কয়েকটি মন্তব্য

কয়েকটি মন্তব্য

উল্লেখিত তথ্য থেকে বলা যায়, বাঙালি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের বৃহৎ অংশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অবসানের পক্ষপাতী ছিল না। কংগ্রেসের অথবা অন্যান্য বিপ্লবী দলের যেসব জাতীয়তাবাদী এবং বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী কর্মীরা ছিলেন তাঁরাও বাঙালি সমাজে তাঁদের বিশেষ শ্রেণি অবস্থানের জন্য জমির প্রশ্নটি গুরুত্ব সহকারে বিশ্লেষণ করেননি। তাঁরা এই কথাও উপলব্ধি করতে পারেননি, যদি ভূমিসমস্যা সমাধানে কার্যকরী ব্যবস্থা অবলম্বন করা না যায়, বিশেষ করে বাংলার মতো একটি অঞ্চলে, যেখানে বেশিরভাগ জমিদার হিন্দু ও বেশিরভাগ কৃষক মুসলমান, তাহলে এই অঞ্চল প্রতিনিয়ত সাম্প্রদায়িক মনোভাবের শক্তি বৃদ্ধি করবে এবং সবসময়ে রাজনীতিবিদদের তাঁদের ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষার্থে সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থাকে ব্যবহার করতে উৎসাহিত করবে। জমিদারেরা এই বিষয়ের প্রতি কখনোই গুরুত্ব আরোপ করেননি। তাঁরা ভূমি ব্যবস্থার মূল কাঠামো বজায় রাখতেই বেশি আগ্রহী ও তৎপর ছিলেন। এই কথা পরিষ্কার করে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে স্যার বিজয়চাঁদ মহতাব এবং ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী উভয়েই ফ্লাউড কমিশনের নিকটে প্রেরিত তাঁদের নোটে বলেন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উচ্ছেদ হলে এই প্রদেশের মেরুদন্ডরূপে ও বুদ্ধিজীবীরূপে বিরাজ করছেন যে-মধ্যস্বত্বভোগীরা এবং যাঁরা হলেন আধুনিক বাংলার স্রষ্টা তাঁরাও অবলুপ্ত হবেন। তার ফলে দেশকে এক বিশৃঙ্খল অবস্থার দিকে ঠেলে দেওয়া হবে। তাঁদের নোট থেকে এই অংশ উদ্ধৃত করা হল :

‘To make extinct the great landholders in the Province may not be difficult, although they might deserve greater consideration as they and their ancestors contributed in no small measure in the past to the establishment of many of the charitable and educational institutions to be found in the Province today. But with the disappearance of all intermediary landlords, who have formed the backbone of the Province, and the intelligentsia and are the creators of modern social and political Bengal, we shall be running the definite risk of a social upheaval of a magnitude which requires very careful thought, for with an undeveloped ‘Proja Party and Raiyats’ Associations we might easily usher in communism which would become a menace to the state itself. The Province is not ready for such a revolutionary step and that is why we consider the proposal of state purchase as unsound in practice, premature and inopportune.৮৭

তাঁরা একথা উপলব্ধি করেননি যে, যদি তাঁরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে পরিবর্তন করে একটি নতুন ভূমি ব্যবস্থা গড়ে না তুলতে পারেন তাহলে সত্যিই এক অস্বাভাবিক সামাজিক-রাজনৈতিক অভ্যুত্থান বাংলাকে গ্রাস করবে; যার ফলে অদূর ভবিষ্যতে হিন্দু জমিদারের ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির গোটা ভিত্তিই, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গে বিপন্ন হবে। ১৯৩৬-১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে, বিশেষ করে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে পাকিস্তান প্রস্তাব গ্রহণের পরে এটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, মুসলিম লিগ নেতৃবৃন্দ মুসলিম কৃষকদের ওপর তাঁদের প্রভাব বৃদ্ধি করার জন্য ভূমিসমস্যাকে পুরোপুরিই ব্যবহার করবেন।৮৮ এই ভূমিসমস্যার ফলেই রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক প্রশ্নসমূহ এতটা মিশ্রিত হয়ে পড়ে যে, বাংলার রাজনৈতিক পরিবেশ খুবই জটিল রূপধারণ করে এবং কংগ্রেস ও লিগ নেতৃবৃন্দকে পরস্পরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপরায়ণ করে তোলে। সুতরাং, ১৯৪৬-১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় হিন্দু-মুসলিম বিরোধের এক করুণ চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। এই সময়ে পূর্ববঙ্গের কয়েকটি জেলায় মুসলিম কৃষকেরা হিন্দুদের জমি চাষ করতে অস্বীকার করে। এমনকি কয়েকটি স্থানে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের জমি চাষ না করতে নমঃশূদ্র কৃষকদের প্ররোচিত করা হয়। বিভিন্ন কারণে হিন্দু-মুসলিম তিক্ততা গ্রামবাংলার জীবনকে বিষাক্ত করে তোলে। যেসব কংগ্রেসকর্মী জাতীয়তাবাদী ঐতিহ্যে লালিত হন, তাঁরা ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের মধ্যে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। এই সময়ে তাঁরা উপদেশ ও নির্দেশ পাওয়ার আশায় মহাত্মা গান্ধির নিকটে পত্রও প্রেরণ করেন। কিন্তু কোনো সুনির্দিষ্ট পথের নিশানা তাঁরা খুঁজে পাননি।৮৯

যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বাঙালি জীবন বিধ্বস্ত ঠিক তখনই অর্থাৎ ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২১ এপ্রিল মুসলিম লিগ মন্ত্রীসভা বঙ্গীয় আইনসভাতে ‘Zamindari Purchase and Tenancy Bill’ নামে একটি বিল আনে। এই বিলে প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমিদারি ক্রয়ের শর্ত যুক্ত করা হয়। কিন্তু এই বিল সম্পর্কে সিলেক্ট কমিটি কোনো রিপোর্ট পেশ করার পূর্বেই বাংলাকে বিভক্ত করবার সরকারি নীতি ঘোষিত হয়।৯০

এই প্রবন্ধের তথ্য থেকে বোঝা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ সৃষ্ট চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অটুট রেখেই এক নতুন বাংলা গড়তে চেষ্টা করেন। অন্যদিকে বিংশ শতাব্দীর স্বাধীনতা সংগ্রামীরা এই প্রশ্নটিকে মুলতবি রেখে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সচেষ্ট হন। আমরা দেখেছি, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উদ্দেশ্য ছিল একটি নির্ভরশীল শ্রেণি তৈরি করা। সন্দেহ নেই, সমগ্র ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই শ্রেণি ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অনুগত ছিল। বিংশ শতাব্দীতে তাঁরা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করলেও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ওপর গড়ে-ওঠা সামাজিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন কখনোই দাবি করেননি। এইসব তথ্যই পরিস্ফুট করে তোলে কী করে একটি সামন্ততান্ত্রিক-ঔপনিবেশিক সমাজে ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার একটি শক্তিশালী সামাজিক উপকরণ হিসেবে টিকে থাকে। এই সময়কার বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা বিশ্লেষণে তাঁদের স্ববিরোধী চরিত্র পর্যালোচনা প্রয়োজন। তাহলেই বোঝা যাবে কেন জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ তাঁদের প্রয়াস সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রসার বন্ধ করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হন, যার ফলে বাংলা বিভক্ত হয়ে পড়ে।৯১

.

৮৭. Report, vol. I, p. 233

৮৮. J H Broomfield, Elite Conflict in a Plural Society : Twentieth Century Bengal, Bombay, 1968 ; পাকিস্তান প্রস্তাব ; বাঙালি বুদ্ধিজীবী, তৃতীয় অধ্যায়।

৮৯. Professor Nirmal Kumar Bose’s Diary and Gandhi Papers, vol. II (1945 to 1947), pp. 139-203, in the Asiatic Society, Calcutta.

৯০. প্রমথ চৌধুরী, রায়তের কথা, কলকাতা, ১৩৫৪ ; বদরুদ্দীন উমর, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলাদেশের কৃষক ; অমলেন্দু দে, স্বাধীন বঙ্গভূমি গঠনের পরিকল্পনা : প্রয়াস ও পরিণতি, কলিকাতা, ১৯৭৫।

৯১. বাঙালি বুদ্ধিজীবী ; Roots of Separatism ; মুনতাসীর মামুন (সম্পাদিত), চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও বাঙালি সমাজ, ঢাকা, ১৯৭৫।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *