কয়লাখনির ভূত
ঘটনাটি শুনেছিলাম আমার এক বন্ধুপত্নীর মুখ থেকে। তিনি অনুরোধ করেছিলেন সব নাম-ধাম গোপন রাখতে তাই কিছুটা কল্পনার আশ্রয় নিতে হল।
ধরা যাক বন্ধুপত্নীর নাম চন্দনা। তার তখন দশ বছর বয়স। ওর বাবা সেসময় ধানবাদে চাকরি করতেন। চন্দনার এক দাদা ছিল, তার মাথায় সবসময় দুষ্টুমি বুদ্ধি খেলত, বিশেষ করে ছোটোদের ভয় দেখাবার ব্যাপারে সে ছিল ওস্তাদ।
ওদের এক মেজোদাদু, মানে মায়ের আপন মেজোকাকা, সেইসময় ধানবাদ থেকে মাইল কুড়ি দূরে একটা কোলিয়ারির ম্যানেজার হয়ে এলেন। তখনও কোলিয়ারিগুলি সরকার থেকে নিয়ে নেওয়া হয়নি। যে কোলিয়ারির কথা বলছি, তার মালিক তখন ছিলেন ছন্দের জাদুকর বিখ্যাত এক কবির ভাই। তিনি আবার ওটা কিনেছিলেন এক ইংরেজ মালিকের কাছ থেকে।
মেজোদাদু প্রথমে ধানবাদে চন্দনাদের বাড়িতে এসে উঠেছিলেন, এক রাত্রি সেখানে কাটিয়ে পরদিন সকালে ওদের নিয়ে তিনি গাড়িতে কোলিয়ারির দিকে রওনা দিলেন।
কোলিয়ারিটা একটা মালভূমির মতো জায়গায়। চারদিক সবুজ, সুন্দর, শুধু একটাই ব্যতিক্রম, এখানে ওখানে খানাখন্দ ফলে গাড়ির ভেতর সবাইকে বেশ কয়েকবার ঝাঁকুনি সহ্য করতে হল।
মেজোদাদু নতুন ম্যানেজার হয়ে আসছেন, তার ওপর তিনি খোদ মালিকের বিশেষ প্রিয়পাত্র, তাই তাঁর সম্বর্ধনার কোনো ত্রুটি ছিল না। কুলি-মজুর থেকে শুরু করে সবাই জড়ো হয়েছিল তাঁর বাংলোর সামনে। একটা কথা বলা হয়নি, কুলি-মজুরদের বেশিরভাগই ছিল সাঁওতাল বা আদিবাসী।
মস্ত বড়ো বাংলো। আগে সাহেব ম্যানেজার ছিলেন তাই তিনি নিজের পছন্দমতো সব ঘর সাজিয়েছিলেন। হল ঘরের মতো পাঁচটা বিরাট বিরাট ঘর। দামি কাঠের দরজা, জাফরি কাটা রঙিন কাচের জানালা, প্রত্যেক ঘরে ফায়ার প্লেস বা আরাম-চুল্লি। বাংলোর পেছনে অনেকখানি জায়গা নিয়ে একটা বাগান। গোটা কুড়ি গোলাপ গাছে নানান রঙের বড়ো বড়ো গোলাপ ফুল ফুটে আছে, আর কোনো ফুলগাছ নেই, বাকিটা বড়ো বড়ো ঘাস আর বুনো গাছে ছেয়ে গেছে।
সেদিন আর রান্নাবান্নার পাট করতে হয়নি, এত খাবার এসেছিল যে কয়েকদিন উনুনে আঁচ দেবার দরকার হবে না। সবাই বিদায় নেবার পর খাওয়া সারতে সারতে বেলা হয়ে গেল। মেজোদাদু খেয়েই কোলিয়ারিতে চলে গেলেন। তিনি শুধু কাজের মানুষই ছিলেন না, অত্যন্ত সাহসী এবং শৃঙ্খলাপরায়ণ মানুষ ছিলেন। চেহারাটাও ছিল দশাসই, শক্তিধর এক মানুষ।
সন্ধের পর চন্দনা, ওর দাদা আর মেজোদিদার এক বোনের মেয়ে, সেও মেজোদাদুর সঙ্গে কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছিল, মাঝের একটা ঘরে বসে লুডো খেলছিল। ওরা একটা জানালার কাছে বসে ছিল। মস্ত জানালা, ওটা ছিল বাগানের দিকে মুখ করা। জানালা খোলাই ছিল। বাইরেটা গাঢ় অন্ধকার। তখন বিজলিবাতির অত ঘটা ছিল না, বাংলোর প্রত্যেক ঘরে ছিল ঝাড়লন্ঠন।
চন্দনার দাদা একবার মাথা তুলে জানালার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন অসাড় হয়ে গেল, তারপরই চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওটা কী! ওটা কী!’
ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে অন্য দু-জনও দেখল অন্ধকারের মধ্যে যেন জ্বলজ্বল করছে দুটো চোখ আর দু-পাটি সাদা দাঁত যেন হাসছে। মেজোদিদার বোনের মেয়ে গোঁ গোঁ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে গেল। ওদের চেঁচামেচিতে বাড়ির সবাই ছুটে এল। মেজোদাদু ধানবাদ থেকে কাজের লোক নিয়ে এসেছিলেন, তা ছাড়াও দু-জন বেয়ারা বাবুর্চি ছিল। কোম্পানি থেকেই তাদের মাইনে দেওয়া হত। তারাও এসে পড়ল, কিন্তু জানালায় আর কিছু দেখা গেল না।
মেজোদাদু ফিরে এসে সব শুনে চন্দনার দাদাকেই বকাবকি করলেন। অন্যদের ভয় দেখাবার ওর স্বভাব তাঁর অজানা ছিল না। হয়তো কোনো আদিবাসীকে শিখিয়ে পড়িয়ে ওখানে দাঁড়াতে বলেছিল। অন্ধকারে তার কালো শরীরটা দেখা যায়নি শুধু জ্বলজ্বলে চোখ আর সাদা দাঁতের পাটি দেখেই মেয়েরা ভয় পেয়েছে। চন্দনার দাদা যত বলে সে অমন কাজ করেনি, তিনি ততই তাকে ধমকান।
পরদিন চন্দনার মা ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ধানবাদে ফিরে গেলেন। ছেলে-মেয়েদের ইস্কুল খোলা আছে তাই থাকার উপায় নেই।
কয়েকদিন কেটে গেছে, মেজোদাদু কোলিয়ারি থেকে ফিরে সন্ধেবেলা সামনের লন-এ একটা আরামকেদারায় বসে বিশ্রাম করছিলেন। চারদিক অন্ধকার শুধু খানিক দূরে কোলিয়ারির অগুনতি আলো মিট মিট করে জ্বলছে।
হঠাৎ মেজোদাদুর নজরে পড়ল তার থেকে কয়েক গজ দূরে ডান দিকের এক কোণে কে যেন বিড়ি ফুঁকছে। মানুষটকে অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু বিড়ির আগুন একবার জ্বলে উঠছে তারপর নিভু নিভু হয়ে আসছে। মেজোদাদু যেন দেখেও দেখেননি এমনভাবে মুখ ফিরিয়ে রইলেন। তিনি একটা কোলিয়ারির ম্যানেজার, হাজার হাজার লোক তাঁর হুকুম মেনে চলে, দোর্দণ্ড তাঁর প্রতাপ, তাঁর সামনে কেউ বিড়ি ফুঁকবে এটা যেমন উচিত নয়, তেমন সেটা দেখাও উচিত নয় তাঁর।
পরে মেজোদিদাকে তিনি বললেন, ‘ওখানে কে বিড়ি টানছিল, না করে দিয়ো। পাশেই একটা গাড্ডা আছে, অন্ধকারে পা হড়কে পড়ে গেলে আর দেখতে হবে না।’
মেজোদিদা কাজের লোকজনকে সেকথা বলতে তারা যেন আকাশ থেকে পড়ল। কেউ ওখানে যায়নি, বিড়িও খায়নি। তা ছাড়া সাহেব ওখানে বসে আছেন, ওদের অত বুকের পাটা নেই যে তাঁকে দেখিয়ে দেখিয়ে বিড়ি ফুঁকবে।
মেজোদাদুর মনটা খুঁতখুঁত করল, তবে কি কয়লাখনির কোনো কুলি ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল! সাহস তো কম নয়!
দিন দুই পরে কোলিয়ারি থেকে একটু বিকেল বিকেল ফিরে তিনি একটা খুরপি আর নিড়ানি নিয়ে বাগানে গেলেন। মালিকে তিনি বলে দিয়েছিলেন বুনো ঘাস আর জংলা গাছ পরিষ্কার করতে। আজ তিনি গোলাপ গাছের গোড়ার মাটি উসকে দেবেন। পাথুরে জায়গা, গাছের গোড়া শক্ত জমাট হয়ে গেছে। কিন্তু পরিচর্যা ছাড়াই রোজ এত ফুল ফোটে সেটাই আশ্চর্য। গোলাপ খুব শৌখিন গাছ, ভালোমতো যত্ন না করলে শুকিয়ে মরে যায় অথচ এই গাছগুলো বিনা পরিচর্যায় ঝড়বৃষ্টি, গরম সব উপেক্ষা করে বেঁচেই শুধু নেই, মনে হয় যেন একেবারে তাজা, ফুলগুলিও তেমন টাটকা আর কী তাদের বাস! সমস্ত বাগানটা ম ম করে গোলাপ ফুলের গন্ধে।
মেজোদাদু খুরপি দিয়ে একটা গাছের গোড়ার মাটি আলগা করতে গিয়ে দেখলেন পাথরের মতো শক্ত হয়ে আছে। তিনি খুব জোরে খুরপিটা বসাবার জন্য হাত তুলেছেন, কে যেন পেছন থেকে তাঁর হাত চেপে ধরল। তিনি ভাবলেন আপিস থেকে ফিরেই বাগানের কাজে হাত লাগিয়েছেন বলে মেজোদিদাই বোধ হয় হাতটা চেপে ধরেছেন। তিনি একটু বিরক্ত হয়েই বললেন, ‘আঃ! কী হচ্ছে, ছাড়।’
কিন্তু তাতে কোনো ফল হল না দেখে তিনি পেছন ফিরে তাকালেন। আশ্চর্য! কেউ তো পেছনে নেই। ব্যাপারটা কী হল! তিনি আস্তে আস্তে হাতটা নামিয়ে নিলেন। হাত নাড়াচাড়া করতে কোনো অসুবিধে হচ্ছে না অথচ…।
চিন্তিত মুখে তিনি ঘরে ফিরে এলেন। মেজোদিদাকে এ ব্যাপারে কিছু বললেন না।
এরপর এক ছুটির দিনে তিনি খনির দু-জন মালকাটারকে বাড়িতে ডেকে পাঠলেন। দু-জনেই আদিবাসী, সাঁওতাল। তিনি তাদের গোলাপ বাগানের চারপাশের জমিটা কোপাতে বললেন, ও জায়গায় তিনি নতুন গাছ লাগাবেন।
লোক দুটি কেমন যেন ইতস্তত করতে লাগল। মেজোদাদু অবাক হয়ে বললেন, ‘কী হল?’
ওদের একজন বলল জমিটা পাথরের মতো শক্ত, কোপানো যাবে না।
মেজোদাদু রেগে গিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, আমিই তবে কোপাচ্ছি।’
তিনি একজনের হাত থেকে কোদালটা প্রায় কেড়ে নিয়ে মাথার ওপর তুলেছেন আর কোদালটা তাঁর হাত ফসকে পেছনদিকে পড়ে গেল।
মেজোদাদু ভাবলেন এসব কাজে তাঁর অভ্যাস নেই বলেই বোধ হয় কোদালটা ঠিকমতো ধরতে পারেননি। তিনি ওটাকে মাটি থেকে কুড়িয়ে নিতে যাবেন এমন সময় যার হাত থেকে তিনি ওটা কেড়ে নিয়েছিলেন, সে তাঁর দু-হাত চেপে ধরে অমন কাজ না করতে অনুরোধ করল।
মেজোদাদু অবাক হলেন। তিনি লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে সে বলল, সাহেবের মঙ্গলের জন্যই একথা সে বলছে।
পর পর কয়েকটি ঘটনায় মেজোদাদুর মনেও একটা খটকা জেগেছিল, তাই লোকটির স্পর্ধায় তিনি মেজাজ হারালেন না, শান্ত কণ্ঠে ব্যাপারটা কী জানতে চাইলেন।
লোকটি বলল সে কিছু গোপন করবে না কিন্তু সাহেব যেন একথা কাউকে না বলেন, তার মুখেই তিনি সব জেনেছেন এটা জানাজানি হলে তার শাস্তি হবে।
লোকটি এক বিচিত্র কাহিনি শোনাল। এই কোলিয়ারির আগের মালিক ছিলেন সাহেব, এখানকার ম্যানেজারও ছিলেন এক সাহেব— নিষ্ঠুর, বিবেকহীন এক মানুষ। একবার খনিতে দুর্ঘটনায় অনেক কুলি-মজুর মারা গিয়েছিল। সবাই ছিল আদিবাসী। হতাহতের সংখ্যা কম দেখাবার জন্য সাহেব রাতারাতি অনেক মৃতদেহ সরিয়ে ফেলেন। তাঁর হুকুমে ওই বাগানেই মাটির তলায় কুড়িজনের মৃতদেহ পুঁতে ফেলা হয়। সাহেব ওখানে গোলাপের চারা লাগিয়ে দেন। এইগুলিই সেই গোলাপ। ওদের তলায় আছে সেই হতভাগ্যদের মৃতদেহ। গোলাপগাছগুলি তাই এত বছরেও তাজা আর ফুলে ফুলে ভরে থাকে তাদের ডালপালা। এখানের জমিতে কেউ হাত দিতে গেলেই তার অমঙ্গল ঘটে। বাকি মৃতদেহগুলি এই মালভূমির এখানে-সেখানে গোর দেওয়া হয়েছিল, তাই এত খানাখন্দ, ভালো করে মাটি ভরাট করাও হয়নি।
ওই ঘটনার পর সেই সাহেব এখানে টিকতে পারেনি। লোকে বলে সাহেব খুব ভয় পেয়েছিলেন, কেন, সেটা কেউ জানে না। তারপর থেকে এই বাংলোয় কোনো ম্যানেজারই তেরাত্তির কাটাতে পারেননি। তাই এতদিন ম্যানেজারের পদটা খালি পড়ে ছিল। ওই লোকটি একথাও বলল যে, বাবু ব্রাহ্মণ, বাড়িতে গিন্নিমা জপতপ করেন তাই বোধ হয় তাঁদের কোনো অমঙ্গল হয়নি। এ নিয়ে কোলিয়ারিতে কথাও উঠেছে, বাবু বোধ হয় টিকে গেলেন।
মেজোদাদু চিন্তিত মুখে ঘরে ফিরে গেলেন, বাড়ির কাউকে এ ঘটনার কথা বললেন না।
আরও কয়েকদিন কেটে গেছে। মেজোদাদু একদিন গোধূলি বেলায় বাগানে বসে আছেন। তিনি ওই হতভাগ্য মজুরদের কথাই চিন্তা করছিলেন। যদি কোনো ক্রিয়াকর্ম করে ওদের আত্মার সদগতি করা যায় তাই চিন্তা করছিলেন। হঠাৎ তাঁর চমক ভাঙল। তাঁর সামনে হঠাৎ যেন মাটি ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক আদিবাসী যুবক। কালো গায়ের রং, কোঁকড়ানো চুল আর চাবুকের মতো ছিপছিপে চেহারা।
‘কে তুই,’ মেজোদাদু ভীষণ চমকে উঠে বললেন, ‘কোথা থেকে এলি?’
লোকটি দাঁত বার করে হাসল, ঝকঝকে সাদা দাঁত, তারপর আঙুল দিয়ে গোলাপ বাগানটা দেখিয়ে দিল।
মেজোদাদু ব্যাপারটা বুঝলেন না, তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
লোকটি নিজের বুকে হাত দিল তারপর আবার গোলাপ বাগানটার দিকে আঙুল দেখাল। মেজোদাদু তবু হাঁ করে তাকিয়ে আছেন দেখে সে গোলাপ বাগানের দিকে এগিয়ে গেল তারপর মেজোদাদুর চোখের সামনেই একটা গোলাপ গাছের তলায় অদৃশ্য হল, যেন মাটির তলায় ঢুকে গেল।
মেজোদাদু এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝলেন। হতভাগ্যদের একজনের প্রেতাত্মা তাঁর কাছে এসেছিল। তিনি যখন তাদের সদগতির কথা চিন্তা করছিলেন তখনই সে তাঁকে দেখা দিল। বোধ হয় মেজোদাদুর উদ্দেশ্যকে সাধুবাদ জানাতেই সে এসেছিল। অসমসাহসী মেজোদাদুর সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল, তিনি তাড়াতাড়ি বাড়ির ভেতর চলে গেলেন।
পরদিন তিনি মাল-কাটার সেই লোক দুটিকে ডেকে পাঠালেন, মৃত্যুর পর তাদের পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মের কথা জানতে চাইলেন। তারা বলল হিন্দুদের মতোই তাদের শব দাহ করা হয়। মেজোদাদু তখন তাঁর ইচ্ছে কথা বললেন, ওই হতভাগ্যদের মৃতদেহ মাটির তলা থেকে তুলে শাস্ত্রীয় নিয়মে তিনি তাদের দাহ করবেন। তাঁর বিশ্বাস তাহলে ওই হতভাগ্যদের আত্মা মুক্তি পাবে।
ওরা কিন্তু এবার মেজোদাদুর কথায় রাজি হয়ে গেল, শুধু তাই নয়, বলল তাদের স্বজাতিদের সবাইকে নিয়ে এসে মেজোদাদুকে এ কাজে সাহায্য করবে। মেজোদাদু পরদিনই কলকাতায় গিয়ে কোলিয়ারির মালিকের সঙ্গে দেখা করলেন, তাঁকে সব খুলে বললেন। সব শুনে তিনি বললেন, ‘এখন বুঝতে পারছি কেন কোনো ম্যানেজার ওই বাংলোয় টিকতে পারছিল না। আপনি সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ, আপনার উপবীতই আপনার রক্ষাকবচের কাজ করেছে।’
তিনি সানন্দে মেজোদাদুর প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন এবং ওই কাজের জন্য আলাদা টাকাও মঞ্জুর করলেন।
এক শুভদিনে আদিবাসীরা এসে কোদালে হাত লাগাল। কয়েকজন পুরোহিত মন্ত্র উচ্চারণ করে গঙ্গা জল ছিটোতে লাগলেন। এই কাজের জন্য কলসি কলসি গঙ্গাজল নিয়ে আসা হয়েছিল। ওই পুরোহিতদের মধ্যে আদিবাসীদের পুরোহিতও ছিল। এবার কিন্তু মাটি কোপাবার সময় কোনো বিঘ্ন ঘটল না।
মাটির তলা থেকে নরকঙ্কাল উদ্ধার হল কুড়িটি। কোনোটাই অক্ষত নেই। হয় করোটি বিচ্ছিন্ন হয়েছে নয় হাত-পা। চোখের জায়গায় গর্ত, দাঁতগুলি বেরিয়ে আছে। বীভৎস সেই দৃশ্য।
অনেকগুলো চিতা একসঙ্গে জ্বলল। পুরোহিতদের মন্ত্রপাঠের মধ্য দিয়ে আদিবাসীরাই তাদের প্রথামতো আগুন দিল সেইসব চিতায়। লেলিহান শিখা যেন আকাশে মিলিয়ে গেল।
তারপর থেকে ওই বাংলোয় আর কখনো প্রেতাত্মাদের উপদ্রব হয়নি। মেজোদাদু ওই কয়লাখনির কুলি মজুরদের উন্নতির জন্য অনেক কিছু করেছিলেন, ওখানকার আদিবাসীরা তাঁকে দেবতার মতো শ্রদ্ধাভক্তি করত। সেই কয়লাখনি আজও আছে তবে সেই জায়গাটা এখন আর চেনার উপায় নেই। বিজলিবাতি আর দালানকোঠায় একটা শহরই গড়ে উঠেছে সেখানে।