কমরেড দামোদরের মর্মবেদনা
ভারতের কৌশল পারটির পশ্চিমবঙ্গজ বাজবাহাদুর কমরেড দামোদর গত শনিবার বিধানসভায় এক আকুল আবেদনে জানান, আইন অমান্যকারীদের প্রতি সরকার যেন মানবিক ব্যবহার করেন। গত শুক্রবার ভারতের কৌশল পার্টি এবং নয় বামের মিলিত উদ্যোগে কলিকাতায় যাঁরা আইন অমান্য করেন তাঁদের প্রতি সরকার যে ব্যবহার করেছেন, পৃথিবীতে আর কোনও। সরকার আইন অমান্যকারীদের প্রতি সেই রকম ব্যবহার করেছেন কি না, কমরেড দামোদর তার কোনও নজির খুঁজে পাননি।
পরে কমরেড দামোদর নাকি সাংবাদিকদের কাছে জানান, ‘সরকার যদি ক্রমাগত আইন অমান্যকারীদের সঙ্গে এই রকম ব্যবহার করতে থাকেন তবে বাধ্য হয়েই আমাদেরকেও চরম পথ বেছে নিতে হবে?
প্রশ্ন : ‘চরম পথ বেছে নিতে হবে’ বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন, কমরেড দামোদর? আপনি কী সশস্ত্র বিপ্লবের কথা বলতে চাইছেন?
কমরেড দামোদর : সশস্ত্র বিপ্লব আজকের দিতে এক অতি বাম হঠকারী ধারণামাত্র। ভারতের কৌশল পার্টি ওই পন্থায় বিশ্বাস করে না।
প্রশ্ন : তবে আপনার চরম পথ কী?
কমরেড দামোদর ফ্লাস্ক থেকে খানিকটা দুধ গলায় ঢেলে বললেন, ‘সরকার যদি আইন অমান্যকারীদের ভবিষ্যতে আইন অমান্যকারী বলে গেরাহ্যি না করেন, আপনারা লিখে নিন, তবে আমরা আইন অমান্য আন্দোলন বয়কট করতে বাধ্য হব। সরকারের হাতে আমরা কিছুতেই আইন অমান্যকারীদের মর্যাদা ধুলায় লুণ্ঠিত হতে দেব না।’
প্রশ্ন : আপনারা আইন অমান্য আন্দোলন বয়কট করবেন। বলেন কী কমরেড দামোদর। সর্বনাশ।
কমরেড দামোদর : হ্যাঁ, সরকার যদি এখনও সতর্ক না হন, তবে শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে ওই চরম পথই গ্রহণ করতে হবে।
প্রশ্ন : আপনারা কী একেবারে শেষ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন?
কমরেড দামোদর : নিয়েছি বলতে পারেন, আবার নিইওনি বলতে পারেন। সেটা নির্ভর করবে সরকারের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার উপর। কারণ, হাজার হোক এই সরকারের সঙ্গে তো আমাদের একটা সম্পর্ক আছেও বটে আবার নেইও বটে। আমাদের স্ট্যান্ডটা এই রকম একটা আপেক্ষিক অথচ অস্তিত্ববাদী সম্পর্কের উপর নির্ভর করছে কি না।
প্রশ্ন : কমরেড দামোদর, আপনি একটু আগে বলেছেন যে, সরকার আইন অমান্যকারীদের যদি আইন অমান্যকারী বলে গেরাহ্যি না করেন— এর দ্বারা আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?
কমরেড দামোদর : একজন আইন অমান্যকারী হিসাবে এবার এই সরকারের কাছ থেকে যে ব্যবহার পেয়েছি তা শুনলে দুনিয়া শিউরে উঠবে।
প্রশ্ন : আপনি নয় বাম আহুত ৩ মে তারিখের আইন অমান্য আন্দোলনের অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাইছেন;
কমরেড দামোদর : না। এবং নয় বাম আহূত আইন অমান্য আন্দোলনের কথা বলতে চাইছি। টু কীপ দি রেকরড স্ট্রেইট, আমাদের পার্টির লাইন অনুসারে এই আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন ভারতের কৌশল পার্টি এবং নয় বামের ঐক্যবদ্ধ মোরচা। এবারে বলি সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। আমরা যথা সময়ে পুলিশ করডনের কাছে এসে বসে পড়লাম। প্রথম সারিতে নেতাগণ এবং তার পিছনে জনতা। তারপর নানারকম ধ্বনি, ভাষণ এবং অবশেষে ফটো তোলাও শেষ হল। তারপর আইন অমান্যও হল। তখনই টের পেলাম, কোথাও কিছু একটা গড়বড় কিছু হচ্ছে। সরকারের ব্যবহারে কোথায় যেন মানবিকতার অভাব-
প্রশ্ন : লাঠি চলল বুঝি?
কমরেড দামোদর : না। তাহলেও তো বোঝা যেত। লাঠি কি আর আগে খাইনি।
প্রশ্ন : তবে কি টিয়ার গ্যাস গুলি?
কমরেড দামোদর : না না, ওগুলো তো আন্দোলনের অঙ্গ।
প্রশ্ন : তবে কী, কমরেড দামোদর? আরও সাংঘাতিক কিছু?
কমরেড দামোদর : সাংঘাতিক বৈ কি? আইন অমান্য আন্দোলন কি একটা ছেলেখেলা? আমরা আইন অমান্য আন্দোলন করছি, তা সরকারি তরফে কোনও গরজই নেই। ওদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে, আমরা বুঝি চাকরি চাইতে গিয়েছি।
প্রশ্ন : এমনও তো হতে পারে, ওরা ঠিক বুঝতে পারেনি?
কমরেড দামোদর : ন্যাকামি করবেন না। না-বোঝার কোনও অবকাশ আমরা কী রেখেছি। কাগজে দিনের পর দিন বিবৃতি দিয়েছি। পার্টি দৈনিকে টেমপো বাড়াবার জন্য বড় বড় হেডলাইন বেরিয়েছে। কোন্ কোন্ শ্লোগান দেওয়া হবে কাগজের প্রথম পাতার তার ফর্দ বেরিয়েছে। বিধানসভায় ঘোষণা করা হয়েছে। পুলিশকে আগে ভাগে খবর দেওয়া হয়েছে। এর পরও না-বোঝার আর বাকি থাকে কী?
প্রশ্ন : এত করার পরও বলতে চান ওরা গেরাহ্যি করেনি?
কমরেড দামোদর : যা ফ্যাক্ট তাই বলছি। আরে বাবা, তোরা সরকারী চাকুরে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব তোদের হাতে দিয়ে আমরা নাগরিকরা নিশ্চিন্ত আছি। তোদের চোখের সামনে আমরা শ্লোগান ট্রোগান দিয়ে আইন ভঙ্গ করে যাচ্ছি। কোথায় এসে পটাপট ধরে ফেলে গাড়িতে পুরবি তা না গেরাহ্যিই নেই!
প্রশ্ন : বলেন কী?
কমরেড দামোদর : তবে আর অমানবিক ব্যবহার বলছি কেন? গ্রেপ্তারই করতে চায় না। শেষে অনেক ধমক ধামক দিয়ে, বিধানসভায় প্রশ্ন তোলবার হুমকি দিয়ে তবে গে গ্রেপ্তার হতে হল। মশাই, গ্রেপ্তারের জন্য এত তদবির তদারক এই বয়েসে সহ্য হয় বলুন?
প্রশ্ন : এ তো ইনসাল্ট। গ্রেপ্তার হবার জন্য এত কাঠখড় পোড়াতে হল?
কমরেড দামোদর : এখানেই শেষ নয়। এই সরকার আমাদের জেলে ঢুকবার ন্যায্য অধিকারটুকুও এবার কেড়ে নিয়েছে। সারা রাত জেলের সামনে একটা খোলা মাঠে আমাদের বসিয়ে রেখেছিল জানেন। চা দেয়নি, জল দেয়নি, একটা পুলিশ পর্যন্ত পাহারায় রাখেনি, জানেন! এই কী আইন অমান্যকারীদের প্রতি সরকারের ন্যায্য ব্যবহার!
‘ছিঃ!’ কমরেড দামোদর বললেন, ‘ঘেন্না ধরে গেছে মশাই। তাই আমি সরকারকে জানিয়ে দিয়েছি যে (এক) আইন অমান্যকারীদের গ্রেপ্তার করতে গড়িমসি চলবে না এবং (দুই) গ্রেপ্তারের পর আইন অমান্যকারীদের বিনা তদবিরে জেলে পুরতে হবে, আইন অমান্য আন্দোলনকারীদের এই দ্বিবিধ ন্যায্য দাবী পূরণের গ্যারানটি সরকার যতক্ষণ পর্যন্ত লিখিতভাবে না দিচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আইন অমান্য আন্দোলন বয়কট করব। আমরণ আমি এই আওয়াজ তুলে যাব : আইন অমান্যকারীদের সঙ্গে সরকারকে মানবিক ব্যবহার করতে হবে, করতে হবে।’
৮ মে ১৯৭8