2 of 2

করোটির অপচ্ছায়া – নিরঞ্জন সিংহ

করোটির অপচ্ছায়া – নিরঞ্জন সিংহ

বাসের সামনের দিকের একটা সিটে বসে গভীর চিন্তায় ডুবে গিয়েছিলেন ডক্টর প্রশান্ত সেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক উনি। বয়েস পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি। সুপুরুষ চেহারা, ফরসা রং। এখনও বিয়ে করেননি। অধ্যাপনা ও ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করে সময় কাটান। মধ্য আমেরিকার প্রাচীন মায়া সভ্যতার রহস্য নিয়ে বহুদিন ধরে গবেষণা করছেন।

বাস লোকভরতি হয়ে যাওয়ায় ছেড়ে দিল। বাসের ঝাঁকুনিতে ডক্টর সেনের তন্ময়তা কেটে গেল। মেরিডা থেকে বাস যাবে চিচেনইৎজা। মধ্য আমেরিকার মেক্সিকো রাজ্যের যুকটান উপদ্বীপের রাজধানী হচ্ছে মেরিডা। মেরিডা শহরকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে রয়েছে মায়া সভ্যতার নানা নিদর্শন। মেরিডা থেকে সকাল-সকাল বেরিয়ে এক-একটা জায়গা একদিনে দেখে আবার সন্ধ্যা নাগাদ মেরিডায় ফিরে আসা যায়। আজ দু-সপ্তাহেরও বেশি মেরিডা শহরের নামকরা হোটেল প্লাজাতে এসে উঠেছেন ডক্টর সেন। এর মধ্যে উনি উশমল, লাবনা, শায়লী, কাবা, ইজমাল, জীবিলসুলতুন জায়গাগুলো দেখে নিয়েছেন। যত দেখছেন ততই ওঁর বিস্ময় বাড়ছে। কিন্তু যে-উদ্দেশ্যে এত দূরের রাস্তা পাড়ি দিয়ে মায়া সভ্যতার দেশ দেখতে এসেছেন সে-উদ্দেশ্য তাঁর এখনও পূর্ণ হয়নি। প্রত্যেক জায়গার গাইড ও স্থানীয় লোকদের সঙ্গে একান্তে কথা বলেছেন, ওদের টাকার লোভ দেখিয়েছেন, কিন্তু ওঁকে আসল জায়গার সন্ধান দিতে পারেনি কেউ। ক্রমে হতাশ হয়ে পড়ছিলেন ডক্টর সেন, ঠিক এইসময় জীবিলসুলতুনের একজন বুড়ো গাইড ওঁকে একটা ভাসা-ভাসা খবর দিল। ও বলল, ‘আপনি একবার চিচেনইৎজায় গিয়ে খোঁজ করুন। আপনি যা খুঁজছেন তা পেয়ে যেতেও পারেন।’

‘চিচেনইৎজার কোথায় কার কাছে খোঁজ করব?’ প্রশ্ন করলেন ডক্টর সেন।

‘তা বলতে পারি না, তবে বছর-দশেক আগে একটা গুজব আমার কানে এসেছিল যে, দুজন বিদেশি পর্যটক নাকি ললটানে ঢুকে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখতে পায়। জিনিসটা তারা উদ্ধার করতে পারে না, কোনওরকমে মরতে-মরতে তারা বেঁচে যায়। আমার মনে হচ্ছে, আপনি চিচেনইৎজায় গেলে সবকিছুর সন্ধান পাবেন।’ বলল সেই বুড়ো গাইড।

আজ চলেছেন তিনি চিচেনইৎজার উদ্দেশে। মেরিডা থেকে দূরত্ব প্রায় দুশো কিলোমিটার। বাসে সময় লাগে ঘণ্টা-তিনেক মতো। চিচেনইৎজা মেরিডার পুবদিকে উশমল ছাড়িয়ে যেতে হবে। শহর ও শহরতলি ছাড়িয়ে ছুটে চলেছে বাস।

বেলা প্রায় এগারোটা নাগাদ বাস চিচেনইৎজা পৌঁছে গেল। মায়া অভিধান অনুযায়ী ‘চি’ শব্দের অর্থ হচ্ছে মুখ, ‘চেন’ শব্দের অর্থ কুয়ো বা জলাধার, ‘ইৎজা’ মায়াদের এক বিশেষ গোষ্ঠীর নাম।

বাস থেকে নামলেন ডক্টর সেন। বড়রাস্তার দু-ধারে ছড়িয়ে রয়েছে ভগ্নস্তূপ। এদের আকৃতিতে নালন্দার অনুকৃতি, দাক্ষিণাত্যের গোপুরমের সাদৃশ্য, মিশরের পিরামিডের অনুরূপতা। এদের শিলাচিত্রে রয়েছে আশীরিয় ভাস্কর্য ও চিত্রকলার মিল।

বীরমন্দিরের খাড়া সিঁড়ি বেয়ে ওপরের চাতালে উঠে গেলেন ডক্টর সেন। ওখান থেকে দেখা যাচ্ছে সামনের বিরাট উঁচু পিরামিড। পিছনে অজস্র ছোট-ছোট থাম। মনে হয়, আগে দালান ছিল। এখানে ষোলোটি বিরাট অট্টালিকার মধ্যে কুকুলকানের দুর্গ দূর থেকে চোখে পড়ে। দুর্গের চারদিকে খাড়া সিঁড়ি। পশ্চিম দিকে উৎসর্গ কুয়ো। ডক্টর সেন নেমে এলেন। শার্দূল মন্দির দেখলেন। দেওয়ালে পাথরের ওপর খোদাই করা আশীরিয় মূর্তির মতো দাড়িওয়ালা মূর্তি। এর পশ্চিমে বিরাট প্রাঙ্গণ। টেম্পল অফ থ্রি লিন্টেলস-এর চারকোণে দেবতা ‘চাক’-এর মুখোশ কুঁদে তোলা হয়েছে। তা ছাড়া রয়েছে বিরাট ধর্মযাজিকা-নিকেতন। এখানেও বিরাট প্রাঙ্গণ। চারধারে বসে দর্শকরা খেলা দেখতে পারে, নাচ-গান শুনতে পারে। বড়রাস্তার ওপারে রয়েছে আরও সব পুরোনো নিদর্শন। একটা চারকোনা বেদির ওপর চোঙার মতো বিরাট উঁচু একটা প্রাসাদ। এটা হচ্ছে নভোবীক্ষণাগার। মেঠো রাস্তার ডান দিকে রয়েছে প্রধান পুরোহিতের সমাধি-মন্দির। এর চারদিকে সব স্তূপ এখনও খুঁড়ে বের করা হয়নি। নভোবীক্ষণাগারের উত্তর-পূর্ব কোণে নৈসর্গিক কুয়ো। এখানে প্রাকৃতিক কোনও কারণে ওপরের মাটির আস্তরণ উঠে যাওয়ায় জলের সন্ধান মেলে বলে অনেক বিশ্বাস করেন। এই জলের উৎসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল চিচেনইৎজার সভ্যতা।

বেলা প্রায় দুটো বাজে। কিছু খেতে হবে, তারপর আসল কাজের খোঁজখবর করতে হবে। প্রয়োজন হলে দু-একদিন এখানে থাকতে হবে। এখানে হোটেল আছে। বড়রাস্তার ধারে কিছু দোকানপাট আছে। সেইদিকে পা বাড়ালেন ডক্টর সেন। দোকানে বিভিন্ন খাওয়ার জিনিস পাওয়া যায়—শরবত, ফল, চা-বিস্কুট, এমনকী ভাত-মাংসও।

ডক্টর সেন একটা দোকানে ঢুকলেন। দোকানদার এগিয়ে আসতে ভাত আর মাংসের অর্ডার দিলেন। খাওয়া-দাওয়া সেরে দোকানদারকে ডাকলেন। পয়সা মিটিয়ে দিয়ে এক ডলার বকশিশ দিলেন। দোকানদার খুশি হয়ে দাঁত বের করে হাসল। ডক্টর সেন বললেন, ‘তোমার দোকানে খেয়ে খুব তৃপ্তি পেলাম। আমার একটা উপকার করবে?’

দোকানদারকে অল্প কথায় সব বুঝিয়ে বললেন।

দোকানদার সব মন দিয়ে শুনল, তারপর বলল, ‘এ ব্যাপারে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারব না, স্যার।’

‘কী অসুবিধে তোমার? যদি টাকাপয়সা লাগে আমি খরচ করতে রাজি আছি। যদি সম্ভব হয় তাহলে আমাকে সাহায্য করো। বহু দূর-দেশ থেকে আমি ছুটে এসেছি।’

ডক্টর সেনের কথায় দোকানদারের মন বোধহয় একটু নরম হল। ও বলল, ‘স্যার, আপনি যা শুনেছেন তা সত্যি। বছর-দশেক আগে দুজন আমেরিকান টুরিস্ট একজন গাইডকে নিয়ে ললটানে ঢুকেছিল গোপনে। ললটানের কথা সবাই শুনেছে, কিন্তু আসলে সেটা কোথায় ও কী করে সেখানে যেতে হয় তা পুরোহিতরা ছাড়া কেউ জানে না। যত টাকাপয়সাই দিন পুরোহিতরা কক্ষনও কাউকে সেখানে নিয়ে যায় না। গাইডটা কী করে যে ললটানের সন্ধান পেয়েছিল তা আজ পর্যন্ত কেউ জানে না। যা হোক, ওরা কোনওরকমে মরতে-মরতে ফিরে আসে। তারপর কথাটা জানাজানি হয়ে পড়ে। তখন পুরোহিতরা গাইডটাকে শাস্তি দেয়। লোকটা পাগল হয়ে যায়। লোকটা এখনও বেঁচে আছে, মাঝে-মাঝে যখন কিছুদিনের জন্যে সুস্থ হয়ে ওঠে, তখন গাইডের কাজ করে। অসুস্থ হয়ে পড়লে আর ওকে দেখা যায় না। তবে গাইডের কাজ করলেও ভুলেও ও আর কোনও টুরিস্টকে ললটানে নিয়ে যায়নি।’

‘লোকটার ঠিকানা জানো তুমি?’ জিগ্যেস করলেন ডক্টর সেন।

‘ঠিকানা জানি, কিন্তু তাতে কোনও লাভ হবে না, স্যার। কারণ, ললটানে ও আর কোনও টুরিস্টকে নিয়ে যাবে না। ওর ওপর পুরোহিতের অভিশাপ আছে। দ্বিতীয়বার ললটানে ঢুকলে ওর অবধারিত মৃত্যু।’

‘তা হোক, তবু তুমি একবার চেষ্টা করো যাতে আমি লোকটার সঙ্গে দেখা করতে পারি। আমি এখানকার হোটেলে কয়েকদিন থাকব।’

‘নিশ্চয় চেষ্টা করব। তবে আপনি কি পুরোহিত মারুর সঙ্গে একবার দেখা করবেন?’

‘তুমি কি যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারো?’

‘পারি—পুরোহিতের বাড়ি খানিকটা দূরে। আমি একটি ছেলেকে সঙ্গে দিচ্ছি, ও আপনাকে পুরোহিতের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে।’

দোকানদারকে ধন্যবাদ জানিয়ে ছেলেটির সঙ্গে চললেন ডক্টর সেন। মিনিট-কুড়ি হাঁটার পর ছেলেটি রাস্তা থেকে দূরে একটা ফাঁকা জায়গায় একটা বাড়ি দেখিয়ে দিয়ে চলে গেল। ডক্টর সেন এগিয়ে চললেন। নানা চিন্তা ওঁর মাথায় ভিড় করতে লাগল। এককালে প্রাসাদ থাকলেও এখন বাড়িটার জরাজীর্ণ অবস্থা।

বাইরের দরজা খোলাই ছিল। ডক্টর সেন দরজার কড়া নাড়লেন। একজন বয়স্ক মানুষ প্রায় নিঃশব্দে দরজার কাছে এগিয়ে এলেন। মুখে চাপদাড়ি। মাথার চুল আর দাড়ি-গোঁফ অর্ধেক পেকে গেছে। বয়স প্রায় ষাটের কোঠায়, কিন্তু দেখলেই বোঝা যায় এখনও যথেষ্ট সবল। ইনিই পুরোহিত মারু তা বুঝতে অসুবিধে হল না ডক্টর সেনের। পুরোহিত মারু অনেকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন ডক্টর সেনের মুখের দিকে। এতক্ষণে ডক্টর সেন মনে-মনে যেন একটু ভয় পেলেন। কী সাংঘাতিক অন্তর্ভেদী দৃষ্টি! মনে হচ্ছে যেন ভিতরটা অবধি খুঁটিয়ে দেখে নিচ্ছেন। ডক্টর সেনও সম্মোহিতের মতো দাঁড়িয়েছিলেন। নিজের পরিচয় দেওয়ার কথাও ভুলে গিয়েছিলেন।

পুরোহিত মারুর কথায় যেন বাস্তবে ফিরে এলেন উনি।

‘কে তুমি? আমার কাছে কেন এসেছ?’ গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করলেন পুরোহিত মারু।

ডক্টর সেন পরিচয় দিলেন। বললেন, ‘আমি বড় আশা নিয়ে ভারতবর্ষ থেকে ছুটে এসেছি একটা জিনিস সম্বন্ধে জানতে। আপনি যদি দয়া করেন তাহলে আমার আশা পূর্ণ হবে।’

‘ললটানের হদিশ আমার জানা নেই। এ ছাড়া তোমার আর কিছু জানবার আছে?’

ডক্টর সেন এবার চমকে উঠলেন। না বলতে ওঁর মনের খবর কী করে জানলেন পুরোহিত মারু! তবে ভারতবর্ষের মানুষ বলে এরকম অলৌকিক কাণ্ডে দিশেহারা হয়ে পড়লেন না। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘আপনি আমাকে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। আমি ভালোভাবে জানি, আপনি ললটানের খবর জানেন। আমি জানি, বছর-দশেক আগে দুজন আমেরিকান টুরিস্ট ললটানে ঢুকেছিল।’

পুরোহিত মারুর দু-চোখ যেন হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠল ‘এ-কথা তুমি জানলে কী করে?’

‘যে করেই হোক আমি জেনেছি। কথাটা যে মিথ্যে নয় তা আশা করি আপনি বুঝতে পেরেছেন। ওদের মধ্যে একজন ললটানের ভেতরের ছবি তোলার চেষ্টা করেন। ন’টা ছবির মধ্যে আটটা ছবিই নষ্ট হয়ে যায়। একটা ছবি প্রিন্ট করে দেখা যায়, যেন একটা উজ্জ্বল আলোর ছবি উঠেছে। আলোটা কীসের তা ওঁরা বুঝতে পারেননি, তবে তাঁরা এটা বুঝতে পেরেছিলেন, অমূল্য কোনও গুপ্ত রহস্য মায়ারা এক শক্তিশালী ফোর্সফিল্ডের আড়ালে সুরক্ষিত করে রেখেছে। ফোর্সফিল্ডের শক্তির উৎস কী বা তার আসল প্রকৃতিই বা কী, তা ওঁরা বুঝে উঠতে পারেননি।’

ডক্টর সেনের কথা শেষ হওয়ার অনেকক্ষণ পরে পুরোহিত মারু বিড়বিড় করে আপনমনে দুর্বোধ্য ভাষায় কী যেন বলে উঠলেন।

‘আমি জানি, আমি যা খুঁজতে এতদূর এসেছি তার হদিশ একমাত্র আপনিই দিতে পারেন। বিশ্বাস করুন, আমার কোনও খারাপ উদ্দেশ্য নেই। আমি ইতিহাসের অধ্যাপক। গত পনেরো বছর ধরে আমি গবেষণা করছি মায়া সভ্যতার রহস্যময়তা নিয়ে। আমার বিশ্বাস, সব রহস্যের চাবিকাঠি লুকোনো আছে ললটানের ফোর্সফিল্ডের আড়ালে। আমার মন বলছে, আমেরিকান টুরিস্টরা দশ বছর আগে যে-জিনিসের ছবি তুলেছিলেন, সেই জিনিসটা খুঁজে পেলে সব রহস্যের সমাধান হবে। আপনি দয়া করে আমাকে একটা সুযোগ দিন।’

ডক্টর সেন কথা শেষ করে পুরোহিত মারুর মুখের দিকে তাকালেন।

পুরোহিত মারু বললেন, ‘এসো আমার সঙ্গে।’

ডক্টর সেন খুশি হলেন। ওঁর মনে হল উনি শক্ত বরফ হয়তো গলাতে পেরেছেন। অনেকগুলো বারান্দা পেরিয়ে পুরোহিত মারুর সঙ্গে একটা আবছা অন্ধকার ঘরে ঢুকলেন তিনি। ঘরটায় কোনও জানলা নেই। ঢোকার জন্য একটিমাত্র দরজা। ঘরে ঢুকে পুরোহিত মারু সেই দরজাটাও বন্ধ করে দিলেন। ঘরটা ঠান্ডা, স্যাঁতসেঁতে। একটা ভ্যাপসা গন্ধ ছড়িয়ে রয়েছে বাতাসে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। বেশ কিছুক্ষণের জন্য যেন অন্ধ হয়ে গেলেন ডক্টর সেন। পুরোহিত মারু ততক্ষণে একটা ছোট্ট মোমবাতি জ্বালিয়ে একটা তাকের ওপর বসিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু মোমবাতির আলো অন্ধকার দূর করার বদলে যেন অন্ধকারকে বাড়িয়ে তুলল। ডক্টর সেনের সারা শরীরটা এক অজানা আতঙ্কে যেন শিরশির করে উঠল। পুরোহিত মারুর ছায়াটা দুলতে লাগল বিপরীত দিকের দেওয়ালে। এতক্ষণে ডক্টর সেনের চোখ সয়ে এল।

ঘরটা মাঝারি ধরনের। চারিদিকে ছড়ানো রয়েছে অদ্ভুত সব জিনিসপত্র। আসলে সেগুলো যে কী তা কিছুই বুঝতে পারছিলেন না ডক্টর সেন। আলো-আঁধারিতে জিনিসগুলো অতিপ্রাকৃত চেহারা ধারণ করেছিল।

‘সামনের আসনে বোসো।’ গম্ভীর স্বরে প্রায় আদেশ করলেন পুরোহিত মারু।

ভয়ে-ভয়ে সামনের পাতা আসনটার ওপর বসে পড়লেন ডক্টর সেন।

‘তোমার যা বলার তা বলেছ। আমি স্বীকার করছি, তুমি অনেক খবর রাখো। পনেরো বছর ধরে মায়া সভ্যতার রহস্য জানবার চেষ্টা করছ। প-নেরো বছর। অনেক সময়, তাই না? আমি বুঝতে পারছি, মায়াদের আসল রহস্য তুমি ধরতে পেরেছ। আমরা যে দূর কোনও নক্ষত্রলোক থেকে পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি হওয়ার বহু লক্ষ বছর আগে এখানে এসে বসবাস করতে শুরু করেছি, তা-ও তুমি বুঝতে পেরেছ। কিন্তু অধ্যাপক, আমি তোমার এবং পৃথিবীর মানুষদের ভালোর জন্যে বলছি, তুমি ললটানের ফোর্সফিল্ডের আড়ালে সুরক্ষিত গোপন রহস্য সম্বন্ধে আর কিছু জানতে চেয়ো না। ও-সম্বন্ধে সব কথা এই মুহূর্ত থেকে ভুলে যাও। আমি জানি, কী সাংঘাতিক জিনিস ওটা। ওটার সম্বন্ধে তোমার কৌতূহল বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে ফোর্সফিল্ডটা ধীরে-ধীরে নষ্ট হয়ে যাবে। তারপর ওই ভয়াবহ জিনিসটি তোমার হাতেই পড়ুক, আর অন্য যে-কোনও মানুষের হাতেই পড়ুক, ও ওর কাজ শুরু করে দেবে। ওকে প্রতিহত করার শক্তি এই মহাবিশ্বে কারও নেই। এমনকী আমাদেরও না। পৃথিবীতে ব্যবহারের প্রয়োজন পড়েনি বলে আমরা পুরুষানুক্রমে ওটাকে পাহারা দিয়ে চলেছি যাতে পৃথিবীর মানুষ এর সন্ধান না পায়। কিন্তু তোমাদের কৌতূহল এতই তীব্র যে, নিজেদের ধ্বংস তোমরা নিজেরাই টেনে আনছ। তোমাদের মঙ্গলের জন্যে আবার বলছি, এই মুহূর্ত থেকে ললটানের রহস্যের কথা সম্পূর্ণ ভুলে যাওয়ায় চেষ্টা করো, তা নইলে পৃথিবীর ভয়ঙ্কর অমঙ্গল ঘটবে।’ পুরোহিত মারুর শেষ কথা ক’টি যেন ভয়াবহ অভিশাপের মতো উচ্চারিত হল।

ডক্টর সেন এতক্ষণে একটু হাসলেন ‘বুঝেছি, আপনি ভয় দেখিয়ে আমাকে সরিয়ে দিতে চাইছেন। জেনে রাখুন, কোনওরকম কুসংস্কারকে আমি প্রশ্রয় দিই না। আপনার গল্পটা শুনতে ভালোই তবে বিশ্বাসযোগ্য নয়।’

পুরোহিত মারুর সমস্ত দেহটা যেন কেঁপে উঠল। ছায়াটা দুলে উঠল। প্রচণ্ড রাগ চাপবার চেষ্টা করাতে ওঁর মুখখানা বিকৃত হয়ে গেল। নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করলেন তিনি। বেশ কিছুক্ষণ বাদে চিবিয়ে-চিবিয়ে বলে উঠলেন, ‘সবকিছু তোমার মন থেকে মুছে দেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে, অধ্যাপক। কিন্তু তা আমি দেব না। হয়তো তোমাদের কাল পূর্ণ হয়েছে। আমার নিষেধ যখন তুমি শুনবে না, তখন যা হওয়ার তাই হোক। আমি বাধা দেব না।’

‘তাহলে আমাকে কি আপনি ললটানে নিয়ে যাবেন?’ খুশি হয়ে জানতে চাইলেন ডক্টর সেন।

‘না, আমি তোমাকে ললটানে নিয়ে যাব না। তবে সত্যিই যদি তোমার কাল পূর্ণ হয়ে থাকে তাহলে ললটানের হদিশ তুমি পেয়ে যাবে। অশুভ শক্তি যদি কার্যকরী হয়ে ওঠে তা হলে তাকে বাধা দেওয়ার কেউ নেই।’ বলে একটু বিষণ্ণভাবে হাসলেন পুরোহিত মারু। তারপর উঠে দরজা খুলে দিলেন।

ডক্টর সেন বাইরে এসে চোখ বন্ধ করতে বাধ্য হলেন। বাইরে উজ্জ্বল সূর্যের আলো। অন্ধকার ঘর থেকে বাইরে এসে ডক্টর সেন রীতিমতো হকচকিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চোখ সইয়ে নিয়ে পুরোহিত মারুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে চললেন তিনি।

রাত প্রায় ন’টা বাজে। চিচেনইৎজার একমাত্র বড় হোটেল, সিটি হোটেলের ঘরে বসে অপেক্ষা করছেন ডক্টর সেন। এয়ার কন্ডিশনড ঘরের মধ্যে বসে থেকেও উনি স্বস্তি পাচ্ছেন না। একবোতল ঠান্ডা বিয়ার শেষ করে আর-একবোতলের অর্ডার দিয়েছেন। ঘরের জোরালো আলোটা নেভানো। টেবিলে ছড়ানো রয়েছে একগোছা কাগজ।

ললটান হচ্ছে মাটির নীচে সুড়ঙ্গ। শহরের নীচে অদ্ভুত সব সুড়ঙ্গ তৈরি করেছিল মায়ারা। কেন তা কেউ জানে না। দু-একটা ছোটখাটো ললটান আবিষ্কার হলেও আসল ও গভীর ললটানগুলোর সন্ধান মানুষ এখনও পায়নি। বছর-দশেক আগে দুজন আমেরিকান টুরিস্ট একটা ললটানে ঢোকেন। মাইকেল ডিওবরেনোভিস হচ্ছেন একজন নৃতত্ত্ববিদ আর ভ্যালেন্টাইন হচ্ছেন সমুদ্র-পুরাতত্ত্ববিদ। তখনই জানা যায় যে, মিশরের পিরামিডের মধ্যে যেরকম ফোর্সফিল্ডের সন্ধান পাওয়া গেছে এই ললটানের ভিতরে ঠিক সেই একই রকমের ফোর্সফিল্ডের অস্তিত্ব রয়েছে। কোনও মূল্যবান জিনিস সুরক্ষিত করে রাখার জন্য ফোর্সফিল্ড ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাই ললটানের ফোর্সফিল্ডের আড়ালে মায়ারা মহামূল্যবান কিছু লুকিয়ে রেখেছে, এ-কথা অনুমান করা মোটেও শক্ত নয়। ডক্টর সেনের সিদ্ধান্তে কোনও ভুল নেই। এবার যে করেই হোক এ-রহস্য তাঁকে ভেদ করতেই হবে।

কিন্তু লোকটা এখনও কোনও খবর নিয়ে আসছে না কেন? তবে কি গাইডটা আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছে? নাকি দোকানদার কোনও খবর পাঠায়নি? দোকানদারের সঙ্গে কি আর-একবার দেখা করবেন? নিজের মনেই ভাবছিলেন ডক্টর সেন। ঠিক এমন সময় হোটেলের বেয়ারা এসে জানাল আলফোঁ নামে একটি লোক ডক্টর সেনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।

ডক্টর সেন খুশি হলেন। বললেন, ‘ওকে আমার ঘরে পাঠিয়ে দাও।’

বেয়ারা চলে গেল। একটু বাদে দরজায় শব্দ হতেই ডক্টর সেন বললেন, ‘ভেতরে আসুন।’

দরজা খুলে একজন স্থানীয় যুবক ঘরে ঢুকল। তামাটে রং। সাধারণ পোশাক। এরই নাম আলফোঁ। ওর দু-চোখে একটা ধূর্ততার ছাপ।

আলফোঁকে দেখে খুব একটা খুশি হতে পারলেন না ডক্টর সেন। কিন্তু গরজ বড় বালাই। ভদ্রতা দেখিয়ে বসতে বললেন ওকে।

একগাল হেসে লোকটা সোফার এককোণে বসল। একটু যেন সঙ্কুচিত ভাব।

‘আশা করি কোনও ভালো খবর এনেছ?’ প্রশ্ন করলেন ডক্টর সেন।

‘আপনি ললটানে যাওয়ার জন্যে গাইড খুঁজছেন?’ আলফোঁ উলটে প্রশ্ন করল।

‘হ্যাঁ। তুমি কি আমাকে নিয়ে যেতে পারবে?’

‘আমি আপনাকে ললটানে নিয়ে যেতে পারলে খুশি হতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ললটানের হদিশ আমি জানি না। তবে আমি একজনের খোঁজ দিতে পারি, যে আপনাকে ললটানে নিয়ে যেতে পারে।’

‘কে সে?’

‘আমার কাকা পিজারো। দোকানদারের মুখে আপনি নিশ্চয় তার কথা শুনেছেন?’

‘হ্যাঁ, শুনেছি। তোমার কাকা কি এখন সুস্থ আছেন?’

‘আপাতত সুস্থ। খুবই আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে রয়েছে ও। তাই আপনার কথা দোকানদারের মুখে শুনে আমি কাকার সঙ্গে কথা বলে আপনার কাছে আসছি।’

‘কাকা রাজি হয়েছেন?’

‘হ্যাঁ, অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছি। তবে আপনাকে একটু বেশি পয়সা খরচ করতে হবে। আশা করি তাতে আপনার আপত্তি নেই।’

‘কত?’

‘কাকাকে দুশো ডলার দিতে হবে, আর কাকাকে রাজি করানোর মজুরি হিসেবে আমার দাবি একশো ডলার।’ বলে আবার দাঁত বের করে হাসল আলফোঁ।

ডক্টর সেন আলফোঁর মুখের দিকে তাকালেন। লোকটার খাঁই খুব কম না, তবে সত্যি যদি পিজারো ওঁকে আসল ললটানে নিয়ে যেতে পারে তাহলে টাকা খরচ করতে উনি পিছপা নন। কিন্তু আলফোঁর কথা উনি যেন পুরোপুরি বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না। টুরিস্ট প্লেসে টুরিস্টদের নানা কায়দায় ঠকানো এখানকার লোকদের বৈশিষ্ট্য। সেইজন্য মনে-মনে ভাবছিলেন কী করা যায়। ওঁকে চুপ করে থাকতে দেখে আলফোঁ একটু দমে গেল।

ডক্টর সেন একটু হাসলেন : ‘টাকার অঙ্কটা যথেষ্ট বেশি হয়ে যাচ্ছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু তোমার কাকা যদি সত্যি-সত্যি আসল ললটানে নিয়ে যেতে পারেন, তা হলে নিশ্চয় আমি তোমার দাবি মেনে নেব।’

‘আপনার সন্দেহের কোনও কারণ নেই, স্যার। আমার কাকাই মিস্টার ডিওবরেনোভিস ও মিস্টার ভ্যালেন্টাইনকে আজ থেকে দশ বছর আগে আসল ললটানে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর কোনওরকমে বেঁচে ফিরে আসে। তার মূল্য কাকাকে দিতে হয়েছে অনেকরকমভাবে। যে-ঝুঁকি কাকা নেবে, দুশো ডলার তার তুলনায় কিছুই না। টাকার ওর খুবই দরকার আর সেইজন্যে টাকার লোভ দেখিয়ে আমি ওকে রাজি করিয়েছি। অবশ্য যাওয়া-না-যাওয়া আপনার ইচ্ছা।’

ডক্টর সেন বুঝলেন, পিজারোই হচ্ছে আসল লোক, যে ওঁকে সঠিক জায়গায় নিয়ে যেতে পারবে। বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি রাজি। তুমি কাকাকে নিয়ে এসো।’

আলফোঁ সোফা ছেড়ে উঠল : ‘ঠিক আছে, আগামীকাল রাত বারোটা নাগাদ আপনি নভোবীক্ষণাগারের সামনে অপেক্ষা করবেন, আমি কাকাকে নিয়ে যাব। গভীর রাতে গোপনে আপনাদের ললটানে যেতে হবে। কাকার রাজি হওয়ার এটা আর-একটা শর্ত।’

‘বারোটা, নভোবীক্ষণাগারের সামনে? ঠিক আছে।’

‘আমার মজুরিটা কাল রাতেই পাব আশা করি।’ বলে আবার দাঁত বের করে হাসল আলফোঁ।

‘নিশ্চয় পাবে, তাহলে পাকা কথা রইল।’

অনেক রাত হয়েছে। ঘরের দরজা বন্ধ করে সুটকেসটা খুলে কয়েকটা ছোটখাটো যন্ত্রপাতি বের করে পরীক্ষা করে দেখে আবার সুটকেসে পুরে রাখলেন ডক্টর সেন। এগুলো ললটানে ঢুকলে কাজে লাগবে। একটা শক্তিশালী ফোর্সফিল্ডকে নিউটলাইজ করার ক্ষমতা এই যন্ত্রের আছে। ফোর্সফিল্ড খুঁজে বের করা, তার বৈশিষ্ট্য ও শক্তি মাপার যন্ত্রও রয়েছে ওঁর সঙ্গে। এগুলো তিনি এখানে আসার পথে নিউইয়র্ক থেকে জোগাড় করেন। সুটকেস বন্ধ করে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন ডক্টর সেন। মনটা খুশি, কিন্তু শোওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ঘুম এল না। পুরোহিত মারুর হেঁয়ালি ভরা কথাগুলো পাক খেতে লাগল মাথার মধ্যে। পুরোহিত মারুর উদ্দেশ্য কী? কেন তিনি ওঁকে এভাবে ভয় দেখালেন?

সারদিন হোটেলেই কাটালেন ডক্টর সেন। সন্ধ্যা নাগাদ হোটেল থেকে বেরিয়ে দোকানদারটার সঙ্গে দেখা করার জন্য বড়রাস্তা ধরে এগিয়ে চললেন। দোকানদার ওঁকে দেখে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাল। ডক্টর সেন একগ্লাস শরবতের অর্ডার দিয়ে এককোণে বসলেন। দোকানদার শরবতের গ্লাস ডক্টর সেনের হাতে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আলফোঁ আপনার সঙ্গে দেখা করেছে?’

‘হ্যাঁ, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।’ বললেন ডক্টর সেন।

‘না, না, ধন্যবাদের কী আছে? তবে সাবধানে যাবেন। ললটান খুব ভয়ঙ্কর জায়গা বলে আমরা মনে করি।’

‘সাবধানেই যাব।’ বললেন ডক্টর সেন।

এমনসময় একটা লোক হাঁফাতে-হাঁফাতে দোকানে ঢুকতেই দোকানদার লোকটার দিকে এগিয়ে গেল : ‘কী ব্যাপার, মাজুলা?’

‘শাপরা, ভয়ানক ব্যাপার—পুরোহিত মারু মারা গেছেন। ওঁর মৃতদেহ প্রধান পুরোহিতের সমাধি-মন্দিরের চত্বরে পড়ে রয়েছে।’

‘সে কী?’ শাপরা, অর্থাৎ, দোকানদার চমকে উঠল।

‘কীভাবে মারা গেছেন উনি?’ প্রশ্ন করলেন ডক্টর সেন।

মাজুলা বলে লোকটি ডক্টর সেনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তা জানি না, তবে মনে হচ্ছে আগুনে পুড়ে। সারা মুখটা ঝলসে গেছে। পুলিশ মৃতদেহ এইমাত্র মেরিডায় পাঠিয়ে দিল ময়না-তদন্তের জন্যে। ওরা বলছে, মৃত্যুটা অস্বাভাবিক।’

‘আগুনে পুড়ে’—কথাটা দুবার অন্যমনস্কভাবে উচ্চারণ করলেন ডক্টর সেন। তারপর মাজুলাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘প্রধান পুরোহিতের সমাধি-মন্দিরে আগুন এল কোথা থেকে?’

‘ওখানে কোথাও আগুন খুঁজে পায়নি পুলিশ। পুলিশের ধারণা, অন্য কোথাও ওঁকে হত্যা করে মুখটা আগুনে ঝলসে প্রধান পুরোহিতের সমাধি-মন্দিরের চত্বরে ফেলে রেখে গেছে। ওদিকটায় লোক-চলাচল খুব কম কিনা।’

‘অসম্ভব!’ বলে উঠল শাপরা, ‘এ-তল্লাটে কেউ পুরোহিত মারুকে খুন করার কথা কখনও স্বপ্নেও ভাববে না। আসলে ওঁকে খুন করার ক্ষমতা কারও নেই। আমার মনে হচ্ছে, পুরোহিত মারু নিজেই কোনও দুর্ঘটনায় পড়ে মারা গেছেন।’

ডক্টর সেন শাপরার মুখের দিকে তাকালেন। তারপর ধীরে-ধীরে দোকান ছেড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন। এরকম বীভৎস দুর্ঘটনা কী করে ঘটল? ডক্টর সেন ভাবতে লাগলেন। পুরোহিত মারুর কথাগুলো পাক খেতে লাগল ওঁর মাথার মধ্যে। অশুভ শক্তি জেগে উঠবে। কিন্তু পুরোহিত মারুর মৃত্যুর রহস্য কী? সত্যিই কি কোনও অমঙ্গলের সূচনা এটা? পুরোহিত মারু বলেছিলেন, কাল পূর্ণ হলে ললটানে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে যাবেন ডক্টর সেন। এ-কথার অর্থ কী? ললটানে নিয়ে যাওয়ার জন্য লোক তো উনি সত্যি-সত্যি খুঁজে পেয়েছেন। তাহলে? মনে-মনে একটা ভয় যেন বাসা বাঁধছে।

রাত এগারোটা নাগাদ একটা ব্যাগে যন্ত্রপাতিগুলো পুরে নিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লেন ডক্টর সেন। সঙ্গে একটা শক্তিশালী টর্চ নিতে ভুললেন না।

রাস্তাঘাট সম্পূর্ণ নির্জন। খুশি হলেন ডক্টর সেন। বড়রাস্তা ধরে নভোবীক্ষণাগারের দিকে এগিয়ে চললেন। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর বড়রাস্তা ছেড়ে ডান দিকে নেমে পড়লেন। এদিকটা আবছা অন্ধকার। ম্লান চাঁদের আলো ছড়িয়ে রয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে চাঁদও ডুবে যাবে। দিনেরবেলায় দেখা আর রাতের অন্ধকারে দেখা এক জিনিস নয়। আবছা আলোয় ভগ্নস্তূপের মধ্যে যেন একটা অশরীরী পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। নভোবীক্ষণাগারটিকে একটা ভয়ঙ্কর পিশাচ বলে মনে হচ্ছে। এখানেই অপেক্ষা করতে বলেছে আলফোঁ। ঘড়ি দেখলেন। রেডিয়াম দেওয়া ঘড়ি। বারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি আছে। ডক্টর সেন এদিক-ওদিক তাকালেন। না, কাউকে দেখা যাচ্ছে না। উনি একটু চিন্তায় পড়লেন। হঠাৎ ওঁর সামনে দুটো ছায়ামূর্তি দেখা গেল। ওরা যেন মাটি ফুঁড়ে ওঁর সামনে হাজির হল। ডক্টর সেন চমকে উঠলেন।

‘আপনি এসে গেছেন?’ আলফোঁর কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে নিজেকে সামলে নিলেন উনি। কোনওরকমে জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ।’

ডক্টর সেন হাত বাড়িয়ে দিয়ে পিজারোর মুখের দিকে তাকিয়ে রীতিমতো চমকে উঠলেন। পিজারোর বাঁ-গালটা পুড়ে চামড়া কুঁচকে গেছে। জায়গায়-জায়গায় ছোট-ছোট মাংসের দলা ঝুলছে। বাঁ-চোখটা গর্ত থেকে যেন ঠেলে বেরিয়ে এসে ঝুলছে। এরকম বীভৎস মুখ জীবনে ডক্টর সেন দেখেননি। পিজারো ততক্ষণে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। কোনওরকমে হ্যান্ডশেক করলেন ডক্টর সেন।

আলফোঁ দাঁত বের করে হেসে বলল, ‘তাহলে আপনারা রওনা হয়ে পড়ুন, আর আমার মজুরিটা?’ বলে হাত পাতল ও। ডক্টর সেন কাঁধের ব্যাগ থেকে একশো ডলার বের করে ওর হাতে দিলেন।

ডক্টর সেন নিঃশব্দে পিজারোকে অনুসরণ করতে লাগলেন। ক’টা রাতজাগা পাখি ডানা ঝটপটিয়ে উঠল। বীভৎসভাবে ডেকে উঠল একটা নাম-না-জানা পাখি। ডক্টর সেন মনে-মনে ভয় পেয়ে গেলেন। কোথায় চলেছেন উনি এই গভীর রাতে? ভৌতিক পরিবেশে বীভৎস সঙ্গীর পিছনে-পিছনে? সত্যিই কি ওঁর উদ্দেশ্য সফল হবে? নাকি শুধুই পণ্ডশ্রম? ডান দিকে প্রধান পুরোহিতের সমাধি-মন্দির, বাঁ-দিকে নৈসর্গিক কুয়ো। পিজারো খুব সন্তর্পণে এগিয়ে চলেছে প্রধান পুরোহিতের সমাধি-মন্দিরের দিকে। এখানেই পুরোহিত মারুর মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গেছে। গভীর রাতে ওঁরাও এগিয়ে চলেছেন সেই একই জায়গায়। ডক্টর সেনের মনে হল, উনি একটা মারাত্মক ভুল করছেন। এভাবে একজন অপরিচিত লোকের সঙ্গে এত রাতে বেরোনো কখনওই উচিত হয়নি। তাহলে কি ফিরে যাবেন? এখনও হয়তো সময় আছে।

একটা ভ্যাপসা গন্ধ যেন বাতাসকে ভারী করে রেখেছে। পিজারো মাঝে-মাঝে টর্চ জ্বালছে। ডক্টর সেন ওকে অনুসরণ করে চলেছেন। একটা কবরের কাছে গিয়ে দাঁড়াল পিজারো। চারদিকে তাকিয়ে দেখল, তারপর টর্চের আলো ফেলল কবরটার ওপর। আলো ফেলেই প্রায় চিৎকার করে উঠল, ‘পাথরটা সরাল কে?’

ডক্টর সেন পিজারোর পিছন থেকে উঁকি মেরে দেখলেন, সামনের কবরটার ওপর যে-ছোট পাথর চাপা দেওয়া ছিল সেটা একপাশে সরানো রয়েছে। একটা গর্তের মুখ দেখা যাচ্ছে। পিজারো গর্তের ভিতর আলো ফেলে কী যেন দেখার চেষ্টা করল, তারপর বিড়বিড় করে বলে উঠল, ‘পুরোহিত মারু তা হলে ললটানে ঢুকেছিলেন, ওঁর মৃত্যুর কারণটা এবার বুঝতে পারছি।’

ডক্টর সেন বলে উঠলেন, ‘এ-কথা আপনার মনে হল কেন?’

পিজারো টর্চের আলোটা নিজের মুখে ফেলে উত্তেজিতভাবে বলে উঠল, ‘আমার মুখের দিকে একটু ভালো করে তাকিয়ে দেখুন তাহলেই বুঝতে পারবেন। সেবার মরতে-মরতে কোনওরকমে বেঁচে গেছি। কিন্তু পুরোহিত মারু ললটান থেকে কোনওরকমে বেরিয়ে আসতে পারলেও মৃত্যুকে এড়াতে পারেননি। হাঃ-হাঃ। পুরোহিত মারুর অভিশাপ আর কাজে লাগবে না। ললটানে ঢোকার আর কোনও বাধাই রইল না আমার।’ কথা শেষ করে পিজারো গর্তে নেমে পড়ল। ডক্টর সেনও নেমে পড়লেন। কিন্তু কোথায় কবর? এ তো একটা সুড়ঙ্গের মুখ! ললটান। নিঃশব্দে এগোতে লাগলেন দুজনে। কখনও ঢালু, কখনও চড়াই, কখনও ডাইনে বাঁক, কখনও বাঁয়ে বাঁক। পিজারো টর্চ জ্বেলেই রেখেছে।

ওঁরা কতক্ষণ চলেছেন তার হিসেব ছিল না। একসময় পিজারো বলল, ‘সামনের বাঁকটা ঘুরলেই ললটানের আসল জায়গা বা কেন্দ্র। এখানে সুড়ঙ্গটা বিরাট বড়। মাথার ওপরকার ছাদ অনেকখানি উঠে গেছে। দু-দিকে যথেষ্ট চওড়া। আরও চারটে ছোট সুড়ঙ্গ এসে মিশেছে এখানে।’

বাঁকটা ঘুরতেই পিজারোর কথা যাচাই করে নিতে পারলেন ডক্টর সেন। উত্তেজনায় তিনি ছটফট করতে লাগলেন। তাড়াতাড়ি পিজারোর হাত থেকে টর্চটা কেড়ে নিয়ে চারপাশে আলো ফেলতে লাগলেন।

‘আর এক পা এগোবেন না, ডক্টর। এক পা-ও না, তাহলে আর ফিরে যেতে হবে না।’ চেঁচিয়ে উঠল পিজারো।

ডক্টর সেন ব্যাগ থেকে যন্ত্রপাতি বের করে ফেললেন। না, কোনও মিটার রিডিং আসছে না। তাহলে কি ফোর্সফিল্ড নেই এখানে? ফোর্সফিল্ড না থাকলে পুরোহিত মারুর মৃত্যু ঘটল কী করে? তবে কি ওঁর যন্ত্র খারাপ হয়ে গেল?

ডক্টর সেন একটুকরো পাথর কুড়িয়ে নিলেন পায়ের কাছ থেকে, তারপর ছুড়ে মারলেন সামনের দিকে। পাথরটা ধপ করে ললটানের কেন্দ্রে গিয়ে পড়ল।

‘এখানেই কি নিয়ে এসেছিলেন মিস্টার ভ্যালেন্টাইনদের?’ পিজারোকে প্রশ্ন করলেন ডক্টর সেন।

‘হ্যাঁ, এই সেই জায়গা। আমি আর মিস্টার ডিওবরেনোভিস একটু এগিয়ে গিয়েছিলাম। সঙ্গে-সঙ্গে দুজনেই ছিটকে পড়েছিলাম। মনে হয়েছিল, কেউ যেন আগুনের গোলা দিয়ে আমাদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। পরমুহূর্তে আমরা জ্ঞান হারিয়েছিলাম। কী করে এখান থেকে বেরিয়েছিলাম জানি না। খুব সম্ভব মিস্টার ভ্যালেন্টাইন আমাদের বাইরে নিয়ে এসেছিলেন। মেডিকেল সেন্টারে দু-দিন পরে আমার জ্ঞান ফিরে আসে।’

‘কিন্তু এখন এখানে আর কোনও বিপদ নেই এ-কথা জোর দিয়ে বলতে পারি।’ বললেন ডক্টর সেন।

‘কী বলছেন আপনি? নিশ্চয় এখানে বিপদ আছে। এইসব ললটানের মধ্যে পুরোহিতরা মন্ত্রের জোরে পিশাচদের বন্দি করে রাখে। ওদের ঘাঁটাঘাঁটি করা কখনও উচিত নয়। চলুন, ডক্টর, এবার ফিরে চলুন। ললটান দেখতে চেয়েছিলেন, আমি দেখিয়ে দিয়েছি।’ পিজারোর কথা শেষ হওয়ার আগেই ডক্টর সেন চারিদিকে টর্চের আলো ফেললেন। মুহূর্তে উনি যেন পাথর হয়ে গেলেন। একদিকের কোণে একটা মড়ার খুলি পড়ে রয়েছে। টর্চের আলো পড়ে খুলিটা যেন আগুনের মতো জ্বলজ্বল করছে। ডক্টর সেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। টর্চের আলোটা একটুও নড়ছে না। এতক্ষণে পিজারোর নজর পড়ল সেই জ্বলন্ত খুলিটার ওপর। ও আবার চিৎকার করে উঠল, ‘আপনাকে অনুরোধ করছি, ডক্টর, আপনি ওটার দিকে আর এক পা এগোবেন না। ফিরে আসুন। আমি এখান থেকেই ফিরে যেতে চাই।’

পিজারোর কথাগুলো সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রতিধ্বনি তুলল। পিজারোর কথা যেন ডক্টর সেনের কানেই ঢুকল না। তিনি সম্মোহিতের মতো এগিয়ে যেতে লাগলেন খুলিটার দিকে। নিচু হয়ে খুলিটায় হাত দিলেন, কিছুই ঘটল না। হাতে তুলে নিয়ে ভালো করে দেখতে লাগলেন খুলিটা। অবাক হলেন। খুলিটা হাড়ের নয়, কোনও মৃত মানুষের নয়। কৃত্রিম খুলি। স্ফটিকের তৈরি। তবে হুবহু মানুষের মাথার খুলি। খুলির ওপরে দুর্বোধ্য ভাষায় কী সব লেখা। পিজারো বোধহয় এতটা সহ্য করতে পারছিল না। ললটানে টাকার লোভে ঢুকলেও কুসংস্কার এড়ানো ওর পক্ষে সম্ভব নয়। তার ওপর রয়েছে পূর্ব অভিজ্ঞতার তিক্ততা। পিজারো আবার চিৎকার করে উঠল, ‘ডক্টর, আপনাকে আবার বলছি, ওই মন্ত্রপূত মড়ার খুলি আপনি ফেলে দিন।’

‘ফেলে দেওয়া সম্ভব নয়, মিস্টার পিজারো। মনে হচ্ছে, যে-জিনিসের খোঁজে আমি এতদূর ছুটে এসেছি তা আমি পেয়েছি। এটা আমি সঙ্গে নিয়ে যাব।’ বলে খুলিটাকে ব্যাগে ঢোকানোর জন্য তৈরি হলেন ডক্টর সেন। কিন্তু পিজারোর চোখে চোখ পড়তে উনি থমকে দাঁড়ালেন। অন্ধকারে পিজারোর চোখ দুটো হিংস্র শ্বাপদের মতো ধকধক করে জ্বলছে যেন। ডক্টর সেন ভালো করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই পিজারো ডক্টর সেনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ডক্টর সেন একটু হকচকিয়ে গেলেন। ওঁর হাত থেকে খুলিটা ছিটকে পড়ল একটি কোণে, যেখানে একটু আগে খুলিটা ছিল। ডক্টর সেন এগিয়ে গেলেন পিজারোকে টেনে তোলার জন্য। টর্চের আলো পিজারোর মাথার দিকে পড়তেই চমকে উঠলেন ডক্টর সেন। ভয়ে আতঙ্কে ওঁর সারা শরীর কেঁপে উঠল থরথর করে।

খুলিটা যেখানে ছিল তার পাশে পড়ে ছিল একটা বড় পাথরের টুকরো। পিজারোর মাথাটা সেই পাথরে লেগে একেবারে দু-ফাঁক হয়ে গেছে। রক্ত আর ঘিলুতে মাখামাখি পাথরটা। মনে হচ্ছে, কেউ যেন পিজারোর মাথাটা ধরে প্রচণ্ড শক্তিতে ঠুকে দিয়েছে পাথরে। পিজারোর হাতটা তুলে ধরলেন। পিজারো বেঁচে নেই। কী ভয়ঙ্কর মৃত্যু! অথচ ঘটে গেল কত দ্রুত! ডক্টর সেন পিজারোর হাতটা মাটিতে নামিয়ে দিলেন। খুলিটা কুড়িয়ে ব্যাগে পুরলেন।

কীভাবে যে তিনি পিজারোর মৃতদেহটা কাঁধে করে সুড়ঙ্গের মুখে ফিরে এসেছিলেন তা ওঁর মনে নেই। সুড়ঙ্গের মুখে সেই নকল কবরটার মধ্যে এসে উনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন।

যখন জ্ঞান ফিরল তখন উনি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বেডে শুয়ে। পুলিশ এল। পুলিশকে সব সত্যি কথা বললে খুলিটা পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতে পারবেন না। তাই একটা মনগড়া কাহিনি বললেন। পুলিশ ললটানের ভিতর পরীক্ষা করে দেখল। ডক্টর সেন ছাড়া পেয়ে গেলেন। খুবই অবাক হলেন তিনি। এরকম একটা অস্বাভাবিক মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত হওয়ার পরও তিনি বেকসুর খালাস পেলেন কী করে তা কিছুতেই ওঁর মাথায় ঢুকল না।

ললটানে ঢোকার দশদিন বাদে পুলিশ আর কাস্টমসের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্লেনে উঠে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন ডক্টর সেন। কিছুক্ষণের মধ্যে প্লেন ছাড়ল। একটু ধাতস্থ হয়ে সামনে-পিছনের যাত্রীদের দিকে চোখ বুলোতে গিয়ে একটু চমকে উঠলেন উনি। দু-সার পিছনে কোণের দিকে বসে একটা লোক ওঁর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। কে লোকটা?

লোকটা নিউইয়র্কের আগে নামল না। ডক্টর সেন খুব চিন্তায় পড়লেন। প্লেন থেকে নেমে এয়ারপোর্ট হোটেলে উঠলেন। রাত প্রায় আটটা। কাল সকালে কলকাতার প্লেন ছাড়বে। রাতটুকুর জন্য আর শহরে ঢুকতে ওঁর সাহস হল না। বিরাট চোদ্দোতলা হোটেল। ঘরে ঢুকে দরজা ভালো করে বন্ধ করে সুটকেস খুলে খুলিটা বের করে টেবিলে রাখলেন। এতক্ষণে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখতে পারবেন ওটা। পুলিশ আর অন্তত ওটা ওঁর হাত থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। এখন তিনি মেক্সিকো পুলিশের আওতার বাইরে। আজকের রাতটা কোনওরকমে কাটাতে পারলে তিনি কলকাতার পথে রওনা দেবেন। সুটকেস থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা বের করে আর-একবার অক্ষরগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু এবারও অন্যান্যবারের মতো হতাশ হলেন। দুর্বোধ্য অক্ষর, অজানা ভাষা। এ-ভাষার পাঠোদ্ধার ওঁর পক্ষে সহজ হবে বলে মনে হল না। তন্ময় হয়ে গিয়েছিলেন ডক্টর সেন, এমনসময় দরজায় কে যেন নক করল। তাড়াতাড়ি খুলিটা সুটকেসে পুরে ঢাকাটা ফেলে দিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। হয়তো হোটেলের কোনও বেয়ারা-টেয়ারা হবে। দরজা খুলতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন তিনি। আলফোঁ। মুখে নকল দাড়ি-গোঁফ লাগিয়ে ছদ্মবেশ নিয়েছে। সেইজন্য ওকে দেখে খুব চেনা-চেনা মনে হয়েছিল। কিন্তু ও এখানে কেন?

‘ছদ্মবেশ ধরে আমার পিছু নিয়েছ কেন? আমি তোমার ও পিজারোর পাওনা মিটিয়ে দিয়ে এসেছি।’

আলফোঁ দাঁত বের করে কুৎসিতভাবে হেসে উঠে পকেট থেকে একটা ছোট্ট রিভলভার বের করে দু-হাতে লোফালুফি করল। তারপর স্থির দৃষ্টিতে ডক্টর সেনের দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে-চিবিয়ে বলল, ‘ডক্টর, সব পাওনা মেটাননি, তাই আপনার পেছনে-পেছনে নিউইয়র্ক পর্যন্ত ছুটে আসতে হল। আপনার সঙ্গে আমার একটু বোঝাপড়া বাকি আছে।’

‘কী বলতে চাও তুমি?’ ডক্টর সেন এবার সত্যি-সত্যি ভয় পেলেন।

‘ডক্টর, মেরিডা পুলিশ ও কাস্টমসকে ফাঁকি দিলেও আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেননি। ওই হীরের খুলি আমার চাই। কোথায় রেখেছেন খুলিটা? বের করুন।’ আলফোঁ তাড়া লাগাল।

‘তুমি ভুল করছ, আলফোঁ,’ নিজেকে একটু সামলে নিয়ে ডক্টর সেন কথা শুরু করলেন, ‘তুমি যেটাকে হীরের খুলি বলে মনে করছ আসলে ওটা হীরের তৈরি নয়। ওটা স্ফটিকের।’

আলফোঁ লাফ দিয়ে সোফা থেকে উঠে টেবিলের কাছে গেল। সুটকেসের ঢাকনা খুলে টপ করে খুলিটা হাতে তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে লাগল। দু-চোখে ওর লালসা। অনেকক্ষণ খুলিটা দেখে ওটা টেবিলে নামিয়ে রাখল।

‘বিশ্বাস করো, আলফোঁ, ওটা বিক্রি করতে পারলেও খুব বেশি টাকা তুমি পাবে না। কিন্তু ওটা আমার গবেষণার কাজে লাগবে। সেইজন্যেই ওটাকে আমি চুরি করে নিয়ে এসেছি। ওটা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ো না। চাও তো আমি তোমাকে আরও কিছু টাকা দিচ্ছি।’

আলফোঁ আবার কুৎসিতভাবে হেসে উঠে বলল, ‘চুরি করা জিনিস নিয়ে গবেষণা করে তার ফলাফল প্রকাশ করতে আপনাকেও অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে, ডক্টর। তার থেকে এই ভালো হল না কি? যাক, ও নিয়ে আর মন খারাপ না করে বরং আসুন, এখন একটু রিল্যাক্স করা যাক।’ বলে টেলিফোন তুলে ড্রিঙ্কের অর্ডার দিল আলফোঁ।

কিছুক্ষণের মধ্যে বেয়ারা পানীয় দিয়ে যেতেই আলফোঁ দুটো গ্লাসে হুইস্কি ঢালল। একটা গ্লাস ডক্টর সেনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে নিজের গ্লাসটা তুলে প্রায় ঢকঢক করে সবটা গলায় ঢেলে দিল। খুলিটার দিকে বেশ কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। তারপর আবার গ্লাসে বেশ অনেকখানি হুইস্কি ঢেলে নিল। সেটুকু গলায় ঢালতে খুব বেশি সময় নিল না ও। তারপর আলফোঁ সোফা ছেড়ে উঠল। ডান হাতে রিভলভারটা তুলে নিতে ভুলল না। খুলিটা নেওয়ার জন্য ও টেবিলের দিকে এগিয়ে চলল। আলফোঁর পা টলছে।

‘মন খারাপ করবেন না, ডক্টর। চলি তাহলে।’ বলে নিচু হয়ে খুলিটায় হাত দিল আলফোঁ। ওর কথা জড়ানো। যথেষ্ট নেশা হয়েছে। ডক্টর সেন আর থাকতে পারলেন না। কোনও কিছু না ভেবেই পিছন থেকে প্রচণ্ড জোরে আলফোঁকে ধাক্কা দিলেন। আলফোঁ টাল সামলাতে না পেরে পা হড়কে গিয়ে ধাক্কা খেল পাশের কাচের জানলায়। ঝনঝন করে কাচগুলো ভেঙে পড়ল আর জানলা গলে আলফোঁর দেহটা ছিটকে বেরিয়ে গেল। ডক্টর সেন নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারলেন না। খুলিটা টেবিলের ওপর পড়ে রয়েছে। কিন্তু আলফোঁ নেই। আলফোঁর মস্ত দেহটা তখন দশতলার ওপর থেকে প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলেছে নীচের সিমেন্টের চাতালের বুক লক্ষ করে। একটা আর্ত চিৎকার ভেসে এল, তারপর সব শেষ।

নিরাপদে কলকাতায় ফিরলেন ডক্টর সেন। আজ থেকে প্রায় বছর আষ্টেক আগে। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের পঞ্চপর্ণী হাউসিং স্কিমের দশতলা বাড়ির আটতলায় ছোট একটা ফ্ল্যাট কিনেছেন তিনি। একটি চাকর আছে, নাম মদন। রান্নাবান্না থেকে সংসারের যাবতীয় কাজ মদনই করে। ডক্টর সেন কয়েকদিন একনাগাড়ে পড়ে রইলেন খুলিটা নিয়ে। নানাভাবে পরীক্ষা করতে লাগলেন। গাদা-গাদা রেফারেন্স বই ঘাঁটতে লাগলেন। লাইব্রেরি থেকে প্রয়োজনীয় বই নিয়ে এসে অনেক রাত জেগে পড়াশুনো করতে লাগলেন। খাতায় নোট করতে লাগলেন পাতার পর পাতা। কিন্তু আসল কাজের কাজ কিছুই হল না। যে-তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই রইলেন। মায়া ভাষার অক্ষরের সঙ্গে কিছু-কিছু মিল থাকলেও মানে বোঝা অসম্ভব হয়ে উঠল ডক্টর সেনের কাছে। তবে একটা জিনিস বুঝতে পারলেন তিনি, ভাষাটা হয়তো মায়াদের আদি ভাষা।

কিন্তু কীভাবে তিনি এগোবেন? যতরকমভাবে সম্ভব তা সবই করে দেখেছেন, কিন্তু মূক ভাষাকে মুখর করে তুলতে পারেননি। প্রায় হতাশ হয়ে পড়ছেন তিনি। তীরে এসে তরী ডুবল। এত কষ্ট আর ঝামেলা করে যে-অমূল্য সম্পদ উদ্ধার করে নিয়ে এলেন, তা কি কোনও কাজেই লাগবে না?

সেদিন গভীর রাতে খুলিটা হাতে করে এইসব কথা ভাবছিলেন ডক্টর সেন। এমনসময় ওঁর মনে হল, খুলিটার চোখের গর্ত দুটোর মধ্যে একটা হালকা সবুজ আলো ধোঁয়ার মতো ভাসছে।

চমকে উঠলেন ডক্টর সেন। মনে হল চোখের ভুল। দুর্বল শরীরে হ্যালুসিনেশান দেখছেন। চোখদুটো রগড়ে আবার ভালো করে তাকালেন খুলিটার দিকে—না, কিছুই নেই। মনে-মনে আশ্বস্ত হলেন ডক্টর সেন। তখুনি হঠাৎ ওঁর বন্ধু জয়ন্ত রায়ের কথা মনে পড়ল। জয়ন্ত ওঁর কলেজের বন্ধু। ও এখন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপিউটার প্রোগ্রামার। হ্যাঁ, জয়ন্ত হয়তো ওঁকে সাহায্য করতে পারে। বহু প্রাচীন অজানা ভাষার পাঠোদ্ধার করেছে জয়ন্ত কমপিউটারের সাহায্যে। জয়ন্ত থাকে সাউথ দিল্লির গ্রিন পার্কে। জয়ন্ত ওর এক কোলিগকে বিয়ে করেছে। মৃদুলা সুন্দরী ও আধুনিকা।

পরদিন সন্ধ্যার ফ্লাইটে দিল্লি রওনা হলেন ডক্টর সেন। দুপুরের দিকে জয়ন্তকে টেলিফোনে জানিয়ে দিয়েছিলেন। গ্রিন পার্কে জয়ন্তর ফ্ল্যাটে প্রায় ন’টা নাগাদ পৌঁছে গেলেন।

ফ্ল্যাটে ঢুকতে-না-ঢুকতে উচ্ছ্বসিত হয়ে মৃদুলা এগিয়ে এল : ‘আপনি নাকি মায়া সভ্যতার দেশ থেকে রহস্যময় কী একটা জিনিস নিয়ে এসেছেন? আমি কিন্তু ওটা আগে দেখব।’ ছোট্ট মেয়ের মতো আবদার ধরল মৃদুলা।

জয়ন্ত একটু কৃত্রিম ধমকের সুরে মৃদুলাকে বললেন, ‘আঃ মৃদুলা, প্রশান্তকে আগে একটু বিশ্রাম করতে দাও।’

মৃদুলা স্বামীর দিকে তাকিয়ে ভ্রকুটি করে বলল, ‘জিনিসটা না দেখে আমি কিছুতেই প্রশান্তবাবুকে বিশ্রাম করতে দেব না।’

‘আরে তোমাকে দেখাব বলেই তো ওটা নিয়ে ছুটে এলাম।’ কথাটা বলেই একটু ঘাবড়ে গেলেন ডক্টর সেন। আসলে উনি বলতে চেয়েছিলেন ‘তোমাদের দেখাব বলেই’, অথচ বলার সময় মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল অন্য কথা। সত্যি, ওঁর যথেষ্ট বিশ্রামের দরকার। ব্রেন খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

জয়ন্ত একবার ডক্টর সেনের মুখের দিকে তাকালেন, কিন্তু কিছু বললেন না।

মৃদুলা হেসে বলল, ‘আপনি ততক্ষণ বন্ধুর সঙ্গে কথা বলুন, আমি রান্নাঘর থেকে একটু ঘুরে আসি।’ বলেই ও চলে গেল।

জয়ন্ত বললেন, ‘তোর ব্যাপারটা এবার খুলে বল তো।’

ডক্টর সেন বললেন, ‘খুব সংক্ষেপে বলছি। মৃদুলাকে এসব কথা যেন বলিস না। হাজার হলেও বাঙালি মেয়ে—কুসংস্কার তো এড়াতে পারবে না। হয়তো ভয় পেয়ে যাবে।’ বলে পুরো ব্যাপারটা জয়ন্তকে বললেন ডক্টর সেন।

‘নে, জিনিসটা বের কর দেখি একবার,’ বললেন জয়ন্ত। ডক্টর সেন সুটকেস থেকে খুলিটা বের করে টেবিলে রাখলেন। আর ঠিক তখুনি মৃদুলা একটা ট্রেতে করে তিনকাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকল। টেবিলের ওপর খুলিটা দেখে একটু থমকে দাঁড়াল। তারপর খুলিটার ওপর থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে টেবিলের কাছে এগিয়ে এসে ট্রে-টা টেবিলে রাখল।

‘কীসব লেখা রয়েছে মনে হচ্ছে খুলিটার ওপরে!’ বলল মৃদুলা।

‘হ্যাঁ, সেইজন্যেই জয়ন্তর কাছে এসেছি—কমপিউটারের সাহায্যে যদি ও এগুলোর পাঠোদ্ধার করতে পারে,’ বললেন ডক্টর সেন।

মৃদুলার দু-চোখে এক অস্বাভাবিক মুগ্ধতা। ও খুলিটা তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে লাগল। তারপর হঠাৎ ও ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল।

ডক্টর সেন তাড়াতাড়ি খুলিটা ধরে ফেললেন। মৃদুলার মুখের দিকে তাকিয়ে ওঁরা দুজনেই চমকে উঠলেন। মৃদুলার দু-চোখ নেশাচ্ছন্ন মানুষের মতো ঢুলুঢুলু। মৃদুলার মাথাটাও যেন অল্প-অল্প দুলছে সাপের মতো।

জয়ন্ত চিৎকার করে উঠলেন, ‘মৃদুলা—মৃদুলা!’

জয়ন্তর চিৎকারে মৃদুলা ভালোভাবে চোখ মেলে তাকাল। ওর নেশাচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গেল। জয়ন্তর মুখের দিকে তাকাল, তারপর ডক্টর সেনের মুখের দিকে তাকাতেই হঠাৎ যেন লজ্জা পেল মৃদুলা। দু-চোখ নামাল ও। ডক্টর সেন রীতিমতো ঘাবড়ে গেলেন। মৃদুলা এরকম অস্বাভাবিক ব্যবহার করছে কেন?

জয়ন্ত একবার মৃদুলার মুখের দিকে, একবার ডক্টর সেনের মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন। কিন্তু কিছু বুঝতে না পেরে বেশ অস্বস্তিতে পড়লেন।

ডক্টর সেন মৃদুলাকে জিগ্যেস করলেন, ‘হঠাৎ কী হল তোমার? ভয় পেয়ে গিয়েছিলে?’

‘না, না, ভয় না,’ স্বাভাবিকভাবে জবাব দিল মৃদুলা।

‘তাহলে হঠাৎ খুলিটা ফেলে দিয়ে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লে কেন?’ এবার প্রশ্ন করলেন জয়ন্ত।

‘খুলিটার চোখের গর্তে চোখ পড়তেই হঠাৎ মাথাটা ঘুরে উঠল। মনে হল, আমি শূন্যে ভেসে চলেছি। স্বপ্নে যেমন মানুষ ডানায় ভর করে অনেকসময় উড়ে বেড়ায়, আমার ঠিক সেইরকম অনুভূতি হচ্ছিল। হঠাৎ চারিদিক গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেল। তারপর মনে হল, কালো ভেলভেটের মতো অন্ধকারের বুকে হীরের চুমকি বসানো। হীরেগুলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। তারপরই সেই ভেলভেটের পরদাটা কেউ যেন একটানে সরিয়ে নিল। ফুটে উঠল স্নিগ্ধ হালকা সবুজ আলো। কীসের আলো তা বলতে পারব না। একটা সুন্দর জায়গায় এসে নামলাম। চারদিকে ফুলের গাছ, বিচিত্র ফুল ফুটে রয়েছে গাছে, তাদের রঙের কী বাহার! গাছে-গাছে নাম-না-জানা অসংখ্য পাখি। যেমন তাদের পাখার রঙের বাহার তেমনি তাদের গলার মিষ্টি আওয়াজ। মনে হচ্ছিল, যেন কোন অদৃশ্য শিল্পী এদের ঐকতান নিয়ন্ত্রিত করছে। একটা বিরাট হ্রদ। নীল জল। ছোট-ছোট ঢেউ। এখানে এলে কারও আর ফিরে যেতে মন চাইবে না।’ মৃদুলা একটু থামল।

জয়ন্ত বললেন, ‘থামলে কেন, তারপর?’

‘তারপর,—’ বলে আবার একটু থামল মৃদুলা।

ডক্টর সেন বুঝতে পারলেন, তারপর মৃদুলা এমন কিছু দেখেছে যা বলতে একটু লজ্জা পাচ্ছে।

‘বলো—বলো,’ তাড়া লাগালেন জয়ন্ত।

ডক্টর সেনের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদুলা বলে উঠল, ‘একটা অদ্ভুত সুন্দর ছেলেকে দেখতে পেলাম। ছেলেটি যেন আকাশ থেকে ভেসে এসে নামল বাগানটায়। সঙ্গে-সঙ্গে বাগানটা রুক্ষ বালিময় মরুভূমিতে পরিণত হল। এমনসময় তোমার ডাক কানে যেতেই স্বপ্নটা ভেঙে গেল।’

দুজনে হাঁ করে মৃদুলার কথা শুনছিলেন। কথা শেষ হতে জয়ন্ত বলে উঠলেন, ‘এ স্বপ্ন নয়, জেগে-জেগে কেউ কি স্বপ্ন দ্যাখে? ওটা তোমার মনের একটা কারসাজি। হ্যালুসিনেশান বলতে পারো।’

‘জয়ন্ত, যে করেই হোক, এ-ভাষার পাঠোদ্ধার তোকে করে দিতেই হবে।’ ডক্টর সেন প্রায় চিৎকার করে উঠলেন।

জয়ন্ত একটু অবাক হয়ে ডক্টর সেনের মুখের দিকে তাকালেন : ‘এত উত্তেজিত হচ্ছিস কেন? বলেছি তো আমি চেষ্টা করব।’ বলে জয়ন্ত খুলিটা তুলে নিয়ে বেশ ভালো করে দেখতে লাগলেন। যে-ই এটা তৈরি করে থাক, আশ্চর্য তার দক্ষতা। এমন নিখুঁত খুলি, দেখে সত্যি বলে মনে হয়। লেখাগুলো ছোট-ছোট কিন্তু আশ্চর্যরকম পরিষ্কার। চোখের গর্তে কৌতূহলী হয়ে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইলেন জয়ন্ত—কিন্তু না, কিছুই ঘটল না ওঁর।

রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে আর কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে শুতে গেলেন সবাই। মৃদুলা ডক্টর সেনের সঙ্গে ওঁর ঘর পর্যন্ত গেল : ‘টেবিলে খাওয়ার জল ঢাকা দিয়ে রেখেছি।’

ডক্টর সেনের মনে হল মৃদুলা শুধু সময় নষ্টের খেলা খেলছে। আরও বেশ কয়েকবার তিনি এখানে থেকে গেছেন। কিন্তু কই, আগে কখনও তো মৃদুলা এরকম ব্যবহার করেনি? কী উদ্দেশ্য মৃদুলার? মৃদুলার মুখের দিকে দৃষ্টি পড়তেই চমকে উঠলেন তিনি। ব্যাচেলার হলেও নারীর এ-মুখভঙ্গির কথা কোনও পুরুষকে কখনও ব্যাখ্যা করে দিতে হয় না। এ আমন্ত্রণের একটাই অর্থ।

মৃদুলা আরও সরে এল ডক্টর সেনের কাছে। ওর গরম নিশ্বাস ডক্টর সেনের গায়ে লাগছে। সুরুচির বাধা আর কতক্ষণ থাকবে? ডক্টর সেন সাংঘাতিক ভয় পেলেন। জীবনে এরকম ভয় আর কখনও পেয়েছেন বলে মনে পড়ল না ওঁর। দু-হাতে মৃদুলার দু-কাঁধ প্রায় খামচে ধরলেন।

মৃদুলা এতটুকু শব্দ না করে ডক্টর সেনের বুকে মুখ ঘষল।

ডক্টর সেন মৃদুলাকে ঠেলে সরিয়ে দিলেন।

মৃদুলা মুখ তুলে তাকাল ডক্টর সেনের মুখের দিকে।

ডক্টর সেন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চাপা স্বরে বলে উঠলেন, ‘এখন যাও, মৃদুলা। জয়ন্ত কিছু ভাবতে পারে।’

এ-কথার কী অর্থ বুঝল মৃদুলা কে জানে। কাঁধ থেকে ডক্টর সেনের হাত সরিয়ে দিয়ে একটু হেসে দ্রুত চলে গেল ও। ডক্টর সেন তখন হাঁফাচ্ছেন।

বিছানা ছেড়ে উঠলেন তিনি। ঘরের মধ্যে অনেকক্ষণ পায়চারি করলেন। তারপর ঘরের আলোটা জ্বেলে খুলিটা নিয়ে বসলেন। অনেক রাত পর্যন্ত অকারণে ওটা নিয়ে নাড়াচাড়া করলেন। তারপর ওটাকে টেবিলের ওপর রেখেই আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন।

হঠাৎ একসময় ওঁর ঘুম ভেঙে গেল। রাত তখন কত হবে কে জানে! বাইরের রাস্তার আবছা আলো ঘরে ঢুকেছে জানলা দিয়ে। কিন্তু অন্য কিছু ভালোভাবে বুঝে ওঠার আগেই ভীষণভাবে চমকে উঠলেন তিনি। পাশে শুয়ে মৃদুলা।

বিছানা ছেড়ে ওঠার চেষ্টা করতেই মৃদুলা ওঁর হাত চেপে ধরল। মৃদুলার বুক উত্তেজনায় ওঠানামা করছে, নিশ্বাস পড়ছে দ্রুত।

ডক্টর সেন মৃদুলার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলেন। ঠিক তখুনি ওঁর দৃষ্টি পড়ল টেবিলে রাখা খুলিটার ওপর। আবছা আলোয় ওটা স্পষ্ট। খুলির মুখটা ওঁর দিকেই ঘোরানো। চোখের গর্ত দুটোর মধ্যে আবার সেই সবুজ আলোর আভাস। ঘুরছে সে-আলো।

সম্মোহিতের মতো বিছানায় শুয়ে পড়লেন ডক্টর সেন। মৃদুলার শরীর ছাড়া আর সবকিছু মুছে গেল ওঁর মন থেকে।

পরদিন জয়ন্ত ডক্টর সেনকে সঙ্গে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেন। খুলির লেখাগুলোর ছবি তুলে নেওয়া হল প্রথমে। তারপর সারাদিন ধরে বিভিন্ন উপায়ে প্রোগ্রামিং করলেন জয়ন্ত। কিন্তু কমপিউটার, পাঠোদ্ধার করা দূরে থাক, সামান্যতম সূত্রটুকুও দিতে পারল না।

‘তাহলে?’ খুব হতাশ কণ্ঠে বলে উঠলেন ডক্টর সেন।

‘মিউজিয়ামে দিয়ে দে ওটাকে। পৃথিবীর মানুষ ভবিষ্যতে যদি কোনওদিন এই ভাষা পড়তে পারে তো পড়বে। আপাতত আমাদের কাজ শেষ।’

বাসায় ফিরতেই মৃদুলা জিগ্যেস করল, ‘কিছু জানা গেল?’

জয়ন্ত বললেন, ‘না, কিছু না।’

মৃদুলা বলল, ‘যাক গে, ওসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে হাতমুখ ধুয়ে আসুন তো, আমি খেতে দিই। তুমিও চট করে হাতমুখ ধুয়ে নাও।’ বলে মৃদুলা রান্নাঘরে চলে গেল।

ডক্টর সেন মৃদুলার দিকে একবার তাকালেন। মৃদুলা আজ স্বাভাবিক। কাল রাতের ঘটনা যেন ওর মনেই নেই। সত্যি, আশ্চর্য এই মেয়েদের চরিত্র। ডক্টর সেনও অবশ্য ব্যাপারটা ভুলে যেতে চাইছেন। ওটা একটা দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কী?

আজও রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর অনেকক্ষণ গল্পগুজব হল। জয়ন্ত বললেন, ‘প্রশান্ত, তোকে আবার বলছি, খুলির দিকে মন না দিয়ে কোনও সুন্দরীর দিকে মন দে, তাতে কাজের কাজ হবে।’

ডক্টর সেন একটু হাসলেন।

মৃদুলা বলল, ‘হাসলে চলবে না। এবার আপনাকে কথা দিতে হবে যে, কলকাতায় ফিরে গিয়েই বিয়ের চিঠি পাঠাবেন।’

ডক্টর সেন মৃদুলার কথা শুনে চট করে মৃদুলার মুখের দিকে তাকালেন। না, সেখানে কাল রাতের ঘটনার কোনও ছাপই নেই। মৃদুলা খুব স্বাভাবিক। তবে কি কাল রাতে সত্যি-সত্যি দুঃস্বপ্ন দেখেছেন ডক্টর সেন? হ্যালুসিনেশান? কিন্তু না, না, তা কখনও হতে পারে না। এখনও যে ডক্টর সেন মৃদুলার নরম শরীরের উষ্ণতা অনুভব করতে পারছেন!

ডক্টর সেন ঘরে ঢুকে আলোটা নিভিয়ে দিলেন। বেশ রাত হয়েছে। গ্রিন পার্ক এখন নিস্তব্ধ। ডক্টর সেন ভাবতে লাগলেন, যে-রহস্য লুকিয়ে রেখে গেছে দূর নক্ষত্রবাসীরা, তা আর কোনওদিন জানা যাবে না। অথচ এই রহস্যময় খুলিটাকে কেন্দ্র করে কতগুলো ঘটনা ঘটে গেল।

জানলা থেকে ঘরের মধ্যে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনলেন তিনি। মনে হল, ঘরের মধ্যে যেন একটা স্নিগ্ধ আলো জ্বলছে। চমকে উঠে খুলিটার দিকে তাকালেন। যা ভেবেছিলেন তাই। খুলির চোখের গর্ত দুটোয় সেই সবুজ আলো। আলো দুটো স্থির নয়। অসম্ভব বেগে তা যেন ঘুরছে। স্পাইরাল গ্যালাক্সির মতো দেখাচ্ছে আলো দুটোকে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ডক্টর সেন। ওঁর সারা শরীর ভয়ে আতঙ্কে ভিতরে-ভিতরে কাঁপতে লাগল। নিশ্চয় আবার অস্বাভাবিক কিছু ঘটতে চলেছে। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল ডক্টর সেনের, কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও ওই আলো থেকে চোখ ফেরাতে পারলেন না। সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে রইলেন ঘুরন্ত সবুজ আলোর দিকে। কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন মনে নেই ওঁর। হয়তো এক মুহূর্তৃ নয়তো অনন্তকাল।

ভোরবেলা যখন ঘুম ভাঙল তখন ডক্টর সেন অন্য মানুষ। মাথার চুল উসকোখুসকো। চোখ দুটো জবাফুলের মতো লাল। বাইরের থেকে ভিতরের পরিবর্তন আরও মারাত্মক। এক রাতে ওঁর বয়েস যেন বেড়ে গেছে অনেক। যে-রহস্য ভেদ করার জন্য দিনের পর দিন হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন, সে-রহস্য আজ আর তাঁর কাছে অজানা নয়। কাল রাতে সব জেনেছেন। জেনেছেন? না, কেউ ওঁকে জানিয়েছেন। এ-রহস্য হয়তো না জানাই ছিল ভালো।

ব্রেকফাস্ট টেবিলে ডক্টর সেনকে দেখে মৃদুলা ও জয়ন্ত দুজনেই চমকে উঠলেন।

‘রাতে নিশ্চয় আপনার ভালো ঘুম হয়নি।’ বলল মৃদুলা।

‘সত্যি, প্রশান্ত। জিনিসটা নিয়ে তুই কিন্তু বড্ড ভাবছিস। একরাতের মধ্যে কী চেহারা হয়েছে, আয়নায় দেখেছিস একবার?’

‘দেখেছি।’ আস্তে-আস্তে জবাব দিলেন ডক্টর সেন।

‘আজই আমি খুলিটা দিল্লি মিউজিয়ামে দিয়ে দেব। তোর কোনও কথা আমি শুনব না।’

ডক্টর সেন একটু ম্লান বিষণ্ণ হাসি হাসলেন : ‘তার আর দরকার হবে না। ওটা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা আমার শেষ হয়েছে।’

কফি খেতে-খেতে ডক্টর সেন বললেন, ‘জয়ন্ত, আমি তোর সঙ্গে একটু বেরোব।’

‘চল,’ বললেন জয়ন্ত।

গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে ডক্টর সেনকে ডাকলেন জয়ন্ত। গাড়িতে উঠে জয়ন্তর পাশে বসে ডক্টর সেন বললেন, ‘জয়ন্ত, আজ তোর অফিসে যাওয়া হবে না। আমি কতকগুলো অতি প্রয়োজনীয় কথা বলতে চাই।’

গাড়ি ঘুরিয়ে কুতুবমিনারের দিকে চলতে শুরু করলেন জয়ন্ত। কুতুবের সামনে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। গাড়ি রেখে ডক্টর সেনকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকলেন জয়ন্ত।

রেস্টুরেন্টটা একদম ফাঁকা। দু-কাপ কফির অর্ডার দিয়ে এককোণে গিয়ে বসলেন দুজনে।

‘বল কী হয়েছে?’ জয়ন্ত ডক্টর সেনের মুখোমুখি বসে জানতে চাইলেন।

‘একটা মারাত্মক ভুল করে ফেলেছি, জয়ন্ত। মারাত্মক ভুল। পুরোহিত মারুর কথা আমার বিশ্বাস করা উচিত ছিল। ললটান রহস্যের কথা আমার ভুলে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু আমি তা করিনি।’

‘কী বলতে চাইছিস খুলে বল। আমি তোর কথার মাথামুন্ডু কিছুই ভালো করে বুঝতে পারছি না।’ বললেন জয়ন্ত।

বেয়ারা দু-কাপ কফি দিয়ে গেল। জয়ন্ত একটা কাপ ডক্টর সেনের দিকে এগিয়ে দিলেন।

ডক্টর সেন গত রাতের কথা বললেন, ‘জয়ন্ত, যে-ভাষার পাঠোদ্ধার করার জন্যে আমি এতদিন উদগীব হয়েছিলাম, তা গত রাতে কেউ যেন আমাকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছে। বুঝিয়ে দিয়েছে, মানুষের জ্ঞান কত সীমাবদ্ধ, অথচ তার অহংকার কত পর্বতপ্রমাণ। সব জিনিস আমি তোকে ব্যাখ্যা করে হয়তো বোঝাতে পারব না। কিন্তু খুলির চোখের গর্ত দুটোর সেই অলৌকিক ঘুরন্ত সবুজ আলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে যে-জিনিস আমি উপলব্ধি করেছি, সেইটুকুই শুধু আমি তোকে বলতে পারি।’

কফি শেষ করে কাপটা সরিয়ে দিয়ে জয়ন্ত বললেন, ‘তাই বল।’

‘সুদূর নক্ষত্রলোকবাসীরা যখন অন্য কোনও গ্রহে অভিযানে বেরোত তখন সাধারণ অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াও আর-একটা মারাত্মক, ভয়ঙ্কর ও অপ্রতিরোধ্য ব্রহ্মাস্ত্র সঙ্গে নিয়ে যেত। নতুন গ্রহে গিয়ে ওরা সাধারণ অস্ত্রের সাহায্যে গ্রহবাসীদের যদি পরাজিত করতে না পারত, যদি বুঝতে পারত যে, গ্রহবাসীদের হাতে ওরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, তখন ওরা সেই ব্রহ্মাস্ত্রকে উন্মুক্ত করে দিত। দূর নক্ষত্রলোকবাসীরা বুঝতে পারত এবার সময় হয়েছে। ওরা আহ্বান জানাত ভয়ঙ্কর পিশাচকে। যে-পিশাচ ওই গ্রহের একটি নবজাতকের ভিতর আশ্রয় নিয়ে শুরু করবে চরম ধ্বংসলীলা। যা কিছু ওই গ্রহবাসীদের প্রিয় জিনিস তা ধ্বংস হতে শুরু করবে। এই নবজাতকের সৃষ্টির কাজ চলে ওই স্ফটিক করোটির মাধ্যমে। ওই মন্ত্রপূত করোটির সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে দূর নক্ষত্রলোকবাসীদের। এ-অস্ত্রের ক্ষমতা সম্বন্ধে আমাদের সামান্যতম জ্ঞান নেই, জয়ন্ত। মায়ারা যখন পৃথিবীতে আসে তখন ওই ব্রহ্মাস্ত্র নিয়ে এসেছিল। কিন্তু এ-ব্রহ্মাস্ত্র পৃথিবীবাসীদের ওপর প্রয়োগ করার কোনও প্রয়োজন পড়েনি।

কারণ, ওরা যখন এই পৃথিবীতে এসেছিল তখন এখানে কোনও বুদ্ধিমান জীবের অস্তিত্ব ছিল না। জন্তু-জানোয়ারকে শায়েস্তা করার জন্যে ওদের সাধারণ অস্ত্র প্রয়োজনের চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী। ওরা আসার বহু-বহু বছর পরে এখানে মানুষের জন্ম হল। গুহাজীবন থেকে খুবই অল্প সময়ে তারা সভ্য হয়ে উঠল। মহাবিশ্বের রহস্য নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করল। যাত্রা করল সৌরমণ্ডল ছাড়িয়ে অন্য নক্ষত্রলোকে। আবিষ্কার করল মায়াদের আসল রহস্য।

‘মায়াদের অস্তিত্ব বজায় রাখা এবার বিপজ্জনক হয়ে উঠল। মায়া পুরোহিতরা জানতেন এই ব্রহ্মাস্ত্রের কথা, জানতেন কোথায় তাকে সুরক্ষিত করে রাখা হয়েছে। পুরোহিত মারু যখন জানতে পারলেন যে, পৃথিবীর মানুষ মায়াদের আসল রহস্য জেনে গেছে, তখন ওই ব্রহ্মাস্ত্রের ফোর্সফিল্ড নষ্ট করে ওদের আদি গ্রহে সংকেত পাঠালেন। মুহূর্তে যোগাযোগ ঘটে গেল স্ফটিক করোটি আর আদি গ্রহের পিশাচসিদ্ধদের মধ্যে। এইবার সেই মহা ভয়ঙ্কর পিশাচ নেমে আসবে তার আধারের মধ্যে। তারপর শুরু হবে ধ্বংসলীলা। জয়ন্ত, আমি এখন সেই পিশাচসিদ্ধদের হাতের পুতুল। শুধু আমি নই। আমি ও মৃদুলা দুজনেই। দূর মহাবিশ্বের ভয়ঙ্কর পিশাচের আধার তৈরির ভার পড়েছে আমার আর মৃদুলার ওপর।’

জয়ন্ত হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন : ‘প্রশান্ত, আমার মনে হচ্ছে, তুই আজই কোনও সাইকিয়াটিস্টের কাছে চলে যা, আর বিশ্রাম নে।’

‘জয়ন্ত, বোস। আমার মানসিক অবস্থা একটুও বিচলিত নয়! যা বলছি খুব ঠান্ডা মাথায় বলছি। আরও একটু তোর শোনা দরকার, তাহলে আমার একটা কথাও অবিশ্বাস করতে পারবি না।’

তারপর ডক্টর সেন আগের রাতের সব ঘটনা জয়ন্তকে খুলে বললেন।

জয়ন্ত হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন, ‘প্রশান্ত, তোকে আমি বিশ্বাস করতাম! তুই আমার এরকম সর্বনাশ করলি!’

‘জয়ন্ত, তুই বিশ্বাস কর, আমি এক ভয়ঙ্কর অশুভ শক্তির পাল্লায় পড়েছি। এর হাত থেকে আমার মুক্তি নেই।’

জয়ন্তর চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছে উত্তেজনায় : ‘তুই চুলোয় যা—তাতে এখন আমার আর এতটুকু দুঃখ নেই! তবে মৃদুলাও রেহাই পাবে না।’ বলেই ঝড়ের মতো রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে পড়লেন জয়ন্ত।

জয়ন্তর গাড়ি পলকে কুতুবের চত্বর ছাড়িয়ে বড়রাস্তায় গিয়ে পড়ল। ডক্টর সেন গাড়ির পিছনে-পিছনে ছুটতে লাগলেন। কিন্তু যা ঘটার তা ততক্ষণে ঘটে গেল। গুরগাঁও-এর দিক থেকে একটা বিশাল লরি দৈত্যের মতো ছুটে আসছিল। উত্তেজিত জয়ন্ত নিশ্চয় সময়মতো সাবধান হতে পারেননি। জয়ন্তর গাড়িটা লরির সামনে গিয়ে পড়ল। সঙ্গে-সঙ্গে গাড়িটা একটা দেশলাই-এর বাক্সের মতো ছিটকে গিয়ে পড়ল রাস্তার বাইরে। দুমড়ে-মুচড়ে তালগোল পাকিয়ে গেল মুহূর্তে।

জয়ন্তর মৃত্যুর পর ডক্টর সেনকে বাধ্য হয়ে বেশ কিছু দিন দিল্লিতেই থেকে যেতে হল। মৃদুলা আঘাত পেলেও একেবারে ভেঙে পড়ল না। মৃদুলা যে মা হতে চলেছে সে-বিষয়ে এখন আর কোনও সন্দেহই নেই। ডক্টর সেন বুঝতে পারলেন, রক্ষা পাওয়ার আর কোনও পথ নেই। এবার শুধু অপেক্ষা করা। মৃদুলা ভিতরের কথা কিছুই জানে না। ও খুশি। কিন্তু ও যদি জানত কী ভয়ঙ্কর জিনিস ও গর্ভে ধারণ করেছে তাহলে আত্মহত্যা করত। নবজাতক ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে নরকের দূত এসে আশ্রয় নেবে সেখানে। ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে কি ধ্বংস করা যায় না ওটাকে?

চিন্তাটা মাথায় আসতেই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন ডক্টর সেন। কিন্তু তা কি সম্ভব হবে? হোক আর না হোক, চেষ্টা তাঁকে করতেই হবে, তা নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও।

রাতে মৃদুলার খাওয়ার জলে গোপনে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিলেন ডক্টর সেন। তাঁর হাত কাঁপছিল—কিন্তু এ ছাড়া কোনও উপায় নেই। মৃদুলাকে সব জানানো কখনওই সম্ভব নয়। এরপর যা-যা করণীয় তা করে ফেললেন তিনি।

ভোরের দিকে অজ্ঞান মৃদুলাকে নার্সিংহোমে এনে তুললেন। বললেন, মৃদুলা ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। দুর্ঘটনায় স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানকে অবাঞ্ছিত বলে ভাবতে শুরু করেছে ও। সার্জেনের সঙ্গে গোপনে কিছু কথাবার্তা হল। বেশ কিছু টাকার বিনিময়ে গর্ভপাতের ব্যবস্থা হয়ে গেল। মৃদুলাকে অপারেশান টেবিলে তোলা হল। ডক্টর সেন উত্তেজিতভাবে পায়চারি করতে লাগলেন অপারেশান থিয়েটারের সামনে। হঠাৎ অপারেশান থিয়েটারের মধ্যে একটা হইচই শুরু হল। একজন নার্স ছুটে বেরিয়ে গেল অপারেশান থিয়েটার থেকে। ডক্টর সেন ভয়ে-ভয়ে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন। বীভৎস দৃশ্য। সার্জেন মেঝেয় চিত হয়ে পড়ে রয়েছেন। অপারেশান থিয়েটারে টাঙানো শক্তিশালী একটা আলো ভারী শেডসুদ্ধ ছিঁড়ে পড়েছে সার্জেনের মাথায়। মাথাটা থেঁতলে গেছে। বালবের কাচের টুকরোগুলো ভেঙে-ভেঙে চোখে-মুখে ঢুকে গেছে। ডক্টর সেন বুঝলেন, সার্জেনকে বাঁচানোর ক্ষমতা এই পৃথিবীতে আর কারও নেই।

কিন্তু মৃদুলা? ও কেমন আছে? না, ওর কিছুই হয়নি। অপারেশান টেবিলে শান্তভাবে শুয়ে আছে।

মৃদুলার জ্ঞান ফিরতেই ওকে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন ডক্টর সেন।

ক’দিন ধরে কী একটা চিন্তা করে চলেছেন ডক্টর সেন। অবশেষে ঠিক করলেন মৃদুলাকে নিয়ে সিমলায় বেড়াতে যাবেন। মৃদুলা এককথায় রাজি।

সিমলায় এসে মৃদুলা খুব খুশি। অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য। তবে পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করলে আজকাল হাঁফ ধরে যায়। ডক্টর সেনের মাথায় এখন একটাই চিন্তা। মৃদুলা কিছুক্ষণ ধরে একটানা বকবক করে যায়, উনি শুধু হুঁ-হাঁ বলে সায় দেন।

ডক্টর সেন বললেন, ‘ডান দিকের এই চাতালটায় বোসো। একটু জিরিয়ে নাও।’

‘ও বাব্বা! নীচে কী বিরাটা খাদ! ওখানে বসলে আমার মাথা ঘুরবে। তার চেয়ে বরং এই দিকটায় বসি।’

‘কোনও ভয় নেই। চলো, আমিও বসছি। এদিকটায় নোংরা।’ ডক্টর সেন মৃদুলার পিঠে হাত দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। মৃদুলা ধপ করে বসে পড়ল। ও হাঁফাচ্ছিল। সামলে নিতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগবে।

এই সুবর্ণ সুযোগ। এ-সুযোগ নষ্ট করবেন না ডক্টর সেন। মৃদুলার জীবনের বিনিময়ে যদি পৃথিবীর মানুষকে রক্ষা করা যায় তার চেষ্টা ওঁকে করতেই হবে। মৃদুলাকে খুন করার জন্য যদি ওঁকে ফাঁসির দড়ি গলায় পরতে হয় তার জন্য ওঁর একটুও দুঃখ নেই। মৃদুলার পাশে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধে হাত রাখলেন ডক্টর সেন। মৃদুলা খুশি হয়ে হাসল একটু। ডক্টর সেন বললেন, ‘নীচের দিকে দেখো, মৃদুলা।’ ডক্টর সেন মৃদুলার কাঁধ থেকে হাত তুলে নিয়ে প্রাণপণ শক্তিতে দু-হাত দিয়ে মৃদুলার পিঠে ধাক্কা দেওয়ার জন্য শরীরটা এগিয়ে দিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে মৃদুলা ডক্টর সেনের কথায় হঠাৎ খানিকটা ঝুঁকে নীচের দিকে তাকাল। মৃদুলার পিঠে ধাক্কা না দিয়ে শূন্যে ধাক্কা দিলেন ডক্টর সেন। সঙ্গে-সঙ্গে ভারসাম্য হারিয়ে ছিটকে পড়লেন নীচের গভীর খাদে। মৃদুলা আর্ত চিৎকার করে উঠল।

ডক্টর সেনকে উদ্ধার করা হল পাইন গাছের মাথা থেকে। না, মারা যাননি। নার্সিংহোমে মাসখানেক থাকার পর ধীরে-ধীরে খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠলেন। শারীরিক সুস্থ হলেও মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেল ওঁর। ডাক্তাররা বহু চেষ্টা করেও কিছু করতে পারলেন না। সবসময় বিড়বিড় করে অসংলগ্ন কথা বলেন। মৃদুলা ছাড়া আর কাউকে চিনতে পারেন না।

মৃদুলা আজকাল একদম সহ্য করতে পারে না ডক্টর সেনকে। মাঝে-মাঝে চিৎকার করে ওঠে, ‘কেন, কেন তুমি আমাকে খুন করতে চেয়েছিলে?’

‘মৃদুলা, সে কি এসেছে?’

‘না, কেউ আসেনি।’ চিৎকার করে ওঠে মৃদুলা।

‘আসবে, সে আসবে। করোটির ঘুরন্ত সবুজ আলো আমাকে জানিয়েছে…অশুভ মুহূর্ত আগতপ্রায়। অশুভ শক্তি জেগে উঠেছে। সে অপেক্ষা করছে নবজাতকের। মানুষের প্রিয় সবকিছু নরকের আগুনে পুড়িয়ে ঝলসে দেবে সেই নরকের পিশাচ।’

‘কী পাগলের মতো বকছ! চুপ করো। মাথাটা একেবারেই গেছে?’ ধমক দিয়ে ওঠে মৃদুলা।

‘মানুষের প্রিয় সবকিছু ধ্বংস হবে। মৃদুলা—মৃদুলা, তাহলে হয়তো একটা পথ আছে—ওই অপ্রতিরোধ্য মহাপিশাচকে ধ্বংস করার হয়তো একটা পথ আছে…।’

‘চুপ করো। তোমার পাগলামি শুনতে আমার একটুও ভালো লাগছে না। দয়া করে চুপ করো।’ মৃদুলা চিৎকার করে ওঠে।

‘পাগলামি নয়, মৃদুলা, সত্যি বলছি বিশ্বাস করো। আমার মন বলছে, একটা পথ আছে। ওকে আমরা ভালোবাসব। গভীরভাবে ভালোবাসব। পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষকে আমরা অনুরোধ করব ওকে ভালোবাসতে। মানুষের প্রিয় হয়ে উঠলে ও নিজেই নিজেকে ধ্বংস করে ফেলবে। মৃদুলা—পৃথিবীর সবাইকে…।’

সে-রাত্রেই ডক্টর সেন মারা গেলেন। দশদিন বাদে নার্সিংহোমে মৃদুলার একটি ছেলে হল। জন্মমুহূর্তে ছেলেটি চিৎকার করল না। ডাক্তাররা অবাক হলেন। ছেলেটা সুস্থ ও স্বাভাবিক। গণ্ডগোল দেখা দিল কয়েকদিন বাদে। একজন প্রসূতি অভিযোগ করল যে, তাকে অন্য কারও ছেলে দেওয়া হয়েছে। এ-ছেলে তার নয়। নার্স টিকিট নম্বর দেখল।

ভদ্রমহিলা বললেন, অন্য কারও ছেলের গলায় ওঁর ছেলের টিকিটটা ঝুলিয়ে দিয়েছে।

নার্স একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কিন্তু পরীক্ষা করে দেখা গেল যে, টিকিট ওলটপালট হয়নি।

সব প্রসূতিই প্রায় একই অভিযোগ করতে লাগল। এমনকী মৃদুলাও দুবার অভিযোগ করল যে, অন্য কারও ছেলে ওকে দেওয়া হচ্ছে। ডাক্তার-নার্সরা দিশেহারা হয়ে পড়লেন, কিন্তু সমস্যার কোনও সমাধান হল না।

করোটির চোখের গর্তে আবার সবুজ আলোর আভা। ঘুরছে—প্রচণ্ড বেগে ঘুরছে সেই ধোঁয়ার মতো আলো। সবকিছু ঠিকভাবে ঘটেছে—ওদের নির্দেশ মতো। আধারে এসে আশ্রয় নিয়েছে মহাপিশাচ। মুহূর্তে-মুহূর্তে সে অন্যরূপ ধারণ করতে পারে। মানুষ চেষ্টা করলেও আর তাকে চিহ্নিত করতে পারবে না। এবার শুরু হবে ওর কাজ। প্রচণ্ড শব্দ করে স্ফটিক-করোটিটা ফেটে টুকরো-টুকরো হয়ে গেল। মন্ত্রপূত করোটির কাজ শেষ।

অপরাধ

পুজো সংখ্যা, ১৯৭৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *