কয়েকটা কমলালেবু – অনুবাদক: বুদ্ধদেব বসু

কয়েকটা কমলালেবু

‘তেরেসিনা কি এখানে থাকে?’

বাটলারের গায়ে তখনও কেবল শার্ট কিন্তু এরই মধ্যে সে গলায় শক্ত কলার চাপিয়েছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত ছেলেটিকে সে একবার দেখে নিল। ছেলেটি তার মোটা কোটের কলার কান পর্যন্ত তুলে দিয়েছে, শীতে নীল হয়ে জমে গেছে তার হাত। এক হাতে একটি ছোট্ট নোংরা ব্যাগ, অন্য হাতে একটা পুরনো আট্যাশে কেস নিয়ে সবচেয়ে উপরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বর্বরের মতো সে বাটলারের দিকে তাকিয়ে।

বাটলারের চোখের উপর মোটা মোটা ভুরু, দেখে মনে হয় তার গাল থেকে দাড়ি কেটে নিয়ে কেউ স্থায়ীভাবে ওখানে বসিয়ে দিয়েছে। সেই ভুরু তুলে সে জিজ্ঞেস করলে, ‘তেরেসিনা? তেরেসিনা কে?’ ছেলেটি মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে এক ফোঁটা শিশির তার নাক থেকে ঝরিয়ে দিলে। তারপর জবাব দিলে, ‘তেরেসিনা— গায়িকা তেরেসিনা।’ বাটলারের মুখে বিস্ময় মেশানো বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠল।— ‘ও! তাঁর নাম বুঝি তেরেসিনা— শুধুই তেরেসিনা? আর তুমি কে বলো তো?’

ছেলেটির মুখে বিরক্তির রেখা ফুটল, ঘোঁৎ করে একটা আওয়াজ বেরুল তার নাক দিয়ে। ‘সে বাড়িতে আছে না নেই বলো দেখি। তাকে গিয়ে বলো যে মিচুচ্চো এসেছে —তা হলেই হবে।’

বাটলারের মুখের উপর একটি সূক্ষ্ম হাসি যেন জমে বরফ হয়ে গেল।

‘কিন্তু এখন তো কেউ বাড়ি নেই। মাদাম সিনা মার্নিল এখনও থিয়েটার থেকে ফেরেননি আর…’

‘আর মার্থা-মাসি?’ মিচুচ্চো তাকে বাধা দিলে।

‘ও আপনি তাঁর বোনপো বুঝি?’ চাকরটা তক্ষুনি সসম্মানে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ‘আজ্ঞে না কেউ বাড়ি নেই। একটার আগে ফিরবেন বলে মনে হয় না। আজ আপনার… আপনার ইয়ের জয়ন্তী-রজনী কিনা… মাদাম তা হলে আপনার কী না হলেন… মাসতুতো বোন না?’

মিচুচ্চো একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললে, ‘না… মানে… ওরা ঠিক আমার আত্মীয় নয়।… আমি… আমার নাম মিচুচ্চো বোনাভিনো… আমার নাম শুনলেই সে চিনবে। ওর সঙ্গে দেখা করতেই আমি দেশ থেকে এসেছি।’

এর পরে বাটলার ভাবলে যে ‘আজ্ঞে’ ‘আপনি’গুলো ব্যবহার না করাই ঠিক হবে। রান্নাঘরের পাশে ছোট্ট অন্ধকার একটা ঘরে মিচুচ্চোকে সে নিয়ে গেল। সেখানে কার উচ্চ নাসিকাধ্বনির শব্দ আসছে। ‘বোসো এখানে— আমি আলো নিয়ে আসছি।’

যেদিক থেকে নাক ডাকার শব্দটা আসছিল, মিচুচ্চো সেদিকে তাকাল, কিন্তু নাসিকাধ্বনির উৎসটি আবিষ্কার করতে পারল না। তখন সে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে দেখল বাবুর্চি আর বয় মিলে ডিনার প্রস্তুত করছে। ভোজ্যবস্তুর গন্ধে সে আচ্ছন্ন হল, মাথা ঝিমঝিম আর গা বমি বমি করতে লাগল তার; সকাল থেকে সে বলতে গেলে কিছুই খায়নি, মেসিনা থেকে এক রাত্রি এক দিন ট্রেনে কাটিয়ে এইমাত্র এসে পৌঁচেছে।

বাটলার আলো নিয়ে এল। ঘরের এক দেয়াল থেকে আর এক দেয়ালে দড়ি ঝুলিয়ে দিয়ে একটা পরদা খাটানো হয়েছে, তার আড়ালে এতক্ষণ নাক ডাকিয়ে যে ঘুমুচ্ছিল সে আধো ঘুমের মধ্যে বিরক্তির স্বরে বলে উঠল: ‘কে?’

‘দোরিনা, ওঠ। সিনোর বোনা ভিচিনো এসেছেন।’

আঙুলে ফুঁ দিতে দিতে মিচুচ্চো বললে, ‘বোনাভিনো।’

‘সিনোর বোনাভিনো এসেছেন… মাদামের বন্ধু… আর তুই কিনা পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছিস! ঘণ্টা বাজলে তোর কানে কখনও যায় না। আমি তো আর এক হাতে সব করতে পারি না। আমাকে এখন খাবার টেবিল সাজাতে হবে, আনাড়ি বাবুর্চিটার পিছনে তো আমি লেগেই আছি… এর উপর কে এল না এল তাও কি আমাকেই দেখতে হবে।’

বাটলারের এই বকুনির উত্তরে শোনা গেল অনেকক্ষণ ধরে আড়মোড়া ভাঙার সঙ্গে তাল রেখে হাইয়ের প্রচণ্ড শব্দ, তারপর হঠাৎ একটা তীব্র আনুনাসিক ধ্বনি। রাগে গজগজ করতে করতে বাটলার চলে গেল।

মিচুচ্চোর একটু হাসি পেল। চোখ দিয়ে বাটলারকে সে অনুসরণ করলে— আরও একটা আধো অন্ধকার ঘর পার হয়ে উজ্জ্বল আলোজ্বলা বিশাল খাবার ঘরের প্রান্তে সে পৌঁছল। কী সুন্দর, কী জমকালো টেবিল সেখানে পাতা! মিচুচ্চো মুগ্ধতায় আত্মবিস্মৃত হল। খানিক পরে সেই নাক ডাকার শব্দে আবার তার চোখ এসে পড়ল পরদার উপরে।

বগলের তলায় ন্যাপকিনটি নিয়ে বাটলার একবার ও ঘরে যাচ্ছে, একবার এ ঘরে আসছে। কখনও দোরিনার উদ্দেশে, কখনও বাবুর্চির উদ্দেশে তার বকরবকর চলেইছে। বাবুর্চিটি নিশ্চয়ই নতুন লোক, আজকের উৎসবের জন্যই তাকে আনা হয়েছে— সে অবিশ্রান্ত এ কথা ও কথা জিজ্ঞেস করে বাটলারকে অতিষ্ঠ করে তুলছে। মিচুচ্চোরও তাকে অনেক কথা জিজ্ঞেস করবার ছিল কিন্তু এখন সেগুলো চেপে যাওয়াই ভাল, বাটলারকে আর ঘাঁটিয়ে কাজ নেই। এ কথাও তাকে জানানো দরকার যে, সে মিচুচ্চোই তেরেসিনার ভাবী স্বামী। কিন্তু কথাটা বলতে সে খুব উৎসাহ পেল না, কেন কে জানে! এ কথা শুনলে তার সঙ্গে অত্যন্ত সসম্মান ব্যবহার না করে বাটলারের উপায় থাকবে না— সেটাই কি কারণ? যদিও এখনও সে তার কোটটি গায়ে চড়ায়নি, তবু বাটলারের ভাব ভঙ্গি কী মার্জিত, কী আত্মস্থ! তার দিকে তাকিয়ে মিচুচ্চো মনে মনে কথাটা ভাবতেও লজ্জায় যেন মরে গেল। সে, তেরেসিনার ভাবী স্বামী! তবু এক সময়ে তার পক্ষে আর আত্মসংবরণ সম্ভব হল না, সে জিজ্ঞেস করে ফেলল, ‘কিছু মনে কোরো না… কিন্তু… এই বাড়ি… বাড়িটি কার?’

বাটলার তাড়াতাড়িতে জবাব দিলে, ‘আমাদেরই, যতক্ষণ এখানে আছি, আমাদেরই।’ আর মিচুচ্চো বসে বসে মাথা নাড়তে লাগল। কী কাণ্ড! সব তা হলে সত্যি!… তেরেসিনার কপাল খুলেছে! সে বড়লোক! এই যে রীতিমতো ভদ্রলোকের মতো দেখতে বাটলার, ওই বয়, বাবুর্চি, ওই যে দোরিনা পড়ে পড়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে—এরা সবাই তা হলে তেরেসিনার চাকর, তেরেসিনার কথায় ওঠে বসে! এ-ও কি বিশ্বাস করতে হবে?

মেসিনার কথা আবার তার মনে পড়ল। একটা জঘন্য চিলকোঠায় তেরেসিনা তার মাকে নিয়ে থাকত। পাঁচ বছর আগে, সেই সুদূর চিলকোঠায় মা-মেয়ের না খেয়ে মরবার দশা হয়েছিল। মরেনি তার জন্যই। সে, মিচুচ্চো, সে-ই আবিষ্কার করেছিল তেরেসিনার কণ্ঠের ঐশ্বর্য। তখন সে সব সময়ই গান গাইত, গাইত পাখির মতো, নিজের প্রতিভা সে নিজেই জানত না। তার গানের মধ্যে একটি উদ্ধত উৎসাহ ছিল— গান দিয়ে সে নিজেকে ভুলিয়েছে, ভুলে থেকেছে তার দুঃখ, তার দুঃসহ দুরবস্থা। তার মা, বাবা— বিশেষ করে তার মা— নিরন্তর বাধা দিয়েছেন, তবু মিচুচ্চোর প্রাণপণ চেষ্টা ছিল কেমন করে সেই দুঃখ একটুও লাঘব হবে। তেরেসিনার বাপ মারা গেল— এর পর সে কি তাকে ত্যাগ করতে পারে? সে নিঃস্ব বলে তাকে ছেড়ে যাবে সে? তার তো ছোটখাটো একটা চাকরি আছে। মিউনিসিপ্যালিটির ব্যান্ডে সে বাঁশি বাজায়।

মিচুচ্চোর মনে যেন দৈব প্রেরণা এসেছিল, যেন সে আকাশ-বাণী শুনেছিল— তাই তো তেরেসিনার কণ্ঠস্বরকে কাজে খাটাবার কথা মনে হয়েছিল তার। মনে পড়ে সেদিন ছিল এপ্রিল মাস, ওদের চিলকোঠার জানলাটি যেন ফ্রেমের মতো খানিকটা উজ্জ্বল নীল আকাশকে ধরেছে। সেই জানলার ধারে বসে তেরেসিনা একটা সিসিলির সুর গুনগুন করছিল। সেদিন তাদের কথায় ছিল উদ্দাম আবেগ। তেরেসিনার মন ভাল ছিল না, মিচুচ্চোর মা বাবা কিছুতেই মত দিচ্ছেন না, আর এই তো সেদিন তার নিজের বাপ…। মিচুচ্চোরও এত খারাপ লাগছিল যে গান শুনতে শুনতে চোখে তার জল এসেছিল। ও গান তেরেসিনার মুখে তো আগেও শুনেছে, কিন্তু ওরকম সে আর কখনও গায়নি। সেদিন তার মন এমন নাড়া খেয়েছিল যে পরের দিনই— তেরেসিনাকে কি তার মাকে কিছু না বলে— তার এক বন্ধুকে, সেই ব্যান্ডের কন্ডাক্টারকে সে সঙ্গে করে ওদের চিলকোঠায় নিয়ে এসেছিল। এইভাবে আরম্ভ হল তেরেসিনার সংগীতশিক্ষা— আর এর পরে দু’বছর ধরে মিচুচ্চো তার মাইনের প্রায় সবটাই তেরেসিনার পিছনেই খরচ করেছে। সে পিয়ানো ভাড়া করল, স্বরলিপি কিনল, এমনকী ওস্তাদজির হাতেই বন্ধুভাবে অল্প-স্বল্প কিছু গুঁজে দিল। কী ভালই ছিল সেই দিনগুলি! তেরেসিনার ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল রঙে আঁকতেন তার ওস্তাদ— তেরেসিনার ইচ্ছা হত দড়িদড়া ছিঁড়ে সেই ভবিষ্যতের দিকে ভেসে পড়ে। আর তারই সঙ্গে সঙ্গে মিচুচ্চোর প্রতি তার কত ভালবাসা, কত কৃতজ্ঞতা! কত সুখের স্বপ্নই দু’জনে মিলে তারা দেখেছে!

কিন্তু তেরেসিনার মা, মার্থা মাসি হতাশভাবে মাথা নেড়েছে। জীবনে আশার অঙ্কুর তার অনেকবার ধরেছে, অনেকবার ঝরেছে— ভবিষ্যতের উপর আর তার আস্থা নেই। মেয়ের কথা ভেবে তার আশঙ্কা হত— মেয়ে যে এই দুঃখ থেকে ত্রাণ পাবার স্বপ্নও দেখছে এটাও তার ভাল লাগত না। বেশ তো— এই দুঃখই তো বেশ গা-সওয়া হয়ে গেছে। আর মূঢ়ের মতো এই যে স্বপ্ন-দেখা, এর কত কঠিন মূল্য যে মিচুচ্চোকে দিয়ে যেতে হচ্ছে, তাও মাসি জানত।

কিন্তু দু’জনের একজনও তার কথায় কর্ণপাত করলে না। একবার এক তরুণ গায়ক-সুরকার এক জলসায় তেরেসিনার গান শুনে বললে যে এই মেয়েকে সংগীত শিক্ষা সম্পূর্ণ করবার জন্য নেপলস-এ না-পাঠানো অমার্জনীয় অপরাধ। যেমন করে হোক নেপলস-এর গীতভবনে একে যেতেই হবে।

মার্থা-মাসির আপত্তি বিফলে গেল। মিচুচ্চো এ নিয়ে আর দু’বার ভাবলে না। এক পুরুত-খুড়ো তাকে কিছু জমিজমা দিয়ে গিয়েছিলেন, বাড়ির লোকের সঙ্গে ঝগড়া করে সে তাই বেচে দিলে, তারপর তেরেসিনাকে নেপলস-এ পাঠাল সংগীতশিক্ষা সম্পূর্ণ করতে।

তারপর আর তার সঙ্গে তার দেখা হয়নি। চিঠিপত্রের বিনিময় হয়েছে, যতদিন গীতভবনে ছিল, তেরেসিনাই চিঠি লিখত। তারপর একবার যখন তার গানের জীবন বন্যার মতো তাকে ভাসিয়ে নিলে, মন্টি কার্লোয় তার নাম ফেটে পড়বার পর সব বড় বড় থিয়েটারওয়ালার সে কাম্য হয়ে দাঁড়াল তখন থেকে চিঠি লিখত মার্থা মাসি। বুড়ো মানুষ ভাল করে কিছুই লিখতে পারত না, আঁকাবাঁকা অক্ষরে খানিকটা কাঁপা-কাঁপা কথা মিচুচ্চোর কাছে এসে পৌঁছোত— আর সেই সঙ্গে তেরেসিনাও এক লাইন জুড়ে দিত— নিজে আলাদা করে লিখবার সময়ই তার হত না। ‘মিচুচ্চো, মা যা লিখছেন সব ঠিক কথা। ভাল থেকো, আমাকে ভালবেসো।’ নিজেদের মধ্যে তারা ব্যবস্থা করে নিয়েছিল যে পাঁচ-ছ’বছর মিচুচ্চো তাকে একেবারে ছেড়ে থাকবে, আর এই সময়ে সে নিজের চেষ্টায় নিজের পথ তৈরি করে নেবে। দু’জনেই ছেলেমানুষ— অপেক্ষা করতে বাধা নেই। কাটল পাঁচ বছর। এই পাঁচ বছরে মিচুচ্চোর আত্মীয়রা তেরেসিনার নামে, তার মা’র নামে নানারকম কলঙ্ক রটাবার চেষ্টা করেছে; এদিকে মিচুচ্চো সেসব মিথ্যা প্রমাণ করবার জন্যে ওদের সব চিঠিপত্র সকলকেই দেখিয়েছে, যে যখন দেখতে চেয়েছে তাকেই দেখিয়েছে। তারপর তার অসুখ করল, বাঁচবার আশা ছিল না। ঠিক এমনি সময়ে মার্থা মাসি আর তেরেসিনা তার ঠিকানায় মোটা অঙ্কের টাকা পাঠিয়েছিল সে তখন তা জানতেও পায়নি।

কিছু টাকা তার অসুখে উবে গিয়েছিল, বাকিটা সে গায়ের জোরে ছিনিয়ে নিয়েছিল তার লোভী আত্মীয়দের হাত থেকে। সে টাকা এখন সে তেরেসিনাকে ফিরিয়ে দেবে। চায়নি, এ টাকা সে চায়নি। দয়ার দান বলে যে তার অপমান হয়েছে তা নয়— তেরেসিনার পিছনে সে তো কতই খরচ করেছে— আর এখন তো দেখতে পাচ্ছে যে এ বাড়িতে ওই টাকা ক’টার থাকা না-থাকায় কিছুই এসে যায় না। এতগুলি বছর সে অপেক্ষা করেছে না-হয় আরও অপেক্ষা করবে। তেরেসিনার আর্থিক সচ্ছলতায় এইটেই বোঝা যাচ্ছে যে ভবিষ্যতের পথ তার খুলে গেছে, তবে আর দেরি কেন? যারা কথাটা শুনে হেসেছে তাদের অবিশ্বাস অতিক্রম করে সেই পুরনো অঙ্গীকারের উদ্ঘাপণ এখনও কি হবে না?

মিচুচ্চো উঠে দাঁড়াল। মনে-মনে যে-সিদ্ধান্তে সে পৌঁছিয়েছে, যেন তারই সমর্থনে তার কপালে কয়েকটা মোটা মোটা রেখা ফুটল। বরফের মতো ঠান্ডা হাতে আবার ফুঁ দিয়ে সে অসহিষ্ণুভাবে পা দিয়ে মেঝে ঠুকতে লাগল। বাটলার তার পাশ দিয়ে যেতে যেতে বললে, ‘কী, শীত করছে? রান্নাঘরে যাও না, ওখানে বেশ আরামে থাকবে।’

বাটলারের নবাবি হাবে-ভাবে মিচুচ্চোর কেমন যেন অপ্রস্তুত লাগল, তার সদুপদেশ শুনে একটুও খুশি হল না। আবার বসে বসে ভাবতে লাগল। খারাপ লাগছিল তার, ভাবনা হচ্ছিল। একটু পরেই দরজার বেল জোরে বেজে উঠল। চমকে উঠল মিচুচ্চো।

‘দোরিনা, মাদাম এসেছেন’ বাটলার তারস্বরে বলে উঠল, তারপর তার কোটটি দু’হাতে ধরে গায়ে চড়াতে চড়াতে ছুটে দরজা খুলতে গেল। মিচুচ্চো তার পিছন-পিছন আসছিল, সে বাধা দিয়ে বললে, ‘তুমি আসছ কেন? বোসো গিয়ে, আমি মাদামকে আগে খবর দিই।’ পরদার পিছন থেকে একটা তন্দ্রাচ্ছন্ন কাতর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘উ-উ-উঃ!’ তারপর একজন স্ত্রীলোক বেরিয়ে এল, মস্ত মোটা, চুলে কলপ। চোখ পর্যন্ত শাল মুড়ি দিয়ে আধো ঘুমের মধ্যে থপথপ করে সে এগিয়ে এল। মিচুচ্চো বড় বড় চোখে তার দিকে তাকাল, সে-ও কপাল থেকে চোখ বের করে অচেনা লোকটিকে দেখে নিলে। ‘মাদাম এসেছেন,’ মিচুচ্চো তাকে আর-একবার খবরটা জানিয়ে দিলে। দোরিনা হঠাৎ যেন জেগে উঠে বললে, ‘যাই—।’ শালটা পরদার পিছনে ছুড়ে ফেলে সে তার বিপুল দেহটিকে দরজার দিকে এগিয়ে নিয়ে চলল।

একে তো বাটলার তাকে ওখানেই বসিয়ে রেখে গেল, তার উপর সেই কলপ-মাখা বিকট মূর্তি! মিচুচ্চোর এতক্ষণের প্রতীক্ষা হঠাৎ যন্ত্রণাময় আশঙ্কায় পরিণত হল। মার্থামাসির কণ্ঠস্বর সে শুনতে পেল— ‘খাবার ঘরে! দোরিনা খাবার ঘরে!’ একটু পরে বাটলার আর দোরিনা ঝুড়ি-ঝুড়ি মহার্ঘ ফুল হাতে নিয়ে তার পাশ দিয়ে চলে গেল। উজ্জ্বল আলো জ্বলছে ওদিককার ঘরে, দরজা দিয়ে মাথা বের করে সে সেদিকে তাকাল। লম্বা ঝুলওয়ালা কালো সান্ধ্য কোর্তায় অনেকগুলি ভদ্রলোক বসে আছেন, তাঁদের কথাবার্তা গোলমালের মতো শোনাচ্ছে। দৃষ্টি অস্পষ্ট হয়ে এল তার। তার হৃদয় যত উদ্বেল, তার মন ততই বিস্ময়-বিমূঢ়— সে বুঝতেও পারেনি কখন তার চোখ জলে ভরে গেছে। একটি দীর্ঘ উচ্চহাসি তার বুকের মধ্যে ব্যথার মতো এসে লাগল— অন্ধকারে চোখ বুজে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সে যেন সেই আঘাত সামলে নিলে। কার হাসি? তেরেসিনার? হা ঈশ্বর! ওখানে, ও-ঘরে বসে অমন করে সে হাসছে কেন?

একটা চাপা চিৎকার শুনে সে চোখ খুলল। তার সামনে মার্থামাসি দাঁড়িয়ে। তাকে আর চেনা যায় না। মাথার টুপি সে এখনও খোলেনি, দামি মখমলের ক্লোকটির ভারে যেন নুয়ে পড়েছে। এ কী হতচ্ছাড়া বুড়ির মতো চেহারা হয়েছে তার।

‘মিচুচ্চো! তুমি!’

মিচুচ্চো প্রায় ভয় পেয়ে বলে উঠল, ‘মার্থামাসি…’

বুড়ি যেন দিশেহারা হয়ে বলতে লাগল, ‘কী কাণ্ড! কখন এলে তুমি? একটা খবর তো দিতে হয়! তোমার কিছু হয়নি তো? এক্ষুনি এলে? সন্ধেবেলা?… তাই তো… তাই তো…’

‘আমি এসেছিলাম…’ কী বলবে ভেবে না পেয়ে মিচুচ্চো আমতা-আমতা করতে লাগল।

মার্থামাসি ব্যস্তভাবে বলল, ‘তাই তো, মুশকিল হল। একটু বসো তুমি— দেখছ তো কত লোকজন এসেছে— আজ তেরেসিনার জয়ন্তী, জয়ন্তী উৎসব… একটু… একটু বোসো এখানে…’

মিচুচ্চো বলতে চেষ্টা করল, ‘মাসি, তুমি… তুমি যদি বলো, আমি না হয়… চলেই যাই।’ কথাগুলো তার গলায় যেন আটকে-আটকে গেল, দম বন্ধ হয়ে এল তার।

‘না, না, বোসো বোসো একটু,’ মাসি তাড়াতাড়ি বললে। ভারী ভাল মানুষ বেচারা, কিন্তু কী করবে, কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না।

মিচুচ্চো বললে, ‘এখন… এই রাত্তিরে… কোথাও যাবার জায়গাও নেই আমার।’

দস্তানা-পরা হাতে মিচুচ্চোকে বসতে ইঙ্গিত করে মার্থামাসি বেরিয়ে গেল, তাকে খাবার ঘরে ঢুকতে দেখে মিচুচ্চোর মনে হল যেন একটা গহ্বরের মুখ হাঁ করে তাকে গিলতে আসছে। খাবার ঘরটি হঠাৎ চুপচাপ। তারপর সে শুনতে পেল, স্পষ্ট শুনতে পেল তেরেসিনার গলা, ‘আমি এক্ষুনি আসছি— এক মিনিট।’

আবার দৃষ্টি অস্পষ্ট হল। সে আসছে তাকে দেখবে। কিন্তু তেরেসিনা এল না, খাবার ঘরের কলরব নতুন করে আরম্ভ হল। কয়েক মিনিট পরে— মিচুচ্চোর মনে হল এক যুগ পরে— মার্থামাসি আবার এল। এবারে তার টুপি, দস্তানা, ক্লোক, সব ছেড়ে এসেছে, অতটা দিশেহারা ভাবও আর নেই। মাসি বললে, ‘এখানেই বসা যাক, কেমন? আমি বসি তোমার কাছে।… ওরা সব ডিনারে বসেছে কিনা। তুমি আমি এখানেই একটু খেয়ে নেব… কত কথা মনে পড়ছে তোমাকে দেখে… বিশ্বাস হচ্ছে না যে সেই তুমি আর সেই আমি… আবার একসঙ্গে… অনেক লোকজন এসেছে ওখানে, কিছু মনে কোরো না তুমি। বোঝো তো, ইচ্ছে থাকলেও ওর উপায় নেই। জীবনে ওকে উন্নতি করতে হবে তো… আর উন্নতি করতে হলে এ সব হবেই। কী সব এলাহি কাণ্ড— পড়োনি কাগজে? হইচই লেগেই আছে। বুড়ো হাড়ে কি এত সয়। কিন্তু আমি আর ক’দিন! কী যে ভাল লাগছে তোমাকে দেখে… বিশ্বাস হচ্ছে না।’

বুড়ির কানে-কানে কে যেন বলে দিয়েছিল, অনর্গল বকে যাও, মিচুচ্চোকে ভাবতে সময় দিয়ো না। একটানা অনেকক্ষণ বকবক করে মাসি স্নেহভরা দৃষ্টিতে মিচুচ্চোর দিকে তাকিয়ে হাতে হাত ঘষে একটুখানি হাসল।

দোরিনা ব্যস্তসমস্ত হয়ে খাবার টেবিল সাজাতে এল—তার এক মুহূর্ত সময় নেই, খাবার ঘরে ডিনার আরম্ভ হয়ে গেছে কিনা।

মুখ অন্ধকার করে বেদনাদীর্ণ গলায় মিচুচ্চো বললে, ‘মাসি, সে কি আসবে না? একবার তার দেখা পাব তো?’

একটু চেষ্টা করে অপ্রতিভ ভাবটা কাটিয়ে উঠে মাসি বললে, ‘বাঃ, তা আসবে না! একটু একা হতে পারলেই আসবে— আমাকে তাই বলল তো।’

এতক্ষণে যেন পরস্পরকে তারা চিনতে পারল। সেই চেনার আলো জ্বলে উঠল তাদের হাসিতে, সেই হাসিতে ভর করে সব আড়ষ্টতা, সব আবেগের আন্দোলন পার হয়ে তাদের মনপ্রাণ পরস্পরকে স্পর্শ করল। মিচুচ্চো তার চোখ দিয়ে বললে, ‘তুমি সেই মার্থামাসি তো?’ আর মাসির চোখ বললে, ‘আহা, এই তো আমার সেই মিচুচ্চো!’ কিন্তু মাসি তার চোখ তক্ষুনি নামিয়ে নিলে, পাছে মিচুচ্চো সেখানে আরও কিছু পড়ে। হাতে হাত ঘষে বললে, ‘খাবে নাকি এখন?’

আশ্বাসের, সুখের স্বরে মিচুচ্চো বললে, ‘খাব না! খিদে পেয়েছে যে!’

‘আগে গ্রেস বলো। এখানে, তোমার সামনে বসে আমারও বলতে লজ্জা নেই।’ মাসি দুষ্টু-দুষ্টু চোখে তাকিয়ে বুকের উপর ক্রুশের চিহ্ন করতে করতে চোখ টিপল।

বাটলার এল প্রথম কোর্স নিয়ে। মিচুচ্চো তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করল, দেখল, মাসি কেমন করে খাবারটা তুলে নেয়। কিন্তু নিজে নিতে গিয়ে মনে পড়ল যে অতটা পথ ট্রেনে আসার পর তার হাত এখনও নোংরা। লজ্জায় লাল হয়ে বাটলারের দিকে চোখ তুলল, বাটলার— তার ভঙ্গি এখন বিনয়বিগলিত— মাথা নিচু করে একটু হাসল, ভাবখানা এইরকম, ‘আজ্ঞে যা ইচ্ছে তুলে নিন।’ ভাগ্যিস মাসি তাকে উদ্ধার করলে, নয়তো কী উপায় হত! ‘মিচুচ্চো, আমি তোমাকে দিচ্ছি।’ কৃতজ্ঞতায় তার মনে হল মাসিকে চুমু খায়।

তার পাতে যেই খাবার দেওয়া হল আর বাটলারও বেরিয়ে গেল, সে তক্ষুনি খুব তাড়াতাড়িতে একবার ক্রুশচিহ্ন করে নিলে। মাসি খুশি হয়ে বললে, ‘লক্ষ্মী ছেলে!’

এবারে সে সহজ হল, মনটা ভারী ভাল লাগল তার। বাটলারের কথা, নিজের নোংরা হাতের কথা আর একবারও না-ভেবে সে এমন ভাবে খেতে আরম্ভ করল যেন জীবনে এর আগে সে কখনও খাবার দ্যাখেনি। তবু, যখনি বাটলার এ ঘর ও ঘর আসা যাওয়া করতে-করতে কাচের দরজাটি খুলেছে, যখনি ও ঘর থেকে হাসি আর কথার উচ্ছ্বসিত অস্পষ্ট ঢেউ তার কানে এসে লেগেছে, তখনি সংশয়-ভরা দৃষ্টিতে মাসির সস্নেহ চোখের দিকে সে তাকিয়েছে— ওখানে কি লেখা আছে তার প্রশ্নের উত্তর? না, তা তো নেই, বরং মাসির চোখে সে যেন এ কথাই পড়েছে, ‘লক্ষ্মী, এখন কিছু জিজ্ঞেস কোরো না— বোঝাপড়া পরে হবে।’ তারপর দু’জনেই একটু হেসে আবার খেতে আরম্ভ করেছে। কত কথা— তাদের! দেশের কথা, দেশের লোকদের কথা মাসি খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে কত যে জিজ্ঞেস করতে লাগল তার আর অন্ত নেই।

‘একটা ড্রিঙ্ক নাও, মিচুচ্চো।’

মিচুচ্চো বোতলটার দিকে হাত বাড়াল, কিন্তু সেই মুহূর্তে খাবার ঘরের দরজা আবার খুলে গেল: খশখশে রেশমি আওয়াজ, দ্রুত পদশব্দ, একটু আন্দোলন, একটু বিদ্যুৎ-চমক, ছোট্ট ঘরটি যেন হঠাৎ আলো হয়ে উঠে তার চোখ ধাঁধিয়ে দিলে।

‘তেরেসিনা…’

চরম বিস্ময়ে তার মুখের কথা ঠোঁটের উপর মিলিয়ে গেল। এ কী? এ কি স্বপ্ন!

যেন একটা মূর্ছার মধ্যে সে তাকিয়ে রইল হাঁ করে। তার মুখ জ্বালা করছে, তার চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে। এ কি সেই? এই তেরেসিনা এই রকম? তার বুক নগ্ন, তার কাঁধ নগ্ন, তার হাত নগ্ন… চিকচিক করছে সাটিন, ঝলমল করছে হিরে। এ কি সত্যিকার মানুষ, এ কি সত্যি?… কী বলছে সে? এই স্বপ্নের কিছুই তার চেনা নয়, না চোখ, না হাসি, না কণ্ঠস্বর।

‘কেমন আছ, মিচুচ্চো? তোমার না অসুখ করেছিল— এখন বেশ সেরে উঠেছ তো? বেশ, বেশ।… আচ্ছা, আবার দেখা হবে। এই তো মা রইলেন তোমার কাছে। ঠিক আছে?’

বলতে বলতে তেরেসিনা ছুটে আবার খাবার ঘরে চলে গেল।

মার্থামাসি মিচুচ্চোকে তার বিমূঢ়তা থেকে টেনে তোলবার চেষ্টা করল।— ‘মিচুচ্চো আর খাচ্ছ না যে?’

মিচুচ্চো তার দিকে ফিরেও তাকাল না।

মাসি থালার দিকে দেখিয়ে জোর করলে, ‘খাও।’

মিচুচ্চো তার নোংরা কুঁচকোনো কলারের মধ্যে দু’আঙুল চালিয়ে দিয়ে গভীর নিশ্বাস নেবার চেষ্টা করলে।… ‘খাব?’ তার থুতনির কাছে আঙুল নিয়ে কয়েকবার নাড়ল, যেন বলতে চায়, ‘আর না— সত্যি আর খেতে পারব না।’ স্তব্ধ হয়ে সে বসে রইল, চূর্ণ, ছিন্ন কয়েক মিনিট আগেকার দেখা স্বপ্নে মগ্ন। তারপর অস্ফুটে বললে, ‘কী হয়েছে ও? কী হয়েছে?…’

তার চোখে পড়ল যে মার্থামাসি অত্যন্ত হতাশভাবে মাথা নাড়ছে, সে-ও আর খাচ্ছে না, অপেক্ষা করছে যেন।

‘আর তো হবে না… না, অসম্ভব’, চোখ বুজে প্রায় নিজের মনে-মনেই মিচুচ্চো আবার বললে।

বোজা চোখের অন্ধকারে সে দেখতে পেল তার আর তেরেসিনার মাঝখানে অতল গহ্বর। না, না, এ তো সে নয়, তার তেরেসিনা তো এ নয়। সব চুকে গেছে— অনেক, অনেকদিন আগেই।

অনেক, অনেকদিন আগে— আর সে কিনা বুঝতে পারল এইমাত্র। বাড়ির লোক তাকে এ কথাই তো বলেছে, সে কিছুতেই বিশ্বাস করেনি। বোকা! বোকা!… আর এখন— এখনই-বা এই বাড়িতে নির্বোধের মতো সে বসে আছে কেন? যদি ওসব ভদ্রলোকেরা জানতেন, যদি বাটলারটাও জানত যে সে, মিচুচ্চো বোনাভিনো, দেহের প্রতিটি স্নায়ু ক্ষয় করে ছত্রিশ ঘণ্টা ট্রেনে চড়ে অত দূর থেকে এখানে এসেছে, এসেছে এই স্থির বিশ্বাস নিয়ে যে এখনও সে তার সেই স্বপ্নরূপিনীর ভাবী স্বামী, তা হলে ওই ভদ্রলোকেরা, ওই বাটলারটা, ওই বাবুর্চি, বয়, দোরিনা— এদের সকলেরই মুখে হো-হো-হো-হো হাসি কি সহজে থামত! কী হাসি, কী হাসির উল্লাস, যদি তেরেসিনা তাকে ধরে নিয়ে যেত ওই খাবার ঘরে, ভদ্রলোকদের সামনে, নিয়ে গিয়ে বলত, ‘দেখুন আপনারা, এই গোবেচারা ছোট্ট মানুষটি, এই বাঁশিওলা— সে আমাকে বিয়ে করতে চায়।’ সত্য, তেরেসিনা নিজেই কথা দিয়েছিল, কিন্তু তখন তো ভাবাও যায়নি যে সে মেয়ে একদিন এই হবে! এ কথাও সত্য যে তেরেসিনার এই জীবন মিচুচ্চোর চেষ্টাতেই সম্ভব হয়েছে, এখানে পৌঁছবার পাথেয় সেই জুগিয়েছিল— কিন্তু তেরেসিনা কত দূরে, কত দূরে চলে এসেছে, আর সে পড়ে আছে সেখানেই, ঠিক সেই আগের মতোই, রবিবারে পার্কে বসে এখনও সে বাঁশি বাজায়। আর কি তার কাছে পৌঁছবার তার উপায় আছে? না, সে কথাই আর ওঠে না। আর এই যে তেরেসিনা আজ একজন জমকালো ভদ্রমহিলা হয়েছে, তার কাছে তার সেই সামান্য টাকা ক’টা কী? কেউ মনে করেনি তো সেই নগণ্য টাকা ক’টার বিনিময়ে আজ সে কোনও দাবি জানাতে এসেছে? ছি, ছি, কী লজ্জা! কী লজ্জা! তার মনে পড়ল তার অসুখের সময় তেরেসিনা যে টাকা পাঠিয়েছিল সেটা তার পকেটেই আছে। লাল হয়ে উঠল তার মুখ, লজ্জায় সে যেন মরে যাবে। উঁচু হয়ে ওঠা বুক পকেটে এক হাত ঢুকিয়ে সে বললে, ‘মাসি, সেই যে তুমি আমাকে টাকা পাঠিয়েছিলে, সেটা ফেরত দিতেও এসেছিলাম আমি। কেন পাঠিয়েছিলে বলো তো? প্রতিদান? ঋণশোধ? তেরেসিনা তো এখন… এখন তো সে একজন “স্টার”… আমার মনে হয় না, কিছু না, অসম্ভব! কিন্তু এই টাকাটা— এই টাকাটা কেন— কোন অপরাধে আমার এই শাস্তি? ওসব চুকে গেছে, ও বিষয়ে আর একটি কথা না… কিন্তু এই টাকাটা তুমি রেখে দাও, মাসি— সব নেই, কিছু কম আছে, এই আমার যা দুঃখ!’

‘কী বলছ তুমি বাছা?’ জলভরা চোখে মার্থামাসি তার কথায় বাধা দেবার চেষ্টা করল। ইঙ্গিতে তাকে চুপ করতে বলে মিচুচ্চো বলতে লাগল, ‘ওটা আমি খরচ করিনি, মাসি। আমার অসুখের মধ্যে আমার আত্মীয়েরা… আমি কিছুই জানতুম না। কিছু কমই রইল, আমিও তো ওর পিছনে অল্প-স্বল্প কিছু খরচ করেছিলাম।… ঠিক আছে তা হলে?… টাকাটা নাও, মাসি, আমি চললাম।’

‘সে কী! এক্ষুনি!’ মাসি তাকে ধরে রাখবার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে উঠল। ‘একটু বোসো— তেরেসিনার সঙ্গে কথা বলে যাও। তোমার সঙ্গে আবার দেখা করবার তার কত ইচ্ছে, বুঝলে না? বোসো তুমি, আমি ডেকে দিচ্ছি।’

মিচুচ্চো দৃঢ়ভাবে জবাব দিলে, ‘না— কী হবে আর। ওখানে ওই ভদ্রলোকদের সঙ্গে আছে, ওখানেই থাক, ওখানেই মানায় ওকে। আমি হতভাগা… যাক, ওকে চোখে দেখেছি, সেটুকুই আমার যথেষ্ট,… বেশ, বেশ, যেতে চাও তো তুমিও যাও, মাসি, তুমিও যাও ওখানে, বসে বসে তাদের হাসি শোনো গে।… আমি ওদের হাসি ঠাট্টার উপলক্ষ হতে চাই না —আমি চললুম।’

মিচুচ্চোর এই আকস্মিক দৃঢ় সংকল্পের সবচেয়ে খারাপ অর্থটিই মাসির মনে উদয় হল। মাসি ভাবলে যে মিচুচ্চোর এটা ঈর্ষার ভঙ্গি, ঘৃণার ব্যঞ্জনা। সম্প্রতি তার মনে হচ্ছিল যে তার মেয়েকে দেখে যে-কোনও লোক তক্ষুনি ভাববে… যা ভাববে তা মুখে আনা যায় না। এইজন্যেই মাসির চোখের জল আজকাল আর শুকোয় না— এত ঐশ্বর্য, এত সমারোহের ভিতরে তার দুঃখের বোঝা অবিশ্রান্ত বহন করে চলেছে সে। ঐশ্বর্য! জঘন্য এই ঐশ্বর্য— এতে তার বার্ধক্য অভদ্র, অশ্রদ্ধেয় হয়ে উঠল!

মাসি বলে ফেলল, ‘মেয়েকে আমি তো আর সামলাতে পারি না, মিচুচ্চো।’

‘কেন পারো না?’ জিজ্ঞেস করেই মিচুচ্চো মাসির চোখে প্রশ্নের উত্তর দেখতে পেল। এর আগের মুহূর্ত পর্যন্তও এ সন্দেহ তার মনে আসেনি। মুখ কালো হল তার। ও, তাই!

মাসি যেন আরও ছোট্ট হয়ে, আরও বুড়ো হয়ে নিজের দুঃখের অতলে তলিয়ে গেল। দু’হাতে সে মুখ ঢেকে আছে, আঙুলগুলো থরথর করে কাঁপছে, চোখের জল কিছুতেই আর সামলাতে পারছে না।

কাঁদতে-কাঁদতে মাসি বললে, ‘তাই ভাল বাছা, তাই ভাল। তুমি চলে যাও। ঠিক বলেছ তুমি, ও আর তোমার নয়। তখন যদি আমার কথা শুনতে তা হলে আর…’

‘তখন!’

মিচুচ্চো নিচু হয়ে মাসির মুখ থেকে জোর করে একখানা হাত সরিয়ে নিলে! কিন্তু সে মুখে এত দুঃখ, এত যন্ত্রণা— ঠোঁটের উপর একটি আঙুল রেখে, এমন করুণ অসহায় চোখে মাসি তার দিকে তাকিয়ে যেন তার দয়াভিক্ষা করল যে মিচুচ্চো নিজেকে সংযত করে কঠিন চেষ্টায় কণ্ঠস্বর নরম করল, অন্য রকম সুরে বললে, ‘মাসি, আমি যেমন অপদার্থ, তুমি… তুমিও তা হলে তেমনি?… কিন্তু যাকগে ও সব, আমি এখন চলি… এখন তো আরও বেশি আমার চলে যাওয়ার দরকার।… মাসি, আমি একটা মূর্খ, কিছুই বুঝিনি। কেঁদো না, মাসি, কেঁদে কী হবে। টাকা… লোকে ঠিকই বলে… টাকা…’

ছোট্ট আট্যাশে কেস আর ব্যাগটি টেবিলের তলা থেকে তুলে নিয়ে যাবার জন্য সে পা বাড়িয়েছে, এমন সময় তার মনে পড়ল যে ব্যাগের মধ্যে ভরে কয়েকটা কমলালেবু তেরেসিনার জন্য সে দেশ থেকে এনেছিল।

‘শোনো, মাসি’ —

ব্যাগের মুখ খুলে সুগন্ধি টাটকা ফলগুলি সে টেবিলের উপর ঢালল।

‘ওখানে যারা এসেছে তাদের মুখের উপর এই ফলগুলি যদি ছুড়ে মারি, তা হলে কেমন হয়?’

‘পাগল নাকি!’ মাসি ফোঁসফোঁস করতে করতে আর-একবার তাকে শান্ত হতে বলল।

তিক্ত হেসে মিচুচ্চো শূন্য ব্যাগটি তার পকেটে ভরে রাখল।—

‘বেশ, ছুড়ব না। এগুলি ওর জন্যেই এনেছিলাম, এখন তোমাকেই সব দিয়ে যাচ্ছি, মাসি।’ একটা লেবু তুলে নিয়ে মাসির নাকের কাছে ধরল। ‘কেমন গন্ধ, মাসি! আমাদের দেশের মিষ্টি গন্ধটুকু পাচ্ছো কি? এর জন্যে আমাকে আবার কাস্টমস-এর ট্যাকসোও দিতে হয়েছে! যথেষ্ট হয়েছে! আর না! মনে রেখো, এ শুধু তোমাকেই দিয়ে গেলাম।… আর ওকে, ওকে আমার শুভ-কামনা জানিয়ো।’

আট্যাশে কেসটি তুলে নিয়ে সে বেরিয়ে গেল, কিন্তু সিঁড়িতে এসেই দারুণ একটা ভয়ে অভিভূত হয়ে পড়ল। দেশ থেকে অনেক দূরে, মস্ত অচেনা শহরে সে একা, সে পরিত্যক্ত— এদিকে রাত গভীর হয়ে আসছে। মোহ ছুটেছে তার, মান লুটিয়েছে ধুলোয়, সে পদচ্যুত, সে অবজ্ঞাত। বাইরের দরজার কাছে এসে দেখল অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। এই বৃষ্টির মধ্যে অচেনা রাস্তায় পা বাড়াবার সাহস তার হল না। পা টিপে-টিপে ফিরে এল, এক প্রস্থ সিঁড়ি উঠে এসে উপরের ধাপে বসে হাঁটুতে কনুই আর হাতে মাথা রেখে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। ডিনার হয়ে যাবার পর, সিনা মার্নিস আবার সেই ছোট্ট ঘরটিতে এল। দেখল তার মা একা বসে বসে কাঁদছে, এদিকে ওরা সবাই হাসি-গল্পে-ঠাট্টায় মশগুল। অবাক হয়ে বললে, ‘ও কোথায়? চলে গেছে?’ মাসি মেয়ের দিকে না-তাকিয়ে শুধু একটু মাথা নাড়ল। সিনা শূন্যের দিকে তাকিয়ে গভীর একটি নিশ্বাস ছেড়ে অস্ফুটে বললে, ‘বেচারা! বেচারা!…’ কিন্তু একটু পরেই তার মুখের ভাব বদলে গেল।

চোখের জল লুকোবার কোনও চেষ্টা না-করে মাসি বললে, ‘এই দ্যাখ, এগুলো সে তোর জন্যে এনেছিল।’

সিনা লাফিয়ে উঠে বললে, ‘ট্যাঞ্জারিন লেবু! সিসিলির ট্যাঞ্জারিন! কী সুন্দর!’ দু’হাত ভরে যে-ক’টা সম্ভব চটপট সে তুলে নিল।

মাসি আর্দ্রস্বরে বললে, ‘এগুলো ওখানে নিসনে, ওখানে নিসনে।’ কিন্তু সিনা একটুখানি কাঁধ-ঝেঁকে ছুটে খাবার ঘরে গিয়ে চেঁচিয়ে বললে, ‘কমলালেবু! ট্যাঞ্জারিন লেবু! সিসিলির ট্যাঞ্জারিন!’

—বুদ্ধদেব বসু

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *