কমলার ছুটির দিন
ডাক্তারবাবু বিকাশকে অনেক রকমে দেখার পর বললেন, হ্যাঁ, উনি যাতে নিজে নিজে চলতে ফিরতে পারেন, তার ব্যবস্থা করে দেওয়া আজকালকার দিনে খুবই সহজ ব্যাপার। বিকাশ হাঁ করে অর্থপিডিক্স সার্জেনের সুঠাম চেহারাটির দিকে চেয়ে আছে। তার কপালে ঘাম। কমলা বলছে, তা হলে আপনি বলছেন, চিকিৎসা করলে ওর পা দুটো সেরে যাবে। ডাক্তার বলছেন, না, ওঁর পা কী করে সারবে? কিন্তু তার মানে এই নয় যে ওকে সারা জীবন বিছানাতেই একা একা শুয়ে থাকতে হবে। সপ্লিন্ট লাগাতে হবে ওঁকে। সেটা লাগিয়ে ক্রাচ নিয়ে চলাটা অভ্যেস করলে উনি একেবারে স্বাধীন। নিজের ইচ্ছেমতোই চলাফেরা করতে পারবেন। কমলা বিকাশকে বলছে, শুনলে তো বিকাশ। এটা ভালই হবে। খুবই ভাল। বিকাশ! কমলা চেয়ে চেয়ে দেখল বিকাশ যে চেয়ারটায় বসে ছিল সেখানে কেউ নেই।
কমলার ঘুম ভেঙে গেল। ভোর হয়েছে। অত ভোরেও আলো বেশ জোরে ফুটেছে। উঠতে গিয়েও বিছানায় গা’টা ঢেলে দিল। আজ আর হুড়পাড় করে ট্রেন ধরতে হবে না। কাল ডাক্তার সরকারের সঙ্গে ওর যে-সব কথা হয়েছিল, সেটা আবার মনে পড়ল তার। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, পেশেন্টকে আনুন একবার, দেখি। এ ব্যাপারে আন্দাজে তো কিছু বলা যায় না। তবে আপনি যা বললেন, তাতে মনে হল, সপ্লিন্ট লাগাতে হবে। আর ক্রাচ নিতে হবে। ওতে অভ্যাস হয়ে গেলে চলতে ফিরতে কাজকর্ম করতে কোনও অসুবিধেই হবে না। এ রকম লোক আজকাল তো গাড়িও ড্রাইভ করছে। কাল বিকাশকে অবাক করে দেবে ভেবেছিল। ডাক্তার সরকারের সহায়তায় কাল সে একটা ইনভ্যালিড হুইল চেয়ারও কিনে এনেছে। বিকাশ খানিকটা নড়তে চড়তে তো পারবে। কিন্তু বিকাশের কী যে হল কাল রাতে। কথাটা তুলতেই পারল না কমলা।
কমলা হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে পড়ল। আজ অফিস নেই, কিন্তু বিকাশ তো আছে। কাজের পাহাড় জমে আছে। বাইরে বেরিয়ে চোখে মুখে জল দিল কমলা। রান্নাঘরে গেল। উনুনটা সাজিয়ে রেখে গিয়েছে ক্ষেমি। তাই আজ আর স্টোভ না জ্বেলে উনুনই আগে ধরিয়ে নিল কমলা। চায়ের জল চাপিয়ে দিল। তারপর বিকাশের ঘরে গিয়ে ঢুকল। বিকাশ যথারীতি বিছানায় উঠে বসেছে তার সাড়া পেয়ে।
তুমি কী এনেছ কমলা?
আবছা অন্ধকারে বিকাশকে খুব ক্লান্ত দেখাল।
কমলা বেডপ্যান, পেচ্ছাবের টিন, বোতল গুছিয়ে নিতে নিতে বলল, তুমি কি রাতে ঘুমোওনি?
না।
কিছু অসুবিধে হয়েছিল?
না।
তবে? কমলা ওগুলো হাতে নিয়ে ফিরে দাঁড়াল।
কৌতূহল।
বিকাশের গলার স্বরটা হাল্কা ঠেকল।
তবে এখন আর সেটা বলছিনে। আরও কিছুক্ষণ ভুগতে থাকো। আমি কাজকর্ম সেরে আসি।
কমলা বেরিয়ে গেল। তার বুকটা হাল্কা হয়ে এল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বেডপ্যান, পেচ্ছাবের বোতল, টিন ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে, সেগুলো নিয়ে ফিরে এল কমলা। সব গুছিয়ে রেখে জানলাগুলো খুলে দিতে লাগল। একটু একটু করে ঘরটায় আলো ভরে উঠতে লাগল। বিকাশের নাকে ফিনাইলের গন্ধ ঢুকতে লাগল। চোখ ভরে সে বাইরের আলো শুষে নিতে লাগল। দিনের শুরুটা খুব ভাল লাগল বিকাশের। আজ কমলাও বাড়িতে থাকবে। কমলাকে ম্যাজিকওয়ালি বলে মনে হতে লাগল তার। কমলার মুখে চোখেও একটা চাপা উৎসবের আভা ছড়িয়ে পড়েছে বলে মনে হল বিকাশের। নাকি সেটা এই চকচকে দিনটার আলোরই ছটা।
কমলা!
কমলার সঙ্গে হঠাৎ বিকাশের কথা বলতে ইচ্ছে হল।
বলো?
কমলা বিকাশের বিছানার কাছে এসে দাঁড়াল। ওর হাতে একটা ধোয়া পাটভাঙা বিছানার চাদর।
আজকে কত রোদ।
কমলা বিছানার চাদর পাল্টাতে লাগল। বিকাশকে এদিক থেকে ওদিক আবার ওদিক থেকে এদিক সরিয়ে দিয়ে পুরনো চাদরটাকে টেনে বের করে ফেলল। তারপর ঐরকম ভাবেই নতুন চাদরটাও পেতে ফেলল।
তোমাকে আজ চান করিয়ে দেব বিকাশ?
না না, কমলা, না।
বিকাশের হঠাৎ আর্ত চিৎকার কমলাকে চমকে দিল।
খবরদার কমলা। খবরদার।
বিকাশের কপালে ঘাম। বিকাশের হাত, ঠোট থরথর করে কাঁপছে। কমলা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বাসী বিছানার চাদরটা বগলে করে নীচে চলে গেল। কমলা চান সেরে একটা ধানি রং শাড়ি পরল। রান্না ঘরে ঢুকে হালুয়া বানাল। তারপর একটা ট্রের উপর দু প্লেট হালুয়া আর দু কাপ চা বানিয়ে নিয়ে উপরে উঠে এল। বিকাশ ততক্ষণে শাস্ত হয়ে গিয়েছে। টেবিলের উপর খাবার আর চা সাজিয়ে একটা চেয়ার টেনে বিকাশের মুখোমুখি বসল।
খিদে পেয়েছে। আজ তো আর ট্রেন ধরার তাড়াহুড়ো নেই। তাই খানিকটে হালুয়া বানিয়ে আনলাম। খাবে তো বিকাশ :
কমলা!
বলো?
আমাকে তোমার কী মনে হয়? অবুঝ?
বিকাশ, আমাকে তোমার কী মনে হয়? ছোট একটা খুকি?
না কমলা।
হ্যাঁ বিকাশ, আমার কিন্তু তাই মনে হয়। এসো, এখন এগুলো ঠাণ্ডা হয়ে যাবার আগে খেয়ে নিই। আমার কিন্তু খুব খিদে পেয়েছে।
কমলা হালুয়ার প্লেটটা তুলে নিয়ে খেতে শুরু করল। বিকাশ কিছুক্ষণ কমলার দিকে চেয়ে রইল। তারপর সেও হালুয়ার প্লেটটা তুলে নিল।
কমলা বলল, পাখাটা চালাও তো বিকাশ। বড্ড গরম লাগছে।
বিকাশ পাখার সুইচটা টিপে দিল। তারপর মনোযোগ দিয়ে খেতে লাগল। একবার কমলার মুখের দিকে চাইল। কিছু বলছে মনে হল। কিন্তু কিছুই বলল না। সে খেতে থাকল। মাঝপথে খাওয়া থামিয়ে দিল। কমলার মুখের দিকে চাইল। চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ।
কী হল বিকাশ? ভাল লাগছে না হালুয়া?
কমলা, তুমি খুব সুন্দর। মানে আজকে তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। মানে এই শাড়িটার রংটা খুব সুন্দর কমলা।
কমলার মুখটা ঝপ করে রাঙা হয়ে গেল। সে চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে চুমুক দিতে লাগল।
তুমি তা হলে দেখতে পাও বিকাশ?
দেখতে পাই মানে?
আমার ধারণা হয়েছিল, অতীত ছাড়া তুমি বুঝি দেখতে পাও না। ভুলটা ভাঙল। কমলা হাসল।
অতীত। হয়তো তুমি ঠিকই বলেছ কমলা। অতীত আমার বুকে চেপে বসেছে। তার হাত থেকে কিছুতেই রেহাই পাইনে। অতীতের হাতে বীভৎস মার খেয়েছি তো। তাই বুক থেকে তাকে আর নামাতে পারিনে।
অতীতের হাতে তুমি একাই মার খেয়েছ বিকাশ?
বিকাশ জবাব দিল না।
কেউ অক্ষত আছে, এমন কাউকে খুঁজে বের করতে পারবে বিকাশ?
বিকাশ চুপ করে আছে। তার হাতে চায়ের কাপ।
অতীত কাউকেই ছেড়ে কথা কয় না। তুমি নিজেকে এত আলাদা মনে করো কেন?
আমি নিজেকে আলাদা মনে করি?
করো না? তার হয়তো কারণও আছে।
আমি নিজেকে আলাদা মনে করি এটা তোমার মনে হয়েছে। এর একটা কারণও আছে বলে তোমার মনে হয়েছে। কী সেই কারণ, কমলা?
কারণটা যে খুব বড় কিছু, তা নয় বিকাশ। তবে ঘটনাটা তো সত্য। তুমি যদি আমাদের মতো চলতে ফিরতে পারতে, তা হলে দেখতে, আমাদের চাইতে তুমি আলাদা কিছু নয়। তুমি দেখতে বিকাশ, অতীতের হাতে প্রচণ্ড মার খেয়েও তুমি আমাদের মতোই একজন, এই বর্তমানের বাসিন্দা। আমরা চলতে পারছি। তুমি চলতে পারছ না। এই তো তফাত?
এই তফাতটা তোমার আছে ছোট্ট হতে পারে কমলা…
তুমি আমাকে ভুল বুঝো না বিকাশ। এই তফাতটা বেশ বড় তফাত। খুবই বড়। তবে এটা এমন নয় যে, এটা পার হওয়া যায় না। এইটেই আমি বলতে চাইছি। এই শারীরিক অসুবিধেটাকে মেনে নেওয়ার কোনও মানে হয় না। আমি এটাই বলতে চাইছি। এই অসুবিধেটা পার হতে পারলে, তুমি অতীতের পিঠে চড়ে বসতে পারতে। আমি এটাই বলতে চাইছি।
তুমিও স্বপ্ন দেখতে ভালবাসো কমলা।
হতে পারে বিকাশ। একবার দেখেছিলাম, সেটা অস্বীকার করি কী করে?
অনিন্দ্য?
হ্যাঁ।
তাকে ভালবেসেছিলে?
হ্যাঁ।
খুব ভালবেসেছিলে?
সে কথা তুলে এখন আর লাভ কী?
তুলতে আপত্তি আছে?
আপত্তি?
হ্যাঁ কমলা। তোমার যদি আপত্তি থাকে, জানতে চাইব না।
জানতে চাও কেন?
কৌতূহল।
কৌতূহল? তুমি জানতে চাও না বিকাশ, তোমার জন্য কলকাতা থেকে, কী আমি এনেছি?
ওটা পরে হলেও চলবে কমলা। আমি অনিন্দ্যকে জানতে চাই।
কমলা বিকাশের মুখের দিকে চেয়ে দেখল। বিকাশের মুখে আগ্রহটা বেশ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে।
কমলা, অনিন্দ্যকে তুমি ভালবাসতে বলে, তুমি আমাদের গাড়ির অ্যাকসিডেন্ট ঘটাবার জন্য মা কালীর কাছে প্রার্থনা করেছিলে।
আমি তখন, আমার বয়েস তখন অনেক কম ছিল বিকাশ। আর তা ছাড়া, সত্যিই তো কালীটালিতে আমি বিশ্বাস করতাম না। পরীক্ষার আগের মুহূর্তে যেমনধারা কালীভক্তি জাগত, সেই রকম আর কি। মানুষ বিশেষত বিয়ের কনে, নিরুপায় এবং মরিয়া হয়ে উঠলে আমাদের এখানে আর কীই বা করতে পারে?
বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে উঠতে পারে।
তা-ই তো যায় বিকাশ। আমাদের মেয়েদের সেইটেই তো গতি। সবাই কি আর মনের আহ্লাদে যায়? কত মেয়ে যে বুকটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে থাক করে বাপের বাড়িতে ফেলে রেখে যায়, তার খবর কি আমরা জানি? তোমার পক্ষে তো সেটা আন্দাজ করাও সম্ভব নয় বিকাশ। তুমি পুরুষ মানুষ। আমি মেয়ে, মেয়ে বলেই এই ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারি।
সেদিনের শুভকর্মটা নির্বিঘ্নে কেটে গেলে তোমাকে তো শ্বশুরবাড়িতে যেতে হত কমলা।
আমরা অনেক দূর এসে পড়েছি বিকাশ। অনিন্দ্যর কথা তুমি শুনতে চেয়েছিলে।
হ্যাঁ, কেবলই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় লাফিয়ে চলে যাচ্ছি। তা গেলেই বা। আজ তো দুজনে কথা বলবার খানিকটা সুযোগ পেয়েছি, আজ কাজও নেই তোমার, বকেয়া প্রশ্নগুলো যদি মীমাংসা করে ফেলা যায়, মন্দ কী?
আমার কাজ নেই? রাজ্যের কাজ জমে আছে। ক্ষেমি এল বলে।
আসুক না ক্ষেমি। তুমি বলো কমলা, সেদিন ঐ সময় পুলিশ এসে আমাকে যদি ধরে নিয়ে না যেত, তা হলে?
এর মধ্যে তুমি অস্পষ্টতা দেখলে কোথায়? আমার বাবা সম্প্রদান করে দিয়েছেন তাঁর সালঙ্কারা মেয়েকে। বিধিমত যা কিছু অনুষ্ঠান হয়ে গিয়েছে। এখন একটা কাজই বাকি, ঢাকঢোল বাজিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া। এখানে সেই মেয়েটা তো আর মানুষ থাকছে না। জলজ্যান্ত একটা মানুষকে মন্ত্র পড়ে বানিয়ে ফেলা হচ্ছে নগদ পণ আর অলঙ্কারের একটা পুঁটলি। তা সেই পুঁটলিকে কে কোথায় নিয়ে যায়, তাতে তার কী আর এসে যায়! আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমিও তো সেই পুঁটলিতেই পরিণত হয়ে যেতাম বিকাশ। বিয়ের আগে তোমার বাবা আমার বাবার কাছ থেকে তাঁর যা পাওনা নিয়ে নিয়েছিলেন। বাসর ঘর নির্জন হয়ে গেলে তুমি তোমার পাওনাটা আমার কাছ থেকে নিয়ে নিতে। নিতে না বিকাশ?
বিকাশ ফ্যালফ্যাল করে কমলার মুখের দিকে চেয়ে রইল। সে তখন কমলার মুখে সেই সালঙ্কারা কন্যার অবনত মুখটা প্রাণপণ চেষ্টায় খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার কানের ভিতরে তখন প্রায় শোনা যায় না এমন একটা সানাইয়ের সুর অস্থির হয়ে লতিয়ে লতিয়ে বেড়াচ্ছে।
অন্যমনস্ক বিকাশ গাঢ় স্বরে বলল, মানুষের মন তো। নিশ্চয় করে কিছু বলা মুশকিল। হয়তো আমার প্রথম কিস্তির পাওনা সেদিন আদায় করে নিতাম, কমলা।
ধরো যদি বাধা দিতাম আমি, তাও? অবশ্য কোনও প্রবল বাধা যে দিতে পারতাম বিকাশ, তাও আজ আর জোর করে বলতে পারছিনে। তুমি বলছ, মানুষের মন, আমি জানি মানুষের শরীর, কখন কিসে সাড়া দিয়ে বসে সেটাও নিশ্চয় করে বলা যায় না।
আসলে কমলা, আমরা কেউই নিশ্চয় করে কিছুই বলতে পারিনে।
কোনও ঘটনাই কি আমরা আটকাতে পারি বিকাশ? আমরা তো জ্বলে পুড়ে মরি পরে।
কমলা তুমি অনিন্দ্যর কথা বলো।
না বিকাশ, ক্ষেমি এসে গিয়েছে। তোমারও অনেক কাজ বাকি রয়ে গিয়েছে। চান যখন করবেই না, তখন খানিকটা গরম জল করে আনি। একটু সাবান ঘষে দিই তোমার গায়ে। কিছু মনে কোরো না বিকাশ, মানুষ নিজের গায়ের গন্ধ নিজে টের পায় না, তাই রক্ষে। কিন্তু যতই তুমি একা একা থাকো, কখনও না কখনও অন্য কাউকে তো তোমার কাছে আসতে হয়। অসুবিধেটা হয় তার। এই ব্যাপারটা তুমি বুঝতে চাও না কেন?
বিকাশ বলল, কেউ আমাকে চান করিয়ে দেবে, এ কথায় আমার আতঙ্ক হয়, কমলা। আমি যদি নিজে নিজে চানটা করে নিতে পারতাম।
কিন্তু সেটা তো এই অবস্থায় সম্ভব নয় বিকাশ। তা বলে সারা জীবন ধরে তুমি চান করবে না?
না। করব না। তোমার অসুবিধে হয়, তুমি এসো না আমার কাছে। বিকাশ চাপা রাগে গরগর করছে।
বেশ, আমি এলাম না তোমার কাছে। তারপর?
বিকাশের চোখ মুখ হিংস্র হয়ে উঠেছে। দুটো হাতের মুঠো শক্ত হয়ে গিয়েছে।
কমলা, কমলা, তুমি, তুমি, ওহ্, তোমার হাত থেকে আমি কি আর রেহাই পাব না কখনও?
তুমি যখনই চাইবে বিকাশ, তখনই তুমি রেহাই পাবে।
কমলার মুখ থমথম করছে। সে স্থির চোখে বিকাশের দিকে চেয়ে আছে। কিন্তু তারপর?
বিকাশ অসহায়ভাবে কমলার দিকে চাইল। কমলার চোখদুটো নরম হয়ে এল। সেও তাকিয়ে রইল বিকাশের দিকে।
কমলা অত্যন্ত সহজ এবং নরম গলায় বলল, আমার কাছে তোমাকে চান করতে হবে না বিকাশ। আমি ক্ষেমিকে বলে দেব, ও তোমাকে চান করিয়ে দেবে। ক্ষেমি আমার মা’র বয়েসী। তা ছাড়া চোখে ভাল দেখে না। তুমি ওকে বোলো, সন্ধের সময় তোমাকে চান করিয়ে দিতে।
কমলা তুমি কি বুঝতে পেরেছ, কেন আমি চান করতে চাইনে?
একটা আন্দাজ করে নিয়েছি।
তুমি তুমি….
অতীতের মার তুমি একাই খাওনি বিকাশ।
পুলিশের মার কমলা। একটা চুরুট। একটা জ্বলন্ত চুরুট কমলা।
বিকাশ খপ করে কমলার হাত দুটো ধরে ফেলল। বিকাশের চারদিকে ঘরবাড়ি আসবাব বাঁই বাঁই করে ঘুরতে লাগল। সে বোধ করল কমলাই শুধু স্থির। শক্ত করে কমলার হাত দুটো ধরে সে এই চক্কর সামলে নেবার চেষ্টা করছে। চোখ বুজে আছে বিকাশ।
জ্বলন্ত চুরুটের ছ্যাঁকা কমলা। একবার দুবার তিনবার। দুনিয়া পালটে গেল আমার। আমার পুরুষত্বের অহংকার ঘুচে গেল কমলা চিরজীবনের মতো। এখন পেচ্ছাব করতে গেলেও মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।
বিকাশ শিউরে উঠল।
তুমি এটা বুঝতে পেরেছিলে কমলা?
এইরকম একটা কিছু আন্দাজ করেছিলাম।
বিকাশ একেবারে শান্ত হয়ে এল। কমলার কী মনে হল, বিকাশের মাথাটা টেনে নিয়ে ওর মাথার চুলগুলো আঙুল দিয়ে বিন্যস্ত করতে লাগল। কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ।
তুমি খুব নিষ্ঠুর কমলা। বাস্তবের মতোই নিষ্ঠুর। সব গোপনীয়তা তুমি কেমন করে টের পেয়ে যাও। তোমাকে আমার ভয় করে।
বিকাশ শান্তভাবে কথাগুলো ঠেলে দিল।
বিকাশ, তুমি আমার দিকে তাকাও। ভাল করে তাকাও। তোমাকে আমার কিছু জানাবার আছে।
বিকাশ কমলার দিকে চাইল।
পরশু রাতে আমার উপর হামলা হয়েছিল।
হামলা হয়েছিল? কোথায়?
ট্রেনে।
ডাকাত?
জানিনে। প্রবল বৃষ্টি পড়ছিল। ট্রেনটার কী হয়েছিল জানিনে। কেবলই থামছিল। যেখানে সেখানে থেমে পড়ছিল। এক সময় দেখি ফাঁকা কামরাটায় আমরা মাত্র দুজন।
কমলার কানে বৃষ্টি আর ট্রেনের শব্দ সমানে আছড়ে পড়ল।
আমার কাছে টাকা ছিল কিছু। আর হাতে একটা ঘড়ি। তাকে দিতে চাইলাম। লোকটা কিছুই নেয়নি।
কিছুই নেয়নি?
এক সময় আমি ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়তে গিয়েছিলাম। লোকটা তৎপরতার সঙ্গে আমাকে ধরে ফেলল। আমি ভেবেছিলাম, লোকটা বুঝি আমাকে খুন করবে। ভয়ে আমি কুঁকড়ে গিয়েছিলাম বিকাশ। সেই সময় তোমার কথা মনে পড়ছিল আমার। ভাবছিলাম, আমি মারা গেলে তোমাকে কে দেখবে? কিন্তু আমি খুন হলাম না। প্রাণটা রইল। চোটটা আমার শরীরের উপর দিয়ে গেল।
কমলা! কমলা!
আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম বিকাশ। দারুণ ভয়। লোকটার গায়ে অসম্ভব জোর। জোর খাটিয়ে তাকে আটকাতে পারিনি।
জোর খাটাতে গেলে তুমি মারা পড়তে কমলা।
বিকাশ?
বিকাশ দেখল কমলা কত দূরে চলে গিয়েছে। কত দূর থেকে ডাকছে। সে সাড়া দেবার চেষ্টা করল।
লোকটার জবরদস্তিতে আমার শরীরটা সাড়া দিয়ে উঠেছিল বিকাশ।
কমলা দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল।
বিকাশ কী বলবে বুঝতে পারছিল না।
সারা রাত আমি এই কথাটাই ভেবেছি।
বিকাশ একটা কথাও বলতে পারছে না।
সকালে উঠেই আমি মন স্থির করে ফেললাম। একদিন প্রাণে বেঁচেছি। কিন্তু আরেক দিন তো মরেও যেতে পারি? তাই অফিসে গিয়েই ছুটি নিলাম। ডাক্তারের কাছে গেলাম।
ভালই করেছো কমলা ডাক্তার দেখিয়ে।
আমি একজন অরথোপেডিক ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম বিকাশ। তাকে তোমার কথা সব বললাম।
আমার জন্য ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলে!
তোমার একটা ব্যবস্থা করা জরুরি হয়ে পড়েছে বিকাশ। এভাবে মানুষ থাকতে পারে না। তোমাকে উঠতে হবে বিকাশ। নিজের চেষ্টাতেই তোমাকে চলতে ফিরতে হবে। আমার উপর নির্ভর করে থাকার কোনও মানে হয় না।
কমলা…
তোমার সব কাজ তো তোমাকে নিজে করে নিতে হবে বিকাশ।
কমলা…
দিদি, ও দিদি।
কমলা উঠে পড়ল।
বিকাশ ডাকল, কমলা!
হাতের কাজ সেরে আসি। খাওয়াদাওয়া করতে হবে তো?
নীচে নামতেই ক্ষেমি বলল, মাছ নেবে তো নাও। সুবল বসে আছে।
কমলা সুবলের ঝুড়িতে উকি মেরে বলল, দে সুবল, কী দিবি?
তুমি কী নেবা গো?
দে না যা হয়।
তা হলে ঝড়বাবুদের পুকুরের এই পোনাটাই নাও।
নে ক্ষেমি। ওটা কুটে দে। দিয়ে দাদাবাবুকে এক কাপ চা দিয়ে আয়। আজ বেলা হয়ে গেল বেজায়।
কমলার আর ফুরসত রইল না। উনুনে তেজ হয়েছে। কমলা রান্নায় ভিড়ে গেল।
মাছ কুটতে কুটতে ক্ষেমি জিজ্ঞেস করল, হাঁ দিদি, তোমার ঘরে ওটা কী নিয়ে এসেছ?
দেখাবখন। তুই হাত চালা।
কিছুক্ষণ পরে ধোয়া মাছের টুকরোগুলো এনে ক্ষেমি বলল, দাও, চা দাও। কমলা ক্ষেমির হাতে এক কাপ চা করে দিয়ে দিল।
বৈকুণ্ঠ এসে জিজ্ঞেস করল, হাঁ গো মাসি, ধান বেচবা নাকি? দাম ভাল আছে।
ক’ বস্তা নিবি?
কত দিতে পারবা?
সে তো তুইই ভাল জানিস।
এখন বস্তা পনের ছেড়ে দাও। দর আরও উঠবে মনে হয়।
নিয়ে যা। হাঁ রে, পঞ্চায়েত কী বলল?
ও নিয়ে তোমার ভাবনার কিছু নেই। তোমার তো বর্গা রেকট করানো হয়ে গিয়েছে। আর কোনও গোলমাল হবে না।
দেখিস বাবা। তোদের উপরেই আমার নির্ভর।
ছুটির দিনের কাজ কমলার। মা থাকতে মাই সব দেখেছে। এখন সব কিছু কমলার ঘাড়ে।
দাও, একটু চা দাও।
তোর কি খুব তাড়া আছে?
না। কেন?
তা হলে তোর মা আসুক। একসঙ্গেই চা খাবি।
সকালে রোদ ছিল। তারপর বৃষ্টি হচ্ছিল। এখন আবার বেশ রোদ। রান্না করতে করতে কমলা বেশ ঘেমে উঠেছে। ক্ষেমি নেমে এসে বলল, দিদি গো, দাদাবাবু যে চান করতে চাইছে।
দাও গো মাসি, এবারে চা দাও। মা তো এয়েছে।
হ্যাঁ, খা। ক্ষেমি এই জল দিলাম। নাও চা করো। একটু খাই।
দাদাবাবু চান করতে চাইছে গো।
মাছটা নামিয়ে নিই। একটু জল গরম করে দিই। তুই আজ দাদাবাবুকে চান করিয়ে দে।
চা খেয়ে বৈকুণ্ঠ চলে গেল। বলে গেল, খেয়ে এসে ধান বের করবে। গরম জল দিয়ে ক্ষেমিকে উপবে পাঠিয়ে দিয়ে, এদিকে একটু গোছগাছ করে রেখে কমলাও একটা নতুন সাবান বের করে নিয়ে উপরে গেল।
নীচে একটা অয়েল ক্লথ পাত ক্ষেমি। আমি দাদাবাবুকে তার উপর বসিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। চান হয়ে গেলে আমাকে ডাকবি। বিকাশ এর মধ্যে কামিয়ে নিয়েছে। কামানোর সরঞ্জাম বিকাশের হাতের কাছেই রেখে দিয়েছে কমলা। ওটা বিকাশ নিজেই করে নেয়। বিকাশের সদ্য কামানো মুখটাকে বালকের মতো মনে হয় কমলার।
বিকাশ, তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাই।
বিকাশকে ধরে অয়েল ক্লথের উপর বসিয়ে দিতে ঘেমে উঠল কমলা।
বিকাশ বলল, আমি যতটা পারি, নিজে করে নিই আগে। তুমি আমাকে জল ঢেলে দাও ক্ষেমি। যেটুকু পারব না, সেটুকু তোমাকে করে দিতে হবে।
কমলা নীচে চলে গেল। ঘর থেকে হুইল চেয়ারটা বারান্দায় টেনে আনল। ভাঁজ খুলে সেটাকে ফিট করে ফেলল, যেমন তাকে ডাক্তারবাবু দেখিয়ে দিয়েছিলেন। এদিক থেকে ওদিকে সেটা ঠেলে নিয়ে গেল। তারপর কী মনে হল, কমলা চেয়ারটায় বসে পড়ল। তারপর ভেতরের গোল চাকা দুটো দুহাতে ঠেলে ঠেলে চেয়ারটাকে আবার এদিকে নিয়ে এল। ব্যাপারটা তেমন কঠিন কিছু না। বিকাশের হাতে এতটুকু জোের নিশ্চয়ই আছে। সে চেয়ারটাকে আবার তার ঘরের ভিতর ঠেলে দিল। আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে ফেলল কমলা। তারপর নিজের ঘরে ঢুকে পাখাটা চালিয়ে হাওয়া খেতে লাগল। হঠাৎ উঠে গিয়ে আলমারি খুলে নতুন একটা পাউডার বের করে আনল। বিকাশের কথা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল কমলা। তারপর ঘরের ঐ একফালি জায়গার মধ্যেই হুইল চেয়ারটাকে ঘোরাতে লাগল সে।
ক্ষেমি ডাকতেই পাউডারের কৌটোটা নিয়ে সে উপরে উঠে এল। ক্ষেমি বিকাশকে শুকনো জায়গায় নিয়ে বসিয়ে দিয়েছে। চুল আঁচড়েছে বিকাশ। বেশ ভালই দেখাচ্ছে। বিকাশকে সাপটে ধরে খাটের উপর বসিয়ে দিল কমলা।
কমলা বলল, এর পরের অনুষ্ঠান পাউডার মাখা। নাও বসে বসে মাখো। আমি খাবারের থালা নিয়ে আসি।
কমলা পাউডারের কৌটোটা মেঝে থেকে তুলে বিকাশের হাতে ধরিয়ে দিল।
যা প্যাচপেচে গরম। পাউডার মেখে দ্যাখো, আরাম পাবে।
এত আরাম, কপালে কি সইবে কমলা?
পরের কথা পরে ভাবা যাবে বিকাশ। আমি আসছি একটু পরে।
কমলা নেমে গেল নীচে। ওর মনে কাজের জোয়ার এসেছে। এরই মধ্যে হাঠৎ বেশ ঝেঁপে বৃষ্টি নেমে পড়ল। কমলা ছোটছুটি করে কাপড় তুলতে লাগল। ক্ষেমিও এসে গিয়েছে।
মুখপোড়া বিষ্টির মরণ নেই গো। বলা নেই কওয়া নেই ভিজিয়ে দিল সব। বাবা বাবা!
দুজনে হুটোপাটি করে উঠোন থেকে সব কাপড়-চোপড় তুলে ফেলতেই ফেলতেই বৃষ্টির তোড় কমে আসতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে থেমেই গেল একেবারে। আগের মতোই রোদ বেরিয়ে পড়ল।
দ্যাখো দিকিনি। দ্যাখো দিকিনি। মুখপোড়ার মস্করা। ও দিদি, কী করব গো এখন!
দে বারান্দাতেই মেলে দে। আমি দাদাবাবুকে খাইয়ে আসি।
.
টং টং টং করে তিনটে বাজতেই কমলার ঘুম ভেঙে গেল। ধড়মড় করে উঠে বসল বিছানায়। বাইরে বেরিয়ে দেখে আকাশে আর রোদ নেই। মেঘের ছায়া পড়েছে মাটিতে। বিকাশকে বলে এসেছিল, খেয়েদেয়ে আসছি। এতক্ষণ ঘুমিয়েছে কমলা? সে মুখে হাতে জল দিয়ে নিল। তারপর চেয়ারটাকে পরিপাটি করে ভাঁজ করে ফেলল।
বেশ ভারী চেয়ার। দোতলায় তুলতে রীতিমত হাঁপিয়ে উঠল কমলা। তারপর ওটাকে ছাতে তুলে ফিট করে নিল। ইনভ্যালিড চেয়ারটাকে যতটা নিঃশব্দে পারে ঠেলে নিয়ে এল বিকাশের ঘরের কাছে। উকি মেরে দেখল বিকাশ ঘুমুচ্ছে। কমলা চেয়ারটাকে ঘরের ভিতর ঢুকিয়ে ফেলল। কমলা!
কমলা হুইল চেয়ারটাকে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে ঈষৎ হাঁপাতে হাঁপাতে সেটা ঠেলতে লাগল। ঘরের এ কোনা থেকে ও কোনা চেয়ারটাকে ঠেলে ঠেলে বেড়াতে লাগল। কমলা যেন তার ছোটবেলার জীবনে ফিরে গিয়েছে। সে চেয়ারটায় বসল।
দ্যাখো বিকাশ, খুব ভাল করে লক্ষ করো। খুব সোজা। এই যে দেখছ বাইরের বড় দুটো ঢাকা…
কমলা চেয়ারটায় চড়ে সেটাকে দু’ হাতের জোরে ঠেলে ঠেলে একেবারে বিকাশের কাছে নিয়ে এল।
এই দ্যাখো বিকাশ, এই যে বড় চাকা, এরই সঙ্গে আরও দুটো চাকা লাগানো আছে ভিতরে। প্রত্যেকটা বাইরের চাকার সঙ্গে একটা ভিতরের চাকা, বুঝলে? তোমাকে এই চেয়ারটা চালাতে হলে ঐ ভিতরের চাকা দুটোকেই দু’হাতে ঠেলতে হবে। এই দ্যাখো।
কমলা চেয়ারটায় চড়ে ওটাকে ঘরময় চালিয়ে চালিয়ে ঘুরতে লাগল।
কিচ্ছু কষ্ট নয় বিকাশ। এই দ্যাখো যখন সোজা চলছি, ভেতরের চাকা দুটোয় দু’হাতের চাপ সমান জোরে দিছি। এই দ্যাখো, বাঁদিকে ঘুরব তো? আচ্ছা, এবারে বাঁ হাতের চাকাটাকে চেপে ধরে রাখলাম। ডানহাতের চাকাটাকে ঠেলছি। এই দ্যাখো, গাড়িটা বাঁদিকে ঘুরে গেল বিকাশ। এই দ্যাখো আবার সোজা চলছি। এই দ্যাখো, এবার ডাইনে ঘুরলাম। এই দ্যাখো বিকাশ, একেবারে তোমার পাশে এসে গেলাম।
কমলা উৎসাহে টগবগ করে ফুটছে। সে নেমে পড়ল চেয়ারটা থেকে
এবার তুমি বসবে চেয়ারটায়? আচ্ছা একটু অপেক্ষা করো। আমি বরং চা নিয়ে আসি। আমরা আগে একটু চা খাই। তারপর তোমার পালা চলবে।
কমলা, কাল রাত্রে তুমি কি এটাই আমার জন্যে নিয়ে এসেছ?
হ্যাঁ বিকাশ, তোমার পছন্দ হয়নি?
পছন্দ?
হ্যাঁ, পছন্দ। ওটা তো তোমারই জিনিস বিকাশ। তোমারই তো কাজে লাগবে। তোমাকে এই ঘরে রেখে আমাকে আর বৃষ্টির ভয়ে জানলাগুলো বন্ধ করে দিয়ে যেতে হবে না। তুমি এই ঘরে তোমার ইচ্ছেমতো ঘুরতে পারবে। দরকার হলে তুমি নিজেই জানলা বন্ধ করে দেবে। দরকার মনে হলে জানলা-টানলা খুলেও দেবে তুমি। তুমি যে এই কাজগুলো নিজে নিজেই করতে পারছ, এতেই তুমি দেখবে বিকাশ, কত হেরফের তোমার হয়ে যাবে।
কমলা, আমি তো শুনেছি, এই জিনিসগুলোর খুব দাম। বিশেষ করে এই হুইল চেয়ারের।
দাম? হ্যাঁ বিকাশ, এই চেয়ারটা একটু দামি। তবে বড় কাজের। চড়ে দ্যাখো।
কত দাম কমলা?
সেটা শোনা কি অতই জরুরি, বিকাশ?
কমলা হাসল।
জিনিসটা যখন হাতের কাছে এসেই গিয়েছে। এসো না, চড়ো একবার। আমি তোমাকে বসিয়ে দিচ্ছি চেয়ারটায়।
কমলা বিকাশকে চেয়ারে তুলবে বলে ওর কাছে এগিয়ে গেল। বিকাশ দু’হাত দিয়ে ওকে প্রচণ্ড এক ধাক্কা মারল। ছিটকে গেল কমলা। কোনও রকমে সামলে নিয়ে কমলা অবাক চোখে বিকাশের দিকে চেয়ে রইল।
তোমার এই মা মা ভাব একেবারে অসহ্য। আমার মাথায় খুন চেপে যায় কমলা। আমার উপর কোনও দিন আর মা-গিরি ফলাতে এসো না কমলা। দোহাই তোমার। দোহাই।
আমাকে দেখে তোমার খুন চেপে যায় বিকাশ?
হ্যাঁ হ্যাঁ কমলা, চাপে। মাঝে মাঝে আমি অস্থির হয়ে যাই।
আমাকে দেখে তোমার খুন চেপে যায়? কেন বিকাশ? আমার অপরাধ কী? কমলা, কমলা, আমাকে একটু একা থাকতে দাও। আমি কিছুই বুঝতে পারছিনে। কিচ্ছু না। ওহ্।
বিকাশ খাটের বাজুতে তার হাতখানা পাগলের মত ঠুকতে লাগল। কমলা দৌড়ে এসে বিকাশের হাতখানা ধরে ফেলল।
আমি তোমার গায়ে হাত তুলেছি কমলা। তোমার গায়ে হাত তুললাম!
হ্যাঁ, তা তুলেছ বিকাশ। তাই বলে কি তুমি তোমার হাতখানা অকেজো করে দিতে চাও? একবার তো ওরা তোমাকে পঙ্গু করে দিয়েছে। বাকিটুকু কি তুমি শেষ করতে চাও? তোমার হাতদুটোর ক্ষমতা বজায় রাখতে পারলে, তুমি হয়তো একদিন সেটা দিয়েই উঠে দাঁড়াতে পারতে। কিন্তু তোমার হাতকে তুমি যদি কমজোর করে ফেল বিকাশ, তা হলে কি তুমি ঘাসে পরিণত হবে না?
কমলা শান্ত ভাবে বিকাশের দিকে চেয়ে আবার বলল, তোমার এই অনুশোচনা নিতান্তই ন্যাকামি বিকাশ।
আমাকে একটু একা থাকতে দাও।
কমলা বলল, বেশ, আমি একটু পরে চা করে নিয়ে আসছি।
কমলা নীচে এসেই ওর ঘরে ঢুকে গেল। বিছানার উপর শরীরটা এলিয়ে দিল সে। বিকাশের এই খেপে যাওয়া মূর্তি এর আগে দেখেনি কমলা। কমলাকে দেখলে বিকাশের খুন চেপে যায়! ওর মনে প্রচণ্ড একটা ঝাঁকি লেগেছে। কেন? কী চায় বিকাশ? কমলা বুঝে উঠতে পারে না। আর একটা ব্যাপারেরও সে মানে খুঁজে পাচ্ছে না এখন। বিকাশের জন্য সে এত ভাবছেই বা কেন? সে কি বিকাশ পঙ্গু বলে? বিকাশ তার স্বামী বলে? বিকাশ তার স্বামী হতে যাবে কেন? একদিন সাতপাক অগ্নিসাক্ষী পুরুতের মন্ত্রোচ্চারণ হয়েছিল বলে? তার বাবা বিকাশের হাতে তাকে সম্প্রদান করেছিলেন বলে? এটা ঠিক, এই সব ঘটনাই তার জীবনে ঘটেছিল। কিন্তু কমলা তো বিকাশকে তার স্বামী বলে মেনে নেয়নি। বিকাশকে আর যাই ভাবুক কমলা, তাকে সে স্বামী হিসেবে ভাবে না। এ বিষয়ে কমলার মনে কোনও ধাঁধা নেই। না, বিন্দুমাত্র নেই। কমলা নিজের মন তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখল। স্বামী হিসেবে বিকাশকে সে কোথাও খুঁজে পেল না। তেমনি সে তার আগের প্রশ্নের পরিষ্কার কোনও উত্তরও পেল না। কমলার শরীরটা ক্রমশ এলিয়ে আসতে লাগল। তার কেমন ক্লান্তি লাগছে। তার উৎসাহ সব যেন শরীরের রোমকূপ দিয়ে গলে গলে বেরিয়ে যাচ্ছে। কী ভেবেছিল সে, আর কী হয়ে গেল শেষ পর্যন্ত! ভেবেছিল বিকাশকে সে হুইল চেয়ারটা দেখিয়ে অবাক করে দেবে। বিকাশ খুশি হবে। তা না, হল একেবারে উলটো। বিকাশ খেপে একেবারে মারমুখী হয়ে উঠল। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস কমলার বুক চিরে বেরিয়ে এল। কমলা আজ কাউকে খুশিও করতে পারে না। একটা ছুটির দিন তার অযথা তিক্ত হয়ে গেল। কাল থেকে আবার সেই আফিস যাওয়া। সেই একঘেয়ে জীবন। হঠাৎ তার মনে পড়ল পরশু রাতের ট্রেনে ঘটে যাওয়া সেই মারাত্মক অভিজ্ঞতার কথা। ঐ লোকটা তাকে মেরেও ফেলতে পারত। ধর্ষণকারীরা তো তা-ই করে থাকে। কিন্তু লোকটা তা করেনি। কিন্তু লোকটা তার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে, ধর্ষণকারীরা কি ঐ রকমই করে? লোকটা তার উপর জবরদস্তি খাটিয়েছিল। কিন্তু তার মধ্যে কি হিংস্রতা ছিল? তার শরীরই বা অমনভাবে সাড়া দিয়ে উঠল কেন? এটা তো ভুল নয় যে সে, কমলা, তিরিশ বছরের এক কুমারী মেয়ে, তার জীবনের প্রথম পুরুষের সংসর্গে এসে তার সঙ্গে মোটামুটি সহযোগিতাই করেছিল। না ভুল নেই এতে। সে ভয় পেয়েছিল, এটা ঠিক, প্রথম দিকে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিল। তার শরীর বাধাও দিয়েছিল তাকে। যতটা পারে, যত রকমে পারে। কিন্তু লোকটা এক সময়ে তার শরীরে চরম উত্তেজনাও জাগিয়ে তুলতে পেরেছিল। সে এক সময় জাপটে ধরেছিল লোকটাকে। ধরেছিল। বিকাশকে যদি সেদিন পুলিশ ধরে নিয়ে না যেত, তবে তার স্বামিত্বের স্বত্ব সে তো আদায় করে নিত। কমলার ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনও জায়গাই তো সেখানে থাকত না। সেদিনের অভিজ্ঞতা কি এর চাইতে খুব বেশি এদিক ওদিক হত? শরীরেরও যে স্বাভাবিক সুখ আছে, সেদিনের সেই অদ্ভুত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে না গেলে বুঝতই না কমলা। অথচ সেদিনের ট্রেনের সেই অভিজ্ঞতাকে মেনেও নিতে পারেনি কমলা। কাঁটার মত খচখচ করে তাকে বিধে চলেছে। বিকাশ একটা ভাল কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। তার নিজের জন্যও একবার ডাক্তার দেখানো দরকার। কমলার ঠোঁটে একটা উষ্ণ উত্তাপ জেগে উঠছে। একটা বলিষ্ঠ বিষণ্ণ মুখ তার মুখে চুমু খাচ্ছে। ট্রেনটা প্রচণ্ড বর্ষণের মধ্যে খন্যান স্টেশনে এসে দাঁড়াল। লোকটা তার হাত ধরে যত্ন করে প্ল্যাটফরমে নামিয়ে দিচ্ছে। ট্রেন চলে গেল। কমলা সেই ঘন বর্ষণের মধ্যে, অন্ধকারে, প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়ে বুক খালি করে কেঁদেই চলেছে। এক লহমার মধ্যে ছবিগুলো কমলার চোখের উপর দিয়ে ভেসে গেল।
হঠাৎ উপর থেকে হুড়মুড় করে একটা প্রচণ্ড শব্দ কানে আসতেই কমলা চমকে উঠে পড়ল। বিকাশ। ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠল কমলা। সে ঊর্ধ্বশ্বাসে উপরে দৌড়োল। আবার বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। উপরের ঘরের দরজার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়াল কমলা। বিকাশ হুইল চেয়ারের চাকা ধরে খাটের নীচে পড়ে আছে।
বিকাশ! বেশ জোরেই একটা আর্তস্বর কমলার গলা চিরে বেরিয়ে গেল। কমলার হাত-পা থরথর করে কাঁপতে লেগেছে।
কমলা, আমাকে চেয়ারটায় বসিয়ে দাও তো। নিজে নিজে পারলাম না।
কমলা দ্রুত পায়ে বিকাশের কাছে গেল।
তোমার চোট লাগেনি তো বিকাশ?
বোধ হয় না। চেয়ারটা হঠাৎ হড়কে গেল। টাল সামলাতে পারলাম না। একা একা এ-চেয়ারে ওঠা যাবে না। না কমলা?
হ্যাঁ, বিকাশ। আমি তোমাকে তুলে দিচ্ছি। দ্যাখো তো, কোথাও লেগেছে কি না? খাটে তুলে দেব বিকাশ, তোমাকে?
না না। তুমি আমাকে চেয়ারটাতেই বসিয়ে দাও কমলা। আমি একটু প্র্যাকটিস করি।
কমলা চেয়ারটাকে ঠিক করে ঘোরাল। একটা ব্রেক টেনে দিল।
দ্যাখো বিকাশ, এটা ব্রেক। চেয়ারের চাকা আর নড়বে না।
বিকাশকে দু’হাতে সাপটে ধরে চেয়ারটায় বেশ করে বসিয়ে দিল কমলা।
এবার ব্রেকটা তুমি খুলে দাও বিকাশ। হ্যাঁ, ঠিক হয়েছে। এবারে সামনের দিকে যাবে তো? দু’হাতে সমান জোর রেখে চাকা দুটো ঠেলে যাও।
বিকাশ পারল না। চেয়ারটা খাটের দিকে ঘুরে গেল। কমলা চেয়ারটাকে পিছনে টেনে এনে দরজার দিকে মুখ করে ঘুরিয়ে দিল। পাচ্ছে আরেকটা হাতে তেমন জোর পাচ্ছে না।
বিকাশ একটা হাতে যতটা জোর ফলে চেয়ারটা এদিক ওদিক ঘুরে যাচ্ছে।
হচ্ছে না কমলা, হবে না।
এক্ষুনি কি হয়? চেষ্টা করে যাও।
বিকাশ চেয়ারটাকে কেবলই বাঁ দিকে ঘুরিয়ে ফেলছে।
বাঁ হাতটা আমার বোধহয় পঙ্গু হয়ে গিয়েছে কমলা।
বাজে কথা, বিকাশ। তোমার বাঁ হাতের ধাক্কা আমি একটু আগেই না খেয়েছি? বেশ জোর আছে তোমার বাঁ হাতে। তুমি চেয়ারটা এবার ডানদিকে ঘুরিয়ে ওর মুখটা সোজা করে নাও তো।
বিকাশ আস্তে আস্তে চেয়ারটার মুখটা সোজা করে দিল।
ঠিক আছে। এবার দু’হাতে সমান জোর রাখো। ঠ্যালো চাকা দুটোকে। ঠ্যালো। হ্যাঁ, ঠ্যালো বিকাশ। ঠেলে যাও।
বিকাশ এতক্ষণে চেয়ারটাকে কায়দা করে আনতে পারল। চেয়ারটাকে ঠেলে ঠেলে সামনের দরজায় গিয়ে ধাক্কা খেল বিকাশ। ওর শরীর ঘেমে গিয়েছে।
কমলা বলল, ব্যস, এই তো হয়ে গেল। এবার একটু বিশ্রাম নাও বিকাশ।
না কমলা, আরও কয়েক চক্কর ঘুরি। এই দ্যাখো কমলা বাঁ দিকে ঘুরছি। এই দ্যাখো কমলা এবার ডানদিকে ঘুরছি। এই সোজা চললাম কমলা। ঠিক যাচ্ছি না?
ঠিক যাচ্ছ বিকাশ। ঠিকই যাচ্ছ।
কমলা চেয়ারে বসে বসে দেখতে লাগল, বিকাশ সারা ঘরময় হুইল চেয়ারে বসে ঘুরপাক খাচ্ছে। বাঁ দিক, ডান দিক, সোজা। বাঁ দিক সোজা ডানদিক সোজা। পিছিয়ে আসছে এগিয়ে যাচ্ছে বিকাশ। যাক ও একটা কাজ পেল সারাদিনের। হাত পা গুটিয়ে কি মানুষ থাকতে পারে?
বিকাশ, দ্যাখো তো তুমি কোনও জানলা বন্ধ করতে পারো কি না?
বিকাশ চলে গেল একটা জানলার কাছে। চেয়ারটাকে এদিক ওদিক করে জানলার দুটো পাল্লা বন্ধ করে দিল।
বিকাশ চেয়ারটাকে একেবারে কমলার সামনাসামনি নিয়ে এল। তারপর কমলার হাত দুটো টেনে নিল। কমলার হাতের তালুর মধ্যে নিজের মুখটাকে গুঁজে দিল বিকাশ।
কমলা শান্ত স্বরে বলল, আর তোমাকে বদ্ধ ঘরে দিন কাটাতে হবে না বিকাশ। যখন ইচ্ছে হবে জানলা খুলে দেবে। বৃষ্টি এলে আবার বন্ধও করে দিতে পারবে।
বিকাশ মুখ তুলল না। কমলার হাতের তালু গরম জলে ভিজে উঠতে লাগল। কমলা চুপ করে গেল। জানলা দিয়ে বৃষ্টির ছাট এসে গায়ে লাগতে লাগল।
একটু পরে কমলা বলল, বিকাশ, তুমি জানতে চাইছিলে, এই চেয়ারটার জন্য কত খরচ পড়েছে। আমি তোমাকে বলব সে কথা। কিন্তু তার আগে তুমি একটা কথা বলো।
বিকাশ বলল, কী কথা কমলা?
তোমার এখন কী মনে হচ্ছে?
বিকাশ মুখ তুলল। সোজা চোখে কমলার মুখের দিকে তাকাল।
আমাকে এখন কেউ যদি পঙ্গু বলে কমলা, তাতে আমি আর বেশি চোট পাব না।
তুমি আর পঙ্গু থাকবে না বিকাশ।
তার মানে?
এখন কিছুদিন এই চেয়ারটায় রপ্ত হয়ে নাও। তারপর তোমাকে নিয়ে ডাক্তারবাবুর কাছে যাব। তোমাকে উঠতে হবে বিকাশ। তোমাকে নিজে নিজে চলতে ফিরতেও হবে। ব্যস, এটুকু করে দিতে পারলেই আমার ছুটি।
তা হলেই তোমার ছুটি কমলা?
নিশ্চয়ই বিকাশ। তুমি তখন তোমার নিজের পথ দেখে নিতে পারবে। তোমাকে অসহায় হয়ে কোথাও তো আর পড়ে থাকতে হবে না। অন্তত এমন কারোর কাছে, যে নিয়ত মা-গিরি ফলাতে চায়।
তুমি খুব রাগ করেছ কমলা, না?
রাগ?
আমিই ঠিক ভাবে বলতে পারিনি। তুমি মনে খুব দুঃখ পেয়েছ। না কমলা?
প্রথমে পেয়েছিলাম। পরে ভেবে দেখলাম, তুমি বোধ হয় খুব ভুল বলোনি। তোমার সঙ্গে আগে আমার কথা বলা উচিত ছিল। কিন্তু কী জানো বিকাশ, আমি হঠাৎ এই চেয়ারটা এনে তোমাকে চমকে দেব ভেবেছিলাম। তোমাকে হঠাৎ খুশি করার একটা ছেলেমানুষি লোভে ধরেছিল আমাকে। এই চেয়ারটা তোমার কাজে লেগেছে। তোমার নিজের উপর তোমার আস্থা বাড়িয়ে দিয়েছে। আমার কাছে সেইটেই বড় কথা।
তোমার কত খরচ হল কমলা?
সেটা শুনতেই হবে?
তুমি না বলতেও পারো কমলা, এটা যদি তোমার কোনও গোপন কথা হয়। কোনও গোপন কথা নয়, বিকাশ। শুনলে তুমি কী ভাববে, সেই কথা ভেবেই আমি কথাটা বলতে ইতস্তত করছি।
তবু তুমি বলো।
এই ইনভ্যালিড হুইল চেয়ারটার দাম পড়েছে পাঁচ হাজার টাকা।
পাঁচ হাজার টাকা! কমলা, পাঁচ হাজার টাকা!
আরও লাগবে বিকাশ।
আরও লাগবে?
হ্যাঁ, লাগবে। এই চেয়ারটায় তোমাকে এক ধরনের ঘোরাফেরার স্বাধীনতা দেবে বিকাশ। তোমাকে কেউ যদি চেয়ারে বসিয়ে দেয়, তা হলেই ঘরটার ভিতর ঘুরতে পারো, কিন্তু সে আর কতটুকু। তুমি আজ দেখলে তো, খাট থেকে নিজে নিজে নীচে নেমে এসে চেয়ারে বসবার বল তোমার পায়ে নেই।
বিকাশ উদ্গ্রীব হয়ে কমলার কথা শুনছিল।
কাজেই চেয়ারের পরেও আমাদের এগুতে হবে। ধাপে ধাপে বিকাশ। ডাঃ সরকারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে তোমার ব্যাপারে। তোমাকে কলকাতায় যেতে হবে বিকাশ।
কলকাতায়? আমাকে তুমি কলকাতায় নিয়ে যেতে চাও কমলা? কিন্তু এই মাংস-পিণ্ডটাকে নিয়ে যাওয়া যে কত কঠিন তা তোমার এখানে আসার দিনেই টের পেয়েছি।
সেদিন তো তোমার কাছে এই রকম কোনও চেয়ার ছিল না।
ইনভ্যালিড হুইল চেয়ার? হ্যাঁ, সেটা ছিল না সেদিন।
বিকাশ চেয়ারটার গায়ে সযত্নে হাত বোলাতে লাগল।
এখন আর তত অসুবিধে হবে না দেখো!
কত উপকারী লোক যে জগতে আছে কমলা, ভাবলে…
আমাকে ঐ দলে ফেলছ বিকাশ?
তোমাকে কোন দলে ফেলব, এখনও ঠিক করে উঠতে পারিনি। আমি বলছি উপকারী মানুষদের কথা। এই কথাটা আজ ঠাট্টার মত শোনায়। কিন্তু আমি একটুও ঠাট্টা করছিনে কমলা। দুজন কনেস্টেবলের কথা বলি। খালাশ পাবার পরে যারা আমাকে ট্রেনে তুলে দিতে এসেছিল। তাদের একজন আমাকে জিপে করে হাওড়া স্টেশনের ভিতরে নিয়ে গেল। আরেকজন টিকিট কেটে দিল। তারপর দুজনে মিলে একটা ইনভ্যালিড চেয়ার জোগাড় করে আনল। বসাল তাতে। দুজনে বয়ে সেটাকে বর্ধমান লোকালের কাছে নিয়ে গেল। ভেন্ডার গাড়িতে গিয়ে জনে জনে জিজ্ঞেস করল, খন্যানে নামবে কারা? দুজন গোয়ালাকে পেয়ে তাদের হাতে আমাকে সঁপে দিল। বারবার করে তাদের অনুরোধ করেছিল সেই কনস্টেবল দুজন, আমাকে তারা যেন স্টেশনের বাইরে নিয়ে গিয়ে একটা রিকশায় চড়িয়ে দেয়। সেউ দুটো লোক কনস্টেবল দুজনকে কথা দিয়েছিল, আমাকে তারা রিকশায় তুলে দেবে। এবং সে কথা তারা রেখেছিল, কমলা।
বিকাশ হুইল চেয়ারটাকে ঠেলতে লাগল।
আমি অনেক সময় বুঝতে পারিনে কেনই বা মানুষ অনর্থক মানুষকে নিপীড়ন করে তাকে পঙ্গু করে দেয়। আবার কেনই বা মানুষ অকারণে মানুষের উপর এতটাই সদয় হয়ে ওঠে, যেমন তোমাকে বললাম। আমি যেমন সেই হিংস্র পুলিশ অফিসারটাকে ভুলতে পারিনে, তেমনি ভুলতে পারিনে সেই কনস্টেবল দুটোর কথা বা সেই গোয়ালা দুটোর কথা। যারা আমাকে কোলে করে ট্রেন থেকে নামিয়ে প্ল্যাটফরম পার করে এনে একটা রিকশায় বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। সেই রিকশাওলার গল্প তোমাকে একদিন বলেছি।
হুইল চেয়ারটা একেবারে কমলার সামনে হাজির করে বিকাশ বলল, পাঁচ হাজার টাকা শোধ করবার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
তার মানে একটা মেয়ের ভালমানুষির সুযোগ নিয়ে তুমি এতগুলো টাকা হজম করে দিতে চাইছ বিকাশ? খুব ধুরন্ধর খাতক তো?
বিকাশ হেসে ফেলল।
সামান্য তো কটা টাকা কমলা। তার জন্য এত বিচলিত হচ্ছ?
সামান্য কটা টাকা! এই তো শুরু। এটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে জানো?
বিকাশ হুইল চেয়ারটাকে ঘুরিয়ে নিল।
তোমাকে ডাক্তারবাবুর কাছে নিয়ে যেতে হবে বিকাশ। তারপর তিনি দেখবেন,
তোমার কতটা ক্ষতি তিনি মেরামত করতে পারবেন। হয়তো আর্টিফিশিয়াল লিম্ব্ লাগবে।
হুইল চেয়ারে একপাক ঘুরে কমলার মুখোমুখি হল বিকাশ।
তার মানে তোমার কিছু গচ্চা যাবে বলে মনে হচ্ছে।
আমারও সেই রকম সন্দেহ হচ্ছে।
বিকাশ হুইল চেয়ারটাকে চালিয়ে এনে একটা খোলা জানলার সামনে দাঁড় করাল।
বৃষ্টি পড়ছে, আবার মেঘ ফেটে রোদও বেরিয়ে পড়েছে। আকাশের খানিকটায় রামধনু ছড়িয়ে আছে।
দ্যাখো কমলা, দ্যাখো।
বিকাশ ছেলেমানুষের মতো চেঁচিয়ে উঠল।
রামধনু, কমলা, রামধনু!
কমলা এসে বিকাশের পাশে দাঁড়াল। বৃষ্টি তখন নেটের পর্দা হয়ে এসেছে।
আকাশ দিয়ে বিকেলের রোদের সুন্দর একটা আভা ফুটে বেরুচ্ছে।
এমন আকাশের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম কমলা।
এমন আকাশ আমিও অনেকদিন দেখিনি বিকাশ। দ্যাখো, স্বপ্নের মত লাগছে না?
এই বিকেলটা স্বপ্নের মতোই আমার মনে চিরকাল গেঁথে থাকবে।
কমলা!
কমলা একটা আমেজের মধ্যে ডুবে গিয়েছিল তখন।
কমলা, আমি তোমার টাকা শোধ দিয়ে দিতে পারব।
বিকাশের স্বরে আত্মপ্রত্যয়ের জোর।
কমলা কথাটা শুনল। সে কোনও উত্তর দিল না। তার ঠোঁটে যে ম্লান হাসিটা ফুটে উঠল, এই বিকেলের অদ্ভুত আলো সেটাকে যেন আরও করুণ করে তুলল।
বিকাশ, তুমি এখানেই বসে থাকো। আমি চা করে নিয়ে আসি।
কমলা চলে যাচ্ছিল। বিকাশ জোরে জোরে হুইল চেয়ারটা চালিয়ে কমলাকে ধরে ফেলল। কমলার মুখের দিকে নজর পড়তেই বিকাশের খুশির ভাবটা ঠোক্কর খেল। কমলার মুখটা ম্লান।
কমলা, চলে যেয়ো না।
চা করে আনি বিকাশ। বেলা গড়িয়ে এল।
আমি কি তোমার মনে দুঃখ দিয়ে ফেলেছি কমলা?
কমলা বিকাশের দিকে চেয়ে শুকনো একটা হাসি হাসল। কমলার একটা হাত ধরে ফেলল বিকাশ।
কমলা, কথাটা ওভাবে প্রকাশ করাটা আমার ঠিক হয়নি। কিন্তু বিশ্বাস করো তুমি, আমি ঠিক ঐ কথাটাই বলতে চাইছি। এমন একটা আকাশ, রোদ, বৃষ্টি, রামধনু, একটা যেন ছবি কমলা। অনেক দিন এ জিনিস দেখিনি, জানো? হয়তো জীবনে আজই প্রথম দেখলাম। হয়তো আর কখনও এমন মুহূর্ত আসবে না, কমলা। তাও হতে পারে। কিন্তু ঐ কটা মুহূর্তে আমি ভুলে গিয়েছিলাম, আমি পঙ্গু। আমি নরক থেকে উঠে এসেছি। আমার কোনও ভবিষ্যৎ নেই। এ সব কথা একদম ভুলে গিয়েছিলাম কমলা। আমার মনে একটা বিশ্বাস জেগেছিল কমলা। এই বিশ্বাস যে, আমি আবার উঠে দাঁড়াতে পারি। নিজের হিম্মতেই পারি। আসলে এতগুলো জিনিস বলতে চেয়েছিলাম তোমাকে। কিন্তু ঐ একটা কথাই বেরিয়ে গেল মুখ থেকে। কমলা, তোমার সব টাকা আমি শোধ করে দেব। এই কথাটাই বেরিয়ে গেল মুখ দিয়ে। কমলা! আর কীভাবেই বা বলতে পারতাম?
অনুশোচনায় কাতর বিকাশের মুখটাকেই দেখল কমলা। তার কেমন অস্বস্তি লাগছিল। তার কান্না পাচ্ছিল। একটা অপরাধী বালকই যেন তার মুখের দিকে চেয়ে রয়েছে।
বিকাশ, গাঢ় স্বরে কমলা বলল, চলো না, আমরা একটু ছাতে যাই। যাবে?
বিকাশ কমলার হাতখানা দু’হাতে আঁকড়ে ধরে রইল শুধু। কথা বলল না। মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
আমি বরং ওদিকের দরজাটা খুলে দিই। তুমি দরজা পর্যন্ত এসো। তারপর আমি পার করে দেব তোমাকে। কিন্তু একদিনে এতটা পরিশ্রম করবে? হাতের উপর তো কম চাপ পড়ছে না? রাতে ব্যথা হবে দেখো।
আমি হাতে যাব কমলা। তুমি এই ঘর থেকে আমাকে বের করে দাও।
কমলা ছাতের দরজা খুলে বিকাশকে চেয়ার সমেত হাতে বের করে আনল। বৃষ্টি গুঁড়ি গুঁড়ি পড়ছে। মাঝে মাঝে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। আকাশে কোথাও কালো কোথাও হাল্কা মেঘ। অস্তগামী সূর্যটাকে ঘিরে কালো আর আলোর এক জ্যোতির্বলয়। রামধনুটার বেশ কিছুটা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। বিকাশ আর কমলার মনে হল ওরা যেন সমুদ্রে এসে পড়ল। ছাতে বেরিয়ে বিকাশ আর এক মুহূর্ত দেরি করল না। হুইল চেয়ারটাকে চালাতে চালাতে ছাতের অন্য দিকে চলতে থাকল। কমলা সাবধান হয়ে তার পিছনে পিছনে যেতে লাগল।
দ্বিতীয় পাক ঘোরার সময় হাতের মাঝামাঝি এসে বিকাশ থেমে পড়ল। ব্যস্, কমলা। আর না। হাত একেবারে এলে গিয়েছে।
চলো তবে ঘরে যাই।
ঘরে? এখনই?
তবে কী করবে?
আর একটু থাকি না এখানে?
এই বৃষ্টিতে?
এই বৃষ্টিতে। ক্ষতি কী? না হয় একটু ভিজলামই আজ।
না। বেশি বাহাদুরি করে দরকার নেই। চলো, এক পাক ঘুরে আমরা ঘরে ঢুকে যাই। আমাকে এবার চা খেতে হবে বিকাশ।
কমলা বিকাশের হুইল চেয়ারটা আস্তে আস্তে ঠেলে ছাতটা ঘুরতে শুরু করল। কমলা হঠাৎ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। বাবার কথা কেন যে এখন মনে পড়ল কে জানে!
কী হল কমলা?
কিছু না, বিকাশ। চলো আমরা ঘরে যাই। জামা কাপড় বেশ ভিজে উঠেছে।
ঘরের ভিতরে ঢুকে হুইল চেয়ারটাকে বিছানার কাছে নিয়ে গেল কমলা। তারপর বিকাশের গা-টা মুছিয়ে, ওকে শুকনো লুঙ্গি আর জামা পরিয়ে খাটে তুলে দিল। ঘরে অন্ধকার।
নিজে নিজে খাট থেকে হুইল চেয়ারে চড়তে যেয়ো না বিকাশ। তোমাকে আরও
কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।
বিকাশ পুট করে আলো জ্বেলে দিল। কমলা হুইল চেয়ারটাকে ঘরের এক কোনায় ঠেলে দিতে যাচ্ছিল।
থাক না কমলা, ওটা আমার হাতের কাছে। ওটা তো তোমার শরীরের খানিকটা। আমি নিজে নিজে আর ওটায় চড়তে যাব না। কথা দিচ্ছি।
কমলা ওটাকে একেবারে বিকাশের গা ঘেঁষে রেখে দিল। তারপর বিকাশের ভিজে পোশাক তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
আমি চা নিয়ে আসছি বিকাশ।
নীচে নামতেই কমলা দেখে ক্ষেমিও ঢুকছে।
এ কী গো দিদি, ভিজে যে একেবারে ঢোল হয়ে গিয়েছে। এত জল লাগল কোথায়?
ছাতে। তুই সন্ধে জ্বাল। তারপর দাদাবাবুর ঘরটা মুছে দিয়ে আয়। আমি গা ধুয়ে ততক্ষণে চা করে ফেলি
কমলা চা নিয়ে বিকাশের কাছে গেল, ক্ষেমি ততক্ষণে ঘর মুছে নীচে নেমে গিয়েছে।
বিকাশের সামনে চা রেখে হুইল চেয়ারটা ঘুরিয়ে নিয়ে তাতেই বসে পড়ল কমলা। কী, তোমার হাতের অবস্থা কেমন?
অনেক দিনের অনভ্যাস। একটু-আধটু ব্যথা-ট্যথা তো হবেই প্রথম প্রথম।
ওরা দুজনে চা খেতে লাগল।
ঠাণ্ডা লাগেনি তো?
ওরা চা খাচ্ছে।
বিকাশ কমলার কথার উত্তর দিল না। সে কিছু ভাবছে। তাকে বেশ অন্যমনস্ক দেখা যাচ্ছে। সে চা খাচ্ছে। কমলাও চা খাচ্ছে। তার চোখ দুটো স্থির হয়ে আছে বিকাশের মুখের উপর।
কমলা, তুমি বিশ্বাস করো, আমি নিজে নিজে উঠে হেঁটে চলতে পারব।
বিশ্বাসে আর অবিশ্বাসে কী যায় আসে বিকাশ। এটা তো আর তেল পড়া জল পড়া নয়। নিজেই তো দেখলে হুইল চেয়ারটায় একবার উঠতে পারলে তোমার কাছে দুনিয়াটা কেমন বদলে যায়।
তা যায়, সত্যিই যায় কমলা। মনে হয় পৃথিবীটা অতটা নিষ্ঠুর নয়, যতটা আমি ভাবছিলাম।
তবে বিকাশ, এ তো কাজের শুরু মাত্র। হুইল চেয়ারটা নিয়ে এলাম, কেন না তোমাকে নড়ানো চড়ানো প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। একটানা শুয়ে থেকে থেকে তোমার মনটাও পঙ্গু হয়ে পড়ছিল।
বড্ড একা একা থাকতে হয় তো।
সে বরং ভাল বিকাশ। দোকা থাকা মানেই তো কথায় কথায় ঝগড়ার সৃষ্টি হওয়া।
কেন যে অমন মাঝে মাঝে খেপে যাই!
একেবারে একা থাকলে মানুষ পাগল হয়ে যায়। তুমি তো এই বাড়িতে মাত্র চার মাস এসেছ বিকাশ। কিন্তু আমি? মা মারা যাবার পর চার বছর এ বাড়িতে একা একা কাটিয়েছি। একেবারে একা। কেমন যেন হয়ে পড়েছিলাম। কেমন যেন….
কমলা চা খেতে শুরু করল। বিকাশ ওর দিকে কিছুক্ষণ নিষ্পলক চেয়ে থাকল।
শুধু আপনি আর কপনি। এ নিয়ে কেউ থাকতে পারে বিকাশ?
বারো বছর সরকারের হেফাজতে ছিলাম। কখনও পুলিশের, কখনও জেলের। তোমার কথা বুঝতে অসুবিধে হয় না আমার। তারপর এ বাড়িতে এলাম। এসে দেখলাম, এখানেও একা।
আমি চেষ্টা করেছিলাম, বিকাশ। একে অফিসের কাজ। তার উপর আজকাল
কলকাতায় যাতায়াতের যা ঝামেলা।
কমলা চা খাচ্ছে। বিকাশ চা খাচ্ছে। ওরা দুজনে দুজনের দিকে চেয়ে আছে। ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা…
কমলা চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখল।
শরীরটা যেন এলিয়ে পড়ত। কিন্তু ব্যাপারটা জরুরি হয়ে উঠল পরশু থেকে। মনে হল, না, আর দেরি করা যায় না। সারারাত সে কী যে উদ্বেগ, তোমাকে বোঝাতে পারব না। মনে হচ্ছিল, আজ রাতেই যদি মরে যাই। কেউ যদি গলা টিপে মেরে ফেলে এক্ষুনি। কি কাল কলকাতায় যাবার পর আমার যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে, যদি মরে যাই। বিকাশের কী হবে? হুইল চেয়ারটার কথা বলা ছিল। ওটা তৈরিই ছিল। তবে টাকা তো কম নয়। কিন্তু কোনও কথাই আর মনে জায়গা দিলাম না।
বৃষ্টি থেমে গিয়েছে কমলা।
হ্যাঁ বিকাশ। একটু পরেই চাঁদ উঠবে।
আজ কি পূর্ণিমা?
মনে হয় না। তবে শুক্লপক্ষ। কবে যেন ঝুলন। সামনেই।
তুমি কি আমাকে ভালবাসো?
ভালবাসা?
অনিন্দ্যকে তুমি তো ভালবাসতে।
বাসতাম। অন্তত আমার সেই রকম ধারণা ছিল।
এখন?
বলতে পারব না।
সে কি আমার জন্য?
না বিকাশ।
তবে?
কী তবে?
কিছু না। আমরা কোনও বিশ্বাসেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না কমলা। তবে কিসের উপর দাঁড়িয়ে আছি বিকাশ?
তাও তো জানিনে। কেমন অদ্ভুত লাগে আমার। আমরা এক সময় সন্ত্রাসে বিশ্বাস করতাম। বিশ্বাস করতাম, খুন করো, গোটা কতক লোককে খুন করো, বিপ্লবের পথ পরিষ্কার হয়ে যাবে। প্রশস্ত হবে। অত্যাচারিত নিপীড়িত যারা, যারা সব দিক থেকে বঞ্চিত, তারা এসে আমাদের দল ভারী করবে। আমার বন্ধুরা খুনে মেতে গেল। তাদের সঙ্গে আমার যোগ ছিল, শুধু এই কারণে আমাকেই ধরে নিয়ে গেল। পঙ্গু হয়ে গেলাম কমলা। কিন্তু যে লোকটা আমাকে পঙ্গু করে দিল, আরও অনেককেই এরকম করেছে, খুন কিন্তু সে হল না। সে প্রমোশন পেল। বড় অফিসার হল। আরও বড় হবে। খুন হল কারা জানো? আমরা খতম করলাম, ঐ যে যে-দুটো লোক আমাকে যত্ন করে ট্রেনে তুলে দিয়ে গেল, ওদেরই মতো কিছু লোক। আমরা তো ভেবেছিলাম, আমাদের পিছনে বঞ্চিত ক্ষুধার্ত মানুষদের ভিড় বাড়বে। কিন্তু তারা সব একে একে সরে পড়ল।
কিন্তু খুনের নীতিতে তুমি তো বিশ্বাস করতে বিকাশ?
করতাম এক সময়। কিন্তু পুলিশে ধরার অনেক আগেই সে বিশ্বাস আমার ছেড়ে গিয়েছিল। না হলে কি বিয়ে করতে আসি?
কিন্তু বিয়ে করতে তোমার তো আদৌ মত ছিল না।
না। কিন্তু আমার যদি খুনের নীতিতে বিশ্বাস থাকত, তা হলে নিশ্চয়ই বিয়ে করার ব্যাপারে, সে যে কারণেই বিয়ে করতে এসে থাকি না কেন, কিছুতেই রাজি হতাম না।
কিন্তু যারা খুন করছিল তখন, তাদের নাম তুমি তো বলে দিতে পারতে পুলিশকে।
হ্যাঁ কমলা, নিশ্চয়ই পারতাম। আর তা হলে এমন অবস্থা হত না আমার।
তবে কেন বললে না বিকাশ?
তাদের নাম বলে দিলে, তারা যে খুন হবে না, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত হতে পারিনি। আমি জানতাম কমলা, তারা ধরা পড়লে খুন হবেই। তারা আমার বন্ধু ছিল।
তুমি যাদের বাঁচাবার জন্য তোমার শরীরের সর্বনাশটা ঘটিয়ে ফেললে তারা কি সবাই বেঁচে আছে বিকাশ?
কয়েকজনের কথা জানি, তারা খুন হয়েছে।
তবে?
তবে কী?
না বিকাশ, কিচ্ছু না।
দুজনে চুপ করে গেল। দুজনেই গভীর ভাবনার মধ্যে ডুবে গেল।
ক্ষেমি হাঁপাতে হাঁপাতে উপরে উঠে এল। দারুণ ভয়ে সে থরথর করে কাঁপছে।
দিদি গো, বাড়িতে পুলিশ এসেছে গো, পুলিশ। বাবা গো!
কমলা বলল, পুলিশ!
বিকাশ বলল, পুলিশ?
ক্ষেমি থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, পুলিশ গো দাদাবাবু, পুলিশ! তোমার খোঁজ করছে।
কমলা বিকাশের মুখের দিকে চাইল।
বিকাশ বলল, কমলা, এখানে নিয়ে এসো।