কম্বিনেশন লক

কম্বিনেশন লক

 এক

তিনতলার ছাদে বেশ সুন্দর একটা ঘর। সেটাকে আরও সুন্দর করে বড়মামা বললেন, ‘ওটা আমার ধ্যান-ঘর। ওই ঘরে আর কারও প্রবেশাধিকার রইল না। আমি গভীর ধ্যানে ডুবে থাকব। অনন্তের সীমানায় ডানা মেলে উড়ব। ভগবানের জানলায় বসব।’

মেজোমামা বললেন, ‘আর কা-কা করে ডাকব। ভগবান একটা গুলতি বের করে—’ঢাঁই!’ বড়মামা এতটুকু উত্তেজিত না হয়ে বললেন, ‘মেজো! এই সব ছোটখাটো কথার অনেক ঊর্ধ্বে চলে গেছি রে! আমাকে তোরা আর ধরে রাখতে পারবি না। তোদের জন্যে আমার দুঃখ হয়। আশীর্বাদ করি, তোদের যেন সুমতি হয়। পরিষ্কার মন, শুদ্ধ শরীর। এত বড় বংশের ছেলে, কিন্তু ভেতরটা আস্তাকুঁড়। হিংসা, লোভ, খাইখাই। শেম, শেম। নিজের ভাই বলে পরিচয় দিতে লজ্জা করে। যাক, আমাকেই বংশের মুখ উজ্জ্বল করতে হবে। পরে আমার নামেই তোদের পরিচয় হবে। ডাক্তার হিসেবে আমি তো বিখ্যাতই। এইবার হব সিদ্ধ সাধক। লোকে বলে, সাধক ডাক্তার। তাই ভাবি, এক-একটা মানুষ সাধনার জোরে কোথায় চলে যায়, আর এক-একটা মানুষ ‘পড়েই থাকি’ বলে নরককে স্বর্গ ভেবে শুয়ে-বসে দিন কাটায়। গাণ্ডেপিণ্ডে খায়, হাত-পা লিকলিকে, এত বড় একটা ভুঁড়ি। দুর্লভ মানব-জন্ম—বেকার বেকার।’ মেজোমামা বললেন, ‘থামলে কেন? বেশ তো হচ্ছিল। যাত্রাপালা। যাই হোক, ওই ঘরটা ছেলেবেলা থেকেই আমার। আমার ঘুড়ি-লাটাই থাকত। ওই ঘরে বসেই আমি ডক্টরেট করেছি। তুমি অন্য কোথাও বসে ধ্যান কোরো। জলের ট্যাঙ্কের তলাতেও বসতে পারো। কোনও একটা গুহায় চলে যাও না।’

‘অবশ্যই তোমার উপদেশে নয়। আমি গুরুগতপ্রাণ, গুরুর নির্দেশে চলি।’

‘তিনি কোথায়? যাঁর এমন উন্মাদ, বিপথগামী শিষ্য!’

‘ভারতবর্ষের কোথাও না কোথাও ধ্যানমগ্ন অবস্থায় আছেন। আমিই তাঁর একমাত্র মহান শিষ্য—যাকে তিনি বলেছেন, যখন যেখানে বসে ডাকবি তক্ষুনি আমি তোর সামনে এসে দাঁড়াব। দ্বাপরে আমি শ্রীকৃষ্ণকে পেয়েছিলুম, কলিতে পেয়েছি তোকে। যুগ কখনও খালি থাকে না রে জানোয়ার!’

‘তোমাকে জানোয়ার বলেন বুঝি! যাক চিনতে পেরেছেন!’

‘জানতুম, তোর খুব আনন্দ হবে; কারণ জানোয়ার শব্দটার শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যাটা তোর পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তুই একটা বিধর্মী বেইমান। ফাঙ্গাসের মতো, ভাইরাসের মতো। প্লেগ, ম্যালেরিয়া, চিকেনগুনিয়া। জানতে, জানতে মানুষের যখন কিছুই আর জানার বাকি থাকে না, তখনই গুরু তাকে ‘জানোয়ার’ উপাধিতে ভূষিত করে কোলে টেনে নেন। বলেন, আমার কাল শেষ হল, শুরু হল তোমার কাল।’

‘অর্থাৎ জানোয়ারের কাল। আমরা যদ্দূর জানি—তুমি তো মানুষ নও।’

‘অ্যাঁ! চিনতে পেরেছিস? তার মানে, জ্ঞানের দিকে, আলোর দিকে এগোচ্ছিস? আমার প্রভাব। হবেই তো! সূর্যের আলো গঙ্গার জলেও পড়ে, নর্দমার জলেও পড়ে। সূর্যদেব কারওকে বঞ্চিত করেন না। ভাই রে! মানুষ হ, মানুষ হ।’

‘মানুষ হয়েছি বলেই তো নিজের জ্ঞানে বুঝতে পেরেছি—তুমি একটি অহংকারের ফানুস। অন্ধকার আকাশে একটা কেলে বাদুড়। এ জন্মে তোমার পক্ষে মানুষ হওয়া সম্ভব নয়। বৃথা চেষ্টা।’

‘হুঁ! ভুল হয়েছে। এবার পাকাপোক্তভাবে বুঝে গেলুম—দানব কখনও মানব হতে পারে না। হলে রামায়ণ-মহাভারতের কালেই হয়ে যেত। তখন তাঁরা হাটে-ঘাটে-বাজারে সাধারণ মানুষের মতো ঘুরে বেড়াতেন। হঠাৎ হঠাৎ যে-কোনও ভক্তের বাড়িতে ঢুকে পড়ে বলতেন—ভক্ত! আজ তোমাকে কৃপা করব—ভাত, ডাল, পোস্ত খাব। যাক, তোমার পেছনে সময় নষ্ট করার মতো যথেষ্ট সময় আমার হাতে নেই। আমার প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। সব সময় আমাকে ভগবানের কাছে থাকতে হয়—Always be with God—বাইবেলে আছে। করুণাময়ের সঙ্গে স্যান্ডউইচের মতো সেঁটে থাকো।’

‘হ্যাঁ—উইচরা কোথায় যাবে—স্যান্ডেই সেঁটে থাকবে।’

বড়মামা মোড়ক খুলে এত বড় একটা ঝকঝকে তালা বের করলেন। তালাটা দেখিয়ে বললেন, ‘কম্বিনেশন লক। মেড ইন চায়না। এর নম্বর জানা না থাকলে খোলা যাবে না। এইটা আমার ধ্যানমন্দিরে লাগিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে জনসেবায় আত্মনিয়োগ করব। এখন সবই তো আমার কাছে পূজা। আহার আমি করি না, ব্রহ্ম করেন। আমার নিদ্রা—যোগনিদ্রা।’

বড়মামা ছাতে চলে গেলেন। এই বলতে বলতে নেমে এলেন, ‘এখন আমি নিশ্চিন্ত। কোনও উৎপাতের ভয় আর রইল না। বিধর্মী কালাপাহাড়রা কত মন্দির ভেঙেছে। তারা সব মরে ভূত। কাশী, সোমনাথ, পুরী, বৃন্দাবন, মথুরা—সবই আছে, থাকবে চিরকাল।’

মেজোমামার মুখের সামনে খবরের কাগজ। সেই আড়ালে শোনা গেল—’একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পদার্থবিদ বসে আছে এই চেয়ারে। সারা বিশ্বে তাকে নিয়ে হইচই। তার গলায় সোনার পদক ঝুলল বলে। এই পরিবার থেকে খুব শিগগিরি বেরিয়ে আসবে চিরস্মরণীয় এক বিজ্ঞনী। বাংলার গৌরব। সাত-আটটা সংখ্যার ধাঁধা? চিনে তালা! একটু ফুঁ। খুলে যাবে। অজ আমার অফ ডে। ইন্টারন্যাশনালে কোনও সেমিনার নেই আজ। ভৈরবকে দিয়ে ওই ঘরে আজই একটা ছোট্ট খাট তোলাব। শীত আসছে। রোদে বসে একের পর এক কমলালেবু খাব। বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে চোখ বুজিয়ে স্বপ্ন দেখব। কানে ‘কসমিক হেডফোন’ লাগিয়ে ভগবানের কথা শুনব। আর আমার যুগান্তকারী থিসিসটা কমপ্লিট করব। ‘পদার্থের দুনিয়ায় অপদার্থ’।’

‘হুঁ’ করে একটা শব্দ। বড়মামা নীচে নেমে গেলেন।

দুই

সকাল। লম্বা ছাদের একপাশে বড়মামা বিষণ্ণ হয়ে বসে আছেন।

জিগ্যেস করলুম—’ধ্যানে বসবেন না? আপনি যে বলেছিলেন সূর্য যখন জিরো-তে তখন স্টার্ট করবেন। সূর্য তো এখন দশ, কি পনেরোয়। এই দেখুন কত ফুল। গন্ধরাজ, চাঁপা। ঘর গন্ধে ভরে যাবে। আপনার এক ভক্ত এই সিল্কের এই চাদরটা পাঠিয়েছেন।’

বড়ামামা খুব নীচু গলায় বললেন, ‘মেমারি ফেল করছে।’

‘সে আবার কী?’

‘তালার কম্বিনেশান ভুলে গেছি।’

‘লিখে রাখেননি?’

‘একটা চিরকুটে লিখে রেখেছিলুম। কোথায় পড়ে গেছে।’

‘তাহলে?’

‘এ আর খোলা যাবে না। ভাবছি অন্য কোথাও একটা ধ্যানঘর করতে হবে।’

‘কোথায়?’

‘এই ঘরটার ছাদের ওপর বিশাল একটা ফাইবার গ্লাসের ট্যাঙ্ক বসাব।’

‘উঠবেন কী করে?’

‘মই দিয়ে উঠে মই বেয়ে ট্যাঙ্কের ভেতরে নেমে যাব।’

‘বাজে পরিকল্পনা।’

‘কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না। সেই কারণে আমাদের তীর্থ সব দুর্গম জায়গায়।’ হঠাৎ মেজোমামা ছাদে এসে ভারিক্কি চালে ঘরটার দিকে এগিয়ে গেলেন। সামান্য নীচু হয়ে চাকাটা ঘোরালেন। তালা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিলেন। প্রথমে শোনা গেল অদ্ভুত একট হাসি। তারপরে গান—’দোষ কারো নয় গো মা/আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা।’

দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল একটা চিরকুট।

বড়মামা বললেন, ‘নিয়ে আয়, নিয়ে আয়।’

তালার নম্বর লেখা বড়মামার সেই চিরকুট। বাড়তি দুটো শব্দ—’ভাগ্যে নেই।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *