কম্পাস

কম্পাস

কুকু-র সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল সেদিন আমার এক সাহিত্যিক বন্ধুর বাড়িতে। কুকু এসেছিল, পরিচালক এবং প্রযোজকের সঙ্গে একটি উপন্যাস নিয়ে ছবি করার বিষয়ে আলোচনা করতে।

কুকুকে শেষ দেখেছিলাম আজ থেকে তিরিশ বছর আগে। তখন আমি সবে স্কুল ফাইনাল পাস করে কলেজে ঢুকেছি। আর কুকু তখন বোধ হয় সিক্স-সেভেনে পড়ে। খুব ফর্সা, একটু মেয়েলি। এবং খুবই সুন্দর দেখতে। অবস্থাপন্ন বাবা-মায়ের চোখের মণি। আদরে, যত্নে, স্বাস্থ্যোজ্জ্বল; চোখ-কাড়া। একমাত্র সন্তান।

কুকুরা পুজোর ছুটিতে এসেছিল উত্তরপ্রদেশের বিন্ধ্যাচলের কাছে শিউপুরা নামে একটি ছোট্ট গ্রামে। আমি গেছিলাম আমার বাবা-মা-ভাই-বোনেদের সঙ্গে। সকলে একত্রিত হয়ে মাছিন্দার পথে চড়ুইভাতি, গঙ্গার ঘাটে ‘ড্যাম-চিপ’ নানারকম মাছ কেনা এবং পরিশেষে বিজয়া সম্মিলনিও।

পথের এবং প্রবাসের আলাপ সাধারণত পথে-প্রবাসেই হারিয়ে যায়। যাঁরা ব্যস্ত মানুষ, তাঁদের কারো পক্ষেই কলকাতার কর্মব্যস্ততার ঘূর্ণির মধ্যে ফিরে এসে আর সেই অবসরের সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয় না।

কুকু-র বাবা-মা কাকা-কাকি আমার মা-বাবাকে বলতেন, কলকাতা ফিরে যেন এই সম্পর্ক বজায় থাকে। বাবা বলতেন, দেখা যাবে। কলকাতায় ফিরেই প্রমাণ হবে হৃদয়ের টান খাঁটি না ঠুনকো।

কুকু-র বাবা ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের ব্যস্ত উকিল। কাকা সলিসিটর। ওঁদের নিবাস ছিল উত্তর কলকাতায়। শ্যামবাজারে।

আশ্চর্য! সেবার ছুটির পর কলকাতায় ফিরে প্রবাসের সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়ে উঠেছিল মুখ্যত কুকুদের পরিবারের আন্তরিকতাতেই। এমন একটি শিক্ষিত, রুচিসম্পন্ন পরিবার আমি খুব কমই দেখেছি। বাড়ির প্রত্যেক মহিলাই সুন্দরী। বিভিন্ন-রঙা তাঁতের ডুরেশাড়ি পরা তাঁদের সুন্দর চেহারা এখনও আমার চোখে ভাসে। রান্না-বান্না, সেলাই-ফোঁড়াই; গান-বাজনা সব কিছুতেই সমান উৎসাহ ছিল দত্ত পরিবারের। সেই পুজোর পরও অনেক বছর কুকুদের ও আমাদের পরিবারের মধ্যে যোগাযোগ আশ্চর্যভাবে বজায় ছিল।

কুকু বড়ো হবে, এই নিয়ে অনেক জল্পনাকল্পনা করতেন তখন থেকেই ওর অভিভাবকেরা। কারো ইচ্ছে ছিল কুকু ডাক্তার হোক। কেউ চাইতেন কুকু বড়ো হয়ে তার বাবার ওকালতির পসারকে আরও বাড়িরে তুলুক। মেসোমশাই-এর চেম্বার খুবই ভালো জায়গায়। অনেক মক্কেল। ওঁদের কারোর সন্দেহ ছিল না যে, পড়াশোনাতে ভালো ছাত্র কুকু তার সুন্দর সপ্রতিভ ব্যবহারে এবং চোখ-কাড়া চেহারাতে একদিন তার বাবার চেয়েও বেশি সুনাম করবে হাইকোর্টে। সচ্ছল পরিবারের সাচ্ছল্য আরও বাড়াবে। বনেদি, কোনো পড়তি-অবস্থার পরিবার থেকে কুকু-র জন্যে সুন্দরী শান্তস্বভাবা বিনয়ী পাত্রী পছন্দ করে আনবেন তাঁরা, যাতে তাঁদের পারিবারিক সুখ এবং ঐতিহ্য সাচ্ছল্যর হাতে হাত রেখে আরও উজ্জ্বল হয়।

আমার ইচ্ছে ছিল সাহিত্যিক হওয়ার। কিন্তু আমার প্র্যাকটিক্যাল, কৃতী বাবা বলতেন, বাঙালি সাহিত্যিকেরা না-খেয়েই থাকেন। যাঁরা সাহিত্যর সঙ্গে প্রকাশনার ব্যাবসাতেও জড়িয়েছেন সফলভাবে নিজেদের, সেই মুষ্টিমেয় দু-একজন ছাড়া, সচ্ছলতার মুখ কেউই দেখেননি। বাবার আদেশ ছিল যে, তাঁরই মতো ডাক্তার হতে হবে।

সাহিত্য নিয়ে পড়া পর্যন্ত হল না বলেই আমার যে বাল্যবন্ধু আজ যশস্বী সাহিত্যিক, তাকে মনে মনে খুবই ঈর্ষা করতাম। সেই কারণেই আমার বন্ধুর মধ্যে আমি যা হতে চেয়েছিলাম, সেই না-হওয়া সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশকে প্রত্যক্ষ করে প্রতিছুটির দিনে চেম্বার এবং এমনকী কল-এ যাওয়াও যথাসাধ্য স্থগিত রেখে তার বাড়িতেই সাহিত্য আলোচনা করে কাটাতাম। তার মাধ্যমেই নামি-দামি সব সাহিত্যিকের সঙ্গে আলাপও হত। যাদের সম্বন্ধে অগণিত পাঠকমহলে অতীব কৌতূহল, তাঁদের খুব কাছ থেকে দেখতাম।

বাঙালি মানসিকতায় যাঁদের ‘সফলতম’ বলে, আমি এখন সেই শ্রেণির লোক। বাবা ছিলেন শুধুই এম বি ডাক্তার। আমি এমবিবিএস করার পর এমএসও করেছিলাম। সপ্তাহে বারো থেকে কুড়িটি পর্যন্ত অপারেশান করতাম বড়ো বড়ো নার্সিং হোমে। টাকার অভাব ছিল না আমার। নিউ আলিপুরে বাড়ি করেছি। শোফার-ড্রিভন গাড়ি আছে। কলকাতার একাধিক নামি ক্লাবের মেম্বার হয়েছি। এককথায় অন্য মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত যেকোনো বাঙালি যেসব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যর স্বপ্ন দেখেন ছোটোবেলা থেকে, বাবার বাধ্য ও যোগ্য সন্তান হয়ে সেই সমস্ত প্রাপ্তিই ঘটেছে আমার।

কিন্তু তারই সঙ্গে বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড়ো যে পাস-টাইম, সেই ঈর্ষা ও পরশ্রীকাতরতার নিত্যশিকার আজ আমি। কোন বাঙালি কত বড়ো, তা প্রমাণিত হয় তাঁর প্রতি ঈর্ষাকাতর বাঙালিদের সংখ্যা কত, তার ওপর। এই পরীক্ষাতে আমি প্রথম শ্রেণিতে, প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ। ছেলে-মেয়ে, নিউ আলিপুরের বাড়ি, স্ত্রী, সল্ট লেকের শ্বশুরবাড়ি, আমার মধ্যমগ্রামের ছোট্ট সুন্দর বাগানবাড়ি ও আমার পেশার খ্যাতি নিয়ে আমি একজন আদর্শ বাঙালি। আত্মীয়স্বজনেরা বলে থাকেন মানুষের মতন মানুষ হয়েছি আমি। এমন মানুষ নাকি আমাদের তিনকুলে কেউ কখনোও হয়নি। আমাকে একনামে সকলে চেনে। পেটের অপারেশান? ডা. মুৎসুদ্দির কাছে যাও। ধন্বন্তরি! অপারেশান থিয়েটারে আমি গাউন পরে গ্লাভস হাতে নিলে নতুন অল্পবয়েসি নার্সরা রীতিমতো নাভার্স হয়ে পড়ে। পরমবিস্ময়ে এবং শ্রদ্ধাতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।

কুকু সম্বন্ধে ওর অনেক আত্মীয়স্বজনের কাছেই শুনতাম যে, ছেলেটা মানুষ হল না। বয়েই গেল একেবারে। কিছুই হল না। ফিলম লাইনে ভিড়ে গেছে। নেশা ভাং করে। ড্রাগ খায়। রোজগার-পাতি নেই। বিয়ে করল না। করবেই বা কী করে? বউকে খাওয়াবে কী? মা-বাবাকেও দেখে না। দেখবে কী করে? মানি-শূন্য মানি-ব্যাগ পকেটে নিয়ে বাবা-মায়ের পায়ে হাত বুলোলেই কি ছেলের কর্তব্য করা হয়? টাকাই হচ্ছে সব কথা। কিছুই করল না জীবনে।

এতদিন পরে দেখে, কুকুকে আমি চিনতেই পারিনি। সাহেবের মতো ফর্সা রঙে একেবারে কালি ঢেলে দিয়েছে। কুচকুচে কালো হয়ে গেছে ও। কোঁকড়া নরম কালো চুলের জায়গায় মাথাভরতি টাক। মুখে একগাল দাড়ি। আধময়লা একটা ট্রাউজার এবং হাওয়াই শার্ট পরনে।

ও-ই আমাকে বলল, নিশ্চয়ই আমাকে চিনতে পারছ না টুটুদাদা?

অবাক হয়ে বলেছিলাম, না তো!

আমি কুকু।

কুকু!

হ্যাঁ, মনে পড়ে না? শিউপুরার কুকু। বিন্ধ্যাচল, মাছিন্দা?

কুকু! বিস্ময়ে, হতাশায় আমি বলেছিলাম। মাই গুডনেস!

ওদের কাজ শেষ হতে বেলা হল অনেক। ফিলম লাইনের লোকেরা বড়োবেশি কথা বলেন। যে-কাজ পাঁচ মিনিটে হয়, সে-কাজ ওঁরা তিন ঘণ্টায় করতে ভালোবাসেন। এককাপ চা-খাওয়া শুট করতে যাঁদের দেড়ঘণ্টা লেগে যায় তাঁদের অভ্যেসটাই বোধ হয় খারাপ হয়ে যায়।

কুকু বলল, উঠবে নাকি টুটুদাদা? বাড়ি যাবে না?

বাড়িতে না গেলেও হত। কারণ, আমার সম্বন্ধীদের সঙ্গে আমার স্ত্রী ও পুত্র বাগানবাড়িতে গেছে। এ রবিবার সকালে একজন ধনী ব্যাবসাদারের স্ত্রীর অপারেশন ছিল। প্রথমে ‘না’ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু এমন একটা টাকার অঙ্ক বলে বসল যে, লোভ আর সামলাতে পারলাম না। ভগবানেরও একটা দাম ধার্য করেছে ওরা। টাকা দিয়েও কেনা যায় না এমন মানুষ সংসারে বোধ হয় আর বেশি নেই।

ভাবলাম, যে-ছোকরার কিছুই হল না জীবনে, তাকে নিয়ে একটু ক্লাবে যাই। ওকে বোঝাই যে, এ ওর পরমদুর্ভাগ্য যে চোখের সামনে ওর চেয়ে সামান্যই কয়েক বছরের বড়ো আমি মানুষটা জলজ্যান্ত থাকা সত্ত্বেও ও সে দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হতে পারল না। নি:শেষে নষ্ট করল এমন করে নিজেকে। নিজের সব সম্ভাবনা।

বললাম, চলো, ক্লাবে যাই। বিয়ার-টিয়ার খাও তো!

কুকু বলল, সবই খাই।

তাহলে চলো।

বাইরে আমার গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। সাদা সিট-কভার লাগানো এয়ার-কণ্ডিশাণ্ড কালো ঝকঝকে গাড়ি। টুপি-পরা ড্রাইভার।

আশ্চর্য! কুকু ইম্প্রেসড হল না। একটুও।

বোধ হয় বম্বে-টম্বে যায় প্রায়ই। ফিলম আর্টিস্টদের দেখেছে নিশ্চয়ই। ও পেছনের সিটে আমার পাশে এসে বসল।

রবিবারের দিন। ক্লাবে লোক গিজগিজ করছে। সামনেই ইলেকশান। কে কে কমিটিতে ইলেকটেড হবেন আর কে কে হবেন না তাই নিয়ে জোর ফিসফিসানি চলছে। আমাকে ক্লাবের অনেকেই চেনে। চেনে বলেই তো কুকুকে নিয়ে আসা! ও দেখুক, জানুক আমি কী হয়েছি আর ও কী…কলকাতার সব গণ্যমান্য মানুষই এই ক্লাবের মেম্বার।

বিয়ারের অর্ডার দিলাম। ছুটির দিনে আমি একবোতল বিয়ার খাই। জাস্ট একবোতলই। কুকুকে সেকথা বললামও।

কুকু বলল, মেজার গ্লাসে করে ঢাকার সাধনা ঔষধালয়ের সারিবাদি-সালসা খেলেই পারো। শরীর এবং চরিত্র দুই-ই ভালো থাকবে। মদ এবং জীবন যারা মেপে মেপে খায় এবং খরচ করে তারা মানুষ ভালো কখনোই হয় না।

আমি কিছু বললাম না।

ও বলল, মদ; মানুষের ইনহিবিশান কাটিয়ে দেয়। কিছু মানুষ আছে, যাদের ইনহিবিশান কেটে গেলে সবই কাটাকুটি হয়ে যায়। বাকি থাকে না কিছুই। সেই মানুষগুলোই মদ খেয়ে মাতাল হতে ভয় পায়।

মাতাল হলে, এই ক্লাব থেকে বের করে দেবে।

বিরক্তস্বরে আমি অন্য দিকে মুখ করে বললাম।

মাতাল হওয়া আর মত্ত হওয়াটা এক নয়। মত্ত হওয়ার কথা বলিনি আমি। যাকগে। বললেও, হয়তো তুমি বুঝবে না। তারচেয়ে বলো টুটুদাদা! লেখা-টেখা কি ছেড়েই দিলে একেবারে? কী সুন্দর লিখতে তুমি—

আমি চাপা গর্বের সঙ্গে বললাম, সময় পেলাম কোথায়? প্রফেশানেই তো—

কুকু বলল, খুবই ব্যস্ত থাকো বুঝি? তার পরই চারিদিকে তাকিয়ে বলল, এই সব মানুষেরা কারা?

ক্লাবের মেম্বার, মেম্বারদের গেস্টস, আর কারা?

কী করেন এঁরা?

কেউ অ্যাকাউন্টেন্ট, কেউ ডাক্তার, কেউ এঞ্জিনিয়ার। কত্ত প্রফেশান। ইন্টিরিয়র ডেকরেটর, ম্যানেজমেন্ট কন্সালট্যান্ট, অ্যার্কিটেক্ট, ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, বিজনেস একজিকিউটিভস। আজেবাজে লোক তো এ-ক্লাবের মেম্বার হতে পারে না।

কুকু বিয়ারে চুমুক দিয়ে চশমার আড়ালে গভীর কালো চোখে প্রচ্ছন্ন হাসির ঝিলিক তুলে বলল, স্বাভাবিক। এখানে যাঁরা আসেন তাঁরা সকলেই তোমারই মতো কৃতী পুরুষ জীবনে। তবে টুটুদা ব্যাপারটা কী জানো? এঁদের বেশির ভাগেরই কোনো গন্তব্য নেই মনে হয়। শ্যালো, মেগালোম্যানিয়াক মানুষ এঁরা। আমি একেবারেই স্ট্যাণ্ড করতে পারি না।

কুকুর ধৃষ্টতা আমাকে মর্মাহত করল। আমার সঙ্গে না এলে এখানে কোনোদিন ও ঢুকতেই হয়তো পারত না। আনগ্রেটফুল সিলি চ্যাপ। এমনিতেই, ওই পোশাকের অদ্ভুত জীবটির দিকে সকলেই তাকাচ্ছে। আমারই পয়সায় বিয়ার খেতে খেতে আমাকে ঘুরিয়ে যা-তা বলছে। একেবারেই অমানুষ হয়ে গেছে ছোকরা।

গন্তব্য নেই মানে কী? সকলকেই কি হরিদ্বারে গিয়ে সাধু হতে হবে নাকি?

আমি শ্লেষের সঙ্গে বললাম।

কুকু হাসল। বলল, তা নয়! আমি জিজ্ঞেস করছিলুম, এঁদের সাকসেস এবং টাকাকে বিযুক্ত করে ফেললে মানুষগুলির জীবনে বাঁচার মতো কিছু কি বাকি থাকবে? লোকে কি কেবল বাড়ি, গাড়ি, টাকা, নামি-ক্লাবের মেম্বার হওয়ার জন্যেই বেঁচে থাকে? ওঁরা নিজেরা যা করেন, তা কি এনজয় করেন? ওঁরা কি বেঁচে আছেন? ওঁদের মধ্যে ক-জন সত্যিই বেঁচে আছেন?

এত সব কথার উত্তর আমার কাছে নেই।

কুকু এবার হাসল। বলল, আছে নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু তুমি জবাব দিতে চাও না। নিজেকেও কখনো এসব প্রশ্ন ভুলেও করতে চাও না। কারণ তুমি ভালো করেই জানো যে আমি কী বলছি। যা করে, মানুষ আনন্দ পায় না, তা মানুষ করবে কেন? তোমার জীবনের উদ্দেশ্যটা কী? কখনো ভেবেছ এ নিয়ে টুটুদা?

শ্লেষের সঙ্গে আমি বললাম, তোমার জীবনের উদ্দেশ্যটাই বা কী?

আমার উদ্দেশ্য, আমি যা-করে আনন্দ পাই, তাই-ই করা। শুনলেই তো! ফিলমের স্ক্রিপ্ট লিখি। ছবি ডাইরেক্ট করারও ইচ্ছা আছে।

পড়াশুনোই তো শেষ করলে না। ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি থাকলে কত্ত সুবিধা হত বলো তো?

কুকু আবার হাসল। বলল, বিদ্যার সঙ্গে ডিগ্রির সম্পর্ক কী? ‘দ্য পারপাস অফ অ্যান ইউনিভার্সিটি ইজ টু টেক দি হর্স নিয়ার দ্য ওয়াটার অ্যাণ্ড টু মেক ইট থার্সটি।’ জিগীষার উন্মেষ ঘটানোই ইউনিভার্সিটির কাজ। ডিগ্রি তো একটা পাকানো কাগজ। এককাপ চায়ের জলও করা যায় না তা পুড়িয়ে।

অনেক বড়ো বড়ো কথা শিখেছ যা হোক কুকু। নাও, বিয়ার খাও। সঙ্গে কিছু খাবে?

না:।

কোন কোন ছবির স্ক্রিপ্ট করেছ তুমি? কোনো নাম করা ছবির?

একটা খুব নাম-করা উপন্যাসের স্ক্রিপ্ট করেছিলাম। কিন্তু প্রডিউসার তাঁর স্ত্রীর নামেই চালিয়ে দিলেন। যাক, আনন্দটা আমারই আছে। আমার একার। নামটা অন্যর। আর একটা ছবির স্ক্রিপ্ট এখন করছি। মানে, গত পনেরো বছর ধরেই করছি। কবে শেষ হবে জানি না। আদৌ শেষ হবে কি না তাও জানি না। কখনো ভালো প্রডিউসার পেলে কিন্তু দেখিয়ে দেব। একটাই ছবি করব জীবনে। ছবির মতো ছবি!

সত্যজিৎ রায় হয়ে যাবে বলছ? রাতারাতি!

আমি বললাম। ঠাট্টার গলায়।

তা, কে বলতে পারে? মানিকদা যখন কফি-হাউসে বসে লাঞ্চের সময় কাপের পর কাপ কফি নিয়ে দূরে তাকিয়ে একটার পর একটা সিগারেট খেতেন তখন অত লোকের মধ্যে থেকেও তিনি নিশ্চিন্দিপুরেই থাকতেন। ‘পথের পাঁচালী’ তো একদিনে হয়নি। আমি স্ক্রিপ্ট-এর কথাই বলছি। কোনো বড়ো কিছুই একদিনে হয় না টুটুদা। জীবনে দামি কিছু পেতে হলে যোগ্য দাম দিয়েই তা পেতে হয়।

বললাম, সেকথা আমাকে না বললেও চলবে। কারণ, আমিও যা পেয়েছি, তা যোগ্য দাম দিয়েই পেয়েছি। কিন্তু তুমি যদি নাম না করতে পারো, তাহলে কি তুমি স্বীকার করবে যে, জীবনটাকে নিয়ে তুমি ছিনিমিনি খেললে!

কুকু এবার খুব জোরে হাসল।

বলল, জীবনের মতো, ছিনিমিনি খেলার দারুণ জিনিস তো আর একটিও দেখলাম না! একমাত্র তোমার নিজের জীবনটাই তোমার হাতে। তুমি জীবনে যা দামি বলে মনে করেছ, হয়তো তার পেছনেই ছুটছ। আমি ছুটছি আমি যা দামি বলে মনে করি, তারই পেছনে। নিজের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার নিশ্চয়ই সকলেরই আছে। একটা কথা আমার মনে হয় প্রায়ই। জানো টুটুদা। জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে আমরা খুব ভয় পাই বলেই আমাদের কিসসু হল না। ছিনিমিনি খেলার মধ্যেই ক্রিয়েটিভিটি নিহিত থাকে।

আমি বললাম, প্রতিভা থাকলেই হয় না। প্রতিভারও গৃহিণীপনার প্রয়োজন আছে। রবীন্দ্রনাথের কথাতেই বলছি।

তুমি হাসালে। রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথই! তুমি কি বলতে চাও প্রতিভার গৃহিণীপনা না থাকলে রবীন্দ্রনাথ ‘রবীন্দ্রনাথ’ হতেন না? আর প্রতিভার গৃহিণীপনা থাকলেই তোমার বন্ধুর মতো আজকালকার চঢক্কা-নিনাদিত পোষাপাখি সাহিত্যিকরা সব রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠতেন?

তোমার সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই।

হ্যাঁ। লাভ নেই। কারণ, তোমার যুক্তি নেই টুটুদা। তুমি যখন কলেজ-জীবনে লিখতে, তখন একটা ভালো গল্প লিখে তুমি যে আনন্দ পেতে, আজ তুমি জীবনে যা কিছুই পেয়েছ, তার যোগফল কি সেই আনন্দের সমান? একটি ভালো গল্প লেখার আনন্দই কি এই সাফল্যের চেয়ে দামি মনে হয় না তোমার কাছে? সত্যি করে বলো তো?

ভাবিনি কখনো। তবে, কমই বা কী পেয়েছি। এত লোকের জীবন বাঁচাই। এতে আনন্দ নেই? এত স্তুতি, এত যশ, এত টাকা, খাতির, প্রতিপত্তি! কম কী?

আনন্দ আছে কি? আসলে, তেমন করে ভাবোনি তুমি। তা ছাড়া তুলনাও চলে না অসম জিনিসে। আনন্দ হয়তো থাকত, যদি স্বার্থহীনভাবে অন্যর জীবনটা বাঁচাবার জন্যেই তা করতে। তুমি চেন্নাইর ডা. বদরীনাথের নাম শুনেছ? ভেলোরে গেছ কখনো? ওঁরাও ডাক্তার। কিন্তু ওঁরা জানেন, আনন্দ কী জিনিস। তোমার অধীত-বিদ্যা সব তো নিজের কারণে, নিজের হিতেই প্রয়োগ করলে সারাজীবন। তোমার মতো পেশাদার লোকমাত্রই তো পয়সাওয়ালা লোকেদের চাকর। সবাই চাকর। ওরা তোমাদের ‘স্যার’ই বলুক আর যা-ই বলুক। তুমিও যেমন চাকর, তোমার সাহিত্যিক বন্ধুও চাকর। পশ্চিমবঙ্গে আজ যে-কারণে ডাক্তারের মতো ডাক্তার বিরল, ঠিক সে-কারণেই সাহিত্যিকের মতো সাহিত্যিকও বিরল। আমার মনে হয়, পেশার মধ্যে; একমাত্র বেশ্যাবৃত্তিই বোধ হয় সবচেয়ে স্বাধীন পেশা এখন। এবং সৎ।

আমি চুপ করে রইলাম। একজন পরিচিত মেম্বার কানের কাছে এসে বললেন, মুৎসু, আমাদের টাই-আপের কথাটা মনে আছে তো? ওরা কিন্তু ওদিকে সব কিছুই করছে। ঢালাও ড্রিঙ্কস—গার্ডেন পার্টি…বুঝেছ! ইলেকশন, কিন্তু এসে গেছে!

কুকু চারিদিকে চেয়ে বলল, তোমাদের ক্লাবে আজ এত উত্তেজনা কীসের?

উত্তেজনা? ইলেকশানের জন্যে। ক্লাবের অফিস-বেয়ারারদের ইলেকশান আছে সামনে।

এই ইলেকশানে কেউ জিতলে কী হবে? তাঁর নতুন হাত-পা গজাবে?

কী আবার হবে? ম্যান অফ ইম্পর্ট্যান্স হবে। আল্টিমেটলি প্রেসিডেন্ট হতে পারলে ক্লাবের কমিটি রুমের দেওয়ালে ছবিও ঝুলবে।

কুকু আবারও হাসল। এবারে শ্লেষের হাসি।

বলল সত্যি টুটুদা। তুমি আমাকে ঝুলিয়ে দিলে! আরও বিয়ার আনাও। তোমাদের এই ক্লাবে না এলে অনেক কিছুই অজানা থাকত তোমাদের জগৎ সম্বন্ধে। এই-ই তোমাদের অ্যাম্বিশান? ব্যাস? এইটুকুই? ক্লাবের দেওয়ালে ছবি ঝোলানোই গন্তব্য তোমাদের জীবনের? এত সামান্য অ্যাম্বিশান সমাজের শিরোমণিদের? তোমাদের মতো এমন এলিটিস্ট ইলেকটোরেটের যদি এই স্ট্যাণ্ডার্ড, তবে দেশের গরিব, অশিক্ষিত, অনাহারী ভোটারদের দোষ দিয়ে লাভ কী?

আমি বললাম, আস্তে, আস্তে। কেউ শুনতে পাবে।

কুকু হাসল।

বলল, তুমি কেন একবোতলের বেশি বিয়ার খাও না এবারে বুঝলাম। পাছে, সত্যি কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়। পাছে, তুমি এই সমাজে, এই ভিড়ে, অপাঙক্তেয় হয়ে পড়ো। তাই না?

বললাম, অন্য কথা বলো কুকু। অন্য কথা বলো।

আহা টুটুদা। তুমি তো অনেকই টাকা রোজগার করলে। বাকি জীবনটা বিনা পয়সায় অপারেশন করো না? গন্তব্য মানে, শুধু হরিদ্বারে গিয়ে সাধু হওয়াই নয়। আমি এই গন্তব্যর কথাই বলছিলাম। নয়তো সব ছেড়ে দিয়ে এবার লেখো। যা কিছু লিখতে চেয়েছিলে, নিজেকে উজাড় করে লেখো। বেটার লেট, দ্যান নেভার।

স্বগতোক্তির মতো বললাম আমি, তুমি তো বলেই খালাস কুকু! ছেলেটার পায়ে দাঁড়াতে এখনও অনেক দেরি।

হা:! জোক অফ দ্য ইয়ার। পুওর ফাদার! আমার বাবার কথাই মনে পড়ে গেল! আমার বাবাও ঠিক এই কথাই বলতেন। আর দেখছ তো আমাকে। এখনও ল্যাংচাচ্ছি। পায়ে আর দাঁড়ানো হল না। টুটুদা! তোমার ছেলেটাকে মুক্তি দাও-না। ও যা হতে চায় ভালোবেসে, যা করে ও আনন্দ পায়; তাই-ই করুক না হয়। একটাই তো জীবন। বাপের কথামতো নাই-ই বা বাঁচল। ওকে নিজের মতোই বাঁচতে দাও। জীবন মানে কি শুধুই ভালো-থাকা, ভালো-খাওয়া? জীবন-এর মানেটাই তো একেকজনের কাছে এক একরকম। তাই না?

দেড়টা তো বাজে। এখানেই লাঞ্চ খেয়ে যাও কুকু। ও হো ভুলেই গেছিলাম। তোমাকে তো ডাইনিং রুমে ঢুকতেই দেবে না।

আমি বললাম।

কেন? কুকু মুখ লাল করে বলল, দেবে না কেন?

তুমি যে স্যুট পরে নেই।

স্যুট পরে নেই মানে? আমার তো স্যুট একটিও নেই-ও। কিন্তু ব্যাপারটা কী?

না। ব্যাপার কিছু নয়। শীতকালে স্যুট ছাড়া এই ক্লাবের ডাইনিং হলে ঢোকা বারণ।

কুকু, হো: হো: হো: করে ফুলে ফুলে হাসতে লাগল।

অনেকক্ষণ পর হাসি থামিয়ে বলল, আমাদের বাবারা সব অসহযোগ করে, খদ্দর পরে আর চরকা কেটে ইংরেজ তাড়াল পঁয়ত্রিশ বছর আগে দেশ থেকে। আর আজকেও স্যুট ছাড়া দিশি লোকদেরও তোমরা খাওয়ার ঘরে ঢুকতে দাও না? জয়। ভারতের জয়! তোমাদের জয়। এই ভারতবর্ষ স্বাধীন করার জন্যেই আমার ন-কাকা পুলিশের গুলি খেয়ে মরেছিল। সত্যই সেলুকাস! বিচিত্র এই দেশ।

অনেকেই আমাদের টেবিলের দিকে দেখছিল। পরে জিজ্ঞেস করবে নিশ্চয়ই, কাকে নিয়ে এসেছিলাম আমি? ইজ্জত একেবারে গলিয়ে দিল কুকুটা। আসলে, দোষ আমারই। এসব লোককে নিয়ে পার্ক স্ট্রিটের বারে-টারেই যাওয়া উচিত ছিল।

কুকু বটমস-আপ করে বলল, এবার উঠব। আমার দম-বন্ধ দম-বন্ধ লাগছে এখানে। থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ। নট সো মাচ ফর দ্য বিয়ার। বাট, আমাকে এক নতুন জগতের সঙ্গে আলাপিত করালে বলে। এখানে আজ না এলে, আমি হয়তো বোকার মতো পুরোনো বিশ্বাসই পোষণ করতাম যে, পৃথিবীতে ডাইনোসররা আর বেঁচে নেই।

বাইরে বেরিয়ে কুকু আর গাড়িতে উঠল না।

বলল, আমি বাসেই চলে যাব। তুমি তো যাবে উলটোদিকে। কেন ঘুরবে মিছিমিছি আমার জন্যে?

খাবে না? চলো, অন্য কোথাও গিয়ে খাই।

খেয়ে নেব কোথাও। খাওয়াটা তো এমন কিছু ব্যাপার নয়। কিছু জুটলেই হল খিদের সময়। চলি, টুটুদা।

কুকু আমার সঙ্গে এলেই ভালো হত। বাড়িতেই খিচুড়ি বা ভাতে-ভাত খেতাম। একবার ভাবলাম, কুকুকে জোর করে বাড়িতে ধরে নিয়ে যাই। গিয়ে, অনেকগুলো বিয়ার খাই, খেয়ে; যেসব কথা আজকে অনেক বছর আমার বুকের মধ্যে পাথরের মতো চেপে বসে আছে, যেসব কথা আমার স্ত্রী, আমার পরিচিত মানুষেরা, আমার সমাজে যাদের যাতায়াত তারা কেউই কখনো শুনতে চায়নি এবং বলতেও দেয়নি আমাকে, যেসব কথা শুনলেও কানে আঙুল দিয়ে আমাকে বলেছে, ‘সাইকোলজিকাল কেস’, ‘কনফিউজড’, বলেছে, ‘ইডিয়ট’; সেইসব কথা কুকুর হাতে হাত রেখে, চোখের জলে বলতাম…

কিন্তু কুকু ততক্ষণে মোড়ের ভিড়ে মিলিয়ে গেছে বড়ো বড়ো পা ফেলে।

কী সুন্দর ওর হাঁটার ভঙ্গি। ঈশশ! কত্ত দিন আমি ভিড়ের মধ্যে, আমার এই ফালতু, মেকি সত্তাকে হারিয়ে দিয়ে, দশজনের একজন হয়ে হাঁটি না। কত্ত দিন ছোটোবেলার মতো ফুচকা খাই না। আলুকাবলি। রাধুর দোকানের চিকেন-রোস্ট, ফুটপাথে দাঁড়িয়ে। বসন্ত কেবিনের মোগলাই পরোটা!

ড্রাইভার বলল, কাঁহা চলেগা সাব?

আমি দরজা খুলে নেমে পড়ে বললাম, তুমি বাড়ি চলে যাও। আমি চলে আসব।

ও একটুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইল আমার মুখের দিকে।

তার পর কিছু না বলে চলে গেল।

ভিড়ের মধ্যে শীতের মিষ্টি রোদে হাঁটতে খুব ভালো লাগছিল আমার। হাঁটতে হাঁটতে, নিজের কাছ থেকে নিজে দূরে এসে আমার কাচের ঘরের জীবনটাকে স্বচ্ছভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। যে-সমাজে আমার মেলামেশা, চলাফেরা, সেখানে ড্রাইভারেরা রোবোট। নিজে থেকে কথা বলা বারণ তাদের। তারা মানুষ নয়।

হয়তো সেখানে প্রত্যেকটা মানুষই রোবেট। সেখানে নিজের মস্তিষ্ক দিয়ে কেউই ভাবে না। নিজের চোখ দিয়ে দেখে না। নিজের ইচ্ছেতে কেউ চলে না। সারাজীবন, সেখানে প্রত্যেকটি মানুষ, অন্য কোনো মানুষের ভূমিকাতে রং-মেখে, স্যুট-পরে, উদ্দেশ্যহীন, উৎকট অভিনয় করে চলে। প্রতিদিন। আমৃত্যু!

কুকু গড্ডলিকায় গা-ভাসানো, পথ-হারানো আমাকে এইমাত্র সঠিক পথের হদিশ দিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *