তৃতীয় খণ্ড (স্নেহের চুমকিকে)
3 of 6

কবি

কবি

আমার এক কবি বন্ধু আছেন। তিনি শুধু ভালো কবি নন, তিনি এক অসাধারণ মানুষ। সময় সময় সন্দেহ হতে পারে, তিনি মানুষ কিনা। মানুষের এক মাত্রায় আছে অমানুষ, আর একমাত্রায় অতিমানুষ। তিনি এই স্কেলের কোন দিকে আছেন স্থির করবে ভবিষ্যৎকাল। কারণ তিনি কবি। সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর নাম থাকবেই থাকবে। ইংরেজিতে বলে —ওয়েট অ্যান্ড সি। অপেক্ষা করো, দ্যাখো। দ্যাখো কি হয়। আমার কবির নীতি হল, ওয়েট অ্যান্ড রাইট, অপেক্ষা করো। লেখার মালমশলা আপনি এসে যাবে। তুমি তাকে ছন্দে ধরে বাজারে নামিয়ে দাও। কবিরা সাধারণত মানুষের অবিচার, অনাচার, শোষণ, নিপীড়নের বিরুদ্ধে কলম ধরেন। ধরে আগুন জ্বালিয়ে দেন। সেই জন্যেই বলা হয় ‘পেন ইজ মাইটিয়ার দ্যান সোর্ড।’ মানে কলম হল গিয়ে বঁটির চেয়ে ধারালো। কবি অপেক্ষা করে থাকেন, তারপর কবিতায় ঝাড়েন।

 যেমন, আমরা একবার তাঁর ঘাড় ভেঙে পাঁচজনে মিলে কচুরি খেয়েছিলুম। তখন আমরা বুঝিনি এর পরিণাম কি হতে পারে। যা হওয়ার তা হল পুজো সংখ্যায়। কবি লিখলেন কবিতা। প্রকাশিত হওয়ার পর আমরা পড়লুম। পড়ে স্তম্ভিত।

কবিতার প্রথম লাইন—পাঁচ বাঁদরে কচুরি খাচ্ছে বউবাজারের দোকানে। মনের চোখে ভেসে উঠল অতীত দৃশ্য। আমরা পাঁচজন মানুষ নই, পাঁচটি নানা বয়সের বাঁদর বউবাজারের নোনতা খাবারের দোকানে দাঁড়িয়ে বেশি না চারটে করে কচুরি খেয়েছিলুম। সেই কচুরি খাওয়ার দৃশ্য। কবি তখন আমাদের হেসে হেসে খাইয়েছিলেন, তখন বুঝিনি হাসির আড়ালে এই প্যাঁচ ছিল। তিনি সেদিন দেখেছিলেন। দক্ষিণেশ্বরের গাছ থেকে নেমে এসেছে পাঁচটি হনুমান। সেই হনুমান পাঁচটি হাউ হাউ করে হিঙের কচুরি গিলছে। কবি তাঁর কাব্যে এইভাবে শোধ নিলেন মাথায় কাঁঠাল ভাঙার।

এরপর তিনি কবিতায় শোধ নিলেন। তাঁর সিনিয়ারের ব্যবহারের। কি নিয়ে একদিন মন কষাকষি হয়েছিল। ব্যাপারটা কিভাবে গড়িয়ে চলে গেল ওপরওয়ালার কাছে। এক সময় মিটমাটও হয়ে গেল। আমাদের কিছু মনেও রইল না আর। পাক্কা ছ’মাস পরে কবি দুটি পূজা সংখ্যায় দুটি কবিতা লিখলেন। প্রথম কবিতা, রাবণ সাড়ে তিন মিটার কাপড়ে তৈরি ফুলহাতা পাঞ্জাবি পরে মোড়ের দোকান থেকে দুখিলি পান কিনে মশমশ করে চিবোচ্ছে। আর এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে। দশ মাথার দুষ্টবুদ্ধি সব এখন এক মাথায় এসে জমেছে। দ্বিতীয় কবিতায় লিখলেন, মোটা মতো লোকটা কাচের দরজা ঠেলে ঢুকলেই বুঝতে হবে একটু পরেই কেউ না কেউ কোতল হবে।

কবি আমাদের খুব প্রিয়। কারণ কবি জীবন দিয়ে কবিতা লেখেন। ধাক্কা খান। নিজেকে বিপদে ফেলে, নিজেকে জ্বালিয়ে জ্বালাময়ী হতে ওঠেন। একেবারে মোহিতলালের কবিতা—যত ব্যথা পাই তত গান গাই। কবির জীবনে ব্যথা পাওয়ার সঙ্গত কোনও কারণ নেই। কলকাতার উপকণ্ঠে এক একর জমিতে ম্যানর টাইপের বাড়ি। জমিতে যা ভেজিটেবল হয়, সেই ভেজিটেবলে সারাবছর তাঁর ছোট্ট সংসারে ভিটামিনের অভাব না হওয়ারই কথা। তাঁর একটি দিঘি আছে। সেখানে পাঁচ কেজি ওজনের লক্ষ্মী মাছেরা সাতসকালে বেলি-ড্যান্স দেখায়। সারসার নারকেল গাছ। বিজয়া করতে এসে বন্ধুরা নাড়ূ খেতে খেতে প্রায় নাড়ুগোপাল হয়ে যায়। তবু কবি কিলো প্রতি পঁচিশ পয়সা সস্তা হবে বলে মানিকতলা থেকে ভেলি কিনে, কম্পার্টমেন্ট সুদ্ধ সমস্ত যাত্রীকে জ্বালাতে জ্বালাতে মাতলা যাবেন। সমবায়িকা থেকে চার কেজি রেপসিড অয়েলের ঢাউস টিন নিয়ে ‘ন স্থানং তিল ধারণং’ রেলকামরায় সহযাত্রীর মালাই চাকতি ডিসলোকেট করতে করতে ঠেলে উঠবেন। কেন এমন করেন। কবি বলবেন—যে মানুষ আছে মাটির কাছাকাছি, তিনি তাদের কাছেই থাকতে চান। তিনি গাড়িচাপা বড়বাবু নন, মেহনতি কবি। জীবনের বিলাসিতা একটিই, ময়দার করা ফুলকো লুচি আর বেগুন ভাজা। তিনি বেগুনাসক্ত। রূপসি বেগুন দেখলে তাঁর মনে জাগে রোমান্স। অনেকে অনেক কিছু দান করেন, তিনি দান করেন বেগুন। তাঁর দপ্তরের শ্রদ্ধেয় ওপরওয়ালাকে তিনি কাঁদিয়ে ছেড়েছিলেন। তিনদিন অন্তর পাঁচ কেজি এলোকেশী বেগুন। নধর, তৈল চিক্কণ চেহারা হলে কি হবে, বেগুন পুতনা রাক্ষুসির মতো তেল টানে। শেষে এমন দাঁড়াল কবি যেকোনও কাজেই ঘরে ঢুকলে তিনি চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে বলেন—নো মোর বেগুন, নো মোর বেগুন।

কবি আমাদের সর্ব অর্থে নির্ভেজাল সরল সুন্দর প্রাচীনপন্থী আদর্শবান মানুষ। আধুনিক যুগের ঘোরপ্যাঁচ, প্যাঁজ পয়জার কিছুই বোঝেন না। লোকে টাকা জমায়, তিনি জমান চেক। একবার কবিপত্নী ছোবড়ার গদি ওলটাতে গিয়ে দেখেন খান-কুড়ি চেক। সব মিলিয়ে টাকার অঙ্কে তিন-চার হাজার হবে। এর মধ্যে তিন বছরের পুরোনো চেকও রয়েছে। কবে তাদের ক্যাশ ডেট চলে গেছে।

কবির আড়াইশো জোড়া প্যান্ট জামা আছে। বেশির ভাগই তিনি সেকালের মোহর রাখার কায়দায় কলসিতে রাখেন মনে হয়। স্ত্রীকে তিনি ভীষণ ভালোবাসেন বলেই ই যুক্ত স্ত্রী, ইস্ত্রিকে সহ্য করতে পারেন না। জামা-প্যান্ট দুটোই গিলে করা। একটা পেয়ারই তিনি মাসের পর মাস পরেন। ভালো জামাকাপড় পরা কাপ্তেনি। জামাকাপড়ে বেশি মাঞ্জা মারলে বারোয়ারিওয়ালারা বেশি চাঁদা চায়। তা ছাড়া, হাবড়া লাইনের ডেলি-প্যাসেঞ্জাররা জামা প্যান্ট কেন, মৌলিক স্কিনটাই খুলে নিতে চায়।

শীত-শীত ভাব এসেছে। কবির আবির্ভাব হল। জামার ওপর জামা। তলার জামাটা বড়। ঝুলে বেরিয়ে পড়েছে। এক কলারের তলা থেকে উঁকি মারছে আর এক কলার। গিলে করা ট্রাউজার। পদযুগলে এক জোড়া শু। আদি রং কেউ বলতে পারলে কান কেটে ফেলে দেব। সে যেন এক পিলপিলি সায়েব। জিগ্যেস করায় গম্ভীর উত্তর—বউ বললে শীত পড়েছে। জিগ্যেস করা হল—লোকে কী বলবে? আদি-অকৃত্রিম উত্তর—’লোক না পোক’—

এই আমাদের প্রিয় কবি। সম্পদ যাঁর বনেদি আদর্শ। জ্ঞান যাঁর তৃষ্ণা। পঞ্চাশ হাজার বই আর আড়াই হাজার কলমের মালিক। নিজের জন্মদিন জানেন না। নামটা মনে রেখেছেন কষ্টে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *