‘কবীন্দ্র রবীন্দ্র… বুঝলেন কিনা’

‘কবীন্দ্র রবীন্দ্র… বুঝলেন কিনা’

সুপ্রিয়মামা আমার নিজের মামা নন। জেঠিমার ভাই। কিন্তু আত্মীয়তার দূরত্ব থাকলেও কখনও-সখনও সম্পর্কটা ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এই মামার সঙ্গে আমাদেরও তা-ই হয়েছিল। ভারী সিধেসাদা লোক, অতিশয় সরল, কোনও ঘোরপ্যাঁচ ছিল না তাঁর। যখন আমরা ময়মনসিংহে এবং খুবই ছোট, তখন থেকেই মামা মাঝে মাঝে এসে হাজির হতেন। সুপ্রিয়মামাকে আমাদের বেশ পছন্দ ছিল। রেলে কাজ করতেন এবং সেই সূত্রেই ইন্সপেকশন-এর কাজে ময়মনসিংহে আসতেন। দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল পার্টিশনের কিছু আগে। মামা ময়মনসিংহ থেকে ফেরার সময় ট্রেনে ভয়ংকর অ্যাকসিডেন্ট হয়। বহু মানুষ মারা যায়। সুপ্রিয়মামা গভীর রাতের সেই অ্যাকসিডেন্টে কামরার ভাঙা অংশের সঙ্গে বহু দূর ছিটকে পড়েন। অতি সংকটজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তার পর ছাড়া পান। তেমন কোনও গুরুতর অঙ্গহানি হয়নি। শুধু জিবটা কাটা পড়েছিল। সেটা জোড়াও লাগানো হয়। বাকি জীবন ওই জিব নিয়েই যা সমস্যা ছিল। জিবটা সব সময় কাঁপত এবং কথা একটু একটু এড়িয়ে যেত।

রেলের সম্পর্কসূত্রে সেই মামা কালক্রমে শিলিগুড়িতে বদলি হয়ে এলেন। রেল কোয়ার্টার্স কাছাকাছিই। ফলে দু’বাড়িতে রোজ যাতায়াত। মামিও নির্ভেজাল ভাল মানুষ। গেলেই কিছু না কিছু না খাইয়ে ছাড়তেন না।

সে দিন সকালে আমার ভাই বাজারে গিয়ে দামি পাইলট পেনটা হারিয়ে এল। খুব মন খারাপ। একটু বেলায় সে মামার বাড়িতে গিয়েছিল, যেমন প্রায়ই যায়। মামার মেজো ছেলে তার সমবয়সি এবং বন্ধু। গিয়ে দেখে মামাবাড়িতে একটা হই-হুল্লোড় হচ্ছে। কারণটা হল, মামা সে দিন বাজারে গিয়ে একটা পাইলট পেন কুড়িয়ে পেয়েছেন। সেটাই সেলিব্রেট করা হচ্ছে। সেই আনন্দের পরিবেশে আমার ভাই মুখ চুন করে জানাল যে, পেনটা তারই। এতে আনন্দটা দপ করে নিভে গেল বটে, কিন্তু মামা এমন হাবভাব করতে লাগলেন যে, এতে তাঁরই যেন অপরাধ হয়েছে। ভারী অপ্রতিভ, বিব্রত।

মামার এক ছেলে গান লিখত। একটু-আধটু গাইতও। ব্যাপারটা মামার বিশেষ পছন্দ ছিল না। আমাকে বলতেন, মনায় ওই সব ছাইভস্ম লেইখ্যা ল্যাখাপড়ার বারোটা বাজাইতাছে। অরে একটু বুঝাইয়া কইয়ো তো! গানগুন লেইখ্যা কী হয়? এই নিয়ে বাপ-ব্যাটায় একটু সম্পর্কের টানাপড়েনও ছিল।

মনা এক বার কিছু গান লিখে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয় গোপনে। কিছু দিন পরে হঠাৎ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নিজের হাতে লেখা চিঠি এসে হাজির। তাতে তিনি মনাকে গান লিখতে উৎসাহই দিয়েছেন। নিজের একটা ছবিও পাঠিয়েছেন।

মফস‌্সল শহরে একটা মধ্যবিত্ত বাড়িতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের চিঠি আসা যে কত বড় ঘটনা, তা আমি জানি। সুতরাং মামার বাড়িতে হইহই পড়ে গেল। মামার মুখে সে কী উজ্জ্বল অহংকারের হাসি! আমাকে ডেকে বললেন, বোঝলা রুণু, হ্যামন্ত মুখার্জির চিঠি আইছে। কত বড় কথা কও দেখি!

বলা বাহুল্য, এর পর আর মনার গান লেখার বাধা হল না।

কালিম্পংয়ের এক বুড়ি মিশনারি মেমসাহেবের ট্রেনে কিছু টাকাপয়সা আর জিনিসপত্র খোয়া গিয়েছিল। সাধারণত রেলের এ সব ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা নয়। কিন্তু ইনি বিদেশিনি বলে রেল ক্ষতিপূরণ দেয়। সেই চেকটা মেমসাহেবকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমার বাবা যাবেন। সেই তক্কে বাবার স্টেশন ওয়াগনে আমি আর সুপ্রিয়মামাও সওয়ার হয়ে গেলাম। বুড়ি তো চেক পেয়ে আহ্লাদে আটখানা। এর পর বাবা গেলেন মিটিংয়ে। আমি আর মামা বেরিয়ে পড়লাম রবীন্দ্রনাথের বাড়ি দেখব বলে।

বাড়ির নাম চিত্রভানু। বেশ বড় বাগান। তার মাঝখানে চমৎকার বাংলো বাড়ি। সে দিন টিপ টিপ করে বৃষ্টি হচ্ছিল। কুয়াশা এবং মেঘও ছিল। সুপ্রিয়মামা রবীন্দ্রনাথের বাড়ি দেখে এমন বিহ্বল হয়ে পড়লেন যে, আবেগে চোখে জল এসে গেল। কাটা জিবের দরুন মামা একটু তাড়াতাড়ি কথা বলতেন, সবটা ভাল বোঝা যেত না। আবেগ হলে আরও অস্পষ্ট হয়ে যেত।

বাড়ির ফটকের ভিতর ঢোকা উচিত হবে কি না, বুঝতে পারছিলাম না। তাই বাইরে দাঁড়িয়েই ভেতরটা দেখছিলাম। এমন সময় দেখলাম, বারান্দার আবছায়ায় এক ভদ্রমহিলা বেতের চেয়ারে বসে। পাশে এক জন দাসী গোছের মেয়ে। ভদ্রমহিলার ইশারায় সেই মেয়েটি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কাকে চাইছেন?

মামা উত্তেজিত। আবেগমথিত গলায় বলার চেষ্টা করলেন, কবীন্দ্র রবীন্দ্র… বুঝলেন কিনা… রবীন্দ্র কবীন্দ্র… আমাগো বিশ্বকবি…

হ্যাঁ, এটাই রবীন্দ্রনাথের বাড়ি।

বারান্দায় যিনি বসেছিলেন, তিনি উঠে দরজায় এসে দাঁড়ালেন। প্রতিমা দেবীকে সেই আমার প্রথম দেখা। কী রূপ ওই বয়সেও! হেসে বললেন, আসুন না, ভিতরে আসুন। ঘুরে দেখুন।

এই আপ্যায়নে মামা এত বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলেন, আর কথাই বলতে পারেননি। চোখের জল মুছেছিলেন। বাগানে ঘুরতে ঘুরতে বার বার শুধু বলছিলেন, কী সৌভাগ্য হে! কী সৌভাগ্য!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *