কবি সাহেব

কবি সাহেব

ভোরবেলা ঘুম ভেঙেই যদি শুনি–কেউ একজন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, চুপচাপ বসার ঘরে বসে আছে, তখন সঙ্গত কারণেই মেজাজ খারাপ হয়। ভোরবেলাটা মানুষের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করার জন্যে আদর্শ সময় না। ভোরবেলার নিজস্ব চরিত্র আছে, আছে কিছু আলাদা নীতিমালা। ভোরবেলার নীতিমালা হলো, ঘুম থেকে উঠে নিজের মতো থাকবে, কোনোরকম টেনশন রাখবে না। হাত-পা ছড়িয়ে চা খাবে। খবরের কাগজ পড়বে। মেজাজ ভালো থাকলে গান শোনা যেতে পারে। মেজাজ খারাপ থাকলে গান শোনারও দরকার নেই। ভোরবেলায় যা করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ তা হচ্ছে–অপরিচিত কারও সঙ্গে কথা বলা। এই সময়ে কথা বলতে হবে শুধু পরিচিত এবং প্রিয়জনদের সঙ্গে।

আমার কপাল মন্দ। যারা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন তারা ভোরবেলায় আসেন। যারা আসেন তারা সহজে যেতে চান না। ইশারা-ইঙ্গিতে অনেকভাবে তাঁদের বুঝানোর চেষ্টা করি দয়া করে এখন উঠুন। আমার ইশারা-ইঙ্গিত হয় তারা বুঝেন না, নয় বুঝেও না বোঝার ভান করে।

আজ যিনি এসেছেন তাঁকেও আমি বিদেয়-হতে-না-চাওয়া লোকদের দলে ফেললাম এবং মোটামুটি হতাশ হয়েই তার সামনে বসলাম। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের উপর। হালকা পাতলা গড়নের ছোটখাটো মানুষ। গায়ের রঙ ধবধবে সাদা। গায়ের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে মাথার চুলও সাদা। কোলের উপর কালো চামড়ার হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে চুপচাপ বসে আছেন। তাঁকে দেখেই মনে হচ্ছে, কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকতেই তিনি অভ্যস্ত। আমি বললাম, আপনি কি কোনো কাজে এসেছেন?

তিনি মৃদু গলায় বললেন, না।

আমি আঁতকে উঠলাম। যারা সরাসরি বলেন, কোনো কাজে আসেন নি, তাঁরা সাধারণত অত্যন্ত বিপদজনক হয়ে থাকেন। দুপুরের আগে তাদের বিদেয় করা যায় না।

আমি বললাম, কী জন্যে এসেছেন আমি কি জানতে পারি?

জি পারেন।

দয়া করে বলুন।

আমি মফস্বলে থাকি। শহরের সঙ্গে আমার যোগাযোগ কম। বড় শহর আমার ভালো লাগে না।

আমি ভদ্রলোকের কথার ধরন ঠিক বুঝতে পারছি না। শহর প্রসঙ্গে তার বিতৃষ্ণা আমাকে শোনানোর কারণও আমার কাছে ঠিক স্পষ্ট হলো না। আমি মনের বিরক্তি চেপে সিগারেট ধরালাম।

শহর পছন্দ করি না, তবু নানা কাজকর্মে শহরে আসতে হয়।

তা হয়। পছন্দ না করলেও এই জীবনে আমরা অনেক কিছু সহ্য করি। আপনি কি চা খাবেন?

জি-না। আমার সামান্য কিছু কথা আছে। কথাগুলো বলে আমি চলে যাব।

আমি আশান্বিত হয়ে বললাম, বলুন। কথা বলে যদি উনি চলে যান তাহলে কথাগুলো শুনে নেওয়াই ভালো। সামান্য কথা বলছেন, তা-ও আশার ব্যাপার, হয়ত, ঘণ্টাখানিকের মধ্যে উদ্ধার পাওয়া যাবে।

আমার বড়কন্যা-বিষয়ে একটি গল্প শোনাব।

শোনান।

আমি অনেক রাত জেগে পড়াশোনা এবং লেখালেখি করি–একরাতে লেখালেখি করছি হঠাৎ শুনি আমার কন্যা খিলখিল করে হাসছে। কিছুক্ষণ থামে, আবার হাসে। আবার থামে, আবার হাসে। আমি বিরক্ত হলাম। তাকে বললাম, হাসছ কেন মা? সে বলল, গল্পের বই পড়ে হাসছি বাবা। আমি বললাম, হাসির গল্প? সে বলল, না দুঃখের গল্প। কিন্তু মাঝে মাঝে হাসির কথা। আমি বললাম, নিয়ে আস। আমার মেয়ে নিয়ে এল। আমি সেই বই পড়লাম। আপনার লেখা বই। আমি আগে কখনো আপনার নাম শুনি নি। এই প্রথম শুনলাম।

এইটা কি আপনার গল্প।

জি।

আপনার গল্প শুনে খুশি হয়েছি। আপনি যে আমার একটি বই পড়েছেন সেটা জেনেও ভালো লাগল।

আমার কথা একটু বাকি আছে।

জি বলুন।

ভদ্রলোক নিচু গলায় বললেন, আমি নিজে একটি গল্পগ্রন্থ রচনা করেছি। সেই গ্রন্থটি নিয়ে এসেছি।

এতক্ষণ ভদ্রলোকের আগমনের কারণ আমার কাছে স্পষ্ট হলো। তিনি একজন গ্রন্থকার। গ্রন্থ প্রকাশে আমার সাহায্যের জন্যে এসেছেন। আমার মন খারাপ হলো এই ভেবে যে আমি ভদ্রলোককে কোনোভাবেই সাহায্য করতে পারব না। তার লেখা যত ভালোই হোক প্রকাশকরা ছাপবেন না। পরিচিতিহীন মফস্বলের লেখকদের প্রতি ঢাকার প্রকাশকদের কোনোই আগ্রহ নেই। আমি বললাম, আপনি কি বইটি প্রকাশের ব্যাপারে আমার সাহায্য চান?

জি-না। বইটি প্রকাশিত হয়েছে।

ভদ্রলোক অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বইটি আমার হাতে দিলেন। আমি বইয়ের পাতা উল্টে চমকে উঠলাম। দুটি কারণে চমকালাম প্রথম কারণ, বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে আমার নামে। উৎসর্গপত্রে এমন কথা লেখা হয়েছে–আমি যার যোগ্য নই। দ্বিতীয় কারণ হলো, এই নিরহংকারী চুপচাপ ধরনের মানুষটি একজন বিখ্যাত মানুষ। এতক্ষণ আমি তাকে চিনতে পারি নি। ইনি দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা। গবেষক, কবি ও প্রাবন্ধিক। বাংলা একাডেমী তার একটি জীবনী গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। লিপির উপর লেখা তাঁর গ্রন্থ ব্রাহমী অথবা ব্রাহ্মী লিপি ও সম্রাট প্রিয়দর্শী পশ্চিম বাংলার বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য।

লিপিতত্ত্বে এদেশে এবং ভারতে তার চেয়ে বেশি কেউ এ সময়ে জানেন বলে আমার জানা নেই।

আমি একই সঙ্গে মুগ্ধ, বিস্মিত এবং লজ্জিত হলাম। এই সরল সাদাসিধা মানুষটিকে এতক্ষণ বসিয়ে রেখেছি–এ কী কাণ্ড! এতবড় ভুল মানুষ করে? গোলাম মোর্তাজা সাহেব উঠে দাঁড়ালেন এবং হাসিমুখে বলেন, আপনি কি একবার আমাদের হবিগঞ্জে যাবেন? আমার বাড়িতে একরাত থাকবেন?

আমি বললাম, অবশ্যই থাকব।

কথা দিচ্ছেন?

হ্যাঁ, কথা দিচ্ছি।

আমার মেয়েরা খুব খুশি হবে। এরা যে আপনাকে কত পছন্দ করে আপনি তা কখনো জানবেন না। আমি আমার মেয়েদের জন্যে কিছু করতে পারি নি। আপনাকে নিয়ে গেলে ওদের জন্যে কিছু করা হবে।

আপনি যখন আমাকে যেতে বলবেন, আমি তখনি যাব।

আমি আপনাকে জানাব।

তিনি আমাকে কিছু জানাতে পারলেন না। হবিগঞ্জ ফিরেই অসুখে পড়লেন–প্রাণঘাতী ব্যাধি-ক্যানসার। চিকিৎসার জন্যে গেলেন জার্মানি। পত্রিকা মারফত তাঁর মৃত্যু সংবাদ পেলাম। মনটা খারাপ হলো। কথা দিয়েছিলাম, কথা রাখা গেল না।

তার প্রায় বছরখানিক পরের কথা–দেওয়ান গোলাম মোতার্জার পরিবারের পক্ষ থেকে আমাকে জানানো হলো–দেওয়ান গোলাম মোর্তাজার নামে একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়েছে। ট্রাস্টি বোর্ডের পক্ষ থেকে মোর্তাজা সাহেবের স্ত্রী আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন মোর্তাজা সাহেবের মৃত্যুদিবস উদ্যাপনের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। কথা রাখার সুযোগ পাওয়া গেল। আমি তিন কন্যা নিয়ে হবিগঞ্জে উপস্থিত হলাম।

হবিগঞ্জে পৌঁছে মোর্তাজা সাহেবের পরিবারের কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেলাম তার সঙ্গে আমার তেমন পরিচয় নেই। এরা আমার মতো অভাজনের জন্যে ভালোবাসার সোনার আসন বানিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। আমি একেবারেই হকচকিয়ে গেলাম।

মোর্তাজা সাহেব সেখানে কবি সাহেব নামে পরিচিত। তাঁর বাড়ি হলো-কবি সাহেবের বাড়ি। তার মেয়েদের পরিচয় হলো–কবি সাহেবের মেয়ে।

কবি-পত্নীর নাম আম্বিয়া খাতুন। অসম্ভব রূপবতী, কঠিন ধরনের মহিলা। থাকেন কানাডায়। স্বামীর মৃত্যুদিবস অনুষ্ঠান উপলক্ষে দেশে এসেছেন। স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন। লেখক-স্বামীকে পারিবারিক সব দায়দায়িত্ব থেকে মুক্ত রাখতে গিয়ে নিজের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ করে এখন ক্লান্ত এবং স্বামীর প্রতি কিছুটা হয়তো অভিমানী।

কবি-পত্নী তার সব কন্যাকে স্কুলের ছাত্রদের মতো লাইন করে দাঁড় করালেন। আমাকে দেখিয়ে কঠিন গলায় বললেন, ইনি তোমাদের বাবার বন্ধু। ইনি তোমাদের চাচা। চাচাকে পা ছুঁয়ে সালাম করো।

বড় বড় মেয়ে, সবাই বিবাহিতা। তাদের ছেলেমেয়েরাও বড় বড়। মার কথা শোনামাত্র আমাকে হতচকিত করে এরা একসঙ্গে আমাকে সালাম করবার জন্যে ছুটে এল। একজনকে দেখলাম কাঁদছে।

আমি বললাম, আপনি কাঁদছেন কেন?

 সে জবাব দিল না। তাঁর এক বোন বলল, ও তো আপনার কথা শুনতে পাচ্ছে না। ও কানে শুনতে পায় না। বাচ্চা হওয়ার কী এক জটিলতায় ওর কান নষ্ট হয়ে গেছে। ওকে কোনো প্রশ্ন করলে কাগজে লিখে করতে হবে।

আমার মনটাই খারাপ হলো। আমি এক টুকরা কাগজ নিয়ে লিখলাম–আপনি এত কাঁদছেন কেন?

 মেয়েটি তার উত্তরে বলল, চাচা, আপনি অবিকল আমার বাবার মতো। নিরহংকারী সাদাসিধা। আপনাকে দেখে বাবার কথা মনে পড়ছে–এইজন্যে আমি কাঁদছি।

আমি সারাজীবন শুনে এসেছি, আমি অহংকারী। এই প্রথম একটি মেয়ে আমাকে বলল, নিরহংকারী। আমার চোখ প্রায় ভিজে উঠার উপক্রম হলো।

কবি-কন্যা বলল, চাচা, আসুন, আমার বাবার লাইব্রেরিটা আপনাকে দেখাই। আমরা বাবার লাইব্রেরিতে যাই না। আজ আপনার সঙ্গে যাব। আর শুনুন, আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন।

আচ্ছা তুমি করেই বলব, তোমরা বাবার লাইব্রেরিতে যাও না কেন?

মা এক কাণ্ড করে রেখেছেন, এইজন্যে যেতে ইচ্ছা করে না।

কী কাণ্ড?

যে কফিনে করে বাবার লাশ জার্মানি থেকে এসেছিল মা সেই কফিনটা লাইব্রেরিতে সাজিয়ে রেখে দিয়েছেন।

সে কী?

হ্যাঁ, কী ভয়াবহ ব্যাপার দেখুন না। আপনি মাকে একটু বলবেন কফিনটা যেন সরানো হয়। মা আপনার কথা ফেলতে পারবেন না।

কবি-পত্নী আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিলেন না। তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, তোমার বাবার কফিন সরানো হবে না। এটা তোমার বাবার শেষ স্মৃতিচিহ্ন। তোমাদের ভালো লাগুক না লাগুক-কফিন থাকবে লাইব্রেরিতে।

লাইব্রেরি দেখলাম। বিস্মিত হওয়ার মতোই লাইব্রেরি। সবই মূলত লিপি বিষয়ক গবেষণা গ্রন্থ। দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপি। কবি-পত্নী জানালেন, দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপির কিছু কিছু ঢাকা মিউজিয়ামে দেওয়া হয়েছে।

লাইব্রেরিতে বসেই গল্পগুজব হতে লাগল। বড় কেতলী করে চা চলে এসেছে। বাটা ভর্তি পান। যার ইচ্ছা চা খাচ্ছে, যার ইচ্ছা পান খাচ্ছ। একদল আবার খেতেও বসেছে। বাড়ির পাশেই শামিয়ানা খাটানো। খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে শামিয়ানার নিচে। এত লোক কোত্থেকে এল সে-ও এক রহস্য।

গল্প করছেন কবি-পত্নী। আমরা শ্রোতা, ভদ্রমহিলার গল্প বলার ভঙ্গি খুব সুন্দর, মাথা দুলিয়ে হাত-পা নেড়ে গল্প করেন। অত্যন্ত আবেগময় অংশগুলি আবেগশূন্যভাবে বলে যান। শুনতে কেমন কেমন জানি লাগে।

কবি সাহেবের কথা আপনাকে বলি। জমিদারের ছেলে ছিল। রাগ করে সব সম্পত্তি ভাইকে দিয়ে বিবাগী হলো। দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়। কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছিল। তাও ভালো লাগে না। জন্ম ভবঘুরে বুঝলেন ভাই? পথই হলো তার ঘর। কপালের লিখন–বিবাহ হলো আমার সঙ্গে। তখন আবার তার লেখার রোগ মাথাচাড়া দিয়েছে। দিনরাত পড়ে আর লেখে। এই যে বইটা দেখছেন ভাই–এই বই লিখতে কবি সাহেবের লেগেছে সাত বছর। কী কষ্ট করে লিখেছে! বিছানার উপুড় হয়ে বসে লিখত। হাতের কনুই থাকত বিছানায়। ঘষায় ঘষায় কনুই এ ঘা হয়ে গেল। আমি বাজার থেকে তুলা কিনে এনে দিলাম। সেই তুলার প্যাড কনুই-এ রেখে লিখত। সংসার তখন অচল হয়েছে, বুঝলেন ভাই। সম্পূর্ণ অচল। সে তো সংসারে কিছু দেখে না। চালের দাম কত, আলুর দাম কত–কিছুই জানে না। সংসার টানি আমি। স্কুলের অতি সামান্য আয়ে বাঁচার চেষ্টা করি। কবি সাহেবকে কিছু বুঝতেই দেই না। একদিন কবি সাহেব মন খারাপ করে বললেন, আম্বিয়া, সংসারের জন্যে তো আমি কিছুই করছি না। আমি তাকে বললাম, সব মানুষকে আল্লাহ কিছু দায়িত্ব দিয়ে পাঠান। লেখার দায়িত্ব দিয়ে আল্লাহ তোমাকে পাঠিয়েছেন। তুমি লেখ। সংসার নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।

সে-ও ভাবত না। তার ছেলেমেয়ে কয়টা তা-ও বোধহয় সে জানতো না। হাসবেন না ভাই। অতি দুঃখে এই কথা বলছি। একদিন কী হয়েছে শুনুন–আমার মেজো ছেলে অসুস্থ। পেট ফুলে ঢোল হয়েছে। ছটফট করে, নিশ্বাস নিতে পারে না। আমি ছেলেকে কবি সাহেবের পাশে শুইয়ে দিয়ে বললাম তুমি ছেলেটাকে দেখ আমি স্কুলে যাই। স্কুল কামাই দিলে আমার তো চলবে না। স্কুলে গেলাম। ফিরে এসে দেখি–কবি সাহেব লিখতে বসেছে। পাশে আমার ছেলে–এখন যায় তখন যায় অবস্থা। আমাকে দেখে কবি সাহেব বলল, শোনো আম্বিয়া, তোমার এই ছেলের। মৃত্যুক্ষণ উপস্থিত। আমি তার উপর থেকে ভালোবাসার দাবি উঠিয়ে নিয়েছি। তুমিও উঠিয়ে নাও। তোমার ছেলে কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যাবে।

আমি আঁতকে উঠলাম। কী বলে এই লোক! ছেলেকে কোলে নিয়ে দৌড়ে গেলাম এক কবিরাজের কাছে। রিকশাও নিলাম না। কারণ রিকশাভাড়া ছিল না। সেই ছেলেকে কবিরাজ চিকিৎসা করে ভালো করলেন। একদিন ছেলে চলে গেল আমেরিকায়। সেখান থেকে বাবার জন্যে সোনার কলম পাঠাল। কবি সাহেব সেই কলম পেয়ে খুশি। ডেকে সবাইকে দেখায়।

বুঝলেন ভাই, কবি সাহেব ছেলেমেয়েদের দিকে চোখ ফেলে নাই। কিন্তু ছেলেমেয়েরা যে কী ভালো তার বাবাকে বাসে। বাবাকে তারা যত ভালোবাসে তার এক হাজার ভাগের এক ভাগ ভালো আমাকে বাসে না। বাবার কিছু-একটা হলে সব ছেলেমেয়ের খাওয়াদাওয়া বন্ধ।

আরেক দিনের গল্প আপনাকে বলি ভাই। একই সঙ্গে দুঃখের গল্প, আবার হাসিরও গল্প। এই গল্প মনে এলে আমি কখনো হাসি, কখনো চোখের পানি ফেলি। হয়েছে কী শোনেন। এক রাতের কথা–আমি ঘুমাচ্ছিলাম। কবি সাহেব আমাকে ডেকে তুলল। বলল, আম্বিয়া, জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখো–কী সুন্দর জোছনা হয়েছে–চলো, জোছনার মধ্যে হাঁটি।

বুঝলেন ভাই? কথা শুনে আমার ভালো লাগল। এইরকম কথা তো কখনো বলে না। ভালো লাগারই কথা। আমি খুশিমনে কবি সাহেবের সঙ্গে হাঁটতে গেলাম। কবি সাহেব হঠাৎ বলল, দেখো আম্বিয়া, মাঝে মাঝে আমার মনটা খুব খারাপ হয়।

আমি বললাম, কেন?

যখন শুনি মানুষের ছেলেমেয়েরা ম্যাট্রিক পাশ করে, ভালো রেজাল্ট করে, তখন একটু আফসোস হয়। মনটা খারাপও হয়।

আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন?

কবি সাহেব বলল, তখন মনে হয়, আমার যদি এক আধটা ছেলেমেয়ে ম্যাট্রিক পাশ করত, আমি লোকজনদের বলতে পারতাম।

কী বলছ তুমি? তোমার যে দুইটা ছেলে ম্যাট্রিক পাশ করেছে। এত ভালো রেজাল্ট করেছে তুমি জানো না?

পাশ করেছে জানি না তো! কী আশ্চর্য!

কবি সাহেব অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। এই রকম একটা মানুষের সঙ্গে ঘর করেছি ভাই। সৃষ্টিছাড়া মানুষ। আমি খুশি যে আমার আগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।

মা’র কথা শুনে মেজো মেয়ে রাগী গলায় বলল, মা তুমি এটা কী রকম কথা বললে? তোমার আগে বাবা মারা যাওয়ায় তুমি খুশি। তোমার এই কথার মানে কী?

আম্বিয়া খাতুন কঠিন গলায় বললেন, মানে আছে রে মা, মানে আছে। মানে ছাড়া আম্বিয়া খাতুন কথা বলে না। তোর বাবার আগে যদি আমি মারা যেতাম–কে তাহলে এই পাগল মানুষটার সেবা করত? আমি বেঁচে আছি বলেই শেষ সময় পর্যন্ত সেবা করতে পেরেছি। আমি বেঁচে আছি বলেই তোর বাবার মৃত্যুর পর তাঁর নামে ট্রাস্ট করতে পেরেছি। মরে গেলে এইসব হতো না রে মা। বেঁচে আছি বলেই হচ্ছে। তোর বাবার দশ বছরের খাটুনির যে পাণ্ডুলিপি সেটা আমি বেঁচে আছি বলেই প্রকাশ হবে। বেঁচে না থাকলে প্রকাশ হতো না। তোর বাবা সেই পাণ্ডুলিপি নিয়ে কী করত? বালিশের নিচে রেখে ঘুমাতো। কাউকে মুখ ফুটে বলত না-পাণ্ডুলিপিটা প্রকাশ করো তো? বলতো মুখ ফুটে?

না।

এখন যা, মুখে মুখে আমার সঙ্গে তর্ক না করে–তোর বাবার পাণ্ডুলিপি এনে তোর চাচাকে দেখা।

মেয়েরা ছুটে গেল বাবার পাণ্ডুলিপি আনতে।

আমি পাণ্ডুলিপি দেখলাম। আমি কোনো লিপি বিশারদ নই কিন্তু পাণ্ডুলিপি দেখে বুঝলাম–বিরাট কাজ হয়েছে। বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক জনাব হারুন-অর রশিদ সাহেব এই পাণ্ডুলিপি গ্রহণ করেছেন। খুব শিগগিরই তা গ্রন্থাকারে বের হবে।

আম্বিয়া খাতুনের সঙ্গে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করলাম। গল্পের এক পর্যায়ে তিনি হঠাৎ করে বললেন, ভাই, আপনি কি ভূত-প্রেত এইসব বিশ্বাস করেন?

আমি বললাম, না।

আমিও করি না। আমি কোনো কিছুই বিশ্বাস করি না। ভূত-প্রেতের নানান ঘটনা শুনি। কিন্তু আমি জানি এর কোনো না কোনো ব্যাখ্যা আছে।

আমি বললাম, অবশ্যই আছে।

আম্বিয়া খাতুন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমি আমার জীবনের একটা ঘটনা আপনাকে বলব। এই ঘটনার ব্যাখ্যা আমি করতে পারি নাই। কবি সাহেবও পারে নাই। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি পারবেন।

এ রকম মনে হওয়ার কারণ কী?

কোনো কারণ নেই। কিন্তু মনে হচ্ছে। গল্পটা বলার আগে একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার। ভাই, আপনি তো অনেকক্ষণ আমার সঙ্গে কথা বললেন, আপনি কি বুঝতে পেরেছেন আমি কঠিন ধরনের সাহসী মহিলা?

বুঝতে পেরেছি।

আপনি কি বুঝতে পেরেছেন যে আমি কখনো মিথ্যা বলি না?

তা-ও বুঝতে পেরেছি।

তাহলে গল্পটা শুনুন। খুব মন দিয়ে শুনবেন। আজ থেকে কুড়ি বছর আগের কথা। আমার এক কন্যা জেসমিনের বয়স তখন আড়াই বছর। খুব সুন্দর মেয়ে। ফুটফুটে চেহারা। সারা দিন নিজের মনে খেলে, কথা বলে। আমার বড়ই আদরের মেয়ে। একদিন দুপুর বেলা আমি বাথরুমে গিয়েছি। মফস্বল অঞ্চলের বাথরুম–মূল বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে, নির্জনে। বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করা মাত্র আমি একজনের কথা শুনলাম। পুরুষমানুষের গলা। খুব পরিষ্কার স্পষ্ট আওয়াজের কথা। কথাটা সে বলল, ঠিক আমার মাথার ভেতরে। কথাটা হলো–তোমার মেয়ে জেসমিন চৈত্র মাসের বারো তারিখ পানিতে ডুবে মারা যাবে। কিছুই করার নাই। কথা শুনে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। আমি চিৎকার করতে করতে কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে ঢুকলাম। কবি সাহেবকে বললাম।

আপনাকে আগে বলা হয় নাই–কবি সাহে ছিল ঘোর নাস্তিক। সে কোনোকিছুই বিশ্বাস করত না। আমার কথা শুনে হাসতে হাসতে বলল, এটা আর কিছুই না, তোমার মনের বিকার। তোমার মেয়েটা ছোট, পাশেই পুকুর। সারাক্ষণ তুমি মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তা করো। এই জন্যে মনে বিকার উপস্থিত হয়েছে। বিকারের ঘোরে এইসব শুনেছ।

কবি সাহেবের কথায় আমার মন শান্ত হলো না। খেতে পারি না। রাতে ঘুমাতে পারি না। চৈত্র মাসের বারো তারিখ আসতে বেশি বাকিও নেই। মনে হলেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। কবি সাহেবকে কিছু বলতে গেলে ও শুধু হাসে।

 বারোই চৈত্র খুব ভোরবেলা কবি সাহেব আমাকে বলল, তোমার মন যখন এত অস্থির তুমি এক কাজ করো–আজ সারা দিন মেয়েটাকে চোখের আড়াল কোরো না। সারাক্ষণ তাকে চোখে চোখে রাখো। তোমার স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই। আমি হেডমিস্ট্রেসের কাছে একটা ছুটির দরখাস্ত লিখে নিয়ে যাব।

কবি সাহেব তা-ই করল। নিজেই একটা ছুটির দরখাস্ত লিখে নিয়ে গেল। আমি সারা দিন জেসমিনকে নিয়ে রইলাম। এক মুহূর্তের জন্যেও চোখের আড়াল করি না। দুপুরবেলা আমার চোখে মরণঘুম নামল। কয়েক রাত অঘুমো কাটিয়াছি। অবস্থা এমন হয়েছে কিছুতেই চোখ ভোলা রাখতে পারছি না। ঘুমুতে গেলাম জেসমিনকে নিয়ে। দরজা-টরজা সব বন্ধ করে দিলাম। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যাবেলা। দেখি বিছানায় জেসমিন নেই। বুক ছ্যাঁৎ করে উঠল। তারপরই দেখি সে ঘরের মেঝেতে আপন মনে একটা বদনা নিয়ে খেলছে। মনটা শান্ত হলো। মেয়েটাকে কিছুক্ষণ আদর করলাম। বাইরে থেকে কবি সাহেব বলল, আম্বিয়া, আমার কাছে কিছু মেহমান এসেছেন। একটু চা করতে পারবে?

আমি চা বানাতে রান্নাঘরে ঢুকলাম। লাকড়ির চুলা ধরতে একটু সময় নিল। যখন আগুন ধরে উঠল তখনি মনে হলো–জেসমিন কোথায়? ওকে না আমার চোখে চোখে রাখার কথা! আমি ছুটে শোবার ঘরে ঢুকলাম। জেসমিন সেখানে নেই। আমি আর অপেক্ষা করলাম না–দৌড়ে গেলাম পুকুরপাআপনি ড়ে। গিয়ে দেখি–জেসমিন মাঝপুকুরে ভাসছে।

ভাই, আপনি অনেক জানেন। পৃথিবীর অনেক কিছুই দেখেছেন, শুনেছেন। আমার এই ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে পারবেন? কবি সাহেবের মতো ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে থাকবেন না, কথা বলুন।

আম্বিয়া খাতুনের কঠিন চোখ দ্রবীভূত হলো। তার চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পড়তে লাগল। তিনি আঁচলে চোখ মুছে মেজো মেয়েকে ডেকে সহজ গলায় বললেন, তোর চাচার নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে। তাঁকে খেতে দে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *