কবি য়েট্‌স্

ভিড়ের মাঝখানেও কবি য়েট্‌স চাপা পড়েন না, তাঁহাকে একজন বিশেষ কেহ বলিয়া চেনা যায়। যেমন তিনি তাঁহার দীর্ঘ শরীর লইয়া মাথায় প্রায় সকলকে ছাড়াইয়া গিয়াছেন, তেমনি তাঁহাকে দেখিলে মনে হয়, ইঁহার যেন সকল বিষয়ে একটা প্রাচুর্য আছে, এক জায়গায় সৃষ্টিকর্তার সৃজনশক্তির বেগ প্রবল হইয়া ইঁহাকে যেন ফোয়ারার মতো চারি দিকের সমতলতা হইতে বিপুলভাবে উচ্ছ্বসিত করিয়া তুলিয়াছে। সেইজন্য দেহে মনে প্রাণে ইঁহাকে এমন অজস্র বলিয়া বোধ হয়।

ইংলণ্ডের বর্তমানকালের কবিদের কাব্য যখন পড়িয়া দেখি তখন ইঁহাদের অনেককেই আমার মনে হয়, ইঁহারা বিশ্বজগতের কবি নহেন। ইঁহারা সাহিত্যজগতের কবি। এ দেশে অনেক দিন হইতে কাব্য সাহিত্যে সৃষ্টি চলিতেছে, হইতে হইতে কাব্যের ভাষা উপমা অলংকার ভঙ্গী বিস্তর জমিয়া উঠিয়াছে। শেষকালে এমন হইয়া উঠিয়াছে যে কবিত্বের জন্য কাব্যের মূল প্রস্রবণে মানুষের না গেলেও চলে। কবিরা যেন ওস্তাদ হইয়া উঠিয়াছে; অর্থাৎ, প্রাণ হইতে গান করিবার প্রয়োজনবোধই তাহাদের চলিয়া গিয়াছে, এখন কেবল গান হইতেই গানের উৎপত্তি চলিতেছে। যখন ব্যথা হইতে কথা আসে না, কথা হইতেই কথা আসে, তখন কথার কারুকার্য ক্রমশ জটিল ও নিপুণতর হইয়া উঠিতে থাকে; অবেগ তখন প্রত্যক্ষ ও গভীর ভাবে হৃদয়ের সামগ্রী না হওয়াতে সে সরল হয় না; সে আপনাকে আপনি বিশ্বাসে করে না বলিয়াই বলপূর্বক অতিশয়ের দিকে ছুটিতে থাকে; নবীনতা তাহার পক্ষে সহজ নহে বলিয়াই আপনার অপূর্বতা-প্রমাণের জন্য কেবলই তাহাকে অদ্ভুতের সন্ধানে ফিরিতে হয়।

ওয়ার্ড্‌স্‌ওয়ার্থের সঙ্গে সুইন্‌বর্নের তুলনা করিয়া দেখিলেই আমার কথাটা বোঝা সহজ হইবে। যাঁহারা জগতের কবি নহেন, কবিত্বের কবি, সুইন্‌বর্ন্‌ তাঁহাদের মধ্যে প্রতিভায় অগ্রগণ্য। কথার নৃত্যলীলায় ইঁহার এমন অসাধারণ নৈপুণ্য যে তাহারই আনন্দ তাঁহাকে মাতোয়ারা করিয়াছে। ধ্বনি-প্রতিধ্বনির নানাবিধ রঙিন সুতায় তিনি চিত্রবিচিত্র করিয়া ঘোরতর টক্‌টকে রঙের ছবি গাঁথিয়াছেন; সে-সমস্ত আশ্চর্য কীর্তি, কিন্তু বিশ্বের উপর তাহার প্রশস্ত প্রতিষ্ঠা নহে।

বিশ্বের সঙ্গে হৃদয়ের প্রত্যক্ষ সংঘাতে ওয়ার্ড্‌স্‌ওয়ার্থের কাব্যসংগীত বাজিয়া উঠিয়াছিল। এইজন্য তাহা এমন সরল। সরল বলিয়া সহজ নহে। পাঠকেরা সহজে তাহা গ্রহণ করে নাই। কবি যেখানে প্রত্যক্ষ অনুভূতি হইতে কাব্য লেখেন সেখানে তাঁহার লেখা গাছের ফুলফলের মতো আপনি সম্পূর্ণ হইয়া বিকাশ পায়। সে আপনাকে ব্যাখ্যা করে না; অথবা নিজেকে মনোরম বা হৃদয়ঙ্গম করিয়া তুলিবার জন্য সে নিজের প্রতি কোনো জবর্‌দস্তি করিতে পারে না। সে যাহা সে তাহা হইয়াই দেখা দেয়। তাহাকে গ্রহণ করা, তাহাকে ভোগ করা পাঠকেরই গরজ।

নিজের অনুভূতি ও সেই অনুভূতির বিষয়ের মাঝখানে কোনো মধ্যস্থ পদার্থের প্রয়োজন ও ব্যবধান না রাখিয়া কোনো কোনো মানুষ জন্মগ্রহণ করেন, বিশ্বজগৎ ও মানবজীবনের রসকে তাঁহারা নিঃসংশয় ভরসার সহিত নিজের হৃদয়ের ভাষায় প্রকাশ করিতে পারেন; তাঁহারাই নিজের সমসাময়িক কাব্যসাহিত্যের সমস্ত কৃত্রিমতাকে সাহসের সঙ্গে অতিক্রম করিয়া থাকেন।

একদিন ইংরেজি সাহিত্যের কৃত্রিমতার যুগে বার্‌ন্‌স্‌ জন্মিয়াছিলেন। তিনি তাঁহার সমগ্র হৃদয় দিয়া অনুভব করিয়াছিলেন ও প্রকাশ করিয়াছিলেন। এইজন্য তখনকার বাঁধা দস্তুরের বেড়া ভেদ করিয়া কোথা হইতে যেন স্কট্‌লণ্ডের অবারিত হৃদয় কাব্যসাহিত্যের মাঝখানে আসিয়া অসংকোচে আসন গ্রহণ করিল।

এখনকার কাব্যসাহিত্যের যুগে কবি য়েট্‌স্‌ যে বিশেষ সমাদর লাভ করিয়াছেন, তাহারও গোড়াকার কথাটা ঐ। তাঁহার কবিতা তাঁহার সমসাময়িক কাব্যের প্রতিধ্বনির পন্থায় না গিয়া কবির নিজের হৃদয়কে প্রকাশ করিয়াছে। ঐ-যে “নিজের হৃদয়’ বলিলাম ও কথাকে একটু বুঝিয়া লইতে হইবে। হীরার টুকরা যেমন আকাশের আলোককে প্রকাশ করা দ্বারাই আপনাকে প্রকাশ করে তেমনি মানুষের হৃদয় কেবলমাত্র নিজের ব্যক্তিগত সত্তায় প্রকাশই পায় না, সেখানে সে অন্ধকার। যখনি সে আপনাকে দিয়া আপনার চেয়ে বড়োকে প্রতিফলিত করিতে পারে তখনি সেই আলোকে সে প্রকাশ পায় ও সেই আলোককে সে প্রকাশ করে। কবি য়েট্‌সের কাব্যে আয়র্লণ্ডের হৃদয় ব্যক্ত হইয়াছে।

এ কথাটাকেও আর-একটু পরিষ্কার করিয়া বলা উচিত। একই সূর্যের আলো নানা মেঘের উপর পড়িয়াছে কিন্তু মেঘখণ্ডগুলির অবস্থা ও অবস্থান অনুসারে তাহাতে ভিন্ন ভিন্ন রঙ ফলিয়া উঠিয়াছে। কিন্তু, এই রঙের ভিন্নতা পরস্পরের বিরুদ্ধ নহে; তাহারা আপন আপন বৈচিত্র্যের দ্বারাই সকলের সঙ্গে সকলে মিলিতে পারিতেছে। রঙ-করা তুলা প্রাণপণে মেঘের নকল করিয়াও মিলিতে পারিত না।

তেমনি আয়র্লণ্ড্‌ই বলো, স্কট্‌লণ্ড্‌ই বলো, বা অন্য যে-কোনো দেশই বলো, সেখানকার জনসাধারণের চিত্তে বিশ্বজগতের আলো এমন করিয়া পড়ে যাহাতে সে একটা বিশেষ রঙ ফলাইয়া তুলে। বিশ্বমানবের চিদাকাশ এমনি করিয়াই বর্ণবৈচিত্র্যে সুন্দর হইয়া উঠিতেছে।

কবি ভাবের আলোককে কেবল প্রকাশ করেন তাহা নহে, তিনি যে দেশের মানুষ সেই দেশের হৃদয়ের রঙ দিয়া তাহাকে একটু বিশেষ ভাবে সুন্দর করিয়া প্রকাশ করেন। সকলেই যে করিতে পারেন তাহা বলি না, কিন্তু যিনি পারেন তিনি ধন্য। আমাদের দেশে বৈষ্ণব-পদাবলি বাঙালি-কাব্য রূপেই বিশ্বকাব্য। তাহা বিশ্বের জিনিস বিশ্বকে দিতেছে, কিন্তু তাহারই মধ্যে নিজের একটা রস যোগ করিয়া দিতেছে; নিজের একটি রূপের পাত্রে তাহাকে ভরিয়া দিতেছে।

সংসারের রণক্ষেত্রে লড়াই করা যাহার ব্যবসায় তাহাকে কবজ পরিতে হয়; তাহাকে সংসারের সমস্ত আবরণ আচ্ছাদন গ্রহণ করিতে হয়; নহিলে পদে পদে চারি দিক হইতে তাহাকে আঘাত লাগে। কিন্তু, আপনাকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করা যাহার কাজ, আবরণের অভাবই তাহার যথার্থ সজ্জা। কবি য়েট্‌সের সঙ্গে আলাপ করিয়া আমার ঐ কথাই মনে হইতেছিল। এই একটি মানুষ, ইনি নিজের চিত্তের অবারিত স্পর্শশক্তি দিয়া জগৎকে গ্রহণ করিতেছেন। মানুষ নানা শিক্ষার ভিতর দিয়া, অভ্যাসের ভিতর দিয়া, অনুকরণের ভিতর দিয়া, যেমন করিয়া চারি দিককে দেখে এ দেখা তেমন দেখা নহে।

যখনি কোনো মানুষ এইপ্রকার অব্যবহিত ভাবে জগৎকে দেখে ও তাহার খবর দেয় তখন দেখিতে পাই মানুষের পুরাতন অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাহার একটা মিল আছে; তাহা খাপছাড়া নহে। যাহারা সরলচক্ষে দেখিয়াছে, সকলেই এমনি করিয়া দেখিয়াছে। বৈদিক কবিরাও জলে স্থলে প্রাণকে দেখিয়াছেন, হৃদয়কে দেখিয়াছেন। নদী মেঘ উষা অগ্নি ঝড়, বৈজ্ঞানিক সত্যরূপে নহে, ইচ্ছাময় মূর্তিরূপে তাঁহাদের কাছে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। মানুষের জীবনের মধ্যে সুখদুঃখের যে অভিজ্ঞতা প্রকাশ পায় তাহাই যেন নানা অপরূপ ছদ্মবেশে ভূলোকে ও দ্যুলোকে আপন লীলা বিস্তার করিয়াছে। যেমন আমাদের চিত্তে তেমনি সমস্ত প্রকৃতিতে। হাসিকান্নার বেদনা, চাওয়া পাওয়া এবং হারানোর খেলা, যেমন আমাদের এই ছোটো হৃদয়টিতে তেমনি তাহাই খুব প্রকাণ্ড করিয়া এই মহাকাশের আলোক-অন্ধকারের রঙ্গমঞ্চে। তাহা এত বৃহৎ যে তাহাকে আমরা একসঙ্গে দেখিতে পাই না বলিয়া আমরা জল দেখি, মাটি দেখি, কিন্তু সমস্তটার ভিতরকার বিপুল খেলাটাকে দেখিতে পাই না। কিন্তু, মানুষ যখন শিক্ষা ও অভ্যাসের ঠুলির ভিতর দিয়া দেখে না, যখন সে আপনার সমস্ত হৃদয় মন জীবন দিয়া দেখে, তখন সে এমন একটা বেদনার লীলাকে সব জায়গাতেই অনুভব করে যে, তাহাকে গল্পের মধ্যে দিয়া, রূপকের মধ্য দিয়া ছাড়া প্রকাশ করিতে পারে না। মানুষ যখন জাগতিক ব্যাপারের মধ্যে আপনারই খুব একটা বড়ো পরিচয় পাইতেছিল– এইটে একরকম করিয়া বুঝিতেছিল যে, সমস্ত জগতের মধ্যে যাহা নাই তাহা তাহার নিজের মধ্যেও নাই, যাহা তাহার মধ্যে আছে তাহাই বিপুল আকারে বিশ্বের মধ্যে আছে– তখনি সে কবির দৃষ্টি অর্থাৎ হৃদয়ের দৃষ্টি জীবনের দৃষ্টিতে সমস্তকে দেখিতে পাইয়াছিল; তাহা অক্ষিগোলক ও স্নায়ু শিরা ও মস্তিষ্কের দৃষ্টি নহে। তাহার সত্যতা তথ্যগত নহে; তহা ভাবগত, বেদনাগত। তাহার ভাষাও সেইরূপ; তাহার সুরের ভাষা, রূপের ভাষা। এই ভাষাই মাবসাহিত্যে সকলের চেয়ে পুরাতন ভাষা। অথচ, আজও যখন কোনো কবি বিশ্বকে আপনার বেদনা দিয়া অনুভব করেন তখন তাঁহার ভাষার সঙ্গে মানুষের পুরাতন ভাষার মিল পাওয়া যায়। এই কারণে বৈজ্ঞানিক যুগে মানুষের পৌরাণিক কাহিনী আর কোনো কাজে লাগে না, কেবল কবির ব্যবহারের পক্ষে তাহা পুরাতন হইল না। মানুষের নবীন বিশ্বানুভূতি ঐ কাহিনীর পথ দিয়া আনাগোনা করিয়া ঐখানে আপন চিহ্ন রাখিয়া গিয়াছে। অনুভূতির সেই নবীনতা যাহার চিত্তকে উদ্‌বোধিত করে সে ঐ পুরাতন পথটাকে স্বভাবতই ব্যবহার করিতে প্রবৃত্ত হয়।

কবি য়েট্‌স্‌ আয়র্লণ্ডের সেই পৌরাণিক পথ দিয়া নিজের কাব্যধারাকে প্রবাহিত করিয়াছেন। ইহা তাঁহার পক্ষে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হইয়াছিল বলিয়াই এই পথে তিনি এমন অসামান্য খ্যাতি উপার্জন করিতে পারিয়াছেন। তিনি তাঁহার জীবনের দ্বারা এই জগৎকে স্পর্শ করিতেছেন; চোখের দ্বারা, জ্ঞানের দ্বারা নহে। এইজন্য জগৎকে তিনি কেবল বস্তুজগৎরূপে দেখেন না; ইহার পর্বতে প্রান্তরে ইনি এমন একটি লীলাময় সত্তাকে অনুভব করেন যাহা ধ্যানের দ্বারাই গম্য। আধুনিক সাহিত্যে অভ্যস্ত প্রণালীর মধ্য দিয়া তাহাকে প্রকাশ করিতে গেলে তাহার রস ও প্রাণ নষ্ট হইয়া যায়; কারণ, আধুনিকতা জিনিসটা আসলে নবীন নহে, তাহা জীর্ণ; সর্বদা ব্যবহারে তাহাতে কড়া পড়িয়া গেছে, সর্বত্র তাহা সাড়া দেয় না; তাহা ছাই-চাপা আগুনের মতো। এই আগুন জিনিসটা ছাইয়ের চেয়ে পুরাতন অথচ তাহা নবীন; ছাইটা আধুনিক বটে কিন্তু তাহাই জরা। এইজন্য সর্বত্রই দেখিতে পাই, কাব্য আধুনিক ভাষাকে পাশ কাটাইয়া চলিতে চায়।

সকলেই জানেন, কিছুকাল হইতে আয়র্লণ্ডে একটা স্বাদেশিকতার বেদনা জাগিয়া উঠিয়াছে। ইংলণ্ডের শাসন সকল দিক হইতেই আয়র্লণ্ডের চিত্তকে অত্যন্ত চাপা দিয়াছিল বলিয়াই এই বেদনা একসময়ে এমন প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল। অনেক দিন হইতে এই বেদনা প্রধানত পোলিটিকাল বিদ্রোহ-রূপC আপনাকে প্রকাশ করিবার চেষ্টা করিয়াছে। অবশেষে তাহার সঙ্গে সঙ্গে আর-একটা চেষ্টা দেখা দিল। আয়র্লণ্ড আপনার চিত্তের সাতন্ত্র্য উপলব্ধি করিয়া তাহাই প্রকাশ করিতে উদ্যত হইল।

এই উপলক্ষে আমাদের নিজের দেশের কথা মনে পড়ে। আমাদের দেশেও অনেকদিন হইতে পোলিটিকাল অধিকার-লাভের একটা চেষ্টা শিক্ষিতমণ্ডলীর মধ্যে প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল। দেখা গিয়াছে,এই চেষ্টার যাঁহারা নেতা ছিলেন তাঁহাদের অনেকেরই দেশের ভাষাসাহিত্য-আচারব্যবহারের সহিত সংস্রব ছিল না। দেশের জনসাধারণের সঙ্গে তাঁহাদের যোগ ছিল না বলিলেই হয়। দেশের উন্নতিসাধনের জন্য তাঁহাদের যাহা-কিছু কারবার সমস্তই ইংরেজি ভাষায় ও ইংরেজি গবর্মেণ্টের সঙ্গে। দেশের লোককে লইয়া যে দেশের কোনো কাজ করিতে হইবে, সে দিকে তাঁহাদের দৃষ্টিমাত্রই ছিল না।

কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে, অন্তত বাংলাদেশে, আমরা সাহিত্যের ভিতর দিয়া নিজের চিত্তকে উপলব্ধি করিতে আরম্ভ করিয়াছিলাম। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রধান গৌরব এই যে, তিনি বঙ্গসাহিত্যে এমন একটি যুগের প্রবর্তন করিয়াছিলেন যখন বাঙালি আপনার কথা আপনার ভাষায় বলিয়া আনন্দ ও গর্ব অনুভব করিতে পারিয়াছিলেন। তাহার আগে আমরা স্কুলের বালক ছিলাম; অভিধান ও ব্যাকরণ মিলাইয়া ইংরেজি ইস্কুলের এক্সেরসাইজ লিখিতাম; নিজের ভাষা ও সাহিত্যকে অবজ্ঞা করিতাম। হঠাৎ বঙ্গদর্শনের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে নিজের একটা ক্ষমতা দেখিতে পাইলাম। আমাদেরও যে একটা সাহিত্য হইতে পারে এবং তাহাতেই যে যথার্থভাবে আমাদের মনের ক্ষুধানিবৃত্তি করিতে পারে ইহা আমার অনুভব করিলাম। এই যে শুরু হইল এইখানেই ইহার শেষ হইল না। ইহার আগে চোখ বুজিয়া আমরা বলিয়াছিলাম, আমাদের কিছুই নাই; এখন হইতে খোঁজ পড়িয়া গেল আমাদের কী আছে। বঙ্গদর্শনেই গোড়ার দিকে যাঁহারা কঁৎ ও মিল্‌কে সিংহাসনে বসাইয়াছিলেন তাঁহারাই অবশেষে দেশের ধর্মকেই সেই রাজাসন দিবার জন্য দলে-বলে উদ্যোগ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন ।

এই উদ্যমের স্রোত নানা শাখা-প্রশাখায় এখনো অগ্রসর হইতেছে। রাজসভায় ভারতবর্ষীয় অমাত্যসংখ্যা বাড়াইতে হইবে, আমাদের এ ইচ্ছাসাধন হওয়া রাজার হাতে; কিন্তু আমাদের মন স্বাধীন হইয়া আপনার পথে আপন সফলতার অভিমুখে অগ্রসর হইবে, এই ইচ্ছা সফল হওয়া আমাদের নিজের শক্তির উপর নির্ভর করে। আমরা যে-কেহ যে-কোনো দিকে নিজের চেষ্টায় নিজের শক্তিকে সার্থক করিতে পারি, সেই লোকই দেশের আত্মশক্তি-উপলব্ধিকে প্রশন্ত করিয়া দিব। সেই উপলব্ধির আনন্দই আমাদের উন্নতি পথযাত্রার একমাত্র সম্বল।

শক্তি-উপলব্ধির গোড়ায় যে প্রবল অহংকার জাগিয়া উঠে তাহাতে সত্য-উপলব্ধির যথেষ্ট ব্যাঘাত করে। তাহা আমাদের আপনাকে শিখাইবার চেয়ে আপনাকে ভুলাইবার দিকেই বেশি ঝোঁক দেয়। তাহা সাঁচ্চার সঙ্গে ঝুঁটার সমান মূল্য দিয়া সাঁচ্চাকে অপমানিত করে। সে এ কথা ভুলিয়া য়ায় যে, কী আমার নাই এইটে সুনির্দিষ্ট করিয়া জানার দ্বারাতেই কী আমার কাছে সেইটে সুস্পষ্ট করিয়া জানা যায়। সেই সুস্পষ্ট করিয়া জানাই আমাদের শক্তিলাভের একমাত্র পন্থা। অহংকার আত্ম-উপলব্ধির সীমাকে ঝাপসা করিয়া দিয়াই আমাদিগকে দুর্বলতা ও ব্যার্থতার দিকে লইয়া যায়। আত্মগৌরবের প্রতিষ্ঠা সত্যের উপর। সুতরাং অহংকারের দ্বারা তাহাকে কিছুতেই পাওয়া যায় না। সত্যের দুর্গপ্রাচীরে ঠেকিয়া ঠেকিয়া অহংকার যতই পরাস্ত হইতে থাকে ততই আমরা আপনাকে জানিতে থাকি।

আমাদের দেশের মতো আয়র্লণ্ডেও আপনার চিত্তশক্তিকে সাতন্ত্র্য দিবার জন্য একটা উদ্যম কিছুকাল হইতে কাজ করিতেছে। সেই উদ্যম প্রথম প্রকাশের মধ্যে স্বভাবতই বিস্তর ফেনিলতা দেখা দেয়; তাহা অনেক সময় ওজন রাখিতে না পারিয়া অদ্ভুতরূপে হাস্যকর হইয়া উঠে; আয়র্লণ্ডেও যে সেরূপ ঘটিয়াছিল তাহা আইরিশ বিখ্যাত লেখন জর্জ্‌ মুরের এতভর তশধ ঊতক্ষনংনরর-নামক বই পড়িলে কতকটা বুঝা যায়।

যাহা হউক, আয়র্লণ্ড নিজের চিত্তসাতন্ত্র্য প্রকাশ করিবার চেষ্টায় নিজের ভাষা কথা কাহিনী ও পৌরাণিকতাকে অবলম্বন করিবার যে উদ্যোগ করিয়াছে সেই উদ্যোগের মধ্যে এক-একজন অসামান্য লোকের প্রতিভা আপনার যথার্থ ক্ষেত্র পাইয়াছে। কবি য়েট্‌স্‌ তাঁহাদেরই মধ্যে একজন। ইনি আয়র্লণ্ডের বাণীকে বিশ্ব-সাহিত্যে জয়যুক্ত করিতে পারিয়াছেন।

য়েট্‌স্‌ যখন সাহিত্যক্ষেত্রে আয়র্লণ্ডের জয়পতাকা বহন করিয়া আনিলেন তাহার কিছুদিন পূর্ব হইতে আয়র্লণ্ডে সাহিত্যের উদ্যম দুর্বল হইয়াছিল। তখন আয়র্লণ্ডে পোলিটিকাল বিদ্রোহের দিন ঘুচিয়া গিয়া পোলিটিকাল বাঁকা চালের কাল আসিয়াছিল; তখন দেশে ভাবের শক্তিকে ঠেলিয়া ফেলিয়া কূটবুদ্ধিরই প্রাধান্য ঘটিয়াছিল।

য়েট্‌সের কোনো একজন সমালোচক লিখিতেছেন–

“এমন সময়ে রণদূত আর-একবার আসিয়া দেখা দিল; এবার দুর্দাম হৃদয়াবেগের বিদ্যুদ্‌বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে কোনো সামাজিক প্রলয়যুগের বজ্রধ্বনি শুনা গেল না। যে সর্বজয়ী মানবাত্মা আপনাকে আপনি উপলব্ধি করিতে পারিয়াছে, এবং মানুষের জগতে যাহার গোপন আঙ্গুলি সমস্ত বড়ো বড়ো ভাঙাগড়ার রহস্যকে গিয়া স্পর্শ করিতেছে, সেই আত্মতৃপ্ত মানবাত্মার বিরাট বিপুল শান্তি আকাশকে অধিকার করিল। নিজের মধ্যে মানবহৃদয়ের পূর্ণতর বন্ধনমোচন প্রকাশ করিয়া য়েট্‌স্‌ আর-একবার গভীরতর ও সূক্ষ্মতর শক্তির সহিত বিদ্রোহের বাণীকে জাগ্রত করিলেন। এবার বাহিরের কোলাহল নহে, এবার কবি মানবাত্মার অন্তরের কথা বলিলেন– তাহাই আয়র্লণ্ডের কথা এবং সমস্ত মানুষের কথা। তিনি গভীরভাবে চিন্তা করিলেন এবং পঞ্চাশ বছর পূর্বে যে কবিত্বরীতি প্রচলিত ছিল তাহা পরিহার করিলেন। কিন্তু, তিনি রচনার যে প্রণালীকে অবশেষে সম্পূর্ণতা দান করিলেন তাহা পুরাতন কবিদিগের রচনারীতিরই উৎকর্ষসাধন। তাঁহার কবিত্ব প্রকৃতির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সৌন্দর্যের প্রতি দৃষ্টিপ্রয়োগ করিয়াছে এবং ধ্বনিমাধুর্যের অন্তরতর সংগীতটিকে আয়ত্ত করিতে পারিয়াছে। যে-সকল চিন্তাসামগ্রীকে তিনি তাঁহার প্রথম কালের অতুলনীয় গীতিকাব্যে গাঁথিয়া তুলিয়াছেন তাহা তাঁহার পূর্বতন দ্রুয়িদ্‌ পিতামহদের নিকট হইতে প্রাপ্ত উত্তরাধিকার; তাহা এই প্রকাশমান বিশ্বপ্রকৃতির রহস্যের মধ্যে প্রবেশ করিয়া প্রকৃতি মানুষ ও দেবতার পরম ঐক্যটিকে উদ্ধার করিয়াছে।’

সমালোচক লিখিতেছেন —

“It was with the publication of The Wanderings of Oisin– in 1889, if I remember aright, — that Yeats sprang into the front rank of contemporary poets, and threatened to add to the august company of the immortals। In the qualities by which he succeeded– and exquisitely delicate music, intensity of imaginative conviction, intimacy with natural and (dare I say?) supernatural manifestations — he was typically Celtic।’

এই imaginative convictionকথাটা য়েট্‌স্‌ সম্বন্ধে অত্যন্ত সত্য। কল্পনা তাঁহার পক্ষে কেবল লীলার সামগ্রী নহে, কল্পনার আলোকে তিনি যাহা দেখিয়াছেন তাহার সত্যতাকে তিনি জীবনে গ্রহণ করিতে পারিয়াছেন। অর্থাৎ, তাঁহার হাতে কল্পনা-জিনিসটি কেবলমাত্র কবিত্বব্যবসায়ের একটা হতিয়ার নহে, তাহা তাঁহার জীবনের সামগ্রী; ইহার দ্বারাই বিশ্বজগৎ হইতে তিনি তাঁহার আত্মার খাদ্যপানীয় আহরণ করিতেছেন। তাঁহার সঙ্গে নিভৃতে যতবার আবার আলাপ হইয়াছে ততবার এই কথাই আমি অনুভব করিয়াছি। তিনি যে কবি, তাহা তাঁহার কবিতা পড়িয়া জানিবার সুযোগ এখনো আমার সম্পূর্ণরূপে ঘটে নাই, কিন্তু তিনি যে কল্পনালোকিত হৃদয়ের দ্বারা তাঁহার চতুর্দিককে প্রাণবানরূপে স্পর্শ করিতেছেন তাহা তাঁহার কাছে আসিয়াই আমি অনুভব করিতে পারিতেছি।

৩৭ আল্‌ফ্রেড প্লেস সাউথ কেন্সিংটন, লণ্ডন , ১৯ ভাদ্র, ১৩১৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *