বাংলার প্রাচীন কাব্যসাহিত্য এবং আধুনিক কাব্যসাহিত্যের মাঝখানে কবি-ওয়ালাদের গান। ইহা এক নূতন সামগ্রী এবং অধিকাংশ নূতন পদার্থের ন্যায় ইহার পরমায়ু অতিশয় স্বল্প। একদিন হঠাৎ গোধূলির সময়ে যেমন পতঙ্গে আাকাশ ছাইয়া যায়| মধ্যাহ্নের আলোকেও তাহাদিগকে দেখা যায় না এবং অন্ধকার ঘনীভূত হইবার পূর্বেই তাহারা অদৃশ্য হইয়া যায়, এই কবির গানও সেইরূপ এক সময়ে বঙ্গসাহিত্যের স্বল্পক্ষণস্থায়ী গোধূলি-আকাশে অকস্মাৎ দেখা দিয়াছিল–তৎপূর্বেও তাহাদের কোনো পরিচয় ছিল না, এখনো তাহাদের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না।
গীতিকবিতা বাংলাদেশে বহুকাল হইতে চলিয়া আসিতেছে এবং গীতিকবিতাই বঙ্গসাহিত্যের প্রধান গৌরবস্থল। বৈষ্ণব কবিদের পদাবলী বসন্তকালের অপর্যাপ্ত পুষ্পমঞ্জরীর মতো; যেমন তাহার ভাবের সৌরভ তেমনি তাহার গঠনের সৌন্দর্য। রাজসভাকবি রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল-গান রাজকণ্ঠের মণিমালার মতো, যেমন তাহার উজ্জ্বলতা তেমনি তাহার কারুকার্য। আমাদের বর্তমান সমালোচ্য এই “কবির গান’গুলিও গান, কিন্তু ইহাদের মধ্যে সেই ভাবের গাঢ়তা এবং গঠনের পারিপাট্য নাই।
না থাকিবার কিছু কারণও আছে। পূর্বকালের গানগুলি, হয় দেবতার সম্মুখে নয় রাজার সম্মুখে গীত হইত–সুতরাং স্বতই কবির আদর্শ অত্যন্ত দুরূহ ছিল। সেইজন্য রচনার কোনো অংশেই অবহেলার লক্ষণ ছিল না, ভাব ভাষা ছন্দ রাগিণী সকলেরই মধ্যে সৌন্দর্য এবং নৈপুণ্য ছিল। তখন কবির রচনা করিবার এবং শ্রোতৃগণের শ্রবণ করিবার অব্যাহত অবসর ছিল; তখন গুণীসভায় গুণাকর কবির গুণপনা-প্রকাশ সার্থক হইত।
কিন্তু ইংরাজের নূতনসৃষ্ট রাজধানীতে পুরাতন রাজসভা ছিল না, পুরাতন আদর্শ ছিল না। তখন কবির আশ্রয়দাতা রাজা হইল সর্বসাধারণ-নামক এক অপরিণত স্থূলায়তন ব্যক্তি, এবং সেই হঠাৎ-রাজার সভার উপযুক্ত গান হইল কবির দলের গান। তখন যথার্থ সাহিত্যরস-আলোচনার অবসর যোগ্যতা এবং ইচ্ছা কয়জনের ছিল? তখন নূতন রাজধানীর নূতন-সমৃদ্ধি-শালী কর্মশ্রান্ত বণিক্সম্প্রদায় সন্ধ্যাবেলায় বৈঠকে বসিয়া দুই দণ্ড আমোদের উত্তেজনা চাহিত, তাহারা সাহিত্যরস চাহিত না।
কবির দল তাহাদের সেই অভাব পূর্ণ করিতে আসরে অবতীর্ণ হইল। তাহারা পূববর্তী গুণীদের গানে অনেক পরিমাণে জল এবং কিঞ্চিৎ পরিমাণে চটক মিশাইয়া, তাহাদের ছন্দোবন্ধ সৌন্দর্য সমস্ত ভাঙিয়া নিতান্ত সুলভ করিয়া দিয়া, অত্যন্ত লঘু সুরে উচ্চৈঃস্বরে চারিজোড়া ঢোল ও চারিখানি কাঁসি-সহযোগে সদলে সবলে চীৎকার করিয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে লাগিল। কেবল গান শুনিবার এবং ভাবরস সম্ভোগ করিবার যে সুখ তাহাতেই তখনকার সভ্যগণ সন্তুষ্ট ছিলেন না, তাহার মধ্যে লড়াই এবং হার-জিতের উত্তেজনা থাকা আবশ্যক ছিল। সরস্বতীর বীণার তারেও ঝন্ ঝন্ শব্দে ঝংকার দিতে হইবে, আবার বীণার কাষ্ঠদণ্ড লইয়াও ঠক্ ঠক্ শব্দে লাঠি খেলিতে হইবে। নূতন হঠাৎ-রাজার মনোরঞ্জনার্থে এই এক অপূর্ব নূতন ব্যাপারের সৃষ্টি হইল। প্রথমে নিয়ম ছিল, দুই প্রতিপক্ষদল পূর্ব হইতে পরস্পরকে জিজ্ঞাসা করিয়া উত্তর-প্রত্যুত্তর লিখিয়া আনিতেন; অবশেষে তাহাতেও তৃপ্তি হইল না, আসরে বসিয়া মুখে মুখেই বাগযুদ্ধ চলিতে লাগিল। এরূপ অবস্থায় যে কেবল প্রতিপক্ষকে আহত করা হয়| তাহা নহে, ভাষা ভাব ছন্দ সমস্তই ছারখার হইতে থাকে। শ্রোতারাও বেশি কিছু প্রত্যাশা করে না–কথার কৌশল, আনুপ্রাসের ছটা এবং উপস্থিতমত জবাবেই সভা জমিয়া উঠে এবং বাহবা উচ্ছ্বসিত হইতে থাকে। তাহার উপরে আবার চারজোড়া ঢোল, চারখানা কাঁসি এবং সম্মিলিত কণ্ঠের প্রাণপণ চীৎকার–বিজনবিলাসিনী সরস্বতী এমন সভায় অধিকক্ষণ টিঁকিতে পারেন না।
সৌন্দর্যের সরলতা যাহাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না, ভাবের গভীরতায় যাহাদের নিমগ্ন হইবার অবসর নাই, ঘন ঘন অনুপ্রাসে অতি শীঘ্রই তাহাদের মনকে উত্তেজিত করিয়া দেয়। সংগীত যখন বর্বর অবস্থায় থাকে তখন তাহাকে রাগরাগিণীর যতই অভাব থাক্, তালপ্রয়োগের খচমচ কোলাহল যথেষ্ট থাকে। সুরের অপেক্ষা সেই ঘন ঘন সশব্দ আঘাতে অশিক্ষিত চিত্ত সহজে মাতিয়া উঠে। এক শ্রেণীর কবিতায় অনুপ্রাস সেইরূপ ক্ষণিক ত্বরিত সহজ উত্তেজনার উদ্রেক করে। সাধারণ লোকের কর্ণ অতি শ্রীঘ্র আকর্ষণ করিবার সুলভ উপায় অল্পই আছে। অনুপ্রাস যখন ভাব ভাষা ও ছন্দের অনুগামী হয় তখন তাহাতে কাব্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, কিন্তু সে সকলকে ছাড়াইয়া ছাপাইয়া উঠিয়া যখন মূঢ় লোকের বাহবা লইবার জন্য অগ্রসর হয় তখন তদ্দ্বারা সমস্ত কবিতা ইতরতা প্রাপ্ত হয়।
কবিদলের গানে অনেক স্থলে অনুপ্রাস, ভাব ভাষা এমন-কি, ব্যাকরণকে ঠেলিয়া ফেলিয়া শ্রোতাদের নিকট প্রগলভতা প্রকাশ করিতে অগ্রসর হয়। অথচ তাহার যথার্থ কোনো নৈপুণ্য নাই; কারণ, তাহাকে ছন্দোবদ্ধ অথবা কোনো নিয়ম রক্ষা করিয়াই চলিতে হয় না। কিন্তু যে শ্রোতা কেবল ক্ষণিক আমোদে মাতিয়া উঠিতে চাহে, সে এত বিচার করে না এবং যাহাতে বিচার আবশ্যক এমন জিনিসও চাহে না।
গেল গেল কুল কুল, যাক কুল–
তাহে নই আকুল।
লয়েছি যাহার কুল সে আমারে প্রতিকূল॥
যদি কুলকুণ্ডলিনী অনুকূলা হন আমায়
অকূলের তরী কূল পাব পুনরায়॥
এখন ব্যাকুল হয়ে কি দুকূল হারাব সই।
তাহে বিপক্ষ হাসিবে যত রিপুচয়॥
পাঠকেরা দেখিতেছেন, উপরি উদ্ধৃত গীতাংশে এক কুল শব্দের কূল পাওয়া দুষ্কর হইয়াছে। কিন্তু ইহাতে কোনো গুণপনা নাই; কারণ, উহার অধিকাংশই একই শব্দের পুনরাবৃত্তিমাত্র। কিন্তু শ্রোতৃগণের কোনো বিচার নাই, তাঁহারা অত্যন্ত সুলভ চাতুরীতে মুগ্ধ হইতে প্রস্তুত আছেন। এমন-কি,যদি অনুপ্রাসছটার খাতিরে কবি ব্যাকরণ এবং শব্দশাস্ত্র সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করেন তাহাতেও কাহারো আপত্তি নাই। দৃষ্টান্ত–
একে নবীন বয়স তাতে সুসভ্য,
কাব্যরসে রসিকে।
মাধুর্য গাম্ভীর্য, তাতে “দাম্ভীর্য’ নাই,
আর আর বউ যেমন ধারা ব্যাপিকে॥
অধৈর্য হেরে তোরে স্বজনী, ধৈর্য ধরা নাহি যায়।
যদি সিদ্ধ হয় সেই কার্য করব সাহায্য,
বলি, তাই বলে যা আমায়॥
একে বাংলা শব্দের কোনো ভার নাই, ইংরাজি প্রথামত তাহাতে অ্যাক্সেণ্ট্ নাই, সংস্কৃত প্রথামত তাহাতে হ্রস্ব-দীর্ঘ রক্ষা হয় না, তাহাতে আবার সমালোচ্য কবির গানে সুনিয়মিত ছন্দের বন্ধন না থাকাতে এই-সমস্ত অযত্নকৃত রচনাগুলিকে শ্রোতার মনে মুদ্রিত করিয়া দিবার জন্য ঘন ঘন অনুপ্রাসের বিশেষ আবশ্যক হয়। সোজা দেয়ালের উপর লতা উঠাইতে গেলে যেমন মাঝে মাঝে পেরেক মারিয়া তাহার অবলম্বন সৃষ্টি করিয়া যাইতে হয়, এই অনুপ্রাসগুলিও সেইরূপ ঘন ঘন শ্রোতাদের মনে পেরেক মারিয়া যাওয়া; অনেক নির্জীব রচনাও এই কৃত্রিম উপায়ে অতি দ্রুতবেগে মনোযোগ আচ্ছন্ন করিয়া বসে। বাংলা পাঁচালিতেও এই কারণেই এত অনুপ্রাসের ঘটা।
উপস্থিতমত সাধারণের মনোরঞ্জন করিবার ভার লইয়া কবিদলের গান–ছন্দ এবং ভাষার বিশুদ্ধি ও নৈপুণ্য বিসর্জন দিয়া কেবল সুলভ অনুপ্রাস ও ঝুঁটা অলংকার লইয়া কাজ সারিয়া দিয়াছে; ভাবের কবিত্ব সম্বন্ধেও তাহার মধ্যে বিশেষ উৎকর্ষ দেখা যায় না। পূর্ববর্তী শাক্ত এবং বৈষ্ণব মহাজনদিগের ভাবগুলিকে অত্যন্ত তরল এবং ফিকা করিয়া কবিগণ শহরের শ্রোতাদিগকে সুলভ মূল্যে যোগাইয়াছেন। তাঁহাদের যাহা সংযত ছিল এখানে তাহা শিথিল এবং বিকীর্ণ। তাঁহাদের কুঞ্জবনে যাহা পুষ্প-আকারে প্রফুল্ল এখানে তাহা বাসি ব্যঞ্জন-আকারে সম্মিশ্রিত।
অনেক জিনিস আছে যাহাকে স্বস্থান হইতে বিচ্যুত করিলে তাহা বিকৃত এবং দূষণীয় হইয় উঠে। কবির গানেও সেইরূপ অনেক ভাব তাহার যথাস্থান হইতে পরিভ্রষ্ট হইয়া কলুষিত হইয়া উঠিয়াছে। এ কথা স্বীকার করিতে হইবে যে, বৈষ্ণব কবিদের পদাবলীর মধ্যে এমন অংশ আছে যাহা নির্মল নহে, কিন্তু সমগ্রের মধ্যে তাহা শোভা পাইয়া গিয়াছে। কবিওয়ালা সেইটিকে তাহার সজীব আশ্রয় হইতে তাহার সৌন্দর্যপরিবেষ্টন হইতে, বিচ্ছিন্ন করিয়া ইতর ভাষা এবং শিথিল ছন্দ-সহযোগে স্বতন্ত্রভাবে আমাদের সম্মুখে ধরিলে তাহা গলিত পদার্থের ন্যায় কদর্য মূর্তি ধারণ করে।
বৈষ্ণব কাব্যে প্রেমের নানা বৈচিত্র্যের মধ্যে রাধার খণ্ডিতা অবস্থার বর্ণনা আছে। আধ্যাত্মিক অর্থে ইহার কোনো বিশেষ গৌরব থাকিতে পারে, কিন্তু সাহিত্য হিসাবে শ্রীকৃষ্ণের এই কামূক ছলনার দ্বারা কৃষ্ণরাধার প্রেমকাব্যের সৌন্দর্যও খণ্ডিত হইয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই। রাধিকার এই অবমাননায় কাব্যশ্রীও অবমানিত হইয়াছে।
কিন্তু প্রচুর স্যেন্দর্যরাশির মধ্যে এ-সকল বিকৃতি আমরা চোখ মেলিয়া দেখি না–সমগ্রের সৌন্দর্যপ্রভাবে তাহার দূষণীয়তা অনেকটা দূর হইয়া যায়। লৌকিক অর্থে ধরিতে গেলে বৈষ্ণব কাব্যে প্রেমের আদর্শ অনেক স্থলে স্খলিত হইয়াছে, তথাপি সমগ্র পাঠের পর যাহার মনে একটা সুন্দর এবং উন্নত ভাবের সৃষ্টি না হয়, সে হয় সমস্তটা ভালো করিয়া পড়ে নাই নয় সে যথার্থ কাব্যরসের রসিক নহে।
কিন্তু আমাদের কবিওয়ালারা বৈষ্ণব কাব্যের সৌন্দর্য এবং গভীরতা নিজেদের এবং শ্রোতাদের আয়ত্তের অতীত জানিয়া প্রধানত যে অংশ নির্বাচিত করিয়া লইয়াছেন তাহা অতি অযোগ্য। কলঙ্ক এবং ছলনা ইহাই কবিওয়ালাদের গানের প্রধান বিষয়। বারংবার রাধিকা এবং রাধিকার সখীগণ কুব্জাকে অথবা অপরাকে লক্ষ করিয়া তীব্র সরস পরিহাসে শ্যামকে গঞ্জনা করিতেছেন। তাঁহাদের আরো একটি রচনার বিষয় আছে, স্ত্রী-পক্ষ এবং পুরুষ-পক্ষের পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস-প্রকাশ-পূর্বক দোষারোপ করা; সেই শখের কলহ শুনিতে শুনিতে ধিক্কার জন্মে।
যাহাদের প্রকৃত আত্মসম্মানজ্ঞান দৃঢ় তাহারা সর্বদা অভিমান প্রকাশ করিতে অবজ্ঞা করিয়া থাকে। তাহাদের মানে আঘাত লাগিলে, হয় তাহারা স্পষ্টরূপে তাহার প্রতিকার করে নয় তাহা নিঃশব্দে উপেক্ষা করিয়া যায়। প্রিয়জনের নিকট হইতে প্রেমে আঘাত লাগিলে, হয় তাহা গোপনে বহন করে নয় সাক্ষাৎভাবে সম্পূর্ণরূপে তাহার মীমাংসা করিয়া লয়। আমাদের দেশে ইহা সর্বদাই দেখিতে পাওয়া যায়, পরাধীনতা যাহার অবলম্বন সেই অভিমানী, যে এক দিকে ভিক্ষুক তাহার অপর দিকে অভিমানের অন্ত নাই, যে সর্ববিষয়ে অক্ষম সে কথায় কথায় অভিমান প্রকাশ করিয়া থাকে। এই অভিমান জিনিসটি বাঙালি প্রকৃতির মজ্জাগত নির্লজ্জ দুর্বলতার পরিচায়ক।
দুর্বলতা স্থলবিশেষে এবং পরিমাণবিশেষে সুন্দর লাগে। স্বল্প উপলক্ষে অভিমান কখনো কখনো স্ত্রীলোকদিগকে শোভা পায়। যতক্ষণ নায়কের প্রেমের প্রতি নায়িকার যথার্থ দাবি থাকে ততক্ষণ মাঝে মাঝে ক্রীড়াচ্ছলে অথবা স্বল্প অপরাধের দণ্ডচ্ছলে পুরুষের প্রেমাবেগকে কিয়ৎকালের জন্য প্রতিহত করিলে সে অভিমানের একটা মাধুর্য দেখা যায়। কিন্তু গুরুতর অপরাধ অথবা বিশ্বাসঘাতের দ্বারা নায়ক যখন সেই প্রেমের মূলেই কুঠারাঘাত করে তখন যথারীতি অভিমান প্রকাশ করিতে বসিলে নিজের প্রতি একান্ত অবমাননা প্রকাশ করা হয় মাত্র, এইজন্য তাহাতে কোনো সৌন্দর্য নাই এবং তাহা কাব্যে স্থান পাইবার যোগ্য নহে।
দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের দেশে স্বামীকৃত সকল-প্রকার অসম্মাননা এবং অন্যায় স্ত্রীকে অগত্যা সহ্য এবং মার্জনা করিতেই হয়–কিঞ্চিৎ অশ্রুজলসিক্ত বক্রবাক্যবাণ অথবা কিয়ৎকাল অবগুণ্ঠনাকৃত বিমুখ মৌনাবস্থা ছাড়া আর কোনো অস্ত্র নাই। অতএব আমাদের সমাজে স্ত্রীলোকের সর্বদা অভিমান জিনিসটা সত্য সন্দেহ নাই। কিন্তু তাহা সর্বত্র সুন্দর নহে ইহাও নিশ্চয়; কারণ, যাহাতে কাহারো অবিমিশ্র স্থায়ী হীনতা প্রকাশ করে তাহা কখনোই সুন্দর হইতে পারে না।
কবিদলের গানে রাধিকার যে অভিমান প্রকাশ হইয়াছে তাহা প্রায়শই এইরূপ অযোগ্য অভিমান।
সাধ ক'রে করেছিলেম দুর্জয় মান, শ্যামের তায় হল অপমান। শ্যামকে সাধলেম না, ফিরে চাইলেম না, কথা কইলেম না রেখে মান॥ কৃষ্ণ সেই রাগের অনুরাগে, রাগে রাগে গো, পড়ে পাছে চন্দ্রাবলীর নবরাগে। ছিল পূর্বের যে পূর্বরাগ, আবার একি অপূর্ব রাগ, পাছে রাগে শ্যাম রাধার আদর ভুলে যায়॥ যার মানের মানে আমায় মানে, সে না মানে তবে কি করবে এ মানে। মাধবের কত মান না হয় তার পরিমাণ, মানিনী হয়েছি যার মানে॥ যে পক্ষে যখন বাড়ে অভিমান, সেই পক্ষে রাখতে হয় সম্মান। রাখতে শ্যামের মান, গেল গেল মান, আমার কিসের মান-অপমান॥
এই কয়েক ছত্রের মধ্যে প্রেমের যেটুকু ইতিহাস যে ভাবে লিপিবদ্ধ হইয়াছে তাহাতে কৃষ্ণের উপরেও শ্রদ্ধা হয় না, রাধিকার উপরেও শ্রদ্ধা হয় না, এবং চন্দ্রাবলীর উপরেও অবজ্ঞার উদয় হয়।
কেবল নায়ক-নায়িকার অভিমান নহে, পিতা-মাতার প্রতি কন্যার অভিমানও কবিদলের গানে সর্বদাই দেখিতে পাওয়া যায়। গিরিরাজমহিষীর প্রতি উমার যে অভিমানকলহ তাহাতে পাঠকের বিরক্তি উদ্রেক করে না–তাহা সর্বত্রই সুমিষ্ট বোধ হয়। তাহার কারণ, মাতৃস্নেহে উমার যথার্থ অধিকার সন্দেহ নাই; কন্যা ও মাতার মধ্যে এই-যে আঘাত ও প্রতিঘাত তাহাতে স্নেহসমুদ্র কেবল সুন্দরভাবে তরঙ্গিত হইয়া উঠে।
মাতা-কন্যা এবং নায়ক-নায়িকার মান-অভিমান যে কবিদলের গানের প্রধান বিষয় তাহার একটা কারণ, বাঙালির প্রকৃতিতে অভিমানটা কিছু বেশি; অর্থাৎ অন্যের প্রেমের প্রতি স্বভাবতই তাহার দাবি অত্যন্ত অধিক; এমন-কি, সে প্রেম অপ্রমাণ হইয়া গেলেও ইনিয়া-বিনিয়া কাঁদিয়া রাগিয়া আপনার দাবি সে কিছুতেই ছাড়ে না। আর-একটা কারণ, এই মান-অভিমানে উত্তর-প্রত্যুত্তরের তীব্রতা এবং জয়পরাজয়ের উত্তেজনা রক্ষিত হয়। কবিওয়ালাদের গানে সাহিত্যরসের সৃষ্টি অপেক্ষা ক্ষণিক উত্তেজনা-উদ্রেকই প্রধান লক্ষ্য।
ধর্মভাবের উদ্দীপনাতেও নহে, রাজার সন্তোষের জন্যও নহে, কেবল সাধারণের অবসর-রঞ্জনের জন্য গান-রচনা বর্তমান বাংলায় কবিওয়লারাই প্রথম প্রবর্তন করেন। এখনো সাহিত্যের উপর সেই সাধারণেরই আধিপত্য, কিন্তু ইতিমধ্যে সাধারণের প্রকৃতি-পরিবর্তন হইয়াছে। এবং সেই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য গভীরতা লাভ করিয়াছে। তাহার সম্যক্ আলোচনা করিতে গেলে স্বতন্ত্র প্রবন্ধের অবতারণা করিতে হয়, অতএব এক্ষণে তাহার প্রয়োজন নাই।
কিন্তু সাধারণের যতই রুচির উৎকর্ষ ও শিক্ষার বিস্তার হউক-না কেন, তাহাদের আনন্দবিধানের জন্য স্থায়ী সাহিত্য, এবং আবশ্যকসাধন ও অবসররঞ্জনের জন্য ক্ষণিক সাহিত্যের প্রয়োজন চিরকালই থাকিবে। এখনকার দিনে খবরের কাগজ এবং নাট্য-শালাগুলি শেষোক্ত প্রয়োজন সাধন করিতেছে। কবিদলের গানে যে-প্রকার উচ্চ আদর্শের শৈথিল্য এবং সুলভ অলংকারের বাহুল্য দেখা গিয়াছে, আধুনিক সংবাদপত্রে এবং অভিনয়ার্থে রচিত নাটকগুলিতেও কথঞ্চিৎ পরিবর্তিত আকারে তাহাই দেখা যায়। এই-সকল ক্ষণকালজাত ক্ষণস্থায়ী সাহিত্যে ভাষা ও ভাবের ইতরতা, সত্য এবং সাহিত্যনীতির ব্যভিচার, এবং সর্ববিষয়েই রূঢ়তা ও অসংযম দেখিতে পাওয়া যায়। অচিরকালেই সাধারণের এমন উন্নতি হইবে যে, তাহার অবসর-বিনোদনের মধ্যেও ভদ্রোচিত সংযম, গভীরতর সত্য এবং দুরূহতর আদর্শের প্রতিষ্ঠা দেখিতে পাইব। তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই।
আমরা সাধারণ এবং সমগ্র ভাবে কবির দলের গানের সমালোচনা করিয়াছি। স্থানে স্থানে সে-সকল গানের মধ্যে সৌন্দর্য এবং ভাবের উচ্চতাও আছে–কিন্তু মোটের উপর এই গানগুলির মধ্যে ক্ষণস্থায়িত্ব, রসের জলীয়তা এবং কাব্যকলার প্রতি অবহেলাই লক্ষিত হয়; এবং সেরূপ হইবার প্রধান কারণ, এই গানগুলি ক্ষণিক উত্তেজনার জন্য উপস্থিতমত রচিত।
তথাপি এই নষ্টপরমায়ু “কবি’র দলের গান আমাদের সাহিত্য এবং সমাজের ইতিহাসের একটি অঙ্গ, এবং ইংরাজ-রাজ্যের অভ্যুদয়ে যে আধুনিক সাহিত্য রাজসভা ত্যাগ করিয়া পৌরজনসভায় আতিথ্য গ্রহণ করিয়াছে এই গানগুলি তাহারই প্রথম পথপ্রদর্শক।
জ্যৈষ্ঠ ১৩০২