঃশর যোজনা করে আমটি পেড়ে দিলেন দ্রৌপদীর হাতে। উপাখ্যানের গতিতে কৃষ্ণ সঙ্গে সঙ্গেই এসে পড়েছেন সেখানে এবং দ্রৌপদীর হাতে আম দেখেই তিনি হায় হায় করে উঠলেন এবং আসন্ন এক ভয়ঙ্কর দুর্ভাগ্যের ইঙ্গিত দিতেই যুধিষ্ঠির তাঁকে অকালের এই আম্রফল নিয়ে প্রশ্ন করলেন।
কৃষ্ণ জানালেন— এটা সন্দীপন মুনির আশ্রম। মুনি এই বনেরই এক-এক স্থানে তপস্যা করার জন্য বেরিয়ে যান সকালে এবং সারা দিন অনশনে তপস্যা করে এখানে ফিরে আসেন। তাঁর তপস্যার প্রভাবে ‘প্রতিদিন এক আম্র এই বৃক্ষে ফলে/সমস্ত দিবস গেলে সন্ধ্যাকালে পাকে।’ মুনি ফিরে এসে অনশন-দিগ্ধ শরীরে এই পাকা আমটি খেয়ে উপবাস ভঙ্গ করেন। সেই আমটি অর্জুন দ্রৌপদীর কথায় পেড়ে ফেলল। এখন জানি না কী অনর্থ হবে। মুনি এসে হয়তো এই ব্যতিক্রম দেখে সবাইকে ক্রোধাগ্নিতে ভস্মই করে ফেলবেন। সকলের বিপদ দেখে যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে অনুনয় করতে আরম্ভ করলেন— কীভাবে এই বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। যুধিষ্ঠিরের শরণাগতি দেখে কৃষ্ণ বললেন— একটাই উপায় আছে। ওই আমটা গাছে ডালে যে অবস্থায় যেমন ঝুলছিল, ঠিক সেই অবস্থায় যদি ফিরিয়ে আনা যায়, তবেই সকলের বিপদ-মুক্তি হবে। সেটা কেমন করে সম্ভব— যুধিষ্ঠিরের এই প্রশ্নে কৃষ্ণ বললেন— এটা খুব কঠিন কাজ নয়, তবে একটাই ব্যাপার, সবাইকে সত্য কথা বলতে হবে। তোমরা পাঁচ ভাই এবং দ্ৰৌপদী— এরা প্রত্যেকে আমার কাছে জানাবে যে, সব সময় তোমাদের মনের মধ্যে কোন কথাটা জাগছে, অর্থাৎ কোন কথা, কোন ভাবনা মনটাকে অনুক্ষণ তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে, সত্য বলতে হবে কিন্তু। পাঁচ ভাই এবং যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদী অঙ্গীকার করলেন— তাঁরা সত্য কথা বলবেন।
প্রথমে ধৰ্মপুত্র যুধিষ্ঠির। তিনি বললেন— আমি আগের মতো রাজ্য ফিরে পেলে আবার যাগ-যজ্ঞ করব, বামুন-ঠাকুরদের খাওয়াব— এই ইচ্ছে আমার মনে জাগে সব সময়। একথা বলতেই আমটা খানিকটা ওপরে উঠে গেল। এরপর ভীমের মনে যা সব সময়ই ঘুরছে— কবে তিনি দুঃশাসনের বুক চিরে রক্তপান করবেন, কবে তিনি দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ করে দ্রৌপদীর অপমানের প্রতিহিংসা নেবেন— এইসব সত্য কথা বলতেই আমটা আরও খানিক ওপরে উঠে গেল। অর্জুনের পালায় অর্জুনও দুর্যোধনের-কর্ণদের অপমান স্মরণ প্রতিশোধ-স্পৃহা ব্যক্ত করতেই আম আরও খানিকটা ওপরে উঠে গেল। একইভাবে নকুল-সহদেবও তাঁদের অন্তরাত্মা ব্যক্ত করে বললেন যে, যুধিষ্ঠিরকেই তাঁরা পুনর্বার রাজা হিসেবে সিংহাসনে দেখার কথা সব সময় পালন করছেন মনে-মনে। নকুল সহদেবের সত্য-বচনে আম আরও দুই ধাপ উঠে প্রায় বৃক্ষ শাখার কাছে চলে গেল। তারপর এল দ্রৌপদীর পালা।
পঞ্চস্বামী গর্বিতা দ্রৌপদীও স্বামীদের সুরে গলা মিলিয়ে বললেন— আমাকে যে কৌরবরা এত দুঃখ দিয়েছে, তাদের ধ্বংস নেমে আসুক ভীমার্জুনের হাতে— এই আমি মনে মনে সব সময় ভাবি। আমাদের শত্রুরা মরেছে, শত্রুরমণীরা সব বিধবা হয়ে কাঁদছে— এই দৃশ্য দেখার জন্য পরম কৌতুকী হয়ে আছে আমার মন। দ্রৌপদী এই কথা বলার পর সবাই যখন ভাবছে যে, আম এবারে স্বস্থানে লগ্ন হবে শাখায়, ঠিক তখুনি আমটি নীচের দিকে নেমে গেল। যুধিষ্ঠির ভয়ে প্রমাদ গণলেন। সকলেই সত্য কথা বলেছে, অথচ এই প্রমাদ কেন— এ-কথা শুধোবার সঙ্গে সঙ্গেই কৃষ্ণ বলে দিলেন — দ্রৌপদী ঠিক সত্য কথা বলেননি, যা বলেছেন তার মধ্যে ছলনা আছে—
গোবিন্দ বলেন রাজা কি কহিব কথা।
সকল করিল নষ্ট দ্রুপদদুহিতা॥
কহিল সকল যত কপট বচন।
সে কারণে পড়ে আম ধর্মের নন্দন॥
পাঁচ ভাই পাণ্ডব কৃষ্ণকে আবারও হাত জোড় করে উপায় বার করতে বললেন। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর কাছেও অনুনয় জানালেন নিজের স্বভাবমতো। কিন্তু কৃষ্ণা দ্রৌপদী তাঁর ভাবনা পরিবর্তন করলেন না, চুপ করে রইলেন। কাশীরাম দাসের মধ্যযুগীয় সমাজের পৌরুষেয়তার প্রতিফলনে এই মুহুর্তে দ্রৌপদীর অন্য বীর স্বামীদের প্রতিক্রিয়া দেখার মতো। অর্জুন এমন কথাও বলছেন দ্রৌপদীকে—
শীঘ্ৰ কহ সত্য কথা।
কাটিব নচেৎ তীক্ষ্ণ শরে তোর মাথা॥
কিন্তু এই পৌরুষের হুংকারে কাজ হল। দ্রৌপদী আস্তে আস্তে তাঁর হৃদয়পট উন্মোচন করে বললেন— কী আর বলব, সব ঘটনাই তো তোমরা জানো। সেই যে আমাদের ইন্দ্রপ্রস্থে রাজসূয়-যজ্ঞ হয়েছিল, যেখানে সকলের সঙ্গে মহাবীর কর্ণও এসে উপস্থিত হলেন নিমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে, তখন মনে-মনে আমি ভেবেছিলাম— আহা! ইনিও যদি কুন্তীর ছেলে হতেন, তা হলে আমার পাঁচ স্বামীর সঙ্গে আর একজন যোগ হয়ে ছ’জন স্বামী হত আমার! আমি সত্য এ-কথাটা এখনও ভুলিনি, মাঝে-মাঝেই কর্ণের সম্বন্ধে আমার এই ষষ্ঠ স্বামীর কল্পনা ঘুরে-ফিরে বেড়ায়—
যজ্ঞ কালে কর্ণবীর আসিল যখন।
তারে দেখি মনে মনে চিন্তিনু তখন॥
এই জন হত যদি কুন্তীর নন্দন।
সেই কথা অদ্যাপি কখন হয় মনে।
এতেক কহিতে আম্র উঠে সেই ক্ষণে॥
দ্রৌপদীর মানসিক সত্য উন্মোচিত হবার সঙ্গে সঙ্গে গাছের আম গাছে গিয়ে স্থান নিল। বাংলার কবি কাশীরাম নীতিকথা শোনাতে চেয়েছেন এই যুক্তিতে যে, এই পৃথিবীতে কোনও বিষয় নিয়েই কোনও অহংকার করে লাভ নেই, ভগবান শ্রীহরি তাঁর নিকট জনেরও সব দর্প চুর্ণ করে দেন। কিন্তু এই নৈতিকতার আড়ালে বঙ্গকবির ক্রান্তদর্শী মন যে অসাধারণ একখানি উপাখ্যান সৃষ্টি করেছে, তাতে একদিকে যেমন চিরন্তনী সতীর বাসনালোকে মহাবীর কর্ণের কাম্য পদসঞ্চার সত্য হিসেবে চিহ্নিত হয়, তেমনই এই সত্য-সম্ভাবনাও প্রকট হয়ে ওঠে যে, দ্রৌপদীর ব্যাপারে কর্ণের চিরাচরিত আক্রোশ আসলে ভগবদ্গীতার সেই মানসিক দার্শনিক প্রক্রিয়া সার্থক করে তোলে। গীতা বলেছে— কামাৎ ক্রোধোহবিজায়তে— অর্থাৎ কামনা প্রতিহত হলেই সেখানে ক্রোধের জন্ম হয়। অতএব দ্রৌপদীর প্রতি কর্ণ চিরকাল যে কর্কশ-পরুষ ব্যবহার করেছেন, তার পিছনে সেই অসম্ভবের সম্ভাবনা ছিল, হয়তো দ্রৌপদীর প্রতি তাঁরও আকর্ষণ ছিল অনির্বচনীয়, অথচ বিপরীত প্রক্রিয়ায়। এ-কথা সোচ্চারে কথিত হয়নি মহাকবির জবানীতে।
কাশীদাসী মহাভারতে দ্রৌপদীর মানসিক অভিব্যক্তি শুনে সবচেয়ে ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন ভীম। তিনিই যেহেতু দ্রৌপদীর ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি ‘পোজেসিভ’ ছিলেন এবং কর্ণকে সূতপুত্র বলে গালি দেওয়াটা যেহেতু তাঁরই এক সহর্ষ অভ্যাসের মধ্যে ছিল, অতএব দ্রৌপদীর সত্যবচন শুনেই ভীম তাঁর গদাখানি বাগিয়ে ধরে প্রায় মারমুখী অবস্থায় দ্রৌপদীকে বললেন—
এই কী তোমার রীতি কৃষ্ণা দুষ্টমতি।
এক পতি সেবা করে সতী কুলবতী॥
বিশেষ তোমার এই পতি পঞ্চজন।
তথাপি বাঞ্ছিস্ মনে সূতের নন্দন॥
এ-কথা ভীম বলবেন কী, সভাপর্বে দ্রৌপদীর লাঞ্ছনাকালে স্বয়ং কর্ণই ব্যঙ্গোক্তি করে দ্রৌপদীকে বলেছিলেন— যার পাঁচ পাঁচটা স্বামী, তাকে তো আর সতীলক্ষ্মী বলে বন্দনা করার দরকার নেই; আর পাঁচটার জায়গায় ছ’টা হলেই বা ক্ষতি কী? তুমি দুর্যোধনকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করো। কর্ণ নিজের কথা বলতে পারেননি ‘দাদার পাতে দই দাও’-এর প্রবাদ মেনে। কিন্তু ষষ্ঠ অথবা প্রথম স্বামী হিসেবে তাঁরই যে সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা থেকে গেছে, একথা সংবেদনশীল কবি মাত্রেই বুঝেছেন এবং মহাভারতের পাঠককূল কর্ণের জন্ম-ঘটনা জানেন বলেই সঙ্গত কারণেই তাঁদের ইচ্ছাপূরণ করেছেন কাশীরাম দাস। অর্থাৎ যদি এমত হত, যদি তিনি কুন্তীর ছেলে বলেই পরিচিত হতেন, তা হলে দ্রৌপদীর বাসনালোকে পাঁচের বদলে ছয়ের আগমন ঘটত সাড়ম্বরে। কর্ণের মধ্যে সেই যোগ্যতা ছিল এবং আকাঙক্ষা হয়তো ছিল দুই তরফেই— কাশীরাম সেই সত্য উন্মীলিত করেছেন mythical truth হিসেবে।
কাব্যে-নাটকে কর্ণের চরিত্র নিয়ে যত ‘রিক্রিয়েশন,’ অথবা আমি বলব— সেগুলিকে ‘ক্রিয়েশন’ই বলা উচিত— সেগুলির মধ্যে প্রধানত ফুটে উঠেছে কর্ণের প্রতি আমাদের সমবেদনা। অবিবাহিতা রমণীর গর্ভজাত সন্তান যদি কখনও নিন্দিত-তিরস্কৃত হয়, তবে সেই তিরস্কার, নিন্দা প্রধানত তাঁর মায়ের নামেই সংক্রান্ত হয়। মানে, ভাবটা এই যে, ভ্রষ্টা অসংযতা নারীর সন্তান, সে আর কত ভাল হবে! কিন্তু ভ্ৰষ্টা নারীর সন্তান যদি কর্মে-ধর্মে নিজের চেষ্টায় সফল হয়, তবে সমাজ তাঁর প্রতি যথেষ্ট সকরুণ হয়ে উঠলেও অন্তঃসত্তায় ভ্রষ্টার স্মরণ-মনন বিলুপ্ত হয় না। কর্ণের জন্ম-বিড়ম্বনায় এই মনোভাব পুরোপুরি তৈরি হবার সুযোগ নেই, কেননা তাঁর মায়ের জায়গায় কুন্তীর মতো এক বিরাট চরিত্র রয়ে গেছে এবং সেকালের সামাজিক নিয়মে তিনি ভ্ৰষ্টাও নন। কিন্তু কুন্তী যেহেতু শেষ পর্যন্ত কর্ণের তথ্য গোপন করে গেছেন, তাই পরবর্তী কালে কর্ণের প্রতি মহাকবি, নাট্যকারদের সহানুভূতির অংশ অনেক বেশি। সামাজিক দিক থেকে যেখানে কানীন পুত্রের সম্পূর্ণ স্বীকৃতি ছিল এবং কন্যা-জননীও যেখানে অসংযমের দায়ে কলঙ্কিত হতেন না, সেখানে কুন্তীর এই তথ্য-গোপন কর্ণের কাব্যিক উজ্জ্বলতা তৈরি করেছে আরও বেশি এবং প্রতিস্থানে কুন্তীকে নিজের সমাজ-স্বীকৃত ছেলেদের কাছেই তীব্র নিন্দা শুনতে হয়েছে এ-বাবদে।
কৌরবপক্ষ এবং পাণ্ডবপক্ষ— কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে দু-পক্ষেরই মৃত সৈন্য-সেনাপতিদের শবদাহ-পর্ব যখন শেষ হল, তখন অস্থি ভাসিয়ে জলতর্পণ করার জন্য কর্ণের স্ত্রীরা গঙ্গায় নামতেই কুন্তী তার পাঁচ ছেলের উদ্দেশে বিলাপ করতে করতে নির্দেশ দিলেন— বাছারা! সমস্ত রথী-মহারথীদের মধ্যে যে নাকি অগ্রগণ্য বীর, অর্জুন যাকে যুদ্ধে মেরে ফেলল, সেই কর্ণের জন্য গঙ্গায় একটু জল দে তোরা, সে তোদের বড় ভাই— কুরুধ্বমুদকং তস্য ভ্রাতুরক্লিষ্টকর্মণঃ। যাকে তোরা সূতপুত্র বলে ভাবতিস, যাকে রাধার ছেলে বলে জানতিস তোরা, সেই সূর্যের প্রভাবশালী ছেলেটা কিন্তু তোদের সবার বড় ভাই। তার জন্য গঙ্গায় একটু জল দে তোরা। যে নাকি দুর্যোধনের হয়ে তোদের সবার সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, যার মতো বীর বোধহয় আর কেউ ছিল না, নিজের প্রাণের চেয়েও যে নাকি যশকেই বেশি বড় মনে করেছে, সেই কর্ণের জন্য গঙ্গায় একটু জল দে তোরা। দেবদেব ভাস্করের ঔরসে আমারই গর্ভে সে তোদের অনেক আগে জন্মেছিল সোনার কবচ-কুণ্ডল পরে। সেই কর্ণ তোদের সবার বড় ভাই— স হি বঃ পূর্বজো ভ্রাতা ভাস্করান্ময্যজায়ত।
জননী কুন্তীর কথা শুনে পাঁচ ভাই পাণ্ডব একেবারে হতবাক হয়ে গেলেন। কোনও কল্পনার সুদূর ছবিতেও এমন আভাস ছিল না যে, তাঁরা যাঁকে গালি দিচ্ছেন, ঘৃণা করছেন, অপমান করছেন, তিনি তাঁদেরই সর্বজ্যেষ্ঠ সহোদর। মায়ের কথা শুনে অমন যে ধীর-স্থির যুধিষ্ঠির, তিনি পর্যন্ত সাপের মতো ফুঁসতে লাগলেন— নিঃশ্বন্নিব পন্নগঃ। যুধিষ্ঠির মাকে বললেন— এমন একটা ঘটনা তুমি এতদিন লুকিয়ে রাখলে কী করে? আর সত্যিই তো এটা ভয়ঙ্কর এক বাস্তব যে, কর্ণ যদি পাণ্ডবদের সকলের বড় হয়ে থাকতেন, তা হলে কৌরব দুর্যোধনের এতটা বাড়াবাড়ি তাঁকে সহ্য করতে হত না, হয়তো বা এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধটাই হত না। যুধিষ্ঠির মাকে বলেই ফেললেন— আজ যদি কর্ণ আমাদের পাশে থাকতেন, তা হলে স্বর্গে থাকলেও কোনও বস্তু আমাদের অধরা থাকত না— নেহ স্ম কিঞ্চিদ্ অপ্রাপ্যং ভবেদপি দিবি স্থিতম্। আর এইরকম একটা মানুষকে তুমি আমাদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখলে।
আজকে যুধিষ্ঠিরের মনে স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন উঠছে— কী হল, এবং কী হতে পারত? হয়তো বা সেইসব পুরনো কথাও মনে পড়ছে— যুদ্ধক্ষেত্রে কর্ণের হাতে নিগৃহীত হয়ে তিনি অর্জুনের গাণ্ডীব ধনুককে ধিক্কার জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন— তুমি মুখেই এত বড় বড় কথা বলো, কর্ণকে শেষ করতে আর কতদিন লাগবে? তাতে দুঃখ আরও বেড়েছে। মাকে তিনি বলেছেন— অর্জুন ছাড়া আমাদের কারও পক্ষে যাঁর বাণাঘাত সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না, যাঁকে সহায় করে দুর্যোধন এত বড় একটা যুদ্ধ চালিয়ে গেল, সেই কর্ণ নাকি তোমারই ছেলে। এমন এক দেবতার মতো পুত্রকে তুমি এতকাল আমাদের কাছে লুকিয়ে রাখলে, এটা তো প্রায় আঁচল চাপা দিয়ে আগুন ঢেকে রাখার মতো— তমগ্নিমিব বস্ত্ৰেণ কথং ছাদিতবত্যসি।
একে কুন্তী পুত্রশোকে অধীর, তার মধ্যে যুধিষ্ঠিরের এই বাক্যবাণ এবং এটা তো সইতেই হবে। কন্যাবস্থায় ছেলেকে ভাসিয়ে দেবার যে যন্ত্রণা, তার থেকে অনেক বড় যন্ত্রণা বুঝি অন্য ছেলেদের কাছে কন্যাবস্থায় জাত পুত্রের আখ্যান শোনানো— তা কুন্তী পারেননি। অথচ সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা বোধহয় এখন হচ্ছে, যখন যুধিষ্ঠির কর্ণের সম্বন্ধে শত প্রশংসা ছুঁড়ে দিয়ে মাকে বলছেন— তুমি এতকাল যে এইভাবে মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলে এই গোপন কথা, তাতে আমরা সবাই মরছি লজ্জায়, ধিক্কারে আপশোসে— অহো ভবত্যা মন্ত্রস্য গ্রহণেন বয়ং হতাঃ। তোমার মন্ত্রগুপ্তির জন্যই সবাইকে নিয়ে আজ আমাদের এত বড় সর্বনাশ হল— পীড়িতাঃ স্ম সবান্ধবম্।
শোনা যায় নাকি, মায়ের এই মন্ত্রগুপ্তির জন্য যুধিষ্ঠির মাকে শাপ দিয়ে বলেছিলেন— এর পর থেকে মেয়েরা আর কোনও কথা মনের মধ্যে চেপে রাখতে পারবে না— ততঃ মনসি যদ্গুহ্যং স্ত্রীণাং তন্ন ভবিষ্যতি— মহাভারতের সব ক’টি সংস্করণে এই শ্লোকাভিশাপ না থাকলেও, বেশ কিছু মুদ্রিত সংস্করণে এই শ্লোক আছে, ঠিক যেমন আর একটি শ্লোকও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। আসলে এই অপ্রচলিত শ্লোকগুলি মহাভারতের শুদ্ধিবাতিক পণ্ডিতেরা গবেষণার ঔপনিবেশিক মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বাদ দিয়েছেন, কিন্তু আমরা মনে করি এতকাল ধরে মৌখিক প্রবাদে যে-সব শ্লোক চলে আসছে, সেগুলিকে শুধু স্থূলহস্তাবলেপ বলে উড়িয়ে দিলে চলবে না। সব চেয়ে বড় কথা, ভারতবর্ষে এমন পণ্ডিত এখনও জন্মাননি এবং জন্মাবেনও না কোনও দিন, যিনি শুধু বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া অধিকাংশ পুঁথির পাঠ অথবা কোথাও প্রাসঙ্গিকতার বিচারে স্বল্প পুঁথির পাঠ বিচার করেই মহাভারত প্রস্তুত করে দেবেন। তর্কযুক্তি সেখানেও অনেক থেকে যাবে। অতএব কুন্তীকে যুধিষ্ঠির যে শাপ দিয়েছেন, সেটার সার্থকতা যেমন অতিক্রম করা যায় না, তেমনই কর্ণচরিত্র লিখছি শুনে মহাভারত-বৃদ্ধ পণ্ডিত অনন্তলাল ঠাকুর আমাকে একটি শ্লোক বলেছিলেন, যা আমি প্রচলিত মহাভারতের বহুল সংস্করণেও পাইনি, অথচ শ্লোকটি ভীষণ রকমের তাৎপর্যপূর্ণ এবং ততোধিক প্রাসঙ্গিক। কর্ণ-চরিত্রের সমস্ত ‘ট্র্যাজিডি’ এই শ্লোকটির মধ্যে লুকিয়ে আছে।
এই শ্লোকের পটভূমি হল— কর্ণের তখন সদ্য মৃত্যু হয়েছে এবং সারা জীবন ধরে কর্ণ পাণ্ডবদের যেভাবে অপমান ভর্ৎসনা করেছেন, তার জন্য আক্রোশ তখনও যায়নি। এই অবস্থায় কর্ণের মতো মহাবীরকে শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে অনেক যুদ্ধের পর দুটি মহাবাণে তাঁর মাথা কেটে ফেললেন, এমনটা খুব সহজ সরল কথা হয়ে যায়। কৃষ্ণ সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন অর্জুনকে, বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, কর্ণের মতো মহাবীরকে শেষ করার কৃতিত্ব শুধুমাত্র একা অর্জুনের নয়, এমনকী একা তাঁরও নয়, এই প্রস্তুতি চলছে অনেক দিন ধরে এবং সেই প্রস্তুতির পথ তৈরি হয়েছে নিজের মতো করেই। কৃষ্ণ নাকি অর্জুনকে বলেছিলেন— কর্ণ মারা যাবার পিছনে ছয় জনের অবদান আছে— এখানে তোমার যেমন অংশ আছে একটা, তেমনই আমারও কিছু অবদান আছে, আমি বুদ্ধি, কৌশল এবং সঠিক সময় নির্ধারণ করেছি। এই ধ্বংসের পিছনে স্বয়ং কুন্তী আছেন, কর্ণের জননী। তিনি যদি শিশুপুত্রকে ভাসিয়ে না দিতেন সেই সময়ে, তা হলে সমস্ত কিছু অন্য রকম হতে পারত। কর্ণের মৃত্যুর আরও এক বড় কারণ— যুদ্ধের চরম মুহূর্তে পৃথিবী তাঁর রথচক্র গ্রাস করল, তাঁর রথের চাকা অনড়ভাবে বসে গেল মাটিতে। এই দুর্ঘটনাটা না ঘটলেও আজকে সব কিছু অন্য রকম হতে পারত। হয়তো এখন তার মৃত্যুই হত না।
অসময়ে কর্ণের রথের চাকা মাটিতে বসে যাওয়ার ঘটনাটা হয়তো নিছক দুর্ঘটনাই, হঠাৎ করেই তা ঘটেছিল অঘটনের মতো। এমন একটা চরম দুর্ঘটনার জন্য মহাভারতের কবি অবশ্য একটা অভিশাপের সৃষ্টি করেছেন। কর্ণ যখন পরশুরামের কাছে মহেন্দ্র পর্বতে অস্ত্রশিক্ষা করছেন, তখন অভ্যাস দৃঢ়তর করার জন্য যেখানে-সেখানে লক্ষ্যভেদ করার চেষ্টা করতেন। এই নিরন্তর অনুশীলনের মধ্যে নিজেরই অজ্ঞাতে এক ব্রাহ্মণের হোমধেনু মেরে ফেললেন কর্ণ। ক্ষুব্ধ ব্রাহ্মণ অভিশাপ দিয়ে বলেছিলেন— যার কথা মনে করে তুই দিনরাত অস্ত্রাভ্যাস করছিস, তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করার সময় চরম মুহূর্তে তোর রথের চাকা বসে যাবে মাটিতে— যুধ্যতস্তেন তে পাপ ভূমিশ্চক্রং গ্রসিষ্যতি। এই অভিশাপ হয়তো যুদ্ধক্ষেত্রে কর্ণের রথচক্রগ্রাসের অঘটনটাকে খানিকটা সযৌক্তিক করে তোলে। তবে কিনা আকস্মিক এইসব ঘটনা যুক্তিহীন ভাবেই ঘটে এবং হয়তো তাই-ই ঘটেছে এবং সেইজন্যই কৃষ্ণ তাঁর বাক্যের মধ্যে ওই ব্রাহ্মণের অভিশাপের কথা বলেননি, তিনি বলেছেন— অচলা এই বসুমতীও কর্ণের মৃত্যু-ঘটনায় সাহায্য করেছেন।
সাহায্য করেছেন দেবরাজ ইন্দ্র। তিনি অর্জুনের স্বার্থে সূর্যপুত্র কর্ণকে বঞ্চনা করে দেবাসুরের অভেদ্য সেই কবচ-কুণ্ডল হরণ করেছেন যুদ্ধের উদ্যোগপর্বে। আর সাহায্য করেছেন পরশুরাম, যিনি কর্ণের মিথ্যাচারিতায় ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন— যুদ্ধের চরম মুহূর্তে তুই ব্রহ্মাস্ত্রের প্রয়োগ-কৌশল ভুলে যাবি। আমার নিজের ধারণা, গুরু পরশুরামও শেষ পর্যন্ত কর্ণকে ব্রহ্মাস্ত্রের প্রয়োগ-উপসংহার শেখাননি, কিন্তু পর পর দুই গুরুর কাছেই কর্ণ ব্রহ্মাস্ত্রের ব্যাপারে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছেন— এটা মহাভারতের কবি— দেখাতে চাননি বলেই পরশুরামের শিক্ষাকল্পে এই বিস্মরণের অভিশাপ সৃষ্টি হয়েছে কবির সংবেদনশীলতায়। বস্তুত পরশুরামের কাহিনীতে কর্ণ কীভাবে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েও অর্জুনকে মারার জন্য ব্রহ্মাস্ত্র করায়ত্ত করতে চাইছেন, এই ঘটনাটাই বড় হয়ে উঠেছে।
সম্পূর্ণ এই শ্লোকটির মধ্যে যে ছয় জনের কথা বলেছেন কৃষ্ণ, তাতে এই কথাটাই সবচেয়ে পরিষ্কার হয় যে, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কর্ণের জীবনের মধ্যে একটা বিরাট বঞ্চনার ইতিহাস লুকানো আছে। এবং অবশ্যই আছে, তাঁর স্বভাবও। ছয় জনের মধ্যে প্রথম হলেন অর্জুন, শেষ জায়গায় তিনি তীক্ষ বাণাঘাতে কর্ণকে মেরে ফেললেন— এটা যে একেবারেই তুচ্ছ এক নৈমিত্তিক কারণ, সেটা কৃষ্ণ বুঝিয়ে দিয়েছেন আরও পাঁচটা নাম উল্লেখ করে। অর্থাৎ কিনা আততায়ীর সর্বশেষ প্রহারের চেয়েও অনেক বড় কথা হল— কর্ণের মৃত্যু আরম্ভ হয়েছে তাঁর জন্মলগ্ন থেকেই, বিশেষত কর্ণের যে স্বভাব এবং সংস্কার পরিস্ফুট হয়েছে সারা মহাভারত জুড়ে— তাঁর অহংমন্যতা, অস্ত্রশিক্ষার ক্ষেত্রে অসংযম এবং মিথ্যাচার, দুর্যোধনের বন্ধুত্বকে চরম এবং পরম প্রাপ্তি বলে মনে করা— এইসব কিছুর মধ্যেই তো এক হতাশা আছে। এই হতাশা থেকে কর্ণের স্বভাব তৈরি হয়েছে বলেই একদিকে যেমন দুর্যোধনের মতো এক দুর্দান্ত পুরুষের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়েছে, তেমনই ভীষ্ম-দ্রোণ— সবারই এক প্রকার অলক্ষ্য স্নেহ তাঁর ওপর ছিল, যার ফলে বারবার কর্ণের জন্মের থেকেও তাঁর সংস্কারের মলিনতা নিয়ে মতামত প্রকাশ করেছেন তাঁরা।
মহাভারতে কৃষ্ণকথিত ওই দুর্লভ শ্লোকটিতে যখন বলা হয়— ষড্ভিঃ কর্ণো নিপাতিতঃ— ছয় জনের দ্বারা কর্ণ হত হয়েছেন— তখনই কর্ণের মৃত্যুর ব্যাপারে অর্জুনের গুরুত্বটা একেবারে লঘু হয়ে যায়। অপিচ এই ব্যঞ্জনাটাও সৃষ্টি হয় যে, যদি কর্ণের জন্ম হত সামাজিক প্রথায়, যদি সেই অভেদ্য বর্ম-কুণ্ডল তাঁর দেহে থাকত এবং অস্ত্রশিক্ষাও পেতেন প্রথাগত আনুষ্ঠানিকতায়, তা হলে কর্ণকে মারা প্রায় অসম্ভব ছিল, অর্জুন তাঁর প্রতিতুলনায় অন্যতর এক মহাযোদ্ধা ছাড়া আর কিছুই হতেন না। সঙ্গে সঙ্গে এও বলি— যদি সব কিছুই কর্ণের জীবনে সুষ্ঠু হত, তা হলে এই মহাকাব্য মহাভারত তৈরি হত না। এত বঞ্চনা আছে বলেই কর্ণ এত মহনীয়, এত বাস্তব, এত উচ্ছ্বাসের জায়গা। মহাভারতের কর্ণ এমন দুরন্ত না হলে কাশীরাম থেকে রবীন্দ্রনাথ, ভাস থেকে বুদ্ধদেব বসু আংশিকভাবে তো অপ্রতিভই থেকে যেতেন।
॥ ১৪ ॥
অবশেষে জীবনের সান্ত্বনার অংশটুকু না বললেই নয়। মাতৃস্নেহের বঞ্চনা যেখানে ঘটে, বাস্তব জীবনেও তার কথঞ্চিৎ প্রতিপূরণ দেখেছি কখনও কখনও। ভারতবর্ষে প্রেমিকার উদ্দাম উচ্ছ্বাস তো হাজারও দেখেছি, কিন্তু সেই প্রেমিকারাও বহু ক্ষেত্রে বড় বেশি জননীর মতো বড় বেশি স্নিগ্ধতায় পটু। যে রসিক লিখেছিলেন— পূর্ব পূর্ব রসের গুণ পরে পরে হয়— তিনি মোক্ষম বুদ্ধিমান এবং রসিক। শৃঙ্গার রসের মধ্যেও যিনি দাস্য সখ্য বাৎসল্যের সঞ্চার দেখতে পেয়েছিলেন, তাঁর রসবোধেই ভারতবর্ষের জীবনবোধ তৈরি হয়েছে বলেই এদেশে জননীর স্নেহাভাব ঘটেনি কখনও। কর্ণ হয়তো জন্মদাত্রীর স্নেহসুখ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু রাধা-মায়ের স্নেহচ্ছায়া তাঁর জীবনে সতত প্রসারিত ছিল নিশ্চয়; তা নইলে বারবার এই দৃঢ়-শব্দ উচ্চারিত হত না— আমি রাধেয়, রাধা আমার মা— রাধেয়োহহম্।
কিন্তু অঙ্গ-রাজ্য ছেড়ে সেই কবেই তো হস্তিনাপুরে চলে এসেছিলেন কর্ণ। জন্মদাত্রীর প্রথম লালন-সুখ থেকে যে শিশু বঞ্চিত থাকে এবং সে যদি তা জানেও, তা হলে অন্যতরা জননীর প্রতিপূরণী স্নেহচ্ছায়া তার জীবনে যেন আরও বেশি প্রয়োজন হয়। সহজ সম্পর্কে, সহজ বাৎসল্যের মধ্যে জননীর উপেক্ষা এবং অবহেলাও তো থাকে কত এবং সেটাও বড় সহজই বটে। কিন্তু জননীর পরিত্যক্ত মানুষ যদি নিজেকে পরিত্যক্ত বলে জানে, তবে সর্বক্ষণ সে স্নেহচ্ছায়া খুঁজে বেড়ায়, অন্যতরা জননী-প্রতিমার। কিন্তু হস্তিনাপুরে এসে কোথায় এই স্নেহচ্ছায়া খুঁজে পেলেন কর্ণ? তাঁর রাধা-মা তো পড়ে রইলেন অঙ্গরাজ্যে, কিন্তু হস্তিনাপুরে কার স্নেহছত্র খুঁজে পেলেন তিনি?
এককথায় এর জবাব হয় না, কিন্তু বিশ্লেষণী বুদ্ধিতে এর জবাব মেলে। কুন্তীর প্রশ্ন আসে কর্ণের সাভিমান মনে তিনি পাণ্ডব-জননী, আর আছেন দুর্যোধনের মা গান্ধারী, যাঁর স্নেহব্যক্তি বিশ্লেষণ করা খুব কঠিন। লক্ষণীয়, দুর্যোধনের জননী হিসেবে যখনই তাঁকে দেখেছি, সব সময়েই মনে হয়েছে— তিনি দুর্যোধনকে শাসন করছেন এবং এই শাসনের আওতা থেকে কর্ণও বাদ যাচ্ছেন না। বরঞ্চ সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে পিতা ধৃতরাষ্ট্রের স্নেহ এবং সমর্থন দুর্যোধন যত পেয়েছেন, কর্ণও সেটা পেয়েছেন ততোধিক। কিন্তু গান্ধারীর ব্যাপারে যেটা দেখার মতো সেটা হল— বিপর্যয়ের মুখে তিনি দুর্যোধনের এমনকী কর্ণেরও অন্যায়ের কথা সোচ্চারে বলছেন বটে এমনকী প্রসঙ্গত ধর্ম কিংবা ন্যায়ের পথ তাঁর কাছে প্রয়োজনের চেয়েও অতিরিক্ত প্রশংসা পায় বটে, কিন্তু দুর্যোধনকে তিনি কোনও সময়েই নিজের ব্যক্তিত্ব খাটিয়ে তেমন করে বারণ করেননি। অর্থাৎ কিনা বারণ যখন করছেন, তখন বিপর্যয় ঘটে গেছে। এই যে বেশ একটা সময় পাওয়া যাচ্ছে অন্যায় পাকিয়ে তুলে অন্যায় করার এখানে দুর্যোধনকে প্রায়ই কিছু বলছেন না গান্ধারী, ফলে দুর্যোধন তো বটেই, তাঁর সঙ্গে তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু কর্ণও হয়ে উঠছে নিরঙ্কুশ।
এও এক অদ্ভুত স্নেহচ্ছায়া, যা বিপরীতভাবে অন্যায়ী পুরুষের দুরাগ্রহগুলি পুষ্ট করে। পাণ্ডবদের জতুগৃহে পাঠানো থেকে আরম্ভ করে পাশাখেলা পর্যন্ত, অথবা বলা উচিত— দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ পর্যন্ত, যত অন্যায়-অত্যাচার হয়েছে, তার আদিতে অথবা মধ্যে গান্ধারী কোনও কঠিন স্ফুটবাক্য উচ্চারণ করেন না যাতে দুর্যোধন থামতে পারেন, আর দুর্যোধন না থাকলে কর্ণ থামবেন কেন? আমরা এটা বলতে পারব না যে, পুরুষশাসিত সমাজ, অতএব ধৃতরাষ্ট্র বা দুর্যোধনকে কিছু বলাটা তাঁর অসুবিধের সৃষ্টি করেছে। হ্যাঁ, মহাভারতীয় সমাজে পুরুষশাসনের অনেক উপাদান আছে, কিন্তু স্ত্রীলোকের কন্ঠ এখানে রুদ্ধ ছিল না। তাঁরাও অনেক বাক-স্বাধীনতা ভোগ করেছেন, বিশেষ করে গান্ধারী তো বটেই! কিন্তু মুশকিল হল, বিপর্যয় ঘটে যাবার পর তিনি কথা বলেন, উপদেশ দেন, কাঠিন্য প্রকাশ করেন, দুর্যোধনের প্রতি বিরুদ্ধ আচরণও করেন, কিন্তু দুর্যোধন যখন দুষ্কর্ম-সাধনের প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত থাকেন কর্ণ-শকুনিদের সঙ্গে, তখন তিনি বাক্যদণ্ডে তা রুদ্ধ করেন না।
দুর্যোধনের প্রতি এটা যেমন তাঁর প্রশ্রয়, তেমনই এই প্রশ্রয় তাঁর কর্ণের ওপরেও ছিল। এটা সবচেয়ে ভাল বোঝা যাবে মহাভারতের স্ত্রীপর্বে এসে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ তখন শেষ হয়ে গেছে। থেমে গেছে রণদুন্দুভির আওয়াজ, ধনুকের টংকার, প্রতিস্পর্ধী বীরদের পারস্পরিক শাসানি। সমস্ত রণভূমি জনশূন্য, সর্বত্র ছড়িয়ে আছে ভগ্ন রথের অবশিষ্ট, মৃত পশু, হাতি, ঘোড়া এবং শত শত যোদ্ধা পুরুষ। সেনা-নায়ক আর সাধারণ সৈনিকের কোনও পার্থক্য বোঝা যায় না এখানে, বোঝা যায় না মৃত পশুদের সঙ্গে তাঁদের পার্থক্য। সমস্ত রণমুখর ভূমিতে আজ অরণ্যের স্তব্ধতা নেমে এসেছে। ছিন্নশাখ বৃক্ষের মতো জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্র বসে আছেন রাজসভায়। কোনও মন্ত্রী-অমাত্য নেই; দুর্যোধন, কর্ণ কিংবা শকুনির কুটিল যাতায়াতে নতুন কোনও সম্ভাবনা তৈরি হবার এতটুকুও আশা নেই আর। অশ্রুক্লিন্ন সম্রাটকে সঙ্গী সঞ্জয় শুধু প্রবোধ দিয়ে চলেছেন নিরন্তর— আর কাঁদবেন না মহারাজ! কেঁদে কী হবে? এই বসুমতী এখন শূন্য নির্জন— নির্জনেয়ং বসুমতী শূন্যা সম্প্রতি কেবলা— কেউ আর বেঁচে নেই।
জননী গান্ধারী ধৃতরাষ্ট্রকে সান্ত্বনা দেবার জন্য গেলেন না সভাস্থলে। অন্তঃপুরের মধ্যে শত শত বিধবার ক্রন্দনধবনি শুনতে শুনতে তিনি আকুল হয়ে উঠেছেন করুণায়। তাঁদের সান্ত্বনা দেবারও ভাষা নেই তাঁর। অতএব শেষ দেখাটা দেখতে যাবেন গান্ধারী, তার জন্য কুরুকুলের সমস্ত বউদের একত্রিত করে তিনি যুদ্ধভূমির দিকে এগিয়ে চললেন। দিকে দিকে শুধু শবদেহ, ছিন্ন মুণ্ড, বিপর্যস্ত উষ্ণীষ, মৃত সৈনিক, সেনা-নায়ক, পশু। একজন আরেকজনের শরীরের ওপর পড়ে আছে, কেউ হাতের গদাটিকে জড়িয়ে ধরেছে কোল বালিশের মতো। মহাভারতের কবি এই অসম্ভব করুণ দৃশ্যের মধ্যেও মৃত্যুর শৃঙ্গার রচনা করেছেন— শত্রুর দ্বারা নিক্ষিপ্ত গদার ওপর সৈনিকের শিথিল, নুয়ে পড়া মুখখানি, সে যেন চুম্বনে অনুৎসুক প্রিয়া রমণীর গায়ে এলিয়ে পড়া কোনও পুরুষের মুখ— শেরতে বিমুখাঃ শূরা বিমুখা ইব যোষিতঃ। গান্ধারী এবং কুরুকুলের অন্যান্য রমণীরা রাশি রাশি এত শবদেহ দেখে প্রথমে বিমূঢ় স্তব্ধ হয়ে গেলেন।
খানিক স্থির হতেই ব্যক্তিগত অন্বেষণ শুরু হল। একে একে গান্ধারী খুঁজে পাচ্ছেন তাঁর পুত্রদের। পুত্রস্নেহে উদ্বেল গান্ধারী বারবার কেঁদে উঠছেন এক-একজনকে স্পর্শ করে। তাঁর ধর্মস্থিত ন্যায় বুদ্ধিতে তিনি জানেন যে, তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্যোধনের দোষেই তাঁর সব ছেলেরা মারা গেছে। কিন্তু তাঁর স্নেহ-ব্যাকুল হৃদয় এই তর্কযুক্তিও তৈরি করে সঙ্গে সঙ্গে যে, একা দুর্যোধনেরই দোষ নয়, তাঁকে চালানো হয়েছে অন্যায় পথে এবং এখানে শকুনি-দুঃশাসন এবং কর্ণের ভূমিকাও কিছু কম নয়— কর্ণ-দুঃশাসনাভ্যাঞ্চ বৃত্তোহয়ং কুরুসংক্ষয়ঃ। গান্ধারী বলতে চান— দুর্যোধনের সাহংকার আস্ফালনে তাঁর দোষটাই লোকচক্ষুতে বেশি ধরা পড়ে, কিন্তু কর্ণ, দুঃশাসন এবং শকুনিও তো এই দুষ্টতায় কম যান না। কিন্তু পুত্র এবং পুত্ৰকল্পদের দোষগুলি তখনই গান্ধারী দেখতে পান, যখন তিনি স্থির ধর্মবুদ্ধিতে প্রতিষ্ঠিত আছেন, কিন্তু এখন চোখের সামনে এতগুলি মৃত্যু দেখে— একটিও পুত্র বেঁচে নেই তাঁর, ছেলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু কর্ণও মারা গেছেন— এই মুহূর্তে তাঁর সমস্ত পুত্রস্নেহ উদ্বেলিত হয়ে ওঠে, তাঁর অন্তর্হৃদয় থেকে বেরিয়ে আসে জননী, তিনি দীর্ণ হন, ক্রুদ্ধ হন, অভিশাপ দিয়ে ভস্ম করে দিতে চান তাঁদের, যাঁরা তাঁর বাৎসল্যের মৃত্যু ঘটিয়েছে।
এইরকম এক বিপন্ন সময়ে উপস্থিত হন ব্যাস। তত্ত্বকথায়, শান্ত সমাচারে প্রশমিত করেন গান্ধারীকে। গান্ধারী আবার রণক্ষেত্রে বিচরণ করতে থাকেন। অভিমানী পুত্র দুর্যোধনের কথা বারবার তাঁর মনে পড়ে। যে পুত্রকে সারাজীবন তিনি শুধু অসংযত হবার জন্য তিরস্কার করেছেন, আজকে তাঁর জন্য গান্ধারীর বিলাপিনী ভাষাই বাঁধন হারিয়েছে। দুর্যোধন কোনওদিন মৃত্যুবরণ করবেন, কিংবা কোনওদিন শেষ হয়ে যাবে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু কর্ণ অথবা জয়দ্রথ— দুর্যোধনস্য কর্ণস্য… কশ্চিন্তয়িতুমর্হতি। দুর্যোধনের মৃত শরীরের পাশে বসে অনেকক্ষণ কাঁদলেন গান্ধারী, তারপর এলেন দুঃশাসনের কাছে। পূর্ব কথা স্মরণ করে বিলাপ করছিলেন গান্ধারী; কথা বলতে বলতে একটা অদ্ভুত কথা জানালেন কৃষ্ণকে। বললেন, পাশাখেলায় পাণ্ডবদের জিতে নেবার পর দুঃশাসন যে দ্রৌপদীকে জঘন্য ভাষায় দাস-স্ত্রী বলে কৌরবগৃহে প্রবেশ করতে বলেছিলেন, সেটা দুটি লোককে খুশি করার জন্য। তারা হল তাঁর বড় ভাই দুর্যোধন এবং অন্য জন কর্ণ— প্রিয়ং চিকীর্ষতা ভ্রাতুঃ কর্ণস্য চ জনার্দন।
গান্ধারী অন্তত এই সত্য বুঝেছিলেন যে, কুরুকুলে দুর্যোধনের প্রভাব যতখানি, কর্ণের প্রভাবও ঠিক ততখানি। গান্ধারী এবার কর্ণের সামনে এসে পৌঁছেছেন। পাশে পাশে এসেছেন কৃষ্ণ। গান্ধারী কৃষ্ণকে বললেন, এই সেই বৈকৰ্ত্তন কর্ণ। মাটিতে এমনভাবে পড়ে আছে যে সেটা ভাবাই যায় না। পুঞ্জীভূত অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে হঠাৎ যেন জল ঢেলে দিয়ে তাকে শান্ত করেছে অর্জুন। বেঁচে থাকতে এই কর্ণ কত মহারথ অতিরথ বীরদের মৃত্যুমুখে পাঠিয়েছে, আর আজ সে পড়ে আছে শরীরে চাপ চাপ রক্ত নিয়ে প্রায় দলা পাকিয়ে— শৌণিতৌঘপরীতাঙ্গং শয়ানং পতিতং ভুবি।
গান্ধারী কর্ণের স্বভাব খুব ভাল জানেন আর জানেন বলেই মাত্র দুটি শব্দে তাঁর চরিত্রের সামগ্রিক উন্মীলন ঘটিয়েছেন। বলেছেন— খুব রাগী ছিল এই কর্ণ এবং সে রাগ পুষে রাখত অনন্তকাল ধরে— অমর্ষী দীর্ঘরোষশ্চ মহেষ্বাসো মহারথঃ। এত বড় বীর হওয়া সত্ত্বেও কর্ণের এই ক্রোধ যা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে সারাজীবন ধরে, তা যে শুধু পাণ্ডবদের ওপর বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়ায় তৈরি হয়েছে, এই ক্রোধ তাঁর নিজেকে নিয়েই যা পথ খুঁজে নিয়েছে কৌন্তেয় অর্জুনের প্রতিপক্ষতার মধ্যে। গান্ধারী বললেন, পাণ্ডব-বীরদের দিক থেকে দুর্যোধন কিংবা আমার ছেলেদের যে ভয় ছিল, সেই ভয় থেকে বাঁচার জন্য আমার ছেলেরা কর্ণকেই তাদের সামনে রেখে যুদ্ধ করেছিল, ঠিক যেমন অন্যতর হস্তী-যূথের যূথপতির সঙ্গে যুদ্ধের জন্য হাতির দল বিরুদ্ধ যূথপতির আশ্রয় নেয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না, পাণ্ডবপক্ষের মত্ত হাতিটা এ-পক্ষের পালের গোদাটাকে মেরে দিয়ে গেল— মাতঙ্গমিব মত্তেন মাতঙ্গেন নিপাতিতম্— আমাদের বাঘটাকে যেন মেরে দিয়ে গেল সিংহ, সব্যসাচী অর্জুন কর্ণকে শেষ করে দিল।
গান্ধারী দেখলেন— অত বড় বীর আজ ভূমিলুণ্ঠিত হয়ে আছেন। তাঁর স্ত্রীরা কাঁদছে, সমস্ত চুল খুলে গেছে তাদের। বিশেষত বৃষসেনের মা— তাঁর ছেলেও মারা গেছে, স্বামীও মারা গেলেন। কর্ণের বিধবা স্ত্রীদের আলুলায়িত করুণ-দশার পাশাপাশি কর্ণ যে প্রতিপক্ষের কাছে কতটা ভয়প্রদ ছিলেন, সেটা জানাতে কিন্তু কখনও ভুলছেন না গান্ধারী। আর ঠিক এইখানেই তাঁর পুত্রসম স্নেহরাশি ঝরে পড়ে কর্ণের ওপর। তিনি বলেছেন— বনবাসের ওই তেরোটা বছর যুধিষ্ঠির যাঁর জন্য ভাল করে ঘুমোতে পারেনি, সবসময় ভেবে এসেছে কী হয়, কী হয়, সেই কর্ণ আজ ঝড়ে-ভাঙা গাছের মতো পড়ে আছে— ভূমৌ যিনিহতঃ শেতে বাতরুগ্ন ইব দ্রুমঃ।
কর্ণের শরীর থেকে তাঁর মাথাটি ছিন্ন হয়ে খানিক দূরে পড়ে গিয়েছিল অর্জুনের বাণে। যুদ্ধভূমিতে দুই দিন এই অবস্থাতেই কর্ণের শবদেহ পড়েছিল। শেয়াল-শকুনে খেয়ে তাঁর শরীরের অবশেষ আছে সামান্যই। গান্ধারীর মোটেই ভাল লাগছে না তাঁকে দেখে। বলেছেন— কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে কলাভঙ্গ হতে হতে চাঁদ যেমন ক্ষীণ হয়ে যায়, তেমনই হয়েছে কর্ণের শরীরের দশা, শেয়ালে-শকুনে খেয়ে কী অবস্থা করেছে সেই মহার্ঘ শরীরের! এরই মধ্যে কর্ণের মাথাটি দূর থেকে এনে শরীরের সঙ্গে একত্র করে শিথিলভাবে জুড়ে রেখেছে কেউ। হয়তো এ-কাজটা করেছেন কর্ণের স্ত্রীরাই, অথবা গান্ধারী নিজে। সেই মৃত্যুক্লিষ্ট ম্লান মুখের ওপর সর্বশেষ চুম্বন এঁকে দিলেন বৃষসেনের মা, কর্ণের স্ত্রী এবং হয়তো মৃতমুখ কর্ণের কপালে স্নেহের চুম্বন দিলেন গান্ধারী— একই সঙ্গে ছেলে মারা যাওয়ায় কর্ণের স্ত্রী যেহেতু আরও বেশি কষ্ট পাচ্ছেন, তেমনই পুত্রস্নেহের কারণেই গান্ধারী আজ কর্ণের কপালে স্নেহশান্তি বিছিয়ে দিলেন যেন— কর্ণস্য বক্ত্রং পরিজিঘ্ৰমানা/রোরূয়তে পুত্রবধাভিতপ্তা।
এই অবশেষেরও একটা শেষ আছে— যেটা মহাভারতের কবির আপন পরিসর। কবি বোঝাতে চান— এই এত পর্ব ধরে যে মহাভারত বললাম, তার মর্ম একটাই— আমরা যে মুহূর্তে এই পৃথিবীতে জন্মাচ্ছি, সেই মুহূর্ত থেকেই আমাদেরই তৈরি করা সমাজনীতি, ধর্মনীতি এবং ব্যবহারিক নীতি আমাদের ওপর চেপে বসছে এবং সেই নীতির ব্যত্যয় হলেই তৈরি হয়ে যায় তথাকথিত পাপ, তৈরি হয়ে যায় অন্যতর এক কুটিল জগৎ, যা অন্যদের সঙ্গে মেলে না বলেই তা অন্যায় অথবা তা পাপ। কিন্তু জন্মের অন্য প্রান্তে যখন মৃত্যু আসে, তখন কিন্তু এই ন্যায়-অন্যায় সব ধুয়ে মুছে যায়। সেখানে ভেদাভেদ নেই, মলিনতাও নেই। এই সমাজনীতি অথবা ব্যবহার-নীতি না থাকলে কেমন হতে পারত আমাদের কর্ণের স্বরূপ, তার একটা নিরপেক্ষ রূপ পাওয়া যাবে মহাভারতের আশ্রমিক-পর্বে।
ঘটনার প্রেক্ষাপটে দেখতে পাচ্ছি— ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীরা তখন বাণপ্রস্থে গেছেন, বিদুরের মহাপ্রয়াণ ঘটে গেছে এবং কুন্তী আছেন ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীর সঙ্গে। রাজা যুধিষ্ঠির ভাইদের নিয়ে দেখা করতে এসেছেন মা এবং অন্যান্য গুরুজনদের সঙ্গে। কয়েকদিন এই অরণ্যভূমিতে কেটে যাবার পর মহামতি ব্যাস এসে পৌঁছলেন সেখানে। বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র তাঁর কাছে নিজের যন্ত্রণা ব্যক্ত করতেই গান্ধারী, কুন্তী, দ্রৌপদী সকলেই অবার নতুনভাবে শোক প্রকাশ করতে লাগলেন। গান্ধারী ব্যাসের কাছে জানালেন যে, মৃত পুত্রদের জন্য এখনও তাঁর মন বড় আকুল হয়, ব্যাস যদি তাঁর তপস্যার শক্তিতে মৃত পুত্রদের একবার দেখাতে পারতেন, তা হলে মনশ্চক্ষে একবার তাঁদের দেখে শান্তি পেতেন গান্ধারী।
ঠিক এই অবস্থায় কুন্তীও প্রপন্ন হলেন শ্বশুর ব্যাসের কাছে, কিন্তু তাঁর নিবেদন ছিল একেবারেই অন্য। কুন্তি বললেন, আপনি আমার শ্বশুর, আমার দেবতারও দেবতা। আপনি দয়া করে আমার সত্য কথাটা শুনুন। কুন্তী এবার বলতে আরম্ভ করলেন সেই চির পুরাতন কর্ণের জন্মকথা, সকলের সামনে, ছেলেপিলেদের সামনে এক নির্লজ্জ স্বীকারোক্তির মতো। কুন্তী বললেন, কোপনস্বভাব দুর্বাসা আমার পালক পিতা কুন্তিভোজের বাড়িতে এসেছিলেন। তাঁকে পরিচর্যা করার ভার পড়েছিল আমার ওপর। আমি অত্যন্ত পবিত্রভাবে তাঁর পরিচর্যা করেছি, কোনও ভুল করিনি কোনওদিন, বরঞ্চ তিনি আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে এমন অসদ্ব্যবহার করেছেন, যাতে আমার রাগ হওয়ার অনেক কারণ ছিল, কিন্তু তবু আমি রাগ করিনি— কোপস্থানেষ্বপি মহৎস্বকুপ্যন্ন কদাচন। আমার এই শুদ্ধমানস এবং পরিচর্যার গুণেই তিনি আমাকে বর দিতে উৎসুক হলেন।
পণ্ডিতজনেরা কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন যে, রাগ হবার কারণ সত্ত্বেও যে কুন্তী রাগ করেননি দুর্বাসার ওপর, এখানেই কি কর্ণের জন্মরহস্য লুকোনো আছে! আমাদের জিজ্ঞাসা হয়— এটা কীসের ইঙ্গিত? কর্ণ কি তা হলে দুর্বাসারই ছেলে? আমরা এই ইঙ্গিতে খুব বেশি আগ্রহ দেখাই না, কেননা তাতে পরবর্তীকালে দেবসঙ্গমে কুন্তীর অন্য পুত্রদের জন্মবাদ বৃথা হয়ে যায়। যদি দেবতার অলৌকিকত্বে বিশ্বাস নাও করি, তবু কর্ণের জন্মের ব্যাপারে দুর্বাসার শরীর-সংশ্লেষ আমরা মানতে পারি না। পারি না, কেননা জীবনের মধ্যে এইসব অঘটন মহাভারতে যত ঘটেছে, তার কোনওটাই মহাকবি লুকোননি; দুর্বাসার সঙ্গে কুন্তীর কিছু শারীরিক ঘটে থাকলে, সেটাও লুকোনোর মতো কবি ব্যাস অন্তত নন। কুন্তীর ওপর দুর্বাসার বরের যে অর্থই হোক, এটাই মেনে নেওয়া ভাল যে, অন্যতর কোনও দেবকল্প পুরুষের সংস্পর্শেই কুন্তী কন্যা অবস্থায় কর্ণের জন্ম দিয়েছিলেন।
কিন্তু আমাদের বক্তব্য অন্য জায়গায়। কুন্তী কামনার কৌতুকে সূর্যদেবকে আহ্বান করে যেভাবে বিব্রত হয়েছিলেন, সে-কথা সবিস্তারে তিনি জানিয়েছিলেন ব্যাসদেবকে। তারপর যা যা ঘটেছিল সব সম্পূর্ণ স্বীকার করার পর কুন্তী বললেন, আমি যা করেছি, তা পাপই হোক, অথবা অপাপই হোক, আমি সেই কর্ণকে একবার দেখতে চাই— তং দ্রষ্টুমিচ্ছামি ভগবন্ ব্যপনেতুং ত্বমর্হসি। ব্যাস কুন্তীকে অভয় দিয়ে বলেছেন, তুমি যা যা করেছ, তাতে কোনও দোষ হয়নি। কর্ণের জন্য তুমি কষ্ট পাচ্ছ, দেখতে পাবে তুমি কর্ণকে— কর্ণং দ্রক্ষ্যতি কুন্তী চ— রাত্রিবেলায় ঘুম ভেঙে গেলে প্রিয়জনকে যেভাবে দেখে, সেইভাবে সহজে তুমি দেখতে পাবে কর্ণকে— আমার তপস্যা বলে।
এইরকম একটা দিনের জন্য বুঝি সারাজীবন অপেক্ষা করেছেন কুন্তী। কর্ণের জন্মলগ্ন থেকে যে অপবাদের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল কুন্তীর জীবনে, সেই আশঙ্কা দিনে দিনে তাঁর অবহেলার যন্ত্রণায় পরিণত হয়েছে, উদ্যোগপর্বে তিনি স্বয়ং কর্ণের কাছেই ধিক্কার লাভ করেছেন। অবশেষে কর্ণের মৃত্যুর পর সত্য প্রকাশ হয়ে পড়লে যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চ পুত্রের ধিক্কার। আজ ব্যাস যেভাবে কর্ণকে তপস্যার শুদ্ধতায় কুন্তীর সামনে নিয়ে এলেন, তাতে কুন্তী দেখলেন— কর্ণ দৃশ্যমান হবার সঙ্গে সঙ্গেই পঞ্চপাণ্ডব ভাই এগিয়ে গিয়ে মিলিত হলেন তাঁর সঙ্গে। কর্ণের মনে কোনও অভিমান নেই, ক্রোধ নেই, সানন্দে তিনি এসে জড়িয়ে ধরলেন পাঁচ ভাই পাণ্ডবকে। তাঁদের মধ্যে এমনই সৌহার্দ ফুটে উঠল যেন কোনওদিনই তাঁরা পাঁচ ভাই ছিলেন না, তাঁরা ছয় ভাই— ততস্তে প্ৰীয়মানা বৈ কর্ণেন সহ পাণ্ডবাঃ।
সেই কুমারীকাল থেকে অপেক্ষা করে আজকে যে কর্ণকে দেখতে পেলেন কুন্তী, এই কর্ণই তাঁর অন্তশ্চিন্তিত বাসনালোকে সুপ্ত ছিল, এই কর্ণকেই তো তিনি চেয়েছেন— মহাভারতের কবি শুধু বুঝিয়ে দিলেন— জীবনের কোনও জটিলতা না থাকলে কর্ণ তো এমনই হতেন, কিন্তু তাতে কুন্তীই কি এত গুরুত্বপূর্ণ কোনও জননী হতেন, নাকি কর্ণই হতেন মহাভারত মহাকাব্যের খ্যাততম প্রতিনায়ক।