কয়েকটি অবিশ্বাস্য রসিকতা
মনীষী অক্ষয় সরকারের সুরসিক পিতৃদেব চুঁচুড়ার গঙ্গাচরণ সরকারের কথা আগে একবার লিখেছি। কিন্তু আমারই দোষে একটা চমৎকার, প্রায় অবিশ্বাস্য উপাখ্যান বাদ রয়ে গেছে।
অক্ষয়চন্দ্র একবার বাবা গঙ্গাচরণের সঙ্গে থিয়েটার গেছেন, ‘মেঘনাদ বধ’ নাটক। মেঘনাদের মৃত্যু হয়েছে, তাঁর স্ত্রী প্রমীলা স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যাচ্ছেন। পাশে চিতা সাজানো হয়েছে। সেই চিতার পাশে রাবণ এসে বিরাট এক ডায়ালগ দিয়ে মঞ্চ থেকে বিদায় নিলেন।
এখন মঞ্চে চিতার সামনে প্রমীলা একা। এদিকে, চিতা নিভতে বসেছে, তাই দেখে প্রমীলা নিজেই নিজের চিতা ফুঁ দিয়ে জ্বালিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন, ওদিকে, তাঁকে ডায়ালগও দিতে হবে।
এই দৃশ্য দেখে স্বাভাবিক কারণেই অক্ষয় সরকার বললেন, ‘এদের কি কেউ নেই? এত বড় লঙ্কারাজ্য, ভৃত্য-পরিচারক, কাজের লোকেরা সব গেল কোথায় ?’
ছেলেরা কথা শুনে গঙ্গারচণ নাকি বলেছিলেন, ‘রাম কি আর কাউকে রেখেছে রে? রাক্ষসপুরী একেবারে শূন্য করে দিয়েছে।’
এর পরের গল্পটি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং এক পকেটমারকে নিয়ে। গল্পটি সম্ভবত সত্যি নয়, কিন্তু বেশ ভাল।
তখনও কলকাতার আর হাওড়ার মধ্যে গঙ্গার ওপরে নতুন বা পুরনো কোনও লোহার সাঁকোই তৈরি হয়নি, ভাসমান কাঠের পুল দিয়ে পারাপার করতে হয়। একদিন শরৎচন্দ্র পায়ে হেঁটে সাঁকো পার হয়ে হাওড়া ফিরছিলেন। তাঁর জামার বুকপকেটে চেন দেওয়া পকেটঘড়ি। অনেকের হয়তো এখনও মনে আছে যে, তখনকার জামায়-পাঞ্জাবিতে বুকপকেটের মধ্যে তিন কোনাচে ঘড়ির পকেট থাকত। যাদের ঘড়ি নেই তারা সেই পকেটে টাকার নোট, দরকারি কাগজ— এই সব রাখত। আমরা ছোট বয়েসে দর্জির দোকানে বায়না করতুম, ‘ওপরের পকেটের মধ্যে ঘড়ির পকেট দিতে হবে।’ সেটা ছিল সাবালকত্বের সোপান বেয়ে ওঠার প্রথম ধাপ।
সে যা হোক, ভরদুপুর। হাওড়ার পুলে খুব ভিড়, লোক ঠেলাঠেলি। শরৎচন্দ্র তাড়াতাড়ি হাঁটছেন, এমন সময় তাঁর খেয়াল হল কেউ একজন তাঁর ঘড়ির পকেট থেকে চেনটা ধরে টান দিয়েছে, ঘড়িটা তুলে নেবার জন্যে।
অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে শরৎচন্দ্র পকেটমারের হাত ধরে ফেললেন, ‘কী ব্যাপার? এটা কী হচ্ছে?’ শরৎচন্দ্রের ধমকের জবাবে পকেটমার বলে উঠল, ‘স্যার ক’টা বাজে আপনার ঘড়িতে, তাই দেখতে যাচ্ছিলাম।’ সঙ্গে সঙ্গে শরৎচন্দ্র পকেটমারের পিঠে একটা দুম করে ঘুষি মেরে বললেন, ‘একটা।’
ঘুষি খেয়ে একটু দম নিয়ে পকেটমার বলল, ‘খুব বেঁচে গেলাম স্যার।’ শরৎচন্দ্র অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মানে?’ ‘মানে আর কী স্যার?’ পকেটমার বলল, ‘বারোটা বাজলে শেষ হয়ে যেতাম যে।’
অতঃপর দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্র, যাঁকে বলা হত শরৎ পণ্ডিত। শরৎ পণ্ডিতের সঙ্গে শরৎচন্দ্রের মধুর রসিকতার সম্পর্ক ছিল। তখন শরৎ পণ্ডিত ‘বিদূষক’ পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করতেন। এদিকে, শরৎচন্দ্রের ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাস প্রকাশিত হয়ে চারদিকে শোরগোল তুলেছে।
এই সময়ে একদিন এক সাহিত্যবাসরে দুই শরৎচন্দ্রে দেখা। দাদাঠাকুরকে আসতে দেখে ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র নাকি হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন, ‘এসো, এসো হে, বিদূষক শরৎচন্দ্র।
দাদাঠাকুরও সহজে ছেড়ে কথা বলার লোক নন। তিনিও নাকি উত্তরে বলেছিলেন, ‘কেমন আছো, চরিত্রহীন শরৎচন্দ্র।’
এই গল্পটি বহুশ্রুত, বহুস্কৃত। কিন্তু কেমন অবিশ্বাস্য, বোধহয় সত্যি নয়। সত্যি না হলেও, বিশেষ কিছু আসে যায় না। এবং শরৎ পণ্ডিত মানে দাদাঠাকুরের নিজের সম্পর্কে একটি বিশ্বাসযোগ্য কথা স্মরণ করি।
দাদাঠাকুরকে কে একজন নাকি জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আপনার উপাধি পণ্ডিত হল কী করে ?’ তিনি জবাবে বলেছিলেন, ‘আমি পণ্ডিত নই তো তবে পণ্ডিত কে? আমি পণ্ড থেকে পণ্ডিত। যখন কোনও কিছু খণ্ড খণ্ড করা হয় তখন সেটা হয় খণ্ডিত, ঠিক সেইরকম আমি যখন যেখানে যাই সেখানে সব পণ্ড হয়ে যায়। আর, সেই সুবাদেই আমি হলাম পণ্ডিত, শরৎ পণ্ডিত।’
অবশেষে নবদ্বীপধাম একটি বিখ্যাত প্রাচীন রসিকতার কাহিনী স্মরণ করি। এটিও প্রায় অবিশ্বাস্য।
বহুযুগ ধরে নবদ্বীপধামে ছিল বাংলার সংস্কৃতির রাজধানী। পাণ্ডিত্য ও রসবোধ নবদ্বীপের ঘরে ঘরে।
নবদ্বীপের এক নৈয়ায়িক পণ্ডিত মধ্যাহ্নভোজনে বসেছেন। ব্রাহ্মণীর নাম পঞ্চাননদেবী। সেদিন খেতে বসে ভাতের থালার পাশে জল না দেখে পণ্ডিত বুঝলেন গৃহিণী জল দিতে ভুলে গেছেন। পণ্ডিত গৃহিণীকে সম্বোধন করে বললেন, ‘পাঁচি, পঞ্চী, প্রণঞ্চি, পঞ্চাননী, বারি আনয়।’
ব্রাহ্মণী সুরসিকা, তিনি উত্তর দিলেন, ‘আর্য, আচার্য, ভট্টাচার্য, শিরোধার্য, গঙ্গোদকম বা কূপোদকম (গঙ্গার জল না কুয়োর জল)?