কমলার একটি সন্ধে

কমলার একটি সন্ধে 

ক্ষেমি বলে, রোজই বলে, তুমি থাকো না গো দিদি, সন্ধে হলে বাড়িতে ঢুকতে আমার বড় ভয় করে। তোমার মা ছিল, বাড়িটা আলো হয়ে ছিল। তোমার মা ও গেল, সব খাঁ খাঁ। তুমি বেরিয়ে গেলেই আমাবশ্যে নেবে আসে গো। সন্ধে পিদিম জ্বালব কী, চৌকাঠ পেরোতেই গা ছম ছম করে। কমলা ঠেলা খেয়ে পাশের লোকটার দিকে আড়চোখে চাইল। কাগজ পড়তে পড়তে লোকটা তার বুকের উপর আবার আলোগোছে তার কনুইটা রেখেছে। সে ওরই মধ্যে যতটা পারে সরে যাবার চেষ্টা করল। বিশেষ সুবিধে হল না। গাড়িটায় এমনই ভিড়। তুমি যে একা একা এত বড় বাড়িটায় কী করে থাকো দিদি। বেরুবার মুখে এমনিতেই কমলার ভয়ানক তাড়া। ঝড়ের মতো রান্নাবান্নার কাজ সেরে ফেলতে হয়। দু’বেলার রান্নাই করে রাখে সে। আটটা দশের গাড়িটা তাকে ধরতেই হয়। তাই ক্ষেমির বকবকানিতে সে বিশেষ রা কাড়ে না। একা থাকার কথা উঠলে মাঝে-সাঝে বলে ওঠে, আ মলো, চোখের মাথা খেয়ে বসে আছ, একা থাকব কোন দুঃখে, বাড়িতে মানুষ নেই? উঠোনের টিউকলে বাসন মাজতে মাজতে ক্ষেমি উপরের দিকে তাকায়, জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর মনে মনে বলে, আবাগি, আবাগি। কমলার এপাশে এক বুড়ো। খক খক করে কেশেই চলেছে। বৃষ্টি নামল। বুড়োটা তাড়াতাড়ি জানলা নামিয়ে দিল। কাঁচুমাচু হয়ে যেন কমলাকেই কৈফিয়ত দিল, অসুখ, বুকের অসুখ গো মা। এই ছোট কামরাটায় রাজ্যের লোক। প্যাঁচপেচে গরম জানলাটা বন্ধ হয়ে যেতে কমলার মনে হল, তার যেন দম বন্ধ হয়ে এল। ও পাশের লোকটা কমলার বুকের উপর শরীরের ভার চাপিয়ে বুড়োটার দিকে ঝুঁকে পড়ল। ও কী করলে ভাই? জানলা খোলো, খোলো। দম বন্ধ হয়ে মরে যাব নাকি আমরা? বেআক্কেলে বুড়ো। আরেকজন খেঁকিয়ে উঠল। বুড়োটা ঘোলা চোখ দুটো কমলার মুখের উপর রেখে বলল, অসুখ, বুকের অসুখ মা। খেঁকুরে লোকটা বলে উঠল, বুকের অসুখ তা ট্রেনে উঠেছ কেন? হাসপাতালে যাও। বুড়োটা বেদম কাশতে কাশতে বিপন্ন হয়ে বলল, অসুখ, অসুখ, বুকের অসুখ গো বাবা, ঠাণ্ডা লাগলে বেড়ে যাবে। বৃষ্টির ছাঁট লাগলে ক্ষেতি হবে বাবা! একে দমবন্ধ হয়ে আসছে কমলার, তার উপর বুড়োটা তার মুখের উপরেই কাশতে শুরু করল। একটা দারুণ অস্বস্তি। তার সঙ্গে ঘেন্না। সে এবার এদিকেই একটু সরে আসার চেষ্টা করল। তার শরীরটা কেমন গুলিয়ে উঠল। সে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজল। এই, ও বুড়ো, কী হে, কথা কানে যাচ্ছে না, খোলো, এক্ষুনি জানলা খোলো। দেখছ না লেডিসের অসুবিধে হচ্ছে। বুড়োটা এবার আর্তনাদ করে উঠল, বুকের অসুখ মা, বুকের অসুখ। খক খক খক। খেঁকুরে লোকটা বলে উঠল, ভাল কথার দিন আর নেই। কী, অসুবিধে হচ্ছে? দেব জানলাটা খুলে! কমলা ক্লান্তস্বরে বলে উঠল, না, আমার তেমন অসুবিধে হচ্ছে না। কমলা শুনল, লোকটা বলছে, আপনি দয়া দেখিয়ে বলে ফেললেন, আর তো আমার কিছু করার নেই। তার শরীরে চাপ পড়তেই কমলা বুঝল, তার এপাশের লোকটাও সিটে হেলান দিল। কমলা চোখ খুলতেই লোকটার সঙ্গে তার চোখাচোখি হয়ে গেল। তার মনে হল লোকটা যেন একটু হাসল। 

কমলা কখনওই এই ট্রেনটায় আসে না। তার ট্রেন পাঁচটা সাতান্ন। আজ হাওড়া ব্রিজে এমন জ্যাম যে, সে ও-মাথা থেকে দৌড়তে দৌড়তে এসেও ট্রেনটা ধরতে পারল না। তার নাকের ডগা দিয়ে পাঁচটা সাতান্ন বেরিয়ে চলে গেল। তাই ছটা পনেরোয় উঠে সে যখন শুনল যে, ট্রেনটা গ্যালপিং, প্রথম স্টপ একেবারে সেই শেওড়াফুলি, সে বেশ স্বস্তি পেয়েছিল। ভেবেছিল বাড়ি পৌঁছুতে খুব একটা তা হলে দেরি হবে না। কিন্তু কী হয়েছে ট্রেনটার, একঘন্টা কেটে গেল, এখনও বিষড়ে পৌঁছুতে পারল না। যেখানে সেখানে থামছে। আর কেবল লোকই উঠছে। বৃষ্টি বেশ জোরে নামল। বিড়ি, সিগারেট, ঘামের গন্ধ একেবারে ভারী হয়ে নেমে এল কামরাটার মধ্যে। কমলার বুকে আবার কাগজপড়া লোকটার কনুই এসে চাপল। কমলা চোখ বুজে অনুভব করল, এবার সে আর আগের মতো অস্বস্তি বোধ করছে না। ট্রেনটা আবার থামল। লোকের কলরবে কামরাটা যেন কাঁপছে। পাশের বুড়োটা দমকে দমকে কেশেই চলেছে। থুথু ফেলছে ভিতরে। ট্রেনটা আবার চলতে শুরু করল। দরজার কাছ থেকে গোটা কয়েক ছোকরা জোরসে সিটি বাজিয়ে উঠল। এখনও ছিরামপুর এল না। একে বলছে গ্যালপিং। কখন যে পৌঁছবো? ঝকমারির আর শেষ নেই। কাগজপড়া লোকটা তাকেই শুনিয়ে চলেছে কথাগুলো, সে বিষয়ে কমলার মনে সন্দেহ নেই কিছু। অ ক্ষেমি? কমলা মায়ের গলা শুনে চমকে উঠল। চোখ মেলে দেখল অজস্র লোকের মাথা। আর সেই মাথাগুলোর উপর দিয়ে একটা ঝালমুড়ির টিন ভেসে বেড়াচ্ছে। সে বাড়ি ঢুকলেই মা ডেকে উঠত, অ ক্ষেমি। কমলি ফিরল! জলটল রেখেছিস তো। এবার তা হলে চা করি? যখন মায়ের বিছানা থেকে ওঠা বারণ তখনও মা উঠে চা করে দিয়েছে। মা যতদিন ছিল, ক্ষেমি বাড়িছাড়া হতে চাইত না। এখন সেই বাড়িতে ঢুকতে ক্ষেমির গা ছম ছম করে। কমলার মনে একটা চাপা ভার। শোক নয়, দুঃখ নয়, একটা ভার শুধু। 

মাত্র দু’ বছর হল মা গত হয়েছেন। তখন ট্রেন সামান্য লেট হলেও কমলার মনে কত উদ্বেগ হত। মা তার জন্য ভাববেন, এই কারণে। অথচ এরই মধ্যে মা তার মন থেকে কত দূরে চলে গেল। বাবা? বাবার কথা কষ্ট করে মনে আনতে হয়। অনিন্দ্য? অনিন্দ্যর মুখটা কি মনে পড়ছে তার? কমলা প্রাণপণে চোখটা বুজে থাকার চেষ্টা করল। অনিন্দ্যর মুখটাকে মরিয়া হয়ে মনের মধ্যে হাতড়াতে লাগল। একটা আবছা চেহারা ভেসেও উঠল। কিন্তু ওই কি অনিন্দ্য? ঠিক বুঝতে পারল না। পনেরো বছর একটা জীবনের পক্ষে কি এতটাই দূর? কমলা চাইল তার মনে একটা তীব্র ব্যথা উঠকু। যে কোনও একটা গভীর দুঃখ তাকে অস্থির করে তুলুক। বাবা যেদিন অনিন্দ্যকে প্রায় তাড়িয়েই দিলেন বাড়ি থেকে, কমলা যেদিন বুঝল, অনিন্দ্য চিরকালের মতোই চলে গেল তার জীবন থেকে, সেই দিনের মতো, কিংবা বাবা যেদিন হঠাৎ মারা গেলেন, সেই দিনের মতো। কিংবা বাড়িতে ঢোকার আগে থেকেই যেদিন ক্ষেমির আর্ত চিৎকার তাকে জানিয়ে দিল মা আর নেই, সেই দিনের মতো একটা হাহাকার কমলার মনের মধ্যে এখন একবার জেগে উঠুক। একবার, এক মুহূর্তের জন্যও আজ, এখন, তার মনে সেই তীব্র দুঃখের বেদনা জেগে উঠুক। খানখান করে ভেঙে দিক কমলার বুকে জমে থাকা এই অনুভূতিহীন ভারটাকে। তাকে অস্থির করে তুলুক কোনও কিছু। কেন যে এমন চাইছে কমলা, তাও সে ঠিক বুঝতে পারছে না। 

পাশের লোকটা তার গায়ের সঙ্গে একেবারে সেঁটে বসে আছে। কখনও তার জাং কমলার জাংকে চেপে ধরছে, কখনও বা তার হাঁটু কমলার হাঁটুটাতে এসে ঠেকছে। লোকটার কনুই কমলার বুকের উপর দিয়ে আলতো ভাবে পিছলে নেমে গেল। তার স্তনের মুখে চাপ পড়তেই কমলার শরীরটা শির শির করে উঠল। শ্রীরামপুরে ট্রেনটা থামল না। তবে তার গতিটা মন্থর হয়ে এল। লোকটার কনুইয়ের মতোই ধীরে ধীরে পিছলে পিছলে চলে যেতে লাগল প্ল্যাটফরমের পাশ দিয়ে দিয়ে। ওপাশের প্ল্যাটফরমে পিছনের একটা লোকাল এসে ঘস করে থেমে পড়ল। চিৎকার উঠল, বর্ধমান, বর্ধমান। কিছু লোক ওদের সেই চলতি ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে পাগলের মতো পড়ি মরি করে বর্ধমান ধরতে ছুটল। এ সব ঘটনায় কমলা কিছুমাত্র উদ্বেগ বোধ করল না। এমন কি, ওদের ট্রেনটা যে লেট-এ চলছে, তার জন্যেও কোনও ভাবনা, চিন্তা, উদ্বেগ, কিছুই আর বোধ করছে না কমলা। সে বড় ক্লান্ত। 

হঠাৎ কমলা চমকে উঠল। লোকটা সত্যিই বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। তার মুখটা কঠিন হয়ে উঠল। অতি কষ্টে চোখের পাতা খুলে স্থির দৃষ্টিতে লোকটার চোখের দিকে চাইল। লোকটাও হকচকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। কমলা বলল, একটু সরে বসুন। লোকটা সরতে গিয়ে সরল না। বলল, কেন? এমন একটা প্রশ্নে কমলাও অপ্রস্তুত হয়ে গেল। আচ্ছা পাজি তো লোকটা। কমলা একটু সামলে নিয়ে প্রায় ধমক দিয়েই বলে উঠল, আমার অসুবিধে হচ্ছে। অসুবিধে হচ্ছে? অ। লোকটা নির্বিকার। কমলা অবাক হয়ে লোকটাকে ভাল করে দেখতে লাগল। পেটা একটা চাষাড়ে শরীর। কিন্তু তার মধ্যে শয়তানি আছে, এমন কিছু তার নজরে পড়ল না। কমলাকে তার দিকে অমন তাকিয়ে থাকতে দেখে লোকটা কমলার কানের কাছে মুখটা এগিয়ে আনল। ফিসফিস করে বলল, অসুবিধে হচ্ছে যখন, তখন আপনিই একটু সরে যাবার চেষ্টা করুন না? এটা কি লোকটার ধৃষ্টতা না সরলতা, কমলা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। সে বিপন্ন হয়ে বলল, সরব কোথায়? এদিকে কি আর জায়গা আছে? বুড়োটা ঠিক তখনই এমনভাবে কেশে উঠল যে কমলার গা ঘিনঘিন করে উঠল। লোকটা বলল, সবাইকার অবস্থাই এক। মানুষ কি কাঠের পুতুলের মতো বসে থাকতে পারে? তাজা শরীর এদিক ওদিক একটু নড়বেই। আপনি যদি হাত পা ছড়াতে চান, আমি না হয় একটু উঠে দাঁড়াই। কমলা ক্লান্তস্বরে বলল, থাক, দরকার নেই। শেওড়াফুলিতে, দুটো ট্রেন একসঙ্গে এসে দাঁড়াল। তুমুল বৃষ্টি। এ গাড়ি থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে লোক বৃষ্টি মাথায় করে দৌড়ে ও-গাড়িতে গিয়ে ওঠবার চেষ্টা করতে লাগল। এ গাড়িটা ছেড়ে দিল। আবার কিছু লোক ও-গাড়ির দিক থেকে দৌড়ে এসে এ-গাড়িতে উঠে পড়তে লাগল। এই এই এই! বিরাট চিৎকার উঠল বাইরে থেকে। ও-গাড়িটা ছেড়ে দিয়েছিল। থেমে গেল। কমলাদের গাড়িটা আস্তে আস্তে প্ল্যাটফরম থেকে বেরিয়ে গতিটা বাড়িয়ে দিল। প্ল্যাটফরমের একটা আলোর নীচে দাঁড়িয়ে একটা আট দশ বছরের মেয়ে সেই তুমুল বৃষ্টির মধ্যে হাঁ করে কাঁদছে, দৃশ্যটা এক লহমার জন্য কমলার চোখে ফুটে আবার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ঘটনাটা কমলার বোবা মনে কোনও দাগ কাটল না। কমলা চাইছিল, মেয়েটার জন্য তার উদ্বেগ হোক, দুঃখ হোক প্রচণ্ড। তার অসাড় মনটাকে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে দিক। কিন্তু অসহায় হয়ে টের পেতে লাগল কমলা যে, সেই বিপন্ন মেয়েটার মুখ তার মন থেকে ধীরে ধীরে মুছে যেতে লেগেছে। অনিন্দ্য যেমন মুছে গিয়েছে, বাবা যেমন মুছে গিয়েছেন, মা যেমন মুছে গিয়েছেন, তেমনি। 

বিকাশ? ট্রেন ঝপ করে থেমে গেল। বুড়োটা বেজায় কাশছে। ভিতরে থুথু ফেলছে? একবার ঠাণ্ডা-মতো কী কমলার পায়ের উপর পড়ল। কমলার শরীর কুঁকড়ে গেল। ওপাশের লোকটা একটু ব্যবধান রচনা করেছিল। কমলা আপনা থেকেই সেদিকে সরে গেল। লোকটা যেন আপন মনেই বলে উঠল, বেচারি আমাদের সকলেরই যক্ষ্মা ধরিয়ে দেবে। ওদিকের জানলা খোলা ছিল। কমলা চেয়ে দেখল গাঢ় অন্ধকার। বৃষ্টির ধারা সেই অন্ধকারকে একেবারে জমাট করে তুলেছে। কমলা অন্ধকারে সদরের তালা খুলতে গিয়ে দারুণ চমকে গেল। কাঁপা কাঁপা গলায় কমলা জিজ্ঞেস করল, কে? অন্ধকার থেকে সাড়া এল, আমি বিকাশ। বিকাশ? কমলা প্রথমে বুঝতেই পারল না, কে বিকাশ? কমলা, আমি বিকাশ। একটা ক্লান্ত স্বর বিমূঢ় কমলার কানে ভেসে এল। কমলা, আমার কোথাও আর যাবার জায়গা নেই। সরকারও আর আমাকে ধরে রাখার প্রয়োজন বোধ করল না। বিকাশ! কমলার বুক ঠেলে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। বিকাশ। তার বোধশক্তি ক্রমে ফিরে এল। বিকাশ। তার বর। 

দরজার তালা খুলে কমলা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর শান্ত স্বরে ডাকল, আসুন। এসো। আমি, আমি নিজে থেকে আর হাঁটতে পারিনে। জেলেই আমার এ অবস্থা হয়। সরকারি ডাক্তাররা বলেছেন, এ আর সারবে না। কমলা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। কোনও সাড়া দিল না। সেদিনও এমনই অন্ধকার ছিল। জানালার বাইরে চেয়ে দেখল কমলা। আর প্রায় এমনি বৃষ্টি। কমলার বুকের উপর কারও হাত ছিল না সেদিন। কিন্তু ভারী চাপটা এমনই ছিল। কমলার বুকের উপর কনুইটা এবার অনেক সাহসের সঙ্গে ফেলে লোকটা একটু হেসে বলল, কী, এবার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো? কমলা ভূক্ষেপ করল না। সে একমনে জানলা দিয়ে সেই প্রবল বৃষ্টি দেখতে লাগল। বিকাশ। তার স্বামী। বাবার জেদ। তাই অনিন্দ্যকে যেতে হল। অনিন্দ্য, তার বাবার মতে, ছেলে ভালো। কিন্তু অনিন্দ্যের সঙ্গে তাদের জাতে মেলে না। তাই অনিন্দ্যকে সরে যেতে হল। আর কোনওদিন দেখা হয়নি অনিন্দ্যর সঙ্গে। বিকাশের সঙ্গে তাদের জাতে মিলেছিল। তাই বাবার জেদে বিকাশ তার স্বামী। কোথায় বাবা? কোথায় মা? এখন বিকাশ এসেছে। পড়ে আছে অন্ধকার রোয়াকের ওই কোণে। নিজে নিজে উঠতে পারে না, হাঁটতে পারে না। পক্ষাঘাত। মা মারা যাবার পর ক্ষেমি ঘ্যান ঘ্যান করত, এই বাড়িতে লোক নেই গো দিদি। একা আসতে ভয় করে। গা ছম ছম করে। তা এখন থেকে ক্ষেমির নালিশ কমবে। লোক একটা থাকবে সর্বক্ষণ এ বাড়িতে। কমলার বরই থাকবে। বিকাশ। একটা পুরুষ মানুষই থাকবে। কমলার মুখ চিরে একটা হাসি ফুটে বের হল। পাশের লোকটার নজরে কমলার হাসিটুকু ঠিকই ধরা পড়ল। সে আলতোভাবে তার হাতের চাপটা বাড়িয়ে দিল। ট্রেনটা হঠাৎ আবার চলতে শুরু করল। কমলা এবার বেশ সহজভাবে বলল, একটু অপেক্ষা করো, একটা আলো জ্বেলে আনি। কমলা আলো জ্বেলে এনে দেখল, না তেমন ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কেন তবে সে আলো জ্বালতে এত ভয় পাচ্ছিল। শুয়ে আছে বিকাশ। বেশ রোগা। আগে কেমন ছিল? এমন রোগা কী? মনে করতে পারল না সে। বিকাশের মুখটা যে পরিষ্কার করে কামানো, এতে কমলা বেশ স্বস্তি পেয়েছিল। আরও একটা স্বস্তি এই যে, বিকাশের দেহটা বেশ হাল্কা ছিল। না হলে সেদিন কমলাকে বিপদেই পড়তে হত। পাঁজাকোলা করে কমলা বিকাশকে এনে তার বিছানাতেই শুইয়ে দিয়েছিল প্রথমে। চুঁচুড়ো আর চন্দননগরে অনেক যাত্রী নেমে গেল। তাদের কামরাটা বেশ ফাঁকা হয়ে এল। লোকটা এবার কমলার কাছ থেকে বেশ সরেই বসল। ওদিকের জানলার কাছে সামনের বেনচিতে একটা সিট খালি হতেই কমলাও সেটাতে গিয়ে বসল। একেবারে জানলার ধারটাই পেয়ে গেল। লোকটা কমলার দিকে চেয়ে হাসল। বলল, এবার বিশুদ্ধ বাতাস পাবেন। এই বেশ ভাল হল। সুইচটা টিপতেই ঘরময় আলো হয়ে গেল। বিকাশ চোখ বুজে ফেলল। কমলা দেখল, বিকাশের কপালের মাঝখানে বেশ গোল করে পোড়া। সে থমকে গেল। বিকাশের কপালে এটা কি ছিল? কমলার মনে পড়ল না। বারো তেরো বছর আগেকার ঘটনা। সেই বিয়ের দিন। আর তা ছাড়া সেদিন বিকাশের মুখের দিকে তেমন তাকিয়ে দেখার অবকাশই বা কোথায় পেয়েছিল কমলা? না, কমলা জেদ করেই বিকাশের মুখ সেদিন দেখতে চায়নি। তার মন জুড়ে ছিল অনিন্দ্যর ছবি। অনিন্দ্য অনিন্দ্য অনিন্দ্য। সে বিকাশের চন্দনের ফোঁটা দিয়ে সাজানো মুখখানা দেখতেই চায়নি সেদিন। চোখ বুজে নিঃশব্দে কেবল কেঁদেই যাচ্ছিল। মা, শুধু মা’ই বুঝতে পেরেছিল ব্যাপারটা। যদিও বাবার কথার উপর মা কোনও কথাই বলেনি। কেননা, বাবার ইচ্ছা অনিচ্ছাই ছিল মায়ের কাছে শেষ কথা, তবুও অনিন্দ্যর ব্যাপারে কমলা মায়েরই সহানুভূতি কিছুটা পেয়েছিল। তার মানে সেদিনের বিচারে বাবা ছিল কমলার শত্রু আর মা ছিল তার মিত্র। এখন বাবাও নেই। মাও নেই। কার উপর রাগ, কার উপর ভালবাসা, সেটাই তার কাছে আর তেমন স্পষ্ট নয়। বিকাশ যখন বর বেশে তার সামনে এসে হাজির হয়েছিল, তখন কমলার মনে অনিন্দ্যর মুখটাই ভরে ছিল। সেই অনিন্দ্যর ছবিও কুরে কুরে খেয়ে দিয়েছে সময়ের উইপোকা। ব্যান্ডেল আসতেই ওদের কামরাটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেল। কেশো বুড়োটা যে কখন নেমে গিয়েছে সেটাও টের পায়নি কমলা। লোকটাও ফাঁকা পেয়ে একেবারে তার সামনে এসে বসল। এই চা, বলে একটা হাঁকও পাড়ল। ভিজতে ভিজতেই একটা ছেলে চা নিয়ে দৌড়ে এল। কী, চা খাবেন তো? এই দুটো চা দে। চটপট চা নিয়ে পয়সা দিয়ে একটা ভাঁড় কমলাকে এগিয়ে দিল লোকটা। তারপর নিজের ভাঁড়ে চুমুক লাগাল। আহ্, আরেকটা চুমুক মারল ভাঁড়ে, লোকটা তারপর বলল, কত দূর যাবেন? কমলা বলল, খন্যেন। ও, তবে তো মেরে এনেছেন। আমার ঝকমারিটা একবার বুঝুন। সেই বর্ধমান। রাত পুইয়ে যাবে কি না কে জানে? কমলা টের পেল লোকটা এবার বেশ কথা কইছে। হয়তো চা খেয়ে খানিকটা চাঙ্গা হয়েছে। চা খেতে কমলারও ভাল লাগছিল। ট্রেনটা ছাড়ল। বৃষ্টিও চেপে এল। উলটো দিক থেকে হাওয়া বইছে বেশ জোরে। খোলা দরজা দিয়ে জল ঢুকে কামরাটা থই থই করছে। জলের ছিটে এসে কমলার পায়েও লাগছে। শরীরটা কেমন স্যাঁতসেঁতে হয়ে আসছে যেন। হঠাৎ বিকাশ চোখ মেলে চাইতেই থতমত খেয়ে গেল কমলা। বিকাশ বুঝল, কী দেখছে কমলা। বলল, রাজটীকা। পুলিশ চুরুটের ছ্যাঁকা দিয়ে বানিয়ে দিয়েছে। বিকাশের চোখে-মুখে একটা দুঃস্বপ্ন যে এক লহমার মধ্যে ছায়া ফেলে গেল, সেটা কমলার নজর এড়াল না। সে অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞেস করল, চা খাবে নাকি? করব? বিকাশ বলল, তা হলে তো ভালই হয়। সেই দুপুর থেকে পড়ে আছি তোমাদের বাইরের রোয়াকে। বুকটা যেন শুকিয়ে গিয়েছে। এইটেই কি তোমার ফেরার সময়? হ্যাঁ বলে কমলা তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে চলে গেল। স্টোভটা ধরিয়ে একবাটি জল তাতে চাপিয়ে দিল। কমলার বুকের কাপড়ে বিকাশের শরীরের ঘেমো গন্ধটা তাকে পীড়িত করে তুলেছে। কমলা ভাবল, চায়ের জল ফুটতে ফুটতে চট করে চান সেরে নেবে কি না। কিন্তু যেই মনে পড়ল কমলার বিছানাতেই বিকাশের অসাড় শরীর শুয়ে আছে, অমনি কমলার গা ঘিনঘিন করে উঠল। চানটা সে আজ পরেই করবে। তার আগে তাকে কয়েকটা কাজ সেরে ফেলতে হবে। বিকাশকে খেতে দিতে হবে। দুপুর থেকে লোকটা ওদের রোয়াকে পড়ে আছে। তার মানে ক্ষেমি আসেনি। বিকাশকে শুতেও তো দিতে হবে। মহা সমস্যায় পড়ল কমলা। ওদের শোয়ার ঘর এখন দুটো। অন্য ঘরগুলো নানা জিনিসের গুদাম হয়ে আছে। তার কোনও একটা পরিষ্কার করে নেওয়া, এখন তার এই ক্লান্ত শরীরে সম্ভব নয়। চায়ের জল হয়ে গিয়েছে। সাঁড়াশি দিয়ে ধরে বাটিটা নামিয়ে ফেলল কমলা। বাটিতে চায়ের পাতা ফেলে দিয়ে সে একটা কাপ নিয়ে এল। একটু ভাবল। তারপর তার জন্যও আরেকটা চায়ের কাপে চা ঢালতে লাগল। স্টোভের উপরে একটা এ্যালুমনিয়মের পাত্র বসিয়ে তার মধ্যেও খানিকটা জল চাপিয়ে দিল। ওতে যে কী হবে, সে বিষয়ে আপাতত কমলার মনে কোনও পরিষ্কার ধারণা নেই। যেমন নেই আরও অনেকগুলো ব্যাপারে। বিকাশকে কোথায় রাখবে? তার ঘরে তো অসম্ভব। কমলা এত বচ্ছর ঐ একটা ঘরে থাকতে এতই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে যে ও ঘরটা হাতছাড়া করার কথা সে চিন্তাই করতে পারে না। ঐ একচিলতে ঘরই তার জীবনের বন্দর, আশ্রয়। বিকাশকে এ বাড়িতে রাখতেই হবে, এমনও কোনও কথা নেই। কালকেই সে তাকে চলে যেতে বলতে পারে। কিন্তু সে-কথা পরে। আজ রাতে কী হবে? উপরের ঘরটাই অল্প পরিশ্রমে গুছিয়ে ফেলা যাবে। সেখানেই বিকাশকে আপাতত রাখবে, ঠিক করল কমলা। 

ট্রেনটার আবার গতি কমতে লাগল। সামনের লোকটা নড়েচড়ে বসল। আজ মনে হয় ভোগাবে। লোকটা বলল। আরেকদিনও এরকম ভোগান্তি হয়েছিল জানেন? মেমারি পৌঁছুতেই রাত দুটো। কমলা জবাব দিল না। সে দু কাপ চা হাতে করে এসে দেখে বিকাশ জামাটা খুলে খালি গায়ে শুয়ে আছে। পাঁজরের উপর স্রেফ চামড়ার আবরণ থাকায় নিঃশ্বাস প্রশ্বাস ফেলবার সময় বিকাশের বুকটা হাঁপরের মতোই ওঠানামা করছে। শরীরের এখানে ওখানেও কয়েকটা রাজটীকার দাগ। কমলা চায়ের কাপ দুটো একটা তোরঙ্গের উপর নামিয়ে রাখল। চট করে গিয়ে বিস্কুট নিয়ে এল। তারপর বিকাশকে জিজ্ঞেস করল, নিজে কি হেলান দিয়ে বসতে পারবে? আসলে ঘামের গন্ধওয়ালা বিকাশের দেহটাকে এখনই আবার ছুঁতে চাইছিল না কমলা। পারব, বলে বিকাশ দু’হাতের জোরে দেহটাকে টেনে টেনে নিয়ে বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে রইল। কমলা বিস্কুট এগিয়ে দিল। বিকাশ বলল, আগে একটু জল খাব। কমলা এক গ্লাস জল ওর ঘরের কলসি থেকে ওরই গেলাসে ঢেলে বিকাশকে দিল। আরেকটা গ্লাস এবার বের করতে হবে। কমলা ভুলে যাওয়া হিসাব নতুন করে কষতে শুরু করল। শুধু কি গেলাস? কত জিনিস এখন নতুন করে বের করতে হবে, তার কি ঠিকঠিকানা আছে? বিকাশকে কমলা চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল, অন্য জামা কাপড় আছে নাকি সঙ্গে? বিকাশ প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ধীরে সুস্থে কটা টাকা আর কয়েক আনা খুচরো বের করে আনল। তারপর মুঠো করে সেগুলো কমলার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, এ ছাড়া আমার আর কিচ্ছু নেই। কিছু নেই কমলা। না, বিকাশ তো কোনও আর্তনাদ করল না। দীর্ঘশ্বাসও ফেলল না। তার চোখে মুখে কাতরতার লেশ দেখতে পেল না সে। কেবল বুকটা পাঁজরার ভিতরে ওঠানামা করছে কমলা চা খেতে খেতে কেবল সেইদিকেই তাকিয়ে রইল। তোমার এখানে কী করে এলাম কমলা, সেইটেই আমি বুঝতে পারছিনে। এখানে আসা আমার তো কোনও মতেই উচিত না। তবে তোমাদের কথা আমার মনে ছিল। তোমাদের এই গ্রামটার কথা, যদিও সেই একদিনই এসেছি, তোমাদের বাড়িটার কথা, তোমার বাবা, তোমার মা, আর আশ্চর্য, কমলা, তোমার কথাও আমার মনে পড়ত। তুমি তো আমার সঙ্গে শুভদৃষ্টিই করলে না। জেদ করে চোখ নামিয়ে বসে রইলে। বাসরঘরেও তো সারাক্ষণ মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলে। তাই না? কমলা চুপ করে রইল। তার সামনে গাঢ় অন্ধকার। আর কী প্রবল বৃষ্টি। ট্রেনটা শেষ পর্যন্ত থেমেই পড়ল। সামনের লোকটা কোথায় গেল? নেমে গেল নাকি? আমি কোনও নালিশ জানাচ্ছিনে কিন্তু। কথাটা বলছি অন্য কারণে। আচ্ছা কমলা, সেদিন বাসরঘরে কতজন পুলিশ ঢুকেছিল বলতে পারো? 

পুলিশ। কত জন? কমলা যেন স্বপ্ন থেকে জেগে উঠছে। ও হ্যাঁ, পুলিশ। কমলা বলল, কতজন তা বলতে পারব না। বাসরঘর ঘিরে ফেলেছিল। পুরো বাড়িটাই নাকি ঘিরে ফেলেছিল ওরা। গ্রামেরও নানা জায়গায় মোতায়েন ছিল পুলিশ। সে গল্প তো আজও গ্রামের লোকেরা করে। কেউ কেউ আবার আমাকে আঙুল দিয়ে দেখাতও। বিকাশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর ঠাণ্ডা গলায় বলল, বিয়েটা তো তুমি করতে চাওনি, না? কমলা স্থির চোখে বিকাশের দিকে চেয়ে বলল, না। চাইনি। বিকাশ বলল, তোমার ওরকম গোঁ দেখে আমারও তা-ই মনে হয়েছিল। আবার থামল বিকাশ। কমলার উঠতে ইচ্ছে করছিল। অনেক কাজ বাকি আছে সারতে। বাবার আলমারি খুলে কী পাওয়া যায় দেখতে হবে। জানো কমলা, এই বিয়েটা আমিও করতে চাইনি। আমি বিয়েই করতে চাইনি তখন। আমি তো জানতাম আমার মাথার উপর কী ঝুলছে। কমলার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, পুলিশ? হ্যাঁ কমলা, পুলিশ। কমলা জিজ্ঞেস করল, কেন? নকশাল আন্দোলন করতাম তখন। নকশালদের কথা শুনেছ? হ্যাঁ, সে তো কলেজে পড়ার সময়কার কথা। তাই। বিকাশ বলল, আজ আর নকশাল করায় কোনও উত্তেজনা নেই। কিংবা আছে হয়তো। সেটা বলতে চাইনি। বলতে চেয়েছিলাম যে তখন আমার বিয়ে করতে আসাটা ঠিক হয়নি। কিন্তু আমার বোনের বিয়ে দেবার ব্যাপারটা খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল। মা নেই আমার। বোনের চালচলনে বাবা কিছু সন্দেহ করে থাকবেন। আমার বোন কারও প্রেমে-ট্রেমে পড়েছিল বোধ হয়। বাবা একটা পাত্র জোগাড় করেছিলেন। ভাল ঘর। সরকারি চাকরিতে ঢুকেছে। কিন্তু নগদ টাকা চাই। আচ্ছা, তোমার বাবা কি আমার বাবাকে টাকা পয়সা আগেই দিয়ে দিয়েছিলেন? কমলা বলল, জানিনে। আগে পরে কোনও ব্যাপারই নয় আমার বাবার কাছে। সাতপাকে যখন ঘোরা হয়ে গেল অগ্নিসাক্ষী করে, বাবার কাছে বিয়ে পাকা হয়ে গেল তার মেয়ের। তা হলে আমার বোনের বিয়েটা ওখানে হয়ে গিয়েছে বোধ হয়। কমলা বলল, হয়েছে। কোথায় হয়েছে তা জানিনে। কোথা থেকে একটা বিয়ের চিঠি এসেছিল আমাদের বাড়িতে। কিন্তু আমার তখন গুরুদশা। কমলা থামল। বিকাশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কে আগে? কমলা বলল, বাবা। আবার কিছুক্ষণ পরে বিকাশ বলল, আমাদের ওখান থেকে তোমাকে কেউ কখনও নিতে আসেনি? তোমার বাবা এসেছিলেন। আমি যাইনি। বিকাশ বলল, তোমার গহনাগুলো বেঁচে গিয়েছে। আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বিকাশ বলল, যাই হোক, এ বাড়িটার সঙ্গে আমার কী বা এমন যোগ, কিন্তু কমলা, ঐ সামান্য সময়ের ঘটনাগুলোর প্রতিটি খুঁটিনাটি আমার বারো বছরের বীভৎস জেল জীবনে আমার চোখে বার বার ফুটে উঠেছে। 

বিকাশের বুকটা, কমলা দেখল, হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে। কমলা ভয় পেয়ে গেল। বলল, এখন আর কোনও কথা-টথা নয়। অনেক কাজ পড়ে আছে আমার। এখন রাঁধতে হবে। তোমার থাকার জন্য একটা ঘর ঠিক করতে হবে। তুমি কি রাত্তিরে চান করবে? চান। বিকাশ যেন কথাটা বুঝতে পারেনি। কমলা বলল, যদি গরম জলে চান করতে চাও, গরম জল দিতে পারি। অনেক দিন চান করিনি কমলা। চান করার যে আরাম তা তো ভুলেই গিয়েছি। চান? কিছুক্ষণ কী ভেবে নিল বিকাশ। তারপর বলল, না কমলা, চান না। থাক। কিছু অসুবিধে আছে। তাই চান আর করিনে। কমলা বিকাশের দিকে চেয়ে আছে দেখে বুঝে নিল কমলা অসুবিধার কারণটা জানতে চাইছে। একটা কৈফিয়ত দেওয়া বিকাশের দরকার। কিন্তু কী বলবে বিকাশ? কী করে বোঝাবে, বিশেষত একটা মেয়েকে, কোথায় তার অসুবিধা। না না, অমনভাবে নিজেকে নগ্ন করে দেখাতে পারবে না। বিকাশ চুপ করে ভাবতে লাগল। 

ঝপ করে আলোটা নিভে গেল। গাড়িটা একেবারে ডেড স্টপ। অন্ধকারে লোকটা এসে তার জায়গায় বসল। এইবারই ষোলকলা পূর্ণ হল। একে অন্ধকার। তারপর একটা লোক নেই এই কামরায়। আমি এদিক থেকে ওদিক দেখে এলাম। শুধু আমরা দুজন 1 নিন, সারা কামরা জুড়ে বসুন। লোকটার হাসির শব্দ শোনা গেল। অন্ধকারে লোকটাকে বেশ যণ্ডা-গুণ্ডা দেখাচ্ছে। জলের ছাটে কামরা ভিজে যাচ্ছে। পায়ের তলা ভিজে উঠল কমলার। সে বেনচির উপর পা তুলে কিছুক্ষণ বসে রইল। এই লোকটার সামনে নিজের বেনচিতে পা ছড়িয়ে দিতে একটু ইতস্তত করছিল কমলা। লোকটা তার দুটো পা কমলার বেনচিতে চাপিয়ে দিয়ে বসে আছে। আরাম করে বসুন, আরাম করে বসুন। এই বেনচিতে পা ছড়িয়ে দিন। দিন না। বলেই খপ করে কমলার দুটো পা টেনে নিয়ে লোকটা একেবারে ওর পাশে রেখে দিল। তারপর বলল, ঝিঁঝিটা ছাড়িয়ে নিন। এতক্ষণ এক জায়গায় বসে থাকলে পা দুটো যে ভেরে যাবে। হঠাৎ কমলার শরীরটা গরম হয়ে উঠল। ভেতরে ঘাম দিতে শুরু করল। বেশ ঘামছে কমলা। বাবার ঘরে অনেক দিন কারও হাত পড়েনি। পরিষ্কার-ঝরিষ্কার করা। খাটে একটা পুরনো তোষক নীচে থেকে টেনে এনে পেতে দিল। বাবার আলমারি খুলে একটা পানজাবি বের করল। একটা লুঙ্গিও পেয়ে গেল। একটা অয়েল ক্লথ বের করে আনল ভাঁড়ার ঘর থেকে, বাবার জন্য আনা বেডপ্যানটা নিয়ে গেল উপরে। সব গোছগাছ করে বিকাশকে গা মুছিয়ে, খাইয়ে, টেনে হিঁচড়ে কোনও রকমে যখন দোতলায় নিয়ে ফেলল, তখন সারাদিনের ধকলে কমলা আর দাঁড়াতে পারছে না। কোনও মতে চানটা সেরে ফেলে সে গিয়ে শুয়ে পড়ল। 

কমলার বিকাশের মুখটাই মনে পড়ল। মুখটা শান্ত নিথর। কোনও ভাব খেলে না তাতে। বিকাশ কথা বলে একটা মাত্রা-বাঁধা স্বরে। তার আর উঁচু নিচু হয় না কখনও। কোনও কিছু যখন চায় বিকাশ তার ভিতরে কোনও দাবি থাকে না যেমন তেমনি আবার প্রার্থীর ভাবও থাকে না সে চাওয়ায়। সহজ সরল একটা বিবৃতি মাত্র। সুখের কথা যখন বলে তখনও এই ভাব, আবার চরম দুঃখ লাঞ্ছনার কথা যখন বলে তখনও সেই একই ভাব। আমাকে ওরা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল কমলা। পারেনি। আসলে আমার বিরুদ্ধে যে খুব গুরুতর কোনও অভিযোগ ওদের কাছে ছিল, তা কিন্তু নয় কমলা। ছোটবেলা থেকেই আমি খুব ভিতু প্রকৃতির। রক্ত দেখলে আমার গা-বমি করে। এখনও করে। আমি কখনও চারু মজুমদারকে চোখে দেখিনি। কখনও কোনও অ্যাকশান স্কোয়াডে আমাকে কেউ নিয়ে যায়নি। তবে হ্যাঁ, আমি গণবিপ্লবে বিশ্বাস করতাম কমলা। এখনও করি। এসব অত্যাচার, শোষণ, জাল-জুয়াচুরি, ভণ্ডামি, এসবের অবসান হবে, এমন একটা পৃথিবী সৃষ্টি হবে কমলা, যেখানে মানুষ মানুষের বন্ধু হবে, মানুষকে মানুষ ভালবাসবে, মর্যাদা দেবে, কোনও অবিচারের শিকার কেউ থাকবে না, এ সবে আমি বিশ্বাস করতাম কমলা, আজও, হ্যাঁ, আজও করি। এই বিশ্বাসটাই আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল ওরা। পারেনি। আমার কাছে গোপন কিছুই ছিল না। ছিল কেবল কয়েকজন বন্ধুর নাম। তারা কী করত তাও আমি তেমন ভাল করে জানতাম না। এটা জানতাম ওরা আমার বন্ধু। ওরা সেই সব নাম আমার কাছ থেকে জানতে চেয়েছিল। আমি আমার হাত দিয়েছি, আমার হাতের আঙুলগুলো ওরা একটা একটা করে ভেঙেছে, আমার পা দিয়েছি, পায়ের আঙুলগুলো ওরা একটা একটা করে ছেঁচে ছিয়েছে মুগুর দিয়ে, আমি আমার গোটা শরীরটাই ওদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম, আমার শরীরের চামড়া চুরুটের ছ্যাঁকা দিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে একটু একটু করে। কিন্তু আমি আমার বন্ধুদের নাম ওদের কাছে তুলে দিইনি। আসলে ওরা বলাও ভুল কমলা। ওদের মধ্যে একজনই ছিল খুব গোঁয়ার। হয়তো এমনিতে তেমন গোঁয়ার নয়, নিতান্ত ছাপোষা মানুষই, কিন্তু আমাকে ভাঙবার জন্য তার কেমন গোঁ চেপে গিয়েছিল। তাও হতে পারে। তুমিও তো আমার মুখ সেদিন দেখতে চাওনি। তোমার গোঁ চেপে গিয়েছিল। আমিও তো কিছু বলিনি। আমার গোঁ চেপে গিয়েছিল। তেমনই হয়তো ওর ব্যাপারটা। আসলে মানুষের দুনিয়াটাই হয়তো এমনি কমলা। কে যে কখন কী করে ফেলে হদিস পাওয়া যায় না। আমি ভাঙব না, ভাঙলে আমি আর আমি থাকব না। ঘাস হয়ে যাব। এই ভয়টাকে কাটাবার জন্যেই না আমাদের ঘাড়ে গোঁ চেপে বসে। অন্যের কথা ভাল জানিনে। আমি জানি আমি ভিতু। তাই আমি সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি, যেন ঘাস হয়ে না যাই। ঘাস হয়তো হইনি। কিন্তু দেখছ তো, পুরো মানুষও আর নেই! আমার আবার এমনি ভাগ্য কমলা যে শহিদও হতে পারিনি। একেবারে পঙ্গু হয়ে বেঁচেই থাকলাম। 

বড্ড শীত করছে, না? লোকটার কথায় সে যেন ঘুম ভেঙে জেগে উঠল। সত্যিই কমলার বেজায় শীত করছে। শরীরে কাঁপুনি ধরে গিয়েছে। জানেন, আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম দরজা দুটো বন্ধ করে দিতে। এত টানাটানি করলাম। কিন্তু একচুলও নড়াতে পারলাম না। একেবারে জাম হয়ে রয়েছে। শীত করছে তো? অনিন্দ্য হাসছে। শীত, হ্যাঁ, শীত করছে বই কী কমলার, কিন্তু সত্যি বলতে কি, তার চাইতেও বেশি করছে ভয়। অনিন্দ্য তাকে টেনে একেবারে বুক জল পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছে। কমলা বারে বারে বলে যাচ্ছে অনিন্দ্য দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু, বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু। চলো, চলো এখন ফিরে যাই। অনিন্দ্য হঠাৎ যেন একটা ঢেউয়ের মাথায় চড়ে ওকে এসে জড়িয়ে ধরল। তারপর দুজনেই তলিয়ে গেল জলের তলায়। কিছুক্ষণ বাদেই দুজনে আবার ভেসে উঠল ভুস করে। কমলা হাসতে হাসতে বলল, শুশুক কোথাকার। অনিন্দ্য বলে উঠল, উঃ কী ভিতু মেয়ে রে বাবা, একেবারে খামচে রক্ত বার করে দিয়েছে। কমলা বলল, কোথায় রক্ত, দেখি? মিছিমিছি বাজে কথা। বাজে কথা? অনিন্দ্য তার ঘাড়ের কাছটা এগিয়ে এনে দেখাল। সত্যিই সেখান দিয়ে রক্ত চোঁয়াচ্ছে। কমলা অপ্রস্তুত হল। কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ও কি আমি করেছি নাকি? অনিন্দ্য ওর হাতটা চেপে ধরে টান দিল। না হাঙরে কামড়েছে। আরেকটা ঢেউ আসতেই কমলার হাত চেপে ধরে সে আরেকটা লম্বা ডুব দিল। তারপর ভেসে উঠে কমলা দম ছাড়তে না ছাড়তেই অনিন্দ্য তার মুখটা দু’হাতের তেলোর মধ্যে তুলে ধরে একটা ছোট্ট চুমু খেয়ে দিয়েছিল। কমলা এক ধাক্কায় ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল অনিন্দ্যকে। রেগে তক্ষুনি ভিজে কাপড়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। ভয়ে কাঁপছিল কমলা। বাবা মা তখনও জগন্নাথের মন্দির থেকে ফেরেননি। খুব একটা স্বস্তি বোধ করল কমলা। সে কলঘরে ঢুকে পড়ে দরজা এঁটে দিল। মুখটা আয়নার সামনে বার বার টেনে এনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিশ্চিন্ত হল কমলা। না কোথাও অস্বাভাবিক কিছু নেই। অনিন্দ্য একটা ডাকাত। কেন এত রেগে উঠেছিল কমলা? অত ভয়ই বা পেয়েছিল কেন? তার জীবনে সেটা প্রথম চুমু বলে? 

লোকটা এবার কমলার পাশে এসে বসল। বড্ড শীত ওখানে। বলে কমলার গায়ে ঠেস দিল। কমলা বলল, এখানেও শীত। লোকটা বলল, কিন্তু এখন অনেক কম। বলেই কমলার মুখে চুমু খাবার চেষ্টা করল। ও কী করছেন। বলে কমলা একলাফে লোকটাকে ডিঙিয়ে এধারে এসে পড়ল। কামরাটা ছাড়িয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। ট্রেনটা তখন বেশ জোরে ছুটছে। দরজার রডটাকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে সে নিজেকে সামলে নিতে চাইল। লোকটা যা বলেছে তা সত্যি। গোটা কামরায় ওরা দুজন ছাড়া আর একটা লোক নেই। এবার কমলা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল। 

কমলা এ দরজায় দাঁড়িয়ে থাকাটাকে বিশেষ নিরাপদ মনে করল না। সে দ্রুত পায়ে পিছনের দরজায় চলে গেল। যেতে যেতে দেখল সমস্ত গাড়িটা জলে ভেসে যাচ্ছে। বাইরে থেকে বৃষ্টির ছাঁটের সঙ্গে গল গল করে জল ঢুকছে। হাওয়া এমনই এলোমেলো যে কখনও এদিক দিয়ে জল ঢুকছে, কখনও আবার ওদিক থেকে। কাজেই দরজার সামনে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই কমলার কাপড় শপশপে হয়ে উঠল। কমলা পিছিয়ে এল। এবার সত্যিই ঠক ঠক করে কাঁপতে শুরু করল কমলা। এমন কাঁপুনি যে সে তাড়াতাড়ি গিয়ে এদিকের কামরায় ঢুকে পড়ল। দুদিকের দুটো জানলা, একটাও বন্ধ নয়। কাজেই দুদিক দিয়েই সমানে জল ঢুকছে ভিতরে। আর হু হু হাওয়া। কমলা খোলা দুটো জানলা থেকে যতটা দূরত্ব রেখে বসা যায়, বসল। বৃষ্টির ছাঁটে গোটা বেনচিটাই ভিজে গিয়েছে। সে চেয়ে দেখল, লোকটাকে দেখা যাচ্ছে না। ওদিকের কামরাটাতেই বসে আছে। পরের স্টেশনেই নেমে যেতে হবে তাকে। এমন একটা কামরায় গিয়ে তাকে উঠতে হবে যেখানে লোক আছে। দুদিকেই চেয়ে দেখল, অন্ধকার। কিছু দেখা যায় না। পাশের কামরায় যদি কেউ থাকে? ভাবল চেঁচিয়ে ডাকবে কি না? কমলা চেঁচাতে গিয়েও চেঁচাল না। তার বদলে বগিটার দেওয়ালে দুম দুম করে কিল মারতে শুরু করল। তারপর কান পেতে শুনতে চেষ্টা করল ওদিক থেকে কোনও সাড়া পাওয়া যায় কি না। কিন্তু কমলা বৃষ্টির ঝাপটের শব্দ ছাড়া আর কিছু শুনতে পেল না। কমলার মনে হল তার তেষ্টা পেয়েছে। গলা বারে বারে শুকিয়ে উঠছে। লোকটা বেরোয়নি তার কামরা ছেড়ে। সেদিকেই চেয়ে আছে কমলা। একদিকে একটা অবসন্নতা আর একদিকে একটা উদ্বেগ কমলাকে ক্লিষ্ট করে তুলল। লোকটা তাকে যদি আক্রমণ করে, কীভাবে তাকে ঠেকাবে কমলা? তুমি অমন করে রেগে গেলে কেন কমলা? তুমি বড় অসভ্য অনিন্দ্য। কমলা ঠিক করে ফেলল, লোকটাকে এগিয়ে আসতে দেখলেই সে বাইরে ঝাঁপ মারবে। তোমার কি খারাপ লেগেছিল কমলা? চট করে একবার দরজার কাছে এগিয়ে গিয়েই পিছিয়ে এল কমলা। ভীষণ জোরে গাড়িটা ছুটছে। বৃষ্টির ছাঁট ছুঁচের মতো এসে বিঁধল কমলার চোখেমুখে। আর কী ভীষণ অন্ধকার। আমি কি খারাপ কিছু করেছি? কমলা এ কথার উত্তর দিল না। কিন্তু সত্যিই তো তার খারাপ লাগেনি ব্যাপারটা। ঠিকই, কমলা সেদিন প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কেন এত ভয় পেল সে এখন আর ঠিক বলতে পারে না। কিন্তু আয়নায় মুখ দেখে যখন নিশ্চিত্ত হল যে সেখানে কোনও দাগটাগ নেই, তখনই কিন্তু তার ভয়টা চলে গিয়েছিল। কমলা সতর্কভাবে কামরায় এসে বসল। তার চোখ দুটো মেলে রইল সামনের দিকে। ট্রেনের গতি কি কিছু কমছে? স্টেশন? বলো কমলা, তুমি কি কিছুর ভয় পেয়ে গিয়েছিলে? কেন এত ভয় পেল সে এখন আর ঠিক বলতে পারে না। কিন্তু আয়নায় মুখ দেখে যখন নিশ্চিন্ত হল যে সেখানে কোনও দাগটাগ নেই, তখনই কিন্তু তার ভয়টা চলে গিয়েছিল। কমলা সতর্কভাবে কামরায় এসে বসল। তার চোখ এক জায়গায় অনেকক্ষণ থেমে ছিল। সেটা কি কোনও স্টেশনে? আদি সপ্তগ্রামে? সতর্ক হওয়া উচিত ছিল কমলার। যখন দেখল গাড়িটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছে, তখনই সতর্ক হতে পারত সে। নেমে যেতে পারত এই কামরা থেকে। অন্য কামরায় গিয়ে উঠে পড়তে পারত। ব্যান্ডেলেই তো সব চাইতে ভাল সুযোগ পেয়েছিল কমলা। কখনও বিকাশ কখনও অনিন্দ্য আজ তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তা ছাড়া সত্যি বলতে কি, এই লোকটাকে সে বুঝতে পারেনি। কম দিন তো আর ডেলি প্যাসেনজারি করছে না কমলা। লোকটা এখনও তার জায়গায় চুপ করে বসে আছে। তাকে এখান থেকে একটুও দেখতে পাচ্ছে না কমলা। তার সঙ্গে অসভ্যতা করার জন্য লজ্জা পেয়েছে? না, ট্রেন তো থামল না। আবার স্পিড তুলেছে। একটা স্টেশন থেকে আরেকটা স্টেশনে যেতে কত সময় লাগে ট্রেনের? লোকটাকে দেখা যাচ্ছে না বলেই কমলার উদ্বেগ বেড়েই চলেছে। লোকটা যা শুরু করেছিল তাতে সে তার মতলব প্রকাশ করে ফেলেছে। এ সব ব্যাপার টের পেতে মেয়েদের বিশেষ দেরি হয় না। লোকটা যদি আবার আসে, যদি কেন, আসবেই, ধীরে ধীরে কমলা বুঝতে পারছে, লোকটা আজ কমলাকে ছাড়বে না। এখন কত রাত? ঘড়ি দেখতে ভরসা পেল না কমলা। কমলার ঘড়িটা দামি ঘড়ি। বিয়ের সময় কিনে দিয়েছিলেন ওর বাবা। তার বাবা, যিনি কিনা তাঁর মেয়েকে প্রাণের চাইতে ভালবাসতেন। সেই বাবাই অন্য জাতের ঘরে মেয়ে পড়বে বলে অনিন্দ্যর সঙ্গে তার বিয়ে দিলেন না। এ কথা জেনেও, যে তাঁর মেয়ে, কমলা, অনিন্দ্যকে ভালবাসে, অনিন্দ্যর সঙ্গে বিয়ে হলে কমলা সুখী হবে। মা বাবাকে এ কথা জানিয়েছিলেন এবং জানিয়ে ধমক খেয়েছিলেন। অনিন্দ্য নিজে তাঁর বাবার কাছে এসেছিল। বাবাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিল। বাবা অনিন্দ্যকে তো চিনতেন, জানতেন। ভালও তো বাসতেন। তবুও সেদিন কী বিশ্রীভাবেই না তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন তার বাবা। অনিন্দ্যর সঙ্গে সেদিন কেন বেরিয়ে গেল না কমলা তাদের বাড়ি ছেড়ে? কেমন তার ভালবাসা? তার বাবার ভালবাসাই বা কেমন? তার বাবার দেওয়া এই ঘড়ি, তার কাছে এখন যা টাকাকড়ি আছে, এ সব দিয়ে কি লোকটার হাত থেকে কমলা আজ রেহাই পাবে না? না কি সে ঝাঁপ দেবে ট্রেন থেকে? মা-ই প্রথম কথাটা বলেছিল। যখন অনেক খোঁজ-খবর করেও বিকাশের কোনও পাত্তা পাওয়া গেল না, বাবা মারা গেলেন, মার শরীরটাও ভেঙে আসতে লাগল তাড়াতাড়ি, তখন হঠাৎ একদিন মা বলে উঠল, কেন তুই অনিন্দ্যর সঙ্গে চলে গেলিনে হতভাগি? অবাক হয়ে সেদিন কমলা তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে চেয়েছিল। মা নিঃশব্দে কেঁদে চলেছেন। মা তখন বারবার অসুখে পড়ছেন। বোধ হয় বুঝতে পারছিলেন তাঁর চলে যাবার দিন ঘনিয়ে এসেছে। তোর বাবা তোর সঙ্গে এত বড় শত্রুতাটা করে গেল আর তুইও সেটা মেনে নিলি? কেন মেনে নিলি? কেন? এখন তোর উপায় কী হবে? কে দেখবে তোকে? আমি চোখ বুজলে এই বাড়ি ঘর জমি-জমা সব তুই বেচে দিয়ে তোর যেখানে খুশি চলে যাস। তোর যেমন ইচ্ছে তুই সেইভাবে থাকিস। আমি বলে গেলাম। তোর পাপ হবে না। তোর পাপ হবে না। এই কথা মা কেন বলেছিলেন, কী বোঝাতে চেয়েছিলেন, কমলা আজও তার কোনও মানে খুঁজে পায়নি। 

কমলা তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। লোকটা অনেকখানি এগিয়ে এসেছে। সে দরজার দিকে দৌড় দিতে গেল। কিন্তু লোকটা মাঝপথেই তাকে সাপটে ধরে ফেলল। বলল, পাগল হয়েছেন নাকি? এমন চলন্ত গাড়ি থেকে কি কেউ লাফ দেয়? কেটে টুকরো টুকরো হয়ে যাবেন যে। কমলা ভিতরে ভিতরে থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছে। তা সত্ত্বেও যথাসম্ভব শান্তভাবে বলল, আমাকে ছেড়ে দিন। লোকটা ততক্ষণে তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়েছে। যেদিকে সে আগে বসেছিল সেখানে কমলাকে নিয়ে যেতে যেতে বলল, ভিজে যে একশা হয়ে গিয়েছেন। নিউমোনিয়া হবে যে। ওখানটা অনেক শুকনো। লোকটা যখন তাকে বেনচিতে শুইয়ে দিচ্ছে তখন কমলা টের পেল ট্রেনটা একটা স্টেশনে ঢুকছে। কমলা লোকটার দিকে চাইতেই সে একটু হেসে বলল, আদি সপ্তগ্রাম। আপনার খন্যেনের এখনও দেরি আছে। কোনও রকম বোকামি করে লাভ হবে না। চুপ করে শুয়ে থাকুন। লোকটার চোখ দুটো অস্বাভাবিকভাবে জ্বলছে। ট্রেনটা থামতে না থামতেই ভোঁ-ও-ও করে সিটি মেরে তক্ষুনি ছেড়ে দিল। কেউই উঠল না তাদের কামরায়। কমলা চেঁচাল না, কোনও রকম উত্তেজনা দেখাল না। শুয়ে শুয়েই বলল, আমার কাছে কিছু টাকা আছে। আর এই ঘড়িটা আছে। বিলাতি ঘড়ি। আর কিছু নেই। লোকটা কমলার কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল। বলল, আমাকে কি আপনি ছিনতাইবাজ মনে করেছেন? ও সবে আমার কোনও দরকার নেই। আপনাকেও কোনও দরকার হত না। এতক্ষণ ধরে একা একা সেই লড়াইটাই করছিলাম। কিন্তু পারলাম না। লোকটা কাত হয়ে ঝুঁকে পড়ে কমলাকে চুমু খাবার চেষ্টা করল। লোকটা খপ করে কমলার একটা হাত টেনে নিয়ে তার বুকে চেপে ধরল। দেখুন দেখুন, এখানে কী হচ্ছে। লোকটার বুক ধড়াস ধড়াস করে লাফিয়ে উঠছে, কমলা সেটা টের পেল। লোকটা বলল, এক সময় মনে হয়েছিল, ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ি। কিন্তু তা হয় না। পারা যায় না। না, উপায় নেই। লোকটা এবার সমস্ত শরীরের ভার দিয়ে কমলাকে চেপে ধরল। না না না। 

.

এখন কমলা শুয়ে আছে। নিথর। আলুথালু। লোকটাকে ঠেকাতে পারেনি সে। প্রথম দিকে তার শরীরটা ভয়ে শিটিয়ে ছিল। এমনিভাবেই সে কিছুক্ষণ প্রতিরোধ করেছিল। যতক্ষণ পেরেছে কমলা, প্রতিরোধ করে গিয়েছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত তার উপোসী শরীরটা যখন তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল, লোকটার জবরদস্তিতে ধীরে ধীরে সাড়া দিতে লাগল, তখন, এমন যে কখনও হতে পারে, এটা দেখে কমলা বিমূঢ় হয়ে গেল। সে চোখ বুজে শুয়ে শুয়েই টের পেল লোকটা তার আলুথালু জামা কাপড় ঠিকঠাক করে দিল, তার চুলেও একবার হাত বুলিয়ে দিল। হঠাৎ ট্রেনের গতি কমছে দেখে সে চোখ মেলল। লোকটা সামনের বেনচে বসে আছে। শান্ত। বলল, ত্যালাণ্ডু। আপনার স্টেশন পরে। লোকটা একটা সিগারেট ধরাবার চেষ্টা করছিল। পারল না। জানলা দিয়ে ভিজে সিগারেটকে বাইরে ছুড়ে দিয়ে লোকটা বলল, আপনি কে তা জানিনে। জীবনে হয়তো আর দেখাও হবে না। কমলার চুলে বিলি কাটতে লাগল লোকটা। কমলার ঘুম আসছে। আবার কি কিছু করবে লোকটা? কমলার ক্লান্ত মনে কথাটা একবার ভেসে উঠল। সে এখন ঘুমোতে চায়। লোকটা ঝুঁকে পড়ে প্রায় ফিসফিস করে কমলাকে বলতে লাগল, এমনটা যে হবে, এমন কোনও মতলব আমার মনে ভাঁজা ছিল না। তবু দেখুন, কী ঘটে গেল। আমাকে আপনার পক্ষে যা মনে করা সম্ভব, বাস্তবে প্রমাণিত যে আমি তা-ই। অন্য কিছু আপনি বিশ্বাসও করবেন না। লোকটা চুপ করল। সে থেমে থেমেই কথাগুলো বলছে। লোকটা কি আশা করছে কমলা কিছু জবাব দেবে? বিশ্বাস করার দরকারও নেই আমাকে। শুধু আমি আপনাকে এই কথাটা বোঝাতে চাই যে এই ঘটনা যে ঘটবে, আগে থেকে সেটা ছকা ছিল না। আমি এই গাড়িতেই উঠব, আপনার পাশের সিটে বসব। গাড়িটা এতটা লেট করবে। এমন বৃষ্টি পড়বে অবিশ্রান্ত। কামরাটা খালি হয়ে যাবে একেবারে। কেউই আর উঠবে না এই কামরায়। এই এতগুলো যোগাযোগ, এর একটাও আমি তৈরি করিনি। লোকটা বাইরের দিকে চাইল। এই ফাঁকা কামরায় বসে একনাগাড়ে পথ চলতে চলতে আপনার মনে হয়নি আমরা দুজন এই পৃথিবীতে একা? একেবারে একা। আমারও কেউ নেই, আপনারও কেউ নেই। দুটো নিঃসঙ্গ লোক দুটো অপরিচিত গ্রহ থেকে নেমে এসে এই ট্রেনে পাশাপাশি চলেছে। ওরা দুজন। একই বেনচিতে। কিন্তু কেউ কারও সঙ্গী নয়। আসলে আমি সঙ্গী পেতে চেয়েছিলাম। গায়ে গা ঠেকিয়ে আপনার শরীর থেকে কিছু উষ্ণতা শুষে নিতে চেয়েছিলাম। এতটা যে এগুব এটা ভাবিনি। আপনি চট করে আমার পাশ থেকে অমন করে উঠে না গেলে, হয়তো এই ভাবনাটা আমার মাথায় আসত না। কিংবা এইটেই হয়তো শেষ পর্যন্ত ঘটত। পকেট থেকে আবার একটা সিগারেট বের করে নিয়ে লোকটা কয়েকবারের চেষ্টায় সেটা ধরিয়ে ফেলল। আপন মনে সিগারেট খেল কিছুক্ষণ। এবার তৈরি হন, খন্যেন আসছে। কমলা ধড়মড় করে উঠে পড়ল। লোকটা হাসল। গাড়ির অল্প আলোয় হাসিটাকে ম্লান দেখল কমলা। অনেকদিন নিঃসঙ্গ থাকলে মানুষ কি এমনই হয়ে ওঠে? এমন ক্ষুধার্ত? এমন খ্যাপা? কমলা বুঝতে পারল না, এই প্রশ্নটা লোকটা কাকে করল, কমলাকে না নিজেকে? গাড়ির গতি কমে আসতে লাগল। কমলার ব্যাগটা বেনচের নীচে পড়ে ছিল। লোকটা নিচু হয়ে সেটা তুলে কমলার হাতে দিল। একটু ঠাট্টাও করল, দেখুন, টাকা কিছু খোয়া গিয়েছে কি না। ঘড়িটা তো এখনও হাতে আছে দেখছি। প্ল্যাটফরম আসার আগের মুহূর্তে লোকটা কমলাকে হাত ধরে কাছে টেনে আনল। আস্তে করে কমলার শরীরটাকে তার দিকে ঘুরিয়ে দিল। তারপর কমলার মুখে গাঢ়ভাবে একটা চুমু খেল। কমলা বাধা দিল না। সে এখন নির্বিকার। ট্রেন থামল। লোকটা কমলার হাত ধরে যত্ন করে তাকে প্ল্যাটফরমে নামিয়ে দিল। ট্রেনের কামরায় গিয়ে উঠে পড়ল লোকটা। ট্রেন ছাড়ল। সেই নিস্তব্ধ প্ল্যাটফরমে সেই তুমুল বৃষ্টির মধ্যে একা দাঁড়িয়ে রইল কমলা। ট্রেনটা চলে যাবার পর ঘন অন্ধকারে সমস্ত স্টেশনটা মুহূর্তের মধ্যেই ডুবে গেল। কোনও দিকেই কিছু দেখা যায় না। সে ভিজতে লাগল। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগল। অনেকক্ষণ ভেজার পর, হাত পা যখন কালিয়ে এসেছে, তখন কমলার মনে পড়ল তাকে বাড়ি ফিরতে হবে। এবং সেটা এমনিতেই শুকনোর দিনে মিনিট দশেকের রাস্তা, আজ তার এই ভিজে এবং ভারী শরীরটা টেনে নিয়ে বাড়ি পৌঁছুতে কত সময় লাগবে কে জানে! কোনও রিকশাই যে এই তুমুল বৃষ্টিতে তার জন্য অপেক্ষা করে নেই, কমলা তা জানে! তবুও সে প্রথমে রিকশার স্ট্যান্ডেই এল। ফাঁকা। নদীর মতো স্রোত বইছে। রাস্তায় জল থৈ থৈ। কমলা এক পা এক পা করে সন্তর্পণে চলতে লাগল। 

বাড়ি যে পৌঁছতে পারবে, মাঝরাস্তা পর্যন্ত আসবার পর, সে আশা হারিয়ে ফেলেছিল কমলা। জল ভেঙে চলতে গিয়ে পায়ের তলায় খোয়া এত বিধছে যে প্রতি মুহূর্তে পা বাড়াতে তার মনে হচ্ছিল সে এই বুঝি মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে। পরিচিত কুকুরের খেউ খেউ শুনে কমলা ভরসা পেল যে সে বাড়ির কাছে এসে পৌঁছেছে। কমলা সদরের তালা খুলে ভিতরে ঢুকে, যথারীতি খিল তুলে, তালা মেরে বন্ধ করে দিল। তারপর বারান্দায় তার হাতে যা কিছু ছিল সে সব ছুড়ে ফেলে চানের ঘরে ঢুকে গেল। তারপর কবাটটা ভেজিয়ে দিয়ে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল সেই ভিজে শানের মেঝেয়। এই নিতান্ত চেনা এবং অত্যন্ত নিরাপদ পরিবেশে এসে কমলা আর পারল না। একটা হাউ হাউ কান্না তার বুক চিরে বেরিয়ে এল। তার শরীরের সমস্ত গ্লানি জল হয়ে তার দুচোখের পথ বেয়ে অবিরল বেরিয়ে আসতে লাগল। কমলা বুঝতে পারল এটা তার প্রতিবাদ, এটা তার আত্মসমর্পণ। অনেকক্ষণ ধরে কাঁদল কমলা। হঠাৎ তাদের দেওয়াল ঘড়িটা শব্দ করে সময় জানাতে শুরু করল। চমকে উঠে সময় গুনতে লাগল কমলা। উৎকর্ণ হয়ে। এগারোটা। কমলা বিস্মিত হল। এগারোটা। কমলা উঠে বসল। তারপর তার জামা কাপড় সব খুলে ফেলল। যদিও শীত করছে তার, তবু সে দাঁড়িয়ে উঠে চৌবাচ্চা থেকে মগের পর মগ জল নিয়ে পাগলের মতো ঢেলে যেতে লাগল তার আদুড় গায়ে। হাতড়ে হাতড়ে সাবানটা খুঁজে নিল। সারা গায়ে ঘষতে লাগল। অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে সেই শীতের মধ্যেও কমলা অনেকটা হাল্কা বোধ করল। পা দিয়ে জামা কাপড় এক কোনায় ঠেলে দিয়ে সে দৌড়ে উঠোন পেরিয়ে তার ঘরের দরজা খুলে ঢুকে পড়ল ভিতরে। দরজা বন্ধ করে দিল। আলো জ্বালল। আলনা থেকে একটা কাপড় টেনে শরীরে জড়িয়ে নিল। তারপর শুকনো গামছা দিয়ে শরীরটা ঘষে ঘষে মুছতে লাগল। চুল মুছতে মুছতে কী মনে হল কমলার, আয়নাটার সামনে এক রাশ ভয় নিয়ে গিয়ে হাজির হল। খুঁটিয়ে খুটিয়ে মুখটা দেখে নিল কমলা। কোনও রকম দাগ সেখানে নেই। ধীরে ধীর সমস্ত শাড়িটাকে সে খুলে ফেলল। তার শরীরটাকে আগাগোড়া সে দেখে নিল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। একটা টানা দীর্ঘশ্বাস তার বুক ঠেলে বেরিয়ে এল। কমলা শাড়িটা পরে নিল। তারপর আলো নিভিয়ে গায়ের উপর একটা চাদর টেনে বিছানায় শরীরটাকে এলিয়ে দিল। সে বেজায় কাঁপতে লাগল। কিছুতেই কাঁপুনি থামছে না। তার হাড়ের ভিতর থেকে, তার মাংস মজ্জার ভিতর থেকে এই প্রবল কাঁপুনি দমকে দমকে উঠে আসছে। চাদরের উপর একটা কাঁথা টেনে দিয়েও কমলা কাঁপুনি থামাতে পারল না। অস্থির হয়ে অস্ফুট স্বরে সে একটানা ডেকে যেতে লাগল—মা মা মা। 

কমলার মাথা ভারী হয়ে আসছে। গলা শুকিয়ে আসছে। অন্ধকার ক্রমশ জমাট, ক্রমশ নিরেট হয়ে কমলাকে ঠেসে ধরতে লাগল। হঠাৎ কমলার মনে হতে লাগল সন্ধ্যার সেই গ্যালপিং ট্রেনটা তার যন্ত্রণাকাতর শরীরটাকে প্রবল বেগে ছিঁচড়ে ছিঁচড়ে টেনে নিয়ে চলেছে। কমলার সাধ্য নেই তাকে বাঁচায়। সে শক্তিও তার নেই। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *