৫. পাশা বুঝল, ওর অনুমান ভুল হয়েছে
পাশা বুঝল, ওর অনুমান ভুল হয়েছে। মিনি-সাবমেরিনের নাবিকরা এখন আর গুরুত্বপূর্ণ ভাবছে না ডুয়েরোকে, বরং ওকে সরিয়ে দেয়াটাই ভাল মনে করেছে। সে-কারণেই আরেকটা টর্পেডো ছুঁড়েছে।
মানুষের মন-যন্ত্রটার কোনও তুলনা হয় না। আর এ কারণেই মানবমনকে ঈর্ষা করে সিলিকন ভ্যালি থেকে শুরু করে টোকিওর সমস্ত কম্পিউটার ডিজাইনাররা। যত দ্রুতই কাজ করুক না কেন কম্পিউটার, যত বেশি মেগাবাইটের মেমোরিই লাগানো হোক না কেন, মানবমনের মত জটিলতা আর দ্রুততার সঙ্গে পাল্লা দেয়ার সাধ্য কোন কম্পিউটারেরই নেই। যে মুহূর্তে টর্পেডোটার ওপর চোখ পড়েছে পাশার, সাথে সাথে ভাবনা খেলে গেছে মনে— তিনটে বিকল্প আছে এখন ওর হাতে। এক, ডুয়েরোকে ছেড়ে বোটের অন্যপাশ দিয়ে লাফিয়ে পড়া; কিন্তু তাতে দুটো বোটই ধ্বংস হয়ে যাবে, আর তাহলে সাগরের মাঝখানে হাবুডুবু খেতে খেতে ভেসে থেকে অন্য কোনও বোটের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না ওর। দুই, স্যান্টোরোর বোটটাকে নিয়ে সরে যাওয়ার চিন্তা করতে পারে। কিন্তু সমস্যাটা হলো, এটার ইঞ্জিন তাড়াহুড়ো করে চালু করতে গেলে বেশি তেল চলে আসে-ইতিমধ্যেই একবার এটা ঘটেছে। এবারও যদি সেরকম ঘটে, দেশে কবর দিতে পাঠানোর জন্য ওর দেহের টুকরোগুলোও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর তিন নম্বর বিকল্পটা হলো, সি কুইনে লাফিয়ে পড়ে থ্রটল পুরো খুলে দেয়া।
মাত্র কয়েক হার্টবিট সময়ের মধ্যে কথাগুলো খেলে গেল পাশার মনে। তৃতীয় বিকল্পটাই বেছে নিল ও।
এক ধাক্কায় ডুয়েরোকে সরিয়ে দিয়ে দৌড়ে এসে লাফ দিল ব্রিজের কিনার থেকে। লাফ দেয়ার সময় ধাক্কাটাতে পুরো জোর দিতে পারেনি, আর তার খেসারত দিতে হলো। সি কুইনে নামতে গিয়ে বা পা’টা পিছলে গেল, তাল সামলাতে না পেরে হোঁচট হয়ে পড়ল কাকতালীয়ভাবে একেবারে হুইলের ওপর। হুইল ধরে নিজেকে সোজা করছে, একই সঙ্গে হাত বাড়িয়ে মোচড় দিল স্টার্টারে, সঙ্গে সঙ্গে জ্যান্ত হয়ে গেল বোটের ইঞ্জিন, উত্তরে ছুটল পাশা।
ডুয়েরোও বোট চালানোর চেষ্টা করছে। থ্রটলটাকে ঠেলে দিল যতদূর যায়। কিন্তু বোটের গতি বাড়ার বদলে ফুটফুট শুরু করল ইঞ্জিন, দুলে উঠল বোট, আরও একবার ডিজেলে ডুবে গেছে ফিউল-ইনটেক ভালভ। মস্ত একটা তীরের মাথার মত পানি কেটে ছুটে আসছে টর্পেডো। ওটার দিকে তাকিয়ে অসহায় রাগে চিৎকার করে উঠল ও।
ডুয়েরোকে থ্রটলের মাথায় কিল মারতে দেখল পাশা। তারপর পাক খেয়ে ঘুরে ফিশিং বোটের পিছনে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল লোকটা। কিন্তু শূন্যেই রয়ে গেল ওর বাড়ানো পা’টা। বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দ, পরক্ষণে ডুয়েরোর বোটের সামনের দিকটা উঁচু হয়ে গিয়ে পানি থেকে লাফিয়ে উঠল বোট। ফিউল ট্যাংক বিস্ফোরিত হওয়ার শব্দ শোনা গেল পর পর দু’বার। মস্ত একটা আগুনের কুণ্ড যেন গ্রাস করে ফেলল বোটটাকে, বৃষ্টির মত ঝরে পড়তে লাগল পোড়া কাঠের টুকরো আর বোটের অন্যান্য ভাঙা অংশ।
দক্ষিণ-পশ্চিমে চলল পাশা। পিছে তাড়া করে আসবে সাবমেরিনটা, জানা কথা। ওটার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে কি না সি কুইন, সর্বোচ্চ কত গতিবেগে ছুটতে পারে, জানে না। তবে যদি কাছাকাছি থেকে থাকে, তো ওটা থেকে ছোঁড়া টরপেডোর সঙ্গে কিছুতেই পারবে না বোটটা, এটা ঠিক।
দীর্ঘ দশটি টান টান উত্তেজনার মিনিট পার করল পাশা, ছুরির মত সাগরের পানি কেটে ছুটে চলেছে সি কুইন। বার বার পিছনে ফিরে তাকাচ্ছে ও। ডুয়েরোর পোড়া বোটের জ্বলন্ত অবশিষ্টাংশের কাছে। পানি ছুঁড়ে মাথা তুলতে দেখল একটা চকচকে জিনিসকে। সাবমেরিনের পেরিস্কোপ। ঘুরছে ওটা। পেরিস্কোপের লেন্সে চাঁদের আলো পড়ে মৃদু দীপ্তি ছড়াচ্ছে। সি কুইনের দিকেই তাকিয়ে আছে ওটা বুঝতে অসুবিধে হলো না পাশার। রানিং লাইট নিভিয়ে দিয়ে, দক্ষিণ কোর্স সেট করল ও।
মিহি পানির ফোয়ারা, নত তলিয়ে গেল পেরিস্কোপ।
এরপর কী ঘটবে, জানে না পাশা। সব কিছু নির্ভর করছে এখন সাবমেরিনটার গতিবেগ-কতখানি জোরে ছুটতে পারে ওটা-তার ওপর। কী-ওয়েস্টের বন্দরে ভিড়ানো বোট আর জাহাজগুলোর আলো চোখে পড়ার পরও নিশ্চিন্ত হতে পারল না ও। আলোগুলো অনেক কাছে চলে আসার পরও যখন কিছু ঘটল না, তখন গিয়ে সত্যিকার অর্থেই চেয়ারে হেলান দেয়ার বিলাসিতাটা উপভোগ করল পাশা। দ্বীপে ফেলে আসা ওর মূল্যবান জিনিসপত্র ভরা ব্যাগটার কথা মনে পড়ল। আগামী দিন সময় পেলে আনতে যাবে ওটা, ভাবল ও। তবে এখন সবচেয়ে জরুরি হলো, অদ্ভুত মিনিসাবমেরিনটার কথা স্টিফেন হান্টারকে ফোন করে জানানো।
*
‘জানি,’ অন্য প্রান্ত থেকে শান্তকণ্ঠে হান্টার বলল। ‘দু’রাত আগে ওরকম একটা সাবমেরিন থেকে টর্পেডো ছুঁড়ে অ্যালামেডা কোস্ট গার্ডের একটা পেট্রল বোট ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে। এর সাক্ষীও আছে। দুটো ছেলে তখন খাড়ির পাড়ের উঁচু তীরে বসে হাওয়া খাচ্ছিল, হাই স্কুলে পড়ে ওরা। পুরো ঘটনাটাই ঘটতে দেখেছে।’
কী-ওয়েস্টের হোটেল রুমে পিঠের নীচে বালিশ দিয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছে পাশা। ‘তারমানে ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলেও ঘোরাফেরা করছে আরেকটা সাবমেরিন? কীসের বিরুদ্ধে লেগেছি আমরা? সাবমেরিনের বহর?’
‘সেটা জানার দায়িত্বই দিয়েছেন আমাকে মিস্টার এক্স,’ হান্টার বলল। ‘মনে হচ্ছে মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই আর কোনদিন শেষ হবে না আমাদের। এক মুহূর্ত থামল ও। টপ প্রায়োরিটি দিতে হবে এটাকে, পাশা। এ সব সাবমেরিন কোথায় বানানো হয়, আমেরিকার সাগর সীমানায় কোন পথে ঢোকে, কোথায় লুকিয়ে থাকে, সব জানতে হবে আমাদের।’
‘হু!’ পাশা বলল। ‘খড়ের গাদায় সুচ খুঁজতে বলছ।’
‘না, অতটা কঠিন বোধহয় হবে না। সাবমেরিন এত সস্তা জিনিস নয়, এমনকী মিনি-সাবমেরিনও অনেক দাম। লক্ষ-কোটি টাকার মালিক, যাদের কত টাকা আছে নিজেরাও জানে না, তাদের কারও পক্ষেই কেবল ওগুলো বানানো সম্ভব।’
একমত হলো পাশা। ‘তাতে অবশ্য কাজের পরিধি ছোট হয়ে আসে, কিন্তু তারপরেও ডজন ডজন সন্দেহভাজনের ওপর নজর রাখতে হবে। প্রতিটি লোককে চেক করে আসল লোকটিকে শনাক্ত করাও যথেষ্ট কঠিন কাজ। প্রচুর সময় লাগবে।’
‘আরেক দিক থেকে ভেবে দেখা যাক। সাবমেরিনের যন্ত্রাংশ স্পেশাল জিনিস। এমন নয় যে কাছের হার্ডওয়্যারের দোকান থেকে গিয়ে কেউ কিনে আনতে পারবে। আমি খোঁজ নিতে লোক লাগাচ্ছি। আমার বিশ্বস্ত লোক আছে, টাকার জন্য যে হাঁড়িকাঠের নিচেও গলাটা বাড়িয়ে দিতে রাজি। কিছুটা সময় লাগবে, তবে সাবমেরিন নির্মাতাকে খুঁজে বের করবই।’
‘ততদিন আমি কী করব?’ পাশার প্রশ্ন।
‘বসে থাকো। বিশ্রাম নাও। আশা করি খুব শীঘ্রি আবার সাগরদানব শিকারে পাঠাতে পারব তোমাকে।’
* *
অন্য সময় হলে খবরটা নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবত না হান্টার। কিন্তু তথাকথিত সাগর-দানবের বর্ণনার সঙ্গে বর্তমানের ঘটনাপ্রবাহ কৌতূহলী করে তুলল ওকে, বিশেষ করে কী-ওয়েস্টে পাশার দেখা সাবমেরিনের কথা শোনার পর। তিন সপ্তা আগের পুরানো খবরের কাগজ বের করে খুঁটিয়ে পড়ল আবার ইয়ট দুর্ঘটনার রিপোর্টগুলো। ন্যাশনাল হেডলাইন হয়ে গিয়েছিল খবরটা, যদিও লোকে পড়ে খুব একচোট হেসেছে।
ব্রুকলিনের অল্পবয়েসী, বিত্তবান এক দম্পতি দুটো ইয়ট কিনে লম্বা সফরে বেরোবে ঠিক করল। ইচ্ছে ছিল, আটলান্টিক সিবোর্ড ধরে এগোবে ওরা, যেখানে থামতে ইচ্ছে করবে সেখানেই থামবে। ফ্লোরিডা উপসাগর পার হয়ে উত্তর সেইন্ট পিটার্সবুর্গের দিকে এগোলো ইয়ট দুটো, আমেরিকার পশ্চিম উপকূলরেখা ধরে।
নেপলসের কাছে এসে ঘটল অঘটন।
গোধূলিবেলায় ইয়টের হুইলে দাঁড়ানো একজন ইয়টসম্যান সাগরের দিকে তাকিয়ে দেখে উত্তরে চলেছে একটা মালবাহী জাহাজ। ওটার পিছন পিছন যাচ্ছে একটা সাগর-দানব। দানবের খাটো মোটা শরীর আর সাপের মত লম্বা গলাটা স্পষ্ট দেখেছে বলে দাবী করেছে লোকটা। উত্তেজনা আর কল্পিত দানবকে বাস্তবে দেখার আগ্রহে কাউকে কিছু না বলে, অন্য ইয়টের চালককে সাবধান না করে, আচমকা ইয়টের নাক ঘুরিয়ে দিল ও।
ফল যা হবার হলো, গুঁতো খেয়ে ওখানেই ডুবে গেল দ্বিতীয় ইয়টটা, আর প্রথমটা ধুকতে ধুকতে বহু কষ্টে ফোর্ট মেয়ারের বন্দরে পৌঁছল। ওখানে কর্তৃপক্ষের কাছে দুর্ঘটনার রিপোর্ট করা হলো। খবর পেয়ে হতভাগ্য দম্পতির কাছে দলে দলে ছুটে এল সাংবাদিকেরা।
মিনি-সাবমেরিনকেই যে সাগর-দানব ভেবে ভুল করেছে ইয়টসম্যান, তাতে আর কোন সন্দেহ রইল না হান্টারের। সঙ্গে সঙ্গে কাজে লেগে গেল ও। স্পেশাল ইনভেস্টিগেট ইউনিটকে খোঁজখবর নিতে বলল। শিপিং রেকর্ড চেক করে জানা গেল, ঘটনাটা ঘটার সময় ওই এলাকায় মালবাহী জাহাজ ছিল তিনটে। একটা এসেছিল মেক্সিকো থেকে, একটা ব্রাজিল, আর তৃতীয়টা হনডিউরাসের পতাকাবাহী, কিন্তু কোম্পানিটা কলাম্বিয়ান। জাহাজটার নাম গ্রিফিথ।
কলাম্বিয়ার সঙ্গে গ্রিফিথের যোগাযোগ আরও কৌতূহলী করে তুলল হান্টারকে। জাহাজটা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার নির্দেশ দিল তদন্তকারীদের। জানা গেল, প্রতি মাসে কলোম্বিয়া থেকে আমেরিকায় দুবার যাতায়াত করে ওটা। নানা ধরনের মাল বহন করে। একটা ব্যাপার দৃষ্টি আকর্ষণ করল হান্টারের , আর সেটা হলো-সব সময় কী-ওয়েস্টের পাশ দিয়েই যায় জাহাজটা, কোন যাত্রায়ই এর ব্যতিক্রম হয় না।
গ্রিফিথ এখন কোথায়, জানার চেষ্টা করল হান্টার। বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হলো না। সেইন্ট পিটার্সবুর্গে ওটা নোঙর করেছে, খবর পেয়ে পাশাকে ফোন করল ও। জাহাজটার ওপর চোখ রাখতে বলল। জানাল, আগের দিন ওখানে পৌঁছেছে গ্রিফিথ, ছত্রিশ ঘণ্টার আগে ছাড়বে না।
‘সি-মনস্টারের কী হবে?’ রসিকতা করল পাশা।
‘সেজন্যই তো বলছি, সেইন্ট পিটার্সবুর্গে খোঁজ করোগে,’ হেসে বলল হান্টার। ‘গ্রিফিথের গায়ে সাগর-দানবের গন্ধ লেগে আছে।’
সামান্যতম দেরি না করে রওনা হলো পাশা। প্রাইভেট প্লেন ভাড়া করে সেইন্ট পিটার্সবুর্গ-ক্লিয়ারওয়াটার ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌঁছল সেদিন দুপুরের সামান্য পরে, যেদিন সকালে ডুয়োরো আর তার বোটটা ধ্বংস করে দিয়ে কী-ওয়েস্টে ফিরেছে ও। এয়ারপোের্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে এসে ডকের কিনারের একটা মোটেলে উঠল। রুমে ব্যাগ রেখে বেরোল।
দিনটা বেশ গরম। কিন্তু নীল রঙের একটা জ্যাকেট গায়ে দিয়েছে পাশা। সাগরের ধারের পুরানো কাপড়ের দোকান থেকে একটা সিম্যান’স ক্যাপ কিনে মাথায় দিল। কাঁধ কুঁজো করে, ক্যাপ নামিয়ে, কলার উঁচু করে, বন্দরের ব্যস্ত মানুষদের ভিড়ে মিশে গেল।
গ্রিফিথকে খুঁজে বের করা কঠিন হলো না। সারি দিয়ে নোঙর করা সাতটা মালবাহী জাহাজের মধ্যে প্রথম থেকে তৃতীয় জাহাজটা গ্রিফিথ। জাহাজের হোল্ডে মাল নামানো হচ্ছে।
মালের বাক্সের একটা স্কুপের পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে পাশা, হঠাৎ মনে হলো কেউ ওর ওপর নজর রাখছে। মুখ তুলে দেখল, পি-জ্যাকেট পরা, ভুড়িওয়ালা মোটা একটা লোক ওর দিকে তাকিয়ে আছে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ, মাথায় এলেমেলো চুল। নিরীহ ভাব করে রইল পাশা, যেন খুব সাধারণ একজন পথচারী, জাহাজ দেখছে, গ্রিফিথের প্রতি কোন বিশেষ আগ্রহ নেই। কয়েক পা এগোল। পিছন ফিরে দেখে, লোকটা নেই।
আগামী সকালে জোয়ার এলে ছাড়বে গ্রিফিথ। ততক্ষণ বন্দরেই থাকবে। একটা দোকানের পে-ফোন থেকে হান্টারকে ফোন করে একটা সার্চ ওয়ারেন্ট ইস্যুর ব্যবস্থা করতে বলল পাশা।
‘কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখাতে না পারলে তো ওয়ারেন্ট ইস্যু করতে পারবেন না জাজ,’ তিক্তকণ্ঠে বলল হান্টার। সরি, পাশা, যা করার তোমাকেই করতে হবে, ওখানে আমি কোন সাহায্য করতে পারব না। যদি বিপদে পড়ো, নিজের চেষ্টায়ই উদ্ধার পেতে হবে। জাহাজটা ছাড়ার আগে স্পেশাল ইউনিট পাঠানোও সম্ভব নয়।’
‘ওসব লাগবেও না। তুমি জানো, একা কাজ করতেই পছন্দ করি আমি। আচ্ছা, পরে যোগাযোগ করব।’
দিনের আলোয় কিছু করা যাবে না। মোটেলে ফিরে এল পাশা। হাতঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখল, সন্ধ্যে ছ’টা। ভালমত একটা ঘুম দিয়ে তরতাজা হয়ে উঠে শেভ সেরে, গোসল করে, তারপর বেরোবে।
ঘুমিয়ে পড়ল ও। অ্যালার্ম বাজার সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলল! উঠে, ঠাণ্ডা পানিতে শাওয়ার নিয়ে চনমনে করে তুলল স্নায়ুগুলোকে। কাপড় পরে লবিতে এসে ভেনডিং মেশিন থেকে খুব কড়া এক কাপ কালো কফি খেয়ে আরও চাঙা করল শরীরটাকে। তারপর বেরিয়ে এল দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার গোধূলি ছাওয়া আকাশের নিচে।
অনেক নির্জন হয়ে এসেছে পানির ধারটা। ডে শিফটের কাজ শেষ, রাতের শিফট সবে শুরু হয়েছে। আশপাশ দিয়ে তাড়াহুড়ো করে হেঁটে যাচ্ছে বন্দর-শ্রমিকরা। পাশার দিকে নজর নেই কারও।
গ্রিফিথের ধার দিয়ে যাওয়ার সময় পাশ ফিরে তাকাল না ও। সামনে কতগুলো বাক্স দেয়াল তৈরি করে রেখেছে। ওগুলোর পাশ কাটানোর সময় একটা ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল জাহাজের ডেকে দাঁড়ানো নাবিকদের।
অন্ধকার হয়ে এল আকাশ। জ্বলে উঠল রাস্তার বাতিগুলো, পানির কিনারের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত। বন্দরে তীক্ষ্ণ ভেঁপু বাজাল একটা টাগবোট।
মাঝরাতের আগে কিছু করা যাবে না। নাবিকদের অধিকাংশ ঘুমিয়ে পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে পাশাকে।
ঠিক এ সময় পি-জ্যাকেট পরা সেই লোকটাকে দেখতে পেল ও। কয়েকজন রুক্ষ চেহারার নাবিককে সঙ্গে নিয়ে গ্যাংপ্ল্যাঙ্ক বেয়ে নেমে আসছে লোকটা। তক্তার সিঁড়ির গোড়ায় নেমে পকেট থেকে একটা সিগার বের করে দাঁতে চেপে ধরল ও। লাফ দিয়ে এসে দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে সেটা ধরিয়ে দিল একজন নাবিক।
নিশ্চয় জাহাজের ক্যাপ্টেন, অনুমান করল পাশা। ছায়ায় গা মিশিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। লোকগুলো হাঁটতে শুরু করলে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে পিছু নিল ও।
একটা রেস্টুরেন্টের দিকে এগোচ্ছে দলটা। খোলা দরজা দিয়ে ভিতর থেকে কথা, হাসি আর মৃদু বাজনা শোনা যাচ্ছে। সারি দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল লোকগুলো।
ক্যাপটা টেনে নামিয়ে, এক মিনিট অপেক্ষা করে, পাশাও ঢুকে পড়ল রেস্টুরেন্টের ভিতর। দরজার ডান পাশে সরে, দেয়ালের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে ভিতরে চোখ বোলাল। আলো এত কম, অন্ধকার চোখে সয়ে আসতে পুরো একটা মিনিট লাগল। সিগারেটের ধোঁয়ায় ভারী হয়ে আছে ঘরের বাতাস। মোটাসোটা এক মহিলা এগিয়ে এল পাশার দিকে। ভুরু কুঁচকে ওর আপাদমস্তক দেখে বলল, ‘আগে তো কখনও দেখিনি আপনাকে? নতুন নাকি? আমি এই রেস্টুরেন্টের মালিক। আমার নাম ক্যাথি? কী লাগবে আপনার?’
ইতিমধ্যে গ্রিফিথের নাবিকেরা একটা টেবিলে বসে পড়েছে। সেদিকে তাকিয়ে জবাব দিল পাশা, ‘এক কাপ কফি হলেই চলবে।’ নাবিকদের পাশের একটা টেবিলে বসল ও।
গ্রিফিথের নাবিকদের কোন তাড়া নেই। খাবারের অর্ডার দিল। পরের একটি ঘণ্টা শুধু খেয়ে আর খোশগল্প করে কাটাল।
খুব ধীরে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে পাশা। কান খাড়া। নাবিকদের টেবিলের খুব কাছাকাছি বসেছে। ওদের কথা সব শুনতে পাচ্ছে। বেশির ভাগ গল্পই সাগর আর জাহাজের। জমিয়ে বসেছে নাবিকেরা। চট করে গিয়ে গ্রিফিথে চুঁ মেরে আসার এটাই সুযোগ। উঠতে যাবে পাশা, ঠিক এ সময় অন্য আরেকটা টেবিল থেকে আরেকজন লোকের মন্তব্য কানে আসতে স্থির হয়ে গেল।
লম্বা একজন নাবিক, মুখে চাপদাড়ি, চেয়ারে ঘুরে বসে পি-জ্যাকেটের দিকে তাকাল। ‘আরি, ফার্নান্দো, কোথায় ছিলে এতদিন? সেই সাগর-দানবটাকে নিয়ে ঘুরতে বেরোনোর পর থেকে আর তো তোমার কোন খবরই নেই।’
দুই টেবিলেরই কয়েকজন লোক হেসে উঠল, তবে ক্যাপ্টেন ফার্নান্দো হাসল না। গম্ভীর মুখে জবাব দিল, ‘জরুরি কাজে ব্যস্ত থাকি আমি, পিরানো।’
এক হাত উঁচু করে তালুতে একটা খাবারের ট্রে নিয়ে পাশার পাশ কাটাল ক্যাথি। ফার্নান্দোর টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
‘এই সাগর-দানবটা আবার কী জিনিস?’ হেসে উঠল পিরানো।
‘কেন, কয়েক দিন আগের খবর পড়নি? নিউ ইয়র্ক থেকে আসা কতগুলো গাধা ফার্নান্দোর জাহাজের পিছন পিছন একটা সাগর-দানবকে যেতে দেখে এমন প্যাণ্ট খারাপ করে ফেলেছিল, নিজেনের ইয়টে ইয়টে গুঁতে লাগিয়ে মরতে মরতে বেঁচেছে।
‘খবরটা পড়েছি,’ ফার্নান্দোর দিকে তাকিয়ে হাসল ক্যাথি। ‘কিন্তু এর মধ্যে তো গ্রিফিথের নাম দেখলাম না।’
‘দেখনি, তার কারণ আছে,’ ফার্নান্দো বলল। ‘ওসব গাঁজাখুরি গল্পে নিজের নাম ঢোকাতে চাইনি আমি। সাগর-দানব বলে কোন জিনিস নেই। আমার জাহাজের পিছন পিছন এলে নাবিকদের কেউ দেখল না কেন?’
একটা ভুরু উঁচু করল পিরানো। ‘আমার যদ্দূর মনে পড়ে, তোমার একজন নাবিক একবার একটা অস্বাভাবিক জিনিস দেখার কথা বলেছিল। বছরখানেক আগে, ভুলে গেছ? ওই যে, আর্জেন্টিনা থেকে আসা সেই অল্পবয়েসী লোকটা, যে জাহাজ থেকে পড়ে গিয়ে ডুবে মরেছিল।’
‘তোমার স্মৃতিশক্তি যে এত ভাল জানতাম না,’ রুক্ষকণ্ঠে ক্যাপ্টেন বলল। ‘কিন্তু সেটা তো এক বছর আগের ঘটনা। এর সঙ্গে ইয়ট অ্যাক্সিডেন্টের কোন সম্পর্ক নেই।’
ফার্নান্দোর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল পিরানো। ‘না, তা ঠিক। এটা নিশ্চয় অন্য আরেকটা সাগর-দানব। আমার মনে হয়, তোমার জাহাজ থেকে এমন কিছুর গন্ধ বেরোয়, পচা মাংসের গন্ধ পেলে মাছি যেমন পাগল হয়ে যায়, দানবগুলোও তেমনিভাবে ছুটে আসে।’
চোখের পলকে দাঁড়িয়ে গেল ফার্নান্দো। পি-জ্যাকেটের পকেটে ঢুকে গেছে ডান হাত। ‘খবরদার, আমার জাহাজের বদনাম করবে না! তোমার ওই নোংরা জিভ আমি কেটে নেব।’
তাড়াতাড়ি দুটো টেবিলের মাঝখানে এসে দাঁড়াল ক্যাথি। ‘উঁহু, ওসব চলবে না এখানে! তোমরা জানো, আমি ওসব বরদাস্ত করি না। মারামারি যদি করতেই হয়, বাইরে যাও, পিছনের উঠানে। আরও ভাল হয়, যদি রাস্তায় চলে যাও। পুলিশের সঙ্গে ঝামেলা করতে ভাল লাগে না আমার।’
‘আরে থামো, থামো; শান্ত হও, দুজনেই,’ পিরানো বলল। ‘পুরানো দোস্তের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ায় আমি তো এমনি একটুখানি মজা করছিলাম। ফার্নান্দোকে আমি অপমান করতে চাইনি।’
‘না করলেই ভাল,’ ভোতাস্বরে বলল ফার্নান্দো। নিজের সঙ্গীদের দিকে সামান্য মাথা ঝুঁকিয়ে উঠতে ইশারা করল। দলবল নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল ও।
অনুসরণ করার জন্য উঠে দাঁড়াল পাশা। পিছন থেকে আরেকটা মজার মন্তব্য কানে এল। ঘরের সবাইকে শুনিয়ে জোরে জোরে বলল পিরানো, ‘ওই শুয়োরটা ভেবেছে কী নিজেকে নিজেই একদিন ভাগাড়ে মরে পড়ে থাকবে, এই আমি বলে রাখলাম, দেখো! আর চারপাশে যে হারে গুজব শোনা যাচ্ছে, সেই দিনটি আসতে খুব বেশি বাকি নেই।’ আত্মতৃপ্তির হাসি হাসল দাড়িওয়ালা লোকটি। ‘কর্তৃপক্ষ সতর্ক হয়ে গেছে, ওর জাহাজের দিকে নজর পড়েছে ওদের, কী হচ্ছে ওটাতে জানতে চায়।’
‘থামো!’ উদ্বিগ্নকণ্ঠে সতর্ক করল ক্যাথি। ‘দেখো, কথা খুব বেশি বলো তুমি। বিপদে যে পড়বে, সে হুঁশও থাকে না।’
‘আরে রাখো,’ তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নেড়ে উড়িয়ে দিল যেন পিরানো।
বিল্ডিঙের সামনের দরজার দিকে চোখ পড়ল পাশার। একটা দরজা সামান্য ফাঁক হয়ে থাকতে দেখল। ও তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আস্তে করে বন্ধ হয়ে গেল ফাঁকটা। বোঝা গেল, কেউ ওখানে দাঁড়িয়ে আড়ি পেতে শুনছিল।
‘আমি যা বলছি ঠিকই বলছি, পিরানো,’ ক্যাথি বলল। ‘এ সব কথার একটি বর্ণও যদি ফার্নান্দোর কানে যায়, তোমাকে আস্ত রাখবে না।’
‘ওই শয়তানটাকে আমি ডরাই মনে করেছ?’ দম্ভ করে বলল পিরানো। ‘এক হাতে ওর চেয়ে বড় বড় মাস্তানকে কাবু করে দিতে পারি।’ কাপের কফির তলানিটুকু চুমুক দিয়ে শেষ করে উঠে দাঁড়াল ও। পা টানতে টানতে বেরিয়ে গেল রেস্টুরেন্ট থেকে।
ভ্রুকুটি করল পাশা। বাঁয়ে মোড় নিয়ে হেঁটে চলল নাবিক, দুনিয়ার কোন দিকে খেয়াল নেই, জোরে শিস দিতে দিতে চলেছে। নিঃশব্দে লোকটার পিছনে চলে এল পাশা।
সরু একটা নির্জন গলির মুখে ঢুকছে পিরানো। পিছন থেকে এক হাতে পাশা ওর চুল খামচে ধরে আরেক হাতে এক কনুই চেপে ঠেলতে ঠেলতে গলির ভিতরে নিয়ে গেল, ধাক্কা দিয়ে ফেলল একটা দেয়ালের ওপর।
পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল পিরানো। ছায়ার অস্পষ্ট আলোয় মৃদু ঝিলিক দিল একটা ছুরির ফলা। গর্জে উঠল, ‘ফার্নান্দো, শুয়োর কোথাকার…’ পাশাকে দেখে চমকে থেমে গেল ও। ওর হাত থেকে ছুরি কেড়ে নিচ্ছে না দেখে আরও অবাক হলো। ‘কে তুমি? এসবের মানে কী?’
‘কথা বলতে চাই তোমার সঙ্গে,’ পাশা বলল।
‘কথা, না!’ পিরানো বলল। ‘কী কথা? দেখো, যে-ই হও তুমি, জলদি সরো আমার সামনে থেকে, যদি নিজের ভুঁড়ি ফাঁসানো নিজের চোখে দেখতে না চাও।’
দুই হাত বুকের ওপর আড়াআড়ি রেখে যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল পাশা। ‘আমার মনে হলো গ্রিফিথের ক্যাপ্টেন ফার্নান্দোকে পছন্দ করো না তুমি।’
ঘাড়টাকে মুরগির মত কাত করে তাকাল পিরানো। ‘সেটা কি কোন গোপন কথা? কিন্তু তাতে তোমার কী? তুমি কী চাও?’
‘তুমি বলছিলে, ফার্নান্দোর জাহাজে অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে। কী, সেটা আমি জানতে চাই।’
‘কেন?’ পিরানো জিজ্ঞেস করল, ‘কে তুমি?’
‘আমি ফেডারেল গভর্নমেন্টের কাজ করি, কী-ওয়েস্টের পিন্টোকে যা বলেছিল পাশা, পিরানোকেও তা-ই বলল।
‘ফেড!’ তাড়াতাড়ি ছুরি নামাল পিরানো। ‘সত্যি? এখানে যা ঘটছে, সেটার তদন্ত করছ?’
‘কী ঘটছে?’
যখন বুঝল, ওকে মারবে না পাশা, আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল পিরানোর আচরণ। ছুরি ঘোরাতে ঘোরাতে হাসল। বলল, ‘অনেক কিছু, মিস্টার! বিশ্বাস করো। আমি সব জানি। কিন্তু বললে আমার লাভটা কী? আমাকে কত দেবে?’
‘কিছুই না।’
হাসি চাপতে পারল না পিরানো, ‘বাহ, দারুণ তো। আমি তোমাকে এত এত তথ্য দেব, বিনিময়ে কিছুই পাব না? কয়েক শো ডলারের তথ্য, বুঝলে। তুমি আমাকে অল্প কিছু দাও, তাতেই সব বলে দেব।’
জোরে নিঃশ্বাস ফেলল পাশা। ‘আমি ভেবেছিলাম তুমি ফার্নান্দোর শাস্তি চাও কিন্তু ভুল করেছি।’ শ্রাগ করে ঘুরে দাঁড়াতে গেল ও।
‘দাঁড়াও!’ পিরানো বলল। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরেছে। ভ্রুকুটি করল। তারপর ছুরিটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিল। ‘বেশ, তুমিই জিতলে। তবে আমার মত একজন ভালমানুষকে এভাবে ঠকানো উচিত হচ্ছে না তোমার। যাকগে, আসল কথায় আসা যাক।’ উসখুস করছে ও।
‘হয় বলো, নইলে গেলাম।’
‘ইটের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল পিরানো। ‘ঘটনার শুরু দু’বছর আগে। তখন কলাম্বিয়ার এক কোটিপতি লোক গ্রিফিথ জাহাজটা কিনে নিয়ে, পুরানো ক্যাপ্টেনকে লাথি মেরে তাড়িয়ে-আমার ভাল বন্ধু ছিল ওই ক্যাপ্টেন-ফার্নান্দোকে ক্যাপ্টেন বানাল। সবাই জানে, ফার্নান্দোর মত খারাপ লোক হয় না। তাই যখন শুনলাম, ওরা মাদকচক্রে জড়িয়ে গেছে, অবাক হইনি।’
হতাশ মনে হলো পাশাকে। তথ্য চায় ও, গুজব নয়।
‘তারপর গ্রিফিথ যখন এক মাসের জন্য গায়েব হয়ে গেল,’ পিরানো বলছে, ‘বুঝলাম, গুজবটা সত্যি। আর্জেন্টিনার সেই লোকটার মর্মান্তিক পরিণতি…’
‘এক সেকেণ্ড,’ বাধা দিল পাশা। ‘এতবড় একটা জাহাজ গায়েব হয় কী করে? কী বোঝাতে চাইছ তুমি?’
জবাব দিতে মুখ খুলল পিরানো। হঠাৎ শক্ত হয়ে গেল ও, বড় বড় হয়ে গেল চোখ। ‘সাবধান!’ চিৎকার করে বলল, ‘তোমার পিছনে!’