কমান্ডো – ৭

৭. প্রায় কুচকাওয়াজ করিয়ে

প্রায় কুচকাওয়াজ করিয়ে জাহাজের পিছনে নিয়ে চলল ওরা পাশাকে। একজন আগে রয়েছে, একজন পিছনে। অনেকগুলো প্যাসেজওয়ে পেরোতে হবে। রাস্তা চিনে রাখার চেষ্টা করছে পাশা। যদিও তাতে কোন লাভ হবে কি না জানে না।

মাঝে মাঝেই অন্য নাবিকদের পাশ কাটাচ্ছে ওরা। এমনভাবে পাশার দিকে তাকাচ্ছে, যেন ও একটা বিষাক্ত সাপ, পিষে মারতে পারলে খুশি হয়।

জাহাজের পেটের গভীরে একটা কম্প্যানিয়নওয়েতে এসে পড়ল ওরা। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার সময় ফাঁপা শব্দ হতে লাগল। ওরা তিনজন ছাড়া আর কেউ নেই সিঁড়িতে। আলো কম। চারদিকে ছায়ার ছড়াছড়ি! এরচেয়ে ভাল সুযোগ আর পাবে না পাশা।

আরেকটা ল্যাণ্ডিঙের দিকে এগোনোর সময় সামনের লোকটা রেইলের ওপর দিয়ে ঝুঁকে নিচে তাকাল। চট করে পিছনে তাকিয়ে পাশা দেখল, বেরেটাধারী দ্বিতীয় লোকটা গাল চুলকাচ্ছে আর হাই তুলছে। বন্দির দিকে প্রতিটি মুহূর্ত কঠোর নজর রাখতে শেখানো হয়নি ওদের। জাতে ওরা চোরাচালানি, পেশাদার খুনী কিংবা মারদাঙ্গাকারী নয়।

বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন পাশার শরীরে। ঝট করে ডান পাটা সামনে বাড়িয়ে ওর দুই ধাপ নিচে দাঁড়ানো লোকটার কিডনির কাছে লাথি মারল, ফেলে দিল রেইলের ওপর। পরক্ষণে ঘুরে গেল পিছনের লোকটার দিকে। বাঁ হাতে থাবা মেরে ওর মাথার দিক থেকে সরিয়ে দিল পিস্তলের নলটা।

ডিগবাজি খেয়ে নিচে পড়তে পড়তে হাত বাড়িয়ে থাবা দিয়ে রেইল ধরে ফেলল পিঠে লাথি খাওয়া লোকটা। পিস্তলটা ছেড়ে দিয়েছে হাত থেকে। শূন্যে ঝুলছে দুই পা। নিজেকে টেনে তুলে আবার এপাশে আসার চেষ্টা করছে।

চোখের পলকে পাক খেয়ে দ্বিতীয় লোকটার পিছনে চলে এল পাশা। একই সময়ে হাত ঝাঁকি দিয়ে বের করে আনল তারটা। গ্যারটের এক মাথা হাতের তালুতে পড়তেই মুহূর্তে টান দিয়ে পুরোটা বের করে ফেলল।

ঘুরতে আরম্ভ করেছে বেরেটাধারী নাবিক। তারটা ওর মাথার ওপর দিয়ে নীচে নামিয়ে গলায় পেঁচাল পাশা।

দম আটকে গেল লোকটার। চামড়ায় বসে গেছে তার। বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করছে ও। এক হাতে গলায় খামচাতে লাগল তারটা ধরার জন্য, কিন্তু কোনমতেই তারে আঙুল বসাতে পারল না। আর কোন উপায় না দেখে পিস্তলটা পিছন দিকে তাক করার চেষ্টা করল।

ওর পিঠে এক হাঁটু চেপে ধরল পাশা। লোকটাকে চেপে ধরল রেইলের সঙ্গে। তারে টান বাড়িয়ে দিয়েছে যতটা সম্ভব। ফুলে উঠেছে হাতের পেশি। চামড়ায় কেটে বসে গেছে গ্যারট। উন্মত্তের মত তারটা খোলার চেষ্টা করছে লোকটা।

পায়ের কাছে খসে পড়ল পিস্তলটা।

রেইল ডিঙিয়ে এপাশে প্রায় চলে এসেছে প্রথম লোকটা। ল্যাণ্ডিঙে পা রেখে পিস্তলটার দিকে এগোল। হাঁপাতে হাঁপাতে পাশাকে বলল, ‘তুমি গেছ!’

গ্যারটের কাজ শেষ। লাশটা ছেড়ে দিয়ে নিচু হয়ে বেরেটাটা তুলে নিয়েই লাফ দিল পাশা। ল্যাণ্ডিং থেকে পিস্তলটা তুলে সোজা হতে আরম্ভ করেছে প্রথম লোকটা।

বেরেটার নল লোকটার পাঁজরে ঠেসে ধরল পাশা, যাতে শব্দ চাপা পড়ে। ট্রিগার টিপে দিল, পর পর দুবার। পড়ে গেল লোকটা। হাঁ করে দম নেয়ার চেষ্টা করছে। ঠোঁটের কোণ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে।

ঝুঁকে বসে কান পাতল পাশা। জাহাজের ইঞ্জিনের ভারী একটানা শব্দ ছাড়া আর কিছুই কানে আসছে না। শোল্ডার রিগে বেরেটাটা ঢুকিয়ে রেখে সিঁড়ি থেকে দ্বিতীয় পিস্তলটা তুলে নিল ও। একটা ৯ এমএম টোরাস। বেল্টের নিচে গুঁজে রেখে লাশ দুটোকে টেনে নিয়ে এল ল্যাণ্ডিঙের দেয়ালের গোড়ায়, অন্ধকার ছায়ার কাছে। আশা করল, ও জাহাজ থেকে নেমে যাবার আগে ও দুটো কারও চোখে পড়বে না।

কিন্তু নামবে কী করে সেটা এক বিরাট প্রশ্ন। সবচেয়ে ভাল হয়, ওপরে উঠে একটা দড়ি খুঁজে বের করে সেটা ঝুলিয়ে জাহাজের পাশ বেয়ে পানিতে নেমে যাওয়া-নাবিকরা ওর নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারটা টের পাওয়ার আগেই; টের পেলে শিকারী কুকুরের মত ওকে ধরতে ছুটে আসবে ওরা। জাহাজের পিছন দিকে দড়ি থাকার সম্ভাবনা আছে।

কম্প্যানিয়ন পেরিয়ে এসে পিছনে ছুটল ও। রাস্তার একটা সংযোগস্থলের কাছে এসে দাঁড়াল। বাঁয়ে মৃদু পায়ের শব্দ শোেনা গেল। সুতরাং ডানে চলল ও। বিশ কদম এগোতেই ঝাঁকি দিয়ে পিছনে চলতে শুরু করল গ্রিফিথের ইঞ্জিন। অনেক পিছন থেকে একটা ঘষার শব্দ ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত জাহাজে। গিয়ার ঠিকমত দাঁতে দাঁতে না পড়লে যেমন হয়, শব্দটা অনেকটা সেরকম; হয়তো মরচে পড়া মস্ত কোনও দরজা জোর করে টেনে খোলা হচ্ছে। চিৎকারের শব্দও কানে এল পাশার।

ফার্নান্দো বলেছে, সূর্য ডোবার পর সাবমেরিনের সঙ্গে দেখা হবে জাহাজটার। হয়তো জাহাজ ও সাবমেরিনের গা ঘেঁষাঘেঁষিতেই শব্দটা হয়েছে।

রাস্তার পরের সংযোগস্থলটায় এসে বাঁ দিকে ঘুরল পাশা। শব্দ লক্ষ্য করে এগোচ্ছে। কীভাবে মাল পাচার করে দেখার লোভ সামলাতে পারছে না। প্রচণ্ড ঝুঁকি নিচ্ছে ও। জানে, ওদিকে গেলে নাবিকদের চোখে পড়ে যাবার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু ঝুঁকি নিয়েও কীভাবে কী করছে ওরা জানার কৌতূহলে সেদিকে এগোচ্ছে।

সিঁড়িতে দুজন নাবিককে কাবু করার পর আর কারও মুখোমুখি হতে হয়নি ওকে। পাশা অনুমান করল, ডেকে ব্যস্ত রয়েছে কিছু লোক, জাহাজের বাকি সবাই চলে গেছে সাবমেরিনটাকে সহায়তা করতে। একটা দরজার কাছে এসে দাঁড়াল ও। সামান্য ফাঁক হয়ে আছে পাল্লাটা। ঠেলা দিতেই খুলে গেল। আর খুলেই স্থির হয়ে গেল ও। নিজেকে সাঁটিয়ে ফেলল বাল্কহেডের সঙ্গে।

মালে ঠাসাঠাসি মস্ত একটা হোল্ডে ঢুকেছে ও। একটা ফোর্কলিফটের চারপাশে বাক্স সাজিয়ে রাখতে ব্যস্ত কয়েকজন নাবিক। এখনও ওকে দেখেনি কেউ।

ওদের ওপর থেকে চোখ না সরিয়ে একটা ক্যাটওঅক ধরে এগোল পাশা। জাহাজের একপাশে, আরেকটা দরজার কাছে চলে এল। সাবধানে পাল্লা খুলে অন্যপাশে বেরোল। এটাও আরেকটা হোল্ড, তবে প্রথমটার চেয়ে ছোট, আর এর অর্ধেকটাতে মাল বোঝাই। কী করবে ভাবছে ও, এ সময় হোন্ডের নিচে সামনের দিকের একটা দরজা দিয়ে ঢুকল একজন নাবিক।

উবু হয়ে বসে তাকিয়ে রইল পাশা। সামনের বাল্কহেডের দিকে এগিয়ে গেল নাবিক, যেখানে রয়েছে আরেকটা ক্যাটওঅকে ওঠার জন্য ধাতব আঙটার সিঁড়ি। কিন্তু সিঁড়িতে না উঠে একটা প্যাসেজওয়ে দিয়ে চলে গেল লোেকটা।

নিচের দরজাটার দিকে তাকিয়ে আছে পাশা, যেটা দিয়ে ঢুকেছিল নাবিক। এমনভাবে ক্যামোফ্ল্যাজ করা, লোকটাকে বেরোতে না দেখলে দরজাটা যে ওখানে রয়েছে বুঝতেই পারত না ও। অন্যপাশে কী আছে দেখার কথা ভাবল।

নিচে নামার জন্য আংটা রয়েছে। সেগুলো বেয়ে দ্রুত নেমে এল পাশা। মাথা নুইয়ে, মালপত্রের আড়ালে আড়ালে দরজাটার কাছে চলে এল। দেয়ালের জোড়ার কাছে চমৎকারভাবে মিলিয়ে দিয়ে লুকিয়ে রাখা হয়েছে একটা হুড়কো। টান দিতেই নিঃশব্দে খুলে গেল। আস্তে করে পাল্লা ফাঁক করে সেখান দিয়ে অন্যপাশে তাকাল ও।

ফেলিডাই লোকটা বুদ্ধিমান।

জাহাজটাকে নতুন করে সাজানোর কথা জানিয়েছে ফার্নান্দো। কিন্তু কতটা সাজিয়েছে, অনুমান করতে পারেনি তখন পাশা। ধাতব দেয়াল তুলে হোন্ডটাকে দু’ভাগ করা হয়েছে। বড় অংশটা আগের মতই মালপত্র রাখার কাজে ব্যবহার হচ্ছে, আর ছোেট অংশটা তৈরি করা হয়েছে একটা মিনি-সাব লুকিয়ে রাখার গুপ্তকক্ষ হিসেবে।

কীভাবে কী ঘটে বোঝা যাচ্ছে এটা দেখে। কলাম্বিয়ায় সাবমেরিনে কোকেইন বোঝাই করে জাহাজে তোলা হয়। তারপর উত্তরে মেক্সিকো উপসাগরের দিকে এগিয়ে যায় জাহাজটা, কী-এর পশ্চিমে নির্দিষ্ট কোনও জায়গায়। অল্প সময়ের জন্য ওখানে থামে গ্রিফিথ, সাবমেরিনটাকে নামিয়ে দেয়ার জন্য। তারপর নিজের পথে চলে যায়, কারও সন্দেহ না জাগিয়ে।

একটা নিখুঁত ব্যবস্থা। নির্দিষ্ট বন্দরে পৌঁছে মালবাহী জাহাজটা যখন এটার বৈধ মাল খালাস করে, মিনি-সাবটা তখন ওটার অবৈধ মাল খালাস করে ডোমিনিক আইল্যাণ্ডে—অন্তত কয়েক রাত আগে পর্যন্ত তা-ই করত। এব্রো ডুয়েরো সেগুলো তুলে নিয়ে গিয়ে মেইনল্যাণ্ডে ছড়িয়ে দিত।

পশ্চিম উপকূলেও নিশ্চয় এ ধরনেরই কোনও ব্যবস্থা রয়েছে।

এ সময় হালের পাশের পানিতে ভাসল মিনি-সাবটা। ছয়জন নাবিক ক্রেন থেকে ঝোলানো শিকলের হুকে ওটাকে আটকাতে ব্যস্ত হলো। আরও চারজন নাবিক বিভিন্ন কাজ করছে। তদারক করছে ফার্নান্দো, পাশার কয়েক গজ দূরে এদিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও। পুরো জায়গাটা উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত।

ক্যাপ্টেনের মনোযোগ এখন অন্যদিকে, এই সুযোগে ওপরের ডেক দিয়ে দড়ি বেয়ে নেমে যেতে পারবে ও।

পাল্লাটা লাগিয়ে দিচ্ছে পাশা, হঠাৎ পিছনে কথা বলে উঠল একটা কণ্ঠ, ‘এই, কে তুমি? এখানে কী করছ?’

কয়েক মিনিট আগে এই দরজা দিয়ে যে লোকটাকে বেরোতে দেখেছিল পাশা, ফিরে তাকিয়ে দেখল, সেই লোকটা। ফিরে এসেছে। হাতে একটা বড় রেঞ্চ। পাশা পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই বাড়ি মারার জন্য রেঞ্চ তুলল লোকটা। পরক্ষণে তলপেটে পাশার হাতের প্রচণ্ড ঘুসি খেয়ে কুঁকড়ে গেল। আরেক ঘুসিতে চিত। কিন্তু চিত হওয়ার আগেই চেঁচামেচি করে ক্ষতি যা করার করে দিয়েছে। হট্টগোেল শোনা গেল অন্যপাশে। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজাটা। ফার্নান্দো দাঁড়িয়ে আছে। পাশাকে দেখে নাবিকদের উদ্দেশ্যে গর্জে উঠল, ‘অ্যাই, এখানে এসে তোমরা! ফেড হারামজাদা বেরিয়ে চলে এসেছে।’ পি-জ্যাকেটের নিচ থেকে ছুরি বের করল।

দৌড়ানোর চেষ্টা করল না পাশা। আংটা বেয়ে উঠতে যাওয়াটা হবে মারাত্মক বোকামি। নিচ থেকে পিস্তলের সহজ নিশানা হয়ে যাবে। আর যদি ওদিক দিয়ে পালাতে পারেও পাশা, ফার্নান্দো সাবধান করে দিলে নাবিকরা খুঁজে বের করবে ওকে।

উল্টোটা করল পাশা। দরজার দিকে ছুটল ও। ছুরি দিয়ে খোঁচা মারার জন্য তৈরি হলো ফার্নান্দো। লক্ষ্য করল না, পিস্তল বের করেছে পাশা। .৯ এম এম বেরেটার একটি মাত্র গুলি খরচ করল ও। গোল একটা লাল ফুটো দেখা দিল ফার্নান্দোর কপালে। পিছিয়ে গিয়ে উল্টে পড়ল এগিয়ে আসা দুজন নাবিকের ওপর, ওকে সাহায্য করতে এগোেল ওরা।

দৌড়ে সাব-কম্পার্টমেন্টে ঢুকে পড়ল পাশা। সমস্ত কাজ থেমে গেছে। বরফের মত জমে গেছে যেন কয়েকজন, বাকিরা ছুরিপিস্তল বের করে ওর ওপর হামলা চালাতে আসছে।

বেল্টে গোঁজা টরাস পিস্তলটা টেনে বের করল পাশা। দুই হাতে দুটো পিস্তল নিয়ে দৌড় দিল জাহাজের খোলের খোলা মস্ত ফোকরটার দিকে, যেটা দিয়ে সাবমেরিনটাকে ঢোকানো হয়। বাঁধা দিতে এল একজন লোক। নির্দ্বিধায় ওর বুকে গুলি করল পাশা। সাবমেরিনের ছাতে দাঁড়ানো আরেকজন রিভলভার তুলল ওকে লক্ষ্য করে। টরাসের একটা বুলেট প্রায় উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে পানিতে ফেলল ওকে।

ফোকরটার কিনারে পৌঁছে গেল পাশা। সামনে বিস্তারিত উপসাগরের পানি। ঝাঁপ দিল ও। পানিতে পড়ার আগে গুলির শব্দ শুনল। তবে ওর কোন ক্ষতি করল না বুলেট। ওপর দিয়ে চলে গেছে। পানিতে পড়ল ও। চারপাশে বুলেট-বৃষ্টি হচ্ছে। সেগুলো এড়াতে মাথার ওপর হাত দুটো লম্বা করে দিয়ে পা ছুঁড়ে যতটা সম্ভব নিচে নেমে চলল ও।

কিছুদূর কোণাকুণি নেমে, সোজা হয়ে জাহাজকে পাশে রেখে সাঁতরে চলল পিছন দিকে। জাহাজের মস্ত প্রপেলার দুটো চোখে পড়ল। বাতাসের জন্য আকুলিবিকুলি করছে ফুসফুস। দম না নিয়ে আর পারবে না পাশা। ভাসতে হবে। পানির ওপর মাথা তোলার সঙ্গে সঙ্গে নতুন বিপদ দেখল। ফ্লাডলাইটের আলো পড়ল ওর ওপর। সঙ্গে সঙ্গে গুলি শুরু হলো। কোয়ার্টার ডেকে দাঁড়িয়ে গুলি করছে লোকটা। ওর মাথা আর কাঁধের খানিকটা শুধু চোখে পড়ছে পাশার। দ্রুত সাঁতরে সরে যেতে শুরু করল ও। কাঁচা লোক গুলি বর্ষণকারী, পানিতে সচল নিশানাকে লাগানোর দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা কোনটাই নেই ওর, তাই প্রাণে বাঁচল পাশা।

ম্যাগাজিন খালি না হওয়া পর্যন্ত গুলি চালিয়ে গেল লোকটা। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই আরেকটা নতুন ম্যাগাজিন ভরবে।

পাশার ওপর খাড়া হয়ে আছে জাহাজের খোল। ঢালু হয়ে উঠেছে। গুলি করতে হলে যাতে সামনে ঝুঁকে আসতে হয় গুলিবর্ষণকারীর, সেজন্য খোলের গায়ে প্রায় লেগে থেকে দ্রুত জাহাজের পেটের দিকে সাঁতরে চলল পাশা। বুঝতে পারছে, বেঁচে যাওয়াটা সাময়িক। শীঘ্রি আরও পিস্তলধারী এসে যোগ দেবে লোকটার সঙ্গে। একজনের হাত ফসকালেও সবার ফসকাবে না।

খোলের গায়ে সেঁটে থেকে, মাথা উঁচু করে তাকাল ও। পুবদিকে, দূরে, একটা দ্বীপ চোখে পড়ল বলে মনে হলো। কিন্তু ওকে বলা হয়েছে, কী থেকে দূরে মাল খালাস করা হয়, কোস্ট গার্ড আর পুলিশের চোখ থেকে দূরে। তারমানে উপসাগরের মাঝখানে রয়েছে এখন ওরা।

জাহাজের ডানপাশে প্রচুর শব্দ আর পানিতে আলোড়ন বুঝিয়ে দিল। সাবমেরিনটাকে টেনে তোলা হচ্ছে। শীঘ্রি রওনা হয়ে যাবে গ্রিফিথ। হয়তো-ভাবল পাশা-ওকে ধরার চেষ্টাও চলতে পারে। তার আগেই জাহাজের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পারলে ভাল হয়।

পুবে সাঁতরে চলল পাশা। নিজের অজান্তেই শক্ত হয়ে গেছে পিঠের চামড়া, যে কোন মুহূর্তে বুলেটের স্পর্শ পাবার আশঙ্কায়। সরাসরি ওর গায়ে ফ্লাডলাইটের আলো পড়ছে। একসঙ্গে গুলি বর্ষণ শুরু হলো চার-পাঁচটা পিস্তল থেকে। আশেপাশে বুলেট পড়ছে। দু’একবার মুখের কাছে পানি ছিটকে উঠল বুলেটের ঘায়ে।

ভেসে থাকলে গুলি খাবে, জানা কথা। সব গুলিই মিস হবে না ওদের। আবার ডুব দিল ও। এক ডুবে চলে এল যতটা সম্ভব দূরে। বাতাসের জন্য ফুসফুসটা যখন আর্তনাদ শুরু করল, তখন ভেসে উঠে তাড়াতাড়ি শ্বাস নিয়ে আবার ডুব। এভাবে ডুবে, ভেসে, এগিয়ে চলল। যখনই মাথা তোলে, সঙ্গে সঙ্গে গুলি বর্ষণ শুরু হয়। তবে ক্রমেই সরে যাচ্ছে পাশা, তা ছাড়া মাথা তুলে দম নেয়ার সময় স্থির থাকে না ও, সেটা একটা কারণ হলেই নেহায়েত ভাগ্যক্রমেই বেঁচে যাচ্ছে ও।

আরেকবার মাথা তুলে অদ্ভুত একটা ঘ্যঁস-ঘ্যাঁসে শব্দ কানে এল পাশার। এখন আর গুলি হচ্ছে না, তাই কীসের শব্দ হচ্ছে দেখার জন্য পিছন ফিরে তাকানোর ঝুঁকি নিল।

ক্রেনের সাহায্যে একটা লাইফবোট নামানো হচ্ছে। সেটা ভর্তি সশস্ত্র নাবিক। কয়েক ফুট নেমে নেমে ঝাঁকি দিয়ে থেমে যাচ্ছে। আবার নামছে। ক্রেনের কন্ট্রোল থেকে নিশ্চয় বোটটাকে দেখতে পাচ্ছে না ক্রেনম্যান। যা-ই হোক, প্রাণ বাঁচানোর প্রচণ্ড তাগিদে মরিয়া হয়ে সাঁতরে চলল পাশা। ডেকে দাঁড়ানো নাবিকেরা চিৎকার-চেঁচামেচি করছে, ওকে উদ্দেশ্য করে গালি দিচ্ছে। চূড়ান্ত মজা দেখার অপেক্ষা করছে ওরা।

পেশিতে খিচ ধরতে আরম্ভ করেছে পাশার। কিন্তু ব্যথার কাছে আত্মসমর্পণ করতে চাইল না ও। সাঁতরে চলল। তবে গতি কমে গেছে। ইতিমধ্যে দুবার ফিরে তাকিয়েছে। শেষবার দেখেছে, পানিতে নামানো হয়ে গেছে লাইফবোটটা। গলুইয়ে বসানো একটা স্পটলাইট। দাঁড় বাইতে শুরু করেছে নাবিকরা।

উল্লাসিত চিৎকার শোনা গেল জাহাজের ডেক থেকে, বোট আর পাশার মাঝে দূরত্ব কমে যেতে দেখে, চেঁচাচ্ছে লোকগুলো। দুজন রাইফেলধারী নাবিক বোটের গলুইয়ে এসে দাঁড়াল। দুজনের মধ্যে একজন ফার্নান্দো রাইফেলের বাঁট কাঁধে ঠেকাল।

বাঁয়ে ঘুরে গেল পাশা। ওর কাঁধের কয়েক ইঞ্চি দূরে চড় মারার মত শব্দ তুলে পানিতে পড়ল একটা বুলেট, রাইফেলের গুলির শব্দ উপসাগরের পানির ওপর দিয়ে যেন গড়িয়ে চলে গেল। ডানে সরল ও, তারপর বাঁয়ে, তারপর আবার ডানে। এঁকেবেঁকে চলাতে দ্বিতীয় গুলিটাও মিস হলো।

চেঁচিয়ে, শিস দিয়ে, ফার্নান্দোকে উৎসাহিত করছে দর্শকরা।

কোনদিকে না তাকিয়ে সাঁতরে চলেছে পাশা। এক কনুইয়ের কাছে পানিতে খামচি দিল যেন শক্তিশালী অস্ত্র থেকে ছোঁড়া বুলেট। পিছু ধাওয়াকারীদের সঙ্গে পেরে ওঠা অসম্ভব। হঠাৎ থেমে গিয়ে, ওয়ালথারটা বের করল ও। এলোমেলো ঢেউয়ে ভেসে থেকে নিশানা করা কঠিন। তবু যতটা সম্ভব লক্ষ্যস্থির করে টিপে দিল ট্রিগার।

ঝাঁকি দিয়ে পিছনে বাঁকা হয়ে গেল ফার্নান্দোর দেহটা। পড়ে গেল বোটের পাটাতনে।

পাল্টা আক্রমণ দেখে খেপে গেল নাবিকেরা। নতুন উদ্যমে উঠতে-পড়তে শুরু করল দাঁড়গুলো। পাশার ষাট ফুটের মধ্যে পৌঁছে গেছে বোটটা। দ্রুত এগিয়ে আসছে। দ্বিতীয় লোকটাকে রাইফেল তুলতে দেখল পাশা। তাড়াহুড়ো করছে না লোকটা, ঠাণ্ডা মাথায় নিশানা করছে। ঠিক এ সময়, পাশার জীবন যখন সরু একটা সুতোয় ঝুলছে, পশ্চিম থেকে মালবাহী জাহাজটার

ঠিক ওপর দিয়ে উড়ে এল একটা সি-প্লেন। সামান্য কাত হয়ে গেল প্যাসেঞ্জার সিটের পাশের ডানা। গর্জে উঠল একটা এম-৬০ অটোম্যাটিক গান। তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকারের মত শব্দ তুলে যেন খেয়ে ফেলতে শুরু করল লাইফবোট আর ওটার যাত্রীদের। প্রথমে ঝাঁকি খেয়ে পানিতে পড়ল রাইফেলধারী, ঝাঁঝরা হয়ে গেছে শরীর। আরও চারজন নাবিকের একই দশা হলো। তারপর ভেঙে পড়ল অসংখ্য গুলি খাওয়া বোটটা, এতগুলো মানুষের ভারের চাপ আর সহ্য করতে না পেরে।

কাত হয়ে ঘুরল উভচর বিমানটা। নীচে নামতে নামতে পানি স্পর্শ করল। ল্যাণ্ড করল মসৃণভাবে। তীব্র গতিতে প্রপেলার দুটো ঘুরিয়ে ছুটে এল পাশার দিকে। ককপিট উইন্ডো আর গান ব্লিস্টার বেগুনি রঙ করা, তার ভিতর দিয়ে কন্ট্রোলে কে রয়েছে দেখা যাচ্ছে না।

জাহাজের ডেক থেকে রাগত কোলাহল শোনা যাচ্ছে। প্লেনটাকে লক্ষ্য করে ছুটে এল উত্তপ্ত সীসা, কিন্তু বেশিরভাগই দূরে পড়ল। কয়েকটা গুলি ডানা আর ফিউজিলাজে লেগে শিস কেটে পিছলে চলে গেল, কোন ক্ষতি না করে।

প্লেনের কাছে সাঁতরে এল পাশা। জাহাজের দিকে পাশ ফিরে থেকে ওকে আড়াল করেছে প্লেনের বডি। একটা দরজা খুলে গেল, ছুঁড়ে দেয়া হলো দড়ির সিঁড়ি, ঢেউয়ের মধ্যে ঝুলে থেকে পানিতে চুমু খাচ্ছে যেন নিচের অংশটা। হাত বাড়িয়ে ওটা ধরে ফেলে বেয়ে উঠতে শুরু করল পাশা। ওপর থেকে শোনা যাচ্ছে চাপা কথাবার্তার শব্দ। একজনের কণ্ঠ অন্যজনের চেয়ে জোরাল, পাশাকে বলল, ‘তাড়াতাড়ি করো, জলদি ওঠো!’ কণ্ঠটা চিনতে পারল পাশা। সিঁড়ির মাথায় উঠে আসতে চোখ পড়ল জ্যাক গ্রিমালদির হাসিমুখের দিকে। হান্টারের ডিপার্টমেন্টের লোক ও, পাইলট।

‘কেমন আছো, পাশা?’ আগুন থেকে তুলে নিতে এলাম তোমাকে।

‘থ্যাংক ইউ, জ্যাক। মনে হচ্ছে, নতুন জন্ম হয়েছে আমার!’ সিটে নেতিয়ে পড়ল পাশা!

কী-ওয়েস্টের দিকে উড়ে চলল প্লেন। পাশা ভাবছে, দক্ষিণ ফ্লোরিডার কাজ আপাতত শেষ। এখানকার চক্রটাকে অকেজো করে দেয়া হয়েছে। তবে সব শেষ হয়নি। ফেলিডাইকে খুঁজে বের করতে হবে এবার। সে-দায়িত্ব আপাতত হান্টারের ওপর ছেড়ে দিয়ে চোখ বুজল ও।

– শেষ –

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *