কমলার আরেকটি সন্ধ্যা

কমলার আরেকটি সন্ধ্যা 

দুজনেই ট্রেন থেকে নামল। আগে আগে বিকাশকে নামার ব্যাপারে সাহায্য করতে যেত কমলা। বিকাশ একটা ক্রাচ আগে নামিয়ে পরে আরেকটা ক্রাচ নামিয়ে দিত। একটু পরেই সমস্ত শরীরটাকে দোলানি দিয়ে নেমে আসত ট্রেনের কামরা থেকে। প্রথম দিকে টাল সামলাতে একটু দেরি হত। সেই মুহূর্ত ক’টার জন্য কমলা সতর্ক হয়ে অপেক্ষা করত। এখন কমলাকে কাছে থাকতে দিতে চায় না বিকাশ। কমলা বুঝতে পারে কমলার উপর নির্ভরশীলতা কমাতে চাইছে বিকাশ। এতে কমলার তো খুশি হবারই কথা। কিন্তু সে এমন অসহায় বোধ করে কেন? 

মাঝে মাঝে সে বাড়িতে থাকতে আবার একই ট্রেনে তারা ফিয়ে 

আজ তিন মাস হয়ে গেল, ক্রাচ ধরেছে বিকাশ। চায় না। কমলার সঙ্গেই কলকাতায় চলে আসে। যায় বাড়ি। সুকুমারের মৃত্যুটা কেমন যেন বদলে দিয়েছে বিকাশকে। কিন্তু শুধু কি সুকুমারের মৃত্যুই তার এতটা বদলাবার কারণ? কমলার মনে আজকাল সন্দেহ হতে শুরু করেছে। আরও কিছু তার মনটাকে ভারী করে তুলেছে। কমলার মন সেদিন কিন্তু ব্যাপারটাকে এদিক দিয়ে কিছু ভেবে দেখেনি। সেদিনের কথাবার্তার টুকরোগুলো ক্রমশ যে কেন তার কাছে অন্য অর্থ নিয়ে হাজির হচ্ছে, কমলা কিছুতেই বুঝতে পারছে না। 

বিকাশ : না না কমলা, তুমি চিনতে পারোনি। 

কমলা : ও হচ্ছে সেই লোক। আমি কী করে ওকে ভুলব বিকাশ?

বিকাশ : তুমি নিঃসন্দেহ কমলা যে সে সুকুমার? 

কমলা : যে ছবিটা তুমি দেখালে বিকাশ, ও যদি সুকুমার হয়, তা হলে আমি নিঃসন্দেহ বিকাশ যে সেদিনের সেই লোকটাও সুকুমারই। 

বিকাশের পাশাপাশি হেঁটে চলেছে কমলা। বিকাশ এক মনে ওভারব্রিজের সিঁড়ি ভাঙতে লেগেছে। কমলা একবার বলেছিল, আমাদের তো তেমন তাড়া নেই বিকাশ। কষ্ট করে তোমার ওভারব্রিজে ওঠার দরকার কী? আমরা তো প্ল্যাটফরম দিয়েই নেমে যেতে পারি। এ সময় তো কোনও গাড়ি-টাড়ি আসে না। বিকাশ যে তার কথা পছন্দ করেনি সেটা তার চাউনি দেখেই টের পেয়েছিল কমলা। সে আর কোনও দিন এ ব্যাপারে বিকাশকে কিছু বলেনি। শুধু বিকাশ যখন সিঁড়ি ভেঙে উঠতে থাকে, কমলা একেবারে তার পিছনে পিছনে সদা প্রস্তুত হয়ে ওভারব্রিজে উঠতে থাকে। এখন তার কিছুটা হাঁফ ধরে। তবুও। বিকাশ একটা একটা সিঁড়ি খুব সন্তর্পণে উঠছে। তার পিছনে পিছনে কমলাও। 

বিকাশ : তোমার দেখার কোনও ভুল হয়নি তো কমলা? মানে তখন তো একটা অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে তুমি ছিলে। বিশেষ করে তোমার মানসিক অবস্থা। সেই সময় তো তোমার মনে একটা ভয়, উত্তেজনা, আতঙ্ক, বুঝতে পারছ আমি কী বলতে চাইছি! 

কমলা : পেরেছি বিকাশ। 

বিকাশ : মনের সে অবস্থায় কোনও মানুষকে অত অল্প সময়ের মধ্যে নিশ্চিতভাবে কি চেনা সম্ভব? তাকে মনে রাখা যায়? 

কমলা : বিকাশ, আমরা হাওড়া স্টেশন থেকে পাশাপাশি বসে আসছিলাম। তখন তো আমার মনের অবস্থা অস্বাভাবিক ছিল না? 

বিকাশ : তাও তো বটে। 

কমলা লক্ষ করেছিল বিকাশ যেন ক্রমশ‍ই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছিল। 

বিকাশ ধীরে ধীরে ওভারব্রিজের উপরে উঠল। এগিয়ে গেল রেলিংয়ের দিকে। এখন একটু জিরিয়ে নেবে বিকাশ। কমলাও জিরোবে কিছুক্ষণ। একটানা এতগুলো সিঁড়ি এক সঙ্গে ভাঙা আজকাল তার পক্ষেও কষ্ট হয়ে উঠছে। ওদের দুজনের মধ্যে সম্পর্ক এখন এমন জায়গায় এসে পড়েছে যে এ সমস্যাটা নিয়ে কোনও আলোচনা করারই সুযোগ পাচ্ছে না কমলা। সে বুঝতে পারে না সুকুমার তার উপর জবরদস্তি করেছে, এই ঘটনাটা বিকাশকে এত বিচলিত করে তুলেছে কেন? অথচ ঘটনা ঘটার পর সেদিন বিকাশকে যখন বলেছিল, তখন ভয় পেয়েছিল বিকাশ, তাঁর সম্পর্কে যথেষ্ট উদ্বেগ বোধ করেছিল, কিন্তু কমলার সঙ্গে তার সম্পর্ক তো শীতল হয়ে ওঠেনি। 

কমলা : লোকটার হাতে লেডিস রুমাল পাওয়া গিয়েছে। তুমি সেটা দেখেছ বিকাশ? 

বিকাশ : রুমালের কথা তুমি কী করে জানলে? 

কমলা : কাগজে রিপোর্ট করেছিল। তা ছাড়া বর্ধমানের ডেলি প্যাসেনজাররা তার পরদিন ওটা নিয়ে খুব আলোচনা করছিল। ওরা বলছিল, রায়দা নাকি নিজের চোখে দেখেছিলেন যে গুলি বিঁধে পড়ে থাকা লোকটার ডান হাতের মুঠোয় একটা লেডিস রুমাল ছিল। তুমি কি এটা জানও বিকাশ? 

বিকাশ : আমি রুমালটা দেখেছি। 

কমলা : (হঠাৎ উত্তেজিত) : তুমি দেখেছ সেই রুমাল? 

বিকাশ : হ্যাঁ কমলা, দেখেছি। সেটা পুলিশের হেফাজতে আছে। 

কমলা : থাক। তুমি রুমালটাকে মনে করতে পারছ? কী রকম রং তার? কী রকম সাইজ? তুমি ঐ রকম আরেকটা রুমাল দেখলে মনে করতে পারবে যে দুটো অবিকল এক রকম কি না? পারবে বিকাশ? 

বিকাশ : হয়তো পারব। হ্যাঁ পারব। কেন বলো তো? 

কমলা : পারবে? 

কমলা তক্ষুনি ছুটে গিয়ে নীচে থেকে একটা পাটকিলে রংয়ের রুমাল তার হাতব্যাগ থেকে এনে দেখিয়েছিল বিকাশকে। 

কমলা : এই রকম না রুমালটা? 

বিকাশ (অবাক হয়ে গিয়েছিল) : হ্যাঁ, এই রুমাল। এই রকমই একটা রুমাল সুকুমারের মুঠোয় ধরা ছিল। 

কমলা : সেটা আমার রুমাল, বিকাশ। সুকুমার কোনও এক সময় আমার ব্যাগ থেকে বের করে নিয়েছিল নিশ্চয়ই। আমি সেদিন ঐ রুমালটা নিয়েই বেরিয়েছিলাম। পরে আর খুঁজে পাইনি। ভেবেছিলাম ধস্তাধস্তিতে সেটা বোধহয় সেই কামরাতেই পড়ে গিয়েছে। 

বিকাশ তার সঙ্গে আজ একটা কথাও বলছে না। কী যেন ভাবছে গভীরভাবে। কমলা লক্ষ করেছে, বিকাশ দিনরাতই কোনও গভীর ভাবনা নিয়ে পড়ে থাকে আজকাল। বিকাশ চলতে আরম্ভ করল। কাঠের ওভারব্রিজে বিকাশের ক্রাচ ঠক ঠক শব্দ করতে করতে চলেছে। কমলা এইবার বিকাশের আগে আগে চলতে লাগল। সিঁড়ি দিয়ে বিকাশ যখন নামতে থাকে, কমলা তখন তার আগে আগে নামতে থাকে। কমলাকে এগিয়ে চলতে দেখে বিকাশ তার দিকে একবার শাস্ত চোখে তাকাল। তারপর নীচের দিকে সতর্ক নজর রেখে বিকাশ চলতে থাকল। বিকাশ যখন পথ চলে তখন তার দৃষ্টি থাকে ক্রাচের ডগায়। স্প্লিন্ট লাগিয়ে বিকাশ এখন পায়ের উপর কিছুটা ভর দিতে পারে। 

কমলা : কিন্তু সুকুমার আমার টাকাপয়সা নিল না। আমি ওকে সবই দিতে চেয়েছিলাম। সব টাকা। স্টেশনে আমাকে যত্ন করে নামিয়ে দিয়েছিল সুকুমার। তার আগে আমার হাতে আমার ব্যাগটা তুলে দিয়েছিল। তারপরে…তারপরে আমাকে ওর বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছিল। দীর্ঘ একটা চুমু খেয়েছিল বিকাশ। তারপরে আমাকে হাত ধরে ট্রেন থেকে নামিয়ে দিয়েছিল। যেন কতকালের চেনা। আমি এর মানে বুঝিনে। 

বিকাশ : চুপ করো কমলা। চুপ করো। এ কথা এখন থাক। 

তারপর থেকেই কমলা দেখেছে, বিকাশ কেমন যেন হয়ে যেতে লাগল। দিনরাত এখন ভাবে। কমলার মনে হয় দুজনের মধ্যে ধীরে ধীরে একটা পাঁচিল যেন কেমন করে উঠে পড়ল। বিকাশকে ডাঃ সরকারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল কমলা। কেন না সে বিকাশের একটা অস্থিরতা টের পাচ্ছিল। কিন্তু সপ্লিন্ট ক্রাচ পেতে যত দেরি হচ্ছিল, ততই… 

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে বিকাশের যত না অসুবিধা হয়, তার চাইতে ঢের অসুবিধা হয় সিঁড়ি ভেঙে নামতে। কমলাকেও তখন সতর্কতার মাত্রা বাড়িয়ে দিতে হয়। যেন সমস্ত ইন্দ্রিয়কেই সজাগ থাকতে সতর্ক করে দেয় কমলা। ওভারব্রিজের শেষ ধাপে এসে মাটিতে নামবার মুখেই বিকাশের একটা ক্রাচ নড়বড়ে একটা নুড়ির উপর পড়তেই ছিটকে তার হাত থেকে বেরিয়ে গেল। টাল খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল বিকাশ। কমলা ব্যস্ত হয়ে তাকে দু’হাতে জাপটে ধরে সামলাল। বিকাশ আর কমলা, দুজনের শরীরই তখন কাঁপছে। 

কী হল মশাই, বলে এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বিকাশের ক্রাচটা তার হাতে তুলে দিলেন। 

বুঝতেই তো পারছেন পঙ্গু লোকেদের জীবনযাপনের হ্যাজার্ড। ধন্যবাদ।

তারপর বিকাশ কমলাকে বলল, সরো কমলা। আমি নামি। 

আমি তোমাকে নামিয়ে দিচ্ছি। 

না। 

কমলা সরে দাঁড়াল। 

বিকাশ মাটিতে নেমে কমলার দিকে চেয়ে একটু শুকন হাসল। 

এ জগতের সীমানা তোমার নাগালের চাইতে আরও অনেক বড় কমলা। তোমার আঁচলের তলায় আর কত দিন ঢেকে রাখবে আমাকে? 

অতি সতর্কভাবে বিকাশ একটু একটু করে এগুতে লাগল। 

তুমি আমাকে একদিন নিষ্ঠুর বলেছিলে বিকাশ। কিন্তু তুমি যে তার চাইতে শত গুণে নিষ্ঠুর, তা তুমি বোধ হয় টের পাও না। 

আমাকে তোমার নিষ্ঠুর বলে মনে হয় কমলা? 

বিকাশ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কমলার মুখের দিকে সে কিছুক্ষণ চেয়ে দেখল। কেমন একটা আলগা লাবণ্য আর তার সঙ্গে সুগভীর ক্লান্তি কমলার মুখটা ছেয়ে আছে। কমলা কেমন অদ্ভুতভাবে হাসল তার দিকে চেয়ে। বিকাশের মনে হল, এটা কান্নাও হতে পারত। বাতাসে শরতের একটা টান এরই মধ্যে এসে গিয়েছে। 

কমলা স্টেশন গেটের দিকে চলতে আরম্ভ করল। বিকাশ তার পাশে পাশে।

আমাকে তোমার নিষ্ঠুর বলে মনে হয় কমলা? 

কমলা জবাব দিল না। 

কমলা! 

কমলা জবাব দিল না। চলতে থাকল। বেরোবার গেটের সামনে ওরা মাত্র দুজন। 

টিকিট কালেকটার ওদের দেখে হাসলেন। ওরা তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল।

তোমার টিকিটটা দিয়ে দাও বিকাশ। 

বিকাশ টিকিট বের করে কালেকটারের হাতে জমা দিল। 

ভদ্রলোক হেসে বললেন, এই ক’দিনের মধ্যে বেশ ভালই রপ্ত করে ফেলেছেন দেখছি। ট্রেনে চাপতে এখন আর অসুবিধে হয় না। না? 

ট্রেনে চাপতে আর অসুবিধা হয় না। তবে রিকশায় চাপতে এখনও গা শিরশির করে। 

আচ্ছা! কেন বলুন তো? 

টিকিট কালেকটার হাতের টিকিটগুলো গুছিয়ে নিতে লাগলেন। 

কোনও কারণ তেমন নেই। তবে কি জানেন, কোনও কোনও জিনিসের উপর মন ঢেলে আস্থা রাখা যায় না। মনে হয় ভর দিলেই স্লিপ করবে। 

ওরা দুজনে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল। ওদের পরিচিত রিকশাওয়ালাটা ওদের দেখে প্যাঁক মেরে এগিয়ে এল। 

ঝড়ু, আজ আর তোকে লাগবে না। যা তুই অন্য লোক ধরে নে। 

কমলা তার ব্যাগ খুলে তাকে একটা টাকা গুঁজে দিল। 

ঝড়ু জিজ্ঞেস করল, কাল সকালে? 

যেমন যাস যাবি। 

কমলা বিকাশের দিকে না তাকিয়েই হাঁটতে শুরু করে দিল। ঝড়ু প্যাঁক প্যাঁক করে শব্দ তুলে বেরিয়ে গেল। বিকাশ কিছুক্ষণ হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল। কমলার এ দুর্বোধ্য ব্যবহারের সে কোনও মানে খুঁজে পেল না। কমলা কোনও কারণে তার উপর বেজায় চটে গিয়েছে, এটা সে বুঝতে পারল। অন্য সময় হলে এ কথা বিকাশ কমলাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারত। কিন্তু এখন কেমন বাধো বাধো ঠেকল তার কাছে। তার মানে কমলা তার কাছ থেকে বেশ দূরে সরে গিয়েছে। আরও সরে যাচ্ছে কমলা। বিকাশ দেখল, কমলা অনেকটা এগিয়ে গিয়ে রিকশা স্ট্যান্ডটা ছাড়িয়ে তার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। মুখখানা তার গম্ভীর। দু’এক গাছি চুল হাল্কা বাতাসে এলমেলো উড়ছে। এইটুকু দূরত্ব থেকেই কমলাকে কেমন অন্য জগতের বাসিন্দা বলে মনে হচ্ছে। বিকাশ ক্রাচে ভর দিয়ে মুখ নিচু করে অতি সন্তর্পণে একটা একটা পা ফেলে ফেলে এগুতে লাগল। ওটা কমলারই রুমাল। খচ করে কথাটা বিকাশের মনে ঘা দিয়ে উঠল। অথচ ওটা পাওয়া গেল মৃত সুকুমারেরই হাতে। কমলাকে সেইদিন ফাঁকা কামরায় পেয়ে সুকুমার নিজেকে আর সংযত রাখতে পারেনি। সুকুমার কমলার কাছে সে কথা অকপটে স্বীকার করেছিল। অন্তত কমলার কাছে এটা সুকুমারের অকপট স্বীকারোক্তি বলেই মনে হয়ছিল। কিন্তু এটা কি বিশ্বাসযোগ্য ঘটনা? কেমন যেন মেনে নিতে পারে না বিকাশ। সত্যি বলতে কি, সুকুমারের মৃতদেহ মর্গে দেখে সে যে রকম আঘাত পেয়েছিল, গুরুতর আঘাত, কমলা যখন তাকে তার রুমালটা এনে দেখাল তখন তেমনি এক গুরুতর আঘাতে সে জর্জরিত হয়ে গিয়েছিল। বোধ হয় পরের আঘাতটা বেশি বেজেছিল তার বুকে। সুকুমার পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছে, এটা তার কাছে দারুণ এক শোকাবহ ঘটনা। কিন্তু বিকাশ ভেবে দেখেছে, এটা তার কাছে কোনও অপ্রত্যাশিত ব্যাপার নয়। এই রকম মৃত্যুই তো সুকুমারের পক্ষে স্বাভাবিক মৃত্যু। কিন্তু মৃত সুকুমার হাতের মুঠোয় কমলার রুমাল চেপে ধরে আছে, এর চাইতে অপ্রত্যাশিত, এর চাইতে আশ্চর্য ঘটনা আর কী হতে পারে? এর জন্য বিকাশের তো কোনও প্রস্তুতি ছিল না। ওরা কি একেবারেই কেউ কাউকে চিনত না? সুকুমারের মৃত্যুতে তা হলে কমলা কেন এত বিচলিত হয়ে উঠেছিল? যে রেপিস্ট, যে তাকে অসহায় পেয়ে তার সুযোগ নিয়েছে, তাকে রেপ করেছে, তার মৃত্যু ধর্ষিতা কমলাকে এত বিচলিত করে তুলবে? সেদিন কমলা যেভাবে ওর আর একটা রুমাল এনে বিকাশকে দেখাল, একেবারে জুড়ির রুমাল, একেবারে এক রকম, তাতে কি এই মনে হয় না যে সুকুমারই যে মরেছে সে সম্পর্কে কমলা একেবারে নিশ্চিত হতে চেয়েছিল। বিকাশ যখন জানাল যে হ্যাঁ, একই রুমাল, তখন অমন শূন্য হয়ে উঠল কেন কমলা? কেউ কাউকে চিনত না? এর আগে কখনওই দুজনার দেখা হয়নি? ট্রেনে? কোনও হাইড আউটে, এই বাড়িতে? এই অঙ্কটা কিছুতেই মেলাতে পারছে না বিকাশ। ফলে প্রচণ্ডভাবে ভুগছে এই জন্য। কমলা যে ধরনের মেয়ে, তাতে সে মিথ্যে কথা বলছে, বিকাশের মন কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারছে না। তাই এ প্রশ্নটা কিছুতেই সে তাকে করতে পারছে না। আবার কেন সে এই জটিল দুর্বোধ্য অঙ্কটাকে মেলাবার জন্য এমন গোঁ ধরে আছে, তাও তো সে বুঝতে পারছে না। সুকুমার এবং কমলা, দুজনেই তো ব্যক্তিহিসাবে সাবালক। তাদের যা খুশি তা-ই করার অধিকার আছে। তার মধ্যে বিকাশ মাথা গলাতে চাইছে কেন? কমলা তার জন্য এ পর্যন্ত যা যা করেছে, তার জন্যই তো বিকাশের কমলার কাছে সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কমলার যদি গোপন জীবন থাকে, কোন অধিকারে সে তা জানতে চাইবে? একদিন সে কমলাকে বিয়ে করেছিল বলে? কিন্তু সে অধিকারের কি কোনও মানে হয়? বিকাশের বোকামি সেটা, বিয়েটাই তো তার বোকামির একটা বড় নিদর্শন। কমলাকে সেই অধিকার মানতে হবে কেন? তারই বা সেটা মানার কী দরকার? তা হলে? তা হলে কী আর থাকে তার আর কমলার মধ্যে? 

কমলার কাছাকাছি এসে পড়ে তার একটা ভারী নিঃশ্বাস পড়ল। তারপর বিকাশ মনে মনে বলল, না, কিছুই থাকে না। কিছু নেইও। আজ সারা ট্রেন সে কমলার পাশাপাশি বসে যেটা ভাবতে ভাবতে এসেছে, বাড়ি গিয়ে সেটা কমলাকে বলে ফেলা দরকার। বলবে সে। 

তোমার কি চলতে অসুবিধে হচ্ছে বিকাশ? একটা রিকশা নেব? 

তুমি রিকশাটা ছেড়ে দিলে কেন কমলা? 

রিকশায় উঠতে তুমি স্বস্তি বোধ করো না, এটা তো আগে জানতাম না বিকাশ? এখন তো আর বৃষ্টি-বাদলাও নেই তেমন। তোমার যদি অসুবিধা না হয় তো রোজই আমরা এটুকু পথ হেঁটেই যাব। 

তুমি কি আমার উপর রাগ করেছ কমলা? 

রাগ? না। 

তা হলে? 

কী তা হলে? 

খরচ বাঁচাচ্ছ? 

হ্যাঁ, সেটা বরং বলতে পারো। 

আমি তোমার উপর খরচের মস্ত একটা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছি। 

কমলা মুখ ফিরিয়ে বিকাশকে একবার দেখল। তারপর হাঁটতে লাগল। 

আমি বুঝতে পারি, কমলা। 

কমলা এবারও কোনও কথা বলল না। 

ওরা দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। 

তুমি ওথেলো পড়েছ কমলা? 

ওথেলো, হ্যাঁ পড়েছি। ওটা আমাদের পাঠ্যও ছিল। 

নাটকটা দেখেছ কমলা? 

না। সিনেমায় দেখেছি। 

কবে? 

অনেকদিন আগে? ক্লাস পালিয়ে। সেই যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। কিন্তু এখন ওথেলোর কথা কেন? 

অনিন্দ্য নিয়ে গিয়েছিল? 

হ্যাঁ। কিন্তু এত জিনিস থাকতে ওথেলোর কথা কেন? 

কথাটা হঠাৎ মনে এল। আমরা কলেজে একবার ওথেলো নামিয়েছিলাম। বাংলায়। আমি ইয়াগো। 

দুজনে হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে ওরা বাড়ির দরজায় এসে পড়ল। কমলা চাবি বের করল। 

বিকাশ বলে উঠল, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব কমলা? 

কমলা থমকে দাঁড়াল। চাবির গোছা তার হাতে। 

করো। 

এখন তোমার কার কথা মনে পড়ছে কমলা? ঠিক এই মুহূর্তে।

কমলা স্থির দৃষ্টিতে বিকাশের মুখের দিকে চেয়ে থাকল। 

আন্দাজ করতে পারো বিকাশ? 

অনিন্দ্য? 

কমলার মুখে একটা কঠিন হাসি ফুটে উঠল। 

না বিকাশ, হল না। সুকুমার। 

সুকুমার! 

বিকাশ দৃঢ়ভাবে কমলার মুখের দিকে চেয়ে রইল। কর্মলাও কিছুক্ষণ বিকাশের দিকে চেয়ে রইল। তারপর চাবি দিয়ে তালাটা খুলল। 

হ্যাঁ বিকাশ, সুকুমার। তোমার ওথেলো আমার মনে আবার একটা প্রশ্ন নতুন করে জাগিয়ে তুলল। সুকুমারের মৃত মুঠিতে আমার রুমলাটা ধরা ছিল কেন? কেউ যদি এই ঘটনাটা নিয়ে একটা নাটক লেখে, বেশ হয়। না বিকাশ? তুমি লিখবে বিকাশ? লেখো না? 

কমলা সদর দরজা খুলে ভিতরে চলে গেল। রোজ কমলা তার জন্য অপেক্ষা করে। বিকাশের মনে হল, কমলার এমন ভয়ঙ্কর মূর্তি সে আগে আর দেখেনি। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে সে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। তারপর সে ক্রাচ দুটোকে বগলে চেপে নিপুণ অভ্যাসে দরজা পার হয়ে উঠোনে, উঠোন পার হয়ে বারান্দায়, বারান্দা পার হয়ে দালানে, দালান পার হয়ে দোতলার সিঁড়ি একটা একটা করে খট খট করে ভেঙে উপরে উঠতে লাগল। এক লহমার জন্য কমলার ঘরে নজর পড়ল তার। কমলা উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছে তার বিছানায়। একবার থামল সে। কিছু ভাবল। তারপর আবার সে সিঁড়ি ভাঙতে লাগল। খট খট খট। 

কমলার কানে শব্দটা একটানা কিছুক্ষণ বাজল। তারপর সমস্ত বাড়িটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *